বুধবার

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : পার্থ চট্টোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাঃ
কাব্যের নান্দনিক বোধকে ভেঙে খান্ খান্ করার অস্ত্র।
-পার্থ চট্টোপাধ্যায়
বিগত শতকের ষাটের দশক। বাংলা কাব্যের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য একটি দশক। এই দশকেই বাংলা কাব্যে জন্ম নিয়েছিল হাংরি জেনারেশানের কাব্য আন্দোলন। কবিতাকে জীবনের সাথে একীভূত করতে চেয়েছিলেন এই দশকের কবিরা। নিয়মকে ভাঙার ভেতর দিয়েই, প্রথাসিদ্ধ বস্তুকে বর্জন করার মধ্যেই এই আন্দোলনের কবিরা আনন্দ পেয়েছিলেন। হাংরির মুখপত্র হাংরি জেনারেশনের প্রথম বুলেটিনে এর কারণ বর্ননা করতে গিয়ে মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন-“কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্থ”। কারণ কবিতার মধ্যদিয়ে জীবনের অর্থ বের করার গতানুগতিক প্রয়াসের দিন শেষ। এখন কবিতার প্রয়োজন অনর্থ বের করার কাজে লাগবে। কবিতা প্রকাশ করবে, “মানবিক দৈহিক এবং শারীরিক ক্ষুধার কথা”। “মানুষ, ঈশ্বর, গণতন্ত্র এবং বিজ্ঞান পরাজিত হয়ে গেছে। কবিতা এখন একমাত্র আশ্রয়”।
উল্লেখ্য মলয় রায়চৌধুরী হাংরি শব্দটি নিয়েছিলেন কবি চসারের “In the sowre hungry tyme” পংক্তি থেকে। হাংরির সাথে রয়েছে ক্ষুধার সম্পর্ক। এই আন্দোলনকে অনেকেই ক্ষুৎকাতর সম্প্রদায় বলেও চিহ্নিত করেছেন। ক্ষুধা শুধু দেহের নয়। মনের। জীবনে এবং কাব্যে এই কবিরা পূর্নভাবেই অঘোর পন্থী। এই কবিদের প্রভাবিত করেছিল এ্যাংরি কবি গোষ্ঠির কাব্য চেতনা। বীটনিক কবিদের কাব্য এবং শৃঙ্খ্লাহীন জীবনবোধ। হাংরির কবিরা সঙ্গী করেছিলেন অ্যালেন গিনেসবার্গকে। যখন হাংরির কবিরা জেলে। কাব্য লেখার অপরাধে। সেই সময় উদ্বিগ্ন অ্যালেন প্রয়াসী হয়েছিলেন কবিদের মুক্ত করতে।
হাংরি আন্দোলন শুরু হবার দু’বছরের মধ্যেই পুলিশ তৎপর হয়। ১৯৬৪র ২ সেপ্টেম্বর এগারো জন লেখকের বিরুদ্ধে এফ.আই.আর করা হয়। দশ জনের নামে ওয়ারেন্ট বের হয়। গ্রেপ্তার ছয় দু’জন। একমাত্র সমীর রায় চৌধুরী ও প্রদীপ চৌধুরী ছাড়া বাকিরা পুলিশের ভয়ে সমস্ত দোষ মলয় রায়চৌধুরীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী “প্রচন্ড বৈ্দ্যুতিক ছুতার” কবিতার জন্য অপরাধী চিহ্নিত হলেন। আদালতে কেস উঠলো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয় রায়চৌধুরীর পক্ষে সাক্ষ দিলেন। প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট এ.কে. মিত্র মলয় রায়চৌধুরীকে দোষী চিহ্নিত করলেন। দু’শো টাকা জরিমানা হল। অনাদায়ে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড। হাইকোর্ট প্রমাণের অভাবে মলয় রায়চৌধুরীকে বেকসুর খালাস করে দেয়। এই ঘটনার পরেও মলয় রায়চৌধুরী হ্যাংরির দু’টো বুলেটিন বের করেন নিজের সম্পাদনায়। ১৯৬৬তে বের করেছিলেন ‘জেব্রা’ পত্রিকা। প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদনা করেন ‘স্বকাল/ফুঃ’’ পত্রিকা। সুবিমল বসাক ‘প্রতিদ্বন্দী’ ও দেবী রায় সম্পাদনা করেন ‘চিহ্ণ’’পত্রিকা। ১৯৬৮-র পরে হাংরি আন্দোলনের গতি প্রায় স্তিমিত হয়ে যায়।
হাংরি জেনারেশনের বাংলা কবিতা আন্দোলনের রাজাধিরাজ বলা যায় মলয় রায়চৌধুরীকে। মলয় রায় চৌধুরী জন্মেছেন ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে। জন্মস্থান বিহারের পাটনা।
২০০৪ এ ‘প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি’ প্রবন্ধে মলয় রায়চৌধুরী বলেছেন-“স্বদেশী আন্দোলনের সময় জাতীয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখন্ডে”। আর এই ভাবনাই একসময়ে মলয়কে হ্যাংরির মত আন্দোলনের জন্ম দিতে বাধ্য করে। উল্লেখ্  করা যায় ওসওয়াল্ড স্পেংলার লিখেছিলেন-‘The Decline of the West’ নামের একটি বইএই গ্রন্থের মূল বক্তব্যই হাংরির আন্দোলনকে প্রভাবিত করেছিল। ওসওয়াল্ড স্পেংলার বলতে চায়েছিলেন- কোন সময়ই কোন কালচারাল হিস্ট্রি সরল রেখায় চলে না। তার প্রসার ঘটে বিভিন্ন ধারায়। এটি জৈব্য প্রক্রিয়া। আর এই কারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁক বদল ঘটবে তা আগে থেকে বলা যায় না। যখন শুধুই নিজের সৃজন ক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই গ্রহণ করতে থাকে। মলয় রায়চৌধুরী ভেবেছিলেন দেশ ভাগের জন্য পশ্চিমবঙ্গ ভয়ানক অবসানের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। উনবিংশ শতাব্দির মনিষীদের মত আবির্ভাব এখানে অসম্ভব। তাই ডিরোজিওর পর্যায়েও  না হলেও হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। আন্দোলন দরকার আওয়াজ তোলা কর্তব্য।
১৯৬১।হ্যাংরির ইসতেহারে মলয় রায়চৌধুরী লিখছেন-
১. অ্যরিস্টটলের বাস্তবতাকে কখনও নকল করা হবে না, কিন্তু বলাতপ্রস্তুতির মাধ্যমে আচমকা জাপটে ধরতে হবে অপ্রস্তুত ছেনালি অস্তি।
২. নৈঃশব্দকে অটুট রেখে নির্বাককে বাস্তব হয়ে উঠতে হবে।
৩. ঠিক সেই রকম সৃষ্টি-উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃ্থিবীকে চুরমার করে পূর্নবার বিশৃঙ্খ্লা থেকে শুরু করা যায়।
৪. লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগাতে হবে।
৫. ফাঁস করে দেয়া হবে যে, কেবল কান্তি সত্তা হিসাবেই জীবন ও অস্তিত্ব স্বীকৃত।
৬. অন্যের প্রদত্ত বোধ-জ্ঞানের চেয়ে বরং সমস্ত রকম সন্দেহ ও অসহায়তাকে গ্রহণ করা হবে।
৭. দ্বিপদ-উন্নতিকামী প্রাণীদের তাবৎ মূল্যবোধকে আক্রমন করে ছারখার করা হবে
৮. চরম সততার উদ্দেশ্যে সব রকম চাটুকারদের মাগিদের শপৎ পূর্বক পরিত্যাগ করা হবে।
৯. আত্মাবিস্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেওয়া হবে।
মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সব্যসাচী লেখকদের অন্যতম। কবি, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক, সাংবাদিক হিসেবে তিনি সফল। তিনিই সম্ভবত প্রথম ব্যক্তি যাঁর হাতে বাংলা পোষ্টমর্ডান সাহিত্যের যথার্থ জন্ম
মলয় রায়চৌধুরীর কাব্য গ্রন্থের সংখ্যা দশটি। তার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য-“জখম”, “শয়তানের মুখ(১৯৬৩), আমার অমীমাংসিত শুভা (১৯৬৪), তুলকালাম আত্মহত্যা (১৯৬৫), মেধার বাতানুকুল ঘুঙুর (১৯৮৭), কৌনপের লুচি মাংস(২০০৩), পোস্টমর্ডান আহ্লাদের কবিতা(২০০১), আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ(২০০০), যা লাগবে বলবেন(১৯৯৬), ছত্রখান (১৯৯৫), চিৎকার সমগ্র(১৯৯৫), ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো ( ২০১৭ ) প্রভৃতি।
মলয় রায়চৌধুরী যখন কাব্য চর্চা শুরু করেছেন সেই সময় চীনে পরমানু বোমা বিস্ফোরণ হচ্ছে। দক্ষিন আফ্রিকার নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার জেল জীবন শুরু হচ্ছে। চীন ভারতের যুদ্ধ এবং কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজিত হচ্ছে ভারতে। হিন্দু মুসুলমানের দাঙ্গা চলছে। ১৯৬৪তে প্রয়াত হচ্ছেন জহরলাল নেহেরু।
এই টালমাটাল সময়ে কবিতা লিখতে এসে সরাসরি প্রথা ভাঙার খেলায় মেতে উঠলেন তিনি। পুরাতন ক্ষয়ে যাওয়া মূল্যবোধকে চ্যালেঞ্জ জানালেন। শব্দ ব্যবহারে নিজস্ব রীতির জন্ম দিলেন। অকথ্য শব্দকে কবিতার কারুসজ্জায় নিয়ে এলেন দ্বিধা ছাড়াই। নিয়ে এলেন যৌনতার খুল্লামখুল্ল প্রয়োগ।
‘প্রচন্ড বৈ্দ্যুতিক ছুতার’। বাংলা কাব্য সাহিত্যের একটি মাইলস্টোন। এই কবিতা লেখার অপরাধে অশ্লীলতার দায়ে দন্ডিত হন কবি মলয় রায়চৌধুরী। এই দীর্ঘ কবিতায় তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার অপশাসনের জন্য রাগের গন গনে আগুনে যেমন ফুঁসছেন; ঠিক তেমনি তাঁর ক্ষোভকে উগরে দিচ্ছেন মধ্যবৃত্তের ভন্ডামির দিকে। শ্লীলতার অশ্লীলতার সীমারেখা বলে সত্যি কি কিছু হয়? কবিতার মোটিভ যদি এমন শব্দের মধ্যে মানানসই হয় যা সমাজের ন্যাকা ভাবনায় অশ্লীল, তার দায় কবির নয়। প্রসঙ্গত চয়ণ করছি এই কবিতার কিছু অংশ। এই অংশগুলি প্রমান দেবে আমাদের বলতে চাওয়া বক্তব্যের সারবত্তাকে।
