মলয়
রায়চোধুরীর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় পঁয়ত্রিশ বছর আগে। সামান্য অভূয়িষ্ট
পড়াশোনা থেকে ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভূয়া লেখা
লিখেছিলাম ১৯৮২ সনে, এক মফস্বলী কাগজে, সেই তখন। এবং, সেই শুরু। সেদিনের
সেই সব্রীড় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই মলয়-সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে।
ততদিনে, তার বিশ বছর আগেই হাংরি আন্দোলনের অন্যতম এই স্রষ্টার নখদন্ত বাংলা
সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে কিছু পিরেনিয়্যাল আঁচড় কেটে ধাবাড় মেরে গেছিল।
১৯৬১ থেকে ১৯৬৫-কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘনাবহুল
অস্তিত্বকাল। যদিও জেব্রা উপদ্রুত ক্ষুধার্থ ফুঃ প্রতিদ্বন্দ্বী স্বকাল
চিহ্ন উম্মার্গ ব্লুজ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি দেবী রায়, ফালগুনী রায়,
প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ,
শম্ভু রক্ষিত, সুবো আচার্য, ত্রিদিব মিত্র প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি
সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র। এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও
সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি, প্রাগুক্ত পত্রিকাগুলিকে আঁকড়ে ধরে কিছু কাল
শর্করীবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি।
এহেন বিশাল ব্যবধানে, এই প্রেক্ষিতে কুড়ি-বাইশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসব যিনি করেছিলেন, সেই মলয় রায়চোধুরী বিশ বছর বাদে লেখালেখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী হতে পারে? এমনিতে পঞ্চাশের কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবিক লিখে আসছিলেন। শক্তির এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি রূপচাঁদ পক্ষী হয়ে যান, সন্দীপন একটা নির্দিষ্ট গদ্যে রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন। বিদেশ থেকে ফিরে উৎপল বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন। ষাটের কবি হিশেবে অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চোধুরী প্রমুখের লেখালেখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে।
মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহ সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে। জীবন নামক ভেলকিবাজ বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে। চটকায়। ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয়। আবার, পেড়েও আনে। জীবন লিখেওছে এমন এক ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না। মন বোঝে না। আদর্শ বোঝে না। আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটারে। অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' পরে 'অংশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ। এই ট্রাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ী করি, তাকে ব্যক্তির ট্রাজেডি হিশেবে চিহ্নিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ত্ব। এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে কিছুদিনের জন্যে এলিট সংসারী হয়ে উঠেছিলেন মলয়। সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত। মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করেছিলেন যে গার্হস্থ্য দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় 'আর কিছুই করছেন না'। ..... কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে বারদিগর লেখালেখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চোধুরী।
প্রত্যাবর্তিত মলয়ের মধ্যে অনেক মাল, অনেক ময়ুজ। মানে, দারুণ-একটা রায়বেঁশে, হৈ হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-তোমার রইল না, মলয়ের কেসটা সের'ম নয়। তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ-কিছু জ্যামিতিক পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন ----- বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে। দেখেশুনে তো মনেই হচ্ছিল গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন। আর, গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিম্বা, লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিঁকে আছেন, না উবে গেছেন।
১৯৮০-৮২ নাগাদ, বিশ বছর বাদে ফিরে-আসা সেই হৈচৈ-হীন নিরুত্তেজ উদ্দান্ত-যমিত শান্ত অব্যস্ত নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চোধুরীর মধ্যে সে দিনের সেই উত্তপ্ত অস্থির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চোধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র। তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত। সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দানুক্ৰমণের ফলাটা এখনো তেমনি পিশুন। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠা অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ্য। যেন পুরনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা।
মলয়ের প্রাইম কনসার্ন হলো কবিতা। কবিতার মধ্যেই যা-কিছু দেখা ও দেখানো। ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের দশকের প্রত্যাবর্তিত মলয়। পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা তিনি গড়ে ফেলেছেন অনেক দিন আগেই। কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুত্থিত মলয় খুব সচেতনভাবে নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন, এটা অবম বা ঊন কথা নয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হয় না, মলয় রায়চোধুরী সেখানে একটা তাক-লাগানো মিশাল। পুনরুত্থিত মলয় গদ্যকার হিশেবেও অভিনিবেশযোগ্য। একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল আর মেদবর্জিত গদ্যের কারিগর তিনি। আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তেহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশক থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারনা, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, তাঁর 'হাংরি কিংবদন্তী' (১৯৯৪) এবং হওয়া ৪৯ প্রকাশনীর 'পোস্টমর্ডানিজম' (১৯৯৫) গ্রন্থদ্বয়ে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য। অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে তাঁর, যা এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করে মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন। দারুন মডার্ন প্রোজ। দারুণ-দারুণ সব কৌণিময়তা, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিশেবে ফুটে ওঠেন। কিন্তু, এখানে তিনি শর্ট ডিস্টান্স রানার। বেশিক্ষণ নাগাড়ে ছুটতে পারেন না। এক-একটা প্যারাগ্রাফের দারুণ স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরোতেই যে দমও ফুরিয়ে আসে। মলয়ের বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাস এই শ্রেণীর গদ্যে লেখা। যে, কারণে, শুধুমাত্র গদ্যের এই রেসের কারণেই তাঁর 'নামগন্ধ' বাদে অন্য কোনো উপন্যাস আমায় টানেনি। এটা আমার ব্যক্তিগত গদ্যকার হবার কুফলের দরুনও হতে পারে।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন। কোনো কোনো কখনওএতে যেন অতিরিক্ত সচেতন। প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত, কিন্তু নুনের পরিমাণ একটু বেশি। শব্দ-ব্যাপারে মলয়ের ঢালাইঘরে অনবরত হিট ট্রিটমেন্ট। দারুণ মেদবিহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার। কিন্তু যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন-হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে ফেলেন। ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেইনলেস হয় না। ক্র্যাক হয়ে যায়। তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন। তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না। যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে-হয়ে বেঁকে বেঁকে যায়। এর ফলে।কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুণ লাগলেও খুব কনট্রাইভড, গদ্য বানাবার দাগগুলো চোখে পড়ে যায়। এটাকে মলয়-গদ্যের দুর্বলতা বলুন, বা বৈশিষ্ট্য।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই আমি মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪সালে, 'এবং' পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্ৰহ 'ভেন্নগল্প'-র অন্যতম ভূমিকা হিশেবে পুনর্মুদ্রিত। আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে লেখা তাঁর প্রথম নভেলা 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সনে এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাসে' (১৯৯১-৯৩ সালে লেখা, এবং ১৯৯৪-এ প্রকাশিত)। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও এই গদ্যে লেখা। এমনকি আমার-পড়া তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'নামগন্ধ'ও সেই একই গদ্যে লেখা। ভেন্নগল্পের এক ডজন ছোটগল্প আর এই তিনটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্ত্বিক মলয় আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে। কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে হাসিল অভিজ্ঞতা, নানা অন্তর্দেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে। কলকাতার পাতি কাগজগুলোতে বিশেষত 'ডুবজলে'র উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাঁদের প্রোডরম্যান ফেজ কাটিয়ে উঠেছেন। আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রূপ যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হয় সেই প্রথম। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশনে যা আগে কখনো এভাবে খাপ খায়নি। মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে। খাস করে বিহারের দেশয়ালি আর সড়কছাপ জং-মরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়েঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে। ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি-ঝাড়খন্ডি বঙ্গকৃষ্টি দারুণ-দারুণ ঝাপটা মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে শুরু করেছিল। একটা সফল ঝাপটা ছিল ন'য়ের দশকের 'ডুবজলে'। বিহারের আর্থ-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার কূপব্যাঙ আলোচক-পাঠকরা। আর তাতেই তাঁরা দারুণ অমায়িক হোস্টেস হয়ে পড়েছিলেন 'ডুবজলে'র। কিন্তু, এটা, মলয়ও জানতেন, রানওয়ে মাত্র--- তিনি উড়ান দেখাবেন পরবর্তীতে। সেই উড়ান-ই হলো মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দাফাঁস উপন্যাস 'নামগন্ধ'।
মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।
----------------------
"নামগন্ধ" নিয়ে বিশদ আলোচনা করব আগামী কাল।
এহেন বিশাল ব্যবধানে, এই প্রেক্ষিতে কুড়ি-বাইশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসব যিনি করেছিলেন, সেই মলয় রায়চোধুরী বিশ বছর বাদে লেখালেখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলে তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী হতে পারে? এমনিতে পঞ্চাশের কবিরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবিক লিখে আসছিলেন। শক্তির এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি রূপচাঁদ পক্ষী হয়ে যান, সন্দীপন একটা নির্দিষ্ট গদ্যে রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন। বিদেশ থেকে ফিরে উৎপল বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন। ষাটের কবি হিশেবে অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চোধুরী প্রমুখের লেখালেখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে।
মলয়ের কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা। এবং আপাত জটিল। বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্থান হিশেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের চেটোয় সেভাবে লাগেনি। কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে। কলকাতা মলয়কে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল। কলকাতা তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের কেউ নও। তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা। তোমার কলমে নিম্নবিত্ত রক্ত। তোমার টেক্সট আলাদা। আলাদা থিসরাস। তফাৎ হটো তুমি। এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে। কোনও সম্পাদক তাঁর কাছে আর লেখা চান না, বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে যায় এবং ক্রমশ সবাই স্লিক করে যায়। লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই বীভৎস যন্ত্রণা, অপমান আর তিরস্কার একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে। এই যন্ত্রণা, এই অপমানই লেখালেখি থেকে নির্বাসন ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে। ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন। সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায়, আর ক্রমশ নিজেকে অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফেলেন। প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা ---- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-র ডিসেম্বরে শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহ সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে। জীবন নামক ভেলকিবাজ বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে। চটকায়। ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয়। আবার, পেড়েও আনে। জীবন লিখেওছে এমন এক ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না। মন বোঝে না। আদর্শ বোঝে না। আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটারে। অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' পরে 'অংশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ। এই ট্রাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ী করি, তাকে ব্যক্তির ট্রাজেডি হিশেবে চিহ্নিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ত্ব। এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে কিছুদিনের জন্যে এলিট সংসারী হয়ে উঠেছিলেন মলয়। সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত। মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করেছিলেন যে গার্হস্থ্য দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় 'আর কিছুই করছেন না'। ..... কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে বারদিগর লেখালেখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চোধুরী।
প্রত্যাবর্তিত মলয়ের মধ্যে অনেক মাল, অনেক ময়ুজ। মানে, দারুণ-একটা রায়বেঁশে, হৈ হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-তোমার রইল না, মলয়ের কেসটা সের'ম নয়। তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ-কিছু জ্যামিতিক পারফরম্যান্স দেখিয়েছিলেন ----- বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে। দেখেশুনে তো মনেই হচ্ছিল গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন। আর, গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন তিনি। কিম্বা, লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিঁকে আছেন, না উবে গেছেন।
১৯৮০-৮২ নাগাদ, বিশ বছর বাদে ফিরে-আসা সেই হৈচৈ-হীন নিরুত্তেজ উদ্দান্ত-যমিত শান্ত অব্যস্ত নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চোধুরীর মধ্যে সে দিনের সেই উত্তপ্ত অস্থির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চোধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র। তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত। সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দানুক্ৰমণের ফলাটা এখনো তেমনি পিশুন। আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠা অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ্য। যেন পুরনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা।
মলয়ের প্রাইম কনসার্ন হলো কবিতা। কবিতার মধ্যেই যা-কিছু দেখা ও দেখানো। ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের দশকের প্রত্যাবর্তিত মলয়। পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা তিনি গড়ে ফেলেছেন অনেক দিন আগেই। কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুত্থিত মলয় খুব সচেতনভাবে নিজের একটা জায়গা বানিয়ে নিয়েছেন, এটা অবম বা ঊন কথা নয়। বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হয় না, মলয় রায়চোধুরী সেখানে একটা তাক-লাগানো মিশাল। পুনরুত্থিত মলয় গদ্যকার হিশেবেও অভিনিবেশযোগ্য। একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল আর মেদবর্জিত গদ্যের কারিগর তিনি। আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তেহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশক থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারনা, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, তাঁর 'হাংরি কিংবদন্তী' (১৯৯৪) এবং হওয়া ৪৯ প্রকাশনীর 'পোস্টমর্ডানিজম' (১৯৯৫) গ্রন্থদ্বয়ে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য। অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে তাঁর, যা এখনো নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করে মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন। দারুন মডার্ন প্রোজ। দারুণ-দারুণ সব কৌণিময়তা, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিশেবে ফুটে ওঠেন। কিন্তু, এখানে তিনি শর্ট ডিস্টান্স রানার। বেশিক্ষণ নাগাড়ে ছুটতে পারেন না। এক-একটা প্যারাগ্রাফের দারুণ স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরোতেই যে দমও ফুরিয়ে আসে। মলয়ের বেশির ভাগ গল্প-উপন্যাস এই শ্রেণীর গদ্যে লেখা। যে, কারণে, শুধুমাত্র গদ্যের এই রেসের কারণেই তাঁর 'নামগন্ধ' বাদে অন্য কোনো উপন্যাস আমায় টানেনি। এটা আমার ব্যক্তিগত গদ্যকার হবার কুফলের দরুনও হতে পারে।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন। কোনো কোনো কখনওএতে যেন অতিরিক্ত সচেতন। প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত, কিন্তু নুনের পরিমাণ একটু বেশি। শব্দ-ব্যাপারে মলয়ের ঢালাইঘরে অনবরত হিট ট্রিটমেন্ট। দারুণ মেদবিহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার। কিন্তু যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প বা উপন্যাস লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন-হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে ফেলেন। ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেইনলেস হয় না। ক্র্যাক হয়ে যায়। তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন। তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না। যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে-হয়ে বেঁকে বেঁকে যায়। এর ফলে।কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুণ লাগলেও খুব কনট্রাইভড, গদ্য বানাবার দাগগুলো চোখে পড়ে যায়। এটাকে মলয়-গদ্যের দুর্বলতা বলুন, বা বৈশিষ্ট্য।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই আমি মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪সালে, 'এবং' পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্ৰহ 'ভেন্নগল্প'-র অন্যতম ভূমিকা হিশেবে পুনর্মুদ্রিত। আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে লেখা তাঁর প্রথম নভেলা 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সনে এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাসে' (১৯৯১-৯৩ সালে লেখা, এবং ১৯৯৪-এ প্রকাশিত)। তাঁর পরবর্তী উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও এই গদ্যে লেখা। এমনকি আমার-পড়া তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'নামগন্ধ'ও সেই একই গদ্যে লেখা। ভেন্নগল্পের এক ডজন ছোটগল্প আর এই তিনটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্ত্বিক মলয় আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে। কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে হাসিল অভিজ্ঞতা, নানা অন্তর্দেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে। কলকাতার পাতি কাগজগুলোতে বিশেষত 'ডুবজলে'র উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাঁদের প্রোডরম্যান ফেজ কাটিয়ে উঠেছেন। আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রূপ যে আক্রান্ত হয়েছিলেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হয় সেই প্রথম। সতীনাথ ভাদুড়ী, প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশনে যা আগে কখনো এভাবে খাপ খায়নি। মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে। খাস করে বিহারের দেশয়ালি আর সড়কছাপ জং-মরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়েঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে। ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি-ঝাড়খন্ডি বঙ্গকৃষ্টি দারুণ-দারুণ ঝাপটা মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে শুরু করেছিল। একটা সফল ঝাপটা ছিল ন'য়ের দশকের 'ডুবজলে'। বিহারের আর্থ-সমাজ-সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার কূপব্যাঙ আলোচক-পাঠকরা। আর তাতেই তাঁরা দারুণ অমায়িক হোস্টেস হয়ে পড়েছিলেন 'ডুবজলে'র। কিন্তু, এটা, মলয়ও জানতেন, রানওয়ে মাত্র--- তিনি উড়ান দেখাবেন পরবর্তীতে। সেই উড়ান-ই হলো মলয়-ট্রিলজির শেষ পর্দাফাঁস উপন্যাস 'নামগন্ধ'।
মলয় জনান্তিকে বলেছেন, এ-উপন্যাস পশ্চিমবঙ্গের কোনো সম্পাদক ছাপতে সাহস পাননি, যে কারণে ঢাকার লালমাটিয়া থেকে বেরিয়েছিল আগে, পরে হওয়া ৪৯ থেকে বেরোয়। গোড়াতেই ফাঁস হয়ে গেল নামগন্ধে কী মাল তিনি দিয়েছেন এবং যা অবধার্য হয়ে উঠেছে এসময়ে, মলয়ের পাঠকৃতি সেই আধুনিক ঝোঁকে স্বতঃউৎসারিত। স্বীয় আয় করা দৃঠি ও অভিজ্ঞতাকে ছিঁড়ে পাঠবস্তুর টুকরো পাত্রে স্বত্বহীনভাবে বিলিয়ে দিচ্ছেন বহুরৈখিক আয়ামে। তাঁর অন্যান্য রচনার মতো এ উপন্যাসও দামাল ঝাপটা মারে ঝাদানভ-প্লেখানভদের বাঙালি ভাবশিষ্যদের এতদিনকার নির্বিঘ্নে মেলে রাখা অরজ্ঞানডির ভুলভুলইয়াপনায়। নামগন্ধেও কাহিনী পরিণাহটি ন্যূন, বক্তব্যেই মূলত মাটাম ধার্য করেছেন মলয়। তিনি সঠিক কষে ফেলেছেন যে বর্তমান কালখণ্ডে ভারতবর্ষীয় হিন্দু-বাঙালির তথাকথিত সংস্কৃতি মূলত ক্ষমতাকেন্দ্রের ও তার চারপাশের সংস্কৃতি। মানে, ঐ কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী হাওড়া-হুগলি-চব্বিশ পরগণার সংস্কৃতি। সুতরাং গুনসুঁচ নিয়ে ধেয়েছেন ওই ক্ষমতাকেন্দ্রটিকে বেঁধবার জন্য।
----------------------
"নামগন্ধ" নিয়ে বিশদ আলোচনা করব আগামী কাল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন