শুক্রবার

একটি কবিতা : শুদ্ধ বসু

ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ আঙরাখার ভেতর চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছি না, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্হতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবষহ ঈশ্বরের পোঁদে চুমো খেতুম
কিন্তু কিছুই ভলো লাগছে না আমার কিচ্ছু ভালো লাগছে না
একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মূত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উৎসব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
দিতেই হবে শুভাকে
ওঃ মলয়
কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কী কোর্বো বুঝতে পার্ছি না
আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্হতা
যোনোকেশরে কাঁচের টুকরোর মতন ঘামের সুস্হতা
আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
আমি বুঝতে পার্ছি না কী জন্যে আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণচৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
জন্মমুহূর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ূটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাপতাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা আন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়
পুনরায় সবুজ তোশকের ওপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছি না
তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
কবিতার জন্যে আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
শুভা
আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে ?
কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি ?
কেন আমি রজোস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায় ?
অথচ আমার নীচে চিত আধবোজা অবস্হায়
আরামগ্রহণকারিণী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হি২স্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব
ওঃ এসমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
পায়জামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে-ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌনপর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখি আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার আপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি
( হাংরি বুলেটিন, ১৯৬৪ )
----------------------------------
( এই কবিতাটির জন্য ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ও কোমরে দড়িবেঁধে প্রথমে থানায় এবং থানা থেকে ছয়-সাতজন অপরাধীর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মলয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ মাস মামলাটি চলে প্রথমে নিম্ন আদালতে, যেখানে মলয়ের একমাস জেলের সাজা ঘোষিত হয় ও তারপর কলকাতা উচ্চ আদালতে, যেখানে তিনি বেকসুর ছাড়া পান। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত ও অজয় হালদার। পাঠকের হয়ত আশ্চর্য লাগবে, মলয়ের বিরুদ্ধে পুলিসের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। দুজন পুলিস ইনফর্মার, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু, ছিলেন পুলিসের ভুয়ো সাক্ষী, যাঁরা মলয়ের পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও কোর্টে জানান যে মলয়ের সঙ্গে তাঁদের বহুবার কফিহাউসে দেখা হয়েছে। সবচেয়ে লজ্জার যে দুজন হাংরি আন্দোলনকারী রাজসাক্ষী , অর্থাৎ অ্যাপ্রুভার, হয়ে মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন; তাঁরা দুজন হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ।এঁদের সাক্ষ্যের কারণেই নিম্ন আদালত মলয়কে সাজা দিয়েছিল ।)

চামচামঙ্গল : হাংরি আন্দোলনের নাম মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানের চামচারা

"... মধ্যস্বত্বভোগী কবি নামধারীরা ভালোই জানে কীভাবে সাফল্য পাওযা় যায় | এরা চায় পাঠকের ঘুম যেন না ভাঙে | জীবন্ত ভাষাকে এরা তাই বিকার বলে অস্বীকার করে | সাহিত্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এদের অতি গোপন এবং ঘনিষ্ঠ লেনদেন চলে | " শৈলেশ্বর ঘোষ ||



এই ছবিগুলিতে মধ্যসত্বভোগীদের সঙ্গে শৈলেশ্বর ঘোষকে দেখা যাচ্ছে প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানের অনুষ্ঠানে

একটি কবিতার জন্য : তাহসিন মল্লিক

একটি কবিতার জন্য ১৯৬৪ সালে মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মকদ্দমা করেছিল তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। মলয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে ও কোমরে দড়িবেঁধে প্রথমে থানায় এবং থানা থেকে ছয়-সাতজন অপরাধীর সঙ্গে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে কোর্টে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। মলয়ের বিরুদ্ধে ৩৫ মাস মামলাটি চলে প্রথমে নিম্ন আদালতে, যেখানে মলয়ের একমাস জেলের সাজা ঘোষিত হয় ও তারপর কলকাতা উচ্চ আদালতে, যেখানে তিনি বেকসুর ছাড়া পান। মলয়ের পক্ষে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত, সত্রাজিৎ দত্ত ও অজয় হালদার। পাঠকের হয়ত আশ্চর্য লাগবে, মলয়ের বিরুদ্ধে পুলিসের পক্ষের সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও উৎপলকুমার বসু। দুজন পুলিস ইনফর্মার, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু, ছিলেন পুলিসের ভুয়ো সাক্ষী, যাঁরা মলয়ের পরিচিত না হওয়া সত্ত্বেও কোর্টে জানান যে মলয়ের সঙ্গে তাঁদের বহুবার কফিহাউসে দেখা হয়েছে। সবচেয়ে লজ্জার যে দুজন হাংরি আন্দোলনকারী রাজসাক্ষী , অর্থাৎ অ্যাপ্রুভার, হয়ে মলয়ের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেন; তাঁরা দুজন হলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ।এঁদের সাক্ষ্যের কারণেই নিম্ন আদালত মলয়কে সাজা দিয়েছিল ।

মিথ্যার বেসাতি ! 'তিন বিধবা' প্রকাশিত হয়েছিল 'এষণা' পত্রিকায়, হাংরি লিফলেটে নয় । শংকর সেন

শৈলেশ্বর ঘোষ বলছেন :-
১৯৬৩ তে একটি লিফলেটে আমার ছোটো একটি লেখা, "তিন বিধবা" প্রকাশিত হলে, পুলিশি তত্পরতা শুরু হয় I ডিটেকটিভ ডিপার্টমেন্ট থেকে লোক কফি হাউসেই আমাকে এনিয়ে শাসানি দিতে থাকে I অনেকেই এই কবিতাটিকে অশ্লীল বলে মন্তব্য করে I
____________________________________________

তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছনায়
হে ঘোড়া, কলকাতায় তিন গেলাস স্বাস্থ্যসুধাপান
পরিত্রাণবিহীনতা হাসে পুরুষের নামাবলীগীতা
ধাতুধর্ম সাতবার গড়াগড়ি খায়- তিন বিধবা
দক্ষিনসাগরে বায়ুসেবী বেড়াতে যায়-
তেত্রিশ দেবতা ফলভোগী- চাষা মাশুল গুনে দেয়
পুণ্যচোর সদর দরজায়- গৃহস্থের মেয়েরা সব
আইবুড়ো ঘুম জেগে সারারাত খিল তুলে দেয়
পুরানগীতা পড়ে কুলধর্ম রক্ষা শেখে, ঘোড়া তুমি
রেশমগুটিপোকায় প্রেম দিলে হৃদয় কোথায় !
গীতাধর্ম পাঠ শুনে কুকুরের অশুকোষে ধাতুমুদ্রা জমে
ঘোড়া তুমি তেত্রিশ কোটি পুণ্যের গায়
নামাবলী লেখো হৃদয় কোথায় ?
তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্যধর্মহীন
রহস্যতলায় হে ঘোড়া
পরিবহনযোগ্য রাস্তা বহুদূর শূন্য পড়ে আছে !

( শৈলেশ্বর ঘোষের 'তিন বিধবা' কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল সতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত 'এষণা' পত্রিকায় । কোনো হাংরি বুলেটিনে নয় । )

শঙ্খ ঘোষের কোঁচা ধরে শৈলেশ্বর ঘোষের এসট্যাবলিশমেন্টে প্রবেশ : কৃশানু বসু

কবি শৈলেশ্বর ঘোষ।হাংরি আন্দোলনের অন্যতম কবি।
হ্যাঁ,ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল তাঁরও সঙ্গে।প্রায় দেড়দশক জুড়ে।অনেক স্মৃতি, ঋণও অনেক।তবু ভেঙে গেল, মুগ্ধতা কেটে গেল!দূরত্বও তৈরি হলো অনেকটা।দূরত্ব বাড়াতে হাজির হয়ে গেলেন তাঁর অনুগত চাকরবাকরেরা! যেমনটি হয়, যেমনটি হয়ে এসেছে এযাবৎ!
তবু অনেক ঋণ তাঁর কাছে।হাংরি এবং হাংরি ঘিরে ষড়যন্ত্র এবং পরিকল্পনাগুলির অনেক গল্প তাঁরই কাছে শোনা যে!
ভালবাসতেন গাঁজা।ভালবাসতেন হেনরী মিলার,আঁতোয়া আর্তো,নিজের প্রশংসা এবং স্তুতি।
সাক্ষাৎকার দেবার আগে, শর্ত রাখলেন,মলয় রায়চৌধুরী এবং 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' নিয়ে কোনো প্রশ্ন করা যাবেনা।মেনে নিলাম।বিরক্ত হলাম প্রথমবার।
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার কথা বলেছেন বরাবর।একইভাবে গভীর রাতে টেলিফোনে যোগাযোগ রেখে গ্যাছেন কবি শঙ্খ ঘোষের সঙ্গে।অন্যদিকে 'শৈলেশ্বর ঘোষ সংখ্যা'-য় লিখতে অস্বীকার করেছেন 'মহামান্য' অভিভাবক-কবি শঙ্খ ঘোষ!
হ্যাঁ, মৃত্যুর আগে সরকার পরিচালিত লিটলম্যাগাজিন মেলার উদ্বোধন করার
সুযোগও পেলেন তিনি।মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জির সঙ্গে ছবিও উঠলো তাঁর!
কবির মৃত্যুর পর এসব কথা বলা যায়?
যায়! যায়তো!
হ্যাঁ, শৈলেশ্বর দা!আপনার কবিতা নিয়ে কালও কথা হলো আর এক তরুণ বন্ধুর সঙ্গে।

বৃহস্পতিবার

বিপ্লবীদেরও কপিরাইট হয় : জীজা ঘোষ


কবি শৈলেশ্বর ঘোষের মেয়ে শ্রীমতি জীজা ঘোষ-এর কপিরাইট সম্পর্কিত চিঠি
২৬.১১.২০১৩
প্রতি : প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়
সম্পাদক : চন্দ্রগ্রহণ
৭ বরদাকান্ত রোড
দমদম, কলকাতা ৭০০ ০৩০


মহাশয়,
আমি, শ্রীমতি জীজা ঘোষ, স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষ-এর কন্যা, আপনার সম্পাদিত পত্রিকা 'চন্দ্রগ্রহণ'-এর 'হাংরি আন্দোলন সংখ্যা' ( শারদীয় ১৪২০, নবমবর্ষ, সংখ্যা ১৭, সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ )-য়, আমার বাবার কয়েকটি কবিতা, প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়াই । ইতিমধ্যে ফোনে আপনার সঙ্গে আমার কথা হয়েছে । তখনও যা জানিয়েছিলাম তা আবারও জানাই -- আপনি আমার বাবার মৃত্যুর পর আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া বাবার রচনাগুলি আপনার পত্রিকা 'চন্দ্রগ্রহণ'-এ ছেপে ঘোরতর অন্যায় করেছেন ।


আপনাকে আগেও জানিয়েছি, আবারও জানাচ্ছি যে, আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষের কোনো কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আর কোনো দিনও কোনো সংকলনে ছাপবেন না বা ছাপাবেন না । আমি আমাদের আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করে জেনেছি যে, কোনো কবি বা লেখকের মৃত্যুর পর ৫০ বছর পর সেটা জাতীয় সম্পত্তি হয় । তখন তাঁর রচনা যে কেউ ছাপতে পারে । 


আমি জানি, এ কাজ আপনি শ্রীমলয় রায়চৌধুরী ও শ্রীসমীর রায়চৌধুরীর দ্বারা নির্দেশিত হয়েই করেছেন । আমার বাবাকে জীবিতথাকাকালীন যাঁরা কুৎসিতভাবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় আক্রমণ করেছেন , তাঁদের সঙ্গে আমার বাবার কোনো সংকলনে কোনো লেখা থাক, এটা আমি বা আমার পরিবারের কেউ চাই না । আমার বাবা স্বর্গীয় শ্রীশৈলেশ্বর ঘোষ-এর এটাই ইচ্ছা ছিল । স্বাভাবিকভাবেই আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আমার স্বর্গীয় বাবার ইচ্ছার সন্মান জানাতে চাই ।


আপনাকে আবারও বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি যে আমার বা আমাদের পরিবারের অনুমতি ছাড়া আমার বাবার কোনো রচনা -- কবিতা, প্রবন্ধ ইত্যাদি আর ছাপবেন না বা ছাপাবেন না । এর পরও যদি না শোনেন তবে আমি ও আমার পরিবারের সদস্যরা আপনার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্হা গ্রহণ করতে বাধ্য হব ।


