রবিবার

মলয় রায়চৌধুরীর কাব্যপুস্তিকা 'ডোমনি' : ভূমিকা বিকাশ দাস


বিকাশ দাস-এর ভূমিকা

ডোমনির সঙ্গে আমার পরিচয় এই বইয়ের কবি মলয় রায়চৌধুরীর সূত্রে । আমি ও মলয় রায়চৌধুরী একই শহরে থাকি, মুম্বাইতে। আমরা দু'জনে একে আরেকজনকে চিনি, কবিতার সড়ক দিয়ে প্রতিদিন যাতায়াতের সময় আমাদের বাক্য-চিত্রকল্প-পংক্তি নিজেদের মধ্যে কথা বলে নেয় । এবার ডোমনিকে সাজিয়ে-গুজিয়ে নিয়ে যাবো মলয়দার বাড়িতে, তাঁর হাতে সঁপে দেবার জন্য । ডোমনির বয়স আমার দু'জনের থেকে কয়েক শতক বেশি, তবু সে চিরতরুণী, যখন তাকে কবিরা ডোম্বী বলে চিনতেন ।
মলয় রায়চৌধুরীর কবিতার বিশেষ কোনো টেমপ্লেট নেই বলেই আমার মনে হয়, যেমন আছে রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ বা শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের । এই ব্যাপারে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাগুলি প্রতিটি বইতে স্বীয় বৈশিষ্ট্য নিয়ে দেখা দিয়েছে, মলয় রায়চৌধুরীর প্রিয় কবি বিনয় মজুমদারের মতো । ষাটের দশকে সাহিত্য-জগতে ঝড়-তোলা 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' থেকে আরম্ভ করে 'শয়তানের মুখ', 'জখম', 'কবিতা সংকলন', 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'চিৎকারসমগ্র', 'ছত্রখান', 'যা লাগবে বলবেন', 'আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ'. 'পোস্টমডার্ন আহ্লাদের কবিতা', 'কৌণপের লুচিমাংস', 'ছোটোলোকের কবিতা' এবং সাম্পতিক 'মাথা কেটে পাঠাচ্ছি যত্ন করে রেখো' -- প্রতিটি কাব্যগ্রন্হে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতায় পরিবর্তন ঘটেছে যা অভাবনীয় । অতি সাধারণ কথার বাক্যে অসাধারণ অন্তর্নিহিত অর্থ ।

আমার মনে হয় তাঁর কবিতায় পরিবর্তন গুলো এসেছে তাঁর অভিজ্ঞতার দৃষ্টিকোন থেকে । তিনি চাকুরি আরম্ভ করেছিলেন পাটনায় ব্যাঙ্কনোট পোড়াবার কাজ দিয়ে, যা আমরা জেনেছি তাঁর প্রথম উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' থেকে । তারপর কৃষি-উন্নয়নের চাকুরিতে চলে গেলেন লখনউ এবং উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক ঘনঘটার ছায়া পড়তে লাগল তাঁর 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' বইয়ের ও পরের কবিতাগুলোয়, তাঁর উপন্যাস 'জলাঞ্জলী' ও 'নামগন্ধ'-তে । লখনউ থেকে মলয় রায়চৌধুরী চলে গেলেন মুম্বাই ও মুম্বাই থেকে ফিরে এলেন কলকাতায় গ্রামীণ উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ হিসাবে । তাঁর স্মৃতিকথা থেকে জেনেছি যে পাটনা ছাড়ার পর তিনি প্রায় দেড় দশক কবিতা লেখেননি এবং প্রচুর বিভিন্ন ভাষায় পড়াশুনা করতেন, ভারতের গ্রামেগঞ্জে চাকুরিসূত্রে ট্যূর করে বেড়াতেন । স্বাভাবিক যে তাঁর কবিতায় সেই পড়াশুনা এবং দরিদ্র গণসংযোগ প্রতিফলিত হয়েছে ।
'চিৎকারসমগ্র', ছত্রখান', 'যা লাগবে বলবেন' ও 'আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ'-এর পর তিনি যখন সরাসরি কাব্যগ্রন্হের নামকরণ করলেন 'পোস্টমডার্ন আহ্লাদের কবিতা, তখন আমরা বুঝতে পারি তিনি কবিতায় ঠিক কী ধরণের বৈশিষ্ট্য আনতে চাইছেন বিশ্বের দরবারে । এই সময়ে মলয়দা তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরীর পত্রিকা "হাওয়া৪৯"-এর একজন পরামর্শদাতা হিসাবে বিভিন্ন দেশের সাহিত্যভাবনা ও কবিতা-লেখন নিয়ে দাদা ও অন্যান্য অনেকের সঙ্গে আলোচনা করতেন ।
মলয় রায়চৌধুরী যে নিজের কবিতার টেমপ্লেট গড়ে তোলেননি তা যতদূর মনে হয় স্বেচ্ছাকৃত । কিন্তু 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতা ও তার দীর্ঘ মামলার কারণে তাঁর কবিতায় বহু পাঠক যৌনতা খুঁজে পান । আমি নিশ্চিত যে 'ডোমনি' বইয়ের কবিতাগুলোয় তাঁরা যৌনতা খোঁজার চেষ্টা করবেন । 'ডোমনি' যৌনতাহীন হবার কোনো কারণ দেখিনা, কেননা সে তো আদপে ডোম্বী, চর্যাপদের ডোম্বী, মলয় রায়চৌধুরীর প্রেম ও আদরে সে উত্তরাধুনিক ডোম্বী তরুণী ।

বিকাশ দাস
মুম্বাই
dasbc57@gmail.com
(M) 9324737493

সোমবার

The Hungryalists : Review by Yannis Livadas

The Hungryalists [Penguin Books 2018] written by Maitreyee B. Chowdhury
Review by Yannis Livadas

Within poetry, we are not all one but probably less than one. The inclusiveness characterizing the breadth of modern literary writing on this relevant planet of known and unknown aspects, quite demonstrates that.

Incessant updates that intertwine with every possible or even unthinkable process to approach some meaning in reality, which as much it helps others to stabilize their creativity so does destabilize their course. Poetry, all over the world, represents the influences and forces that derive from the unapproachable definition of this nature.
Let us therefore know how to study the spiritual energies that life offers to poetry and vice versa, since the temporality of our perception is something more accurate and more definite than the mindfulness of man.

Some strangers in India, like ourselves, everywhere, were moving towards their fulfillment, writing poems under the burden of a tangible broadness: the Hungryalists.
What happened in Indian poetry since the time of Rabindranath Tagor is known, Indian poetry was recovered, revived and stabilized its presence. In the meantime, it has undergone the necessary modernization, it communicated with the rest of the world, developed in parallel, and left a certain stigma in the twentieth century, not particularly important, apart from a few distinguished neo-existentailist poets (e.g. Jibanananda Das, Arun Kolatkar) and the Hungryalist movement.

Modern Indian poetry presents a number of efforts and attempts, while it continues to twist and contrast trying to locate its orientation, its exactness. The modern propositions presented by Indian poetry, often have a very distinctive classification of values and concepts, which is not always as close as that of the western or, it is identical.
It is also important to discern the performance of the westernized spirit and at the same time the heaviness, or otherwise the lightness, of the impact of this westernization. Indian poetry since the days of the Hungryalists continues to proclaim a break out of its strictly controlled aesthetic environment, to act as it is appropriate, but its result is not always worthy of the need for poetic invention. From this we have something to learn, discerning and reviewing this process in relation to the way in which exactly the same thing is happening in the later poetry of the western world, which today lacks heterogeneity of content, and it is also restrained by a distinct tendency to seek comfort in the warmth of theoretical detracting from the intellectual experience.
Therefore, before we refer to the magnitude and the severity of any possible achievement, in general, let us ponder first with the condition of naturalness, when it exists, when it does not and when it is sought. This is the fundamental criterion.

The Hungryalists were a company of unpredictable poets who emerged from the tradition, being ready to create turning points in order to re-initiate Indian poetry, and at the same time to prove its resilience. Their rejection of poetic traditionalism was an act of restitution since their counterblast was valued by a strong demand of return to the originality of poetry, which was displaced by sociopolitical and aesthetical decadence. Some facts seem to be unchanged into the row of time; every now and then the poet is duty-bound to stand against the same abjections.

The poetry of Hungryalists remains new, if one considers the essential facts of modern and contemporary poetry of India. It is still fresh, open; since its distinctions pertained evenly to the renovation of poetic form and scope.

The history of the Hungryalist movement is presented into a well-documented volume which is unique. The author and editor of the book, Maitreyee Bhattacharjee Chowdhury, has done an excellent job. The book offers an extensive yet indirect analysis of the Hungryalist poetry, it is arranged chronologically and geographically, almost like a historiography of the movement ; it re-establishes the Hungryalists into the course of contemporary literature and, what’s more, it gives an opportunity to the younger readers to get a more connective and more solid idea of it, by studying it as one among the not so many phenomena which have left their marks during the last sixty or so years.

The writers of the Hungryalist core were Binoy Mazumdar, Shakti Chattopadhyay, Samir
Roychoudhury, Debi Roy and of course the most prominent Malay Roy Choudhury; whom once I was quite lucky to meet and to attend one of his readings in a downtown terrace in Calcutta. Besides the most important and catalytic mentioned, one can refer to Utpal Kumar Basu, Binoy Majumdar, Sandipan Chattopadhyay, Basudeb Dasgupta, Falguni Roy, Subhash Ghosh, Tridib Mitra, Alo Mitra, Ramananda Chattopadhyay, Anil Karanjai, Saileswar Ghosh, Karunanidhan Mukhopadhyay, and Subo Acharya.

Today it would be at least unfair to study Hungryalism unilaterally in association with the
Beat Generation. The connection between them is rather unsubstantial, some of the Beats supported keenly and justifiably the young Indian poets; yet the Hungryalists were
autonomous, were an analogue movement and although the similarities between the two are obvious, the Hungryalists had their own methods, their own perspective; their own sequence of literary accomplishments.

Sometimes the emergence of a literary movement demonstrates the backwardness that must be overcome so that literature can be able to reacquire its venturous and creative orientation.

After the publication of this book, an anthology of Hungryalist poetry in English seems more imperative than ever.
Paris 2019The Hungryalists [Penguin Books 2018]

বুধবার

প্রতিষ্ঠান, হাংরি আন্দোলন ও কৃত্তিবাস গোষ্ঠী : শিবনারায়ণ রায়

শিবনারায়ণ রায় : প্রতিষ্ঠান, হাংরি আন্দোলন এবং কৃত্তিবাস গোষ্ঠী

                                 

কোনও সমাজ যখন নানা কারণ সমাবেশে স্হবির ও উদ্ভাবনাহীন হয়ে পড়ে তখন সেখানে 
প্রাণ ও গতির সঞ্চার বিভিন্ন উপায়ে ঘটতে পারে । এটি অনেক ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে বহিরাগত 
শক্তির আঘাতে ; কখনও কখনও অভ্যন্তরীন বিরোধ এবং তজ্জাত অত্যয়ের ফলে । 
কখনও বা কিছু সংখ্যক সচেতন আদর্শবাদী উদ্যোগী স্ত্রী-পুরুষের একনিষ্ঠ প্রয়াসে 
সেই সমাজের সংবিষ্ট ও ভোগবৃত্ত দশা থেকে উদ্ধার ঘটে । হয়তো সামাজিক উজ্জীবনের
 জন্য উদ্যোগী কয়েকজনের উদ্যম ও অধ্যবসায়ই যথেষ্ট নয় । 
তবু তাঁদের কাছে সমাজের ঋণ গভীর ; তাঁদের জীবন পরবর্ত প্রজন্মের প্রেরণার উৎস ।

