রবিবার

ত্রিদিব মিত্র সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরী


যখন কবি ত্রিদিব মিত্রর সঙ্গে দিন-নেই রাত-নেই কলকাতার তলপেট চষে বেড়াতুম


হাংরি আন্দোলনে ত্রিদিব মিত্র আর আলো মিত্রর অবদান ছিল তাদের দুজনের লেখালিখির চেয়ে বেশি তার প্রচার কর্মকাণ্ড । হাংরি আন্দোলন যে হঠাৎই সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারলো তা ত্রিদিব আর আলোর কর্মকাণ্ডের কারণে, কেননা বুলেটিন বিলি করা, মুখোশ দিয়ে আসা, দেয়ালে পোস্টার লাগানো এ কাজগুলো ওরা দুজনে ভালোভাবে করতে পারতো কেননা কেবল ত্রিদিবেরই চাকরি ছিল না, আর অন্যান্য যাদের চাকরি ছিল না, যেমন সুবো আচার্য, প্রদীপ চৌধুরী প্রমুখের তুলনায় ত্রিদিব বেশ রাগি ছিল । খালাসিটোলা, নিমতলা, হাওড়া স্টেশানে কবিতাপাঠ, মাইকেলের সমাধিতে অনুষ্ঠান, এগুলো ত্রিদিবেরই আইডিয়া । সুবিমল বসাকের ছাতামাথা বইটাও অমন কোনো অ-সাহিত্যিক জায়গায় মোড়ক উন্মোচন হয়েছিল।

ত্রিদিব মিত্র হাওড়া-কলকাতার রাস্তা আর গলিগুলো যতো ভালো করে চিনতো ততো আমি চিনতুম না, আজও চিনি না, আর এখন তো বহু রাস্তা আর গলির নাম পালটে গেছে, কোন রাস্তার যে কি নাম হয়েছে তা জানি না, গুলিয়ে ফেলি । আমার চেয়ে বয়সে এক বছরের ছোটো ছিল ত্রিদিব ; ছিল অত্যন্ত সুদর্শন । আর এই সৌম্যকান্তি চেহারার জন্যে যখন ও বাড়ি থেকে পালিয়েছিল, সেই সমস্ত অবাঙালি শহরে ওর ভালো অভিজ্ঞতা হয়নি । বস্তুত সেই অভিজ্ঞতার কারণেই ও হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয় । কলকাতার পথে-পথে ওর সঙ্গে হাঁটাহাঁটিতে বেশ আমোদ পেয়ে আমি “জেব্রা” পত্রিকার প্রথম সংখ্যায় কলকাতার রোডম্যাপ দিয়েছিলুম, তখনকার পত্রিকাগুলোর শিল্পবোধ থেকে একেবারে আলাদা । অবিনাশ কবিরাজ লেনের ভেতর দিয়ে পিসেমশায়ের বাড়ি যেতুম অথচ গলিটার সুখ্যাতির কথা জানতুম না । কতো-কতো যে গলি, চন্দন মুদি লেন, ককবার্ন লেন, বসাক বাগান লেন, বেচু ডাক্তার লেন, অ্যান্টনি বাগান লেন, বাঁশতলা লেন, ডিক্সন লেন, এলগিন লেন, গাবতলা লেন, হালদারপাড়া লেন, ঈশ্বর মিল লেন, জালাল লেন, কলকার লেন, কলুটোলা লেন, লারকিন লেন, লাভার্স লেন আর হাড়কাটা লেন তো ছিলই ,এককালে মেডিকাল কলেজের বেওয়ারিশ লাশেদের হাড় কেটে মেয়েদের চিরুনি ইত্যাদি নাকি তৈরি হতো গলিটায় ।