১. মা, তুমি আমায় কঙ্কা্ল রূপে ভূমিষ্ট করলে না কেন!
তাহলে আমি দুকোটি আলোক বর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
২. সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্ন ভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উতসব
৩. আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমার শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
৪. হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যু যৌন-পর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠ খেয়োখেয়ি।
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা পড়তে পড়তে অবাক হতে হয়, নিজেকে নিয়ে তিনি যেন শব ব্যবচ্ছেদের টেবিলে ছুঁরি কাঁচি হাতে চিরে চিরে দেখছেন ব্যবচ্ছেদি চিকিৎসকের মত। তা নয়তো কিভাবে এমন নিজের সমালোচনায় নিজে মগ্ন হতে পারছেন?
“আদালতের পেঙ্গুইনদের সাথে খেলা করে এলুম
আমার এই কাঁতরা চেহারা দেখে বুঝে নাও প্রজ্ঞাহীন হতে চেয়েও কিছু হল না”। ( কপর্দকহীনতা )
                                         শাসক ও শাসন যন্ত্র ভারতবর্ষের পক্ষে স্বাধীনতা লাভের পরেও কী ভয়ঙ্কর তা মলয়ের কবিতায় বারে বারে ধরা দিয়েছে। ‘লোহার রড’ নামে সেই প্রখ্যাত কবিতায় অনেকটা শ্লেষের সঙ্গেই তাই তিনি বলছেন-
“এদের পুলিশ আমার চুলে সরেজমিন তল্লাশি চালিয়ে
এক জোড়া পাকা চুল ধরে নিয়ে গেছে”। (লোহার রড)
মলয় রায়চৌধুরী পড়তে পড়তে তাঁর তীব্র শ্লেষের সাথে করমর্দনের বিষয়টি পাঠক হিসেবে আমি রসিয়ে রসিয়ে অনুভব করি। সমাজ নিয়মের বাঁধাধরা ছকের কোন বিষয় নিয়েই কি ব্যঙ্গই না তিনি করেছেন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত। যেমন একটি জায়গায় লিখছেন-
“এ দেশের শাসকদের বাঁধা লিউকোপ্লাস্ট মুখে বোবা থাকার অধিকার আমার আছে।
এ দেশের নেতাদের ফোঁপরা বক্তৃতা আর গালমন্দ শোনার অধিকার আমার আছে
এ দেশের অবোরোধকারীদের আটকানো পথে হার্টফেল করার অধিকার আমার আছে।
আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয় যে বাংলা ভাষা আমার স্বদেশ নয়”। (আমার স্বদেশ)।
শব্দ ব্যবহার থেকে শুরু করে শব্দের অমূল্য প্রয়োগে মলয় রায়চৌধুরীকে মনে রাখতেই হবে। কোর্বো, তর্মুজ, পার্ছিনা, চুর্মার-এভাবে নিজের মত করে প্রয়োগ যেমন করছেন। আবার তীক্ষ্ণ ফলার মত মেদহীন দু তিনটি শব্দে নিশানা করছেন পচে যাওয়া সিস্টেমকে। আসলে সিস্টেম হয়ে ওঠা নৈতিক-অনৈতিক পচা মূল্যবোধের ওপর তাঁর যত ক্রোধ। তাঁর যত অভিমান। একটি কবিতা তুলে আনছি এ প্রসঙ্গে-
“লেখা পায়। লিখি।।
খিদে পায়খাই।।
প্রেম পায়। করি।।
জ্বালা পায়। জ্বলি।।
নেশা পায়। গিলি।।
হাসি পায়। হাসি।।
ছোঁয়া পায়। ছুঁই।।
দেখা পায়। দেখি।।
রান্না পায়। রাঁধি।।
দান পায়। থুই।।
পড়া পায়। পড়ি।।
শোয়া পায়। শুই।।
হিসি পায়। মুতি।।
হাসি পায়। তুলি।।
ঘৃ্না পায়। করি।।
হাগা পায়। হাগি।।
হাঁচি পায়। হাঁচি।।
ব্যথা পায়। কাঁদি।।
পাদ পায়। পাদি।।
নাচ পায়। নাচি।।
গান পায়। গাই।।
                        শ্বাস পায়। হই।              (ইনসমলিয়া)।
কবিতাটি এখানে শেষ হতে পারতো। কিন্তু তা হলে অমোঘ সত্যটি বলা হত না। জীবনানন্দের নায়ক একা হতে হতে সমাজ বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। তারপর লাশকাটা ঘরে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন চিরদিনের মত। নির্বোধ পৃ্থিবীতে বোধযুক্ত মানুষের সমস্যার কথা বলতে গিয়ে জীবনানন্দ লিখলেন ‘বোধ’। যেখানে নায়ক একা হতে হতে বিচ্ছিন্ন হলেন সমাজ থেকে। এরপর হয়তো বা কবির মনে হয়েছিল বিচ্ছিন্নতার পরিনতি তবে কোথায়? কিসে? ফলে ‘বোধ’ এর উপসংহার লিখলেন ‘আট বছর আগের একদিন’ নামের কবিতায়। যেখানে সমাজবিছিন্ন মানুষটি আত্মহত্যা করে বিছিন্নতার যন্ত্রনা থেকে মুক্ত পেলেন। ‘ইনসমনিয়া’র শেষে এসে মলয় রায়চৌধুরী লিখলেন-
“ঘুম পায় না।
 স্বপ্ন হয় না।।‌”
টি.এস.এলিয়টের সংলাপ নির্ভর অসমাপ্ত কবিতা- Fragment of an Agon-এ ডোরিস এবং সুইনির কথোপকথনের ভেতর আছে-
Sweeney-Birth, and copulation and death.
That’s all thats all, thats all,
Birth, and copulation and death.
Doris- I’d be bored,
Sweeney- You’d be bored,
birth, and copulation and death
Doris- I’d be bored.
Birth, and copulation and death
that’s all the facts when you come to brasstacks:
Birth, and copulation and death
I’ve been born, and once is enough.”
বর্তমানে চূড়ান্ত যান্ত্রিক জীবনযাপনের সময়ে অন্তিম আশ্রয় সম্ভবত- Life is Death
আলোচিত কবিতার ঘুম না আসা, স্বপ্ন না হওয়ার অর্থই সেই Life is Death এর দিকে এগিয়ে যাওয়া। ‘তুলকালাম আত্মহত্যা’ কবিতার একটি অংশে এই ভাবেই লিখছেন-
“এতকাল সুন্দর ও শিব ছিল সত্য
যুক্তি ছিল সত্য
ঈশ্বর সত্য ছিল
অ্যাজটেকরা মৃত্যুকে সত্য বলে মনে করেছিল
এখন আত্মহত্যা ছাড়া সত্য নেই
মুন্ডহীন দেহে দায়িত্ব রহিত চুমো
                   বাঁচতে দাও কিংবা মরে যেতে”     (তুলকালাম আত্মহত্যা)
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় অকথ্য শব্দ প্রয়োগের ছুঁতমার্গ নেইশব্দ সেখানে আমার মনে হয় ব্রহ্ম হয়ে উঠেছে। যৌনতা এসেছে শিল্পের পোশাকে।
মলয় রায়চৌধুরীকে পড়লে আমাদের চিরকালীন নান্দনিক কাব্য বোধের দুয়ারে একটা ধাক্কা লাগে। কবিতার পূর্ন নুতন ভাষা যেন তিনিই সৃজন করলেন বাংলায়। ঠিক ঐতিহ্য বিরোধিতা নয়নিজের সময়ের উলঙ্গ বাস্তবতাকে তীরের ফলার মতো বিদ্ধ করাই তাঁর স্বপ্ন। তাঁর প্রতিজ্ঞা। সনাতন কবিতা বোধের যাবতীয় বাগানকে মত্ত হাতির মত দলে পিষে এগিয়েছেন মলয়। অকথ্য ভাষা, মুখের ভাষা, সংখ্যা দিয়ে রেখার বিনির্মান, ছন্দকে তছনছ করে ছন্দ মুক্তির প্রয়াস, নৈরাজ্যের আবহাওয়া বুক চিতিয়ে সিস্টেমের বিরোধীতা এই সমস্ত মিলিয়ে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা কবিতার ব্যতিক্রমী পথিক। চয়ন করছি কথাগুলির সমর্থনে কিছু রেখা-
(১) পাজামায় শুকিয়ে-যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলেছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে    (প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার)
(২) বীর্য না থাকাটা একধরনের শৌর্য            (বং)
(৩) শ্রীনন্দর বয় ইয়ং ল্যাড কুরুকেড মাইন্ড হার্ড
কহে আর সি ডি বার্ড এ পেলাকারড কৃষ্ণকেলি
হাফ ইংলিশ হাফ বাঙ্গালি                       (এই রে)
(৪) আয়রে সেঁদো গর্ভদ্বারে জিত আমাদের
হবেই হবে লাৎখোররাই জেতে।
জীবনানন্দের পরবর্তী সময়ে বাংলা কবিতায় এক অর্থে নতুনের সন্ধান বন্ধ যখন, মলয় রায়চৌধুরীর মত ছুটন্ত ঘোড়ার প্রয়োজন ছিল বাংলা কাব্যের প্রয়োজনে। তিনি এসেছিলেন কোন এক ভাঙনের পথে। রুদ্ধ রাতের মতো স্থবির বাংলা কাব্যের আঙিনায় যোদ্ধার বেশে এসেছিলেন মলয়। চমকে উঠেছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্রযন্ত্র। স্থিতধী পাঠক। কবিতা লেখার জন্য জেলে ঢোকানো হয়েছিল তাঁকে। দমানো যায়নি। ২০০৩ এ সেই রাষ্ট্রযন্ত্রই তাঁকে বাঁধতে চেয়েছিল অনুবাদ সাহিত্যে অকাডেমি পুরস্কার দিয়ে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার দিতে চেয়েছিল লিটিল ম্যাগজিন পুরস্কার। প্রত্যাখান করেছেন মলয়। এ সাহস তিনিই করতে পারেনএ সাহস তাঁকেই মানায়। আজীবন সৈনিক তিনিআঘাতে ক্লান্ত নন। আদরে গলে পড়ার লোক নন। কবিতার তলোয়ারে ‘সিস্টেম’ নামক স্থবিরতাকে সুযোগ পেলেই আঘাত করেছেন। বাংলা কাব্যের এই কান্তিহীন সেনাপতি শিখিয়েছেন পালিয়ে বাঁচার থেকে নখ দাঁত বের করে প্রতিপক্ষকে আক্রমন করার নামই জীবন। অকথ্য ভাষায় হোক আর
যৌনতার খুল্লামখুল্ল প্রয়োগেই হোক-রাষ্ট্র স্থবির হলে কবি সেনাপতি জেগে আছেন আঘাতে আঘাত করে আধ মরাদের বাঁচাতে।



তথ্যসূত্রঃ
(১)প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি- মলয় রায়চৌধুরী
(২)হাংরি আন্দোলন- উইকিপিডিয়া
(৩)হাংরি শ্রুতি ও শাস্ত্র বিরোধী আন্দোলনঃ ড. উত্তম দাশ
(৪)হাওয়া ৪৯- মলয় রায়চৌধুরী
(৫)অবহকাল।- মলয় রায়চৌধুরী সংখ্যা ২০০৩। সম্পাদনা- রতন কুমার বিশ্বাস।
(৬) মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ২০০৪-১৯৬১। আবিষ্কার প্রকাশনী।

****************

পার্থ চট্টোপাধ্যায়
গ্রাম+ডাকঃ জিরাট
জেলাঃ হুগলী

হাংরি আন্দোলনের কবি প্রদীপ চৌধুরীর কবিতা



“আমি কোন জেনারেশনের নই ...আধুনিক পৃথিবী এবং পৃথিবীর যাবতীয় জেনারেশন- প্রকৃতপক্ষে অধঃপতিত নষ্ট সর্বহারা ভীরু উন্মাদ নির্বাক চোর অন্ধ সন্ন্যাসী কমরেড অভিযাত্রী নষ্টদেহ গলিত অন্তকরণহীন যক্ষাক্রান্ত শুধুই-লাশ স্থাবর অস্থাবর প্রানীজগতের সকলের শিরা উপশিরার চেতন-অচেতন অবসেসড আত্মার এক অলৌকিক সামগ্রিকতার আমি এক খুবই ছোট অথবা অতিশয় বিশাল প্রতিবিম্ব মাত্র।আমি পাগল প্রতিভাবান দুটোর কোনোটাই নই,কারণ এই শব্দগুলির অর্থ আজো আমার কাছে পরিষ্কার নয়,যেরকম পরিষ্কার নয় ঈশ্বর শয়তান কবিতা পাপ সতত আদর্শ চেহারা বর্ণমালা এবং মানুষের কনসেপ্ট-অথবা এগুলি আমার কাছে আউটডেটেড হয়ে গেছে।আলাদা আলাদা ভাবে যে কোনো শব্দই  অর্থহীন”- পৃথিবীর সবুজ মাংসে দাঁড়িয়ে একজন কবি যখন ফর্মের সমাজ ফর্মের কবিতা ফর্মের আধামানুষ আর ফর্মের শিরাশরীরের বিরুদ্ধে টোটাল বন্ধ্যা ফর্মটার বিরুদ্ধে এতটাই স্পষ্ট হয়ে ওঠেন তখন স্পষ্ট হতে থাকে তাঁর ভানহীন কবিতাযাপন। কবিতার বাইরে আর একটা মানুষ তৈরি হয়,গোষ্ঠীর বাইরে। তাকে তখন আর সংরক্ষিত করা যায় না কোনো ভূমিকা কিংবা পরিশিষ্টে। তাই প্রদীপ চৌধুরীকে চিহ্নিত করতে গেলে আমাদের ফিরে ফিরে আসতে হবে এমনই এক আবহাওয়ায় যেখানে তিনি একটি জেনেরাশনের অন্যতম কান্ডারী আবার সেখানেই নিজের হাতে সেই জেনেরাশনের মৃত্যুও ঘোষনা করছেন তিনি-এ যেন শিল্প পেরোনো এক শিল্পী, যেন কবিতার দেশ দেশান্তরে ঘুরে বেড়ানো সেই পরবাসী পর্যটকটি যিনি শব্দের নগ্ন থেকে নগ্নতরের কাছে নতজানু হতে চাইছেন ,ফিরে ফিরে আসছেন শিল্পের অস্থির শৃঙ্গারগুলির কাছে,সুগন্ধ দংশনগুলির কাছে।কবি মাত্রই কুড়ানি,প্রত্যক্ষতায় বৃদ্ধি পেতে পেতে স্বেচ্ছাচারে পূর্ণ করে তোলেন তাঁর কবিতাযাপন।সেখানে তিনি তাঁর নিজস্ব স্বকীয়তাকেই বারবার চেতনার ক্ষুধা তেষ্টায় নবীকরন করতে থাকেন।সময়হীন গুহার ভেতর রেখে দিয়ে যান নিজেরই কবন্ধ শরীর আর কোলাহলপূর্ণ ছায়া।আর জীবনের দৃঢ়অর্গল দরজার সামনে দাঁড়িয়ে প্রদীপ চৌধুরী এমনই এক কবি এমনই এক সর্বহারা ,কবিতা ছাড়া যার চূড়ান্ত বলে কিছু নেই,কবিতাকেই তিনি করেছেন ‘আলটিমেট সিন্থেসিস’।কবিতার সর্বগ্রসী চক্রব্যুহ থেকে সংস্কার থেকে সচরাচর আমাদের পৌঁছতে দেরী হয়ে যায় যে অনুনভব একটা জাগরনের কাছে সেখানেই মাঝেসাঝে প্রদীপ চৌধুরীর মত মূল্যবোধ বিতরনী সভায় জামা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে আসা কিছু কবিকে পেয়ে যাই আমরা।প্রতিমূর্হতে কবিতা যার কাছে একটা আন্দোলন ,সন্ধি মূর্হতেও সিঁড়ি ভাঙ্গার মূর্হুতেও যিনি কবিতায় খুঁজে চলেছেন “জীবন থেকে জীবনের যাবার বাকী ইতিহাস”।
সুরক্ষিত ছন্দময় কবিজীবন তো প্রদীপ চৌধুরী কখনই চাননি বরং চেয়েছেন অতন্দ্র প্রহরীর অধিকার চেয়েছেন শিল্পের চৌহদ্দীতে লেগে থাকা মায়ানগরীর ছাইভস্ম সরাতে,চেয়েছেন সাংস্কৃতিক মুরুব্বীদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে গতানুগতিকতার বিরুদ্ধাচরণ করতে,গড়ে তুলতে বিকল্প সাহিত্য। কি এই বিকল্প সাহিত্য? ৬০ এর হাংরী আন্দোলনের অন্যতম স্রষ্টা প্রদীপ চৌধুরী।এবং যা অনেকেই জানেনা তা হল সাহিত্যের জাবরকাটা থেকে বেনিয়া প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোতে যে হাংরী যে ক্ষুধার্ত আন্দোলন নিয়ে আজ এত গবেষনা সেই আঁভা গার্দের সাথে ত্রিপুরাকে যুক্ত করেছিলেন প্রদীপ চৌধুরী। তাঁর সম্পাদিত ‘স্বকাল’ সাহিত্যপত্র ত্রিপুরা থেকে প্রকাশিত হয়েও হয়ে উঠেছিল বাংলা সাহিত্যের অবিচ্ছেদ্য অংশ।আবার ‘হাংরি জেনারেশনের মৃত্যু’শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁকে বলতে শুনি-“ সামন্ত সভ্যতার রমরমা দিনে কবিতার ‘পবিত্রতা’ অক্ষত রাখতে আমরা যারা একত্রিত হয়েছিলাম এবং আক্রমণ করেছিলাম ইমারত সভ্যতা ও কালোটাকার বিকার থেকে জাত বাবুকালচার ও বাবু সাহিত্যকে ,জীবনের বিশাল থাপ্পড় তাদের কাকে কোথায় ছিটকে দিয়েছে, তাদের কে কোথায় কিভাবে বেঁচে আছেন আমি জানিনা। শুধু জানি আমরা ছিলাম তাই কার্ফ্যু জারি করেও ওরা প্রত্যুষ ঢেকে দিতে পারেনি। ...কখনো হয়ত দেখা হবে একই বইয়ের দুই মলাটের ভিতর,বন্ধু বন্ধুর পাশে,পূর্ণ মানুষ পূর্ণ মানুষের সঙ্গে,রেস্তোঁরায় চা –কফি খাওয়া হবে, কিন্তু তা হাংরি হিসেবে নয়... অথবা একই আকাশের নিচে, গণমিছিলে, ৮০ কোটি , ৮০,০০০ কোটি মানুষের সংগে ,সকলের সমষ্টিগত শব্দের সিম্ফনি যখন অন্য গ্রহকে অনুপ্রাণিত করবে, সেই তো আমার সম্পূর্ণতা।... প্রতিষ্ঠান হিসেবে চিহ্নিত হবার আগেই আমি হাংরি জেনেরাশনের মৃত্যু ঘোষনা করি“... আর এখানেই ভার্জিন কবি প্রদীপ চৌধুরী। এই তাঁর বিকল্প সাহিত্য।যিনি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাঁর কাব্য আন্দোলন শুরু করলেও আন্দোলনকে প্রতিষ্ঠান হতে দেননি, হাংরি তাকে দিয়েছে একটি পথ একটি বিকল্প পথ এবং সেই পথ ধর এগিয়ে চলা।হাংরি তাকে দিয়েছে সাহিত্যের চিরন্তন তীর্থভূমিতে দাঁড়িয়ে মেরুদন্ড সোজা করে কবিতার অন্ধকার দেখাবার সাহস, তিনি সেই কবি যিনি শব্দের পুরুষানুক্রমিক রক্ত থেকে বেরিয়ে পড়ে জুয়া খেলেছেন বিশ্বকবিতার আর্তিতে।কোনো খন্ড জেনারেশন বা খন্ড আর্দশে বিশ্বাসী নন বরং স্বয়ংসম্পূর্ণ  একটা গোটা লেখক যিনি বারবার বিরোধী শিবির থেকে উঠে এসেও একা একা জেগে বসে আছেন নতুন বৃষ্টিপাতের কাছে। ফিরে ফিরে আসছেন প্রজন্মের খেয়া নিয়ে নতুন প্রসূতিসদনের মোড়ে। ষাটের বাংলা কবিতার বধ্যভূমিতে শূন্য অবস্থান থেকে শুরু করেছিলেন হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গেরিলা প্রদীপ চৌধুরী,অথচ শূন্যের বৃত্তটা তিনি আজও ভাঙতে চাননি কারন বিকশিত অস্তিত্বের মানুষটার খোঁজ আজও তার, আজও তিনি নিজেকে অনুসরণ করছেন
তাঁর কবিতার মেটাবলিজম বা মডুলেশন নিয়ে এত স্বল্প পরিসরে আলোচনা বুদবুদ নির্মাণমাত্র।বরং এক কথায় বলা যেতে পারে জীবন থেকে যে গোঙানি তাই তার গলার রগ চেপে ধরেছে।প্রতিবাদ প্রতিরোধ নয় বরং গর্ভের চেয়েও কালো কোনো গর্তে কবিতা খুঁজে ফিরেছেন তিনি,সেই কালো গর্ত  সেই নির্লিপ্ত স্বাদহীন অন্ধকূপ যেখান থেকে বেরোনো সম্ভব নয় অথচ যেখান থেকেই পাতলুন ছিন্নভিন্ন করে কবিতা লিখতে বসে পার্থিব মানুষ ,যেখানে কিডন্যাপড হয়ে রয়েছে পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ ক্রাইম।হাংরী আন্দোলন করার অপরাধে(অজুহাতে!)বিশ্বভারতীর দর্শন বিভাগ থেকে বহিষ্কৃত হন প্রদীপ চৌধুরী, ১৯৬৪ তে ত্রিপুরায় থাকাকালীন মকদ্দমা হয় কবিতায় অশ্লীলতার দায়ে এবং পরে তিনি স্নাতকোত্তর হন যাদবপুর থেকে,বুৎপত্তি লাভ করেন ফরাসী ভাষায়।তাঁর একাধিক কবিতা অনুদিত হয় ফরাসী ভাষায়;সংকলিত পত্রিকা ‘ফুঃ’ যাতে বিধৃত সারা পৃথিবীর নিন্দিত ও নন্দিত একাধিক লেখকের লেখা,বেরজরাক কবিতা উৎসবে শ্রেষ্ঠতার পুরষ্কার পায় ১৯৯৬ সালে।আর এ সবকিছুই একজন কবি করে গেলেন স্পৃহাহীনভাবে কেবল গোপণ কিছু আনন্দে।পাঠক জানল না।পরিবর্তণ জানল না।প্রথার ক্ষণিক জয়ধ্বনি চাপা দিয়ে গেল কবিতার সৎ সন্ধানকে উন্মোচনকে ।বাজার আর বিশ্বায়নের মুদ্রিত দেহটির বাইরে এ কেবল একজন কবির অনাত্মীয় প্রবাসে জেগে থাকা ছাড়া আর কি!প্রদীপ চৌধুরির মত কবি ,যার কাছে সাহিত্য জিনিসটাই এক অর্থে ‘জীবনচরিত’ তিনি কি যৌথ জীবনের বাইরে রয়ে গেলেন একটাই সমগ্র ‘আমি’ কে খুঁজতে!একজন কবির কাছে তো অনন্ত কোনো ভাগ্য নেই অমরতা নেই কেবল আছে অপেক্ষা,‘আমি’র দিকে আলো ফেলে জেগে থাকা।নিজের নিকটজন হয়ে জেগে থাকা।জেগে থাকা তার সুজন কুজন সাদা শহর তার মাস্টাবেশন আর মেটামরফসিসের বাইরে কোনো এক দীক্ষিত দ্বীপে।যার দিকে যুগের পর যুগ ধরে প্রথাবিরোধিতার রজস্বলা নদী বয়ে চলেছে সনাতনী সাহিত্যচর্চার লৌকিক শরীর ভিজিয়ে দিয়ে, আর ছন্নছাড়া কবি তার নতুন ভ্রমণ সরনিতে দাঁড়িয়ে প্রার্থণা করছেন সমুদ্রের দরজাগুলো খুলে দাও-সমুদ্রের দরজাগুলো খুলে দাও। খোলা টেবিলে পৃথিবীর জরুরি খবর লেখা খোলা খাম রেখে উচ্চারণ করছেন –