বঙ্গদেশে সমাজসংস্কার আন্দোলন উনিশ শতকের শেষভাগ থেকে স্তিমিত হয়ে আসে । 
একদিকে ধর্মীয় অভ্যূথ্থান অন্যদিকে জাত্যাভিমানী উগ্র রাজনীতি, 
একদিকে সাম্প্রদায়িক বিরোধ অন্যদিকে চরমপন্হী ক্রিয়াকলাপ বঙ্গীয় নবচেতনার 
কেন্দ্র থেকে যুক্তিবাদ, উদারনতি ও সমাজসংস্কারের উদ্যোগকে সরিয়ে দেয় ।
 মহারাষ্ট্র এবং ভারতবর্ষের আরও কোনও কোনও অঞ্চলের বিশ শতকেও 
সমাজসংস্কার আন্দোলনের সক্রিয় এবং অনেক ক্ষেত্রে ফলপ্রসূ উপস্হিতি চোখে পড়ে । 
কিন্তু বাংলার ধর্ম ও রাজনীতির মারাত্মক সন্নিবেশ ও প্রাধান্য দেশটাকে শেষ 
পর্যন্ত দু'টুকরো করে । তবে শিক্ষিত বাঙালি মনের গভীর প্রবণতা ও সামর্থ্য বিশ শতকের 
প্রথমার্ধেও সার্থক প্রকাশ পেয়েছিল বাংলা সাহিত্যে । দেশবিভাগের আগে দুই মহাযুদ্ধের মধ্যবর্তী 
দশকগুলিতে বাঙালি মনের সবচাইতে সমৃদ্ধ ও সম্ভাবনাপূর্ণ আন্দোলনগুলি কয়েকটি 
সাহিত্যপত্রকে কেন্দ্র করেই রূপ নিয়েছিল ; তাদের মধ্যে বিশেষভাবে স্মরণীয় 'সবুজপত্র',
 'কল্লোল', 'শিখা', 'কবিতা', 'পরিচয়' ও 'পূর্বাশা' । এইসব পত্রিকা শুধু নতুন লেখকদের 
আকৃষ্ট করেনি, বাংলা সাহিত্য ও চিন্তার ক্ষেত্রে নানারকম পরীক্ষার ও উদ্ভাবনার সম্ভাবনা 
খুলে দিয়েছিল । এইসব পত্রিকার উদ্দেশ্য ছিল জীর্ণ বাঙালি জীবনে ভাষা ও সাহিত্যকর্মের
 ভিতর দিয়ে নতুন উদ্দীপনা ও সামর্থ্যের সঞ্চার করা ।

দেশবিভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে আর এই ধরণের পত্রিকা অথবা সাহিত্য আন্দোলন বড় 
একটা চোখে পড়ে না । সাহিত্যজগতে ব্যাবসয়ী প্রতিষ্ঠানের ( দেশ ও আনন্দবাজার  গোষ্ঠী ) 
বিবর্ধমান একচেটিয়া কারবার, কমিউনিস্টদের প্রচারসর্বস্ব উচ্চরোল, 
ক্ষীণসামর্থ্য লেখকদের নিজের নিজের স্বল্পস্হায়ী কাগজ বার করবার অতিপ্রজ প্রচেষ্টা --- 
সব মিলিয়ে সাহিত্যিক আন্দোলনের ঐতিহ্য দ্রুত ক্ষীণ হয়ে আসে । 
যে অর্থে 'সবুজপত্র' বাংলা সাহিত্যে নতুন একটি পর্বকে এনে তাকে প্রকাট করে তুলেছিল, 
যে অর্থে ত্রিশের দশক বাংলা কবিতা ও কথাসাহিত্যের বিপ্লবকাল, 
সেই অর্থে গত তিরিশ চল্লিশ বছরে পশ্চিমবাংলায় বাংলা সাহিত্যে স্মরণীয় কিছু ঘটেনি।
 সুরচিত কবিতা, গল্প, পপবন্ধ, এমনকি উপন্যাসও স্বল্পসংখ্যায় লেখা হয়েছে বটে । 
কিন্তু কোনও প্রতিশ্রুতিসম্পন্ন আন্দোলন বা নতুন দিগদর্শীর সন্ধান মেলে না । 
 কৃত্তিবাস পত্রিকার সঙ্গে কিছু সমর্থ তরুণ যুক্ত ছিলেন ; তাঁদের ভিতরে কয়েকজন 
পরবর্তীকালে বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন ; কিন্তু কৃত্তিবাসের চরিত্রে আন্দোলন 
গড়ে তোলবার অথবা নতুন দিক খুলে দেবার আভিমুখ্য ও শক্তি আদৌ ছিল না । 
 'সবুজপত্র', 'কবিতা', 'পরিচয়', বা 'পূর্বাশা' জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে কৃত্তিবাসের নাম
 যুক্ত করা নিতান্তই অসঙ্গত । ওই পত্রিকার প্রধান লেখকদের মধ্যে কয়েকজন 
পরে আনন্দবাজার, যুগান্তর, আজকাল ইত্যাদি ব্যাবসায়িক পত্রিকার আশ্রয় নিয়ে
 বিবেচনার পরিচয় দিয়েছেন ।

ষাটের দশকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রায় একই সময়ে শহুরে তরুণ-তরুণীদের
 ভিতর ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দেয় --- তাঁদের আপন আপন দেশের রাষ্ট্র, সমাজ, 
প্রচলিত ধর্ম ও নীতিনিয়ম, আর্থিক ব্যবস্হা ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ সব কিছুই 
ওই তরুণ তরুণীদের করে অসহনীয় এবং সেকারণে বর্জনীয় মনে হয় । 
প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ এবং বার্কলি, কলম্বিয়া, জাকর্তা, পিকিং---
 বিভিন্ন শহরে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে ছাত্র-ছাত্রীদের আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে । 
এই বিক্ষোভ তৎকালীন সাহিত্যেও প্রকাশ পায় । এক দশক পরে এই বিক্ষোভ অবসিত হয়ে আসে ।
 প্রতিষ্ঠিত ব্যবস্হার রক্ষণশীল শক্তি আবার নিজের প্রবলতার প্রমাণ দেয় । 
কিন্তু ওই বিক্ষোভ যে পৃথিবীব্যাপী এক মানসিক অনিশ্চয়তার ও বিশৃঙ্খলা এনে দিয়েছে, 
আশির দশকে সেটি আর প্রচ্ছন্ন নেই ।

ষাটের এবং সত্তরের দশকে আমি বেশিটা সময় ভারতবর্ষের বাইরে ছিলাম ।
 বন্ধুদের কাছ থেকে এবং পত্রপত্রিকার সূত্রে জানতে পারি যে, অন্তত পশ্চিমবাংলাতেও
 শিক্ষিত তরুণ-তরুণী মহলে ব্যাপক বিক্ষোভ দেখা দিয়েছে। 
বার্লিন, বার্কলি এবং জাকর্তায় যে যুবাবিস্ফোরণ আমি দেখেছি, 
কলকাতার ছাত্র-ছাত্রীদের অস্হির আলোড়নের সঙ্গে তার কোনও সম্পর্ক ছিল কিনা 
আমার জানা নেই । রাজনীতির ক্ষেত্রে এই বিক্ষোভ রূপ নেয় নকশাল আন্দোলনে --
 বিপ্লবী বুলির আড়ালে ভারতীয় কমিউনিস্ট নেতাদের সুবিধাবাদী ক্রিয়াকলাপ 
তাদের কিছুসংখ্যক তরুণ---আদর্শবাদী অনুগামীদের মনে যে বিরূপতা জাগিয়ে 
তুলেছিল নকশাল আন্দোলনে আকার খোঁজে । তাদের মধ্যে একটি ছিল হাংরি আন্দোলন । 
এটি সম্পর্কে কিছু সংবাদ বিদেশি পত্র-পত্রিকায় পড়ি ; 
কিছু খবর পাই আমার মারাঠি ও গুজরাটি বন্ধুদের কাছে । 
শক্তি ও সন্দীপনের লেখা আগে পড়েছিলাম । কিন্তু এই আন্দোলনের যিনি উৎস ও তাত্বিক, 
সেই পাটনাবাসী তরুণ মলয় রায়চৌধুরীর নাম আমি পূর্বে শুনিনি । 
অশ্লীল কবিতা লেখার অভিযোগে এর আগে অথবা পরে অন্য কোনও বাঙালি কবির 
হাতে হাতকড়া পরানো হয়েছে বলে আমার জানা নেই । 
নজরুল ইসলাম রাজনৈতিক লেখার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন । 
মলয় এদেশে পুলিশী শ্লীলতাযুদ্ধের একজন উল্লেখ্য শহীদ ।

এই বছরের গোড়ায় চিঠিপত্রের সূত্রে মলয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ।
আমি তাঁকে লিখি যে, হাংরি আন্দোলনের একটি বিবরণ যদি তিনি তৈরি করতে পারেন,
 'জিজ্ঞাসা'য় প্রকাশের জন্য সেটি বিবেচিত হবে । তবে বিবরণটি তথ্যভিত্তিক হওয়া চাই,
 এবং সেটি যেন পৈশুন্যচিন্তিত না হয় । মলয়ের যে প্রবন্ধটি এই সংখ্যায় প্রকাশিত হল, 
আমার বিবেচনায় সেটি সুচিন্তিত, সুলিখিতএবং তথ্যসমর্থিত । 
পাটনার ছেলে মলয় এখন লখনউতে বসবাস করেন । 
অভিমান করে দীর্ঘকাল লেখা ছেড়ে দিয়েছিলেন । 
তাঁর প্রবন্ধটির ভাষা ঝরঝরে, গতিশীল ও মেদরিক্ত ; 
আমার বিশ্বাস অন্তত বাংলা গদ্যে মলয়ের নিজস্ব কিছু দেবার আছে ।

লেখাটি পড়ে এবং সেই সূত্রে এক সময়কার হাংরি লেখকদের 
কয়েকটি বই ও পত্রিকার সঙ্গে পরিচিত হয়ে দু-একটি কথা মনে হয়েছে ।
 ইংরেজিতে মলয় যে ম্যানিফেস্টোগুলি লিখেছিলেন তাদের ভাষাগত 
কছু ত্রুটি থাকলেও বক্তব্য অস্পষ্ট ছিল না । 
হাংরিরা চেয়েছিলেন সভ্যতার সমস্ত কৃত্রিমতাকে বর্জন করতে, 
সম্ভব হলে উচ্ছেদ করতে, পপাণশক্তি স্বাভাবিক উৎক্ষেপণের পথে 
সব বাধাকে সরিয়ে তাকে মুক্তি দিতে । মলয় লিখেছিলেন.
 "কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে" ; 
অলোকরঞ্জন একটি চিঠিতে লক্ষ্য করেছিলেন যে "অনির্বাচিত মানবস্বভাব আপনাদের 
( অর্থাৎ হাংরি লেখকদের )  উপপাদ্য" । সব রোমান্টিক ও বৈপ্লবিক আন্দোলনই প্রচলিত ব্যবস্হার,
 বিধি নিষেধের, কৃত্রিমতার ও সভ্যতার বিরোধী ।
 কিন্তু "আরণ্যকতা ও বর্বরতা"র মধ্যে যে মুক্তি তার দুরবস্হা সভ্যতার নিয়মকানিন
 চাপানো বন্দিত্বের চাইতে বেশি বই কম পীড়াদায়ক নয় । সভ্যতা এবং
 স্বতঃস্ফূর্তির মধ্যে বিরোধ আছে । মানুষের পক্ষে দুটিই দরকার । 
একটিকে খাটো করে অন্যটিকে প্রধান করে তুললে মানুষেরই বিকাশ ব্যাহত হয় । 
হাংরিরা তাঁদের ক্ষোভ আক্রোশ ব্যর্থতা ও আত্মাভিমানকে উচ্চণ্ডভাবে প্রকাশ করে রফাশ্রয়ী, ভণ্ড,
 জীর্ণ, বাঙালি বাবুসমাজকে উচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন । তাঁদের অনেকের লেখার মধ্যে গোড়ার 
দিকে সততা ছিল, কোনও কোনও লেখায় মৌলিকতার আভাস ছিল, কিন্তু যে আত্মপ্রত্যয়, 
যে ধৈর্য, নিষ্ঠা ও অনুশীলন শুধু ক্ষোভ অথবা স্বতঃস্ফূর্তি থেকে আসে না, অথচ যা না-থাকলে
 চিৎকার আপনা থেকেই কিছু তার কবিতা হয়ে ওঠে না, মনে হব সেই শর্তনিরপেক্ষ গুণগুলি 
অর্জনে তাঁদের যথেষ্ট আগ্রহ ছিল না । এ জন্য হয়তো পশ্চিমবাংলার সামাজিক সাংস্কৃতিক 
পরিবেশ দায়ি, অথবা হাংরিদের যুক্তিবিমুখ জীবনাদর্শ, অথবা তাঁদের স্বকামী চরিত্র, 
অথবা এসবের সমাবেশ ।
সুবিমল বসাক বাঙাল ভাষায় টনটন ঘন আন্ধারের যে অস্হির কাহিনি
 ( 'ছাতামাথা' ১৯৬৫ ) এবং চিখখৈর পাড়নের যে নিস্তারহীন কবিতাগুলি ( 'হাবিজাবি' ১৯৭০ )
 লিখেছিলেন, 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' নামে ১৯৬২ সালে 
মলয়ের যে আলোচনাধর্মী পুস্তিকাটি বেরিয়েছিল, শৈলেশ্বর ঘোষের কিছু কবিতা,
 'জেব্রা', 'প্রতিদ্বন্দ্বী' ইত্যাদি পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন হাংরি লেখকের
  কিছু রচনা এসবের ভিতর এক ধরণের সম্ভাবনা চোখে পড়ে যা পরে বিকাশ লাভ করেনি ।
 সিদ্ধি, গাঁজা, মদ, মারিহুয়ানা হয়তো-বা কল্পনাকে উদবেলিত করে, 
কিন্তু সে রসায়নে অভিজ্ঞতা ও স্বপ্নের উপাদান শিল্পে রূপান্তরিত হয়, মাদক তার অনুঘটক নয় ।

মলয়ের বিবরণে যেটি আমার কাছে সবচাইতে গ্লানিকর দিক মনে হয়েছে সেটি পুলিশের মূঢ়, 
অতিনৈতিক জুলুমবাজি নয়, সেটি হল প্রথম ধাক্কাতেই বিদ্রোহী লেকখদের হার মানা । 
মকদ্দমা শেষ পর্যন্ত হয় মলয়ের বিরুদ্ধে ; তাঁর বেশিরভাগ সাহিত্যিক সহকর্মীই
 ( শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ) হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে 
নিজেদের সম্পর্ক পুলিশের কাছে অস্বীকার করেন । শহিদ হওয়া শিল্পীদের দায়িত্ব নয় ;
 কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধ এবং বিপন্ন বন্ধুর প্রতি আনুগত্য না থাকলে কোনও আন্দোলনই
 শক্তি অর্জন করতে পারে না । শিল্পকৃতির জন্য আন্দোলন জরুরি নয়; 
শিল্পী ও ভাবুকদের মধ্যে অনেকেই নির্জনে সাধনা করবার পক্ষপাতী । 
কিন্তু কোনও আন্দোলন --- শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে হোক, আর জীবনের অন্য বিন্যাসেই হোক
 -- প্রভাব ফেলতে পারে না, যদি না সেই আন্দোলনে যাঁরা অংশভাক 
তাঁরা সৎ, নীতিনিষ্ঠ এবং পরস্পরের কাছে নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হন ।
 যেমন উৎসবে ব্যসনে তেমনি দুর্ভিক্ষে, রাষ্ট্রবিপ্লবে, রাজদ্বারে এবং শ্মশানে
 যে পাশে থাকে সেই তো বন্ধু । অবশ্য মাইকেল একাই একটা আন্দোলন করেছিলেন । 
বাংলা কাব্যের সেই বিপ্লবের কালে তাঁর কোনও সহকর্মী ছিল না । 
কিন্তু একদিকে তাঁর ছিল অসামান্য প্রতিভা, অন্যদিকে অসংশয় বন্ধুভাগ্য । 
হাংরি আন্দোলনের দীর্ঘ বিবলিওগ্রাফি ( সত্যেন চক্রবর্তী, 'প্রতিদ্বন্দ্বী', আগস্ট ১৯৭০, পৃ: ২২-২৪ ) 
থেকে বোঝা যায় ষাটের দশকে ব্যাপারটা বেশ উত্তেজনা সৃষ্তি করেছিল ।
 কিন্তু বাংলা সাহিত্যে অথবা বাঙালি লেখক/পাঠকদের মনে এই আন্দোলন ফলপ্রসূ 
কোনও প্রভাব ফেলেছিল কিনা সে বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে । 
হয়তো কোনও কোনও ট্যাবু তাঁরা ভেঙেছিলেন ।
 কিন্তু বাজার ও সরকারের কাছে যারা হাত পেতেই আছে, 
পরবর্তী বিশ বছরে তাদের চতুরালি ও জনপ্রিয়তা বেড়ে গেছে বই কমেনি ।
( 'জিজ্ঞাসা' পত্রিকার কার্তিক-পৌষ সংখ্যায় শিবনারায়ণ রায়-এর লেখা সম্পাদকীয় )