বুধবার

সাতদিন পত্রিকায় দেয়া মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার

সাতদিন পত্রিকায় দেয়া মলয় রায়চৌধুরীর  সাক্ষাৎকার
মলয় রায়চৌধুরী ( ১৯৩৯ ) একজন কবি, ঔপন্যাসিক, নাট্যকার, প্রবন্ধলেখক ও অনুবাদক । পশ্চিমবঙ্গে ষাটের দশকে যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন ( অন্যেরা হলেন দেবী রায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও সমীর রায়চৌধুরী ), তিনি তাঁদের অন্যতম । কবিতা লেখার জন্য ১৯৬৪ সালে তাঁকে অশ্লীলতা ও রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে হাতকড়া পরিয়ে কোমরে দড়ি বেঁধে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল । এ মকদ্দমা তিনি হাইকোর্টে জিতে যান । তাঁর ‘জখম’ কবিতাটি বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে । ১৯৬৮ সালে তিনি মধ্যপ্রদেশের রাজ্যস্তরের হকি খেলোয়াড় সলিলা মুখোপাধ্যায়কে বিয়ে করেন । বর্তমানে তিনি মুম্বাইতে কাণ্ডিভালি শহরতলিতে একটি বহুতলে একরুমের ফ্ল্যাটে সস্ত্রীক থাকেন । তাঁর মেয়ে, জামাই নাতনিরা বিদেশে থাকেন এবং ছেলে ও ছেলের স্ত্রী থাকেন রিয়াধে, সউদি আরবে ।

প্রশ্ন : নিজের লেখালিখির আপনি কি ভাবে মূল্যায়ন করেন ?
উত্তর: কোনো মূল্যায়ন করি না । যেমন খিদে পায়, ঘুম পায়, পেচ্ছাপ পায়, তেমন লেখা পায় বলে লিখি । খিদের যেমন মূল্যায়ন করি না, তেমনই লেখালিখির । মূল্যায়ন করতে হলে অন্যের ধরে থাকা আয়না দরকার । আমি তো নিজের জন্য অন্যের আয়নার প্রয়োজন বোধ করি না ।
প্রশ্ন : আপনার প্রথম লেখা এবং প্রথম বইয়ের অভিজ্ঞতা জানতে চাই ।
উত্তর : আমার প্রথম লেখা দুটি কবিতা, প্রকাশিত হয়নি, কেননা সেদুটি ছিল প্রেমানুভূতি ; একটি বাংলায়, স্কুলের উঁচু ক্লাসের সহপাঠিনী নমিতা চক্রবর্তীকে, যিনি আমার ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসে সুমিতাদি ; আরেকটি ইংরেজিতে, চুম্বনের দাম হিসাবে, স্নাতকস্তরে নেপালি সহপাঠিনী ভূবনমোহিনী রাণাকে, ‘রাহুকেতু’ উপন্যাসের রাণো । প্রথম প্রকাশিত লেখা ইংরেজিতে  ১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি ম্যানিফেস্টো, বাংলায় এপ্রিল ১৯৬২তে হাংরি ম্যানিফেস্টো। যে উথালপাথাল ঘটিয়ে ছিল তা কল্পনাতীত । সম্ভবত হ্যাণ্ডবিলের মতন বিলি করা কাগজে তখনও পর্যন্ত সাহিত্য করার কথা ভাবা হয়নি, আর হ্যাণ্ডবিলের মতন ছিল বলে দ্রুত পৌঁছে যেতে পেরেছিল সর্বত্র । প্রথম বই ছিল ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’ যে বইটি প্রকাশিত হবার পর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের উল্টোডাঙার বস্তিবাড়ির সামনে পেটরল ঢেলে পুড়িয়ে দিয়েছিলুম । বইটা বের করার ভার দিয়েছিলুম শক্তিদাকে; উনি ম্যাসাকার করে দিয়েছিলেন, কাউকে দিয়ে প্রূফ দেখাননি, নিজে দেখেননি, অত্যন্ত বাজে কাগজে ছাপিয়েছিলেন এবং পুরো পাণ্ডুলিপি কমপোজ করাননি । আমার উপন্যাস ‘রাহুকেতু’তে আমি ঘটনাটা দিয়েছি । তার পরের বই, যাকে প্রকৃত অর্থে বলা যায় পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া বই, তা হল ‘কৃত্তিবাস’ থেকে প্রকাশিত কাব্যগ্রন্হ ‘শয়তানের মুখ’,  প্রকাশক ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় । বইটি এবং আমাকে নিয়ে কলকাতায় হইচই হচ্ছে জেনে তিনি আমেরিকা থেকে ১৩ জুন ১৯৬৪ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে একটা চিঠিতে লিখেছিলেন, “আপনি মলয়কে এত পছন্দ করছেন -- কিন্তু ওর মধ্যে সত্যিকারের কোনো লেখকের ব্যাপার আছে আপনি নিশ্চয়ই মনে মনে বিশ্বাস করেন না ।” আবার কলকাতা ফিরে যখন দেখলেন যে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু আমার বিরুদ্ধে সরকার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেছেন, তখন উনি তুরুপের তাসটি খেলে আমার পক্ষের সাক্ষী হয়ে গেলেন ! জীবনের এমনতর ঘটনাকে কী বলবেন ?
প্রশ্ন : বাংলাসাহিত্যের কোন শাখা তুলনামূলকভাবে সমৃদ্ধ বলে আপনি মনে করেন ?
উত্তর: কবিতা তো অবশ্যই, এবং প্রবন্ধ । কবিতা লেখার জগতটা কারোর দ্বারা নিয়ন্ত্রিত থাকছে না, কলকাতার প্রাতিষ্ঠানিক কলকাঠি নাড়া সত্ত্বেও । আর এখন ইনটারনেট হয়ে এলাকাটা সম্পূর্ণ স্বাধীন ; শব্দ, বাক্য, ছন্দ, বিন্যাস নিয়ে যথেচ্ছ বিস্তার ঘটিয়ে চলেছেন তরুণ কবিরা, বিশ্বের বিভিন্ন ভাষায় যে কবিতা লেখা হচ্ছে, যেগুলোর ইংরেজি অনুবাদ পড়ার সুযোগ পাচ্ছি, তার পাশে বাংলা কবিতাকে রাখলেই ব্যাপারটা স্পষ্ট হয়। গল্প-উপন্যাস এখনও বিষয়নির্ভর হয়ে রয়েছে, আলোচকরা গপপো নিয়ে চিন্তিত, যেকারণে আমরা জয়েস, প্রুস্ত, কাফকা, ফকনার, মার্কাজের মতন গদ্যশিল্পী পাইনি; গল্প-উপন্যাসের বাংলা গদ্য এখনও ইউরোপীয় ভাষাগুলোর স্তরে তাই পৌঁছোয়নি ।
প্রশ্ন : বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির যুগে সাহিত্য জীবনে কতটা প্রতিফলন ঘটাতে পারে ?
উত্তর : প্রশ্নটা ঠিক বুঝতে পারলুম না । জীবনের প্রতিফলন সাহিত্যে ? নাকি সাহিত্যের প্রতিফলন জীবনে ? পশ্চিমবঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির এমনই হাল যে ভালো ফলাফল করলেই ছাত্ররা রাজ্য ছেড়ে অন্য রাজ্যে পালান, তারপর বিদেশে পালান । 
প্রশ্ন : আপনার প্রিয় লেখক সম্পর্কে কিছু বলবেন কি ?
উত্তর : সারা জীবন কেবল একজন তো আর প্রিয় লেখক হতে পারেন না ; বয়সের সঙ্গে, পাঠ-অভিজ্ঞতার সঙ্গে যাঁদের লেখার প্রতি আকর্ষিত হয়ে্ছি, তাঁরা পালটে যেতে থেকেছেন । তবে কিছুকাল আগে  যে বই দুটো আমি বহুবার পড়েছি তা হল ‘ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অফ সলিচুড’ এবং পামুকের ‘রেড’ । আমি কিন্তু বই সংগ্রহ করি না ; বইয়ের লাইব্রেরি নেই আমার । বই আর পত্রিকা পড়া হয়ে গেলে বিলিয়ে দিই । আমার কোনো স্টাডিরুম, লেখার টেবিল, পড়ার ঘর জাতীয় ব্যাপার নেই । আর আজকাল তো কাগজ-কলমও ব্যবহার করি না । যাঁরা বাড়িতে সাক্ষাৎকার নিতে আসেন, তাঁদের পিলে চমকে যায় ।
প্রশ্ন : আপনার নিজের প্রিয় লেখা কোনটা এবং কেন ?
উত্তর : ‘নখদন্ত’ নামে একটি সাতকাহন । রামায়ণ থেকে সাতকাহনের আইডিয়া আর মহাভারত থেকে গল্পের ভেতরে গল্পের ভেতরে গল্প টেকনিক প্রয়োগ করেছি, সেই সঙ্গে ব্যক্তিগত রোজনামচার টুকরো-টাকরা, আর পশ্চিমবাংলায় পাট চাষ-চট শিল্পের বিলুপ্তির রাজনৈতিক পৃষ্ঠপট । এটা প্রিয় এইজন্য যে এই বইটা লিখে আমি হ্যাপি ফিল করেছিলুম । 
প্রশ্ন : আপনার লেখালিখির পেছনে মূল প্রেরণা কি ?
উত্তর : এটা অ্যাডিকশান । অ্যাডিকশানের বোধ হয় প্রেরণা হয় না ।
প্রশ্ন : শর্তসাপেক্ষে লেখালিখি ছেড়ে দিতে বললে কি ছাড়তে পারবেন ?
উত্তর : জানি না ভারতের সাহিত্য একাডেমিকে লেখা আমার চিঠিটা বাংলাদেশে পৌঁছেচে কিনা । চিঠিটা আমি এখানে তুলে দিচ্ছি ; মনে হয় এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া আছে চিঠিটিতে ।
April 30, 2004
Prof K. Satchidanandan
Secretary
Sahitya Akademi
Rabindra Bhaban
35 Ferozeshah Road
New Delhi