বিনীত নিবেদন
জীজা ঘোষ


যখন দেবী রায়ের সঙ্গে পথে-পথে হ্যাণ্ডবিল বিলি করতুম : মলয় রায়চৌধুরী

প্রথমেই বলে নিই যে হারাধন ধাড়া অর্থাৎ দেবী রায়ের কবিতা ও জীবন সম্পর্কে এম ফিল করছেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজিভাষার একটি ছাত্র। সম্প্রতি  তিনি দেবী রায়ের বাড়িতে গিয়েছিলেন এবং সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন, যেটি একটি আন্তর্জাতিক ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে। দেবী রায়ের কবিতাতেই, বাংলা ভাষায় প্রথম যুক্তিভাঙন দেখা দিয়েছিল, লেভেল জাম্পিং দেখা দিয়েছিল, চিত্রকল্পের ভঙ্গুরতা দেখা গিয়েছিল, ইমেজের ফ্লাক্স দেখা গিয়েছিল, এবং জীবনানন্দের পর তার কবিতায় মুক্ত সমাপ্তি ও মুক্ত সূচনার প্রাধান্য, কবিতার শিরোনাম দিয়ে কবিতা-বিশেষের বিষয়কেন্দ্র চিহ্নিত করেন না তিনি। প্যারিস রিভিউ, পোয়েট্রি, লন্ডন ম্যাগাজিন, লিটহাব ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত ইউরোপীয় কবিতাগুলো পড়লে আমার বক্তব্য স্পষ্ট হবে। সাবজেকটিভিটি-নির্ভর আমাদের বৈদ্যায়তনিক ও সাংবাদিক আলোচকরা এই ব্যাপারগুলো সম্ভবত বুঝতে পারেন না, কেননা বেশিরভাগ আলোচকই পড়ে আছেন মান্ধাতার “ভালো লাগা” দিনকালের ব্যক্তি-প্রাতিস্বিক দুনিয়ায়। সেই কারণেই দেবী রায় সম্পর্কে আগ্রহী হয়েছেন ইংরেজি বিভাগের ছাত্র, বাংলা বিভাগের নয়।

দেশ-ভাগের আগে উচ্চবর্ণের বাঙালি কমিউনিস্ট নেতারা পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিলেন।


আরেকটা কথা এখানে শুরুতেই বলে নিই; শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে মুচলেকা দিলেও দেবী রায় দেন নি, তিনি দুই ঘোষভাইয়ের মতন হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তার সম্পর্ক অস্বীকার করেন নি। রাজসাক্ষী এবং পুলিশের পক্ষের সাক্ষীদের মতন তিনি আমার বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দেন নি। আমার পক্ষে তরুণ সান্যাল, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, জ্যোতির্ময় দত্ত ও সত্রাজিৎ দত্তের সাক্ষ্য সত্ত্বেও আমার এক মাসের কারাদণ্ডাদেশ হয়েছিল রাজসাক্ষী ও পুলিশের সাক্ষীদের সাক্ষ্যের কারণে। জজসাহেব আমার পক্ষের সাক্ষীদের পাত্তা দেন নি।
বছরখানেক হলো দেবী রায়ের স্ত্রী মারা গেছেন, এবং সে-কারণে তিনি নিঃসঙ্গ বোধ করেন, ও একা সময় কাটাতে ভালোবাসেন। আমার সঙ্গে তার যোগাযোগ নেই; তিনি আমার সঙ্গে যোগাযোগ রাখা পছন্দ করেন না, যদিও গবেষকরা আমার সঙ্গে যোগাযোগ করলে আমি তাদের পাঠাই দেবী রায়ের বাড়িতে।
হারাধন ধাড়া নামে সমবয়সী এক যুবককে খুঁজে পেয়ে, ১৯৬১ সালে, কী আনন্দ যে হয়েছিল কী বলব; সেসময়ে লক্ষ করেছিলুম যে কবিতা, কৃত্তিবাস, শতভিষা, পরিচয়, উত্তরসূরী, ধ্রুপদি ইত্যাদি পত্রিকায় কোনো নিম্নবর্গের কবির লেখা প্রকাশিত হয় না। আঁচ করেছিলুম যে তারাও কবিতা পাঠান নিশ্চয়ই, কিন্তু সম্পাদক মশায়রা পদবী দেখেই বাদ দিয়ে দেন। তার আগে, ১৯৫৯-৬০ থেকে আমি আর দাদা একটা সাহিত্য-সংস্কৃতির আন্দোলনের কথা ভাবছিলুম; হারাধন ধাড়া নামটা পেয়ে আর যুবকটির সঙ্গে পরিচয় করে আন্দোলনটা ফাইনাল করতে দেরি হলো না। হারাধন ধাড়া বলেছিলেন যে সংসার চালাবার জন্য উনি চায়ের দোকানে হেল্পারের কাজও করেছেন, কাপডিশ ধুয়েছেন, খদ্দেরদের বকুনি সহ্য করেছেন। জীবনের সঙ্গে লড়াই করে তিনি ১৯৫৮ সালে স্কুল ফাইনাল পাশ করেন এবং ১৯৬০ সালে ইন্টারমিডিয়েট অফ আর্টস পাশ করেন। তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ কলকাতা ও আমি প্রকাশিত হয় ১৯৬৫ সালে, হাংরি আন্দোলনের সময়ে।
দেশ-ভাগের আগে উচ্চবর্ণের বাঙালি কমিউনিস্ট নেতারা পাকিস্তান সৃষ্টি সমর্থন করেছিলেন, কিন্তু যেই দেশ-ভাগের তোড়জোড় শুরু হলো, তারাই সবচেয়ে আগে পশ্চিমবাংলায় পালিয়ে এলেন, নিম্নবর্গের বাঙালিদের দিশেহারা করে দিয়ে। যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল, যিনি নিম্নবর্গের ছিলেন, তিনি তক্ষনি পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন নি, কেননা জিন্নাহ তাকে মন্ত্রীত্ব দিয়ে পূর্ব বাংলার নিম্নবর্গের বাঙালিদের নিজের সঙ্গে রাখার প্রয়াস করেছিলেন, ১৯৪৭ থেকে ১৯৫০ পর্যন্ত তিনি করাচিতে ছিলেন। পাকিস্তানে হিন্দুদের প্রতি অবিচার আর অত্যাচার প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছিল তাকে এবং শেষ পর্যন্ত ১৯৫০ সালে লিয়াকত আলি খানের হাতে পদত্যাগপত্র ধরিয়ে চিরকালের জন্য ভারতে চলে আসেন। এই উত্তরঔপনিবেশিক পটভূমিতে হাংরি আন্দোলনের সামনের সারিতে একজন নিম্নবর্গের প্রতিনিধি জরুরি ছিল।Debi
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের কারণে, উচ্চবর্ণের বাঙালিদের মতন, নিম্নবর্গের বাঙালিরা নতুন পূর্ব পাকিস্তানে থেকে গিয়েছিলেন, যা, আমার মনে হয়, এক বিরাট ব্লান্ডার ছিল। এখন ভারতে জাঠ, মারাঠি, গুজ্জরদের মতো ধনীরাও চাকরি ও শিক্ষায় কোটা চাইছেন। অথচ বহু বাঙালি, নিম্নবর্গের হওয়া সত্ত্বেও তা দাবি করতে পারছেন না, কেননা প্রথমত তাদের সংবিধানের নির্দিষ্ট তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় নি, দ্বিতীয়ত মণ্ডল কমিশনও তাদের পিছড়াবর্গের অন্তর্ভুক্ত করেন নি। বাংলাদেশ রাষ্ট্র হবার পর সেখানে নিম্নবর্গের হিন্দুরা যেকোনো ছুতোয় আক্রান্ত হন, তাদের মন্দির ভেঙে ফেলা হয়, তাদের প্রতিমা নষ্ট করে দেওয়া হয়।
হারাধন ধাড়াকে চিঠিতে লিখেছিলুম আমার স্কুলের সহপাঠী সুবর্ণ উপাধ্যায়ের পাইকপাড়ার আস্তানায় এসে দেখা করতে; সুবর্ণ তখন মনীন্দ্র কলেজে সবে পড়াতে ঢুকেছে, আর কলকাতায় গিয়ে উত্তরপাড়ার বসতবাড়ির বদলে ওর আস্তানাতেই উঠতুম। পরিচয় হবার পর হারাধন ধাড়াকে নিয়ে গেলুম পাটনায়। সেখানে দাদা আর শক্তি চট্টোপাধ্যায় আগে থেকে মৌতাত জমিয়ে ফেলেছিলেন। তার পরের গল্প সকলেই জানেন যে, হাংরি জেনারেশন নামে আন্দোলন শুরু করার তোড়জোড় আরম্ভ হলো। ১৯৬১ সালের পয়লা নভেম্বর আমি ইংরেজিতে লেখা একটা বুলেটিন পাটনায় ছাপিয়ে নিয়ে গেলুম হারাধন ধাড়ার বাড়ি, রইলুম দিনকতক উনার একঘরের বস্তিবাড়ির বাসায় আর আরম্ভ হলো হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের বুলেটিন বিলি। এখন লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদেরও পত্রিকা বিলি করেন, বিলি না করলে বোধহয় তাকে লিটল ম্যাগাজিন বলা যায় না। বুলেটিনে প্রকাশকের ঠিকানা দেওয়া ছিল হারাধন ধাড়ার হাওড়ার বস্তিবাড়ির।
কলকাতায় হারাধন ধাড়া নামের জন্য, যাতে হাংরি আন্দোলনের বিরোধিতাটা অমন একটা স্তর থেকে শুরু করা যায়, কফি হাউসে অনেকেই ওর নামটিকেই আক্রমণ করা আরম্ভ করলেন। হারাধন ধাড়া আমায় জানালেন যে উনি নামটা পালটে ফেলতে বাধ্য হচ্ছেন, আগেই ওই নামের জন্য তার লেখা সম্পাদকরা নিতেন না আর এখন তো হাংরি আন্দোলনকে আক্রমণ করার ওছিলায় তার নামকেই আক্রমণ করা হচ্ছে। হারাধন বাধ্য হয়ে এফিডেভিট করে নিজের নাম দেবী রায় করে নিলেন।
দেবী রায় নাম নেওয়ার দরুন হাংরি মামলার সময়ে আরেকটা সমস্যা দেখা দিয়েছিল। সেই সময়ের ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনার, যিনি আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও অনুসন্ধানের তদারকি করছিলেন, তার নাম ছিল দেবী রায়। তাকে বোঝানো হয়েছিল যে হারাধন ধাড়া ইচ্ছে করে তাকে হাস্যকর প্রমাণ করার জন্য নিজের নাম পাল্টে দেবী রায় করে নিয়েছেন। অথচ আমরা কেউ জানতুমই না যে ডিটেক্টিভ ডিপার্টমেন্টের ডেপুটি কমিশনারের নাম দেবী রায়, যিনি আবার ছিলেন কৃত্তিবাসের কবি তারাপদ রায়ের নিজের মেসোমশায়। তারাপদবাবুও তাকে উল্টোপাল্টা বুঝিয়েছিলেন। তারাপদবাবু যে হাংরি আন্দোলনের বিরুদ্ধে উল্টোপাল্টা কথা বলার দায়িত্ব নিজের আয়ত্তে নিয়েছেন তা ডেবোরা বেকারের দেওয়া সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়। ডেবোরা বেকার, যিনি ইংরেজি ভাষার ভারতীয় ঔপন্যাসিক অমিতাভ ঘোষের স্ত্রী, অ্যালেন গিন্সবার্গের ভারতবাস নিয়ে দ্য ব্লু হ্যান্ড নামে একটি বই লিখেছেন এবং তাতে হাংরি আন্দোলন নিয়ে উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন। তিনি কোনো হাংরি আন্দোলনকারীর সঙ্গে দেখা করেন নি, লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরিতে গিয়ে তথ্য সংগ্রহ করেন নি, তারাপদবাবুর দেওয়া তথ্যের ওপর নির্ভর করে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে উল্টোপাল্টা কথা বলেছেন।

দেবী রায়ের সাহচর্য ছাড়া হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা সম্ভব হতো না।