কলকাতার তলপেট তখন এতো আলো ঝলমলে ছিল না, রাস্তায় দিনের বেলাতেও এখনকার মতন লোকজন ছিল না, ফুটপাথ জুড়ে মাঝরাতে লোকেরা ঘুমোতো বটে তবে এখনকার মতন এতো গাদাগাদি নয় ; শোবার জন্য তখনকার দিনে বাড়ির ছাদও ভাড়া পাওয়া যেতো, পা ছড়িয়ে দু আনা, পা গুটিয়ে এক আনা । গাঁজা বা চরস ফুঁকে, যা তখন বেআইনি ছিল না, সরকারি দোকানে পাওয়া যেতো, চষে বেড়ানো যেতো কলকাতার তলপেট, ফুটপাথে চিকনসুন্দরীরা দরাদরি করতো খদ্দেরদের সঙ্গে ফিসফিসিয়ে, পুলিস তখন অনেক কম ঘুষ নিতো, টাকায় নয়, আনায়, ষোলো আনায় এক টাকা, চৌষট্টি পয়সায় এক টাকা, তামার পয়সা । কলেজ স্ট্রিটের ফুটপাথ দখল করেনি বইয়ের দোকান, প্রেসিডেন্সির দেয়ালের ধারে কোনো দোকান ছিল না । রাত নটার পরই সুনসান কলকাতা, সুনসান কলেজ স্ট্রিট,  কিন্তু তখনও গুণ্ডা-মাস্তানদের আবির্ভাব হয়নি, এলাকা দখলের রাজনৈতিক বাঁটোয়ারা হয়নি, তাই যথেচ্ছ চষে বেড়ানো যেতো কলকাতার তলপেট । সিনেমা দেখায় আমি আর ত্রিদিব দুজনেই তেমন উৎসাহিত ছিলুম না, যেমনটা ছিল বাসুদেব দাশগুপ্ত ।

১৯৬৩ সালে পাটনা থেকে কলকাতায় গিয়েছিলুম তিন মাসের জন্য অফিসের কাজে, থাকতুম ডালহাউসি স্কোয়ারে অফিসের গেস্টহাউসে, কাছেপিঠেই ছিল হিন্দি কবি রাজকমল চৌধুরীর সংবাদপত্রের দপতর, যেখানে অফিসে বসেই গাঁজা টানা যেতো  । চারটেতেই আমার ছুটি হয়ে যেত বলে পথে-পথে ঘোরাঘুরির সময়-সুযোগ ছিল দেদার । ত্রিদিব তখন কোনো চাকরি করত না, শুধু আলো মিত্রর সঙ্গে প্রেম করার জন্যে ঘুরে বেড়াতো দুজনে মিলে । আলো চাকরি করতো । আলো মদ খাওয়া, গাঁজা, চরস ফোঁকা তেমন অনুমোদন করতো না, কিন্তু ত্রিদিবের অতিউৎসাহের কারণে দুম করে ওকে আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন করতে পারছিল না । ত্রিদিবকে নিয়ন্ত্রণ করার উদ্দেশে আলো ইংরেজিতে হাংরি আন্দোলনের একমাত্র পত্রিকা “দি ওয়েস্ট পেপার” প্রকাশ করা আরম্ভ করে । লেখাগুলোর স্টেনসিল সুবিমল বসাক তৈরি করে দিতো আর ত্রিদিব আলো সেগুলোর পৃষ্ঠা স্টেপল করে পত্রিকা বিলি করতো ।

ত্রিদিবের এই গুরুত্ব কারোর-কারোর পছন্দ হল না আর তারা যেমন দেবী রায়কে হাংরি আন্দোলন থেকে বের করে দিতে চেয়েছিল, তেমনই অবজ্ঞা করতে লাগলো ত্রিদিব মিত্রকে । ফলে ত্রিদিব আর আলো “উন্মার্গ” নামে বাংলায় একটা পত্রিকা বের করার তোড়জোড় করল, কিন্তু কয়েকটা সংখ্যা বেরোবার পর কেউ-কেউ তাতে লেখা দিতে চাইল না । হাংরি আন্দোলনের হয়ে ত্রিদিব আর আলো “ওয়েস্ট পেপার” পত্রিকায় একটা ভালো কাজ করে গেছে, তা হল “অ্যালেন গিন্সবার্গের ওপর হাংরিদের প্রভাব” সম্পর্কিত প্রবন্ধ ।

হাওড়া আর কলকাতার পথে হাঁটাহাঁটির সময়ে ত্রিদিব মনের দুঃখে বন্ধুদের এই অদ্ভূত আচরণের ব্যাখ্যা খুঁজতো। আমিও আজ পর্যন্ত কোনো বৌদ্ধিক ব্যাখ্যা পাইনি । মনে হয় এটা আধুনিকতাবাদের অবদান, এই একে বের করে দাও, তার লেখা ছেপোনা ইত্যাদি, যা আঁদ্রে ব্রেতঁ সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে করেছিলেন । আঁদ্রে ব্রেতঁ ভাবতেন সুররিয়ালিস্ট আন্দোলনে তাঁর একচেটিয়া অধিকার আছে, কিন্তু আমি প্রথম থেকেই বলছিলুম যে এটা সেরকম আন্দোলন নয়, হাংরি আন্দোলন কারোর বাপের সম্পত্তি নয় । ত্রিদিব ছিল পশ্চিমবঙ্গের অভিজাত পরিবারের, সেটাও হয়তো অনেকের কাছে ভালো ঠেকছিল না ।

হাংরি আন্দোলনের যে বইটি শঙ্খ ঘোষের অনুরোধে দে বুক স্টোর প্রকাশ করেছে তাতে ত্রিদিব মিত্রের লেখা নেই, অথচ শঙ্খ ঘোষের লেখা আছে । ব্যাপারটা বেশ খটমট । উল্কা আর ঋষি সৌরককে দেয়া দাদা সমীর রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার থেকে জানতে পারলুম যে, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের মৃত্যুর পর ‘দেশ’ পত্রিকায় তাঁর স্মৃতিচারণ করার সময়ে শঙ্খ ঘোষ হাংরি প্রসঙ্গে টেনে এনে  ( যার কোনো দরকারই ছিল না ) আমাকে আর দাদাকে অপদস্হ করার চেষ্টা করেছিলেন ; আমি যে অঞ্চলে থাকি ‘দেশ’ পত্রিকা পাওয়া যায় না। আমার মনে হয় হাংরি আন্দোলনকে যে দুজনের ভেঙে ফেলার হাত ছিল তাঁরা হলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর শঙ্খ ঘোষ ; সন্দীপন, উৎপল, শক্তিকে আমেরিকা থেকে চিঠি লিখে-লিখে হাংরি আন্দোলন ছাড়তে বাধ্য করেছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তেমনই শঙ্খ ঘোষ “উদ্বাস্তু লেখক” তকমায় কয়েকজনকে উৎসাহিত করে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিলেন আর হাংরি সংকলন প্রকাশিত হবার সময়ে তাতে কেবল সেই তকমার লেখকরাই থাকলো । ত্রিদিব আর আলো বাদ গেলো ।

আমি কোনো চিঠিপত্র সংগ্রহ করতুম না, পড়া হয়ে গেলে ছিঁড়ে ফেলে দিতুম । আমার ধারণা ছিল না যে সাহিত্যিক হতে হলে অন্যের চিঠিপত্র সংগ্রহ করে রাখতে হয়, এমনকি নিজে যে চিঠি লিখছি তারও প্রতিলিপি রাখতে হয়, নিজের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণ করতে হয় । পাটনার বাড়িতে তো কেউ তার আগে সাহিত্যিক হননি । ত্রিদিবই আমাকে জানিয়েছিল যে চিঠিপত্র নষ্ট করে আমি ভুল করছি । তারপর থেকে যে চিঠিপত্র পেতুম তা ত্রিদিবকে দিয়ে দিতুম, বাঁকুড়ার এক তরুণকেও দিয়েছি অনেক চিঠি, তার নাম ভুলে গেছি, জানি না সে কোথায় হারিয়ে গেছে । ত্রিদিব চিঠিগুলো নিয়ে একটা বাংলা সংকলন আর একটা ইংরেজি সংকলন সম্পাদনা করল, যদিও বই দুটো ছাপা হয়েছিল আমার মামলা শেষ হয়ে যাবার পর কিন্তু কারোর কারোর ত্রিদিবের এই উদ্যোগ পছন্দ হয়নি। ত্রিদিব আমাকে যে চিঠি পাটনার বা উত্তরপাড়ার ঠিকানায় লিখছিল তা থেকে বুঝতে পারছিলুম যে ও আন্দোলনের কয়েকজন সম্পর্কে এতোই বিরক্ত হয়ে পড়েছে যে লেখালিখি ছেড়ে দিতে চায় ।

