মঙ্গলবার

যখন হাংরি আন্দোলনে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় পেণ্ডুলাম ছিলেন



প্রথমে পড়ুন দেবশিস মজুমদারকে দেয়া সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই সাক্ষাৎকার-চুটকি, তারপর আরও কিছু সন্দীপনীয় মাল-মশলার সঙ্গে পরিচয় করাবো ।

‘কৃত্তিবাস’-এর সূত্রেই শক্তির সঙ্গে আলাপ এবং শক্তির সূত্র ধরেই ‘হাংরি জেনারেশনে’র সঙ্গে যোগাযোগ। হাংরির প্রতি এই আকর্ষণের কারণটা কী ছিল?
প্রথম কথা, আমি হাংরি জেনারেশনের লেখক নই। যদিও বুলেটিনে হয়তো একবার ২/৪ লাইন লিখেছি কিনা মনে নেই। তাতে হাংরি বলে কিছু ছিল না। যেমন, হাংরি জেনারেশন বলে যদি কোনো আন্দোলন হয়ে থাকে তাতে যোগদান করার কোনো ব্যাপার ছিল না। তবে মলয়রা যাদের ‘হাংরি’ লেখক বলে মনে করেছিল তাদের মধ্যে অবশ্যই আমি একজন। জীবনানন্দ দাশও একজন। সমীর আর শক্তির প্রতি আমার বন্ধুত্ব ছিল। সেই সূত্রেই যেটুকু। কিন্তু সব খবর রাখতামও না। একবার একটা আড্ডায় আমি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তাহলে কিছু মুখোশ কিনে বিভিন্ন লোককে পাঠানো যাক। ওপর থেকে নিচে সমস্ত স্তরের লোককেই। সে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায়ই হোক আর সাগরময় ঘোষই হোক। ঠিক হল মুখোশে লেখা থাকবে – ‘মুখোশ খুলে ফেলুন।‘ দ্যাট ওয়াজ মাই আইডিয়া। আর আমার আইডিয়া বলে সমীর রায়চৌধুরীর সঙ্গে গিয়ে মুখোশগুলো কিনতে হল। এই রকম সব ঘটনা আর কি। তারপর ওরা যখন অ্যারেস্ট হল তখন আমি বিয়ে করেছি, ৬৪ সালের কথা। সত্যিকথা বলতে কি রীণারা খুবই অভিজাত পরিবারের মেয়ে। এই যেমন ধরো ওর দাদা পাঁচটা আংটি পরে। যারা উত্তর কলকাতায় থাকে। চামড়া রক্তাভ। তা যাইহোক, বিয়ে করে দমদমে ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে উঠেছি, এমন সময় একদিন লালবাজার থেকে ডেকে পাঠালেন। আমার কিন্তু সাহস বলতে যা বোঝায়, তা হল ভীরুর সাহস। আমাদের দলে সাহসী বললে বলতে হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কথা। এবং বারবার যে ওর দিকে আকর্ষিত হই তা ওই সাহসের কাছে। আর বাকি সব ভীতুর দল। তখন তো সুনীল এখানে নেই – আইওয়াতে। এদিকে এখানে এরা সব আন্দোলন করেই খালাস। লিখতে যে হবে সে ধান্দা তো নেই। লেখক বলতে যা তা ওই আমি, শক্তি আর উৎপল। আর একজনের কথা বলতে হয়, তাকে হাংরি জেনারেশনই বল আর যাই বল, সে হচ্ছে বাসুদেব দাশগুপ্ত।

সত্যিই, আজও ‘রন্ধনশালা’র গল্পগুলো পড়লে অভিভূত হই।
ওই রকম বই ওই সময় ওই একটাই। তা, বাসুদেব তো লিখলো না। আসলে লেখাটাই হচ্ছে প্রকৃত বিপ্লব করা আর সেটাই করে যেতে হয়। যাই হোক, হাংরি জেনারেশনের একটা সংখ্যা বেরিয়ে গেল পাটনা থেকে যাতে খুবই অশ্লীল লেখাটেখা ছিল। সেই পত্রিকার প্রিন্টার অ্যাণ্ড পাবলিশার হিসাবে ছিল আমার নাম।

আপনি জানতেন না?
উইদাউট মাই নলেজ – টোটালি। সেইজন্য লালবাজারে গিয়ে আমি বলেছিলাম যে, এই সংখ্যাটা আমি ছাপিনি বা প্রকাশ করিনি। কিন্তু সাক্ষী দেওয়ার সময় মলয়কে সম্পূর্ণভাবে ডিফেণ্ড করি। বলি, সাহিত্যের ক্ষেত্রে এইরকম এক্সপেরিমেন্ট হয়েই থাকে। আজ যা অশ্লীল, পরে তাই শ্রেষ্ঠ সাহিত্য হয়ে দাঁড়ায়। পরে কোনো একটা লেখায় বোধ হয় এই বিষয়টা স্বীকার করেছে সমীর রায়চৌধুরী। তবে সমীর শক্তির বিষয়ে যেটা বলেছে সে ব্যাপারে আমি কিছু বলব না। যদি সত্যি সত্যি ঘটনাটা ঘটে থাকে তবে তা দুঃখজনক। শক্তি যদি বলে থাকে বিষয়টা সত্যিই অশ্লীল তা হলে যা দাঁড়াচ্ছে সেটা খুব খারাপ।

পড়লেন তো ? কোনো বুলেটিনেই ওনার নাম পাবলিশার হিসেবে ছিল না, তা সে পাটনা থেকে হোক বা মঙ্গল গ্রহ থেকে । এবার পড়ুন হারাধন ধাড়া অর্থাৎ দেবী রায়কে লেখে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠিখানা :

প্রিয় দেবী,
পর-পর দুসপ্তাহ এলেন না, কোনো চিঠিপত্রও নেই, দোষ একটিমাত্র করেছি । এতোদিনের বন্ধুত্বে একটি, আপনাকে লেখা দিইনি । এজন্যে যদি কিছু মনে করে থাকেন, আমার কিছু করার নেই । উৎপল আপনার ওখানে গিয়েছিল ? প্রিয় উৎপল অনেকদিন দেখা হয়নি । রয়েড স্ট্রিটে উঠে গেছেন ? আমি সুনীলের একটা চিঠি পেয়েছি । আমি খুব ভালো নেই । একদিন যদি চলে আসেন ভাল হয় --- আপনি তো শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না । আপনি চলে এলেই পারেন । বীটদের একটা পত্রিকা Now ডাকে পেয়েছি । প্রেরক C.Plymell একজন কবি । 1537 N. TO Peka/Wichita/Kansas/USA. একটা উত্তর দিন । ভাই শক্তি, 'দেশে' কলাম ছাপানো ব্যাপারে তৈরি plan কী successful হল, অন্যান্য planগুলো, শংকর, বরেন, সুভাষ মুখো থেকে শুরু করে নরেশ গুহ স্টিল সুনীল, বুদ্ধদেব, নীরেনবাবু ইত্যাদি মিলিয়ে, ও বিধু, রবীন দত্ত, সামসের সমেত ও অধুনা সংকর কী যেন ( ছাড়পত্র সম্পাদক ) প্লাস শরৎ, ভাস্কর, প্রণব প্রভৃতি নিয়ে যে বিরাট জাল ফেলেছিস, সেটা এবার তোল । আমরা আর কতো সময় দাঁড়িয়ে থাকব ? তারপরেও অপেক্ষা করতে হবে । আমেরিকাগামী প্লেনে দমদমে see off  করতে পারলে তবে আমাদের ছুটি । প্রিয় সুনীল, আপনার চিঠি পেয়েছি । আমার bedroom-এ উঁকি মারছেন কেন ? আমার সমূহ বিপদ --- এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্বারা বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না এখন আমার কী করা উচিত, এখন এই প্রথম আমাকে অপরের উপদেশমতো চলতে হবে । প্রিয় দীপেন, তোমার কী হল ? কোথায় থাক ? তুমি যেন আমার সব অপরাধের শাস্তি আমি ভোগ করছি । প্রিয় উৎপল, আপনি ছাড়া কারো সম্পর্কে এখন বন্ধুত্বের বোধ নেই । সুনীলের জন্য আছে, কিন্তু তা বোধহয় সে আমেরিকায় আছে বলে ।
         শ্যামবাজার থেকে টু-বি ধরেছি, দোতলা, মাঝে-মাঝে বাসস্টপগুলির সুযোগ নিয়ে লিখছি । একদিন আসুন ।
                                                                                                                              আপনাদের সন্দীপন ।

এই চিঠিটা সন্দীপন হাংরি বুলেটিন বা হাংরি আন্দোলনের পত্রিকায় প্রকাশ করতে দিয়েছিলেন । চিঠিটা পড়ে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় চটে-মটে সন্দীপনকে এই চিঠি দিয়েছিলেন, আয়ওয়া, আমেরিকা থেকে :

15 June 1964
313 South Capital
Iowa City, Iowa, USA
         সন্দীপন, নদীর পাড়ে গাছের ছায়ায় বসেছি, প্রচণ্ড হাওয়া, সঙ্গে ৫ ডজন বিয়ার ক্যান, পাশে সাঁতারের পোশাক পরা একটা ধলা মেয়ে, মাঝে মাঝে তার পাছায় টোকা মারছি পায়ের আঙুল দিয়ে, এ দৃশ্য কেমন ? অবিকল এই দৃশ্যের মাঝে আমি শুয়ে আছি । চিঠি লিখছি। কিন্তু আমি এ দৃশ্যের মধ্যে নেই । হাতের তালু গোল করে খুব ছোটো করে, চোখের কাছে আনছি -- সব কিছু দূরে চলে যাচ্ছে । মেয়ের মুখও । খিদে নেই । তেষ্টা নেই । তবু বিয়ার খাচ্ছি । কারণ, এখানে বসে খাওয়া বেআইনি বলে, ঘরের মধ্যে খুব গরম, থাকতে পারিনি। ঘাসের ওপর গড়িয়ে এলাম। একটা দূরন্ত খরগোশকে ধরার জন্য পাঁচবার ছুটে গিয়েছিলাম ।
         কী ভালো লেগেছিল আপনার চিঠি পেয়ে । বিশেষত লাল পেনসিলের অক্ষর । যেন দুটো চিঠি পেলুম । গল্পটা আপনার ভালো লাগবে না জানতুম । গদ্য লিখে আপনাকে খুশি করতে পারব এমন দুরাশা আমার নেই । সত্যি নেই । কারণ, আপনি গ্রেট গদ্য লিখেছেন একসময়, এখন আর তেমন না । কিন্তু যা লিখেছেন, তার ধারে কাছে আর কেউ পোঁছতে পারেনি । আমি ওরকম গদ্য লিখতে পারি না । লিখবো না । কিন্তু ওই গদ্যই আমার প্রিয় পাঠ্য । আপনি পড়বেন, এই ভয়ে আমি সহজে গদ্য লিখতে চাই না । তবু কখনও লিখি, হয়তো টাকার জন্য, টাকার জন্য ছাড়া কখনও গদ্য লিখেছি বলে মনে পড়ে না । লিখেছিলুম একটা উপন্যাস, সেতা ছাপার সম্ভাবনা নেই । আমার কবিতার জন্য আপনাকে ভয় করি না, কবিতা লেখার ক্ষমতার ওপর আমার বেশি আস্হা নেই, আপনি যেরকম কবিতা ভালোবাসেন, অথবা যাই হোক --- আমি সেরকম কখনও লিখব না । আমি কবিতা লিখি গদ্যের মতো, ওরকমই লিখে যাবো । ও সম্বন্ধে আমার কোনো দ্বিধা নেই । শক্তি অসাধারণ সুন্দর বহু লাইন লিখেছে । আমার চেয়ে অনেক বড়, আমি ওকে শ্রদ্ধা করি । কিন্তু শক্তির কবিতা মুণ্ডহীন, আমি ওরকম লিখতে পারব না, চাই না, কারণ আমি ওরকম ভাবে বেঁচে নেই । বরং উৎপলের কবিতা আমাকে অনেক বেশি আকর্ষণ করছে । কিন্তু এখানে এই শুয়ে থাকা, গাছের ছায়া মুখে পড়ছে --- তখন মনে হয় কোথাও কিছু নেই, না কবিতা, না হৃদয় ।
         প্রিয় সন্দীপন, দু-দিন পর আজ সকালে আবার আপনার চিঠি পেলুম । কি সব লিখেছেন কিছুই বুঝতে পারলুম না । কেউ আমাকে কিছু লেখেনি । শরৎ ও তারাপদ কফিহাউসে কি সব গণ্ডোগোলের কথা ভাসা-ভাসা লিখেছে । সবাই ভেবেছে অন্য কেউ বুঝি আমাকে বিস্তৃত করে লিখেছে । কিন্তু আপনার চিঠি অত্যন্ত অস্বস্তিজনক । তিনবার পড়লুম, অস্বস্তি লাগছে । বিছানা থেকে উঠে কলের কাছে গেলুম, ফিরে এলুম টেবিলে, আবার রান্নাঘরে, ভালো লাগছে না, কেন আমাকে এরকম চিঠ লিখলেন । আমি তো শুয়েছিলুম । আমি তো বিছানায় রোদ ও আলস্য নিয়ে খেলা করছিলুম । কেন আমাকে এমনভাবে তুললেন !
         সন্দীপন, আপনি অনেকদিন কিছু লেখেননি, প্রায় বছরতিনেক । তার বদলে আপনি কুচোকাচা গদ্য ছাপিয়ে চলেছেন এখানে সেখানে । সেই স্বভাবই আপনাকে টেনে নিয়ে যায় হাংরির হাঙ্গামায় । আমি বারণ করেছিলুম । আপনি কখনও আমাকে বিশ্বাস করেননি । ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলেন । আমি শক্তিকে কখনও বারন করিনি, কারণ আর যত গুণই থাক --- শক্তি লোভী । শেষ পর্যন্ত উৎপলও ওই কারণে যায় । কিন্তু আমি জানতুম আপনি লোভী নন । আপনার সঙ্গে বহুদিন এক বিছানায় শুয়েছি, পাশাপাশি রোদ্দুরে হাঁটার সময় একই ছায়ায় দাঁড়িয়েছি । সেই জন্য আমি জানতুম । আমি আমার লোভের কথা জানতুম । সেই জন্যই বুঝেছিলুম আপনার লোভ আমার চেয়ে বেশি নয় । আমার ওতে কখনও লোভ হয়নি, হয়েছিল অস্বস্তি থেকে ঘৃণা । ইংরেজিতে রচনা ছাপিয়ে ইওরোপ আমেরিকার দৃষ্টি আকর্ষণ করা আমার বিষম বদ রুচি মনে হয়েছিল আগেই, এখানে এসে আরও বদ্ধমূল হয়েছি । হাংরির গ্যাঁড়াকলের প্রতি আরও ক্রুদ্ধ হয়েছি । অপরের কৌতূহল এবং করুণার পাত্র হতে আপনার ইচ্ছে করে ? হাংরি এখানে  যে দু'একজন পেয়েছে, তাদের কাছে তাই । আমি এতদিন দেশে রইলুম --- অনেক সুযোগ এবং আহ্বান পেয়েছিলুম, কোথাও তবু একটি লাইনও ইংরেজি পদ্য ছাপাইনি । ছাপালে কিছু টাকা পেতুম, তবু না । কারণ সবাইকে বলেছি, আমি বাংলা ভাষার কবি, আমি শুধু বাংলাতেই লিখি, যে ভাষাব কথা বলে ৭ কোটি লোক --- ফরাসি ও ইতালির চেয়ে বেশি । এবং ফরাসি ও ইতালির চেয়ে কম উন্নত ভাষা নয় । আমার কাজ কবিতালেখা, নিজের কবিতা অনুবাদ করা নব, ও কাজ অন্যের । তোমাদের দরকার হলে বাংলা শিখে অনুবাদ করে নাও । এই ধরনের সূক্ষ্ম পিঠ চাপড়ানির ভাব লক্ষ্য করেই আমি বাংলা কবিতার ইংরেজি অনুবাদ গ্রন্হের কাজ, যেজন্য আমি এখানে এসেছিলুম, এক লাইনও করিনি ।
         হাংরির এই ইংরেজি মতলোব ছাড়া, বাংলা দিকটা আরও খারাপ । ওর কোনো ক্রিয়েটিভ দিক নেই । শর্টকাটে খ্যাতি বা অখ্যাতি পাবার চেষ্টা --- অপরকে গালাগাল বা খোঁচা দিয়ে । আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন ---   কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে, আপনি নিশ্চই মনে-মনে বিশ্বাস করেন না । আমি চলে আসার পরও আপনি হাংরির পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন --- হিন্দি কাগজের জন্য আপনি কি একটা লিখেছিলেন --- তাতেও হাংরির জয়গান । ভাবতে খুব অবাক লাগে --- আপনার মতো অ্যাব্সট্র্যাক্ট লেখক কী করে ইলাসট্রেটেড উইকলিতে ছবি ছাপাটাও উল্লেখের মনে করে । এগুলোই হাংরির গোঁজামিল । এই জন্যেই এর সঙ্গে আপনার সম্পর্ক থাকাতে বারবার দুঃখ পেয়েছি, দুঃখ থেকে রাগ, রাগ থেকে বিতৃষ্ণা । একটা জিনিশ নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, আমি কখনও প্রত্যক্ষভাবে প্রকাশ্যে বিরোধিতা করিনি, ভেঙে দেওয়ার চেষ্টা করিনি । পারতুম । করিনি, তার কারণ, ওটা আপনাদের শখের ব্যাপার, এই ভেবে, এবং আপনারা আপনারা ওটাকে দাঁড়  করাবার চেষ্টা করছিলেন কৃত্তিবাস বা সুনীলের প্রতিপক্ষ হিসেবে । সে হিসেবে ওটাকে ভেঙে দেওয়া আংমার পক্ষে নীচতা হতো খুবই । বিশ্বাস করুব, আমার কোনো ক্ষতির কথা ভেবে নয়, আপনার অপকারের কথা ভেবেই আমি আপনার ওতে থাকার বিরোধী ছিলুম । এটা হয়তো খুব সেন্টিমেন্টাল শোনালো, যেন কোনো ট্রিক, কিন্তু ও-ই ছিল আমার সত্যিকারের অভিপ্রায় ।
         এবারে নতুন করে কী ঘটলো বুঝতে পারলুম না । যে ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন, সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম । এবং এটা খুবই গোলমেলে --- যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে এক সঙ্গে লিখেচেন, যেটা চারজনকে একসঙ্গে পাঠানো যায় না, সেতা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কী জন্য, বুঝতে পারলুম না । কিংবা আমার বোঝারই বা কী দরকার ? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্যি দিয়েছে এই আষাড় মাসের সন্ধ্যাবেলা ? আমি কলকাতায় ফিরে শান্তভাবে ঘুমোবো, আলতো পায়ে গুরবো --- আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই । মলয় আমার চিঠি কেন ছাপিয়েছে ? আমার গোপন কিছু নেই--- বিষ্ণু দেকে আমি অশিক্ষিত বলেছি আগেও, কৃত্তিবাসের পাতায় ব্যক্তিগত রাগে, কারণ উনি ওঁর সংকলনে আমার কবিতা আদ্দেক কেটে বাদ দিয়েছেন বলে । কিন্তু মলয়ের সেটা ছাপানোর কি মতলব ? যে প্রসঙ্গে লিখেচিলুম সেটা ছাপিয়েছে তো ? আমি ওকে লিখেছি সম্প্রতি, 'সামনে-পেছনে বাদ দিয়ে , ডট ডট মেরে চালাকির জন্য আমার চিঠি যদি ছ আপাও, তাহলে এবার ফিরে গিয়ে কান ধরে দুই থাপ্পড় মারব।' আপনার চিঠি সম্বন্ধেও তাই । আপনার চিঠি ওরা ছাপিয়েছে, সেটাই খারাপ --- যা লিখেছেন তা নয় । বেশ করেছেন লিখেছেন --- আমি না পড়েই বলছি । ওটা আপনার শক্তির আর আমার ঘরোয়া ব্যাপার --- আর কার কি তাতে ? আপনার যা খুশি বলার অধিকার আছে ।
         কিন্তু ওসব থাক সন্দীপন । আপনাকে কেউ মারবে না । কার অমন স্পর্ধা আছে ? যদি আপনি জায়গা দেন, আমি সব সময় আপনার পাশে আছি ।  অনেকে আছে । আপনার সঙ্গে কত ঝগড়াঝাঁটি হয়েছে --- কিন্তু এই দীর্ঘদিন নিরালায় ভেবে দেখলুম, আপনাকে বাদ দিয়ে আমাদের চলে না । এক হিসেবে আপনি আমার অপরাংশ, আপনার চরিত্রের  অসংলগ্নতা, ভুল এবং জোচ্চুরি -- সব কিছু আমার প্রিয় । যেন আমার না পাওয়া জীবন । লেখক হিসেবে, 'প্রতিভাবান' এই শব্দটা যদি ব্যবহার করতে হয় --- তবে আমাদের পুরো জেনারেশনে তন্ময় দত্ত ছাড়া --- শুধু আপনার সম্বন্ধেই আমি ওকথা ভাবি । আপনার ঐ সুখের সূক্ষ্ঞ শরীর কেউ ছোঁবে না --- কলকাতা শহরে এমন কেউ নেই । না নেই । আপনি নরম ভাবে শুয়ে থাকুন রীনার পাশে, আপনি ওঁকে মঙ্গল গ্রহের গল্প বলুন ।
         আমি কলকাতায় পৌঁছোবো --- ১৮ আগস্ট । নানা কারণে এখানে এক মাস দেরি হয়ে গেল । দেরি হয়ে গেল আমারই বোকামিতে খানিকটা । জুনের মাঝামাঝি বা আস্টের প্রথমে প্যারিসে একটা থাকার জায়গা পাওয়ার সম্ভাবনা আছে কয়েকদিনের জন্য । আমি জুন মাসটা নষ্ট করেছি --- সুতরাং আগস্ট পর্যন্ত অপেক্ষা না করে উপায় নেই । এই ঠিকানায় আছি জুলাই-এর বারো তারিখ পর্যন্ত অন্ততঃ, তারপর নিউইয়র্ক ও ইংল্যান্ড । এখানে থেকে এম. এ. পড়তে পারি আমি --- আপনার মনে এরকম ধারনা এল কি করে ? আমি কি সম্পূর্ণ কাণ্ডজ্ঞানহীন হয়েছি ? কৃত্তিবাসে আপনার লেখা নিয়ে প্রচুর গণ্ডোগোল করেছি --- তবু, এবার কৃত্তিবাসে আপনার লেখা না দেখে মন খারাপ লাগলো । এখান থেকে কোনো জিনিস নিয়ে যাওয়ার হুকুম আছে আপনার কাছ থেকে ?
         ভালোবাসা ।
                                                                                                                        সুনীল