হারাধন ধাড়া নিম্নবর্গের হবার কারণে তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলুম, এই কথাটা লেখার জন্য দেবী রায় কয়েকটি পত্রিকায় আমার সম্পর্কে উনার রোষ প্রকাশ করেছেন; তাছাড়া ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে মে ১৯৬৫ পর্যন্ত গ্রেপ্তার হয়ে জামিনে থাকার কারণে সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড ছিলেন বলেও তিনি আমার উপর রুষ্ট, বলেছিলেন যে চাকরি চলে গেলে আত্মহত্যা করতে হবে। তবে উনার রোষ প্রকাশ শৈলেশ্বর ঘোষের পর্যায়ের নয়, যিনি সুযোগ পেয়েই আমার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করেছেন, যে কাজটা, শৈলেশ্বর ঘোষের মৃত্যুর পর তার তৈরি করে বাজারে ছেড়ে-যাওয়া চেলারা এখন করে। গ্রেপ্তার হবার পর কলকাতায় উনি জামিনদারও পাচ্ছিলেন না। শেষে তখনকার ‘মহেঞ্জোদারো’ পত্রিকার সম্পাদক সমীর রায় তাকে জামিনে ছাড়ান।
আমি একথা স্বীকার করি যে দেবী রায়ের সাহচর্য ছাড়া হাংরি আন্দোলন আরম্ভ করা সম্ভব হতো না দেবী রায়ের হাওড়ার বস্তিবাড়িতে সেসময়ে সকলেই লেখা জমা দিতে যেতেন, আর বস্তির রূপ দেখে ভিরমি খেতেন। আমার শৈশব কেটেছে পাটনার ইমলিতলা পাড়ায়, তাই বস্তিজীবনের সঙ্গে আমার ভালোই পরিচয় ছিল, কেননা ইমলিতলা ছিল বিহারি অন্ত্যজ আর অত্যন্ত গরিব মুসলমানদের পাড়া। দুর্ভাগ্যবশত, পরে যারা যোগ দিল, তারা দেবী রায়কেই হেনস্থা করা আরম্ভ করল, হাংরি জেনারেশন সংকলনগুলো থেকে দেবী রায়কেই বাদ দিয়ে দিল আর তার বদলে তাতে এমন সকলকে ঢুকিয়ে দিল যে পুরো ইতিহাসটাকেই ঝাপসা করে দেবার ব্যবস্থা করে ফেলা হলো।
দেবী রায়ের যে কতটা গুরুত্ব ছিল তা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের এই চিঠিটি থেকেই স্পষ্ট হবে, তখনও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় জানেন না যে হারাধন ধাড়া এফিডেভিট করে দেবী রায় নামে পরিচিত হতে চাইছেন :
মির্জাপুর, ৫ অক্টোবর ১৯৬৩
প্রিয় হারাধনবাবু
হাংরি জেনারেশনের জন্য লেখা পাঠালাম। প্লট, কনটেন্ট, ক্র্যাফ্ট—এসব বিষয়ে ডেফিনিশন চেয়েছেন, আপাতত অন্য কতকগুলো ডেফিনিশন পাঠালাম, ওগুলো পরে লিখব। প্রকাশযোগ্য কিনা দেখুন।
ছাপালে সবকটি একসঙ্গে ছাপাতে হবে—নইলে খাপছাড়া লাগবে। ছাপার ভুল যেন বেশি না থাকে, দরকার পড়লে অনুগ্রহপূর্বক একটা ফ্রেশ কপি করে প্রেসে দেবেন।
‘অমৃত’তে আমার বইয়ের যে বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছিল, দেখেছেন? নইলে পাবলিশারের কাছে গিয়ে তার একটা কাটিং পাঠাবার ব্যবস্থা করেন তো খুশি হই। ওই বিজ্ঞাপনটাই দেশে বেরোবার কথা আছে—যদি বেরোয় তার প্রুফটা কাইন্ডলি দেখে দেবেন। আনন্দবাজারে লেখকদের কোনো বিবৃতি বেরিয়েছিল নাকি? তাহলে তারও একটা কাটিং পাঠাবেন ।
সামনের মাসে বাড়ি পাল্টাব। আরো একমাস থাকব বা ততোধিক। সহজে যাব না। শরীর ভালো। ছোটগল্পে আবার লেখা দিতে পারলাম না, সম্ভব হলে ক্ষমা করবেন।
আগামী সপ্তাহে নতুন ঠিকানা পাঠাব। তার আগে চিঠি দিলে, কুমুদ বাঙলো, রুম নং ৫, টিকোর, চুনার, মির্জাপুর,—এই ঠিকানায় দেবেন। ‘আক্রমন’ বানান কী? ‘ন’ না ‘ণ’?
লেখাটা প্রকাশ হবার আগে আপনি ছাড়া কেউ যেন না দেখে। অনেক বাদ দিয়ে, খুব নরম করে, সবদিক বাঁচিয়ে লিখেছি, ভয় নেই।
হাংরি জেনারেশনের একটা সিম্বল করতে বলেছিলুম, তার কী হলো? ৫ নয়া পয়সা দাম করতে পারেন। কমাগুলো ভেবেচিন্তে দিয়েছি, ওইগুলোই আসল জিনিস যেন থাকে।
শেষের তারিখটা যেখানে আছে, ওখানে প্রকাশের তারিখ দেবেন।
‘অভিযান’ পূরবীতে হয়েছিল তো?
সুনীলবাবুকে (হাজরা) প্রীতি জানাচ্ছি।
ইতি
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
দেবী রায় (১৯৬৩)
দেবী রায় (১৯৬৩)
এই চিঠিটিতে হারাধন ধাড়াকে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় দেবী রায় নামে সম্বোধন করছেন। চিঠিটি বেশ মজার এবং দেবী রায়ের সঙ্গে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে একত্রে সম্বোধন করা হয়েছিল বলে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেশ ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে দেবী রায় তখনও হারাধন ধাড়া। দেবী রায় চিঠিটি হাংরি বুলেটিনে ছাপার বদলে সুবিমল বসাককে দিয়েছিলেন, কেননা সুবিমল বসাক তখন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামে হাংরি আন্দোলনের একটা পত্রিকা প্রেসে দিয়েছিলেন। বস্তুত এটি কেবল চিঠি নয়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের অসাধারণ সেন্স অফ হিউমারের প্রকাশ। প্রতিদ্বন্দ্বী প্রকাশিত হতেই, যাদের নাম এতে উল্লেখ করা হয়েছে তারা ধুয়ো তোলেন যে ব্যক্তিগত ছিঠি ছাপিয়ে সাহিত্যিকদের অপমান করা হচ্ছে। অথচ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এই লেখাটি একটি নিরীক্ষামূলক রচনা হিশাবে দিয়েছিলেন হাংরি বুলেটিনে প্রকাশ করার জন্য।
প্রিয় দেবী,
পরপর দুসপ্তাহ এলেন না, কোনো চিঠিপত্রও নেই। দোষ একটিমাত্র করেছি। এতদিনের বন্ধুত্বে একটি, আপনাকে লেখা দিই নি। এজন্যে যদি কিছু মনে করে থাকেন, আমার কিছু করার নেই। উৎপল আপনার ওখানে গিয়েছিল? প্রিয় উৎপল অনেকদিন দেখা হয় নি। রয়েড স্ট্রিটে উঠে গেছেন? আমি সুনীলের একটা চিঠি পেয়েছি। আমি খুব ভালো নেই। একদিন যদি চলে আসেন, ভালো হয়—আপনি তো শক্তির মতো ধান্দায় ঘোরেন না। আপনি চলে এলেই পারেন। বিটদের একটা পত্রিকা NOW ডাকে পেয়েছি। প্রেরক C. Phymell একজন কবি। 1537 N, To Peka, Wichita, Kansas, USA. একটা উত্তর দিন। ভাই শক্তি, দেশে কলাম ছাপানো ব্যাপারে তৈরি প্ল্যান কি successful হলো, অন্যান্য planগুলো, শংকর, বরেন, সুভাষ মুখো থেকে শুরু করে নরেশ গুহ স্টিল সুনীল, বুদ্ধদেব, নীরেনবাবু ইত্যাদি মিলিয়ে ও বিধু, রবীন দত্ত, শামসের সমেত ও অধুনা শংকর কী যেন (ছাড়পত্র সম্পাদক) প্লাস শরৎ, ভাস্কর, প্রনব প্রভৃতি নিয়ে যে বিরাট জাল ফেলেছিস, সেটা এবার তোল। আমরা আর কত সময় দাঁড়িয়ে থাকব? তারপরেও অপেক্ষা করতে হবে। আমেরিকাগামী প্লেনে দমদমে সি অফ করতে পারলে তবে আমাদের ছুটি। প্রিয় সুনীল, আপনার চিঠি পেয়েছি। আমার bedroom-এ উঁকি মারছেন কেন? আমার সমূহ বিপদ—এই প্রথম আমার মনে হচ্ছে, আমার দ্বারা বুঝে ওঠা সম্ভব হবে না এখন আমার কী করা উচিত, এখন এই প্রথম আমাকে অপরের উপদেশমত চলতে হবে। প্রিয় দীপেন, তোমার কী হলো? কোথায় থাক? তুমি জেনো আমার সব অপরাধের শাস্তি আমি ভোগ করছি। প্রিয় উৎপল, আপনি ছাড়া কারো সম্পর্কে এখন বন্ধুত্বের বোধ নেই। সুনীলের জন্য আছে, কিন্তু তা বোধহয় সে আমেরিকায় আছে বলে। শ্যামবাজার থেকে টুবি ধরেছি, দোতলা, মাঝেমাঝে বাসস্টপগুলির সুযোগ নিয়ে লিখছি। একদিন আসুন।
—আপনাদের সন্দীপন

শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিল।


প্রতিদ্বন্দ্বীতে এই রচনাটি প্রকাশিত হবার পর কলকাতার আঁতেলরা বেশ খাপ্পা হয়েছিলেন। সেন্স অফ হিউমারের অভাবে, যাদের উল্লেখ চিঠিটিতে করা হয়েছে, তারা মাঝখান থেকে খাপ্পা হয়ে উঠলেন আমার ওপর, কেননা হাংরি বুলেটিন ছাপাবার খরচ আমি বা দাদা দিতুম। প্রতিদ্বন্দ্বী যদিও সুবিমল নিজের মাইনের টাকায় ছাপিয়েছিল। আবু সয়ীদ আইয়ুব তো অ্যালেন গিন্সবার্গকে নালিশ ঠুকে বসলেন, “দ্য হ্যাভ প্রিন্টেড লেটার্স অ্যাবিউজিং ডিস্টিংগুইশড রাইটার্স ইন ফিলদি অ্যান্ড অবসিন ল্যাংগুয়েজ।” লেখাটা প্রকাশিত হবার পর সন্দীপনকে সবাই ঘিরে ধরলে উনি পুরো দোষটা আমার আর দেবী রায়ের ওপর চাপিয়ে দিলেন। কফি হাউসে টেবিলের তলা থেকে তাসের কার্ড বিলির মতন টেবিলের তলা দিয়ে নিয়ে নিজের বিয়ের কার্ড বিলি করলেন, দেবী রায়ও কার্ড পেল, আমাকে দিলেন না তিনি, এতই খাপ্পা হয়ে গিয়েছিলেন আমার ওপর। পরে জেনেছি যে তাকে লালবাজারে ডেকে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে জেরা করা হবেছিল বলে তিনি ঘাবড়িয়ে গিয়েছিলেন আর আমার বিরুদ্ধে স্টেটমেন্ট লিখে দিয়ে এসেছিলেন। হাংরি আন্দোলন মামলায় তিনি আমার বিরুদ্ধে পুলিশের পক্ষে সাক্ষী হয়েছিলেন। শৈলেশ্বর ঘোষ আর সুভাষ ঘোষ মুচলেকা দিয়ে আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়েছিল। আমার যে একমাসের কারাদণ্ডের সাজা হয়েছিল তা আমার বিরুদ্ধে যারা সাক্ষ্য দিয়েছিল তাদের কারণে। জজ সাহেব আমার পক্ষের কোনো সাক্ষীর বক্তব্যকে গুরুত্ব দেন নি।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তার চিঠিসাহিত্যটি বিভিন্নজনকে পাঠিয়েছিলেন বিভিন্ন রঙের কালিতে লিখে, প্রত্যেকের জন্য আলাদা কালি। চিঠিটি দেবী রায়কে সম্বোধন করা, কিন্তু আমেরিকা থেকে ১৫ জুন ১৯৬৪ সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে লেখা সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া থেকে তার ব্রাহ্মণ্যবাদী মানসিকতার ঝলক দেখা যায়, কিয়দংশ তুলে দিচ্ছি এখানে :
“এবার নতুন কী ঘটল বুঝতে পারলুম না। যে ছাপা জিনিসটার কথা লিখেছেন সেটা দেখলে হয়তো বুঝতে পারতুম। এবং এটা খুবই গোলমেলে—যে চিঠি আপনি চারজন বন্ধুকে একসঙ্গে লিখেছেন, যেটা চারজনকে একসঙ্গে পাঠানো যায় না, সেটা হারাধন ধাড়াকে পাঠালেন কী জন্য, বুঝতে পারলুম না। কিংবা আমার বোঝারই বা কী দরকার? আচ্ছা মুশকিল তো, আমাকে ওসব বোঝার জন্য কে মাথার দিব্বি দিয়েছে এই আষাঢ় মাসের সন্ধ্যাবেলা? আমি কলকাতায় ফিরে শান্তভাবে ঘুমাব, আলতো পায়ে ঘুরব—আমার কোনো সাহিত্য আন্দোলনের দরকার নেই।”
ইতোমধ্যে কলকাতায় আমাদের বিরুদ্ধে লালবাজারে অভিযোগ জমা হওয়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। কফিহাউসে গুজব ছড়ানো আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। পুলিশের দুজন খোচর, পবিত্র বল্লভ আর সমীর বসু আমাদের যাবতীয় লেখাপত্র, বুলেটিন, পত্রিকা নিয়ে গিয়ে জমা দিচ্ছিল লালবাজারের প্রেস সেকশানে। সে-সময়ের কফি হাউসের আবহাওয়া নিয়ে দেবী রায়ের এই চিঠি :
হাওড়া, সকালে, বাড়িতে
২২ জুন, ১৯৬৪
মলয়,
তুমি-আমি নাকি কলকাতায় অ্যারেস্ট হয়ে গেছি। চতুর্দিকে গুজব। কয়েকজন চেনা-হাফচেনার সঙ্গে দেখা হলে অবাক চোখে তাকাচ্ছে; ভাবখানা এই, ‘কখন ছাড়া পেলে।’ আমার তো এখন একতারা নিয়ে বাউল হয়ে বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে কলকাতায়। সবাই তালে আছে, ‘বাঘে ছুঁইয়ে দেবার’, পর্নোগ্রাফি প্রমাণ করার। সুবিমলকে মেসে কে একজন বলেছে, ‘দেখব কী করে হাংরি বুলেটিন বের হয়।’ সমীর রায়কে টেলিফোন করে ‘আমাদের দাদারা’ বাণী দেওয়ার তালে ছিল, কিন্তু বুঝে গেছে সমীর খচ্চর ছেলে, শালাদের কোঁচা খুলে নেবে। সমীরদার কী খবর? এদিকে পারিজা (পাতিরাম) খচে লাল। আমরা কেন ‘গনদা পরতিকা’ দিয়েছি ইত্যাদি।
শৈলেশ্বর বালুরঘাট থেকে ফিরেছে, দেখা করে নি, চিঠিও দেয় নি—ডাকে পাঠিয়েছি ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’। শৈলেশ্বররা লেখে এক, করে এক, বলে এক, ভাবে আরেক, ছোঃ। ‘এষণা’র ব্যাপারটা জেনে নিও।
চিঠি লিখো। লালমোহন বলছিল, ‘ছোটগল্প’ বেরোবে।
দেবী রায়
হাংরি আন্দোলনে যারা যোগ দিয়েছিলেন, তিরিশজনের বেশি, তাদের অধিকাংশকে, দেবী রায়ই ডেকে এনেছিলেন, এবং কলকাতায় অ্যারেস্ট হবার সম্ভাবনার কথা ছড়িয়ে পড়তেই বেশিরভাগই কেটে পড়েন। ১৯৬৩-এর প্রথম দিকে প্রকাশিত ইংরেজি ম্যানিফেস্টোতে তাদের নাম পাওয়া যাবে। সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ এনারা সকলেই দেবী রায়ের সঙ্গে দুর্ব্যবহার আরম্ভ করেন, এবং কেমন করে তাকে হাংরি আন্দোলন থেকে বের করে দেওয়া যায় তার ছক কষতে থাকেন, অথচ দেবী রায়ের আহ্বানেই তারা হাংরি আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। ২রা সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ দেওয়া নিজেদের মুচলেকায় তা স্বীকারও করেছিলেন শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ :
শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকার অংশ:
১৯৬৩ সনে সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া নামে একজন তার হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন। তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই।
সুভাষ গোষ :
আমার সঙ্গে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর পরিচয় হয়। সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায়। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি জেনারেশনের যে কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না। আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায়প্রকাশিত হয়।
শেষ পর্যন্ত তারা ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর ইত্যাদি পত্রিকা থেকে দেবী রায়কে ছাঁটাই করে দিয়েছিলেন। দেবী রায় সেই জন্য নিজে ‘চিহ্ন’ নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করেন। দেবী রায়কে যে কোণঠাসা করার চেষ্টা হচ্ছিল তা তার এই চিঠিদুটো থেকে স্পষ্ট হবে।
হাওড়া, ১০ মে, ১৯৬৬
শোনো মলয়,
কে আমার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করেছিল, ভুলি নি। লালবাজারে টেবিল ঠুকে অনিল ব্যানার্জি বলেছে ‘হেড কোয়ার্টার কোথায়?’ হোঃ হোঃ, শৈলেশ্বর বলেছিল, ‘আজ্ঞে পাটনায়’। তোমার খবর কী? আমার ওল্ড ফুল নামটা ব্যবহার করেছ—যা অতীতের তা যেতে দাও। খালাসিটোলায় সুভাষের কলার চেপে ধরতে বলে ওঠে, ‘প্রণবদা, দেখুন না, এরা কী করছেন আমাকে, একটা পান খাওয়ান না।’ হাঃ হাঃ, আরে সবই জানি। নিজের কবিতার স্বপক্ষে একটা কবিতা লিখছি।
দেবী রায়
বর্ধমান, ১০ জুলাই, ১৯৬৮
প্রিয় মলয়,
কিছুদিন আগে, সুবো আমাকে বলেছিল, আমার কবিতায় ‘সংহতির অভাব সম্ভবত’—পরিষ্কার লিখেছি, ‘প্লাস্টিক জীবন, সবুজ সূর্য’ কবিতার মধ্যে আমার কবিতাও পারম্পর্যহীন, এলোমেলো—অপ্রকৃতিস্থ। তোমার ‘কামড়’ এ-যাবৎ যত কবিতা আমি পড়েছি, তোমারই লেখা—ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয় সবচেয়ে ম্যাচিওর।
ফুলস্কেপের প্রায় আরো দিনকয় আগে আমি কৃষ্ণগোপালবাবুকে পোস্ট করলাম। ওতে লিখেছি আমাকে কী ঘোড়েল এবং বাবু বলে মনে হয়, এবং আরো যত খবরাখবর, যথা ত্রিদিব মদ্যপান করতে অস্বীকার করলে সুভাষ-শৈলেশ্বর ওরা ওর হাংরিত্ব নিয়ে হাসাহাসি করে—এটা আমিও লক্ষ করেছি। ত্রিদিবের তো জবাব দেওয়ার একটা কারেজ থাকা দরকার। ঐ মুহূর্তে গালগলা ফুলিয়ে বসে থাকলে কি হবে? কী জানি, আমি ওর অমঙ্গল কামনা করি না, বিশ্বাস করো। আগেকার চেয়ে আজ আমি অনেক বেশি জটিলতামুক্ত—complex বিহীন, কিন্তু ওকে লিখে প্রমাণ করতে বলো যে সে বেঁচে আছে, এ যাবৎ তার কোনো লেখা—তার দৃঢ় চরিত্রের ছাপ বহন করেছে কি? যে লিখতে পারবে তার পলিটিক্স না করলেও চলবে—আর এটাও খুবই সত্যি যে তুমি নিজেও কিছু-কিছু ভুল ও বোকামো করেছ। যার ফল তোমাকেই ভোগ করতে হবে, এবং এটাই তোমার নিয়তি, সিরিয়াসলি লিখে যাও, try to forget the past, যার যার দল তৈরি করার—তারা তা করার চেষ্টায় সময় খরচ করুক। আমি কারোর সম্পর্কেই আর মোহগ্রস্ত নই। যদি কেউ সিরিয়াসলি লেখে, হাজার শত্রু হলেও, আমি তার কথা পরবর্তী প্রবন্ধে লিখে যাব, এবং তার ব্যক্তিচরিত্রের কিছু খবরাখবর—এরা লেখে এরকম—এদের জীবনযাত্রা পদ্ধতি এরকম—এরা কথাবার্তা বলে আরেকরকম। শৈলেরশ্বর ৩২ পৃষ্ঠায় লিখেছে, ‘নিজের ভাইকে পর্যন্ত ভাই বলে স্বীকার করি না’, ২৬/২৭ পৃষ্ঠায় দেখো, ‘আমার ভাই খুব অসুস্থ; তোমার শুশ্রূষার জন্য আমি তোমাকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে ১০ পয়সার চা…’ কোনটা ট্রুথ? জোর করে কোনো কিছু বানিয়ে তুললে—ফাঁপিয়ে তুললে, তা টেকে না কোনোদিনই।

বন্ধুদের (?) ব্যবহারে আমি এতদূর মর্মাহত ছিলাম যে বিয়ে করার একটা প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম।


নিশ্চয়ই কোনো-কোনো লাইন শৈলেশ্বর মারাত্মক লিখেছে, যার যতটুকু প্রাপ্য সেটুকু সে পাবেই। আমিও দেবো। ১নং ফৌজ ম্যানেজার শক্তির পতন, ২নং মলয়, পতনের জবাবও আমি দেবো। এসব খেয়োখেয়ির মূল কারণ কি আনন্দবাজারের চাকরি আর পজিশন? আমি কোনো কিছুই ভুলি নি। ভুলে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কে আমার সঙ্গে কিরকম ব্যবহার করেছিল, করে যাচ্ছে, কী নিদারুণ mental depression-এর মধ্যে দিয়ে আমার দিন কেটেছে, আমি জানি, মাত্র দশ পয়সা নিয়ে কলেজ স্ট্রিট যাওয়া, খালি পেটে কফির পেয়ালার দিকে তাকিয়ে থাকা, দুনিয়ার লোকের কাছে টাকা ধার করা, বন্ধুদের খাওয়ার সময়ে হুট করে হাজির হওয়া—এসব আমি ভুলি নি। চাকরি চলে গেলে হয়তো আমায় সুইসাইড করতে হবে। বন্ধুদের (?) ব্যবহারে আমি এতদূর মর্মাহত ছিলাম যে বিয়ে করার একটা প্রয়োজন অনুভব করেছিলাম। সমস্ত ব্যাপারটাই ভুলে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু ভুলে যেতে পারি নি। আরো সহজ করে নেওয়ার জন্য আমাকে পার্টটাইম চাকরি করতে হয় এখনও। লেখাটাই আমার কাছে মূল পয়েন্ট।
আমি ঈশ্বর বা ট্রুথে যেমন বিশ্বাস করি, ঐ একই কারণে, সাহিত্যেও আমার বিশ্বাস—বিবাহেও অবিশ্বাস করি না।
সুভাষ-শৈলেশ্বর গরুর মাংস খায় না, অথচ ত্রিদিব মদ খেতে অস্বীকার করলে ওরা ওর হাংরিত্ব নিয়ে চ্যালেঞ্জ করে—যদিই সুবো শ্রীশ্রীঅনুকুলচন্দ্র চক্রবর্তীর কাছে দীক্ষা নেয় এবং ধ্যানের মারফত তার জীবনের গণ্ডগোল সারিয়ে তুলতে চায় বা ভুলে যেতে, কারোরই কোনো অধিকার নেই এসব নিয়ে ইনসাল্ট করার।
এ-সব নিয়ে আরো বিস্তারিত ২নং কিস্তিতে লিখছি। তোমার কিছু খবরাখবর পাঠাতে পারো, এবং আমার সম্পর্কিত চিঠিগুলো—কলকাতার।
একজন আধুনিক আমাদেরই বয়সী যে কী করে লেখে ‘তোমার সতীচ্ছদের জন্য আক্ষেপ নেই আমার’, আমি ভাবতেও পারি না। ২৬/২৮ বছর বয়সী কোনো যুবকের লেখা এ-কথা ভাবতেই আমার কুৎসিত লাগে।
—দেবী রায়
খালসিটোলায় কমলকুমার মজুমদার একবার দেবী রায়কে বলেছিলেন, ‘বাছা, ডিপ্লোম্যাট হও’। দেবী রায় কমলবাবুর উপদেশ মনে রেখে এই কবিতাটা লিখেছিলেন :
আগুনের কবিতা
ভিতরের আগুন আমাকে শান্ত হতে দেয় না
বাহিরের সব ওলোটপালোট ঘেয়ো অশান্তি
আগুনকে আরও উসকে দেয়!
—কেই বা পছন্দ করে উলঙ্গ জীবন?
…………”বাছা, ডিপ্লোম্যাট হও”

মলয় রায়চৌধুরী

জন্ম ২৯ অক্টোবর, ১৯৩৯। বিশিষ্ট বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক।

মলয় রায়চৌধুরীর ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ১০টি সমালোচনা গ্রন্থ এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে ‘শয়তানের মুখ’, ‘জখম’, ‘ডুব জলে যেটুকু প্রশ্বাস’, ‘নামগন্ধ চিৎকার সমগ্র’, ‘কৌণপের লুচিমাংস’, ‘অ্যালেন গিন্সবার্গের ক্যাডিশ ও হাউল গ্রন্থের অনুবাদ’ প্রভৃতি অন্যতম।

শিক্ষা : পাটনার সেইন্ট জোসেফ কনভেন্টে প্রাথমিক এবং রামমোহন রায় সেমিনারিতে ম্যাট্রিকুলেশানের পর অর্থনীতিতে সাম্মানিক স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

মলয় রায়চৌধুরী ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে, সাহিত্য অাকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

জীবন প্রতিষ্ঠান : শৈলেশ্বর ঘোষ

জীবন প্রতিষ্ঠান : শৈলেশ্বর ঘোষ

দুঃসময়ে আমাদের জন্ম কয়েক হাজার বছরের বিশ্বাস যখন নষ্ট হয়ে গেছে। যে মূল্যবোধগুলি প্রধানতঃ ভারতীয় জীবনকে একটা ইতিবাচক ভিত্তিভূমির উপর দাঁড় করিয়ে রেখেছিল তার আড়ালে কাজ করে যাচ্ছিল অবিশ্বাস ঘৃণা লোভ আর শোষণ প্রবৃত্তি—যাদের হৃদয় ও মন এই পাপগুলি দ্বারা পুরোপুরি কবলিত তারা শুধু নিজেরা মিথ্যা হয়েই থেমে থাকেনি, তাদের চারপাশে যারা আছে তাদেরকে মিথ্যায় রূপান্তরিত না করা পর্যন্ত তারা যথেষ্ট আনন্দিত হতে পারে নি। কয়েক হাজার বছরের হিন্দু সভ্যতা এবং দু’হাজার বছরের খ্রীষ্টিয় সভ্যতা মানুষের মানুষ-শোষণ প্রবৃত্তি সম্পর্কে কোন সচেতনতা দেখাতে পারে নি। পাপ ও দুঃখ সম্পর্কে অনেক কথা বলা হয়েছে, অনেক উপদেশ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সেগুলি কোন কাজে লাগেনি। অবৈধ ধারনার মতো ঈশ্বর ক্রমশঃ মানুষের কাছ থেকে দূরে সরে গেছে। ন্যায় ও সত্যের সামগ্রিক বিনাশের মধ্যে জন্ম আমাদের। জীবনানন্দ এই অবস্থাকে বলেছিলেন, অন্তিম বিশ্বাসের মুহূর্ত—আমার মনে হয় শূন্যতার এই অতলস্পর্শী অন্ধকারে অবিশ্বাসেরও চূড়ান্ত বিসর্জন হয়ে যায়।
 

অবিশ্বাসও একটা অবলম্বনের মতো কাজ করে অনেক সময়। ‘আমি অবিশ্বাসী’—এটা তো একটা বিশ্বাসই। ফলে বিশ্বাসের ধ্বংসের পর কিছু সময়ের জন্য অবিশ্বাস মানুষকে, ইতিহাসকে, ধরে রাখে। কিন্তু শূন্যতার অতলস্পর্শী খাদে যে পড়ে তার মধ্যে আর অবিশ্বাসও থাকে না—পুরানো মূল্যবোধগুলি ধ্বংস হবার সঙ্গে সঙ্গেই তার মৃত্যু ঘটে—সে রূপান্তরিত হয় পরম শূন্যে—এরকম ভয়ঙ্কর শূন্যের মধ্যে আমিও নিজেকে আবিষ্কার করি এবং বুঝতে পারি আমারও মৃত্যু সম্পূর্ণ হয়েছে। নিজের এই অবস্থা সম্পর্কে সচেতন হওয়া মাত্রই শুরু হয় যন্ত্রণা, অতল গুহা থেকে বেরোবার রাস্তাটা খোঁজা শুরু হয়—আমার কাছে এটা হ’ল জীবনের দিকে মৃতের অভিযাত্রা। আর এর প্রতি মুহূর্তের পরিস্থিতি ও ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া আমার রচনা। পুরানো ঈশ্বর মৃত এবং অপসারিত, সেই শূন্যে ঝলসে উঠছে বস্তুবিজ্ঞানের চমকপ্রদ আলোকছটা। চোখ ধাঁধিয়ে দিয়ে অন্ধকারের মাত্রাকে আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। আমার সুবিধা, আমার চারপাশের অধিকাংশ মানুষকে দেখছি তারা মিথ্যা হয়েই থাকতে ভালবাসে, ফলে আমি হয়ে যাই একা, আমার সমস্ত যন্ত্রণা একাই ভোগ করতে হয়, একাই খোঁজতে হয়—আমার জ্ঞানের ভিতর এই অভিজ্ঞতা কাজ করে যে আমার মৃত্যু হয়েছিল। কে আমাকে মেরেছিল? নিঃসন্দেহে বুর্জোয়া ব্যবস্থার অসত্য মূল্যবোধগুলি। এই সত্য বুঝে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হয়েছে মৃতের সক্রিয়তা। মৃত্যুর সমান এই শূন্যতার অন্ধকার চঞ্চল ও জীবন্ত হয়ে উঠতে থাকে আমার চেতনার সমসক্রিয়তায়। আমি মৃত কিন্তু মৃত্যু-সচেতন এই চেতনা আমাকে জীবনের দিকে নিয়ে যেতে চায়। সব হারিয়ে যে একদিন নিঃস্ব হয়েছিল আজ আর সে ততটা নিঃস্ব নয়, আজ তার আছে শূন্যতার চেতনা, গভীরতম অন্ধকারের অভিজ্ঞতা। এই অভিজ্ঞতা চেতনাই সে মানুষকে জানাবে। জানতে চাওয়াই তার অস্তিত্বের সক্রিয়তা। সার্ত্র যখন জাঁ জেনে সম্পর্কে বলতে গিয়ে লেখেন : মার্কস সমাজকে বদলাতে চেয়েছিল, র‌্যাবোঁ জীবনকে বদলাতে চেয়েছিল কিন্তু জেনে কিছুই বদলাতে চান না। জেনে যদিও এরকম কোন অভিপ্রায় প্রকাশ করেন নি কিন্তু তাঁর অভিজ্ঞতাজাত চেতনাকে তিনি মানুষের কাছে উপস্থিত করার প্রেরণা পেলেন কোথা থেকে—নিজের চেতনাকে মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চাওয়াটাই সক্রিয়তা। যে অভিজ্ঞতাজাত-চেতনা সমস্ত মানুষের মধ্যে ঢুকে পড়বে এবং তাদের চেতনা সমুদ্রে পরিবর্তনের সম্ভবনা জাগিয়ে দেবে। মৃত যখন নিজের মৃত্যু-সচেতন হয়ে ওঠে তখনই তার পুনর্জন্মের সূচনা—পাতাল নদীর মত বহমান এক জীবনের দিকে সে এগিয়ে যেতে থাকে। এটা একটা সক্রিয় কিন্তু অবচেতনের ইচ্ছা, ইচ্ছার সৃষ্টি তার অভিজ্ঞতা চেতনা রাজ্যে।
 
আমি জীবনের উপর থেকে কুয়াশার পর্দ্দটা সরিয়ে ফেলতে চাই, মিথ্যার এই আবরণটাকে সরিয়ে ফেলতে পারলে দেখতে পাব এক অন্ধকার সমুদ্রকে—প্রকৃত ঘটনাগুলিকে চিনতে পারবো, শব্দের আসল তাৎপর্য বুঝতে পারব, অন্তত চেতনায় অবচেতন জগৎ স্পষ্ট হবে—মনুষ্যত্বহারা কুঁকড়ে যাওয়া আজকের পৃথিবীর মানুষ এটা দেখতে চায়না। কিন্তু যার না দেখে কোন উপায় নেই, আমি এরকম একজন। দেখি, দেখতে চাই।প্রথমে যাত্রা অজানার দিকে, এরপর উল্টো দিকে। অজানা থেকে সত্যকে জানার দিকে। অজ্ঞান থেকে চেতনায়। শূন্য অবস্থা থেকে হয়ে ওঠা। অজানার অতলস্পর্শী গহ্বর থেকে উঠে আসা জানায়, জ্ঞানে। একই অস্তিত্বের মধ্যে এই ভ্রমণ, তবে সুখকর ভ্রমণ নয়। রক্তক্ষয়ী অন্তঃসংগ্রামের অভিজ্ঞতা, এই ভ্রমণেরই অভিজ্ঞতা। বুর্জোয়া মূল্যবোধ জনিত ক্লান্তি অবসাদ ও মৃত্যু চেতনায় আচ্ছন্ন অবস্থা থেকে মুক্তির খোলা আকাশে উঠে আসার এই চেষ্টা। যে মুক্তি আমারই কিন্তু তা অন্যদেরও হতে পারে। একই সঙ্গে ইন্দ্রিয় থেকে চেতনায়, চেতনা থেকে ইন্দ্রিয়ে স্বচ্ছন্দ ও বাধাহীন যাতায়াত। এই হ’ল আমার প্রকৃত স্বাধীনতা। আজ দেখছি পৃথিবী কেবলই ইন্দ্রিয়পরায়নতা ও বস্তুসীমার মধ্যে সংকীর্ণ হচ্ছে এবং নিজের ধ্বংসের সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করে তুলছে। ক্ষমতা-সুখ, স্বাচ্ছন্দ্যস্পৃহা আর হৃদয়ের জাড্য এই হ’ল আজকের মানুষের সাধনা। ভালবাসা—টাকায় কেনা যায়। জীবন—বাড়ি, গাড়ি আর ব্যাঙ্কে সুরক্ষিত। ইতিহাসের নির্মমতম সময় এটা। সমাজ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ লক্ষ ডালপালা ধরে ঝুলে আছে এইসব মানুষেরা—ঝুলতে ঝুলতে চলছে এদের হাগামোতা মৈথুন ক্রিয়া, বংশবিস্তার, ক্ষমতাবিস্তার, শোষণ ও খুনের ষড়যন্ত্র! প্রত্যেকে প্রাণপণে ধরে আছে এক একটি ডাল। যত ক্ষুদ্রই সে ডাল হোক না কেন। প্রতিটি মুহূর্তেই এদের আতঙ্ক, বুঝি ঐ ডাল হাত থেকে সরে যায় বা সরিয়ে দেয়া হয়। এই ভয় মৃত্যু ভয়ের সমান। এরা জানে প্রতিষ্ঠান থেকে ছিটকে যাওয়া মাত্রই ঘটবে সেই সর্বনাশ! তখন সে পতিত—মূল্যহীন, নামহীন। আবার এই প্রতিষ্ঠানের ডাল যারা ধরতে পারেনি তাদের মর্মন্তুদ কান্না, যারা ডাল ধরে ঝুলে আছে তারা শুনতে পাচ্ছে। এরা মানুষ-ভাইরাস! এদের কাজ হ’ল অন্যের জীবনকে নষ্ট করা, অন্যের স্বাধীনতা হরণ করা, অন্যের সম্ভবনার দুয়ার রুদ্ধ করে দেওয়া। এই রক্ত পিপাসুর দল জানে জীবনে তারা মাত্র একবারই মরবে, কিন্তু তা তাদের জানা দরকার যে তারা ইতিমধ্যেই মৃত। এরাই জীবনের যে কোন সুস্থ স্বাভাবিক প্রকাশ দেখামাত্র নিজেদের অহংসর্বস্ব দরজা ভালো করে এঁটে দেয়। এদের প্রতিষ্ঠান গণ্ডির বাইরে যা কিছু ঘটবে তাকেই এরা অপরাধ বলে চিৎকার করবে। এরা সমাজ প্রতিষ্ঠানের ডাল ধরে ঝোলে আর পায়খানা করে, এদের পায়খানার দুর্গন্ধে আবিল হয়ে উঠেছে পৃথিবীর বাতাস। প্রতিষ্ঠানের তোয়াক্কা না করে যে কিছু মুষ্টিমেয় মানুষ বেঁচে আছে তাদের শ্বাসকষ্টের কারণ এই। এদের পায়খানাতে ইতিহাসের আয়তন বেড়ে চলেছে। হায়, মানুষের ইতিহাস! আমাদের রক্ত আর চোখের জলে সন্তরণ এই ইতিহাসের। রক্ত? হ্যাঁ, সেই সব আত্মার—বিদ্রোহী ও সন্তের। চোখের জল? হ্যাঁ, আমাদের হৃদয়চক্ষু থেকে যে জল ঝরে। যারা দেখে তাদের চোখগুলি উপড়ে নেয়া হয়, হৃদয়ই চোখের কাজ করে, হৃদয়চক্ষু থেকে জল ঝরে। চক্ষুকোটর থেকে ঝরে আগুন। পৃথিবী তো আমাদের হৃদয়দৃষ্টি চিনতে পারে না এজন্য দীর্ঘশ্বাস… যারা গু থেকে রক্ত আলাদা করে নেয় তাদের মৃত্যুর মুখ্য কারণ এই-ই। এই অপরাধের ফলে গভীর, গভীরতর অন্ধকার ঘিরে ধরে আমাকে। ঈশ্বর নেই, কিন্তু মানুষ আছে, আছে মানুষের পৃথিবী—এটাই হ’ল এই পৃথিবীর চিত্র।
 
দুই
গভীর অন্ধকারের ঘুম থেকে নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দে জেগে উঠলাম আবার…
আমি অনেক দিন
অনেক অনেক দিন
অন্ধকারের সারাৎসারে অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থেকে
হঠ্যাৎ ভোরের আলোর মূর্খ উচ্ছ্বাসে নিজেকে পৃথিবীর জীব বলে
বুঝতে পেরেছি আবার
ভয়পেয়েছি
অন্ধকার, সে কোন আলোর নাম? পৃথিবীতে এমন সব ঘটনা ঘটে, এমন সমস্ত শব্দ উত্থিত হয়, সন্ধিতে সন্ধিতে এমন সব অতি গোপন ক্রিয়াপ্রতিক্রিয়া চলে, ফলে জীবনে কোন হিসাবই ঠিকমত মেলে না। এজন্য দুঃখ হয় অনেকের কিন্তু সুনিশ্চিত নিয়ম কখনই কারও জন্য দুঃখিত বোধ করে না। জন্ম-জীবন ও মৃত্যু—এই তিন পয়েন্টের জটিলতাই এই অন্ধকার। আমাদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দই এই অন্ধকারকে বহন করে। বিভ্রান্তিকর অবশকারী ধাঁধার মত জীবনের রাস্তাকে অস্বচ্ছ করে এই অন্ধকারই। এই অন্ধকারের মধ্য থেকেই ক্রমশ জেগে উঠতে থাকে মৃত আত্মা—নদীর চ্ছল চ্ছল শব্দই জীবনের ডাক, সেই ডাক যে শুনতে পায় সেই জানে জেগে ওঠার প্রকৃত অর্থ কি! তাকে বুঝতেই হয় পুনর্জন্মের এক প্রভাত অপেক্ষা করে আছে তার জন্য। কিন্তু সে কি পারবে সেখানে পৌঁছাতে? সংশয় নিয়েই চলমান হতে হয়—বাস্তবে তাকে জেগে উঠতে হয় সেই একই পৃথিবীতে কিন্তু চেতনার রূপান্তরিত আলোয় উদ্ভাসিত নতুন এক পৃথিবী। জীবনকে তখন আর ‘শত শত শূকরীর প্রসব বেদনার আড়ম্বর’ মনে হবে না, লোষ্ট্রের মত নিক্ষিপ্ত হয়ে সে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল কিন্তু নবজন্মের চেতনা তাকে গতিশীল এবং সক্রিয় করে তুলেছে। নিজের সম্পূর্ণ মৃত্যু দেখার পর সে ফিরে যাবে ঐখানেই যেখান থেকে তাকে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে ফিরে গিয়ে আর ভয় কিসের? ভয়ের উৎসেই তো সে গিয়েছিল—এইসব অভিজ্ঞতার পর আর ভয় থাকে না।
 
আমার পূনর্জন্ম যদি সম্পূর্ণ হয় তবে ‘মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখি দাঁড়াবার জন্য’ নির্দ্দেশ কেউ আমাকে আর দিতে পারবে না। যে পৃথিবীতে স্পন্দন, সংঘর্ষ, গতি, যেখানে উদ্যম চিন্তা কাজ—নিয়ত মৃত্যু যেখানে প্রতিটি মানুষকে চালনা করছে—সেই পৃথিবীর কাছে আমি মৃত, অনুপোযোগী। আমার হৃদয় থেকে মুছে গেছে ঘৃণা আর আক্রোশ।
 
সূর্যের রৌদ্রে আক্রান্ত এই পৃথিবীতে কোটি কোটি শূয়োরের আর্তনাদ-উৎসব চললেও আমাকে তা আর পীড়িত করতে পারবে না। সমস্ত দ্বন্দ্বের অন্তনির্হিত হাসি তখন আমি স্পষ্ট দেখে ফেলেছি। অন্ধকারের স্তনের ভিতর যোনির ভিতর অনন্ত মৃত্যুর মতো মিশে থাকে চাই না আর। এই অভিজ্ঞতার, এই সচেতনতার পর জীবন থেকে মৃত্যুর কাছে আশ্রয় ভিক্ষা করা আমার কাছে নিষ্প্রয়োজন। মূল্যবোধগুলির বোঝা থেকে মুক্ত হওয়া মাত্রই অন্ধকারের অতল যোনি গর্তে নিক্ষিপ্ত হয়েছিলাম, সেটা আমি চাইনি, সেটা ঘটেছে, এইটুকু জানি—সেখান থেকেই আবার উঠে আসার, জেগে ওঠার চেষ্টা—জেগে ওঠা স্মৃতিহীন বসন্তে!
 
আমিষ অন্ধকার : বাবা ছেলেকে বলছে তুমি সকলের মত ইতিহাসকে শ্রদ্ধা করতে শেখ, এই ইতিহাসই তোমার বর্তমান-ভবিষ্যৎ। চেয়ে দেখ কেউ হাগে আর কেউ সে গু বয়ে নিয়ে যায়। যে মাথায় গু তুলে নেয় সে তো আর মানুষ থাকে না, কেউ তাকে ছোঁয় না, ইতিহাস ওদের জন্য আলাদা বস্তি দিয়েছে—ওরা সেই বস্তিতে থাকবে, মাতলামি করবে বংশবিস্তার করবে—ইতিহাসের কলঙ্ক ওরা। কিন্তু তুই থাকবি সেই শ্রেণীতে, ইতিহাস যে শ্রেণীর দখলে! মা বলেছেন, মেনে নেয়াই ধর্ম। বাবাই তোমার পরিচয়, বাবার প্রতিবাদ করো না। ইতিহাসের অংশ হিসাবে নিজেকে প্রমাণ কর, এছাড়া তোমার অস্তিত্বের আর কোন অর্থ নাই। গর্ভ যন্ত্রণা পর্যন্তই তুমি সত্য ছিলে… আসুন আমরা একবার দেখি এই রোমান থিয়েটারে কি ঘটেছে : অন্ধকারের জরায়ুর মধ্যে এই থিয়েটারের অভিনয় চলছে—
 
প্রভুর খপ্পর থেকে পলাতক ক্রীতদাসকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছে সেখানে দর্শকদের দাবীমত তাকে একবার হিংস্র ঘাতকের সামনে ছেড়ে দেখা হবে। ক্ষুধার্ত হিংস্র পশুর দাঁতে বিদ্রোহীদের ছিন্নভিন্ন হতে দেখে ভয়ঙ্কর যৌনপুলক হচ্ছে দর্শকদের। বন্ধনছিন্ন ক্রীতদাসের তো দৃষ্টি ছাড়া আর কোন অস্ত্র নাই—হিংস্র পশুর প্রতিটি আক্রমণে দর্শকদের মুখের বীভৎস বিকৃতি ও চাপা শীৎকার—আর তখনই বেড়ালের মুখে ধরা ইঁদুরের মুখে হাসি। যতবার ঐ জানোয়ার হত্যা করে আমাকে ততবারই নতুন জীবন লাভ করি আমি, জানি, জিতব আমিই। প্রতিটি আক্রমণে ক্রীতদাসের দাস-চেতনাই ধ্বংস হবে, অবশিষ্ট থাকবে যেটুকু তাই তার প্রকৃত জীবন, অথ্যাৎ মুক্তি চেতনা। বন্ধছিন্ন ক্রীতদাসই কেবল ইতিহাসে গু আর রক্ত আলাদা করতে পারে। লুসিফার ঈশ্বরের সাম্রাজ্য পাপে ঢেকে দাও! জন্তু-মানুষ নিজের অরণ্য সীমাকেই স্বাধীনতার চৌহদ্দী বলে মনে করে, প্রবৃত্তির ক্রীতদাসেরা প্রভুদের মুখের হাসিকেই সূর্যের মত দেখতে চায়। প্রভু খুশী হয়ে পিঠে চাপর দিলেই চরিতার্থ তাদের জীবন। অমরতা এই ক্রীতদাসদেরই!! আমাদের শুধু শব্দহীন মৃত্যুহীন অন্ধকার ঘিরে রাখে, আর অন্ধকারেই ক্রমশ বীতকাম হই আমরা, অপরাধ-চেতনা থেকে মুক্ত হয়ে উঠে আসতে হয় আমাদের, সমুদ্র হৃদয়ের চিরন্তন পবিত্রতার কাছে।
 
তিন
ইতিহাস আমাদের বলেছিল : নিজের বিষ্ঠার দিকে তাকাবে না, নিজের যৌনাঙ্গ দেখাবে না—
দুর্ভাগ্য ইতিহাসের যে আমি তাই করেছি—
ইতিহাস বলেছিল, ভাল হও
শোষণ যুদ্ধ ধ্বংস ও মৃত্যু—এই তো ইতিহাস। জীবন প্রতিষ্ঠানের প্রধান মুখভঙ্গী এগুলিই। অসচেতন ভাবে ভাল হওয়ার অর্থই হ’ল এই প্রতিষ্ঠানের কাছে বলি হওয়া। এই ইতিহাসের উল্টোদিকের রাস্তা ধরতে হয়েছে সৃষ্টিশীল, মানুষদের—কবরের শৈত্য, শ্মশানের উৎসবের মধ্যে সুস্থভাবে শ্বাস নেয়া সম্ভব নয়। যেতে হয় এর উৎস পর্যন্ত।
ইতিহাস আমাদের বলেছিল : কবিতা-শিল্প, ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দান—কবি-শিল্পীকে ইতিহাস মাথায় তুলে রাখে, পুরস্কার দেয়, ইতিহাসে তুমিও জায়গা পাবে—সৌভাগ্যবশতঃ আমরা বুঝতে পারি এই বুর্জোয়া শিল্প-কবিতা মানুষের জীবনের দুর্ভাগ্যচেতনার, অর্থহীন ধাঁধার মধ্যে কোন আলোরশ্মি ফেলতে পারে নি। বুর্জোয়ার এই খেলা জীবনের অন্তর্গত অন্ধকারকে লুকিয়ে রাখার নিকৃষ্ট চালাকি মাত্র। তাই আমরা মনে করি জীবন অভিজ্ঞতার উলঙ্গ প্রকাশই কবিতা-সত্য। অভিজ্ঞতাই চেতনা সমুদ্রকে আলোকিত করে, এই আলোড়ন ও মন্থনের ফলে উঠে আসে জীবনের তলদেশে লুকান সত্যগুলি, আর ঐ সত্যগুলির মধ্যে থাকে আমার পরিচয়। জীবন-প্রতিষ্ঠানের অপরাধীরা এই অভিজ্ঞতাকেই ভয় পায়। লরেন্স বলেছিলেন—’পৃথিবী কোন নতুন তত্ত্বকে ভয় পায় না, ভয় পায় নতুন অভিজ্ঞতা।’ এই অভিজ্ঞতাই জীবন-প্রতিষ্ঠানের ধারক বাহকদের মুখ একেবারে হাট করে খুলে দেয়। যারা অপরাধী নয় এমন কিছু মানুষ তো নিশ্চয় আছে, এই অভিজ্ঞতাগুলি তারাও গ্রহণ করে, তাদের চেতনা-আকাশ আরও সত্য করে এই নতুন অবিজ্ঞতা। যে রচনা কোন নতুন অভিজ্ঞতা নয়, তা কোনসৃষ্টিই নয়।
 
মহত্বের পাগড়ী, করুণার নামাবলী, ইতিহাসের পেচ্ছাপখানা থেকে কোন জীবিত মানুষই তুলতে পারে না।
শেষ ধ্বংসের আগে অপরাধীর সবগুলি ইন্দ্রিয় একসাথে মুক্তি চাইছে আজ।
 
চার
তোমাদের আত্মপ্রদর্শনীই তোমাদের ভালবাসা। গ্রাস করাই তোমাদের ভালবাসা; আর যা গ্রাস করতে পারে না তার উপর পেচ্ছাপ কর—কিছুই ফিরিয়ে দিতে জান না তোমরা—নিষ্কলঙ্ক জীবনকে তোমরা ভয় পাও সবচেয়ে বেশি। তোমাদের অপরাধী আত্মা আতঙ্কে শূন্য হয়ে আছে—এই গ্রহটাকেই উড়িয়ে দিয়ে নিজেদের অপরাধ থেকে মুক্তি চাইছ তোমরা। নিজেদেরই ঘৃণা কর তোমরা, শেখাতে চেয়েছিলে আমাকেও তাই। তোমরা যা দেখনা আমি তাই দেখি, আমাকে তাই আক্রমণ কর তোমরা—তোমাদের প্রতি আক্রমণে আমি মরি কিন্তু হৃদয়চক্ষু দিয়ে সেই মৃত্যু ঘটনা প্রত্যক্ষ করতে পারি এবং তাকে প্রকাশ করতে পারি। নিজের মৃত্যু ঘটনা প্রকাশ করাই আমার বেঁচে ওঠা। এই মৃত্যু ও পুনর্জন্মই আমার ইতিহাস। আমি আর অন্য কোন মুক্তিতে বিশ্বাসী নই—প্রতিটি মৃত্যুর পর প্রতিটি জীবনই আমার মুক্তি। এখন কাজ একটাই—ফাঁসীকাঠে ঝোলান দড়িটা বিচারকের গলায় পরিয়ে দেওয়া।
 
পাঁচ
তোমরা সুস্থ পৃথিবীর কথা বল; কিন্তু পৃথিবী তো কোনদিনই সুস্থ ছিল না—প্রতি শিরায় যার অসুখ নাই তার নামই মানুষ। মানুষ এক বিশৃঙ্খল সংগঠন। তার মাথা যা ভাবে মুখ তা বলে না, হৃদয় যা অনুভব করে মাথা তা অস্বীকার করে, প্রকৃতি যা নির্দেশ করে কর্ম সে পথে যায় না, হাত যা করতে চায় মন তার প্রতিবাদ করে, মন যা স্বাভাবিক ভাবে হাত তা করতে দ্বিধা করে—এই সামগ্রিক বিশৃঙ্খলা, এই আবর্তিত দ্বন্দ্বের নাম মানুষ। কিন্তু বিশৃঙ্খলার মধ্যে দিয়ে এক কেন্দ্রিয় আবেগ কাজ করছে—সেই আবেগই কবিতা। জীবন বহমান আছে বিপরীতমুখী শক্তিগুলির ঘাত প্রতিঘাতে, ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায়। প্রকৃত সাহিত্য এই দ্বন্দ্বের ক্রমপ্রসারিত চেতনা। মানুষের ভিতরের নাটবল্টুগুলোর পারস্পরিক ধাক্কাধাক্কির যে প্রবলতর যন্ত্রণা, তা থেকে মুক্তি চায় মানুষ, ধর্ম তাকে একদিন এই মুক্তি দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। মানুষ অস্তিত্বের দ্বন্দ্ব, যন্ত্রণা ও অসুস্থতা থেকে পরিত্রাণ খুঁজেছিল ধর্মের মধ্যে আশ্রয় নিয়ে। অস্তিত্বের বিশৃঙ্খল ও বিপরীতমুখী প্রবণতাগুলিকে নিয়ম ও শৃঙ্খলে বাঁধতে চেয়েছিল ধর্ম। কিন্তু কোন ধর্ম আচরণ দ্বারাই মানুষের মুক্তি আসে নি। ধর্মপ্রাণ আর ধর্মহীন আজ মুখোমুখী দাঁড়িয়ে আছে এবং দু’জনের মুখাবয়কে আর আলাদা করা যাচ্ছে না। উভয়েই একই অপরাধ প্রক্রিয়ায় যুক্ত হয়ে পড়েছে। জীবনের আমিষ অন্ধকারকে অর্থদান করে তাকে স্বচ্ছ করে তুলতে ব্যর্থ হয়েছে তথকথিত ধর্ম-দর্শন। কবির অনুসন্ধানে এই সব দর্শন কোন আলোই ফেলতে পারে না। ব্যতিক্রম কিছুটা গৌতম, ভয়ঙ্কর অন্ধকারে নিজের শব ত্যাগ করে সে পুনর্জন্ম লাভ করে বুদ্ধ হয়েছিল।
 
কবির ধর্ম—আমি মনে করি আত্ম বিস্ফোরণ, আত্মাবিষ্কার ও আত্মউন্মোচন। অস্তিত্বের সামগ্রিক বিশৃঙ্খলাকে সত্য সৌন্দর্যে সাযুজ্য দান করে কবি নিজেই এক ধর্ম। দুরূহ পথেই তাকে আত্মধর্ম আবিষ্কার করতে হয়। আর অসত্যে জারিত জীবনকে আক্রমণ করে তবেই তাকে পৌঁছাতে হয় সত্য-ধর্মে।
 
বুর্জোয়া শোষণে আর পচামূল্যবোধগুলির চাপে আত্মবিশ্বাস হারিয়ে শূন্য হয়ে মানুষ আশ্রয় নেয় ধর্মগুরুর কাছে—আর বুর্জোয়া নিজেও নিজেরই মূল্যবোধে মিথ্যায় পরিণত হয়ে আশ্রয় করে ঐ এক ধর্ম আর ধর্মগুরু। শোষিত আর শোষক একই ঘাটে জল খেতে থাকে, এটাই হল বুর্জোয়া ইতিহাসের চমকপ্রদ অধ্যায়—তালগোল পাকান এক মিলন, যা থেকে সত্যকে বের করে আনা প্রায় অসম্ভব। জীবন প্রতিষ্ঠানের লুকান মুখটি হ’ল এই সব তথাকথিত ধর্ম। বুর্জোয়া ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য একের পর এক জীবন বিরোধী সংস্কারের জন্ম দিয়ে চলে তথকথিত এই ‘ধর্ম’। কবির মৃত্যু তখনই হয় যখন সে মাথা মুড়িয়ে ফ্যালে—ধর্মতত্ত্ব বা দর্শনের কাছে পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে—ব্যক্তিগত সমাধান চায়। যে কবি, তার কোন ব্যক্তিগত সমাধান নাই, কারণ সে আর কোন ব্যক্তি মানুষ মাত্র নয়। চলমান জীবনে তাকে হুটোপুটি খেতেই হয়, না হলে সে থেকে যাবে এক নঙর্থক শূন্যে। প্রবাহমান মানবচেতনার সক্রিয় অংশ সে—সেই প্রবাহমানতা থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া মাত্রই তার অপমৃত্যু। ব্যক্তিগত সমাধান নেয়া মাত্রই সে বিচ্ছিন্ন এবং মৃত। সে তখন সমাজ রাষ্ট্রের এক সাধারণ সদস্য—এছাড়া তার অন্য কোন পরিচয় থাকে না। কবি এজন্যই জীবন প্রতিষ্ঠানের মারাত্মক গ্রাস সম্পর্কে সচেতন থাকবেন। কবির কোন ব্যক্তিগত দুঃখ, ব্যক্তিগত যন্ত্রণা, ব্যক্তিগত কষ্ট থাকে না। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণা একাকীত্ব আনন্দ ভালবাসা ও ভালবাসাহীনতা—যা সে নিজের অভিজ্ঞতায় লাভ করে, সেগুলি সবই সমগ্র মানবচেতনার। কবি এই চেতনার প্রতীক। সে রূপান্তরিত চেতনা এবং সত্য-ধর্ম। জীবন প্রতিষ্ঠানে বুর্জোয়া-অপরাধ সম্পর্কে যার হৃদয়ে কোন ঘৃণার সৃষ্টি হয়নি, যে মনে প্রাণে এই ব্যবস্থাকে সেবা করে, পুরস্কৃত হয়, সে কখনই নিজেকে রূপান্তরিত করতে পারে না সত্যে। শব্দ দিয়ে ‘শিল্প’ সৃষ্টির দরকার হয় তারই। তথকথিত ধর্ম আর ‘শিল্প’ এগুলি জীবন প্রতিষ্ঠানের ছলনাময়ী হাসি মাত্র!
 
নিজের স্বাধীনতায় আমি হতে চাই আমারই ঈশ্বর—এক জীবনেই বহু জন্ম বহু মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পৌঁছাতে হবে এই লক্ষ্যে—মুক্তির, জ্ঞানের উপত্যকায়!
—ক্ষুধার্ত (১৯৮৪)

সুবোধ সরকার : আন্দোলনের 'এক্সপায়ারি ডেট' হয় ? [ হাংরি আন্দোলন ]

সুবোধ সরকার : আন্দোলনের 'এক্সপায়ারি ডেট' হয় ? [ হাংরি আন্দোলন ]

                                    


কবিতা লেখে একজন কিন্তু ফুটবল খেলে এগারো জন ।

আন্দোলন করতে লোক লাগে । পত্রিকা লাগে । চাঁদা তুলতে হয় । টাকা লাগে । কিন্তু যিনি লেখেন, তাঁর কিছু লাগে না । তাঁর লাগে একটা কলম, সাদা কাগজ, আর এক বাটি আগুন -- যেটা তাঁর মাধায় থাকে । যাঁরা দেখতে পান, তাঁরা দেখেন, লেখকের মাথা থেকে চুলের ভিতর দিয়ে মাঘ নিশীথের ধোঁয়া বেরিয়ে আসছে । 

বাংলা কবিতায় আন্দোলন হয়েছে, কিন্তু তেমন কোনও কাজে লাগেনি । গত পঞ্চাশ বছরে সবচেয়ে বড়ো আন্দোলনের নাম 'হাংরি' । 'টাইম' ম্যাগাজিনে  তার কাইনি ছাপা হয়েছিল, আবার এদিকে উচ্চ আদালতে উঠেছিল । এত বড় সৌভাগ্য আর কোনো সাহিত্য আন্দোলন উদযাপন করতে পারেনি ।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একটা চিঠি লিখছেন আয়ওয়া থেকে সমীর রায়চৌধুরীকে ।

আমেরিকার 'বিট আন্দোলন' ১৯৬৪ সালের মধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছে -- সেটাই জানাচ্ছেন সুনীল । তিনি লিখছেন, 'বিট আন্দোলন সম্পূর্ণ ভেঙে গেছে  -- সবাই বিচ্ছিন্ন, অনেকের সঙ্গে অনেকের ঝগড়া । একমাত্র অ্যালেনই আনকমপ্রোমাইজিং এখনও । বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গেছে -- এখন ওর নকল আন্দোলন আমাদের ভারতবর্ষে আরম্ভ হওয়া স্বাভাবিক । আমি আয়ওয়া ছাড়ছি ১০/১২ তারিখ । তারপর কিছুদিন নিউ ইয়র্ক । তারপর মার্গারিটের সঙ্গে দেখা করব প্যারিসে । তারপর যদি পয়সা থাকে লণ্ডন ও রোমে দু'চারদিন ।'

'গোখরোর আন্দোলিত উহুরু' নামে একটি গদ্যে মলয় রায়চৌধুরী চুরমার করে ছেড়ে দেওয়া একটি মন্তব্য করেছিলেন -- 'কবিতা হল আস্তিনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ । কবিতার বিষয়বস্তু এখন আমি । আমিই সিসমোগ্রাফ, আমিই ভূমিকম্প, আমিই ভাঙাচোরা খেতখামার।' এই কথা যিনি লিখতে পারেন, তিনি কবি নন, তিনি 'ঋষি' । কিছুটা হাত গোটানো, কিছুটা মস্তান, কিন্তু তিনি ঋষি এবং একজন হাংরি । এই মহৎ কথাগুলো বলে ফেলে মলয় কি হাংরি আন্দোলনের কফিনে শেষ পেরেকটি মেরে দিলেন ? কেননা তিনি নিজেই বলছেন, 'আমি মনে করি ১৯৬৫ সনে যেদিন পুলিশ আমাকে চার্জশিটের সঙ্গে শৈলেশ্বর, সুভাষ প্রভৃতির মুচলেকা দেয়, সেদিনই হাংরি আন্দোলন ভেঙে যায় ।' কী আশ্চর্য ! সুনীল লিখছেন এক বছর আগে আয়ওয়া থেকে, বিট আন্দোলন মরে ভুত হয়ে গিয়েছে । আর মলয় বলছেন হাংরি শেষ হয়ে গেল ।
                                                                 

সেই সময়, ১৯৬৪, মির্জাপুর স্ট্রিট থেকে একটি কুশ্রী লিফলেট ছাড়া হয় বাজারে, তার রচয়িতা ও প্রকাসক ছিলেন পাঁচের দশকের পাঁচটি ( তিনটিও বলা যায় ) শ্রেষ্ঠ ভূকম্পনের একটি -- 'ফিরে এসো চাকার' কবি বিনয় মজুমদার ।

কী লেখা হয়েছিল লিফলেটে ? একটি অংশ তুলে দিই :
'শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের অনিপুণ নপুংসকরূপ আশা করি এ যাবৎ পাঠাকপাঠিকা স্বচক্ষে দেখার সুযোগ পাননি । -- কবিটির জন্ম কি কুকুর আর গাধার সঙ্গমজাত ফল ?...রেকটাম বিট করে দিয়েচি বলেই এইসব কেঁচোবৃন্দ বীটনিক নাম নিয়েছিল।'

একজন বৃহৎ কবি আরেকজন বৃহৎ কবিকে এত খারাপ ভাষায় আক্রমণ করতে পারেন, আগে জানা ছিল না । তবে কে কাকে আক্রমণ করছেন, সেটা আমার বিষয় নয় । কবিরাই তো কবিদের সবচেয়ে খারাপ ভাষায় আক্রমণ করে এসেছেন সারা পৃথিবীতে । কবিরাই কবিদের সহ্য করতে পারেন না, কবিরাই আবার অন্যদের বলেন অসহিষ্ণু, গভীরে নেমে খোঁজ করলেই দেখা যাবে এসব ব্যক্তিগত কারণে । রাষ্ট্র, সমাজ, ধর্ম -- ওগুলো সব আসলে 'বাহানা'। মহম্মদ দারউইস বলেছিলেন : 'তোমার কুৎসা ওরা করতই, এতদিন অপেক্ষা করছিল একটা রাষ্ট্রীয় সংকটের জন্য, সংকটের সময় একজন কবিকে পেটানো অনেক সহজ হয়ে যায়, সংকটের জন্য কে দায়ী, সেটা তৎক্ষণাৎ বিচার করা যায় না, কিন্তু অন্ধকার ঝোপে লাঠি চালানো যায় ।'
                             

একটা আন্দোলন কি তুবড়ির মতো আকাশে উঠে, মাটিতে নামতে নামতেই ফুরিয়ে যায় ? একটা আন্দোলন কি 'এক্সপায়ারি ডেট'-সমেত জন্ম লাভ করে ?আমি সাহিত্যের ইতিহাসের ছাত্র হিসাবে লক্ষ করেছি আকাশে উঠতে এবং আকাশ থেকে নামতে এবং ছাই হয়ে ভস্ম হয়ে মাটিতে ঝরে পড়তে গেলেও একটা যুগ লাগে । নিজেকে বিনাশ করে ভস্ম নিজেই ঝরে পড়ে মাটিতে, কিন্তু মাটির পোড়া অংশ তখন ইতিহাসের নবীন মাথা তুলে ধরে । সেটা 'হাংরি' যেমন করেছে, 'শ্রুতি'ও করেছে । কিন্তু নাম হল 'কৃত্তিবাস'-এর । নাম হয়েছে 'কবিতা'র । এখানেই তো মজা ! 'কবিতা' কোনো ঘোষিত আন্দোলন করেনি । কিন্তু বুদ্ধদেব বসুর নেতৃত্বে 'কবিতা' হয়ে উঠল সবচেয়ে বড় 'গেম চেঞ্জার' । শত অপমানের ভিতর মাথা তুলে দাঁড়ালেন বরিশালের জীবনানন্দ দাশ । একাই হয়ে উঠলেন একটি জাতি । একাই হয়ে উঠলেন একটি ভাষা । একাই হয়ে উঠলেন একটি উপমহাদেশ ।

হাংরিদের সঙ্গে থেকে এবং নিজেকে আপৎকালীন অবস্হায় সরিয়ে নিয়ে সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় লিখেছিলেন, 'আমি বিশ্বাস করি একজন লেখক একাই তার মৌলিক ভাষাশৈলী নিয়ে একশো । সে নিজেই মানুষ, সভ্যতা এবং সমাজ বিপ্লবের স্হাবর নিদর্শন । কাজেই অনেকে মিলেজুলে ওভাবে হয় না ।'

অনেকে মিলে ফুটবল খেলতে হয়, মৃগয়ায় যেতে হয়, পাহাড় কাটতে হয়, কিন্তু ভাষা তৈরি করার সময় কেউ পাশে থাকেন না , তখন একজন লেখক একা এবং নিষ্ঠুর, তিনি জানেন তাঁকে বিরাট পাহাড়ের ভিতর নিজের গাঁইতি চালিয়ে একটা গুহা বানাতে হবে ।

গুহাগাত্রে প্রতিটি বাক্যের শেষে যেন তাঁর সই থাকে ।

আমরা জানি প্রতিটি বাক্যের শেষে কোনও লেখক সই করেন না, কিন্তু সই থেকে যায় ।
[ প্রতিদিন ( ছুটি ) পত্রিকায় ১৪ই মে ২০১৭ তারিখে প্রকাশিত ]

মঙ্গলবার

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : অধ্যাপক তরুণ মুখোপাধ্যায়ের বিশ্লেষণ

বিশ শতকের ষাট বা ছয় দশক বাংলা কবিতার ইতিহাসে যে কারণে স্মরণীয় হয়ে আছে, তার মধ্যে 'হাংরি আন্দোলন' অন্যতম, এ বিষয়ে দ্বিমত নেই । আর সেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম নেতা মলয় রায়চৌধুরী, যিনি আজও সৃজনক্ষম । কারো আনুকূল্য বা হাততালির প্রশংসা করেন না । ভুল কি ঠিক, সে বিচার করবে ইতিহাস বা মহাকাল । পরোয়াহীন এই লেখককে তাঁর নিজস্ব ভাষামুদ্রা ও ভঙ্গির জন্য অভিবাদন জানাতেই হয় । তথাকথিত বিপ্লবী কবি না হয়েও, কবিতার অস্ত্র প্রয়োগে তিনি সংগ্রামী কবি হতে পেরেছেন ।

১৯৬১ সালের নভেম্বরে হাংরি আন্দোলনের যে বুলেটিন প্রকাশিত হয়েছিল, সেখানে চোদ্দোদফা দাবি পেশ করা হয়। যার মধ্যে উল্লেখ্য :-
1. The merciless exposure of the self in its entirety.
2. To present in all nakedness all aspects of the self and thinking before it.
3. To challange every value with a view to accepting or rejecting the same.
4. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.
5. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.

আমরা জানি প্রথা ভাঙার এই স্পর্ধা তখন সরকার মানতে পারেনি । কাব্যে অশ্লীলতার জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে গ্রেপ্তার করা হয় ।

বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের পর নতুন সুর শুনিয়েছিলেন তিরিশের কবিরা । চল্লিশের কবিদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও প্রতিবাদী ভঙ্গি আরেকমাত্রা যোগ করেছিল । আত্মকথন ও আত্মরতিকে সম্বল করে অন্য রকম স্বাদ নিয়ে এলেন পঞ্চাশের কবিরা । আর ষাটের কবিরা, বিশেষভাবে 'হাংরি আন্দোলন' আমূল নাড়া দিল বাংলা কবিতার সনাতন ঐতিহ্যকে, নিয়মানুবর্তিতাকে । কবিতার ভাষায়, ছন্দে, অলংকারে, স্তবকে, তুমুল ভাঙচুর পাঠকের অভ্যস্ত চোখ ও কানকে বিব্রত করে তুলল । বিশেষত মলয় রায়চৌধুরীর লেখায় যৌনতার সঙ্গে এলো ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিষ্ফল যন্ত্রণা ।

কিভাবে মলয় রায়চৌধুরী তাঁর কবিতায় আত্মপ্রক্ষেপণ ঘটিয়েও নিরপেক্ষ হয়ে যান, সামাজিক ঘটনার দ্রষ্টা হন, নির্মম সমালোচনায় শাণিত ইস্পাত হয়ে ওঠেন, তাঁর কবিতাগুলি পড়লে টের পাওয়া যায় । তাঁর "কবিতা সংকলন"-এর নানা মেজাজের আটটি কবিতা আলোচনা করে তাঁর কবি কৃতি ও কবিস্বরূপ বুঝতে ও বোঝাতে চেষ্টা করা যাক । আলোচিত কবিতাগুলি হলো -- কামড়, ফুলিয়ার হাতটান, উৎখাত, তুলকালাম আত্মহত্যা, কপর্দকহীনতা, লোহার রড, রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা, প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ।

'কামড়' নামাঙ্কিত কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী যে ভঙ্গিতে ভারতবর্ষকে প্রশ্ন করেছেন, বিদ্রুপ করেছেন, পড়তে পড়তে মনে হয় সত্তরের কবি সুবোধ সরকার মলয়ের কাছে অধমর্ণ । ধান্ধাবাজ সুবিধাবাদী এই দেশের চরিত্র, মানুষের প্রকৃতি, নিপুণ ভঙ্গিতে তিনি তুলে ধরতে পেরেছেন--

আর কোল্কাতা এখন নিম রেনেসঁসের ভেতর দিয়ে কোথায় যাচ্ছে জানি না
ভারতবর্ষ দু'চারটে লেখা ছাপিয়ে দিন না উল্টোরথ, দেশ, নবকল্লোলে
আমিও মনীষী হয়ে যাই, কিংবা শান্তিনিকেতনে নিয়ে চলুন
সাহিত্যের সেবা করব, ধুতি-পাঞ্জাবি দেবেন একসেট
আজ বিকেলে চলুন খালাসিটোলায় বঙ্গসংস্কৃতি করি ।

শেষ পর্যন্ত মলয়ের সুতীক্ষ্ণ ব্যঙ্গ, "নিজের হৃৎপিণ্ড খেয়ে নিজের সঙ্গে রফা করে নিলে কেমন হয়"? এই ব্যঙ্গাত্মক মনোভাবেই তিনি দেখেন, "পায়রার বুকে টাইম বোমা বেঁধে শান্তির জন্য ওড়ানো হচ্ছে" ( ফুলিয়ার হাতটান ) । পিকাসোর আঁকা শান্তিদূতও আজ নিরাপদ নয়, প্রতারক -- অন্তত নেতাদের হাতে । এই মর্মান্তিক সত্য মলয়ই পারেন উচ্চারণ করতে ।

তাঁর অন্যান্য কবিতার মধ্যে পাই আত্মবীক্ষ্ণণ ও আত্মসমালোচনা । যেমন 'কপর্দকহীনতা' কবিতায় লিখেছেন--

আদালতের পেঙ্গুইনদের সঙ্গে খেলা করে এলুম
আমার এই কাঁতড়া চেহারা দেখে বুঝে নাও
প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না ।
*                 * *
কাঠমগজ কাঠমগজ
নিজেকে বিশ্বাস করা গেল না ।

ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার মিশেল এখানে আছে । আদালত ও পুলিশের ভূমিকায় ক্ষুব্ধ কবি ঠাট্টা করে বলেন,

এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়েছে
এক জোড়া পাকাচুল ধরে নিয়ে গেছে  ( লোহার রড )

পৃথিবীর আকার, আয়তনের অভ্যস্ত ধারণায়  ( 'পৃথিবী গোলাকার কমলালেবুর মতন' ) পদাঘাত করে মলয় লেখেন -- "অণ্ডকোষের কাছে বাড়া-কমা শিখছে পৃথিবী" । কিরকম জীবন তিনি কাটাচ্ছেন, কোন সমাজে ও পরিবেশে বাস করছেন, তারও ছবি অকপটে আঁকেন কবিতায় ---

চশমার কাচে চুয়ে পড়ে কুয়াশায় হাওয়া-ধোনা শিশিরের ধাতুরস
পিরানহা মাছের ঝাঁকে-ঝাঁকে সাঁতার কটি মনে হয় ( উৎখাত )

যাঁরা মনে করেন আত্মরতিই এই কবির আশ্রয়, ভুল করেন । চারপাশের জীবন ও জগতকে তিনি গভীরভাবে দেখেছেন । জেনেছেন । 'বেঁচে থাকা বা প্রেম' এবং মৃত্যু তাই সমার্থক হয় তাঁর কাছে আর বুঝে যান 'হৃদয় নামে কিছু নেই' । দ্রষ্টা কবির বোধিলাভ এইরকম ---

ছাপার অক্ষরের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেল এবার
সভ্য ও সংস্কৃতিবান হয়ে মানুষের লাভ হয়নি
মূর্খ বেড়েছে  ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

সংবাদনশীল ও সামাজিক একজন কবির পক্ষে এই অভিজ্ঞতা মর্মান্তিক । কবিতার শেষাংশে মলয়ের হাহাকার সহৃদয় পাঠককে স্পর্শ করে, কষ্ট দেয়--

এককালে সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
যুক্তি ছিল সত্য
ঈশ্বর ছিল সত্য
অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
যুক্তিহীন দেহে দায়িত্বরহিত চুমো
বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে ( তুলকালাম আত্মহত্যা )

এ যেন আলবেয়ার কামুর 'মিথ অফ সিসিফাস' -- অ্যাবসার্ড জগতে অস্তিত্ব-অনস্তিত্বের দ্বন্দ্বে রক্তাক্ত হওয়ার আর্তনাদ । এই সুরই যেন একটু অন্য ভাবে পাই 'রবীন্দ্রনাথের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা' কবিতায় । তথাকথিত রবীন্দ্রবন্দনা ও বিরোধিতায় না গিয়ে ষাটের কবি আত্মকথনে মগ্ন হন । চারপাশের যে ভাঙন, হত্যা, সন্ত্রাস, হৃদয়হীনতা -- দেখতে দেখতে কবি অস্হির হয়ে ওঠেন ।

হরিণের মাংস কাটা হয়েছিল কোদাল দিয়ে
আমার ছেলেমেয়েরা খরগোশের চোখ উপড়ে
                     খেলা করেছিল বেতলার দুর্গে

নতুন প্রজন্ম কিভাবে হিংসা ও হিংস্রতায় দীক্ষা নিয়েছে, এ যেন তারই দলিল । যেখানে রবীন্দ্রনাথের সত্য-সুন্দর-মঙ্গল ব্যর্থ । বেঁচে থেকে পৃথিবীকে মধুময় বলা আর সম্ভব নয় । অসম্ভব চলে যাবার আগে পৃথিবীকে প্রণতি জানিয়ে তারই মাটির তিলক কপালে এঁকে নেওয়া । বরং কবি বলতে পারেন --

অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে আমার লাশ বাঁচিয়ে তুলতে চাইছি
আমাকে ক্ষমা করুন ।

মলয় রায়চৌধুরীর খয়াত-অখ্যাতি ও প্রতিষ্ঠা যে কবিতার জন্য তার নাম 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' । যে কবিতার পরতে পরতে মিশে আছে যৌনতার আমিষ গন্ধ । ১৯৬৩ লেখা এই কবিতা যখন ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত হয়, তখন দেশকালের পরিস্হিতি কেমন ছিল, তা এক নজরে দেখে নিতে পারি ।

ক) চীনে পরমাণু বোমা বিস্ফোরণ ।
খ) দক্ষিণ আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যাণ্ডেলার কারাদণ্ড ।
গ) চিন-ভারত যুদ্ধে কমিউনিস্ট পার্টির বিভাজন ।
ঘ) হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ।
ঙ) প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর মৃত্যু ।

এই পটভূমিতে অতি-ব্যক্তিগত কবিতা লিখলেন মলয় । তাঁদের ইস্তাহারে যা বলেছিলেন -- Merciless exposure of the self বা  Nakedness of all aspects of the self --- এখানে তা পাওয়া গেল, কবিতার ভাষায়, গঠনেও প্রথাভাঙা হলো । মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ করলেন, অস্বীকৃত হলো Traditional form শুধু গদ্যকবিতা রূপে নয়, শব্দ ব্যবহারে তিনি নিজস্বতা মুদ্রিত করলেন । লিখলেন --- কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, কোল্কাতা, ওর্ফে, চুর্মার, জাফ্রান ইত্যাদি শব্দ । অকথ্য শব্দ ব্যবহারেও তিনি অলজ্জিত --- 'ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম' । কবিতার মধ্যে যৌন রসাত্মক শব্দ, বাক্য ও ভাবনা অজস্র ছড়িয়ে আছে । কয়েকটি বিচ্ছিন্ন পংক্তি উদ্ধৃত করছি ---

১. আমি জানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
২. শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমায়
৩. তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও
৪. আমাকে তোমার লাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ করতে দাও
৫. পায়জামায় শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে

শুভা নাম্নী নারীর কাছে এই ধরণের কাতরোক্তি কবি করলেও, আসলে যেন যৌনগাথা রচনা তাঁর উদ্দেশ্য ছিল না । যুগজ্বরে আক্রান্ত কবি যেন নিরাপত্তাহিনতায় ও আশ্রয় প্রার্থনায় আকূল হয়েছেন । যেমন, ষাটের আরেক কবি, ভাস্কর চক্রবর্তী নিরাশ্রয় মানসিকতায় বলেছিলেন, "শীতকাল কবে আসবে সুপর্ণা, আমি তিনমাস ঘুমিয়ে থাকব" । মলয় এই পলায়নী মনোভাবের বদলে অনুভব করেছেন, "নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই"। হতাশায় কবি বলেছেন, "কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই" । আমাদের সৌভাগ্য, মলয় রায়চৌধুরী কবিতার জন্য আজও বেঁচে আছেন ; যুদ্ধ করে চলেছেন । তাঁর সংগ্রামের হাতিয়ার কবিতাই ।