Dear Sir
                      Refusal to accept Sahitya Akademi Award
           
          Thanks for your telegram dated 30.4.2004 conveying that my translation work of Dharmaveer Bharati’s “Suryer Saptam Asva” has been awarded the Sahitya Akademi Translation prize.
          I am constrained to refuse this award. As a matter of principle I do not accept literary and cultural prizes, awards, lotteries, grants, donations, windfalls etc. They deprave sanity.
          My decision to refuse the award is in no way to affront late Dharmaveer Bharati, who was a great admirer of my work, and had supported me during my literary ordeals in 1960s when most of the Bengali intelligentia had conspired against the Hungryalist movement. Your magazine the “indian Literature” itself had never bothered to write about this movement.
Sincerely
Malay Roychoudhury
আর কী শর্ত থাকতে পারে ?  জেনিফার লোপেজের সঙ্গে মহাকাশযানে করে অন্তরীক্ষে এক পাক খেয়ে আসা বা ক্যাটরিনা কাইফের সঙ্গে জাহাজের রেলিঙে দাঁড়িয়ে পেংগুইনদের সাঁতার দেখা ? 
প্রশ্ন : একজন লেখকের ভেতরের ‘মানুষসত্তাকে’ আপনি কিভাবে ব্যাখ্যা করেন ?
উত্তর : কোনো লোক লেখক হয়েছে বলেই তো আর তার ভেতরের মানুষসত্তাটা পালটে যেতে পারে না । সে লেখক না হলেও তার মানুষসত্তাটা যা ছিল তাই থাকবে । আসেপাশে লেখকদের যা সব কাণ্ড-কারখানা দেখি, তা থেকে স্পষ্ট যে তারা লেখক না হলেও ওই সমস্ত কাজ-কারবারই করত । আমি লেখক না হলেও মানুষটা আমি যা রয়েছি তা-ই থাকতুম । আমার সত্তা জিনিশটায় যদি বাইরের কোনো উপাদানের অবদান থেকে থাকে তাহলে তা শৈশবের বিহারি অন্ত্যজ আর দুস্হ মুসলমান অধ্যুষিত ইমলিতলা পাড়ার একলেকটিক পরিবেশ ; যেকোনো বাড়িতে যেকোনো সময়ে প্রবেশ করতে পারতুম, এমনকি পাড়ার মসজিদেও, যা বর্তমান ভারতীয় সমাজে অকল্পনীয় ।
প্রশ্ন : মৃত্যুকে আপনি কোন দৃষ্টিতে দেখেন ?
উত্তর : সত্যি বলতে কি, মৃত্যু সম্পর্কে আমি বেশ কনফিউজড ।
প্রশ্ন : লেখালিখি ছাড়া আর কি আপনার কাছে প্রিয় এবং অপ্রিয় ?
উত্তর : আমি খেতে ভালোবাসি । বয়সের কারণে নানা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে চলে গিয়েও যতটা পারা যায় খাওয়ার ব্যাপারটায় রদবদল করতে থাকি । আমি রাঁধতেও পারি । আমি আর দাদা রান্নাঘরে মাকে টুকিটাকি সাহায্য করার সময়ে অনেককিছু রাঁধতে শিখে গেছি । মাঝে ভেবেছিলুম যা রান্নার রেসিপি নিয়ে একটা বই বের করব, তা আর হল না । আমি বিরক্ত হই আমার একাকীত্ব বিঘ্নিত হলে, এমনকি আশেপাশের আওয়াজও আমার একাকীত্বকে নষ্ট করে বলে বিরক্ত হই । আমি বেসিকালি একজন লোনার, একা থাকতে ভালোবাসি ।
প্রশ্ন : সাহিত্যের বাইরে আরো একটি প্রশ্ন, আপনার বন্ধু এবং শত্রুকে কিভাবে মূল্যায়ন করেন ?
উত্তর : বন্ধু বলতে যা বোঝায় তা আর আমার নেই । স্কুল-কলেজে ছিল আমার তিনজন বন্ধু, সুবর্ণ-বারীন-তরুণ । তারপর থেকে আমি বন্ধুহীন । আমার একাকীত্বপ্রিয়তার জন্যই বোধহয় আমি বন্ধুহীন । এই এখন হঠাৎ যদি আমার স্ত্রীর কিছু হয়, এমন কেউই নেই যাকে ডাক দিতে পারব । অমন পরিস্হিতিতে ডাক দিতে হবে অ্যাম্বুলেন্সকে । শত্রুও নেই । কেনই বা কেউ শত্রুতা করবে ? লেখালিখির জগতে অনেকে অনেক কিছু লেখে আমার বিরুদ্ধে ; তার জন্য তাদের শত্রু তকমা দেয়া উচিত হবে না ।