ত্রিদিবের এই চিঠিগুলো পড়লে কিছুটা ধারণা হবে :-
শিবপুর, ১৯ আগস্ট, ১৯৬৫
ডিয়ার মলয়,
         তোমার পোস্টকার্ড পেয়েছি বেশ কিছুদিন, এবং সঙ্গে-সঙ্গে চিঠি দেওয়ার একটা প্রয়োজন বোধ হল । তবু রোজই, লিখতে বসেই, কী লেখা যেতে পারে এসময়ে, এইসব আগুপিছু ভাবতে-ভাবতে আর লেখা হয়ে ওঠেনি।
         সুবিমল অত্যন্ত অস্বস্তির মধ্যে আছে । পারিবারিক গোলমালের মধ্যে ও জড়িয়ে পড়েছে আচমকা । আমার বাড়িতেও অবস্হা খুবই ঘোলাটে । নানান অকারণে আমাদের দুজনের মধ্যে ( আমি ও আলো ) আবহাওয়া প্রায়ই গরম হয়ে উঠছে, কেন, কোন কারণে, প্রায় খুঁজেই পাচ্ছি না । Settled হতে পারছি না ।
         লেখালিখির ব্যাপার বর্তমান অবস্হায় অসম্ভব বলেই মনে হচ্ছে । ব্যক্তিগত ঝামেলা এতো প্রচণ্ডভাবে ঠেসে ধরছে, কোনো কিছু লেখার মতো মানসিক স্হৈর্য এবং অবসর নাগালের বাইরে । Naked Lunch আর  
Writers in Revolt পড়ে আছে । এ অবস্হায় নিজেকে ক্রমশ নষ্টামির মধ্যে গড়িয়ে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো কিছু সাময়িক রিলিফ পাওয়া যেতো, তাও সম্ভব হয়ে উঠছে না ।
                                                                                         ত্রিদিব

শিবপুর, ১০ অক্টোবর
ডিয়ার মলয়,
         তুমি ওখানে কী করছ ? আর কী কী ভাবছ ? নতুন নাটক ? প্রবন্ধ ? এসব আর লিখছ না কেন ? প্রবন্ধ ছাড়া কীরকম জ্যালজেলে মনে হয় পত্রিকা । সুবিমল এখন ভালোই আছে । শয়তানি ব্যাপারে ওর ঘিলু এখন বেশ Spontaneous, যে যার চালিয়ে যাচ্ছে ঠিকই । এবং কাউকে দিয়ে ল্যাং মারালেও আজ আমার বালছাল কিছুতেই কিছু এসে যায় না । নোংরা বন্ধুত্বও আমার কিছুই করতে পারল না. As usual saint-ই থেকে গেলাম বন্ধুদের কাছে — তাদের গালাগালি চ্যাংড়ামির মধ্যেও ।
        তাবৎ ACTIVITIES আরও WIDE SCREEN-এ দেখবার চেষ্টা করো মলয় ।
        কেবল নিজেদের খেয়োখেয়ি দিয়ে কি আর পুরো Eastablishment-কে ধাক্কা দেয়া যায় ?
        শারদীয়া ‘দৈনিক বসুমতী’তে আমাদের সম্পর্কে একটা লেখা বেরিয়েছে । লেখাটার নাম ‘যুবযন্ত্রণা ও সাহিত্য’ । লেখক : বাবু শ্রীশ্রী অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত । আগাপাশতলা জ্যাঠামো । সাবধানবাণী । হয়তোবা হুঁশিয়ারিও । সুনীলের পোঁদ ধুইয়ে দেয়া । এক কধায় সামাজিক জ্যাঠাশিক্ষকের সাহিত্য-পাণ্ডামি । বিস্তারিত কিছু লেখার দরকার আছে কি ? ওসব গাণ্ডবদের তোমার তো ভালো করেই চেনা । আলো’র “হাংরি জেনারেশনের শোকসভা” কার্ডটা ওদের এমন বিচলিত করেছে যে ক্ষ্যাপা কুকুরের মতন কামড়াতে গিয়ে আমাদেরই Publicity দিয়ে ফেলছে । হাঃ হাঃ হাঃ ।
         হ্যাঁ, আরো কিছু ছবি তুলিয়ে নিলাম একজনকে ফাঁসিয়ে । পরে পাঠাচ্ছি ।
                                                                                                  ত্রিদিব

শিবপুর, ১৭ জুলাই
ডিয়ার মলয়,
         পোস্টকার্ড পেয়েছো সম্ভবত । শুক্রবার পাঞ্জাব মেলে চাপছি । সুবিমলের সঙ্গে গতকাল হাওড়া স্টেশনে দেখা, সন্ধেবেলা । ট্রেন ধরতে না পারায় সোমবার রাত্তিরে সিদ্ধি চলেছিল ।
         সুভাষ ঘোষ ইদানিং নতুন সাকরেদ যোগাড় করেছে, কফিহাউস থেকে বা কফিহাউসে এনে । গদ্য ও কবিতার উপর, হাংরিদের, অমিতাভ দাশগুপ্ত ও মোহিত চট্টোপাধ্যায়ের দুটো প্রবন্ধ ‘ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ’-এ বেরোচ্ছে । সে-ব্যাপারে উভয় ঘোষবাবু ও দাশগুপ্তবাবু ( বাসুদেব ), দাশগুপ্ত ও চাটুজ্যেবাবুর বাড়িতে ঘনঘন যাতায়াত, পাঞ্চিং লিঞ্চিং ইত্যাদি ব্যাপারে বড়োই ব্যস্ত । সুভাষ প্রচার করতো ১৯৬০ সালে তুমি নাকি  সুবোকে ( আচার্য ) তুলে এনেছো । AVANT GARDE আদ্যপান্ত পড়েও খুঁজে পেলাম না । তাছাড়া ‘হাংরি বুলেটিন’ প্রথম বেরোয় ১৯৬১-এর শেষে আর সুবোর লেখা গোলমাল ‘হাংরি বুলেটিন’-এ ১৯৬৩ সালে, তখন আমার বাসায় থাকত ।
         সুভাষ ‘ক্ষুধার্ত খবর’-এর জন্য এক পৃষ্ঠার লেখা চেয়েছিল । এবং আমিও ‘উন্মার্গ’-র জন্য সুভাষের । কিন্তু সুভাষবাবু এতো ব্যস্ত কিংবা…..
                                                                                            ত্রিদিব

শেষ পর্যন্ত লেখালিখি ছেড়েই দিল ত্রিদিব । পাটনায় ও এসেছিল আমাদের সঙ্গে নেপালে যাবে বলে । তা আলো পাটনা এসে ওকে ফিরিয়ে নিয়ে গেল । একদিন কাকভোরে বাবা সদর দরোজা খুলতে গিয়ে দ্যাখেন একটি মেয়ে লাল গামছায় একপ্রস্হ শাড়ি-ব্লাউজ পুঁটলিতে বেঁধে নিয়ে বসে আছে । সম্ভবত রাত থেকেই বসেছিল । ফিরিয়ে নিয়ে গেল ।

ত্রিদিবের একটা পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল সুবিমল বসাক, কালো রঙের প্রচ্ছদ । সেটা আর কারোর কাছে পাওয়া যায় না । হাইকোর্টে আমার মামলা শেষ হবার পর ত্রিদিব আর আলো নিজেদের বিচ্ছিন্ন করে ফেলল হাংরি বন্ধুদের সঙ্গে । কবে ওরা বিয়ে করল তাও জানি না । আমার সঙ্গে তারপর আর দেখা হয়নি । এখন শুনি অবসর নিয়ে ছেলের সঙ্গে ত্রিপুরায় তার চাকুরিক্ষেত্রে থাকে । কলকাতায় এলেও, এমনকি সুবিমল বসাকের সঙ্গেও যোগাযোগ করতে চায় না । আমার কথা বাদ দিচ্ছি, কেননা আমার জন্যেই সবাই পুলিশের নেকনজরে পড়েছিল ।

