সোমবার

হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী : প্রদীপ চক্রবর্তী

 হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরী : প্রদীপ চক্রবর্তী

আজ সেই অভিশপ্ত দিন | পঁচিশে এপ্রিল  | ঠিক এক বছর আগে এই দিনে , প্রদীপ দা , কবি প্রদীপ চৌধুরী আমাদের ছেড়ে চলে গিয়েছিলেন |আজ তাঁর প্রথম মৃত্যু বার্ষিকী | দেখতে দেখতে একবছর হয়ে গেলো !  এবং সেই যাওয়াটা এ জন্যই আজও আমি মানতে পারি নি , কারণ সেই সময় করোনার বাড়াবাড়ির জন্য , কেউ যদি সেই রোগে মারা গিয়ে থাকেন , তাহলে সরকারি মতে তাঁকে গণ চিতায় পোড়ানো হবে | করোনায় সেই সময় , প্রদীপ দা র ছেলে , পুত্রবধূ , নাতনি পর্যন্ত আক্রান্ত ছিল | এর ফলে একজন আত্মীয়ের মাধ্যমে তাঁকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসে , সবার অনুপস্থিতিতে , ধাবার মাঠে গণচিতায় পুড়িয়ে দেওয়া হয় | হাংরি আন্দোলনের অবিসংবাদী পুরুষ , যিনি ফরাসি ভাষায় পন্ডিত ছিলেন | এবং ফ্রান্সে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ পড়িয়েছেন বেশ কিছু বছর | যার জীবন ও বোহেমিয়ানিজম , বিট প্রজন্মের আমেরিকান কবিদের সঙ্গে মেলে | সেইরকমই ডাকাবুকো বিপজ্জনক এবং বিট প্রজন্মের কবিদের অন্যতম বন্ধু | বিশ্বের বহু গুণী বিশিষ্ট লেখকের বন্ধু | যার সমস্ত লেখা ফরাসি ভাষায় অনূদিত | যার নামে একটি স্বতন্ত্র ওয়েব সাইড আছে ফ্রান্সে | যিনি সম্পূর্ণ ভাবে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগে পর্যন্ত , নষ্ট আধুনিকতার অন্যতম বেনিয়া প্রচার মাধ্যমকে উপেক্ষা করে গেছেন এবং তাবৎ প্রচার লোভী বাঙালি কবিদের চে শত হস্তে দূরে থেকেছেন | যিনি মনে করতেন , কবিতার বিনিময় হয় না | কবির যাপনের নিষিদ্ধ ইস্তেহার হলো কবিতা | কবির দরকার শার্দুলের মতো দৃঢ় মেরুদাঁড়া | যেকোনো জায়গায় অকপট ভাবে , সে সত্য কথা বলবে | এরজন্য জেল জরিমানা ফাঁসি অত্যাচার অনাহার যেকোনো বিপর্যয় কবি হাসি মুখে মেনে নেবেন | এবং কবিতার ইস্তেহার - এ যা যা বলেছেন কবি প্রদীপ চৌধুরী , তা শেষ দিন পর্যন্ত তিনি নিজে মেনে চলেছেন তা |

নিজের যেকোনো লেখা যে কোনও সংকলন তিনি হাসি মুখে যেকোনো সময় পুড়িয়ে দিতে পারতেন | অত্যন্ত বন্ধুবৎসল , চূড়ান্ত ভাবে অহমিকাশূন্য , একজন পবিত্র বালকের সজীব মন ও তীব্র ডানপিটে সক্রিয়তা নিয়ে তিনি শেষ দিন۔ পর্যন্ত বেঁচে ছিলেন | শেষের দিকে , মানে শেষ পাঁচ - সাত বছর খুব কাছের বন্ধু ছিল , সব্যসাচী হাজরা , এবং এই আমি | এছাড়াও সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁর অগণনীয় বন্ধুর সংখ্যা এবং তাদের ঈর্ষণীয় পরিচয় আপনাকে পাঠক অবাক করবে |

সারাজীবন , বিলাসব্যাসনশূন্য , খাঁটি কলার তোলা রাজার মতো বেঁচেছিলেন প্রদীপ দা | ভয়ডরহীন প্রকৃত বন্ধুর মতো | যাকে কবিতার অশ্লীলতার জন্য , ছাত্রাবস্থায় বিশ্বভারতী রাষ্ট্রীকেট করেছিল | যিনি ত্রিপুরার সাহিত্য সভায় , কবিতা পড়তে গিয়ে , প্রকাশিত পত্রিকার সংখ্যায় নিজের ছাপানো কবিতাগুলো ছিঁড়ে বলেছিলেন , কিসসু হয় নি ۔۔۔۔ফু: !

তার ত্রিভাষার পত্রিকাটির নামও۔ ফু: | বাংলা ইংরেজি ফরাসি | বাংলা ভাষায় এরম কাগজ ভূভারত বা পৃথিবীতে বিরল বলা যায় | এবং তিন ভাষার সত্যিকারের শ্রেষ্ঠ কবি সাহিত্যিকদের লেখায় সমৃদ্ধ হতো এই পত্রিকা |

ফ্রান্সের সব চে দামি ও নামি , আমাদের এখানে আনন্দ  পাব্লিশার্স , মিত্র ঘোষ , দেজ এর মতো ۔۔۔ কিন্তু সেই প্রকাশনী ওয়ার্ল্ড  ওয়াইড তার আন্তর্জাতিক মার্কেট কে ছড়িয়ে দিয়েছিলো , সেই প্রকাশনী , চেয়েছিলো প্রদীপ চৌধুরীর যাবতীয় লেখা নিয়ে একটি সমগ্র তৈরী করবে | এবং তার জন্য ফ্রান্সে যেতে হবে | সেই যাওয়া আসার খরচ , পাঁচ তারা হোটেলে থাকা এবং যাবতীয় হাত খরচা বহন করবে সেই প্রকাশনী | সেই সংস্থা ভারতীয় মুদ্রায় , প্রায় এডভান্স তিরিশ লক্ষ টাকা দিতে চেয়েছিলো | ভাবুন স্যার ! হ্যাঁ ঠিক শুনছেন | বই বেরোনোর আগেই তিরিশ লক্ষ টাকা ভারতীয় মুদ্রায় | সেই চুক্তির কাগজ আমি নিজের চোখেই দেখেছি |

ভাবুন স্যার ۔۔۔

এই বঙ্গে , সে অন্য জীবিত ও প্রখ্যাত হাংরি হোক বা না হোক বা যে ই ই ই  হোক , কোন মাই কা লাল আছে , যে লেখালিখি করে , এডভান্স তিরিশ লক্ষ টাকা পাবে এবং যাবতীয় অন্যান্য ঈর্ষণীয় সুযোগসুবিধা | কোন পাগল ছাড়বে এই লোভনীয় প্রস্তাব !

কিন্তু প্রদীপ চৌধুরী সেই বিরল বোকাদের একজন , যিনি এতো ভালোবাসেন তার মাতৃভাষাকে যে তিনি ফরাসি সংস্থাটিকে জানিয়ে দেন , যদি বই হয় এখান থেকেই হবে এবং ফ্রান্সে গিয়ে তিনি ফরাসি ভাষায় তার সমগ্র প্রকাশে আগ্রহ পাচ্ছেন না | অতএব ,

সেই " কবিতা সংগ্রহ " নিজেই এই বাংলা থেকে বের করেছিলেন প্রদীপ চৌধুরী | নিজের যৎসামান্য পেনশনের টাকা আর ছেলের কাছ থেকে কিছু নিয়ে এবং নিজের স্ত্রী' র গয়না বিক্রি করে |

এরম বাংলাভাষার শহীদ ক জন আছেন ? মুখে মারিতং জগতে , দেখছি তো প্রচার পাগলা হাংরিদের |

আর সেই প্রদীপ চৌধুরী , গণ চিতায় , ধাবার মাঠে একা একা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন | গতবছর এই দিনে | কোনও পাঠক , বাংলাভাষার তাবড় লেখককুল , যারা এই বঙ্গে বাংলাভাষার জন্য যাবতীয় সুযোগ নিয়ে বলি প্রদত্ত ! কেউ কেউ কেউ  জানতেই পারলেন না , একজন প্রকৃত মানুষ ও কবি কীভাবে একা একা পুড়ে যান , আগুনকে সাক্ষী করে | এই পৃথিবী আকাশ বাতাস ধরিত্রী পঞ্চভূত ও বিপুল অণু পরমাণু মহাজগৎ কেবল তাদের অসীম কবি সভায় এক সত্যিকারের বাঘের বাচ্চাকে , একজন কলার তোলা সম্রাটকে ডেকে নিয়েছিল তাদের আসরে কবিতা পড়ার জন্য ۔۔۔۔

প্রিয় প্রদীপ দা , আমি ও সব্য আজও আপনার সঙ্গে একাকার হয়ে আছি | ভোলা নয় , আমাদের অজস্র নির্জন রাতের পথ চলা আবার শুরু হবেই ۔۔۔۔

দেখা তো হবেই কোথাও না কোথাও ۔۔۔۔۔

প্রদীপ দা লাভ ইউ বস

..