এবার পড়ুন দেবী রায়কে লেখা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের চিঠি । চিঠিতে উনি প্রস্তাব দিচ্ছেন যে হাংরি আন্দোলনের একটা সিমবল তৈরি করা হোক আর বুলেটিনগুলোর পাঁচ পয়সা দাম রাখা হোক।        

        মির্জাপুর, ৫ অক্টোবর ১৯৬৩
        প্রিয় হারাধনবাবু
        হাংগরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম । প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট — এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব । প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন ।       ছাপালে সবকটি একসঙ্গে ছাপাতে হবে — নইলে খাপছাড়া লাগবে । ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে, দরকার পড়লে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন ।
        ‘অমৃত’তে আমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল, দেখেছেন ? নইলে পাবলিশারের কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যস্হা করেন তো খুশী হই । ওই বিজ্ঞাপনটাই দেশে বেরোবার কথা আছে — যদি বেরোয় তার প্রুফটা কাইন্ডলি দেখে দেবেন । আনন্দবাজারে লেখকদের লেখকদের কোনো বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি ? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
        সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব । আরো একমাস থাকবো বা ততোধিক । সহজে যাব না । শরীর ভালো । ছোটোগল্পে আবার লেখা দিতে পারলাম না, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন ।
        আগামি সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাবো । তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর, — এই ঠিকানায় দেবেন । ‘আক্রমন’ বানান কী ? ‘ন’ না ‘ণ’ ?
        লেখাটা প্রকাশ হবার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে । অনেক বাদ দিয়ে, খুব নরম করে, সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই ।
        হাংগরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, তার কী হল ? ৫ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন।           
কমাগুলো ভেবেচিন্তে দিয়েছি, ওইগুলোই আসল জিনিস যেন থাকে ।
    শেষের তারিখটা যেখানে আছে, ওখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন ।
    ‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো ?
    সুনীলবাবুকে ( হাজরা ) প্রীতি জানাচ্ছি ।
    ইতি
    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

বুঝতে পারছেন তো যে পেণ্ডুলাম দোল খেতে শুরু করেছে । ১৯৬৪ সালে হাংরি মামলা আরম্ভ হতে লালবাজার থেকে যখন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের ডাক পড়ল, তখন উনি আমার বিরুদ্ধে পুলিসের সাক্ষী হতে রাজি হয়ে গেলেন আর ১৫ই মার্চ ১৯৬৫ তারিখে এই জবানবন্দি দিলেন, মানে পেণ্ডুলাম দোল খেয়ে গ্যালিলেওকে পর্যন্ত ঘাবড়ে দিয়ে থাকবে:
       I am graduate of Calcutta University and employed as an Assistant Inspector, Calcutta Corporation. I am also a writer and used to visit the College Street Coffee House where young writers of Calcutta generally assembled in the evening. Samir Roychoudhury is a personal friend of mine. I came to know the sponsors of Hungry Generation, namely Shakti Chatterjee, Malay Roychoudhury and others. Although I am not directly connected with the Hungry Generation but I was interested in the literary movement. Some of the manifesto of the Hungry Generation contain advertisement of my literary works. In one of the publication my name was cited as the publisher. This was done with a motive to exploit my reputation as a writer but since my prior consent was not taken I took exception. The present publication in question also came to my notice. As a poet myself I do not approve either the theme or the language of the poem of Malay Roychoudhury captioned        I have severed all connections with Hungry Generation. I had correspondence with Malay Roychoudhury who often sought my advise in literary matters.
                                                                             Sandipan Chattopadhyay
                                                                                 15 March 1965
আমি যখন হাইকোর্টে কেস জিতে গেলুম, তখন পেণ্ডুলাম মাঝখানে এসে ঝুলে থাকার কথা বলল, ৩০ জুলাই ১৯৬৭ তারিখের এই পোস্টকার্ডখানায় :
প্রিয় মলয়,
হাইকোর্টের রায় পড়ে তোমাকে মনে-মনে তৎক্ষণাৎ কনগ্র্যাচুলেট করেছি । একটা মামলা হওয়া দরকার ছিল, কাউকে না কাউকে এরকম মামলার আসামী হতেই হত । সীমাবদ্ধ হওয়া সত্বেও এর ফলাফল আধুনিক সত্য সাহিত্যের পক্ষে যথেষ্ট ভালো হবে, মনে হয় ।
কৃতিত্ব সবটাই তোমার একার, তবু লেখক নামের যোগ্য সকলেই একে পুরস্কার বলে মনে করবে ও ভাগ করে নিতে চাইবে । ব্যক্তিগতভাবে আমি পুরস্কৃত হওয়ার আনন্দ পেয়েছি ।
                                                                                      প্রীতিসহ
                                                                                   সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়

আবার ১৯৮৬ সালে সুমিতাভ ঘোষালের ‘গদ্যপদ্য সংবাদ’ পত্রিকায় পেণ্ডুলাম আরেক দিকে যেতে চাইলো।

“সে সময়ে আমাদের কেউই পাত্তা দিত না । তা যারা হাংরি আন্দোলন শুরু করে, সেই মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরী আমাকে জানান যে আমার লেখা ওদের ভালো লেগেছে, ওরা যে ধরণের লেখা ছাপাতে চায় তা নাকি আমার লেখায় ওরা দেখতে পেয়েছে, তাই আমার লেখা ওরা ছাপাতে চায় । ওদের কাছে পাত্তা পেয়ে আমি খুবই আহ্লাদিত হয়েছিলুম ।
হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার আমি অনেক পরে দেখেছি । সেসময়ে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটা গল্প আমাকে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল । বলতে গেলে সেই গল্পটার জন্যই আমি হাংরি আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলুম । গল্পটার নাম আমার ঠিক মনে নেই । গল্পটা ছিল অনেকটা এইরকম -- একটা ছেলে, তার ভীষণ খিদে । একদিন ছাত্রীকে পড়াতে পড়াতে ছাত্রীর আঁচলের খুঁটটা খেতে শুরু করে । এইভাবে সে একটু একটু করে পুরো শাড়িটা খেয়ে ফ্যালে । এ ব্যাপারটায় সে বেশ মজা পেয়ে যায় । এর পর থেকে সে অনেক কিছুই খেতে শুরু করে । যেমন জানালা, চেয়ার, ছাপাখানা, নোটবুক ইত্যাদি । একদিন এক হোটেলের সান্ত্রীকে সে খেয়ে ফ্যালে । এই ছেলেটিই একদিন গঙ্গার ধারে তার প্রেমিকাকে নিয়ে বসেছিল । হঠাৎ তার সেই খিদেটা চাগাড় দিয়ে ওঠে । তখন সেই ছেলেটি গঙ্গার পাড়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটা জাহাজকে খেতে চায় । কিন্তু সেই ছেলেটি জাহাজটাকে খেতে পারে না । জাহাজটা ছেড়ে দেয় । তখন সেই ছেলেটি একটা চিরকুট গঙ্গায় ভাসিয়ে দ্যায় । সেটা ঠিক কার উদ্দেশে ভাসিয়েছিল তা জানা যায় না । ছেলেটির প্রেমিকার উদ্দেশ্যেও হতে পারে । পৃথিবীর উদ্দেশ্যেও হতে পারে । বা অন্য কিছুও হতে পারে । এখানেই গল্পটা শেষ । এই গল্পটা আমাকে সেসময়ে ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিল এবং আমার মনে হয়েছে ক্ষুৎকাতর আন্দোলনের এটাই মূল কথা ।
আমি হারি আন্দোলনের সঙ্গে ভীষণভাবেই জড়িত ছিলাম । হাংরি আন্দোলনের আদর্শ -- আমার ভালো লেগেছিল, এবং আমি তা মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলাম বলেই আমি ওদের সঙ্গে ছিলাম । এ ব্যাপারে আমার কোনো দ্বিমত নেই । কিন্তু পরের দিকে ওরা আমাকে না জানিয়ে আমার নামে পত্রিকা টত্রিকা বার করে । যা আমাকে ক্ষুব্ধ করেছিল ।
তখন আমি কৃত্তিবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম । কিন্তু এই হাংরি আন্দোলন যখন শুরু হয় তখন সুনীল আমেরিকায় । এই আন্দোলনকে সুনীলের অসাক্ষাতে একটা ক্যু বলতে পারা যায় ।
প্রতিষ্ঠানের লোভ আমার কোনোদিনই ছিল না । বাংলাদেশে যদি কেউ আগাগোড়া প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার ভূমিকা পালন করে থাকে তবে তা আমি । আমার 'বিজনের রক্তমাংস' গল্পটি বেরোনোর পর থেকে আমার সে ভূমিকা অব্যাহত ।
আমি মনে করি ওরকমভাবে দল পাকিয়ে সাহিত্য হয় না । একজন লেখক নিজেই অতীত, নিজেই ভবিষ্যত, নিজেই সমাজ, নিজেই সভ্যতা, এবং নিজেই সবকিছু । সাহিত্য সৃষ্টিতে দলের কোনো ভূমিকা থাকতে পারে না ।
আমি মুচলেকা দিয়েছিলাম তার দুটো কারণ । এক, আমি পুলিশকে ভীষণ ভয় পাই, আর দুই, আমার বউ আমাকে জেলে যেতে বারণ করেছিল । বউ বলল, যে একেই তো তোমার মতো মদ্যপকে বিয়ে করার জন্য আমার আত্মীয় পরিজনরা সব আমার সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়েছে । তার ওপর তুমি যদি জেলে যাও তাহলে সোনায় সোহাগা হবে । সেই জন্যে আমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ত্যাগ করি ।”

গ্যালিলেও আগেই পেণ্ডুলামের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কথা বলে গেছেন, আমার নতুন কিছু বলার নেই ।
                                 

শুক্রবার

হাংরি জেনারেশনের কবি শৈলেশ্বর ঘোষ ( ক্ষুধার্ত গোষ্ঠী ) বসে আছেন তৃণমূল মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের পাশে


হাংরি আন্দোলনের ঔপন্যাসিক সুবিমল বসাক





































হাংরি আন্দোলনের ঔপন্যাসিক সুবিমল বসাক যাঁর রচনা বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকোত্তর সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে

মঙ্গলবার

জুলিয়েট রেনোল্ডস : ছবি আঁকা, হাংরিয়ালিজম ও বিট আন্দোলন


         দুটি আন্দোলনেই, কবি ও লেখকদের সংখ্যাধিক্যের কারণে, বেশ কম লোককেই পাওয়া যাবে যিনি তর্ক জুড়বেন যে বিট আন্দোলন এবং হাংরি আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে ছিল সাহিত্যের আন্দোলন । দুটি আন্দোলনই ডাডাবাদীদের সঙ্গে তাঁদের তুলনাকে আকৃষ্ট করলেও, কেউই এই দুটিকে শিল্পের আন্দোলন বলতে চাইবেন না, যা কিনা ডাডা আন্দোলনকে বলা হয়, তাঁদের গোষ্ঠীতে সাহিত্যিকরা থাকলেও ।

         কিন্তু বিট এবং হাংরিয়ালিস্টদের ইতিহাস ও উত্তরাধিকারকে যদি খুটিয়ে দেখা হয় তাহলে সন্দেহ থাকে না যে যেমনটা আলোচকরা মনে করেন তার চেয়ে অনেকাংশে বেশি ছিল শিল্পীদের অবদান এই দুটি আন্দোলনে। বিট আন্দোলনের ক্ষেত্রে প্রাথমিক বিশ্লেষণেই তা সত্য বলে প্রমাণিত হয় । তাঁদের আন্দোলনে শিল্পের যে স্হির-নিবদ্ধ সন্দর্ভ প্রধম থেকে ছিল তা কখনও থামেনি । অবশ্য মনে রাখতে হবে যে বিটদের সম্পর্কে তথ্যাদি ভালোভাবে নথি করা হয়েছে, যা হাংরি আন্দোলনকারীদের ক্ষেত্রে হয়নি, ব্যাপারটা প্রথম বিশ্ব ও তৃতীয় বিশ্বের ফাটলের অবদান । বিট আন্দোলন কাউন্টার কালচার হিসাবে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশে উদয় হয়েছিল, যখন কিনা হাংরি আন্দোলন তার কায়া পেয়েছিল দরিদ্র, অবিকশিত একটি দেশে, তাও তারা সীমিত ছিল একটি রাজ্যে বা এলাকায় । তাছাড়াও, হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনৈতিকভাবে এমন করে দাবিয়ে দেয়া হয়েছিল যা বিটনিকদের ক্ষেত্রে একেবারেই ঘটেনি । গিন্সবার্গ, ফেরলিংঘেট্টি, কোরসো, বারোজ এবং বাকি সবাই তাঁদের কুখ্যাতিকে নিজেদের সুবিধার জন্য ব্যবহার করতে পেরেছিলেন, তাঁরা তা না চাইলেও পেরেছিলেন । এর ফলে তাঁদের আন্দোলন বহুকাল টিকে থাকতে পেরেছিল এবং লতায় পাতায় বেড়ে উঠতে পেরেছিল, জনমানসে কাল্ট হিসাবে স্হান করে নিতে পেরেছিল । 
  
         অপরপক্ষে, ১৯৬১ সালে মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সমীর রায়চৌধুরী ও দেবী রায় যে আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন তা কয়েক বছরের মধ্যেই সরকারি লাঠিচালনা ও নিজেদের মধ্যে অবনিবনার কারণে স্তিমিত হয়ে যায়, অবনিবনার কারণ ছিল সরকারের লোকেদের দ্বারা আন্দোলনকারীদের হয়রানি ও নাকাল করার চাপ । অশ্লীলতার আরোপে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যদের বিরুদ্ধে মামলা ও পরে মলয়ের জেলজরিমানা ছিল হাংরি আন্দোলন ভেঙে ফেলার জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিকল্পনা । তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে প্রত্যেক সদস্যের বাড়িতে নির্মম পুলিশি হানা দিয়ে বৌদ্ধিক ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল, বই, পাণ্ডুলিপি এবং চিঠিপত্র । 

         হাংরি আন্দোলনের শিল্পীদের ক্ষেত্রে, বেনারসে, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাধ্যায় এবং সহযোগী শিল্পীদের ‘ডেভিলস ওয়র্কশপ’ নামে স্টুডিও তছনছ করে দিয়েছিল পুলিশ, নষ্ট করে দিয়েছিল তাঁদের আঁকা পেইইনটিঙ, আন্দোলনের নথিপত্র, যা পরে আর ফেরত পাওয়া যায়নি । সৌভাগ্যবশত অনিল করঞ্জাইয়ের কিছু কাজ, হাংরি আন্দোলনের লাগোয়া সময়ের, সরিয়ে ফেলা সম্ভব হয়েছিল এবং তাঁর সংগ্রহের দুর্মূল্য সম্পদ হিসাবে সংরক্ষণ করা গেছে, যেগুলোয় পাওয়া যাবে হাংরি আন্দোলনের আইডিয়া এবং উদ্বেগ । এগুলো থেকে হাংরি আন্দোলনকে আরও গভীর ভাবে বোঝা যায় । এটা বলা ক্লিশে হবে না যে শব্দাবলীর তুলনায় উদ্দেশ্যকে ছবি আরও স্পষ্ট করে মেলে ধরতে পারে। অনিল করঞ্জাই ( ১৯৪০ - ২০০১ ) ছিলেন হাংরি আন্দোলনের প্রতি সমর্পিত একমাত্র শিল্পী । একই ধরণের বিট চিত্রশিল্পী ছিলেন রবার্ট লাভাইন ( ১৯২৮ - ২০১৪ )। অ্যালেন গিন্সবার্গ লিখেছেন যে বিট আন্দোলনের জন্ম দেয়ায় রবার্টের বেশ বড়ো অবদান আছে । রবার্টের সান ফ্রানসিসকোর বিশাল বাড়িতে বোহামিয়ান, পোশাকহীন, বুনো তরুণ-তরুণী বিট আন্দোলনকারীরা সবাই মিলে বিট আন্দোলনকে চরিত্র দিয়েছিলেন । বিট আন্দোলনের গ্রাফিক্স আর পোস্টার এঁকে দিতেন রবার্ট। অনিল এবং করুণাও হাংরি আন্দোলনে একই কাজ করতেন ।

          গিন্সবার্গ এবং রবার্ট নিজেদের মধ্যে নান্দনিক ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতেন । তাঁরা দুজনেই আণবিক কাখণ্ডে বিষণ্ণতায় আক্রান্ত যুবসমাজের চেতনায় প্রতিফলিত অবক্ষয় ও মৃত্যুবোধকে নিজেদের কাজে প্রতিফলিত করতে চাইতেন, রবার্ট লাভাইনের কথায়, “স্হায়ীত্বের মিথ্যা” সম্পর্কে তিনি গিন্সবার্গের থেকে জেনেছিলেন । যে জগতের ভবিষ্যৎ নেই সেখানে স্হায়ী শিল্পকর্মের ধারণা তাঁকে অবশ করে দিয়েছিল, যা থেকে তাঁর মুক্তি পাওয়া অসম্ভব ছিল যদি না তিনি বিটনিকদের সংস্পর্শে আসতেন । ‘পাগল, ল্যাংটো কবি’ হিসাবে লোকে গিন্সবার্গকে জানতো, এবং রবার্টকে গিন্সবার্গ বলেছিলেন ‘মহান উলঙ্গ শিল্পী’, দুজনেই সহকর্মী ও বন্ধুদের চরিত্র তুলে ধরেছিলেন নিজের নিজের কাজে, প্রথমজন জ্বলন্ত ‘হাউল’ কবিতায় এবং দ্বিতীয়জন তাঁর রেখা ও রঙে । তাঁর আঁকা যুবক গিন্সবার্গের অয়েলপেইন্ট ব্যাপারটাকে বিশদ করে তুলেছে ।

           বিটদের তুলনায় অনিল করঞ্জাই পোরট্রেট আঁকা বেশ দেরিতে আরম্ভ করেন । স্টাইলের দিক থেকেই আর্টিস্ট দুজন ভিন্ন, কিন্তু তাঁদের আঁকা বেশ কিছু পোরট্রেটে পাওয়া যাবে ব্যক্তিবিষয়ের কোমলতা । এটা অনিলের ক্ষেত্রে পাওয়া যাবে করুণার বাচ্চা মেয়ের চারকোল স্কেচে, যে বাচ্চাটাকে অনিল জন্মের সময় থেকেই জানতো, আর হাংরি আন্দোলনকারীদের ম্যাসকট হয়ে উঠেছিল ।

             রবার্ট লাভাইন, প্রেমে গিন্সবার্গের প্রতিদ্বন্দ্বী, পিটার অরলভস্কির যে বিরাট পেইনটিঙ এঁকেছিলেন, সেইটিই ছিল গিন্সবার্গের সবচেয়ে প্রিয় ছবি । উলঙ্গ, সুন্নৎ না-করা লিঙ্গ যৌনচুলে ঢাকা, ছবিটা যৌনতা উত্তেজক হলেও দুঃখি আর বিষণ্ণ । গিন্সবার্গ লিখেছেন যে তিনি পিটার অরলভস্কির সঙ্গে পরিচয়ের আগে ছবিটা যখন দেখেছিলেন তখন ‘চোখের দিকে তাকিয়ে প্রেমে বিদ্যুৎপৃষ্ট বোধ করেছিলেন।’ সেই সময়কার মানদণ্ড অনুযায়ী গিন্সবার্গ এবং লাভাইন দুজনেই ছিলেন পর্নোগ্রাফার । কিন্তু কবির তুলনায় শিল্পী বেঁচে গিয়েছিলেন আদালতের হয়রানি থেকে, বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার কেননা সত্তর দশকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত সামনাসামনি নগ্নতা এবং সমকামকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ মনে করা হতো । রবার্ট লাভাইনের মতো অনিল করঞ্জাইও নগ্নিকা এঁকেছিলেন এবং আদালতের চোখরাঙানি পোহাতে হয়নি । কিন্তু অনিলের ‘ক্লাউডস ইন দি মুনলাইট ( ১৯৭০ ) রোমা্টিক ক্যানভাসে বিট পেইনটারের তুলনায় অনিলকে ভিশানারি বলে মনে হয় ।

         প্রখ্যাত কবি এবং ‘সিটি লাইটস’-এর প্রতিষ্ঠাতা লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, যাঁকে ‘হাউল’ প্রকাশ করার জন্য অশ্লীলতার আরোপের মুখে পড়তে হয়েছিল এবং যিনি হাংরি আন্দোলনকারীদের মামলার সময়ে হাংরিয়ালিস্টদের রচনা প্রকাশ করেছিলেন, নিজেও শিল্পী ছিলেন । ফেরলিংঘেট্টির এক্সপ্রেশানিস্ট দৃশ্যাবলী, প্রথম দিকে বিমূর্ত, পরে ফিগারেটিভ এবং প্রায়ই সরাসরি রাজনৈতিক -- দর্শকদের নাড়া দেয় এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে তাঁর গুরুত্ব বৃদ্ধি করে ।

         ‘নেকেড লাঞ্চ’ গ্রন্হের লেখক উইলিয়াম বারোজ, যাঁকে আইনের ফাঁদে পড়তে হয়েছিল, বিট জেনারেশনের একজন নামকরা সদস্য, তিনিও ছিলেন ভিশুয়াল আর্টিস্ট । কিন্তু বারোজের পেইনটিঙ এবং ভাস্কর্য প্রকৃতপক্ষে আতঙ্ক সৃষ্টিকারী । তিনি অনেক সময়ে নিজের মনের গভীরতাকে তুলে ধরার জন্য চোখ বন্ধ করে আঁকতেন, যাগুলো হতো উন্মাদগ্রস্ত, কেবল কড়া মাদক সেবনের এবং অযাচারী যৌনতার ফলেই নয়। বেশ কিছু ক্যানভাসে বুলেটের ছ্যাঁদা আছে, তাঁর দর্শকদের জানাবার জন্য যে উইলিয়াম টেলের মতন গুলি চালাতে গেলে তিনি নিজের স্ত্রীকে খুন করেছিলেন, স্ত্রীর মাথাকে খেলার বল মনে করে । বারোজকে বলা হতো ‘পাঙ্ক’-এর পিতা, পরে ‘পপ শিল্পের পিতা’ অ্যাণ্ডি ওয়ারহল-এর সঙ্গে বন্ধুত্ব করেন এবং দুজনে একত্র হলে আমোদ করতেন । অ্যাণ্ডি ওয়ারহল বন্দুকের ব্যাপার ভালোই জানতেন, যদিও তিনি ছিলেন আক্রান্ত, আক্রমণকারী নন । ‘দি ফ্যাক্টরি’ নামে খ্যাত ওয়ারহলের নিউ ইয়র্কের স্টুডিওতে বারোজ প্রায়ই যেতেন ।

         প্রথম দিকে বিটদের বিমূর্ত এক্সপ্রেসানিস্ট পেইনটারদের সঙ্গে একাসনে বসানো হয়েছিল, যদিও বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটাররা তাঁদের জীবনযাত্রায় বিটদের অচিরাচরিত ব্যক্তিগত জীবনের মতন ভবঘুরে ছিলেন না । তাঁরাও মিডিয়াকে ও দর্শকদের তাঁদের কাজের মাধ্যমে চমকে দেবার প্রয়াস করতেন । তাঁরাও, একইভাবে, প্রথানুগত আঁকার রীতিনীতিকে জলাঞ্জলি দিয়ে নিজেদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রকাশ করতেন । তার জন্য তাঁরা বিশাল বিশাল ক্যানভাসে দ্রুত তরল স্ট্রোক দিতেন ; একে তাঁরা বলতেন ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’, আর এই ‘অরগ্যাজমিক ফ্লো’ ছিল হাংরিয়ালিজমের মননবিন্দু । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট পেইনটিঙকে এখন নৈরাজ্যবাদী মনে হতে পারে, যা বিট এবং হাংরি আন্দোলনের রচনাপদ্ধতিতে একই ধরনের ছিল বলা যেতে পারে, কিন্তু হাংরি পেইনটারদের শিল্পকলা ছিল সুচিন্তিত, তাঁদের কেঅস ছিল পরিকল্পিত ।

         একজন শিল্পী উন্মাদের মতন অনিয়ন্ত্রিত আবেগে এঁকে চলেছেন ব্যাপারটা নিছক ক্লিশে, এবং কম সংখ্যক শিল্পীই অনিল করঞ্জাইয়ের মতন এই ব্যাপারটায় জোর দিয়েছেন । নিওফাইট হিসাবেও, অস্হির তেজোময়তা ও পরিপূর্ণ জোশে অনিল করঞ্জাই এঁকেছেন প্ররিশ্রমান্তিক সুচিন্তিত ক্যানভাস । হাংরি আন্দোলনকারীদের সঙ্গে থাকার কারণে, যাঁদের মধ্যে তাঁর বয়স ছিল সবচেয়ে কম, এই বৈশিষ্ট্যগুলো গুরুত্ব পেয়েছে । যে একমাত্র শিল্পী তাঁকে প্রভাবিত করতে পেরেছিলেন, তিনি হলেন ডাচ শিল্পী হিয়েরোনিমাস বশ ( ১৪৫০ - ১৫১৬ ) । বশের গ্রটেস্ক বিদ্রুপাত্মক চিত্রকল্প অনিল করঞ্জাইকে অনুপ্রাণিত করত, যে সময়ে অনিল শ্রেণিবিভাজিত এবং শোষিত সমাজের একক ভিশন নিজের পেইনটিঙে গড়ে নেবার প্রয়াস করছিলেন । বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিজম সম্পর্কে অনিল বহু পরে জেনেছেন ।

          সবচেয়ে কুখ্যাত বিমূর্ত এক্সপ্রেশানিস্ট জ্যাকসন পোলক -- ‘ফোঁটাগড়ানো জ্যাক’ --- একজন ‘অ্যাকশান পেইনটার’, ক্যালিফর্নিয়ার ‘দি আমেরিকান মিউজিয়াম অভ বিট আর্ট’’-এ বহু শিল্পীর সঙ্গে স্হান পেয়েছেন । চরম ডাডাবাদী মার্সেল দুশঁও পেয়েছ, যিনি, বিটনিকরা জন্মাবার আগেই ‘অ্যান্টি-আর্ট’ শব্দবন্ধটির উদ্ভাবন করেছিলেন, এবং সেকারণে বিটদের আদর্শ । কিন্তু শোনা যায় যে পঞ্চাশের দশকে যখন অ্যালেন গিন্সবার্গ ও গ্রেগরি কোরসো প্যারিসে দুশঁর সঙ্গে দেখা করেন, দুজনে নেশায় এমন আচ্ছন্ন ছিলেন যে গিন্সবার্গ দুশঁর হাঁটুতে চুমুখান, আর কোরসো নিজের টাই কেটে ফ্যালেন । বয়স্ক দুশঁর তা পছন্দ হয়নি । বিটদের সেসময়ের আচরণ এমনই স্বার্থপরভাবে অসংযত ছিল যে তাঁরা অনেককে চটিয়ে দিতে সফল হয়েছিলেন, এমনকি জাঁ জেনেকেও, যাঁর আদবকায়দা মোটেই ভালো ছিল না ।

         বেনারসে বসবাসের সময়ে অনিল করঞ্জাই ও অ্যালেন গিন্সবার্গের মাঝে ছবি আঁকার বিষয় নিয়ে কোনো অর্থবহ আলোচনা হয়েছিল বলে মনে হয় না । মার্কিন লোকটির আগ্রহ ছিল উচ্চতর ব্যাপারে প্রতি, অর্থাৎ সাধু, শ্মশানঘাট, মন্ত্র, গাঁজা ইত্যাদি । হিন্দি ভাষার বৌদ্ধ কবি নাগার্জুনের সঙ্গে অনিল ও করুণা অ্যালেন গিন্সবার্গকে হারমোনিয়ামের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পাশাপাশি গিন্সবার্গ ও অরলভস্কিকে ছিলিম টানার কায়দা শিখিয়ে ছিলেন, যা প্রায় ধর্মাচরণের ব্যাপার এবং মোটেই সহজ নয় । এ ছাড়া হাংরি আন্দোলনকারীদের ছবি আঁকায় গিন্সবার্গ বিশেষ আগ্রহ দেখাননি । অনিলের খারাপ লাগেনি কেননা তাঁর বয়স তখন কম ছিল, আনন্দ পেয়েছিলেন ইংরেজিতে কথা বলার সুযোগ পেয়ে, যা ভাষায় অনিল তখন অত সড়গড় ছিলেন না । অনিল আর করুণা দুজনেই খ্যাতিপ্রাপ্ত মার্কিন সাহেবকে বিশেষ পাত্তা দিতেন না, কিন্তু পরবর্তীকালে গিন্সবার্গের আমেরিকা কবিতার পঙক্তি চেঁচিয়ে অনিল বলতেন, “আমেরিকা তোমার ডিমগুলো কবে ভারতে পাঠাবে?” 

            সন্দেহ নেই যে গিন্সবার্গ রেসিস্ট ছিলেন না, অন্তত সচেতনতার স্তরে । কিন্তু তাঁর মধ্যে সাদা চামড়ার মানুষের ঔদ্ধত্য ছিল, যা অন্যান্য বিটদের মধ্যেও ছিল । প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন হওয়া সতবেও একটা স্তরে তা ছিল অত্যন্ত এলিটিস্ট । যেমন বারোজ, স্ত্রীকে খুন করার পরেও ছাড়া পেয়ে গিয়েছিলেন, কেননা তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেছিলেন এবং তাঁর পরিবার ছিল বৈভবশালী । গিন্সবার্গ ততোটা ধনী পরিবারের না হলেও বেশ কমবয়সেই সুপারস্টার হয়েগিয়েছিলেন । তিনি ভারতে এসে যতোই গরিব সেজে থাকুন, তা তাঁকে তাঁর মঞ্চ থেকে নামাতে পারেনি, তা ছাড়া ভারতে তিনি চামচাগিরির সুখও পেয়ে থাকবেন । সম্ভবত হাংরি আন্দোলনকারীরাই একমাত্র তাঁর সঙ্গে সমানে-সমানে আইডিয়া আদান-প্রদান করেছিলেন এবং তাঁর কবিতায়  ও ভাবনাচিন্তায় হাংরি আন্দোলনকারীদের প্রভাব স্বীকার না করাটা তাঁর সম্পর্কে ভালো ধারণা তৈরি করে না ।

         গিন্সবার্গ, যিনি ভারতের ধর্মে পরোক্ষভাবে আকৃষ্ট হয়েছিলেন বলে মনে হয়, হাংরি আন্দোলনকারীদের ধর্ম সম্পর্কিত ভাবনাচিন্তাকে গ্রহণ করতে পারেননি । হাংরি আন্দোলনকারীরা ঈশ্বরকে বিসর্জন দিয়েছিলেন আর যে কোনো ধরণের উপাসনা-অর্চনা সম্পর্কিত বিশ্বাসকে সমসাময়িক ভাষায় নিন্দা করেছেন । অনিলের শৈশব বেনারসে কাটার দরুন তিনি ছোটোবেলা থেকেই ধর্মে বিশ্বাস করতেন না ; তিনি মন্দিরের বয়স্কদের বারো বছর বয়স থেকেই চ্যালেঞ্জ করতেন, আর তাদের তর্কে হারিয়ে দিতেন হিন্দুধর্মের জ্ঞানের সাহায্যে । বিজ্ঞাননির্ভর মানসিকতা নিয়ে অনিল সারাজীবন আস্তিক ছিলেন । প্রথম দিকের বৌদ্ধধর্ম তাঁকে আকৃষ্ট করলেও অনিল তিব্বতি বৌদ্ধধর্মের সমালোচনা করতেন, আর শেষ জীবনে অ্যালেন গিন্সবার্গ এই ধর্মে ধর্মান্তরিত হন । অবশ্য বিশ্ববীক্ষার সঙ্গে বিট কবিদের যুদ্ধবিরোধী রাজনীতির মিল ছিল, যেমনটা ছিল হাংরি আন্দোলনের অন্যান্য সদস্যদের ।

         হাংরি আন্দোলনকারীদের রাজনীতির কথা যদি বলতে হয়, শেকড়পোঁতা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সবাই যেমন তীব্র আক্রমণ চালাতো তাকে অনিল করঞ্জাই সমর্থন করতেন, কিন্তু তাদের অ্যানার্কিজমকে মেনে নিতে পারেননি অনিল । হাংরি আন্দোলনকারীদের বক্তব্য যে মানবাস্তিত্ব হল রাজনীতিরও আগের এবং রাজনৈতিক মতাদর্শগুলোকে বর্জন করা দরকার, তাও মানতে পারেননি অনিল । অনিল কিছু দিনের জন্য কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিয়েছিলেন কিন্তু হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার আগেই  বেরিয়ে আসেন । তা সত্বেও অতিবামের দিকে তাঁর ঝোঁক ছিল । হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে যাবার পরে তিনি নকশাল দলে যোগ দিয়েছিলেন, এই কথাটা সত্য নয় ।

         এ কথা সত্য যে বেনারস ও কাঠমাণ্ডুতে হাংরি আন্দোলনকারীরা যৌথ যৌনতার অর্গিতে নিজেদের সমর্পণ করেছিলেন, কিন্তু তা বিটদের যৌনজীবনের হইচইয়ের সামনে অত্যন্ত হালকা । অনিল এবং করুণা হিপি আর বিদেশি সাধক-সাধিকাদের সঙ্গে বেনারসে আন্তর্জাতিক কমিউনে  বসবাস করেছিলেন, এমনকি করুণা ছিলেন সেই কমিউনের ম্যানেজার ও মুখ্যরাঁধুনি । চেতনার বিস্তারের জন্য তাঁরা এলএসডি, ম্যাজিক মাশরুম ইত্যাদি মাদক নিয়ে পাঁচিল ঘেরা জায়গায় নীরক্ষা করতেন । অনিলের চেতনায় এর প্রগাঢ় প্রভাব পড়েছিল কেননা অনিল দায়িত্বহীনভাবে মাদক সেবন করতেন না, পজিটিভ থাকার প্রয়াস করতেন, পেইনটার হিসাবে ভিশানের বিস্তার ছিল তাঁর কাম্য । ‘ড্রাগ অ্যাবিউজ’ বলতে যা বোঝায় তার খপ্পরে তিনি পড়েননি ।

           হাংরি আন্দোলনকারীরা তাঁদের পেইনটিঙ ইচ্ছে করে পুড়িয়ে দিয়েছিলেন, এটাও বাড়িয়ে-চাড়িয়ে তৈরি করা গালগল্প, ১৯৬৭ সালে কাঠমাণ্ডুর বিখ্যাত একটি গ্যালারিতে প্রদর্শনীর শেষে এই সমস্ত ব্যাপার ঘটেছিল বলে প্রচার করা হয় । লেখকদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল যাতে মলয় রায়চৌধুরী ও অন্যান্য হাংরি আন্দোলনকারীদের  কবিতা পাঠের জন্য আমন্ত্রণ করা হয়েছিল । করুণা তার যাবতীয় পেইনটিঙ পুড়িয়ে নষ্ট করে ফেলেছিলেন । অনিল করঞ্জাই একপাশে দাঁড়িয়ে মজা উপভোগ করেছিলেন । অমন শিল্পবিরোধী কাজ তাঁর মানসিকতার সঙ্গে খাপ খায়নি । অনিলের আইকনোক্লাজম ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরণের ।

         হাংরি আন্দোলনকারীদের মতাদর্শের সঙ্গে তাঁর কিছুটা অমিল থাকলেও, হাংরির নান্দনিক দৃষ্টিভঙ্গী গড়ে দিয়েছিলেন অনিল । ষাটের দশকে বেনারসের কমিউনে টানা বাহান্ন ঘণ্টায় আঁকা তাঁর ‘দি কমপিটিশন’ পেইনটিঙে তা প্রতিফলিত হয়েছে, কাজটা একটা বটগাছকে নিয়ে, যাকে তিনি উপস্হাপন করেছিলেন কেঅস এবং সময়ের সঙ্গে লড়াইয়ের মেটাফর হিসাবে । এই পেইনটিঙে হাংরি আন্দোলনকারিদের উদ্দেশ্য যেমন ফুটে উঠেছে তেমনই বিটদের উদ্দেশ্য ; প্রকৃতিপৃথিবীর  সঙ্গে মানুষের একাত্মতা, যে পৃথিবীতে অশ্লীলতা বলে কিছু হয় না এবং মানুষের ইনোসেন্স পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয় ।

         হাংরি আন্দোলনের পরের দশকগুলোয় অনিল করঞ্জাইয়ের অঙ্কনজগতে পরিবর্তন ও পূর্নতাপ্রাপ্তি ঘটলেও, হাংরি আন্দোলনের সময়কার অভিজ্ঞতা তাঁর চেতনায় থেকে গিয়েছিল । তাঁর আইডিয়াগুলো হয়তো বিভিন্ন সূত্র থেকে আহরিত, কিন্তু হাংরি আন্দোলনের লক্ষ্য তাঁর দৃষ্টির বাইরে ককনও যায়নি । তাঁর আঁকা পরবর্তীকালের ছবিগুলো অনেকাংশে ক্লাসিকাল, বাস্তবতার বহিঃপ্রকাশ । তাঁর ল্যাণ্ডস্কেপগুলো দেখলে প্রথমদিকের পরাবাস্তব চিত্রকল্পের  বিরোধাভাসমূলক মনে হবে, যা তাঁর দর্শকদের বিভ্রান্ত করে । কিন্তু একথা নিশ্চয় বলা যেতে পারে যে প্ররোচনাদায়ক অলঙ্কারপূর্ণ চিত্রকল্প থেকে তিনি দূরে সরে গেলেও, ছবির ভিত্তিতে পরিবর্তন ঘটেনি । প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত অনিল করঞ্জাইয়ের ছবিতে পাওয়া যাবে মানবাস্তিত্বের নাট্য যা প্রকৃতি নিজের মুড ও আঙ্গিকের মাধ্যমে প্রকাশ করে চলেছে । আর হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতার সঙ্গে তা খাপ খায় । 

         বিনয় মজুমদার তাঁর ‘একটি উজ্বল মাছ’ কবিতায় চিত্রকল্পর আত্মাকে ধরে রেখেছেন, যখন তিনি বলেন:   
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী
দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা ।

         অনিল করঞ্জাইয়ের জীবনেও মিলনের এই স্বপ্ন বার বার ফিরে এসেছে তাঁর আঁকা ছবিগুলোয় । ১৯৬৯ সালে আঁকা ‘দি ড্রিমার’ নামের পেইনটিঙে অনিল স্পষ্ট করে তুলেছেন সৃষ্টিকর্মীর একাকীত্ব : সেই ‘ড্রিমার’  হাংরি আন্দোলনের সংঘর্ষময় এলএসডি মাদকে মুখিয়ে রয়েছে ; অনিলের আরেকটি ওয়াটার কালারে মলয় রায়চৌধুরীর ঘোষণা এসেছে ছবির থিম হয়ে । মলয় বলেছিলেন, “আমি মনে করি প্রথম কবি ছিলেন সেই জিনজাসথ্রপাস প্রাণী  যিনি লক্ষ লক্ষ বছর আগে মাটি থেকে একটা পাথর তুলে নিয়ে তাকে অস্ত্র করে তুলেছিলেন।” পরের দিকে অনিলের একা কবি ও দার্শনিকরা, পাথরে খোদাই করা, প্রকৃতির শৌর্যমণ্ডিত, তাদের অস্ত্র কেবল তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা । এই ছবিগুলো মহান আর্টিস্টের মতন করে আঁকা । হাংরি আন্দোলন-এ অনিলের মতন এমন একজন ছবি আঁকিয়ে ছিলেন যিনি মৌলিক ।

রবিবার

ফরজানা ওয়ারসি : হাংরি আন্দোলন - মহাসড়কে ফেরেশতার দল


“আজ্ঞে স্যার, কালকে সকালে পাড়ার লোকেরা তাকে কুপিয়ে মেরেছে”
                                                               মলয় রায়চৌধুরী ( অস্তিত্ব )
         এই কবি কোনো দলের রঙের পোশাকে র‌্যালিতে যোগ দিয়ে পথে বসে থাকবেন না, অনশনে যোগ দেবেন না, কিংবা জেল ভরে তোলার ডাক দেবেন না । ক্ষমতাবানদের থেকে অনুমোদনের ছাপ্পা তিনি পাবেন না । তিনি কোনো নিও-গান্ধি নন, তবু তাঁকে বলা হয়েছে উগ্র-গান্ধিবাদী । সে-সময়ে ‘শান্তিপূর্ণ’ শব্দটি প্রতিবাদ শব্দের সঙ্গে জুড়ে বাক্যবন্ধ তৈরি করা হয়নি । তাঁরা বৈদ্যুতিন মিডিয়ায় সাক্ষাৎকার দেননি কিংবা বড়ো উদ্যোগপতিদের সমর্থনের জন্য হাত পাতেননি । তেমন ভাবনার কথা বললে তাঁরা চটে গিয়ে  থুতু ছিটিয়ে দিতেন ।    একেবারে সত্যকার দ্যুৎকার । পৃথিবী দেখছে ভারত কেমন জোচ্চোরদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেবার দেখনদারি করছে এবং ‘নিরহঙ্কারী’ নায়ক আন্না হাজারেকে ঠেকনো দিয়ে তুলে ধরেছে, আমি সেই সময়ের কথা ভাবি যখন প্রতিবাদ ও মতান্তর ভণ্ডামির ব্যাপার ছিল না । সৎ প্রতিবাদ থেকে সৃষ্টিশীলতা জন্মায়, তাকে সাউণ্ড বাইটের জোরে বেঁচে থাকতে হয় না ।
        “ আমার মনে হয় মানুষ প্রথমে তত্ব তৈরি করে আর তারপর তা প্রয়োগ করতে গিয়ে সমাজের প্রচুর ক্ষতি করেছে।    ডাণ্ডি মার্চের নকল করার ঘটনাটাই ভেবে দ্যাখো, সেকালের তত্বকে এখন প্রয়োগ করে আবার মার্চ করার প্রদর্শনী । সকলেই জানে যে ব্যাপারটা একটা ফার্স । সংস্কৃতির তত্ব হয় না ।” এই কথাগুলো আমি কুড়ি বছর আগে শুনেছিলাম । আমি বসেছিলাম হাংরি আন্দোলনের প্রধানপুরুষ মলয় রায়চৌধুরীর মুম্বাই শহরতলির ফ্ল্যাটে, সেই মানুষটির বাড়িতে যাঁর কলম থেকে ক্ষুধার্ত মানুষদের পাকস্হলির ক্ষারে পরিপূর্ণ শ্বাস বেরিয়ে আসত ।   
          ছোটো একটা বসার ঘরে -- একটা সোফা, চেয়ার, ডাইনিং টেবিল, না ডাইনিং টেবিল ছিল না -- রান্নার তেলফোড়নের আওয়াজকে  পরস্পরবিরোধী মনে হয়নি আমার । এই মানুষটি উপজাতিদের সঙ্গে জঙ্গলে বসবাস করতে যাননি, মোটা মোটা বই লেখেননি, সোয়ারোসকির মতন ঝলমলে দামি ইংরেজি বাগ্মীতায় দেশদ্রোহের বাখান দেননি । খ্রিসমাসের দিন যিশুর নামে যেমন রঙিন রাঙতা ওড়ানো হয় তেমন করে দক্ষিণপন্হীদের দিকে প্যামফ্লেট উড়িয়ে স্মিত হাসি হাসেননি । তখন অবশ্য দক্ষিণপন্হী শত্রু ছিল না । যেমন ছিল না ক্ষমতাবানদের সামনে হাত কচলানো । সব কিছুই ছিল ‘অপর’ ।
         উনি নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে বিস্ফোরক আদর্শের খাতিরে বোমা বানাতে পারতেন। উনি নিজেকে আদর্শবাদীর মোড়কে ঢেকে ভারি মাথা আর পায়ে ফাটল নিয়ে ডিগবাজি খেয়ে মৃত্যুর দেশে চলে যেতে পারতেন। তা উনি করেননি । উনি রক্তমাংস, রক্তাক্ত জখম, মর্ত্যের নরক, পতিত এলাকার কবিতা লেখা বজায় রাখলেন। ওনার অতীতের অন্ত্রে এখনও ক্রোধ রয়ে গেছে । অতীতের হাইপোডারমিক সিরিঞ্জে মরচে ধরে গেলেও হয়তো অনেক সময়ে উইথড্রল সিম্পটম দেখা দেয়, তবু তা উনি পরিত্যাগ করেননি ।   
         পঞ্চাশের দশককে যখন গোর দেয়া হয়ে গেছে এবং অ্যালেন গিন্সবার্গ নিজের পোশাক পালটে একধরণের  নিশান হয়ে উঠেছেন, কলকাতার একদল কবি যাঁরা বাঙলাভাষায় কবিতা লিখতেন তাঁদের কাদামাখা হাতে আরম্ভ করেছিলেন হাংরি আন্দোলন । লিরিক রচনাকারদের অলস জীবনে তা উথালপাথাল ঘটিয়ে দিয়েছিল। হাংরি আন্দোলনকারীরা ছিলেন বিলাসবহুল খাইয়েদের প্রতিসন্দর্ভের জগতের যুবকদল, কিন্তু তাঁদের ‘হাংরি’ নামকরণ তাঁরা করেছিলেন জিওফ্রে চসারের কভাণ্টারবারি টেলসের পঙক্তি ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ থেকে এবং তার বুনিয়াদ গড়ে তুলেছিলেন অসওয়াল্ড স্পেংলারের সংস্কৃতি সম্পর্কিত ব্যাখ্যা থেকে, যে, একটি সংস্কৃতি তার অবসানের সময়ে বাইরের উপাদান আত্মসাৎ করতে থাকে । সাক্ষাৎকারে মলয় রায়চৌধুরী বলেছিলেন, যে, “আমি এই ধারণায় ক্ষুধার ও সংস্কৃতির বাস্তবতা খুঁজে পেয়েছিলাম” ।
         হাংরিদের কবিতাকে বলা হচ্ছিল হিস্টিরিয়া-আক্রান্ত, কিন্তু তা সত্বেও তাঁদের কবিতা যাবতীয় টেকনিক থেকে স্বাধীন হয়ে উঠেছিল । মলয় রায়চৌধুরী তাই লিখেছিলেন, “শিল্পের জন্য সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দেবো।” সেই উক্তি কোনো ফাঁকা বাহাদুরি ছিল না । হাংরিদের কাজকর্মকে বলা হয়েছে অদ্ভুত । তাঁরা ছেঁদো পার্টিপলিটিক্স বর্জন করতে চেয়েছিলেন, যেন সবায়ের সামনে পাদতে চাইছেন, ঢেঁকুর তুলতে চাইছেন । এমনকি টাইম ম্যাগাজিন তাদের ২০ নভেম্বর ১৯৬৪ সংখ্যায় বলতে বাধ্য হয়েছিল যে, “সৃষ্টিশীলতার ঝড় বইয়ে দেবার জন্য গত গ্রীষ্মে হাংরি আন্দোলনকারীরা কলকাতার গন্যমান্য লোকেদের -- পুলিশ কমিশনার থেকে ধনী চিরকুমারদের -- চার অক্ষরের নিমন্ত্রনপত্রে আহ্বান জানিয়েছিলেন টপলেস প্রতিযোগীতা দেখার প্রদর্শনীতে আসতে । ব্যাপারটা হয়তো ছিল হিপোক্রিটদের আক্রমণ করার জন্য । মলয় বলেছেন যে, “রাস্তায় নেমে প্রতিবাদের পরিবর্তে নিজেদের লেখার মাধ্যমে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । আমরাই প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী হিসাবে ঘোষিত হলাম এবং বাংলা কবিতার জগতে এটা ছিল প্রথম একটা ভালো খবর।”
         কিন্তু তাঁর পক্ষে ভালো খবর ছিল না । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, কম বয়সীদের নষ্ট করার প্রয়াস ইত্যাদি অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হলো তাঁদের বহু সদস্যকে -- এবং  মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে আরেকটি বাড়তি আরোপ ছিল, সাহিত্যে অশ্লীলতার । অন্যান্য সদস্যদের পুলিশ ছেড়ে দিয়েছিল, কেননা তাঁরা মলয়ের বিরুদ্ধে মুচলেকা দিয়েছিলেন । তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল যতদিন না কলকাতার উচ্চ আদালত তাঁকে মুক্তি দিয়েছে।
যে কোনো বাড়িতেই ঘটনাটা সবাইকে ব্যতিব্যস্ত করবে । মলয়, তখনও বিয়ে করেননি, দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তাঁকে এমন দৃশ্য সহ্য করতে হয়েছে যখন  তাঁর অসহায় বাবার চোখের সামনে পুলিশ তাঁর মায়ের স্টিল ট্রাঙ্ক ভেঙে ফেলেছে । তাঁর বাবা-মা স্কুলে পড়াশুনা করেননি । “হাংরি আন্দোলনে আমরা প্রায় সবাই ছিলাম প্রথম প্রজন্মের শিক্ষিত, দরিদ্র পরিবারের সদস্য ।” তাঁদের সামনে যা পরিবেশন করা হতো তাকেই সংস্কৃতি হিসাবে মেনে নিতে হতো । মলয়ের ঠাকুর্দা ছিলেন শিল্পী এবং রাজা-রানীদের পেইনটিঙ আঁকতেন ।
        প্রতিটি বাঙালির আরেকজন ঠাকুর্দা তাঁদের প্রভাবিত করতে পারেননি । “রবীন্দ্রনাথ ছিলেন কোটিপতি ; তাঁকে সামনে রেখে আমাদের প্রসঙ্গ উথ্থাপন করা যা্য় না । কেবল রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকেই নয়, পরবর্তী কবিদের থেকেও, আমাদের আত্মিক বৈশিষ্ট্য ও অনুভববেদ্যতা সম্পূর্ণ ভিন্ন ছিল । সাইত্যজগতে প্রবেশ করার সময়ে আমরা নিয়ে আসলাম আমাদের নিজেদের বর্গের অভিজ্ঞতা, যা সেই সময়ে বঙ্গসংস্কৃতি এবং পাশ্চাত্য সংস্কৃতি থেকে আলাদা ছিল । ফলে আমাদের তখনই স্বীকৃতি দেয়া হয়নি ।” তাঁদের রক্তমাংসের আঘাতজনিত জখম থেকে রক্তের স্রোত বয়ে গেছে । মলয় লিখেছিলেন, “যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও।”
         হাংরি আন্দোলনকারীরা কি ভীতি ছিল যে তাঁদের আরম্ভ করে যুদ্ধ তাঁরা শেষ করে যেতে পারবেন না ? সাক্ষাৎকারে মলয় বলেছেন, “এখনকার চিত্রকল্প এবং শব্দাবলী সন্ত্রাসে পরিপূর্ণ, যা এই সময়ের প্রতিফলন, যে ধরনের অভিজ্ঞতা নম্র সাধারণ মানুষ পছন্দ করে না । কিন্তু হ্যাঁ, বিশেষ পাঠকবর্গকে আকৃষ্ট করার প্রয়াস ছিল বৈকি । তারপর আমরা আত্মপ্রশ্নে জর্জরিত হতে আরম্ভ করলাম, কেনই বা পাঠককে আনন্দ দেবার জন্য লেখালিখি করা হবে ! তাকে কেন আঘাত দিয়ে জাগিয়ে তোলা হবে না ? সেক্ষেত্রে পাঠক তোমাকে মনে রাখতে বাধ্য হবে ।”
         প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষও হাংরি আন্দোলনকারীদের কাজকর্মে-লেখায় ষড়যন্ত্রমূলক উদ্দেশ্য আবিষ্কার করে থাকবেন -- রাজনৈতিক উথ্থান -- হাংরিদের লেখায় যেন তেমন ব্যাপারই ছিল । জনৈক আলোচক লিখেছিলেন যে মলয়ের প্রেমের কবিতাতেও রাজনীতি পাওয়া যায় । “ মলয় বললেন, সেভাবে দেখতে গেলে জীবনের সব ঘটনাকেই যেমনভাবে ইচ্ছা ব্যাখ্যা করা যায় । দ্যাখো, তুমি হয়তো ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না, কিন্তু তোমার মনের ভেতরে কোনো কারণে যে আতঙ্ক, কিছু একটা আঁকড়ে ধরার চেষ্টাকে লোকে ঈশ্বরে বিশ্বাস বলে মনে করতে পারে । বহু আলোচক রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বিশ্লেষণ করতে ভালোবাসেন । কিন্তু ভেবেচিন্তে কবিতায় কেউ বিশুদ্ধ রাজনীতি আনে না ।” তবু মলয় রায়চৌধুরী নিজেকে রাজনীতির মানুষ বলে মনে করেন না, হাংরি মতাদর্শের ভেতরে বসবাস করা সত্বেও । “আমরা ছিলাম সাংস্কৃতিক বহিরাগত । আমরা কলকাতাকে সেই সমস্ত জিনিস এনে দিয়েছিলাম যা তার আগে ছিল নন-মেট্রোপলিটান উপাদান”, বললেন মলয় ।
         হাংরি আন্দোলন ঝালর হয়ে ঝুলে থাকার জন্য আরম্ভ করা হয়নি ; বরং তা লড়াই করে সংস্কৃতির ভেতরে প্রবেশ করে নিজের স্হানাংক নির্ণয় করতে চেয়েছিল, যে সংস্কৃতি যা পাচ্ছিল তাকেই চিবিয়ে চর্বিত চর্বণ করে ফেলছিল । অতএব কিনারে ঠেলে দেওয়া মোটেই পছন্দ হয়নি তাঁদের । হাংরি আন্দোলনকারীদের সরকারি অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ডাকা হতো না । মলয় বলেছেন, “বড়ো একটা পাঠক সমাজ আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গিয়েছিল ; বন্ধুরা কেটে পড়েছিল আদালতে আমার সাজার সংবাদে । বেশ কঠিন হয়ে পড়েছিল আমার লেখাপত্র প্রকাশ করা । তাই লেখালিখি ছেড়ে দিয়েছিলাম । মাঝে আমি সাহিত্যের বিষয়ে কিছুই ভাবতাম না, নিজের ছেলে-মেয়ের সঙ্গে খেলতাম ।”
         বিপ্লব তার বৃত্ত পুরো করে ফেলেছিল । যে লোকটা দেশের গ্রামেগঞ্জে চরে বেড়াতো, চাষিদের সঙ্গে সময় কাটাতো, মেঝেয় শুয়ে রাত কাটাতো, তার কাছে তখন “জীবনযাপন কবিতা লেখার চেয়ে আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল।” মলয়ের কাছে লেখালিখি বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল । মলয় বুঝতে পারছিলেন যে গ্রামে গেলে এখন  কুয়োর জল খেলে তাঁর পেট খারাপ হয়, ফলে বোতলের জল খেতে হতো । ব্যাপারটা এমন একজন মানুষের অকপটতার প্রতিফলন যিনি একদা লিখেছিলেন, “অজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে” । তাহলে কোথায় পরিবর্তন ঘটল ? তাকি আনুই ? প্রতীক্ষা ? “আমি কনফিউজড । কাঠামোকে কেমন করে পালটে ফেলা যেতে পারে সে ব্যাপারে আমি কনফিউজড।” শহরতলিতে কাটানো আরামের জীবন এবং পরিবারের সঙ্গে অতিবাহিত সময় কি তাঁকে মানসিক শান্তির জগতে এনে দিয়েছিল ? কোনো রিগরেট ছিল কি ? তাঁর কোনো কোনো বন্ধু নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন । মলয় বলেছেন, “ওই ধরনের বৈপ্লবিক পন্হা আমার কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না।” প্রতিষ্ঠান তো সংস্কৃতিরই অঙ্গ এবং তাও ক্রমশ অধঃপতনের পথে নেমে চলেছে । বয়সের সঙ্গে-সঙ্গে বেঁচে থাকার ব্যথাগুলো বৃদ্ধি পেতে থাকে, তখন কিছু-কিছু ব্যাপারকে ঝেড়ে ফেলে দিতে হয়, অনেককে অস্বীকার করতে হয় ।
         আপনি কি বিষ খাবার পর নীলকন্ঠ ? হাংরি আন্দোলনকি এখনও প্রাসঙ্গিক ? “আমি জানি আমি বদলে গেছি”, বললেন মলয়, “আমার কবিতার ধরণও বদলে গেছে, এখন নিজেকে বিপ্লবী ঘোষণা করাটা জোচ্চুরি হবে।”
         রাজপথ দিয়ে লোকেরা হেঁটে যাচ্ছে । ক্যাম্পের আগুনের চারিপাশে যুবকেরা বসে আছে । জনগণ মনে রেখেছে উড়ন্ত শব্দের কাঁপনভরা কন্ঠস্বর, মতান্তরের রেশমগুটিতে অমরত্ব পেয়ে গেছে সেই কন্ঠ । মলয় পরবর্তী কবিতায় প্রশ্ন তুলেছেন, “জামাটা গলিয়ে নেবো ? দু-মুঠো কি খেয়ে নেবো ? পিছনের ছাদ দিয়ে পালাব কি ?”
         বিপ্লব এখন রোবোটের আকার নিয়েছে । সিসটেম ও কাউন্টার সিস্টেম ঘন অন্ধকারে কোন গুলো থেকেও উঁকি মেরে টেনে বের করে আনবে যাকে চায় তাকে । মলয় রায়চৌধুরী তার এখনকার কবিতায় ঠিকই বলেছেন, “দুপাশে শহর জ্বলছে/কাঁখে শিবলিঙ্গ নিয়ে ল্যাংটো মোহান্ত ছুটছে।”
         আপনি নিজেই নির্নয় নিন । আজকের মিউটিনি আপনাকে খালি হাতে ফেরাবে না ।
কাউন্টারপাঞ্চ
১১ নভেম্বর ২০১১