সোমবার

মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা : জয়িতা ভট্টাচার্য

মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা : জয়িতা ভট্টাচার্য
বাংলা সাহিত্যে নারী কালি কলমের মতোই অনিবার্যনারী রহস্যময়ী,ছায়াবৃত,তার দেহবল্লরী তার মায়াময় রূপ সবই সাহিত্যের উপাদানচর্যাপদ বৈষ্ণব পদাবলির মূল রাধা কৃষ্ণ প্রেমলীলাকে ভক্তি একসঙ্গে দেখা হয়েছিলো
যদিও বাংলা সাহিত্যের প্রাচ্যের মতো কোনো পর্ববিভাগ যথার্থ রোমান্টিক যুগ,আধুনিক উত্তরাধুনিক যুগের স্পষ্ট বিভাজন নেই তবু লেখনশৈলীর ভাবগত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়

রবীন্দ্রনাথের কবিতায় আমরা প্রায় প্রথম নারীর গভীর ভূমিকা গুরুত্ব দেখতে পেলামতাঁর নারী কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কল্পনার নারী নয়তাঁরা তাঁর বাস্তব জীবনে মনোজগতে স্পষ্ট প্রভাব ফেলেছেন
অনুপ্রেরণাদাত্রী কাদম্বরী দেবীকে উদ্দেশ্য করে লিখেছেন অনেক কবিতা,কখনো স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর জন্য বিরহকাতর প্রেমের কবিতাযাদের স্পর্শ তাঁকে একদ- শান্তি দিয়েছেন, লিখেছেন তাঁদের নিয়েও কবিতা
"আঙিনাতে যে আছে অপেক্ষা করে
তার পরনে ঢাকাই শাড়ি,কপালে সিঁদুর "
আবার চিত্রাঙ্গদা নৃত্যনাট্যে কবি নারীর মাধুর্য শক্তিশালী রূপের প্রকাশ করেছেনকুরূপা সুরূপার মধ্যে অপূর্ব দোলাচল
“পূর্বে উল্লিখিত কবিদের সৃষ্ট নারীরা সকলেই যেন স্বপ্নফ্যান্টাসিতাদের বাস্তবের শক্ত মাটিতে ,কষ্ট যন্ত্রণা র লেশমাত্র ছোঁয়নাকেবল মাধুর্যজৈবিক ও জীবন জারিত নারীর কথা বলার ঝুঁকি কোনো কবি কিন্তু নেননি জনপ্রিয়তার বা বানিজ্যমূল্যের কথা ভেবে হয়তোবা!”
আরেকটু অগ্রসর হলে দেখা যায় কবি নজরুল ইসলাম নারীকে কবিতায় কখনো মাতৃরূপে পেতে আকুল হয়েছেন আবার প্রেয়সীর জন্য ব্যাকুলতা তাঁর বিরহের কবিতায় "প্রিয়া রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি/আঁখির পলকে মরুভূমি হয়ে গেল বনভূমি "স্বয়ং কবিতাকেই নারীরূপের কল্পনা করেছেন
 অন্যদিকে আধুনিক যুগে কবি জীবনানন্দ ভিন্ন মেরুতে থেকে নারীকে অবলম্বন করে কবিতা লিখেছেননারী সেখানে ইমেজারি পরমাপ্রকৃতির দ্যোতককখনো সুপ্ত কামনার প্রতীক কখনো বা শূন্য হৃদয়ের প্রতিচ্ছবিএভাবেই আজ বিশ্ব বাংলার এক ফ্যান্টাসি "বনলতা সেন" ক্লাসিক হয়ে গেছেন
"কোথায় গিয়েছ তুমি আজ এই বেলা
মাছরাঙাটা ভোলেননি দুপুরের খেলা
শালিখ করেনা তার নীড় অবহেলা
উচ্ছাসে নদীর ঢেউ হয়েছে সফেন
তুমি নাই বনলতা সেন"

পরবর্তী কালে আরেক নারী বিখ্যাত হয়ে গেছেন কবিতার মাধ্যমেতিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের " নীরা"নীরাকে তিনি দেখেননি তাঁর দেখা বিভিন্ন নারী সান্নিধ্যের কোনো কোনো মুহূর্ত দিয়ে গড়া এই আদ্যন্ত কাল্পনিক নারী

"নীরার শরীর খারাপ হলে সবার মন খারাপ হয়"
".....আজই কি ফিরেছ?
স্বপ্নের সমুদ্রে সেকি ভয়ঙ্কর মেদহীন শব্দহীন যেন
তিনদিন পর আত্মঘাতী হবে
হারানো আংটির মতো দূরে
তোমার দিগন্ত দুই উড়ুক্কু ডুবে কোনো
জুয়াড়ির সঙ্গিনীর মতো
অথচ একলা ছিলে,
ঘোরতর স্বপ্নের ভিতর তুমি একা"

সুনীল নিজেই দুঃখ করে বলেছেন তিনি অনেকবার চেষ্টা করেছেন নীরাকে রক্ত মাংসের মানুষী হিসেবে উপস্থাপন করতে কিন্তু তা প্রতিবার পেরিয়ে গেছে শিল্পীর সীমানা
নীরা একটা কনসেপ্ট হয়ে থেকে গেছেআবেগ বর্জিত কোনো শরীরী আবেদনবিহীন এক আইডিয়াল প্রেয়সী এবং তুমুল জনপ্রিয়

 পূর্বে উল্লিখিত কবিদের সৃষ্ট নারীরা সকলেই যেন স্বপ্নফ্যান্টাসিতাদের বাস্তবের শক্ত মাটিতে ,কষ্ট যন্ত্রণা লেশমাত্র ছোঁয়নাকেবল মাধুর্যকিন্তু এক প্রেয়সী সে বাস্তবিক তা হয় নাতারও পরাজয় আছে
ক্লেশ,বেদনা মাটির সোঁদা গন্ধে ভরা তার শরীর
সেই জৈবিক জীবন জারিত নারীর কথা বলার ঝুঁকি কোনো কবি কিন্তু নেননি জনপ্রিয়তার বা বানিজ্যমূল্যের কথা ভেবে হয়তোবা!
ফলে এইসব নারীকে ভাবতে গেলে কল্পনার আশ্রয় নিতে হয়ট্র্যাডিশনাল এলিটিস্ট কোনো নারী যার গমের মতো রং ,মসৃণ আজানুলম্বিত কেশ,কাজল আঁখি এসব মনে করে নেওয়া যায়
ঠিক এই এলিটিস্ট কনসেপ্ট টাই ভেঙে দিয়েছেন হাংরি আন্দোলনে পুরোধা পোস্টমডার্ন কবি ,সাহিত্যিকরা মলয় রায় চৌধুরী

তার প্রেমিকা " চুমু খেয়ে টিস্যু দিয়ে ঠোঁট মুছে নেয়" ,

"মাথা বেয়ে ওঠে বুনো মহিষের সিং
ঝড়ের মস্তি দিয়ে পাউডার মাখিয়ে দিস অবন্তিকা " বা হরিণের নাচের সঙ্গে কাতুকুতু ''এমন সব অতিবাস্তব নিত্য ব্যবহৃত শব্দ প্রয়োগ করার ঝুঁকি,এমন অভিনবত্ব বাংলা প্রেমের কবিতায় মেটাফর ব্যবহার করার ঝুঁকি বোধহয় একমাত্র মলয় রায় চৌধুরী নিতে পেরেছেন
 মলয় তাঁর কবিত্বের ভারী চোগাচাপকান ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে পাঠকের কাছে হয়ে উঠেছেন এক স্বাভাবিক কামার্ত প্রেমিকতাঁর সাহিত্য সত্ত্বা বিলীন হয়ে গেছে মানবসত্ত্বায়
আর তাই তাঁর প্রিয় নারী "অবন্তিকা"এক ব্যতিক্রমী উত্তরাধুনিক নারীমলয় অনায়াসে লেখেন,
"বোঁটায় তোর গোলাপ রং অবন্তিকা
শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা "(পপি ফুল)

"কবিতায় নারীদের মধ্য ইমেজারি, ফ্যান্টাসি বা শুধু মাধুর্য ভেঙে দিয়ে একমাত্র মলয় রায় চৌধুরী সৃষ্টি করতে পেরেছেন উত্তরাধুনিক নারী"অবন্তিকা " এক রক্ত মাংসের নারী তার যাবতীয় যৌনতা,রিরংসা,ক্রোধ .....তার কৃষ্ণকালো দেহ বল্লরী নিয়ে সে জৈবিক কবিতাযে কবিতা পুরুষ এমনকি নারী পাঠককে নড়িয়ে দেয়
"অবন্তিকা"কোনো মিথ নয় সে পাশের বাড়ির মেয়েটি ,সে ইমলিতলার নারী,সে অন্ত্যজ মুসলমান নারী অথবা লক্ষ্নৌ এর হারেম থেকে বিতারিত হতদরিদ্র নারী ,উপজাতি নারী
মলয় রায়চৌধুরীর অবন্তিকা তীব্র শরীরী
এই প্রসঙ্গে বলাই যায় মলয় রায় চৌধুরী জীবনের বাস্তবতাকে সাহিত্য করে তুলেছেনতা ইচ্ছে মতো ম্যাজিক রিয়ালিজম উত্তীর্ণ হয়েও সে জীবন্ত এক শারীরিক নারী
এর আগে কবিরা কাব্য সাযুজ্য শব্দ বেড়া টপকে যাবার সাহস পাননিকিন্তু অবন্তিকাকে মলয় রায়চৌধুরী টেনে হিঁচড়ে গেঁথে দিয়েছেন মাটির গভীরে
অবন্তিকা 'শরীরেই সার্বভৌম মননে নয় মনে করে যেসব মহিলা, মলয় তাঁদের অনায়াসে ডাকতে পারেন 'মুখপুড়ি'
অথচ পরক্ষণেই পড়ি
"শ্বাস ভ্যাপসা চোখের তলায় যুদ্ধ চিহ্ন এঁকে ডেথ মেটাল মাথা দোলাচ্ছিস"এর মতো যাদুবাস্তবতা
- তে যেভাবে দুর্গাকে বর্ণনা করা হয়েছে প্রায় সেভাবেই দুঃসাহসী এই কবি লিখেছেন,
"অবন্তিকা বললি তুই:
আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব
রেঁধে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো
ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভুজ!
লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল!
ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নীঁখুত বাতুলতা!
শ্রীধর দিলেন আয়তন!

আর তুই কী দিলি?অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর?

আমি বললুম :
আমি দিয়েছি প্রেম
অবন্তিকা তুই বললি
প্রেম আলো হয়ে বেগে আসে
আর তত বেগে চলে যায়"

অনবদ্য ভাষায় মলয় রায় চৌধুরী অবন্তিকা তাই আল্ট্রামর্ডান এক পরিপূর্ণ ইউনিভার্সাল নারীকবিতা নারী

পোস্টমডার্ন সাহিত্যে বাংলা কবিতায় নারীর এই ক্রম বিবর্তন কবিতাকে বিশ্ব সাহিত্য সম মানে উত্তোররণ করেছেন বিভিন্ন কবি যার পথিকৃত সেই আধুনান্তিক কবি রবীন্দ্রনাথ