রবিবার

বাসুদেব দাশগুপ্ত সম্পর্কে অজিত রায়

শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের। চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না। প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, ছোটলোক আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা। আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি। প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক। ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি। সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা। পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল। এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন। এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়। বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন। এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মানং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো। অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।" আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন। প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল। উভয়ে মিশে গ্লোকাল। এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ। শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা। হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'। সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না। বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন। যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।

পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন। এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন। দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা। সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল। মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল। সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই। আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে। তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে। কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে। একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন। এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সমর সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি। সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়। এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে। হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'। শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত। তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'। কী ব্যাপার?? কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে। তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়। ধন্দ কাটে না। বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?' উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।

এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা। অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।

দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন। তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে। তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক। পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা। উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা। দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি। শবেবরাত। আখেরি চাহার শুম্বা।

আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট। আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন। সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।

ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা। ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে। অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।' এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল। এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন