শনিবার

সুপ্রীতি বর্মন : আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরীর পজিটিভ ইরটিসিজম



বুদ্ধদেব বসু ইরটিক উপন্যাস লিখেছিলেন, ‘রাতভর বৃষ্টি’, কিন্তু তিনি ইরটিক প্রেমের কবিতা লেখেননি। মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্বের কবিতা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ইরটিক প্রেমের কবিতা, মলয় রায়চৌধুরী ইরটিক উপন্যাস লিখেছেন, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’। মলয় রায়চৌধুরী দ্বিতীয় পর্বেও বহু ইরটিক কবিতা লিখেছেন, একজন বাউলের প্রেমের পজিটিভ ইরটিসিজমের কবিতা । কোটিজন্মের যায় পিপাসা বিন্দুমাত্র জলপানে ।

মলয় রায়চৌধুরী এক উজ্জ্বল ধ্রুবতারা, একজন বাউল । শব্দ, চিত্রকল্প, বাকবন্ধ তাঁর একতারা, গুবা, সারিন্দা, ডুবকি,  নুপর, খমক । সকল পথ হারিয়ে ফেলা তরুণী-প্রেমিকার গূঢ় তলাতল খুঁজে তুলে এনেছেন রত্নধন, চাঁদের উদয় দেখিয়েছেন অমাবস্যায় । অভেদের সন্ধানে বেরিয়ে তিনি নবদ্বার-পিয়াসী এক জাজ্বল্যমান প্রতিমূর্তি, যাঁর হৃদয়ের কোলাজে স্বর্ণালী কলমের ছোঁয়ায় ফুটে ওঠে স্থলপদ্মে ভাসমান ‘ন্যাংটো তন্বী, । আড়ালের দরমা ছুঁড়ে ফেলে অকপট সহবাস, নগ্নমূর্তির দাম্পত্য কিংবা প্রেমিকের সত্তায়, কৃষ্ণের যতেক লীলা সর্বোত্তম নরলীলা । ধূসর চিত্রকল্পের পরোয়া না করে, পুরুষতান্ত্রিক স্বৈরাচারীতায় না ভুগে, নারীজন্মে পুরুষত্বের অসীম সোহাগশশী কলঙ্কিত না করে, প্রেমের পবিত্র অর্ঘ্যে অর্চনায় হাংরি আন্দোলনের পথিকৃৎ, যে অর্চনার মায়াবী বর্ণনা আছে তাঁর ‘নামগন্ধ’ উপন্যাসে, খুশি মণ্ডলের উদ্দেশ্যে যিশু বিশ্বাসের প্রেমপূজা । আদালতে জেল-জরিমানার ভ্রূকুটি, বন্ধুদের রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়া, তবুও কবির বাউলসত্তাকে কে কবে চোখ রাঙিয়ে অবরুদ্ধ করতে পেরেছে ? মলয় রায়চৌধুরীর মতো অতো দম কারোর নেই ; এ  এক সাহসী স্পর্ধা অতল-নিতল-তলাতল সন্ধানের । তাই আমিও কোনও রোক-টোখ ছাড়া স্বাধীনচেতা মননে তাঁর প্রেমের কবিতাগুচ্ছের কয়েকটির বিশ্লেষণ করছি । । বিশ্লেষণের গভীরতার মাপনযোগ্যে যতটা ইহ-দেহবাদের যে আনন্দ তুলে ধরেছি তা শুধু নিঃস্বার্থ ঐশ্বর্গিক প্রেমের অঞ্জলি, আমার স্বামী-সোহাগের অভিজ্ঞতা থেকে।

“ঘাস” কবিতাটিতে হৃদয়গ্রাহী প্রেম নিবেদনের পংক্তি কথকথা :  “আমি জন্মাবো কুমারী উরুদ্বয়ের মাঝে কোঁকড়া কৃষ্ণ ঘাস হয়ে তাতে লুকানো গন্ধমাদনের ঝর্না। মহীরুহ নই তাই জিরোই মনে হয় শুকিয়ে গেছি।”  ঢেউ তুলি তোমার ঘর্মাক্ত শরীরে বাড়তি বীজ ফেলবো রাতে। তখন মনে হয় গোল্ডফ্লেকের ধোঁয়ায় নিকোটিনের আসক্তি ওষ্ঠদ্বয়ের হিমাঙ্কে দূর্বল দূর্বাঘাসে আখচার মৌসুমীর অকাল বর্ষণ হবে। সর্বভুক শিখায় উজ্জ্বলা পোড়ামাটি বীর্য উত্থিত  হয় পুরুষালি ঘাসে আর প্রেমিকার দেহে উদ্ভাসিত অপরিমেয় গভীরতায় সংক্ষিপ্ত চিল্কা হ্রদ। অবুঝ কিশোরী খামচে ধরে তক্ষক জিভের টপাটপ গ্রাসে অধিগ্রহন ফেনায়িত ঢেউ। অধিগ্রাসে পুরুষালী ঘাস সমর্পিত পাষান ঈশ্বরী বেদী তোমাকে। মৃন্ময়ীর চুলচেরা বিশ্লেষণ আজ ক্ষুরের ডগায় নাছোড় প্রেমিকের মাথাচাড়া। বিছানায় এলানো মৃত্তিকার নগ্নকায়ার সাথে ভূরাজত্বে তৃষ্ণার্ত সঙ্গীর নাগপাশে মুঠোয় অধঃক্ষেপ মৈথুন। মলয় রায়চৌধুরীর ইরটিক কবিতাগুলো বাউলের দেহতত্বের ভূবনমঞ্চ ।

“ন্যাংটো তন্বীর জন্য প্রেমের কবিতায়” কুচকুচে চকচকে পুংঘোড়ায় বসে আছেন ন্যাংটো তন্বী।

যৌননৌকায় টালমাটাল পুংঅশ্বের রোমের কেশর ঝাঁকানো ভরাডুবি পিচ্ছিল স্রোতের উষ্ণ প্রসবন।

অশ্বারোহীর রক্ষাকবচ কনডোম,,, ফানেলে জ্বলন্ত ভিসুভিয়াসের অগ্ন্যুৎপাতের উৎসেচক কেরোসিনে চোবানো আর বর্হিগত অপসারনে ডেসিমেলে কম্পমান স্যাঁতসেতে ধরিত্রী। চুষিকাঠির ইচ্ছেমতন রস নিংড়ানো সরস জিহ্বায় উৎকোচ গাঁটের পর গাঁট খেজুর গাছ। গৃহস্থের পরিপাটি তোশক বিছানা আজ হুলুস্থুলুস দুন্ধুভির  গর্জনে কুমারী মেঘে জমাট জলঙ্গি কামনার রসমজ্জায়। লাজুক ঘোমটায় তরুণাস্থির চলন রুফটপের সানসাইনে মালসায় জমেছে গতরাতের ঋতুস্রাব। পুংঘোড়ার ঈষৎ কম্পিত লাফে অচিন পাখির সন্ধান।

“বৈদ্যুতিক ছুতার” কবিতায় কাম রজঃগুণে প্রেমিক জেদি মন সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাবে। সে দেউলিয়া থাকতে চায়,  নিঃস্ব, কারণ প্রেম হল তার একমাত্র পাথেয় । সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর ছেড়ে চলে যাচ্ছে তার প্রিয়তমার বিরহের উদ্বিগ্নতা । দুর্নিবার যন্ত্রনায় ছিন্ন প্রেমিক-স্বত্তার উৎকন্ঠিত হৃদয় প্রেমিকাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিতে চায় আপন ক্ষুধায়। লকলকে জিহ্বায় শ্যাওলা জমেছে  নিরাসক্তির ঘোমটার উদাসীনতায় । কবি যেন গা ঠেশে, ছাড়ো ছাড়ো, একরাশ আকাঙ্খায় অশ্রাব্য ঘুমের স্নিগ্ধতার দূরত্ব গড়ে ফেলেছেন ।তাই বোধহয় চোখের পালকি থেকে বিদায় নিয়েছে দৈহিক স্পর্শের টান— কন্যা এখন যুবতী।

প্রতিবেশী নাভিগহ্বরে শুয়ে আছে সোঁদা গন্ধের বিনুনি,  কবি-প্রেমিকের বীর্যের আঠালো স্রোতে নিংড়ে পেতে চাইছে আজ জরায়ুর গন্ধ, সে প্রেমিকা, সে শুভা, সে বাউলের সঙ্গিনী। মলয়-বাউলের কাছে স্বর্গ-নরক, জন্মান্তর, মূর্তি, মন্দির, শাস্ত্রগ্রন্হ স্বীকৃত ছিল না ; ধর্মের হাংরি ম্যানিফেস্টোয় তিনি লিখেছিলেন সেসব কথা ।

মশারীর রৌদ্রদগ্ধ আঁতুড়ঘরে হাপরের দীর্ঘশ্বাসে রাত্রিযাপনের কোলাজে নিতম্বের দূর্দন্ডপ্রতাপে শ্রীমতি সোহাগটুকু নিংড়ে রক্তিম টিপে করেছে বন্দী। আঠালো স্রাবে বৈদ্যুতিক ঝাপটা কবি আজ হয়েছেন ছুতোর; কবি বলেছেন যিশুখ্রিস্ট ছুতোর ছিলেন, শুভা তাঁর মেরি ম্যাগডালেন। প্রেমিকের অপটু ধস্তাধস্তি কুঠারে প্রেমিকার নাভিতে উছলিয়ে বৈতরিনী জাহ্নবীর ছলাকলায় গূঢ় অভ্যন্তর সরস মরণ-পতন। উড়ুক্কু কলা ঊরুদ্বয়ে আগোল প্রেমিকার  যৌবনতটে কবির আঁশ কামড়ে যোনির সুস্থতা নাড়ি ছেঁড়া রোমান্টিসিজম শুভার প্রতি কাঙাল হৃদয় প্রেমিক মলয়ের। তিনি চিৎকার করে বলছেন, শুভার স্তনের বিছানায় আমাকে শুতে দাও, শেষবার ঘুমোতে দাও, মর্মান্তিক আকুতি এক ব্যথিতচিত্তের । ভরাট স্তনের শিমূলে মাথা গোঁজার ঠাঁই। উদ্দাম ন্যাংটো তন্বীর আঁচড়ে কোঁকড়ানো চুলে মেঘের কার্নিশ আকন্ঠ ভরে যাচ্ছে আজ ধাতুর স্রোতে।

রূপশালী নাভিমাসে বীর্যস্নেহে স্নিগ্ধ গথিক ভাস্কর্য আঁকশি রূপে নেতিয়ে থাকা দূর্বল শরীরী বাকলের হেতাল বনে আনতে চায় মরা কোটালের বান। পরিপক্ক সোহাগের ডোরে যন্ত্রণা মন্থনে উদ্যত উদ্ধত জেদী আদি যৌনতা ঢোঁড়া সাপ স্ফীতগতরে ঊরুজাত রোঁয়াওঠা শিহরনের কম্বলে দগ্ধভূমি পুরুষত্বের ঔরসে নিষিক্ত জরায়ু আজ তার একচ্ছত্র অধিকার। তাই আজ সব প্রয়োজন শূন্য প্রেমিকার গর্ভে ঔরসজাত সন্তান রূপে শুক্র থেকে প্রেমিকের জন্ম হোক এ যেন এক প্রতিশ্রুতিবদ্ধ প্রেমিকের দৃঢ় অঙ্গীকার, কালজয়ী উৎসর্গীকরণ, বাউলের দেহতত্ত্বের সঙ্গমে।         
পাঁজর নিকুচি করা ঝুরি নামছে স্তনে আর তুলকালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরের সমগ্র অসহায়তা। যোনি মেলে ধরো, বাউল-প্রেমিকের আকুতির টান পাঁজরাবদ্ধ উৎসবে । কুমারী অমাবস্যায় পদ্মবোঁটার উন্মোচন অন্তর্বাস ছিঁড়ে বেআব্রু শুভার রজঃস্বলায় প্রেমিক শ্লেষা হয়ে মিশে যেতে চায়।মায়ের যোনিবর্ত্মে অাত্মগোপন বা ধিক্কার স্বীয় অধিকারে তাই অথৈ বানে পিতার আত্মমৈথুনের পেচ্ছাপে তার বয়ে যাওয়া কেবল এক নিষ্পাপ প্রেমিকের স্বীকারোক্তি শুভার প্রতি তার শেষ প্রয়োজন।তাই ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে চায় এক প্রেমিকের পাপতাড়িত কঙ্কাল। এক অসাধারণ সান্ধ্যভাষায় রাঙানো চিত্র প্রেমিক সোহাগ স্বপ্ন গর্ভবতী শ্রীময়ী শুভার আসন্ন প্রস্ফুটিত কুসুম। শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলে ৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমন্ডলীর দিকে।রূপায়নে যেন কোন অন্তরীক্ষের দেবশিশু উন্মোচনে আজ বেজে ওঠে বাউলের দেহযন্ত্র । অন্তিমে বিপর্যয়ে আলোড়িত-হৃদয় এক নিষ্পাপ প্রেমীর ।  গরীবের দেওয়াল জুড়ে দেখবে কেমনে তোমার প্রতুষ্যের বাসি ওষ্ঠমধুর সঞ্চয় যামিনীর কোলাহল। তাই আরশি থাকার পরেও স্বয়ংদর্শন ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে শুধু প্রেমিকের আত্মসমীক্ষণ— অপ্রতিষ্ঠিত খেয়োখেয়ি অনন্তকালের জন্য।

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো”—, এই কবিতায় এক আশ্চর্য উপস্হাপন প্রেমিকসত্তা মলয়ের যা হৃদয়গ্রাহী সংলাপের চৌম্বকীয় আকর্ষণে গ্রথিত করবে মস্তিষ্ক– এক উচাটন-উন্মাদ শোকে পাঠক তাতে সহজেই যোগসূত্র খুঁজে পাবেন, যদি তাঁর আত্মত্যাগ নিঃস্বার্থ প্রেমের নিমিত্ত হয়। সংসারীর অতৃপ্ত ন্যাকা দেহভাষা নয়। বাউলের দেহবন্দনা । আজ তবে  প্রেমালাপে সঙ্গীতময় হোক নগ্ন শরীরে। পুরুষ ঠোঁটে আর নগ্ন দৃষ্টির উন্মাদ প্রেমে কামার্ত শৃঙ্গারে নারী তুমি আভূষিত হও। আর নেশারু হোক অতৃপ্ত প্রেমের আগুন প্রেমিকার দেহরহস্যের জতুগৃহে। কারণ আজ অতিরিক্ত বাচনিক ক্রিয়াজাত অগ্নির উপশম হোক তোমার মাই চটকানো দুগ্ধ পানে ছটফটানি/ অস্থিরতা জাগ্রত হোক নবকল্লোলে প্রেমিকার মুখশ্রীর রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তোমার ন্যাংটো তন্বী আজ হোক আমার উন্মুক্ত আরশি, স্বর্গসুখ পাই স্বীয় মুখদর্শনে আর এটাই আমার ভ্যালেনটাইন দিনের শ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। ষোলোকলায় উন্মুক্ত বিভঙ্গে আলতা চরণে রমণী তুমি তাই নিঃস্ব আজ আমি ঘুমহীন নৈঃশব্দে যন্ত্রনায় আবদ্ধ এক পাগল প্রেমী যার আজ আত্মধ্বংসের ভ্যালেনটাইন কার্ড বা গিফ্টপ্যাক  কাটা মাথার রক্তক্ষরণ। আজ তবে তার উচ্ছন্নে, প্রেমে, শরীর সার্বভৌম নয়, তাই আমি মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো। জঙ্ঘাহীন তাই অনাবৃষ্টির শোক, তবুও তোমার যৌনগন্ধী বেড়ায় আবদ্ধ যোনির হাসিমারা অভয়ারণ্যে আশ্রয় নিক নিষ্পাপ স্কন্ধহীন দামাল পুরুষ প্রেমিক লক্ষ্মীতত্ত্ব জাগাক সে রাতপেঁচার শীৎকারে তুমিও আঙুলে জড়িয়ে তাকে, ঝড় তোলো, বিদ্যুত খেলাও।

মলয়ের কাটা মাথা তোমার কোলে রেখো, তোমাদের কোলে রেখো— কিন্তু মৈথুনানন্দে চিত্তপ্রাণ জাগে কপালে।কঙ্কালসার হিম  ন্যাংটো শরীর তোমার বিবর্জিত রোমন্থন শীৎকার কি করে আজ সম্ভব তোমার সাথে সঙ্গম, কেবল মাথার সাথে । আমিও নির্বাক সাতপাঁচ ভেবে কাপুরুষ ভীত শামুকের ন্যায় মাথা মাংসল যোনিকেশরে ঢুকে আত্মগোপন করি চন্দ্রাহত ওষ্ঠে। মনে আছে একদিন শতরূপা গৌরচন্দ্রিকায় আমার মুখশ্রীর লাবণ্যে হতদগ্ধ হয়েছিলে তুমি কিশোরী, বলেছিলে চলো পালাই, একসাথে তবেই অমাবস্যার চাঁদে আমাদের প্রেমের মোক্ষ প্রাপ্তি কিন্তু আমি কাপুরুষ ভীতু প্রেমিক কাঙাল তোমার প্রেমে। মলয় রায়চৌধুরীর ডিটেকটিভ বইয়ের প্রথম প্যারা আরম্ভ হয়েছে এক যুবতী এক পুরুষের হাত ধরে যখন বলেছিল, ‘চলুন পালাই’। সাহসিকতার মাস্তুলে জমেছে আজ অস্তরাগের বিষাদনৌকা, কেন ভাসাতে পারিনি সেদিন।
তুমিও শিহরিত,  কুন্ডলী পাকিয়ে দাঁতের কর্ষণে চুঁইয়ে পড়তে থাকে উঁচিয়ে থাকা অমৃতদুগ্ধ বোঁটার উষ্ণপ্রসবন সিঙ্গেল মল্ট হাঁ করা মুখে ঢালতে লেগেছো অনর্গল আর ঘামে দরদর করে ভিজে আমিও প্রাচীন পুরুষাঙ্গ বর্জিত ঠোঁটে ডুব দিই অতলান্ত অলকানন্দায়। তাঁর আনন্দ, নৃত্য, গীতিময়তা যেন র‌্যাবেলেস্ক ।
আমরা জানি মলয় রায়চৌধুরীর প্রিয় পানীয় হল সিঙ্গল মল্ট ও আবসাঁথ । বোদলেয়ার, র‌্যাঁবো, ভেরলেনেরও প্রিয় ছিল আবসাঁথ । স্লিভলেস ব্লাউজ তোমার ভিজে সপসপ অন্তর্বাস আর আমার বাউলসুলভ একা মাথার জরায়ুমুখে গৌড়ীয় লবণাক্ত লিঙ্গের কোন স্কোপ নেই আর। শুধু মস্তকের ঔদ্ধত্ব্যে আজ হতে খুব ইচ্ছা করে জ্যান্ত লকলকে জিব্রাগ্রীবা। উঁকি দিয়ে চতুরঙ্গ কৌশলে কোন লাউডগা উদোম করুক তোমায় আমার জিহ্বায় লুকানো তীক্ষ্ণ করাত। হস্তকরপদ্মহীন তাই রুদালির শোক আলিঙ্গনে লুপ্ত তোমার কষিয়ে বুকে জাপটে ধরার বাহুডোর। আজ তাই হতে চাই নিঃষ্পাপ সন্তান অঙ্গ বিবর্জিত তোমার কৃষ্ণগহ্বরের প্রসবে। আজ না হয় সম্ভ্রান্ত লাবণ্যরসে মাধুর্য আনুক রমণীয় লাস্যে তোমার উন্মোচিত জ্যোৎস্নাময় যোনির গোলাপপাপড়ি তাতেই শুষ্ক ফাঁটা ঠোঁট দিয়ে একটু আদর ঘষি আর তাতেই উদ্গীরন হোক  মায়াবী মাদকের সিঙ্গল মল্ট। লিঙ্গকলা উচ্ছেদ তাই আমাকে আর উলঙ্গ দেখার আতঙ্কে ভুগতে হবে না। আজ শুধু সম্রাট- মস্তকে হয়েছি জেহাদি। চোখ মুদে তবুও তোমার কস্তুরী ঘ্রাণের নাভিতে দিতে চাই আহুতি আমার চারুকলার কেশগুচ্ছের ঝিম ধরা মাতলামো। মার্জিত করো আজ আমায় কারণ আজ আমি এমন এক ব্যাধ যান্ত্রিক নখ ও দাঁতের শান দেওয়া অস্ত্রছাড়া তাই অসহায় হয়েছে তোমার হুক।

“বুড়ি” কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরীর এক আশ্চর্য সৃষ্টি যেখানে বাউলের অন্তিম চরণে মোচড়ানো প্রেমিক  হৃদয়ে নিঃস্ব রিক্ততার শূন্যতার যন্ত্রণার সাথে মিলেমিশে একাকার তার বুড়ি স্ত্রীর প্রতি যে নাকি তার দিদিমার বয়সী:-

এই বুড়ি আমার দিদিমার বয়সী
চুল পেকে গেছে, কয়েকটা দাঁত
নেই, দিদিমার মতন শুয়ে থাকে–
কবে শেষ হয়ে গেছে পুজো-পাঁজি
ক্যালেণ্ডারে ছবি-আঁকা তিথি
দিদিমার মতো এরও প্রতিরাতে
ঘুম পায় কিন্তু আসে না, স্বপ্নে
কাদের সঙ্গে কথা বলে, হাসে
চোখে ছানি তবু ইলিশের কাঁটা
বেছে ঘণ্টাখানেকে মজে খায়
দিদিমার মতো, বলেছে মরবে
যখন, চুড়ি-নাকছাবি খুলে নিয়ে
পাঠাতে ইনসিনেটরে, এই বুড়ি
চল্লিশ বছর হলো সিঁদুর পরে না
পঞ্চাশ বছর হলো শাঁখাও পরেনি
দামি-দামি শাড়ি বিলিয়ে দিয়েছে
দিদিমা যেমন তপ্ত ইশারায়
দাদুকে টেনে নিয়ে যেতো রোজ
এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।

“স্বচ্ছ দেওয়াল” কবিতায়—– একটি লজ্জার দেওয়াল প্রতি কুমারীর অলক্ষ্যে যুগে যুগে অনুরাগের আকাঙ্খায় জেগে থাকে  আর তার অধিবাস উন্মুক্ত হয় কোন যৌবনের বান ডাকে। ছিঁড়ে যায় সেই স্বচ্ছ দেওয়াল যার ভাঙা ও ভাঙতে দুটোতেই অনাবিল আনন্দ জেগে ওঠে।কোন আড়াল আর অবশিষ্ট থাকে না দুজনের মাঝে শুধুই এক আসন্ন-আনন্দের  নবাঙ্কুরের জন্ম:-

“দেওয়ালখানা
বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে রাখছে
সেই যুবকের জন্য
যাকে সে ভাঙতে দেবে
যুবকেরা তবু গলদঘর্ম হয়
যে ভাঙছে তারও
অহমিকা নাচে ঘামে
রসের নাগর খেতাব মিলেছে
প্রেমিকের।
দেওয়ালখানা প্রেমের ঘামেতে ভিজিয়ে ফেলা দরকার।”

“অবন্তিকার শতনাম” কবিতায় ফিরে এসেছেন আধুনিক কবিতার বাউল মলয় রায়চৌধুরী ; দ্রাক্ষাস্তনে একাগ্রচিত্তে ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীর জপমালা শীর্ণ কায়ার শ্বাসরুদ্ধ নাছোড়বান্দা আলিঙ্গনে শঙ্খিনী আড়মোড়া ভাঙে ভাঁজে ভাঁজে জেগে ওঠে পুরুষোত্তম ব্যাকুল উগ্র নিঃশ্বাসের উৎকোচে চাঁই বাঁধে শঙ্কা কাছ ছাড়া ফুটন্ত দুধে। অবন্তিকাকে একশো নামের ব্যঞ্জনায় জপে জাগ্রত হয় প্রেমিকের সদাজাগ্রত কুন্ডলীচক্র দৈহিক নবরসের পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোড়নে শতনামে অবন্তিকা তোমায় খোঁজে। আমি অবন্তিকার দুটো মাইয়ের নাম দিয়েছি কৃষ্ণচূড়া আর রাধাচূড়া, বাঁদিকের বোঁটার নাম করেছি কুন্দনন্দিনী…বঙ্কিমের বিষবৃক্ষ তখন ও পড়ছিল চিৎ শুয়ে,প্যান্টির নাম পিকাসো যোনি তার কোন আদল আদরা নেই।ভগ্নাংঙ্কুরের নাম কোন মিষ্টান্ন দ্রব্য বিশেষ জিহ্বার লালার উৎসেচক।ওষ্ঠের নাম আফ্রিকান সাফারি আর পাছা দুটির নাম গোলাপসুন্দরী। উরুর নাম ককেশিয়া আরো কতক নামের শিরোপার ব্যাঞ্জনায় অবন্তিকার শতনাম মুক্তকন্ঠে জপ করছে কোন প্রেমের তপস্যায় লীন পাগল প্রেমিক।”—এরকম কবিতা কেবল মলয় রায়চৌধুরীই লিখতে পারেন, যা আনন্দের, উদ্দীপনার, প্রেমের, রসমগ্নতার, সহজিয়া, দেহসাধনার গান, মধুস্রাবী, তন্ময়তায় নিবিষ্ট । মধ্যবিত্ত কবিচেতনার বাইরে ।

“পপির ফুল” কবিতাটিও রহস্যময়—- এই কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী পোস্তগাছের ফুল ও ফল নিয়ে লিখেছেন অথচ তা সান্ধ্যভাষায় । পোস্তফুলের রঙ গোলাপি, ফল সবুজ, আঁচড় দিলে আফিম তৈরি হয়, পেকে গেলে ফেটে পোস্তর বীজ পাই । কিন্তু  এই নিষিক্ত প্রেমে অধ্যুষিত পঙক্তিগুলো ছেঁকে তোলে রোমকূপে জেগে ওঠা ফুলেল শয্যার কমফর্ট জোন। নরম অঙ্গুলির পেন্সিলস্কেচে হালকা ছোঁয়ায় আঁচড়ে তন্বী-সঙ্গিনী কবোষ্ণ কব্জি জেঁকে বসে ঘনত্বে চারকোল শেডে রোমকূপে আসক্তি ক্যানভাসে। রামকিঙ্করের স্থাপত্যে সটান এলানো বিবস্ত্র কালীমূর্তি পদমূলে বিছানো তোরঙ্গ বলশালী সুউচ্চ গতর পুরুষালি সিংহনাদে  ইজেলে টানা রঙের তৈলচিত্রে মধুদ্রবনে মহাপরিনির্বান। সাতলহরীর ছন্দপতনের ঝংকারে ভার্জিন কলসের জল মুখ ডুবিয়ে আকন্ঠ পান করে যাও যত চেটে খাও তত নেশায় আদম হয়ে ওঠো। রাতের পোশাকের খোলসের তলায় স্তন দৃঢ়মুষ্ঠিতে পিচ্ছিল দলিত স্তনের গোলাপী রঙে আবিষ্ট বোঁটায় অসমাপ্ত চুম্বন আঁকড়ে ধরে শেষটুকু আবরন চাদরে অবন্তিকা তুই ইরটিক প্রেমের আগার :-

“বোঁটায় তোর গোলাপ রঙ অবন্তিকা
শরীরে তোর সবুজ ঢাকা অবন্তিকা
আঁচড় দিই আঠা বেরোয় অবন্তিকা
চাটতে দিস নেশায় পায় অবন্তিকা
টাটিয়ে যাস পেট খসাস অবন্তিকা”

“নেভো মোম নেভো” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন লেডি ম্যাকবেথকে নিয়ে ; লেডি ম্যাকবেথ মোমবাতি নিয়ে পাগলের মতো ছুটছেন :-

“পাছার দু-ঠোঁটে, আহা কি মসৃণ হতো রাজরানি হওয়া, যেন ইস্কাপন
নষ্ট করে নেচে উঠছে বিদ্যুতের খ্যাতি, যার অস্তিত্বে আমি বিশ্বাস করি না
আগুন নগ্নিকা, বুক দুটো অতো ছোটো কেন
লেডি ম্যাকবেথের লোভ সিংহাসনে রাজমহিষীর মতো উঁচু বুকে
বসে আছো, স্কুল-ফেরত সম্পূর্ণ উলঙ্গ তুমি হাঁটছো পাশাপাশি
তেমন নারীও, আত্মজীবনীতে লিখবেন কিন্তু প্রথম হস্তমৈথুনের স্বাহা
ক্লিটোরিসে অঙ্গুলিবাজনার মৃদু উগরে-তোলা ঝর্ণাঝংকার।”

“রাবণের চোখ” কবিতা মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন কুলসুম আপাকে নিয়ে । তাঁর আত্মজীবনীতে আমরা জেনেছি কৈশোরে মলয় রায়চৌধুরী তাঁদের বাড়িতে হাসের ডিম কিনতে যেতেন । কুলসুম আপা তাঁকে মাংস খাইয়ে বশ করে একদিন রেপ করেছিলেন, কবিতাটির পৃষ্ঠভূমি পাঠক যদি জানতে না পারেন তাহলে এই কবিতার ভিতরে প্রবেশ করতে পারবেন না :-

শৈশবের কথা । সদ্যপ্রসূত কালো ছাগলির গা থেকে
রক্ত-ক্বাথ পুঁছে দিতে-দিতে বলেছিল কুলসুম আপা
‘এভাবেই প্রাণ আসে পৃথিবীতে ; আমরাও এসেছি
একইভাবে’ । হাঁস-মুরগির ঘরে নিয়ে গিয়ে আপা
আমার বাঁ-হাতখানা নিজের তপ্ত তুরুপে চেপে
বলেছিল, ‘মানুষ জন্মায় এই সিন্দুকের ডালা খুলে’ ।
রাবণের দশজোড়া চোখে আমি ও-সিন্দুক
আতঙ্কিত রুদ্ধশ্বাসে দ্রুত খুলে বন্ধ করে দিই ।

“জ্যামিতির উৎস”  কবিতায় মহালয়ায় বীরেন ভদ্রর চণ্ডীপাঠকে দূর্গার পরিবর্তে দেবী অবন্তিকার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেছেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃষ্টির রহস্যের উন্মোচনে বাউল-প্রেমিকের সংলাপে। সিকোয়েন্স এ সৃষ্টিকর্তাদের সৃষ্টি সুখের উল্লাসে অনুভবকে আঙ্গিক দিয়েছে প্রেমিকার শরীরের প্রতি আঁকে বাঁকে অপরূপা তিলোত্তমার সৃষ্টি। অবন্তিকাই কবিতা, তাঁর নিজের কবিতার বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন মলয় এই কবিতায়:-

অবন্তিকা বললি তুই :
নৌকো মাতাল হতে যাবে কেন ? এ-যুগে সমুদ্রটা নিজেই মাতাল !
আমি বললুম :
যত জ্যামিতি কি শুধু তোরই দখলে ? কার কাছ থেকে পেলি ?
অবন্তিকা বললি তুই:
আর্কিমিডিস দিলেন দেহের ঘনত্ব !
রেনে দেকার্তে দিলেন শরীরের বাঁকগুলো !
ইউক্লিড দিলেন গোপন ত্রিভূজ !
লোবাচোভস্কি দিলেন সমন্বিত আদল !
ব্রহ্মগুপ্ত দিলেন মাংসময় বুকের নিখুঁত বর্তুলতা!
শ্রীধর দিলেন আয়তন !
নারায়ণ পণ্ডিত দিলেন দৃষ্টি আকর্ষণের ক্ষমতা !
আর তুই কী দিলি ? অক্ষরে সাজানো যত ফাঁকা মন্তর ?
আমি বললুম :
আমি দিয়েছি প্রেম !
অবন্তিকা তুই বললি :
প্রেম তো আলো হয়ে বেগে আসে আর তত বেগে চলে যায় !

সাম্প্রতিক কালে মলয় রায়চৌধুরী নিজের কবিতাকে বলেছেন ডোমনি ; বাউল মলয়ের কাছে কবিতাই তাঁর দয়াল, মলয় স্বয়ং একজন সাঁই । এই কবিতার নাম ‘মলয় সাঁইয়ের গান’:-

ডোমনি, তুইই দয়াল, কালো জাগুয়ার চামড়ায় মোড়া দেহ তোর
দু’জনে ধুলোয় গড়াগড়ি দিয়ে যা শিখেছি তা পশুসঙ্গের মহাবোধ
ডোমনি, তুইই দয়াল, ঘামের ত্বকে মোড়া বিকেলের পাঁকবিলাসিনী
পুলিশের গুলি খেয়ে কিশোরী বয়সে তুই খোঁড়া হয়ে গেলি
ডোমনি, তুইই দয়াল, মেছুনির হাজা-হাত, কাগজকুড়ানিয়াফাটল-গোড়ালি
কী করে মগজে নিয়ে যাবো সুষুম্নার মুখে ইড়ার রাস্তায় জড়ো করা বীজ
ডোমনি, তুইই দয়াল, বন্দু ধারণের যোগ্য করে তুলবি কবে
দম নেবো আর ছাড়ব না দঞ যাতে কুম্ভকে থাকি বহুক্ষণ
ডোমনি, তুইই দয়াল, পচা মাংসের গন্ধ তোর মুখে, ঠোঁটেতে কাকের রক্ত
তোর লবণামৃতে সকাল-সন্ধে চান করিয়ে পাপিষ্ঠ করে তুলবি আমাকে
ডোমনি, তুইই দয়াল, শ্রেনিহীন করে দিস, আমিশাষী রসে
নাভিচক্রে কাতুকুতু থিতু করে আসক্তির স্বর্ণলতা দিয়ে মুড়ে দিস
ডোমনি, তুইই দয়াল, বলে দে কেমন করে কুণ্ডলনী চক্র জেগে যাবে
তর্জনীতে অষ্টগুণ ধরে রাখবার ক্রিয়া তোয়াক্কাবিহীন করে দিবি
ডোমনি, তুইই দয়াল, আমাকে যথেচ্ছাচারী মূর্খ করে তোল
নিরক্ষর হয়ে যেতে চাই, অশুদ্ধচিত্ত, নির্বোধ, কমলকুলিশ
ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত ধরাধরি করে ডুব দিই বিষ্ঠার পাঁকে

“মলয়দাস বাউলের দেহতত্ব” কবিতায় মলয় রায়চৌধুরী আধুনিক জীবনের কর্মব্যস্ত নারীদের বাউল-সঙ্গিনীর আসনে বসিয়েছেন, কবিতা হয়ে উঠেছে অধুনান্তিক, উত্তরাধুনিক, প্রেমিকার প্রয়োজনও উত্তরাধুনিক দেহবন্দনার গুপিযন্ত্র  :-

ডোমনি, তুইই দয়াল, যখন বিদেশে যাস কেন রে আনিস কিনে সেক্সটয় ?
ভাইব্রেটর, ডিলডো, বেন-ওয়া-বল, গুহ্যের মুক্তমালা ?
ডোমনি, তুইই দয়াল,জানি কেন বিডিএসএম কবিতার বই এনেছিস,
জি-বিন্দু হিটাচির ম্যাজিকের ছড়ি ? নিপল টিপে কাঁপাবার ক্লিপ ?
ডোমনি, তুইই দয়াল, হাত-পায়ে দড়ি চোখে ঠুলি আমাকে চেয়ারে
উলঙ্গ বেঁধে রেখে দিয়েছিস, নিজের ফাঁস খুলে তলাতল রক্তের স্বাদটুকু দিলি
ডোমনি, তুইই দয়াল, শুদ্ধ প্রেমে মজল যারা কাম-রতিকে রাখলে কোথায়
চাবুক মারিস তুই, চুলের মুঠি ধরে ক্ষিরোদধারাকে চুষে বের করে নিস
ডোমনি, তুইই দয়াল, চাতক স্বভাব নাহলে অমৃতের দুধ তুই দিবিনাকো
আমার খিদে নেই, মুখের ভেতরে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ খেয়ে মজে গেছি
ডোমনি, তুইই দয়াল, যতো ইচ্ছে আনন্দ কর, দেহ নিয়ে খেল
আমি একটুও নড়ব না, আহ উহ করব না, যতো চাই ধাতুবীজ নিস
পরিশেষে বলি,  মলয় রায়চৌধুরীর প্রেমের কবিতার পর্যালোচনার বিশ্লেষণে এইকথা নিঃসন্দেহে বলা যেতে পারে যে প্রত্যেকটি সৃষ্টিতে চাক্ষুষমান এক পজিটিভ ইরটিসিজম, এক বেপরোয়া উন্মাদ প্রেমের রসানুভূতি,  যাতে তাঁর প্রেয়সীর আঙ্গিক মাধুর্যে চিত্রিত হয়, মধুবনীপটের সান্ধ্যভাষায় রঙীন লৈখিক-চিত্রে বর্ণিল হয়ে ওঠে পাঠক-পাঠিকার মনের ও দেহের জগত ।







বৃহস্পতিবার

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে বাসব রায়

মলয় রায়চৌধুরী আমার মনোযোগ আকর্ষণ করেন মাত্র দুটো কারণে। ফিফটিজ-এ লেখালিখি শুরু করলেও তাঁর ভাষায় একেবারে রাবীন্দ্রিক ছাপ নেই। তখন যাঁরা লিখছিলেন বাংলা ভাষায়, মলয় ঠিক তার উলটোদিক থেকে লিখেছেন এবং লিখতে লিখতে নিজস্ব একটি ভাষা তৈরি করেছেন। চলমান গদ্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে, তাকে অস্বীকার করে লেখা সত্যিই কঠিন বিষয় ছিল, এমনকি আজও তা সমান সত্য। এখানে অজিত রায়ের ভাষার কথা বলতে হয় যে তিনি সমকালকে অতিক্রম করেছেন, অন্তত ভাষার দিক থেকে। 
 
এবং মলয়ের নিজেকে উপুড় করে দেওয়ার ক্ষমতাকে আমি সেলাম করি। মলয় নিজেকেই যেন ছুরি দিয়ে কোপাতে থাকেন, আর তখন যে রক্তপাত হয় সেটাই তাঁর লেখালিখি। ছোটলোকের ছেলেবেলা, ডুবজলে, মেধার বাতানুকূল, নামগন্ধ যাই পড়ি না কেন, মলয় সেখানে নিজের মাংসের টুকরোই সাজিয়ে রেখেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার যে মলয় রায়চৌধুরী বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী লেখক হতে আসেননি, তিনি এসেছিলেন বাঁকবদলের জন্য, যেন সেটাই তাঁর কাজ। মলয়ের সেরা লেখা কোনটা? আমি জানি না, সম্ভবত মলয়ও জানেন না। কেননা তিনি সেরা লেখা লিখতে চাননি কখনো, চেয়েছিলেন চলমান সাহিত্যের ওপর হাতুড়ির ঘা মেরে নিজের ভাষাটাকে প্রতিষ্ঠা করতে। এবং কোনো সন্দেহ নেই যে তিনি সফল। 

 
আজ অজিত রায়, এর আগে নবারুণ, যে ভাষায় লিখছেন সেটা মলয় রায়চৌধুরীরই লিগ্যাসি।

সোমবার

নীরব মাহমুদ : সুবো আচার্য, হাংরি আন্দোলন, সাক্ষাৎকার


( সুবো আচার্য ছিলেন হাংরি আন্দোলনকারী । তাঁর বিরুদ্ধেও গ্রেপতারি পরোয়ানা ছিল । কিন্তু তিনি সেসময়ে ত্রিপুরার একটি গ্রামে গিয়ে গা ঢাকা দেন। পরে পুলিশ কেবল মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে মামলা করেছে শুনে সুবো আচার্য ত্রিপুরা থেকে ফেরেন, এবং দেওঘরে গিয়ে অনুকূল ঠাকুরের শিষ্যত্ব নিয়ে সাহিত্যজগত থেকে উধাও হয়ে যান । স্টেট ব্যাংকের চিফ ম্যানেজার হিসাবে অবসর নেবার পর কলকাতায় ফিরলে 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকার সম্পাদক প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁকে খুঁজে বের করে এই সাক্ষাৎকারটি নেন । আগ্রহীরা পড়ে সুবো আচার্যের পলায়ন ও পুনরাবির্ভাব ও নির্বাণের গল্প পাবেন সাক্ষাৎকারটিতে । 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকা, বসন্ত সংখ্যা, ২০১৪, ৭ বরদাকান্ত রোড, দমদম, কলকাতা ৭০০ ০৩০, মুঠোফোন : ৯৮৩১৬৭৯৩৭৭ ) 

প্রশ্ন : আপনার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না । হাংরি আন্দোলন মামলায় যাঁরা রাজসাক্ষী হয়েছিলেন, তাঁদের মুচলেকা থেকে তাঁদের পারিবারিক তথ্য পাওয়া যায় । আপনি যদি আপনার জন্ম, বাবা-মা, পরিবার, বাল্যকাল নিয়ে কিছু বলেন তাহলে ভালো হয় । 

উত্তর: আর দশটা বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেরা যেভাবে মানুষ হয়, আমিও সেভাবেই মানুষ হয়েছি -- খুব অল্প বয়সেই, দেশভাগের সামান্য আগে আমরা বাঁকুড়ায় চলে আসি --- সেখানেই আমার বড়ো হওয়া --- স্কুল-কলেজের পরে কলকাতায় এসে পড়াশুনো -- প্রথমে প্রেসিডেন্সি কলেজের মাধ্যমে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ( ড. হরপ্রসাদ মিত্রের সৌজন্যে ) কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে তুলনামূলক সাহিত্যের পোস্ট গ্র্যাজুয়েট ক্লাসে ভর্তি হই -- পরে এমন সব ঘটনা ঘটতে থাকে, যে একসময় আমি বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে আসি আমার তখনকার বন্ধু প্রদীপ চৌধুরীর সঙ্গে -- মূল কারণ ছিল কবিতা লেখা ও জীবনকে দেখা -- এছাড়া আর কিছু নয় --- তখনও হাংরি জেনারেশানের কারুর সঙ্গে আলাপও হয়নি --- আমার এ সিদ্ধান্ধ একজনই মাত্র সমর্থন করেছিলেন -- তিনি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় -- আয়ওয়া থেকে একটি চিঠিতে লিখেছিলেন --"যেভাবে জীবন কাটাতে চাইছ সেটা দিব্য"-- তারও প্রায় বছরখানেক বাদে যোগাযোগ হয় শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব, দেবী রায় আর ফালগুনী রায়ের সঙ্গে --- বন্ধুত্ব হয়, ভাববিনিময় হয়, একসঙ্গে উন্মত্ত জীবনযাপন শুরু হয় -- কলকাতার নাড়িনক্ষত্র, অন্ধিসন্ধি, গলিঘুঁজি দেখতে দেখতে চোখের ওপর থেকে যেন একটা পর্দা সরে যায় -- মলয়ের সঙ্গে জীবনে দুবারই দেখা হয়েছে --- একবার দুমকায় সমীরদার কোয়ার্টারে তাঁর আম্ন্ত্রণে গিয়ে -- দ্বিতীয়বার মলয় যখন সাহিত্যসংক্রান্ত মামলা মিটে যাওয়ার পর সুবিমল আর ত্রিদিবকে নিয়ে আমার তখনকার চাকরি স্হলে এসেছিলেন -- তখন সদ্য পিতৃহীন হয়েছি -- বিধবা মা আর এক দাদার সঙ্গে থাকতাম--- সঙ্গী ছিল গ্রন্হ, গ্রন্হ, গ্রন্হ --- লেখা আর লেখা আর লেখা আর বিরতিহীন, একাকী মদ্যপান আর মৃত্যুচিন্তা-- মৃত্যুর চিন্তা আমার সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল -- জীবনের এক বিচিত্র উদঘাটন হতে থাকে আমার কাছে --বাড়ির কাছেই ছিল একটা শ্মশান -- মধ্যরাতে ছাদে দাঁড়িয়ে মদ্যপ এক মৃত্যুচিন্তাকাতর যুবা, যে কয়েকবছর আগেও ধর্মতলা এলাকায় সন্ধ্যেয় ট্র্যাফিক অগ্রাহ্য করে উচ্চস্বরে কবিতা আবৃত্তি করতে করতে রাস্তা পেরোতো--- কলকাতা কিন্তু কবিকে অসন্মান করেনি -- নয়তো কবেই মরে যেতুম -- দেঘরে 'সৎসঙ্গ আশ্রমে শ্রীশ্রীঠাকুর অনুকূলচন্দ্রের সমীপে পৌঁছোই মৃত্যুরহস্য জানার জন্য -- তাঁরই নির্দেশে আমার দীক্ষা -- তাঁর দুটি মাত্র ছোট বাক্য বুঝতে আমার বছর আষ্টেক সময় লেগেছিল -- জীবনের দিগন্ত খুলে যেতে থাকে -- তাঁরই অনুপ্রেরণায় আমি যাবতীয় ধর্মগ্রন্হ থেকে হাহরণ করতে থাকি সারকথাগুলি--- জীবনের রাস্তাটাই সম্পূর্ণ বদলে যায় -- কথা যদি আমি বলি যে, তিনি সর্বক্ষণ আমার সঙ্গে থাকেন-- তাহলে লোকে পাগল বলবে আমায় । এই যে আপনার প্রশ্নগুলির উত্তর লিখছি এখনও তিনি আমার সঙ্গে আছেন --- ফলে সত্য থেকে বিচ্যুত হওয়া বা অহং নিয়ে মত্ত হহোয়ার কোনো উপায়ই নেই । তাঁর অনন্ত করুণা ও দয়ায় আমি গোটা জীবনটাকে দেখতে পাই -- শুধু দেখি না, মৃত্যুর ওপরে বসে প্রার্থনা করি, "অন্ধজনে দেহ আলো, মৃত্যুজনে দেহ প্রাণ--" 

প্রশ্ন : হাংরি আন্দোলনে আপনি কার মাধ্যমে যোগ দিলেন ? কবে নাগাদ আপনার মনে হল যে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে আপনি আত্মপ্রকাশ করতে পারবেন ? যে কাজকর্মের জন্য ষাটের অন্যান্য গোষ্ঠীর তুলনায় হাংরিদের খ্যাতি, তাতে কি অংশ নিতেন ? খালাসিটোলা যাওয়া, গাঁজা-হ্যাশিশ টানা, দলবেঁধে যত্রতত্র যাওয়া, ইত্যাদিতে অংশ নিয়েছেন কি ? হাংরি আন্দোলন মকদ্দমায় আপনার বিরুদ্ধেও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছিল । পুলিশ কি আপনার খোঁজে গিয়েছিল ? গ্রেপ্তার হলে মুচলেকা দিতেন ? মকদ্দমার সময়ে বন্ধুদের সমর্থনে নিম্ন/উচ্চ আদালতে যেতেন ? মকদ্দমার সময়ে আপনি কোথায় থাকতেন ? 

উত্তর : আমি, যতদূর মনে পড়ে, শৈলেশ্বর, সুভাষ, বাসুদেব এবং প্রদীপের সঙ্গেই মেলামেশা করতাম -- মলয়ের সঙ্গে যোগাযোগ হয় বহু পরে -- কারুর বেঁধে দেয়া ম্যানিফেস্টো বা নিয়মে লেখার কথা ভাবিনি কখনও, ফলে আমার ব্যাপারটা ছিল আমার মতন । লেখার ব্যাপারে আমার সেরকম কোনও বাসনা ছিল না -- শেক্সপিয়ার এর ঐ লাইনটা আমি খুব সমর্থন করি --"অ্যাম্বিশান ইজ এ থিং হুইচ মেকস অ্যান এনজেল এ সিনার" । প্রতিষ্ঠা বা নানারকম বিশেষণে ভূষিত হওয়া নিয়ে আমার কোনো মাথাব্যথা নেই । মলয়ের মামলা চলার সময়ে আমি ত্রিপুরায় থাকতাম -- তেলিয়ামুড়া নামে একটা জায়গায় স্কুলশিক্ষক ছিলাম -- কলকাতার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না -- ফলে এদিকের কিছুই জানতাম না । ওখানে ছমাসের বেশি থাকার পর আমি কলকাতায় ফিরে আসি । না, পুলিশ আমার সম্পর্কে কি কি করেছিল জানি না -- তবে, ওরা একটা ক্ষতি করেছিল -- ওদেই অ্যাডভার্স রিপোর্টের জন্য মিনিস্ট্রি অফ এক্সটারনাল অ্যাফেয়ার্স এ আমার প্রায় হওয়া একটা চাকরি শেষ অব্দি হয়নি -- মনে পড়ে, খুব ব্যথা পেয়েছিলাম -- বাস্তব ক্ষতি হয়েছিল দুটো -- আমার পিতৃদেব খুব হতাশ অবস্হায় চলে গিয়েছিলেন -- এবং যে মেয়েটি আমার জন্য বহু বছর অপেক্ষা করেছিল, সে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করে । কিন্তু এতে ওদের আর কি যায় আসে । আজ আমারও কিছু এসে যায় না । ইট ইজ এ পার্ট অফ দি গেম । ধ্বংস ও সৃষ্টির লীলা ছাড়া একে আর কি বলা যায় ! 

প্রশ্ন : আপনি কি নিজেকে প্রতিষ্ঠানবিরোধী মনে করেন ? অনেকে অভিযোগ করেন যে হাংরিরা প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে অথচ গোষ্ঠীপতি দাদা ও বইবাজারের বাণিজ্যিক কর্তাদের ধরে সংকলন প্রকাশ করতে এবং তার জন্য টাকা নিতে, তাদের বাধে না । এ বিষয়ে আপনার অবস্হান যদি স্পষ্ট করেন । 

উত্তর : এই চিন্তা থেকে আমি লক্ষ মাইল দূরে । তাছাড়া আমি বোধহয়, সেরকম গুরুত্বপূর্ণ কিছু ছিলাম না । শক্তি বা সন্দীপন সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না । তবে এদেশে প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার কথা বলে প্রাতিষ্ঠানিকতার প্রতি লোভ অনেকেরই আছে । সকলেই তো আর সতীনাথ ভাদুড়ি বা শঙ্খ ঘোষ নন । তাছাড়া লেখাটাই তো কথা, মূল ব্যাপার । 

প্রশ্ন : 'কথা ও কাহিনি' প্রকাশিত সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন সমীর চৌধুরী । সম্পাদকীয় পড়ে আমাদের মনে হয়েছে যে হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে সমীর চৌধুরীর কোনো ধারণা ছিল না । তিনি কয়েকজনের রচনা নিয়ে দপ্তরির কাজ করেছেন । আপনি কী বলেন ? 

উত্তর : আপনার কথাই তো ঠিক । 

প্রশ্ন : দে'জ থেকে প্রকাশিত হাংরি সংকলনটিকে অনেকে বলেন 'দারা-পুত্র-পরিবার' সংকলন । যে চারজন হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন, তাঁদের রচনা এই সংকলনে নেই । যাঁদের কার্যকলাপের জন্য হাংরি আন্দোলনের খ্যাতি, তাঁদের রচনা নেই । যাঁদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা বেরিয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশের রচনা নেই । তার পরিবর্তে আছে অমুকের স্ত্রী, তমুকের শ্যালক, তমুকের আত্মীয়, পাঁচের দশকের কবি, ইত্যাদি । আপনি সৎপথের ধার্মিক মানুষ হয়ে কোন তর্কে এই সংকলনে নিজেকে অন্তর্ভুক্ত করলেন ? 

উত্তর : ঐ সংকলনের কথা আমি জেনেছি 'দেশ' পত্রিকার বিজ্ঞাপন থেকে -- প্রদীপ চৌধুরীর টেলিফোন পেয়ে । আমি করলে অবশ্যই অন্যরকম হতো । মলয়কে বাদ দেয়া মানে তো শিরচ্ছেদ করা । 

প্রশ্ন : আপনি অনুকূল ঠাকুরের শরণাপন্ন কেন হলেন ? আপনি কি হাংরি আন্দোলনের জীবনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিলেন বা অধঃপতনের পথে চলে যাচ্ছিলেন ? আপনার কি মনে হয়েছিল যে হাংরিদের জীবন প্রকৃতপক্ষে একটি ইঁদুরকল, এবং তা থেকে মুক্তি প্রয়োজন ? হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কি অনুকূল ঠাকুরের মতবিরোধ আছে ? অনেকে তেমনটাই মনে করেন । আপনি কি বলবেন ? 

উত্তর : প্রশ্নের প্রথম অংশ সম্পর্কে কিছুই বলবো না । শুধু দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা সম্পর্কে বলি -- বই পড়ে কখনও ভগবানের অনুভূতি হয় না -- ঈশ্বরের জ্ঞান পেতে হলে কি করতে হয় ? ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলেছেন, "ঈশ্বর শুদ্ধ মনের গোচর" -- আগে জলে নামতে হবে তবে তো সাঁতার -- ডাঙায় সাঁতার দিলে বুকের ছাল-চামড়া ছিঁড়ে যাবে । কবি সমর সেনের 'বাবু বৃত্তান্ত' পড়লে এমন একটা দৃষ্টান্ত পাবেন যা অফুরন্ত হাসির খোরাক হয়ে আছে । হাংরিরা অসম্পূর্ণ -- ঠাকুর সম্পূর্ণ -- তিনি দ্বন্দ্বাতীতং গান সদৃশং । 

প্রশ্ন : আপনি কোনো কাব্যগ্রন্হ প্রকাশ করেননি কেন ? অথচ আপনি আপনার কবিতা 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দে'জ' প্রকাশিত সংকলনে অন্তর্ভুক্তির জন্য দিয়েছেন ? আপনি তো স্টেট ব্যাঙ্কের উঁচু পদে ছিলেন, মাইনেও ভালো পেতেন, তবু কাব্যগপ্রন্হ প্রকাশ করলেন না কেন ? আমরা, সাধারণ পাঠকরা, আপনার একটি কাব্যগপ্রন্হ খুঁজে বেড়াই । 


উত্তর : ভীষণ টাকার অভাব -- নয়তো, প্রকাশক পেলে হয়তো একটি বই বার করা যেতো । প্রশ্ন : আপনি কি মেডিটেশন করেন ? মেডিটেশনের সময়ে আপনার মনে কি কোনো কবিতার উন্মেষ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেয় ? এখনকার তরুণ কবিদের মেডিটেশান সম্পর্কে কোনো পথনির্দেশ দিতে পারেন কি ? উত্তর : পরামর্শ দিলে কেউ কি শুনবেন ? স্বামী বিবেকানন্দের 'ইন সার্চ অফ গড অ্যাণ্ড আদার পোয়েমস' পড়েছেন ? সন্ত কবীরের দোহা পড়লে বিস্ময়ে মূক হয়ে যেতে হয় -- এগুলো সবই মেডিটেশনের পথে পাওয়া -- কবীর পড়তে পড়তে আমি বার বার দেখি রবীন্দ্রনাথের অনেক আগেই তিনি অনেক কথা বলেছেন যা রবীন্দ্রনাথে ঘুরে ফিরে এসেছে । তবে ব্যক্তিটি তো রবীন্দ্রনাথ -- অসম্ভব এবং প্রবল পরিপাক শক্তি ছিল তাঁর । কবীরের ব্যবহৃত শব্দগুচ্ছ রবীন্দ্রনাথ বাংলায় এনেছেন ঈষৎ পরিবর্তিত করে । এবং মনে হবে এসবই রবীন্দ্রনাথের । 


প্রশ্ন : সুভাষ ঘোষ ও বাসুদেব দাশগুপ্ত সিপিএম-এ যোগ দিয়ে ছিলেন, অথচ হাংরি পত্রিকাও প্রকাশ করতেন । সুভাষ ঘোষের বাড়িতে জ্যোতি বসুর ফোটো ঝোলানো থাকত, লাল ঝাণ্ডার ভাঁড়ার ছিল । তাঁরা দুজনেই সিপিএম-এর মিছিলে অংশ নিতেন । তাঁদের এই রাজনৈতিক কার্যকলাপ কি প্রতিষ্ঠানের আশ্রয়ে তাঁদের সুবিধাভোগী প্রমাণ করে না ? আপনার কি মনে হয় ? 

উত্তর : কি জানি, ওদের রাজনৈতিক মতামত নিয়ে কখনও আমার সঙ্গে কথা হয়নি । বাসুদেবের শেষ দিকের রাজনৈতিক উপন্যাস আমার একেবারেই ভালো লাগেনি । 

প্রশ্ন : 'চন্দ্রগ্রহণ' পত্রিকার হাংরি আন্দোলন সংখ্যা ( সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ২০১৩ ) পড়ে আপনার কি মনে হয়েছে যে 'কথা ও কাহিনি' এবং 'দেজ' থেকে প্রকাশিত সংকলনগুলির তুলনায় এটি একটি সামগ্রিক কাজ, এবং সেকারণে প্রশংসনীয় ? উত্তর : কিছুই হয় না --- যতক্ষণ না দেখছি ততক্ষণ কোনও মন্তব্য করা ঠিক হবে না । প্রশ্ন : আপনি কি জানেন যে হাংরি আন্দোলন নিয়ে পিএইচ ডি এবং এম ফিল হয়েছে ? ওয়েসলিয়ান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মারিনা ডি হেলার হাংরি আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন ? ইউটা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনামিকা বন্দ্যোপাধ্যায় ফিল্ম তুলে নিয়ে গেছেন ? ইউ টিউবে হাংরি কবিতা পাঠ করে রেকর্ড করেছেন বাংলাদেশ, আমেরিকা, কানাডা ইত্যাদি দেশের কবিরা ? ফালগুনী রায়ের কবিতা নিয়ে ফিল্ম করেছেন শর্মী পাণ্ডে ? মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি নিয়ে ফিল্ম করেছেন মৃগাঙ্কশেখর গঙ্গোপাধ্যায় ? এই সংবাদগুলো শুনে আপনার কেমন প্রতিক্রিয়া হয় ? 'বাইশে শ্রাবণ' নামে একটি ফিল্মে প্রখ্যাত পরিচালক গৌতম ঘোষ জনৈক হাংরি কবির ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, জানেন ? ফিল্মটি আপনি দেখে থাকলে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইব । 

উত্তর : সিনেমাটা আমার সেভাবে দেখা হয়নি । তবে গৌতম ঘোষ একজন ব্রিলিয়ান্ট অভিনেতা -- সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনের পরে দুজন আমার খুব প্রিয় পরিচালক -- একজন আমার একদাকালের বন্ধু বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত -- অন্যজন অবশ্যই দি ম্যাসকুলাইন বয় অফ মাই টাইম, গৌতম ঘোষ । তৃতীয়জন সৃজিৎ মুখোপাধ্যায় । তবে যা বর্ণনা শুনেছি, আমরা একটু অন্যরকম ছিলাম । দৃশ্যত আমাদের অবয়বেই খানিকটা পাগলামির ভাব ছিল। কিন্তু আমরা আত্মহত্যা করিনি -- একটা অনুসন্ধান ছিল আমাদের -- সেটা অবিশ্যি এক একজনের এক একরকম । অ্যালেন গিন্সবার্গের তো শেষ পর্যন্ত বৌদ্ধদর্শনে খুব বিশ্বাস হয়েছিল । যদিও ওঁর ঈশ্বরানুভূতির ব্যাপারটা সেভাবে আমাদের প্রভাবিত করেনি -- যা ওঁদের প্রবল ক্ষতি করেছে তা হল নানা রকমের নেশা । বাহিরের চেষ্টায় কিছু হবে না ভাই -- এটা সম্পূর্ণ অন্তর্গত ব্যাপার । প্রণব, শ্মশানে গেলেই কি সব হয় ? ঈশ্বরলাভের জন্য বহু জন্মজন্মান্তের সুকৃতি লাগে । আর লাগে সংকল্প, লাগে "মুখ্য হরিকথা -নিরূপণ" করে যাওয়া । মানুষের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ঈশ্বরকে বা মূল উৎসকে খুঁজে পাওয়া -- সেটা হলেই সমস্ত অসম্পূর্ণতা তুচ্ছ হয়ে যায় । কবিতা মানে তো আমার কাছে আজ 'দি জার্নি টোয়ার্ডস দি ইটারনাল ট্রুথ -- আমি কি চাই ? এ টাচ অফ দি ইনফিনিট -- এ টাচ- এ রিয়াল টাচ । কোনো অজ্ঞাত কারণে আমার বেঁচে থাকা নয় । শংকরাচার্য বলতেন --ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা-- বুদ্ধও তাই বলতেন -- সূক্ষ্ম ভাবনা থেকে সূক্ষমতর ভাবনায় যেতে হবে -- বাসনার দাস হলে নির্বাণের পথ বন্ধ হয়ে যায় । সেইজন্যেই সহস্রমুখ চেতনার অধিকারী হতে হয় ।

রবিবার

তামারা ইয়াসমিন - হাংরি মুভমেন্ট : কালচারাল বাস্টার্ড আর হা-ভবঘুরেদের বিপ্লব

8 Sep 2018
Tamara Yasmin
https://roar.media/bangla/main/literature/hungry-movement-an-unsung-cultural-revolution
3242 Views
ষাটের দশক। দেশভাগের পর পশ্চিম বাংলায় এক বিশৃঙ্খল অবস্থা। একদিকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু কলোনিতে বাড়ছে মানুষের ভিড়, অন্যদিকে স্বরাজের স্বপ্নকে গুঁড়িয়ে চলছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। ঠিক এই সময় আবির্ভাব ঘটলো একদল তরুণ কবির। এক পাতার বুলেটিনে তারা জীবন, দর্শন, রাজনীতি আর যৌনতা বিষয়ে কবিতা, গদ্য, অনুগল্প আর স্কেচ ছাপালো। তারপর কফি হাউজ, পত্রিকা দপ্তর, কলেজের বাংলা বিভাগ আর লাইব্রেরি গিয়ে বিলি করতে থাকলো হ্যান্ডবিল আকারে। কলকাতার মোড়গুলোতে দাঁড়িয়ে পাঠ করলো তাদের রচনাগুলো। রচনাপাঠের জায়গাকে ঘিরে হাজারো মানুষের ভিড় জমে যায়। রবীন্দ্রনাথ আর জীবনানন্দের ভক্ত বাঙালি এমন ধারার কবিতা আগে শোনেনি। কোনো কোনো কবিতার প্রথম লাইনটাই ধাক্কা দিয়ে গেল- “তিন বিধবা গর্ভ করে শুয়ে আছি পুণ্য বিছানায়”। আবার কোনোটায় উঠে এলো বাস্তব জীবনের প্রহসন- “আমি খালি পেটে ইন্টারভ্যু দিতে গিয়ে বলে এলুম অর্থমন্ত্রীর কাকিমার নাম”। বাংলা সাহিত্যকে এই প্রথমবারের মতো বুদ্ধিজীবীদের সভা থেকে নামিয়ে আনা হলো রাস্তায়, সাধারণ মানুষের মাঝে। যে তরুণ কবিরা এই বিপ্লব ঘটালো, তারা নিজেদের দাবি করল 'হাংরি জেনারেশন' হিসেবে। আর এই ক্ষুধার্ত কবিদের নেতৃত্ব দিলেন ২১ বছরের এক তরুণ, মলয় রায়চৌধুরী; ভবিষ্যতে যিনি নিজের পরিচয় দিতে গিয়ে বলবেন ‘একজন কালচারাল বাস্টার্ড’।
Advertisement
আন্দোলনের সময় মলয় রায়চৌধুরী;
তবে শুধু কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি এই ক্ষুধার্ত কবির দল। ১৯৬৩ সালের কথা। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমএলএ, সচিব, লেখক এবং সাংবাদিকরা পেতে থাকলেন বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। কোনোটা জন্তু-জানোয়ারের, কোনোটা দানবের। জোকার, মিকি মাউস, দেবতা- কোনো ধরনের মুখোশই বাদ গেল না। প্রতিটি মুখোশের সাথে লেখা থাকে, “দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন”। অন্যদিকে কবি সাহিত্যিকদের পাঠানো হলো বিয়ের কার্ড। তাতে লেখা "Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry"। মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে ছোটগল্পের নামে আসতে লাগল সাদা কাগজ, আর বুক রিভিউয়ের জন্য পাঠানো হতো জুতোর বাক্স। প্রথাগত সাহিত্য আর সংস্কারের বিরুদ্ধে ক্রমে আরও জোরদার হলো 'হাংরি মুভমেন্ট'। কখনো তারা একটি বইয়ের দাম ধরলেন এক লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি বি সিল, আবার কখনো চিত্রপ্রদর্শনীর আয়োজন করে শেষদিন পুড়িয়ে ফেললেন সমস্ত চিত্রকর্ম। কিন্তু প্রশাসনকে খেপিয়ে হাংরিয়ালিস্টদের এই আন্দোলন বেশিদিন চলতে পারল না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ছয় কবির হাতে হাতকড়া পরানো হলো অশ্লীল রচনা আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার দায়ে। কিন্তু, সাহিত্য কি কখনো অশ্লীল হয়? নাকি এর পুরোটাই ছিল প্রতিষ্ঠিত সমাজের মুখোশধারী ভীত সুশীল শ্রেণীর ষড়যন্ত্র?
হাংরি মুভমেন্টের কথা উঠে এসেছে চলচ্চিত্রেও। সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের 'বাইশে শ্রাবণ' চলচ্চিত্রের নিবারণ চক্রবর্তীর কথা মনে আছে নিশ্চয়ই? নিবারণরূপী গৌতম ঘোষকে সৃজিত হাজির করেছিলেন একজন হাংরিয়ালিস্ট কবির চরিত্রে। উদ্ধত, অহংকারী আর খ্যাপাটে নিবারণ সিস্টেম নিয়ে বললেন- "একটা পঁচে যাওয়া সিস্টেম, প্রত্যেকটা মানুষ পঁচে যাওয়া। কয়েকটা লাশ ঘুরে বেড়াচ্ছে।” এই সিস্টেমের সাথে হাংরি প্রজন্মের দ্বন্দ্ব ছিল প্রকাশ্য। হাংরিয়ালিস্ট কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন,
"কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না
যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে
তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?"
https://assets.roar.media/assets/GqqnkqBIEQg5T0G9_16602232_1368676819869867_6703701947626399845_o.jpg
হাংরি আন্দোলনের ইশতেহার; Source: revolvy.com
হাংরি আন্দোলনকারীরা তাদের মুভমেন্টকে 'কালচারাল কাউন্টার' বলতেন। পশ্চিমা বিশ্বে তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী একটি প্রজন্ম, কালচারাল কাউন্টার ঘটিয়ে নতুনধারার এক সমাজের বীজ বুনে ফেলেছে। আমেরিকার 'বিট জেনারেশন' আর ব্রিটেনের 'অ্যাংরি ইয়াংম্যান' গোষ্ঠির লেখকেরা মূলধারার সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আঘাত হেনে বিশ্বে জনপ্রিয়। অনেকে এজন্য হাংরি জেনারেশনকে বিট জেনারেশনের সাথে তুলনা করলেন। বিট জেনারেশনের অনুপ্রেরণাতে হোক বা যেভাবেই হোক না কেন, ১৯৬১ সালে পাটনা থেকে রীতিমতো ইশতেহার ছাপিয়ে আন্দোলন শুরু করলেন মলয় রায়চৌধুরী। বিদ্রোহ ঘোষণা করলেন প্রচলিত ধারার সাহিত্য আর সমাজ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে। কবিতার ইশতেহারে তিনি লিখলেন, “শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত”। লিখলেন, “এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে”। রাজনৈতিক ইশতেহারে বললেন,“রাজনৈতিক বিশ্বাসের চেহারা পালটে দেওয়া হবে”। এই হাংরিয়ালিস্টদের ইশতেহারে লিড দিলেন উল্টোডাঙা বস্তির বাসিন্দা কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়, আর প্রকাশক ও সম্পাদক হাওড়া বস্তিবাসী দেবী রায়। মলয়ের বড় দাদা সমীর রায়চৌধুরী প্রথম জীবনে কৃত্তিবাসের সাথে যুক্ত থাকলেও এই আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। হাংরি বুলেটিন ছাপানোর অধিকাংশ খরচ সমীরই দিতেন। ১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত হন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণাবিধান মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, সতীন্দ্র ভৌমিক, অজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, তপন দাশ, মনোহর দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হাংরি আন্দোলনের লেখকেরা। ঘড়ির কাঁটার অভিমুখে: শৈলেশ্বর ঘোষ, মলয় রায়চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, বাসুদেব দাশগুপ্ত, ডেভিড গার্সিয়া এবং সুবিমল বসাক;
মলয় এই আন্দোলনের ধারণা নিয়েছিলেন ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের বাক্য “The Sour Hungry Time” আর জার্মান দার্শনিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘The Decline of the West’ গ্রন্থ থেকে। শৈলেশ্বর ঘোষের মতে, ‘হাংরি জেনারেশন’ শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬২ সালে বিনয় মজুমদারের কবিতার সমালোচনা করতে গিয়ে শক্তি বলেছিলেন, বিদেশের সাহিত্যকেন্দ্রে যে ধরনের আন্দোলন চলছে, তেমন আন্দোলন এখানে হলে তা কেবলমাত্র ক্ষুধা সংক্রান্ত হতে পারে। “ওদিকে ওদেশে সামাজিক অবস্হা অ্যাফ্লুয়েন্ট, ওরা বিট বা অ্যাংরি হতে পারে। আমরা কিন্তু ক্ষুধার্ত।” শক্তির এই ক্ষুধা অবশ্য শুধু আক্ষরিক অর্থেই ক্ষুধা ছিল না। তা ছিল সাহিত্যে মনের ভাব প্রকাশের ক্ষুধা, যথার্থ শব্দ প্রয়োগের ক্ষুধা, সৃষ্টির আকাঙ্ক্ষা আর অবদমিত বাসনা পূরণের ক্ষুধা। 

হাংরিয়ালিস্টদের এই ক্ষুধার্ত কার্যক্রম বুঝতে হলে তাদের সামাজিক অবস্থাটা বুঝতে হবে। এই হাংরি জেনারেশনের কবিরা শৈশব এবং কৈশোরে দেশভাগ দেখেছে। এদের একটি বড় অংশ বেড়ে উঠেছিল পূর্ব বাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু পরিবারে। তাদের আর্থ-সামাজিক নিরাপত্তা ছিল না। যারা পশ্চিমবঙ্গের ছিলেন, তাদেরও অনেকে বেড়ে উঠেছিলেন মানবেতর পরিবেশে। এই লেখকেরা জীবনকে যেভাবে দেখেছেন, সেভাবেই কবিতায় ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। কবিদের মধ্যে হাংরিরা কেবল মাইকেল মধুসূদন আর জীবনানন্দকে শ্রদ্ধা করতেন। মলয় অবশ্য ভালোবাসতেন রবীন্দ্রনাথের গান। সেই সময় পশ্চিম বাংলায় বামপন্থীরা সক্রিয়। কিন্তু এই হাংরি জেনারেশনকে আকৃষ্ট করতে পারলেন না তারা। এই তরুণেরা মার্কসকেও নাকচ করে দিয়েছিলেন। মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতাগুলো সোভিয়েত ভাঙার ২৫ বছর পূর্বেই অনুধাবন করেছিলেন এই বিপ্লবীরা। এবার তারা কবিতা, স্কেচ আর পোস্টারে তুলে আনলেন সমাজকে। ‘জখম’ কবিতায় মলয় লিখলেন-
“মানুষের দেয়া আইনানুগ মৃত্যুদণ্ড পেয়ে কেবল মানুষই মরে যাচ্ছে
ফ্যাক্ট্রি আর বিবাহ দুটোরই রেজিস্ট্রি হয়ে চোলেছে নিয়মমাফিক
কোল্কাতায় মদের ব্যবসা থেকে নৈতিক মাইনে পাচ্ছে ৪৫০০০ ডান হাত
১ একরে ১৩৫ জোড়া পায়ের ঠেসাঠেসি আরাম খাচ্ছে ১৯৬৫ মডেলের কোল্কাতা”

হাংরি ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে অনিল করঞ্জাইয়ের স্কেচ;
হাংরি মুভমেন্ট দ্রুতই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। দেশীয় পত্রিকাগুলো আন্দোলনকারীদের নিয়ে মুখরোচক সব সংবাদ লিখে চলল। তাদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী কর্মকাণ্ড পত্রিকায় নিয়মিত ছাপতে থাকলো। শিরোনামে লিখলো: “হা-ঘরে সম্প্রদায়”, “কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা”, “সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?”, "Erotic Lives & Loves of Hungry Generation"। কলকাতা, বেনারস আর নেপাল গিয়ে হিপীনীদের সাথে তাদের অবাধ যৌনচর্চার বর্ণনা ছাপালো কিছু সংবাদপত্র। হাংরিয়ানদের বিরুদ্ধে নানারকম অপপ্রচারও শুরু হল। বলা হলো, তারা বিটনিকদের মতো মাদকাসক্ত। প্রকৃতপক্ষে, হাংরিয়ালিস্টরা সৃজনশীলতা বৃদ্ধির আশায় মাদক নিতেন না। ব্যক্তিবিশেষে মদ্যপান বা নেশাদ্রব্যের অভ্যাস থাকলেও তা আন্দোলনের সাথে সামগ্রিকভাবে জড়িত ছিল না। হাংরি কবিদের বিকৃত যৌনতার ধারক বলেও চালানোর চেষ্টা হলো। শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ মেসে এক ঘরে থাকতেন, তাই ছড়ানো হল তারা সমকামী। এভাবে সত্য-মিথ্যে মিশিয়ে গণমাধ্যমে নানাভাবে প্রচার চলতে লাগল।

কল্লোল আর কৃত্তিবাসী গোষ্ঠী যা পারেনি, হাংরিরা কিন্তু তা-ই করে দেখিয়েছিলেন। হাংরি কবিতাগুলো বাকিদের চোখের সামনেই আমেরিকার লিটল ম্যাগাজিনগুলোতে প্রকাশিত হচ্ছিলো। ১৯৬৪ সালের ১০ই জুন আমেরিকা থেকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মলয়কে চিঠি লিখলেন-
"কলকাতা শহরটা আমার, ফির গিয়ে আমি ওখানে রাজত্ব করব। দু'একজন বন্ধুবান্ধব ওই দলে আছে বলে নিতান্ত স্নেহবশতই তোমাদের হাংরি জেনারেশন গোড়ার দিকে ভেঙে দিইনি। এখনও সে ক্ষমতা রাখি। লেখার বদলে হাঙ্গামা ও আন্দোলন করার দিকেই তোমার লক্ষ্য বেশি। যতো খুশি আন্দোলন করো, বাংলা কবিতার এতে কিছু এসে যায় না ।"
হাংরিদের এই অভ্যুত্থানে মূলধারার বাংলা কবিতায় পরিবর্তন হয়তো তাৎক্ষণিকভাবে দেখা গেল না, কিন্তু প্রতিষ্ঠিত কবি-সাহিত্যিক আর প্রশাসনের হর্তাকর্তাদের প্রতিক্রিয়াটা ঠিকই দেখা গেল। ১৯৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে এগারো জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হলো। মলয় রায়চৌধুরী, মলয়ের দাদা সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী- এই ছয় কবিকে গ্রেপ্তার করলো পুলিশ। এই লেখকদের বাড়িঘর তল্লাশী করার সময় পুলিশ বহু লেখা নষ্ট করলো। পাশাপাশি বই, ফাইল, টাইপরাইটার ইত্যাদিসহ সব ধরনের কাগজপত্র উঠিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। এগুলো আর কখনও ফেরত দেয়া হয়নি। হাতে হাতকড়া আর কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে আদালতে নেওয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীকে। জিজ্ঞাসাবাদের পর মলয় ছাড়া বাকিদের ছেড়ে দেওয়া হলো। মলয়ের 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' নামের কবিতাটিকে অশ্লীল আখ্যা দিয়ে চার্জশিট গঠন করল পুলিশ। মলয় লিখেছিলেন-
“আমাকে তোমার গর্ভে আমারই শুক্র থেকে জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমিও কি পেশাদার ভদ্রলোক হতুম মৃত ভায়ের মতন ?
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতীচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও আমায়”
তৎকালীন পত্রিকা এই কবিতাকে 'বেহুদা' বললেও এই একটিমাত্র কবিতাই পরবর্তীতে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া থেকে জায়গা করে নিয়েছিল ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত, ‘Modern And Postmodern Poetry of the Millenium’  সংকলনে।
যে ১১ জনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়েছিল, তাদের কারও কারও চাকরি চলে গেল, কারও হলো বদলি। সবার স্বাভাবিক জীবন নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। ভয়ে অনেকে আন্দোলন ছেড়ে দিলেন। এই সময় বদলে যায় চিত্র। মলয়ের সাথে যিনি ছিলেন হাংরি বুলেটিনের লিডার, সেই শক্তি চট্টোপাধ্যায় আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিলেন তার বিপক্ষে। অন্যদিকে মলয়ের পক্ষে সাক্ষী দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। ভরা আদালতে সুনীল বললেন, কবিতাটিতে কোনো অশ্লীলতা নেই। নিম্নআদালত সাজা দিলেও পরবর্তীতে উচ্চআদালতের দেওয়া রায়ে, ১৯৬৭ সালে বেকসুর খালাস পেলেন মলয় রায়চৌধুরী।

মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা পত্রিকার প্রচ্ছদ;
হাংরি জেনারেশন তৎকালীন সমাজের প্রথাগত নীতিবোধ আর চেতনায় দারুণ আঘাত হেনেছিল।  প্রতিঘাতে তাদেরও আক্রান্ত হতে হয়েছিল। কিন্তু এরপর আর হাংরি মুভমেন্ট জ্বলে উঠতে পারেনি। হ্যান্ডবিল আকারে প্রকাশিত হাংরি বুলেটিনগুলো দ্রুত ছড়িয়ে পড়লেও সেগুলো সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। বুলেটিনের বাইরে হাংরি আন্দোলনকারীরা জেব্রা, প্রতিদ্বন্দ্বী, উন্মার্গ, চিহ্ন, এষণা, ফুঃসতীন্দ্র এবং দি ওয়েস্ট পেপার নামে কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিল। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র এবং ঢাকার বাংলা একাডেমি মিলে এর মাত্র কয়েকটি বুলেটিন আর পত্রিকা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়।
‘হাংরি জেনারেশন’ যেসব সাহিত্যিকদের জন্ম দিয়েছে, তারা ব্যক্তিগত জীবনে এক অর্থে অসফল হলেও তাদের এই আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসঙ্গতিকে, এত অল্প সময়ে এভাবে কলমের আঘাতে আর কোনো সাহিত্যকেন্দ্রিক আন্দোলন, জর্জরিত করতে পারেনি।

তথ্যসূত্র

১। ক্ষুধার্ত সংকলন; সম্পাদনা: শৈলেশ্বর ঘোষ; প্রকাশক: সাহিত্য অকাদেমী, নিউ দিল্লি; প্রকাশকাল: ১৯৯৫

শনিবার

ভালোবাসা


প্রতিষ্ঠানবিরোধী ১০০ কবির কবিতার প্রদর্শনী, আজেরবাইজানের বাকু শহরে

আজেরবাইজানের বাকু শহরে সম্প্রতি ১০০ প্রতিষ্ঠানবিরোধী কবিদের কবিতার প্রদর্শনী হয়ে গেল । প্রদর্শনীতে সেই সব কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যা লেখার জন্য কবিদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল বা লকাপে পোরা হয়েছিল কিংবা জেলে ঢোকানো হয়েছিল । মলয় রায়চৌধুরীর 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটি প্রদর্শনীতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।
















 

বৃহস্পতিবার

উৎপলকুমার বসু : মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে দু-একটি কথা


         মলয় রায়চৌধুরী এখনকার বাংলা সাহিত্যে একটি বিশিষ্ট নাম ।

         তিনি ছয়ের দশকে লিখতে শুরু করেন এবং এখনও লিখছেন । তাঁর কবিতা, গদ্য, প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, ইস্তাহার ও Polemics এর সমগ্র সংগ্রহ প্রকাশিত হলে একটি প্রয়োজনীয় কাজ হবে বলে আমার ধারণা ।

         তিনি সাহিত্যিক নন । অর্থাৎ ‘সাহিত্যের সেবক’ বললে আমাদের স্মরণে যে-ছবিটি ভেসে ওঠে, তাঁকে সেই শ্রেণিতে ফেলা যাবে না । বাংলা সাহিত্য তাঁর হাতে যতটা না পূজিত হয়েছে --- আক্রান্ত হয়েছে তার থেকে অনেক বেশি ।

         গত চল্লিশ বছরে, বাংলা সাহিত্যের রণক্ষেত্রে যা ঘটেছে, তা লিপিবদ্ধ করার যোগ্যতা বা ধৈর্য আমার নেই । তবে, সংক্ষেপে এটুকু বলা যায় যে মলয় রায়চৌধুরী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়েই যুদ্ধে নেমেছিলেন । তাঁর তাত্বিক প্রস্তুতি ছিল । এবং তথাকথিত বাংলা ‘সংস্কৃতি’-র ঘরে তাঁর লালন পালন নয় বলে ওই কালচারের পীঠভূমিগুলিকে অবজ্ঞা করার মতো দুঃসাহস তিনি দেখিয়েছেন । 

         বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাঁকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না-গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । জীবনানন্দ কয়েকটি উপাদানকে অবলম্বন করেছিলেন । যেমন অভিনব ইমেজ বা চিত্রকল্পের ব্যবহার, মহাজাগতিক সচেতনতা, মানুষের উদ্যম ও প্রচেষ্টার প্রতি তীব্র অবজ্ঞা এবং সংশ্লিষ্ট আরও কয়েকটি গৌণ বিষয় । মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর প্রজন্মের লেখকদের ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল । কিন্তু অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তাঁদের অন্য ধরণের পথসন্ধান শুরু হয় । বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেওয়া ছাড়া অন্য উপায় ছিল না । তিনটি উপন্যাস ও স্মৃতিচারণেও মলয় রায়চৌধুরীর ওই আক্রমণাত্মক প্রবণতা লক্ষ্য করি । কথা প্রসঙ্গে তিনি একবার বলেছিলেন -- ‘লেখা রাজনীতি ছাড়া আর কী হতে পারে ?’

         বলাবাহুল্য, তিনি দলীয় বা সংসদীয় রাজনীতির কথা বলেননি । তিনি বলেছিলেন, ‘পলিটি’-র কথা । আমরা সবাই মিলে কীভাবে থাকব -- মলয় রায়চৌধুরী তারই একটা বোঝাপড়ার দলিল তৈরি করেছেন ।

[ হাওয়া৪৯ পত্রিকা, এপ্রিল ২০০১ ]

মঙ্গলবার

পৃথা রায়চৌধুরী : মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা




বিতর্ককে নস্যাৎ করে কজন হয়ে উঠেছেন নিজস্ব ঘরানার ব্র্যান্ড নেম? বিতর্ককে কবচকুন্ডল করেই আজও তিনি সোজা কথায় বলেন:

“একাই লড়েছিলুম।
কেউ বলেনি ‘হোক কলরব’
একাই নেমেছিলুম ব্যাংকশাল কোর্টের সিঁড়ি বেয়ে
সেদিন একাই ঘুরেছিলুম কলকাতার পথে সকাল পর্যন্ত” 

তাই তো মলয় রায়চৌধুরী হাজার কোটি মেকিদের থেকে এতটা ওপরে। একাই লড়েছেন আর জিতে গেছেন, আমাদের অনেকেরই ক্ষমতা নেই এভাবে রুখে দাঁড়াবার। নিজের প্রতি, নিজের কবিতার প্রতি, সৎ থাকতে তিনিই পেরেছিলেন, পেরেছিলেন নির্দ্বিধায় সাহিত্য অ্যাকাডেমি সহ বহু পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করতে।
“আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য, সাবর্ণ গোত্রের যোদ্ধা
আজ পর্যন্ত কেউ তরোয়াল চালানোয় আমাকে হারাতে পারেনি
কতো মুণ্ড এক কোপে ধরাশায়ী করেছি তার গোনাগুন্তি নেই
আমার বংশধরেরা তাই করবে একদিন, প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে–
ঘোড়ার পিঠে বসে চালাবে তরোবারি, যারাই সামনে আসবে মূর্খ মুণ্ড
গলা থেকে কেটে ফেলবে ধুলায়, সেসব মুণ্ড বেঁচে থাকবে, কথা বলবে
দরবারে গিয়ে যে-যার লেজটি নাড়িয়ে রাজা বা রানির সেবাদাস হয়ে
সারটা জীবনভর ঘেউ-ঘেউ করে ক্রমে-ক্রমে জীবাশ্মের রূপ নেবে”

লাইন কটা তুলে নিয়েছি ‘আমি লক্ষ্মীকান্ত, মহারাজা প্রতাপাদিত্যের অমাত্য’ কবিতা থেকে, শিহরিত হয়েছি বারবার এই কবিতা পড়ে, মনে মনে বলেছি, “যথার্থ! যথার্থ বলেছো মলয় রায়চৌধুরী, নিজের বংশগৌরবে গৌরবান্বিত তুমি। সেই আপোষহীন উচ্চশির লক্ষ্মীকান্তের বংশধর তুমি । সাবর্ণ রায়চৌধুরী বংশের ৩৪তম উত্তরপুরুষ, প্রতি পদে রয়েছো আপোষহীন, নির্ভীক।” ১৬ই জুলাই, ২০১৭ এই কবিতা আমি পড়ি ফেসবুকেই মলয় রায়চৌধুরীর পোস্টে। কবিতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরীদের ইতিহাস জীবন্ত হয়ে উঠছে প্রতি শব্দে, ছত্রে আর আমাকে বলেছে, “চিনে নে!” এই কবিতায় কিন্তু আমরা কবির ভেতর দিয়েই মানুষটাকেও দেখতে পাচ্ছি, চিরকালের প্রাতিষ্ঠানিকতায় মাখানো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মুখর হয়ে ওঠা, একা লড়াকু মানুষটা, যার হাতের কলম বরাবর তরোয়ালের মতোই ঝলসে উঠেছে, ফালাফালা করে দিয়েছে যা কিছু বস্তাপচা।
না, এখানে মানুষ মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে মোটেই আলোচনা করতে বসিনি, সেই স্পর্ধা আমার নেই, মনে মনে কেবল এই ভেবে গর্বিত হই, এই মহান কবি, সম্পর্কে আমার জ্যাঠাশ্বশুর হন, আর এঁর লেখা পড়ে পড়ে শিউরে উঠি কেবল। নিজে যেহেতু কবিতা লিখি, তাই বিশেষ করে পড়ে ফেলি ওঁর কবিতা, বুঝি, কতটা আপাত সরল ভাষ্যের ভেতর দিয়ে উনি নিংড়ে বার করে আনেন মানুষের ভেতরের সমস্ত দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, জটিল ভাবনা বা চলতে থাকা নানান সংঘাত। বসেছি জেঠুর কবিতা সম্পর্কে সামান্য দুকলম লিখতে,  কিন্তু প্রতি পদক্ষেপে যেন মনে হচ্ছে কবি মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার সামনে আমরা সকলে এতোটাই ছোটো, যে তাঁর সব কবিতা নিয়ে আমরা আলোচনা তো করতে পারি, কিন্তু তা হয়ে দাঁড়ায় সুউচ্চ পর্বতের নীচে দাঁড়িয়ে ঘাড় উঁচু করে পর্বতশৃঙ্গের ভয়াল সৌন্দর্যকে ব্যাখ্যা করার সমতুল্য।
কবি তাঁর বহু বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতা লেখার ‘অপরাধে’ অশ্লীলতার দায়ে কারাবাস করেন, এ কথা সাহিত্য জগতের প্রতিটি মানুষ জানেন, এই কবিতা নিয়ে আজও প্রতিনিয়ত সাহিত্য সংক্রান্ত গবেষণা করা হয়, আন্তর্জাতিক স্তরেও। যা এককালে কবিকে অপমানজনক পরিস্থিতিতে দাঁড় করিয়েছিল, তা এখন একপ্রকার কিংবদন্তী। বড়ো বেশি শরীরধর্মী, যৌনতার আঁশটে ভাষায় লেখা এই কবিতা পড়ে আপাতভাবে শ্লীল সমাজ চোখে-মনে কাপড় বেঁধে গান্ধারী হয়ে যান আজও, অথচ কবিতাটির ভেতর যে চরম যন্ত্রণার প্রকাশ, তা বুঝে নিতে পারলে, এই কবিতা হয়ে ওঠে অমৃত, আপাত অশ্লীল ভাষ্যের গরল মন্থন করে পাঠক পেয়ে যান অমৃত। যন্ত্রণা অপরিসীম, কবিতাটির নিচের কটি লাইনে…

“প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না”
আবার কতটা তীব্র ব্যথা অনুভব হলে কবি এমন অস্থির ভাবে লিখতে পারেন,

“আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”… 

পাঠক ঢুকে যান কবিতার ছত্রে ছত্রে রন্ধ্রে রন্ধ্রে, কি মারাত্মক আঘাত করেছেন কবি প্রতিষ্ঠানকে, ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিয়েছেন চাঁদ-তারা-নদী-তুমি আমি-ফল্গুধারা কাব্যভাষাকে। আর এই প্রচণ্ড বেগে হুড়মুড়িয়ে ঢুকে আসা কর্কশ সপাট কবিতাকে হজম করে নিতে তখনও বহু মানুষ পারেননি, আজও অনেকে পারেননা, বলাই বাহুল্য।
ঝলসে দেওয়া কবিতার কণ্ঠ তাঁর হয়তো ছোটবেলার অস্বাচ্ছন্দের জন্য বেড়ে ওঠা ক্ষোভ বিদ্রোহ ভরা বুকের একেবারে ভেতরের অনুভূতির জন্য। আবার এই কবিই ‘আমার জন্মদিন নেই’ কবিতায় লিখে ফেলেন,

“ঠাকুমা কবে জেঠা আর বাবাকে প্রসব করেছিলেন 
তার তিথি ঠাকুমা জানেন
প্রসবদিন পালনের তো কোনো রেওয়াজ নেই
তাই মা আমাকে কোন তিথিতে প্রসব করেছিলেন জানি
মায়ের কষ্টের গল্প জানি
হাসপাতালে ভর্তির গল্প জানি
কিন্তু আমার জন্মদিন জানি না”…
সাধারণ পাঠক আমি, কবির অন্তরাত্মা ছুঁয়ে বলি, এতটাও নরম ভাব এই রুক্ষ জমিতে থাকে ! কেবল বারুদ আর লাভা নিয়ে যে কবির বিচরণ, তার ভেতরের প্রকৃত মানুষের হৃদয় কে-ই বা সহজে বুঝেছে!
পাঠক যেন ক্রমাগত তড়িতাহত হতে থাকেন তাঁর বিজলীসম কবিতায় । কবির তাৎক্ষনিক মনের ভাব, চঞ্চলতা তিনি প্রকাশ করেন  ভিন্নধর্মী কবিতায়। আবার এই তিনিই ‘নখ কাটা ও প্রেম’ কবিতায় হঠাৎ লিখে ফেলেন, বলা ভালো প্রশ্ন করে বসেন,

“রবীন্দ্রনাথ, দেড়শ বছর পর একটা প্রশ্ন আপনাকে :
কে আপনার নখ কেটে দিত যখন বিদেশ-বিভুঁয়ে থাকতেন–
সেই বিদেশিনী ? নাকি চৌখশ সুন্দরী ভক্তিমতীরা ?” 

ভাবা যায়? নেকুপুষু প্রেমের কবিতা লিখে তুলতুলে ভাব ভাগ্যিস তিনি তাঁর কবিতায় আনেননি। বরাবর প্রথাভাঙ্গার নিদর্শন হয়েছে তাঁর প্রায় প্রতিটা কবিতা। কি অসামান্য প্রেম দেখিয়েছেন তিনি তাঁর ‘বুড়ি’ কবিতায়। গভীর প্রেম এই কবিতায়।

“এও আমাকে বলে এবার ঘুমোও
আর রাত জাগা স্বাস্হ্যের পক্ষে
খারাপ, এই বুড়ি যে আমার বউ
বিছানায় শুয়ে বলে, কাউকে নয়
কাউকে দিও না খবর, কারুক্কে নয়–
এ-কথাটা আমারই, কাউকে নয়
কারুক্কে বোলো না মরে গেছি ।“ 


মন খারাপ করে, গলায় ব্যথা-ব্যথা কষ্ট হয়, অথচ কি চরম প্রেম ! গভীর অনুভূতি, পরম ভরসা ফুটে ওঠে, প্রতি ছত্রে। বিষাদেরও যে এমন মিঠে সোয়াদ, তা বোধহয় এই কবিতা পড়লে তবেই বোঝা যায়। এ যেমন একাধারে প্রেমের কবিতা, তারই সাথে এ চিরশাশ্বত মৃত্যুচেতনার কবিতা। আমরা ভাবতে বাধ্য হই, এই এত আঁকড়ে থাকা, এত ভালোবাসা, এত জীবন প্রাচুর্যের মাঝেও মৃত্যুচেতনা কতটা ঘিরে রাখে আমাদের অবচেতন।
মলয় রায়চৌধুরীর দাদা,  অর্থাৎ স্বর্গত সমীর রায়চৌধুরীর মৃত্যুর পরের দিন লেখা কবির যে কবিতা, ‘সেন্স অফ লস’ এর স্তবগান’, তা যেন পাঠককে কবির জায়গায় বসিয়ে দেয়,

“কাল বাইশে জুন, ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা সমীর রায়চৌধুরী”…………
“কাল, বাইশে জুন ২০১৬, সকাল আটটা পনেরোয় দাদা মারা গেছেন 
দাদা মানে মিনু” 

 
কবিতার প্রথম লাইন কবিতার মাঝামাঝি আবার ফিরে এসেছে। প্রথম লাইনের পরে এসেছে প্রয়াত দাদার পোশাকি নাম, আর মাঝখানে এসেছে দাদার ডাকনাম। এইভাবে একই লাইনের ব্যবহারে, অথচ দুবার দুরকম নামের ব্যবহারে আমরা আসল ‘সেন্স অফ লস’ বুঝতে পারি। বুঝতে পারি, কতটা জড়িয়ে রাখেন কবি তাঁর সদ্যপ্রয়াত দাদার স্মৃতি, কতটা হারাবার বোধ পীড়াদায়ক হয়ে উঠেছে কবির কাছে।


হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা ‘জখম’ কবিতাটি মলয় রায়চৌধুরী এইভাবে আরম্ভ করেছেন :
“চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে তার নীচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখছি এখন
দুঃখ-কষ্টের শুনানী মুলতুবি রেখে আমি আমার সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নিচ্ছি
হাতের রেখার ওপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে জেনে নিচ্ছি আমার ভবিষ্যত” 

হাংরি জেনারেশানের পুরোধা কবির নিজের বিশেষ প্রিয় কবিতা ‘জখম’ থেকে নেওয়া এই কটা লাইনে দ্রিম দ্রিম করে শুরুয়াতি সুর শোনা যায় এক অনন্ত ক্ষুব্ধ আহত অস্থির কণ্ঠের কবিতার। ‘জখম’ ভর্তি কবি হৃদয় থেকেই কাব্যধারায় বেরিয়ে আসে এই অনন্ত শোণিতাভ দীর্ঘ কবিতা, কবিতায় বারবার প্রয়োগ হয়েছে তাঁর নিরীক্ষার বিশেষ বানানরীতি…

“বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল
এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে  মলয়ে কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়
আশপাশ দিয়ে ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়
কব্জিতে ঘড়ির কাঁটা রেখে চলে যাচ্ছে সারসার সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের লাভলোক্সানময় দল”

আবার কি অনায়াস উচ্চারণে কবি তাঁর লেখা অবিস্মরণীয় ছত্রগুলোর ইংরেজি অনুবাদ করেছেন সময়ে সময়ে…
“armature on thye left turned slag long ago
now eyeflesh twitching in the smoke of malay’s burning
skeleton
dismantled tempests sweep by at 99mph
uniform queues of wristwatched zombies tattle”


রাজনৈতিক বা তৎকালীন সাম্প্রদায়িক যতো অসহিষ্ণুতা এবং অস্থিরতা যেন ফুটে ওঠে এই ‘জখম’ ভর্তি কবিতায়। যা তখন সত্যি ছিল, তা আজও চরম প্রাসঙ্গিক। তাই এটুকু বলাই যায়, কবি মলয় রায়চৌধুরী সময়ের থেকে এগিয়ে গিয়ে নিজের অন্তঃস্থল খুঁড়ে, সচেতনভাবে মানুষের কথা বলে যান তাঁর কবিতায়। তিনি কাব্যকথায় মানুষের অবচেতনের সমস্ত কথা এবং সচেতন যাপনের সার কথা সমস্তই বলে যান অকপট ভাবে।
এই কবি তাঁর কবিতা সম্পর্কে বলেছেন, তাঁর “কবিতা পায়”; ঠিক মানুষের বাকি সব পাওয়ার মতোই কবিতাও পায়। কবিতার সাথে কতটা ওতপ্রোত ভাবে সম্পৃক্ত হলে একাত্মতা থাকলে এবং কবিতার প্রতি একনিষ্ঠ থাকলে কেউ এই কথা বলতে পারেন, তা সাধারণের পক্ষে বোঝা হয়তো দুষ্কর। গতানুগতিকতার মন্থর চালে চলে আসতে থাকা বাংলা কবিতার রক্ষণশীল বেড়াকে তিনি তাঁর কথ্যভাষার বম্বশেলে গুঁড়িয়ে দিতেই “গেল গেল” রব যেমন উঠেছিলো, সেই রবের কারণগুলোকে কিন্তু লুকিয়ে-চুরিয়ে হলেও পড়ে ফেলত গোঁড়া বাঙালি । ভাষা সাহিত্যের তথাকথিত এলিট ক্লাস সেসব না পড়ে ফেললে, নিজেদের টলোমলো আসন সামলে রাখার জিগিরে কীভাবে  গেল-গেল রবের হিড়িক তুলতেন?
ভয় পেয়েছিলেন কি এই আগুন কলমকে তাঁরা?

সম্প্রতি পড়লাম তাঁর কবিতা ‘রাষ্ট্রের বহি-খাতা’; পড়েই নিজেকে এবং অসংখ্য মানুষের অত্যন্ত সমস্যাসংকুল জীবনের এক মোক্ষম প্রশ্নের সম্মুখীন দাঁড়াতে হল, আমরা কি হরেদরে সকলেই এই সাংবিধানিক গণতন্ত্রের চাকার চোখে নিজের দেশে অভিবাসী মাত্র? আমাদের নাগরিকত্ব, আমাদের স্বদেশের শেকড় কি কেবল সরকারের ঠাপ্পা মারা, সরকারী শিলমোহর আঁকা কয়েক টুকরো কাগজের মুখাপেক্ষি?

 দলিল থাকলেও ফেলে দিতুম, তবে দলিলের জেরক্স 
দেখেছিলুম, ষোড়শ শতকের কারোর ফার্সিতে লেখা নাম 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে ষোড়শ শতকের
সেই পূর্বপুরুষে ওর রক্তের শেকড় রয়েছে?  
বাড়ির ট্যাক্স বাবা দিতেন, তার আগে দাদু
দাদুর বাবা, তার আগে নবাবের খাজনা–
বিলডার ঘুষের ঠেলা মেরে মালিকানার
সমস্যা সমাধান করে ফেলেছিল 
এখন রাখি কেমন করে প্রমাণ করবে যে
 ভারতের সত্যিকারের নাগরিক?”

রাখি কবির বোন। বোনের ন্যায্য চিন্তার মধ্যে দিয়ে আসলে তিনি প্রতিফলিত করেছেন এই দেশের নাগরিকদের চিন্তাক্লিষ্ট চেহারা।

কবি শ্লেষাত্মক ভঙ্গীতে লিখে ফেলেছেন ‘রাস্তার কবিতা’। তার ছত্রে ছত্রে লেখা আছে, বলা ভালো বয়ান করা আছে আমাদের তুচ্ছতা। আপাতদৃষ্টিতে এখানে যা শুধু কবির দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির লঘু বর্ণনা, তা আসলে গভীরে ঢুকে নাড়া দেয় আমাদের, বুঝিয়ে দেয়, এইটুকুই আমাদের মূল্য। চোখ বাঁধা অন্ধ আমাদের ঝাঁকুনি দেয় তাঁর সোজা সরল কথ্য ভাষায় লেখা গভীর অর্থবহ সমস্ত কবিতা।

“কাগজ কুড়োনোর কাজ আরম্ভ করে প্রথম ছেঁড়া নোংরা কাগজের টুকরো
তুলেই কাগজটা ছেড়ে দিতে হলো
কাগজটা দিয়ে দিলুম কুড়ানিকে
যে আঁস্তাকুড় থেকে কাগজ বাছাই করছিল
আসলে যে কাগজটা তুলেছিলুম সেটায় দেখলুম
আমারই একটা কবিতা, ‘কালিমাটি’ পত্রিকায় বহুদিন আগে 
প্রকাশিত হয়েছিল
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা নিয়ে লিখতে বসলে সামান্য কটা পাতায় তা সীমিত রাখা বড়ই কষ্টকর, অথচ সুবিশাল কিছু লেখা এখানে সম্ভব না, কারণ তা যে দুতিন পাতার ভেতর লিখতে হবে, তা কবি আগেই বলেছেন। তবুও সামান্য হয়তো বড়ো হয়ে গেল লেখাটা। তাঁর কবিতার কথা বলতে গেলে অবশ্যম্ভাবী ভাবেই আসবে ‘অবন্তিকা’র কথা। এক অনবদ্য প্রেমের কবিতা, ‘মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো’।

“মাথা কেটে পাঠাচ্ছি, যত্ন করে রেখো
মুখ দেখে ভালোবেসে বলেছিলে, “চলুন পালাই”
ভিতু বলে সাহস যোগাতে পারিনি সেই দিন, তাই
নিজের মাথা কেটে পাঠালুম, আজকে ভ্যালেনটাইনের দিন
ভালো করে গিফ্টপ্যাক করা আছে, “ভালোবাসি” লেখা কার্ডসহ

সব পাবে যা-যা চেয়েছিলে, ঘাম-লালা-অশ্রুজল, ফাটাফুটো ঠোঁট”… 

হেন প্রেমিক বা প্রেমিকা নেই, যার অন্তঃস্থল পর্যন্ত শিরশির করে উঠবে না এই কবিতা পাঠ করে।
“কি-বোর্ডে পাকাচুল পড়ে, তুলো দিয়ে সরিয়ে দিই ; চশমার লেন্সে পাকাচুল পড়ে, মুছে সরিয়ে দিই। তবু লেখালিখি ছাড়তে ইচ্ছে করে না”… সম্প্রতি কবি এমনটাই বলেছেন।

এক সাধারণ গুণমুগ্ধ পাঠিকার আসন থেকে চীৎকার করেছি, আরও, আরও লিখুন কবি, এত লিখুন যে আমাদের মগজের রক্তক্ষরণ যেন বন্ধ না হয়। রক্তের সরোবর বানান আমাদেরই হৃদয়ের ক্ষরণে, সেই সরোবরকে আয়না করে আমরা সকলে উঠে দাঁড়াই ঋজু দৃপ্ত কবিতার কাঁধে ভর করে। তাঁর নিজের ভাষায়, “কবিতা কেবল মঞ্চে বিড়বিড় করে পড়ার ব্যাপার নয়;  উন্মাদের মতো চীৎকার করে না পড়লে প্রতিষ্ঠান কষ্টযন্ত্রণার গোঙানি শুনতে পায় না।” শিখি তাঁর প্রতিটি উক্তি থেকেও। কবি মলয় রায়চৌধুরীর কাছে “কবিতার কোনও সংজ্ঞা নেই, নির্দেশিকা হয় না তাই যা ইচ্ছা, যেমন ভাবে ইচ্ছা লিখুন”… এই মানুষের কবিতা নিয়ে আলোচনা করা কি সহজ কথা? যিনি কবিতাকেই প্রেমিকা করে নিতে পারেন, তাঁর কবিতার কাছাকাছি গিয়ে তাকে স্পর্শ করাই নিজের মধ্যে এক সুবিশাল অর্জন।
“আবলুশ অন্ধকারে তলপেটে লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ি
পিছমোড়া করে বাঁধা হাতকড়া স্যাঁতসেঁতে ধুলোপড়া মেঝে
আচমকা কড়া আলো জ্বলে উঠে চোখ ধাঁধায়
তক্ষুণি নিভে গেলে মুখে বুট জুতো পড়ে দু-তিনবার” 


তাঁর ‘আলো’ নামক কবিতার প্রথম চার লাইন উদ্ধৃত করে এই লেখা শেষ করছি। এই কবিতার মধ্যে দিয়ে কবি পেরেছিলেন সামগ্রিকরূপে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে ফুটিয়ে তুলতে। রাষ্ট্রের শাসনের নামে যে সন্ত্রাস, যার চাবুকের নীচে আলোহীন বাঁচতে-থাকা বোবা মানুষেরা প্রতিবাদী হলেই, তারা প্রথা ভাঙতে চেষ্টা করলেই, কি কি ঘটে যায়, তা ধরে রেখেছে এই কবিতার প্রতিটি শব্দ। অথচ লড়াকু প্রতিবাদী কবি কণ্ঠ লিখে ফেলে এই কবিতার শেষ লাইন দুটি মূল উপাদান হিসেবে…

“একসঙ্গে সব আলো আরেকবার নিভে গেলে
পরবর্তী আক্রমণ সহ্য করার জন্য নিজেকে তৈরি করে নিই।”

কলকাতার সাহিত্যজগত থেকে দূরে বসে কবি ভারতীয় সমাজের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা থেকে সচেতনভাবে সৃষ্টিতে মেতে লিখে চলেছেন ষাটের দশক থেকে জ্যা মুক্ত তীরের মতো ক্ষিপ্র ধারালো কবিতা। তাঁর লেখা স্বাধীন ও স্বতন্ত্র।
সত্যিই তিনি অসীম শক্তিশালী, আমার কাছে কবিতার ঈশ্বরসম বলেই, তাঁর কবিতার কাছে সহজ মনে না পৌঁছতে পারলে আজও শ্লীল-অশ্লীল, অথবা নানান দোহাই পাড়ে যারা, তাদের উদ্দেশ্যে কবির ভাষায় বলি,”আমাকে ধিক্কার দেয়া যায় আমাকে উপেক্ষা করা যায় না।” কারুর আনুকূল্য অথবা হাততালি, পুরস্কার ইত্যাদির পরোয়া না করে তিনি লিখে চলেছেন আজও তাঁর বাঁধনছাড়া বেপরোয়া নিজস্ব শৈলীতে।

সোমবার

ঝুমা চট্টোপাধ্যায় : মলয় রায়চৌধুরীর উপন্যাস 'ঔরস'



মলয়  রায়চৌধুরীর উপন্যাস ‘ঔরস’
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়

মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে কোনোদিন আমার মুখোমুখি সাক্ষাৎ হয়নি। মাঝ দুপুর বা ঝিঁঝিঁ পোকা সন্ধ্যেয় পুরনো খবরের কাগজের কোণায় মুড়ে সেই অতিরিক্ত ঝাল আর গুড় তেল দেওয়া লংকা-আমের আচার টুকু আর টুকলির মা, ব্যস এই অসামান্য জিনিষদুটোর মুখোমুখি হলেই চিরকাল যার পর নাই খুশী হতাম কিন্তু আশি সালের পর যারা বাংলাদেশ থেকে এসেছিল বরাবর তারা সেল( স্টীল অথারিটি অব ইন্ডিয়া লিমিটেড)এর কোয়ার্টারে উন্নত বসবাস করবে এমনটা আশা করা ভুল, তাই ক’এক বছর পর টুকলি আর তার মা কোথায় চালান হয়ে গেল বলা মুশকিল, আর হ্যাঁ অবশ্যই মলয় রায়চৌধুরী যিনি হাংরী মুভমেন্টের কবি ,দেখেছেন লিখেছেন দিয়ারা , দ্বীপের মত চর, জেগে ওঠে, জল প্রবাহকে জড়িয়ে শুয়ে থাকে বছরের পর বছর...এবং সেই চরে বসবাসকারী অজস্র মানুষের সুখ শান্তি পাইপ-গান কাট্টা –তামাঞ্চা গাঁড়াসা ভোজালি এক নল্লা দু নল্লা একে সান তাল্লিশসেই সব প্রত্যক্ষদর্শীরা যারা চায়নি গঙ্গার বুকে চর জাগুক, পুরনো পলি জমে শক্ত হয়ে ক্রমে শুকনো ডাঙ্গা ও অগণিত মানুষের উদ্বিগ্ন ক্রম বিবর্তন, মলয় রায়চৌধুরী তাদের ক্ষোভ লালসা আঘাত প্রত্যুত্তর টু বি স্পেসিফিক, ‘ঔরস’ উপন্যাস দিয়ে আমাদের বুঝিয়েছেন দেখিয়েছেন ভুলিয়েছেন জাগিয়েছেন হয়ত কোথাও গোপনে কাঁদিয়েওছেন, যে কান্নাটা আমি বহু বছর আগে টুকলির মার জন্য কাঁদতে পারতাম। মলয়ের লেখা তবুও সব সময় পড়িনা, কারণ তা একলা একটা খন্ডে গিয়ে শেষমেষ যাবতীয় সুখ-শান্তির সমাপ্তি বা কোকিল ডাকা ভোরএ ঘুম ভাঙ্গিয়ে তুলবে না বলে।শুধু যখন আর কিছু পড়া বা শোনা মাথায় অবিশ্রান্ত একঘেয়ে কামান দেগে দেগে ইনফরমেশনের পাহাড় গড়ে তোলে,ঠিক তখুনি ‘ছোটলোকের ছেলেবেলা’, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ বা ‘ ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এক আধবার চোখ বুলিয়ে নিলেই যথেষ্ঠ। ‘ঔরস’ও তাই-ই, তবে একবারে হয়নি, পরপর তিন বার পড়ে ফেলতে হল। এক নিঃশ্বাসে দ্রুত,কারণ উপন্যাসটাও যেন ঐ এক নিঃশ্বাসে দ্রুত কয়ে যাওয়া। যার কথা ও সুর দুটোই মলয় রায়চৌধুরীর।
একজন রেগুলার পাঠক বলতে যা বোঝায় মলয় রায়চৌধুরীর তেমন পাঠক আমি না। কিন্তু ওনার অতীত বর্তমান ও ভবিষৎ পাঠক, তাদের আবেদন নিবেদন এবং সপ্রেম গোপন দীর্ঘশ্বাস, এবং তাঁর রচনাবলীর প্রকাশক সম্পাদক এবং বইএর পুনর্মুদ্রন, প্রাপ্তিস্থান এবং অল্প হলেও দ্রুত চোখ বুলিয়ে নেওয়া ‘মূল্য’ আমার নজরে থাকে, থেকেই যায়। আরও মন দিয়ে লক্ষ্য করি ওনার বইগুলির প্রচ্ছদের ভেতর দিকের প্রথম পাতা, যেখানে একদম নীচে ছোট ছোট হরফে ‘ এই লেখকের অন্যান্য বই’। ঔরস উপন্যাস পড়ার আগে ওনার পুরনো লেখাগুলো পড়েছিলাম, কোনও কোনও লেখা আবার দুবারও। অসংখ্য চরিত্র, তাদের হিজিবিজি উপস্থিতি,সংলাপ, বাদানুবাদ,আর্জি, দাবী-দাওয়া বকমবকম...
‘মাছ খাও না?’ জানতে চাইল ঢ্যাঙা যুবতী, জিনসের ঘাঘরা। ‘তুমি তো বাঙালী?’
আবোল তাবল মাংস আর শুঁটকি মাছের বোঁটকা ভয় অতনুর। বরং নিরামিষ খেয়ে চালিয়ে দেবে। যুবতীর কন্ঠস্বর কিছুটা ভাঙা ভাঙা, শোনেনি এর আগে। এত কাছাকাছি একজন যুবতীর সঙ্গে, একজন নয় দু-জন, সে কথা বলতে পারছে। ছি ছি মিথ্যে বলা উচিত হয়নি।
‘তুমি ফ্যামিলি আনতে পারতে’। বেঁটে মতন যুবতীর খোঁজ খবর।
‘বিয়ে করিনি এখনও।’ বিছানা থেকে নেমে, টেবিলে রাখা ফ্রায়েড রাইসে এক নজর লোভী চাউনি , বলল অতনু। এদের ইংরেজী সত্যি কত ভালো। নিজেরটায় বাঙালী টান, ভজকট
‘ভালো কথা’ একসঙ্গে বলে উঠল দুজনে। একজন আর একজনের মাথায় আলতো চাঁটি মেরে, ‘গুড লাক’......  ( ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস)

‘ মা জিগ্যেস করলেন, আচ্ছা আমায় বলো দিকিন বুড়ো ছেলেটা কার? বটঠাকুরের দু-দুটো মেয়ে থাকতে ও ছেলেটা কেন? ছেলেটা আসলে কার?’
কার মানে? তুমি তো জানোই দাদা বৌদি ওকে পুষ্যি নিয়েছিল।
সেটাই তো জানতে চাইছি। কেন পুষ্যি নিয়েছিলেন? ছেলেটা যে আমার বড় জার নয়, তা আমি জানি। সকলেই জানে।
কার ছেলে কি করে জানব? তোমার সামনেই তো দাদা পাঞ্জাবী বউটার কাছ থেকে দেড়শো টাকায় কিনেছিল বাচ্ছাটা।
আমার এতদিন সন্দেহ হয়নি। আজকে সন্দেহ হল বলেই জানতে চাইছি। বাচ্ছাটা কি তোমার দাদার? উনিই কি বুড়োর আসল বাবা?
তা কেন ? না বোধহয়। দাদার মত অমন দেবতুল্য মানুষ। ...... ’’ ( ছোটলোকের ছোটবেলা)

কবি মলয় রায়চৌধুরী, ঔপন্যাসিক মলয় রায়চৌধুরী, প্রাবন্ধিক মলয় রায়চৌধুরী, নাট্যকার মলয় রায়চৌধুরী, গল্পকার মলয় রায়চৌধুরী, অনুবাদক মলয় রায়চৌধুরী, সমালোচক মলয় রায়চৌধুরী,সাক্ষাৎকারী মলয় রায়চৌধুরী, গ্রামোন্নয়ন-উপদেষ্টা মলয় রায়চৌধুরী,আবৃত্তিকার মলয় রায়চৌধুরী, ভাবুক মলয় রায়চৌধুরী, দার্শনিক মলয় রায়চৌধুরী, রান্নাশিল্পী মলয় রায়চৌধুরী যে ভাষায় যেমত শব্দবন্ধ ব্যবহার করে উপন্যাস লেখেন, ঔরস তার ব্যতিক্রম না। ভাষার মাধুকরী করেছেন, করতে হয়েছে, যে বুঝবে জানবে তিনি ক্রমে বড় হয়ে উঠেছিলেন যে মহল্লায় চারিদিকে তার কুর্মি দোসাদ ডোম চামার কামার মুসলমান এবং যাদব। কবিসৃষ্টি অপেক্ষা কবিকে জানিলে অধিকতর লাভ’’, লাভ আজও এই মুহুর্তে ছত্রিশ কোটি বাঙালির পুরুষানুক্রমে অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতের খতিয়ান, যে খতিয়ান মলয় দিয়ে গেছেন তাঁর প্রতিটি উপন্যাসে গল্পে কবিতায় প্রবন্ধে মনে মননে ফেস বুক পোস্টে, দিচ্ছেন, ভাবছেন ভাবাচ্ছেন আমরা কি বাঙালি? কি হলে বাঙালি হয়? কোথায় বাঙালির আইডেনটিটি বা পরিচয়। কার উত্তরসুরী আমরা? কবে বাঙালির বাঙালিত্ব শুরু? শেষ বলে কিছু আছে? নেই? কেন নেই? পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি, বিহারের বাঙালি, গুজরাটের বাঙালি,ব্যাঙ্গালোরের বাঙালি,দন্ডকারণ্যের বাঙালি, কর্পোরেটের বাঙালি, যখন তখন যেখান সেখান থেকে তাড়া খাওয়া বাঙালি,ব্যবসাদার মাফিয়া ডন খুনী কেন্দুপাতার ডিলার বাঙালি, পার ভাঙা যেমন নদীর মুদ্রাদোষ, বজ্রগর্ভ মেঘের সঞ্চার সত্ত্বেও বৃষ্টিহীনতা যেমন মৌসুমী বাতাসের ব্যাধি,তেমন মলয়ের এই বাঙালি দেখা আ-দিগন্ত...
সাহিত্য সমস্ত জীবন থেকে আহরিত হয় বলে সাহিত্য সমালোচনা ভাষাতত্ব,বিজ্ঞান,দর্শন ইত্যাদি নানান আন্ত-সম্পর্ক যুক্ত বিষয় থেকে নিজেকে আলাদা রাখতে পারেনা। এজন্য আমরা শুধুমাত্র মলয়ের ঔরস উপন্যাসের পাঠকৃতির দিকে নজর না দিয়ে তাঁর সমগ্র সাহিত্য দর্শনের দিকে নজর দিলে ভাল করব। যা থেকে তার লেখনীর গুণিতক গুলোকে খুঁজে পাওয়া যাবে। যাকে উত্তর আধুনিক বলেও চিহ্নিত করা যাবে। আধুনিকতা একটা প্যারাডাইম। যাকে ফুকো বলেছেন epistemeআধুনিকতা ‘প্যারাডাইম শিফট্’ থেকে আসে উত্তর আধুনিকতা। যেখানে একটা প্যারাডাইম থেকে আসে অন্য আর একটা প্যারাডাইম। কথা প্রযুক্তি সেই সামগ্রিক প্যারাডাইম শিফট্ বা বাঁকবদলের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। যে পরিবর্তন অর্গানিক বা জৈবিক। মলয় ঘুরে বেড়ান জীবনের নানান বিষয়ের মধ্যে যাকে আধুনিকতা দিয়ে বোঝা যায় না। ঔরস উপন্যাস শুধু মৃত্যুর গল্প না, আনন্দ ও বেদনা এখানে সমান উচ্চারিত। সুশান্ত ঘোষ সর্বদা এক আনন্দ অনুভব করে। সে বিহারী জোতদার পরিবারের যুবকদের মতন, রাজপুত ভুমিহার কুরমি যারা,কিংবা ব্রাহ্মণ কায়স্থ বিহারী আমলার শহুরে ছেলেদের ধাঁচে, অফিসে প্রতি ঋতুতে হালফ্যাশান এনেছে। দপতরের গৃহবধূ কর্মীদের নজরে সুশান্ত অবিনশ্বর যাদুখোকন, লিচুকুসুম্‌ মাগ ভাতারের অচলায়তনের ফাটল দিয়ে দেখা মুক্ত দুনিয়ার লালটুশ। কৃষিবিজ্ঞানে স্নাতক সুশান্ত, আরও স্বচ্ছলতার আপ্রাণে, শীতে দাক্ষিণাত্য থেকে আম, কোংকন থেকে  এঁচোড় কাঁঠাল, গ্রীষ্মে সিমলা থেকে টম্যাটো কড়াই শুঁটি ফুলকপি..., ঠগিদের বংশধর হবার গোপন গর্ব আছে তার। সুশান্ত ঘোষ একটানা গেঁজিয়ে যেতে পারে, চোখে চোখ রেখে, নন স্টপ, যেন বাজে বকার মধ্যেই পালটে যাচ্ছে হিজড়েতে, সবায়ের অজান্তে।
কি হয় অমন কথা বলাবলির, এক্সচেঞ্জ হলে সুশান্তর পাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে, ঠোঁট বন্ধ রেখে হাইতোলা চেপে, ভেবেছে অতনু। অতনু চক্রবর্তী। ময়লা বলতে যা বোঝায়, অতনুর গায়ের রং তার চেয়ে এক পোঁচ ফরসা। দু চোখে সব সময় বরফের বুদবুদ, ভেতরে ভেতরে উসখুসে নদীর স্রোত। গত অঘ্রানে তেইশে পড়েছে...... অতনুর হাতে মানসী বর্মনের গচ্ছিত রাখা বাদামি নরম ফোমলেদার ব্যাগ,কয়েক লক্ষ টাকার নোংরা নোট আর অসীম পোদ্দারের গোপন ডায়রী তাতে। .....গত বছর গরমকালে সুশান্ত অতনুকে এক শনিবার মহংগুর দোকানে বিকেল ছ’টা নাগাদ অপেক্ষা করতে বলেছিল। বগেরির মাংস খেয়ে জীবনের অ্যাকশন রিপ্লে দেখাতে নিয়ে যাবে......এসব ওদের প্রথম যৌবনের গল্প। এর বিবরন আছে ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ এ। ঔরস উপন্যাস হল এরই পরবর্তী- সুশান্ত, ছেলে অপু, বউ বেবি, শ্বশুর তারিনী মন্ডল,পাটনা শহরের পুরনো পারিবারিক কিছু সম্পর্ক ইত্যাদি ইত্যাদি। গল্পের কেন্দ্রে থাকে মৃত্যু। আর তার চারপাশ জুড়ে থাকে বাঙালি আইডেন্টিটিক্রাইসিস,শারিরীক,জৈবিক,মানসিক ক্ষুধা। জীবন আর মুত্যুকে এক সঙ্গে দেখার যে প্রশ্ন করে সুশান্ত তা শেষ পর্যন্ত হেলে সাপই থেকে যায়।
যে কোনও ধরনের দুঃখ কাব্য-সাহিত্যের উপজীব্য অর্থাৎ বেদনা ব্যথা না থাকলে সে গল্প কবিতা শোনা হয়ে গেলেও পরে আর মনে থাকবে না। মলয় বলছেন , আনন্দের বিপরীত দুঃখ নয়। আনন্দ বলতে বোঝায় প্রীতি হর্ষ সুখ প্রমোদ যেগুলোর স্প্যান ওই ফ্ল্যাশটুকু। বিরল প্রতিস্বের মানুষের কথা যদি ভাবি, যেমন ধরা যাক চৈতন্যদেব ও রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, তাঁদের ক্ষেত্রেও আনন্দের স্প্যান দীর্ঘ হবার কোনও কারণ দেখিনা। বয়সের সঙ্গে এই স্প্যানের হেরফের হয়, এমনও মনে হয় না। কিন্তু দুঃখের ক্ষেত্রে হয়। যে কারণে দুঃখের কোনও দীর্ঘ স্প্যানের মধ্যে এক বা একাধিক আনন্দের ফ্ল্যাশ গড়ে উঠে মিলিয়ে যাবার ঘটনা ঘটতে পারে। বস্তুত এই ফ্ল্যাশের বিমূর্ততার জন্যে ‘অনির্বচনীয়’’ আনন্দ শব্দবন্ধ তৈরী হয়ে থাকবে। কেননা দুঃখও তো বর্ণনাতীত, অবর্ণনীয়,অনির্বাচ্য হতে পারে। আনন্দের তুলনায় বেশি। আনন্দকে যে কাল খন্ডে ব্রহ্মা বলা হয়েছিল, সে সময় থেকেই আনন্দকে মনে হয়, অনির্বচনীয় মনে করা হয়েছে। ব্রহ্মের দুটি রূপের কথা ভাবা হয়েছিল। একটি নির্গুণ ও অমূর্ত, অন্যটি সগুণ ও মূর্ত। সে যুগে দুঃখ নিয়ে সাংখ্য দর্শনে ভাবা হয়েছিল, এবং স্বাভাবিক ভাবেই তাকেও নিয়ে যাওয়া হয়েছিল অ্যাবস্ট্রাকশনে। অন্তত আমাদের সময়ে চিন্তা ভাবনার ফর্মে তা অ্যাবস্ট্রক্ট মনে হবে। সাংখ্যের প্রণেতা কপিল মুনির ব্রহ্ম ভাবকল্পকে আনন্দের সঙ্গে একাত্ম করে ফেলা হয়েছিল। সাংখ্য দর্শনে দুঃখ নিয়ে ভাবা হল। তার কারণ কপিল মুনি ঈশ্বরকে অসিদ্ধ প্রমান করলেন। বললেন,বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে প্রকৃ্তির বিকার থেকে। সাংখ্য অনুযায়ী দুঃখ ত্রিবিধঃ আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক আর আদিদৈবিক। আধ্যাত্মিক দুঃখ দুই রকমঃ- শরীর খারাপ হবার দুঃখ, এবং ঈর্ষা ভয় রিপুর কারণে মনে দুঃখ। আধিভৌতিক দুঃখও দুরকম। প্রথম যদি ভুতে ধরে, দ্বিতীয় – মানুষ পশু পাখি সাপখোপের দেওয়া দুঃখআধিদৈবিক দুঃখ উৎপন্ন হতে পারে দেবতার প্রকোপে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগে। এই সমস্ত অ্যাবস্ট্রাকশন গুলোর কারনে আনন্দ ও দুঃখের ভাবকল্পে প্রাচীনকালে ভেবে দেখা হয়নি, বা সম্ভবত চিন্তার ফর্মের জন্যে ভাবা সম্ভব হয়নি,যে সমাজ ও সম্প্রদায়ের ব্যবস্থাটি থেকেই কারোর আনন্দ আর কারোর দুঃখ ঘটতে পারে।( হাওয়া ৪৯,চল্লিশতম সংকলন মাঘ ১৪১৭বইপার্বন২০১১, পৃঃ -১৩)
মলয়কে তিন বছর বয়সে ক্যাথলিক স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হয়েছিল। প্রতিদিন যেতে হত বাইবেল ক্লাশ করতে। তিনি বলছেন,চার্চের যে স্মৃতি রয়ে গেছে তা দুঃখের। আজও যে কোনও ক্যাথলিক চার্চে ঢুকলে ইন্সটিংটিভলি তাঁর দুঃখ চাগিয়ে ওঠে। মলয়ের জানতে ইচ্ছে করে আনন্দস্বরূপ ব্রহ্ম ও বেদনাময় খৃস্ট – এভাবনা দুটি রেঁনেশাসকালীন ধর্মান্ত্রিত হিন্দুরা কিভাবে মেলাতেন, কারণ ঐ সব হিন্দুরা বেশিরভাগই ছিলেন উচ্চবর্ণের। খৃস্টধর্মের প্রভাবেই আধুনিকতাবাদী পাশ্চাত্ত্য কবিদের রচনায় এত বেশি দুঃখ ব্যথা, বেদনা, কষ্ট, যন্ত্রনা। লক্ষণীয় যে হরিচরণ বন্দোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ গ্রন্থে ব্যথা ও বেদনা শব্দদুটি নেই,যদিও ব্যথ ও বেদন আছে। ঔরস উপন্যাস অবশ্যই একটি দুঃখের গল্প যেখানে গল্পের শেষে মলয় আমাদের তেমন কোনও সমতল জায়গায় নিয়ে দাঁড় করাননি। মূলধারার বৃহত্তর বাঙালি জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েও বঙ্গীয় সংস্কৃতির খড়কুটো আঁকড়ে বেঁচে থাকা এক বাঙালি পরিবারেরই গল্প নিয়েই এই উপন্যাস লিখিত। লেখক কি নিয়ে কিভাবে লিখবেন তা সম্পূর্ণ তাঁর নিজস্ব অভীপ্সা। শরৎচন্দ্রের সময়ে ছিল বার্মা মুলুক,রবীন্দ্রনাথের নীড় বিশ্ববিধাতার সাথে যুক্ত,জীবনান্দের মিস্টিক অতীত ও কার্তিকের বাংলা। সেই সব স্পেসের সাথে বর্তমান স্পেস আলাদা। এখন লেখা অনেকটাই ই-স্পেসে। মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন দিনের পর দিন মাসের পর মাস ঘটনার অনুক্রমে সত্যের প্রুরালিটি। যার প্রত্যেকটা আলাদা আলাদা দৃষ্টিকোণ তৈরী করে। যেমন...... ‘হাত পা বাঁধা, গুটকাদেঁতো মুখে লিউকোপ্লাস্ট, বছর তিরিশের ঢাউসভুঁড়ি হুলোচোখ ট্রাক ড্রাইভারটা মার খেয়ে আধজখম হয়ে খড় কাটার যন্ত্রে সবুজ নাইলন দড়ি বাঁধা অবস্থায়, অজ্ঞান হয়ে নেতিয়ে ছিল,প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে পাশিদের পাড়ায় তোতারাম পাসওয়ানের মহাত্মা গান্ধী রাস্ট্রীয় কর্মযোজনার টাকা মেরে তৈরী খামারে। ট্রাক চালক বৈশাখি যাদবের কাছ থেকেই তারিণীর সাঙ্গপাঙ্গরা আঁচ করতে পেরেছিল খুনের পেছনে কাদের হাত থাকতে পারে। আররে, বৈশাখি হ্যায় কংসায়তি যাদব, অসলি কৃষ্ণায়তি যাদব নেহি হ্যায়, মুহ খোলেগা ক্যায়সে নেহি; ডরপোক কংসায়তি ফাট্টু কাঁহিকা।
তারিণী মন্ডল দিয়ারার চরের জমিদার, সুশান্ত ঘোষের শ্বশুর। তার মেলা সম্পত্তি। এবং সে সবের একমাত্র ওয়ারিশ নাতি অপু,অশ্বমেধ ঘোষ। সুশান্ত ঘোষ বাবা মার জন্য স্মৃতির জারকে আচ্ছন্ন সুশান্তর মন কেমন করে মাঝেমাঝে, তখন গ্যাঁজানো তরমুজের চোলাই করা সোমরস নিয়ে বসেন, সঙ্গে শুয়োয়ের মাংসের বড়া,আদা-রসুন-পেঁয়াজবাটা আর বেসনমাখা, হামানদিস্তায় থেঁতো করা মাংসের বড়া, সাদা তেলে যা রাঁধতে ওনার বেবি নামের মেঠোগন্ধা বউএর ভারিভরকম মায়ের জুড়ি নেই। ওনার ছেলে অপু, যদিও বাংলা বলতে পারে কিন্তু মাকে শুনিয়ে হিন্দিতেই বলে, হাঁ পিজিয়ে পিজিয়ে অওর গম গলত কিজিয়ে; আরে অগর আপকা দিল নঁহি লগতা থা তো ভাগ কেঁও নঁহি গয়ে থে? য়ঁহাসে নিকলকে ভাগলপুর স্টেশন, অওর ওঁয়াহাসে সিধে পটনা, স্টেশন ভি ঘর কে নজদিক।পর আপ নহিঁ ভাগে। লগতা হ্যায় আপকো অপনে বিবি সে জ্যাদা প্যার অপনে সসুরসে হ্যায়। বিবি কঁহি ভি মিল জাতি, মগর তারিণী মন্ডলকে তরহ মকখনভরা পহাড় নহিঁ না মিলতা, য়হি হ্যায় না আপকা গম?
সুশান্ত তাই মাঝে মধ্যেই পটনা চলে যায়। পরিবারের বাদবাকি লোকজনদের সঙ্গে খানিক সময় কাটিয়ে আসেন। অবশ্য সুশান্তর বাবা মা আর কেউ বেঁচে নেই, আছেন বড় জ্যাঠাইমা, বড় জ্যাঠা আর ভাইঝি ইতু। এদের সঙ্গে খানিক মন খুলে কথাবার্তা বলেন , বিশেষ করে ভাইঝি ইতু অনেকটাই তাঁকে বোঝে। ইতু নিজেও নিজের মনের কথা কাকা সুশান্তকেই খুলে বলে। পটনার এই আদ্যিকালের বাড়ি আর বস্তপচা মূল্যবোধ ছেড়ে সেও যেদিকে দুচোখ যায় বেরিয়ে যেতে চায়। কারণ এই পরিবারে ইতুও অনাদৃতা, তারও বাবা মা কেউ নেই। এমনকি একমাত্র প্রেমিক অমিত,তাকেও এ বাড়ির সবাই বেজন্মা বদনাম দিয়ে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। অমিত হল সুশান্তর সেই যৌবন কালের বন্ধু অতনু চক্রবর্তী ও অতনুর বান্ধবী মানসী বর্মনের পালিত পুত্র। অমিত আর ইতুর মধ্যে নিভৃত একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বাড়ির লোকজন তা জানতে পেরে অমিতকে বেজন্মা অপবাদ দেয়। ফলত অমিতের রাতারাতি গৃহত্যাগ। সুশান্তর কাছে ইতু মনের আক্ষেপ প্রকাশ করে। বলে অমিতের জন্যই সে এই বাড়িতে এখনও বাস করছে, কারণ অমিত ফিরে আসবে। সুশান্ত তাকে পড়াশোনা কেরিয়ার নিয়ে ভাবতে বলে, কিন্তু ইতুর অত ইচ্ছে নেই। ইতু এখন পালিয়ে যেতে পারলেই বাঁচে,সুশান্তর মত। অবশ্য সুশান্ত তো পালিয়ে যাননি, ছোটবেলায় তাঁকে তারিণী মন্ডল কিডন্যাপ করে নিয়ে গিয়েছিলেন। মুক্তিপণের টাকা না পাওয়ায় নিজের মেয়ে বেবির সঙ্গে সুশান্তর বিয়ে দিয়েছিলেন। এদিকে উপন্যাসের শেষে দেখা যায় অমিত ইতুর ফের সাক্ষাৎ, ইতু চলে গেল অমিতের সঙ্গে। জায়গাটা হল দন্ডকারণ্যের গভীর জঙ্গল, যেখানে গোঁড় গারিয়া ইত্যাদি আদিবাসীদের অবস্থান। জীবনের হাজার জটিলতা থেকে মুক্তি পেতে ইতু জঙ্গলে ছুটল, লেখক লিখেছেন- নমস্তে ইতুদিদি, শুনে,কালো মোটর সাইকেলের পিলিয়নে বসে,ইতুর নাকে ছেলেটির যৌবন গ্রন্থির ঝাপটের উগ্র গন্ধ নাকে সে লাগতে প্রায় বমি পেয়ে গেল; উফ, ফেরোমোন। মুখে থলেটা চাপা দিয়ে সামলালো। কিছুটা যাবার পর বুঝতে পারল যে এক হাতে ছেলেটির পেট ধরে থাকতে হবে, আরেক হাতে মোটর সাইকেলের হ্যান্ডেল, নয়ত সড়কের যা অবস্থা, নির্ঘাৎ ছিটকে পড়বে কোনও পাথরে চাকা পড়লেই। ঘামে ভেজা পেটে হাত রেখে ধরতে, ছেলেটি বলল, হ্যাঁ ঠিক করে বসুন। এ রাস্তা ভালো নয়, এই তো সবে দুটো ব্লক নিয়ে নারায়নপুর জেলা তৈরী হয়েছে। ইতুর মনে পড়ল অমিত এভাবেই ওর স্কুটারে পেট ধরে বসেছিল, আর নাভিতে সুড়সুড়ি দিয়েছিলযুবকটির পেট, বর্ষায় ভেড়ার লোমের মতন, বেশ ভিজে,উনিশ কুড়ি বছর হবে, গায়ের রং মুখের গড়ন দেখে আদিবাসি বলেই মনে হল। ইতু জিজ্ঞেস করল, দান্ত্যেশ্বরী মন্দির কি পড়বে রাস্তায়? ছেলেটি বলল, না, দিদি। দান্ত্যেশ্বরী হল বস্তারের দেবী। নারায়নপুরে অবুঝমারিয়াদের দেবী হল কাকসারবৈগারা রাসনাভাকে পুজো করে, আর গোঁড়রা পুজো করে মেঘনাদকে। উত্তর শুনে যুবকটিকে কোনও পালটা প্রশ্ন করল না ইতু। নিজেকেই প্রশ্ন করল, মেঘনাদ? এ কোন মেঘনাদ? রামায়ন?...।
মলয় রায়চৌধুরী বহু পঠিত, বহুচর্চিত, বহু নিন্দিত ও একই সঙ্গে বহু আলোচিত। বরাবর তিনি টিকে থাকার গল্পই লিখে এসেছেন। এই উপন্যাসের অনেক চরিত্র। মনে হয় শুধুমাত্র জীবনের ভজকট দিক গুলো দেখাবার জন্য এমন ভাবে অহেতুক চরিত্র সংযোজনা। সুশান্ত আর তাঁর ছেলে অপুর মধ্যে তেমন কোনও বাদানুবাদ বা সংলাপ নেই, অথচ ভাইঝি ইতু আর সুশান্ত নিজেদের মধ্যে এমন গল্প করেছে যে তা নাহলেও এই উপন্যাসের অঙ্গহানি হত না। ইতুর মুখ দিয়ে মলয় যে সব কথা বা ডায়ালগ বলেছেন যা শুধু মলয়কেই মানায়( সেই শুভা কে বোবা করে এক তরফা যেমন বলেছিলেন, প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতারেরই এক্সটেন্ডেড পার্ট। এর থেকে মলয় আর বের হতে পারলেন না!) সমাজ ও পরিবার সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরী যা যা ভাবেন, যেভাবে ভাবেন, আজ যে শিশুটি দিয়ারা চরে জন্ম নিল, হতে পারে বড় হয়ে সে দিয়ারা চরকেই মডেল টাউন বানিয়ে ফেলল। অপু তার নানা নানির খুনের বদলা নিয়েছে। অথচ তার মানসিক টানাপোড়েন উপন্যাসে বেশি নেই। সে ক্রুদ্ধ, বদ মেজাজী বা রাজনীতি বিলাসী। দিল্লীবাসী ও সময়ের স্রোতে চলা এক যুবক। কিন্তু এটুকু হলেই তার কথা শেষ হয়না। প্রত্যেক মানুষের দুটি করে চিন্তা স্রোত, বিষয় যাই হোক, সর্বদাই মানুষের মন সেই বিষয়ে প্রথমেইএকটি গড়পরতা চিন্তা ভাবনা করে। আবার সম সাময়িক দ্রুত একটি শুদ্ধ চিন্তাও পাশাপাশি কাজ করে চলে। অপু এই মুহুর্তের জেনারেশান। সুতরাং তার কাছ থেকে পাঠকের অন্য যে কোনও আশা বা চাহিদা থাকতেই পারে। কিন্তু সে যেন তার বাবা মা বা নানার প্রতিবিম্ব বা একই চিন্তা ভাবনার উত্তরসুরী। এই চরিত্রটি দিয়ে লেখক ঔরস উপন্যাসকে ভিন্ন মাত্রা এনে দিতে পারতেন। কিন্তু তা হয়নি। অপু একটি গড়পরতা চরিত্র ছাড়া আর কিছু না। মনে রাখার মতন অপু  কিচ্ছুই করে উঠতে পারেনি। ইতু অমিত তারিণী মন্ডল জ্যাঠাইমা সৌদামিনী ইত্যাদিরা না থাকলেও উপন্যাস নিজের নিয়মেই এগিয়ে যেত। ইতু অমিতের একত্র সহবাস হয়েছে, কিন্তু গল্পের শেষে দেখা গেল দুজনে দুই দিকে। তারিণী মন্ডল ও তাঁর স্ত্রী মন্থরা দেবী খুন হলেন, সুশান্ত আত্মহত্যা করল,অপু কোথায় পালালো না পাহাড় থেকে ঝাঁপ দিল ,চরিত্রের পরিনতি মনে দাগ কাটে না। আসলে মলয় স্পেস এর গল্প লিখেছেন, লিখেছেন একটি নিদির্ষ্ট কালখন্ডের চিত্র-চরিত্রায়ন। হতে পারে এইটি হয়ত উত্তর আধুনিকতা। যেন বহমান সময় স্রোত থেকে হঠাৎই এক আঁজলা জল তুলে নেওয়া।
মলয় বলছেন, লেখালেখি সম্পর্কে যখন আমরা ব্যক্তিগত পরিমন্ডল ও মানসিক স্থিতি গড়ে তুলছিলুম, ১৯৫৯-৬০ নাগাদ, তখন কেন লিখব, কেন ভাবছি, কেন কেউ পাঠবস্তুটি পড়বে, এ সমস্ত ধারনা গড়ে ওঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ে, স্থানীয় বুদ্ধিজীবি মহলে সাহিত্যের আলোচনায়, আলোচকরা ছিলেন ডক্তর জনসন প্রভাবিত এবং প্রতিটি রচনা বা তার অংশের ব্যাখা ছিল পূর্বনির্ধারিত, প্রায় অপরিবর্তনীয়। প্রতিটি মাষ্টারমশায় ‘সোনার তরী’ থেকে একই সংকেত পাচ্ছেন দেখে, মুখ বুজে স্তম্ভিত হয়ে যেতুম। শোকের কবিতায় শোক প্রকাশ করতে অস্বীকার করার বোধটি বাংলা কবিতায় বেশ দেরীতে এসেছে, আটের নয়ের দশকে, যখন পোস্টমডার্ন বা উত্তর-ঔপনিবেশিক কবিতা তার নিজস্ব আদল পেল। বিভা বসু রচিত ‘একটি দুরারোগ্য মুক্তি’, সুবীর সরকার রচিত ‘যুদ্ধরত সৈনিকদের অ্যালবাম’, কামাল হোসেন রচিত ‘শবদের কাঁধে করে’ অ্যান্টিএলিজিগুলো মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। ইংরিজিতে সম্ভবত শোক প্রত্যাখানের প্রথম এলিজি ডিলান টমাসের ‘রি-ফিউজাল টু মোর্ন ডেথ বাই ফায়ার অব আ চাইল্ড ইন লন্ডন’।
একদা এলিজি ছিল নির্জন সমাধি। এখন সেখানে হুল্লোড় আর হইচই। তাত্ত্বিক,দার্শনিক,নান্দনিক,রাজনৈতিক,আর্থিক,সাংস্কৃতিক লাশে ঠাসা। পোস্টমডার্ন বলা হোক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক যে নামেই ডাকা হোক বর্তমান কালখন্ডটিকে, সামাজিক ভাবে মৃত্যু পেয়েছে একটি বীভৎস রূপ, যা শোকের সংজ্ঞায় পরিবর্তন ঘটিয়েছে। যে এলিজি ছিল লিরিক জঁরের অন্তর্গত, তা এখন চীৎকার ও বুক চাপড়ানি, ভয় ও উদাসীনতা,অবিশ্বাস ও বুকনির খোলা ময়দান। সুবিমল বসাকের একটি রচনা আছে। নাম, ‘আত্মার শান্তি দু-মিনিট’। শহুরে দ্রুতির গর্জনে দাঁড়িয়ে ওই বিয়োগব্যথাতুর দু-মিনিট হয়ে ওঠে দুই শতাব্দী। সময় নিজেই আজ আবিষ্ট ও আচ্ছন্ন। সময় এখন বিকার তত্ত্বের অন্তর্গত। গ্রীক এলিজি প্যাসটরাল ছিল। বাংলা ও এউরোপীয়ান এলিজি ছিল স্মৃতি আশ্রয়ী। এখনকার অ্যান্টি এলিজি জানে যে স্বজনের মৃত্যুতে আর্থিক লোকসানে মানুষ অধিক শোকার্ত,ব্যথিত ও আতঙ্কিত। যা অস্বাভাবিক তাকেই স্বাভাবিক করে ফেলেছে আধুনিকতা। শোকের আদিম রূপটি সেহেতু মডার্ন ও পোস্টমডার্ন এলিজিতে পাওয়া যাবে না।
প্রায় আশি বছর বয়সে পৌঁছেছেন মলয়। কথা হল এমন ধরনের উপন্যাস আবার নতুন করে লেখার কি কিছু দরকার ছিল? এতদিন যা যা লিখেছেন, যেভাবে লিখেছেন, মনে হয় ঔরস তারই পুনরাবৃত্তি। বর্ত্তমান কালখন্ড সমাজ পরিবার মানুষ সময় ইত্যাদি সব কিছুকেই অসংখ্য ডাইয়ামেনশনে ঘুরিয়ে মারছে। একটা সময়ে, সে বেশিদিন আগের কথা না, মানুষ একান্নবর্তী পরিবারে জীবন কাটাত। তারপর কালের নিয়মে সে প্রথা ঘুচে গিয়ে এল অণু পরিবার। স্বামী স্ত্রী আর এক বাচ্ছা। এখন সময় আরও বদলেছে। বাচ্ছা ভারতের নামী স্কুলে পড়ে ও সেখানেই থাকে। স্ত্রী মোটামুটি একটি চাকরী করে আর স্বামী আগের চাকরী ছেড়ে বর্তমানে ব্যাবসা করছেন। প্রায়ই তিনি আজ হংকং, কাল আয়ারল্যান্ড, পরশু জাপান ছুটছেন। স্কুলে সামার ভ্যাকেশন হলে বাচ্ছাটি আর বাড়ি আসতে চায় না। স্কুল থেকে সাউথ আফ্রিকা ট্যুর হচ্ছে। মাকে ফোনে জানিয়ে দিচ্ছে , এবার গরমের ছুটিতে সে বন্ধুদের সঙ্গে সেখানেই বেড়াতে যাবে। মা-ও অগত্যা রাজী হয়ে গেলেন। পরবর্তী সময়ে দেখা গেল, কর্মব্যস্ত স্বামী নেক্স্ট ফ্লাইট ধরার আগে গোগ্রাসে কিছু ব্রেড ওমলেট দিয়ে দ্রুত লান্চ সেরে নিচ্ছেন। হতাশা ও একাকীত্বে ভুগতে থাকে স্ত্রী বাড়িতে আজকাল রান্না বান্নার পাট প্রায় তুলেই দিয়েছেন। একমাত্র বাচ্ছা ( এবার সে বড় হয়ে গেছে) একদিন মাকে জানাল,সম্প্রতি বিশেষ একটি অ্যাপস খুব শীঘ্রই চালু হতে চলেছে। থালা ভর্তি খাবার দাবার সাজিয়ে কম্পিউটারের সামনে বসে গেলেই হল। যারা একেবারে একলা, দুপুর বা রাত্রে খাবার সময় সব রকম খাবার দাবার নিয়ে স্ক্রীনের সামনে বসে অন লাইন এমন কাউকে সঙ্গী পাবে বিপরীত দিক থেকে সেই মানুষটিও অমন খাবারের থালা নিয়ে একলা খেতে বসেছে। এক কথায় অন লাইন খাবার টেবিল, একলা খাওয়াও হল না, উলটে প্রাপ্তি হল খেতে বসে নানা রকম গল্প গুজব। এই মুহুর্ত্তের গল্প এটা। এমন বিষয় নিয়ে মলয় আপনি কিছু লিখে দেখাতে পারেন। ঔরস উপন্যাসকে কোথাও কোথাও চর্বিত চর্বন বলে মনে হয়েছে। সেই এক ঘেয়েমি থেকে পাঠক নতুন স্বাদ পেতেও পারেন।

...............................................................................................................।।ঋণ স্বীকার ঃ
ছোটলোকের ছোটবেলা, ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস –মলয় রায়চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ – সম্পাদক- সমীর রায়চৌধুরী, হাওয়া৪৯,মাঘ১৪১৭,বই পার্বণ ২০১১
সমীর রায়চৌধুরীর ছোটগল্প- অশোক তাঁতী( দমদম জংশন, ২য় বার্ষিক সংখ্যা, ২০১৮)
.....................................................................................................................।।
ঝুমা চট্টোপাধ্যায়