শনিবার

হাংরি আন্দোলন : অজিত রায়ের সমালোচনা

                                           
             হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সুইডেনের লেখিকা জারা মাস্ত
আভাঁগার্দ আন্দোলন - হাংরি আন্দোলন
অথবা নিছক নষ্ট তৈজসে সমলৈঙ্গিক গিল্টি
-------------------------------------------------------
অজিত রায়

কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন। যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন। তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়। জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে। হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে। তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়। সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা। সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।
১৯৫৯-৬০। বৃটিশবীর্যিত মুলুকের পোঁদে গাঁড়সা পুঁতে গাদি সামলাচ্ছেন নেহেরু। দেশের দুই প্রান্তে পার্টিশানের টসটসে পাঁচড়া। পুব পাকিস্তান থেকে আগত অন্যৎপুষ্ট মানুষের কিছু থোপনা তখনও আনলোড হচ্ছে শেয়ালদার টেসেলেটেড চাতালে। হাভাতে মানুষের কেরবালা বিধানবাবুর গড় জুড়ে ছিৎরে পড়ছে। দেশভাগের সময় পুব বাঙলা থেকে যে কিশোরগুলো বাবা-মায়ের কড়ে ধরে কলকাতায় এসেছিল, তারা এদণ্ডে গাগতরে বেতর, কিন্তু বয়সে ও মগজে সাজোয়ান। দেশভাগের খসা চোকলা। কাঁধের চিক্কুটে ঝোলায় কবিতার লাজুক খাতা আর কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ ঢুয়ে কলকাতার রাস্তায় গলিঘুঁজিতে এক রাত্তির হিল্লের মনসুবায় চোখমুখ কালিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাঁঝের আলা মদ্দিম হলে সারমেয় অধ্যাসিত ফুটপাতে, হয়ত-বা কোনও দয়াল বন্ধুর ঘাড়ে অথবা গেরস্ত বাড়ির হেঁসেল-ঠোরে রাত গুজরান। ইহাদের প্রত্যেকের বুকে কবিতা নামের পিলপিলে গণ্ডুপদটি ক্ষণে ক্ষণে ঢসন মারে। ইহারা সকলে প্রবল কবিতা-পিশাচ। পিশাচ, কেননা ইহাদের মাঘার ঘিলুতে জবরদস্ত পুঁজরক্ত যাহা গোপন আঁধারে কলম দিয়া চোয়ায় আর দেউলের দেউটি সহসা নিভায়।
ষাটোত্তর গরদিশের দিনগুলি। গেরস্তের জবরদখল-করা হেঁসেলে আচকা নোটিশ হয়ে গেল। ভাঙা আয়না, দাঁড় টুনানো চিরুনি, তেলের শিশি, জীর্ণ ফতুয়া, কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ আর লজ্জাবতী কবিতার ধুকড়ি নিয়ে পথে দাঁড়াল সুভাষ। সুভাষ শলা করল, ----- শৈল, চ, দুজনে মিলে একটা ঘর নিই। টালায় ১৬-বি শ্যামচরণ মুখার্জি স্ট্রিটের একতলায় দুর্গন্ধ-পীড়িত ফালি-খানেক ঘর যোগাড়ও হয়ে গেল। খিড়কির পাল্লা সরালেই ড্রেনের ধারে পাছা ঝুলিয়ে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কৃশগাঁড় বিভীষিকা।
সুভাষের গেরামের ইশকূলে কমপয়সার চাকরি। দু-বেলা যুৎসই অন্ন জোটে না বটে, কিন্তু গদ্যের হাতটি খাসা। তাহাতে ড্যাশ ও হাইফেনের যাচাই ভুরিভোজ। শৈলেশ্বরেরও মতিগতি উনিশবিশ। অল্প পড়াশোনা। ভাঙাচোরা ফ্যামিলির ছেলে। অশহুরে, তথা জন্মলব্ধ সারল্য ও সততা। ফলে মানিকজোড় হতে সূর্যঘড়ি লাগেনি। দুজনেই টিউশানি ধরে, আর ছাড়ে। হপ্তায় দু-দেড় দিন ভিজিট, আর চার-পাঁচদিন একুনে নাগা। ফলে আট থেকে দশদিনের মাথায় জবাব হয়ে যায়। খাওয়ার পয়সা নেই। বৃদ্ধ পিতা পঙ্গুত্বের লেংগি খেয়ে খাটের প্রাণী। ছাত্র-রাজনীতির গাজোয়ারি-প্রসূত 'লম্বা' হাঁকন বাবদ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নীমসম্বন্ধ। ফলে, দিনগুলি বেজায় নড়বড়ে, জীবনযাত্রা ধূরিপথহীন। সাহিত্য করা তো দূর অস্ত, সাহিত্যের জিগির-মাত্রে পিছদাঁড়ায় কাঁপন। ডাইনির ছমছমে খিখি অষ্টপ্রহর। ক্কচিৎ পকেটে বাড়তি খুচরো জুটলে শ্যালদার চোরা-হোটেলে জলের সঙ্গে পাঞ্চ করে, ভরদুপুরে কান্ট্রি-লিকার। শ্যামবাজারের জন্তা হোটেলে ছ'আনায় ভরপেট খানা। লেটনাইটে ঘুমের ধাক্কায়, বাড়ি। একজনের ঘুম জুটত, অন্যজনের জুটত না। শৈলেশ্বরের ছিল ইনসোমনিয়ার ব্যামো। সারা-সারারাত মরা মাছের নিস্পন্দ চাউনি সিলিং-পানে।
সুভাষরা একসময় ক'জন বন্ধু মিলে 'এষণা' নামে একটা কাগজ বের করত। খুবই পাতি, অতীব বালখিল্য সে কাগজ। সুভাষ-বাদে অন্যরা সবাই মামুলি মাস্টারবেট-করা লেখক, মানে পার্ট-টাইম। অল্প খিঁচে নিল, ব্যস, সাহিত্যের বাঘ মারা হয়ে গেল। আপিসে-আপিসে কেরানিগিরি, আর রোববার সকালে পাঁচ পয়সায় আধ প্যাকেট ক্যাপস্টান কিনে শ্যামবাজার কফিহাউসে ধুন্ধুমার আড্ডা। কফির কাপ আর তামাকের কড়া ধোঁয়ায় বাঙালির বেড়ে বাফুনারি। শৈলেশ্বর-সুভাষরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়, গেঁয়ো বুদ্ধি, গেঁয়ো কথাবার্তা। অপরপ্রান্তে, ধাউড়দের মুখে বিদিশি বই, ফরেন-কলমচিদের রেফারেন্স। ইনজিরির ছররা। দুজনের মধ্যে শৈলেশ্বরের বুদ্ধি একটু খোলা, মওকা বুঝে, সময় থাকতে কাগজটাকে নিজের হেফাজতে নিল। কাপ্তানি সুভাষের, কিন্তু কলকাঠি শৈলর হাতে। অবশ্য, চারটে মাত্র ইস্যুই হাপিস হয়েছিল 'এষণা'র।। হাংরি জেনারেশান সাহিত্যের ঐ ছিল গর্ভ-সূচনা। অচিরেই এষণার ছাদনায় এসে ভেঁড়ে প্রদীপ আর সুবো।
এবং আরও একজন। বছরটা ১৯৬৩।
ছেলেটির বয়স কুড়ি। রুজির যোগাড়ে গোড়ার দিকে থাকত কলকাতায়। টালা ব্রিজের কাছে খেলাত বাবু লেনে। বারোঘর এক উঠোনের একটি পোড়া বাড়িতে। সারাদিন রুজির খোঁজে, ফিরত রাত নিবিড়ে। পড়ে ন্যুনাধিক একটা হিল্লে হলে, অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে পাকাপোক্ত নোঙর। সেও ছিল দেশভাগের ঠাঁটা চোকলা। ডাঁসা বাঙাল। জিরজিরে শরীর। উপদ্রুত মন। চাঁচাড়ি-ঘেরা তার এক-কাটরা বাড়ি। ছেঁড়া শাড়ির গাঁঠরি। বাতায় ঠোঁসা সরষে তেলের শিশি। একটিপ তেল মেখে, শ্যালো টিপে দু-বালতি জলে স্নান সেরে ও গামছায় সর্বাঙ্গ মুছে, ভাঙা আয়নার সামনে ব্যাকব্রাশে টেরি চিরে দরমার দরজা ভেজিয়ে এক রোববার সে ঐ 'এষণা'র ঠেকে। লেট এন্ট্রি।
ছেলেটির নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত।
হালিতেই সে ঝুলি থেকে বের করে এগিয়ে দ্যায় একটি লিটল ম্যাগাজিন। পবিত্র বল্লভ সম্পাদিত 'উপদ্রুত'। তাহাতে একটি দীর্ঘ গদ্য, ---- নাম 'রন্ধনশালা'। সে বলেছিল, 'গল্প'।
বাসুদেব 'রন্ধনশালা' রচনা করেন একষট্টিতে। তেষট্টিতে সেটি ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়। গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে। শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না। এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়। বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।
রন্ধনশালার হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়। খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে।
আসলে, শৈলেশ্বর জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে যে ছোটলোক বা সংখ্যালঘুর মনোভাব কাজ করছিল, রন্ধনশালা ও তৎ-পরবর্তী গদ্যসমূহে সেটাকেই ঝাড়বাতির তলায় মেলে ধরেছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত।
শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের। চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না। প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, ছোটলোক আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা। আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি। প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক। ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি। সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা। পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল। এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন। এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়। বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন। এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মানং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো। অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।" আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন। প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল। উভয়ে মিশে গ্লোকাল। এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ। শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা। হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'। সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না। বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন। যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।
পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন। এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন। দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা। সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল। মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল। সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই। আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে। তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে। কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে। একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন। এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সময় সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি। সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়। এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে। হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'। শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত। তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'। কী ব্যাপার?? কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে। তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়। ধন্দ কাটে না। বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?' উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।
এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা। অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।
দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন। তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে। তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক। পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা। উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা। দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি। শবেবরাত। আখেরি চাহার শুম্বা।
আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট। আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন। সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।
ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা। ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে। অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।' এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল। এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।
সাহিত্যের আখড়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র নয়াল কিছু নয়। সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, হুজুগ আর বাওয়াল যুগে যুগে। সেই কোন ১৯০৫ থেকে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি লন্ডনের ব্লুমসবেরি মহল্লার এক থুত্থুড়ে কোঠায় ফি বেস্পতি সাঁঝে জমা হতেন সস্বামী ভার্জিনিয়া উলফ, রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, জন মেনার্ড কিন্স, ই এম ফর্স্টার, লিটন স্ট্র্যাচি, ডানকান গ্রান্ট প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ঐ আড্ডাবাজরা 'ব্লুমসবেরি গ্রূপ' নামে বিখ্যাত। মোটামুটি ঐ ধাঁচেরই ছিল বাংলার বিনয় সরকার, সুনীতি চাটুজ্জে, সতীশচন্দ্র মুখুজ্জেদের 'ডন সোসাইটি'; এবং কিছু পরে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-মানিক-প্রমুখের 'কল্লোল গোষ্ঠী'। যদিও জাতে ও চরিত্রে কিঞ্চিৎ আলাদা, কিন্তু তিনটিই ছিল নিছক আড্ডা-বিশেষ। সাহিত্যের আড্ডা। যা পরবর্তী কালে সাহিত্যের কিছু খাস সামিয়ানায় ঠেক পেতে কলকাতার কফি হাউসে আরও-অঙ্ক-কষে হতো, এবং যা এখন আরো-অন্যভাবে, অন্যত্রও হয়। বুকফেয়ার, নন্দনচত্ত্বরে, ইভন ফেসবুকে এবং ব্লগে। কিন্তু সাহিত্য তথা শিল্পে সেরম বাওয়াল ওরফে মুভমেন্ট যদি কিছু হয়ে থাকে, আমাদের রামায়ণ-মহাভারত-চৈতন্যের লীলাখেলা-সমূহ বাদ দিয়ে, তাহলে তার বিসমিল্লা ধরতে হয় ১৮৩০-এর ফরাসি বোহেমিয়ানদের হুল্লোড় থেকেই। তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের ঐ ছিল সাড়াজাগানো পয়লা ভেঁপু। এবং পরবর্তী কালে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই বিগউল ফোঁকা অব্যাহত থাকে। ফলে, মার্কিন ইন্টেলেকচুয়ালদের মাথায় হঠাৎ 'Angry' ঠাপ্পাটা দেখে তেমন হাসি নির্গত করার কারণ ছিল না বিশুদ্ধবাদীদের। কারণ ঐ মার্কিন অ্যাংরিরা এতখানিই বাগী আর রাগী ছিল যে নিজেদেরকে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বলতেও ওরা রীঢ়া বোধ করত। ওরা নিজেদের জাহির করত 'Anti-Intellectual' বলে। আসলে, জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংগোটি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গেগরি করসো, ই ই কামিংস, কেনেথ রেকথ, হেনরি মিলার প্রভৃতি আমেরিকান কবি-লেখকদের, তথাকথিত সামাজিক ধ্যানধারণার প্রতি প্ৰচণ্ড রকমের অনীহা ও আক্রোশ থেকে গড়ে ওঠা ঐ গোষ্ঠী নিজেদের জাহির করত 'বিট' বলে। বিট মানে হেরো, পরাস্ত, হতাশ, গাণ্ডু আর এইরকম আরও কিছু। 'অ্যাংরি' কথাটা তো খচমচ করত চল্লিশের দশকের জ্যাজ বাজিয়েদের ঠেকে। তাছাড়া, মোটামুটি ঐ সময়েই ইংল্যান্ডের একদল তিক্ত-বিরক্ত-রাগী লেখক সেখানকার গঙ্গাজলী সাহিত্যকে লাথিয়ে রাতারাতি দাগি হয়েছিলেন 'Angry Young Men' নামে। অ্যাংরিরা ছিলেন জন ওয়েন, জন ব্রেন, কিংসলি অ্যামিশ প্রমুখ। অ্যাংরি আর বিটরা একসময় একটা জয়েন্ট অ্যান্থলজিও বের করে। যে-কারণে ঐ দুই বাওয়াল-পার্টিকে অভিন্ন ভেবে কিছু মানুষ চরম ভুল করেছিল। কিন্তু, ভুল তো ভুলই। আসলে হয়েছিল কি, কেরুয়াকের সুহৃদ হারবার্ট হাংকি তখন কুচেল দুনিয়ায় গহন চলাফেরায় মগ্ন এবং তাঁকে ছিঁচকে চোর, মাস্তান আর মাতাল-গাঁজাখোর বলে চেনানোর জন্যে 'বিট' খিস্তিটা চালু ছিল। এবং, খুব অবান্তর হবে না যদি ধরা হয় কেরুয়াক উক্ত লিংক থেকেই শব্দটা গেঁড়িয়েছিলেন।
এই বিটদের সঙ্গে বাঙালি যুবাদের হাংরি হাঙ্গামাকে গুলিয়ে ফেলার বেওকুফি বা ধাউড়বাজি ঠিক হবে না। আবার 'হাংরি'র স্রোত-সূত্র যে 'ক্ষুধার্ত' বা 'কাঙাল' ---- এটা ঠিক না। কেননা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা কখনই মার্কামারা হতে রাজি নয়, তারা হামেহাল শেষধাপের জন্য ত্বরায়। আর, ধাপগুলো হলো অবিরাম নিচের দিকে, ঘাস আর মাটির দিকে। 'মার্কা' ব্যাপারটা মৌলবাদের লক্ষণ। প্রতিষ্ঠানের কারকিত। যেমন আমাদের পৌরাণিক নামগুলো। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, শিব, কৃষ্ণ, রাম, সীতা প্রত্যেকেরই হাজারটা করে নাম। পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে লোকসভার মেম্বার, এঁদের অনেকগুলো করে নাম। যত গুণের ঘাট, তত নামের বাড়। তাছাড়া, এটাও ফ্যাক্ট, যে, ব্যক্তিকে অভিধায়িত করার জন্য যেসব শব্দকলাপ আমাদের চারপাশে ডাঁই করা আছে, এখনও, সবই সেই ব্রিটিশ মাস্টারবেশিয়ানদের নিচুড়ে-যাওয়া বইপত্র, ডিক্সনারি আর আধুনিকতাবাদী বুকনি-বীর্য থেকে হাসিল। আসলে কিন্তু, শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতিক-আর্থিক অবস্থা, তাতে সেরকম মর্ডানিস্ট স্পেশেলাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সারবীজ সব পচে-হেজে গেছে। এখন আধুনিকতা ব্যাপারটাই একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর ও ধাপ্পাবাজ।
যাই হোক। বলবার কথা এই, হাঙ্গামার শরিকরাও যেভাবে দাবি করেছেন, ---- হাংরি, আর-পাঁচটা সাহিত্য আন্দোলনের মতোই, পূর্বাপর স্বমেহিত ছিল, তাতে কোনো বাহ্যিক ক্যাটালিটিকের কলকাঠি ছিল না। যে-কারণে এই হাঙ্গামার আবির্ভাব-কালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চাশের শেষে, বিশেষত ষাটের দশকের শুরুশুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একই ধাঁচে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা আর বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাদের নিজ-নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সমাজ, চালু ধর্মীয় নীতিকানুন, আর্থিক বন্দোবস্তি আর কালচারাল বাতাবরন তামাম-কিছু ঐ নাগর-যুবাদের কাছে চরম অসহনীয়, সুতরাং পরম ত্যাজ্য ও বর্জনীয় ঠাহর হতে থাকে। প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ্ব থেকে বার্কলি, জাকার্তা, কলম্বিয়া, পিকিং ----- বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রবল বাগী ও তোড়ফোড়-প্রবণ হয়ে ওঠে। লিহাজা, বিক্ষোভের ঐ চোনা সাহিত্যের জলকেও লোনা করে ফেলবে, এ তো অতি লাজিম কথা।
বিশেষত, দেশভাগটা বাঙালির সত্যিকারের পাইন মেরে দিয়েছিল। ঐ প্রেক্ষাপটে, যখন নিত্যনতুন মৃত্যুপদ ও ভীতিপদ বাঙালির বত্রিশ ইঞ্চি পোস্তবাটা-বুক ক্ষণে ক্ষণে ভেবড়ে দিচ্ছে, মুহুর্মুহু মূক করে দিচ্ছে আস্ত-একটা বাতেল্লাবাজ জাতিকে, চেতনা সন্ত্রস্ত ও দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে, নালা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে অনাহারী নেড়ি ও মানুষের ছা, ------ আমরা তখনও অবিশ্বাস্য নজরে দেখতে পাই হাজার বছরের ঝরঝরে মূল্যবোধগুলো বাঙালির জীবনে নতুন ধারণার পথ দেখাবে বলে, তখনও, রক্তচক্ষু মেলে দাঁড়িয়ে! নতুন শক্তি জীবনকে পথ দেখাতে চায়, তখনও। ঐ রক্তচক্ষুগুলো কাদের?? কোটি কোটি মূক ও মূঢ়ের বেদনাকে মূর্ত ধ্বনিতে তবদিল করতে উঠে আসে অই, কারা??? আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙলা মায়ের আনাচ-কানাচ থেকে, অন্ধগলি আর ঘুঁজিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে অশিক্ষিত নিরক্ষর অর্ধ-নিরক্ষর ভাঙা-ভাষা ভাঙা-বানানের একগুচ্ছ অন্ত্যজ, অপর, সাব-অলটার্ন, ডায়াসপোরিক ছোটলোক। নপুংসক বুর্জোয়া শ্যাল-কুত্তায় নুচে খাবে বাংলা সাহিত্যকে, তার আগেই টিনের সুটকেশ, ভাঙা মগ, ছেঁড়া পাজামা, নোংরা গেঞ্জি ও বিষ্ঠা-লাঞ্ছিত মুর্দাফরাসের কেরবালা হা-রেরে তরিবতে ধেয়ে এলো বাংলা সংস্কৃতির মূল বিতর্দির দিকে। গোড়ার দিকে এদের পিওর লাথখোর বলে মনে হবে, এদের ভাষা গেঁয়ো আর এদের কথাবার্তা অশ্লীল স্ল্যাং-মাফিক মনে হবে, ---- সেটা একরকম রফা। মৃতের চিতায় অগ্নি-অস্তিত্বের ঐ ছিল পূর্বাভাস।
হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ছিল, নাকি হুজুগ? হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা কে? ----- এই দুটি বিতর্ক এত এত দফা এত এত এত ভাবে দলিত মর্দিত ধর্ষিত হয়েছে যে তাকে এখন কেঁদেই বাঁচতে দেওয়া উচিত। বিশেষত দ্বিতীয় প্রশ্নটি। জঙ্গল মে মোর নাচা, কিসনে দেখা? প্রত্যেকে বলে আমি, আমি, আমি। অক্ষরের গোলামি থুয়ে অক্ষরের মালিক হওয়ার সাধ, প্রত্যেকের। তাঁরা মেতে উঠেছেন অন্ধকারে, অহংকারে, ব্যক্তিগত আরোপে, আমিত্বের বহ্বাস্ফোটে। আমি, আমি, আমি। আয়ে গওয়া হরামিয়ন সব, একে মারে যান আফত-মা হ্যায়। ----- বিতর্কটি এখন যেন এই বলছে, কঁকিয়ে, ----- এবং খাবি খেয়ে মরছে।
১৯৬২। 'সম্প্রতি' পত্রিকার থার্ড সংকলনে বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমীক্ষা বেরুল 'হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব' শিরোনামে। লেখক : শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অনেকের ধারণা, বাসু-সুভাষ-শৈলরাও খেয়েছিলেন, যে, এই লেখা থেকেই হাংরি জেনারেশন নামের সূত্রপাত। ধারণাটা কিছু বাতাসও পেয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে হাংরি মামলায় 'this literary movement was started by me' বলে শক্তির স্টেটমেন্ট জমা পড়ায়। হাংরি গোষ্ঠীর এককালীন গড়িমসি সদস্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও নাকি ঐ মর্মে বয়ান রুজু করেছিলেন। কিন্তু শক্তির এ লেখা তো বেরিয়েছিল বাষট্টি সনে; অথচ, ১৯৬১ সনের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ছেপে গিয়েছিল 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের ইস্তেহারটি, তাতে বার্জাস টাইপে পরিষ্কার ছাপা হয়েছিল : স্রষ্টা মলয় রায়চোধুরী, নেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক দেবী রায়।
আসলে, পরে জানা যায়, হাংরি জেনারেশন ছিল এমনই এক চ্যাংমাছ, কারো একার মুঠোয় বেশিক্ষণ ধরা থাকেনি। হাঙ্গামার ধূসর সূচনালগ্নের আরেক শরিক, বিলেত-রিটার্ন কলেজ-প্রভাষক উৎপলকুমার বসু পরবর্তীতে (১৯৯৪) জানালেন : "হাংরি জেনারেশন সেভাবে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। যার খুশী, যেখান থেকে পারে হাংরি জেনারেশন নাম দিয়ে বুলেটিন বের করে বাজারে ছেড়ে দিত। এই আন্দোলন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। কতকগুলো ফতোয়া মলয় সমীর শক্তি লিখেছিল। এগুলোর নিচে অনেকের নাম বসিয়ে দেয়া হ'ত। বহু ক্ষেত্রেই যাদের নাম দেওয়া হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাও করা হঁ'ত না। ..... হাংরিদের সেভাবে কোন কাগজও ছিল না। হয়ত ত্রিপুরা থেকে একটা কাগজ বেরল, নাম দিয়ে দিল ---- হাংরি জেনারেশন বুলেটিন নম্বর ১২। হয়ত তার ১০ বা ১১ বেরোয়নি।"
আসলে, ১৯৬২-৬৩ সনে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে এই বাওয়ালমুখী পালাবদলের তীব্র চাগাড়ে দুটি প্রধান উপ-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরের বুকে। একটি কেন্দ্রের মধ্যমণি ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং সুবো আচার্য। অপর কেন্দ্রে ছিলেন মলয় রায়চোধুরী, সমীর রায়চোধুরী, দেবী রায় এবং সুবিমল বসাক। উভয় কেন্দ্রের সদস্যরাই, কমবেশি, তথাকথিত ছোটলোক, গরিব আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত। এবং প্রত্যেকের বয়স ছিল বিশ-পঁচিশের কোঠায়। যে-বয়সে যত আলো পড়ে, তত ভয় কমে। উপকেন্দ্র যেহেতু দুটি, সুতরাং দু-রকমের হাংরি বাওয়াল শুরু হয়েছিল। একটা, শৈল-বাসু-সুভাষদের বস্তি-কলকাতার 'ছোটলোকি' বাওয়াল; এখানে যে-দলের নাম দেওয়া যাক হাংরি -- 'এ' গ্রূপ। অন্যটা মলয়-সুবিমলদের ডায়াসপোরিক বাওয়াল, অর্থাৎ 'বি'-গ্রূপ। দ্বিতীয় গ্রূপের সর্বময় কর্তা ছিলেন পাটনার ছোটলোক আর কুচেল অধ্যুষিত দরিয়াপুর মহল্লার নামচিন ষ্টুডিওঅলা রঞ্জুবাবুর ছোটছেলে বিশ বছরের ফনকু ওরফে ফনা, অথবা ইমলিতলার মুল্লু খান ওরফে মলয় রায়চোধুরী, সেটা জোরও ধরেছিল মলয়ের জোরদার ইস্তেহারি ভাষার চটকে, অপেক্ষাকৃত বেশি; আর, তাঁদের সে-টিমও ছিল বেশ ভারি। বহু পুরনো জ্ঞানপাপী সে-দলে ভিড়েছিল। 'এ' গ্রূপ এই 'বি' গ্রূপের নাম দিয়েছিল 'চুলকে দেওয়া হাংরি জেনারেশন'। প্রথম গ্রূপটি মলয়কে 'মফসসলের অজ্ঞাত গাড়োল' বলেও চালাতে চেয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত। তাঁরা, প্রত্যেকে ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মভাবে, মলয়ের বিরোধীপক্ষ। বিশেষত আশির দশকে পুনরুত্থিত মলয়ের নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে চালানো, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাস-বিকৃতি এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রচারে দাগা পেয়েই প্রথম গ্রূপটির গোসা ধরতামাশি পেয়েছিল এবং তাঁরা পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিলেন। সুতরাং প্রথম দলটির ঐ পাঁচ শরিক যাঁরা আন্দোলন-চলাকালীন, ষাটের দশকে যা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি, আশি ও তৎ-পরবর্তী পিরিয়ডে মলয়ের মতই, নিজেদেরকে 'হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা' হিশেবে প্রচার করা শুরু করে দেন। দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না বলে এহেন পারস্পরিক কাদাহোলি। আমি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুম্ভলস চাই না, অতএব কোন্দলটি এড়িয়ে যাচ্ছি।
এ-কথা ঠিক যে হাংরি কোন ইজম ছিল না। ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া। আরও বলতে পারি, একটা ঘটনা, বাংলাভাষায় সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল এক ঢেউ, উঠে এসে, আছড়ে পড়েছিল এজি-গোয়িং সাহিত্যের ল্যাসলেসে মসৃণ চত্ত্বরে। সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের লিরিকফুলের বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনো-অব্দি একলোতা বৈপ্লবিক সমীহা।
('হাংরি সাহিত্যের সংগ্রহশালা' থেকে)
Comments
Tanumay Goswami
Tanumay Goswami আবারও পড়লাম l আরো কিছু নতুন আবিষ্কার l বাষ্পপুঞ্জ ঘিরে ধরা ইতিহাসে নতুন করে আলো পড়লো এই লেখার মাধ্যমে l

শুক্রবার

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া : হাংরি আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা

                                                                       

হাংরি আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা
Suvrajit Barua·Saturday, 25 July 2015
সময়টা ইংরেজি ১৯৬৪ সাল। সেপ্টেম্বর মাসে ইন্ডিয়ান প্যানাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল । তাঁরা হলেন: মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক । এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়েছিল । মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি পরে হেঁটেছিলেন কোলকাতার রাস্তায় চোর- ডাকাতের পাশে।
কিন্তু কেন? কেন ফেরারী হয়ে যান সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়? কেন বিশ্বভারতী থেকে রাসটিকিট হন প্রদীপ চৌধুরী? উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনা থেকে বরখাস্ত হন? বেছে বেছে কেন কবিদের দেয়া হল যন্ত্রণা?
উত্তরটা আমরা পরে খুঁজবো। তার আগে বাংলা সাহিত্যের ভাঙ্গা-গড়া নিয়ে একটু নাড়াচাড়া করে আসি। প্রথমেই বলে নিচ্ছি সাহিত্য হচ্ছে শিল্পের খুবই সরল একটি শাখা। যেমন শাখা চারুকলা কিংবা সঙ্গীত। আমরা সারা পৃথিবী জুড়ে অনেক শিল্প বিপ্লব এর কথা শুনেছি, পড়েছি। ১৭, ১৮ শতক এর Amatory Fiction বা যৌন কাল্পনিক সাহিত্য। যার উল্লেখযোগ্য লেখক হচ্ছেন Eliza Haywood, Delarivier Manley। এরপর সময়ের স্রোত বেয়ে ঘটেছে আরও অনেক। ১৭ শতকের Cavalier Poets যার উল্লেখযোগ্য লেখকদ্বয় Richard Lovelace, William Davenant। এরপর John Donne, George Herbert, Andrew Marvell প্রমুখ সাহিত্যক এর Metaphysical poets। আলেকজান্ডার পোপ, জোনাথোন সুইফট এর চিরায়ত আদর্শ, বিদ্রুপ এবং সংশয়বাদকে আশ্রয় করে “দ্য অগাস্তান” আন্দোলন করলেন ১৮ শতকে। ১৯ শতকে যুক্তি, বিজ্ঞান সব ফেলে আবেগ আর কল্পনাকে আশ্রয় করে ভিক্টর হুগো, ক্যামিলো ক্যাস্তেলো “অবাধ কল্পনাপ্রবণতা”য় বেঁধে ধরলেন সাহিত্য কে। এরপর Dark Romanticism, Realism আরও কত কি..!!
বাংলা সাহিত্যেও এরকম দুটি আন্দোলন হয়েছিল। যার একটি ১৯৬১-১৯৬৫ তে আর একটি ১৯৬৯ এ। ১৯৬১-১৯৬৫ এর এই আন্দোলনটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম আন্দোলন। বাঁধ ভাঙার আওআজ তুলে ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে বাংলা শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি মুভমেন্ট বা ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদশর্টিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষমেষ এই হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে্র ঔপনিবেশিক সাহিত্যকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে দিয়ে নিজেদের স্বত্ত্বার বহিঃপ্রকাশই ছিল এই আন্দোলন এর আপাত অভিপ্রায়। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন। মলয় রায় চৌধুরী এই বিখ্যাত সাহিত্য আন্দলেনের মূল পথিকৃৎ। সেলুকাস এই কবির সাথে ছিলেন কবির দাদা সমীর রায় চৌধুরী, আন্দোলনের সম্পাদনায় ও বিতরণে ছিলেন কবি দেবী রায় এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্রোপাধ্যায়।
১৯৬১ সাল দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে সাহিত্য, ওদিকে আবার পচে গলে পড়ে যাচ্ছে উন্নত ভারত বর্ষের স্বপ্ন। কবি মলয় রায় নিজে বলেছিলেন, “স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতিয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পঁচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে ”।
তিনি Oswald Spengler এর লেখা "The Decline of the West" বইটির মূল বক্তব্য থেকে এই আন্দোলনের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন | Oswald Spengler এই বইটিতে বলেছিলেন, কোনো সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না| যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে | কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন | তাঁর মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালীর আবির্ভাব আর সম্ভব নয় |
তাঁর মনে হয়েছিল যে কিছুটা হলেও এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানো দরকার,আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন। অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে কবিগণ হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন।হাংরি আন্দোলনকারীরা শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি Geoffrey Chaucer এর In Swore Hungry Time বাক্যটি থেকে।
আর সেই ভাবনা থেকেই কবি মলয় রায় তাঁর দাদা সমীর রায়, দুই বন্ধু দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় এর সাথে ধারনাটি ব্যাখ্যা করেন এবং হাংরি আন্দোলনের প্রস্তাবনা দেন পড়ে তাদের এবং অন্যান্য তরুণ লেখক কবি শিল্পীদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করেন | নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত করা হয় পাটনা থেকে এবং সেখানে বাংলা ছাপাবার প্রেস না পাওয়ায় বুলেটিনটি প্রকাশিত করা হয় ইংরেজীতে | অতি স্বল্প কালের মধ্যেই হিন্দী ও নেপালী ভাষাতেও এই আন্দোলন ছড়িয়েছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্দোলনে মিশে যান বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল করঞ্জাই এবং করুণানিধান নামের দুজন চিত্রকরও ছিলেন এই আন্দোলনে । এই আন্দোলন কে নিয়ে স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরীর লেখা, দিল্লী থেকে প্রকাশিত পত্রিকা "দিগঙ্গন" এর উত্সব সংখ্যা ২০০৪ এ প্রকাশিত "প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি" প্রবন্ধতে তিনি বলেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্হনা-নির্ভর, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত ।" তঁরা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতেকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে । ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায় । গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ । ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন । এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠিও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্তবাধিকারীর নামে । পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক ননগদনতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর । লক্ষ্মণিয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় । তার কারন সৃজনশীলতার ক্ষেত্রে ব্যাক্তি মালিকানার উদ্ভব ও বিকাশ ইউরোপীয় অধিবিদ্যাদত মননবিশ্বের ফসল।” হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন । এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন । বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্ট্রিট কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন । হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা । কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কারন অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। ১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন । সেগুলো হল, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃ সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিতএষণা, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি দি ওয়েস্ট পেপার ।
১৯৬৩ সালের শেষদিকে সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয় । বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে দাদাইজম প্রভাব লক্ষ্য করেছেন । এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন ।এই সমস্ত কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে তাঁরা দাবী করতেন যে অচলায়তনকে ভাঙা যাবে । অবশ্য তাঁদের অনুকরণে পরবর্তীকালে বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এসেছেন বাংলা সাহিত্যে ।
১৯৬৪ সালে, তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের রাজত্বকাল মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ ও সমীর রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা হয়| পরে অন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে অশ্লীল সাহিত্য রচনা করার অভিযোগে মামলা করা হয়, তাঁর "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতাটির জন্য | হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ৩৫ মাস অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত মামলা চলতে থাকে।
২৬ জুলাই ১৯৬৭ তে উচ্চ আদালত মলয় রায় চৌধুরী কে বেকসুর খালাস করে দেন। আর এভাবেই শেষ হয় ক্ষুধিত কবিদের হাহাকার। চোর ডাকাতের পাশে হাতকড়া পড়ে হেঁটে যাওয়া কবি এবং কবি আর তাদের ম্লান হয়ে যাওয়া কষ্ট ঢাকা পড়ে যায় এক নতুন সম্ভাবনায়। হাংরি আন্দোলনকারীরা বৈপ্লবিক পরিবর্তনএর প্রথম ফল পাওয়া গেল নামকরণে যেমন, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, আমি আর লীনা হঁটে চলেছি, ক্ষেপচুরিয়াস, ইত্যাদি । হাংরি আন্দোলন প্রথম যৌথভাবে প্রন্তিকের ডিসকোর্সকে স্হান করে দিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতায় একটি ছবি সম্পূর্ণ গড়ে ওঠার আগেই তা মিলিয়ে গিয়ে আরেকটি ছবি ভেসে ওঠে । বাংলা কবিতায় এটি এখন প্রতিষ্ঠিত শৈলী । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় এদের ব্যপারে লিখেছেন, "ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর" করেছেন তাঁরা”। আর প্রতিটি ভাংচুর এ জন্ম নেয় নতুন শিশু, নতুন প্রাণ। অবিরাম স্রোতধারায় নিষ্পেষিত অদম্য ভালোবাসা জেগে উঠে কামনাশুন্য নির্বোধ ব্যারিকেডে।

অজিত রায় : আভাঁগার্দ আন্দোলন - হাংরি আন্দোলন

                                     

নষ্ট তৈজসে সমলৈঙ্গিক গিল্টি

অজিত রায়

কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন।  যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন।  তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়।  জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে।  হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে।  এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে।  তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়।  সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা।  সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।


১৯৫৯-৬০।  বৃটিশবীর্যিত মুলুকের পোঁদে গাঁড়সা পুঁতে গাদি সামলাচ্ছেন নেহেরু।  দেশের দুই প্রান্তে পার্টিশানের টসটসে পাঁচড়া।  পুব পাকিস্তান থেকে আগত অন্যৎপুষ্ট মানুষের কিছু থোপনা তখনও আনলোড হচ্ছে শেয়ালদার টেসেলেটেড চাতালে।  হাভাতে মানুষের কেরবালা বিধানবাবুর গড় জুড়ে ছিৎরে পড়ছে।  দেশভাগের সময় পুব বাঙলা থেকে যে কিশোরগুলো বাবা-মায়ের কড়ে ধরে কলকাতায় এসেছিল, তারা এদণ্ডে গাগতরে বেতর, কিন্তু বয়সে ও মগজে সাজোয়ান।  দেশভাগের খসা চোকলা।  কাঁধের চিক্কুটে ঝোলায় কবিতার লাজুক খাতা আর কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ ঢুয়ে কলকাতার রাস্তায় গলিঘুঁজিতে এক রাত্তির হিল্লের মনসুবায় চোখমুখ কালিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাঁঝের আলা মদ্দিম হলে সারমেয় অধ্যাসিত ফুটপাতে, হয়ত-বা কোনও দয়াল বন্ধুর ঘাড়ে অথবা গেরস্ত বাড়ির হেঁসেল-ঠোরে রাত গুজরান।  ইহাদের প্রত্যেকের বুকে কবিতা নামের পিলপিলে গণ্ডুপদটি ক্ষণে ক্ষণে ঢসন মারে।  ইহারা সকলে প্রবল কবিতা-পিশাচ।  পিশাচ, কেননা ইহাদের মাঘার ঘিলুতে জবরদস্ত পুঁজরক্ত যাহা গোপন আঁধারে কলম দিয়া চোয়ায় আর দেউলের দেউটি সহসা নিভায়।


ষাটোত্তর গরদিশের দিনগুলি।  গেরস্তের জবরদখল-করা হেঁসেলে আচকা নোটিশ হয়ে গেল।  ভাঙা আয়না, দাঁড় টুনানো চিরুনি, তেলের শিশি, জীর্ণ ফতুয়া, কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ আর লজ্জাবতী কবিতার ধুকড়ি নিয়ে পথে দাঁড়াল সুভাষ।  সুভাষ শলা করল, ----- শৈল, চ, দুজনে মিলে একটা ঘর নিই।  টালায় ১৬-বি শ্যামচরণ মুখার্জি স্ট্রিটের একতলায় দুর্গন্ধ-পীড়িত ফালি-খানেক ঘর যোগাড়ও হয়ে গেল।  খিড়কির পাল্লা সরালেই ড্রেনের ধারে পাছা ঝুলিয়ে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কৃশগাঁড় বিভীষিকা।


সুভাষের গেরামের ইশকূলে কমপয়সার চাকরি।  দু-বেলা যুৎসই অন্ন জোটে না বটে, কিন্তু গদ্যের হাতটি খাসা।  তাহাতে ড্যাশ ও হাইফেনের যাচাই ভুরিভোজ।  শৈলেশ্বরেরও মতিগতি উনিশবিশ।  অল্প পড়াশোনা।  ভাঙাচোরা ফ্যামিলির ছেলে।  অশহুরে, তথা জন্মলব্ধ সারল্য ও সততা।  ফলে মানিকজোড় হতে সূর্যঘড়ি লাগেনি।  দুজনেই টিউশানি ধরে, আর ছাড়ে।  হপ্তায় দু-দেড় দিন ভিজিট, আর চার-পাঁচদিন একুনে নাগা।  ফলে আট থেকে দশদিনের মাথায় জবাব হয়ে যায়।  খাওয়ার পয়সা নেই।  বৃদ্ধ পিতা পঙ্গুত্বের লেংগি খেয়ে খাটের প্রাণী।  ছাত্র-রাজনীতির গাজোয়ারি-প্রসূত 'লম্বা' হাঁকন বাবদ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নীমসম্বন্ধ।  ফলে, দিনগুলি বেজায় নড়বড়ে, জীবনযাত্রা ধূরিপথহীন।  সাহিত্য করা তো দূর অস্ত, সাহিত্যের জিগির-মাত্রে পিছদাঁড়ায় কাঁপন।  ডাইনির ছমছমে খিখি অষ্টপ্রহর।  ক্কচিৎ পকেটে বাড়তি খুচরো জুটলে শ্যালদার চোরা-হোটেলে জলের সঙ্গে পাঞ্চ করে, ভরদুপুরে কান্ট্রি-লিকার।  শ্যামবাজারের জন্তা হোটেলে ছ'আনায় ভরপেট খানা।  লেটনাইটে ঘুমের ধাক্কায়, বাড়ি।  একজনের ঘুম জুটত, অন্যজনের জুটত না।  শৈলেশ্বরের ছিল ইনসোমনিয়ার ব্যামো।  সারা-সারারাত মরা মাছের নিস্পন্দ চাউনি সিলিং-পানে।


সুভাষরা একসময় ক'জন বন্ধু মিলে 'এষণা' নামে একটা কাগজ বের করত।  খুবই পাতি, অতীব বালখিল্য সে কাগজ।  সুভাষ-বাদে অন্যরা সবাই মামুলি মাস্টারবেট-করা লেখক, মানে পার্ট-টাইম।  অল্প খিঁচে নিল, ব্যস, সাহিত্যের বাঘ মারা হয়ে গেল।  আপিসে-আপিসে কেরানিগিরি, আর রোববার সকালে পাঁচ পয়সায় আধ প্যাকেট ক্যাপস্টান কিনে শ্যামবাজার কফিহাউসে ধুন্ধুমার আড্ডা।  কফির কাপ আর তামাকের কড়া ধোঁয়ায় বাঙালির বেড়ে বাফুনারি।  শৈলেশ্বর-সুভাষরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়, গেঁয়ো বুদ্ধি, গেঁয়ো কথাবার্তা।  অপরপ্রান্তে, ধাউড়দের মুখে বিদিশি বই, ফরেন-কলমচিদের রেফারেন্স।  ইনজিরির ছররা।  দুজনের মধ্যে শৈলেশ্বরের বুদ্ধি একটু খোলা, মওকা বুঝে, সময় থাকতে কাগজটাকে নিজের হেফাজতে নিল।  কাপ্তানি সুভাষের, কিন্তু কলকাঠি শৈলর হাতে।  অবশ্য, চারটে মাত্র ইস্যুই হাপিস হয়েছিল 'এষণা'র।। হাংরি জেনারেশান সাহিত্যের ঐ ছিল গর্ভ-সূচনা।  অচিরেই এষণার ছাদনায় এসে ভেঁড়ে প্রদীপ আর সুবো।


এবং আরও একজন।  বছরটা ১৯৬৩।

ছেলেটির বয়স কুড়ি।  রুজির যোগাড়ে গোড়ার দিকে থাকত কলকাতায়।  টালা ব্রিজের কাছে খেলাত বাবু লেনে।  বারোঘর এক উঠোনের একটি পোড়া বাড়িতে।  সারাদিন রুজির খোঁজে, ফিরত রাত নিবিড়ে।  পড়ে ন্যুনাধিক একটা হিল্লে হলে, অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে পাকাপোক্ত নোঙর।  সেও ছিল দেশভাগের ঠাঁটা চোকলা।  ডাঁসা বাঙাল।  জিরজিরে শরীর।  উপদ্রুত মন।  চাঁচাড়ি-ঘেরা তার এক-কাটরা বাড়ি।  ছেঁড়া শাড়ির গাঁঠরি।  বাতায় ঠোঁসা সরষে তেলের শিশি।  একটিপ তেল মেখে, শ্যালো টিপে দু-বালতি জলে স্নান সেরে ও গামছায় সর্বাঙ্গ মুছে, ভাঙা আয়নার সামনে ব্যাকব্রাশে টেরি চিরে দরমার দরজা ভেজিয়ে এক রোববার সে ঐ 'এষণা'র ঠেকে।  লেট এন্ট্রি।

ছেলেটির নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত।


হালিতেই সে ঝুলি থেকে বের করে এগিয়ে দ্যায় একটি লিটল ম্যাগাজিন।  পবিত্র বল্লভ সম্পাদিত 'উপদ্রুত'।  তাহাতে একটি দীর্ঘ গদ্য, ---- নাম 'রন্ধনশালা'।  সে বলেছিল, 'গল্প'।

বাসুদেব 'রন্ধনশালা' রচনা করেন একষট্টিতে।  তেষট্টিতে সেটি ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়।  গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে।  শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না।  এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়।  বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।


রন্ধনশালার হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়।  খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন।  বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই।  বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে।


আসলে, শৈলেশ্বর জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে যে ছোটলোক বা সংখ্যালঘুর মনোভাব কাজ করছিল, রন্ধনশালা ও তৎ-পরবর্তী গদ্যসমূহে সেটাকেই ঝাড়বাতির তলায় মেলে ধরেছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত।


শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের।  চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না।  প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, ছোটলোক আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা।  আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি।  প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক।  ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি।  সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা।  পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল।  এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন।  এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়।  বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন।  এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মানং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো।  অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।"  আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন।  প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল।  উভয়ে মিশে গ্লোকাল।  এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ।  শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা।  হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'।  সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না।  বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন।  যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।


পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন।  এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন।  দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা।  সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল।  মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল।  সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই।  আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে।  তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে।  কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে।  একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন।  এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সময় সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি।  সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়।  এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়।  এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে।  হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'।  শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত।  তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'।  কী ব্যাপার??  কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে।  তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়।  ধন্দ কাটে না।  বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?'  উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।


এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা।  অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।


দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন।  তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে।  পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে।  তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক।  পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির।  জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা।  উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি।  চলছে পঞ্চাশের খেলা।  দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে।  বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার।  যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি।  শবেবরাত।  আখেরি চাহার শুম্বা।


আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট।  আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল।  শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।'  বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ।  পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন।  বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার।  আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে।  উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন।  এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি।  কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল।  বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন।  সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।


ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়।  ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়।  বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা।  ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে।  ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের।  তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে।  অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।'  এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল।  এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।


সাহিত্যের আখড়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র নয়াল কিছু নয়।  সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, হুজুগ আর বাওয়াল যুগে যুগে।  সেই কোন ১৯০৫ থেকে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি লন্ডনের ব্লুমসবেরি মহল্লার এক থুত্থুড়ে কোঠায় ফি বেস্পতি সাঁঝে জমা হতেন সস্বামী ভার্জিনিয়া উলফ, রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, জন মেনার্ড কিন্স, ই এম ফর্স্টার, লিটন স্ট্র্যাচি, ডানকান গ্রান্ট প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা।  ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ঐ আড্ডাবাজরা 'ব্লুমসবেরি গ্রূপ' নামে বিখ্যাত।  মোটামুটি ঐ ধাঁচেরই ছিল বাংলার বিনয় সরকার, সুনীতি চাটুজ্জে, সতীশচন্দ্র মুখুজ্জেদের 'ডন সোসাইটি'; এবং কিছু পরে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-মানিক-প্রমুখের 'কল্লোল গোষ্ঠী'।  যদিও জাতে ও চরিত্রে কিঞ্চিৎ আলাদা, কিন্তু তিনটিই ছিল নিছক আড্ডা-বিশেষ।  সাহিত্যের আড্ডা।  যা পরবর্তী কালে সাহিত্যের কিছু খাস সামিয়ানায় ঠেক পেতে কলকাতার কফি হাউসে আরও-অঙ্ক-কষে হতো, এবং যা এখন আরো-অন্যভাবে, অন্যত্রও হয়।  বুকফেয়ার, নন্দনচত্ত্বরে, ইভন ফেসবুকে এবং ব্লগে।  কিন্তু সাহিত্য তথা শিল্পে সেরম বাওয়াল ওরফে মুভমেন্ট যদি কিছু হয়ে থাকে, আমাদের রামায়ণ-মহাভারত-চৈতন্যের লীলাখেলা-সমূহ বাদ দিয়ে, তাহলে তার বিসমিল্লা ধরতে হয় ১৮৩০-এর ফরাসি বোহেমিয়ানদের হুল্লোড় থেকেই।  তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের ঐ ছিল সাড়াজাগানো পয়লা ভেঁপু।  এবং পরবর্তী কালে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই বিগউল ফোঁকা অব্যাহত থাকে।  ফলে, মার্কিন ইন্টেলেকচুয়ালদের মাথায় হঠাৎ 'Angry' ঠাপ্পাটা দেখে তেমন হাসি নির্গত করার কারণ ছিল না বিশুদ্ধবাদীদের।  কারণ ঐ মার্কিন অ্যাংরিরা এতখানিই বাগী আর রাগী ছিল যে নিজেদেরকে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বলতেও ওরা রীঢ়া বোধ করত।  ওরা নিজেদের জাহির করত 'Anti-Intellectual' বলে।  আসলে, জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংগোটি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গেগরি করসো, ই ই কামিংস, কেনেথ রেকথ, হেনরি মিলার প্রভৃতি আমেরিকান কবি-লেখকদের, তথাকথিত সামাজিক ধ্যানধারণার প্রতি প্ৰচণ্ড রকমের অনীহা ও আক্রোশ থেকে গড়ে ওঠা ঐ গোষ্ঠী নিজেদের জাহির করত 'বিট' বলে।  বিট মানে হেরো, পরাস্ত, হতাশ, গাণ্ডু আর এইরকম আরও কিছু।  'অ্যাংরি' কথাটা তো খচমচ করত চল্লিশের দশকের জ্যাজ বাজিয়েদের ঠেকে।  তাছাড়া, মোটামুটি ঐ সময়েই ইংল্যান্ডের একদল তিক্ত-বিরক্ত-রাগী লেখক সেখানকার গঙ্গাজলী সাহিত্যকে লাথিয়ে রাতারাতি দাগি হয়েছিলেন 'Angry Young Men' নামে।  অ্যাংরিরা ছিলেন জন ওয়েন, জন ব্রেন, কিংসলি অ্যামিশ প্রমুখ।  অ্যাংরি আর বিটরা একসময় একটা জয়েন্ট অ্যান্থলজিও বের করে।  যে-কারণে ঐ দুই বাওয়াল-পার্টিকে অভিন্ন ভেবে কিছু মানুষ চরম ভুল করেছিল।  কিন্তু, ভুল তো ভুলই।  আসলে হয়েছিল কি, কেরুয়াকের সুহৃদ হারবার্ট হাংকি তখন কুচেল দুনিয়ায় গহন চলাফেরায় মগ্ন এবং তাঁকে ছিঁচকে চোর, মাস্তান আর মাতাল-গাঁজাখোর বলে চেনানোর জন্যে 'বিট' খিস্তিটা চালু ছিল।  এবং, খুব অবান্তর হবে না যদি ধরা হয় কেরুয়াক উক্ত লিংক থেকেই শব্দটা গেঁড়িয়েছিলেন।


এই বিটদের সঙ্গে বাঙালি যুবাদের হাংরি হাঙ্গামাকে গুলিয়ে ফেলার বেওকুফি বা ধাউড়বাজি ঠিক হবে না।  আবার 'হাংরি'র স্রোত-সূত্র যে 'ক্ষুধার্ত' বা 'কাঙাল' ---- এটা ঠিক না।  কেননা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা কখনই মার্কামারা হতে রাজি নয়, তারা হামেহাল শেষধাপের জন্য ত্বরায়।  আর, ধাপগুলো হলো অবিরাম নিচের দিকে, ঘাস আর মাটির দিকে।  'মার্কা' ব্যাপারটা মৌলবাদের লক্ষণ।  প্রতিষ্ঠানের কারকিত।  যেমন আমাদের পৌরাণিক নামগুলো।  সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, শিব, কৃষ্ণ, রাম, সীতা প্রত্যেকেরই হাজারটা করে নাম।  পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে লোকসভার মেম্বার, এঁদের অনেকগুলো করে নাম।  যত গুণের ঘাট, তত নামের বাড়।  তাছাড়া, এটাও ফ্যাক্ট, যে, ব্যক্তিকে অভিধায়িত করার জন্য যেসব শব্দকলাপ আমাদের চারপাশে ডাঁই করা আছে, এখনও, সবই সেই ব্রিটিশ মাস্টারবেশিয়ানদের নিচুড়ে-যাওয়া বইপত্র, ডিক্সনারি আর আধুনিকতাবাদী বুকনি-বীর্য থেকে হাসিল।  আসলে কিন্তু, শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতিক-আর্থিক অবস্থা, তাতে সেরকম মর্ডানিস্ট স্পেশেলাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সারবীজ সব পচে-হেজে গেছে।  এখন আধুনিকতা ব্যাপারটাই একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর ও ধাপ্পাবাজ।

যাই হোক।  বলবার কথা এই, হাঙ্গামার শরিকরাও যেভাবে দাবি করেছেন, ---- হাংরি, আর-পাঁচটা সাহিত্য আন্দোলনের মতোই, পূর্বাপর স্বমেহিত ছিল, তাতে কোনো বাহ্যিক ক্যাটালিটিকের কলকাঠি ছিল না।  যে-কারণে এই হাঙ্গামার আবির্ভাব-কালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।  পঞ্চাশের শেষে, বিশেষত ষাটের দশকের শুরুশুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একই ধাঁচে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা আর বিক্ষোভ দেখা দেয়।  তাদের নিজ-নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সমাজ, চালু ধর্মীয় নীতিকানুন, আর্থিক বন্দোবস্তি আর কালচারাল বাতাবরন তামাম-কিছু ঐ নাগর-যুবাদের কাছে চরম অসহনীয়, সুতরাং পরম ত্যাজ্য ও বর্জনীয় ঠাহর হতে থাকে।  প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ্ব থেকে বার্কলি, জাকার্তা, কলম্বিয়া, পিকিং ----- বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রবল বাগী ও তোড়ফোড়-প্রবণ হয়ে ওঠে।  লিহাজা, বিক্ষোভের ঐ চোনা সাহিত্যের জলকেও লোনা করে ফেলবে, এ তো অতি লাজিম কথা।


বিশেষত, দেশভাগটা বাঙালির সত্যিকারের পাইন মেরে দিয়েছিল।  ঐ প্রেক্ষাপটে, যখন নিত্যনতুন মৃত্যুপদ ও ভীতিপদ বাঙালির বত্রিশ ইঞ্চি পোস্তবাটা-বুক ক্ষণে ক্ষণে ভেবড়ে দিচ্ছে, মুহুর্মুহু মূক করে দিচ্ছে আস্ত-একটা বাতেল্লাবাজ জাতিকে, চেতনা সন্ত্রস্ত ও দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে, নালা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে অনাহারী নেড়ি ও মানুষের ছা, ------ আমরা তখনও অবিশ্বাস্য নজরে দেখতে পাই হাজার বছরের ঝরঝরে মূল্যবোধগুলো বাঙালির জীবনে নতুন ধারণার পথ দেখাবে বলে, তখনও, রক্তচক্ষু মেলে দাঁড়িয়ে!  নতুন শক্তি জীবনকে পথ দেখাতে চায়, তখনও।  ঐ রক্তচক্ষুগুলো কাদের??  কোটি কোটি মূক ও মূঢ়ের বেদনাকে মূর্ত ধ্বনিতে তবদিল করতে উঠে আসে অই, কারা???  আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙলা মায়ের আনাচ-কানাচ থেকে, অন্ধগলি আর ঘুঁজিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে অশিক্ষিত নিরক্ষর অর্ধ-নিরক্ষর ভাঙা-ভাষা ভাঙা-বানানের একগুচ্ছ অন্ত্যজ, অপর, সাব-অলটার্ন, ডায়াসপোরিক ছোটলোক।  নপুংসক বুর্জোয়া শ্যাল-কুত্তায়  নুচে খাবে বাংলা সাহিত্যকে, তার আগেই টিনের সুটকেশ, ভাঙা মগ, ছেঁড়া পাজামা, নোংরা গেঞ্জি ও বিষ্ঠা-লাঞ্ছিত মুর্দাফরাসের কেরবালা হা-রেরে তরিবতে ধেয়ে এলো বাংলা সংস্কৃতির মূল বিতর্দির দিকে।  গোড়ার দিকে এদের পিওর লাথখোর বলে মনে হবে, এদের ভাষা গেঁয়ো আর এদের কথাবার্তা অশ্লীল স্ল্যাং-মাফিক মনে হবে, ----  সেটা একরকম রফা।  মৃতের চিতায় অগ্নি-অস্তিত্বের ঐ ছিল পূর্বাভাস।


হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ছিল, নাকি হুজুগ?  হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা কে?  ----- এই দুটি বিতর্ক এত এত দফা এত এত এত ভাবে দলিত মর্দিত ধর্ষিত হয়েছে যে তাকে এখন কেঁদেই বাঁচতে দেওয়া উচিত।  বিশেষত দ্বিতীয় প্রশ্নটি।  জঙ্গল মে মোর নাচা, কিসনে দেখা?  প্রত্যেকে বলে আমি, আমি, আমি।  অক্ষরের গোলামি থুয়ে অক্ষরের মালিক হওয়ার সাধ, প্রত্যেকের।  তাঁরা মেতে উঠেছেন অন্ধকারে, অহংকারে, ব্যক্তিগত আরোপে, আমিত্বের বহ্বাস্ফোটে।  আমি, আমি, আমি।  আয়ে গওয়া হরামিয়ন সব, একে মারে যান আফত-মা হ্যায়। ----- বিতর্কটি এখন যেন এই বলছে, কঁকিয়ে, ----- এবং খাবি খেয়ে মরছে।


১৯৬২।  'সম্প্রতি' পত্রিকার থার্ড সংকলনে বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমীক্ষা বেরুল 'হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব' শিরোনামে।  লেখক : শক্তি চট্টোপাধ্যায়।  অনেকের ধারণা, বাসু-সুভাষ-শৈলরাও খেয়েছিলেন, যে, এই লেখা থেকেই হাংরি জেনারেশন নামের সূত্রপাত।  ধারণাটা কিছু বাতাসও পেয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে হাংরি মামলায় 'this literary movement was started by me' বলে শক্তির স্টেটমেন্ট জমা পড়ায়।  হাংরি গোষ্ঠীর এককালীন গড়িমসি সদস্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও নাকি ঐ মর্মে বয়ান রুজু করেছিলেন।  কিন্তু শক্তির এ লেখা তো বেরিয়েছিল বাষট্টি সনে; অথচ, ১৯৬১ সনের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ছেপে গিয়েছিল 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের ইস্তেহারটি, তাতে বার্জাস টাইপে পরিষ্কার ছাপা হয়েছিল : স্রষ্টা মলয় রায়চোধুরী, নেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক দেবী রায়।


আসলে, পরে জানা যায়, হাংরি জেনারেশন ছিল এমনই এক চ্যাংমাছ, কারো একার মুঠোয় বেশিক্ষণ ধরা থাকেনি।  হাঙ্গামার ধূসর সূচনালগ্নের আরেক শরিক, বিলেত-রিটার্ন কলেজ-প্রভাষক উৎপলকুমার বসু পরবর্তীতে (১৯৯৪) জানালেন : "হাংরি জেনারেশন সেভাবে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না।  যার খুশী, যেখান থেকে পারে হাংরি জেনারেশন নাম দিয়ে বুলেটিন বের করে বাজারে ছেড়ে দিত।  এই আন্দোলন ছিল অনিয়ন্ত্রিত।  কতকগুলো ফতোয়া মলয় সমীর শক্তি লিখেছিল।  এগুলোর নিচে অনেকের নাম বসিয়ে দেয়া হ'ত।  বহু ক্ষেত্রেই যাদের নাম দেওয়া হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাও করা হঁ'ত না।  ..... হাংরিদের সেভাবে কোন কাগজও ছিল না।  হয়ত ত্রিপুরা থেকে একটা কাগজ বেরল, নাম দিয়ে দিল ---- হাংরি জেনারেশন বুলেটিন নম্বর ১২।  হয়ত তার ১০ বা ১১ বেরোয়নি।"


আসলে, ১৯৬২-৬৩ সনে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে এই বাওয়ালমুখী পালাবদলের তীব্র চাগাড়ে দুটি প্রধান উপ-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরের বুকে।  একটি কেন্দ্রের মধ্যমণি ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং সুবো আচার্য।  অপর কেন্দ্রে ছিলেন মলয় রায়চোধুরী, সমীর রায়চোধুরী, দেবী রায় এবং সুবিমল বসাক।  উভয় কেন্দ্রের সদস্যরাই, কমবেশি, তথাকথিত ছোটলোক, গরিব আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত।  এবং প্রত্যেকের বয়স ছিল বিশ-পঁচিশের কোঠায়।  যে-বয়সে যত আলো পড়ে, তত ভয় কমে।  উপকেন্দ্র যেহেতু দুটি, সুতরাং দু-রকমের হাংরি বাওয়াল শুরু হয়েছিল।  একটা, শৈল-বাসু-সুভাষদের বস্তি-কলকাতার 'ছোটলোকি' বাওয়াল; এখানে যে-দলের নাম দেওয়া যাক হাংরি -- 'এ' গ্রূপ।  অন্যটা মলয়-সুবিমলদের ডায়াসপোরিক বাওয়াল, অর্থাৎ 'বি'-গ্রূপ।  দ্বিতীয় গ্রূপের সর্বময় কর্তা ছিলেন পাটনার ছোটলোক আর কুচেল অধ্যুষিত দরিয়াপুর মহল্লার নামচিন ষ্টুডিওঅলা রঞ্জুবাবুর ছোটছেলে বিশ বছরের ফনকু ওরফে ফনা, অথবা ইমলিতলার মুল্লু খান ওরফে মলয় রায়চোধুরী, সেটা জোরও ধরেছিল মলয়ের জোরদার ইস্তেহারি ভাষার চটকে, অপেক্ষাকৃত বেশি;  আর, তাঁদের সে-টিমও ছিল বেশ ভারি।  বহু পুরনো জ্ঞানপাপী সে-দলে ভিড়েছিল।  'এ' গ্রূপ এই 'বি' গ্রূপের নাম দিয়েছিল 'চুলকে দেওয়া হাংরি জেনারেশন'।  প্রথম গ্রূপটি মলয়কে 'মফসসলের অজ্ঞাত গাড়োল' বলেও চালাতে চেয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত।  তাঁরা, প্রত্যেকে ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মভাবে, মলয়ের বিরোধীপক্ষ।  বিশেষত আশির দশকে পুনরুত্থিত মলয়ের নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে চালানো, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাস-বিকৃতি এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রচারে দাগা পেয়েই প্রথম গ্রূপটির গোসা ধরতামাশি পেয়েছিল এবং তাঁরা পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিলেন।  সুতরাং প্রথম দলটির ঐ পাঁচ শরিক যাঁরা আন্দোলন-চলাকালীন, ষাটের দশকে যা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি, আশি ও তৎ-পরবর্তী পিরিয়ডে মলয়ের মতই, নিজেদেরকে 'হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা' হিশেবে প্রচার করা শুরু করে দেন।  দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না বলে এহেন পারস্পরিক কাদাহোলি।  আমি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুম্ভলস চাই না, অতএব কোন্দলটি এড়িয়ে যাচ্ছি।


এ-কথা ঠিক যে হাংরি কোন ইজম ছিল না।  ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া।  আরও বলতে পারি, একটা ঘটনা, বাংলাভাষায় সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি।  বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল এক ঢেউ, উঠে এসে, আছড়ে পড়েছিল এজি-গোয়িং সাহিত্যের ল্যাসলেসে মসৃণ চত্ত্বরে।  সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের লিরিকফুলের বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনো-অব্দি একলোতা বৈপ্লবিক সমীহা।
 









পি. এস. কাজল : হাংরি আন্দোলন এবং একজন হাংরি কবি

হাংরি আন্দোলন এবং একজন হাংরি কবি

আন্দোলনের  শুরু : ১৯৬১  সালের নভেম্বরের দিকে পাটনা শহর হতে এ আন্দোলন শুরু হয় । যে কবিরা এ আন্দোলন শুরু করেছিলেন তাদের মধ্যে মলয় রায় চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র , সুনিমল বসাক, শক্তি চট্রোপাধ্যায়, সমীর রায় চৌধুরী এবং বিনয় মজুমদার  ছিলেন অন্যতম । বাঙলা বা ভারতীয় ইতিহাসে ইশতেহার বিলি করে সাহিত্য আন্দোলন মনে হয় এর (হাংরি) বাইরে আর নেই । যদিও প্রথম প্রকাশিত ইশতেহারটি ইংরেজি ভাষায় করা হয়েছিল । তার কারন তৎকালে পাটনায় কোন বাংলা প্রেস ছিল না । ১৯৬১ হতে ১৯৬৪ পযর্ন্ত এ আন্দোলন বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করতে সমর্থ  হয়েছিল । বেশ কিছু বাস্তব অবস্থার কারনে সরকারের কোপানলে পড়ে এবং কয়েকজন হাংরি কবির বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ১৯৬৪ সালের পর এ আন্দোলন তার প্রকাশ্যতা হারায় ।  নকশাল বাড়ীর আনোলনের পর উত্তর বঙ্গের তরুন কবিরা এ আন্দালনকে আবার জীবন দান করার চেষ্টা করেছিলেন । কিন্তু তাত্বিক ভিত্তি না থাকায় তারা সফলতা পায় বলে অনেকে মনে করেন ।      আর এ আন্দোলকে যারা সমর্থন করতো এবং  কবিতায়- চেতনায় ধারন করতো তারা ইতিহাসে হাংরি কবি বা হাংরি জেনারেশন নামে পরিচিত ।
ছবি- হাংরি আন্দোলনের ইশতেহার-১৯৬৪
হাংরি আন্দোলন: ত্রিদিব মিত্র কবিতা

হাংরি জেনারেশন আন্দোলন: রাজসাক্ষী সুভাষ ঘোষ-এর মুচলেকা
সুভাষ ঘোষ-এর মুচলেকা:
আমার নাম সুভাষচন্দ্র ঘোষ। গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে যাতায়াত করছি। সেখানে আমার সঙ্গে এক দিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয়। সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায়। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি আন্দোলনের যে কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না। আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আমি তা আমার রুমমেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই। সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল। আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ। আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল ‘হাঁসেদের প্রতি’ প্রকাশিত হবে। আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করি না, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পর আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি।
(স্বাক্ষরের তারিখ ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ )
সুভাষ ঘোষ পরে একটি ফ্যাসিস্ট রাজনৈতিক দলে যোগ দেন, যে দলটি পশ্চিমবঙ্গ জুড়ে নারকীয় অত্যাচার চালিয়েছিল। তিনি এই দলের সদস্য হন এবং দলের রাজনৈতিক মিছিলে ও র‌্যালিতে দলের পতাকা নিয়ে ইনক্লাব জিন্দাবাদ করে বেড়াতেন। তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলন একটি প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন । তাঁর এই অধৎপতনের কারণে পরবর্তীকালে তাঁর কলম থেকে আর উল্লেখযোগ্য লেখা বেরোয়নি।
হাংরি জেনারেশন : রাজসাক্ষী শৈলেশ্বর ঘোষ-এর মুচলেকা
হাংরি জেনারেশন সাহিত্য আন্দোলনে সবচেয়ে লজ্জার ঘটনা ছিল দুই জন আন্দোলনকারীর রাজসাক্ষী হওয়া। এনারা দুইজন হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ। কেবল রাজসাক্ষী হওয়াই নয়, এনারা দুই জন মুচলেকাও লিখে দিয়েছিলেন। মলয় রায়চৌধুরীর যখন নিম্ন আদালতে একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ হল, এনাদের টিকিটিও দেখতে পাওয়া যায়নি। প্রায় দশ বছর চুপচাপ থেকে এনারা আবার উদয় হন। হাংরি জেনারেশন শব্দটি এড়িয়ে এনারা ক্ষুধার্ত নাম দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করা আরম্ভ করেন। তা এই জন্য যে মুচলেকায় তাঁরা লিখে দিয়েছিলেন যে হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ও ম্যাগাজিনের সঙ্গে তাঁদের কোনও সম্পর্ক নেই।
তারপর আটের দশকে মলয় রায়চৌধুরী পূনর্বার কবিতা লেখা আরম্ভ করলে এবং বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হতে থাকলে এনাদের মনে হয় যে তাঁদের মৌরসিপাট্টা বুঝি শেষ হতে চলল। কিন্তু পাঠকবর্গ ইতোমধ্যে তাঁদের কুকর্মের কথা জেনে গিয়েছিলেন। এনারা দুইজন বহু ছোকরাকে জুটিয়ে পুনরায় হাংরি জেনারেশনের জাওয়াজ তোলেন। পাঠক আর তাঁদের বিশ্বাস করছে না দেখে তাঁরা হাংরি জেনারেশন সংকলন বা হাংরি জেনারেশন সমগ্র ইত্যাদি নামে ঢাউস গ্রন্হাবলী বাজারে ছাড়তে আরম্ভ করেন। এই গ্রন্হগুলিতে মলয় রায়চৌধুরী তো ছিলেনই না, উপরন্তু প্রধান-প্রধান হাংরি আন্দোলনকারীদেরো পাওয়া যাবে না। ১৯৬১-এর মূল আন্দোলনকারীরা রাজসাক্ষীদের সাথে যোগাযোগ রাখতে চাননি, লেখাও দেননি। শেষ পর্যন্ত এই দুইজন বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে বিশ্বাসঘাতক প্রতিপন্ন হন যা অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় তাঁর জিজ্ঞাসা পত্রিকার সম্পাদকীয়তেও লিখেছিলেন।
বিশ্বাসঘাতক দুইজনের মুচলেকা নিম্নে দেয়া হল:
শৈলেশ্বর ঘোষ:
আমার নাম শৈলেশ্বর ঘোষ। আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড় হয়েছি বালুরঘাটে। আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাট হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি, ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে আই এস সি, ১৯৫৮ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বি এ, আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স। ১৯৬৩ সনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন। তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদে৪র সঙ্গে পরিচিত হই। আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি। গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছে কয়েকটা কবিতা চান। তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি। আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি। তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোটে দুবার কবিতা লিখেছি। মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দু তিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি। সাধারণত এই সব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত। এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না। অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয়। ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভদ্রকালীতে ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার। মাইনে পাই দু’শ দশ টাকা। বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশনার পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়, আমি এই সংস্হার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি। ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না

হত্যাকাণ্ড
ত্রিদিব মিত্র
আমাকে বারবার জীবন থেকে হড়কে জীবনের ফঁদাই পড়তে হচ্ছে
মৃত্যু কেবলই কেবলই প্রতারণা করছে আমার সঙ্গে
চারটে বাঘ আর তিনটে বুনো শুয়োরের
ধ্বস্তাধস্তি চলছে আবছা জ্যোৎস্নায়
আমার মিথ্যে জিভ থেকেই সত্যের চ্যালেঞ্জ ফঁড়ে
ঝলসা দিচ্ছে মানু-বাচ্চাদের
তাদের কান্না শুনে বধির হয়ে যাচ্ছে আমার কান
আনন্দে সাততলা অব্দি লাফিয়ে উঠছে আমার জিভ
প্রেমিকার কষ্ট দেখে আনন্দে কঁদে উঠেছিলাম আমি
চুমু খেতে গিয়ে আলজিভ শুকিয়ে আসছে আমার
চারিদিকের ভিজে স্যাঁতসেতে অন্ধকার থেকে
আমি দানব না যিশুকৃষ্ট বুঝতে না পেরে
রেস্তঁরায় ভিড় করছে মেয়েমানুষেরা
আজ আর কোনো রাস্তা খঁজে পাচ্ছে না কেউ সরলভাবে হাঁটবার
সব রাস্তাই লুটিয়ে থাকে
সব পাপোষের তলায় গড়িয়ে যায় ধুলোর ঝড়
সব জীবনের মথ্যেই ভয়ংকর কাঁপানো অর্থহীনতা শূন্যতা
আঃ মৃত্যু বাঞ্চোৎ মৃত্যু
অপমৃত্যুও ফেরার হয়ে পালাচ্ছে আমার ভয়া
কেননা আমি বুঝে গেছি মৃত্যুর দমবন্ধ ভান
কেননা আমি মৃত্যুর কাছে গিয়েছিলাম সরল চোখে
ভয়ে কঁচকে গিয়েছিল তার চোখ
অন্ধ চোখে কঁদে উঠেছিল মাথা নিচূ করে
এবং খালি হাতে নির্জন রোদে ফিরতে হল আমাকে জটিল চোখে
নিজেকে নিজের থেকেও লুকিয়ে রাখতে পারছি না আর
আমার নপুংসকতা দেখে তুমি হেসে উঠেছিলে-আমার ভালবাসা
ভয় আর ভালবাসার মধ্যে শুয়ে তুমি ফিরে গেলে ভয়ের কাছে
বঁচার তাগিদে তুমি ফিরে এলে মগজের কাছ-বরাবর
ফালতু মগজের জ্যামিতিক অঙ্ক থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলাম আমি বিশৃঙ্খলায়
সভ্যকে ঘৃণা করেও লুকিয়ে রইলে সভ্যতার কলকব্জায়
বদহজম থেকে তৈরি হল আমার বদরাগ
সমাজের ভুল চেতনা থেকে নিজেকে ঝুলিয়ে দিলাম শূন্যের বেতারে
টেলিফোনের মধ্যে দিয়ে রোজ তিন কোটি চুমু
এপার-ওপার করছে পৃথিবীময়
রেলের মোটা তার বেয়ে উড়ে যাচ্ছে ৭৪ কোটি মাছি
আমার শরীরের চারিদিকে অসংখ্য ‘টোপ’
নিজেকে ঝাঁঝরা করে জীবনের সঙ্গে মানুষের সঙ্গে
খেলতে চাইলাম চাতুরী
তোমার প্রতারণা থেকে ভালবাসা আলাদা করতে পারছি না একদম
আমি ভাবছি আমাদের প্রথম অভিসম্পাতের কথা
আমি ভাবছি আমাদের শেষ চুম্বনের কথা
আমার দিব্যজ্যোতি আমার আম্ধকার
আমার চারধারে বেইজ্জতি আর বেলেল্লাপনা বারবার
চলছে মানুষের
আমি বুঝতে পারছি মানুষ মানুষকে ভালবাসতে পারছে না
….মানুষ মানুষকে কোনোদিনই ভালবাসেনি
উঁচু বাড়ির মাথা থেকে লাফিয়ে পড়ছে হৃদয়সুদ্ধ লাশ
আমি দেখতে পাচ্ছি প্রয়োজন কিরকম মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে আকাশের দিকে
আমার ধর্ম কি মনে করতে পারছি না কোনোদিন বুঝিনি বলে
আমার শিরা থেকে রক্ত ছিনিয়ে নেবে বলে
স্হায়ী-অস্হায়ী যুদ্ধ চলছে মানুষের আগুপিছু
পাঁজর গুঁড়ো করে বেরিয়ে আসছে রজনীগন্ধার ডানা
অ্যালকহলিক রক্তের ফেনা থেকে তৈরি হচ্ছে আঁশটৈ ক্ষুরধার ভালবাসা
আমি ক্রমশ প্রেম থেকে শরীরহীনতায় ভাসছি
প্রেমিকার বেগুনি মুখ জ্বলে উঠছে ফঁসে যাচ্ছে প্রয়োজনমত
অদরকারি কাগজপত্রে ঢেলে দিচ্ছি আমার বর্তমান
কবিতা আমার বুক থেকে শুষে নিচ্ছে আমার আয়ু
আমার ভালবাসা রক্তমাংস থেকে মানুষ তৈরি করছে তাদের ফিচলেমি
অসুস্হ ভালবাসা ফিরিয়ে আনবার জন্য
মনুষ্যযন্ত্রের সঙ্গে হায় তুমিও
আমার সকল উত্তাপ জযো করে তৈরি করলাম লালগোলাপের পালক
ব্যবসায়িক উৎপাদন থেকে কুড়িয়ে নিলে তুমি একমুঠো প্রতারণা
আগুনের হল্কা চুঁড়ে দিলে আমার গায়ে
শিশুর মত হেসে উঠলাম আমি
পুড়ে গেল আমার সমস্ত শরীর
আকাশ ঘঁষে ছুটে গেল আমার ক্রোধ
স্বাধীনতার হাতে হাত রাখতে পারছে না কেউ ভয়ে
ওঃ
আমার আর সবার মাঝখানে গজিয়ে উঠছে একটা সুদীর্ঘ গভীর ফাটল
আমি বুঝতে পারছি আমার দ্বারা কিছুই হবে না
নিজেকেও তেমন করে ভালবাসা হল না আমার
এই এক জন্মেই হাঁপিয়ে উঠছি আমি
এক সঙ্গেই হাসছি আর হাসছি না
ওঃ ক্লান্তি ক্লান্তি – অক্লান্ত আওয়াজ – আঁকাবাঁকা টানেল –
লুপ – পরিসংখ্যান – ক্ষুধা – মহব্বৎ – ঘৃণা –
কেবল বোঝা বয়েই জীবন চলে যায় ১০১% লোকের
আত্মাকে খঁজে পাওয়া যাচ্ছে না সমস্ত শরীর ছেঁকেও
বিপ্লবউত্তেজনানারীসংঘর্ষহিংস্রতাবন্যনীরবতা নাচছে
আমি একবারও নিজের দিকে তাকাতে পারছি না ফিরে
মানুষের কোনো কাজই করে উঠতে পারলাম না আজ ওব্দি
ফালতু অব্যবহার্য হয়ে কুঁকড়ে শুয়ে আছি বমিওঠা চোখে
মগজে চোলাই কারবার চলছে গুপ্ত ক্ষমতার
কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে লালা ওরফে আমার ভালবাসা আমার অসহায়তা
মানুষের রক্তাক্ত পেঁজা শরীরের পাহাড় দিয়ে তৈরি হচ্ছে
অক্ষম আর আঊর্ব স্বাধীনতা
মানুষের ক্ষীণ শরীর বেয়ে শরীর ঘিরে শরীর ধরে চলেছে
অসংখ্য বিশৃঙ্খল শৃঙ্খলা
ওঃ আমি কোনো দিনই ভালবাসতে চাইনি
আঃ…………………………….আঃ
কলজে গঁড়িয়ে যায় চাপা হিংস্রতায়
বুকের ভেতর ইনজিনের চাপা ক্রোধ
রক্তের উত্তেজনে থেকে তৈরি হচ্ছে বন্যতা
অস্তিত্বহীন আত্মার পায়ে স্বেচ্ছায় প্রণাম রেখেছিল সুবো
তিন মাস জঘন্য নীরবতার পর আঁৎকে উঠে কুঁকড়ে গিয়েছিল প্রদীপ
মানুষের সাহসিকতাকে ভুল করে সন্দেহ করতে শিখেছি
ভুল জেনে ভুল মানুষের সঙ্গে মিশে
আমি চালাক হতে ভুলে যাচ্ছি স্বেচ্ছায়
ভাঁটার সঙ্গে সঙ্গে চতুরতা মূর্খতাও গড়িয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে
ত্রিদিবের মুখ ত্রিদিব নিজেই কতদিন চিনতে পারেনি
আদপে সত্য কোনো স্পষ্ট মুখ খঁজে পাচ্ছি না নিজের
“মানুষের নিজস্ব কোনো চরিত্র নেই” বলতে ককিয়ে উঠেছিল
৩৫২ কোটি মানুষ তায় ঐতিহ্য আর পোষা চরিত্রহীনতা
ওঃ অসম্ভব কষ্ট হচ্ছে এখন
কে বা কারা গলা টিপে ধরছে ভুল করে
আমার ।
তাদের অজান্তেই…
(১৯৬৩ সালে শিবপুরের পুরানো বাড়িতে থাকাকালীন রচিত, এবং মলয় রাচৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা’ পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত । )
অনেকে মনে করেন হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু বর্তমান আধুনিক কবিদের  ( সরকারি দালাল গুলোকে বাদ দিলে যারা থাকে ) লেখা কবিতা বা তাদের চিন্তা চেতনা দেখলে আমার মনে হয় না এ আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । তবে এটা ঠিক আন্দোলনের রকমেরও পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যায় নি তবে পরিবর্তন হয়েছে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনশীলতার মত । আর স্পেংলারের সংস্কৃতি সংগা বা পরিবর্তনের নিয়মকে যথার্থ  ধরলে , আমাদের বর্তমান সংস্কৃতি কি স্বাভাবিক গতিধারায় চলছে । আমাদের সংস্কৃতি কি নিজ সমাজ হতে খাদ্য বা বেচে থাকার মত উপাদা  পাচ্ছে ? উত্তর যদি হয় না তবে আমাদের সংস্কৃতি কোন পথে যাবে ?

বৃহস্পতিবার

হাংরি আন্দোলনের কবি বিনয় মজুমদার

                                                                     


‘জাগতিক সফলতা নয়, শয়নভঙ্গির মতো
অনাড়ষ্ট সহজবিকাশ সকল মানুষ চায়’

         আমার মনে হয়েছে, গাণিতিক সৌন্দর্য তত্বের ওপর বিনয় মজুমদার গড়ে তুলেছেন তাঁর  চারটি সাব-জনার ( sub-genre )-এর কবিতার বনেদ, ‘ফিরে এসো, চাকা’, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং হাসপাতালে ও শিমুলপুরে দিনযাপনের খতিয়ান ‘শিমুলপুরে লেখা কবিতা’, ‘কবিতা বুঝিনি আমি’, ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ , ‘ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য’ আর ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ । ‘ফিরে এসো, চাকা’ ছিল বাংলা সাহিত্যে ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণের সঙ্গে তুলনীয়, এবং পরবর্তী সাব-জনারগুলো প্রতিবার নতুন স্বচ্ছতা নিয়ে উদ্ভাসিত হয়েছে ।
        যিনি গণিতের  সৌন্দর্যে সমর্পিত তিনি নান্দনিক তৃপ্তি পান, গণিতের নির্দিষ্ট রূপকে সুন্দর মনে করে আনন্দ উপভোগ করেন, দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার মাঝেও তিনি হর্ষের মনন-জগতে বসবাস করেন । যাঁরা বিনয় মজুমদারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন তাঁরা জানেন যে উত্তর দেবার সময়ে তিনি হঠাৎই রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন, এবং শিমুলপুরে থাকাকালীন কয়েকটি গানও রচনা করেছিলেন ।  
         ওমর খৈয়াম ও এমিলি  ডিকিনসনও গণিতের সৌন্দর্যের বনেদে গড়ে তুলেছিলেন তাঁদের কাব্য। গণিতের সাথে কবিতা ও সঙ্গীতের, এমনকি পৃথিবীর বিভিন্ন ধর্মের আরাধ্য পুস্তকগুলোর গাণিতিক লেখনবিন্যাসে ( যেমন বাইবেল, কোরান, জেন্দাভেস্তা, গীতা, ত্রপিটক, গুরুগ্রন্হ, তোরা, তালমুদ, কিতাব-ই-আকদাস, অগমসমূহ, কোইজিকি ইত্যাদি ) পার্থক্য খুঁজে পান না গণিত ও কবিতার বিস্ময়ে আক্রান্ত বেশ কয়েকজন গণিতবিদ । কবিতা ও সঙ্গীতের মতো তাঁদের মননে গণিত অনির্বচনীয়, তা ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি ক্রিয়ায় বিদ্যমান । গাণিতিক সৌন্দর্যের বিখ্যাত উদাহরণটি হল পিথাগোরাসের  উপপাদ্যটি । বিনয় মজুমদারের সঙ্গে জীবনানন্দের প্রধান তফাত এখানেই । বিনয় দারিদ্র্য, দুঃখ, কষ্ট, অবহেলা, অসুস্হতা, নিঃসঙ্গতা সত্বেও থাকতেন আনন্দের প্রভায় জ্যোতির্ময় ।
         কবিতাকে জীবনের সঙ্গে একাত্ম করেছেন বিনয় মজুমদার । তাঁর কাছে অনেকেই জানতে চাইতেন ‘কবিতা কী?’ বিনয় ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বলেছেন, “কবিতা কী তা বলা অসম্ভব । কেন ? বলুন তো আপনি কী ? আপনি কি একশো কোটি বছর আগে থেকে পৃথিবীতে আছেন ? আপনি মরলে কি যে-কোনো অবস্হায় হোক প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকতে পারবেন ? আপনি যখন আলুডাল খান, এই আলুডাল পাকস্হলীতে গিয়ে হজম হয়ে শেষে প্রাণবন্ত মাংস হয় । তা হলে দেখা যাচ্ছে পাকস্হলীতে জড়বস্তু আলুডাল  প্রাণবন্ত হচ্ছে অর্থাৎ পাকস্হলীতে প্রাণ সৃষ্টি হচ্ছে এই তত্বে কি আপনি বিশ্বাস করতে পারেন ? যদি না পারেন তবে আপনার প্রাণ কী ? এইভাবে দেখা যাবে যে আপনি নিজের সম্বন্ধে কিছু কথা জানেন না । নিজেকেই পুরোপুরি জানেন না আপনি । তা হলে কবিতা কী তাও আপনার জানা অসম্ভব ।”
         ২০০০ সালে প্রকাশিত ডেভলিন কিথ তাঁর ‘ডু ম্যাথেমেটিশিয়ানস হ্যাভ ডিফারেন্ট ব্রেইনস’ গ্রন্হে হাঙ্গরিয় গণিতবিদ পল এরডস -এর এই উদ্ধৃতির মাধ্যমে গণিতের সঙ্গে সঙ্গীতের সম্পর্ক স্পষ্ট করেছেন : Why are numbers beautiful ? It is like asking why is Beethoven’s Ninth Symphony beautiful. If you do not see why, someone can not tell you. If they are not beautiful, nothing is.
         ১৯১৯ সালে বারট্রাণ্ড রাসেল তাঁর ‘দি স্টাডি অফ ম্যাথেম্যাটিক্স’ গ্রন্হে লিখেছিলেন : Mathematics, rightly viewed, possesses not only truth, but supreme beauty — a beauty cold and austere, like that of sculpture ; without appeal to any part of our weaker nature, without the gorgeous trappings of painting or music, yet sublimely pure, and capable of a stern perfection such as only the greatest art can show. The true spirit of delight, the exaltation, the sense of being more than Man, which is the touchstone of the highest excellence, is to be found in mathematics as surely as poetry.
         আইনস্টাইন বলেছিলেন, Pure mathematics is, in its way, the poetry of logical ideas.
         গণিত ও কবিতা উভয়েরই যে ব্যাপারে মিল আছে তা হলো ভাষার মাধ্যমে পরিমাপ ও আঙ্গিকের প্রতি তাদের নিখুঁত হবার প্রচেষ্টা ; মাত্রা বা সংখ্যানিরূপণ ; সমানতা ; ছন্দ ; প্রণালী ; পুনরাবৃত্তি ; অনুক্রম এবং পরিণতি ; পৃষ্ঠার ওপরে আঙ্গিক ও লেআউট, এবং প্রকাশের সংক্ষেপণ, ঘণীভূত করার ইন্দ্রজাল । স্বকীয় মর্মার্থ থেকে পৃথক করার জন্য শব্দ ( সংখ্যা ) ও প্রতীকের একাত্মতাকে একটি স্তরে মান্যতা দিয়ে সংখ্যাবিন্যাস অথবা বাকবিন্যাসের নিরীক্ষা করে গণিত ও কবিতা উভয়ই । জ্ঞান ও বোধ-অভিজ্ঞতার একটি আদর্শ অথচ বিমূর্ত এলাকা গড়ে তোলে উভয়ই, যেখানে সত্য ও মর্মার্থের প্রকৃতি, এবং কেমন করে তাদের সবচেয়ে ভালোভাবে প্রকাশ করা যায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে সম্পর্কায়িত করা যেতে পারে, তার অন্বেষন করে । উভয়ই কল্পনা ও আবিষ্কারের  ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ । শৈশবে অক্ষর এবং সংখ্যা শেখার উপায় হলো ছন্দের মাধ্যমে মুখস্হ করা । সেই বয়স থেকেই অক্ষর ও নামতা মনে রাখার চেষ্টা করানো হয় একই ভাবে ; তাদের জন্য রচিত কবিতাগুলো গণিত মেনে লেখা হয় যাতে তাদের মনে থাকে । চন্দন ভট্টাচার্যকে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “ছন্দে ও অন্তমিলে লিখলে সে-কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায় । কাজেই পাঠকের স্মৃতিতে কবিতা সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি।”
         বেদের শ্লোকগুলো, যা ছন্দে রচিত, তাতে গণিতের সংযোজন করেছিলেন অপস্তম্ব, বৌধায়ন, মানব, কাত্যায়ন, বরাহ, হিরণ্যকেশিন — ধর্মাচরণের বিষয়গুলো জ্যামিতিক ছক দিয়ে এবং সেগুলো  ছন্দের মাধ্যমে উপস্হাপন করেছিলেন । অশ্বমেধ-হোম-যজ্ঞ ইত্যাদির সময়ে সেই জ্যামিতিক ছকগুলো আঁকা হতো । এখনও পুরোহিতরা অনেকে পুজো, অন্নপ্রাশন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ ইত্যাদির সময়ে মাটিতে নকশা আঁকেন, জল দিয়ে, কুশকাঠি দিয়ে, বালির ওপর আঙুল দিয়ে, সিঁদুর দিয়ে । বর্তমান কালখণ্ডে পৌঁছে আমরা শূন্য ও এক-এর বাইনারি কবিতায় পৌঁছেছি । গণিতের ক্ষমতার অংশিদার হলো কবিতা, এই তর্কে যে ভাবকল্প যতো ব্যাপকই হোক না কেন, গণিত ও কবিতা তাকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র সংখ্যাপ্রণালী অথবা বাকপ্রণালীতে আঁটিয়ে দিতে পারে — এমনকি বিশাল ব্রহ্মাণ্ডকে্ অত্যন্ত ছোট ফর্মে ভরে ফেলতে পারে ।
         কিংবদন্তি অনুযায়ী ঋষি বৃহস্পতির সাতটি মুখগহ্বর থেকে সাত রকমের ছন্দ নিঃসৃত হয়েছিল, এবং প্রতিটির গণিত-কাঠামো সুস্পষ্ট । সংস্কৃত কাব্যরচনার জন্য গণিত নির্দেশিত ছিল । ছন্দের গণিত বর্ণিত আছে বেদাঙ্গতে, যথা গায়ত্রীঃছন্দ ( ৬ x ৪ ), উশ্নীঃছন্দ ( ৭ x ৪ ), অনুষ্টুভছন্দ ( ৮x ৪ ), বৃহতীঃছন্দ ( ৯x ৪ ), ত্রিষ্টুভছন্দ ( ১১x  ৪ ) ইত্যাদি । পিঙ্গলের ‘ছন্দসূত্র’ গ্রন্হে গণিতের সঙ্গে মাত্রা ও শব্দের সম্পর্কনিয়ম আলোচনা করা হয়েছে । ‘নাট্যশাস্ত্র’তে বলা হয়েছে মাত্রার গণিতবর্জিত শব্দ হয় না ; শব্দের গণিতহীন মাত্রা হয় না । ছান্দস বিষয়ে গাণিতিক নিয়মগুলি আলোচিত হয়েছে অগ্নিপূরাণ, নাট্যশাস্ত্র, বৃহৎসংহিতা ও মানসোল্লাস-এ । ‘মহাভারত’-এর ছন্দের গণিত মূলত অনুষ্টুভ ও ত্রিষ্টুভ ।
         ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ার সময়ে বিনয় মজুমদার বটানিকাল গার্ডেনে প্রায়ই যেতেন ; গঙ্গার ধারের দৃশ্যাবলী দেখতেন  । পরে যখন শিমুলপুর গ্রামে বসবাস করতে গেলেন তখন আরও কাছ থেকে প্রতিদিন পুকুরের মাছ গাছপালা ফুলফলের জন্ম ও বিকাশ দেখার অফুরন্ত সময় পেতেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে তিনি গণিতের ফিবোনাচ্চি রাশিমালার বিস্ময়কে বকুলফুল এবং বিভিন্ন গাছের শাখা-প্রশাখার প্রসারণের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন । এই রাশিমালা আবিষ্কার করেছিলেন ত্রয়োদশ শতকের গণিতবিদ ফিবোনাচ্চি, যিনি বলেছিলেন, ‘প্রকৃতির মূল রহস্য তাঁর বর্ণিত রাশিমালা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় । এই রাশিমালা শুরু হয় শূন্যতে এবং সিরিজের পরবর্তী সংখ্যাগুলো প্রতিটি তার পূর্ববর্তী দুটি সংখ্যার যোগফল । সূর্যমুখী ফুলের পাপড়িবিন্যাস, শামুকের খোলের ওপরকার ডোরা, ফুলকপির ছড়িয়ে পড়ার বিন্যাস, মৌমাছির পরিবারতন্ত্র, বিভিন্ন গাছের শাখাবিন্যাস, আনারসের বাইরের বিন্যাস ইত্যাদিতে পাওয়া যাবে প্রকৃতির এই নান্দনিক-গাণিতিক খেলা ।
         গণিতে ‘ফিবোনাচ্চি সিরিজ’ নিয়ে বিনয় এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

অনেক কিছুই তবু বিশুদ্ধ গণিতশাস্ত্র নয়
লিখিত বিশ্লিষ্টরূপ গণিতের অআকখময়
হয় না, সে-সব ক্ষেত্রে উপযুক্ত গণিতশাস্ত্রের
নির্যাস দর্শনটুকু প্রয়োগ করেই বিশ্লেষণ
করা একমাত্র পথ, গণিতশাস্ত্রীয় দর্শনের
বহির্ভূত অতিরিক্ত দর্শন সম্ভবপর নয় ।
সেহেতু ঈশ্বরী দ্যাখো গণিতের ইউনিট
পাউণ্ড সেকেণ্ড ফুট থেমে থাকে চুপে
এদের নিয়মাবদ্ধ সততা ও অসততা মনতস্ত্বে বর্তমান ইউনিটরূপে
আলোকিত করে রাখে বিশ্বের ঘটনাবলী চিন্ত্যনীয় বিষয়গুলিকে
আগামীর দিকে ।

         পোল্যাণ্ডের কবি উইসলাভা সিমবোরস্কা, যিনি ১৯৬৬ সালে কবিতায় গণিত ও জৈবজীবনের রহস্যকে একীভূত করার জন্য নোবেল প্রাইজ পেয়েছিলেন, তাঁর ‘পাই’ শিরোনামের বিখ্যাত কবিতাটি পড়লে বোঝা যাবে,  যে-কবিরা গণিতকে ভালোবাসেন তাঁদের কবিতা কীভাবে রূপায়িত হয়েছে । আমি ইংরেজি অনুবাদটিই এখানে তুলে দিচ্ছি :-

The admirable number pi
three point one four one.
All the following digits are also initial,
five nine two because it never ends.
It can not be comprehended six five three five at a glance,
eight nine by calculation,
seven nine or imagination,
not even three two three eight by wit, that is, by comparison,
four six to anything else
two six four three in the world.
The longest snake on earth calls it quits at about forty feet.
Likewise, snakes of myth and legend, though they may  hold
out a bit longer.
The pageant of digits comprising the number pi
does not stop at the page’s edge.
It goes on across the table, through the air,
over a wall, a leaf, a bird’s nest, clouds, straight into the sky,
through all the bottomless, bloated heavens.
Oh how brief — a mouse tail, a pigtail — is the tail of the comet !
How feeble the star’s ray, bent by bumping up against space !
While here we have two three fifteen three hundred nineteen
my phone number your shirt size the year
nineteen hundred and seventy-three the sixth floor
the number of inhabitants the sixty five cents
hip measurement two fingers a charade, a code,
in which we find hail to thee blithe spirit, bird thou never
were
alongside ladies and gentlemen, no cause for alarm,
as well as heaven and earth shall pass away,
but not the number pi, oh no, nothing doing,
it keeps right on with its rather remarkable five,
in uncommonly five eight,
its far from final seven,
nudging, always nudging a sluggish eternity
to continue.
         গণিতের সৌন্দর্য নিয়ে কবিতা ইউরোপ আমেরিকায় বহুকাল যাবত লেখা হচ্ছে । যেমন মারিয়ান মুর-এর ‘দি আইকোস্যাসফিয়ার’, কার্ল স্যাণ্ডবার্গের ‘অ্যারিথম্যাটিক’, ওয়ালেস স্টিভেন্সের ‘ল্যাণ্ডস্কেপ ফাইভ’, ভ্যাচেল লিন্ডসের ‘ইউক্লিড’ ইত্যাদি ।
         আল মাহমুদ যথার্থই বলেছিলেন, “বিনয় অগোছালো একজন কবি আর আমি খুব গোছানো কবি”, তিনি আশ্রয় নিয়েছেন ধর্মে, যখন কিনা বিনয় মজুমদার ধর্মকে ছোঁয়াচে-রোগের মতো পরিহার করে গণিতের আশ্রয় নিয়েছেন,  এবং গণিত যাঁরা ভালোবাসেন তাঁদের মতন বিনয় মজুমদার একজন বেপরোয়া কবি । বিনয়ের এই গাণিতিক কবিতার মতো আল মাহমুদ কোনোদিন রহস্যময় কবিতা লেখেননি, লেখা সম্ভব ছিল না তাঁর শেষ পর্যায়ের মৌলবাদী জীবন পরিসরে  । বিনয় মজুমদার লিখিত একটি গণিতাশ্রিত গান :-

একটি গান
X = 0
এবং Y = 0
বা X = 0 = Y
বা X = Y
শূন্য  0 থেকে প্রাণী X ও Y সৃষ্টি হলো
এভাবে বিশ্ব সৃষ্টি শুরু হয়েছিল ।

এবং একটি গাণিতিক কবিতা :-
X, Y ও  Z
দুটো ভ্যারিয়েবল X ও  Y
X ও Y থেকে তৃতীয় একটি ভ্যারিয়েবল বানাতে চাই
আমরা । তৃতীয় ভ্যারিয়েবল ‘Z’  সহজেই বানানো যায়
ক্যালকুলাসের দ্বারা ।
একমাত্র ঐ ক্যালকুলাসের জন্যই ময়ূরীর সন্তান আরেকটি
ময়ূরীই হয় — ডিম থেকে ময়ূর হয়, তারপরে
‘Z’ হয় ।  Y আর X
Y ইজ আ ফাংশন অফ X
ঠিক ডিমটাও হয় সেইরকম । ডিমের ভিতরে
‘Y’- ও আছে ‘X’ -ও আছে । সুতরাং ‘Z’ সহজেই
হয় Y নতুবা X -এর মতন হয়ে । ময়ূরীর ডিম
তার ভিতরে ময়ূরীও আছে ময়ূরও আছে ।
সুতরাং ডেরিভেটিভ হয় ময়ূর হবে নয়তো ময়ূরী হবে ।

         বিনয় লিখেছেন, এবং এখানে সত্য কথাটার ওপর আমি জোর দিতে চাই :-

ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি ।
যে-কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায় ।
         
         বিনয় মজুমদারের চিন্তার গাণিতিক ব্যাপ্তি, ১৪১৩ সালে ‘অউম’ পত্রিকায় দেয়া সাক্ষাৎকার যা বলেছিলেন, তা থেকে স্পষ্ট হবে, “তোমরা মহাগ্রন্হ শুনেছ কি ? পড়েছ কি ? জানো কি ? পৃথিবীর যত বই আছে, সব বই মিলে আসলে একখানি বই । তারই নাম মহাগ্রন্হ । এই মহাগ্রন্হ নিজের প্রয়োজনে বাড়ে । ঠিক আমগাছের মতো বাড়ে মহাগ্রন্হের শাখা-প্রশাখা । মহাগ্রন্হ এখনই বেড়ে যাচ্ছে, এই কলমের মুখ দিয়ে এই মুহূর্তে মহাগ্রন্হ বৃদ্ধি পাচ্ছে । বর্তমান পাঠক যা পড়তে পড়তে টের পাবেন । এবং এই যে পৃথিবীর যেখানে যত লোকই, এখন যারা লিখছে — সবার হাত দিয়েই মহাগ্রন্হ বেড়ে চলেছে । রসায়নশাস্ত্র, উড়োজাহাজ বানাবার বিদ্যা, লোকেদের লেখা চিঠি, ভূগোল, জ্যোতির্বিদ্যা — এইরূপ অসংখ্য বিষয়ে বর্তমান মুহূর্তে লেখা হচ্ছে, এ সবগুলিই একখানি মহাগ্রন্হের বৃদ্ধিমাত্র । যেমন আমগাছের ডাল একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে, তেমনি মহাগ্রন্হ একসঙ্গে অনেক গজায় এবং বাড়ে ।

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতায় বিনয় এই একই গাণিতিক ব্যাপ্তি লক্ষ্য করেছেন দর্শনে । তিনি বলেছেন :-

দর্শনের জগতেও নানা পরিবার আছে, অগণন পরিবার আছে
সে-সকল পরিবারে — আলাদা যে কোনো পরিবারে সবার চেহারা
চরিত্র ইত্যাদি প্রায় একরকমের হয়, তাই এত পরিবার হয়
এমন পরিবারের কারো সাথে কথা বলে নিতে গিয়ে যদি তাকে
পাওয়া নাই যায় তবে সেই পরিবারভূক্ত — একই পরিবারভূক্ত কারো
অন্য কারো কাছে সেই কথা বলে আসা যায় একই আলোচনা করা যায়;
তাতে খুব অসুবিধা হয় না, হয়তো বেশি সুবিধাও হয়ে যেতে পারে ।

         ‘লোক’ পত্রিকার জন্য ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীম বিনয় মজুমদারের যে সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, তাতে ছন্দ সম্পর্কে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :
         প্রশ্ন : আপনি তো পয়ারেই কবিতা লিখলেন সারা জীবন । পয়ারেই কি আপনি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন?
         বিনয় : এখন আর পয়ারে লিখি না তো । হ্যাঁ, অধিকাংশই, সেই ১৯৬০ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯৫ পর্যন্ত পয়ারেই লিখে গেছি । একটানা । তবে আমার পয়ারে তফাত আছে, অন্য পয়ারের মতো না । তফাতটা আমি বলছি ; শোনো, এটা হচ্ছে সংস্কৃত পয়ার, ছন্দিত সংস্কৃত ছন্দ আসলে । আর পয়ার ছন্দ বললাম দুটো । কিন্তু কর্কশ ছন্দ ছিল । সেটা মন্দাক্রান্তা ছন্দ । ওই মন্দাক্রান্তা ছন্দটা হচ্ছে মেঘদূতের ছন্দ । ছন্দটাকে ভেঙে আমি এমন বানালাম যে, পয়ার ছন্দটা খুব মিষ্ট হয়ে গেল । পয়ার ছন্দটাকে আমি মিষ্ট বানালাম নানান কাণ্ড করে । ‘আমার ছন্দ’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছি আমি । সম্পাদক রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় তার পত্রিকায় ছাপিয়েছে ।
         প্রশ্ন : পরে সেটা বই হয়ে বেরিয়েছে ।
         বিনয় : কোন বইতে যেন ?
         প্রশ্ন : ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ ও অন্যান্য’ বইতে ।
         বিনয় : হ্যাঁ, প্রতিভাস থেকে বেরিয়েছে । সেই বইতে ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধটি আছে । ‘আমার ছন্দ’ প্রবন্ধে পয়ার ছন্দে কীভাবে লিখেছি, পয়ার ছন্দটাকে আমি কীভাবে নিজস্ব পদ্ধতিতে নিয়ে এসেছি সেটা বিশদভাবে লিখেছি, খুবই বিশদভাবে লিখেছি । গাণিতিক ছবি-টবি দিয়ে খুবই সুন্দরভাবে লিখেছি । তারপরে পয়ারটা খুব মিষ্ট ছন্দ হয়ে গেল । এ জন্য পয়ারেই, যেহেতু আমি পয়ারেই ওইরকমের মিষ্ট পয়ার লেখা আবিষ্কার করলাম ; সেই হেতু ঠিক করলাম যে আমি এর পরে শুধু পয়ারেই লিখব, আর কোনও ছন্দে নয় ।
         ‘ঈশ্বরীর স্বরচিত নিবন্ধ’ বইটিতে বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “রূপ থেকে অরূপে আসা, আবার অরূপ থেকে রূপে ফিরে যাওয়া, রূপের সহিত অরূপের পারস্পরিক সম্পর্কে — এ সকল বিষয় অত্যন্ত মূল্যবান । গণিতশাস্ত্রেও ঠিক এই । একই ব্যাপার ঘটে । কোনো রূপের নির্যাসরূপে থিওরেম বা ফর্মুলা তৈরি করা হয় । অতঃপর সেই থিওরেম বা ফর্মুলা থেকে যত খুশি রূপ ফিরে পাওয়া যায়, যত খুশি রূপের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় । এই অর্থে –’এই করেছ ভালো,নিঠুর, এই করেছ ভালো…’ কবিতাটি একটি ফর্মুলা — জীবন ফর্মুলা ।”
         বিনয় মজুমদার রবীন্দ্রনাথের এই গানটিকে ফর্মুলা বলায়, অনুমান করা যায়, হয়তো, তিনি নিজের জীবনের ক্ষেত্রেই এই ফর্মুলাটিকে রূপায়িত হতে দেখলেন, যেমনটা রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দ নিজেদের জীবনের ক্ষেত্রে দেখেছিলেন ।

দুই
         উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে ব্রিটিশ সরকার, নিজেদের নিয়ন্ত্রণ তদানীন্তন বর্মায়, বর্তমানে মিয়ানমারে, প্রসারণ ঘটালে, নিজেদের সঙ্গে বহু বঙ্গভাষীকে টেনে নিয়ে যায়, প্রধানত সরকারি চাকরিতে ইংরেজির ব্যবহারে দক্ষ ঔপনিবেশিক শিক্ষায় সড়গড় কেরানি এবং জঙ্গলগুলো থেকে সেগুন ও অন্যান্য কাঠ কেটে সেগুলো রপ্তানির কাজে লাগাবার জন্য, স্বাস্হ্যবান চাষিদের তুলে নিয়ে যায়, যারা কালক্রমে বন্দরশহর রেঙ্গুন বা য়াঙ্গন,এবং প্রাকৃতিক জঙ্গলে ঘেরা মান্দালয়ে বসতি স্হাপন করে । সেসময়ে নিন্মবর্ণের চাষিদের নমঃশুদ্র বলা হতো না, বলা হতো চণ্ডাল, উচ্চবর্ণের বাঙালিরা যাদের সংস্পর্শ থেকে দূরে থাকতো, তাঁরা ছিলেন চতুর্বর্ণের বাইরে একটি অস্পৃশ্য বর্ণ । তখনকার পূর্ববঙ্গে চণ্ডাল বিদ্রোহের চাপে ১৯০১ এর আদমশুমারিতে ব্রিটিশ সরকার চণ্ডাল বর্গের পরিবারদের নমঃশুদ্র হিসাবে চিহ্ণিত করার হুকুম জারি করেছিল । বিনয় মজুমদারের বাবা ব্রিটিশ ভারতের পি ডাবলিউ ডিতে চাকরি করতেন এবং সেই সূত্রে মিয়ানমারে পোস্টেড ছিলেন । বিনয় মজুমদারের বয়স যখন সাড়ে সাত বছর তখন তাঁরা মিয়ানমার ত্যাগ করে স্বদেশে ফিরতে বাধ্য হন ।
         পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন যে বিনয় মজুমদারের জীবন ও সাহিত্যে অবদান আলোচনা করতে বসে চণ্ডাল ও নমঃশুদ্রের প্রসঙ্গ কেন তুলছি । তার কারণ দুটি । প্রথম হলো এই যে ইরেজরা মিয়ানমারের জঙ্গলের গাছকাটার জন্য এবং ধান চাষের জন্য প্রধানত বাঙালি নমঃশুদ্রদের ও অবাঙালি অন্ত্যজদের তুলে নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক যেভাবে তারা ওয়েস্ট ইন্ডিজ, ফিজি, মরিশাস ও লাতিন আমেরিকায় ভারতীয়দের জোর করে বা ফুসলিয়ে কায়িক শ্রমের জন্য তুলে নিয়ে গিয়েছিল । দ্বিতীয় কারণ হলো বিনয় মজুমদারের কবিতায় তাঁর চণ্ডাল বা নমঃশুদ্র হবার কথা বেশ কয়েকবার এসেছে । সম্ভবত তিনি আঁচ করেছিলেন, যে তাঁর চেয়ে কম প্রতিভাবান উচ্চবর্ণের কবিদের ওপর প্রতিষ্ঠান আলো ফেললেও তাঁকে রেখে দিয়েছে অন্ধকারে । তাঁর অসুস্হতার সংবাদ প্রচারের পরও তাঁর কবিতায় এই প্রসঙ্গটি এনেছেন তিনি, এবং রামায়ণ রচয়িতা বাল্মীকি সম্পর্কে দুর্বলতার উৎসও হয়তো তাঁর জন্মসূত্রের এই বোধ, আমার মনে হয়, কেননা সাধনা করার পর নারদ বাল্মীকিকে ঋষি ও ব্রাহ্মণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিলেন, যদিও বিনয় বলেছেন যে ‘বাল্মীকি’ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বলে তাঁর একটি বিতর্কিত বইয়ের নাম ‘বাল্মীকির কবিতা’ ।
        সেই সময়ের মিয়ানমারে নিম্নবর্গের ভারতীয়দের বলা হতো ‘কা-লা’ অথবা ‘কা-লার’, তাদের ত্বক কৃষ্ণবর্ণের বলে। নিজের দেহত্বক সম্পর্কে সেনসিটিভ ছিলেন বিনয়, তিনি লিখেছেন, “সত্যব্রতর বাবাকে আমি দেখেছি/সত্যব্রতর বাবা-ই তখন রাজা/রাজা বলে যে দুধের মতন সাদা গায়ের রঙ তা নয়/প্রায় আমার মতনই গায়ের রঙ।” উল্লেখ্য যে বিনয় মজুমদার সম্পর্কে পশ্চিমবাংলায় যাঁরা কাজ করেছেন, তাঁদের বেশির ভাগই নিম্নবর্গের ।
        বাংলাদেশের একটি পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীম, অমলেন্দু বিশ্বাস, মানসী কীর্তনীয়া এবং মানসী সরকারকে ২০০১ সালে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এই ধরণের প্রশ্নোত্তর হয়েছিল:-
         প্রশ্ন : আপনার পাণ্ডুলিপিখানা এখানে ছাপানোর ব্যবস্হা না করে ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের মিউজিয়ামে পাঠানোর উদ্দেশ্য কী ? এখানে কি কোনও রহস্য আছে ? কোনও গোপন ব্যাপার না থাকলে খুলে বলুন ।
         বিনয় : মূল উদ্দেশ্য — নমঃশূদ্র । আসল কথা হচ্ছে এটা । নমঃশূদ্র সমাজে তখন কবি বলে কেউ ছিল না । আমি প্রথম নমঃশূদ্র কবি । আমার কবিতা লিখতে বহু কষ্ট করতে হয়েছে । বহু অবহেলা সইতে হয়েছে । আমার বই কেউ ছাপতো না । প্রথম ছাপল মীনাক্ষী দত্ত, তার মানে জ্যোতির্ময় দত্তর বউ অর্থাৎ বুদ্ধদেব বসুর মেয়ে — ১৯৬৮ সালে । টাকা দিয়েছে মীনাক্ষী দত্ত নিজে । অথচ ‘ফিরে এসো, চাকা’ প্রথম ছাপা হয় ১৯৬২ সালে । তারপর, সেই নমঃশূদ্র বলে তো এখনও অবহেলা সইতে হচ্ছে ।
        প্রশ্ন : সেটা কি কবি-সাহিত্যিকদের কাছ থেকেও ?
        বিনয় : কবিদের কাছ থেকে, খবরের কাগজের কাছ থেকে, পত্রিকার কাছ থেকে, প্রকাশকের কাছ থেকে, অনুবাদকের কাছ থেকে, সমস্ত । দেখলাম ভেবে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’টাকে বাঁচাতে হয় । আমার নিজের টাকায় তো ছাপা সম্ভব না । এত বড় বই, টাকা পাব কোথায় ? আমার চাকরি তো নেই । সুতরাং পাঠিয়ে দিলাম ব্রিটিশ মিউজিয়ামে । থাকুক ওদের কাছে । ওদের কাছে থাকলে তবু একটা সান্ত্বনা থাকবে যে — আছে ।
        বিনয় মজুমদারের দুটি রচনা আমার চোখে পড়েছে, হয়তো আরও কয়েক জায়গায় লিখে থাকবেন মনের কথা, অভিমানের কথা, প্রথম কবিতাটিতে উচ্চবর্ণের কবিরা, যাঁরা তাঁকে সাংস্কৃতিক রাজনীতির মাধ্যমে কোনঠাশা করে দিয়েছিল, তাঁদের তিনি বলছেন নাপিত, যে কবিরা শরীরের চুল কামিয়ে দ্যায় এবং চুগলি করে বেড়ায় । দ্বিতীয় কবিতাটি লেখার সময়ে তাঁর মনে যে মাইকেলের উক্তি বিঁধেছিল, তা প্রকাশ হয়ে পড়ে, নয়তো সাধারণ পাঠকরা মধুসূদনের লাইন তিনটি মনে রাখবেন না  ।

নাপিত বনাম নমঃশুদ্র
নাপিত উপরে নাকি নমঃশুদ্র সম্প্রদায় উপরে — এ কথা
যখন আলোচ্য হল তখন কেবলমাত্র এই বললাম
সাহিত্য দিয়েও নয়, গোপাল ভাঁড়ের গল্প দিয়ে
নয়, রাজনীতি দিয়ে ভাবো । কতজন মন্ত্রী হয়েছে এ
নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ে — তাই দিয়ে ভাবো ।
নাপিতদের কেউ মন্ত্রী হতে পারেনি তো আর
বহু নমঃশুদ্র মন্ত্রী হয়েছে তো এ যাবৎ গুনে গুনে দ্যাখো ।
এই রাজনীতি দিয়ে বোঝা যায় নমঃশুদ্র সম্প্রদায় নাপিতের উপরেই ঠিক ।
                      ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য [ ২০০৭ ] বই থেকে )

সত্যব্রত ও আমি
কবি মধুসূদন দত্তের কবিতা :
         ‘চণ্ডালে বসাও আনি রাজার আলয়ে ।
         কিন্তু নহি গঞ্জি তেমা, গুরুজন তুমি
         পিতৃতুল্য, ছাড় দ্বার, যাব অস্ত্রাগারে…’
মধুসূদন দত্ত এই কবিতা লেখার শ-খানেক বছর পরে
মৈমনসিংহের রাজা সত্যব্রত চৌধুরী এবং চণ্ডাল আমি
এক ঘরের ভিতরে দুই বছর ছিলাম — ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ।
এইসব আমি ভাবি এবং অবাক হয়ে যাই ।
সত্যব্রত ব্রেকফাস্ট খায় FIRPO হোটেলে ।
এবং বর্তমানে ৭২ বছর বয়সে চা খাই তা সিনেমায়
তুলে নিয়ে গেছে ঢাকার মুসলমানরা । আমি
FIRPO রেস্তোঁরায় একবারই ব্রেকফাস্ট খেয়েছিলাম
সত্যব্রতর সঙ্গে ।
                      ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য [২০০৭ ] বই থেকে )

          বিনয় যখন প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তেন তখন সত্যব্রত চৌধুরী নামে তাঁর এক সহপাঠী ছিল । সত্যব্রতর বাবা ছিলেম ময়মনসিংহের জমিদার । সত্যব্রতর দাদা শ্রীপতি চৌধুরী ছিলেন সিনেমার হিরো । কবি বিমল চন্দ্র ঘোষ তখন সিনেমার গান লিখতেন । সত্যব্রত চৌধুরী বিনয়কে বিমলচন্দ্র ঘোষের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দ্যান । বিমলচন্দ্র ঘোষ, বিনয় জানিয়েছেন, থাকতেন যদু ভট্টাচার্য লেনে এবং শীত গ্রীষ্ম যাই হোক, লেপ গায়ে দিয়ে শুয়ে থাকতেন । পাশে একটা বিরাট আকারের অ্যাশট্রে । তাতে অজস্র ক্যাপস্ট্যান সিগারেটের টুকরো । উনি বিনয়কে বলেছিলেন, তোমার কবিতা আমাকে দেখাবে তো । তখন প্রত্যেক রবিবার বিনয় যেতেন বিমলচন্দ্র ঘোষের বাড়ি । বিমলচন্দ্র ঘোষ কয়েকটা কবিতা প্রকাশ করেছিলেন ‘বারোমাস’ পত্রিকায় । বিমলচন্দ্র ঘোষের আগে রমাপদ চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছিলেন বিনয় । কবিতার খাতা দিয়ে এসেছিলেন । রমাপদ চৌধুরী তখন ‘ইদানিং’ নামে একটা পত্রিকা বার করতেন ।  রমাপদ চৌধুরী কয়েকদিন খাতাটা রেখে বিনয়কে ফেরত দিয়ে বলেছিলেন, তুমি লিখে যাও, লিখে যাও ।
         বন্ধু মনোজ বিশ্বাসকে বিনয় মজুমদার একবার বলেছিলেন, “জানিস, মজুমদার পদবিটা নবাব-বাদশার কাছ থেকে পাওয়া যেতো । আমার মনে হয় ওরা যদি বুদ্ধি করে মজুমদার না দিয়ে, মজুতদার দিতো, তাহলে খুব মানানসই হতো — বিনয় মজুতদার । কি রে, মজুতদার দিলে ভালো হতো না ? দেখ না, কতো যন্ত্রণা, কষ্ট, নিঃসঙ্গতা, ব্যথা সব একটা খাঁচার মধ্যে মজুত করে বসে আছি !”
         দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপানিরা মিয়ানমার আক্রমণ করলে আরও বহু বাঙালি পরিবারের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের বাবা বিপিনবিহারি মজুমদার ( বিনয়ের মায়ের নাম বিনোদিনী, ঠাকুরনগরের শিমুলপুর গ্রামে তাঁদের বাড়িটির নাম ‘বিনোদিনী কুঠি’  ) ছয় ছেলে-মেয়ে নিয়ে ফিরে এসে বর্তমান বাংলাদেশে ঢাকা ডিভিশনের গোপালগঞ্জ উপজেলার ( সে সময়ের ফরিদপুর জেলা ) বৌলতলিতে তাঁদের আদি নিবাসে বসবাস আরম্ভ করেন । বিনয়ের ঠাকুর্দার নাম নিমচাঁদ । বিনয়ের বাবা মারা গেছেন ৯৩ বছর বয়সে, ১৯৮৪ সালের ৪ঠা জুলাই । তাঁর ছয় মাস আগে মা মারা যান ।
         বেশির ভাগ বাঙালি যুদ্ধের সময়ে মিয়ানমার থেকে পায়ে হেঁটে বর্তমান বাংলাদেশে ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে  পৌঁছে ছিলেন । বিপিনবিহারি মজুমদারও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে পায়ে হেঁটে নিজেদের গ্রামে পৌঁছেছিলেন । বাংলাদেশের উপরোক্ত পত্রিকায় সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের বিনয় বলেছিলেন যে, “পাহাড় দিয়ে আমি হেঁটেছি যুদ্ধের সময় । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ১৯৪২ সালে আমি নাগা খাসিয়া পাহাড়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে ফিরেছি।” অতো দীর্ঘ পথ সাড়ে সাত বছরের বালকের পক্ষে পায়ে হেঁটে অতিক্রম করা সম্ভব ছিল না । একজন নাগা শ্রমিকের পিঠের ঝুড়িতে বসে বিনয়কে অনেকটা পথ পেরোতে হয়েছিল । তার স্মৃতিতে তিনি এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

একটি নাগার কথা
একটি নাগার কথা মনে এল কেন যে হঠাৎ।
চা বাগানে মহিলারা যেমন ঝুড়িটি পরে, ফিতে
কপালে ঝুলিয়ে নিয়ে, তেমনি একটি ঝুড়ি পরে
সেই ঝুড়িটির ‘পরে আমাকে বসিয়ে সেই নাগা
হেঁটে হেঁটে আসছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে ।
তার মানে নাগাটির পিঠে ঝুড়ি, ঝুড়ির উপরে আমি বসা,
ঝুড়িটি তো ঝুলছিল নাগার
কপাল থেকে ফিতের সাহায্যে তাই মনে পড়ে গেল ।
এভাবে আমাকে বয়ে আনছিল উনিশ’শ বিয়াল্লিশ সালে ।
                                                ( শিমুলপুরে লেখা কবিতা – ২০০৫ )
         বিনয়ের ভাই-বোনদের সম্পর্কে বিশদ তথ্য সংগ্রহ করতে পারিনি, তাঁর এক প্রয়াত  অগ্রজ অনিল মজুমদার-এর তথ্য ছাড়া, যিনি মধ্যমগ্রামের হৃদয়পুরে বসবাস করতেন, এবং সম্ভবত মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায়, অর্থাৎ স্কিৎসোফ্রেনিয়ায়, আক্রান্ত হন । মেজো ভাই সুনীল কোথায় থাকতেন জানি না। দূর সম্পর্কের অথবা পরিচিত এক দিদি হাবড়ায় থাকতেন, এবং বিনয় মজুমদারের মৃত্যুর পর দিদির ছেলে উত্তম বিশ্বাস বিনয় মজুমদারের রচনাগুলো প্রকাশের দিকে খেয়াল রেখেছেন । পারিবারিক তথ্য প্রয়োজন এই জন্য যে মধ্যবয়সে তাঁদের পরিবারে অন্যান্য  সদস্য ও আগের প্রজন্মের সদস্যরা অপ্রকৃতিস্হতা্য ভুগেছিলেন কিনা, কেননা আমার এক কাকা এবং মেজ জ্যাঠা মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায় আক্রান্ত হন, আমার ঠাকুর্দার ছোটো ভাইও মধ্যবয়সে অপ্রকৃতিস্হতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
         অপ্রকৃতিস্হ বলতে আমি পাগল বলছি না, অসংলগ্ন কথাবার্তা বা আচরণের কথা বলছি, স্কিৎসোফ্রেনিয়ার কথা বলছি । মস্তিষ্কের রোগ আর জিনগত রোগের মধ্যে পার্থক্য আছে । জিনগত রোগ সারাবার জন্য জিন এডিটিং অথবা জিন থেরাপি করতে হয়, যা আমাদের দেশে এখনও এসে পৌঁছোয়নি । তা সম্ভব না হলে পরিবারের সদস্যদের মাঝে বসবাস থেরাপির কাজ করে । স্কিৎসোফ্রেনিয়া মূলত একটি জিনগত রোগ, এই জিনগত রোগ হোমো স্যাপিয়েনদের দেহে প্রবেশ করেছিল বহুকাল আগে, প্রাগৈতিহাসিক যুগে,, যখন তাদের সঙ্গে নেয়ানডারথালদের সম্পর্ক ঘটে । বাংলাভাষায়, আমাদের দুর্ভাগ্য যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখলেই তাকে পাগল বা ক্ষ্যাপা বলে চালিয়ে দেয়া হয় । ‘পাগল’ ছাড়া আর কোনো শব্দই নেই ।
         স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত বিদেশি কবি ও শিল্পীদের কথা আমরা জানি, যেমন আঁতোয়াঁ আর্তো, কনস্ট্যানটিন বাতিয়ুশনভ, রিচার্ড ব্রটিগান, ভিক্টর হিউগোর মেয়ে আদেলে হিউগো, ফিনল্যাণ্ডের কবি ইউনো কাইলাস, রাশিয়ার ব্যালে নর্তক ভাসলাভ নিজিন্সকি, লর্ড বায়রন, ডিলান টমাস, পাবলো পিকাসো, নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত গণিতজ্ঞ জন ন্যাশ যাঁর জীবনকাহিনি নিয়ে ‘এ বিউটিফুল মাইন্ড’ নামের একটি ফিল্ম হয়েছিল । আর বলা বাহুল্য ভ্যান গগ । মধ্যবয়স থেকে এই বিকলনের কারণে পিকাসো অতিযৌনতায় আক্রান্ত হয়েছিলেন ।
         পশ্চিমবাংলায় ঋত্বিক ঘটক, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, রামকিঙ্কর বেইজ মানসিক বিকলনে আক্রান্ত হয়েছিলেন । মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও চিকিৎসা করিয়েছেন লুম্বিনি পার্ক মানসিক চিকিৎসালয়ে । তাঁরা স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন না । তারাপীঠের বামাক্ষ্যাপার আচরণকে আমরা মনে করি সাধকের স্বাভাবিক দিনানুদৈনিক ব্যাপার, দাহরত শবের মাংসভক্ষণকে কেউই মস্তিষ্কবিকৃতি বলে মনে করেননি । রামপ্রসাদ সেন গঙ্গায় গলা পর্যন্ত জলে দাঁড়িয়ে শ্যামাসঙ্গীত গাইতেন, হিসেবের খাতায় শ্যামাসঙ্গীত লিখতেন, আমরা কখনও ভাবিনি যে তাঁকে ইলেকট্রিক শক দিতে হবে । তার কারণ প্রাগাধুনিক কালখণ্ডে সাধকদের সেই কাজগুলোকে আমরা স্বাভাবিক মনে করতুম । অঘোরী এবং তান্ত্রিকদেরও বঙ্গসমাজে পাগল বলা হতো না । বিনয় মজুমদারকে বার বার পাগল বলা হয়েছে বলে তিনি অপমানিত, আহত ও বিরক্ত বোধ করতেন ।
         বিনয় মজুমদারদের পারিবারিক পদবি ছিল মৃধা, এবং বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলায় তাঁদের গ্রামের বাড়িকে গ্রামবাসীরা মৃধাবাড়ি নামে চিনতো । ব্রিটিশ পি ডাবলিউ ডিতে চাকরি পাবার সময়ে বিনয়ের বাবা মৃধা পদবি ত্যাগ করে নবাবি আমলে পাওয়া মজুমদার পদবি নিয়েছিলেন । অবিভক্ত বাংলায় ফিরে  ১৯৪২ সালে বিনয় মজুমদার গোপালগঞ্জ সদর উপজেলার বৌলতলির তারাইল পাঠশালায় ভর্তি হন । ১৯৪৪ সালে ছাত্রবৃত্তি পরীক্ষায় প্রথম হবার পর তাঁকে ভর্তি করা হয় ফরিদপুর হাই ইংলিশ স্কুলে । তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল স্কুলের ম্যাগাজিনে । কিন্তু বৌলতলিতে বেশিদিন বসবাস করা সম্ভব হয়নি । সুরাবর্দির ডায়রেক্ট অ্যাকশান ডের আহ্বানে হিন্দু ও মুসমান সম্প্রদায়ের মাঝে বহুকালের যে সম্পর্ক ছিল তা ভেঙে পড়া আরম্ভ হয়, ক্রমশ বৌলতলিতেও হিন্দুদের ওপর অত্যাচার আরম্ভ হলে অন্যান্য গ্রামবাসীদের সঙ্গে ১৯৪৮ সালে বিপিনবিহারী মজুমদারও ছেলে-মেয়েদের নিয়ে হিন্দু উদ্বাস্তুদের সঙ্গে কলকাতায় চলে আসেন, কলকাতার উপকন্ঠে ঠাকুরনগরের শিমুলতলা গ্রামে চাষের জমিজমা কিনে বসবাস আরম্ভ করেন ।
         ভারতে চলে এসে বিপিনবিহারী মজুমদার বুদ্ধিমানের কাজ করেছিলেন । গত বছরে, মানে ২০১৬ সালে, আমরা দেখেছি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নমঃশুদ্র সম্প্রদায়ের পরিবারদের ওপর আক্রমণ হয়েছিল,  আর দুর্গাপুজো-কালীপুজোর সময়ে তাঁদের উৎসব ভণ্ডুল করে দিয়ে মূর্তিগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছিল । তা সত্ত্বেও সেখানকার নামকরা কবি-লেখকরা সরকারি খুদকুঁড়ো পাবার আশায় মুখ খোলেননি । দেশভাগের আগে পূর্ববঙ্গের উচ্চবর্গের হিন্দু কমিউনিস্ট নেতারা দেশভাগ সমর্থন করেছিলেন । দেশভাগ হতেই সবচেয়ে আগে পালিয়ে আসেন তাঁরা, সেখানকার নিম্নবর্ণ হিন্দুদের দিশেহারা করে দিয়ে, আর পশ্চিমবঙ্গে এসে সাম্যবাদের নামে গদি দখল করে বসেন । নমঃশুদ্র জনগণকে পূর্ব পাকিস্তানে ধরে রাখার জন্য জিন্নাহ যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে মন্ত্রীত্ব দিয়েছিলেন । যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের আশ্বাসে বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের পরিবার থেকে গিয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে । যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যিনি নিজেও নমঃশুদ্র ছিলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত করাচিতে বসবাস করে পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের ওপর অত্যাচারের ঘটনা সহ্য করতে না পেরে ভারতে পালিয়ে আসেন, এবং লিয়াকত আলি খানকে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে দেন ।
         বিনয় মজুমদার জন্মেছিলেন মিয়ানমারের মেকটিলা অঞ্চলের তেডো শহরে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩৪, অর্থাৎ, দেশভাগজনিত সাম্প্রদায়িক বিভাজনে বৌলতলীর দাঙ্গায় ভিটা ছাড়ার  সময়ে তাঁর বয়স ছিল চৌদ্দ বছর । মিয়ানমার ছাড়ার সময়ে তাঁর বয়স ছিল সাড়ে সাত বছর । যুদ্ধ ও দাঙ্গায় আক্রান্ত বিপুল সংখ্যক মানুষের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে দেশ থেকে দেশান্তর ও স্হান থেকে স্হানান্তর, এই  বিপর্যস্ত জীবন কাটানোর দুঃসহ ঘটনাবলী বিনয় মজুমদারের শৈশব-কৈশোরের চেতনায় গভীর প্রভাব ফেলে থাকবে । স্কিৎসোফ্রেনিয়ার দুটি উৎসের কথা বলেছেন মনোবিদরা, পারিপার্শ্বিক ঘটনাবলীর প্রভাবে স্কিৎসিফ্রেনিয়া জিনের প্রাণবন্ত হয়ে ওঠা,  এবং বংশপরম্পরায় পাওয়া জিন যা যৌবনে দেখা দেয়। মিয়ানমার থেকে পলায়ন, দেশভাগজনিত দাঙ্গার প্রভাব কিশোর বিনয়ের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করেছিল নিঃসন্দেহে, এবং আমার মনে হয়, বংশের জিনগত প্রভাবও ছিল, কেননা বিনয়ের মৃত্যুর আগের দিন তাঁর মধ্যমগ্রাম নিবাসী দাদা অনিলবরণ মজুমদারকে ‘কবিতীর্থ’ সম্পাদক উৎপল ভট্টাচার্য ফোনে মৃত্যুশয্যায় বিনয়ের শারীরিক অবস্হা জানানো সত্বেও তিনি কোনো আগ্রহ দেখাননি ; বরং বিরক্ত বোধ করেন তাঁকে জানাবার জন্য ।

তিন
         ১৯৮২ সালে সমর তালুকদারকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছেন যে, “আমার বাবা ১৯৪৮ সালে এখানে ( শিমুলপুর ) এসে প্রায় এগারো বিঘার মতন জমি কিনে এই ছোট্ট বাড়িটা তেরি করেন । তখন এক বিঘা জমির দাম ছিল পঞ্চাশ টাকা । এখানে ঠাকুরনগর স্টেশানটি হয়েছে প্রাক্তন এম. পি. ঠাকুরবাবুর প্রচেষ্টায় । লোকও বেড়েছে অনেক । স্টেশনের কল্যাণে এখন জমির দাম কুড়ি হাজার টাকা বিঘা । এই তো, সেদিন বাবা দু’বিঘা জমি বিক্রি করে দিলেন ।”
         ১৯৪৯ সালে তাঁকে, বিনয় মজুমদারকে, কলকাতার মেট্রোপলিটান ইন্সটিটিউটের বউবাজার শাখায় ক্লাস নাইনে ভর্তি করা হয়েছিল। ১৯৫১ সালে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে আই এস সি তে ভর্তি হন । সেই ব্যাচের ছাত্রদের মধ্যে গণিতে সর্বোচ্চ নম্বর পান । এর পর বিনয় মজুমদার শিবপুরের বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ১৯৫৭ সালে মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিঙে স্নাতক হন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম । ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের তিনি ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি । ইঞ্জিনিয়ার হবার পর কিছুকাল চাকরি করেন ইনডিয়ান ইন্সটিউট অফ পাবলিক হেল্হ দপতরে, ইনডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইন্সটিউটে,   অধ্যাপনা করেন ত্রিপুরা গভর্নমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে, এবং ইঞ্জিয়ারের চাকরি করেন দুর্গাপুর স্টিল প্ল্যান্টে ।
         কলকাতার সাহিত্যিকদের সঙ্গে যোগাযোগের অভাবের কারণে এবং কবিতা রচনায় একাগ্র হতে চাইছিলেন বলে  চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে কলকাতা ফিরে আসেন। অবশ্য চাকুরিস্হলে তাঁর সহকর্মীরা তাঁর সঙ্গে ভালো ব্যবহার করতেন না, সেটাও একটা কারণ । মারুফ হোসেনকে ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “১৯৫৭ সালে আমি ছাত্রাবস্হায় কিছু যন্ত্রপাতি আবিষ্কার করেছিলাম । সে সময়ে আমার সহপাঠী ও শিক্ষকেরা যে ব্যবহার করলেন আমার সঙ্গে তা ভোলবার নয় । তারপর চাকরি করলাম সেখানেও সহকর্মীরা আমার সঙ্গে যা ব্যবহার করলেন চাকরি ছেড়ে দিলাম । তখন মনে হল জীবনে একবার মাছের মতো শ্বাস নিতে জলের ওপরে উঠেছিলাম ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে । ইঞ্জিনিয়ারিঙে রেকর্ডস মার্কস পেয়ে ।”
          তারপর থেকে তিনি নিজের জীবনকে নিজের ইচ্ছামতো পরিচালিত করেছেন, তাঁর কবিতার স্পেকট্রাম বিশাল হয়ে ওঠে, গণিতবিদ রামানুজম এবং সুফি সন্তের চরিত্রের মিশেলে যে ধরণের প্রতিস্ব গড়ে উঠতে পারে, বিনয় পেয়েছিলেন সেরকমই প্রতিস্ব । এই বিশাল পরিধিতে ধরে রাখা জ্ঞান ও কবিত্বের সময়ানুগ বাঁকবদলগুলো তাঁকে বাংলা কবিতার বোধিবৃক্ষ করে তুলেছে । বলা যায় যে জীবনানন্দের পর তিনি বাংলা কবিতার প্রধান বাঁকবদলকারী কবি । বিনয় জীবনানন্দের মতন কবিতার একটি জনারেই আটক থাকেননি । চারটি বিভিন্ন সাব-জনারে  ( sub-genre ) কাজ করেছেন, এবং তৃতীয়টি দুঃসাহসিক কাজ, বলা যায় মধ্যবিত্ত ডিসকোর্সকে ফাটিয়ে চৌচির করে দিয়েছেন ‘বাল্মীকির কবিতা’ নামের কাব্যগ্রন্হের সাব-জনারে। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ কাব্যগ্রন্হের জনার থেকে বেরিয়ে যেতে চাননি, সারা জীবন তাতেই নিজেকে আটক রেখেছিলেন ।
         বিনয় মজুমদার প্রায় প্রতিটি সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে তিনি চাকরি ছেড়ে কবিতা লেখা আরম্ভ করেন বন্ধুদের কথায় — শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তারাপদ রায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, দীপক মজুমদার, শরৎ মুখোপাধ্যায়, শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখের কথায় । অথচ বিনয় যখন ঠাকুরনগরে নিষ্কপর্দক অবস্হায় জীবন কাটাচ্ছেন তখন তাঁর বন্ধুরা প্রতিষ্ঠিত, এবং ইচ্ছা করলেই বিনয়কে দিয়ে কোথাও অর্থকরী লেখালিখির ব্যবস্হা করে দিতে পারতেন । ২০০১ সালে শামীমুল হক শামীমকে বিনয় বলেছিলেন, “চাকরি না করে আমি ছিলামও বটে । ওরা চাঁদা তোলা শুরু করল বটে এবং দিয়েও ছিল বছরখানেক, বছর দেড়েক । তারপরে কিন্তু চাঁদা দেওয়া বন্ধ করে দিল । আমি অত্যন্ত, অতিশয় কষ্টে, দিন কাটিয়েছি তারপর । ১৯৬৪ সালের পরে ১৯৭০ সালে আমি আমার বাবার কাছে এখানে চলে আসি । ছয় বছর আমি অত্যন্ত টাকার অভাবে ভুগেছি । টাকার অভাব দেখে বাবা আমাকে ১০০ টাকা করে দিত । আমি প্রতি মাসে পয়লা তারিখে শিমুলপুর এসে টাকা নিয়ে চলে যেতাম কলকাতায় । কলকাতায় ঘর ভাড়া করে ছিলাম।”
         বিনয় মজুমদার সম্পর্কে তাঁর সমসাময়িক কবিদের আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গী ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় প্রকাশিত সমর তালুকদারের ১৯৮২ সালের এই কটি কথা থেকে টের পাওয়া যায়, যা সমরবাবু বিনয়ের সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে লিখেছেন : “কফিহাউসের টেবিলে এক সন্ধ্যায় হঠাৎ হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে বসলেন শ্রীঅমিতাভ দাশগুপ্ত, বসেই চিৎকার করে হাসতে শুরু করে দিলেন, সে হাসি থামতেই চায় না — আমরা যারা টেবিলে ছিলাম ভেবে নিলাম বোধহয় ক্লাবে ( খালাসিটোলায় ) প্রচুর হয়েছে । হাসি থামতে বললেন, ‘তোমরা শালারা একেবারেই অপদার্থ। কলকাতায় কী ঘটছে কিছুরই খবর রাখো না ।’ সত্তরের দশক — বড়-বড় চোখ করে ওঁর দিকে চেয়ে থাকলুম দুরুদুরু বুকে — এবার কে গেল ? কোন শ্রেণিশত্রু ! অমিতাভ বললেন, ‘বিনয়দা এ-যাত্রা বেঁচে গেলেন — গোবরা মানসিক হাসপাতালে আছেন — স্নানটা অন্তত করছেন নিয়মিত — খাওয়া দাওয়াও মন্দ করছেন না । বেশিরভাগ একা-একাই থাকেন, আর কী সব নাকি বিড়বিড় করে বলেই চলেন অনবরত । শুনেছি পাশের ঘরে এসে জুটেছিলেন ঋত্বিক ঘটক । বাংলা মদের সাপলাইয়ের কোনও অভাব ছিল না । এ যেন একটা এক্সকারশান । ওখানেই ঋত্বিক শেষ করেছেন তাঁর ‘জ্বালা’ নাটক, অভিনয়ও হয়ে গেছে ওই গোবরাতেই — প্রধান ভূমিকায় বিনয় মজুমদার ।”
         পরে ঋত্বিক ঘটক বলেছিলেন, “আমি সাম্প্রতিক কালের এক কবির সম্পর্কে আস্হা রাখি, যিনি কবিতার জন্য যথার্থ জন্মেছেন । আমার মনে হয় এ-কালে বাংলাদেশে এতোবড় শুভবুদ্ধি সম্পন্ন কবি আর জন্মাননি । তিনি হলেন বিনয় মজুমদার।” প্রৌঢ় বয়সে বিনয়ের স্মৃতি থেকে ঋত্বিক ঘটক মুছে গিয়েছিলেন ; বিনয় বলেছিলেন, ঋত্বিকের সম্পর্কে তাঁর কিছুই মনে নেই ।
         আমরা যারা সেই সময়ের অমিতাভ দাশগুপ্তকে খালাসিটোলায় মাতাল অবস্হায় উল্টোপাল্টা আচরণ করতে দেখেছি, বলতুম যে উনি হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিলিপি । সেই সময়ে কলকাতায় মধ্যবিত্ত কমিউনিস্টদের বাংলা মদ অর্থাৎ শ্রমজীবিদের পানীয় খেয়ে বিশেষ বুদ্ধিজীবি প্রমাণ করার চল ছিল । তাছাড়া বুদ্ধদেব বসু বাঙালি লেখকদের বদলেয়ার, হেনরি মিলার, অ্যালেন গিন্সবার্গ প্রমুখের জীবন ও কাজের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর অনেকেই এই বিদেশি কবি-লেখকদের জীবনকে আত্মস্হ করার প্রয়াস করেছিলেন সেসময়ে, মদের জমঘট এবং যৌনপল্লীতে সমবেত হইচইয়ের মাধ্যমে ।   
         বস্তুত বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো,চাকা’ ছিল বাংলা কবিতার জগতে, আগেই বলিছি, ক্যামব্রিয়ান বিস্ফোরণ; ওই কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলোর পাশে পঞ্চাশ দশকের কবিদের কাজগুলো জোলো হয়ে যাচ্ছিল, একমাত্র শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের ‘হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য’ ছাড়া । শক্তির ছন্দময় অথচ দুর্বোধ্য কবিতার তুলনায় বিনয়ের কবিতা তরুণ কবিদের কাছে সহজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠেছিল, তার কারণ তাঁর কবিতার ক্ল্যারিটি এবং অসাধারণ রূপকল্প । ফলে বিনয়ের বিরোধিদের সংখ্যা এবং ক্ষতিকারক লবি বেড়ে উঠতে সময় লাগেনি । বিনয়ের কবিতার উচ্ছ্বসিত বিশ্লেষণ  করে জ্যোতির্ময় দত্ত ‘দি স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লেখার পর বিরোধিরা আরও বেশি বিনয়-নিন্দা আরম্ভ করে দিয়েছিল । ‘দি স্টেটসম্যান’ সংবাদপত্র সেসময়ে বর্তমানকালের আনন্দবাজারের চেয়ে বেশি নজরকাড়া প্ল্যাটফর্ম ছিল । সমসাময়িকদের কার্যকলাপে বিনয়ের ক্রুদ্ধ ও অপমানিত হওয়া স্বাভাবিক ছিল, বিভিন্ন টেবিলে গিয়ে তিনি গালমন্দ করতেন । একদিন তিনি কফিহাউসের এক বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন বেয়ারাদের অভিযোগের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার হন আর কুড়ি দিনের জেল-হাজতবাস করতে হয় । সেসময়ে গুজব ছিল যে তাঁর সমসাময়িক কয়েকজন কবি তাঁকে উসকেছিলেন।
         কলকাতার বিরক্তিকর পরিবেশ থেকে মুক্তি পাবার জন্য বিনয় মজুমদার ১৯৬৬ সালে পায়ে হেঁটে বনগাঁ সীমান্ত পেরিয়ে চলে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান, ফরিদপুরের নিজেদের গ্রাম তারাইলে, তখন তাঁর বত্রিশ বছর বয়স । গ্রামে গিয়ে আত্মীয় আর পরিচিত লোকজন পেয়ে গেলেন । সেখানকার  যুবকেরা দিব্বি তাঁর আদর আপ্যায়ন করল । ভোরবেলা একজনকে ইংরেজি পড়াতেন, দুপুরবেলায় শেখাতেন অঙ্ক। আর রাত্রিবেলা চার-পাঁচজনকে পড়াতেন — ক খ গ ঘ থেকে শুরু করে ক্লাস নাইনের পড়া পর্যন্ত । বাকি সময়টা আড্ডা মেরে বেড়াতেন । থাকা খাওয়া আর সিগারেটের বিনিময়ে । কলকাতা ছেড়ে সেখানে বেশিদিন থাকতে ভালো লাগলো না । একদিন স্হানীয় থানায় গিয়ে জানালেন যে তিনি অনধিকার প্রবেশকারী ভারতীয় নাগরিক, বিনা পাসপোর্ট-ভিসায় পাকিস্তানে প্রবেশ করেছেন, তাঁকে যেন ভারতে ফিরে যেতে বলা না হয়, যদি দরকার হয়, তিনি মুসলমান হয়ে যেতে রাজি, তিনি মুসলমান হয়েই তাঁর গ্রামে থাকবেন যেখানে তাঁর বাবা-মা জন্মেছিলেন, তাঁকে যেন ভারতে পাঠানো না হয় ।
         বিনয় জানিয়েছেন, “ঢাকা থেকে গোয়েন্দা এলো । আমাকে বলল, কবিতা লেখেন নাকি ? কাগজ দিচ্ছি, লিখুন দেখি কী কবিতা লেখেন । ফোটো তুললো আমার । সামনে, দুই পাশে, চুল দাড়িসহ, চুলদাড়ি কামিয়ে ইত্যাদি নানাভাবে ফোটোতোলা হল।” বিচারাধীন আসামি হিসাবে ছ’মাস জুডিশিয়াল কাস্টডিতে থাকার পর তাঁকে বেকসুর মুক্তি দেয়া হয় । সেই অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে বিনয় বলেছেন, “আমাদের হাজতের চেয়ে ওদের হাজত অনেক ভালো । লোকগুলো ভদ্র, খাওয়াদাওয়া ভালো । সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো কী জানো, যত্ন করে বেশ কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে দিলে, সঙ্গে দু’পাশে দু’জন এসকর্ট, যারা আমাকে সীমান্ত অব্দি পৌঁছে দিয়েছিল ।”
         শামীমুল হক শামীম বিনয়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “হঠাৎ মুসলমান হবার আকাঙ্খা জাগল কেন ?” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “তখন এত কষ্টের ভিতরে চলছিল অবস্হা হিন্দুদের নির্যাতনে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যাওয়ার যোগাড় । তখন আমি পালিয়ে চলে গেলাম ফরিদপুর । বাল্যকালের বন্ধবান্ধবদের সঙ্গে দেখা । আমি বললাম মুসলমান হব । আমাকে তোমরা তোমাদের ধর্মে নিয়ে নাও । তারপর তারা বহু ভেবে বলল — তোমাকে আমরা মুসলমান করব না, তুমি হিন্দুই থাক । তোমাকে আমরা মুসলমান করতে রাজি নই ।”
         পরে, ১৯৯৮ সালে ধর্ম নিয়ে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লেখেন ( ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ কাব্যগ্রন্হের অন্তর্ভূক্ত ।

এই এক
এই এক গুপ্ত রোগ পৃথিবীর সবার হয়েছে ।
যদিও গোপন খুব, তবুও সংবাদপত্রে মাঝে-মাঝে ছাপে —
এসব রোগের কথা নিক্তি অনুসারে
ছাপা হয়ে যায় দেখি । আড়াই হাজার বছর
আগের ডাক্তার বুদ্ধ কিছু কিছু ওষুধ বলেছে–
সে-সব ওষুধে কিন্তু মায়ামৃত সুফল ফলেনি ।
আরেক ডাক্তার ছিল হজরত মোহম্মদ, তার
কথামতো ওঠে বসে রোগীগণ, তবু
রোগ তো সারে না, আরো বেড়ে যায়, দেখি
সীমান্তেও গুলিগোলা অল্প স্বল্প বিনিময় হয় ।

         বিনয় মজুমদারের নিজের কলমেই পড়া যাক কবিতার বিশ্বে তাঁর প্রবেশের কথা : “কৈশোর থেকেই আমি কবিতা লিখতে শুরু করি । প্রথম কবিতা যখন লিখি তখন আমার বয়স তেরো বছর । নানা কারণে সেই ঘটনাটা আমার স্পষ্ট মনে আছে । কবিতাটির বিষয়বস্তু ছিল এই : এক পালোয়ান বাজি ধরে একটি চলন্ত মোটরগাড়িকে টেনে পেছিয়ে নিয়ে এলো । এর পরেও আমি মাঝে-মাঝে কবিতা লিখতাম । কিন্তু ষোলো-সতেরো বছর বয়স পর্যন্ত কী লিখেছিলাম, কবিতাগুলির দশা কী হয়েছিল কিছুই এখন আর মনে নেই । তখন কলকাতার স্কুলে পড়ি । মাস্টারমশাইরা ঘোষণা করলেন যে স্কুলের একটা ম্যাগাজিন বেরোবে । ছাত্রদের কাছে লেখা চাইলেন । আমি একটা কবিতা লিখে ফেললাম ; তার একটা পংক্তি এখনও মনে আছে — ‘ভিজে ভারি হলো বেপথু যুথীর পুষ্পসার’ । মাস্টারমশাইয়ের হাতে নিয়ে দিলাম । তিনি পড়ে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন । কিন্তু কী জানি কেন, শেষ পর্যন্ত সে ম্যাগাজিন আর বেরোলো না । এর পরবর্তী সময়কার কবিতা লেখার ব্যাপার একটু বিশদ ভাবেই আমার মনে আছে । স্কুল ছেড়ে কলেজে এসে ভর্তি হলাম এবং আমার কবিতা লেখার পরিমাণও কিছু বাড়লো । আমার একটি খাতা ছিল । ডবল ক্রাউন সাইজের চামড়ায় বাঁধানো, কাগজের রঙ ইঁটের রঙের মতো । খাতাটি খুব মোটা । আমার সব লেখাই এই খাতায় লিখতাম । স্কুলে কবিতা লিখতাম কচিৎ-কদাচিৎ । কিন্তু কলেজে উঠে নিয়মিত লিখতে শুরু করি । লিখতাম বেশ গোপনে-গোপনে, যাতে কেউ টের না পায় । কারণ আমি কবিতা লিখি  — একথা কেউ বললে খুব লজ্জা হতো আমার । কলেজের হোস্টেলে থাকতাম । ফলে অন্যান্য আবাসিকরা শীঘ্রই জেনে ফেললো যে আমি কবিতা লিখি । আমার ঘরে দুটি সিট ছিল । আমার রুমমেটই বোধহয় ফাঁস করে দিয়েছিল খবরটা । আমাদের রান্নাঘরের দেওয়ালে একটা নোটিসবোর্ড টাঙানো ছিল । হোস্টেল কর্তৃপক্ষের নোটিসগুলি ঐ বোর্ডে আঠা দিয়ে সেঁটে লাগানো হতো । কিছু দিনের ভেতরেই ঐ নোটিশবোর্ডে আমার লেখা কবিতাও সেঁটে দিতে লাগলাম — সবগুলিরই বিষয়বস্তু হোস্টলের খাবার দাবার সম্বন্ধে ছাত্রদের অভিযোগ । সবই হোস্টেলের সহকারী সুপারিনটেনডেন্ট সম্পর্কে লেখা ব্যঙ্গ কবিতা । পড়ে ছাত্ররা কিংবা সুপারিনটেনডেন্ট যে প্রশংসা করতো তা নয় । ডালে কেন ডাল প্রায় থাকেই না, কেবল জল, মাংস কেন ঘন ঘন খেতে দেওয়া হয় না — এই সবই ছিল নোটিশবোর্ডে সাঁটা কবিতার বিষয়বস্তু । কলেজে একটা দেওয়াল পত্রিকাও ছিল । খুব সুন্দর হাতের লেখায় শোভিত হয়ে পত্রিকাটি নিয়মিত বেরোতো । আমার লেখা কবিতা কিন্তু কখনও এ-দেওয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত হয়নি । সেই সময় আমার সব কবিতায় মিল থাকতো । মিলগুলি অনায়াসে মন থেকে বেরিয়ে আসতো । তার জন্য একটুও ভাবতে হতো না । কবিতা যখন লিখতাম তখন মনে হতো আগে থাকতে মুখস্হ করা কবিতা লিখে যাচ্ছি, এতো দ্রুত গতিতে লিখতে পারতাম । এক পয়ার ভিন্ন অন্য সব ছন্দেই লিখতাম । কবিতাগুলোর বিষয়বস্তু ছিল বিচিত্র, প্রায় সবই কাল্পনিক । দু’একটা বিষয়বস্তু অবশ্য আমার এখনও মনে আছে — চিল্কা হ্রদের ধারে এক সঙ্গিনীসহ বসে বসে চারিপাশে নিসর্গকে দেখছি বা এক সঙ্গিনীসহ মোটরগাড়িতে করে খুব দ্রুত বেগে চলেছি, মনে হচ্ছে গাড়িটা পৃথিবীর এক উপগ্রহ বিশেষ বা ট্রেনে করে দৈনিক লক্ষ লক্ষ কেরানি কী ভাবে চাকুরি করতে কলকাতায় আসে ইত্যাদি ইত্যাদি । সেই সময়ে লেখা কবিতাগুলো খুব দীর্ঘ হতো । ছোটো কবিতা আমি প্রায় লিখতে পারতাম না । এবার একটু আগের কথা লিখে নিই । আমি যখন দশম শ্রেণিতে পড়ি, মনে হচ্ছে, তখনই সিগনেট বুক শপ নামক দোকানটি সবে খুললো । তখন দোকানের মালিক দিলীপবাবু নিজেই দোকানে বসে বই বিক্রি করতেন । কী করে যে তাঁর সঙ্গে আলাপ হলো ঠিক মনে নেই । আমি তখন দৈনিকই ঐ দোকানের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতাম । বোধ হয় বই কিনতে গিয়েই আলাপটা হয়ে থাকবে । আমি প্রায় দৈনিক একখানা করে কবিতার বই তাঁর কাছ থেকে কিনতাম । রবীন্দ্রোত্তর যুগের বাছা বাছা কবিদের বই অনেক কিনে ফেললাম, পড়েও ফেললাম সব । অথচ কোনো কারণে সেই বইগুলি মনে বিশেষ সাড়া জাগাতো না । বয়স কম বলেই হয়তো অমন হতো । যাই হোক, ইংরেজি ক্লাসিকাল কবিদের বই আমি প্রায়শই লাইব্রেরি থেকে এনে পড়তাম । সেই বয়সে তাদের কবিতা আমার ততো ভালো লাগতো না । আবার মনে হচ্ছে বয়স কম বলে অমন হতো — একথা বোধহয় ঠিক লিখিনি । কারন তখন রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির মধ্যে আমার ভালো লেগেছিল ‘প্রান্তিক’ নামক ছোটো বইখানি । এখনও আমার ঐ বইখানি সবচেয়ে ভালো লাগে । বয়স বাড়ার ফলে আমার সে অল্প বয়সের ভালো লাগা পাল্টায়নি । যা হোক আমি নিজে কী লিখতাম সেইটেই এ প্রবন্ধের বিষয়বস্তু । বিষয়বস্তু লিখেই মনে পড়লো কবিতা লেখার অন্যতম প্রধান ব্যাপার হচ্ছে একটি ভালো বিষয়বস্তু মনে আসা । তখনকার বিষয়বস্তু ছিল অধিকাংশ কাল্পনিক একথা আগেই লিখেছি । শহরের দৃশ্যাবলী — পথ ঘাট মাঠ বাড়ি — এসকল আমার কবিতার বিষয়বস্তুতে আসতো না । মাঝে-মাঝে গ্রামে আসতাম । গ্রামের দৃশ্যাবলীও আমার বিষয়বস্তু হতো না । অর্থাৎ কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি সেই বয়সেই লিখতে পারতাম না । এতোদিন পরে এখন কিছু কিছু লিখতে পারি । এ প্রসঙ্গে পরে আবার আসবো । ইতিমধ্যে কলেজ পালটে অন্য এক কলেজে চলে যেতে হলো । সেখানে বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশুনা করতে হতো । সেখানে কলেজের পড়াশুনায় এতো বেশি সময় দিতে হতো যে অন্য কোনো বিষয়ে মনোনিবেশ করার সময় পাওয়া যেতো না । ফলে বছর দুয়েক আমার কবিতা লেখা বন্ধ থাকলো । গঙ্গার ধারে কলেজ, পাশেই বোটানিক গার্ডেন । নদীর পাড়ে বিরাট কাঠগোলা । আন্দামান থেকে জলপথে নিয়ে আসা বিশাল বিশাল সব কাঠের গুঁড়িতে নদীর পাড় ঢাকা। সেখান থেকে গঙ্গার দৃশ্য অপূর্ব । কেবল বর্ণনামূলক কবিতা আমি তখনও লিখতে শিখিনি । ফলে সেই কলেজে থাকাটা আমার কাব্যচর্চার ভিতরে বিশেষ স্হান পায়নি । সেই কলেজে ছিলাম চার বছর ছাত্রাবাসে । তার প্রথম দু’বছর কবিতা লেখার সময়ই পাইনি । শেষ দু’বছর কিছু কিছু সময় পেতাম এবং মাঝে মাঝে লিখতাম । কাপড়ে বাঁধানো রয়াল সাইজের একটা প্রকাণ্ড ডায়েরি আমি যোগাড় করেছিলাম। মিল দিতে বিশেষ বেগ পেতে হতো না । মিল যেন আপনিই এসে যেতো । এই কলেজে আসার পর আমি পয়ারে লেখার চেষ্টা করতাম । কিন্তু দুঃখের বিষয় নির্ভুল পয়ার আমি একবারও লিখতে পারতাম না। কোথায় ভুল হচ্ছে সেটি স্পষ্ট টের পেতাম । কিন্তু সে ভুল শোধরাবার উপায় খুঁজে পেতাম না । তখন থেকে শুরু করে চার বছর লেগেছিল আমার পয়ার লেখা শিখতে । এবং ১৯৬০ সালের শুরুতে আমি পয়ার লেখার নিখুঁত পদ্ধতি আবিষ্কার করি । তারপর পয়ার ভিন্ন অন্য কোনো ছন্দে লিখিইনি । এখন পয়ারই  আমার প্রিয়তম ছন্দ । শুধু পয়ারেই লিখি । নানা কারণে এখন আমার মনে হয় কেউ নিখুঁত পয়ার লিখতে পারলেই তাকে কবি বলে স্বীকার করা যায়, স্বীকার করা উচিত । যাই হোক, সেই বয়সের কথায় ফিরে যাই। আমাদের কলেজ থেকে ছাত্রদের সম্পাদনায় একটা বার্ষিক সাহিত্য সংকলন বেরোতো । তাতে আমার লেখা কবিতা চেয়ে নিতো । গোটা কয়েক কবিতা ছেপেছিল । এই কলেজে পাঠকালে লেখা কবিতায় কাটাকুটি আবির্ভূত হয় । আগে কাটাকুটি করার বিশেষ দরকার হতো না । এবার দরকার হতে লাগলো । কবিতায় অলঙ্কার বলতে আগে দিতাম শুধু উপমা । এবার কবিতায় উপমার সঙ্গে সঙ্গে প্রতীকও ব্যবহার করতে লাগলাম । সে সময়কার কবিতার খাতাগুলি আমি সব হারিয়ে ফেলেছি । আমার যতোদূর মনে পড়ে ঐ কলেজে চার বছরব্যাপী পড়ার সময়ে আমি গোটা পঞ্চাশ কবিতা লিখেছিলাম । শুধু যে সময়াভাব এর জন্য দায়ী তা নয় । কাব্যিক বিষয়বস্তুর অভাবও এর জন্য দায়ী । অনেক পরে আমি যে কোনো বিষয়বস্তু নিয়ে কবিতা লেখার পদ্ধতি আবিষ্কার করি । অনেক পরে শক্তি চট্টোপাধ্যায় আমার বইয়ের এক সমালোচনায় লিখেছিলো, আমি যে কোনো বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে পারি, এমনকি ‘গু-গোবর’ নিয়েও আমি সার্থক কবিতা লিখতে পারি । কিন্তু তখনও অবস্হা অমন হয়নি । সেই কলেজে পাঠকালে ভাবলাম কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক, আর কিছু বিষয়বস্তু কাব্যিক নয় । এখন আমার মনে হয়, ব্যাপারটা তেমন নয় । সব বিষয়বস্তুই কাব্যিক এবং যার দৃষ্টিতে এই কাব্যিকতা ধরা পড়ে, তিনিই কবি । এমনকি চিন্তা করার নির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে, যে পদ্ধতিতে ভাবলে কাব্যিকতা বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয় । বিষয়বস্তুর মধ্যে কাব্যিকতা লুকিয়ে থাকে, তাকে বের করার জন্য চিন্তার সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে । এসব কথা আমি টের পাই, বুঝতে পারি, ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের গোড়া থেকে । তার আগে জানতাম না । যাই হোক, ১৯৫৭-ও শেষ হলো, আমার কলেজে পড়াও শেষ হলো । পঠদ্দশা শেষ হয়ে গেল । কলেজের ছাত্রাবাস ত্যাগ করে আমি শেষ অবধি কলকাতায় চলে এলাম । এই সময় কুশল মিত্র নামে এক কবির সঙ্গে আমার আলাপ হয় । তার কবিতার বই তখন সবে বেরিয়েছে । যেদিন বেরোলো সেদিন তিনি বললেন, চলুন মিষ্টির দোকানে, আপনাকে মিষ্টি খাওয়াই । এই বইয়ের প্রকাশক দেবকুমার বসুর সঙ্গে আমাকে আলাপ করিয়ে দিলেন । অধুনালুপ্ত ‘গ্রন্হজগৎ’ দোকানটি ছিল দেবকুমার বসুর । আমি মাঝে মাঝে দেবকুমার বসুর দোকানে গিয়ে বসে থাকতাম । আমি স্হির করলাম আমারও একখানি বই প্রকাশ করা দরকার । কলকাতায় তখন নিজেকে একেবারে নবাগতর মতন মনে হতে লাগলো । কফির আসরে, আড্ডাখানাগুলিতে, আমি যেতাম আমার অফিস ছুটি হলে পর । দেখতাম আলোচনার বিষয় সর্বত্রই সাহিত্য এবং রাজনীতি । অথচ বাংলা সাহিত্যের খবর আমি তখন রাখতাম না । রাখার সুযোগই হয়নি ইতিপূর্বে । ফলে আলোচনায় যোগদান করা আমার হতো না । চুপচাপ বসে শুনতাম কে কী বলে । তারপর ভাবলাম আর কিছু না হোক লোকজনের সঙ্গে মেশার জন্যই তখনকার কাব্যসাহিত্য কিছু পড়া ভালো । ফলে কিছু পড়াশুনা শুরু করলাম । এই সময় ‘দিগদর্শন’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদকের সঙ্গে আমার জানাশোনা হয় । তিনি আমার কাছ থেকে কিছু অনুবাদ চেয়ে নিয়ে তাঁর পত্রিকায় প্রকাশ করলেন । আনুবাদগুলি কবিতার নয়, গদ্যের । এই সময়ে মোহিত চট্টোপাধ্যায় ও অমিতাভ চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । ওঁরা তখন কবিরূপে অল্পপরিচিত । মোহিতবাবু তখন এম. এ. পড়তেন । আমি তখন সাহিত্য বিষয়ে আলোচনায় মোটামুটি যোগদান করতে শিখছি । আমার কোনো কবিতা আমি কোনো পত্রিকায় পাঠাতাম না । আপন মনে লিখে খাতাতেই রেখে দিতাম । দেবকুমার বসু আমার কবিতার বই প্রকাশ করতে রাজি হলেন । আমি তখন আমার পুরোনো কবিতার খাতা ফের পড়তে লাগলাম । পড়ে মনে হলো, গোটা পঞ্চাশ কবিতার মধ্যে কবিতাপদবাচ্য বলা যায় গোটা পাঁচেককে । মনটা খুব দমে গেলো । তখন নতুন কিছু কবিতা লিখতে গেলাম । সব পয়ারে । বাছাই ইত্যাদি করে অতো ছোটো একখানি পুস্তিকা প্রকাশ করা যায় বলে দেখা গেল । দেবকুমারবাবু অতি সজ্জন । তিনি বললেন, চলুন দেবুদার কাছে, মলাট আঁকিয়ে নিয়ে আসি । চললাম তাঁর সাথে দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের বাড়িতে, বেলেঘাটায় । কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মুড়ি খেতে খেতে তিনি একটা ছবি এঁকে দিলেন । অতি সুন্দর হলো দেখতে । বই ছাপা হয়ে বেরোলো । মোট ষাট পাউন্ড অ্যান্টিক কাগজে ছাপা । জানাশোনা লোকেদের কয়েকজনকে দিলাম পড়তে । কিন্তু কেউ আমার কবিতা সম্বন্ধে উচ্চবাচ্য শুরু করলো না, প্রশংসাও করলো না । দেবকুমারবাবু নিশ্চয়ই সাময়িক পত্রিকায় দিয়েছিলেন । কেউ ভালো করে রিভিউ করলো না । সব চুপচাপ, যেন আমার বই প্রকাশিত হয়নি । এ-বইয়ের নাম ‘নক্ষত্রের আলোয়’ । দেবকুমার বাবুর মাধ্যমে আমার বহু তরুণ কবির সঙ্গে আলাপ হয় । তাঁরাও আমার বই সম্পর্কে কোনো আলোচনা করতেন না । তবে এটা ঠিক যে লক্ষ্য করে পড়ে দেখতাম অন্যান্য তরুণ কবির লেখা থেকে আমার কবিতা ভিন্ন প্রকারের, একই রকম নয় । আমার কবিতা বেশ পুরোনো ধাঁচের, সেগুলিকে ঠিক আধুনিক কবিতা বলা চলে না । এই সময় কবি বিষ্ণু দের সঙ্গে আমার আলাপ হয় । কী করে হয়েছিল এখন আর তা মনে নেই । মোট কথা মাঝে মাঝে সন্ধ্যার সময়ে তাঁর বাড়িতে যেতাম । কোনো কোনো দিন কবিতার খাতা নিয়ে যেতাম । তিনি খাতা পড়ার জন্য রেখে দিতেন । তৎকালে ‘সাহিত্যপত্র’ নামে একটি পত্রিকা বেরোতো বিষ্ণুবাবুর তত্বাবধানে । ঐ ‘সাহিত্যপত্রে’ আমার একটি কি দুটি কবিতা তিনি ছেপে দিয়েছিলেন । ‘নক্ষত্রের আলোয়’ বইখানা পাঠক-সমালোচক মহলে সমাদৃত না হওয়ায়  আমি খুব ভাবিত হয়ে পড়লাম । অন্যান্য তরুণ কবির ঢঙে লেখা তো আর চাইলেই হয়ে ওঠে না । ফলে এরূপ চিন্তা আমি করতাম না । কলকাতার কোনো লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যোগাযোগ তো দূরের কথা, জানাশোনাই ছিল না । আমার বয়স তখন তেইশ-চব্বিশ । ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ । এসময়ে লেখা আমার কবিতা বর্জন করে মন খুব বিষময় । এই ভেবে ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ চলে গেলো । ১৯৫৯ খ্রিস্টাব্দটি চাকুরি না করে শুয়ে শুয়েই কাটিয়ে দিলাম । এই সময় প্রচুর বিদেশি সাহিত্য পাঠ করি । ধীরে ধীরে আমার মনে কবিতা রচনার একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতি আবির্ভূত হয় । এই ১৯৫৯ সালে আমায় বেশ কিছু অনুবাদ করতে হয় । পাইকপাড়া থেকে ‘বক্তব্য’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো । সম্পাদক ছিলেন বিমান সিংহ । আমি থাকতাম গ্রামে ; আমার গ্রামের ঠিকানায় তিনি প্রায়ই চিঠি দিতেন অনুবাদ কবিতা প্রার্থনা করে । আমি অনুবাদ করে পাঠাতাম এটা ঠিক । কিন্তু তিনি আমার নিজের লেখা কবিতা কেন চান না — এ ক্ষোভ আমার মনে মনে থাকতো । কিছু বিরক্তও বোধ করতাম । আমি যে কবিতা লিখি সে কথা সম্পাদক জানতেন, ‘নক্ষত্রের আলোয়’ তিনি পড়েছিলেন । তবু কখনো আমার নিজের লেখা কবিতা চাইতেন না । এরপর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের একেবারে গোড়ার দিকে আমি স্হির করলাম সর্বান্তঃকরণে কবিতাই লিখি । চাকুরি আপাতত থাক । গ্রাম ছেড়ে কলকাতায় চলে এলাম । সকালে জাগরণ থেকে শয়ন পর্যন্ত সারাক্ষণ কবিতাই ভাবতাম । আশেপাশে শহরের যে দৃশ্যাবলী দেখতাম তার কোনো কিছু কাব্যিক মনে হলে তখনি নোটবুকে টুকে রাখতাম । ছোটো আকারের কবিতার নোটবই সর্বদাই প্যাণ্টের পকেটে রাখতাম । সৃষ্টির মূল যে সূত্রগুলি তা জড়ের মধ্যে প্রকাশিত, উদ্ভিদের মধ্যে প্রকাশিত, মানুষের মধ্যেও প্রকাশিত । এদের ভেতরে সূত্রগুলি পৃথক নয়, একই সূত্র তিনের ভেতর বিদ্যমান । এই সার সত্য সম্বল করে ভেবে দেখলাম জড়ের জীবনে যা সত্য , মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য, উদ্ভিদের জীবনে যা সত্য মানুষের জীবনেও তা-ই সত্য । অতএব জড় ও উদ্ভিদের জীবন অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করতে লাগলাম আমি । এবং তাদের জীবনের ঘটনাকে মানুষের জীবনের ঘটনা বলেই চালাতে লাগলাম । এইভাবে শুরু হলো কবিতার জগতে আমার পথযাত্রা, আমার নিজস্বতা । এইভাবে সৃষ্টি হলো ‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা’ ।”

         ঠিক কী যে বিনয়কে উদ্বেলিত করেছিল, ১৯৬০ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলো লিখতে, তা রহস্যই থেকে গেছে । শিবপুরের ছাত্রজীবন থেকে কলকাতায় ফিরে, কফিহাউসে যাতায়াত করে, প্রেসিডেন্সির করিডরগুলোয় ঘুরে, গায়ত্রী চক্রবর্তী নামের সেই কিশোরীটির স্মৃতিই কী ? স্মৃতির গোপন ঘায়ের রক্ত আবার যদি না বেরোতো তাহলে এই তিন বছরের কবিতাগুলো লেখা সম্ভব হতো না বলেই মনে হয় । এমনও হয়েছে যে একই দিনে তিনি দু’তিনটি কবিতা লিখেছেন ; রাতে তাঁর ঘুম হয় না, যৌবনের স্বাভাবিক কুসুম-কুসুম জ্বরে তপ্ত হয়ে ওঠেন, যার দরুন রস এসে চাপ দিতে থাকে, ছন্দিত ঘর্ষণে উত্তেজনা চরমে ওঠে, তারপর রসপাত হলে শান্তি হয় । বিনয়ের সঙ্গে জীবনানন্দের এখানে পার্থক্য এই যে, জীবনানন্দ ‘যোনি’ শব্দটি বহুবার প্রয়োগ করলেও, ব্রাহ্মধর্মের বেড়াজাল তাঁকে যুবকের যৌন উত্তেজনার যন্ত্রণা সম্পর্কে এরকম খোলাখুলি লিখতে দিতো না ।

২২ জুন ১৯৬২ তারিখে বিনয় মজুমদার এই কবিতাটি লিখেছিলেন :-

যাক তবে জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয় ।
সব শান্তি দূরে থাক, সব তৃপ্তি, সব ভুলে যাই ।
শুধু তার যন্ত্রণায় ডুবে থাক হৃদয় শরীর ।
তার তরণির মতো দীর্ঘচোখে ছিল সাগরের
গভীর আহ্বান, ছায়া, মেঘ, ঝঞ্ঝা, আকাশ বাতাস ।
কাঁটার আঘাতদায়ী কুসুমের স্মৃতির মতন
দীর্ঘস্হায়ী তার চিন্তা — প্রথম মিলনকালে ছেঁড়া
ত্বকের জ্বালার মতো গোপন, মধুর এ-বেদনা ।
যাক সব জ্বলে যাক, জলস্তম্ভ, ছেঁড়া ঘা হৃদয় ।

২৯ জুন ১৯৬২  তারিখে লিখেছিলেন এই কবিতাটি

তুমি যেন ফিরে এসে পুনরায় কুন্ঠিত শিশুকে
করাঘাত করে-করে ঘুম পাড়াবার সাধ করে
আড়ালে যেও না ; আমি এতদিনে চিনেছি কেবল
অপার ক্ষমতাময়ী হাত দুটি ; ক্ষিপ্র হাত দুটি…
ক্ষণিক নিস্তারলাভে একা-একা ব্যর্থ বারিপাত ।
কবিতা সমাপ্ত হতে দেবে না কি ? সার্থক চক্রের
আশায় শেষের পংক্তি ভেবে-ভেবে নিদ্রা চলে গেছে।
কেবল কবোষ্ণ চিন্তা, রস এসে চাপ দিতে থাকে ।
তারা যেন কুসুমের অভ্যন্তরে মধুর ঈর্ষিত
স্হান চায়, মালিকায় গাঁথা হয়ে ঘ্রাণ দিতে চায় ।
কবিতা সমাপ্ত হতে দাও নারী, ক্রমে…ক্রমাগত
ছন্দিত ঘর্ষণে, দ্যাখ, উত্তেজনা শীর্ষ লাভ করে
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে ।
আড়ালে যেও না যেন, ঘুম পাড়াবার সাধ করে ।

চার
         বিনয় মজুমদার স্বীকার করেছেন যে তিনি কাল্পনিক বিষয় নিয়ে লেখেন না, তাঁর বিষয়বস্তু বাস্তবজগত থেকে সংগ্রহ করা । সুতরাং অনুমান করা যেতেই পারে যে ‘গায়ত্রী’ বাস্তব জগতেরই কেউ একজন ; বনলতা সেন, নীরা বা সুপর্ণার মতো কাল্পনিক নন । এখানে উল্লেখ্য যে জীবনানন্দ দাশ এবং ভাস্কর চক্রবর্তী স্ত্রীর সঙ্গে স্বাভাবিক মধ্যবিত্তের মতন দাম্পত্য সম্পর্কে গড়ে তুলতে পারেননি, যেকারণে তাঁরা কাল্পনিক প্রেমিকা তৈরি করে নিয়েছিলেন । ‘গায়ত্রীকে, বা ‘ফিরে এসো, চাকার’ পরে বিনয় মজুমদারের বড়ো কাজ ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । এই বইটি সম্পর্কেও তাঁর কলমেই পড়ি তিনি কী বলছেন:
         “এ পর্যন্ত আমি কোনোদিন নিসর্গমূলক কবিতা লিখিনি । অধিকাংশই ঘটনার বিবৃতি লিখেছি । অতঃপর আমায় কলকাতার শহরতলিতে থাকতে হয়, যাকে প্রায় গ্রাম বলা যায় । চারিদিকে নানা গাছপালা লতাপাতা ছিলো, ছোট বড়ো পুকুর ছিল । ভাবলাম প্রকৃতির বর্ণনা লেখা যাক । এক মাসের ভেতর খুব দীর্ঘ ছয়টি কবিতা লিখলাম । হিসাব করে দেখলাম, বই আকারে ছাপলে এই ছয়টি কবিতা ৪৮ পৃষ্ঠার বেশি জায়গা নেবে । ফলে আর বেশি লিখলাম না । বইয়ের নাম দিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ এবং কবিতাগুলির কোনো নাম না দিয়ে সংখ্যাচিহ্ণ দিয়ে চিহ্ণিত করলাম  — ১, ২, ৩, ৪, ৫ এবং ৬ । একবার ভাবলাম কায়দা করে ছ’টি কবিতাকে জোড়া লাগিয়ে একটা কবিতা করি, ৪৮ পৃষ্ঠার লম্বা একটা কবিতা । কিন্তু এতো দীর্ঘ কবিতা পত্রিকায় ছাপা অসম্ভব হবে ভেবে শেষ পর্যন্ত আলাদা আলাদা ছ’টি কবিতাই রাখলাম । এর প্রথম কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘অনুভব’ পত্রিকার সম্পাদক গৌরাঙ্গ ভৌমিক, দ্বিতীয় কবিতাটি নিলেন ‘এক্ষণ’ পত্রিকার সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য, তৃতীয় কবিতাটির কী হয়েছিল তা গোপন রাখতে চাই, চতুর্থ ও পঞ্চম কবিতা দুটি ছাপতে নিলেন ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকার সম্পাদক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং ষষ্ঠ কবিতাটি ছাপতে নিলেন ‘দৈনিক কবিতা’ পত্রিকার সম্পাদক বিমল রায়চৌধুরী । সকলেই যথা সময়ে ছেপে বার করলেন । পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায় বললেন, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইখানা আমি ছেপে বের করব, কবিতার সঙ্গে ইলাসট্রেশন দেবো । অমিতাভ দাশগুপ্ত বললো, তোর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সমালোচনা লিখব, বই হয়ে বেরোবার আগেই । কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে দেখা গেলো তাদের কথা প্রশংসাবাক্য মাত্র। ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র তৃতীয় কবিতাটি ছাপা হয়েছে জ্যোতির্ময় দত্ত সম্পাদিত ‘কলকাতা’ পত্রিকায় — ১৯৭০ সালে । এই একই প্রকার কবিতা আমি আরো লিখে যেতে পারতাম । কিন্তু পড়তে একঘেয়ে হয়ে যাবে ভেবে লিখিনি । এর পরে আমার কবিতা লেখার গতি খুব মন্দ হয়ে আসে ।”
         একজন কবি যদি আখের গোছাবার ধান্দায় থাকতেন তাহলে তিনি পরের পর ‘ফিরে এসো, চাকা’র মতোই কবিতা লিখে যেতেন, যা বিনয়ের পক্ষে সেই সময়ে সহজও ছিল, কেননা তিনি অমন কবিতা লেখার পদ্ধতি ও ছন্দ রপ্ত করে ফেলেছিলেন । কিন্তু সেই পথ ছেড়ে বিনয় লিখলেন আদিরসাত্মক কবিতা । র‌্যাবেলের ‘গার্গাঁতুয়া পাঁতাগ্রুয়েল’ আলোচনাকালে বাখতিন বলেছেন, লেখক যদি বেপরোয়া না হন তাহলে তাঁর পক্ষে কার্নিভালেস্ক রচনা সম্ভব নয় । বিনয় প্রচলিত গণ্ডি কেটে বেরিয়ে গেলেন এবং লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’, তারপর ‘বাল্মীকির কবিতায়’ ভুট্টা সিরিজ ও ডালাসারির কবিতাগুচ্ছ, এবং হাসপাতাল ও গ্রামজীবনের দিনপঞ্জিমূলক কবিতা , অর্থাৎ বিদ্যায়তনিক সাহিত্যের ক্যাননের তিনি ধার ধারলেন না, বলা যায় সপাটে চড় কষালেন সাহিত্যিক মূল্যবোধের মালিকদের গালে । গণ্ডিকেটে বেরোনোর সঙ্গে বিনয়ের স্কিৎসোফ্রেনিয়ার সম্পর্ক খোঁজা ভুল হবে কেননা র‌্যাবেল-এর এবং ডন কিয়োটের লেখক সেরভানথেসের স্কিৎসোফ্রেনিয়া ছিল না।
        নিজের জীবনকে কবিতার জগতে এমনভাবে নিয়ে গেলেন বিনয় যে আর সবাইকে শুনিয়ে বলার দরকার হলো না যে শুধু কবিতার জন্য তিনি অমরত্বের তোয়াক্কা করেননি, এবং সত্যই তাই, তিনি কারোর তোয়াক্কা করেননি, আর এই ধরণের কবিতাও তাঁকে লিখে যেতে হয়নি যা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘শুধু কবিতার জন্য’ রচনায় লিখলেন :-

শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম শুধু কবিতার
জন্য কিছে খেলা, শুধু কবিতার জন্য একা হিম সন্ধ্যাবেলা
ভূবন পেরিয়ে আসা, শুধু কবিতার জন্য
অপলক মুখশ্রীর শান্তি এক ঝলক ;
শুধু কবিতার জন্য নারী, শুধু
কবিতার জন্য এত রক্তপাত মেঘে গাঙ্গেয় প্রপাত
শুধু কবিতার জন্য, আজো দীর্ঘ দিন বেঁচে থাকতে লোভ হয় ।
মানুষের মতো ক্ষোভময়, শুধু কবিতার
জন্য আমি অমরত্ব তাচ্ছিল্য করেছি ।

         বিনয় মজুমদার যখন ২০০৩ সালে বাঙ্গুর সাইকিয়াট্রি ইন্সটিউটে চিকিৎসাধীন তখন তাঁর প্রয়াত মা ও বাবার সম্পর্কে মনকেমনকে কেন্দ্র করে দুটি কবিতা লিখেছিলেন, পড়লে টের পাওয়া যাবে তাঁর চিন্তাধারা কোন পথে চালিত হচ্ছিল সেসময়ে :

মায়ের
মায়ের ইনসোফেগাস ক্যানসার হয়েছিল
কোনো কিছু গিলে খেতে পারত না, জল
খেতে পারত না ।
পীযুষ ডাক্তার
গ্লুকোজ ইনজেকশান দিত দুই হাতে ।
তাতে আর কী বা হয়, না খেয়ে পনেরোদিন থেকে
মা-ও মারা গেল ।
মরবার আগে একবার
আমার বাবাকে মা তো কুকুর বলেছে ।
মরবার আগে মা আমার
বাড়ির চাকরটির পা-ও ধরেছিল ।
এর নাম মৃত্যু মহাশয় ।

         নিজের মাকে নিয়ে এই ধরণের কবিতা বিনয়ের আগে আমরা আর কোনো কবিকে লিখতে দেখিনি । সকলেই মাকে নিয়ে যেসব কবিতা এযাবৎ লিখেছেন সেগুলো নাটুকে ও কৃত্রিম বলে মনে হয় । এবার পড়া যাক বাবাকে নিয়ে লেখা কবিতা :

যখন আমার বাবা
যখন আমার বাবা খুব বুড়ো হয়েছিল
বয়স তিরানব্বই বৎসর হয়েছিল তখন তো বাবা
বিছানায় বসতেই পারত না, শুয়েই থাকত ।
বুড়ো হলে এই হয়, আমারো তো হবে ।
বড় ভগ্নীপতি এসে হাবড়ায় নিয়ে
বাবার পেটটি কেটে এনেছিল, পরে
একটানা এগারোটি দিনব্যাপী রক্ত পড়েছিল
কাটা পেট থেকে ।
তারপরে বাবা মারা গেল ।
বাবার তো আত্মা নেই পূনর্জন্ম নেই ।
বাবাকে পোড়ালে পরে বাবার ছাই তো আছে, এই
ছাই ভাবে পৃথিবীর মাটির সহিত ।

       বাবা-মায়ের প্রতি দায়িত্বের জন্য বিনয় মজুমদার জার্মানিতে গণিত অধ্যাপকের চাকরি পেয়েও জাননি । ১৯৯৮ সালে ‘অধরা মাধুরী’ পত্রিকার জন্য বোধিসত্ব রায়কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় জানিয়েছিলেন, “ বার্লিনে নেমন্তন্ন করেছিল আলেকজান্ডার ডি ভার্স্ট বলে একজন ভদ্রলোক । তিনি ছিলেন গণিতের অধ্যাপক । আমি তাঁকে দরখাস্ত দিই, আমি চাকরি করতে চাই জার্মানিতে । আমি তাঁকে আমার গণিতের গোটা কয়েক খাতা পাঠিয়েছিলাম । সেইগুলি পড়ে উনি আমাকে নিমন্ত্রণ করলেন । বললেন, তুমি এসো, আমাদের বার্লিন বিশ্ববিদ্যালয়ে অঙ্ক কষাবে । তোমাকে মাইনে দেয়া হবে ইউ. এস. এ.’র স্কেলে । তখন আমি বাবাকে বললাম, আমাকে দেখছি জার্মানিতে ডেকেছে ! অঙ্ক কষাতে হবে এম. এস. সি ক্লাসে, জার্মান বিশ্ববিদ্যালয়ে । বাবা বললেন, দ্যাখ, আমরা বুড়ো হয়ে গেছি । আমার বয়স আশি-পঁচাশি বছর । তোর মায়ের বয়সও ওইরকম । আমাদের বাড়িতে দেখাশুনা করার মতো কেউ নেই । তুই-ও একা আছিস। তুই আর যাসনে কোথাও । আমাদের দেখাশোনা কর । সুতরাং আমি আর জার্মানিতে যেতে পারিনি।”
        দার্শনিক-তাত্বিক গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক, যাঁকে নিয়ে’ গায়ত্রীকে’ ( পরিবর্তিত নাম’ ‘ঈশ্বরীকে’ এবং আরেকবার পরিবর্তিত নাম ‘ফিরে এসো, চাকা ) বইয়ের কবিতাগুলো বিনয় মজুমদার লিখেছেন , এবং  বিনয় নিজেও তা প্রথম দিকে স্বীকার করেছিলেন, এবং জীবনের মধ্যভাগে তা স্বীকার-অস্বীকারের দোনামনায় ভোগা আরম্ভ করেন, তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে স্নাতক হন ১৯৫৯ সালে ।
          গায়ত্রী চক্রবর্তীর বাবার  বাড়িতে বিনয় গিয়েছেন কয়েকবার তা তিনি ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার সম্পাদক শামীমুল হক শামীম-এর  কাছে স্বীকার করেছেন, এবং কিশোরী গায়ত্রীর প্রতি তিনি টান অনুভব করতে থাকেন, সেই টান তিনি আজীবন বয়েছেন, একতরফা প্রেমের টান, নিজের মনের কথা উচ্চবর্ণের ধনী পরিবারের স্মার্ট কনভেন্টে-পড়া ইংরেজি-বলিয়ে কিশোরীটিকে বলে উঠতে পারেননি । তাঁর অবস্হান থেকে তা বলা বিপজ্জনক ছিল ।
        শামীমুল হক শামীম প্রশ্ন করেছিলেন, “ফিরে এসো, চাকা’ যাঁকে উৎসর্গ করেছেন সেই গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?”
         বিনয় মজুমদার উত্তরে বলেছিলেন, আমি যখন ইডেন হিন্দু হোস্টেলে ছিলাম তখন গায়ত্রীর বাবা ছিলেন সুপারিনটেনডেন্ট, জনার্দন চক্রবর্তী, দাদার নাম প্রসূন চক্রবর্তী । তখন ওর বয়স বারো । তখন থেকে দেখেছি । পুরোহিতের মেয়ে তো । বেশি কথাবার্তা হয়নি । আলাপ-আলোচনা হতো — কবিতা নিয়ে। ‘কবিতা লিখেছি কবে, দুজনে চকিত চেতনায়’ — এবার বুঝলে তো ! তারপর ভালো ছাত্রী হওয়ার ফলে সহকারী অধ্যাপক হিসাবে ২৩ বছর বয়সে আমেরিকায় চলে গেল। আমি তিনটি বই তাকে উৎসর্গ করেছি।”
         গায়ত্রী স্মার্ট তন্বী ছিলেন, আকর্ষনীয়া, প্রতিভাময়ী, কিন্তু সুন্দরী বলতে যা বোঝায়, তাঁর যৌবনের ছবি দেখে তা মনে হয় না । মিষ্টি মেয়ে বলতে যা বোঝায়, তাই ছিলেন তিনি । কিন্তু তরুণ বিনয়ের অস্তিত্বে তিনি প্রগাঢ় ছাপ ফেলতে পেরেছিলেন, “কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে” কবিতাটি পড়লে তার আঁচ পাওয়া যায় :

         কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে ।
         কৌটার মাংসের মতো সুরক্ষিত তোমার প্রতিভা
         উদ্ভাসিত করেছিল ভবিষ্যৎ দিকচক্রবাল ।
         সময়ে ভেবেছিলাম সন্মিলিত চায়ের ভাবনা,
         বায়ুসেবনের কথা, চিরন্তন শিখরের বায়ু ।
         দৃষ্টিবিভ্রমের মতো কাল্পনিক বলে মনে হয়,
         তোমাকে অস্তিত্বহীনা, অথবা হয়তো লুপ্ত, মৃত ।
         অথবা করেছ ত্যাগ, অবৈধ পুত্রের মতো, পথে ।
         জীবনের কথা ভাবি, ক্ষত সেরে গেলে পরে ত্বকে
         পুনরায় কেশোদ্গম হবে না ; বিমর্ষ ভাবনায়
         রাত্রির মাছির মতো শান্ত হয়ে রয়েছে বেদনা–
         হাসপাতালের থেকে ফেরার সময়কার মনে ।
         মাঝে মাঝে অগোচরে বালকের ঘুমের ভিতরে
         প্রস্রাব করার মতো অস্হানে বেদনা ঝরে যাবে ।

পাঁচ

         অরুণেশ ঘোষ ‘গায়ত্রীকে’ বা ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের প্রতি বিনয়ের আকর্ষণ স্বীকার করেননি । অরুণেশ লিখেছিলেন, “এমন একটা গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল যে, প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বিনয় পাগল হয়ে গেছে আর সেই উন্মত্ত অবস্হার মধ্যে লেখা হয়েছে ‘ফিরে এসো, চাকা’র কবিতাগুচ্ছ । আরও গুজব ছিল, এমন একটি অভিজাত, উঁচু বংশীয় আর সুন্দরী মেয়েকে সে দূর থেকে ভালবাসত — সে ঘূনাক্ষরেও নাকি ধারণা করতে পারেনি, কোনো উন্মাদপ্রায় কবি তাকে ভালবেসে লিখে ফেলেছে  শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ কবিতাবলি । এই গুজবের রেশ এখনও রয়ে গেছে।”
         আসলে গায়ত্রী সম্পর্কে ক্রাশ এবং স্কিৎসোফ্রেনিয়া যে দুটি সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার তা ধরতে পারেননি অরুণেশ । বোধিবৃক্ষের তলায় গৌতমবুদ্ধ উলঙ্গ হয়ে বসেছিলেন আমৃত্যু, কিন্তু তার জন্য তাঁকে তাঁর শিষ্যরা পাগল তকমা দেননি । একজন ভিখারিনিকে নিজের কাপড় খুলে দিয়ে উলঙ্গ হেঁটেছিলেন শিষ্যদের সঙ্গে, তার জন্য তাঁকে পাগল বলা হয়নি । সম্প্রতি হরিয়ানা বিধানসভায় জনৈক উলঙ্গ দিগম্বর জৈন সন্ন্যাসী বক্তৃতা দিয়েছিলেন ; তাঁকে কেউ পাগল বলেননি। মহাবীরও উলঙ্গ বসে সাধনা করেছিলেন, শিষ্যদের বাণী শুনিয়েছেন, তার জন্য কেউ তাঁকে সমাজবহির্ভূত উন্মাদ মনে করেনি । কবিদের বোধিপ্রাপ্তির পথে যাত্রাকে তাহলে কেন পাগলামি ইত্যাদি বলা হবে ! এই বিপর্যয় এনেছে আধুনিকতাবাদী শিক্ষা, ইউরোপের সংস্কৃতি । ব্রিটিশরা আসার আগে ভারতবর্ষে পাগলাগারদ বলে কিছু ছিল না।
         গণিতের অধ্যাপক নারায়ণচন্দ্র ঘোষও মনে করেন যে গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে অহেতুক মিথ সৃষ্টি করার চেষ্টা হয়েছে। ‘গায়ত্রীকে’ নামকরণ তিনি সম্পৃক্ত করেছেন হিন্দু ধর্মের গায়ত্রীমন্ত্রের সঙ্গে, যে মন্ত্রটি দ্বারা উপনয়নের সময়ে সদ্যব্রাহ্মণকে দীক্ষিত করা হয় । তিনি ‘সৃষ্টিসন্ধান’ ওয়েব-পত্রিকায় লিখেছেন যে, “বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হটি বিভিন্ন নামে প্রকাশিত হয়েছে । ১৯৬১ সালে চোদ্দটি কবিতা নিয়ে বিনয়ের ‘গায়ত্রীকে’ নামের কবিতার বই প্রকাশিত হয় । চোদ্দর সঙ্গে আরও তেষট্টিটি কবিতা যোগ করে ১৯৬২ সালে প্রকাশিত হয়  ‘ফিরে এসো.চাকা’ কাব্যগ্রন্হ। ‘ফিরে এসো, চাকা’ নাম পালটিয়ে একই কবিতাগুচ্ছ নিয়ে ১৯৬৪ সালে নতুন নামে প্রকাশিত হয় ‘আমার ঈশ্বরীকে’ । নামকরণের কারণেই গায়ত্রী চক্রবর্তী-চাকা-ঈশ্বরী সম্পৃক্ত হয়ে এক মিথের জন্ম দিয়েছিল এবং গাণিতিক চেতনার কবির বিশ্লেষণাত্মক ছন্দময় কাব্যপ্রবাহকে ‘হতাশাজনিত মস্তিষ্কবিকৃতি’, ‘ব্যর্থ প্রেমিকের পাগলের প্রলাপ’ প্রভৃতি উক্তি দ্বারা অভিহিত করে কবি বিনয় মজুমদারের কাব্যভাবনার মূলকে সৃষ্টির আড়ালে রাখার সচেতন বা হেঁয়ালি প্রয়াস দেখা যায় । অনেক সময়ে মিথ যেন সত্য মনে হয়:
                                ‘কী রহস্য যেন সর্বদা আমাকে ঘিরে রাখে’
‘রহস্য’ কবিতার এই পংক্তিটি যেন কবি বিনয় মজুমদারের নিজের জীবনযাপন, কাব্যকৃতি, প্রেম-বাসনা, বিষাদ-আনন্দের অনুরণন । তাঁর কবিতায় জননপ্রক্রিয়া, পদার্থবিদ্যা, বীজগণিত, কফিহাউস, পড়শি রঞ্জিত, পীযুষ ডাক্তার, কৃত্তিবাস, হাংরি আন্দোলন, বাবলা গাছ, লাঙল,  হারাধন, বুচি, জীবনানন্দ, বাবা, মা, মানসিক হাসপাতাল, চন্দ্র, সূর্য, নক্ষত্র, মঘা তারা, রেবতী, কৃত্তিকা, ছন্দভাবনা, সমাজভাবনা, সরস্বতীপুজো, সব একাকার হয়ে গেছে । সেখানে কোনো কাব্যের নামকরণ বা কাব্যভাবনাকে বিশেষ কৌণিক বিন্দু থেকে মূল্যায়ন করলে মিথ আরও মিথের জন্ম দেবে । বিনয় রহস্য উন্মোচনে তাই বড়ো বেশি সাবধানী হওয়া বোধহয় শ্রেয় :
                                     ‘তাকাই সামনে সোজাসুজি
                                      ব্যাকুল আশায় তাকে খুঁজি’
যিনি ব্যাকুল আশায় তাঁকে খোঁজার প্রয়াস চালিয়েছেন সম্ভবত সেই বিনয় মজুমদারকে খুঁজতে দুচোখ ধারালো করা প্রয়োজন এবং এ-কাজে কোনো মিথর শিকার না হয়ে মনে রাখা দরকার : সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো । কেননা বিনয় মজুমদারের কথায় :
                           ‘নিষ্পেষণে ক্রমে-ক্রমে অঙ্গারের মতন সংযমে
                            হীরকের জন্ম হয়, দ্যুতিময়, আত্মসমাহিত’
এ তো বিনয়ই শিখিয়েছেন । তাই মিথ নয়, যুক্তসমীকরণে বিনয়-প্রতিভার সন্ধান চালানো ভালো :

     যে কোনো গণিতসূত্র নিয়ে তার পরবর্তীদের
    বাঁপাশে আনার পরে সে সমীকরণে
    সমান চিহ্ণের পরে — ডানপাশে শূন্য হয়ে যায় ।
    এইভাবে কতিপয় যত খুশি সূত্র নিয়ে এগুলির বামপার্শ্বগুলি
    গুণ করে শুধুমাত্র একটি সমীকরণ সহজেই পাই
    এবং ডানপার্শ্বে শূন্য শূন্যের সমান
    সদ্য উল্লিখিত এই একটি সমীকরণ জ্যামিতিতে রূপায়িত হলে
    অনেক পৃথকরূপ পৃথক পৃথক চিত্র পাওয়া যায় সর্বদাই পাই ।
    মূল সমীকরণের — আলাদা আলাদা সব সমীকরণের
    আলাদা সকল চিত্র একীভূত সমীকরণের
    জ্যামিতিক রূপায়ণে তার মানে পাওয়া যায় অনেক সূত্রকে
    একীভূত করা যায় কেবল একটিমাত্র করে ফেলা যায় ।
    তাতে আমাদের কিছু লাভ হয় এখানে আমার বৌ রাধা
    এই লিখে রাখা ভালো সবার অবগতির জন্যই নিশ্চয় ।
                                                          
নারায়ণচন্দ্র ঘোষ আরও বলেছেন যে, “প্রকল্পিত সমীকরণের পদ্ধতি অজানা থাকলে রাধার একীভূত সত্তার প্রসঙ্গ সহজবোধ্য হয় না । অজানা থেকে যায় রূপময়তার পরিসরে আলাদা হয়ে যাওয়া, আলাদা থাকা, বহুময়তা আর সমন্বয়, সমাবিষ্ট, একীভূত হওয়ার সম্ভাবনাসূত্র — ভেদ ও অভেদের গমনপথ, পারস্পারিকতার রহস্য । বিনয়কে বুঝতে হলে, বিনয়ী হয়ে বলা ভালো, গাণিতিক চেতনায় সমৃদ্ধ হওয়া জরুরি ; অন্যথায় মিথ মিথের জন্ম দেবে ; বিনয় কেবলমাত্র অবিনশ্বর প্রেম কাহিনীর প্রতীক হয়ে থাকবেন। মিথপ্রেমীদের পথ তখন মহাশূন্যের কোটরে দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হবে । গণিতবিদ নারায়ণবাবু তাই পৌরাণিক মিথে টেনে নিয়ে গেছেন বিনয়ের ‘চাকা’কে । তিনি বলেছেন সুদর্শন চক্রের আবহমণ্ডলে ভারতবাসী তথা বাঙালির অবস্হান । কত না মিথ সুদর্শনচক্রকে উপলক্ষ্য করে । অশোকচক্র, সেও কি কম কথা । উপনিষদে বর্ণিত সত্যচক্র হলো একটি ত্রিমুখী সিংহের পায়ের নিচে একটি ছোটো চক্র আর মাথার উপরে আরেকটি বড়ো চক্র । এর অর্থ হলো পশু শক্তি সত্যকে দমন করতে চাইলে সত্য আরও বড়ো আকার নিয়ে পশু শক্তির উর্ধ্বে নিজের স্হান করে নেয় ।”
        বলা বাহুল্য, নারায়ণবাবুর এই যুক্তি আমি ঠিক বুঝতে পারিনি । বিনয়ের কবিতায় পুরোহিততন্ত্র ও ব্রা্‌হ্মণ্যবাদের প্রতি খোঁচা বেশ কয়েকটি কবিতায় ও সাক্ষাৎকারে পাওয়া যায় ।
        কবি জুবিন ঘোষ ‘দৈনিক সংবাদ’ পত্রিকার ২০১৬ সালের একুশে জানুয়ারি সংখ্যায় বিনয় মজুমদারের ‘ফিরে এসো চাকা’ কাব্যগ্রন্হটি সম্পর্কে আলোচনাকালে নারায়ণ ঘোষের বক্তব্যকে আরও প্রসারিত করেছেন গায়ত্রীমন্ত্র ও ষটচক্রের প্রেক্ষিতে । তিনি বলেছেন যে, গায়ত্রী শুধুমাত্র একটা মন্ত্র নয়, এটা হিন্দুদের একটা পরম সাধিত স্তব । যার সুর অমর । ‘শান্তিনিকেতন’ গ্রন্হে ‘ভক্ত’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ থাকুর লিখেছেন, “একদিকে ভূলোক, অন্তরীক্ষ, জ্যোতিষ্কলোক, আর একদিকে আমাদের বুদ্ধিবৃত্তি, আমাদের চেতনা — এই দুইকেই যদি এক শক্তি বিকীর্ণ করছে, তার এই শক্তি বিশ্বের মধ্যে এবং আপনার বুদ্ধির মধ্যে ধ্যান করে উপলব্ধি করবার মন্ত্র হচ্ছে গায়ত্রী ।” বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতার শেষ কয়েক পংক্তির মধ্যে বলেছেন, “আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন/সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” সেখানে এক অমরতার চিহ্ণ পাই সকল আকাশে বিচরণ করার শক্তির মধ্যেই । গায়ত্রী স্তবের সুর যা ‘জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে’ আসে হিন্দুদের কাছে । এই অমরতা যা মন্ত্রের সুরেই সম্ভব । স্বর না থাকলেও সুর থেকে যায় অনাদিকাল, পুনরাবিষ্কার হয় তার । সেই গায়ত্রী শব্দোচ্চারণের সুরেই বিনয় বলেছেন, “লিপ্ত হবো পৃথিবীর সকল আকাশে।” এখন বেদ মন্ত্রের আলোকে দেখা যাক ‘ধী’ কী ! সূর্যের কল্যাণতম তাপ মানবের ব্যক্তিচৈতন্যের উপরে বেগ সৃষ্টি করে জ্ঞান, আত্মা বা ‘ধী’ এর পরিস্ফূটন ঘটায়। এই ‘ধী’, যা মানুষের আত্মশক্তিকে তেজপূর্ণ করে, সূর্যের অমৃতজ্যোতির সঙ্গে সাযুজ্যতা দিয়ে থাকে। ‘ধী’ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের ২/৪০/৬ ঋক বলছে, ‘ধিয় পূষা জিম্বতু বিশ্বামিত্রো রয়ি সোমা রয়িপতির্দাধতু।’ মানে হলো, সব জীবনের ধ্যানে, মননে, চিন্তনে রয়েছেন পূষা, তিনিই ‘ধী’ যা সবার ধ্যানচৈতন্যের স্ফূরণ করে, সোমলতাকে ‘ধী’ রসবন্ত করে । গায়ত্রী স্তবেও বলছে ‘ধিযো নঃ প্রচোদয়াৎ’। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, এই ধ্যানকে উপলব্ধি করতে হয়, আবিষ্কার করতে হয়, তাই তো ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় বিনয় লেখেন, ‘দীর্ঘ তৃষ্ণা ভুলে থাকি আবিষ্কারে, প্রেমে।’ গায়ত্রীমন্ত্র একবার মনস্হ করে হয় না, তাকে ধীরে ধীরে ১০ থেকে ১০৮ বার করতে হয় । বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’ কবিতায় লেখেন, ‘নিমেষেই/গলধঃকরণ তাকে না করে ক্রমশ রস নিয়ে/তৃপ্ত হই’ — এই ধীর স্বাদ গ্রহণের চমৎকার অবস্হায় প্রকৃত সাধক বিনয় মজুমদার ‘পরাবর ব্রহ্ম’ দর্শন করেন । দর্শনের শেষে যা আসে তা দেব দর্শনের মতো মিলিয়ে যায়, শরীর সাকার হয় না, চিত্ররূপ থেকে যায় মনে, ‘প্রাচীন চিত্রের মতো চিরস্হায়ী হাসি নিয়ে তুমি/চলে যাবে ; ক্ষত নিয়ে যন্ত্রণায় স্তব্ধ হব আমি’ ( ভালোবাসা দিতে পারি — ১৮.৫.৬২ ) । এই ভাবে স্তব বা বেদমন্ত্রে গায়ত্রী জীবন্ত মানুষী হয়ে ওঠেন । ঠিক যেমন গায়ত্রীমন্ত্রের মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে এক অপূর্ব আলোর পরিস্ফূরণ, স্রোতের তরঙ্গশীর্ষে রয়েছে উত্তরণের সাংকেতিক লিপি । লক্ষ-কোটি মুহূর্তের প্রবাহে যিনি নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে এই শক্তিকে আত্মস্হ করেন, তিনিই যোগী । ‘ধী’ অর্থাৎ বোধ আমাদের রক্ষা করছে । বোধের পূজারী হলেন বিনয় মজুমদার । তিনি বারবার গায়ত্রীর মূল রসকে সেই স্তরের ব্যাখ্যায় অন্তস্হিত মর্মে পদার্পণ করেছেন । ‘ধী’ ও গায়ত্রীকে মিশিয়ে দিয়েছেন কাব্যের আধ্যাত্মিকতায় ।
        জুবিন ঘোষ আরও বলেছেন, এবং যা বলেছেন, খতিয়ে দেখলে দেখা যাবে যে বিনয়ের ‘বাল্মীকির কবিতার’ ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য, যদিও জুবিন ঘোষ ‘বাল্মীকির কবিতা’র পপসঙ্গ তোলেননি এখানে । জুবিন বলেছেন, “ফিরে এসো, চাকা’ তো সভ্যতার প্রধান চক্র, যার মাধ্যমে মানবসভ্যতা গড়িয়ে এগিয়েছে, আর চক্র মানেই ‘ষটচক্র’ । সেখানে দেখব রয়েছে : ১) মূলাধারচক্র; ২) সাধিষ্ঠচক্র ; ৩) মণিপুরচক্র ; ৪) অনাহতচক্র ; ৫) বিশুদ্ধিচক্র ও ৬) আজ্ঞাচক্র । এই চক্রের পুনঃসাধনার কথাই বলেছেন কবি বিনয় মজুমদার। এতো সূক্ষ্ম আধ্যাত্মিক গভীরতার দিকে এগিয়েছে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’, যাকে বলতে পারি ফিরে এসো চক্র — সভ্যতার সাবলীল গতিসমূহ মানবদেহের সাবলীল সাধনাসমূহ । মূলাধারচক্র সাধনায় মানুষের বাসনা সিদ্ধ হয় — সে মুক্তি লাভ করে । বিনয় ‘আমার আশ্চর্য ফুল’-এ বলছেন, ‘কাকে বলে নির্বিকার পাখি/অথবা ফড়িং তার স্বচ্ছ ডানা মেলে উড়ে যায়/উড়ে যায় শ্বাস ফেলে যুবকের প্রাণের উপরে/…/আমি মুগ্ধ ; উড়ে গেছ ; ফিরে এসো চাকা । এই মুগ্ধ উড়ে যাবার মধ্যে মুক্তির স্বাদ । মুগ্ধতার অর্থ বাসনা পরিতৃপ্তির ফল । এই মুগ্ধ উড়াল আমরা বার বার পাই ‘ফিরে এসো, চাকা’র প্রথম কবিতাতেই, ‘একটি উজ্বল মাছ, যা ১৯৬০ সালের ৮ই মার্চ লেখায় আশ্রিত — ‘একটি উজ্বল মাছ একবার উঠে/দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে পুনরায় ডুবে গেল/ এই স্মিত দৃশ্য দেখে বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হল ফল/…/বিপন্ন মরাল ওড়ে অবিরাম পলায়ন করে ।’ আবার ‘কাগজ কলম নিয়ে’ ( ১৪/১০/১৯৬০) বিনয় লিখছেন, ‘তবু কী আশ্চর্য দ্যাখো, উপবিষ্ট মশা উড়ে গেলে/তার সেই উড়ে যাওয়া ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়।’ এই ওড়াটাই হলো মুক্তির আর্কিটাইপ, উড়ে যেতে চাইছে সব ছিন্ন করে, মুক্তি পেতে চাইছে বাসনা তৃপ্ত করে, যা মূলাধারচক্র সাধনার মূল রস , যা আবার ফিরে এসেছে ‘মুকুরে প্রতিফলিত’ ( ২৬/৮/১৯৬০) কবিতায়, ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।’ এভাবেই ঈচ্ছিক মুক্তির পথে বার বার তাঁর কলম লিখে চলেছে মূলাধারচক্রের সার কথা। মণিপুরচক্র বলছে যে, এই সাধনার ফলে সাধক অন্যের শরীরেও প্রবেশ করতে পারেন, যেভাবে ‘আমার আশ্চর্য ফুল যেন চকোলেট এক বস্তুস্হিত অবস্হান থেকে অন্য বস্তুস্হিত অবস্হানে চলে যাচ্ছেন কবি । স্বচ্ছ জলে মিশে যাওয়াটাই মণিপুরচক্র । প্রায় প্রত্যেক কবিতায় এই বৌদ্ধিক সাধকের মিশে যাওয়াটাই অনুভব করতে হয় । একটা চিত্র বার বার অন্য চিত্রের সঙ্গে, অন্য আর্কিটাইপের সঙ্গেমিশে যাচ্ছে ।  বিশুদ্ধিচক্রে পরমযোগী হবার সাধনা বার বার তাঁর কাব্যে এসেছে, যেমন ‘কী উৎফুল্ল আশা নিয়ে সকালে জেগেছি সবিনয়ে’ । এমন তো একজন প্রকৃত ঋষিই পারেন, পরম সাধকেই তো তিনি উত্তীর্ণ ।”
        জুবিন ঘোষ বাসনা পরিতৃপ্তির যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন তা আমরা বিনয়ের ভুট্টা সিরিজ কবিতাতেও পাই। সেই কবিতাগুলোয় একটি আশ্চর্য ফুল রূপান্তরিত হয়েছেন একজন রক্তমাংসের ফুলে । হিন্দু তন্ত্রসাধকদের মতো বিনয়ও আশ্রয় নিয়েছেন রক্তমাংসের অভিজ্ঞতায় । বিনয় তাঁর জাগতিক অভিজ্ঞতাকে অসম্পূর্ণ রাখতে চাননি, যা তিরিশের মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছিল । ভুট্টা সিরিজের কবিকে আমরা হিন্দু তন্ত্রসাধকদের অন্বেষণের সঙ্গে তুলনা করতে পারি, যাঁরা তনুমনের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিশ্লেষণ করতেন । দেবীর আধারে নির্বাচিত সঙ্গিনীর সঙ্গে যৌন একাত্মের মাধ্যমে জরা, ব্যাধি, বার্ধক্য, মৃত্যুকে নিয়ন্ত্রণ করতেন ; মৃত্যুঞ্জয়ী ও ভয়জয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করতেন । হিন্দু ও বৌদ্ধিক তান্ত্রিকদের যৌন একাত্মতা ছিল দেহ ও মনের পরস্পরের জাগতিক ও আধ্যাত্মিক বুনন, পুরুষের সঙ্গে নারীর, মানবের সঙ্গে দৈবের । বিনয় মজুমদার রক্তমাংসের ঈশ্বরীকে খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর রাধায় । সর্বোচ্চ প্রাপ্তির জন্য বিনয় মজুমদার স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে চেয়েছেন, বোধিপ্রাপ্ত, এবং চেয়েছেন শেষতম শান্তি, যাতে মন থেকে যাবতীয় নোংরা বিদায় নিয়ে তাঁকে বামাক্ষ্যাপার স্তরের বোধিতে উন্নীত করতে পারে ।
        অরুণেশ ঘোষ, জুবিন ঘোষ ও নারায়ণচন্দ্র ঘোষ, এবং তাঁদের মতো আরও অনেকে বিনয়ের কবিতায় গায়ত্রী চক্রবর্তীর অস্তিত্ব নস্যাৎ করতে চাইলেন কেন বোঝা কঠিন । বিনয়ের ইনটারমিডিয়েট পড়ার সময়ে আরও ছাত্রী ছিলেন প্রেসিডেন্সি কলেজে । গায়ত্রীর নামটিই কেন তাঁর কাব্যগ্রন্হের নামকরণে এলো ? পুরাণের নানা রকমের চক্র বিনয়কে ‘ফিরে এসো, চাকা, অথবা ‘গায়ত্রীকে’ অথবা ‘আমার ঈশ্বরীকে’ নামকরণে উদ্বুদ্ধ করেছিল, এরকম ভাবতে খটকা লাগে । বিনয় যদি ব্রাহ্মণ পরিবারের বা উচ্চবর্ণের সন্তান হতেন তাহলে না হয় কিছু যুক্তি দেয়া যেতে পারত ।
         তরুণ বয়সে কোনো কিশোরীর প্রতি ক্রাশ যদি হয়েই থাকে এবং তা যদি মনের গভীরে বাসা বেঁধে তরুণটিকে সেই কিশোরীকে নিজের কবিতায় তুলে আনতে প্ররোচিত করে থাকে, সেটাই তো বরং স্বাভাবিক মনে হয় । তবে বিনয় নিজেই বলে গেছেন যে লিখিত কবিতার ভেতরে যা লুকিয়ে থাকে এবং পরবর্তীকালে তাকে পাঠ করলে যদি নতুন কিছু পাওয়া যায় তাহলে তা কবিতাটির অন্তর্গত ‘অতিচেতনা’ ; এই অতিচেতনা এবং অতিসত্য গণিতে থাকে, যে কারণে একই গণিততন্ত্র পরবর্তীকালে আরেকজন গণিতবিদের জন্য অন্য পথের দিশারী হয়ে ওঠে । তাই নারায়ণবাবু ও জুবিনবাবুর যুক্তিকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করা উচিত হবে না, তাঁরা বিনয়-কথিত ‘অতিচেতনা’ আবিষ্কার করেছেন তাঁর কবিতায় ।
         ১৯৮২ সালে ‘কোনো গোপনতা নেই’ শীর্ষক সাক্ষাৎকারে “বাস্তব কবিতা বলে কিছু হয়কি?” প্রশ্নের উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “পুরোটাই — কবিতার প্রত্যেক শব্দ, প্রত্যেক বাক্য, বাস্তব জগত, বাস্তব অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া।” ১৯৬৬ সালে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে তিনি লিখেছেন যে একেবারে কাল্পনিক ভাবনা হলো চিন্তাশূন্য শূন্যস্হান, তার মানে মৃত :-

সব মিলে একটিই বিশাল জীবন তবে ভূবক্ষে রয়েছে
আপাত দৃষ্টিতে দেখা যে-কোনো তথাকথিত একটি ব্যক্তিকে
বিশাল সমগ্র থেকে আলাদা করে নিলে হঠাৎ —
যদি কোনোদিন নিতে কোনোভাবে পারা যায় তবেই হঠাৎ
দেখা যাবে ব্যক্তিটির চিন্তা বলে কিছু নেই, মন তার শুধু
চিন্তাশূন্য শূন্যস্হান — একেবারে কাল্পনিক, তার মানে মৃত

          অর্থাৎ পুরাণের কোনো মিথ থেকে তিনি চাকা ও গায়ত্রীকে এনেছেন বলে বিশ্বাস করা কঠিন । সুমন গুণও বলেছেন, “বিনয়ের ভাষ্য আক্ষরিক অর্থেই ব্যক্তিগত; নিজেকে কেন্দ্র করেই তাঁর বিস্তার ।
         ওই সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “আচ্ছা, কবিতা কি এমন হতে পারে না — ধরো, খাতা কলম নিয়ে রেল লাইনের ধারে গিয়ে বসলাম, যা দেখি ঠিক তাই লিখি — না দেখা একটা শব্দও যেন না থাকে — যেমন ধরো —
    সামনেই ধানক্ষেত দীর্ঘায়িত হয়ে পড়ে আছে
    ধানক্ষেতটির ওই পাশ দিয়ে রাস্তা চলে গেছে
    উত্তরের দিক থেকে ঠিক দক্ষিণের দিকে — তাই দেখি…।

         ‘গায়ত্রীকে’, ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘ঈশ্বরীকে’ কাব্যগ্রন্হটির অসাধারণ প্রেমের কবিতাগুলোও বাস্তবজগতের, এবং এখানেই জীবনানন্দ দাশ-এর কবিতার সঙ্গে বিনয় মজুমদারের পার্থক্য । ১৯৮২ সালের উপরোক্ত সাক্ষাৎকারটিতে বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “গায়ত্রীকে কি তুমি ভালোবাসতে ?” উত্তরে বিনয় মজুমদার, একজন প্রেমিক যেভাবে নিজের গোপন প্রেমের কথা বলে, বলেছিলেন, “আরে ধ্যুৎ, আমার সঙ্গে তিনচার দিনের আলাপ — প্রেসিডেন্সি কলেজের নামকরা সুন্দরী ছাত্রী ছিলেন ইংরেজি সাহিত্যের, তারপরে কোথায় চলে গেলেন, আমেরিকা না কোথায়, ঠিক জানি না।”
         পরে অজয় নাগ জিগ্যেস করেছিলেন, “বিনয়দা, চক্র মানে কী ?” উত্তরে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “চাকা, যা গড়িয়ে গিয়ে চলে আসে, যেখান থেকে শুরু করেছিল ; যে চাকা চালায় সে চক্রবর্তী, আমি সেই চক্রবর্তীকে ফিরে আসতে বলেছি, গায়ত্রী চক্রবর্তীকেই একটা আস্ত চাকা বানিয়ে দিয়েছি ।” ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে মারুফ হোসেন জিগ্যেস করেছিলেন, “গায়ত্রী চক্রবর্তী সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই ।” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “যিনি আমার গুরুদেব ছিলেন, বাংলা ভাষা পড়াতেন আমাকে প্রেসিডেন্সি কলেজে, সেই জনার্দন চক্রবর্তীর মেয়ে হলো গায়ত্রী চক্রবর্তী । ইডেন হিন্দু হোস্টেলের সুপারিনটেনডেন্টও ছিলেন । আমি ওই হোস্টেলে থেকেছি দুই বছর । গায়ত্রীর বয়স তখন কত হবে ? ১০-১১-১২ বছর । আমার তখন হবে ধরো ১৬-১৭-১৮ বছর । তখন আমি ওকে দেখেছি ।”
         ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতাটি সম্পর্কে মাসুদুল হক বিনয় মজুমদারের মনোভঙ্গ বিশ্লেষণ করে বলেছেন যে, “ব্যাপারটি এভাবে উপলব্ধি করা যায় । পুকুরের তলদেশে একটি নারীমৎস্য দুঃখ নিয়ে সাঁতরে বেড়াচ্ছে । হঠাৎ একটি পুরুষ মৎস্য কোনো এক আনন্দের স্পর্শ দিল । সে-সুখে নারীমৎস্যটি জলমাধ্যম থেকে বায়ুমাধ্যমে উড়াল দেয় । কিন্তু সে আনন্দের উড়াল ক্ষণিকের, কেননা সে অনিবার্যভাবেই আবারও দুঃখের স্রোতে মিশে যাবে । কিন্তু মাঝখানে প্রকৃতির ঐক্যের কারণে, আপেক্ষিত তত্বের পরিপ্রেক্ষিতে, এই উড়াল দৃশ্য একটি ফল দেখে নিয়ে দার্শনিক বেদনাতে আপক্ক রক্তিম হয়ে ওঠে । নিউটনের সেই আপেলের ভূপৃষ্ঠে পতিত হবার যে ঘটনা তা দুঃখবাদের কেন্দ্রগামী বিন্দু । যাকে তিনি অভিকর্ষীয় ত্বরণ দিয়ে ব্যাখ্যা করেন এই বস্তুবিশ্বের পরিপ্রেক্ষিতে । কিন্তু মূল বিষয় হচ্ছে দুঃখবাদের এক অনন্ত সমীকরণ । সেই সমীকরণই ঘটান বিনয় মজুমদার, তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় গণিতের সমীকরণ দিয়ে । বিনয় তো নিজের সম্পর্কে বলেছেন, মূলত আমি গণিতবিদ, আমার অধিকাংশ সময় কাটে গণিত চিন্তায় ; আর কবিতা, মানুষ যেরকম কাজের অবসরে সুন্দর সুন্দর ফুলের বাগান তৈরি করে, তেমনি ।”
         মাসুদুল হক কিন্তু  বিনয় মজুমদারের দুঃখের উৎসসূত্রটি জানাননি ।
         বিনয়ের চোখে গায়ত্রী নামের যুবতীটি সুন্দরী,  তিনি একজন গর্বোদ্ধত স্মার্ট ইংরেজিতে-কথা-বলিয়ে কনভেন্টে-পড়া যুবতী সন্দেহ নেই, তবে ফিল্মস্টার বা মডেলদের মুখশ্রীর সৌন্দর্যের দাবিদার তাঁকে বলা যায় না । তাঁর সৌন্দর্য সবাইকে ছাপিয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হবার, এবং পরবর্তীকালে দেরিদার অনুবাদকের ও সাবঅলটার্ন দর্শনের মুখপাত্রীর।  গায়ত্রীর চলে যাওয়াটাও ফিরে এলো ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হে, এবং যে ছবিগুলো কবিতায় বিনয় মজুমদার নিয়ে এলেন, তা বাস্তব জগতের, চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা নয়, অবলোকিত বাস্তব :

         বেশ কিছু কাল হল চলে গেছ, প্লাবনের মতো
         একবার এসো ফের ; চতুর্দিকে সরস পাতার
         মাঝে থাকা শিরীষের বিশুদ্ধ ফলের মতো আমি
         জীবন যাপন করি ; কদাচিৎ কখনো পুরোনো
         দেওয়ালে তাকালে বহু  বিশৃঙ্খল রেখা থেকে কোনো
         মানুষীর আকৃতির মতো তুমি দেখা দিয়েছিলে ।
         পালিত পায়রাদের হাঁটা, ওড়া, কুজনের মতো
         তোমাকে বেসেছি ভালো ; তুমি পুনরায় চলে গেছ ।

         বিনয় মজুমদারের কাব্যসমগ্রের সম্পাদক তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় কাব্যসমগ্রের প্রথম খণ্ডে উল্লেখ করেছেন, ‘গায়ত্রীকে’ কবিতাপুস্তিকাটির নামকরণ প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার তাঁকে লিখেছিলেন, গায়ত্রী চক্রবর্তী প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তো এবং ১৯৬০ কি ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে বি.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে পাশ করেছিল । সে-ই আমার কবিতা বুঝতে পারবে ভেবে তাকেই উদ্দেশ্য করে ‘গায়ত্রীকে’ বইখানি লেখা । সেই হেতু বইয়ের নাম ‘গায়ত্রীকে’ রেখেছিলাম ।

ছয়
         জীবনানন্দের সবচেয়ে জনপ্রিয় কবিতা ‘বনলতা সেন’-এর যদি উল্লেখ করি তবে দেখা যাবে যে তা সম্পূর্ণ কবিকল্পিত, তা অবলোকিত বাস্তব নয়, যা আমরা বিনয় মজুমদারে পাই । তাছাড়া জীবনানন্দ বলছেন ‘থাকে শুধু অন্ধকার’ যা সারাজীবন দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা সহ্য করার পরও বিনয় মজুমদারকে বলতে শোনা যায় না । ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে ( ১৯৮৭ ) বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, “আপনি এরকম থাকেন কী করে ? রহস্যটা কী ? সর্বদাই এমন আনন্দে ?” জবাবে বিনয় বলেছিলেন, “আমি সারাক্ষণ আনন্দে থাকি এটা সত্য কথা । তার জন্য আগে থাকতে ব্যবস্হা করে রাখতে হয় ।” পক্ষান্তরে জীবনানন্দ লিখেছিলেন :-

হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে
সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকার বিদর্ভ নগরে
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু’দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি-দ্বীপের ভিতর
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে ‘এত দিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন ।

সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন
সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ;
পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল ;
সব পাখি ঘরে আসে — সব নদী — ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন ;
থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন ।

          পাশাপাশি পড়ে দেখা যাক বিনয় মজুমদারের অবলোকিত বাস্তবের কবিতা, বিশেষ করে যেগুলো জনপ্রিয় । বিনয় প্রয়োগ করছেন যা বিজ্ঞানের দ্বারা প্রমাণিত, যা যুক্তিপূর্ণ, এমন ছবি :

একটি উজ্জ্বল মাছ
একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃতপ্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় ডুবে গেলো — এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ক রক্তিম হলো ফল ।
বিপন্ন মরাল ওড়ে, অবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নিচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে ;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায় তবু
এমন সময়ে তুমি হে সমুদ্রমৎস্য, তুমি… তুমি…
কিংবা দ্যাখো, ইতস্তত অসুস্হ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যপ্ত বনস্হলী
দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলনের শ্বাসরোধী কথা ।

আর যদি নাই আসো
আর যদি নাই আসো, ফুটন্ত জলের নভোচরী
বাষ্পের সহিত যদি বাতাসের মতো নাই মেশো,
সেও এক অভিজ্ঞতা ; অগণন কুসুমের দেশে
নীল বা নীলাভবর্ণ গোলাপের অভাবের মতো
তোমার অভাব বুঝি, কে জানে হয়তো অবশেষে
বিগলিত হতে পারো ; আশ্চর্য দর্শন বহু আছে
নিজের চুলের মুগ্ধ ঘ্রাণের মতন তোমাকেও
হয়তো পাইনি আমি, পূর্ণিমার তিথিতেও দেখি
অস্ফূট লজ্জায় ম্লান ক্ষীণ চন্দ্রকলা উঠে থাকে,
গ্রহণ হবার ফলে, এরূপ দর্শন বহু আছে           

         জীবনানন্দ দাশ-এর ‘রাত্রি’ ( সাতটি তারার তিমির ) কবিতাটি এবার পড়ে দেখি । দেখবো যে জীবনানন্দ কলকাতা শহরকে পর্যবেক্ষণ করে কবিতাটি লিখেছেন ; বিনয় মজুমদারের অবলোকন পদ্ধতির  ( act of observing, viewing, noticing from personal experience ) সঙ্গে জীবনানন্দের পর্যবেক্ষণ পদ্ধতির ( act of seeing or looking at and act of ruminating historical events ) পার্থক্য আছে । বিনয় নিজের কবিতার খাতায় মার্জিনে যে নোটগুলো নিতেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লেখার সময়ে, সেগুলো প্রধানত ছিল তাঁর ব্যক্তিজীবনে পাওয়া অভিজ্ঞতাগুলো, যখন কিনা জীবনানন্দ অন্য খাতায় নোট নিয়ে রাখতেন বাক্যের, শব্দবন্ধের, চিত্রকল্পের, যেগুলোর সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিজীবনের তুলনায় বাইরের জগতের বিষয়বস্তু বা ঘটনা এবং পৃথিবীর লুপ্ত সভ্যতাগুলোর স্মৃতিচারণ বেশি । জীবনানন্দের ‘পর্যবেক্ষণ’ আর বিনয়ের ‘অবলোকন’ এর সূক্ষ্ম তফাত । ‘রাত্রি’ কবিতাটি :

হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল ;
অথবা সে হাইড্র্যাণ্ট হয়তো বা গিয়েছিল ফেঁসে ।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে ;
একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে

অস্হির পেট্রল ঝেড়ে — সতত সতর্ক থেকে তবু
কেউ যেন ভয়াবহভাবে প’ড়ে গেছে জলে ।
তিনটি রিকশ ছুটে মিশে গেল শেষ গ্যাস ল্যাম্পে
মায়াবীর মতো জাদুবলে ।

আমিও ফিয়ার লেন ছেড়ে দিয়ে — হঠকারিতায়
মাইল মাইল পথ থেঁটে — দেয়ালের পাশে
দাঁড়ালাম বেণ্টিঙ্ক স্ট্রিটে গিয়ে — টেরিটিবাজারে ;
চীনেবাদামের মতো বিশুষ্ক বাতাসে ।

মদির আলোর তাপ চুমো খায় গালে ।
কেরোসিন কাঠ, গালা, গুনচট, চামড়ার ঘ্রাণ
ডাইনামোর গুঞ্জনের সঙ্গে মিশে গিয়ে
ধনুকের ছিলা রাখে টান ।

টান রাখে মৃত ও জাগ্রত পৃথিবীকে ।
টান রাখে জীবনের ধনুকের ছিলা ।
শ্লোক আওড়ায়ে গেছে মৈত্রেয়ী কবে ।
রাজ্য জয় করে গেছে অমর আত্তিলা ।

নিতান্ত নিজের সুরে তবুও তো উপরের জানালার থেকে
গান গায় আধো জেগে ইহুদী রমণী ;
পিতৃলোক হেসে ভাবে , কাকে বলে গান —
আর কাকে সোনা, তেল, কাগজের খনি ।

ফিরিঙ্গি যুবক কটি চলে যায় ছিমছাম ।
থামে ঠেস দিয়ে এক লোল নিগ্রো হাসে ;
হাতের ব্রায়ার পাইপ পরিষ্কার করে
বুড়ো এক গরিলার মতন বিশ্বাসে ।

নগরীর মহৎ রাত্রিকে তার মনে হয়
লিবিয়ার জঙ্গলের মতো ।
তবুও জন্তুগুলো আনুপূর্ব — অতিবৈতনিক
বস্তুত কাপড় পরে লজ্জাবশত ।

         শার্ল বদল্যারের মতন জীবনানন্দও একজন পথচর ছিলেন, নিশাচরও, এবং তাঁর ‘পথ হাঁটা’ কবিতাটি পড়লে তা স্পষ্ট হবে :

কী এক ইশারা যেন মনে রেখে একা-একা শহরের পথ থেকে পথে
অনেক হেঁটেছি আমি, অনেক দেখেছি আমি ট্রাম বাস সব ঠিক চলে
তারপর পথ ছেড়ে শান্ত হয়ে চলে যায় তাহাদের ঘুমের জগতে
সারারাত গ্যাসলাইট আপনার কাজ বুঝে ভালো করে জ্বলে ।
কেউ ভুল করেনাকো — ইঁট বাড়ি সাইনবোর্ড জানালা কপাট ছাদ সব
চুপ হয়ে ঘুমাবার প্রয়োজন বোধ করে আকাশের তলে ।
একা একা পথ হেঁটে এদের গভীর শান্তি হৃদয়ে করেছি অনুভব ;
তখন অনেক রাত — তখন অনেক তারা মনুমেন্ট মিনারের মাথা
নির্জনে ঘিরেছে এসে ; মনে হয় কোনোদিন এর চেয়ে সহজ সম্ভব
আর দেখেছি কি ? এক রাশ তারা আর মনুমেন্ট ভরা কলকাতা ?
চোখ নিচে নেমে যায় — চুরুট নীরবে জ্বলে — বাতাসে অনেক ধুলো খড় ;
চোখ বুজে একপাশে সরে যাই — গাছ থেকে অনেক বাদামি জীর্ণ পাতা
উড়ে গেছে ; বেবিলনে একা একা এমনই হেঁটেছি আমি রাতের ভিতরে
কেন যেন ; আজো আমি জানিনাকো হাজার হাজার ব্যস্ত বছরের পর ।

         বিনয় মজুমদার পথচর ছিলেন না, নিশাচর তো নয়ই । মাঝবয়সে আসঙ্গ-উন্মুখ বিনয় যৌনপল্লীতে ( যাকে তিনি বলেছেন তাঁর ‘বৃন্দাবন’ ) হয়তো   রাধার কাছেও, তিনি যেতেন ‘বিশাল দুপুরবেলায়’, ‘প্রকাশ্য দিনের বেলা’ । ‘বাল্মীকির কবিতা’ প্রকাশিত হয়েছে ১৯৭৬ সালে, তার মানে তখন তাঁর বয়স ৪২ । তার আগে ১৯৬৬ সালে তিনি লিখেছেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ নামে আদিরসাত্মক কবিতাটি, তখন তাঁর বয়স ৩২, যে বয়সে পঞ্চাশ দশকের কয়েকজন কবি সোনাগাছি যাওয়া আরম্ভ করেন । আমি তাঁদের সেই পাড়ায় দেখেছি বলে জানি । আমার হাংরি মামলার উকিলের বাড়ি ছিল ঠিক অবিনাশ কবিরাজ লেনের উল্টোদিকে, এবং উকিলের জানালা দিয়ে সবই দেখা যেতো ।
         কল্পনা নয়, বাস্তব জীবন থেকেই বিনয় তুলে এনেছেন তাঁর কবিতা ও গল্পের রসদ । ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের গ্রামে চায়ের ঠেকে আড্ডা দিতে দিতে যা চোখে পড়ত, সেগুলোই উঠে আসত বিনয় মজুমদারের কবিতায় এবং গদ্যকাহিনিতে । এই পর্বে বিনয় তাঁর দিনপঞ্জীর কাব্যায়ন করতেন : “দিনপঞ্জী লিখে লিখে এতোটা বয়স হলো/দিনপঞ্জী মানুষের নিকটতম লেখা।” যৌনপল্লীতে রাধার কাছে দিনের বেলায় যাবার স্বীকৃতি রয়েছে তাঁর ‘চাঁদের গুহার দিকে’ কবিতায়:-

চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, মেঝের উপরে
দাঁড়িয়ে রয়েছে চাঁদ, প্রকাশ্য দিনের বেলা, স্পষ্ট দেখা যায়
চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষে চেয়ে থাকি, ঘাসগুলো ছোটো করে ছাঁটা ।
ঘাসের ভিতর দিয়ে দেখা যায় গুহার উপরকার ভাঁজ ।
গুহার লুকোনো মুখ থেকে শুরু হয়ে সেই ভাঁজটি এসেছে
বাহিরে পেটের দিকে । চাঁদ হেঁটে এসে যেই বিছানার উপরে দাঁড়াল
অমনি চাঁদকে বলি, ‘তেল লাগাবে না আজ’, শুনে চাঁদ বলে
‘মাখব নিশ্চয়, তবে একটু অপেক্ষা কর’ বলে সে অয়েলক্লথ নিয়ে
পেতে দিল বিছানায়, বালিশের কিছু নিচে, তারপর হেঁটে এসে চলে গেল
নিকটে তাকের দিকে, একটি বোতল থেকে বাম হাতে তেল নিয়ে এল
এসে তেল মাখা হাতে ভুট্টাটি চেপে ধরে ।
যখন ধরল তার আগেই ভুট্টাটি খাড়া হয়ে গিয়েছিল ।
চাঁদ আমি দুজনেই মেঝেতে দাঁড়ানো মুখোমুখি
এক হাতে ঘসে ঘসে ভুট্টার উপরে চাঁদ তেল মেখে দিল ।

         বিনয়ের দৃষ্টিপথে ব্যবিলন, বিম্বিসার, অশোক, মালয় সাগর, আত্তিলা, বিদিশা, শ্রাবস্তী, দারুচিনি দ্বীপ, লিবিয়ার জঙ্গল ইত্যাদি পড়ে না । বিনয়ের কাছে গ্রামের তুচ্ছ জিনিস আর সামান্য চাষি বা দোকানিও গুরুত্বপূর্ণ, তিনি সকলের নাম জানেন, চেনেন। বিনয় লিখেছেন : “সকলকিছুর মানে আছে, মানে থাকে, মানে নেই এরকম কিছু/স্বাভাবিক প্রকৃতিতে কখনো সম্ভব নয়, সৃষ্টি হলে মানে হয়ে যায়।” ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ বইটিতে  তাঁর গ্রামের মানুষজনদের সঙ্গে তাঁর প্রত্যক্ষ যোগাযোগের সূত্র পাই । শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় চম্পাহাটি গ্রামে জমিজমা কিনে বেশ কয়েক বছর ছিলেন, অথচ তাঁর গল্পগুলোয় সেই আন্তরিকতা পাওয়া যায় না যা বিনয়ের ছোটগল্পের চরিত্রদের সঙ্গে বিনয়ের কথাবার্তায় পাওয়া যায় । শ্যামল একটি সাহিত্যিক দূরত্ব গড়ে চরিত্রগুলোকে উপস্হাপন করেছেন ।
         জীবনানন্দ সম্পর্কে বিনয় মজুমদারের শ্রদ্ধা ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনের সঙ্গে এই প্রশ্নোত্তরে ফুটে ওঠে :
         প্রশ্ন : আপনার মতে বাংলা কবিতার শ্রেষ্ঠ কবিতা কোনটি ?
         বিনয় : জীবনানন্দের ‘সমারূঢ়’ অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবিতা । ( বিনয় আবৃত্তি করেন )
বরং নিজেই তুমি লেখোনাকো একটি কবিতা
বলিলাম ম্লান হেসে ; ছায়াপিণ্ড দিল না উত্তর ;
বুঝিলাম সে তো কবি নয় — সে যে আরূঢ় ভণিতা;
পাণ্ডুলিপি, ভাষ্য, টীকা, কালি আর কলমের ‘পর
বসে আছে সিংহাসনে — কবি নয় — অজর, অক্ষর
অধ্যাপক ; দাঁত নেই — চোখে তার অক্ষম পিচুটি ;
বেতন হাজার টাকা মাসে — আর হাজার দেড়েক
পাওয়া যায় মৃত সব কবিদের মাংস কৃমি খুঁটি ;
যদিও সে-সব কবি ক্ষুধা প্রেম আগুনের সেঁক
চেয়েছিল — হাঙরের ঢউয়ে খেয়েছিল লুটোপুটি ।
         প্রশ্ন : হাঙর মানে ?
         বিনয় : হাঙর মানে মনস্তত্ববিদগণ, হাঙর মানে ডাক্তারগণ, হাঙর মানে পুলিশগণ, হাঙর মানে মন্ত্রীগণ, হাঙর মানে পুরোহিতগণ । এই হাঙরদের পাল্লায় পড়ে প্রাণ বেরিয়ে যাবার যোগাড় । বহু কবি মারা গিয়েছেন এদের দুর্ব্যবহারের জন্য । ভেবে দ্যাখো আমরা পাঁচ দশকে যারা কবিতা লিখতাম তাদের মধ্যে বর্তমানে কজন টিকে আছে ? জনা দশেক । তাও নয় । হাঙরেরা দিয়েছে বাকিগুলোকে শেষ করে । ফলে ভয়ে ভয়ে লেখা বন্ধ করে দিয়েছি । এখন একটু জ্বলাতন কম আছে । তবে মরে গেলেই মুক্তি পাব। আমার মুক্তি আলোয় আলোয় এই আকাশে/আমার মুক্তি ধুলায় ধুলায় ভাসে ভাসে ।
         এখানে মনে করিয়ে দিই যে বিনয় যাদের দ্বারা সীমাবদ্ধ হয়েছেন, বা যারা তাঁকে অসীমের দিকে যাত্রায় বাধা দিয়েছেন, তাদের বলছেন হাঙর, মনস্তত্ববিদরা, ডাক্তাররা, পুলিশরা, এমনকি গায়ত্রীর পরিবার যে পুরোহিতের পরিবার ছিল, সেই পরিবারকেও । সময় ও বয়সের সঙ্গে কিশোরী গায়ত্রী ক্রমশ আবছা হয়ে বিনয়ের কাছে হয়ে উঠেছেন বিমূর্ত ঈশ্বরী ।
         ২০০৩ সালে প্রৌঢ়া গায়ত্রী চক্রবর্তীকে নিয়ে এই কবিতাটি লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার, কবিতাটি থেকে অনুমান হয় যে সেই কিশোরী গায়ত্রী যে তাঁকে আকর্ষণ করেছিল, সে তার স্মৃতিতে আর নেই, চাকা আর ফেরেনি :

আমরা দুজনে মিলে
আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো।
তোমার গায়ের রঙ এখনও আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছ ।
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি ।
আমার মাথার চুল যেরকম ছোটো করে ছেটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও সেইরূপ ছোট করা ছাটা,
ছবিতে দেখেছি আমি, দৈনিক পত্রিকাতেই ; যখন দুজনে
যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কী জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
আশা করি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে ।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে,
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে,
চিঠি লিখব না ।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায় ।
                              ( হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ )
         ২০১৩ সালে কলকাতায় যে লিটেরারি ফেস্টিভাল হয়েছিল, সেখানে বাংলা কবিতা আলোচনাকালে বিনয়ের কবিতাকে গায়ত্রী চিহ্ণিত করেছিলেন ‘জ্ঞানতত্ত্বের মহাকাব্য’ এবং ‘এপিসটেমলোজিকাল এপিক’ হিসাবে । গায়ত্রী পরবর্তীকালে লিখেছিলেন ‘ক্যান দি সাবলটার্ন স্পিক’ ; আমি বলব এর উত্তর তো বিনয় মজুমদার, যিনি সাবলটার্ন বর্ণের বলে কবিতা রচনা সত্ত্বেও জীবদ্দশায় সেরকম গুরুত্ব পাননি, যেমন পেয়েছেন তাঁর সমসাময়িক উচ্চবর্ণের কবিরা ।
          বিনয় যে বহুবার মানসিক চিকিৎসালয়ে ছিলেন এবং তাঁকে অনেকে পাগল মনে করে, তা তাঁর চেতনায় ক্ষতের মতন থেকে গিয়েছিল । অন্যের অস্বাভাবিক আচরণকে কেন পাগলামি বলে হবে না তা তিনি লক্ষ্য করেছেন এবং লিখেছেন । ‘কয়েকটি কবিতা’র পাঁচ সংখ্যক কবিতায় কলকাতা কফি হাউসে দুটি যুবতীর অস্বাভাবিক আচরণ নিয়ে এই রচনাটি লিখেছিলেন বিনয় :

আমাদের কফি হাউসে
অন্তত দেড়শো জন লোকের সামনে বসে
একজন যুবতী একজন যুবকের হাতে হাত বোলায়
আর রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনায় — ‘তুমি কেমন করে
গান করো হে গুণী…’
যুবতীটি সবার সামনেই যুবকটির হাতে বহুক্ষণ যাবৎ
হাত বোলায় আর বোলায় আর বলে —’আপনি আমার
দাদার মতো।’
এবং যুবতীর বোন আরেক যুবতী কফি হাউসের
টেবিলের নীচে যুবকটির পা দুই পা দিয়ে
জড়িয়ে ধরে সবার সামনেই, কফি
হাউস ভর্তি লোকের সামনেই । এ করে প্রত্যহ ।
অর্থাৎ পাঠকগণ আমার মতে সব মেয়েই একটি
                                                   ‘মানসিক হাসপাতাল’
                                ( ছোটো ছোটো গদ্য ও পদ্য, জানুয়ারি ২০০৭ )

সাত
         ‘ফিরে এসো, চাকা, বইটির অসাধারণ কবিতাগুলো সত্বেও বিনয় মজুমদারকে সেই ধরণের গুরুত্ব দেয়া হচ্ছিল না, যেমন শক্তি-সুনীল শক্তি-সুনীল ধুয়ো তুলে একটা প্রাতিষ্ঠানিক প্ল্যাটফর্মে তাঁদের দাঁড় করিয়ে দেয়া হয়েছিল । স্বাভাবিক যে নিজের মধ্যে পুষে রাখা অপরত্ববোধ বা আদারনেস বিনয় মজুমদারের মানসিকতায় প্রগাঢ় প্রভাব ফেলে থাকবে । আশ্চর্য যে ওই সময়ের কবিদের তরুণ বয়সের অজস্র ফোটো পাওয়া যায় অথচ বিনয়ের তরুণ বয়সের ফোটো দুষ্প্রাপ্য । বিনয় মজুমদারের প্রায় সমস্ত ফোটোই এমন যে যাঁরা ফোটোগুলো তুলেছেন তাঁরাও প্রমাণ করতে চাইছেন যে বিনয় একজন “অপর’’– উস্কোখুস্কো চুলের বিনয়, লন্ঠন হাতে চলেছেন বিনয়, মাথায় মাফলার জড়িয়ে বিনয়, হাতে বালতি ঝোলানো বিনয়, খালি গায়ে বেঞ্চে বসে বিনয়, ইত্যাদি । আর্যনীল মুখোপাধ্যায় এমনকি লিখেছেন যে বিনয় ছিলেন ‘একসেনট্রিক’ ; আমি বলব বিনয় ছিলেন ‘একলেকটিক’ । বিনয় তো সাহিত্য সভায় কবিতা পাঠও করতেন অথচ সেই সময়ের বিনয়ের ফোটো পাওয়া যায় না কেন ? শক্তি-সুনীল-শরৎ এমনকি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ফোটোও পাওয়া যায়, কিন্তু গায়ত্রীর প্রেমিক যুবক বিনয়ের ফোটো বিরল । অপর করে দেয়া বা ‘আদারিং’ শব্দটি গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাকের সৃষ্ট ।
         সবচেয়ে বিস্ময়কর, বিনয় মজুমদারের সাহিত্যিক প্রতিষ্ঠা নিয়ে কোনো লোভ ছিল না, যেমনটা ছিল তাঁর দশকের অধিকাংশ কবি-লেখকের, এবং পরের প্রতিটি দশকের কবি-লেখকদের মধ্যে । পুরস্কার, সম্বর্ধনা, রেডিও-টেভিতে রঙিন জামা পরে হাত-পা নাড়াতে দেখা যায়নি তাঁকে । আনন্দবাজার আর দেশ পত্রিকার করিডরে কোনোকালেই ঘুরঘুর করতে যাননি । কিন্তু তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁকে কোনঠাশা করে দেবার প্রয়াস চলছে । তিনি অনুমান করেছিলেন যে তাঁর পাণ্ডুলিপি সেইভাবে সংরক্ষিত হবে না যেভাবে খ্যাতনামা কবিদের পাণ্ডলিপি সংরক্ষণ করা হয় ।  “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি যাতে সংরক্ষণ করা হয় তাই বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ ও ওয়েস্ট বেঙ্গল আর্কাইভকে অনুরোধ করেছিলেন । তারা প্রত্যাখ্যান করলে পাঠিয়ে দেন ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে । পঁচিশ বছর পর একটা চিঠি লিখে বিনয় মজুমদার জানতে পারেন যে পাণ্ডুলিপিটি সেখানে সযত্নে সংরক্ষণ করা হয়েছে ।
         গণিত নিয়ে তাঁর গবেষণা সম্পর্কে ১৯৭২ সালে দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে দেয়া সাক্ষাৎকালে বিনয় মজুমদার জানিয়েছিলেন, “১৯৬৩ সালের কিছু চিন্তাকে আমি ভাবলাম মৌলিক আবিষ্কার এবং সেগুলোকে আমি লিখে ফেললাম । লিখে ফেলে প্রথমে আমি ম্যাকমিলান কোম্পানিকে দিয়ে বললাম যে, ভাই দ্যাখ তো তোমরা ছেপে দিতে পারো কিনা পুস্তকাকারে । তবে শেষ পর্যন্ত ছাপা হয়নি, তার কারণ আমি যা শুনেছিলাম, তা হল যে ওদের অধিকাংশই পাঠ্যপুস্তক ছাপার দিকে নজর । একদম একেবারে যা কিনা মৌলিক আবিষ্কার, যা কোথাও পাঠ্য নেই, সেটা ছাপতে ওদের অসুবিধা হয়, বিক্রির ব্যাপার রয়েছে, বিক্রি হয় না । যাই হোক পরে সেই ম্যানাসক্রিপ্ট, ১৯৬৩ সালের ব্যাপার বলছি, ১৯৬৪ সালের শেষ দিকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম আমার কাছ থেকে অ্যাকসেপ্ট করল । আমি পাঠিয়েছিলাম, ওরা বলল, হ্যাঁ, আমরা আপনার পাণ্ডুলিপিখানাকে যত্নের সঙ্গে প্রিজার্ভ করছি, আমাদের মিউজিয়ামে রেখে দিচ্ছি । আমি নিশ্চিন্ত হলাম । সেই পাণ্ডুলিপিখানাকে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে প্রিজার্ভ করে রেখেছে ।  এর মাস কয়েক পর আমি লিখলাম যে
আমার কাছে তো কোনও কপি নেই ভাই, আমার একটা কপি দরকার । ওরা তখন পুরো ম্যানাসক্রিপ্টকে, ধরো একশো পৃষ্ঠা হবে, সেটাকে ওরা পুরো ফোটোকপি করে, ওই একশো পৃষ্ঠা আমাকে পাঠিয়ে দিলো । আমি সেই ফোটোকপিগুলোকে ভালো করে ভাঁজ করে বাঁধালাম, সুন্দর চামড়া দিয়ে বাঁধিয়ে আমাদের ন্যাশানাল লাইব্রেরি, ভারত সরকারের লাইব্রেরি, ওখানে জমা দিয়ে দিলাম । সে হচ্ছে তোমার ধরো ১৯৬৫ সালের গোড়ার দিকের কথা । আমার পাণ্ডুলিপি ব্রিটিশ মিউজিয়ামে যে কপি রয়েছে, সেই কপির ভেতরে বারংবার ব্রিটিশ মিউজিয়ামের স্ট্যাম্প মারা রয়েছে । ওই স্ট্যাম্প দেখে ন্যাশানাল লাইব্রেরি ওটা অ্যাকসেপ্ট করল । আমার তারণা ওই পাণ্ডুলিপিখানা এক মৌলিক আবিষ্কার, গণিতের মৌলিক আবিষ্কার ।         Interpolation Series and Geometrical Analysis and United Analysis Roots of Calculus.” তবে ? যিনি এইভাবে নিজের রচনাবলী নিয়ে চিন্তা করতে পারেন তাঁকে কলকাতার সাহিত্যিকরা ‘পাগল’ হিসেবে দেগে দিল কেন ?
         ১৯৭২ সালে ‘গল্পকবিতা’ পত্রিকায় গণিত ও কবিতা নিয়ে দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেয়া বিনয়ের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছিল । বিনয় তখন কবিতা লেখা ছেড়ে দিয়েছেন, এবং তার কারণ তিনি জানিয়েছিলেন যে গণিত তাঁর মস্তিষ্ক দখল করে আছে । প্রশ্নোত্তরের প্রাসঙ্গিক অংশটুকু পড়লে বিনয়ের সেই সময়কার ভাবনাচিন্তা কোন পথে প্রবাহিত হচ্ছিল তা স্পষ্ট হবে ।
        প্রশ্ন : কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে যে জীবিত খুব কম জনই আপনার মতো কবিতার এতো ভেতরে যেতে পেরেছেন । আপনি খুব সার্থক এবং সাবলীলভাবে, বলা যেতে পারে, কবিতার অতো ভিতরে গিয়েও কেন কবিতা ছেড়ে দিলেন এটা হচ্ছে প্রশ্ন । আর কবিতা লেখা ছেড়ে দেওয়ার আগে পর্যন্ত আপনি নিশ্চয়ই ভেবেছেন যে এই এই কারণে, এই এই অসুবিধে হচ্ছে আমার কবিতা লেখার জন্য — যার ফলে আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দেব । আমরা সেই ভেতরের কারণটা জানতে চাইছি ।
        বিনয় : ভেতরের ?
        প্রশ্ন : ভেতরের কারণ বলতে আপনার মনের ভেতরে যে কারণটা ছিল, যেটা আপনাকে কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে প্রণোদিত করেছে । এই আর কি !
        বিনয় : কিছুদিন আগে তুমি আমাকে লিখেছিলে যে ‘আমার ঈশ্বরীকে’ বইয়ের পিছনে গণিত গ্রন্হের বিজ্ঞাপন দেখেছ তুমি । শুধু ‘আমার ঈশ্বরীকে’ কেন, অনেকগুলো বইয়ের ভিতরে বিজ্ঞাপন আছে । ‘আমার ঈশ্বরী’ বইয়ের বিজ্ঞাপনও আছে । ‘ঈশ্বরীর’ বলে আমার একটা বই আছে, তার ভিতরেও বিজ্ঞাপন আছে। ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’ বলে আরেকখানা বই আছে, তার ভিতরেও গণিতগ্রন্হের বিজ্ঞাপন রয়েছে । এমনকি এক ফর্মার একটি ছোটো পুস্তিকা বেরিয়েছিল ‘অধিকন্তু’, সেই ‘অধিকন্তু’র ভিতরেও আমার লেখা গণিত গ্রন্হের বিজ্ঞাপন রয়েছে । এই গণিতের জন্য আমি কবিতা লেখা ছেড়ে দিতে বাধ্য হলাম।
        প্রশ্ন : কিন্তু গণিত এবং কবিতা কি পাশাপাশি চালানো যেত না ? আপনি চেষ্টা করলে পারতেন । সকলের পক্ষে সম্ভব না হলেও । এবং গণিত ও কবিতার মধ্যে কোথাও মিলও তো আছে । হায়ার ম্যাথমেটিকসের কথা আমি বলছি, আমি যতদূর শুনেছি অবশ্য।
       বিনয় : কথাটা অবশ্য সত্য । গণিত জিনিসটা ইচ্ছা করলে আত্মস্হ করা যায় না, আবার ইচ্ছা করলে এড়ানোও যায় না । মাথার ভিতরে যখন চিন্তা আসে, গণিত বিষয়ক চিন্তা, তখন তাকে ফেলবার উপায় থাকে না । চিন্তাগুলো বার বার আসতে থাকে । গণিতের নানা সূত্র, গণিতের নানা দর্শন, গণিতের নানা প্রকৃতি মাথার ভিতরে আসতে থাকে, সেটাকে ইচ্ছা করলে বন্ধ করা যায় না । কত সময় মাসের পর মাস মাঝে-মাঝে মাঝে-মাঝেই আসতে থাকে । এইভাবে গণিত একজনের চিন্তাকে, এবং আমার চিন্তাকে আত্মসাৎ করে নিয়ে বসে আছে । আমি এই যে বাড়িতে বসে থাকি, কখনও ঘুরে বেড়াই, যখনই একটু-একটু একা থাকি, অন্য মনে, তখনই দেখা যায় মাথায় গণিতের বিষয়ে চিন্তা আসছে । এই ভাবে আসা শুরু করেছে এমন নয়, বহু-বহু অনেক বছর আগে থেকেই, ১৯৫৬-৫৭ সাল থেকেই বলা যেতে পারে । তারপর প্রায়ই আসে মাঝে-মাঝে, আর আসতে-আসতে যখন কোনও চিন্তাকে মনে হয়, গণিত বিষয়ক চিন্তাকে মনে হয়, যে এটা লিখে রাখা উচিত, কাজে লাগতে পারে, আমার কিংবা অপরের যদি কাজে লাগে, তখন তাকে লিখেও রাখতে হয় । এইভাবে গণিতের চিন্তা আমার সমস্ত চিন্তার ভিতরে একটা প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করে আছে দীর্ঘকাল থেকে ।
        প্রশ্ন : গণিতের বিষয় নিয়ে নতুন করে আপনি ভাবতে শুরু করেছেন আবার তাহলে !
        বিনয় : না, কবিতা আমি লিখতাম, এটা ঠিক, কিন্তু সেটা আমার গণিত চিন্তার ফাঁকে-ফাঁকে, এবং তুমি আমার কবিতাগুলো পড়লে দেখতে পাবে যে অধিকাংশই গাণিতিক কবিতা ।
        প্রশ্ন : হ্যাঁ, সেটা আমি লক্ষ্য করেছি ।
        বিনয় : এটা তুমি লক্ষ্য করেছ, ভালো করেছ । বইগুলি এখনও সব পাণ্ডুলিপি আকারে পড়ে আছে । গণিতের কোনও গ্রন্হ আমার ছাপা হয়নি, সমস্ত গ্রন্হই পাণ্ডুলিপি আকারে পড়ে আছে । এখন এই বর্তমানে আমায় তো সারাক্ষণ গণিত ভেবেই কাটাতে হয় । না ভেবে উপায় থাকে না, মাথায় এসে উদিত হয়, যাকে বলে আবির্ভূত হয় । সারাক্ষণ । অন্য কোনও চিন্তা করতেই পারি না । এই চিন্তার উপরে, এই চিন্তার আসা যাওয়ার উপরে, আমার নিজের কোনও হাত নেই । নিজের কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই । মাথায় আসতে থাকে সারাবেলা, ফলে কবিতা লেখার কথা ভাবতেই পারি না, কবিতা আর মাথায় এখন আসেই না । তুমি নিজে কবি, কবিতার আবির্ভাব কী করে হয় নিজের মনে বুঝতেই পারো । নিশ্চয়ই টের পাও কবিতা কী করে আবির্ভূত হয় । সে ইচ্ছে করলে যে কবিতা আবির্ভূত হল সেরকমও নয়, আবার ইচ্ছে করে কবিতা এড়িয়ে গেলে সেরকমও নয় । কবিতার যখন আসার সময় তখন এসে যায় । গণিতও সেরকম, যখন আসার সময় তখন এসে যায় । আমার মাথায় এখন শুধু গণিতই আসছে, অন্য কিছু চিন্তা করার অবকাশ থাকছে না ।”   
        ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য ১৪১২ বঙ্গাব্দের সাক্ষাৎকারে চন্দন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিনয় মজুমদারের বিজ্ঞানভাবনা নিয়ে যে কথাবার্তা হয়েছিল, তা পড়লে বিনয়ের একটি সামগ্রিক ছবি তৈরি হয় :-
        প্রশ্ন : একজন কবিতা পাঠক হিসেবে যখন কবি বিনয় মজুমদারের মহত্ব বা uniqueness-এর কারণ খুঁজতে বসি, তখন মনে হয় বৈজ্ঞানিক মনন, বৈজ্ঞানিক যুক্তিপদ্ধতি আর বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণ ক্ষমতাকে কাব্যরসে আগাগোড়া ডুবিয়ে হাজির করার অভূতপূর্ব গুণটিই আপনার কাব্য-সার্থকতার জন্য এক নম্বর কৃতিত্ব দাবি করতে পারে । ‘ফিরে এসো, চাকা’র খুব জনপ্রিয় কয়েকটি লাইন তুলে নিচ্ছি উদাহরণ হিসেবে । ‘মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়’– এই লাইনের শিরদাঁড়া একটি বৈজ্ঞানিক সাধারণ জ্ঞান বা যুক্তিসিদ্ধ পর্যবেক্ষণ ছাড়া আর কিছু তো নয় । অথচ লাইনটি একটি শ্রেষ্ঠ পংক্তি হয়ে উঠল কীভাবে ? ‘প্রকৃত’ শব্দের প্রয়োগের জন্য । ‘প্রকৃত’ শব্দটি কাব্যগুণের দ্যোতক হিসেবে কাজ করছে এখানে । একই ভাবে, ‘একটি উজ্বল মাছ…পুনরায় ডুবে গেল’, এই দীর্ঘ বিখ্যাত কবিতার লাইন মূলত বিধৃত করেছে ক্লাস নাইনের ফিজিক্স জ্ঞানকে, একটি নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মিশিয়ে । আমরা সবাই পড়েছি জলের রঙ নেই । গভীর জলের মধ্যে যখন আলোকরশ্মি প্রবেশ করে, তখন রশ্মিগুচ্ছ  বর্ণালীতে বিশ্লিষ্ট হয় । বর্ণালির সাতটি রঙের সাতটি বিভিন্ন চ্যুতিকোণ আছে । জলের গভীরতার ওপর নির্ভর করে কোনও নির্দিষ্ট রঙের চ্যুতি আমাদের চোখের অবস্হানের সঙ্গে মিলে-মিশে যায় । ফলে জলকে আমরা সেই রঙেই রঙিন দেখি। আপনি দৃশ্যত সুনীল না লিখে দৃশ্যত সবুজ বা দৃশ্যত তমস — যেখানে সব রঙ শোষিত — লিখতে পারতেন। কিন্তু লাইনটায় কবিতা সৃষ্টি হল ‘প্রকৃত প্রস্তাবে’ শব্দবন্ধের আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে । বিজ্ঞানভাবনার হাড়কাঠামোর ওপর সৌন্দর্যের মাংসত্বক বসিয়ে দিলো সে । এইরকম নানা উদাহরণ আছে । যেমন মশা উড়ে গেলে তার এই উড়ে যাওয়া ‘ঈষৎ সঙ্গীতময় হয়ে থাকে’ সেই বিষয়টা । এখন কথা হচ্ছে বৈজ্ঞানিক মননকে এভাবে বাংলা কবিতায় তো কেউ আনেননি ?
        বিনয় : তোমাদের এই কথাটা ভুল । প্রাচীনকালেও কবিরা বিজ্ঞানভাবনা থেকে কাব্যের আঙ্গিক সৃষ্টি করে নিয়েছেন । আমি যে খুব নতুন কিছু করছি তা নয় । যেমন ধরো কালিদাসের ‘কুমারসম্ভব কাব্য’ । একটি দৃশ্যে যখন হরপার্বতীর বিয়ে হচ্ছে, সেখানে কালিদাস লিখলেন, পৃথিবীর চারদিকে যেমন আলো আর অন্ধকার ক্রমাগত ফিরে-ফিরে আসে, তেমনি শিব আর উমা আগুনের চারপাশে প্রদক্ষিণ করছেন । এটা তো বিজ্ঞানই । অথবা, এই সংস্কৃত শ্লোকটি লক্ষ্য করো — ‘হংসের্যথা ক্ষীরম অম্বু মধ্যাত’। মানে হল, হাঁস যেমন অম্বু অর্থাৎ জলের ভেতর থেকে ক্ষীর বেছে নেয় । তো, এটাও তো সেই তোমার ভাষায় যুক্তিসিদ্ধ বা বৈজ্ঞানিক পর্যবেক্ষণকে কাব্যে প্রকাশ করা । তাই নয় কি ? আমিও লিখেছি ‘ব্রোঞ্জের জাহাজ আছে যেগুলি চুম্বক দ্বারা আকৃষ্ট হয় না । এরূপ জাহাজে বৈজ্ঞানিক সামুদ্রিক গবেষণা করে।’ এই কবিতাটি ‘গায়ত্রী’ কাব্যগ্রন্হে আছে । ‘ফিরে এসো, চাকা’তে নেওয়া হয়নি ।
        প্রশ্ন : বেশ । কিন্তু পরের দিকের কাব্যগ্রন্হে আর একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেল । বিজ্ঞান বা অঙ্কের কোনো কনসেপ্টকে আপনি মানবজীবনের কোনও ঘটনার মতো উল্লেখ করেছেন কবিতায় । বা বহু জায়গায়  অঙ্কের সূত্র দিয়ে মানুষের জীবনকে ব্যাখ্যা করতে চাইছেন । বিজ্ঞান ও অঙ্কের সূত্রেরা এভাবে রক্তমাংসে জীবিত হয়ে উঠছে ।
       বিনয় : মনুষ্যীকরণ । মনুষ্যীকরণ । আর কিছুই না । সেই সময়ে বিজ্ঞানের বেশ কিছু বই অনুবাদ করতে হয়েছিল আমাকে । বইগুলো মন দিয়ে পড়ে দেখলাম, বৈজ্ঞানিক সত্যদের মানুষের জীবনের সঙ্গে মেলানো যায় । এবং এটা কবিতা লেখার এক নতুন পদ্ধতি হতে পারে ।
       প্রশ্ন : সীমা, অসীম, কল্পনা, ব্যোম, রেখা ইত্যাদি জ্যামিতিক ধারণাগুলিকে আপনি মানব বা  মানবীচরিত্র দিতে লাগলেন কবিতায় । জ্যামিতির ওপরও আপনার অসম্ভব টান লক্ষ্য করি ।
       বিনয় : ঠিক তাই । আচ্ছা আমি হচ্ছি ইঞ্জিনিয়ারিঙের ছাত্র । একটা কথা আছে, ড্রইং ইজ দি ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ইঞ্জিনিয়ার্স । আমি যদি একটি ড্রইং এঁকে পাঠিয়ে দিই তবে পৃথিবীর যে-কোনো প্রান্তেই  একজন ইঞ্জিনিয়ার সেটি দেখে বুঝতে পারবে আমি কী বলতে চেয়েছি । নানা রকম ভাবনা মনে আসে । ধরো ম্যাক্সিমা-মিনিমা বিষয়টা । একটা কার্ভড লাইনের পয়েন্ট অফ ইনফ্লেকশান-এ কার্ভটাকে ডিফারেনশিয়েট করলে পাচ্ছ একটা পজিটিভ ম্যাক্সিমা, তাকে আবার ডিফারেনশিয়েট করলে আসবে নেগেটিভ স্ট্রেট লাইন, তাকে ফের ডিফারেনশিয়েশানের ফল হলো নেগেটিভ মিনিমা বা ইনফিনিটি…অর্থাৎ অসীম । সুতরাং কার্ভটির পয়েন্ট অফ ইনফ্লেকশান-এ কী ঘটছে, তার একটা ডায়াগ্রাম এঁকে আমি একখানা জেরক্স করে রেখেছি ।
        প্রশ্ন : আপনার আরেকটি চূড়ান্ত রহস্যময় কবিতা হলো ‘সমান সমগ্র সীমাহীন’-এর ছয় নম্বর লেখাটি: ‘একটি বিড়ি ধরিয়ে সেই পোড়া দেশলাই/কাঠি দিয়ে আমি/টেবিলে লিখেছিলাম অসীম এক নং যোগ অসীম দুই নং যোগ অসীম তিন নং যোগ ফোঁটা ফোঁটা ফোঁটা…’ এবং তারপর লেখা যখন সমাপ্তিকে ছুঁতে চাইছে সেই সময়ে ‘পেলাম অসীম সিংহ/পেলাম অসীম বালা, অসীম মজুমদার/পেলাম অসীম রায় ভাইরে/অসীম’ । আমরা জানি ইনফিনিটি অবিভাজ্য । তো এই অসীমকে ভাগ করা বা বিভিন্ন অসীমের ধারণা করা কীভাবে সম্ভব ?
        বিনয় : কতকগুলো চিন্তা আমার মাথায় অনেকদিন ধরেই ঘুরপাক খায়, এটি তার অন্যতম । ধরা যাক, আমাদের এই ঠাকুরনগরে এক বিঘে বর্গ ক্ষেত্রাকার জমি আছে, অর্থাৎ দৈর্ঘ্যে এক বিঘে, প্রস্হেও এক বিঘে । এবার যদি মাটির ওপর ওই জমির অংশটুকু কল্পনা করি, তবে তা আকাশ ছাড়িয়ে অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত হয়ে যাবে । একইভাবে জমিটির মাটির নীচেও নেমে যেতে অসীম পর্যন্ত ছড়িয়েছে । কাজেই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের এক টুকরো অসীম পাওয়া গেল ।
         প্রশ্ন : কিন্তু বর্গক্ষেত্র তো দৈর্ঘ্য আর প্রস্হের গুণফল । তার অস্তিত্বের ধারণা শুধুমাত্র টু-ডাইমেনশানাল । সেটি আকাশে বা পাতালে প্রসারিত হওয়ার উপায় কোথায় ?
         বিনয় : বেশ, তাতে না হয় আমি আরেকটি মাত্রা জুড়ে দিলাম । সুতরাং তাকে ত্রিমাত্রিক কল্পনা করতে আর অসুবিধা নেই । এইভাবে, ধরো, ওই এক বিঘে বর্গক্ষেত্রের  পাশে আর এক টুকরো এক বিঘের বর্গক্ষেত্র, তার পাশে আরও একটা, এইভাবে টুকরো টুকরো অসীমকে পেয়ে যাচ্ছি । এই অংশগুলির কোনওটির নাম দেয়া যায় অসীম বালা, কেউ অসীম রায়, কেউ অসীম মজুমদার ইত্যাদি । আবার এই সব আলাদা অসীমের যোগফল এক পূর্ণ অসীমও কিন্তু রয়েছে । সে যেন এক ঈশ্বর, এই ব্রহ্মাণ্ডের রাজা । সম্পূর্ণ অসীম যেন এই ছোট-ছোট অসীমের সাহায্যে আমাদের বিশ্বকে শাসন করে চলেছে ।
         ২০০০ সালে ভালোবাসা নিয়ে রোমন্হন করেছিলেন বিনয় মজুমদার, এবং আরেকবার ভেবেছিলেন মানসিক শান্তির কথা এই কবিতাটিতে :-

একমাত্র ভালোবাসা
ভালোবাসা একমাত্র ভালোবাসা ভরে দিতে পারে মনে
                                      শান্তি এনে দিতে
কেবল নারীর প্রতি পুরুষের কিংবা কোনো পুরুষের প্রতি
                                      কোনো নারীর প্রণয় ভালোবাসা ।
— এ তো আছে থাকবেই, তদুপরি প্রতিটি বিশেষ্য পদকেই
ভালোবাসা হল সেই ভালোবাসা যাতে মনে
                                               শান্তি এনে দেয়
আর এই শান্তি কী বা আমাদের প্রয়োজন ?
মনে যদি শান্তি থাকে তবে আর কোনো কিছু
                                         চাওয়ার থাকে না ।
যদি বা চাওয়ার থাকে তা এরূপ যাতে মনে
                                 শান্তি ঠিক আগের মতন থেকে যায়
আমাদের চাওয়া আর পাওয়ার তালিকাগুলি এইভাবে
                                        আমরাই তৈরি করে থাকি ।
                                                   ( কবিতা বুঝিনি আমি — জানুয়ারি ২০০১ )

আট

        যে লোকটির নিজের সম্পর্কে এই ইতিহাসবোধ আছে তাঁকে কেমন করে ‘পাগল’ বলা হয় ? এ যেন উস্কো-খুস্কো চুলের জন্য আইনস্টাইনকে পাগল বলার মতন । বস্তুত বিনয় মজুমদারের মানসিক চিকিৎসালয়ের প্রেসক্রিপশানগুলো কোনো গ্রন্হের অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ।
         বিনয় মজুমদারের রাজনৈতিক মতামত নিয়ে প্রচুর বিতর্ক হয়েছে, বিশেষ করে ‘পরিচয়’ পত্রিকায় প্রকাশিত “আমি এক কমিউনিস্ট এই কথা উচ্চারিত হোক/দিকে-দিকে পৃথিবীতে’, কবিতাটি লেখার পর । ‘কবিতা বুঝিনি আমি’ কাব্যগ্রন্হে তাঁর এই কবিতাটিও বিতর্ককে উসকে দিয়েছে :-

দেশে সাম্যবাদ এলে
দেশে সাম্যবাদ এলে সকল মন্দির
ডিনামাইটের দ্বারা ভেঙে ফেলা হবে
আর যদি কেউ তার বিবাহের কালে
পুরোহিত ডেকে আনে মন্ত্র পড়াবার
নিমিত্ত তাহলে তাকে যাবৎ জীবন
কারাদণ্ড দেওয়া হবে যথা ভগবান
নামক ব্যক্তিকে দাহ করা দরকার
হয়ে পড়ে একদিন অথবা যেমতি
অন্ধকারে বজ্রপাত প্রয়োজন হয় ।
মাঝে-মাঝে মন ক্রমে মহীর মানুষ
অসভ্য অসভ্যতর হয়েই চলেছে
এইভাবে মুহূর্তেই ভাবি মানুষের
গড় আয়ু বেড়ে যাচ্ছে — এ চিন্তা আমার
সান্ত্বনা আনত না মনে, আমি তো ভ্রান্ত না ।

         কিন্তু ১৯৮২ সালে ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার দেয়া সাক্ষাৎকারে  সমর তালুকদার যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন, “শুনেছি সেই সময়ে ( ১৯৫১-১৯৫২ )  তুমি মার্কসবাদের সঙ্গে পরিচিতই হওনি শুধু — ‘ডাস ক্যাপিটাল’-টাও নাকি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়ে ফেলেছিলে ?” জবাবে বিনয় বলেন, “সে সময়টা বড়ো অদ্ভুত সময় ছিল । মার্কসবাদ সম্পর্কে লেখাপড়া, মার্কসবাদ নিয়ে আলোচনা একটা ফ্যাশানের মতোই দাঁড়িয়ে গিয়েছিল — বিশেষ করে শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে । Serious commitment of sincere conviction কতটা ছিল তা বুঝতেই পারি আজ ভারতবর্ষের কমিউনিস্ট আন্দোলনের চেহারা দেখেই । চীনের পার্টি আর আমাদের পার্টির জন্ম প্রায় একই সময়ে — ওরা কোথায় আর আমরা কোথায় ! কী করেই বা হবে ? — ভাবা যায় কমিউনিস্ট পার্টির ( ভারতের ) ইতিহাস লেখা হচ্ছে বুর্জোয়া সরকারের জেলে বসে — ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ইতিহাস ! একে এক ধরণের অর্ডারি লেখা বলা যায় নাকি ? আমি নিজে ন্যাশানাল বুক এজেন্সিতে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্রুফ দেখে দিয়েছি।”
         সমর তালুকদার বিনয়কে বলেন, “পশ্চিমবঙ্গে তো কমিউনিস্টরা শাসন চালাচ্ছেন এখন ?” উত্তর বিনয় বলেন, “ধ্যূৎ, এরা আবার কমিউনিস্ট নাকি !” লক্ষ্যনীয় যে বিনয় মজুমদার কথাটা বলছেন ১৯৮২ সালে, এবং তখনই তিনি আঁচ করে ফেলেছিলেন নেতাদের অধঃপতন, অথচ বহু কবি-লেখক সেসময়ে আর তারপরও বহুকাল বামপন্হীদের লোভী লেজুড় আর স্যাঙাত হয়ে সেঁটে ছিলেন । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে তো মৃত্যুর কয়েক বছর আগেও দেখা গেছে বইমেলায় বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের পেছন-পেছন ঘুরছেন । স্বাভাবিক যে বিনয়ের মতন এই ধরণের খোলাখুলি কথাবার্তা বললে কার্ড হোল্ডারদেরও পার্টিতে পাত্তা দেয়া হতো না ।
         ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য মারুফ হোসেনের সঙ্গে বিনয়ে যে প্রশ্নোত্তর হয়েছিল তা থেকে তাঁর সামাজিক অবস্হানের আঁচ পাওয়া যায় ।
         প্রশ্ন : ষাট-সত্তরের উত্তাল সময় । খাদ্য আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, নকশাল আন্দোলন । বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সময়কে নিয়ে কবিতা লিখে চলেছেন একের পর এক, সহযাত্রী মণিভূষণ ভট্টাচার্য, সমীর রায় প্রমুখ । আর আপনি ১৯৬৬ সালে লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । প্রকাশ হল ১৯৭৪-এ । এটা কি সময় থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া নয় ?
         বিনয় : আমি লিখেছি আমাকে নিয়ে, অন্য কাউকে নিয়ে কবিতা লিখিনি । সবই আমার দিনপঞ্জি । দিনপঞ্জি লিখে লিখে এতটা বয়স হলো/দিনপঞ্জি মানুষের নিকটতম লেখা । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ হল আমার একাকীত্ব নিয়ে ।
         প্রশ্ন : ওই সময় আপনার জীবনে কোনও প্রভাব ফেলেনি ?
         বিনয় : না, একদম না । আমি তখন থাকতাম কলকাতা -২৮, মানে দমদম ক্যাণ্টনমেন্টে দিদির বাড়ি । আসলে পঞ্চাশের কবিরা প্রায় সবাই আত্মজীবনীমূলক কবিতা লিখেছে । শুধুমাত্র নিজেদের নিয়ে লেখা । এটা একটা ট্রেণ্ড বলা যেতে পারে । কেননা এর আগে রবীন্দ্রনাথ বিভিন্ন বিষয়ে কবিতা লিখেছেন । জীবনানন্দ লিখেছেন, নজরুল লিখেছেন । পঞ্চাশের পরেও বিভিন্ন কবিরা লিখেছেন । কিন্তু পঞ্চাশের প্রায় সবাই নিজেদের নিয়ে লিখেছে ।
         প্রশ্ন : এর কারণ কী বলে মনে করেন আপনি ?
         বিনয় : তার আবার কারণ কী ! তখন দেশ সবে স্বাধীন হয়েছে । সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত কবি বলে আমাদের কবিতায় আনন্দের কথা ছিল । স্ফূর্তিও ছিল প্রচুর ।
         ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীম-এর সঙ্গে প্রায় একই বিষয়ে বিনয়ের সঙ্গে এই কথাবার্তা হয়েছিল :-
         প্রশ্ন : আপনি যখন লেখালিখি শুরু করেন তখনকার কলকাতার আর্থ-সামাজিক অবস্হা সম্পর্কে জানতে চাই ।
         বিনয় : আর্থ-সামাজিক অবস্হা কী হবে ? সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে । প্রচুর উদ্বাস্তু এসে হাজির হয়েছে । কলকাতায় তাদের থাকতে দেওয়ার জায়গা হচ্ছে না । বাড়িঘর নেই, বেকার, চাকরি নেই, কী চাকরি দেবে ? চাল-ডালের অভাব । এখন একেক বিঘে জমিতে ধান হয় ২৫ মন, তখন হতো ৮ মন । খাবার নেই । পুরো বীভৎস অবস্হা তখন । ১৯৫৩ সালে অনেক হাতে-পায়ে ধরে নেহরু আমেরিকা থেকে গম আনায় । দেশ ভাগ হয়েছে ১৯৪৭-এ । সারা বছর না খেয়ে, শুটকি মেরে, চাকরি নেই, বাকরি নেই, থাকার জায়গা নেই  — এ অবস্হায় থেকে ৬ বছর পর আমেরিকা দয়া করে গম পাঠাল । সেই গম খেয়ে-খেয়ে মানুষের দিন চলে । কিন্তু দেশ তো স্বাধীন । ৫০-এর কবিরা সেই স্বাধীনতা পাওয়ার ঠিক পরবর্তী সময়কার কবিরা, স্বাধীন যে বছর হল সেই বছর বেশ কিছু কবিতা লিখেছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ও তাই । কবিতাগুলো খুব আনন্দদায়ক হয়েছিল কিংবা আনন্দ-স্ফূর্তির কবিতা হয়েছিল ।
         প্রশ্ন : তার মানে কম বয়সে লেখার ফলে আনন্দদায়ক হয়েছিল ?
         বিনয় : না, স্বাধীনতা পাওয়ার ফলে ।
         ‘ পুনর্বসু’ পত্রিকার জন্য  দেয়া ১৯৮৭ এর সাক্ষাৎকারে, রণজিৎ দাশ জানতে চেয়েছিলেন, “শেষ লেখাটায় আপনি বলেছেন, যে আমি এক কমিউনিস্ট, এই কথা উচ্চারিত হোক ?” জবাবে বিনয় বলেন, “হ্যাঁ, যখন আমি লিখেছিলাম, তখন আমার মনে হল যে এইটা হওয়াই ভালো বুঝলে, ‘পরিচয়’ পত্রিকা… ’পরিচয়’ পত্রিকা, আমার কাছে একটা কবিতা চাইল । কমিউনিস্টদের কাগজ, বুঝেছ ? তখন ভেবে চিন্তে দেখলাম, লিখে দেব । কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য আমি ছয়মাস ছিলাম । এত খাটতে হয়, এত দৌড়োদৌড়ি ছুটোছুটি, যে আর আমার দ্বারা হল না, ছেড়ে দিলাম । হ্যাঁ, রাত্তির সেই এগারোটা পর্যন্ত বক্তৃতা, বুঝতে পারছ ?”
         এখানে পরিষ্কার যে বিনয় মজুমদার সেই সময়ের চালু ধুয়ো “গরিব হওয়া ভালো, উদ্বাস্তু হওয়া ভালো, সর্বহারা হওয়া ভালো, ইংরেজি না শেখা ভালো, কমপিউটার না শেখা ভালো, অবরোধ করা ভালো, কারখানা লাটে উঠিয়ে দেয়া ভালো” ইত্যাদি ভাঁওতার খপ্পরে পড়েননি ।
         কেবল বামপন্হীদের সমালোচনায় নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি বিনয় মজুমদার । অগ্রজ আর সমসময়ের কবিদের সম্পর্কেও নিজের মনের কথা বলেছেন, রাখঢাক করেননি । ১৯৯৮ সালে ‘অধরা মাধুরী’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে বোধিসত্ব রায় বিনয়ের কাছে প্রশ্ন রেখেছিলেন, “বাংলা আধুনিক কবিতা কি পাশ্চাত্যের অনুসারী ?” উত্তরে বিনয় বলেন, “না তো ! ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট আমলে যত বাঙালি কবি ছিল সবাই ইংরেজির অধ্যাপক । ব্রিটিশ গভর্নমেন্ট এদের ছাড়া কাউকে কবি হতে দেয়নি । জীবনানন্দ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণুদে, সমর সেন, অমিয় চক্রবর্তী এঁরা ইংরেজির অধ্যাপক । ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের ইচ্ছানুসারে এই সব কবির কাজই ছিল ইউরোপিয়ান কবিতা নকল করা।”
         ২০০১ সালে ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেন, “শক্তি খুব ভালো কবিতা লিখত কিন্তু শেষ বয়সে মাথাই খারাপ হয়ে গিয়েছিল । সুনীল যে কী লেখে তা আমি জানি না । মন্তব্য না করাই ভালো ।”   ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য মারুফ হোসেনের প্রশ্ন, “আপনার সমসাময়িক কবিদের কবিতা আপনার কেমন লাগে?” এর উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “এদের কবিতা আমার খুব বেশি ভালো লাগে বলি না । উৎপলকুমার বসুর কবিতা ভালো লাগত । ‘গোলাপ তোমাকে আমি ঈর্ষা করি/কত না সহজে তুমি তার মত্ত কেশে ঢুকে যাও ।” উৎপল বসুর এটুকু কবিতাই মনে আছে । অমিতাভ দাশগুপ্তর কবিতা একখানাও মনে নেই ।”
         ১৯৮২ সালে ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর সে ধরনের কবিতা লিখছেন কোথায় — ওনাকে এখন বরঞ্চ ঔপন্যাসিক বলাই ভালো । নীরেন চক্রবর্তীর অনেক আগের লেখা মন্দ নয় — এখন উনি লেখা বন্ধ করে দিলেই ঠিক কাজ হবে বলে মনে হয় । শঙ্খ ঘোষ মাঝে মাঝে ভালো লেখেন ।” প্রতিষ্ঠানে যাঁরা ছড়ি ঘোরান তাঁদের সম্পর্কে এই  ধরণের সাক্ষাৎকার দেবার পর যে সাহিত্যের জন্য পুরস্কার পাওয়া এবং বহুল প্রচারিত পত্রিকার পাতায় ঠাঁই পাওয়া কঠিন তা আমরা বহুকাল হলো জেনে গেছি ।
         জীবনের শেষ দিকে বিভিন্ন পুরস্কার পাবার আগে বিনয় মজুমদারকে সুধীন্দ্রনাথ দত্ত পুরস্কার দেয়া হয়েছিল, দশ হাজার টাকা, প্রধানত তাঁর আর্থিক অবস্হার কারণে । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় পুরস্কারের টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন এবং বিনয়কে পুরস্কারটি দেবার জন্য একটি মঞ্চ তৈরি করে অনুষ্ঠান করা হয়েছিল । বিনয় মজুমদার বসে ছিলেন একটি চেয়ারে । একের পর এক বক্তা সাম্প্রতিক কবিতা নিয়ে, বিনয় মজুমদারের কবিতা নিয়ে বক্তৃতা দিতে থাকেন । ঘণ্টাখানেক পর বিরক্ত হয়ে বিনয় মঞ্চ থেকে নেমে নিজের ঘরে ফিরে যান । কিন্তু তারপরও বক্তৃতা থামেনি । কলকাতা থেকে যাঁরা বক্তৃতা দেবার জন্য গ্রামে পৌঁছেছিলেন, সবায়ের কোটা শেষ হবার পর অনুষ্ঠান ফুরোয় । চা-সিঙাড়া-সিগারেট পর্ব শেষে তাঁরা বিনয়ের ঘরে গিয়ে দেখেন যে তিনি নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছেন ।
         মৃত্যুর এক বছর আগে তাঁকে অকাদেমি পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল, রবীন্দ্র পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল ওই বছরেই, তাও সেই পুরস্কারটি তাঁকে ভাগাভাগি করে নিতে হয়েছিল জীবনানন্দ গবেষক ভূমেন্দ্র গুহর সঙ্গে ! রবীন্দ্র পুরস্কার পেয়ে বিনয় বলেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ সরকার একজন ডাক্তার আর একজন ইঞ্জিনিয়ারকে সাহিত্যের স্বীকৃতি দিলো । রবীন্দ্র পুরস্কার তাঁর আগে দেয়া হয়েছিল অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত, প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত, অমিতাভ দাশগুপ্ত এবং সমরেন্দ্র সেনগুপ্তকে । আনন্দ পুরস্কার তাঁকে দেয়া হয়নি, যে পুরস্কার পেলে তাঁর দৈনন্দিন খরচের সুরাহা হতো, অথচ ওই পুরস্কার দুবার করে দেয়া হয়েছিল সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তসলিমা নাসরিন ও জয় গোস্বামীকে । অকাদেমি পুরস্কার নিতে তিনি যাননি, তাঁর ঠাকুরনগরের বাড়িতে এসে দিয়ে যান দিব্যেন্দু পালিত, উপস্হিত ছিলেন অমিয় দেব ।
         বিনয় মজুমদার কয়েকবার আত্মহত্যার প্রয়াস করেছিলেন বলে শোনা যায় । ঠিক কোন কারণে তিনি নিজের জীবনকে শেষ করে দিতে চেয়েছিলেন, সে-বিষয়ে কোনো সাক্ষাৎকার অথবা নিকটজনের বিবৃতি পড়িনি । পুলিশও হস্তক্ষেপ করেছিল কিনা জানি না । তবে স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় জিন জাগ্রত হয়ে উঠলে  সেই সময়টায় আত্মহত্যা করার রোখ মাথায় চেপে বসে ।
         জয় গোস্বামী, যিনি বিনয়ের কবিতার পাণ্ডুলিপি দেখেছেন, এবং টেলিফিল্মে বিনয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছেন, তিনি ‘আকস্মিকের খেলা’ ( ২০০২) গ্রন্হে  বলেছেন যে বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি যেন কাফকার ডায়েরি । পাণ্ডুলিপির মার্জিনে আছে স্বপ্নের অনুবর্তীতা, দ্রুত-নেয়া নোট, সংক্ষিপ্ত লিখন — তাঁর মনে হয়েছে তিনি যেন কবির পাশেই রয়েছেন, যেমন যেমন কবি তাঁর লাইনগুলোকে আদল-আদরা দিচ্ছেন ।
       জয় গোস্বামী এই সূত্রে উল্লেখ করেছেন বার্গম্যানের  ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’ ফিল্মটির, যা মোটামুটি ‘ফিরে এসো, চাকা’ রচনার সমসাময়িক । ফিল্মটিতে একজন নারী দেয়ালের ফাটলের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকেন, যা নারীটিকে এক ঐন্দ্রজালিক জগতে নিয়ে যায়, যেখানে সবাই আলোচনা করছে এবং অপেক্ষা করছে,  লোকগুলোর মুখশ্রী উজ্বল, যে কোনো মুহূর্তে ঈশ্বরের দেখা পাবার জন্য । একজন কবি যদি ভিন্নভাবে আসপাশের বস্তু ও ঘটনাবলীর দিকে তাকান, এবং সাধারণ মানুষ যেটুকু সচরাচর দেখতে পায়, তার চেয়েও বেশি কিছু দেখতে পান কবি, তাহলে তাকে মানসিক রোগগ্রস্ত তকমা দিয়ে দেয়া হয়, ‘থ্রু এ গ্লাস ডার্কলি’ ফিল্মের নারীটির মতো ।
         গ্রামের পথে বাজারে  বিনয় মজুমদার স্হানীয় একটি দোকানের দিকে তাকিয়ে যখন অবলোকন করেন, তা শার্ল বদল্যারের ফ্ল্যনেয়ার থেকে ভিন্ন । তিনি দোকানটি, দোকানে রাখা জিনিসপত্র, দোকানের বিক্রেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন এবং সম্পর্কটির বিস্তার ঘটিয়ে বিশাল সৃষ্টিজগতের সঙ্গে সম্বন্ধস্হাপন করেন । সাধারণ গ্রামীণ দোকানটির সম্পর্ক রয়েছে স্হানীয় খেতের চাষিটির সঙ্গে, পৃথিবীর অভিকর্ষের সঙ্গে, অক্লান্ত সূর্যের সঙ্গে, দেবী সরস্বতীর সঙ্গে । ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ ( ১৯৯৮ ) গ্রন্হে শিমুলপুরে তাঁর দিনযাপনের চিন্তাকর্ষক খতিয়ান মেলে ।

নয়
         একজন কবির সঙ্গে জনসাধারণ কেমনতর আচরণ করেন তা আমরা কাজী নজরুল ইসলামের ক্ষেত্রে দেখেছি ; তাঁর জন্মদিন এলে তাঁকে বিয়ের বরের মতন কপালে চন্দনের ফোঁটা দিয়ে ফুলের মালা পরিয়ে বরণ করা হতো । অথচ কবি কিছুই বুঝতে পারছেন না । ভ্রাতৃতুল্য ব্যক্তির প্রতি নিষ্ঠুরতা হলো  সম্পর্কের একটি প্রাগৈতিহাসিক আচারানুষ্ঠান । কবিরা এই সামাজিক শোষণপদ্ধতি থেকে পরিত্রাণ পান না, বিশেষ করে তাঁকে যদি মনে করা হয় মস্তিষ্কবিকৃত একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি । জন্মদিন পালন এই আচারানুষ্ঠানে লুকিয়ে থাকা নিষ্ঠুরতা ও অবমাননার উৎসব, যাতে অংশগ্রহণ করে লোকটিকে হেনস্হা করা হয়, এবং প্রক্রিয়াটির মাধ্যমে মানুষটিকে সমভোগতান্ত্রিক বারোয়ারি পীঠস্হানে বসিয়ে হাস্যকর করে তোলা হয় । প্রতিভাবান মানুষকে নিষ্ঠুরতার অস্ত্র প্রয়োগ করে রোমান্টিসাইজ করার এটি একটি ভয়ঙ্কর খেলা । বিনয় এটি বুঝতে পেরেছিলেন, আর সে কথা তাঁর ‘কয়েকটি কবিতা’র ছয় সংখ্যক কবিতায় লিখেছেন :

আমার জন্মদিন পালন করত আগে
কয়েক বছর আগে ।
আহ্বায়ক ছিল অমলেন্দু বিশ্বাস নৌকা পত্রিকার সম্পাদক ।
দৈনিক ‘আজকাল’ পত্রিকায় সংবাদ ছাপা হতো–
‘১৭ই সেপ্টেম্বর কবি বিনয় মজুমদারের
জন্মদিন পালন করা হবে, আপনারা দল বেঁধে আসুন
শিমুলপুরের কবির বাড়িতে ।’
অনেকেই আসত । এসে কবিতাপাঠ গানবাজনা
ইত্যাদি করত । এই অনুষ্ঠানে খাওয়া দাওয়াও হতো ।
কয়েক অতিথি আমার প্রতি সদয় ছিল না–
আমাকে কতবার মানসিক হাসপাতালে
নেওয়া হয়েছিল সেই কথা আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে
আলোচনা করত । তাতে আমি মনে খুব ব্যথা পেতাম ।
ফলে আমি আমার জন্মদিন আর পালন করতে দিই না ।
আমার জন্মদিন পালন বন্ধ হয়ে গেছে ।
         
         কবিতাটি থেকে স্পষ্ট যে, আয়োজকগণ এবং যাঁরা কলকাতা থেকে গিয়ে শিমুলপুরে জড়ো হতেন, তাঁরা গোপনে একজন প্রতিভাবান স্কিৎসোফ্রেনিয়া  রোগির রোগটিকেই উৎসবে বদলে দিয়ে নিজেরা আনন্দ করতে চাইতেন । কবিকে মনে করিয়ে দিতেন যে তিনি কতোবার মানসিক চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছিলেন, যেন মানসিক চিকিৎসালয়ে থাকা একজন দ্রষ্টা কবির বৈশিষ্ট্য । তাঁকে মনে করিয়ে দেয়া হতো যে তাঁর অসুস্হ জীবনের আরেকটি বছর হাতছাড়া হয়ে গেল । নিজের জন্মদিনে জড়ো হওয়া লোকগুলো সম্পর্কে যিনি এরকম কবিতা লিখতে পারেন, তাঁকে কি মানসিক অসুস্হ বলা যায় !
         ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ ( ২০০৩ ) কাব্যগ্রন্হের ভূমিকায় বিনয় মজুমদার লিখেছেন, “কবিতীর্থ প্রকাশিত ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ গ্রন্হের প্রায় সব কবিতাই হাসপাতালে থাকাকালে লিখেছি । একটা কথা আমি দিনে তিনচার বার বলি — সবই সৃষ্টিকর্তার লীলাখেলা । এবারেও তাই লিখি । আমাকে হাসপাতালে পুরে সৃষ্টিকর্তা কী পরীক্ষা করলেন কে জানে ! কী দুরূহ পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে সৃষ্টিকর্তার কাছে এবং পাঠকপাঠিকাগণের কাছে । পরীক্ষায় পাশ করেছি বোঝা যায় ।”
         “কবিতা লেখা আমি মাঝে-মাঝে ছেড়ে দিই । তখন এমন-এমন কাণ্ড ঘটে যাতে ফের লিখতে বাধ্য হই । এই বইখানাও তেমনি জোর করে লেখানো । কবিতা না লিখে বছর চারেক ছিলাম । তারপর আমাকে হাসপাতালে পুরে কাগজ এবং কলম দিয়ে আমাকে বলা হল — ‘কবিতা লিখলে ছাড়া হবে নচেৎ নয়।’ তার ফলে আমি লিখেছি ‘হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ’ বইখানা ।”
         স্কিৎসোফ্রেনিয়ার নিরাময় হিসাবে হয়তো মানসিক চিকিৎসকরা তাঁকে কবিতা লিখতে বলতেন ।
         রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে বাঙালির নিষ্ঠুরতা বিষয়ে বিনয় একটি কবিতা লিখেছেন, শিরোনাম ‘কিছু কিছু কবির’ । এই কবিতাটিতে বিনয় মজুমদার দেখিয়েছেন যে মৃত্যুপথযাত্রী রবীন্দ্রনাথের প্রতি নিষ্ঠুরতার মাধ্যমে যতো বেশি পারা যায় কবির প্রত্যাদেশ ছেঁকে বের করে আনার চেষ্টা করেছিল সমবেত জনগণ । রবীন্দ্রনাথের সেই মুহূর্তের কাঁপা কাঁপা কন্ঠের কবিতাকে দ্রষ্টার দিব্যদৃষ্টি করে তোলার চেষ্টা হয়েছিল, যাকে বলা যায় রবীন্দ্রনাথের ‘বাণী’ । একজন কবি, যিনি মানবজীবনের অস্হিরতা সম্পর্কে চিরকাল চিন্তা করে গিয়েছেন, তাঁকে মৃত্যুশয্যায় একটি স্বয়ংক্রিয় দিব্যদৃষ্টির যন্ত্রে পালটে ফেলার চেষ্টা হলো । এখনকার দিন হলে মোবাইল ফোনে রেকর্ড করা হতো, টিভি সাংবাদিকরা ক্যামেরা মাইক নিয়ে পৌঁছে যেতো আর জানতে চাইতো তিনি কেমন ফিল করছেন ! । বিনয়ের ক্ষেত্রেও, “মানসিক হাসপাতাল থেকে ফেরা” কিংবা “মানসিক হাসপাতালে প্রতিভাবান কবি বিনয়” নাম দিয়ে মোবাইলে তোলা হয়ে থাকবে হয়তো ।

কিছু কিছু কবির সঙ্গে বাঙালিগণ
খুব নিষ্ঠুর ব্যবহার করেছেন ; এবং মনে হয়
ভবিষ্যতেও করবেন । যেমন রবীন্দ্রনাথ যখন মৃত্যুশয্যায়
হাত নাড়তে পারছিলেন না
তখনো বাঙালিগণ দাবি করলেন যে
রবীন্দ্রনাথ মুখে মুখে একটি কবিতা বলুন
সেই কবিতা কাগজে লিখে নেবেন অন্য একজন ।
অগত্যা রবীন্দ্রনাথ কবিতা বললেন এবং
তা লিখে নিলেন একজন শ্রোতা ।
এই হলো রবীন্দ্রনাথের শেষ কবিতা ।

         দাদা সমীর রায়চৌধুরী ‘অপর’ তত্ত্বটি বিশ্লেষণের প্রেক্ষিতে পুরাণ থেকে ‘সংজ্ঞা’ নিরুপণ আলোচনা করেছিলেন। উনি বলেছিলেন, মার্কণ্ডেয় পুরাণে সংজ্ঞা বিশ্বকর্মার মেয়ে আর সূর্যের স্ত্রী । সংজ্ঞাকে নিয়ে যে আখ্যান তা থেকে জানা যায় কখন তিনি চোখ বোজেন, আর কখনই বা চপলভাবে দৃষ্টিপাত করেন, আবার কখনও চোখ মেলে পরম মিলনে প্রস্ফূট হয়ে ওঠেন । এই অবলোকন বদলের ওপর নির্ভর করে কখন তিনি সংযমনকারী যমকে প্রসব করবেন, আর কখনই বা প্রসব করবেন চঞ্চলাস্বভাবা নদী যমুনাকে, আবার কখন জন্ম দেবেন যুগলদেবতা অশ্বিনীকুমারদের । অশ্বিনীকুমার যম নন, তবে যমজ, সৌন্দর্যের অধিকারী আর নিরাময়ে পারদর্শী — স্বর্গবৈদ্য ; বিশ্বচরাচরের মহাপারিবারিক আসঙ্গযুক্ত দ্বিপাক্ষিক শঙ্খিলতার মহাপরিপূরকতা বজায় রাখা যাঁর ধর্ম । চোখ মেলে সংজ্ঞা আরও প্রসব করেন রেবন্ত, যিনি সর্বদা সংঘর্ষে, প্রতিবাদে উদ্যত । যিনি পূর্বের ক্লেদ অপসারণ করে নবীনতাকে প্রশ্রয় দেন । এই আখ্যান বিনয় মজুমদারকে সংজ্ঞায়িত করে, অবলোকন ক্ষমতার মাধ্যমে তিনি জগতসংসারের বিশাল স্পেকট্রামকে পাঠকের সামনে মেলে ধরেন ।
         ‘আজকের পত্রিকা’র ১১ই ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় বীরেন মুখার্জি লিখেছেন যে বিনয় মজুমদার একজন ইনট্রোভার্ট বা আত্মমুখিনতার রূপদক্ষ শিল্পী — অপ্রাপ্তির বিভিন্ন অনুষঙ্গ, স্বগতোক্তি কিংবা আত্মকথন যা শান্তরস-সিক্ত তা রয়েছে তাঁর ‘ফিরে এসো, চাকা’ পর্যায়ের কবিতায় — তীব্র ব্যঞ্জনাধর্মী ও গভীর অর্থবোধক, তাঁর কবিতার সুর তন্ময় ব্যক্তিগত কিংবা মন্ময় বস্তুগত ; তাঁর কাব্যবোধ তাঁর প্রেমিক সত্তাকে প্রজ্ঞাবান করার পাশাপাশি জ্ঞানের গভীরতায় জারিত । তবে বীরেন মুখার্জি মনে করেন যে বিনয় মজুমদারের ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ পাঠে তাঁকে ‘কামোন্মাদ’ বলে মনে হয় । তিনি বলেছেন, জৈবিক মিথুন-সত্তায় আক্রান্ত বিনয় না পাওয়ার তীব্রতর বেদনা শব্দমাধুর্যে উপস্হাপন করলেও, তা অত্যন্ত নিচুস্বরে, যেমন :-

কবিতা সমাপ্ত হতে দাও, নারী, ক্রমে, ক্রমাগত
ছন্দিত, ঘর্ষণে, দ্যাখো, উত্তেজনা শীর্ষলাভ করে,
আমাদের চিন্তাপাত, রসপাত ঘটে, শান্তি নামে ।
আড়ালে যেও না যেন ঘুম পাড়াবার সাধ করে ।

বিনয় মজুমদারকে নানা ধরণের উন্মাদের তকমা দেয়া হয়েছে দেখে বীরেন মুখার্জি সম্ভবত ‘কামোন্মাদ’ তকমাটি ধরিয়ে দিলেন । ‘কামোন্মাদ’ ! এরকম ভয়ঙ্কর আরোপ আর হয় না, যেন বিনয় একজন গ্রিক দেবতা স্যাটারিয়াসিস । বিনয় নিজেই বলেছেন যে তিনি ‘ইরোটিক’ কবিতা লিখতে চান, কেননা ইরোটিক কবিতা লেখার যে চল ইংরেজরা আসার আগে ছিল তা শেষ হয়ে গেছে । কথাটা সত্যি । শ্রীরামপুরের পাদরি আর ম্যকলে সাহেবের ভিকটোরিয় শিক্ষাপদ্ধতির দরুণ প্রাগাধুনিক বাংলার ধারা থেকে নিজেদের মুক্ত করে নেওয়াকে মধ্যবিত্ত বাঙালি গৌরবের ব্যাপার মনে করেছে বহুকাল, তার ওপর ব্রাহ্মধর্মের হাস্যকর রক্ষণশীলতা মিশে সেই ধারাকে সম্পূর্ণ তামাদি করে দিয়েছে ।
         ইংরেজি ভাষার কবি নন বলে ওভিদ, কাতুল্লুস, সেক্সটাস প্রোপার্টিয়াস, পেত্রার্ক, পিয়ের লোয়ুস, গ্রেগোরিও দে মাত্তোস, হিল্ডা হিলর্স্ট, গ্লাউকো মাটোসো, ভিনি করেয়া, ম্যানুয়েল মারিয়া প্রমুখ বাদ গেছেন আমাদের বিদ্যায়তনিক জগত থেকে । ইংরেজিতেও কবিরা লিখেছেন, যেমন চার্লস সুইনবার্ন ( লাভ অ্যাণ্ড স্লিপ ), রবার্ট হেরিক ( আপঅন জুলিয়াজ ক্লোদস ), ই ই কামিংস ( মে আই ফিল সেড হি ), ডাবলিউ এইচ অডেন ( দি প্ল্যাটনিক ব্লো ), জন ডান ( টু হিজ মিসট্রেস গোইং টু বেড ), এমিলি ডিকিনসন ( কাম স্লোলি ইডেন ), ওয়াল্ট হুইটম্যান ( আই সিং দি বডি ইলেকট্রিক ), হার্ট ক্রেন ( ভয়েজেস ) ইত্যাদি । ইংরেজরা সবচেয়ে বড়ো যে ক্ষতি করে গেছে, তা হলো আমাদের সনাতন রসশাস্ত্রকে লোপাট করে দিয়ে নিজেদের ভাষার অলঙ্কার বাংলা ভাষায় চাপিয়ে দেয়া ।
         বাংলা সাহিত্যে ইরটিক কবিতা লেখার ঐতিহ্য ছিল । জেমস লঙ-এর কুযুক্তির দরুন বটতলা সাহিত্য বিলুপ্ত হতে সময় লাগেনি । চর্যাপদ, কালিদাসের মেঘদূত, বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, মানসিংহ-ভবানন্দ উপাখ্যান, দৌলত কাজীর সতীময়না লোরচন্দ্রানী, সপ্তদশ শতকের শুকুর মামুদের গোপীচন্দ্রের সন্ন্যাস ইত্যাদি । বহু আলোচক বিনয়ের ‘ফিরে এসো, চাকা’র পর আর তাঁর কাব্য বিশ্লেষণে এগোন না, তাঁদের মধ্যমেধা-মধ্যবিত্ত মননে চোট লাগে । নৈসর্গিক বর্ণনার মাধ্যমে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে যে যৌনতা আছে তা হয়তো বহু পাঠক ধরতে পারেন না, কিন্তু ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হের ভুট্টা সিরিজে ও ডালাসারির কবিতায় গিয়ে তাঁদের মধ্যবিত্ত চেতনা আক্রান্ত হয় । ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হের পরেও বিনয়ের কবিতার বই বেরিয়েছে, ছোটো গল্পের বই বেরিয়েছে, সেগুলো নিয়ে আগ্রহ দেখা যায় না তাঁদের !
         কবিতা লিখে আনন্দের কথা বলেছেন বিনয়, তা যেমন কবিতাই হোক, তাঁর ‘কবিতালেখা’ নিবন্ধে, “তুমি কষ্ট পাচ্ছো সেই কষ্টের কথা লিখে তুমি আনন্দ পেতে পারো । সৃষ্টির ব্যাপারে এই আনন্দটা তিন স্তরে বিভক্ত । লেখার আগে একটা জিনিস ভাবতে হচ্ছে, তখনকার আনন্দ একরকম ; যখন লিখছি তখন আরেকরকম, আর লেখার শেষে আরেকরকমের আনন্দ । আনন্দ না থাকলে শিল্পসৃষ্টি হয় না ।” তারপর যোগ করেছেন, “ময়ূর পেখম তুলে নাচে  — আমরা দেবতারা মন খুলে কবিতা লিখি । ময়ূরের নাচের মতনই কবিতা লেখা ব্যাপারটা ।”

দশ
         বিনয়ের ঈশ্বরীতে ফিরি । উচ্চাকাঙ্খী গায়ত্রী  আমেরিকায় গিয়ে ১৯৬০ সালে ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেন, এবং কিছুকাল পরেই তাঁদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় । আমার মনে হয় আমেরিকায় পাকাপাকি বসবাসের জন্য ট্যালবট স্পিভাককে বিয়ে করেছিলেন গায়ত্রী, আর ছাড়াছাড়ির পরেও তিনি নিজের নাম থেকে স্পিভাক পদবি বাদ দেননি। আমেরিকায় গিয়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজিতে স্নাতকোত্তর এবং তুলনামূলক সাহিত্যে পিএইচ ডি করেন । স্নাতক স্তরে ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন । বিনয় মজুমদার গায়ত্রীর প্রতিভায় আকৃষ্ট হয়ে থাকবেন, কেননা হোস্টেল সুপারিনটেনডেন্টের  বাড়িতে আত্মগর্বী গায়ত্রীকে তিনি দেখে থাকবেন কয়েক ঝলক মাত্র । পরবর্তীকালে গায়ত্রীর বিশ্বব্যাপী খ্যাতি তাঁকে বিনয়ের কবিতার কেন্দ্রে এনে থাকবে । ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইটির খ্যাতির পরেও গায়ত্রী বহুকাল জানতেন না যে বিনয় মজুমদার নামে প্রতিভাবান অথচ উচ্চাকাঙ্খাহীন, প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া এক ইঞ্জিনিয়ার যুবক তাঁকে নিয়ে প্রেমের কবিতা লিখেছেন। গায়ত্রী কেবল কলকাতার খ্যাতনামা উচ্চ পরিবারের মেয়ে নন, তাঁর দাদুর বাবা ছিলেন রামকৃষ্ণদেবের চিকিৎসক, গায়ত্রীর বাবা সারদা দেবীর কাছে দীক্ষা নিয়েছিলেন — কলকাতার বুর্জোয়া পরিবার বলতে যা বোঝায় । বিনয় তাই এঁদের বলেছেন পুরোহিত পরিবার ।
         ষাটের দশকে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে যখন আমার পরিচয় হয় তখন আমিও জানতুম না যে ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের চাকা হলো গায়ত্রী চক্রবর্তী নামের একজন বিদুষী । বিনয় মজুমদার দুই বছরের জন্য হাংরি আন্দোলনে ছিলেন । সেই সময়ে তিনি একটার পর একটা চারমিনার সিগারেট খেয়ে তর্জনীকে নিকোটিনের রঙে মুড়ে ফেলে ছিলেন । উনি আমায় বলেছিলেন, “তুমি শক্তিকে নেতা করেছো আর শক্তি আমাকে নেতা করেছে।”
         ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকায় মারুফ হোসেনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন, মলয় “হাংরি সাক্ষাৎকারমালা” নামে একটা বই প্রকাশ করেছে । ওতে আমাকে বা শক্তিকে প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়নি।” এই বক্তব্য থেকে মনে হয় যে হাংরি আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি বিনয় চেয়েছিলেন, এবং তাঁকে প্রতিষ্ঠাতার আসনে বসাইনি বলে আহত বোধ করেছিলেন । উনি স্পষ্ট বললে, ওনাকে প্রতিষ্ঠাতার স্বীকৃতি দিলে, বরং পরবর্তীকালে  হাংরি আন্দোলন নিয়ে সুনীল-শক্তি-সন্দীপন যে সাংস্কৃতিক রাজনীতি আরম্ভ করেছিলেন তা ঘটত না ।
         সেই সময়ে কলকাতায় হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে যে ভীতির সঞ্চার হয়েছিল, তাতে বিনয় মজুমদারও প্রভাবিত হয়ে থাকবেন । ২২ জুন ১৯৬৪ তারিখে দেবী রায় আমাকে একটা চিঠি লিখেছিলেন, তাতে এই কথাগুলো ছিল, “তুমি-আমি নাকি কলকাতায় অ্যারেস্ট হয়ে গেছি, চতুর্দিকে গুজব । কয়েকজন চেনা হেফচেনার সঙ্গে দেখা হলে অবাক চোখে তাকাচ্ছে । ভাবখানা এই : কবে ছাড়া পেলে ? আমার তো এখন একতারা নিয়ে বাউল হয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কলকাতায় । সবাই তালে আছে ‘বাঘে ছুঁইয়ে দেওয়ার’, পর্নোগ্রাফি প্রমাণ করে । সুবিমলকে মেসে কে একজন বলেছে, ‘দেখব কী করে হাংরি বুলেটিন বের হয় ।” সেপ্টেম্বর ১৯৬৪-এ আমরা সত্যিই গ্রেপ্তার হই আর আমার বিরুদ্ধে মোকদ্দমা আরম্ভ হয় ।
         সেই সময়ের এলিট বঙ্গসমাজ যে কতোটা চটেছিলেন, হাংরি আন্দোলনের ওপর, তা অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর ৩১ অক্টোবর ১৯৬৪-এর এই চিঠি থেকে অনুমান করা যায়:-
Dear Mr. Ginsberg,
        I am amazed to get your pointlessly discourteous letter of 13th. That you agree with the Communist characterization of the Congress for Cultural Freedom as a fraud and a bullshit intellectual liberal anti-communist syndicate did not, however, surprise me ; for I never thought the Congress for Cultural Freedom had any charge of escaping your contempt for everything ‘bourgeois’ or ‘respectable’.
         If any known Indian writer or intellectual come under police repression for their literary and intellectual work, I am sure the Indian Committee for Cultural Freedom would move in the matter without any ungraceful promptings from you. I am glad to tell you that no repressions of that kind has taken place here currently. Malay Roychoudhury and his young friends of the Hungry Generation have not produced any worthwhile to my knowledge, though they have produced and distributed a lot of self-advertising leaflets and printed letters abusing distinguished persons in filthy and obscene language ( I hope you agree that the word ‘fuck’ is obscene and ‘bastard’ filthy, at least in the sentence ‘Fuck the bastards of the Gangshalik School of Poetry’; they have used worse language in regard to poets whom they have not hesitated to refer to by name ). Recently they hired a woman to exhibit her bosom in public and invited a lot of people including myself to witness this wonderful avantgarde exhibition ! You may think it your duty to promote in the name of cultural freedom such adolescent pranks  in Calcutta from halfway round the world. You would permit me to differ from you in regard to what is my duty.
         It was of course foolish of the Police to play into the hands of these young men and hold a few of them in custody for a few days ( they have all been released now ) thus giving the publicity and some public sympathy — publicity is precisely what they want to gain through their pranks.
        I do not agree with you that it is the prime task of the Indian Committee for Cultural Freedom to take up the cause of these immature imitators of of American Beatnik poetry. I respect your knowledge of European literature but can not permit myself to be guided by your estimation of writers in my language — a language of which you to choose to remain totally ignorant.
        With all good wishes in spite of your grave disagreements and in admiration of some of your wonderful poems.
                                                                               Yours Sincerely
                                                                             Abu Sayeed Ayyub
         অ্যালেন গিন্সবার্গকে এই চিঠিটা লেখার সময়েও আবু সয়ীদ আইয়ুব আমাদের গ্রেপ্তার হওয়া ও মকদ্দমা সম্পর্কে কোনো খবর রাখেননি । আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল কোমরে দড়ি বেঁধে আর হাতে হাতকড়া পরিয়ে, তা উনি জানতেন না । উনি যখন চিঠিটা লিখছেন তখন কেউই মকদ্দমা থেকে ছাড়া পায়নি ; তারা ছাড়া পেয়েছিল ১৯৬৫ সালের মে মাসে । আইয়ুব সাহেব জানতেন না যে আমার বিরুদ্ধে মামলা আরম্ভ হয়েছে য পঁয়ত্রিশ মাস চলেছিল । শঙ্খ ঘোষ যখন ১৯৭১ সালে ‘শব্দ আর সত্য’ প্রবন্ধটি লেখেন, তখন তিনিও খবর রাখেননি যে ইতিমধ্যে নিম্ন আদালতে আমার জেল-জরিমানার দণ্ডাদেশ হয়ে গেছে, বা হয়তো জেনেও চেপে গিয়েছিলেন, আর প্রবন্ধতে কেবল লিখে দিয়েছেন ‘কয়েকজন যুবককে একদিন হাজতবাস করতে হয়েছিল’ । শঙ্খ ঘোষের এই বইটি বিভিন্ন কলেজে বাংলা ভাষার সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত, এবং ছাত্রদের কাছে ভুল বার্তা চল্লিশ বছর যাবত চলেই চলেছে; নতুন সংস্করণেও তিনি সঠিক তথ্য দেবার প্রয়োজন মনে করেননি ।
         যাই হোক, পরে  হাংরি বুলেটিন থেকে নেতা ব্যাপারটা আমি বাদ দিয়ে দিই ।  বিনয়ের কবিতা কয়েকটা বুলেটিনে প্রকাশিত হয়েছিল । সেসময়ে বিনয় মজুমদারের কথাবার্তায় অসংলগ্নতা লক্ষ্য  করিনি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় আর সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের সাহিত্যিক রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে বিনয় মজুমদার আন্দোলন ত্যাগ করেন, কিন্তু আন্দোলন ছাড়ার সময়ে শক্তি আর সন্দীপনকে গালমন্দ করে একটা বুলেটিন নিজেই ছাপিয়েছিলেন, বিলি করতে দিয়েছিলেন আমাদের । বিনয়ের কবিতার নতুনত্বের কারণে ওনার খ্যাতি তরুণ মহলে দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছিল, যা সহ্য করতে পারছিলেন না পঞ্চাশ দশকের কবি আর লেখকরা। আমি গ্রেপ্তার হয়েছিলুম বলে হয়তো বিনয়ের কিছু ভীতিও জন্মেছিল হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে।  
          শক্তি চট্টোপাধ্যায়, নির্মল মৈত্র এবং সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে উল্লেখ করে তাঁর লেখা বুলেটিনটি তুলে দিচ্ছি এখানে । স্বাভাবিক যে এই বুলেটিনটির পর তাঁর সময়ের কবি-সাহিত্যিকরা, যাঁরা তাঁকে আর্থিক সাহায্য করার কথা বলেছিলেন, সেই সাহায্য বন্ধ করার জন্যে তদবির আরম্ভ করেন আর শেষাবধি বন্ধও করে দেন।
১) শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এযাবৎ পাঠকপাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি ; সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করে অবস্হাকে বেশ মজাদার করেছেন ; পদলেহী কুকুরের নিয়োগকারিণী চালচুলোহীন এক নারীর আত্মার নির্দেশনা অনুসারে উক্ত কবি নিজেকে মহিলা মনে করে কবিতা লেখেন ; আর কথপোকথনকালে দেখি মহিলার অভিনয় করায় শ্রীমানটির কোনো ভাবলেশ উপস্হিত হয় না ; অথচ ক্রমে-ক্রমে আমার দাসীত্ব দিয়ে সেই বেয়াদপ আত্মাটিকে শায়েস্তা করেছি আর অঙ্কশাস্ত্রে শ্রীমতি এখন মতামত জ্ঞাপনের মতন স্হূলতা দেখাবার বিপদের ঝুঁকি নিতে সক্ষম হবে কি ?  কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ।
২) স্হাপত্যবিদ্যায় ফেল মেরে-মেরে এক ছাগছানা বীর্যজাত নির্মল মৈত্রেয় জীবিকায় হাস্যকর ভিক্ষাবৃত্তি ঝুলে আছে । তবে ভয় নেই, যতক্ষাণ তার কচি পায়ু আছে, দালালী রয়েছে ।
৩) সন্দীপন, হে শ্রীমান, দাস-অনুদাস শব্দটি শুনেছিলাম কবে যে ঠিক মনে নেই । তবে এটা নিশ্চিতই কবুল করতে হবে — দাসী-অনুদাস বলে কোনো শব্দ এ যাবৎ আমি তো শুনিনি । ফলে যথাযথরূপে তোমার অবস্হা প্রকাশের স্বচ্ছতা, বৎস, ভবিষ্যতে ভেবে দেখা যাবে ।
৪) দল পাকাবার আগে, পরেও তাদের, রেকটাম বীট করে দিয়েছি বলেই, এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল ।
                                                                                     ১০.৬.১৯৬৪
                                                                                 রচয়িতা ও প্রকাশক
                                                                                     বিনয় মজুমদার
                                                                          ৬৯, মীর্জাপুর স্ট্রিট, কলকাতা – ৯

           কফিহাউসে বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন পুলিশ হাজতে থাকার সময়ে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে পুলিশ দুর্ব্যবহার করে থাকবে, হয়তো   থানার লকআপে তাঁর আচরণেও স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগির ব্যাখ্যাহীন আস্ফালন নিচু স্তরের পুলিশকর্মীদের বিরক্ত ও ভীত করে থাকবে । আর হাংরি আন্দোলনে আমাদের গ্রেপ্তারি-মামলা ইত্যাদি নিয়ে কলকাতার সাহিত্যজগত তখন বেশ উত্তপ্ত । বিনয়ের ওপর হাজতে পুলিশ সত্যই খারাপ ব্যবহার  করে থাকবে, যে কারণে বিনয়ের বাঁ কান আর বাঁ চোখ নষ্ট হয়ে গিয়েছিল । সঞ্জয় চক্রবর্তীকে দেয়া ১৯৯৩ সালে ‘যোগসূত্র’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছেন যে, বেঙ্গল ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ার সময়ে তাঁর চোখ কান সবই ভালো ছিল। কিন্তু কলকাতাতেই পরে লোকে ধরে বাঁ-চোখ আর বাঁ-কান নষ্ট করে দিয়েছিল । সম্ভবত বারবার ইলেকট্রিক শক দেবার ফলে অবস্হা আরও খারাপ হয়ে গিয়েছিল । সঞ্জয় চক্রবর্তীকে বিনয় বলেছিলেন যে উনি চারবার জেল খেটেছেন । দ্বিতীয়বার জেলে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে গিয়ে । অন্য দুইবারের তথ্য আমি যোগাড় করতে পারিনি । ১৯৭২ সাল থেকে যে সাক্ষাৎকারগুলো বিনয় মজুমদার দিয়েছেন, তাঁর উত্তরগুলো থেকে মনে হয় যে তিনি ঠিকমতন শুনতে পারছেন না, এবং মাঝে-মাঝে তাঁর উত্তর অস্ফূট হয়ে যাচ্ছে । পরে তাঁর ডান কানের ব্যথা বেড়ে গিয়ে শ্রবণশক্তি কমে যায়, যা উনি এই কবিতাটিতে লিখেছেন :-

চোদ্দই অগাস্ট আজ
চোদ্দই অগাস্ট আজ দু-হাজার দুই সাল । কানে
তীব্র ব্যথা, ফলে
সব কাজ বন্ধ আছে, অতি কষ্টে কবিতাটি লিখছি এখন ।
ডান কানে তীব্র ব্যথা, এবং ডাক্তার
ওষুধ দিয়েছে কিন্তু ব্যথা তো সারেনি ।
কানের শ্রবণশক্তি কিছুটা কমেছে ।
যদি কেউ কথা বলে তাকে বলি ‘চিৎকার করো’।
যদি চিৎকার করে তাহলে শুনতে পাই, না হলে শুনি না ।
                                                ( হাসপাতালে লেখা কবিতাগুচ্ছ – ২০০৩ )
         ১৯৯৯ সালে ‘প্রচ্ছায়া’ পত্রিকার জন্য সাক্ষাৎকারে মারুফ হোসেন বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, “হাংরি জেনারেশন সম্পর্কে কিছু শুনতে চাই”। জবাবে বিনয় মজুমদার বলেছিলেন, “শক্তি চট্টোপাধ্যায় ‘ফিরে এসো, চাকা’ সমালোচনা করতে গিয়ে সম্প্রতি পত্রিকায় প্রথম লিখল ‘খুতকাতর সম্প্রদায়’ । বলল আমি নাকি হাংরি জেনারেশনের প্রতিষ্ঠাতা । এরপর হাংরি জেনারেশন পত্রিকা বেরোলো ‘ক্ষুধার্ত’ । হাংরি জেনারেশনের বুলেটিন । সেই পত্রিকার প্রথম সংখ্যার প্রথম কবিতাটিই ছিল আমার । ‘খেতে দেবে অন্ধকারে সকলের এই অভিলাষ’ । আমার পরে শক্তির কবিতা । তারপরে মলয় রায়চৌধুরী প্রমুখের কবিতা । এরপর আমি শক্তিকে লিখলাম, না আমি প্রতিষ্ঠাতা নই । হাংরি জেনারেশন যখন শুরু হয়, যখন পত্রিকা বেরোয় তখন আমি দুর্গাপুরে চাকরি করি । ফলে আমার পক্ষে কোনো আন্দোলন শুরু করা সম্ভব নয় । সুতরাং আমি নই, শক্তি চট্টোপাধ্যায় হল হাংরি জেনারেশনের প্রতিষ্ঠাতা । পরে শক্তি হাংরি থেকে বিচ্যুত হল, আমিও বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম । ফলে মলয় রায়চৌধুরী হাংরি প্রতিষ্ঠা করেছে বলে দাবি করে । কথাটা মোটামুটি সত্য কথাই । শেষ পর্যন্ত ও-ই যখন হাংরি জেনারেশন চালাচ্ছে তখন ওকেই প্রতিষ্ঠাতা বলা কর্তব্য বলে আমার মনে হয় । এটা উচিত ।”
         প্রথম সংখ্যায় নয় । বিনয়ের কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল দশ নম্বর বুলেটিন থেকে । তার আগের বুলেটিনগুলো আমি পাটনা থেকে ইংরেজিতে ছাপাতুম । দেবী রায় কলকাতায় ছাপানো আরম্ভ করলে বাংলায় নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে । আর “ক্ষুধার্ত” হলো সুভাষ ঘোষ-শৈলেশ্বর ঘোষ-বাসুদেব দাশগুপ্তদের সত্তর দশকের পত্রিকা, হাংরি বুলেটিন নয় । মামলায় রাজসাক্ষী হবার দরুন ওরা হাংরি শব্দটা তখন ব্যবহার করতে ভয় পেতো, তাই “ক্ষুধার্ত” বের করতো । আমি “হাংরি কিংবদন্তি” বইটা লেখার পরে ওদের টনক নড়ে । শঙ্খ ঘোষের বদান্যতায় হাংরি আন্দোলনের বিকৃত ইতিহাস ও আমাকে গালাগালসহ দে’জ থেকে “ক্ষুধার্ত” সংকলনগুলো হাংরি জেনারেশনের নামে প্রকাশিত হয়েছে । বলা বাহুল্য যে তাতে বিনয় মজুমদার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অনিল করঞ্জাই, আলো মিত্র এবং আমার কোনো রচনা নেই । অর্থাৎ যাঁরা আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তাঁদের লেখাই নেই ।
         শক্তি আর সন্দীপনও একই সময়ে হাংরি আন্দোলন ছাড়েন, প্রধানত আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ওসকানিতে; সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মনে করেছিলেন যে তাঁর ‘কৃত্তিবাস’ গোষ্ঠী ভেঙে দেবার ষড়যন্ত্র হিসাবে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা হয়েছে, আর সেকথা তিনি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে চিঠি লিখে জানিয়েছিলেন । বস্তুত সেসময়ে তিনি এতোই হিংসুটে মনোভাবের হয়ে গিয়েছিলেন যে তারপর আমার কাছ থেকে কখনও কবিতা চাননি, দাদাকে চিঠিতে লিখেছিলেন যে মলয় কবিতা লিখতে জানে না, যদিও তার আগেই উনি ‘কৃত্তিবাস প্রকাশনী’ থেকে আমার ‘শয়তানের মুখ’ কাব্যগ্রণ্হ প্রকাশ করেছিলেন, ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় আমার যে কবিতা প্রকাশ করেছিলেন সেগুলো ‘কৃত্তিবাস সংকলন’ গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত করেছেন । তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায়ও আমাকে ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকায় কবিতা লিখতে বলেছিলেন । আমি ‘নীরার জন্য প্রেমের কবিতা’ লিখেছিলুম যা প্রকাশ করতে চাননি তাঁর সহসম্পাদকরা । এই কবিতাটা আমার ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো’ কাব্যগ্রন্হে আছে ।
         সেই সময়ে কফি হাউসের বেয়ারার মাথায় লাঠি মারার দরুন বিনয় মজুমদারকে পুলিস আটক করেছিল, কুড়ি দিন জেল-হাজতে কাটাতে হয়েছিল। আরেকটা মারামারির দরুণ মাতালদের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেশ আহত হয়েছিলেন, তাঁর চোখ-মুখে রক্তের কালশিটে পড়ে গিয়েছিল । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় দাদাকে লেখা একটা চিঠিতে এই ব্যাপারগুলো বেশ রসিয়ে লিখেছিলেন । মারামারির একটা পর্ব শুরু হয়ে গিয়েছিল তখন ; সুবিমল বসাককে কফিহাউসের সামনে শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর অনুজ কবিরা ঘিরে ধরেছিলেন মারার জন্য কিন্তু সুবিমলের হিন্দি গালাগালের হুঙ্কারে সবাই পালিয়েছিল ।

এগারো
         স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হবার বয়স হল ষোলো থেকে তিরিশ বছরের মধ্যে । তা মূলত জিনগত রোগ হলেও, জন্মের আগে গর্ভে ভ্রুণের দুর্বলতার জন্য, সামাজিক চাপে মস্তিষ্কে ডোপামাইন ও গ্লুটামেটের রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য, ভাইরাসের আক্রমণে জিনে প্রভাবের জন্যে ঘটতে পারে । চিকিৎসা হয় প্রধানত অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের দ্বারা, বন্ধুবৎসল পরিবেশের দ্বারা, পরিবারে আদরযত্নের দ্বারা ।
         ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলো লেখা হয়ে যাবার পর বিনয় মজুমদার প্রথমবার স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হয়েছিলেন বলে অনুমান করা যায় । প্রেসিডেন্সিতে পড়ার সময় তিনি স্বাভাবিক ছিলেন এবং  ইডেন হোস্টেলের মাঠে ফুটবল খেলতেন ; ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ছাত্র ইউনিয়ানের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন । সুতরাং ছাত্রাবস্হায় তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় আক্রান্ত হননি । তাহলে কি গায়ত্রীকে নিয়ে কবিতা রচনার প্রচণ্ড চাপ গড়ে উঠেছিল বিনয়ের ওপর ? সমর তালুকদার ১৯৮২ সালে কবিতীর্থ পত্রিকায় লিখেছিলেন, তিনি ষাটের দশকের মাঝামাঝি যখন বিনয় মজুমদারকে দেখেছিলেন তখন “বিনয়ের মাথায় ঝাঁকড়া অগোছালো চুল, মুখভর্তি দাড়ি, জামাকাপড়ে মালিন্যের করুণতম ছাপ, গায়ে দুর্গন্ধ, আঙুলে বড় বড় নখভর্তি ময়লা । আর ছিল সমস্ত শরীর, স্নায়ু-গ্ল্যাণ্ডভর্তি রাগ । সবাইকে ভেংচাচ্ছেন — কাউকে খামচে দিচ্ছেন নিজের খেয়ালখুশিমতো । অশ্লীল ভাষায় থুতু ছিটিয়ে চলেছেন টেবিলে টেবিলে।”
          আমি কিন্তু হাংরি আন্দোলনের শুরুতে বিনয়ের ওই রূপ দেখিনি । কোন ঘটনার চাপ তাঁর  ভারসাম্যকে দুলিয়ে দিয়েছিল তা জানি না, কবিতা লেখার চাপ ছাড়া । হিন্দি লেখক ও ‘জ্ঞানোদয়’ পত্রিকার সম্পাদক শরদ দেওড়া এই সময়ের বিনয় মজুমদারকে নিয়ে “কলেজ স্ট্রিট কা নয়া মসিহা” নামে একটা বই লিখেছিলেন । অন্যান্য সমসাময়িক কবিদের তুলনায় বিনয় যে কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন তা অবাঙালি লেখক শরদ দেওড়ার সাহিত্যিক শ্রদ্ধাজ্ঞাপন থেকে স্পষ্ট হয় ।
         স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জন্য একজন লোক কবি বা আঁকিয়ে হন, নাকি তিনি কবি বা আঁকিয়ে বলে স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জিন জাগ্রত হয়ে ওঠে, এই প্রশ্নের কোনো উত্তর মনোবিদরা খুঁজে পাননি আজও । কোনো কোনো পুরাতাত্বিক মনে করেন যে গুহার দেয়ালে হোমো এরেকটারদের আঁকা যে ছবিগুলো দেখা যায় তা হয়তো স্কিৎসোফ্রেনিয়ার জিন দেহে ছিল এমন মানুষদের আঁকা ।  অধিকাংশ বিখ্যাত লেখক-কবি-আঁকিয়ের চরিত্রে সমাজের বাইরে বসবাস করার এবং সীমালঙ্ঘনের আগ্রহ দেখা গেছে । কবিতার ও ছবিআঁকার শৈলী সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে আর পরিবর্তনের সেই উথ্থান-পতনের সঙ্গে নিজের কাজকে সামাল দেবার প্রয়াস করতে হয়, এই ব্যাপার যেমন দেখি পাবলো পিকাসো এবং পল গঁগার ক্ষেত্রে, তেমনই দেখা গেছে বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রে । এর দরুণ আলোচকদের প্রশংসা অথবা কটূ সমালোচনা জোটে কবি-লেখক-আঁকিয়ের । তাঁদের ভাবতে বাধ্য করে যে সাহিত্য বা ছবি আঁকা তাঁদের সারা জীবন হয়তো চাকুরিহীন থাকতে বাধ্য করবে, এই ভাবনা বিনয় মজুমদারে পাই আমরা । এক সাক্ষাৎকারে তাঁকে জিগ্যেস করা হয়েছিল, তিনি বিয়ে করেননি কেন ? উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, তাঁর কোনো চাকরি নেই, বাঁধা আয় নেই, তাই ।  
           স্কিৎসোফ্রেনিয়া রোগের উপসর্গ হল অজীর্ণ, যা লোকটিকে সারা জীবন বইতে হয়, অনেক সময়ে পেট খারাপের দরুন যেখানে-সেখানে মলত্যাগ হয়ে যায় ; তারপর অ্যান্টিসাইকোটিক ওষুধের ক্রিয়ায় অজীর্ণ  স্হায়ী হয়ে যায় ; ফলে ফ্যানাভাত খেতে হয় বা আলুসিদ্ধ খেতে হয় । বিনয় মজুমদার শেষ বয়সে তাঁর অজীর্ণ নিয়ে একটি কবিতা লিখেছিলেন, তাতে “মুগ্ধ মলত্যাগ” অভিব্যক্তিটি অসাধারণ :-

আর গাইব না
অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর গান গাই না তো ।
যেখানে সেখানে মুগ্ধ মলত্যাগ শেষ হয়ে গেছে ।

বর্তমানে বসে আছি আমার চৌকির উপরে ।
পরনে একটি লুঙ্গি, গায়ে এক গেঞ্জি আছে ।
ঢেকুর বেরোচ্ছে বটে, তবে এ ঢেকুর ধোঁয়া ঢেকুর নয় ।
কোনো গন্ধ নেই এ ঢেকুরে ; আমি একা একা আছি ঘরের ভিতরে ।
আমার বাড়ির সব আলো জ্বালা আছে ।
তদুপরি হারিকেন লন্ঠনটি জ্বালা আছে টেবিলের উপরে ।
অজীর্ণ, তোমাকে নিয়ে আর গান গাই না তো, আর গাইব না ।

        আধুনিকতাবাদের সবচেয়ে গোলমেলে ব্যাপার হলো যে বৃহত্তর সমাজ তাঁদের সম্পর্কে একটি নেগেটিভ  ধারণা গড়ে তোলে, যেন নিউরোটিক এবং মনস্তাত্বিক বিপর্যয় কবিতা রচনা বা ছবি আঁকার জরুরি উপাদান । বঙ্গসমাজে আমরা দেখেছি যে প্রাগাধুনিক কালে এই ধরণের মানুষ সমাজের বাইরে বেরিয়ে অঘোরী-তান্ত্রিক-সন্ন্যাসী-সুফি-দরবেশ-ফকির-আউল-বাউলের জীবন বেছে নিতেন । সুফি সন্তরা যেভাবে নৃত্য করেন তাকে সালাফিস্টরা বলেন পাগলামি, তার কারণ সবাইকে সালাফিস্ট ভাবধারায় পিটিয়ে সমরূপী করার তত্ত্বকে অস্বীকার করেন সুফিরা ; এ এক ধরণের সাম্রাজ্যবাদি প্রয়াস, তত্বের উপনিবেশের জেলখানায় ঢুকিয়ে বন্দি করে রাখার চেষ্টা । পাকিস্তানে সুফি সন্তদের সমাধিগুলোকে সালাফিস্টরা বোমা মেরে উড়িয়ে দিচ্ছে, তার দরুণ সমবেত তীর্থযাত্রীরাও মারা যাচ্ছেন । বুল্লে শাহের মতন সন্তের গান নিষিদ্ধ করে দিয়েছে সালাফিস্টরা । বিনয় মজুমদারের ক্ষেত্রেও , বহু আলোচক তাঁকে ‘ফিরে এসো, চাকা’ কাব্যগ্রন্হের সাব-জনারেই আটক রাখতে ভালোবাসেন , অথচ তিনি আরও তিনটি সাব-জনারের কবিতা লিখে গেছেন ।         
         আজকাল দেখি অনেকেই, এমনকি দরবারি তাঁবেদাররাও, উপদেশ দেন যে হাংরি হলে কী করা উচিত আর কী করা উচিত নয় ! আমি পড়াশুনায় ভালো ছিলুম বলে গ্রামীণ উন্নয়নের কাজে উঁচু পদে চাকরি করেছি বলে আমাকে আক্রমণ করা হয়, যেন গরিব সেজে ঘুরে বেড়ানো উচিত ছিল । হাংরি আন্দোলনের সময়ে বিনয় মজুমদার যদি ভুট্টা সিরিজের কবিতা লিখতেন তাহলে সরকার সংবাদপত্র বিদ্যায়তনিক প্রতিনিধিরা তাঁর কি গতি করতেন তা সহজেই অনুমেয় । গোর্কি সদনের অনুষ্ঠান থেকে ‘বাল্মীকির কবিতা’র কবিতা পাঠ করার জন্য বিনয় মজুমদারকে অশ্লীল কবি ছাপ্পা দিয়ে বিতাড়ন করা হয়েছিল । ১৯৭৭ সালে প্রকাশক ‘বিশ্ববাণী’র কাছে লালবাজার থেকে নির্দেশ গিয়েছিল যাতে বইটি বিক্রি করা না হয় । পুলিশকর্তারা তো নিজে থেকেই নির্ণয় নেন না ; কোনো সাহিত্যিক খোচর তাঁদের কাছে বইটির কথা রসিয়ে-রসিয়ে বলে থাকবে, একটি কপি প্রেস সেকশানে জমা দিয়ে, একথা আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, হাংরি মামলায় ‘উপদ্রুত’ নামের পত্রিকার সম্পাদক পবিত্র বল্লভ পুলিশের খোচরের কাজ করতেন, এবং আমাদের যাবতীয় প্রকাশনা নিয়মিত পৌঁছে দিতেন লাল বাজারের প্রেস সেকশানে, তার বিভাগীয় প্রধান ডেপুটি কমিশনার ছিলেন আবার কবি তারাপদ রায়ের মেসোমশায় । এই খোচরটিকেই সৃজিত মুখার্জি তাঁর ‘বাইশে শ্রাবণ’ ফিল্মে তুলে ধরেছিলেন ।
         আধুনিকতাবাদের ফলে কবি বা ছবি আঁকিয়ের আর্থিক অবস্হা খারাপ হয়ে উঠলে সাধারণ সমাজ এবং রাজনীতিকরা কবি বা ছবি আঁকিয়ের চরিত্রের নেগেটিভ  দিকগুলোকে গুরুত্ব দেন । বিনয় মজুমদারকে আর্থিক সাহায্যের সময়ে এই তর্ক তুলেছিলেন অনেকে । ইউরোপে নেগেটিভ ছাঁচে ফেলে মার্কা-মারা করে দেবার ইতিহাস বেশ প্রাচীন । আধুনিতাবাদের প্রভাবে আমরাও সেই ছাঁচটা নেগেটিভ বলে চিহ্ণিত করতে শিখেছি । এই ইউরোপীয় মানদণ্ডের ফলে সাহিত্য এবং ছবি আঁকার যে সৃজনশীল প্রক্রিয়া তার অর্থপূর্ণ বিশ্লেষণ হয় না । সৃজনশীল সাহিত্যিক ও ছবি আঁকিয়ে বা নৃত্যশিল্পীর ওপর ব্যাপারটা ভয়ংকর চাপের কাজ করে । এই প্রসঙ্গে আমরা আধুনিকতার বাইরে বসবাসকারী রামকিঙ্কর বেইজের প্রসঙ্গ তুলতে পারি । সামাজিক মানদণ্ডের বাইরে বসবাসকারি লালন সাঁই, তুকারাম, কবীর, রবিদাস-এর প্রসঙ্গ তুলতে পারি, যাঁদের এখন বলা হয় সন্ত ।
         কবি, লেখক, ছবি আঁকিয়ে যা করেন তার প্ররোচনার উৎস কোথায় ? যাঁরা টাকা রোজগারের জন্য করেন তাঁদের কথা আমি বলছি না । এই প্রশ্নটা আলোচকদের, দার্শনিকদের, মনোবিদদের, চিকিৎসকদের বহুকাল ধরে ভাবাচ্ছে । নতুন প্রজন্মে নতুনতর তত্ত্ব উপস্হাপন করা হয়েছে । সৃজনশীল প্রক্রিয়ার যুক্তিহীনতাকে নিদারুণ অবজ্ঞা করে প্ল্যাটো বলেছিলেন যে “কবিরা সঠিক চেতনার মানুষ নন, তাঁরা সৃজনদেবীর নিশিডাকে যুক্তির জগত থেকে বিচ্ছিন্ন ।”
         ১৪১৩ বঙ্গাব্দে ‘অউম’ পত্রিকার জন্য জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়ের নেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :-
         প্রশ্ন : ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’য় আক্রান্ত হয়ে স্বদেশ নির্বাচনের দায়িত্ব একদিন যে সাম্রাজ্যবাদ আপনাকে দিয়েছিল, আজ এই অন্ধকার ও প্রায় অজ্ঞাত পৃথিবীর মধ্যে বাঁচতে বাঁচতে আপনার কি মনে হয় না যে বস্তুত সেই সাম্রাজ্যবাদই আসলে কোনও দিন ছিল আপনার বাস্তুচেতনা ?
         বিনয় : কবি ঈশ্বর গুপ্ত লিখেছিলেন — “তুমি মা কল্পতরু/আমরা সব পোষা গোরু।” বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন, তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তখন লোকে বলেছিল, ‘একটি এঁড়ে বাছুর জন্মেছে।’ প্লেটো বলেছিলেন — তাঁর রিপাবলিকে কোনো কবি রাখা হবে না । এই মত এখনও এই পশ্চিমবঙ্গে ছাপা হয় ( ব্যঞ্জনবর্ণ পত্রিকা ) । আর কবিরা নিজেদের ঢাক নিজেরাই শুধু পেটায় । তবে ওই প্লেটোই যখন জন্মেছিল, তখন মন্ত্র পড়া হয়েছিল কবিতায়, ওই প্লেটোর অন্নপ্রাশনের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল. সেই মন্ত্র কবিতা, ওই প্লেটোর বিয়ের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল, সেই মন্ত্র কবিতা, ওই প্লেটোর শ্রাদ্ধের সময় যে মন্ত্র পড়া হয়েছিল, তা-ও কবিতা, এমনকি জীবিত অবস্হায় প্রত্যেক রবিবারে ওই প্লেটো গির্জায় যে প্রার্থনা করত, তাও কবিতা — এর পরে আর কী বলা যায় ।’
         বিনয় মজুমদার প্ল্যাটোকে একজন খ্রিস্টধর্মী অনুমান করে কথাগুলো বললেও, জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়ের তথাকথিত জোলো বামপন্হী ভাবধারাকে যুৎসইভাবে উপড়ে দিতে পেরেছিলেন । বিনয় মজুমদার ধর্মে আস্হা রাখেননি কিন্তু ‘সৃষ্টিকর্তা’ নামের কোনো  ক্ষমতাকে বিশ্বাস করেছেন, যা তাঁর এই কবিতায় পাই আমরা :-

২০ আগস্ট ১৯৯৮
তিন চোখ, চার হাত — এইসব দেবদেবীদের
মূর্তি দেখে যেতে হবে চিরকাল ? কী করে টের
পেয়েছিল হিন্দুগণ — এরা সব আছে ?
ধীরে ধীরে যেতে হয় হিন্দুদের পঞ্জিকার কাছে ।
পঞ্জিকায় ছবি ছাপা — দশভূজা, আরো কতোজন ।
এদের এড়িয়ে দেখি বেঁচে থাকে খ্রিস্টানের মন ।
এই বিশ্বে দীর্ঘকাল টিকে থাকে যা যা
তা তা সত্য ; তাহলে দেবতাদের রাজা
ইন্দ্র আর সরস্বতী, লক্ষ্মী এরা আছে
তবুও আমার মনে সন্দেহ থেকেই যায়, বলি কার কাছে
সেহেতু কখনো কারো পুজাই করিনি ।
তবু সৃষ্টিকর্তা আছে যার কাছে আমি আজো ঋণী ।
আমার বাঁহাত আছে এটা যত সত্য বলে মানি
সৃষ্টিকর্তা আছে এটা তত সত্য বলে আমি জানি ।
                                          ( শিমুলপুরে লেখা কবিতা — ২০০৫ )
         বিনয় মজুমদারের সমসাময়িক কবিরা, এমনকি পরবর্তী প্রজন্মের কবিরাও, এই ফান্ডামেন্টাল প্রশ্নগুলো নিয়ে নিজেদের ভাবনাচিন্তা উপস্হাপন করেননি । তাঁরা কেবল আঙ্গিক আর বিষয়বস্তুর ভেতরে নিজেদের চিন্তাকে সীমিত রেখেছেন ।
         ফ্রেডরিক নিৎশে বলেছিলেন যে “মানসিক অসুস্হ না হলে কবি বা শিল্পী হওয়া যায় না ; অস্বাভাবিকতা থেকে সৃজনশীলতার সৃষ্টি হয় ।” আবার ফ্রেডরিক নিৎশেই বলেছেন যে খ্রিস্টধর্মের প্রসার ঘটেছে মানুষের চরিত্রে সৃজনশীলতার অস্বাভাবিকতা থেকে। খ্রিস্টধর্মের প্রসার সম্পর্কে একই কথা বলেছিলেন টমাস অ্যাকুইনা । গভীরভাবে ভেবে দেখলে ধর্ম ব্যাপারটাই অস্বাভাবিক ; সেকারণেই ধর্মের মতন অব্যাখ্যেয় চিন্তার দরুণ মানুষ পরস্পরের সঙ্গে লড়ে মরে। ২০০১ সালে বাংলাদেশের ‘লোক’ পত্রিকার জন্য শামীমুল হক শামীমকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, “ধর্ম জিনিসটা বড় গোলমেলে। আমি ওই সাতে পাঁচে নেই । ধর্মীয় কারণে জীবনানন্দের চেয়ে নজরুল এদেশে উপেক্ষিত হচ্ছে এবং ঠিক একই কারণে নজরুলকে তোমরা জাতীয় কবি করেছ।” ওই সাক্ষাৎকারে বিনয় আরও বলেছেন, “গান্ধী বলেছেন ‘ঈশ্বর আল্লাহ তেরো নাম সব কো সন্মতি দে ভগবান’ । এই কথা বলাতে গান্ধীকে গুলি করে মেরে ফেলল । ধর্মভিত্তিক একটা বিভাজন হয়ে গেছে । ধর্মের চেয়ে বরং মৃত্যু নিয়ে লেখা সাহিত্যিকদের স্মরণীয় করে রাখে।  জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার’, ‘আট বছর আগে একদিন’ কী অদ্ভুত কবিতা !”
          সবাই কবিতা লেখেন না, ছবি আঁকেন না, কৈশোরে আর তরুণ বয়সে আরম্ভ করে ছেড়ে দেন, কিন্তু অনেকে ছাড়তে পারেন না, খ্যাতি বা টাকাকড়ির জন্য নয়, তাঁরা ছাড়তে পারেন না কেননা, তাঁরা আটক পড়েন কোনও এক অস্বাভাবিক মননঘুর্ণিতে, তাঁরা তাড়িত হন সাইকোপ্যাথিক সাহসের  কোনো এক মানসিক চাঞ্চল্যের নিশ্চয়তায়, যা কিনা সৃজনশীল ব্যক্তিমানুষের চরিত্রের সৎ উপাদান, এবং সেই প্রক্রিয়ার সঙ্গে ক্রিয়াবৈগুণ্যে সম্পর্কিত । ‘ট্রেণ্ডস ইন কগনিটিভ সায়েন্সেস’ পত্রিকার জুলাই ২০১৫ সংখ্যায় ‘থিংকিং টু মাচ : সেল্ফ জেনারেটেড থট অ্যাজ দি ইনজিন অফ নিউরটিসিজম’ শিরোনামের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে যে স্বতঃচিন্তা সৃজনশীল কাজে সাহায্য করে বটে কিন্তু তা ব্যক্তিবিশেষের দুঃখেরও কারণ হয়ে ওঠে । বিনয় মজুমদার একটি লেখায় বলেছেন যে দুঃখের কবিতা লিখে কবি আনন্দ পান । ‘নেচার নিউরোসায়েন্স’ পত্রিকার জুন ২০১৫ সংখ্যায় বলা হয়েছে যে, স্কিৎসোফ্রেনিয়া এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডার ব্যক্তিএককের ভেতরে ঘুমিয়ে-থাকা বংশগত জিনটি সহজাত সৃজনীপ্রতিভাকে জাগিয়ে তোলে,  এবং এই জিনগুলো সাধারণ মানুষের থেকে ভিন্ন ।
         কে জেমিসন তাঁর  ‘টাচড উইথ ফায়ার : ম্যানিক ডিপ্রেসিভ ইলনেস অ্যাণ্ড দি আর্টিস্টিক টেমপেরামেন্ট’ ( ১৯৯৬ ) বইতে বলেছেন যে কবি ও ছবি আঁকিয়েদের সৃজনশীলতার সঙ্গে তাঁদের মুডের বিশৃঙ্খলা এবং শৈল্পিক বাতিকজনিত মনোভঙ্গের সরাসরি যোগাযোগ আছে । তাঁদের শৈল্পিক ক্ষমতা যতো হ্রাস পেতে থাকে তাঁদের অবদমিত বিষণ্ণতাবোধ ও যৌনতায় বিফলতা ততো বেশি তাঁদের মেজাজকে বিধ্বস্ত করতে থাকে । স্টিফেন ডায়ামণ্ডস ‘অ্যাঙ্গার ম্যাডনেস অ্যাণ্ড দি ডায়ামনিক : দি সাইকোলজিকাল জেনেসিস অফ ভায়োলেন্স, ইভিল অ্যান্ড ক্রিয়েটিভিটি’ ( ১৯৯৯ ) গ্রন্হে বলেছেন যে, সৃজনশীলতার সঙ্গে ক্রোধ, ক্ষিপ্তাবস্হা, আকস্মিক উদ্দীপনা, উগ্রতা, মন্দচিন্তা, অশ্লীল ভাবনা ও অসংলগ্ন আচরণের সম্পর্ক আছে, এবং তা কবিতায়-ছবি আঁকায় বা আচরণে  ফুটে ওঠে ; বহুক্ষেত্রে শিল্পী তাঁর পুরোনো গড়ে তোলা ইমেজের বাইরে বেরিয়ে যাবার প্রয়াস করেন ।
         বিনয় মজুমদারের  কবিতাগুলো সম্পর্কে কেউ-কেউ সেরকম কথাই বলে থাকেন । অথচ বিনয় মজুমদার ইনসেন বা ম্যাড ছিলেন না, তিনি স্কিৎসোফ্রেনিয়ায় ভুগতেন । স্কিৎসোফ্রেনিয়া যদি জিনগত রোগ হয়,  তাহলে কেন তাঁকে ‘পাগল’ তকমা দিয়ে ইলেকট্রিক শক দেয়া হতো ? প্রায় তিরিশ বার তাঁকে ইলেকট্রিক শক দেয়া হয়েছে ; আটবার ভর্তি করা হয়েছে মানসিক চিকিৎসালয়ে, যেখানে স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসার কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছিলেন না । যাঁরা চিকিৎসা করতেন তাঁরা হয় এম.বি.বি.এস অথবা মনোবিদ ।
         সুমন গুণ, ছন্দবিদ অমূল্যধন মুখোপাধ্যায়ের একটি উক্তি উদ্ধৃত করে বলেছেন, বাঙালির সহজাত আলস্যপ্রবণতার একটি জনপ্রিয় প্রকাশ হলো জীবনানন্দের কবিতায় ছড়ানো অক্ষরবৃত্ত ছন্দ । এই ছন্দই বিনয় মজুমদারেরও পছন্দ । তাঁর প্রতিটি কবিতা পয়ারে লেখা । সুমন গুণ বলেছেন, এই প্রাকরণিক সখ্য তাঁদের সংঘবদ্ধ করেছে । এই দুজন কবির ঘরানার মধ্যে একটি বৈষয়িক সম্বন্ধও আছে । তাঁরা দুজনেই কবিতায় এক স্মিত দার্শনিকতার প্রশ্রয় দিয়েছেন । জীবনানন্দের দর্শন ভেতরে জড়িয়ে রাখে সময়ের ইতিহাসের ঘোর । আর বিনয়ের কবিতা ঘটনার, বিজ্ঞানের, গণিতশাস্ত্রের উদাহরণ পাওয়া যায় ।  রবীন্দ্রনাথের পরে সময় ও সমাচার নিয়ে এমন অক্ষুন্ন মনস্কতা অন্য কোনো কবির লেখায় বিশেষ পাওয়া যায় না । জীবনানন্দ ও বিনয় কোনও ঘটনার বিবরণ দিয়ে থেমে যান না, সেই ঘটনা বা প্রসঙ্গের একটি সাধারণ নির্ণয়ও রচনা করেন । সুমন গুণও ‘ফিরে এসো,চাকা’ কাব্যগ্রণ্হের পর সম্ভবত আর এগোননি ।
         বিনয় মজুমদার তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বলেছেন,  “গোবরডাঙায় সন্দীপ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার একবার আলোচনা হয়েছিল । সন্দীপ এবং আমি একমত হলাম যে গত আড়াই হাজার বছরে যত বই লিখেছে ভারতীয়গণ, তার একটা মোটামুটি হিসেব  করলে দেখা যাচ্ছে দুইজন অমর কবি আছেন । এক শতাব্দীতে সারা ভারতে মাত্র দু’জন । এই হিসেবটাই সত্য । সুতরাং হে বাঙালিগণ, কবি জীবনানন্দের কী দশা হবে আগামী ২০০০ বছর পরে কে বলতে পারে ? কিন্তু জীবনানন্দ খুব খারাপ কবিতা লেখেননি । জীবন যোগ আনন্দ — একসঙ্গে মিলে জীবনানন্দ । তা সত্বেও জীবনানন্দ একটিও আনন্দের কথা লিখতে পারেননি । সব বেদনার কবিতা লিখেছেন ।”
         ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে বিনয় আরও লিখেছেন, “আমি কৈশোরে দাড়ি গোঁফ গজাবার আগে, প্রায় প্রত্যহ দিলীপ গুপ্ত মশাইয়ের সিগনেট বুকশপে যেতাম। দিলীপবাবু আমাকে একটানা আবৃত্তি করে শোনাতেন, তৎকালীন তরুণ কবিদের কবিতা — জীবনানন্দ, সমর সেন, বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে প্রমুখ আরো নানাজনের কবিতার বাছা-বাছা অংশগুলি । আমি হাঁ করে শুনতাম । ফলে সপ্তাহে অন্তত একখানা এদের রচিত বই খানিকটা প্রেমে পড়েই কিনে ফেলতাম । জীবনের আনন্দের, মানে জীবনানন্দের কোনো কবিতার বই তখন কলেজ স্ট্রিট বইপাড়ায় কেনার জন্য পাওয়া যেতো না । সুতরাং দিলীপ গুপ্ত মশাই জীবনানন্দের বাড়িতে গিয়ে একখানি ‘ধূসর পাণ্দুলিপি’ এনে আমাকে দিয়েছিলেন । যতখানি ব্যথাভারাতুর মন হলে জীবনানন্দের ব্যথাভারাতুর কবিতাগুলি ভালো লাগে, ততদূর ব্যথাভারাতুর মন আমার তখনো হয়নি । তবুও আমার কবিতাগুলির প্রতি কেমন যেন মায়া জন্মেছিল । ধূসর শালপাতায় জড়িয়ে যেমন মাংস বিক্রি করে, তেমনি দু-খানি ধূসর মলাটের মধ্যে কবির হৃৎপিণ্ড জড়িয়ে আমার হাতে দেওয়া হয়েছিল ।”
         মামুদ সীমান্ত, যিনি ভারতে এসে শিমুলপুর গ্রামে গিয়ে বিনয় মজুমদারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন, জোগিরার ১৮ অক্টোবর ২০১২ সংখ্যায় লিখেছেন, “যে দৃষ্টি দিয়ে বিনয়কে মানসিক অসুস্হ বিবেচনা করে থাকি, মূলত সেটাই বিনয়ের কাব্যভাষা । লক্ষ্য করার বিষয়, বিনয়কে আমাদের এই অপ্রকৃতিস্হ বোধ-বিবেচনার ফলে বিনয়ের কোনো কবিতায় ব্যঙ্গ-রসাত্মক উপমাটি আমাদের কাছে অন্য মানে তৈরি করে । জৈবনিক দীক্ষায় তিনি কি অন্যমনে শেষমেষ কবিতাকেই ধিকৃত করেছিলেন সমর্পণের দায়ে ? বিনয়ের এইরূপ ভাষা-প্রক্রিয়ায় খেলা করার বিষয়টি বাংলা কবিতার সমঝদার পাঠকশ্রেণিকে নিশ্চয়ই আন্দোলিত করে । বিষয়-বৈচিত্র্যে বিনয়ের কাব্যভাষায় যথেচ্ছ চমক আছে । বিনয় সেই অবতারপ্রাপ্ত হয়েই জন্মেছেন । কিন্তু সমকালের বিকৃত বিবেচনাই তাঁর সে অবস্হানকে ক্ষুন্ন করেছে । বৈচিত্র্যের বদলে হয়ে উঠেছেন মরুবৃক্ষের ন্যায় বিপন্ন, বৈভবহীন, ছিন্ন-মণিষা । ভুল আলোচনার শিকার হয়ে পীড়িত হয়েছেন তিনি। তাঁর কাব্যভাষা মহাকালের খণ্ডিত কম্পনরূপে সাক্ষরিত হয়ে থাকলো আমাদের কাছে ।”
         মামুদ সীমান্ত আরও লিখেছেন, “বিনয় তাঁর কাব্যে অবস্হান করেন উত্তমপুরুষে । এই উত্তমপুরুষটি এককেন্দ্রিক, অন্য অর্থে বহুধাবিভক্তও বটে । কবিতার অন্তর্গত সেই উত্তমপ্রকৃতিটিরই প্রকাশনা ঘটিয়েছেন নির্দ্বিধ, কোথাও ফাঁকি দেননি । এটি তাঁর একটি সেনশেশানাল ফেজ । অথচ তাতে বিনয়ের কোনো খেদ নেই । কেননা বিনয় সেদিকে ফিরেও তাকান না বা তাকানোর প্রয়োজন বোধ করেন না । তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’, যাকে বলা হচ্ছে যৌনতার ভাষনির্মাণ, সেই কবিতাগুলোকেই আমার বহুল অর্থে লিখিত বলে মনে হয় । প্রশ্ন উদ্রেক হয় যে কবিতাগুলো পাঠের শুরুতেই পাঠক যৌনতা বিষয়ক আচ্ছন্নতায় মোহগ্রস্ত হয়ে পড়েন । এক্ষেত্রে যৌনতার সূত্র ধরে  বাংলা কবিতায় উপমা ও বিবৃতির গাণিতিক ব্যাখ্যাটিকেই তিনি পাল্টে দিতে চেয়েছিলেন ।. কবিতাগুলোর মূল্যায়ন বিষয়ে অধিকাংশ পাঠকের নিম্নরুচির উপমাবিচার বাদ দিলে, কবিতাগুলো সর্বাধিক কাব্যশৃঙ্গারে উন্নীত । ভারতীয় উপমহাদেশে কামশৃঙ্গারের বিশ্লেষিত উপস্হাপনায় যেরূপ চিত্র সম্পর্কে আমরা জ্ঞাত, বিনয়ের কবিতা মোটেও তা থেকে পিছিয়ে থাকে না । ‘আমার ভুট্টায় তেল’ জাতীয় কবিতায় রূপকার্থে ব্যবহৃত এমন সব শব্দ পাওয়া যায় যাকে বহু পাঠক, প্রাবন্ধিক, আলোচক এ যাবত কবিতাগুলিকে যৌনতার অপব্যাখ্যা দিয়ে কবিতার মূল টার্ম ভেঙে বিনয়কে কাণ্ডজ্ঞানহীন দোষী সাব্যস্ত করেছেন, যা একজন উচ্চমার্গীয় কবি-লেখকের ক্ষেত্রে কোনো কালেই প্রাপ্য ছিল না । কবিতাগুলি পাঠশেষে, সর্বাগ্রে আমি এটাই মনে করি, বিনয় মজুমদার এই কাব্যগুলোতেই ভাষার গূঢ়তাত্বিক কারিগরি করেছেন।”
          তিনটি কবিতা পাঠ করে দেখা যাক :-

বসার পরে
বসা শেষ হয়ে গেলে দেখা যায় ভুট্টা অতি সামান্যই নরম হয়েছে ।
নদী সোজা উঠে পড়ে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখি গ্লাসের বাহিরে
রস লেগে আছে কিনা, নদী তার হাত দিয়ে আমার ভুট্টাটা
তখন — বসার শেষে কখনো ধরে না, ভুট্টা রসে ভেজা থাকে ।
আমি কিন্তু হাত দিই, ঘাসের উপরে হাত বোলাতেই থাকি,
ঘাস টেনে টেনে দেখি, ঘাসের উপরে হাত বোলাতেই থাকি,
ঘাস টেনে টেনে দেখি, অনেক অশ্লীল কথা অনায়াসে বলি ।
নদীর গ্লাসের দৃশ্য — গ্লাসের বাহিরটিকে প্রাণভরে দেখি
( গ্লাসের ভিতরে দেখি বসার সময়ে শুধু ) বসা শেষ হলে
গ্লাস খুলে দেখতে সে এখনো দেয়নি, আমি বহির্ভাগ দেখি ।
হঠাৎ বেলের দিকে চোখ পড়ে মুগ্ধ হয়ে যাই ।
বেল দুটি এ বয়সে অল্প পরিমাণ ঝুলে পড়েছে, সে দুটি
মনোমুগ্ধকর তবু চোখ ফের নেমে যায় নিচের গ্লাসের দিকে, সেই
গ্লাসের উপরিভাগ বসার সময়ে যতো চওড়া  দেখেছি
এখন ততটা নয়, সরু হয়ে পড়েছে তা ঘাসগুলি ঘন হয়ে পড়েছে এখন ।

যৌবন কাহিনী
এখন ফুলকে খাই প্রায়শই কলকাতা গিয়ে ।
কয়েক বছর ধরে খাওয়া হলো, ছেলেও হয়েছে ।
আরো ছেলে মেয়ে চাই — এই কথা ফুলকে বলেছি,
খাওয়ার সময়ে আমি ধাক্কা দিতে দিতে এই কথাই বলেছি ।
ফুল তাতে রাজি আছে, এই ভাবে দুজনের জীবন চলেছে ।
ফুলের ঘরের পাশে আরো বহু ঘর আছে, প্রতিটি ঘরেই
নদী আছে, তারা সব আমার খাওয়ায় খুব সহযোগীতাই
করে থাকে সর্বদাই, ফুল যেই বলে ‘আজ একবার বসি’
অমনি সে নদীদের একজন জল এনে দেয় ।
আমরা খাওয়ার পরে সেই জলে কলা গুহা ধুই ।
আমি গেলে মাঝে মাঝে তাদের ভিতরে কেউ জিজ্ঞাসাও করে
‘আজ তুমি বসবে কি’ এইসব পরস্পর খাওয়ার সহযোগীতা করে
সেখানে — আমার ফুল যেখানে রয়েছে সেই বাড়িটিতে
নদী আছে, প্রতিবার খাওয়ার পরেই ভাবি তারা সব দেবী ।

তিন ঘণ্টা পরে
একবার বসা হলে কমপক্ষে সারাদিন তার
আমেজ শরীরে থাকে, ভুট্টা থাকে কাৎ হয়ে পড়ে
সহজে দাঁড়ায় না সে ; মাঝে মাঝে ভুট্টাকে ফুটিয়ে
ময়লা ও লেগে থাকা রস তুলে আনি
হাতের আঙুল দিয়ে এবং সে ময়লা ও রসের সুঘ্রাণ
নাক দিয়ে শুঁকি খুব ভালো লাগে ; প্রথম প্রথম
বসার পরেই আমি ভুট্টা ধুয়ে ফেলতাম — চাঁদ জল দিয়ে
গুহা ধুয়ে ফেলবার পরেই আমার ভুট্টা ধুয়ে দিতো জল ঢেলে ঢেলে ।
অবশ্য কয়েকবার নিজেও ধুয়েছি আমি নিজে জল ঢেলে ।
তারপর ভাবলাম ভুট্টাতে গুহার রস লেগে থাকা ভালো ।
তাতে বেশি সুখ পাবো, রস শুঁকে আনন্দও পাবো ।
সেহেতু এখন আর ধুই না এবং আমি মাঝে মাঝে ভুট্টাকে ফুটিয়ে
ময়লা ও লেগে থাকা রস তুলে এনে তাই শুঁকি ।
ভালো লাগে, তার হেতু এই রস চাঁদের গুহার ।

         সমর তালুকদার বিনয় মজুমদারকে প্রশ্ন করেছিলেন, “নারী সংসর্গের অভাব বোধ কর না ?” উত্তরে বিনয় বলেছিলেন, “এটা ব্যক্তিগত — এ ব্যাপারে তোমার সঙ্গে কোনো আলোচনা করব না।”

বারো

         ‘শব্দের শিশির’ গ্রন্হপ্রণেতা কবি ও প্রাবন্ধিক জয়িতা চক্রবর্তী বলেছেন যে, “প্রত্যেক সৃষ্টিশীল কাজেই প্রাথমিক উথ্থান কবিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দেয় ; তাঁর সেরা সৃষ্টিগুলি একে-একে শেষ হতে থাকে । অধোগতি হয়েছে একথা শুনতে হয় তাঁকে । ব্যতিক্রম রবীন্দ্রনাথ, যাঁর সেরা সৃষ্টিগুলি পরিণত ও শেষ পর্বে পাওয়া যায় । শিল্পী কখনও নিঃশেষিত হন না । পঞ্চাশের দশকের কবি বিনয় মজুমদার যতো জনপ্রিয় ততোটাই নিন্দিত । আমি মনে করি ‘ভালো কবিতা’ বা ‘মন্দ কবিতা’ বলে কিছু হয় না । বিনয় মজুমদারের প্রথম পর্বের কবিতাগুলিতে রোমান্টিসিজম ছিল, যা বাঙালি পাঠকের চির পছন্দের । শেষ পর্বের লেখাগুলো সময়ের চেয়ে এগিয়ে । কবিতা যেখানে জীবনের অপ্রিয় সত্য, জৈব সত্য ও জীবনের বাহ্যিক অর্থহীনতাকে নগ্নভাবে প্রকাশ করে । অনেক কবির মতে বিনয় মজুমদারের সেসব কবিতা অপাঠ্য, বিকৃতরুচির পরিচায়ক । আমি জোর দিয়ে বলছি, তারা বদ্ধ জলাশয় । এমনকি ভুট্টা সিরিজের কবিতার বই পুলিশ অব্দি গড়ায় । স্টল থেকে তুলে নেওয়া হয় তাঁর বই । বাঙালির যৌনতা সম্পর্কে ছুঁৎমার্গ কাটবে না ; তাঁরা ঘোমটার আড়ালে খেমটা নাচ পছন্দ করেন । বিনয় মজুমদারের কবিতায় আছে কাব্যগুণ, আছে জীবনবোধ । তাই শেষজীবনে অসুস্হ শরীরে লেখা কবিতাগুলি অত্যন্ত উপভোগ্য ও উত্তরআধুনিক কবিতাধারায় সৃষ্ট ; একজন সাহসী লেখকের মননশীলতার পরিচয়।”

         এই প্রসঙ্গে পুনরাধুনিক কবিতার প্রবক্তা ও কবি অনুপম মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “এই ভুট্টাপর্বের কবিতাগুলোর জন্য তাঁকে কম গালমন্দ খেতে হয়নি । অনেকেই তাঁকে সিরিয়াসলি নিতে চাইলেন না আর এই কবিতাগুলো লেখার পরে । কিন্তু বিনয় ভুট্টা পর্বের কবিতাগুলোয় সম্ভবত সেটাই করলেন, যেটা পিকাসো তাঁর অন্তিমপর্বের এচিংগুলোয় করেছিলেন । নিজের জৈবিক এবং প্রায় হাস্যকর ও অসহায় কামপ্রবৃত্তিকে তুলে আনলেন চোখের সামনে । তিনি ‘লিঙ্গ’ লিখলেন না, এমনকি তার দেশজ প্রতিশব্দটিও লিখলেন না, তিনি লিখছেন ভুট্টা। এটা শব্দের প্রতিস্হাপন । এই খেলাই আমি আজকাল নিজের কবিতায় খেলি । আমি তাঁর স্হানে থাকলে ‘লিঙ্গ’ কেটে ‘ভুট্টা’ লিখতাম, কিন্তু কাটা শব্দটিও পাশে রেখে দিতাম । বিনয় ‘রমণী’ লিখলেন না, তার বদলে ‘চাঁদ’ লিখলেন । ‘যোনি’ লিখলেন না, তার বদলে ‘গুহা’ লিখলেন । ‘সঙ্গম’ লিখলেন না, তার বদলে ‘নাচ’ লিখলেন । বললেন, মেয়েদের নিয়মিত নাচা উচিত । বেশ্যাগৃহে গিয়ে সঙ্গমকে ‘বসা’ লিখলেন । কোনো মেয়ের নাম দিলেন ‘ঔদার্য’, এবং মনে মনে তার সঙ্গে রমণ করে কবিতা লিখলেন । যোনিপ্রদেশকে বললেন মায়াসভ্যতা । বীর্যের ফোঁটাকে বললেন চন্দন । কিন্তু যখন তাঁর কবিতার নাম হলো ‘আমার ভুট্টায় তেল’, স্পষ্টই বোঝা গেল তিনি কী লিখছেন — একজন দেহপসারিণী নিজের যোনিতে নেওয়ার আগে একজন পুরুষের লিঙ্গে তেল মাখাচ্ছেন । যেমন গাছের তলায় রাখা লম্বাটে পাথর দেখলে মানুষ প্রণাম করে, কারণ তার মাধায় শিবলিঙ্গ উদ্ভাসিত হয়, যেমন আলুর শুঁড় দেখেই তাকে বস্তা থেকে সরিয়ে কুলুঙ্গিতে রাখা হয়, গণেশ হিসাবে । কিন্তু একজন প্রতিষ্ঠিত কবি এভাবে সরাসরি কামবিষয়ক কবিতা লিখবেন এটা অনেকেই মানতে পারেননি, আজও পারেন না । তাঁরা আজও ‘ফিরে এসো, চাকা’, অথবা খুব বেশি হলে ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’কেই বিনয় মজুমদার মনে করেন এবং স্বস্তিতে থাকেন, মধ্য ও শেষ পর্বের বিনয়কে উন্মাদ আখ্যা দিয়ে।” ( ২০১৬ )
         অনুপম মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য লক্ষনীয় । অনুপম বলছেন না যে বিনয় তাঁর এই কবিতাগুলোয় ‘উপমা’ প্রয়োগ করেছেন । বিনয় মজুমদার শব্দের ‘প্রতিস্হাপন’ ঘটালেন । এখানেই জীবনানন্দের সঙ্গে বিনয়ের পার্থক্য । জীবনানন্দ  তাঁর কবিতায় ‘মতো’ ‘যেন’ ইত্যাদি প্রয়োগ করে গেছেন, যা বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে তাঁর পরের কবিতায় আর করেননি, ‘বাল্মীকির কবিতা’য় তো করেনইনি । উপমা বাদ দেবার দরুণ বিনয় প্রকৃতির সঙ্গে পরমাপ্রকৃতির অভেদকে সনাক্ত করছেন । কিন্তু জীবনানন্দ যে ক্রমে উপমা থেকে সরে গিয়ে প্রতীকে এবং প্রতীক থেকে বস্তু-সম্পর্কে চলে যেতে লাগলেন, তা বিনয় ব্যাখ্যা করে দেখিয়েছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে । বিনয়ের এই পর্বের কবিতায় শব্দের প্রতিস্হাপনের কথা অর্ঘ্য দত্ত বকসীও বলেছেন তাঁর  “প্ল্যানচেটে যৌনসমীক্ষায় বিনয় মজুমদার” আলোচনা পুস্তিকায়, তিনি এদের বলেছেন প্রতীক : চাঁদ, নদী, ফুল, গুহা,হ্রদ ( যোনি ), ঘাস ( যোনিরোম ), লেবু, বেল ( স্তন ), ভুট্টা, কলা, চন্দনকাঠ ( লিঙ্গ ) ।
         এই প্রতিস্হাপন বাংলা কবিতায় নতুন নয় । চণ্ডিদাস-এর ৮৭৯ পদ পাঠ করা যাক :

         সহজ সহজ সবাই কহয়ে
                               সহজে জানিবে কে ।
         তিমির অন্ধকার যে হইয়াছে পার
                               সহজে জেনেছে সে ।।
         চান্দের কাছে অবলা আছে
                               সেই সে পিরীতি সার ।
         বিষে অমৃততে মিলন একত্রে
                               কে বুঝিবে মরম তার
         বাহিরে তাহার একটি দুয়ার
                               ভিতরে তিনটি আছে ।
         চতুর হইয়া দুইকে ছাড়িয়া
                               থাকিব একের কাছে ।।
         যেন আম্রফল অতি সে রসাল
                               বাহিরে কুশী ছাল কষা ।
         ইহার আস্বাদন বুঝে যেই জন
                               করহ তাহার আশা ।।

         নিজের কবিতার কৃৎকৌশলের সঙ্গে বিনয় মজুমদার প্রথম থেকে শেষ পর্ব পর্যন্ত সচেতন ছিলেন ; কবিতার সৃজন এবং বর্জনীয় উপাদান সম্পর্কে অতিসতর্ক থাকতেন । সেকারণে দেখা যায় যে আলোচনাকালে তিনি আধুনিক পেইনটিঙ থেকে ব্রাশ স্ট্রোকের বিলয় এবং মেটাফর থেকে কবিতার মুক্তির কথা বলেছেন, যাতে জীবনের রহস্যময়তাকে সম্পূর্ণ উদ্ঘাটন করা না হয়, এবং সেই সঙ্গে আধ্যাত্মিকতার ও পারলৌকিকতার ফাঁদে না পড়তে হয় ।
         প্রণব সরকার বলেছেন, “বিনয় একালের কামসূত্র বা ভুট্টা সিরিজের কবিতা বা ‘বাল্মীকির কবিতা’র ভিতরে রূপক ও প্রতীকের ব্যবহার করেছেন দক্ষতার সঙ্গে, যা আমাদের কাছে সরাসরি অশ্লীল কোনো ভাব প্রকাশ করে না । বরঞ্চ প্রাপ্তবয়স্কদের মনস্ক করে ।”
         উপরোক্ত বক্তব্যের সম্পূর্ণ বিরোধিতা করে প্রবীর ভৌমিক বলেছেন, “যে সৌন্দর্যময় নারীচেতনার তান্ত্রিক পূজারী বিনয়, তিনিও অপরিচ্ছন্ন, বিকৃত, বমন উদ্রেককারী এই লাইনগুলো লেখেন, ‘গুহায় বোজানো মুখ চেপে ধরে ঠেলা দিই/সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ঝুঁকে পড়ি/ভুট্টাটি সহজভাবে ঢুকে গেলে সঙ্গে সঙ্গে ধাক্কা শুরু করি ।’ এ বিনয়কে মানায় না । বিনয়ের এই কবিতাগুলোকে মহিমান্বিত করে ছোট করবার একটা অপচেষ্টা চলছে । আমাদের সতর্ক হওয়া উচিত।”
         রনজিৎ দাশ একটি যুক্তি দেবার প্রয়াস করেছেন । তিনি বলেছেন, “আর দশজন আধুনিকের মতো বিনয়ও হেঁটেছেন বদল্যার নির্দেশিত এই স্বপ্নসম্ভব পথেই, কিন্তু পৌঁছেছেন এক ভিন্ন গন্তব্যে।”
         প্রশ্ন হলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ লিখে বিনয় তো বাংলা কবিতার ইতিহাসে জীবনানন্দের পর নিজস্ব স্হান করেই নিয়েছিলেন । তাহলে তিনি ‘অঘ্রাণের অনূভূতিমালা’ আর ‘বাল্মীকির কবিতা’ এবং তার পরবর্তী সাব-জনারের কবিতাগুলো লেখার উদ্যোগ নিলেন কেন ! এগুলো লেখার জন্য তো তিনি টাকা পাননি, বরং পুরস্কারের লক্ষ্যবস্তু থেকে দূরে ছিটকে গিয়েছিলেন । বদল্যারের জীবনকাহিনির প্রভাবে পঞ্চাশের কবিরা কলকাতার যৌনপল্লি যাওয়া আরম্ভ করেন ঠিকই, বিনয়ও, আমার অনুমান,  তাঁদের কিছু পর থেকে তাঁর নারীহীন যৌনজীবনের প্রয়োজন মেটাতে যাওয়া আরম্ভ করেছিলেন বটে, কিন্তু কবিতা লিখে তার প্রমাণ দিতে যাবেন কেন ?
         আমার মনে হয় যে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে-তুলে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা এবং তাঁর গুণমুগ্ধরা , একই খোঁচা বার বার দিয়ে তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করে দিচ্ছিলেন। তা থেকে মুক্তি পাওয়া জরুরি হয়ে উঠেছিল, এবং তার প্রথম ধাপ হিসাবে তিনি লিখলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’. যেটিকে তিনি বললেন “নারীভূমিকা বর্জিত আদিরসাত্মক কবিতা”– ঈশ্বরী অথবা গায়ত্রীর ভূমিকা আড়াল করার এটি প্রথম পদক্ষেপ । বিনয় লিখলেন :-

        এইখানে পাহাড়ের ভাঁজ বলা যেতে পারে, বাঁক বলা যেতে পারে, অথবা
        দু-দুটি পাহাড় এসে মিলে গেছে যদি বলা হয় তবে একেবারে
        হুবহু বর্ণনা হয় ; …মিশেছে প্রায় সরলকোণের খুব কাছাকাছি এক স্হুলকোণে
        
        ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ থেকে  প্রাসঙ্গিক লাইন তুলে তুলে ব্যাখ্যা দিয়েছেন অর্ঘ্য দত্ত বকসী তাঁর ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি– বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ বিশ্লেষণে ( ২০১৪ ) । অর্ঘ্য বলেছেন, “অনেকটা উল্টোনো বিস্ময়বোধক চিহ্ণের মতো লাগে এই যোনি । বিস্ময়বোধক, তাই হয়তো উল্টোনো, ডিসপ্লেসড । দেহের সর্বাপেক্ষা গোপন স্হানে যোনির অবস্হান। দুই পাহাড়ের মধ্যবর্তি গোপনতায় । চাঁদের গুহার দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকেন কবি । কবি বলছেন, প্রাণলোকে ( অনুভূতিমণ্ডলে ) প্রবেশাধিকার দিয়ে তৎলোকে বিক্ষোভ সৃষ্টি করে তৃপ্তিদান করানোর বাসনা এবং গোপনতার অনুভূতির সঙ্গে যোনির সরাসরি সম্পর্ক । যোনি varies directly as প্রাণলোকে প্রবেশাধিকার দেওয়ার বাসনা — গোপনতা । তাই পাহাড়ের জীবনেও গোপনভাবে প্রবেশ করে কবি বর্ণনা করেছেন এই জোড় ও মধ্যবর্তী গোপন গোপন ক্রীড়ার স্হান — বানিয়েছেন প্রাকৃতিক যোনি — প্রকৃত কবিতার মতো ! প্রকৃত সারসের মতো !”
         এক কোণে, পাহাড়ের কোণের ফাঁকেই হল আমার বাড়িটি, ঠিক কোণে
         পাহাড়ের ঢালু গায়ে চুড়ার কিছুটা নীচে ঢালু কোণে বাড়িটি ঢোকানো
         লম্বালম্বিভাবে পাহাড়ের ভিতরে অনেক দূর খুব বেশি সুন্দর উপায়ে

অর্ঘ্য বলেছেন, “স্তন বা চূড়ার নীচে যৌনস্হান যা ঢালু অংশে স্হাপিত সেখানে যোনিমুখ থেকে ভিতরে ‘ঢোকানো’ দীর্ঘ যোনিগহ্বর ও তাতে নিত্য অবস্হানরত অনুপ্রবেশিত শিবলিঙ্গ, সদারমণরত নিত্য পূজা।”

         বারান্দাটি শুধু এই পাহাড়ের পাথরের গা থেকে বেরিয়ে ঝুলে আছে
         সামান্যই বেরিয়েছে, পাতলা লতার গাছে বারান্দাটি চারপাশে ঘেরা

অর্ঘ্য মনে করেন, “বাড়ি যদি লিঙ্গ হয়, বারান্দা তবে স্বভাবতই বাইরে ‘ঝুলে’ থাকা চারপাশের যৌনরোমসহ অন্ডকোষ । বিনয় অন্যত্র ঘাসের কথা বলেছেন যা প্রকৃতপক্ষে যোনিরোম।”         
         দ্বিতীয় পদক্ষেপ হল ‘বাল্মিকীর কবিতা’ — যা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী ও গুণমুগ্ধ স্তাবকদের থেকে গায়ত্রীকে সম্পূর্ণ আড়াল করার  জন্য যথেষ্ট ছিল ।
         ‘বাল্মীকির কবিতা’ নিয়ে বিনয়ের মনে দোনামনা ছিল বলে মনে হয় । ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে  ১৪১২ বৈশাখে চন্দন ভট্টাচার্যের সঙ্গে বিনয়ের এরকম কথাবার্তা হয়েছিল :-
          প্রশ্ন : এখনকার বাংলা কবিতায় মেয়েরা যৌন আকাঙ্খামূলক লেখাগুলো বেশ খোলামেলা ভাবেই লিখছেন । প্রতিষ্ঠিত কবিরা স্বাগতও জানাচ্ছেন এই পরিবর্তন কে । উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, গ্রন্হির বর্তমান সংখ্যাতেই তসলিমা লিখেছেন একটি গদ্য, নাম ‘নারী শরীর’ । আপনিও যৌন অভিজ্ঞতার কথা সরাসরি দু’একটি প্রতীকের আড়ালে লিখেছিলেন ভুট্টা সিরিজের কবিতায় । একটা ছোট কবিতার বইও সম্ভবত হয়েছে কবিতাগুলি জড়ো করে । পরে আপনি তাদের disown করেন । আজ এই মুহূর্তে কি পাল্টাবেন মতামত ? এই ধরণের কবিতার স্হায়ীমূল্য কি আছে ?
         বিনয় : ( মৃদুস্বরে বলে যান ) না, কোনও বই নেই তো । আমার জানা নেই এমন কোনও বইয়ের কথা । এগুলো উল্লেখযোগ্য লেখা নয় ( অস্বীকারের ভঙ্গীতে হাত নাড়েন ) । তবে মহিলা কবিরাই চিরকাল ভালো কবিতা লিখে এসেছেন । যেমন, ‘আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে, কথায় না বড়ো হয়ে কাজে বড়ো হবে ।’ কিংবা ওই লেখাটা, ‘ফুটফুটে জ্যোৎস্নায়…।’ আর স্হায়ী মূল্যের কথা বলছ ? দ্যাখো, প্রথমে যখন লিখতে শুরু করি তখন লক্ষ্য ছিল পাঠককে জ্ঞান দান, তার বুদ্ধি বাড়ানো, কবিতাগুলিকে তার মনে রাখানোর চেষ্টা, তার সঙ্গে যেন আমার কথাও মনে পড়ে, সেদিকে নজর রাখা ইত্যাদি । কবিতা কীভাবে হয়, কীভাবে সার্থক, আমিও জানি না । হয়ে যায়, এই পর্যন্ত।’
         ‘কবিতীর্থ’ পত্রিকায় ১৯৮২ সালে প্রকাশিত সমর তালুকদারের ঠাকুরনগর স্টেশানে ট্রেনের জন্য অপেক্ষার সময়ে কথাবার্তার মাঝে বিনয় মজুমদার সমরবাবুকে জিগ্যেস করেছিলেন, “১৯৭৭ সালে বিশ্ববাণী থেকে প্রকাশিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ বইটি তিনি পড়েছেন কিনা।” ১৯৯৩ সালে কথাপ্রসঙ্গে ‘যোগসূত্র’ পত্রিকার জন্য নেয়া সাক্ষাৎকারে অজয় নাগকে বিনয়  বলেছিলেন, “আদিরসাত্মক কবিতাগুলি নিয়ে একটা বই বেরোয় তার নাম দিই ‘বাল্মীকির কবিতা’ ; কেন যে লিখেছিলাম মনে নেই এখন ।”
         বিনয়ের কবিতাকে প্রতি-রোমান্টিসিজমের প্রসারণ থেকে, যা কিনা পুনরুদ্ধারের অতীত এক নিগূঢ় পন্হা, এবং যা কিনা অবিরাম রোমান্টিক-নিউরোটিককে ,  আর আমাদের জীবনযাপনের আধুনিকতাবাদী ব্যাজস্তুতিকে, পর্যদুস্ত করে, তা থেকে বের করে আনা দরকার । বিনয়ের কবিতা আক্রান্ত হয়েছে সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, বাঙালি ভদ্রলোকের সাংস্কৃতিক রাজনীতিতে, যার পাল্লায় এক সময়ে জীবনানন্দকে পড়তে হয়েছিল, রবীন্দ্রনাথকেও পড়তে হয়েছিল । এখানে বিনয়ের এই কবিতাটি প্রাসঙ্গিক :

হাসপাতালে
এজরা হাসপাতালে যখন ছিলাম
তখন পাগল বলে ডাকত আমাকে
রাত্রিবেলা অন্ধকারে দেখতাম আমাকে খাওয়ার
নিমিত্ত রামদা হাতে আসত পরমেশ ও
                     উমা দাশগুপ্ত, দেখে আমি
বলতাম দরজায় লেখা আছে আমি আছি পাগলা গারদে
আমি তো পাগল আর পাগলের মাংস খেলে
তোরাও পাগল হয়ে যাবি
           প্রতিদিন রাত্রিবেলা এ কাণ্ড ঘটতো ।
তখন আমাকে আর কেটে কেটে খেতে আসত না ।

         প্রত্যেকেই অস্তিত্বের পাগলাগারদে জীবন কাটান । সেটা হলো অক্ষমতার অস্তিত্ব । তা এই জন্য নয় যে আমরা মানসিকভাবে যুক্তিহীন প্রাণী, বরং মানুষকে মেরে ফেলে তার মাংস খাওয়াকে অসম্ভব মনে করা যায় না । আমরা সবাই কিনারায় দাঁড়িয়ে কাঁপছি । মানুষ মেরে তার মাংস খাবার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যাবে না । সেই দিন আগত । প্রতিটি বাঁকে আমরা আমাদের সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর, এবং তা মেরে ফেলে মাংস খাওয়ার চেয়ে কম কিছু নয় । পাগলাগারদের পাহারাদার অভিভাবকদের ভূমিকা সেটাই । সুযোগ পেলেই মানুষ তার সহযাত্রীদের প্রতি নিষ্ঠুর হবার যারপরনাই প্রয়াস করে ।  পাগলাগারদের বিশেষ অভিভাবক হবার সংজ্ঞা সেইটাই । আমরা নিজেদের কেটে টুকরো করছি, আমাদের অস্হিরতা আমাদের তা করতে প্ররোচিত করছে, যাতে আমরা সমাজে নিজেদের প্রাসঙ্গিকতা বজায় রাখতে পারি ।
         কলকাতা শহরের হাসপাতালগুলোয় রোগীদের ক্রুদ্ধ আত্মীয়দের আক্রমণাত্মক আচরণ দেখলেই তা টের পাওয়া যাবে । স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসক আমাদের দেশে বিরল ; যে চিকিৎসকরা আছেন তাঁরা ম্যাডনেস ও ইনস্যানিটির ডাক্তার, যে কারণে সোভিয়েত দেশ ভেঙে পড়লে নিমু ভৌমিক তা সহ্য করতে না পেরে স্বদেশে ফিরে আসেন এবং উন্মাদ হয়ে যান, তাঁকে বাঁচানো যায়নি, তিনি জার্মান কবি ফ্রেডরিক হ্বেল্ডারলিনের মতন ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’ মানসিক রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন । সোভিয়েত দেশে নিমু ভৌমিক সারা জীবন সুস্হ ছিলেন। বাংলা ভাষায় ‘হাইপোকনডিয়াইসিস’-এর বাংলাও পাগল হয়ে যাওয়া, কেননা হাইপোকনডিয়াইসিসের বাংলা প্রতিশব্দ নেই ।
         মালটিপল পার্সোনালিটি ডিজঅর্ডার, প্যারানয়া, সাইকোসিস, ডিপ্রেশনজনিত অসংলগ্নতা, উদ্বেগের অসংলগ্নতা, ট্রমাজনিত আচরণ, ফোবিয়া, হ্যালুসিনেশনবোধ, ডেলিউজান, অ্যানেরোক্সিয়া নার্ভোসা, বুলিমিয়া নার্ভোসা সোমাটোফর্ম, স্মৃতিবিলোপ, সবই বঙ্গসমাজে পাগলামির নাম দিয়ে চালানো হয় । স্কিৎসোফ্রেনয়াও তিন রকমের হয় : অ্যাক্টিভ, ক্যাটাটনিক এবং ডিসঅর্গানিজড — শরীরে রাসায়নিক ও হরমোনের ভারসাম্যের তারতম্য দিয়ে নির্ধারিত হয় । সবগুলোকেই বলা হয় মস্তিষ্কবিকৃতি বা পাগল হয়ে যাওয়া ! লুম্বিনী পার্কের চিকিৎসকরাও শব্দগুলোর বাংলা প্রতিশব্দ তৈরি করেননি ।
         বাংলা ভাষায় শব্দসংখ্যা এতোই কম যে এই বিষয়ে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে ‘অউম’ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে বিনয় মজুমদার জয় মুখোপাধ্যায় ও সন্মোহন চট্টোপাধ্যায়কে বলেছিলেন,  “ শিবরাম চক্রবর্তী বলেছিলেন যে, একটি কবিতায় একস্হানে একটিমাত্র শব্দ বসার কথা । জ্ঞানেন্দ্রমোহন দাসের অভিধানে ১,২০,০০০ শব্দ আছে । সেই শব্দের ভিতর থেকে একটিমাত্র শব্দ এনে বসাতে হবে । এই খুঁজে বের করা কবির বিষয় । এটা শিবরামের হলেও সমান চিন্ত্যনীয় । কারণ আগেই বলেছি যে ধেনুর সঙ্গে বেণু, গেনু, পেনু এইসব শব্দ অভিধান থেকে বেছে বের করার সময় সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পরে পড়তে হয় ।” বস্তুত সৃষ্টিকর্তার মাতব্বরির খপ্পর থেকে বেরোবার জন্যই কবিরা একটি শব্দের জায়গায় আরেকটি শব্দ প্রতিস্হাপন করেন, যা বিনয় মজুমদার করলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ ও ‘বাল্মীকির কবিতা’ কাব্যগ্রন্হে । উল্লেখ্য যে হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় ইংরেজি শব্দের ডিজিটাইজেশনের পর জানিয়েছে যে তাতে শব্দসংখ্যা ১০,২২,০০০ ; অর্থাৎ আমাদের ভাষার দশগুণ । ইংরেজির চেয়ে তুর্কি ও জার্মান ভাষায় শব্দের সংখ্যা বেশি । শেক্সপিয়ার বহু শব্দ তৈরি করে দিয়ে গেছেন । জীবনানন্দের মতন বিনয় মজুমদারও বেশ কয়েকটি শব্দ তৈরি করেছেন। আটের দশক থেকে কবিরা শব্দ তৈরি করছেন, কলকাতার সাধারণ মানুষও সমবেত শব্দ তৈরি করেন । কিন্তু বাংলা ভাষার জন্য অক্সফোর্ড ডিকশনারি কমিটি না থাকায় শব্দ সংগ্রহ করে অভিধানে ঢোকানো হয় না ।
        বিনয় মজুমদারের কোন ধরণের স্কিৎসোফ্রেনিয়া হয়েছিল তা তাঁর হাসপাতালের কাগজ দেখে গবেষকরা বের করবেন কখনও, আশা করি । তাঁর অসংলগ্নতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে অসফল আশপাশের মানুষেরা তাঁকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করে দিতেন মানসিক চিকিৎসালয়ে । এই প্রসঙ্গে বিনয় মজুমদার লিখেছিলেন, “পশ্চিমবঙ্গের পাগলাগারদ সমূহের পরিদর্শক আমি । আমার সরকারি চাকরিই তাই । যা বেতন পাই তাতে মোটামুটি সংসার চলে যায় — একার সংসার।” ১৯৯৩ সালে সঞ্জয় চক্রবর্তীকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন, সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব পাকিস্তানে যখন ছিলেন, “তখন কেউই বড়ি-ফড়ি কিছু খাওয়াতেও এলো না । ইনজেকশানও দিতে এলো না । তোফা ছিলাম । আর ভারতবর্ষে আমাকে সাতবার পাগলাগারদে পোরা হয়েছে । অনেকেই তো পাগলাগারদে ছিলেন । তাঁদের জীবনীতে তা লেখা হয় না । আর আমার জীবনী লিখতে গেলে প্রথম বাক্যই লেখে — গোবরা মানসিক হাসপাতালে ছিলেন । পাগলাগারদে আর কে কে ছিলেন শুনবে ? লুম্বিনী পার্কে ছিলেন মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক । এঁদের জীবনী যখন লেখে তখন তো একথা এভাবে লেখে না যে এঁরা পাগলা গারদে ছিলেন । অথচ আমার ক্ষেত্রে প্রথমেই ওই কথা — মানসিক হাসপাতালে ছিলেন ।”
         আমাদের মানসিক অবস্হা দিয়ে আমাদের প্রকৃতিস্হতা সংজ্ঞায়িত হয় না । হয় আমাদের বেঁচে থাকার উপরিতল দিয়ে – বিনয়ের উপরোক্ত কবিতার ক্ষেত্রে ‘মাংসভক্ষণ’ নিষ্ঠুরতাকে গোপন করে রেখেছে, মানুষের নিষ্ঠুরতা, প্রতিপদে সামনের শত্রুকে খেয়ে ফেলার ষড়যন্ত্র । এই নিষ্ঠুরতা যেন সহ্য হয়ে-যাওয়া নৈতিকতা । প্রতি রাতেই যে তা ঘটে তা বিনয়’ বাল্মীকির কবিতা’য় আমাদের দেখিয়েছেন । মানুষের মাংসভক্ষণ হয়ে ওঠে মানুষের অন্তরাত্মার ভক্ষণ । এই কবিতাটি পড়ে দেখা যাক :

মাংস খাওয়া
আমি যদি মুরগির মাংস খাই
তাতে মুরগির উপকার হয় ।

জীবিত অবস্হায় ছিল তুচ্ছ মুরগি
তার মাংসে খুব উন্নত স্তরের কিছু ছিল ।

প্রবাদ বাক্য হচ্ছে মাংসে মাংস বৃদ্ধি ।

তার মানে যখন মুরগির মাংস খেলাম
তখন সে মুরগির মাংস আমার শরীরের
মাংস হয়ে গেল ।

তার মানে সবই বুঝতে পারি
আমার শরীরের মাংস মুরগির
মাংসের চেয়ে উন্নত স্তরের কিছু ।

এতে দেখা যাচ্ছে মুরগির উপকার হয়ে গেল ।

তেরো

         বিনয় মজুমদারের অসুস্হতাকে তরুণ কবি-লেখকরা অনেকেই রোমান্টিসাইজ করার প্রয়াস করেছেন — তা একজন মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে ছেলেখেলা । কলকাতায় বসবাস করে দূরত্ব বজায় রেখে বিনয়ের অসুস্হতার নান্দনিকতা গড়ে তুলতে চেয়েছেন তাঁরা, যেন তাঁরা বিনয়ের কবিতার উদ্ধারকারী। কবি কিন্তু তাঁর পারক্যবোধকে সযত্নে আগলে রাখতেন, এবং অতিথি গুণমুগ্ধদের ভাবপ্রবণ আচরণকে প্রকৃতি-পৃথিবীর অত্যন্ত জটিল ব্যাখ্যার মাধ্যমে সীমায়িত করে দিতেন । বিনয়ের চরিত্রে ছিল অদম্য বলিষ্ঠতা। তাই তিনি নিজে যে ধরণের কবিতা ও গদ্য লিখবেন বলে মনস্হ করতেন, তাই লিখতেন । তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ পড়লে বোঝা যায় তিনি ভাবনাকে কোন পথে পরিচালিত করতে চেয়েছিলেন । কবিতায় দিনপঞ্জির অনুপ্রবেশ ঘটনোর মাধ্যমে তিনি নিজের জীবনচর্যা রেকর্ড করেছেন এবং এগিয়ে গেছেন, যেমনটা দিনপঞ্জি লেখকেরা করে থাকেন, আগের দিনের ঘটনাকে পেছনে ফেলে আসেন । কবিতা লেখা হয় ভাষার মাধ্যমে, এবং ভাষা চিরকাল সময়বন্দী, পরবর্তীকালে গিয়ে তা আটকে যায়, যেমন চর্যপদের ক্ষেত্রে ঘটেছে, সময়ের দ্বারা তা সীমায়িত । প্রতিষ্ঠানকে উপেক্ষা করেও তিনি হয়ে উঠেছিলেন একজন কাল্ট ফিগার, আর নিজের দুরাবস্হাকে উপস্হাপন করে সেই প্রতিষ্ঠানকে হাস্যকর ও অপ্রয়োজনীয় প্রতিপন্ন করে দিয়েছেন । কিন্তু তাঁর ব্যক্তিগত ব্যথা তিনি তাঁর কবিতাকেই অবিরাম জানিয়ে গেছেন, ‘ফিরে এসো, চাকা’ বইয়ের কবিতাগুলোর সময় থেকে । তাঁর একটি কবিতার শিরোনাম ‘আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি’ — তাঁকে যারা পাগল তকমা দিয়েছিল তাদের এটা সরাসরি আক্রমণ, কেননা তিনি কেবল মস্তিষ্ক দিয়ে ভাবছেন না, সমগ্র অস্তিত্ব দিয়ে ভাবছেন ।

আমরা সর্বাঙ্গ দিয়ে ভাবি

আই গ্রাফটিং করা হয়
তার মানে একজনের চোখ
কেটে তুলে নিয়ে অন্য একজনের
চোখের জায়গায় জোড়া লাগিয়ে
দেওয়া হয় ।

প্রথম ব্যক্তির চোখ উপড়ে
নেওয়া হল । জোড়া লাগিয়ে
দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে ।

এই উপড়ে নেওয়া এবং জোড়া
লাগানো, এই করতে সময় লাগল
ধরা যাক পাঁচ মিনিট । এই পাঁচ মিনিট যাবৎ
চোখ জীবিত ছিল ।


একজনের শরীরের রক্ত বার করে নিয়ে
বোতলে পুরে রাখা হয় এবং কয়েক
দিন পরে এই বোতলের থেকে অন্য
একজনের শরীরে ঢুকিয়ে
দেওয়া হয় এর থেকে বোঝা যায়
বোতলে পোরা অবস্হায় রক্ত জীবিত
ছিল, রক্তের প্রাণ ছিল, রক্ত ভাবছিল ।
কারণ দ্বিতীয় ব্যক্তির শরীরে ঢুকে
রক্ত স্বাভাবিক হয়ে গেল ।


‘খ’-এ যা লিখেছি ( বোতলে যখন রক্ত ছিল তখন রক্তের প্রাণ
ছিল ) তাহলে মুরগি যখন কাটা অবস্হায় পড়েছিল ( ‘ক’ দেখো )
তখন মুরগির মাংসের প্রাণ ছিল, ভাবছিল সুতরাং একজন মানুষ
মুরগির মাংস খেলে পাকস্হলির ভিতরের মুরগির মাংস জীবিত,
ভাবছিল পরে এই মুরগির মাংস মানুষের শরীরে মাংস হয়ে
গেল । এই নতুন দ্বিতীয় অবস্হায় মুরগির উপকার হল ।

         অদ্রীশ বিশ্বাস তাঁর স্মৃতিচরণে লিখেছেন, “আমি যখন প্রেসিডেন্সির ছাত্র, তখন বিনয় মজুমদারকে ঠাকুরনগর থেকে মেডিকাল কলেজে এজরা ওয়ার্ডে ভর্তি করে নিয়মিত কলেজ থেকে এসে দেখাশোনা আর গল্প করার ভার দেন তৎকালীন দুই উচ্চপদস্হ আমলা তারাপদ রায় ও কালিকৃষ্ণ গুহ । সেই সময় থেকে বিনয় মজুমদার ওনার বিখ্যাত খবরের কাগজের সংবাদই কবিতায় ঢোকান । আর ছিল ডায়েরি বা দৈনন্দিনকে কবিতায় ঢোকানোর পর্ব। এই পদ্ধতির ব্যবহার নিজের চোখে দেখা । অনেক কবিতা আজও সংগ্রহে আছে । কিন্তু বিনয় মজুমদার যে মহাপয়ারের জন্য বিখ্যাত, সেই কবিতাগুলো, ‘ফিরে এসো, চাকা’ নিয়ে শৈবাল মিত্র একটা চমৎকার টেলিফিল্ম বানান যা অনালোচিত থেকে গেছে বাঙালি জীবনে । এই সেই একমাত্র টেলিফিল্ম যেখানে গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাককে সেরিব্রাল ডিরেক্টারের মতো করে তুলে এনেছেন । কিন্তু বিনয় মজুমদারের সঙ্গে সময় কাটাতে কাটাতে আমি ওঁর লেখা দুষ্প্রাপ্য কাব্যগ্রন্হ ‘বাল্মীকির কবিতা’ বিষয়ে আলোচনা তুলি । দেখি, উনি আগ্রহ দেখাচ্ছেন না, এড়িয়ে যাচ্ছেন । বললেন, কোথায় শুনলাম এই নাম । আসলে ‘বাল্মিকীর কবিতা’র কথা বলেন সন্দীপ দত্ত । তখন আমি কপি সংগ্রহ করি বইটার প্রকাশকের ঘর থেকে । কিন্তু দেখি সন্দীপ দত্ত কথিত সেটা একটা খণ্ডিত সংস্করণ ; মানে, সব কবিতা নেই। ব্রজগোপাল মণ্ডল ছিলেন প্রকাশক । তারপর বিনয় মজুমদার বলেন ‘এটা হলো বিনয় মজুমদারের একমাত্র ইরোটিক কবিতার বই বা বাংলা ভাষায় একমাত্র ইরোটিক কবিতা । ভারতীয় কামসূত্র বা দেশীয় আকাঙ্খাকে তত্ত্ব হিসাবে ব্যবহার করা ও ব্যক্তিজীবনকে মিশিয়ে কবিতার ইরোটিকা তৈরি করা ।’ কেউ জানতো না । প্রকাশক ছাপতে রাজি হয়নি । খণ্ড ছেপেছে । আমি সন্দীপ দত্তের কাছে কিছু পূর্ণসংস্করণের খোঁজ পাই । কপি মেলে না । তখন বিনয় মজুমদার ঠাকুরনগর থেকে কপি এনে দেন । পড়ে আমি অবাক হই যে কেন এমন একটা কবিতার ইরোটিকা বাঙালি পড়তে পারবে না । এটা নিয়ে লিখি ও পুনর্মুদ্রণের দাবি করি । এই দাবি বিনয় মজুমদার সমর্থন করে ইনটারভিউ দেন সুবীর ঘোষকে । তারপর দেজ থেকে ‘বাল্মীকির কবিতা’র পূর্ণাঙ্গ সংস্করণ  বের হয় । ওই ‘বাল্মিকীর কবিতা’র সূত্রেই আমি ওঁর বউ ও ছেলের খোঁজ পাই । তাদের নাম রাধা ও কেলো । একদিন সোনাগাছিতে গিয়ে তাদের আবিষ্কার করি আর সেলুলয়েডে ইনটারভিউ তুলে আনি।”
         অদ্রীশ বিশ্বাস যদি সংবাদপত্র থেকে গড়া বিনয়ের কবিতাগুলো প্রকাশ করেন তাহলে আমরা বিনয়-চরিত্রের আরেকটা ডাইমেনশনের সঙ্গে পরিচিত হবো, বিনয়ের কবিতার আরেকটি সাব-জনারের কথা জানতে পারবো ।
         এই সূত্রে সন্দীপ দত্ত জানিয়েছেন যে, “১৯৭৫ সালে এক সাহিত্য সন্মেলনে বিনয় মজুমদার ‘বাল্মীকির কবিতা’ বই থেকে কবিতা পড়া শুরু করা মাত্র ভদ্রলোকদের উঠে যেতে দেখেছিলাম।”
         পরে বিনয় মজুমদারকে নিয়ে একটি টেলিফিল্ম হয়ছিল যাতে বিনয়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন জয় গোস্বামী । বিনয় ফিল্মটা প্রতিবেশীর টিভিতে দেখেছিলেন । এই বিষয়ে চন্দন ভট্টাচার্য তাঁকে প্রশ্ন করলে প্রথমে তিনি নিরুত্তর থাকেন, পরে বলেন, “এক-দু ঘণ্টার সিনেমায় কি গোটা জীবন ধরা যায়!”
         বিনয় মজুমদারের বউ রাধা আর ছেলে কেলোকে নিয়ে লেখা কবিতাটি একটি গাণিতিক প্রতর্কে মোড়া :

ভারতীয় গণিত
ক্যালকুলাসের এক সত্য আমি লিপিবদ্ধ করি ।
যে কোনো ফাংকশানের এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ এক বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির ফার্স্ট ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
এনেথ ডেরিভেটিভে এন
সমান বিয়োগ দুই বসিয়ে দিলেই
সেই ফাংকশানটির থার্ড ইন্টিগ্রেশনের ফল পাওয়া যায়–
এই ভাবে সহজেই যে কোনো অর্থাৎ
দশম বা শততম অথবা সহস্রতম ইন্টিগ্রেশনের
ফল অতি সহজেই পাই ।
এই কবিতায় লেখা পদ্ধতির আবিষ্কর্তা আমি
বিনয় মজুমদার । আমার পত্নীর নাম রাধা
আর
আমার পুত্রের নাম কেলো ।

        বিনয়েরর স্মৃতিশক্তি বার্ধক্যেও প্রখর ছিল, সাক্ষাৎকারগুলোয় তিনি অনায়াসে রবীন্দ্রনাথ ও জীবনানন্দের কবিতা আবৃত্তি করতে পারতেন, রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে উঠতেন । ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হের প্রকাশক উৎপল ভট্টাচার্য জানিয়েছেন যে এই গ্রন্হের জীবনানন্দ বিষয়ক নিবন্ধগুলো জীবনানন্দের বই ছাড়াই, কেবল স্মৃতি থেকে লিখেছিলেন বিনয় মজুমদার। বইটিতে ‘ধূসর জীবনানন্দ’ শিরোনামে তাঁর এই কবিতাটি আছে :-

ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে
কতিপয় ছিল শুধু বলেছিল, ‘এই জন্মদিন’ ।
এবং গণনাতীত পারাবত মেঘের স্বরূপ
দর্শনে বিফল ব’লে, ভেবেছিলো, অক্ষমের গান ।
সংশয়ে সন্দেহে দুলে একই রূপ বিভিন্ন আলোকে
দেখে-দেখে জিজ্ঞাসায় জীর্ণ হয়ে তুমি অবশেষে
একদিন সচেতন হরীতকী ফলের মতন
ঝরে গেলে অকস্মাৎ, রক্তাপ্লুত ট্রাম থেমে গেলো ।
এখন সকলে বোঝে, মেঘমালা ভিতরে জটিল
পূঞ্জীভূত বাষ্পময়, তবুও দৃশ্যত শান্ত, শ্বেত ;
বৃষ্টির নিমিত্ত ছিলো, এখনো রয়েছে, চিরকাল
রয়ে যাবে ; সঙ্গোপন লিপ্সাময়ী, কল্পিত প্রেমিকা–
তোমার কবিতা, কাব্য, সংশয়ে-সন্দেহে দুলে-দুলে
তুমি নিজে ঝরে গেছো, হরীতকী ফলের মতোন ।

         নিজেকে বিনয় মজুমদার  কখনও কবিতার শহিদ বলে মনে করেননি, কেননা সাহিত্যকে জীবিকা বা ধনোপার্জনের সঙ্গে একাসনে বসাননি তিনি, তাঁর সমসাময়িক কবিদের মতন। ‘কবিতার শহিদ’ তকমাটা শক্তি চট্টোপাধ্যায় চাপিয়েছিলেন বিনয়ের ওপর । প্রাপ্তির জন্য লালসা ছিল না তাঁর, কিংবা জাগতিক ধনদৌলতের জন্য দুঃখ। অনুষ্টুপ পত্রিকায় ২০১৩ সালে সুমন গুণ ঠিকই লিখেছিলেন যে “জীবনানন্দের সময় থেকে এখনও পর্যন্ত এই রকম সয়ম্ভর কবি আর কেউ নেই।” এক সময়ে বিনয় ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হের পাণ্ডুলিপি সংরক্ষণের জন্য পাঠিয়ে দিয়েছিলেন লণ্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে । সেই বিনয়ই শিমুলপুরে বসবাসের সময় থেকে পাণ্ডুলিপি এবং লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত কবিতা  সংরক্ষণ করা আর জরুরি মনে করতেন না ।
         বিনয় এক স্বতন্ত্র সত্বার কবি, তাঁর সময়ের সবচেয়ে বৈচিত্রময় কবি তিনি, বিচিত্রপথগামী তাঁর ভাবনা । আঙ্গিকগত বিন্যাস, শব্দ, ছন্দ, চিত্রকল্পের মিশ্রণে তাঁর কাব্যচেতনা অভিনব । ‘আধুনিক কবিতার হালচাল’ প্রবন্ধে বিনয় বলেছেন, “কালোত্তীর্ণ নয়, কালোপযোগী লেখাই অমর।” সহিদুল হক ২০১৭-এর বাংলা কবিতা পোর্টালে লিখেছেন, “বিনয় মজুমদার তাঁর বহু কবিতায় তথাকথিত অশ্লীলতাকে এক আশ্চর্য সুন্দর শৈল্পিকরূপ দান করেছেন ।” বিনয় মজুমদার অত্যন্ত সচেতন মানুষ ছিলেন, নয়তো তাঁর কথা শোনার জন্য তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তরুণ কবিরা জড়ো হতেন না, এবং তা প্রায় প্রতিদিন ।, কেবল তাঁর লেখার ব্যাপারেই নয়, তাঁর পার্সোনা নিয়ে সাহিত্যিকরা যে ছবি গড়ে তুলতে চাইছেন তা সম্পর্কেও সচেতন ছিলেন তিনি তা এই কবিতাটি থেকে পরিষ্কার হবে, তাঁর জীবনের শেষ পর্বে লেখা :-

মনস্তত্ত্ববিদদের কীর্তি
ভাস্কর চক্রবর্তী পাগলা গারদে ছিল
কিন্তু পাগলা গারদ বলে না, বলে এটা মানসিক হাসপাতাল ।
ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবাকে মনস্তত্ত্ববিদগণ বলেছে আপনার
ছেলে আপনার চাইতে বেশি খ্যাতিমান
এই কথা বলাবলি করছে অন্যান্য কবি ও কবিবন্ধুগণ
ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেও একথা বলেছে ।
এটা ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ
এই মনোরোগ আমরা সারিয়ে দিতে পারি
কিভাবে সারাতে পারি ?
ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে যে আমার বাবা
আমার চাইতে বেশী বিখ্যাত লোক
আমাকে পশ্চিমবঙ্গে কেউ চিনল না বাবাকে চেনে
এই কথা ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই লিখবে
এই রকম মনোরোগীর চিকিৎসা আমরা বহু
করেছি । সঞ্জয় ভট্টাচার্য, ঋত্বিক ঘটক এদের
আমরা চিকিৎসা করেছি ।

হে জনসাধারণ এই যে ভাস্কর চক্রবর্তী
ভাবে যে ভাস্কর চক্রবর্তী জনসাধারণের চাইতে
উঁচু দরের বাঙালি একজন ।
আমরা এই ভাস্কর চক্রবর্তীর মনোরোগ চিকিৎসা
করতে পারি । চিকিৎসা করতে পারলে ভাস্কর চক্রবর্তী নিজেই
বলবে যে আমি জনসাধারণের সমান মানে
কেরানির সমান, স্কুল মাস্টারের সমান । চাষার
সমান ।
তোমরা শুধু অনুমতি দাও ভাস্কর চক্রবর্তীর
চিকিৎসার জন্য তাহলে আমরা ভাস্কর চক্রবর্তীকে
তোমাদের সমান অর্থাৎ কেরানি, চাষী, স্কুল মাস্টার
রিকশাওয়ালার সমান । একথা ভাস্কর চক্রবর্তী
নিজেই বলবে আমাদের এখানে চিকিৎসা করার
পর ।

বাঃ ভাস্কর চক্রবর্তীর বাবা অনুমতি দিয়েছেন
জনসাধারণ অনুমতি দিয়েছেন । এইবার তাহলে
হাসপাতালে চিকিৎসা শুরু করি ।
এই রকমের পাগলাগারদে ডাক্তাররাও আছে
যেমন রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস এম. বি. বি. এস. পাশ
করা ডাক্তার সে আছে মেডিকাল কলেজের পাগলা
গারদে । এইরকম ভাবে পুলিশও আছে পাগলা গারদে ।
                    ( তার মানে মানসিক হাসপাতালে ) ।
মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা করা হচ্ছে
পুলিশ অনন্ত দেবরায়কে অর্থাৎ এরা হচ্ছে বিশেষ
বিশেষ উদাহরণ ।
পুলিশ, এম.বি.বি.এস. পাশ করা ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ
বিশ্বাস । এর পরে কবি বাদ দিলাম । অন্যান্য
যারা পাগলা গারদে ছিল এবং আছে ডাক্তার রবীন্দ্র
নাথ বিশ্বাস, পুলিশ অনন্ত দেবরায়

কিন্তু এই রকমের দু’একজন ডাক্তার পুলিশ
এদের সঙ্গে পাগলা গারদে আছে শত শত জনসাধারণ
হাজার হাজার জনসাধারণ এবং

ডাক্তার রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস নিজেই বলল যে
তার নিজের হয়েছে ক্রনিক শিজোফ্রেনিয়া
এই অসুখের কোনো চিকিৎসা নেই রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস
কে সারাজীবন ঔষধ খেতে হবে এবং আনুসঙ্গিক
চিকিৎসা করাতে হবে ।

এ তো হল একজন ডাক্তার, একজন কবি, একজন পুলিশ
এদের ভাগ্য আর অন্যান্য যাদের এই ভাগ্য হয়েছে
তারা হলেন হাজার হাজার জনসাধারণ ।

         ডি. জ্যাবলো হার্শম্যান এবং জুলিয়েন লিয়েব ( ১৯৯৮ ) তাঁদের  ‘ম্যানিক ডিপ্রেশান অ্যাণ্ড ক্রিয়েটিভিটি’ গবেষণাপত্রে বলেছেন যে সৃজনশীল শিল্পীরা ম্যানিক ডিপ্রেশানকে নিজের জীবনে ও কাজে সদর্থক উদ্দেশে ব্যবহার করতে পারেন । পল গঁগা যখন দেখলেন তিনি ফ্রান্সে বসে আঁকতে পারছেন না তখন ইউরোপের সমাজকে পরিত্যাগ করার জন্য তাহিতি দ্বীপে বসবাস করতে  চলে গিয়েছিলেন । ম্যানিক ডিপ্রেশানে আক্রান্ত হয়েছিলেন নিউটন , বিটোফেন এবং চার্লস ডিকেন্সও । মনোভঙ্গের বাঁধন কেটে বেরোবার জন্য ডিকেন্স লিখেছিলেন ‘ক্রিসমাস ক্যারল’ ।
         লুডউইগ এম অ্যারনল্ড ‘দি প্রাইস অফ গ্রেটনেস : রিজলভিং দি ক্রিয়েটিভিটি অ্যাণ্ড ম্যাডনেস কনট্রোভার্সি’ ( ১৯৯৫ ) গ্রন্হটি  ১০০০ বিখ্যাত মানুষের জীবনকাহিনি বিশ্লেষণ করে লিখেছেন। তিনি তর্ক দিয়েছেন যে যাঁদের চেতনার স্তর সাধারণ মানুষের থেকে আলাদা, স্কিৎসিফ্রেনিয়া, হিস্টিরিয়া, সংবেদনের অতিরেক, যৌন অক্ষমতা, যাঁরা নিঃসঙ্গতা পছন্দ করেন, তাঁদের মুক্তির পথ হলো সৃজনশীল শিল্প, তাঁদের ক্ষেত্রে তা নিরাময়ের কাজ করে । বিনয় মজুমদারকে কেউ কেউ বলেছেন পাগল ; কিন্তু তাই যদি হবে তাহলে তিনি রুশভাষা শিখে ছয়টি বই অনুবাদ করলেন, একুশটি কাব্যগ্রন্হ লিখলেন, ছয়টি গদ্যের বই, গণিতের বই লিখলেন কেমন করে ? এখনও তাঁর বহু রচনা অগ্রন্হিত রয়েছে ।
         দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক প্রশান্ত চক্রবর্তী, সম্প্রতি বিজেপির ছাত্র সঙ্গঠন যাঁকে আক্রমণ করে পাঁজরের হাড় ভেঙে দিয়েছে,  তাঁর ‘দি অপুলেন্স অফ এক্সিসটেন্স : এসেজ অন ইসথেটিক্স অ্যাণ্ড পলিটিক্স’ ( জানুয়ারি ২০১৭ ) বক্তৃতামালায় বিনয় মজুমদার সম্পর্কে এই কথাই বলেছেন যে,  “বিনয়ের কবিতা আলোচনাকালে চিরকাল তাঁর একাকীত্বপ্রিয়তা এবং নিউরটিক প্রলক্ষণকে তাঁর কবিতার মূল্যায়নের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়েছে ; এর চেয়ে বেশি নাটুকে ও বিরক্তিকর ভাবপ্রবণতা আর হতে পারে না । বিনয়ের কবিতার বিশুদ্ধ প্রাণচাঞ্চল্য মূল্যায়নের পথে এটি পরিত্যাজ্য বাধা । বিনয় ছিলেন পরমোৎকর্ষ-সন্ধানী এবং সতর্ক কবিতাশিল্পী ।”
         প্রশান্ত চক্রবর্তী আরও বলেছেন, এবং এই প্রসঙ্গে ওপরে আলোচিত সংজ্ঞার অবলোকনের প্রসঙ্গ এসে পড়ে, কবিজীবনের শেষ পর্বে বিনয় মজুমদার কবিতাকে জার্নাল লেখার মতো করে তোলেন । তিনি নিজের চারিপাশের বস্তুগুলো এবং ঘটনাগুলোর দিকে গভীর ভাবে তাকাতেন এবং সেগুলি রেকর্ড করতেন । তার ফলে একদিকে আমরা যেমন একজন ঘটনাপঞ্জীর দ্রষ্টাকে পাই, তেমনিই আরেকদিকে পাই কলকাতার বাইরে চলতে থাকা সূক্ষ্ম পরিবর্তনগুলো । পংক্তিগুলো জার্নাল রচনার অসাধারণ অভিব্যক্তি, তাতে কোনোরকম কৃত্রিম কবিত্ব করা হয়নি, তার চেয়েও বেশি কিছু উপস্হাপন করা হয়েছে যা বুনিয়াদি : স্রেফ বেঁচে থাকা । রেকর্ড করার অর্থ হল গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বস্তুদের পারস্পরিক সম্পর্ক অনুসন্ধান ।
         বিনয়ের লেখার প্রথম কালখণ্ড ছিল মূলত ১৯৫৮ থেকে  ১৯৬৬ । এই সময়টাতেই পঞ্চাশের কবিদের অনেকে সোনাগাছি-হাড়কাটা-খিদিরপুর যাওয়া আরম্ভ করেন, প্রধানত বুদ্ধদেব বসুর বদল্যার সম্পর্কিত বইটি প্রকাশিত হবার পর । বিনয় মজুমদার একা সোনাগাছি এলাকায় যেতেন বলে অনুমান করি, তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা’ থেকে সেরকমই মনে হয় ; যৌনকর্মীর ঘরের যে বর্ণনা তাঁর কবিতায় পাই তা কেউ যৌনকর্মীর ঘরে না গেলে বলতে পারবেন না । অদ্রীশ বিশ্বাসের স্মৃতিচারণা থেকেও তেমনটাই আঁচ করা যায় । নিয়মিত গ্রাহক সোনাগাছিতে ‘বাবু’ অভিধা পান ; বিনয় হয়তো কিছুকালের জন্য রাধার ‘বাবু’ প্রেমিক ছিলেন । রাধা নামে এক যৌনকর্মী আর তার ছেলের সঙ্গে নিজের সম্পর্কের কথা বলে গেছেন বিনয়।  অদ্রীশ বিশ্বাস জানিয়েছেন যে তিনি যৌনপল্লীতে গিয়ে রাধা আর কেলোর ফিল্ম তুলে এনেছিলেন । সেগুলো প্রকাশিত হলে পাঠকের অনুসন্ধিৎসা মেটে । ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো পড়লে বিশ্বাস করা যায় যে তিনি নিয়মিত নারীসঙ্গ করতেন কোনো এক সময়ে । হয়তো লেখালিখি তাঁকে এই সময়টায় ছেড়ে গিয়েছিল বলে তিনি রাধায় আশ্রয় নিয়েছিলেন । হাংরি আন্দোলনের গল্পলেখক বাসুদেব দাশগুপ্ত যখন আর লিখতে পারছিলেন না তখন তিনি ‘বেবি’ নামে এক যৌনকর্মীর ‘বাবু’ হয়ে ওঠেন । হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী জানিয়েছেন যে বাসুদেব দাশগুপ্ত সে-সময়ে ভায়াগ্রার সন্ধান করতেন ।
         “অঘ্রাণের অনুভূতিমালা” কাব্যগ্রন্হে ‘বিশাল দুপুরবেলা’ শিরোনামে একটি কবিতা আছে । যাঁরা দুপুরবেলায় সোনাগাছি নিয়মিত যান তাঁরা জানেন যে এই সময়টাতেই অনেকক্ষণের জন্য নিজের কাছে পাওয়া যায় প্রেমিকা-যৌনকর্মীকে । সময়টা বিশাল, দুজনে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করে সন্ধ্যার খদ্দের না আসা পর্যন্ত অঢেল সময় । যিনি ‘বাবু’ তিনিও নিজের জীবনের দুপুরবেলাতেই আগ্রহী হয়ে ওঠেন, অমন সম্পর্কে, বাসুদেব দাশগুপ্তের মতন । বাসুদেব দাশগুপ্ত অমন দুপুরবেলা কাটিয়ে সন্ধ্যার সময়ে আমার দাদা সমীর রায়চৌধুরীর বাড়িতে এসে চিৎপটাঙ হয়ে শুয়ে পড়তেন, নেশা কেটে গেলে অশোকনগরে বাড়ি ফিরতেন ।
         আশি ও নব্বুই দশকে বিনয় মজুমদার অসুস্হ হয়ে পড়েন এবং তাঁকে দেখাশোনা করতো কলকাতা শহরতলীর  ঠাকুরনগরের শিমুলপুরের একটি পরিবার । অনেকে এই আশ্রয়কে তুলনা করেছেন মানসিক রোগাক্রান্ত পরিবার-পরিত্যক্ত কবি ফ্রেডরিক হ্বেলডার্লিনের সঙ্গে, যাঁকে অমনই একটি গরিব মুচি পরিবার আশ্রয় দিয়েছিল । কেমন ছিল বিনয় মজুমদারের সে সময়ের জীবন ? এই কয়েকটা লাইন পড়লে কিছুটা আঁচ পাওয়া যাবে, কেবল কার্বোহাইড্রেট খেয়ে দিনের পর দিন চালিয়েছেন বিনয় মজুমদার, জীবনানন্দের পর শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি । সে সময় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ম্যাণ্ডেভিলা গার্ডেন্সে বসে খাচ্ছেন মুর্গির ললিপপ দিয়ে স্কচ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় খাচ্ছেন স্ত্রীর রান্না করা উপাদেয় স্বাস্হকর খাদ্য । বিশ্বভারতী  কর্তৃপক্ষ বক্তৃতা দেবার জন্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে নিজের ক্যাম্পাসে আহ্বান করে নিয়ে গিয়েছিলেন, প্রধানত শক্তি-সুনীল ব্র্যাণ্ডটাকে ব্যবহার করার জন্য , বিনয়কে নিমন্ত্রণ জানাতে তাঁরা হয়তো ভয় পেয়েছিলেন । শিমুলপুরে পাকাপাকি থাকতে গিয়ে বিনয়ের দৈনিক জীবন কেমন কাটছিল তা উনি বিয়াল্লিশ মাত্রার মহাপয়ারে লিখে রেখে গেছেন :

এইমাত্র পান্তাভাত
এইমাত্র পান্তাভাত খেলাম অর্থাৎ আমি হাত ধুতে গেছলাম
         অবশ্য খাবার পরে এঁটোথালা ধুই আমি নিজে
ভোরে ধুই দুপুরেও ধুই শুধু রাত্রিবেলা ধুই সে এঁটো থালা
        ভোরবেলা রাত্তিরের এঁটোথালা হাতে নিয়ে যাই
বুচির বাড়ির কাছে, এঁটো থালা দিয়ে আসি তার হাতে, বুচি নিজে
        ধুয়ে দেয় রাত্তিরের  এঁটো থালাখানি ।
সেই ধোয়া থালাটিতে বুচি নিজে খাদ্য দেয় আমার ভোরের খাদ্য
         গতকাল দিয়েছিল বেগুনসিদ্ধ ও ভাত আর
আজ দিল তো পান্তাভাত ; ভোরে বেশিদিন দ্যায় আলুসিদ্ধ আর ভাত
         মনে হয় আগামীকাল দেবে আলুসিদ্ধ ভাত।
আজ আমি এঁটো থালা কলঘরে ধুয়ে এনে রেখেছি তো টেবিলের
        উপরেই, এই ধোয়া থালাটিতে ভাত দেবে বুচি ।
                                         ( ‘পৃথিবীর মানচিত্র’ কাব্যগ্রন্হ — ২০০৬ )
        অসুস্হতার পরে তাঁর কবিতা রচনার আরেকটি পর্ব শুরু হয়, প্রধানত লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের চাহিদা মেটাতে, যে কবিতাগুলিতে বিনয় তাঁর সামনেকার বস্তুজগতের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক এবং বস্তুগুলোর পারস্পারিক সম্পর্ক ব্যাখ্যা করে চলেছেন ।
         ‘মনে থাকা’ শিরোনামে একটি কবিতায় বিনয় জানিয়েছেন যে, যে-কবিতার মানে বোঝা যায় না তাও ওনার মনে থাকে । তাঁর স্মৃতিশক্তি শেষ বয়সেও ছিল প্রখর । বিনয়ের মনে থাকলেও দুর্বোধ্য কবিতা আমার মনে থাকে না । বিনয় তিনটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন :

অমিয় চক্রবর্তী :
“খড়মাঠ কথা কয়, অজানা খোটানি
ঘনমেঘ চলে ছায়াটানি
নয় নীল শূন্য ত্রিশূল
টুকরো পাহাড়”

বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় :
“সাদা বা কালো ক্ষণপাথর
এ কোন আলো হৃদয়ে বা
অথবা নীচে নীল সাগর
পাহাড়ে নাচে হৃদয়ে বা
বুড়োর এ মন কবরে যায়
যখের ধন গভীরে চায়
হৃদয়ে তবু প্রেম নাচায়
পাহাড়ে বা হৃদয়ে”

মৃদুল দাশগুপ্ত
“কয়েক মুহূর্তকাল থামো —
আমি তাকে বলি
থেমে অশ্ম মন্ত্র ও মেশিন”

চোদ্দ

         ‘গ্রন্হি’ পত্রিকার জন্য চন্দন ভট্টাচার্যকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে ( মে, ২০০৫ ) বিনয় মজুমদার কবিতা-বিশেষের মনে রাখা নিয়ে ছন্দ ও অন্ত্যমিলকে গুরুত্ব দিয়েছিলেন :
         চন্দন : আপনি কয়েক বছর আগে বলেছিলেন, ছন্দ ও অন্ত্যমিলে লিখলে সে কবিতা পাঠকের মনে থেকে যায়। কাজেই পাঠকের  স্মৃতিতে কবিতাকে সুমুদ্রিত করার এটাই সেরা পদ্ধতি । এখনও কি তাই মনে করেন কবি ? তবে কি গদ্যে লেখা কবিতাগুলি মানুষ বিস্মৃত হবে কালে কালে ?
         বিনয় : আজও তাই মনে হয় ।
         চন্দন : কিন্তু ধরুন, লাতিন আমেরিকার বা ইউরোপেও তো শুধু গদ্য কবিতার ছড়াছড়ি । মিটার নামক শব্দটা ওরা হয়তো ভুলেই গেছে । শুধু কিছু গানের কথা ছাড়া —
        বিনয় : গানও আজ কবিতা হয়ে গেছে । আমিও তো গদ্য কবিতা লিখেছি, প্রথম কবিতাটির নাম ছিল “আমার প্রথম গদ্যকবিতা”, বেরিয়েছিল ‘রোপণ’ পত্রিকায় । আমার ধারণা লোকে গদ্য কবিতা পংক্তির পর পংক্তি এভাবে মনে রাখে না । মনে রাখে শুধু কবিতাটির বিষয়বস্তুকে ।
        চন্দন ভট্টাচার্য প্রশ্ন করতে পারতেন যে তাঁর ভুট্টা সিরিজের কবিতাগুলো কি তাহলে বিষয়বস্তুকে মনে রাখার জন্য ।
         বিনয় মজুমদারের কিন্তু প্রতিটি কবিতাই বোঝা যায় । ‘ফিরে এসো, চাকা’ এবং ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইয়ের কবিতাগুলো তো বটেই, স্কিৎসোফ্রেনিয়ার চিকিৎসা করে ফিরে এসে লেখা যে কবিতাগুলোর জন্য তিনি অনেকের দ্বারা আজকাল নিন্দিত হন, সেই কবিতাগুলোও । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বইতে ছয়টি দীর্ঘ কবিতা আছে । বিনয় মজুমদার বলেছেন যে কবিতাগুলি যদিও নারীভূমিকাবর্জিত, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যাকে লেখা চিঠিতে  তিনি জানিয়েছিলেন কবিতাগুলো আদিরসাত্মক । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে বিনয় মজুমদার ‘অতিচেতনা’ ও ‘অতিসত্য’. নামে দুটি ভাবকল্পের সূত্রপাত ঘটালেন ।
         ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হে বিনয় লিখেছিলেন

আমার সচেতনতা যেন অতিচেতনার সমপরিমাণ হয়ে যায়
উভয় চেতনা যেন সমান কুশলী হয় সমান সক্ষম হয়ে যায়
দুই চেতনার মাঝে যোগাযোগ ব্যবস্হাটি যেন খুব স্বচ্ছলতা পায়

         বিনয় সচেতনতা ও অতিচেতনায় পার্থক্য করেছেন । সচেতনা কবির প্রতিস্বের, যিনি কবিতাটি অথবা গল্প-উপন্যাস লিখছেন, তাঁর। কিন্তু অতিচেতনা ও অতিসত্য  পাঠবস্তুতে লুকিয়ে থাকে । কিছুকাল পরে পড়লে কবি অথবা পাঠক টের পান যে তাঁর সচেতনতায় ছিল না এমন জিনিসও রয়েছে পাঠবস্তুতে ; আবার বহুকাল পরে পড়লে আরও নতুন উদ্ভাস পাবেন তিনি,  যা প্রথমবার বা দ্বিতীয়বার পড়ে পাননি । অর্থাৎ পাঠবস্তুটি নিজের উপরিতলের নীচে অতিচেতনার ও অতিসত্যের বহুবিধ স্তর সঙ্গোপনে রেখে দেয় । বিনয়ের অতিচেতনা ও অতিসত্য তাঁর ব্যক্তিপ্রতিস্বের নয়, তা পাঠবস্তুটির ।
         ১৯৮৭ সালে ‘পুনর্বসু’ পত্রিকার জন্য রণজিৎ দাশের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বিনয়ের অতিচেতনা ও অতিসত্য বিষয়ে এরকম প্রশ্নোত্তর হয়েছিল :
         প্রশ্ন : কথা হচ্ছে যে, আমি একটা কথা মনে করি, সেটা হচ্ছে যে আমি মনে করি, আমার সঙ্গে তখন একমত হয়েছিলেন আপনি — যে কোনও অভিজ্ঞতাই একজন কবির লেখার বিষয় নয় ! মানে যে কোনও অভিজ্ঞতা, হঠাৎ একটা অভিজ্ঞতা হল, এটাই আমার লেখার বিষয় হয়ে উঠতে পারে না । মানে যতক্ষণ না সেই অভিজ্ঞতাটা আমার মধ্যে জারিত হচ্ছে । জারিত হতে হতে এমন একটা পয়েন্টে এসে পৌঁছোল, যখন সেটা, শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা বা একটা সাধারণ উপলব্ধির স্তরে থাকে না — মানে সেটা একটা, কী বলব, অভিজ্ঞা বা আদ্যাজ্ঞানের অবস্হায় চলে যায় । তখনই একটা, সেই অবস্হা থেকে যখন একটি লোক লেখে, তখন সেটাই চূড়ান্ত কবিতা হয়ে উঠতে পারে, সম্ভাবনা থাকে । তো আপনি কি এটা মনে করেন ? কেননা আপনার কবিতা পড়ে তো — তাই মনে হয়েছে, কেননা চার বছর অতিক্রম করবার পরে–
         বিনয় : কবিতায় অবচেতন মন বলে একটা জিনিস আছে, শুনেছ ? সেটা কিছু-কিছু লোকের কবিতায় খুব থাকে । তুমি নিজের কবিতা রেখে দাও, ছাপা কবিতা…চার…পাঁচ, আস্তে আস্তে তোমার নিজের কবিতার মানেই তোমার কাছে কিন্তু ধীরে-ধীরে উন্মোচিত হতে থাকবে, মনে হবে যেন, এই মানেটাও, রয়ে গেছে কবিতার মধ্যে, খেয়াল, খেয়াল না করে লিখে ফেলেছ, বুঝতে পারলে, এই যে জিনিসটা এটাকে তোমার অবচেতনাই বল, অতিচেতনা, আমি ‘অতিচেতনা’ বলে একটা শব্দ সৃষ্টি করেছি, আলট্রা ভায়োলেট রে ।
         প্রশ্ন : এটা অনেক ভালো শব্দ, অনেক ভালো শব্দ ।
         বিনয় : অতিচেতনা ।
         প্রশ্ন : খুব ভালো, কাজে লাগবে ।
         বিনয় : আমি প্রথম ব্যবহার করেছি, ‘অতিচেতনা’ শব্দটা আগে ছিল না ।
         প্রশ্ন : আপনি তো ‘অতিসত্য’ বলেও একটা সাংঘাতিক শব্দ ব্যবহার করেছেন, এক জায়গায় আছে —অতিসত্য ।
         বিনয় : আচ্ছা, কনসাস মাইণ্ড, অ্যাঁ ?
         প্রশ্ন : অতিসত্য । অতিসত্য, আপনার লেখায় এক জায়গায় আছে । –’শুধু সত্য আমি’, ‘বাকিসব অতিসত্য, শুধু সত্য আমি’।
         বিনয় : অতিসত্যটা তখন….
         প্রশ্ন : আপনি ‘অতিসত্য’ ব্যবহার করেছেন । মানে, সমাসবদ্ধভাবে । তাহলে ‘আমার’ সঙ্গে চারিদিকের তফাত একটা আছে ?
         বিনয় : অ্যাঁ ?
         প্রশ্ন : আমার সঙ্গে ।
         বিনয় : তুমি যা লিখে রেখেছ, রেখে দাও, ছাপা হোক, বই হোক, দশ, পনেরো, কুড়ি বছর পরে নিজেই টের পাবে ভিতরে-ভিতরে একটা গভীরতম অনুভূতিও রয়ে গেছে, নিজেও ভালো করে লক্ষ্য করতে পারোনি লেখার সময় ! বুঝতে পারছ ! লেখার সময়ে তুমি নিজেও ভালো করে লক্ষ্য করনি, তোমার অজ্ঞাত, তোমার নিজেরই অজ্ঞাতসারে এমন কিছু হয়ে গেছে । তাকে আমি নাম দিলুম অতিসত্য, সেটা একদম অতিচেতন মন । সাবকনসাস, কনসাস, এদুটো ছিল, আলট্রাকনসাস বলে, আলট্রা কনসাস, আলট্রাকনসাস, নাম দিলুম ‘অতিচেতনা’ ।
         প্রশ্ন : আচ্ছা এটা কি সব লেখা সম্পর্কেই মনে হয়, না কিছু-কিছু লেখা সম্পর্কে মনে হয় ?
         বিনয় : তুমি নিজে মনে-মনে ভাব ।
         বিনয় মজুমদারের দেয়া সাক্ষাৎকারগুলো অন্যান্য কবিদের সাক্ষাৎকারের থেকে একেবারে আলাদা। বিনয় সাক্ষাৎকারের মাঝেই নিজের কবিতা, জীবনানন্দের কবিতা, রবীন্দ্রনাথের কবিতা আচমকা আবৃত্তি করে সাক্ষাৎকার যাঁরা নিচ্ছেন আর নিজের মাঝে একটি অভিকরসম্পর্ক গড়ে তোলেন, দূরত্বকে মুছে ফেলেন। গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক তাঁর নিজের দেয়া সাক্ষাৎকার সম্পর্কে একবার বলেছিলেন যে তা হল Gesture towards a history of vanishing present  এবং the interview is an enabling violation that allows the interviwee subject to produce a narrative of the self through a responsive encounter with the OTHER, as well as produce an ethics of accountable transformation. The interviewee not only articulates strategic essentialism but performs it. এই বক্তব্য বিনয় মজুমদারের দেয়া সাক্ষাৎকারগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোয্য। অন্যান্য লোকেদের যদি জিগ্যেস করা হয় ,কেমন আছেন, তাঁরা উত্তর দ্যান ‘চলছে’ । বিনয় কিন্তু জানান যে তিনি আনন্দে আছেন ।
         সত্তর দশকের কবি বারীন ঘোষাল ‘অতিচেতনা’ নামে একটি কাব্যিক ভাবকল্পের কথা বলেছেন যা বিনয় মজুমদারের চিন্তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন । বারীন ঘোষাল ব্যক্তিএককটির প্রতিস্বের অতিচেতনার কথা বলেছেন, সে কারণে বারীনবাবুর ‘অতিচেতনা’ কবিতার ভাবকল্পে সমর্পিত কবিদের আঙ্গিকে  প্রতিফলিত হয়, এমনটাই তাঁরা মনে করেন, এবং সেই আঙ্গিকের প্রতি নজর দিলে স্তেফান মালার্মের বিখ্যাত কবিতা “এ রোল অফ দি ডাইস উইল নেভার অ্যাবলিশ চান্স’-এর প্রভাব সহজেই চোখে পড়ে । মালার্মে বলেছিলেন বস্তুজগতের সত্য স্বপ্রকাশিত হয় কবির অতিচেতনার ( সুপারকনসাশনেস ) দ্বারা । দি নিউ ইয়র্কার পত্রিকা এপ্রিল ২০১৬ সংখ্যায় বলেছে যে স্তেফান মালার্মে হলেন ‘প্রফেট অফ মডার্নিজম’  । বিট ঔপন্যাসিক উইলিয়াম বারোজ কিন্তু বলেছেন যে অতিচেতনা ( সুপার-কনসাশনেস ) সম্ভব হয় মাদক সেবনের মাধ্যমে এবং সেই অবস্হায় সাহিত্য সৃষ্টি সম্ভব নয়। বলা বাহুল্য যে বিনয় মজুমদারের অতিচেতনা থেকে এনাদের অতিচেতনা সম্পর্ণ আলাদা ।
         ‘নিশিকড়’ প্রবন্ধে বারীন ঘোষাল লিখেছেন, “চেতনা শব্দটা একটু গোলমেলে । অনেকে একে বিবেক, চৈতন্য ইত্যাদির সাথে গুলিয়ে ফেলেন । মানুষের মনে যখন একটা বদ্ধমূল ধারণা হয় যা অন্ধ সেটাকেই তার চেতনা মনে করে । একই বিষয়ে অনেক চেতনা, আবার অনেকানেক বিষয়ে বহুবিধ চেতনা তার হতে পারে। অনেক সময়েই চেতনাগুলোর মধ্যে সংঘাত হয় তাদের আপাতবিশৃঙ্খলার জন্য, কার্য ও কারণের মধ্যে সম্পর্কহীনতার জন্য, মিথ্যা বিশ্বাসের জন্য, এবং ভাষা ও শব্দের প্রতীকভাষ্যের জন্য । চেতনাগুলির মধ্যে যদি শৃঙ্খলা সম্ভব হয় তবে তার মানসিকতাও সমৃদ্ধ হয় । আবার দেখুন, মানুষের শরীরে বস্তুগত শূন্যতা ৭০%, যা তার প্রতিটি পরমাণুর কোয়ার্কের সমষ্টিগত অন্ধকার । এই অন্ধকারও সচল, তার ডাইমেনশান আছে, আলোয় আসতে চায় । এটা তার প্রগতির লক্ষণ, প্রকৃতির শিক্ষা । চেতনাদলের অপার বিশৃঙ্খলার মধ্যে মানুষের পরিবেশ-সঞ্জাত যে সর্বশ্রেষ্ঠ প্যাটার্নটি সম্ভাবিত হয় তা-ই তার অতিচেতনা ।” প্রশ্ন হলো বারীনবাবুর ‘নতুন কবিতা’ আন্দোলনের সকলেরই ব্যক্তি-প্রতিস্বে যা ঘটে তা কি অন্য মানুষদের থেকে আলাদা ?  
         অতিচেতনা সম্পর্কে ‘অষ্টাবক্র গীতা’য় বলা হয়েছে যে, “তুমি তখন পৃথিবী নও, জল নও, আগুন নও, বায়ু নও, আকাশ নও তখন স্বাধীনতাবোধের জন্য নিজের আত্মনকে অতিচেতন বলে মনে করো এবং ওই স্হিতিতে  সাক্ষী থাকো পঞ্চভুতের ।”
           একটি থেকে আরেকটি সাব-জনারে বিনয় স্বচ্ছন্দে চলে গেছেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলো এবং তার পরে লেখা কবিতাগুলো আঙ্গিক ছন্দ ও ভৌতজগতের নৈসর্গিক বিস্তার  ‘ফিরে এসো, চাকা’ থেকে সম্পূর্ণ সরে গেল । প্রশ্ন ওঠে, তা কি এইজন্য যে আলোচকরা তাঁর কবিতাকে বার বার জীবনানন্দের সঙ্গে তুলনা করছিলেন । বিনয় বলেছেন জীবনানন্দের কবিতা অত্যন্ত জটিল, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু চেষ্টা করেছিলেন জীবনানন্দের ঢঙে লিখতে । কিন্তু তিনি নিজে যে প্রভাবিত নন, এবং মৌলিকতা যাতে কবিতা রচনা করার সময়ে আসে শেষ পর্বের এই কবিতাটিতে বয়ান করে গেছেন :

কলমটি পড়ে আছে টেবিলের কোণে
হাত দিয়ে কলমটি ধরি…
এইভাবে আমি কবিতা রচনা করি
যাতে মৌলিকতা কবিতায় আসে
কারো কাব্য অনুসরণের চেষ্টা তো করিনি আমি
যা-যা ঘটে যা-যা করি তাই লিখি মাঝে -মাঝে ।

পনেরো

         মাদুলি পত্রিকার বিনয় মজুমদার সংখ্যায় ( ২০১০ ) শিমুল সালাহউদ্দিন “‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ আবিষ্কার” প্রসঙ্গে লিখেছেন যে ঢাকার এক সাহিত্য আসরে একজন আবৃত্তিকার এই কবিতাটি আবৃত্তি করেছিলেন, এবং খোঁজ নিয়ে তিনি জানতে পারেন কবির নাম বিনয় মজুমদার :-

বিড়িতো ফুরালো প্রায় । দুটি বিড়ি আছে
শালপাতা দিয়ে এই বিড়ি বানায় । এপর্যন্ত লিখে
মনে এলো রেললাইনের পাশে লম্বা এক শালবন
বানিয়েছে । শালপাতাগুলির সেই শাদা শাদা ফুল ।
গন্ধ আছে নাকি এই শালফুলে, ঘ্রাণ যদি না থাকে
এই শালফুলে তবে শালফুল অঘ্রাণ
এবং এই শালফুলের মানে শালফুলের মনের অনুভূতি
ধরা আছে আমাদের পৃথিবীর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালায়”

         শিমুল সালাহউদ্দিন লিখেছেন, “পড়িতে বসিলাম ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ । জীবন্ত সব ডালপালা সমেত যেন অন্ধকারে একটি মৃত গাছ আমার জানালায় নড়িয়া উঠিল । মৃত গাছ তথাপি প্রসারণশিল তার ডালপালা । জীবন্ত । নির্লিপ্ত দাঁড়িয়ে কথা কই্ছে যেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র সেই ঘোর বাধ্য করিল বিনয়ে আসক্ত হইতে, বিনয়কে ভয় পাইতে, বিনয় নিয়া পড়াশুনা চিন্তা করিতে । দেখিলাম বিনয় পণ্ডিতরা বিবৃতি করেছেন বিনয় মানসিক অসুস্হতার কারণে কলকাতা মেডিকাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রহিয়াছিলেন । দীর্ঘ সময় । কিন্তু সেই সময়ে লিখিত এক পংক্তির দুইশত একটি কবিতার ভিতর দিয়া খেয়া-নাও পাড়ি দিতে দিতে এ অধমের কখনও মনে হয় নাই সেই মেদুর কবিতাপংক্তিসমূহের কোনো একটাও পাগলপ্রলাপ । বিনয়ের এ কবিতাগুলো যেন ভিন্নতর দর্শনের আয়না, জন্মশেকড় হইয়া দেখা দিলো আমার কাছে । কল্পনা, তাঁহার পরিচিত দৃশ্যকল্প জগতে কল্পনার স্হান বিনয়ের এ কবিতাগুলোতে নাই । যেন বা জীবনের প্রতি অনাসক্ত এক দ্রষ্টা বিপরীত আয়নায় দেখিতেছেন জগতকে । কবিতার সবকটি লাইন জুড়িয়াই রহিয়াছে অনন্য সব বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান এবং অনুধাবন । কেবল কবিতা কেন, বিনয় গদ্য সাহিত্যও সাজান পরতে-পরতে, তাকে তাকে, থাকে থাকে, গণিত প্রভাবিত দার্শনিকতায় । প্রতিভা ও মেধার সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানি না আমি । কোনো লেখক বা কবিকে আমাদিগের জগতে চরিয়া খাওয়া তথাকথিত অ্যাকাডেমিশিয়ানরা যে সকল অভিধায় ভূষিত করিয়া থাকেন, তা-ও করা যায় কিনা এ-লইয়া রহিয়াছে পক্ষে-বিপক্ষে প্রভূত বিতর্ক । তবে বিনয়ের কবিতা, তামাকে ডুবিয়া গিয়া যেমন, তেমনি বিনয়ের শত্রু ধরিয়া নিয়াও নিঃসন্দেহে বলা যায়, কোনো গণিতে, কোনো ভূগোলেই কোনো কবি-লেখক-সৃষ্টিশীল সত্ত্বাকে আটক করিয়া রাখা যায় না । দৃশ্যত এমনই এক অতিবাস্তব-অধিবাস্তব অনুধাবনের মাঝখানে নির্লিপ্ত দাঁড়াইয়া সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন একের পর এক । হইয়া উঠিয়াছেন রাজা । ঘোর আর প্রবণতার । আর শব্দ, ব্যঞ্জনা, উপমায় উপমিত করিয়াছেন কবিতার ঘরগেরস্হালি, শিথান-পৈঠা-উঠান । নিজস্ব ডায়েরির মতো সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র আঙ্গিকের কাব্যে হইয়া উঠিয়াছেন দৃশ্য আর বলিবার মতোন নিরাসক্ত, নির্মেদ, সাবলীল, বহমান, অক্ষরবৃত্ত ছন্দের ষোলোঘুটির ঘরের প্রবাদপুরুষ।”
         ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কবিতাটির তৃতীয় পর্ব কিছুটা পড়ে দেখা যাক, যে পর্বটি এক সম্পাদক ছাপবেন বলে নিয়ে অশ্লীলতার ভয়ে ছাপতে চাননি, কেননা তখনও হাংরি মামলা হাইকোর্টে চলছে আর বিনয় মজুমদার বছর দুয়েকের জন্য হাংরি আন্দোলনে ছিলেন । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ রচনার পরে ‘বাল্মীকির কবিতা’কে স্বাভাবিক ও অনায়াস অগ্রগতি বলে চিহ্ণিত করা যায়, যে পথে হাঁটার সাহস আর কোনো কবি এতাবৎ দেখাতে পারেননি ।
          বহু পরে, জ্যোতির্ময় দত্ত ওনার ‘কলকাতা’ পত্রিকায় প্রকাশ করেন তৃতীয় পর্বটি :-

সকল বকুল ফুল শীতকালে ফোটে, ফোটে শীতাতুর রাতে
যদিও বছর ভর, আষাঢ়ে-আশ্বিনে, চৈত্রে বকুলের নাম শোনা যায়,
শুনি বকুলের খ্যাতি, বকুলের প্রিয়তার সকল কাহিনী
তবু খুব অন্তরঙ্গ মহলেই শুধুমাত্র আলোচিত হয়
তার ঢাকাঢাকি করে এ-সব নরম আর গোপন বিষয় ;
অচেনা মহলে প্রায় কখনোই বকুলের নাম বা কাহিনী
তোলে না, শরমবোধে চেপে যায় যেন কেউ বকুল দ্যাখেনি ;
তবে — তবু আমি জানি সকলেই এ-সকল মনে মনে ভাবে
বড়ো বেশি করে মনে মনে ভেবে থাকে সারাটা জীবন
ভেবে বেশ ভালো লাগে বকুল ফুলের রূপ এবং সুরভি ।
আমাদের সব চিন্তা অদৃশ্য বাস্তব হয়ে পাশে চারিধারে
রূপায়িত হতে থাকে, হয়ে যায়, অবয়বসহ হয়ে যায়,
চলচ্চিত্রাকারে হয়, চিন্তাগুলি অবিকল এমন বাস্তব
বলেই হয়তো এতো ভালো লাগে বকুলের বিষয়ে ভাবনা ।
বকুলের আকারের বিষয়ে ভাবনা তবু বেশি ভালো লাগে
ঘ্রাণ ও রঙের চেয়ে অন্যান্য গুণের চেয়ে ফুলের আকার
চিরকাল সকলেরই অনেক অনেক বেশি ভালো লেগে থাকে–
মাঝখানে বড়ো এক ছিদ্রপথ, ছিদ্রপথ ঘিরে
অনেক পাপড়ি আছে, এলোমেলো সরু সরু পাপড়ি ছড়ানো ;
এই চেহারাটি আমি স্বভাবত সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি
এ-সকল পাপড়িকে অতিশয় সাবধানে নাড়াচাড়া করি,
এখন এই তো এই বকুলবাগানে একা অঘ্রাণের রাতে
নাড়াচাড়া করে দেখি, অতি সাবধানে টানি, ধীরে-ধীরে টানি
যাতে এ-সকল দল ছিঁড়ে বা উঠে না যায় ; কী রকম লাগে,
মনে হয়, মনে পড়ে এতো বড়ো বাগানের শরীরের থেকে
শুধুমাত্র ভালো-ভালো, মূল্যবান জিনিসকে বেছে-বেছে নিয়ে
যে-রকম চর্চা হয়, সৌন্দর্যচর্চার রীতি চিরকাল আছে
তার বিপরীতভাবে গদ্যময়তার থেকে বাদ দিয়ে দিয়ে
সারহীন অঙ্গগুলি সরিয়ে-সরিয়ে রেখে ডালপালা পাতা
একে-একে বাদ দিতে-দিতে শেষে যখন এমন
আর বাদ দিতে গেলে মূল কথা বাদ যায় যার তখন থেকেই
দেখা যায় জোছনায় ফুল ফুটে আছে, এই বকুল ফুটেছে,
দেখা যায় একা-একা অঘ্রাণের জোছনায় আমি ও বকুল,
বকুলের ফাঁকটির চারধারে সরু-সরু পাপড়ি ছড়ানো
অতি সোজা সাদা কথা যেন অবশিষ্টরূপে পড়ে আছে তবু–
তবু এ তো ডাল নয়, তবু এ তো পাতা নয়, এ হলো বকুল ।

‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র ছয়টি কবিতাই বেশ দীর্ঘ, এবং একই কথা শুনতে শুনতে পাঠক আগ্রহ যাতে হারিয়ে না ফেলেন, এবং পাঠকের মনে প্রশ্নের উদয় হয়, তাই বিনয় মজুমদার ‘এলিমিনেশান পদ্ধতি’ প্রয়োগ করে মাঝে-মাঝে কবিতার মাঝখানে বাঁকবদল ঘটিয়ে দিয়েছেন । এই এলিমিনেশন পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁর একটি প্রবন্ধ আছে যা আমরা পরে আলোচনা করব । যেমন ওপরের ওই লাইনটির পরে একটি ভাঙন তৈরি করে  তিনি আরম্ভ করছেন এইভাবে :

শতকরা একেবারে একশতভাগ খাঁটি দর্শনের নাম
সংজ্ঞা অনুসারে ধর্ম, মনে হয় চারপাশে মহাকাশময়
অনাদি সময় থেকে, গণিতেরই মতো বহু কবিতা রয়েছে
চুপচাপ পড়ে আছে কোনোদিন একে-একে আবিষ্কৃত হয়
কোনো অঘ্রাণের রাতে বকুলবাগানে খুব মৃদু জোছনায়
সুডৌল পাতার ফাঁকে গহ্বরের মতো কিংবা ছিদ্রের মতোন ।

        এর পরে বাঁকবদল করে কবিতাটিকে অন্যদিকে চালিত করলেন বিনয়, বা বলা যায়, যারা এতক্ষণ আঁচ করতে পাচ্ছিলেন না বকুলফুল প্রকৃতপক্ষে ঠিক কোন জিনিশ, তাঁদের নিয়ে গেলেন পথ দেখিয়ে :

ছবি আঁকবার কালে কোনো যুবতীর ছবি আঁকার সময়ে
তার সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
সবচেয়ে দরকারি, কোনো অঙ্গ কোনোক্রমে বাদ চলে গেলে
অন্যান্য অঙ্গগুলি যতো ভালো আঁকিই না কেন এই ছবি দেখে
ভয় করে, সকলেরই অতিশয় ভয়াবহ বলে মনে হয় ।
তাই সব প্রত্যঙ্গকে হাজির রাখাই হলো বেশি দরকারি–
দরকারি বকুলের কুঁড়িগুলি শাদা-শাদা গোল-গোল কুঁড়ি–
এই কথা বকুলের কাছে আমি চোখ বুজে বলে ফেললাম,
বলি, ও বকুল, তুমি বোঝো না কি কুঁড়িগুলি খুব বেশি ছোট,
আরো ঢের বড়ো-বড়ো নরম-নরম হবার কথা না ?
এ-সকল কুঁড়ি নেড়ে টিপে-টিপে সুখ পেয়ে — পাবার পরে না ?
শুনে ফুল হেসে ফ্যালে, মৃদু-মৃদু হেসে ফ্যালে, কথা সে বলে না ।
হেসে ফেললেই এই ঠোঁট দুটি এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায়
গোলটুকু এতো বেশি ফাঁক হয়ে যায় কেন বকুল-বকুল,
হাসিকান্না যাই হোক গোল ঠিক এক মাপে থাকার কথা না —
এই কথা আমি বলি, একটু বিস্মিত হয়ে বলে ফেলি আমি ।

         এলিমিনেশান পদ্ধতি প্রয়োগ সম্পর্কে বিনয় মজুমদার আলোচনা করেছেন তাঁর ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে । তিনি লিখেছেন, “যে-কোনো রচনা সম্পূর্ণ বিবরণ-সংবলিত হওয়ার কথা । কিন্তু তা থেকে কোনো অংশ ( স্তবক ইত্যাদি ) কিংবা বাক্য সুপরিকল্পিতভাবে বাদ দিলে, এই বাদ দেওয়ার ব্যাপারটিকে বলি ‘এলিমিনেশান’,  যেমন রবীন্দ্রনাথের ‘পুজারিনি’ কবিতাটির শেষ স্তবক এবং ঠিক তার আগের স্তবক — এই দুইয়ের মাঝখানে ঘটনার বিবরণ মহাকবি স্বেচ্ছায় সুপরিকল্পিত ভাবে বাদ দিয়েছেন :-

এমন সময়ে হেরিলা চমকি প্রাসাদে প্রহরী যত
           রাজার বিজন কানন-মাঝারে
           স্তূপপদমূলে গহন আঁধারে
জ্বলিতেছে কেন যেন সারে সারে প্রদীপমালার মতো ।
মুক্তকৃপাণে পুররক্ষক তখনি ছুটিয়া আসি
            শুধালো, “কে তুই ওরে দুর্মতি,
            মরিবার তরে করিস আরতি।”
মধুর কন্ঠে শুনিল, শ্রীমতী, আমি বুদ্ধের দাসী”

সেদিন শুভ্র পাষাণফলকে পড়িল রক্তলিখা ।
           সেদিন শারদ স্বচ্ছ নিশীথে
           প্রাসাদকাননে নীরবে নিভৃতে
স্তূপপদমূলে নিভিল চকিতে শেষ আরতির শিখা ।।’

শেষ স্তবকের ঠিক আগের স্তবকে কবি লিখেছেন যে প্রাসাদের প্রহরীরা দেখতে পেলো  রাজার বিজন কাননে স্তূপপদমূলে প্রদীপমালা জ্বলছে । তার পরেই শেষ স্তবক — শেষ স্তবকে শুধু লিখেছেন যে সেদিন শুভ্র পাষাণফলক রক্তচিহ্ণিত হল এবং শেষ আরতির শিখা চকিতে নিভে গেল । এতে রচনা অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে, বেশি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়েছে । অনুরূপভাবে কোনো রচনার কোনো বাক্য বা বাক্যাংশ বাদ দেওয়ার উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করছি বর্তমান প্রবন্ধের রচয়িওতারই একটি কবিতা । ‘আমার ঈশ্বরীকে’ গ্রন্হের তৃতীয় সংস্করণে ছিল, ‘যে গেছে সে চলে গেছে, দেশলাইয়ের বিস্ফোরণ হয়ে/বারুদ ফুরায় যেন, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’, ইত্যাদি । পরে ‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী’র  সংস্করণে পরিমার্জনার পর লিখি : ‘যে গেছে সে চলে গেছে, অবশেষে কাঠটুকু জ্বলে/আপন অন্তরলোকে’ ইত্যাদি । এতে কবিতাটি অধিকতর হৃদয়গ্রাহী হয়েছে বলে আমার ধারণা । চিত্রশিল্পীদেরও এই ধরণের এলিমিনেশান ব্যবহার করা ভিন্ন গত্যন্তর নেই । পিকাসোর চিত্রে ( একটি উদাহরণ ‘মা ও ছেলে’ ), মাতিসের চিত্রে ( একটি উদাহরণ সেই দীর্ঘ গ্রীবা বিশিষ্ট তরুণী মহিলা ), দেখা যায় বিশদরূপে আঁকতে গেলে যত রেখা ব্যবহার করতে হয়, তত রেখা তাঁরা ব্যবহার করেননি, বহু রেখাই বাদ দিয়ে দিয়েছেন । দিয়েছেন সংক্ষেপে কাজ সারার জন্য, শ্রীমণ্ডিত করার জন্য । এলিমিনেশানের ফল রহস্যময়তা ও দুর্বোধ্যতা । জীবনানন্দের নিজেরই রচনায় এলিমিনেশানের একটি সুন্দর উদাহরণ মনে পড়ল : ‘বিবর্ণ প্রাসাদ তার ছায়া ফেলে জলে।/ও প্রাসাদে কারা থাকে ? কেউ নেই — সোনালি আগুন চুপে জলের শরীরে/নড়িতেছে-জ্বলিতেছে -মায়াবীর মতো যাদুবলে’ ইত্যাদি । এখানে এই আগুন কি কোনো আলেয়ার, নাকি ওই প্রাসাদ থেকে আসা আলোর প্রতিফলন, না কি অন্য কোনো স্হান থেকে আসা আলোর প্রতিফলনও হতে পারে । কবি সে কথাটি বাদ দিয়ে দিয়েছেন, যেন বিষয়টি অত্যন্ত গোপন কথা । ফলে কবিতাটির এস্হানটি  রহস্যময় হয়ে উঠেছে, পাঠক উপরিউক্ত সম্ভাবনাগুলির কোনটি হতে পারে ভাবতে শুরু করেন ; পথ চলতে-চলতে রহস্যের ঘ্রাণ পেয়ে থেমে পড়ার মতো, থেমে পড়ে চতুস্পার্শ্ব একটু খতিয়ে দেখার মতো । এর ফলে সেই খতিয়ে দেখা স্হানটি পথিকের মনে গেঁথে যায়, গেঁথে যায় অনুরূপভাবে কবিতাটির পংক্তিগুলিও । ফলে দেখা যাচ্ছে এলিমিনেশান কবিদের মস্ত সহায়, প্রায়শই ভরসা । এলিমিনেশানের ফলে রহস্যময়তা বাড়ে, দুর্বোধ্যতা বাড়ে– মাঝে-মাঝে কবিতার অর্থ ‘কোনোদিন বোঝা যাবে না’ অবস্হায়ও এসে দাঁড়ায় । কিন্তু কবির চরম উদ্দেশ্য পাঠককে ভালো লাগানো, বোঝানো নয়।”
         বিনয় মজুমদার ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে লিখেছেন যে জীবনানন্দের ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় সৌন্দর্যতত্বের কয়েকটি ব্যাপার অনুপস্হিত ; প্রবন্ধটি ১৯৬৬ সালে লেখা ।

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ-পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দ্যাখে তারা ;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই — প্রীতি নেই —
                           করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ ছাড় ।

যাদের গভীর আস্হা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয় ।

“এতে ‘এলিমিনেশান নেই । আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতি নেই” । বিনয় বলেছেন, “অঙ্কিত চিত্র যেমন আলোকচিত্র নয়, কবিতাও তেমনি সাংবাদিকতাময় মাধ্যম নয় । অর্থাৎ চিত্রশিল্পীকে ভেবে-চিন্তে সুপরিকল্পিত ভাবে আলোকচিত্র হতে চ্যুত হতে হয় — তার উদ্দেশ্য দর্শককে অধিক পরিমাণে ভালো লাগানো। তেমনি কবিকেও ভেবেচিন্তে সুপরিকল্পিতভাবে সংবাদসুলভ রচনা থেকে চ্যুত হতে হয় । ফলে জন্ম হয়েছে ইমপ্রেশনিস্ট চিত্রের, অ্যবসট্র্যাক্ট চিত্রের । ফলে জন্ম হয়েছে অ্যাবসট্র্যাক্ট চিত্রের সমধর্মী আধুনিক কবিতার। আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে চ্যুতির একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত জীবনানন্দে — ‘ঘাসের উপর দিয়ে বয়ে যায় সবুজ বাতাস/অথবা সবুজ বুঝি ঘাস ? /অথবা নদীর নাম মনে করে নিতে গেলে চারিদিকে প্রতিভাত হয়ে ওঠে নদী’, ইত্যাদি । এখানে কবি স্বেচ্ছায় আলোকচিত্রধর্মিতা থেকে অত্যন্ত বেশি সরিয়ে নিয়ে এসেছেন রচনাকে এবং রচনাও আশ্চর্য হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে ।”
         কবিতাটির বিশ্লেষণে বিনয় মজুমদার বলেছেন, “মূল বিষয়বস্তু যা কবিকে ‘অদ্ভুত আঁধার এক’ কবিতায় উক্ত বা ব্যক্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হতে বাধ্য করেছিল, সেই মূল বিষয়বস্তুটি নেই । অর্থাৎ সাক্ষপ্রমাণহীন অবস্হায় রয়েছে কবিতাটির বক্তব্যবিষয় । এগুলো কবিতাটির এডিটিং-এর অঙ্গ । কিন্তু এই কবিতাটিতে আছে: ১) আবিষ্কার । যে-কোনো নতুন আবিষ্কার চমকপ্রদ এবং মনকে সেহেতু নিজের দিকে আকৃষ্ট করে । ২) উপমার বদলে সাবস্টিটিউশান আছে । প্রকৃতপক্ষে মূলে সাংবাদিকসূলভ কতকগুলি বাক্য কবির লেখার ছিল ; সেই বাক্যগুলির সাবস্টিটিউটরূপে কতকগুলি বাক্য কবি লিখেছেন, মূল বাক্যগুলি একদম না লিখে । মূল বিষয়বাহী বাক্যের সাবস্টিটিউটরূপে কবি অ্যানালজাস বিষয়বাহী বাক্য লিখলেন, এবং তা করতে উপমা, উপমার থেকে প্রতীক তাঁকে সাহায্য করল । ৩) বারংবার পঠনেচ্ছা-উদ্রেকের ব্যবস্হা আছে । অন্যতম প্রকৃত চিন্তনীয় বিষয় এই যে কবিতার অদ্ভূত সংসৃজন, এতে বিবৃত দার্শনিক আবিষ্কার, এর অন্তর্নিহিত এবং অনুল্লেখিত বেদনা, কবিতায় সৃষ্ট বিষণ্ণ পরিবেশ, মন্হর গতি ইত্যাদি সব মিলিয়ে পাঠককে কবি দ্বিতীয়বার পাঠে বাধ্য করতে সমর্থ হয়েছেন । এবং প্রথমে, দ্বিতীয়বার পাঠের পরে তৃতীয়বার পাঠের আগ্রহ আরো বাড়তে থাকে — কারণ পাঠক নিজে তখন পাঠক থেকে কবি হতে থাকেন, চিন্তায় পড়ে, বাধ্য হয়ে । রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত তুচ্ছ ( রবীন্দ্রনাথের তুলনায় ) মনে করতে বাধ্য, আর জীবনানন্দের কবিতা পাঠ করতে করতে পাঠক নিজেকে অত্যন্ত মূল্যবান মনে করতে বাধ্য, যার ফলে পাঠকের পঠনেচ্ছা বাড়তেই থাকে । ৪) সহজে মুখস্হ করে রাখার ব্যবস্হা আছে । বারংবার পড়তে পড়তে যাতে কবিতাটি স্মৃতিস্হ হয়ে যায় সেদিকে কবি দৃষ্টি রেখেছেন । ৫) গভীরতা আছে । অর্থাৎ পাঠকের চিন্তার খোরাক প্রচুর পরিমাণে বিদ্যমান । ৬) সংযম আছে । সংযম কবিদের অত্যন্ত প্রয়োজনীয়, এক দুরূহ তপস্যার মতো । যে-সব ব্যাপার লক্ষ্য করে কবি এই ‘সিদ্ধান্ততে’ পৌঁছেছেন, সেসব ব্যাপার অনুল্লেখিত, অলিখিত । ‘সিদ্ধান্তটিই’ কবিতা । ৭ ) বহুমাত্রিক চরিত্র আছে । বহুমাত্রিক শব্দটি আমি মাল্টিডাইমেনশানাল অর্থে ব্যবহার করছি । মাত্রা বা ডাইমেনশন মানে স্বয়ংসম্পূর্ণ কিন্তু একটিমাত্র বিষয় ধরছি — যেমন প্রেম, জীবনদর্শন, সমাজনীতি, রাজনীতি, বিজ্ঞান ইত্যাদি ।”
         ১৯৬৬ সালে লেখা উপরোক্ত বিশ্লেষণের মূল বিন্দুগুলো এই জন্যই উপস্হাপন করলুম যে বিনয় সেই সময়েই লিখছিলেন ছয় পর্বে দীর্ঘ তাঁর ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’।  ১৯৯৯ সালে মারুফ হোসেনকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বিনয় বলেছিলেন ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা; কবিতাটি তিনি লিখেছেন তাঁর একাকীত্ব নিয়ে। আশা করি আলোচকরা বিনয়ের এই কবিতাটি এবং পরবর্তীকালে রচিত ‘বাল্মীকির কবিতা’ পড়ার সময়ে খেয়াল রাখবেন যে বিনয় তাঁর কবিতার ক্রাফটে কেমন ধরণের বৈশিষ্ট্য বুনে দ্যান । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’র বকুল ফুল তার ছিদ্রপথ এবং ফাঁক আর পাপড়িদের নিয়ে আরো সুস্পষ্টভাবে ফিরে এসেছে ‘বাল্মীকির কবিতা’য় । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ কাব্যটিকে বিনয় মজুমদার বলেছেন সেটি হলো ‘ধর্মগ্রন্হ’ ; এই ধর্ম তাঁর ব্যক্তিগত ধর্ম, কেননা একটা আগেই পড়েছি যে ধর্ম থেকে বিনয় সাত হাত দূরে । অর্ঘ দত্ত বকসী তাঁর  ‘বিনয় মজুমদার ও অঘ্রাণের অনুভূতি — বিশাল দুপুরবেলার যৌনসমীক্ষা’ নিবন্ধে বলেছেন যে “জীবন থেকে, গণিত থেকে, আত্মসমীক্ষা থেকে পাওয়া যাবতীয় দর্শনের মহাবিস্ফোরণ আছে এই কবিতাগ্রন্হে” ।
         বিনয় মজুমদার যখন সীমান্ত পেরিয়ে পুর্ব পাকিস্তানে নিজের গ্রামে গিয়ে কিছুকাল ছিলেন, তখন তাঁর আচরণে গ্রামবাসীরা কোনো অস্বাভাবিকতা পাননি । বিনয় যখন শিমুলপুর গ্রামে পাকাপাকি বসবাস আরম্ভ করলেন তখনও তাঁর আচরণ থেকে অস্বাভাবিকতা বিদায় নিয়েছিল । তার কারণ পূর্ব পাকিস্তানের গ্রামে এবং শিমুলপুরে তিনি ফিরে পেয়েছিলেন তাঁর কৌম-প্রতিস্ব, হয়ে উঠেছিলেন প্রকৃতির সবুজ ভূখণ্ডের অঙ্গাঙ্গী । ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’ বিনয়ের সেই কৌম-প্রতিস্বকে উন্মুক্ত করেছে, কোনো রাখঢাককে তোয়াক্কা করেনি।
         ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বেরিয়ে কলকাতা মহানগরের জটিল ও সর্পিল পথসমষ্টির  বিভ্রান্তিকর রাস্তা, পথ, গলির এবং সেখানকার মানুষদের ভুলভুলাইয়ায় তাঁর কৌম-প্রতিস্ব আবছা হয়ে উঠছিল ক্রমশ । তা থেকে মুক্তি পাবার জন্যই হয়তো তিনি পূর্ব পাকিস্তানে নিজেদের ছেড়ে আসা গ্রামে চলে গিয়েছিলেন । কলকাতা মহানগরে তিনি আক্রান্ত হচ্ছিলেন পারস্পরিক দূরত্বের অসম্বদ্ধতায়, অপসৃতির বোধে । শিমুলপুরে পৌঁছে তিনি স্রষ্টাকে খুঁজে পেলেন, যা একযোগে তাঁর ভেতরে এবং বাইরে বিদ্যমান । ‘অউম’ পত্রিকার জন্য দেয়া সাক্ষাৎকারে ১৪১৩ বঙ্গাব্দে তিনি বললেন, “শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর — এই অনাদি একের থেকে সৃষ্টি হয়েছিল এ বিশ্বের সবকিছু । অত্রি তারা আমাকে বলেছিল, শরীরই অন্তর আর অন্তরই শরীর । আমারও তাই মত । বেঁচে থাকতে হলে এই একটি বাক্যাংশই মনে রাখতে হবে । আর কোনও মন্ত্র নেই ।” ‘ফিরে এসো, চাকা, ‘অঘ্রাণের অনুভূতিমালা’,  ‘বাল্মীকির কবিতা’ ও পরের দিনপঞ্জিমূলক সাব-জনারের কাব্যগ্রন্হগুলোতে আমরা বিনয়ের এই বার্তাটিকেই প্রতিটি পংক্তিতে প্রবহমান দেখি ।

ষোলো
         বিনয় মজুমদার কয়টি নাটক লিখেছিলেন জানি না । ‘ধূসর জীবনানন্দ’ গ্রন্হে একটি নাটক অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, ১৯৯৫ সালে লেখা । নাটকটির নাম ‘আপনারা হাসুন’ । বইটি ২০০৬ সালে প্রকাশিত হয়েছিল, যে বছর উনি মারা যান । তার মানে আর কোনো নাটক সম্ভবত উনি লেখেননি ।
        রচনাটিকে আমি নাটক বলছি কেননা বিনয় মজুমদার একটি মঞ্চ কল্পনা করেছেন । আসল যে ব্যাপারটি তিনি ঘটিয়েছেন তা হল মঞ্চের মাঝখানে নাটকের প্রমটারকে একটি চেয়ারে বসিয়ে রেখেছেন, যার হাতে একটি গ্রন্হ, যখন কিনা প্রমটার উইংসের আড়ালে থাকেন এবং অভিনেতা-অভিনেত্রীরা যাতে সংলাপ ভুলে না যান তাই আড়াল থেকে সংলাপ প্রমট করেন, দর্শকরা তাঁকে কখনও দেখতে পান না । ওই চেয়ারটি ছাড়া মঞ্চে আর কোনো আসবাব নেই । শাড়ি-ব্লাউজ পরা নামহীন তিনজন সুন্দরী নারী আছেন মঞ্চে যাদের কোনো সংলাপ নেই । বিনয় হয়তো বলতে চেয়েছেন, নারীদের প্রমট করার প্রয়োজন হয় না এবং তাঁরা অযথা সংলাপ খরচ না করে ঘটনাবলীর প্রতি নজর রাখেন । প্রমটারও নামহীন ।
         তিনজন পুরুষ আছেন মঞ্চে, এবং তারা প্রমটার যে সংলাপ বলে তার পুনরুক্তি করে । প্রমটার মাঝে-মাঝে সেই চরিত্রগুলোর নাম নিয়ে আদেশ করে, অমুক এবার তুমি বলো, অথবা তমুক এবার তুমি বলো, ইত্যাদি । পুরুষ চরিত্রগুলোর নাম হলো :
         ১ ) পিঙ্গুহুয়া : পাজামা পরা অভিনেতার বাংলা নাম কাহালি ।
         ২ ) টিরিনচাগা : প্যান্ট পরা অভিনেতার বাংলা নাম বুদ্ধ ।
         ৩ ) গেঞ্জি পরা অভিনেতার বাংলা নাম দীপক ।
         চরিত্রগুলোর নামকরণে গণিতের খেলা আছে কিনা তা ডিকোড করা দুরূহ । বিনয় মজুমদার মূলত একজন কবি ও গণিতজ্ঞ, তাই নাটকটির বাস্তবতাকে পাশে সরিয়ে তাকে মেটাফর হিসাবে ব্যাখ্যা করার প্রলোভন হয় । সংলাপগুলোতেও রহস্য বুনেছেন বিনয় কিন্তু তার মাধ্যমে চরিত্রগুলোর মধ্যে সম্পর্ক গড়ে ওঠে না । ফলে মঞ্চটাকে মনে হয় সমাজের একটি সামগ্রিক মানসিক স্হিতি। চরিত্রগুলো মঞ্চের কারাগারে আটক , তারা প্রমটারের সংলাপ আউড়িয়ে জীবনযাপন করতে বাধ্য । তারা নিজের মনের কথা বলার স্বাধীনতা পায়নি । অতএব মঞ্চটি অথবা এই জগতসংসারটিকে একটি আবদ্ধ জায়গায় আটক থাকার গারদ বলে অনুমান করা যায় । কিন্তু প্রমটার লোকটি তার কাজের মাধ্যমে চরিত্রগুলোকে নিয়ে একটি ন্যারেটিভ গড়ে তুলতে অসমর্থ ।
         নাটকটির সংলাপের পুনরুক্তির পর পুনরক্তি  থেকে আঁচ করা যায় যে, বিনয় মজুমদার একটি বাধ্যবাধকতার ও সীমাবদ্ধতার দমবন্ধকর পরিসরকে আগাম অনুমান করতে পেরেছিলেন, যাকে নিয়ন্ত্রণ করছে অন্ধকার ও ক্ষতিকর ক্ষমতাগুলো । সেই নিমিত্তবাদকে গড়ে তুলেছে একটি নিষ্ঠুরতা যার মুখোমুখি হতে মানবসমাজ বাধ্য । এখানে উল্লেখ্য যে বিনয় মজুমদার যখন এই নাটকটি লেখেন তখন বামপন্হী ভাবধারায় প্রভাবিত গ্রুপ থিয়েটারগুলোর রমরমা চলছে । তাছাড়া বিনয়ের নিবন্ধগুলোয় ‘নবান্ন’, ‘ছেঁড়া তার’, ‘উলুখাগড়া’ ইত্যাদি নাটকের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় না । সাক্ষাৎকার গ্রহনকারীরাও তাঁকে নাটক বা গ্রুপ থিয়েটার সম্পর্কে প্রশ্ন করেননি । হয়তো তাঁরা জানতেন না যে বিনয়  ১৯৯৫ সালে একটি নাটকও লিখেছেন ।
         বিনয় তাঁর নাটকটির মাধ্যমে সে-সময়ের নাটক-সংস্কৃতিকে তুলোধনা করেছেন । গ্রুপ থেয়েটার তখন ক্রমশ জীবাশ্ম হয়ে উঠছিল, জীবনের বুনিয়াদি প্রশ্নাবলী থেকে সরে গিয়ে র‌্যালি ও র‌্যালায় মজে যাচ্ছিল, দারিদ্র্যকে গৌরবান্বিত করা আরম্ভ করেছিল, যাকে বলা যায় এক ধরণের বামপন্হী এলিটিজম, নানা জারগণের ধুমধাড়াক্কা । থিয়েটার ক্রমশ হয়ে পড়ছিল লিখিত নাটকের চাকর । বিনয় তাই প্রমটারটিকে নিয়ে এলেন চাকরের ভূমিকায় যে আবার একই সঙ্গে প্রভূত্ব করে । প্রমটার খোলাখুলি দেখিয়ে দিচ্ছে যে যেগুলোকে নাটকের মাস্টারপিস মনে করা হয়, গ্রুপ থিয়েটারের সেই সব ভাষাপ্রবৃত্তির কোনো স্হান আর বাঙালিসমাজে নেই । তারা বর্তমান প্রজন্মের সঙ্গে যোগাযোগ করতে অক্ষম । তারা কেবল ব্যক্তি-বিশেষেরর মামুলি সমস্যাকে মানসিক সমস্যা বলে উপস্হাপন করতে চেয়েছে ।
         মানসিক সমস্যা বলতে যে ঠিক কী বোঝায় তা বিনয় মজুমদারের চেয়ে ভালো আর কেউ জানতেন না বাংলা সাহিত্যের জগতে ।

         ১৯৯৮ সালে বিনয় মজুমদারের চল্লিশটি ন্যারেটিভ’ নিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বিনয় মজুমদারের ছোটগল্প’ । ছোটগল্পের সংজ্ঞা অনুযায়ী এগুলো ছোটোগল্প নয়, কোনো গদ্যেই সেই হুইপক্র্যাক এনডিং এবং ব্যক্তি-এককের সমস্যা নেই । ন্যারেটিভগুলো শিমুলপুরে বিভিন্ন গ্রামবাসীর সঙ্গে বিনয়ের কথোপকথন, বিনয়ের দিনপঞ্জিমূলক কবিতাগুলো গদ্যে রূপান্তরিত । এগুলোকে বলা যায় ‘গল্পহীন গল্প’ । বাংলা ভাষায় গল্পহীন গল্প বিনয়ই সম্ভবত প্রথম লিখেছেন ।
        বড়ো ও ছোটো আইডিয়াগুলোকে বিভিন্ন চরিত্রের মাধ্যমে উপস্হাপন করেছেন বিনয় ; ঠাকুরনগরের মানুষের সামনে তুলে ধরেছেন সেই আইডিয়াগুলোকে । চল্লিশটি গদ্যকে যদি ঘটনা অনুযায়ী জুড়ে একটি দীর্ঘ গদ্য তৈরি করা হয়, তাহলে বিনয়ের সেই সময়ের জীবনযাপন ও গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক নিয়ে একটি ন্যারেটিভ গড়ে উঠবে ; সেগুলোকে বলা যায় গল্প সম্পর্কে গল্প । গদ্যগুলো দিয়ে ন্যারেটিভের নদী তৈরি করেছেন বিনয়, প্রতিটি গদ্য পৃথকভাবে তার শাখানদী । আর প্রতিটি শাখানদী তার সংলাপপ্রবাহে লুকিয়ে রেখেছে একটি বার্তা । গদ্যগুলো জুড়ে একটা দীর্ঘ পাঠবস্তু তৈরি করলেও তা মেটাফিকশান হবে না ।
         গদ্যগুলো গতানুগতিক গল্পের মতন ফরমুলাচালিত নয় । ফরমুলানির্ভর গল্প ক্রমশ একটি সমস্যা উপস্হাপন করে এবং শেষে গিয়ে তার সমাধান ঘটে । বিনয়, যিনি একজন গণিতবিদ, তিনি প্রতিটি গদ্যে ওই ফরমুলাতেই অন্তর্ঘাত ঘটিয়ে দিলেন । ফরমুলা-নির্ভর গল্প রচিত হয় বাজারের কথা ভেবে এবং সেটি একটি মার্কেটেবল প্রডাক্ট — বাস্তব হোক বা কাল্পনিক । চিরাচরিত কাহিনি-প্রণালীকে চ্যালেঞ্জ করলেন প্রণালীহিনতার দ্বারা ।
           প্রথানুগত গল্পের মতন কোনো বাঁধাধরা আরম্ভ ঘটান না, সংলাপ দিয়ে আরম্ভ করেন, এবং পাঠককে তিনি কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন তা পাঠক সেই সংলাপগুলোকে অনুসরন করার পর টের পায় ; বহুক্ষেত্রে তিনি পাঠককে কোথাও নিয়ে গিয়ে মাঝপথে ছেড়ে দেন, যাতে বাকি পথটা পাঠক নিজেই নির্ণয় নিয়ে এগোতে পারে । তাতে কিন্তু ফরমুলা গল্পের নাটক জোড়েন না বিনয় । সংলাপের আঙ্গিকটি অনেক সময়ে এমনভাবে উপস্হাপিত হয় যে বোঝা যায় বিনয় নিজেই বিরুদ্ধ-যুক্তি-প্রদর্শক কিংবা মূল প্রতর্ক থেকে নিজেকে সরিয়ে রেখেছেন, যাতে যাঁর সঙ্গে বিনয় কথা বলছেন তাঁকে ছোটো করা না হয় । সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় যাকে বলতেন ‘না-গল্প’, বিনয়ের ন্যারেটিভগুলো তা নয়, অর্ক দত্ত বকসী যাকে বলছেন ‘প্রগল্প’, তাও নয়, এবং অর্ক চট্টোপাধ্যায় যাকে বলেছেন ‘গল্পনা’ তাও নয় । বিনয়ের গল্পগুলোর উপসংহার এবং ক্যাথারসিস ঘটে কাহিনিটি ফুরিয়ে যাবার পর অন্য কোথাও ।
         ঠাকুরনগরের একজন বা কয়েকজনের সঙ্গে কোনো একটি বিষয়ে আলোচনা আরম্ভ করেন বিনয়, এবং তা বিনয় নামেই করেন । সেই আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে  যুক্তি, শ্লেষ, বিদ্রূপ, ব্যাজস্তুতি, হাস্যরস, বৈজ্ঞানিক-তর্ক, সরল গণিত, ব্যঙ্গ, আমোদ, ঠাট্টা, কৌতুক, গভীর জ্ঞান, প্ররোচনা ইত্যাদির  মাধ্যমে শ্রোতার মনে শেষ পর্যন্ত প্রত্যয় উৎপাদন করেন তিনি। কিছু-কিছু ক্ষেত্রে সমাজের বিরুদ্ধে আক্রমণ আছে, এবং সেগুলো এমনভাবে উপস্হাপন করেছেন তিনি যেন ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক । কোনো-কোনো প্রতর্ক তাঁর কবিতাতেও আছে । প্রায় প্রতিদিন সাধারণ মানুষের সঙ্গে বিতর্কিত বিষয়ের আলোচনা করে বিনয় মজুমদার, যাঁকে গ্রামের মানুষ জানে একজন বিখ্যাত কবি হিসাবে, পারস্পরিক হায়ারারকি ভেঙে ফেলেছেন।
        ‘মনা আজ এসেছিল আমার কাছে…’ গল্পটিতে তিনি মনে নামের ছেলেটিকে বলছেন, “দ্যাখো, আমিই চাঁদ নিয়ে কবিতা লিখেছি, ‘চাঁদের গুহার দিকে নির্নিমেষ চেয়ে থাকি…’, যা তাঁর ‘বাল্মীকির কবিতা”র লাইন, এবং কথা প্রসঙ্গে পাঠককে মনে করিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর কাছে বইটির গুরুত্ব আছে । গল্পটিতে  তিনি গণিতবিদ ও ইঞ্জিয়ার লেওনার্দো দা ভিঞ্চির সঙ্গে নিজের তুলনা করেছেন, লেওনার্দোর মতন তাঁরও অবিবাহিত থাকার প্রসঙ্গে এনেছেন, ‘মোনালিসা’ আঁকার কথা তুলেছেন, বলেছেন যে লেওনার্দোর মতন তিনিও ছবি এঁকেছেন সাহিত্যচর্চা করেছেন, কিন্তু একবারও গায়ত্রী প্রসঙ্গ আসেনি ।
         ‘পরোপকারী’ গল্পে বিনয় হোটেল মালিক মিত্র মশায়কে বোঝাচ্ছেন যে তিনি মুর্গির মাংস, পাঁঠার মাংস খাওয়াচ্ছেন খদ্দেরদের । মানুষেরা পাঁঠা পোষে, খাইয়ে দাইয়ে মোটা করে, তারপর তাকে কেটে খায় । কারণ মানুষ পাঁঠার চেয়ে অনেক উঁচুস্তরের জীব । তিনি প্রস্তাব দেন যে মিত্র মশায় সেই তর্কে যদি মানুষের মাংস কেটে খদ্দেরদের খাওয়ান তাহলে একজন মানুষের মাংস খেয়ে আরেকজন মানুষ দেবতার পর্যায়ে উন্নীত হবে । মিত্র মশায় বলেন বুঝেছি । বিনয় জানান যে কলকাতায় তিনি নিজের চোখে দেখেছেন যে মানুষের মাংস খাচ্ছে মানুষ, একবার নয়, অনেকবার ।
         ‘শ্রেষ্ঠ গল্প’ নামের পাঠবস্তুটিতে খাদ্যবস্তু থেকে মানুষের দেহে মাংস তৈরি হবার কথা আরেকবার এসেছে । মিষ্টি বিক্রেতা মুকুন্দ বণিকের সঙ্গে বিনয়ের কথাবার্তা হয় । মুকুন্দ বণিক প্রতিদিন মানুষকে মিষ্টি বিক্রি করে তাদের দেহে মাংস তৈরি করে দিচ্ছেন । তেমনই চাষিরাও মানুষের দেহে মাংস তৈরি করে । বিনয়ও বছরে আড়াই হাজার ডাব বেচে অন্তত আড়াইটে ডাবের সমান রক্ত তৈরি করে দেন মানুষের শরীরে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কিছুই করেন না, কেবল মুখে-মুখে গল্প মেরে বেড়ান । মুকুন্দ বণিককে বিনয় জানান যে সেই জন্যই তিনি মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ে অনেক উপরে । মুকুন্দ বণিক তর্কে বিশ্বাস করেন এবং বলেন যে যত মন্ত্রী আছে, বিধানসভায় সদস্য আছে, রাজ্যপাল তাঁরা মুকুন্দ বণিকের নীচেই । এই একই বিষয় ফিরে এসেছে ‘আমার চাষিভাইরা’ গদ্যে, যখন বিনয় দ্যাখেন যে রেলস্টেশনে মাইক বসিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে স্হানীয় নেতা গোবিন্দ দেব । বিনয় মজুমদার সেখান দিয়ে যাচ্ছিলেন দেখে তাঁকেও বক্তৃতা দিতে বলা হয়, চাষিদের ধানের দাম, পাটের দাম বাড়ানোর জন্য । বিনয় একটি দীর্ঘ বক্তৃতা দেন এবং জানান যে চাষিদের ফসল খেয়েই মানুষের দেহে বছর-বছর রক্তমাংস হয়, চাষিরা ভালো-লোক খারাপ-লোকের পার্থক্য করেন না, তাঁদের ফসল সকলেই খায়, সেকারণে ধানের আর পাটের দাম বাড়ানো জরুরি ।
         শেষ গদ্যটিতে যুগপৎ অনেককে ঠোনা মরেছেন বিনয় মজুমদার । গদ্যটির শিরোনাম ‘সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ’ । গদ্যটিতে বিনয় একজন সৃষ্টিকর্তা এবং তাঁর নির্দেশেই নানা ঘটনা ঘটে ।  ভারতের লোকে স্বাধীনতা চাইছে এবং ষষ্ঠ জর্জ পরামর্শ চাইছেন মেরির কাছে । উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, মতিলাল নেহরু, করমচন্দ গান্ধিকে এক এক করে পেশ করা হলো সম্রাটের সামনে। তাঁরা তিনজনেই জানালেন এ হলো বিনয়দার লীলাখেলা, স্বাধীনতা দিতে হবেই । মনস্ত্বত্ববিদরা সম্রাটকে জানালো যে এই ভারতীয়দের পরীক্ষা করে জানা গেছে যে তারা মনোরোগী । সম্রাটের অমাত্য নিলসন জানতে চাইল, এদের চিকিৎসা কোথায় করা হবে, লণ্ডনে না অন্যত্র ? সম্রাট আদেশ দিলেন, এই তিন যুবকের মনোরোগের চিকিৎসা করা হোক ভারতে — কলকাতায় মেডিকাল কলেজের এজরা ওয়ার্ডে ।
         বিনয় মজুমদারের ‘ছোটোগল্প’ নামের এই পাঠবস্তুগুলোকে বিদ্যায়তনিক ডিসকোর্সের বাইরে ঠেলে দেয়া হয়েছে অথচ মর্মার্থ ও সংলাপের এরকম বুননশৈলী আর কারো গদ্যে দেখা যায় না । সাধারণ মানুষ ও তাদের সংলাপ ব্যবহার করে বিনয় নির্মাণ করেছেন একটি দার্শনিক ভঙ্গী অথবা অভিগমন । গ্রামে জীবনযাপনের দরুন তিনি জানেন যে মানুষের জীবনে ভাষা একটি প্রাথমিক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, তা একজনের সঙ্গে আরেকজনের সহজ যোগাযোগের মাধ্যম, তা বাস্তবতাকে পালটে দিতে পারে, অভিজ্ঞতাকে আদল দিতে পারে । সংলাপ তখনই নিজস্ব হয়ে ওঠে যখন বক্তার মস্তিষ্কে সেই সংলাপের উদ্দেশ্য গাঁধা হয়ে যায় । সাধারণ মানুষগুলোর সঙ্গে কথা বলার সময়ে বিনয় খেয়াল রেখেছেন যে গাম্ভীর্যের ভেতরে লুকোনো হাসাহাসি বুদ্ধির খেলাকে পরস্পরের মধ্যে জীবন্ত করে তোলে ।
[ রচনাকাল জানুয়ারি – মার্চ ২০১৭ ]