ওর একটা কবিতাই আমি সংগ্রহ করতে পেরেছি, ১৯৬৩ সালে শিবপুরের পুরোনো বাড়িতে থাকার সময়ে লেখা, তার কারণ কবিতাটা আমার সম্পাদিত “জেব্রা” পত্রিকা দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল । ফালগুনী রায়, মনে হয়, ত্রিদিবের কবিতায় প্রভাবিত হয়েছিল। ত্রিদিবের কবিতাটার নাম “হত্যাকাণ্ড”, যাঁরা ত্রিদিবের কবিতা পড়েননি তাঁদের জন্য দিলুম এখানে ।

আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফাঁদেই পড়তে হচ্ছে
মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে
চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের
ধস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়
আমার জিভ মিধ্যে থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফুঁড়ে
ঝলসে দিচ্ছে মানুষ-বাচ্চাদের
তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান
আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ
প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কেঁদে উঠেছিলাম আমি
চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার
চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে
আমি দানব না যিশুখৃষ্ট বুঝতে না পেরে
রেস্তরাঁয় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা
আজ আর কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার
সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে
সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়
সব জীবনের মধ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা
আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু
অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়ে
কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান
কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে
ভয়ে কুঁচকে গিয়েছিল তার চোখ
অন্ধ চোখে কেঁদে উঠেছিল মাথা নিচু করে
এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে
নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর
আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে — আমার ভালোবাসা
ভয় আর ভালোবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে
বাঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর
ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়
সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়
বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ
সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যের বেতারে
টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু
এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়
রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি
আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য ‘টোপ’
নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে
খেলতে চাইলাম চাতুরী
তোমার প্রতারণা থেকে ভালোবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম
আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা
আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা
আমার দিব্যজ্যোতি আমার অন্ধকার
আমার চারিধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার
চলছে মানুষের
মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালোবাসেনি
উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্দু লাশ
আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে
আমার ধর্ম কী তা মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে
আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে
স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু
পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা
অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটে ক্ষুরধার ভালোবাসা
আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি
প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফুঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমতো
অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান
কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু
আমার ভালোবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি
অসুস্হ ভালোবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য
মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও
আমার সকল উত্তাপ জড়ো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক
ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা
আগুনের হল্কা ছুঁড়ে দিলে আমার গায়ে
শিশুর মতো হেসে উঠলাম আমি
পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর
আকাশ ঘেঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ
স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে
ওঃ
আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল
আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না
নিজেকেও তেমন করে ভালোবাসা হল না আমার
এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি
একই সঙ্গে হাসছি আর হাসছি না
ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি অক্লান্ত আওয়াজ আঁকাবাঁকা টানেল—
লুপ-পরিসংখ্যান-ক্ষুধা-মহব্বত-ঘৃণা—
কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের
আত্মাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও
বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে
আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে
মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ অব্দি
ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমি-ওঠা চোখে
মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার
কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালোবাসা আমার অসহায়তা
মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে
অক্ষম আর অনুর্বর স্বাধীনতা
মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে
অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা
ওঃ আমি কোনো দিনই ভালোবাসতে চাইনি
আঃ……………………………………আঃ
কলজে গুঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়
বুকের ভেতরে ইনজিনের চাপা ক্রোধ
রক্তের উত্তেজনা থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা
অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রনাম রেখেছিল সুবো
তিনমাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ
মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি
ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে
আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়
ভাঁটার সঙ্গে-সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতোদিন চিনতে পারেনি
আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খুঁজে পাচ্ছি না নিজের
“মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই “ বলতে ককিয়ে উঠেছিল
৩৫২ কোটি মানুষ তার ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা
ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন
কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে
আমার
তাদের অজান্তেই……….

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন