শনিবার

হাংরি আন্দোলনের কবি দেবী রায়-এর কবিতা

রবিবারের পড়া: বাংলাভাষার শিল্প ...
সেই শনিগ্রহ
আপনি এত সজ্জন..
কেন যে এককালীন ইয়ারদোস্ত
এত যে অশ্লীল !
কি আর করা যাবে ?
আছেন সেই শনিগ্রহ বন্ধুস্হানে
.
প্রকাশক একজন,
জানিয়েছিলেন ফোনে !
কি আর করা ?
নিশ্চয় ছিলুম আহাম্মক -- নৈলে
ওকে বিশ্বাস করলুম কিভাবে ?
দিন কি যাবে
এভাবে ?

চাঁদের ওপিঠে
ছিল একাকী প্রচণ্ড থমথমে কথা বলার
স্বাধীনতা তথা ফ্রি-স্পিচ ? দুমুখে ও কাজে
মুখোমুখি দাবি রাখে সহাস্য আলোচনায়
.
আজ ৩রা জানুয়ারি উনিশ দিহাজার
আরো এই তীব্র শৈত্যাভাব বুঝিয়ে দেবে 
কাকে বলে শীতের কামড়, একাকীত্ব ? এই মেঘলা দিনান্তে
.
সেই নারী শরীরের ‘ওম’ সুতীব্রভাবে আমায় টানে
বৃক্ষরোপণ কি সম্ভব ? চাঁদের ভূ-পৃষ্ঠে ?

কমলকুমার মজুমদারকে
ভিতরের আগুন, আমাকে শান্ত হতে দেয় না ;
বাহিরের সব উল্টোপাল্টা ঘেয়ো-অশান্তি
আগুনকে, আরও উসকে দেয় !
.
— কেই বা পছন্দ করে উলঙ্গ জীবন ?
..                              .’বাছা, ডিপ্লোম্যাট হও’!           

বুকের মধ্যে সিংহাসন 

এখনও যে ভালোবাসা পায়নি
এবং
যে ভালোবাসা হাতের মুঠোয় পেয়েও হারিয়েছে
..                                            ..এই দুজনের মধ্যে কে বেশি দুঃখী–
..                                           ..দুঃখের ভার, বেশি কার ?
প্রায় সব ফুলই আমি ভালোবাসি
ফুলের ভিড়ে, রজনীগন্ধা সবচেয়ে প্রিয় আমার !
তা বলে দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে আমাকে
..                                     ..মালাকার হতে বোলো না !
অল্পবিস্তর সব রমণীই আমার ভালোবাসার পাত্রী
তবে বুকের মধ্যে সিংহাসন পেতেছি, শুধু একজনার !
ক্ষণিক দুর্বলতার মোহে আমাকে ভ্রষ্টাচারের দিকে
..                                       ..ঠেলে দিও না!
.
ভালোবাসা পত্রবহুল বৃক্ষের মতন !
বৃক্ষের কাছে হেঁটে গিয়ে স্পষ্ট গলায় বলি :
‘মানুষের হাতে-গড়া পৃথিবীতে, যে-কটা দিন
..                           ..বেঁচেবর্তে আছি
..                                       ..ভরিয়ে তোলো এ-জীবন
ভালোবাসার অভাব যেন কোনোদিন—
..                                             ..গ্রাস না করে আমায় !   
           
    বৈদিক মেঘে
   
       
টেলিগ্রাফের তারে, ঠিক একজোড়া নয় — পরপর
অল্পদূরত্বে দু’জোড়া লেজঝোলা দেখা গেল ভোরে !
সুমিষ্ট লাগল না মোটে, কেন যে ! ওদের কন্ঠস্বর
যেন ফেটে বেরিয়ে আসছিল ! গলা-গলা
ফুলিয়ে ঝগড়া করছিল কি ? জলায় এতকাল কলমি,
শুসনি উঠেছিল বেড়ে, তার ডগায় ফড়িং বেড়াত
ঘুরে ঘুরে ! সব কিছু নস্যাৎ করে ধাঁই থাঁই
করে উঠে যায় জি-প্লাস জলভারানত মেঘ ভেসে
যায় ! এইসব স্পষ্ট অবয়বের পক্ষে এই যে
রুক্ষ কঠোর বাস্তবতা
..            ..ওই ল্যাজঝোলা পাখি
..            ..দেখেছিলাম ভাগ্যিস, তাই রক্ষে !
কারুরই কিছু এসে যায় কি ?
আহা! কী আশ্চর্য, কী আনন্দের  কথা
হে পরম ব্রহ্ম, হে পরমাত্মা
এত বছর প্রাণপাত, তবু তোমার নাগাল
পেলাম না ! সর্বস্তরে, বৈদিক মেঘে ঘোর অন্ধকার !           
   
        অক্ষরের খুঁটিনাটি
   
       
‘অক্ষরের খুঁটিনাটি’ বলতে যা বোঝায় !

ড্রইংরুমে ‘পাতিল, ‘ কি সাজানো যায় ?
রাখি, জানালার পাশে
ফুলদানিতে, চনমনে সজীব ফুল !
‘বনসাই’য়ের দিকে একটানা তাকিয়ে
থাকলে বিকের মধ্যে কষ্ট হয় ! — কে তার
ডালপালা
..           ..দিয়ে ছেঁটে  কী এক ছন্দিত
..                          ..নিপূণ কৌশলে ?
বাহিরে অঝোর বৃষ্টি ! চোখের পারে ভাসে
ব্যবিলন । ভাবি, সে-ও বনসাই এক অর্থে
কী এক নিষ্ঠুর পরাক্রম শক্তি বারবার
ঝাঁপিয়েছে তাত
উপর
..                 ..ওই হিংস্র দাঁত ও নখ…
জীবনও কি
…                    ..এতই মৃত্যুলোভাতুর !

শুক্রবার

মীজানুর রহমান : "হাংরি কিংবদন্তি" বইয়ের প্রথম প্রকাশক

মীজানুর রহমান কে? তিনিই প্রথম ধারাবাহিক "হাংরি কিংবদন্তি" প্রকাশ করেছিলেন ।
আজ  ( 26 June )মীজানুর রহমানের মৃত্যুদিবস। ২০০৬ সালের এই দিনে তিনি চলে গেছেন।
মীজানুর রহমান চলে গেলেন। কোন মিজানুর রহমান? সম্পাদক মীজানুর রহমান। কিসের সম্পাদক? ‘মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’র। এটা আবার কী রকম পত্রিকা?
সাহিত্যের বোদ্ধা পাঠক, কবি, গল্পকার, ঔপন্যাসিক, চিত্রশিল্পী—সংক্ষেপে, দেশের বিদ্বৎসমাজের সদস্যরা অনুগ্রহ করে ভাববেন না মশকরা করছি। আসলে, ১৪ কোটি মানুষের এই দেশে দৈনিক পত্রিকা পড়েন যদি ৫০ লাখ, তো তাদের মধ্যে কজন চেনেন মীজানুর রহমানকে?

আমাদের এই তারকা-খচিত গণমাধ্যমে তাঁর জায়গা ছিল না বললেই চলে; আর গণমাধ্যমে যার জায়গা হয় না মানুষ তাকে চিনবে না এটাই স্বাভাবিক। গত ২৫ জুন দিবাগত রাতে কলকাতার এক ক্লিনিকে তিনি মারা গেছেন—এই সংবাদ দেশের কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে ছাপানোর জন্য তদবিরে নেমে আবিষ্কার করলাম, শুধু সাধারণ মানুষ কেন, সাংবাদিক ও সংবাদ ব্যবস্থাপকদের মধ্যেও এমন মানুষ আছেন যারা তাঁকে চেনেন না। এটাও অবাক হওয়ার মতো কিছু নয়। যেসব কৃতি ও দুষ্কৃতির কারণে একজন মানুষ মূলধারার সংবাদমাধ্যমে জায়গা পান, মীজানুর রহমান সাধারণ বিচারে তেমন কিছু করেননি।
তাহলে কেন প্রথম আলোর মূলব্যান পাতায় আজ তাকে এ জায়গা(টুকু) দেওয়া হচ্ছে? যে কোনো পাঠক নিশ্চয়ই এ কৈফিয়ত চাইতে পারেন, কারণ প্রায় তিন লাখ মানুষ এই পত্রিকা পয়সা দিয়ে কেনেন, পড়েন কম পক্ষে ১৫ লাখ।
কিন্তু প্রিয় পাঠক, কৈফিয়ত দেব কী করে?
মীজানুর রহমানের স্মরণে এই কথাগুলো লেখা ও ছাপা হচ্ছে ভালোবাসা থেকে। আমরা তাঁকে ভালোবাসি। ভালোবাসার কি কৈফিয়ত হয়?

১৯৮৩ সাল থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মীজানুর রহমান তার ত্রৈমাসিক পত্রিকার যে ৮০টি খন্ড সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, শুধু সে-জন্যেই তাকে ভালোবাসা যায়। সৃজনশীলতা, মননশীলতা, ইতিহাস-ঐতিহ্যের চেতনা, জ্ঞানের ও সুরুচির যে-চর্চা তিনি করে গেছেন, সে জন্য তাঁকে আমাদের শ্রদ্ধা করা উচিত, মনে রাখা উচিত। তিন মাস পর পর ছ/সাত ফর্মার নিয়মিত সংখ্যাগুলো ছাড়া তিনি ঢাউস আকারের যে বিশেষ সংখ্যাগুলো সম্পাদনা ও প্রকাশ করেছেন, সেগুলোর জন্য তাঁকে আমাদের সালাম জানানো উচিত। শুধু পাখি নিয়ে প্রায় ৮০০ পৃষ্ঠার একটি পত্রিকা, ‘পক্ষী সংখ্যা’। এরকম আরো অনেক : বৃক্ষ সংখ্যা, নদী সংখ্যা, আবার বৃক্ষ ও পরিবেশ সংখ্যা, এবং বিস্ময় মানবেন প্রিয় পাঠক, দুই খ- মিলিয়ে প্রায় ১৪০০ পৃষ্ঠার ‘গণিত সংখ্যা’ তিনি আমাদের উপহার দিয়েছেন। শিল্পী রশিদ চৌধুরী, পটুয়া কামরুল হাসান, কবি আহসান হাবীব, শামসুর রাহমান, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে বিশেষ সংখ্যাগুলোর কথাই বা কেন বলব না।
মীজানুর রহমান অনেক মানুষকে দিয়ে অনেক কিছু লিখিয়ে নিজের পত্রিকায় প্রকাশ করেছেন। তাঁর উৎসাহে ও অবিরাম তাগাদায় অনেকেই অনেক কিছু লিখেছেন, যে লেখাগুলো হয়তো কখনো লেখা হতো না। যেমন, যখন পক্ষী সংখ্যার কাজ চলছিল, তখন তাঁর পরিচয় ও আলাপ ঘটে সাবেক কূটনীতিক সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের সঙ্গে। তিনি আবিষ্কার করেন, এই ভদ্রলোকের জানাশোনার পরিধি ব্যাপক ও বিচিত্র। সব বিষয়ে বলেনও চমৎকার। মীজান সাহেব একদিন হাশেম সাহেবকে বললেন, ‘পক্ষী সংখ্যার জন্য কিছু লিখুন না।’ সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেম কুণ্ঠার সঙ্গে বলেন, তিনি সরকারি চাকরির কাজে ইংরেজি ভাষা ব্যবহার করতে অভ্যস্থ, বাংলা ভাষায় কিছু লেখার সাহস পান না। (আসলে প্রকাশ করার, কারণ তিনি বাংলায় কিছু প্রবন্ধের নোট, ভ্রমণবৃত্তান্ত ও অন্যান্য টুকিটাকি বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে লিখে রাখতেন। কিন্তু সুধীন দত্তীয় গদ্যের ভক্ত এই বিদ্বৎজন ভাবতেন তাঁর বাংলা লেখাগুলো আজ আর প্রকাশযোগ্য নয়।) মীজান সাহেব তাঁকে সাহস দিয়ে বলেন, আপনি যখন বাংলায় এত সুন্দর বলেন, তখন লিখবেনও চমৎকার। এরকম করেই সৈয়দ নাজমুদ্দীন হাশেমের হাতে বেরিয়ে আসে ‘সব পাখি নীরব কেন’ শিরোনামের এক অপূর্ব সুন্দর প্রবন্ধ, (পক্ষী সংখ্যায় প্রকাশিত) এবং তারপর তিনি বাংলায় আরো অনেক লিখেছেন।
নাছোড়বান্দা সম্পাদক মীজানুর রহমানের তাগাদায় আর অবিরাম পীড়নে আবদুশ শাকুর লিখেছিলেন গোলাপ নিয়ে, তার পত্রিকার বৃক্ষ সংখ্যায়। অনেকে এখন জানেন, আবদুশ শাকুরের ‘গোলাপ সমগ্র’ সেরা মননশীল বই হিসেবে ২০০৪ সালে প্রথম আলো বর্ষসেরা বইয়ের সম্মান লাভ করেছে। এরকম অনেক দৃষ্টান্তের মধ্যে থেকে আরেকটা: বামপন্থী তাত্ত্বিক নেতা ও রাজনীতিক আবদুল হালিম পিরিস্ত্রোইকার পরে যখন রাজনীতি থেকে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে গুটিয়ে নেন, এবং সম্ভবত এক ধরনের বুদ্ধিবৃত্তিক ও মানসিক বিষাদজনিত নিষ্ক্রিয়তার শিকার হন, তখন মীজানুর রহমানের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে ওঠে। অনেক সন্ধ্যায় দুজনকে দীর্ঘ আলাপ করতে দেখেছি মীজানুর রহমানের ধানমন্ডির বাসায়। মীজানুর রহমান আবদুল হালিমের মধ্যে বিশুদ্ধ জ্ঞানের এক গভীর অনুরাগীর দেখা পান, যাঁর প্রধান আগ্রহ গণিতে। গণিত সংখ্যার জন্য আবদুল হালিমকে দিয়ে তিনি লিখিয়ে নিলেন একাধিক লেখা। এ ছাড়া তার পত্রিকার সাধারণ সংখ্যাগুলোর জন্যও আবদুল হালিম বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন, যেসবের মধ্যে বিষয় হিসেবে সঙ্গীত ছিল, সম্ভবত নৃত্যকলাও। পত্রিকার সুবাদে আবদুল হালিম শেষ জীবনে মীজানুর রহমানের সঙ্গে এমনই ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন যে, সাধারণ সংখ্যাগুলো যখন ছাপা হতো, সম্পাদক-পত্নী নূরজাহান বকশীর কষ্ট কমানোর জন্য হালিম সাহেব নিজে পত্রিকার কপিগুলো প্রেস থেকে বহন করে মীজান সাহেবের বাসায় নিয়ে আসতেন ।
অবিরাম অনুরোধে আর তাগাদায় বিভিন্ন জনকে দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে লিখিয়ে, সেসব লেখা সম্পাদনা করেই মীজানুর রহমান সারা জীবন কাটিয়ে গেলেন তা কিন্তু নয়। নিজেও লিখেছেন বিস্তর। সেগুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে তার পত্রিকার ৮০টি সংখ্যার প্রত্যেকটিতে, ‘সম্পাদকের কড়চায়’। এ ছাড়াও বিভিন্ন বিষয়ে আলাদা আলাদা প্রবন্ধ-নিবন্ধ লিখেছেন অনেক। ইতিহাস-ভূগোলের প্রতি গভীর আগ্রহ ছিল তার। যেমন জানতেন শৈশব-কৈশোরের নগরী কলকাতাকে, তেমনি তার জানা ছিল ঢাকার ইতিহাসের অনেক খুঁটিনাটি বিষয়, পুরান ঢাকা অলিগলি, তস্য-গলি সব ছিল তার হাতের তালুতে। ‘সেকালের ঢাকা’ সিরিজ নামে তার বেশ কিছু লেখা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়। সেগুলো একসঙ্গে জড়ো করে ‘ঢাকা পুরাণ’ নামে একটি বই প্রকাশের পরিকল্পনা করেছিলেন।

লিখেছেন প্রচুর, কিন্তু প্রকাশিত বই তার মাত্র দুটি। একটি ‘কমলালয়া কলকাতা’ বা তিরিশ ও চল্লিশের দশকের মহানগরীর শঙ্খরব। এটি তার কৈশোরের স্মৃতি। অন্যটি ‘কৃষ্ণ ষোলোই’ (১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার মহাদাঙ্গার চাক্ষুষ বিবরণ)।
প্রায় সারাটা জীবনই ভুগেছেন হাঁপানিতে। প্রৌঢ় বয়েসে যোগ হয়েছিল আরও নানা রোগ-ব্যাধি। সবশেষে পড়েছিলেন চোখের এক জটিল অসুখে, খুব দ্রুত দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলছিলেন। কিন্তু সমস্ত রোগ-ব্যাধির সঙ্গে যুদ্ধ করে অবিরাম কাজ গেছেন। ৭১ বছর বয়েসে শুরু করেন অকল্পনীয় এক কর্মযজ্ঞ: এনসাইক্লোপিডিয়া। একাই তৈরি করবেন এক ‘মহাজ্ঞানকোষ’। একেবারে বিফল হননি। প্রায় ৭০০ পৃষ্ঠার দুটি খন্ড তৈরি করেছেন, ভূমিকাও লেখা শেষ, বাকি ছিল শুধু প্রেসের কাজ।
ক্ষীণদেহ-ভগ্নস্বাস্থ্য মীজানুর রহমানের ছিল আসুরিক পরিশ্রম করার শক্তি ও প্রেরণা। শেষের দিকে চোখ দুটি শত্রুতা শুরু করলে লেখা সম্পাদনার কাজে আঁতসি কাচের সাহায্য নিতেন। চোখের এই অবস্থা নিয়ে রসিকতা করে লিখেছেন তাঁর পত্রিকার নিজের সম্পাদিত সবশেষ সংখ্যার ‘সম্পাদকের কড়চা’য়: ‘চক্ষু যুগল সাঁট করিয়া মাস ছয়েক হইল লাগাতার ধর্মঘটে পড়িয়াছে...পড়িতে গেলে হরফগুলি ব্যালে-নৃত্যের নর্তকীদের মতো সারা পৃষ্ঠা জুড়িয়া নাচিয়া কুঁদিয়া লঙ্কাকান্ড করিয়া বসে। আবার আলস্যবিলাসে মত্ত হরফগুলি ‘রহিয়া আলিসে ঠেস্না বালিশে’ রূপ বদলাইতেও কার্পণ্য করে না। ওদিকে লজ্জাশীলা হরফেরা নেকাব পরাকে দোষাবহ মনে করে না। চক্ষুর্দ্বয় জ্বালাপোড়া করে যখন বর্ণেরা বঙ্কিম ভঙ্গিতে নাচিতে থাকে..।’
কাজ করতে ভালোবাসতেন, কাজেই আনন্দ পেতেন। আর মনে করতেন, স্বাস্থ্যের অবস্থা যতই খারাপ হোক, বাঁচবেন কমপক্ষে ৯০ বছর, কাজ করবেন আরও অনেক। ভালোবাসতেন যা কিছু ভালো ও সুন্দর। নদী ভালোবাসতেন, ফুল ভালোবাসতেন, গাছ ভালোবাসতেন। দ্বিজেন শর্মাকে ‘বৃক্ষসখা’ ডাকতেন এই মীজানুর রহমান।

মীজানুর রহমানকে ভালোবাসা যায় আরও একটা কারণে: তাঁর লেখা পড়ে বাংলা ভাষার শক্তি ও সৌন্দর্য উপলব্ধি করি। মনে হয় আমার বাংলা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না হেন বিষয় মানবের জ্ঞানজগতে নেই। তাঁর ভাষার স্বাদ পেতে হলে বিচিত্র বিষয়ে তাঁর লেখাগুলো পড়া ছাড়া উপায় নেই। তাঁর কৈশোরের স্মৃতি নিয়ে লেখা ‘কমলালয়া কলকাতা’র ভূমিকা থেকে কয়েক লাইন এখানে তুলে দিচ্ছি:
‘বেনারসের ফণি কাকাবাবুর তোলা আমার ন’ মাসের ননুয়া-গা ফটোটার দিকে তাকিয়ে ভাবি—ঐটুকুন দেহের ওপর দিয়ে দেখতে দেখতে কেমন ষাটটি বছর পার হয়ে গেল! এই ষাট বছরের পরিসরে শৈশবের সতেরটি সবচেয়ে মধুর বছর কিন্তু কলকাতার ভাগে। ১৯৩১ থেকে ১৯৪৭—বানভাসি চুনুরী অতীতের দিকে যখন ফিরে তাকাই, তখন জন্মাবধি যে শুভনগরীর কোলেকাঁখে বড় হয়েছি, কমলালয়া কলকাতার সেই সুখদ দিনমানের শঙ্খরব যেন আজও কানে এসে পশে। আমাদের তিরিশ ও চল্লিশের প্রথম পাদের গা-হাত-পা-ছেড়ে-দেয়া মহাসুখী কলকাতার কথা কোনোদিন লিখব ভাবি নি। এ তো সেই কলকাতা, যার বৌবাজার, গড়পাড় ও মির্জাপুরের পল্লীতে পল্লীতে লেত্তির হুকুমে লাট্টু ঘোরে, মাঞ্জার ডামরে আকাশ জুড়ে ঘুড়ি ওড়ে আর একটু সবুজ কি নির্জন এলাকা বুঝে বলের গায়ে লাথি পড়ে, বহু মঞ্জরী স্মৃতি আমাকে আনন্দভেলায় চাপিয়ে শৈশবের পৈথানে নিয়ে যায়..।’
খুব জনপ্রিয় একজন ঔপন্যাসিক সেদিন প্রশ্ন করলেন, ‘মীজানুর রহমানকে যদি আমরা না চিনি, সে দোষ কার? ওনার না আমাদের?’
এই প্রশ্নের কোনো উত্তর দিতে পারিনি। উত্তর যে নেই তা নয়। কিন্তু সে প্রশ্ন এখন অর্থহীন হয়ে গেছে। মীজানুর রহমান এখন আর আমাদের মধ্যে নেই। সবকিছুর উর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি। নিজের জন্য কী নিয়ে গেছেন কে জানে; আমাদের জন্যে রেখে গেছেন তাঁর জীবনের সমস্ত কৃতি। সেগুলো মূলব্যান।

মীজানুর রহমান, আপনাকে সালাম।#

ছবিতে থাকতে পারে: এক বা আরও বেশি ব্যক্তি, ফিতে, সানগ্লাস এবং ক্লোজআপ


  • হাংরি আন্দোলনের কবি অরুণ বণিক-এর কবিতা



    শনিবার

    অরুণেশ ঘোষ নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

    অরুণেশ ঘোষ নিয়েছেন মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

       
                                                       
                                               

    অরুণেশ ঘোষ পশ্চিমবাংলার সত্তর-আশির দশকের খ্যাতনামা কবি। তাঁর সঙ্গে কখনও
     মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎ পরিচয় হয়নি। হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার এক দশক পর
     তিনি নিজেকে একজন হাংরি আন্দোলনকারী ঘোষণা করে সেই সময়ের সিপিএম দলের কয়েকজন 
    কবি-লেখকের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে পুনরায় জীবনদানের প্রয়াস করেন। কিন্তু আশির দশকের 
    মাঝামাঝি পর্যন্ত তিনি জানতেন না যে হাংরি আন্দোলন মামলায় মলয় রায়চৌধুরীরই কারাদণ্ডের 
    আদেশ দিয়েছিল নিম্ন আদালত এবং উচ্চ আদালতে সে আদেশ নাকচ হয়ে যায়। তিনি সেই প্রথম 
    জানতে পারেন যে তাঁরই দুই সঙ্গী শৈলেশ্বর ঘোষসুভাষ ঘোষ সেই মামলায় মলয়ের বিরুদ্ধে 
     রাজসাক্ষী হয়েছিলেন এবং মুচলেকা লিখে দিয়েছিলেন যে তাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব
     সম্পর্কে ছিন্ন করছেন এবং ভবিষ্যতে এই আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখবেন না। মুচলেকা 
    দেবার কারণে তাঁরা নিজেদের পত্রিকার নাম রেখেছিলেন ‘ক্ষুধার্ত’, এবং ‘হাংরি’ শব্দটি এড়িয়ে যেতেন।
     অরুণেশ ঘোষ এই সমস্ত তথ্যাদি পান শিবনারায়ণ রায় তাঁর ‘জিজ্ঞাসা‘ পত্রিকায় সম্পাদকীয়তে
     বিষয়টি খোলশা করার পর। বিশদ তথ্যাদি সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘জিরাফ পত্রিকার
     জন্য ১৯৮৫ সালে ডাকযোগে এই সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত তিনি মলয় রায়চৌধুরীর 
    কোনো রচনা এবং হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনাগুলোর সঙ্গে 
    পরিচিত ছিলেন না। এই সাক্ষাৎকারটি নেবার পর তিনি আর কখনও মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে 
    যোগাযোগ করেননি; মাথাভাঙা থেকে কলকাতায় এলেও মলয়ের সঙ্গে দেখা করেননি। ২০১১ সালে
     জলে ডুবে অপঘাতে মৃত্যুর কয়েকবছর পূর্বে তিনি তৃণমূল দলের প্রতি সহানিভূতিসম্পন্ন ও ঘোর
     সিপিএম বিরোধী হয়ে ওঠেন।

    অরুণেশ: “সঙ্গী-সাথীদের বিশ্বাসঘাতকতায় বীতশ্রদ্ধ হয়ে লেখা ছেড়ে দেন”— আপনার সম্পর্কে 
    এরকম একটি ধারণা বাজারে চালু রয়েছে, সেটা কি সত্য ? যদি সত্য হয়, তাহলে বিশ্বাসঘাতক কারা ? 
    কীরকম সেই বিশ্বাসঘাতকতা ? বিস্তারিত বলুন।

    মলয়: তোমার মতন নাছোড় কিছু পাঠক আমার এদিক-সেদিক ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গোটা পঞ্চাশেক
     হবে মনে হয়। বাজার পর্যন্ত খ্যাতি আমার নেই। ওটাকে একরকম প্রাতিস্বিক যুক্তি বলা যেতে পারে। 
    কথাটা শরৎকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন ‘পথের পাঁচালি’ পত্রিকার দ্বাদশ সংকলনে। আর-কেউ 
    বলেছেন কিনা নজরে পড়েনি। শরৎবাবু বলেছিলেন, ‘এরা বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান, উচ্চাভিলাষী, 
    আবেগপ্রবণ, অসহিষ্ণু, খ্যাতিলোভী এবং শতবিদ্রোহ সত্ত্বেও পুলিশের রক্তচক্ষু দর্শনে সন্ত্রস্ত। ‘টাইম’ ম্যাগাজিনে 
    যখন ওদের মামলা প্রকাশিত হয়, তখন যুগপৎ বিশ্ববিখ্যাত হওয়া এবং পুলিশের কাছে মুচলেকা দেওয়ার
     উত্তেজনায় কাতর এদের কারো-কারো চেহারা দেখেছি।’ এই সব কথা বলে শরৎবাবু তারপর আমার
     লেখা ছেড়ে দেবার কথাটা টেনে এনেছেন। উনি বলতে চাইছেন, পুলিশের কাছে দেওয়া সুভাষ ঘোষ
     শৈলেশ্বর ঘোষ এর মুচলেকা এবং উৎপলকুমার বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় আর
     শক্তি চট্টোপাধয়া্য-এর দেওয়া জবানবন্দিগুলো হল বিশ্বাসঘাতকতা এবং ওই মুচলেকা 
    ও জবানবন্দিগুলোর জন্যেই আমি লেখা ছেড়ে দিই। এটা ঠিক যে ওই মুচলেকা ও জবানবন্দিগুলি 
    আর সেই সঙ্গে রাজসাক্ষী-সরকারি সাক্ষী হতে রাজি হওয়ার দরুণই পুলিশ আমার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত মামলাটা দাঁড় করাতে পারে।
     এটাও ঠিক যে, আমাকে চার্জশীট দেবার দিন পর্যন্ত তাঁরা আমায় তাঁদের দিয়ে-ফেলা মুচলেকা-জবানবন্দি
     আর অ্যাপ্রুভার হবার কথাটা চেপে রেখেছিলেন, যার জন্য আমার উকিলরা উচিত ব্যবস্হা নিতে পারেননি।
     কিন্তু প্রথমত, একে বিশ্বাসঘাতকতা বলা যায় না কারণ আমি কোনো দিনই তাঁদের বিশ্বাসযোগ্য মনে 
    করিনি। অবাক লেগেছিল বটে। ছাড়া পাবার জন্যে তাঁদের কাছে অন্য উপায় ছিল না। শক্তি অবশ্য
     প্রতিশোধ নিয়েছিলেন, তাঁর ব্যাপারটা ভয়ের নয়। তিনি আমার দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়ার প্রেমে পড়ে
     মেয়েটির বাবা-মা’র দ্বারা তিরস্কৃত হয়েছিলেন ( আমাকে ও দাদাকে তার জন্য দায়ি করেছিলেন)। 
    সেটা কাটিয়ে উঠতে পারেননি— শক্তিবাবুর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগই ছিল না এফ আই আর-এ।
     প্রণয়ে ব্যর্থ হয়ে তিনি শোধটা তুললেন কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। সন্দীপন কেন সাক্ষ দিয়েছিলেন, 
    কে তাঁর ওপর চাপ সৃষ্টি করেছিল, আমি জানি না। তাঁর বিরুদ্ধে-ও এফ আই আর ছিল না। 
    তিনি নিজেও আজ ওব্দি এ-ব্যাপারে মুখ খোলেননি। অথচ পেঙ্গুইনের বইটায় নিজেকে হাংরিয়ালিস্ট 
    আন্দোলনের স্রষ্টা বলেছেন। উৎপলবাবুর নামও ছিল না এফ আই আর-এ। দ্বিতীয়ত, আমি লেখা
     ছেড়ে দিই–বা লেখা আমাকে ছেড়ে দেয়– সম্পূর্ণ অন্য কারণে। মামলার গণ্ডোগোলের মাঝে আমার
     জীবনে একের পর এক নানান ঘটনা ঘটতে থাকে । সে সব এত ব্যক্তিগত যে, তার গোপনতাই যেন 
    সুস্হতা মনে হয়। সেগুলো গোপন রাখার মধ্যে একাকীত্বের ভাল লাগা আছে। একজন লেখকের লেখা 
    বা না-লেখার সঙ্গে আমি মনে করি না সঙ্গী-সাথীদের কিছু করার থাকে, কেননা লেখাটাতো প্রাতিস্বিক
     ব্যাপার। আমি সৃজনশীল লেখার কথা বলছি। শরৎবাবুর বক্তব্য সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া তুমি  
    দেবাশিষ প্রধান-এর ‘কবিতার কাগজ’ শারদ ১৩৯১ সংখ্যায় পাবে। তবে যতটুকু মনে করতে
     পারি, জুলাই ১৯৬৭-এ হাইকোর্টে মকদ্দমা জিতে যাবার পর আর কোনও লেখা লিখিনি। লেখার জন্য 
    স্হির হয়ে বসার মানসিকতা ছিল না। অস্তিত্বের অদম্য অস্হিরতায় আমি লেখা ছেড়ে দিয়েছিলুম। 
    হয়তো এই কারণেই সুবো আচার্য দীক্ষা নিয়েছিলেন অনুকুল ঠাকুরের কাছে। হয়তো একই কারণে
     মার্কসবাদী দলে আশ্রয় নিয়েছেন বাসুদেব দাশগুপ্তত্রিদিব মিত্র; নকশাল হয়ে গিয়েছিলেন  
    করুণানিধান মুখোপাধ্যায়। মৃত্যুর দিকে এগিয়েছিলেন ফালগুনী রায়। সুতরাং তোমার 
    ওই বাজারচালু অভিযোগ বা ধারণাটি অসত্য।

    অরুণেশ: হাংরি আন্দোলনের মূল স্রষ্টা কে ? আপনি না শক্তি চট্টোপাধ্যায় ? না কি কোনো 
    ব্যক্তিকেই বলা যায় না মূল উদ্ভাবক। আপনার কি মনে হয় না স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিভিন্ন ঘটনা-পরম্পরার 
    পরিণামে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছিল ? তার মূল নেতা বলে কেউ নেই ?

    মলয়: তুমি হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবনা, আরম্ভ, গড়ে ওঠা, নেতৃত্ব সব একাকার করে ফেলছ।
     হাংরি শব্দটা আমি খুঁজে পেয়েছিলুম ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসার-এর In The Sowre Hungry Tyme 
    বাক্যটি থেকে। কী রকম অপ্রতিরোধ্য শব্দবন্ধ্য দেখছ তো ? মনে হয় যেন আমাদের সময়ের জন্যি লেখা।
     এই হাংরি শব্দটা আমি প্রয়োগ করি ইতিহাসের দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের 
    The Decline of the West গ্রন্হে তুলে ধরা অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে । প্রথম বুলেটিনটায়, 
    যা আমি পাটনায় ১৯৬১ সালের নভেম্বরে চাপিয়েছিলুম, তুলে দিয়েছিলুম ওই কথাবার্তা। 
    পাটনায় ছাপানো বুলেটিনগুলো সবই ইংরেজিতে কেননা বাংলা প্রেস প্রথম থেকেই ছাপতে অস্বীকার করে। 
    অনেকে, না জেনেই, ভুরু কুঁচকে এর মধ্যে বিদেশি গন্ধ পেয়েছিল। ঠিকানা দেয়া থাকত দেবী রায়-এর হাওড়ার বাড়ির। আন্দোলন করার জন্যেই ভেবে-চিন্তে অনেককিছু করা হয়েছিল। প্রথম থেকেই বলা
     হয়েছিল আন্দোলনরূপেই এর আবির্ভাব। আমি বুলেটিন, মুখোশ, পোস্টার, বিয়ের কার্ডে পদ্য, রেড-লাইটে 
    কবিসন্মিলন, চৌরঙ্গীতে আদিবাসী রমণী, ইত্যাদির খরচ জুগিয়ে গেছি। ‘পোপের সমাধি‘ 
    উৎপলকুমার বসু নিজেই প্রকাশ করেন। তখন রিজার্ভ ব্যাংকে একশো সত্তর টাকার কেরানিগিরি করতুম। 
    এক পয়সাও বাড়িতে দিতে হত না। আন্দোলনকে ছড়িয়ে দেবার জন্যে এবং নতুনদের আকৃষ্ট করার জন্যে 
    শক্তির সে সময়ের ইমেজকে অস্বীকার করা যায় না। তাঁর ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ সেসময়ের কবিতার
     প্রেক্ষিতে ছিল অভাবনীয়। নেতা হিসেবে তাঁর নাম আমিই প্রয়োগ করি। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর 
    একা এবং কয়েকজন’ সে তুলনায় জোলো মনে হয়েছিল। শক্তির নামে নেতা যোগ করার জন্যে সুনীল 
    দমদমে একদিন সকালে প্রচণ্ড ক্রোধ প্রকাশ করেছিলেন। বলেছিলেন, ‘আমি কি শক্তির থুতু চাটব?’ 
    কলকাতার সাহিত্য-রাজনীতি পাটনায় বসে জানা ছিল না। এজন্যেই পরবর্তীকালে তিনি উষ্মা প্রকাশ 
    করেছেন যে তাঁকে বাদ দেয়া ছিল উদ্দেশ্য। সুনীল যে ভুলটা করেছিলেন তা হল হাংরি ছিল আন্দোলন, 
    আর ‘কৃত্তিবাস’ একটা পত্রিকা। শক্তির জায়গায় সুনীল থাকলে এই আন্দোলন কী চেহারা নিত বলা যায় না,
     কারণ একদল ভিন্ন চরিত্রের তরুণ আসতেন তাঁর পেছনে-পেছনে। তবে মোটামুটিভাবে আমিই পরিচালনা
     করেছিলুম। শক্তি ত্যাগ করেন ওই ব্যর্থ প্রণয় থেকে তাঁর কবিত্ব গীতিময় ও কূটবর্জিত হয়ে উঠছিল বলে।
     দেবী রায়কে আমি টাকা পাঠিয়ে দিতুম। লেখা যোগাড়, ছাপানো, পাঠানো এসব তিনি করতেন, তাই তাঁর
     অবদানও অস্বীকার করা যায় না। দেবীর কাজগুলো, পাটনায় বসে, যেখানের প্রেস হাংরি বুলেটিন ছাপতে
     চায়নি, আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না। তুমি যা বলছ, তাও ঠিক। স্বতঃস্ফূর্ততার ইনটার-অ্যাকশান একটা 
    পর্যায়ে আন্দোলনকে জোরদার করে। তখন আর কেউ নেতা ছিল না। তাই শম্ভু রক্ষিত যখন হাংরি 
    আন্দোলনের হয়ে ‘ব্লুজ’ ছাপান তখন চটে যান অনেকে। এখন তো কুচবিহার ছাড়াও আসানসোল ত্রিপুরা 
    মেদিনীপুরেও হাংরি ছিটমহল গড়ে উঠেছে শুনি। আমি কাউকেই চিনি না।

    অরুণেশ: সারা দেশেই ক্ষুধার্ত আন্দোলনের জোয়ার বইছে। ঠিক তখনই লেখা বন্ধ করে সরে গেলেন কেন ?
     ক্ষুধার্ত লেখালিখির প্রতি বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছিলেন ? আন্দোলনের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন ?

    মলয়: তুমি বোধহয় বলতে চাইছ হাংরি খ্যাতি ভাঙিয়ে খাওয়া আরম্ভ করলুম না কেন , নাকি ? 
    লেখা কেন ছেড়েদিয়েছিলুম তা তো তোমায় বললুম এক্ষুনি। খ্যাতির তালে, গুছিয়ে নেয়া যেতে পারত অবশ্য।
     কিন্তু তখন আমার মনমেজাজ এমন যে, বেঁচে থাকাটাই মূল জিজ্ঞাসা হয়ে দাঁড়িয়েছে। 
    লেখালিখি কিংবা ভবিষ্যত ভাবার ফুরসত ছিল না।আর ক্ষুধার্ত লেখালিখির প্রতি বিশ্বাস বলতে
     কী বোঝাতে চাও? লেখক তো নিজের লেখা সম্পর্কে ভাবনা-চিন্তা করবে। ওটা তো সবে মিলি করি কাজ 
    গোছের ব্যাপার নয়। যেমন তোমার লেখার সম্পর্কে জীবতোষ দাসের যে মতামতই থাকুক না কেন,
     তা তো ওর লেখালিখির নিদান নয়। আন্দোলনের ভবিষ্যত সম্পর্কে যে-ধারনাই থাকুক না কেন 
    আন্দোলনকারীর, তার জন্যে তিনি লেখা বন্ধ করে দেবেন কেন ? তুমি বোধহয় নিজেকে বুঝিয়ে উঠতে 
    পারছ না কেমন করে অত খ্যাতির মাঝখানে লেখা বন্ধ করে দিলুম দুম করে। আমিও মনীষ ঘটককে
     জিগ্যেস করেছিলুম, কেন উনি লেখা ছেড়ে দিলেন ? উনি বলেছিলেন, ‘মাথায় আসে না, মাথায় আসলেও
     হাত ওব্দি আসে না।’ তোমার কথাবার্তা থেকে তোমার ওই ঘুঘুমারি গ্রাম দেখার খুব ইচ্ছে হচ্ছে। 
    তখনকার আমার জীবনের একটা ঘটনা তোমায় বলি। বাড়িতে আমার মেজজ্যাঠামশায়ের লাশ পড়ে। 
    মুখাগ্নি করার কথা আমার, আমি সেদিন বিয়ে করছি। শ্রাদ্ধের ভোজ খেতে এসে অনেকেই তো দক্ষিণার 
    টাকাটা আমার স্ত্রীর হাতে ‘মেনি হ্যাপি রিটার্নস’ বলে দিয়ে গেলেন।

    অরুণেশ: পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতি যদি সত্য হয়, তাহলে দেখা যাচ্ছে যারা হাংরি আদর্শের 
    বিরোধিতা করেছিলেন, তারাই পরবর্তীকালে ‘ক্ষুধার্ত’ পত্রিকা ও লিফলেট বের করেছেন। তাদের
     এই সক্রিয়তা দিয়েই কি পুলিশের কাছে দেওয়া সাক্ষ্য, ধরেই নিচ্ছি তা সত্য, মিথ্যা প্রমাণিত হয় না ?

    মলয়: আমি দেখছি জবানবন্দি-মুচলেকাগুলো তোমাকেই দোটানায় ফেলেছে। সবচেয়ে আগে তুমি 
    ব্যাংকশাল কোর্ট থেকে নথিপত্রগুলোর একটা করে সার্টিফায়েড কপি জোগাড় করো।
     ৯ নম্বর প্রেসিডেন্সি ম্যাজিসট্রেটের এজলাসের ১৯৬৫ সালে মকদ্দমা নং জি আর ৫৭৯। 
    তার পর মুখচোখ ধুয়ে মাথা ঠান্ডা করো। তুমি কখনও পুলিশের খপ্পরে পড়নি মনে হচ্ছে।
     তুমি তো এখন হাংরি আন্দোলন করছ। ধরো তখন তুমিও একজন আন্দোলনের শরিক। 
    তুমি কী করতে ? মুচলেকা-জবানবন্দি দিয়ে আবার ‘ক্ষুধার্ত‘ বের করতে ? আমার মনে হয় 
    ডক্টর উত্তম দাশ তাঁর আলোচনায় যা বলেছেন সেটাই সঠিক। ‘মহাদিগন্তে’ ওঁর লেখাটা পড়েছ 
    তো জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৮৪ সংখ্যায় ? ওঁর বক্তব্য হল, “এই লেখকদের মধ্যে মূল আদর্শের প্রতি
     আনুগত্য ছিল.  ফেঁসে যাওয়া মামলায় মলবকে ডুবিয়ে দিয়ে সরে পড়বার তুমুল ইচ্ছা ছিল না, 
    তবে সাধ্য ও সাহস ছিল না সাহায্যে আসার। কিন্তু কোর্টে মামলা চলাকালীন নিজেদের বিবেক
     শুদ্ধ রেখেছিলেন শৈলেশ্বর ও সুভাষ। পুলিশের কাছে জবানবন্দির ভয় ও বিহ্লতা নিজেদের মুক্ত করেছেন।”
     ওঁদের সঙ্গে তোমার বন্ধুত্ব থাকায় কিংবা বহু খবর তোমার গ্রামে বসে না পাবার দরুণ, তোমার এরকম
     গ্লানিবোধ হচ্ছে কেন ? আন্দোলনের কুড়ি বছর পর তুমি নিজেকে হাংরি আন্দোলনকারী মনে কর
     বা না-ই কর, তাতে তোমার নিজের লেখার হেরফের হবার তো কথা নয়। কিউবিস্ট আন্দোলনের
     এত পরেও ওই ফর্মে উৎকৃষ্ট ছবি আঁকা হচ্ছে। তবে ? ওভাবে পুলিশের কাছে দেওয়া বিবৃতির সত্য-মিথ্যা
     যাচাই হয় না। বিবৃতি দিয়েও তাঁরা কোর্টে আমার পক্ষে সাক্ষ্য দেন। সেটাই তো যথেষ্ট। আর নিজেকে
     হাংরি না বললেও, সুভাষ কিংবা শেলেশ্বরের লেখায় কোনও উৎকর্ষগত পরিবর্তনের প্রশ্ন ওঠে না।

    অরুণেশ: শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে দেবী রায়ের কাছে যে অভিযোগগুলি করেছিলেন, কি করে তার 
    সত্যতা প্রমাণ করবেন? ওই অভিযোগগুলি সম্পর্কে বিস্তারিত ও খোলাখুলি বলুন।

    মলয়: তুমি বোধহয় ‘পথের পাঁচালী’ কিংবা ‘মহাদিগন্ত’ পত্রিকা পড়ে ওই চিঠিটার কথা জেনেছ।
     চিঠিটা খুব-সম্ভব ১৯৬৭ সালে বা তার আগে লেখা যখন বেশ উত্তেজিত অবস্হায় ছিলুম। দেবীবাবু
     ওটা যত্ন করে রেখেছেন মনে হয় আর গবেষণা করার জন্য  বা কেউ তথ্য চাইলে ওটা মেলে ধরেন। 
    চিঠিটায় কী আছে, এতদিন পর আর খেয়াল নেই, সেসময়ের খেয়োখেয়ি আছে হয়তো। আমার এখনকার 
    মানসিকতায়, আমি ওই চিঠির বক্তব্য থেকে অনেক দূরে। এখন কাউকে সামগ্রিক তাচ্ছিল্য পছন্দ করি না। 
    চিঠিটা গর্হিত।

    অরুণেশ:শৈলেশ্বরের পালটা অভিযোগ, বিদেশের একটি পত্রিকায় The Greatest Poet of Bengal
     নিজের সম্পর্কে এই প্রবন্ধটি নিজেই লিখে ‘চুরি করে’ শৈলেশ্বর, প্রদীপ, সুভাষ এদের নাম বসিয়ে দিয়েছিলেন। 
    এই অভিযোগ সম্পর্কে খোলাখুলি বলুন।

    মলয়: আমি যতদূর মনে করতে পারছি ও-ধরণের কোনও রচনা কোনও কাগজে আমার নজরে পড়েনি। 
    তুমি তো সেই ১৯৭৫ থেকে শৈলেশ্বরবাবুর বাসায় যাতায়াত করছ এবং যথেষ্ট নুন খেয়েছ। পত্রিকাটা 
    ওঁর কাছে চাইলে না কেন? সত্য-মিথ্যা নিজেই যাচাই করে নিতে পারতে। আমার সঙ্গে দেখা করার জন্যে 
    যেখানে অ্যালেন গিন্সবার্গওকতাভিও পাজ আসছেন, সেখানে বিদেশের কোনো কাগজে সম্পূর্ণ
     নাম-না-জানা শৈলেশ্বর, প্রদীপ, সুভাষের সার্টিফিকেটের দরকার হয় কী ? নিজেই ভেবে দ্যাখো। 
    তিনজনের লেখা ওই প্রবন্ধটা জোগাড় করতে পারলে পাঠিও। আর, চুরি করার অভিযোগ থাকলে কেউ 
    লেখা থেকে সরে পড়ে নাকি ? তাহলে তো ‘প্যাপিলন‘ বা ‘আওয়ার লেডি অব দি ফ্লাওয়ার্স’ লেখাই হত না। 
    তুমি যখন বলছ, তখন শৈলেশ্বরবাবু কোথাও-না-কোথাও অভিযোগটা লিপিবদ্ধ করেছেন। 
    পাও যদি তো এক কপি সংগ্রহ করে দিও। কিন্তু এই বয়সে শৈলেশ্বরবাবু অমনধারা কথাবার্তা 
    বলেন বলে মনে হয় না। অবশ্য তাঁর সঙ্গে আমার বহুকাল দেখানেই। তিনি মাঝে একদিন রাত্তিরে 
    একজনের মাধ্যমে আমায় খবর পাঠিয়েছিলেন যে বিবৃতিগুলো এখন জনগোচরে না আনাই ভালো—
    কিন্তু তখন আমি ওগুলো ডক্টর উত্তম দাশকে দিয়ে দিয়েছি অলরেডি। শুনেছি পুলিশ কমিশনার 
    প্রণব সেন ফাইলটা ক্লোজ করার সময়ে যত্নে রাখার নোটিং দিয়ে যান। ফলে কেউ না কেউ খুঁজে বের করতই।
    অরুণেশ: যে জ্যোতির্ময় দত্ত কুৎসিতভাবে ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে আক্রমণ করেন, সেই জ্যোতির্ময় দত্তের
     কাগজে হঠাৎ করে লিখতে গেলেন কেন ?

    মলয়: তুমি সপ্তম সংকলন ক্ষুধার্ত পড়েছ তো ? ওতে শৈলেশ্বর ঘোষ সম্পর্কে আমার একটা নিবন্ধ আছে।
     শৈলেশ্বরবাবুর লেখা নিয়ে বোধ হয় ওটাই আপাতত একমাত্র প্রামাণ্য রচনা। তোমার, জীবতোষ দাস,  
    অশ্রুকুমার শিকদারের ধানাই-পানায়ের সঙ্গে তুলনা করে দেখতে পার। আমার মকদ্দমায় ওনার আচমকা
     রাজসাক্ষী হতে রাজি হয়ে গিয়ে ৩৫ মাস ব্যাপী আসামি হা…জি…র চিৎকারের নিস্তরঙ্গ অন্ধকারের
     ধ্বনিপিঞ্জর সত্ত্বেও ওটা লিখেছি। জবানবন্দি-মুচলেকার পরেও লিখেছি। তাঁরই কাগজ । তাঁরই সম্পর্কে। 
    তবু লিখেছি। এতে নৈতিকতার গণ্ডোগোল নেই। তাছাড়া বহু তথ্য তুমি যেমন জান না, সেরকম এটাও
     জান না বোধ হয় যে ‘সল্টেড ফেদার্স’ পত্রিকায় শৈলেশ্বর, সুবো, প্রদীপ, সুভাষের লেখা উনিই অনুবাদ 
    করেন। যে সময়ে সুবিমল বসাক ছাড়া কোনও ক্ষুধার্ত কোর্টে আসতেন না, জ্যোতির্ময় দত্ত খোঁজ-খবর 
    করেছেন, মকদ্দমা লড়ার পয়সা জোগাড় করে দিয়েছেন, হাইকোর্টের জন্যে করুণাশঙ্কর রায়কে উনিই
     খুঁজে দিয়েছিলেন। এমনকি, আমার তরফের সাক্ষী হবার জন্যে জ্যোতির্ময় প্রথমে এগিয়ে আসেন। 
     তরুণ সান্যাল-ও,বামপন্হী দলের সঙ্গে তর্ক করে নিজে সাক্ষী দিতে রাজী হন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
      যদিও বলে থাকেন যে , তিনিই সবচেয়ে প্রধম আমার সাক্ষী হতে রাজি হন, ওটা ভুল। জ্যোতির্ময় দত্ত 
    আর তরুণ সান্যাল লেখকের স্বাধীনতার জন্য এগিয়ে আসেন। সুনীলবাবু প্রথমে রাজি হননি। আমার দাদা  
    সমীর রায়চৌধুরী তাঁর বাল্যবন্ধু। দাদার অনুরোধে শেষ পর্যন্ত সাক্ষ্য দেন। তবে তাঁর সাক্ষে  ম্যাজিস্ট্রেট 
    ওরকম স্মার্ট কথাবার্তায় বিপন্ন বোধ করেছিলেন। হ্যাঁ, এটা ঠিক, ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে হেয় করার জন্য 
    জ্যোতির্ময় দত্ত ‘দেশ‘ পত্রিকায় কোনও বিশেষ সংখ্যায় নিবন্ধ লিখেছিলেন। তখন আমিও রেগে গিয়েছিলুম।
     কিন্তু জ্যোতি ক্ষুধিত প্রজন্মের প্রতি অপছন্দ জাহির করেও যত সাহায্য একই সময়ে করেছিলেন, 
    হাপিস হয়ে-যাওয়া ক্ষুধার্তরা সে-সময়ে তা করেনি। আরেকটা জিনিস তুমিও লক্ষ করবে। 
    আমার লেখা থাকলে পত্রিকার চরিত্র পালটায়। জ্যোতির্ময় দত্ত আমার একটা উপন্যাস প্রকাশ করবেন। 
    সম্পাদকের যথেষ্ট সাহস দরকার হয় আমার ক্রিয়েটিভ লেখা ছাপতে। আর উনি তো ‘এমারজেন্সির’ 
    সময়ে ছাদ থেকে লাফ মেরে পা ভেঙেছিলেন। আমরা সবাই তখন কি-ই বা করেছি। সাশ্রুনয়নে পৃথিবীর 
    দিকে তাকিয়ে জন্মান্ধ যে সৌন্দর্যকে বিমূর্ত মনে করে, সেই বনপ্রান্তর, গাঁওবাসা, মেঘসূর্য দেখেই 
    আমাদের জীবন মূর্ত। কেউ আক্রমণ করলে তা সহ্য করার যথেষ্ট ক্ষমতা রাখি। আমি আমার সততা
     বজায় রাখব এবং জ্যোতির্ময় তাঁর নিজের। আমরা কেন পরস্পরের সঙ্গে ঢলানি করব?

    অরুণেশ: যাঁরা এখন ক্ষুধার্তবিরোধী, যাঁরা ক্ষুধার্ত আন্দোলনকে মনে করেন ‘মিউজিয়ামের বিষয়বস্তু’,
     তাঁদের সঙ্গেই আপনার ঘনিষ্ঠতা। আপনিও কি তাই মনে করেন ?

    মলয়: ব্রিটিশ মিউজিয়ামের এনট্রি খাতায় ১৮৭৩ সালের র‌্যাঁবো-র সই দেখার জন্যে প্রতি বছর
     কয়েক লক্ষ লোকের ভিড় হয় বলে শুনেছি। আমিও আমার মতনই লিখে আমার মতনই ওরকম অবাক
     পাঠকের শ্রদ্ধা চাই। তোমার ভাসাভাসা কথায় বুঝতে পারছি না ঠিক কার কথা তুমি বলতে চাইছ ? 
    তুমি, আমার মনে হয়, দীপঙ্কর রায়-এর লেখাটার কথা টেনে এনেছ। তিনি গ্যাঁটের কড়ি খরচ করে 
    তাঁর পত্রিকায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের মতামত ছেপেছিলেন, আমার এক সাক্ষাৎকারের সঙ্গে। 
    অতয়েব তাঁর সঙ্গে আমার ততটাই ঘনিষ্ঠতা, যতটা তোমার সঙ্গে। আর কার কথা বলছ ? 
    পবিত্র মুখোপাধ্যায়, ধুর্জটি চন্দ, বাসুদেব দেব ? না, তাঁদের সঙ্গেও নেই। তবে যে-কারণে 
    তোমার পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হতে অনিচ্ছা বা লজ্জাবোধ বা গ্লানিবোধ নেই, সেরকম তাঁদের পত্রিকার
     সঙ্গে যুক্ত হতে আপত্তি নেই। আমি টোটালিটেরিয়ান নই। আমার চরিত্র এমন, যে কারোর সঙ্গে 
    ঘনিষ্ঠতয় অসুবিধা হয়, যদিও আমি ঘনিষ্ঠতা চাই। আমি কোথাও আড্ডা মারতে যাই না, সন্ধ্যার 
    পর থেকে একলা থাকি, খুব কম কথা বলি, কোনও বন্ধুবান্ধব নেই। পাঠকের ব্যাপারে একটা খবর
     দিই তোমায়। তোমার বইটা প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত রিভিউ করার পর তোমার বন্ধু ক্ষুধার্তরা সবাই
     তাঁকে রেগুলার বই-পত্রিকা পাঠিয়েছেন। এতেও নষ্টামির কিছু নেই। এখন প্রণবিন্দু তো সম্পূর্ণ ভিন্ন
     মানসিকতার মানুষ, অথচ তোমার লেখার প্রশংসা করেছেন। তিনি ক্ষুধার্ত নন বলে তাঁর মধ্যেকার
     পাঠককে কি তুমি অনাদর করবে ? বহুকাল পরে অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত-র সঙ্গে দেখা হতে, 
    তিনি বলে উঠলেন, ‘বাব-বা কী শান্ত-শিষ্টটাই হয়ে গেছেন, চেনাই যায় না’। শুনে আমার ভালই লেগেছে।

    অরুণেশ: ১৫/১৬ বছর পর আবার লেখালিখিতে ফিরে এসে, এখন নিজেকে আর ক্ষুধার্ত লেখক
     মনে করেন না। নিজেকে মনে করেন ৮০-র দশকের লেখক। আমরা জানি দশকওয়ারি কবি বা 
    লেখকরা ছোটকাগজগুলোতে হাত মকসো করে চলে যান বড় কাগজে, প্রতিষ্ঠানে। আপনার লক্ষও কি তাই ?

    মলয়: তোমার কি মনে হয় আমার নামের জন্যে প্রতিষ্ঠানের দরকার ? প্রতিষ্ঠান মানে তো 
    তুমি বলতে চাইছ আনন্দবাজার যুগান্তর বসুমতী সত্যযুগ কালান্তর গণশক্তি প্রতিক্ষণ 
    রেডিও টিভি। আমার সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই তাহলে। হাংরি আন্দোলনকে এককালে 
    যাঁরা সারা ভারতে প্রচার করেছিলেন সেই কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস 
    এখন ভারত-প্রতিষঠানের কর্ণধার। সেই পুপুল জয়াকর, যিনি আমার মকদ্দমার কথা
     ইন্দিরা গান্ধীর নজরে এনেছিলেন, তিনি এখন ভারতবর্ষের সাহিত্য-সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রক। 
    গ্যাঁট হয়ে বসতে চাইলে, কলকাতায় আমাকে চেয়ার খুঁজে বেড়াতে হবে না। হাত মকসো করার সময়
     আমার নেই বলেই মনে করি। আমার লেখা ছাপলে একটা ছোটকাগজ কোন স্তরে পৌঁছোয়, 
    সে অভিজ্ঞতা আমার এই সাক্ষাৎকার প্রকাশের পর টের পাবে। এতকাল ধরে তো বেশ কিছু সংখ্যা 
    তো বের করেছ ? নিজেকে ক্ষুধার্ত লেখক মনে করি না , কারণ এখন আমার জীবনযাপন, 
    আর্থিক অবস্হা, ভাবনাচিন্তা লেখালিখি সবই অন্যরকম। আমি মনে করি পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা 
    নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান—সেখানে সর্বহারা আর বুর্জোয়ার প্রভেদ নেই, যেটা মরিচঝাঁপি থেকেই
     বেশ পরিষ্কার। আমি একজন সাংস্কৃতিক জারজ যে ওই বাঙালি এসট্যাবলিশমেন্টে সম্পূর্ণ 
    বহিরাগত– দি আউটসাইডার অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুব সাহেবের
     চিঠিটা পড়েছ তো ? উনিও সেখানে নিজেকে বঙ্গভাষী ঘোষণা করেছেন। মানে, ভাষাটা তাঁর, 
    আমার নয়। আমার কাছে ‘আনন্দবাজার‘ ও ‘জিরাফ‘ দুটোই ওই পক্ষের জিনিস। আমি যে 
    দেশকে লিখব আমার লেখাটা সেই দশকের। সে-ব্যাপারটা যে তুমি ধরতে পারনি তা তো বুঝতেই 
    পারছি।’ক্ষুধিত প্রজন্ম ষড়যন্ত্র মামলা’ থেকেই ওই প্রতিষ্ঠান আর দশক ব্যাপারগুলো আমার কাছে ঝরঝরে।
     কলকাতার বৃষ্টিতে বিহারি মুটের মাথার চুবড়িতে বসে সর্বহারার নেতাকে রাস্তা পার হতে দেখেছি।
     নিজেকে ‘ক্ষুধার্ত’ বলে মনে করি না মানে এ নয় যে, তোমার কবিতা বা সুভাষ ঘোষের গদ্য-র 
    সৃজনশীলতাকে হালকা হাসি বা জটিল বাক্যাংশ দিয়ে উড়িয়ে দেব। প্রতিষ্ঠানে ঢুকতে চাইলেই ঢোকা 
    যায় কে বললে তোমায় ? লাল হলুদ নীল যে প্রতিষ্ঠানর যেতে চাইবে তার রং ধরতে হবে তোমায়,
     কিংবা পালটে-পালটে এ-রং সে-রং করতে হবে, তোমার নিজের রং বজায় রাখা চলবে না। সেখানে 
    আমার রং তো কয়লার, আগুন লাগালেই শুধু বদলায়। রইল বড়-কাগজের প্রশ্ন। তাদের কাজ স্হিতাবস্হা
     বজায় রাখা। শারদ ১৩৯১ ‘কৌরব‘-এ প্রকাশিত আমার গল্পটা তুমি তো পড়েছ । পড়ে ধারণা হয়েছে কি যে,
     আনন্দবাজার যুগান্তর গণশক্তি ওটা ছাপত ? আমি তোমায় গল্পটার স্বত্ত্ব দিয়ে দিচ্ছি। তুমি ঘুরে-ঘুরে ফিরি 
    করে এসে জানিও তোমার অভিজ্ঞতা। আমার চেয়ে অক্ষম অথর্ব সহসম্পাদকরা ওখানে লেখা বাছাই করে। 
    আমার লেখা হাতে নিলে তাদের হাতে আঙুলহাড়া হয়ে যাবে, মালিক তাদের চাকরি কেড়ে নেবে। 
    আমার লেখা মলয় রায়চৌধুরীর লেখা হবে, তা যদি তাঁরা ছাপেন তো আপত্তি কিসের ? 
    আমি পাঠকের শ্রদ্ধায় বঙ্কিম মাইকেল মানিক সতীনাথ লোরকা নেরুদা ব্রেখত মায়াকভস্কি জোশ
     মলিহাবাদীর মতন স্হান চাই। আমি কাগজ চাই না । আমি প্রকাশক চাই—এমন কি শংকর বা 
    বিমল মিত্রের বইয়ের প্রকাশকও যদি আমার বই ছাপতে চান তো আমি ছাপতে দেবো। আমি তোমার
     মতন পাঠক চাই যাঁরা ওই গণ্ডগ্রামে বসেও আমার লেখাকে প্রশ্রয় দেবেন। তোমার কথার মোটিভ, 
    আমি এর আগে সূত্রপাত, দ্বন্দ্বশূক, আন্তর্জাতিক ছোটোগল্প, এখন এইরকম, বিজ্ঞাপন পর্ব, প্রথমত 
    ইত্যাদি পত্রিকায় দেখেছি। এও দেখেছি যে ওই কাগজগুলোর গায়ে খাঁটি পেডিগ্রিপ্রাপ্ত কলকাতা-কেন্দ্রিক বাঙালি
     এসট্যাবলিশমেন্টের আঁশটে গন্ধ আগাপাশতলা ভরা আছে। তারাও মনে করে পশ্চিমবাংলাই বুঝি বাঙালির
     একমাত্র পার্থিব-মানস। বস্তুত ওই বহিরাগতের বোধই আমায় হাংরি আন্দোলনে প্ররোচিত করেছিল। 
    ওইসব কাগজে যখন লেখা হয়েছিল হাংরি আন্দোলনের সাথে সামাজিক মূল্যবোধের কোনও যোগ নেই,
     তখন তোমার উচিত ছিল তাদের বলা যে অসওয়াল্ড স্পেংলার-এর সভ্যতার অবক্ষয় সম্পর্কিত ইতিহাসের 
    দর্শন মুখস্হ করে আসতে, কেননা সামাজিক অবক্ষয়ের  এমন তথ্যনির্দেশ মার্কস-এও নেই ।
     আমার প্রথম বইটাই ছিল ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’।

    অরুণেশ: আপনার ক্ষুধার্ত পর্যায়ের মৌলিক লেখার সঙ্গে পাঠক একেবারেই অপরিচিত। 
    সেগুলি কি বই এর আকারে বের করা যায় না ? পাঠক দেখতে চায় আপনার মৌলিক কাজ। ভাবছেন কিছু ?

    মলয়: হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা আমার কবিতার বই, নাটক, ইশতাহারগুলো অনেকে 
    রেখেছেন নিজেদের কাছে, কিন্তু হাতছাড়া করতে চান না। তুমি এক্ষুনি বলেছিলে মিউজিয়ামের বিঢ়য়বস্তু।
     ইশতাহারগুলোর কিছু জেরক্স জোগাড় করেছি। ন্যাশানাল লাইব্রেরি থেকে কবিতা আর নাটকের কপি 
    করাবার চেষ্টা করছি। তিনটে বই বের করার ইচ্ছে আছে হাংরি আন্দোলনের সময়ে রচিত লেখা নিয়ে :
     ইশতাহার সংকলন, নাটক সংকলন এবং কবিতা সংকলন। সহৃদয় প্রকাশকের খোঁজে। বইগুলোর
     প্রকাশনা সম্পর্কিত তধ্যও আমি দিতে চাই। শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেন ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার‘, 
    একটা কপি রেখে বাকিগুলো পেট্রল ধরিয়ে আগুন লাগানো হয়েছিল। ‘শয়তানের মুখ‘ বেরোয় 
     কৃত্তিবাস প্রকাশনী থেকে, তার বহু কবিতায় ‘ক্যানসেল্ড’ স্ট্যাম্প মারা হয়েছিল। সেরকম একটা 
    কপি সংগ্রহ করতে হবে। ‘ইল্লত’ নাটক প্রত্যাখ্যান নিয়ে ‘বহুরূপী’‘গন্ধর্ব‘ আপিসে কর্তারা কেলোর
     কিত্তি করেছিলেন। ইশতাহার বিতরণ করার দরুণ সুবিমল বসাককে কলেজস্ট্রিট কফিহাউসের বাইরে
     ঘিরে ফেলে প্রহার করা হয়েছিল। সেই ইশতাহারটা সংগ্রহ করতে হবে। আমি নিজের কোনো লেখাই
     সংগ্রহে রাখিনি। কিন্তু তুমি ক্ষুধার্ত ঘোষণা করলে নিজেকে অথচ তোমার কাছে কেন আমার 
    লেখাগুলো সাপ্রেস করা হল, তা জানবার চেষ্টা করোনি দেখছি। নাকি, কলকাতা থেকে বহুদূরে
     আছ বলে প্রাথমিক তথ্যে অহরহ বঞ্চিত হও। নাছোড়বান্দা পাঠক কিন্তু খুঁজে বের করে। 
    লেখা ছেড়ে দেওয়া সত্ত্বেও এই দেড় দশক ধরে অচেনা পাঠক আমার পেছু ছাড়েননি। তাঁরা 
    আমার কৃতজ্ঞতাভাজন। আমিই এতদিন তাঁদের কাছে বোবা হয়ে থেকেছি। ইশতাহারগুলো বিনে 
    পয়সায় বিলি করা হত বলে অনেকে এককালে টিটকিরি মেরেছেন। আমার বই বের হলে, তোমায় কিনতে হবে। 
    আমি কাউকে সৌজন্য কপি দেব না। যে পড়তে চায় সে কিনে পড়ুক।

    অরুণেশ: আপনি বলেছে, ‘আমিই আন্দোলন, আমিই ভেঙে দিচ্ছি’। কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন 
    শুরু হয়েছিল ? সে-উদ্দেশ্য কি সফল হল? নাকি ব্যর্থতার জন্যই ভেঙে গেছে ?

    মলয়: ছ্যাঃ, তথ্যের বিকৃতি ঘটাচ্ছ তুমি। আমি অমন বলিনি। আমি বলেছি, ‘যাঁরা নিজেদের এখন
     হাংরি বলছেন, তাঁরাই হাংরি ক্ষুধার্ত ক্ষুৎকাতর। আমি মলয়, মলয় রায়চৌধুরী হয়ে উঠতে চাই।
     আমিই আন্দোলন’। তুমি আমার বক্তব্যের ইমপোর্ট ধরতে পারোনি। তুমিও নিজেকে হাংরি বলছ 
    বলে বোধহয় কথাটা তোমার খারাপ লেগেছে। আমি আমার সম্পর্কে যাই ভাবি না কেন, তাতে
     তোমার অবমাননার কিছুনেই। আমি আমার সম্পর্কে চিন্তা করি, আমার অভিজ্ঞতা, অনুভব, 
    অনুভূতি অনুযায়ী, যা জমে চলেছে বছরের পর বছর। তুমি তোমার বিষয়ে ভেবে যা ঠিক করছ তা
     তোমার মানসদুনিয়া। তবে, আমি মনে করি, ১৯৬৫ সালের মে মাসের তিন তারিখে হাংরি আন্দোলন
     প্রকৃত অর্থে ফুরিয়ে যায়। কেননা সেইদিন ব্যাংকশাল কোর্টে আমাকে যে চার্জশীট দেয়া হয়, তার
     সঙ্গে হাংরিদের দেয়া জবানবন্দি-মুচলেকাগুলো জানাজানি হয়ে যায়। তারপরে আন্দোলনকে আমি
     কিছুদিন হিঁচড়ে নিয়ে যাই, কিছুদিন শৈলেশ্বর, কিছুদিন সুবিমল বসাক, তারপর তুমি। হাংরি আন্দোলন
     এবং হাংরিয়ালিজম দুটো আলাদা ব্যাপার, এটা তো জানো ? তেসরা মে ১৯৬৫এর পর আন্দোলন আর
     ‘মুভ’ করে না, ফলে তা আর ‘মুভমেন্ট’-ও থাকে না, যা থাকে তা হল ভরবেগ। আন্দোলন কী ভাবে ভাঙল
     এবং কেন, ওই সময়ে তুমি থাকলে টের পেতে। এখন তথ্যের ভিত্তিতে আঁচ করো। আমি বলব তুমি 
    একজন হাংরিয়ালিস্ট, হাংরি আন্দোলনকারী নও। আন্দোলন যে সফল হয়েছিল, তার প্রমাণ তো তুমিই। 
    নয়তো আন্দোলন আরম্ভ হবার দেড় দশক পরে তুমি নেজেকে ক্ষুধিত প্রজন্মের একজন মনে করে গৌরব 
    বোধ করবে কেন ? এই সূত্রে আরেকটা কথা বলি এখন। সমরেশ বসু-র ‘বিবর’ বের হলে  
    সন্তোষকুমার ঘোষ লিখেছিলেন, এবং পরে বাসুদেব দেব তা রিপিট করেছেন, যে, হাংরি আন্দোলন 
    যা করতে চেয়েছিল, সমরেশবাবু ‘বিবর‘-এ তা করে দেখিয়ে দিলেন। হাংরি আন্দোলন যৌনতাকে 
    কমোডিটি করতে চায়নি, তাই যৌন-শব্দ ও বাকপ্রতিমা এমনকি অনুষঙ্গ এসেছে সম্পূর্ণ অযৌন প্রেক্ষিতে, 
    যখন কি না সমরেশবাবু যৌনতাকে পাঠকের সঙ্গে তাঁর মাধ্যম করেছেন। সেই সঙ্গে হাংরি আন্দোলনের ঝড়
     যে অনুসন্ধিৎসা এনেছিল পাঠকদের মধ্যে, সমরেশবাবু তার বাজার তৈরি করে যৌনতা বেচতে বসে যান। 
    তার আগে তাঁর লেখার বিষয়বস্তু একেবারে আলাদা হত। তাঁর নিজের কোনও গদ্যশৈলী নেই। 
    যৌনতানির্ভর তাঁর লেখাগুলোকে এক্সপোজিশান মনে করা ভুল। হাংরি আন্দোলনের শিক্ষিত 
    সমীক্ষা তেমন হয়নি, কিছু হাফ-লিটারেট এদিক-ওদিক ভাসা-ভাসা মন্তব্য দিয়ে অনেকে ছেড়ে দিয়েছেন।
     বাংলাভাষার সমস্যা হল কোনও সমালোচক নেই, সকলেই কবিলেখক। কবি বা গল্প-উপন্যাস লেখকের 
    কাছ থেকে উচিত সমালোচনা আশা করা যায় না। নিজের ঢাক না পিটে তাই সময়ের অমোঘ নির্দেশের
     অপেক্ষা করো।

    অরুণেশ: এটা কি স্বীকার করবেন যে ক্ষুধার্ত অনুপ্রেরণায় অনুপ্রাণিত কবি ও লেখক ছাড়া, অনেকেই 
    হয়তো সরাসরি ক্ষুধার্ত নয়, অন্যকারোর দ্বারা সেরকম মৌলিক লেখা হচ্ছে না। যা হচ্ছে তা মৃত ও অসাড়।

    মলয়: তোমার এই ধারণাটা শঙ্খ ঘোষ তো আগেই ভেঙে দিয়েছেন তাঁর সাক্ষাৎকারে। 
    আন্দোলন জীবন ও সাহিত্যকে পৃথক রাখেনি। আন্দোলন ঝড় বইয়ে দেয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার।
     আন্দোলন লেখায় সততাকে প্রধান শর্ত করে। তবু, অনেকে, আলাদা মানসিকতা থেকে যথেষ্ট মৌলিক
     লেখা লিখতে পেরেছেন। যেমন জয় গোস্বামী, মল্লিকা সেনগুপ্ত, শঙ্করনাথ চক্রবর্তী, কমল চক্রবর্তী, 
    বরুণ চৌধুরী, কেদার ভাদুড়ি প্রমুখ। এছাড়া পুষ্কর দাশগুপ্ত কবিতার আঙ্গিকে চূড়ান্ত অস্হিরতা
     ঢুকিয়ে তাকে একটা সাবভারসিভ শস্ত্রের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন, সজল বন্দ্যোপাধ্যায় 
    পরেশ মণ্ডলের সঙ্গে— তাকে, সেই প্রচেষ্টাকে, নস্যাৎ করাটা ভুল হবে। শক্তি, সন্দীপন, উৎপল,
     বিনয় হাংরি আন্দোলনে ছিলেন বলেই মৌলিক বলা যায় না। তাঁরা আগে থাকতেই লিখছিলেন—
     আমরাই বরং তাঁদের সাহসের দ্বারা এককালে অনুপ্রেরণা পেয়েছি। ক্ষুধার্তরা বা ক্ষুধার্ত অনুপ্রেরণা
     ছাড়া আর কিছু মৌলিক নয় মনে করাটা ছেলেমানুষি হয়ে যায়। ক্ষুধিত প্রজন্ম আন্দোলনকে
     অস্বীকার করে বা হেয় করে অনেকে একইরকম ছেলেমানুষি করেন। তুমি তো কলকাতায় থাক না, 
    মাটিপৃথিবীর কাছাকাছি নিজের গাঁয়ে থাক, তোমার মধ্যে অন্তত উদারতার বিস্তার আশা করা যায়।
     নাকি, অসুখের বীজ তোমার মধ্যেও সেঁদিয়েছে ? তোমার লেখা যেসব কাগজে বেরিয়েছে তার কয়েকটায় 
    এই রকম মন্তব্য অনেকে করেছে দেখলুম, যে, শক্তি, উৎপল, সন্দীপন কিসুই লিখতে পারেননি ইত্যাদি। 
    একদিকে তুমি বলবে ক্ষুধিত প্রজন্মের লেখকরাই মৌলিক, আবার অন্য দিকে যেই কেউ তোমাদের
     বিরোধিতা করলেন , কিংবা আন্দোলন থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিলেন বলে, তাঁর লেখা মৌলিক নয়,
     এই যুক্তিটা জোচ্চুরির পর্যায়ে পড়ে। যেমন ,বাসুদেব দাশগুপ্তকে নিয়ে কী করবে তোমরা ভেবে 
    পাচ্ছ না এখন, কেননা তিনি হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ভিন্ন কথা বলা আরম্ভ করেছেন। তাঁর রাজনৈতিক
     মতামতের জন্যে তো তাঁর পূর্বের লেখাগুলো নস্যাৎ হয় না। ‘রন্ধনশালা‘ বইটা এখনও প্রকৃত সমালোচকের
     অপেক্ষায় পড়ে আছে। আরেকটা নতুন ক্ষুদ্রতা এবার কলকাতায় গিয়ে নজরে এলো। এলাকাভিত্তিক
     এসট্যাবলিশমেন্ট। উত্তরবঙ্গের লেখকের প্রতি উত্তরবঙ্গের লেখকের সহানুভূতি দয়াদাক্ষিণ্য, সে তার 
    মতাদশ ইত্যাদি যেমনই হোক না কেন। সেরকম মেদিনীপুর-প্রসূতদের, বাঁকড়োদের। জানি না ঘুঘুমারিতে
     বসে তুমি এটা টের পেয়েছ কি না। আমি এককালে কলকাতায় জুতো-লাথি খেয়েছি অনেক, 
    তাই যেন সহজে অনেককিছু বুঝে ফেলি। তুমি শুনেছ কি না জানি না, ক্ষুধিত প্রজন্ম ষড়যন্ত্র 
    মামলায় আমাকে আর আমার দাদাকে একটা বিশেষ ইনটারোগেটিং বোর্ড জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন, 
    একাধিক টেপরেকর্ডারে তা রেকর্ড করা হয়েছিল, হোম মিনিস্ট্রিতে পাঠানো হয়েছিল।
     দীপক মজুমদার একটা স্বাক্ষর সংগ্রহের চেষ্টা করেছিলেন, তাও ভেস্তে দিয়েছিলেন হোমরা লেখক আর 
    চোমড়া সাংবাদিকরা। দীপকের কাছ থেকে তুমি অনেক অজানা তথ্য পাবে। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে 
    আগাগোড়া জানতে হলে সংশ্লিষ্ট সবায়ের সঙ্গে তোমায় যোগাযোগ করতে হবে, নয়তো কেবল একটা
     ডায়মেনশনই পাবে তুমি।

    অরুণেশ: ক্ষুধার্ত লেখালিখি থেকে সরে গিয়ে, আপনি আপনার ক্যারিয়ার তৈরি করেছেন, বড় অফিসার
     হয়েছেন, সমাজের উঁচু সারিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে আবার ফিরে এসেছেন সাহিত্যের জগতে 
    নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে—- এই অভিযোগ কী ভাবে খণ্ডন করবেন ?

    মলয়: না, এই অভিযোগ খন্ডন করতে চাই না, কারণ আমি জানি, আমি একজন লুমপেন বুর্জোয়া,  
    আরামপ্রিয়, জোয়ার-বাজরার রুটি খেয়ে হজম করতে পারি না, চম্বল এলাকার ডালতরকারি প্রচণ্ড ঝাল লাগে,
     স্কচ খেতে ভাল্লাগে, ইত্যাদি। তুমি যে বলছ ক্ষুধার্ত লেখালিখি থেকে, তা কিন্তু ঠিক নয়, বলা দরকার
     লেখা থেকেই একেবারে। তবে, লেখালিখি বজায় রাখলেও যে চাকরি করছি তা-ই করতুম, 
    কেননা বি এ-এম এ তো ভালো চাকরি পাবার মতনই করেই পাস করেছিলুম, নয়ত স্কুল মাস্টারি 
    করতে হত একথা বলতে পার। লন্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে ভর্তি হবার মুহূর্তে ক্ষুধিত প্রজন্ম
     আন্দোলনের আরম্ভ ঘটে। আই এ এস এর  চেষ্টা করার কথা মনে আসেনি তাই। 
    কয়ারিয়ারের জন্যে সুতরাং চেষ্টা করতে হয়নি। বরং খ্যাতির যেখানটায় পোঁছেছিলুম,
     লেখা বজায় রাখলে সেখান থেকে চাকরির সুবিধা হত। মাইনে কড়ি ভালো পাই এখন। 
    অফিসারিও করি। মানে, যে সব সর্বহারার প্রতিনিধিরা অজস্র টাকা মাইনে পেয়ে কাজ 
    করতে চান না, তাঁদের দিয়ে কাজ করাই। গ্রামে-গ্রামে কৃষকদের কাছে যেতে হয় যখন-তখন,
     কখনও বুন্দেলখন্ড, কখনও নইনিতাল। এ সি ফার্স্ট ক্লাস থেকে গুমনাম স্টেশনে নেমে দেখি 
    ছোঁচাবার জল নেই; কননৌজের দিগন্ত পর্যন্ত বিস্তৃত গোলাপের চাষ। সমাজের উঁচু সারি বলতে কী 
    বোঝায় তুমি একেবারেই জান না। ওই সারিতে কালীপুজোয় লক্ষ টাকার বাজি পোড়ে, দোলের
     দিনেরাতে বোমবেটে মাগিরা সোনার বিস্কুট কুড়োয়। সততা নিয়ে সেখানে যাওয়া যায় না। 
    অভিজ্ঞতার অভিনব আগার গড়ে উঠেছে মেধায়। আমি রজনীশ, মহেশ যোগী, রামকৃষ্ণ মঠ 
     এসব করেও দেখেছি। হিপি-হিপিনীদের সঙ্গে জীবন কাটিয়েছি। চূড়ান্ত নেশা করেছি হরেকরকম। 
    জোয়ারের ভরাযৌবন নদী যেমন চরিত্রহীন করে তোলে চাঁদকে, এবং জ্যোৎস্নারসে আপ্লুত চরাচরের
     জলশরীরও। অধঃপতনের মুখে উদ্দাম আনন্দোচ্ছাস। তুমি বলছ সাহিত্যে প্রতিষ্ঠিত হবার কথা।
     আমি যে ধরণের গদ্য লেখা আরম্ভ করেছি তা প্রতিষ্ঠা দিতে পারবে বলে মনে হয় তোমার ? এখানে ?
     কলকাতায় ? আরে এখানে তো জয়েস প্রুস্ত পাউন্ড র‌্যাঁবো হুইটম্যানের পর্যন্ত চামড়া তুলে ফেলত 
    ধুতিপরা বাবুরা। একজন তো অলরেডি হুঁশিয়ার করেছেন, যে, বন্দুক সাফ করা আরম্ভ হয়ে গেছে, 
    সাবধান। হাংরি আন্দোলনের প্রতি তোমার দুর্বলতা বা আকর্ষণেই হয়ত, কিংবা আন্দোলনের
     উদ্ভাবনার কথা ভেবেছিলুম বলে, তুমি মনে করছ বুঝি দেড় দশক পরে এসেও হাই তুলতে-তুলতে 
    প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাব, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যখন ‘দেশ’ পত্রিকার দণ্ডপাণি; সুবো আচার্য আর 
    দেবী রায়-এর পদ্য ছেপেইছেন, শৈলেশ্বর ঘোষকে জাবগা দিয়েছেন সংকলনে, আমারও দু-দশটা 
    লেখা ছেপে যাবে। কিংবা বঙ্কিম চ্যাটার্জি স্ট্রিট একযোগে দাঁড়িয়ে উঠে বলবে, ওয়েলকাম হোম’ ! নাকি ?  
    সুবিমল মিশ্রের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, গোণাগুনতি পাঠক পাওয়াও সমস্যা। পাঠক এতটা কোরাপ্ট হয়ে 
    গেছে যে সৃজনশীল বাংলা লেখার প্রতি সে আস্হা হারিয়ে ফেলেছে। সোনাগাছিতে বলশয় ব্যালের 
    ব্যবস্হা হয় না। এখানে ল্যাঙাকুকুরে-ভরা বিভূঁই গ্রাম-স্টেশনের নির্জনতা। নকশাল কিশোরের 
    নিভে-যাওয়া চিতা থেকে বুলেট কুড়িয়ে তার মা আঁচলে বেঁধে রাখেন। নাচের ঘাঘরার মতন ফুলে 
    ওঠে ছুঁড়ে-দেয়া খ্যাপলাজাল। প্রতিটি প্রসবে শূকরযুবতী প্রমাণ করে তার হারাম-গরিষ্ঠতা। 
    প্রতিষ্ঠার জন্যে হরতনের টেক্কায় তৈরি হতে থাকে চতুর্দিকের ছিদাম মুখশ্রী।

    ( এই সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হবার পর অরুণেশ ঘোষ নিজেও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা জলাঞ্জলি দিয়ে ‘দেশ’ 
    পত্রিকায় লিখেছেন। পরে দে বুকস থেকে হাংরি সংকলন প্রকাশিত হলে রাজসাক্ষী শৈলেশ্বর ঘোষ ও 
    সুভাষ ঘোষে ও বহু অখ্যাত লেখকের সঙ্গে তাতে অন্তর্ভূক্ত হতে কুন্ঠিত হননি। অনেকের মতে জীবনের 
    শেষ দিকে তিনি পরাজিত বোধ করতে থাকেন এবং সেকারণে জলে নেমে আত্মহত্যা করেছিলেন । )