                                 “ আমাকে জাগিয়ে রাখ
                                          রঙীন দেশলাইর কাঠি ছুঁড়ে দিয়ে মুখের ভেতর’’ ---





গুদাম

আমি বিপদ্দজনক চরে আমার শরীর থেকে বিচ্ছুরিত আমার শরীর কিংবা
                                                                           শরীরহীনতা
আগলে বসে আছি,দু হাত সাধ্যের মধ্যে ধরা যায়না গলি ও রাজপথ
গুদাম বোঝাই প্রতিটি কব্জি থেকে খুলে আনো সময়ের নিঃস্ব চালাকি
দারোয়ান,প্রয়াস মানেই আয়ুক্ষয়
মৃত্যুই প্রজননসাধ্য জীবনের মত তীব্র রক্তক্ষরণে?
চিৎপাৎ নষ্ট বুক নগরবোঝাই যানবাহন,ডাস্টবিন,ট্রাক
আমাদের গলিত প্রতিভা শহরের শেষ প্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে,চেটে খাবে
আমার মতন তীব্র চূর্ণ নির্জনতা
পুরুষ,কোমর থেকে পুরুষাঙ্গ যোজন ছিটকে গিয়ে অশ্লীলতা করে
বেকার চোখের সামনে পরপর সাতদিন আংশিক ঝড় ও শুষ্ক বৃষ্টি
তোমার আলমারী জুড়ে পলি জমছে শ্বেত আক্রমণ শুধু আমার শরীরে
সেকি ধর্ষণের জন্য প্রেমে ডুবে
ঘৃণারও অযোগ্য ঐ দারোয়ান বেষ্টিত গুদাম।


ধাতুময় কাপ

কিছুতেই চুমুক দেওয়া হল না এই ধাতুময় কাপে- আমার প্রত্যেক লোমকূপে, কেঁপে উঠছে আমার জিড়জিড়ে হাড়,আরো দ্রুত,পাশবিক ঠান্ডা বায়ু দালান ফাটিয়ে এসে হরিণ-চামড়ার
স্ট্র্যপে অকৃত্রিম খেলা করে-পোকামাকড়ের আড্ডাখানা,গত শতাব্দীর কোন ব্যারাকের পায়খানার মতো মনে হয় তোমার শরীর,তোমার শরীর অনুমোদিত পরাজয় ঘটে সৈন্যদের,কিছুতেই জানানো চলে না , কি কৌশলে

আমি ট্রামের ডান্ডায় আরো বহুদিন ঝুলে থাকবো,অসনাক্ত মহামারী ,একা হাঁটা ,বহুদিন জীবন্ত ম্যাজিক,এইসব করে আরো বহুকাল মূমূর্ষ সারেঙদের সঙ্গে শুয়ে থাকবো,আকাশের তলে গঙ্গার আদিম জঙ্গলে,বিদেশ থেকে কোন জিনিস আসে না সঠিক নেশার যোগ্য,জাহাজ বোঝাই কাঁচামাল,জানি কোন পাষণ্ডের ঘরে,ভার্সিটিতে ধর্মীয় আড্ডায় আমার কবন্ধ আত্মা সাঙ্গকেতিক ‘সিটি’মারছে,সঠিক অন্ধতা আমি পেয়ে গেছি ২২ বছরেই-প্রতিটা লেবেল ক্রসিং খুলে যাচ্ছে-


সব তামার পয়সা আমি বিলিয়ে দিয়েছি বন্ধু সন্তদের হাতে

সব তামার পয়সা আমি বিলিয়ে দিয়েছি বন্ধু সন্তদের হাতে
চুমু খাবার মতো আবার আসতে বলেছি ওদের
দুপুর রোদে চোখের জল যেরকম সাদা শহর ছিঁড়ে ফেলে
এবং লাল পাপড়ির স্রোতে জারজ শিশুর ভেলা
ভাসে-আমি এই নেশায় লিপ্ত হয়ে তোমাকে
চেয়েছি কিংবা চাইনি অথবা তোমাকে প্রহার করে
ফুরিয়ে দিলাম পুংক্ষমতা

ডিয়ার ডিয়ার

মৃত্যুর মতো ঠান্ডা রাত গ্রাস করছে আমাকে
মৃত্যুর মতো প্রেম আমাকে গিলে ফেলছে
একা,                                ডিয়ার ডিয়ার

তুমি ছাড়া পৃথিবীর সকলে আমার এ চীৎকার শুনছে
নিরালোক,জ্যোৎস্নার ভেতর
আমি চেহারা সুন্দর করতে অবাক সেলুনে ঢুকে গেছি
গলিত রাত্রির জলে আমার মুখ নরম করে
গালে ও বগলে বসিয়ে দিয়েছে নক্ষত্রের ক্ষুর
আত্মাই আমার সেই ধূর্ত নাপিত,তারও ত্রাণ নেই

পিতার মতো ক্রুর,জন্মের চেয়ে কালো,কালো রাত
আজ প্রেমিকের রাত ফুঁসছে
                 ডিয়ার ডিয়ার
অন্ধ বারান্দায় আজ ফুলে উঠছে বালিকার পেট
                                         ডিয়ার ডিয়ার

একি হত্যা,শূন্যতা অথবা শ্মশান থেকে
আরেক জন্মের জন্যে অলৌকিক ভাবে জেগে ওঠা?
                                           ডিয়ার ডিয়ার

আমার এ জন্মের শেষ নাস্তিকতা তুমি

ঈশ্বর পরিষ্কার কর আমার নিঃশ্বাস
ঈশ্বর আমার মুখ থেকে চোয়াল খুলে নাও
বিধবার রাত্রির মতো দীর্ঘ ও শূণ্য করে দাও আমার আত্মা
চোখের জলের মত তরল করো আমার শরীর
আমার শরীর বৃষ্টির মতো
                                    ভিজিয়ে ভিজিয়ে নষ্ট করে দাও
                                                         ডিয়ার ডিয়ার

আঠার মৃত্যুর পর আমি তোমার কাছেই ফিরে এশ্চি
ডোম বালক,তরল নিসর্গে ডুবে আছি ক্রূরতম প্রেমে
আলজিবের ধার ক্ষয়ে গেছে
এখন তোমাকে ছাড়া কিছু নেই,কেউ নেই
ক্ষয় হয়, তোমাতেই দেহ দেহহীন হয়ে পড়ে থাকে
ঘিলু ও কুবুদ্ধিগুলি কাশের ফুলের মতো
                                             মানুষের ভালোবাসা কাড়ে

তোমাকে আমার কোলের উপর বসিয়েছি
যেন এক মাতাল তরনী উড়ে যাচ্ছে শহর ছাড়িয়ে
                                                             ডিয়ার ডিয়ার

ফলস প্রদীপ চৌধুরী

আমার এক একটা জন্ম ১ একটা পাৎলুন ছিন্নভিন্ন
করে দিয়ে আমাকে রেখে যায় এই শহরের সময়হীন
                                    গুহার ভেতর-
                                    কোলাহলপূর্ণ ছায়া
এবং শিশুর চিৎকার ও পীত চোখের ছায়া,জল। আঘাত করার
জন্যে কিছুতেই ব্যবহার করতে পারছিনা তোমাকে।তোমার জরায়ুর
আঁশের সঙ্গে মাখামাখি আমার কবন্ধ দেহ এবং পৃথিবী

ক্যালকাটা সেলুনের চেয়ারগুলিও খেয়ে ফেলেছে আমার শরীরের
জলোচ্ছ্বাস,খেয়ে ফেলে নির্ঘাৎ কোন জায়গায় অকেজো ইঞ্জিনের
মতো ঝুলে থাকবে ডিসেম্বর থেকে ৫ই ফ্রেব্রুয়ারী অব্দি,ডিয়ার সুভাষ
ডিয়ার মলয়,সেদিন আরেকবার জুয়া খেলব ফাঁকা পকেটে আর
                                          একবার
খুলির ভেতর থেকে চোখগুলি,মৃত গণিকার জন্মদিনে প্রেমিকার আংটিগুলি
নেশার টেবিলে রেখে জুয়া খেলব---এভাবেই দিনগুলি
                              তাসের ভাঁজের ঠিক কাছাকাছি
এসে সটকে পড়ছে আমাকে ছাড়াই আমার ২৪ জন্মদিন-
                        ৫ই ফেব্রুয়ারী কিংবা ১৩ই এপ্রিল


১০০ কুমারীর অনুপস্থিতে

শব্দে গুড়ো হয় দেহ,কিন্তু কাকে দিতে পারি এই দেহ এই শব্দগুলি
সোনার বেলুনগুলি নষ্ট করে উড়ে যায় ১০০ কুমারী
পিকনিক রোদের মতো ঘ্রাণ আসে
অসম্ভব হর্ণ দিয়ে চলে যায় ফাল্গুনের শেষ মালগাড়ী
অন্ধকার দালানের পাশে
১০০ কুমারী  তা কি-অথবা তা জীবনেরই ধুলি?

কেবল আমারই বুকে অপ্রেমের ক্ষত বাড়ে
১০০ কুমারী শব্দ,শব্দহীন
১০০ কুমারী জ্যোৎস্না,খড়ের ঘরের দীর্ঘদীন
নেশাখোড় হাড়ে ।

আলজিব থেকে রক্ত ঝরে !

এখন মাতাল হয়ে টলতে টলতে বাইরে এসে দাঁড়াই,দেখি আকাশের কি পরিমাণ ক্ষতচিহ্ন
আমার উল্টোদিকে,আমার কাতর লিঙ্গের মতো ঐ বিশাল অকুস্থলে ওরাও লেপ্টে আছে,
আমার জন্মে ও কয়েক হাজার অপমানে।প্রাণহীন এই শহরের ইঞ্জিন এখন আমার চোখের সামনে বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে,বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে ১২ টার পর গেরেজ করা ট্রাকলরী,ট্রাম,টার্মিনাস- বাস,৪০০ ধাঙরের অপকর্ম—মোড়ে বিকল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অবাস্তব গাছপালা এবং সন্তদের চোখের মণি তরল পিচুটির মধ্যে অনবরত ঘুরে যায়; আমার প্রত্যেক প্রেমিকা বেশ্যা হয়ে যায়- বেশ্যারা জননী হয়ে যায়,বিকল হয়ে যায় রেস্তোঁরার লাল আলোএবং কাছাকাছি গীর্জার চূড়া।

এত বাজে ব্যাপারের মধ্যে আমি দিনরাত নেশা করব ভৌতিক লালসা গুলিকে চালনা করে দেব ওদের মধ্যে,আমার এই কবিতা ১০০ যোনিহীন কুমারীর জন্যে , হায় নৌকার প্রতি পাল ছিঁড়তে ছিঁড়তে একই জলের শব্দ, আছাড়ের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেলেও রাত শেষ হয় না,ভালবাসা ফুরিয়ে যাবার পর কোমরে যৌআঙ্গুল,আমি আবার শব্দের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে ফিরে পেতে চাই কবিতা,একজোটে শিশু পৃথিবীর আকাশে ওড়াচ্ছি বেলুন—শীতল অসুখে টলতে টলতে আমি শহরের ধূলো-ময়লা মসৃণ পাতা চুমু খাচ্ছি চুমু খেতে খেতে আলজিব থেকে রক্ত ঝরে !

মাথার ভেতরে বিস্ফোরণ

মাথার ভেতরে বিস্ফোরণ এভাবেই,সুভাষ ও আমার,
যে চোখের বালিপাতা কোনদিন খোলা হয়নি
শরীর ফাটিয়ে বাইরে চলে আসে
সেই বিকিরণহীন,অন্ধ চোখ
-মহাজাগতিক রশ্মি,মোভি ক্যামেরার সামনে স্পষ্ট ধরা পড়ে,
এ এক নতুন কোলকাতা-
নতুন চোখ নিয়ে আমরা পরস্পরকে দেখি
আমাদের বিলুপ্তি ও বিশাল গর্জন

এক তৃতীয় ক্ষমতা শাসন করছে কোলকাতা দুপুর ।

শরীরের ক্ষয় এবং ক্রমাগত নতুন শরীর
-জারজ হেরাক্লিট-
গ্রন্থিহীন এ শহর,শেকড়হীন সভ্যতা ও ঈশ্বর ভাইরাস
এক পবিত্র জীবন-স্রোত সাঁতরে সপ্ল্যানেড
পেরোচ্ছি আমরা,আমি ও সুভাষ-
আর কাকে কাকে খাবে এই স্রোত,বৈদান্তিক দাঁত ?

শরীর বেলুনের মতো ফাঁপা
অথবা তা অভিকর্ষ-বিকল্প জন্মের ?

চর্মরোগ-১

মৃত-ক্যাকটাস এবং পোড়া বালির ওপর আমার বিছানা পাতা রয়েছে, লোমশ এবং কর্কশ বিছানার ওপর আমার চোখ আমার মুখের ভেতর বিস্ফারিত,আমার চারদিকে শরীরময় গরম নিশ্বাস,যৌনউত্তেজনার ব্যথা,অসহ্য গুমোট এক ধরনের আরাম,আমাকে এখুনি কিছু হারাতে হবে,অথবা পেতে,একহাজার রঙীন বেলুন ফেটে পড়ে,আমার নাভিতে এই অস্বস্তি,সমুদ্রের নীচে আগুনের মতো টকটকে ফুটে আছে কি সব গাছের আগায় ।

নীল পৃথিবীর উপর এভাবে মাঝে মাঝে আমার বিমূঢ় চলাফেরা আমার শীর্ণ ঠ্যাং ঢেউয়ের দিকে ফিরে ছটফটিয়ে ছিঁড়ে যেতে চায়।শরীর থেকে আলাদা হয়ে,মেয়েদের ঘাড়ে দাঁত ফুটিয়ে আমি কোন শান্তি পাচ্ছিনা,ঘুমুচ্ছি,জড়িয়ে ধরছি পাথরের মতো মসৃণ পাছা,একেবারে ফ্রেসকোর মতো চুপচাপ অবস্থার মধ্যে মিউজিয়মে তলিয়ে থাকতে পারি।আশ্চর্য !

আমি আমার সব অসম্পূর্ণতার কথা বুঝতে পারি, গলির ভেতর এই নামহীন কোলাহল,সমস্ত চাপ আমার শরীরে ভর করেছে,প্রত্যেক দেয়ালে নিস্তেজ চুন-সুড়কি,আমার চোখের সামনেই এই পতন ঘটে গেল, আমি জানতাম নির্সগের ভেতর দাঁড়িঁয়ে থাকতে থাকতে কি পাশবিকভাবে আমি পাৎলুন ছিঁড়্রে ফেলতে চেয়েছি,আমি আমার ঘিলু বদল করতে চাই, কিংবা উপড়ে ফেলতে ,পশু-পাখী,পাখীর ডিম ও আগুনের হল্কার উপর আমার এই নির্বিকার প্রভূত্ব,বেকার বেকার ---

লোমকূপ ছিঁড়ে শিশ দিতে দিতে আমার সর্বশরীর কেঁপে উঠছে, প্রতিটি লোমহীন গর্ত,আলাদা আলাদা আমার নাভি ও আমা লিঙ্গ,আমার উরু আমার বয়স,আমার ডায়েরী,আমার নাড়িনক্ষত্র,আমার বয়স,আমার নার্ভাসনেস,আমার হাতকড়া, নভালজিন।আমার স্বার্থপরতা ও সততা,গুজবসঞ্চিত মা-বাবা,ঋতু বদলের সঙ্গে সঙ্গে পালিয়ে যাচ্ছে, সমুদ্রের পেটের ভেতর আমি পাখিদের গোঙানি শুনতে পাচ্ছি, ৫ ই ফেব্রুয়ারী তার যবতীয় আবির্ভাব মুছে ফেলছে রোমান ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে ।

হেনরি মিলারের সঙ্গে সাঁতার

ট্রাফিক উৎপাত নেই এইদিকে,খুব অনায়াসে এখানে আমার মুন্ড ধড় থেকে খুলে রাখা চলে,বোতাম সরানো চলে,শরীরের দিকে না তাকিয়েই ঠান্ডা রোদে শানিত ঠান্ডায় বালুর ওপর থেকে মুখ তুলে ফেঁসে যাই কিংবা ছুটি এভেন্যু,হোটেল দুমড়িয়ে,ট্র্যাশ ট্র্যাশ ,বিদঘুটে সর্দির পর সাতদিন জুৎ পাইনা,কিসসু জমেনা,সাতদিন কফি না খাওয়ালে,বিদেশ থেকেও আমি যেরকম বঙ্গভাষায় বাড়ি ফিরি,অথবা বাড়িতে বসে করসোর কবিতা পড়ি, হেনরি মিলারের সঙ্গে সাঁতার কাটি চৌবাচ্চায়(এখন কাটিনা)নেংটো হয়ে,স্বাভাবিকভাবে, হা ঈশ্বর অমানুষ হবার সময়ও ওঁর সঙ্গে চুপচাপ,কিংবা এভাবে আমার অকথ্য থুতনি সোয়া ইঞ্চি সরে এশ্চে,১৯৬৫ সালে কোষ্ঠদোষ,গোঁফজোড়া ছিঁড়ে খায়,চামড়ার ভেতরে পচে বয়সের নষ্ট আদিরস-আকাশ পেরিয়ে এসে একা হাঁটি আকাশের অনেক ভেতরে- দেশি ফাল্গুনের মদ বাচাল কন্ঠায় ঢালি,গিলতে পারিনা,এমন কুস্থানে আমি চলে এশ্চি কন্ডাক্টারহীন বাসে চেপে ---

ব্যক্তিগত ৬

এই ধাতুসূর্যের নীচে সম্পূর্ণ পৃথিবী
আমিএর প্রতিটি গলি ও
অন্ধ গ্রন্থিতে উন্মত্ত অপভ্রমণ করেছি
আমি নিজের কাছ থেকে কোন সাহায্য
পাইনি,অনুপ্রেরণা পেয়েছি কুয়াশা সকালের
দেয়াল ভেদ করে
নরকচুল্লীর কাছে পৌঁছে যেতে

নির্মিত আগুন ! এই উপগ্রহ!
ভারসাম্য রাখার জন্য লিভারযন্ত্রের
দিকে অনাবশ্যক হাত বাড়াতে হয়না

আমি নাগরিকের দায়িত্ব
ও কর্তব্য
জরুরীকালীন ঝটপট প্রস্রাব সেরে
হাসা,পুরোন ঠোঁটে চুমু খেয়ে
নতুনভাবে যুদ্ধ ঘোষণা-
এবং রহস্য জন্ম-নাটক থেকে
একদিন  সত্যি সত্যি মাকে আতুন
ঘরে রেখে আসা-

আমি সবকিছুর জন্যে তৈরী
সবকিছু কাছে পেয়েও
তাকে কাছে পাবার উত্তেজনায় কেঁপে উঠি-
ভালবাসা,আমার লুপ্ত রোমহর্ষগুলি
এই প্রচন্ড জখম থেকে আবার শুরু হয়


 অধিগ্রহণ

সুরভিত ঊরুতে হাত রেখে দেখি তেমনই
প্রদাহ আছে,কিন্তু সেই পাখিগুলি
ভুল ব্যবহারের ফলে উড়ে গেছে,চোখে পড়ে,
কালো কালো ক্ষত,তাদের ঝলসানো
পালকগুলি সারামুখে লেগে আছে।
অভ্যস্ত আঙুল জানে এ কার অধিগ্রহণ ।

আমার অপভ্রমণের শেষ পাতা কটি
নিজেরাই উড়ে গেছে,আবছায়া রাস্তায়
অভিযাত্রীম,সতীর্থ ও রোমশ উষ্ণতা ;
শীত-তাপনিয়ন্ত্রিত,নির্দিষ্ট নিয়মে
চণ্ডাল গঙ্গার কাছে এসে যায়, বলে,’যাবে নাকি।‘

গলুয়ের ভেতর বসে আমরা যে যার
ঊরুতে হাত রাখি,আমাদের কামনার
আগুনে পোড়ে পাখির শরীর-
গোল ইস্পাতের মতো চকচকে থালায়
ঝলসানো টুকরোগুলি জড়ো করি-

একটি রহস্যময় জেটি শুয়ে সব কিছু দেখে ।                                                              

কসমস বনাম আমি

বহুসময় বিছানায় কাটাবার পর-ও
সিদ্ধান্ত নেয়া যায় না
আসন্ন ঘুম- আসলে তা মর্ফিয়ার সম্মোহণ কিনা
সে নারী,ঘুমিয়ে গেছে,
পরিতৃপ্ত,ঐ সবে মজা পেয়েছিল।
ঐ তো আমার ছেলে শুয়ে আছে-
হাতে বল,বহুবর্ণ গোলপোস্ট,পকেট চিকলেট ভর্তি-
ক্লাস ফোরে ফার্স্টবয় সে ।
আমার মার্ফিন সে তো ওদেরই মুখের হাসি,
ঘাম ও রক্তের মূল্যে স্টেরিলাইজড চকচকে সিরিঞ্জ ।

মাথার ভেতর তবু নাগরিক মধ্যরাত
পরবর্তী ঘন্টাধ্বনি এরপর আমারই বুকে,

হয়তো এই শতাব্দীর অস্তিম সেখানে-
সেখানে ছাউনি পাতা,কামানের ধ্বনি ,
স্পিলনটারের মত শব্দ-আমার কবিতা
অপরাধীদের প্রতি,ঊনিশ শো আটাত্তর
কিংবা শৈলেশ্বরের অস্ত্রের আগুন,
এবং প্রতিটী বেশ্যার বুকে একটি করে উদ্বাস্তু ফুসফুস-
চোয়াল শাণিত করে এই দিকে ফিরে আয়,
হায়েনার মত,চেয়ে দেখ এই দিকে প্রতিপক্ষ ;

টি.ভি.চিত্র

এক পাশে কাৎ হয়ে শুয়ে আছে
এই ঘর,মৃত্যু নয়,মাথার ওপরে
অপরাধ,অপচ্ছায়া,স্বপ্ন ...জন্মান্তর ।

প্রতিপালনের ছলে এই সহবাস
প্রতিপালিত শরীর দু নম্বর খাতার মতো
চাপা দেওয়া নেশা ও উদ্বেগ

এক পাশে কাৎ হয়ে নুয়ে আছে
এই ঘর , এক পাশে গ্যাসচুল্লী-
আরশোলা-অধ্যুসিত খালি মিটসেফ ।

রক্তের ভেতর ঢুকে পড়ছে কালো হাত

 রক্তের ভেতর ঢুকে পড়ছে কালো হাত।
‘কিছু দাও’ শরীরময় প্রতিধ্বনিত চীৎকার ।
আমি এই লোভীকে কিছু দিতে পারি না।
আমার গোপনীয়তা শেষ ।
আমার ভালবাসা ক্রীয়াশীল নয় ।
আমি শিরার ভেতর কার চাপা হাসি শুনি ।
সে-ও আমি ।

বিকল্প ?

দুঃখিত।
শতাব্দী শেষের আরেকটি রাত্রি
এই ভাবে শেষ হচ্ছে
এই ভাবে আজ ।

একটি দিন একটি রাত্রিতে এসে মিশেছে ।

একটি দিন ও একটি রাত্রির মধ্যে
আমি অনুপ্রবিষ্ট ।
একটি মিশকালো শতাব্দীর জরায়ুর
ভেতর গাদাগাদি ভ্রূণ,
রক্ত,অবয়ব,লালা মাখা
খর্বাকৃতি জনক ও জননী
অস্থির অন্ধকার থেকে
আরেকটি পৃথিবীর দিকে ঝাঁপ দিচ্ছে ।

আমার সিগারেট ক্রমে ক্ষয়ে আসে।
এই রাত্রি কোন পৃথিবীর?

দুঃখিত
প্রসূতি অথবা গর্ভপাত-
“আমাদের হাতে ৩য় কোন বিকল্প নেই !”


জ্বর

জ্বরের ঘোর বেড়ে না গেলে
স্বপ্ন বিকশিত হয় না। স্বপ্ন
অর্থাৎ চাওয়ার তীব্রতা – তীব্র ক্ষুধা
                           জ্বর জ্বর জ্বর
                        ভালবাসার জ্বর
                     ঘৃণা তাড়িতের জ্বর
              বিদ্রোহের জ্বর
পলাতকের হাজার মাইল দীর্ঘ জ্বর –

একজন তাড়িত মানুষের কোন বয়স নেই

একজন বিপ্লবীর প্রধান হাতিয়ার
                    তার বুকের গভীর জ্বর

একজন কবির জ্বর প্রবাহিত নদী


একজন কবির মৃত্যু

দিনের আলো ঢেকে রেখেছে,গাছপালা,পশু
আর মানুষের বন,আকাশ থেকে
ধ্রুবতারা উঁকি মেরে দেখে যায়-
এখনো সে জেগে আছে তো?

সে এক অদ্ভুত মানুষ !
রক্তমাংস,জাগ্রত মাথা আর
অক্সিজেন ভরা বুক নিয়ে সে লিখে যায়
তা সহজ আত্মার গান,
মুক্ত স্বপ্ন গুলি ! ধ্রুবতারা
উঁকি মেরে দেখে যায় ঃ মহাশূন্য থেকে
ছিটকে আসা একটি বালক
কোন নাচের ছন্দে ভালোবাসার কথা বলে ?

মানুষের ভাষা মঞ্চের উপড় গান বা নাচের
ছন্দের মতো হয় না
মানুষের কামনা ও কাজ চাঁদের মতো
চিরকাল স্নিগ্ধ থাকে না
(সমুদ্রের সঙ্গে চাঁদের যে কথা হয়
হায়,যদি এই ছন্দ পাওয়া যেতো !)

সে এক অদ্ভুত মানুষ, তাই সে
যা মানুষী-ঘটনা-শুধু তাই বুঝতে পারত
হয়ত জীবনে কোথাও ভালবাসা ক্ষীণ ছিল,
তাই সে জীবনকে উলোট-পালট করে খুঁজে দেখতো
ভালবাসা তোর উৎস কোথায়?
(উৎস নেই- স্বতোৎসারিত?)

নির্বাসণে এসে তাই কি সে জেনেছিল?
মদের মার্ধুয দিয়ে সে ভরে দিতে চেয়েছিল
ধর্মনিরপেক্ষ ভারতবর্ষ
আর এই অকৃত্রিম উপগ্রহটিকে ?

হয়ত এই ভাবেই একদিন তার ভরা গলার
উচ্চকিত হাসি,পূর্ণতার আলো
আততায়ীকেও এনেছিল তার গ্রন্থ-গুহায়
একই মেঝেতে বসে ভাগ করে খেয়েছিল
মদ ও মধু
সে ওদের বোঝাতে চেয়েছিল
ঐসব রক্তচক্ষু হৃদয়ে ভালবাসা নেই
ওরা দুষ্ট ও নিষ্ঠুর
সে ভালবাসার স্রোতে ভেসে গিয়ে
তার আততায়ীদের বুকে জড়িয়ে ধরে
বলেছিল-“একমাত্র ভালোবাসার শর্তহীণ
সংক্রমণই মানুষকে মানুষের মতো
ধরে রাখতে পারে “-

নিয়োজিত আততায়ী আর এক মূর্হুতে
দেরী না করে তার বুকে বসিয়ে দিয়েছিল
ভাড়া করা ছোরা,তারপর
চোরের মতো অন্ধকারে হারিয়ে দিয়েছিল

সেই অদ্ভুত মানুষ এখন আর পর্ণকুটীরে থাকে না।
পাহাড় ফুঁড়ে বেরিয়ে আসা দেবদূতের মতো
সে তার নিয়তির কাছে ফিরে গেছে
কবিতা ও ধর্মের অলৌকিক মায়ার জগতে ।

আজ আকাশের কোন ধ্রুবতারা নেই
আজ মধ্যসমুদ্রে একটুও ডিঙি নৌকা নেই
অদ্ভুত চাঁদের আলোয় ভেসে বেড়ানো তার
লাশটিকে ঠিকভাবে সনাক্ত করার
অধিকার আর কারোর নেই
একজন কবির মৃত্যু,প্রতিবাদ;-প্রকৃতি -ঘটনা।



                                ****************************