সোমবার

অনিল করঞ্জাই সম্পর্কে মলয় রায়চৌধুরী


যখন অনিল করঞ্জাই-এর সঙ্গে অরূপের এঁটোকাঁটা খেতুম

প্রিয় মলয়
         গাঁজা টানার ছবিগুলো পাঠালাম মলয় ।
         আমাদের নতুন অ্যাক্টিভিটি বলতে
         লাল চাইনিজ কাপড়ের জামা টাইপের কোট জাতীয়
         একটা করে বুশশার্ট — নিউ রোডের
         টেরিলিন মার্কা সাহেবরা হাহুতাশ
         করছে আমাদের দেখে । এক একদিন রাস্তায়
         ভিড় জমে যায়
         কখনো কানের পাশে শুনতে পাই হাংরি ।
         কিছু ড্রইং আরও করেছি, পাঠাব ।
         মগজে দপদপ করছে অনেক কিছুই ।
         ত্রিদিবকে একটা ছবি আর দু-এক টুকরো লেখা পাঠিয়েছি ।
                                                     অনিল করঞ্জাই

         এই চিঠিটা অনিল করঞ্জাই কাঠমাণ্ডু থেকে আমায় লিখেছিলেন ১৯৬৫ সালে। কাঠমাণ্ডুতে তিন মাস ছিলুম ঠমেল নামের এক বিশাল চালাপ্রাসাদে, আমি অনিল করুণা সুবিমল কাঞ্চন আর দাদা, ওরা তাড়াতাড়ি ফিরে গিয়েছিল ; আমি চাকরি থেকে সাসপেন্ড ছিলুম বলে হাতে অফুরন্ত সময় ছিল, তাই টানা তিন মাস থেকে গিয়েছিলুম  । ঘরে-ঘরে হিপি-হিপিনি ।

         অনিল আর করুণানিধান মুখোপাধ্যায় মিলে আমার অনেকগুলো ফোটো তুলেছিল, কোনোটায় গাঁজা খাচ্ছি, কোনোটায় চরস ফুঁকছি, কখনও হিপি-হিপিনিদের জমঘটে, কখনওবা সন্ধ্যাবেলা কোনো মন্দিরে বুড়ো নেপালিদের জমঘটে বসে । একটাই ফোটো ছিল হিপিনি ম্যাডেলিন করিয়েটের সঙ্গে, যে আমার “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসের স্বর্ণপ্রতিমা ।  পাটনার বাড়িতে ছিল ফোটোগুলো । আমি পাটনা ছাড়ার পর সবই এদিক-ওদিক হয়ে গেছে আমার সংগ্রহের বইপত্রের সঙ্গে ।

         হাংরি আন্দোলনের পোস্টারগুলো অনিল আর করুণা দু’জনে এঁকে দিতো । সেসময়ে পোস্টার ছাপাবার হ্যাঙ্গাম ছিল । অনিল একটা উর্দু খবরের কাগজের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে তাদের লিথো প্রেস থেকে পোস্টারগুলো ছাপিয়ে নিতো । কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসের দেয়ালে ত্রিদিব আর আলো মিত্র দুজনে সেঁটে দিতো পোস্টার । যারা আমাদের বিরোধী, তা প্রায় সকলেই আমাদের বিরোধী ছিল, তারা পোস্টারগুলো খুঁচিয়ে ছিঁড়ে ফেলতো । খালাসিটোলাতেও পোস্টার মারা হয়েছিল । জীবনের পরম্পরাগত সীমাগুলো লঙ্ঘনের জন্য মাঝে-সাঝে সঙ্গী বা সঙ্গিনীর দরকার হয় । অনিল করঞ্জাই বেশ কয়েকটা সীমা ভেঙে ফেলতে আমায় সাহায্য করেছিল সেসময়ে, যেমন আমি অনেককে সাহায্য করেছিলুম তাদের বাড়ির গড়া ট্যাবুগুলো ভেঙে ফেলতে ।

         অনিলের পরিবার দেশভাগের সময়ে তখনকার পূর্ব পাকিস্তানের রঙপুর থেকে কাশীতে চলে এসেছিললেন  কারণ পশ্চিমবঙ্গে ওনাদের পরিবারের কেউ ছিলেন না । বাঙালিটোলায় আশ্রয় নিয়েছিলেন অনিলের বাবা, এবং একজন ডাক্তারের কমপাউণ্ডারের কাজ করে স্ত্রী, তিন ছেলে আর এক মেয়ের সংসার চালাতেন । অনিল ছিলেন জ্যেষ্ঠ, কিন্তু ছবি আঁকার জন্য পনেরো বছর বয়সে বাড়ি ছাড়েন ; ছয় বছর শিক্ষানবিশী করেন ভারতীয় কলাকেন্দ্রের শিল্পী কর্নমান সিংহের অধীনে । আঠারো বছর বয়স থেকে তিন  বেনারস পলিটেকনিকে প্রতিমা নির্মাণ শেখেন, সেই সঙ্গে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতকলা ভবনে মিনিয়েচার ছবি আঁকা শেখেন। এরপর তিন বছর অনিল চুনারের সরকারি কুম্ভকারশালায় শিক্ষকতার চাকরি করেছিলেন । জীবনে এই তিন বছরই চাকরি করেছেন অনিল করঞ্জাই, বাকি জীবনটা কাটিয়েছেন অরূপের এঁটোকাঁটা খেয়ে, পেইনটিঙ এঁকে ।

         প্রাইমারি স্তরে অনিল বাংলা মাধ্যম স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন, সেসময়ে শতকরা চল্লিশভাগ বেনারসনিবাসী ছিলেন বাঙালি । অনিলের মা হিন্দিতে কথা বলতে পারতেন না । তাঁদের বাড়িতে যে মাছ বিক্রি করতে আসতো সেও বাংলাতেই কথা বলতো । অনিলের শৈশবে বাংলায় কথা বলার আবহ ছিল । এখন বেনারসে বাঙালি বলতে কেবল বিধবারা ; বাঙালি পরিবার আর নেই । কোনো স্কুলে বাংলা পড়ানো হয় না ।

         বেনারসে বাঙালিটোলায়, যে পাড়ায় অ্যালেন গিন্সবার্গ ও পিটার অরলভস্কি থাকতেন, সেই পাড়ায় একটা বড়ো ঘর ভাড়া নিয়ে ইউনাইটেড আর্টিস্টস নামে একটি গোষ্ঠীর পত্তন করেন অনিল, যার সদস্যরা, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ছাড়া, ছিলেন সুবীর চট্টোপাধ্যায়,  বিভূতি চক্রবর্তী, অরুণ দত্ত ও বিভাস দাস । তাঁরা ‘ডেভিলস ওয়র্কশপ’ নামে যৌথ স্টুডিওয় ছবি আঁকা আরম্ভ করেন । একটি পেইনটিঙকে সমবায়ী গরজে সবাই মিলে একত্রে আঁকার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে একটি কৌম অভিব্যক্তি দেবার প্রয়াস করতেন তাঁরা । উদ্দেশ্য ছিল ঔপনিবেশিক ব্যক্তিপ্রতিস্ববাদ থেকে পেইনটিঙকে মুক্ত করা । উল্লেখ্য যে ভারতীয় আধুনিকতাবাদী ভিজুয়াল আর্টসে তাঁদের আগের প্রজন্মের হইচই তখন ফুরিয়ে এসেছে । এম এফ হুসেনের কুড়ি ফুটের কাজ ‘জমিন’ আঁকা হয়ে গেছে ; কলাভবনে রামকিংকর বসিয়েছেন বিশাল মূর্তি ; নেহেরুর বদান্যতায় ছবি আঁকিয়েরা দলে দলে ঘুরে এসেছেন ফ্রান্স, ব্রিটেন, পোল্যাণ্ড, যুগোস্লাভিয়া, ইটালি, সাও পাওলো ইত্যাদি ; ইউরোপ থেকে ফিরে এসেছেন এন এন সৌজা ; ফেলোশিপ দেয়া আরম্ভ করেছে রকেফেলার ফাউণ্ডেশান ।

         অনিল আর করুণানিধান হাংরি আন্দোলনে যোগ দেবার পর এবং হিপিদের সঙ্গে মাদক ও অবাধ যৌন সম্পর্কের কারণে দলটা ভেঙে যায়, তারপর অনিল আর করুণা নকশাল আন্দোলনের প্রতি আকর্ষিত হলে, পুলিশের ধরপাকড় আরম্ভ হতে, সবাই বেনারস ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হন । হাংরি আন্দোলনের ৪৮ নম্বর ইশতাহারটি ছিল ছবি আঁকা নিয়ে, যা লিখেছিলেন অনিল ও করুণা যৌথভাবে । ১৯৮২ সালে সেটিতে কালানুগ রদবদল করে ‘আর্ট টুডে’ পত্রিকায় প্রকাশ করেছিলেন অনিল ।

         অনিল করঞ্জাইও অ্যালেন গিন্সবার্গকে একজন অরিয়্যান্টালিস্ট বলে মনে করতেন, গিন্সবার্গের খোঁড়া, নুলো, ভিখারি, কুষ্ঠরোগি, পথে পড়ে থাকা শব, মণিকর্ণিকা ঘাটের শবদাহ ইত্যাদির ফোটোতলায় অনর্থক আগ্রহের কারণে । গিন্সবার্গ প্রায়ই যেতেন মণিকর্ণিকা ঘাটে, কিন্তু সেই ঘাটে যে শবেদেরও জাত-পরিচয় জরুরি, কোন নির্দিষ্ট জায়গায় তাদের পোড়ানো হচ্ছে, সেগুলো কখনও খেয়াল করেননি ।

         কলকাতা থেকে বেনারসে পুলিশ গিয়ে  নকশালদের ধরে নিয়ে গিয়ে পথেই লোপাট করে দিচ্ছিল । অনিলের মতন শিক্ষা করুণানিধানের ছিল না, কিন্তু করুণানিধান ছিল অনিলের অন্তরঙ্গ বন্ধু ; বই আর পত্রিকায় ছবি আঁকার অর্ডার পেলে অনিল তা করুণাকে দিতেন । করুণার স্ত্রী এবং বাচ্চা ছেলে ছিল, একটি মন্দির চত্ত্বরে থাকতেন,  কিন্তু হিপিদের মাঝে মাদক পৌঁছে দেয়া এবং হিপিনীদের সঙ্গে শোয়ায় করুণার স্ত্রীর কোনো আপত্তি ছিল না ।

         ভিয়েৎনাম যুদ্ধ এড়াতে মার্কিন যুবকরা দলে-দলে হিপি হয়ে যাচ্ছিল ; বেনারস হয়ে উঠেছিল তাদের ঘাঁটি, বেনারস হয়ে চলে যেতো কাঠমাণ্ডু । বেনারসের যাবতীয় ঘাঁতঘোঁত করুণার পরিচিত ছিল, ফলে সহজেই হিপি-হিপিনীদের গাইড হয়ে ওঠে । হিপিরা কাঙমাণ্ডু যাবার পথে পাটনায় আমাদের বাড়িটা হলটিং স্টেশন হিসাবে ব্যবহার করতো, কেননা কাঠমাণ্ডু যাবার জন্য পাটনা থেকে স্টিমারে গঙ্গার ওইপারে গিয়ে শোনপুরে ট্রেন ধরে নেপাল সীমান্তে পৌঁছোতে হতো, তারপর বাসে করে কাঠমাণ্ডু । হিপি যুবক-যুবতীরা দুজনের জোট বেঁধে আসতো বটে কিন্তু তা হতো সাময়িক, ইচ্ছেমতন ঘনঘন সঙ্গী পালটে ফেলতো, কিংবা সঙ্গী থাকলেও দুজনেই অন্য কারোর সঙ্গে শুতে পারতো, প্রেমে পড়ে সম্পর্ক ভাঙার ব্যাপার ছিল না । হিপিদের মধ্যে প্রেম ব্যাপারটা নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত হয়ে গিয়েছিল ।

         অনিল করঞ্জাইও লোলা লোরিঙ নামে অমন একজন হিপিনীকে পেলো, যে এডওয়ার্ড নামে এক মার্কিন হিপি যুবকের সঙ্গে বেনারসে এসেছিল ; এডওয়ার্ড লোলাকে ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে জুটি বেঁধে চলে গেল শ্রীলঙ্কা । লোলার দায়িত্ব প্রথমে বর্তেছিল করুণার ওপর, করুণা লোলাকে অনিলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দ্যান।  অনিলের চোখে লোলা ছিলেন ভারতীয় বৈশিষ্ট্যের সুন্দরী, যদিও লোলার কোনো পেইনটিঙ অনিল এঁকেছিলেন কিনা তা জানা যায় না, কেননা বেনারসের পুলিশ অনিলদের স্টুডিও লণ্ডভণ্ড করার সময়ে পেইনটিঙগুলোও নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিলের দ্বিতীয় স্ত্রী জুলিয়েট রেনোল্ডস বহুকাল পরে গিয়েছিলেন বেনারস, কিন্তু অনিলের স্মৃতির কিছুই আর পাননি সেখানে ।

         করুণার বিপরীত চরিত্রের মানুষ ছিলেন অনিল ; গম্ভীর, গ্রন্হকীট, স্বল্পবাক, ছবি-আঁকা এবং ভাস্কর্য  ও তার বাঁকবদল সম্পর্কে আগ্রহী, উৎকর্ণ শ্রোতা, গাঁজা-চরস-আফিম খাবার সীমা বাঁধা ছিল অনিলের, যাতে ছবি আঁকার মতন মেজাজ বজায় থাকে । তাঁর বড়ো-বড়ো নিশিডাক চোখ, টিকোলো নাক ও শ্যামল ত্বকের কারণে হিপি যুবতীরা, যাঁরা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হতেন, তাঁকে বলতেন ‘ডার্ক অ্যাডোনিস’ । করুণাই মূলত অ্যামফিটেমাইন, মেসকালিন, লাইসার্জিক অ্যাসিডের জগতে হিপিদের মাধ্যমে ঢুকেছিল আর আমাদের পরিচয় করিয়েছিল । এই রাসায়নিকের নেশায়, আমার মনে হয়েছে, লেখালিখি করা যায় না ।

         অনিল নকশাল ছিলেন না,কিন্তু তাঁর সহানুভূতি ছিল আন্দোলনটির প্রতি । পরে তিনি ঘোর সিপিএম বিরোধী হয়ে ওঠেন, পশ্চিমবাংলায় পরিবর্তনের হাওয়া ওঠার দশবারো বছর আগে থাকতে । সাঁইবাড়ির ঘটনাকে তিনি তুলনা করেছিলেন রাক্ষসদের মানুষের মাংস ভক্ষণের সঙ্গে । অনিল কোনো ধর্মে বিশ্বাস করতেন না, কিন্তু যখন কলকাতায় সতেরোজন সন্ন্যাসীকে গায়ে পেট্রল ঢেলে পোড়ানো হয়েছিল তখন তাঁর সঙ্গে দিল্লির সিপিএম অ্যাক্টিভিস্টদের ঘোর বাকযুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল । কিন্তু বামপন্হী আন্দোলনগুলোর জন্য তিনি পোস্টার এঁকে দিতেন । পিইউডিআর-এর লোগো তাঁর আঁকা । অনিল ‘হাই আর্ট’ এবং ‘লো আর্ট’ বিভাজন-চিন্তার বিরোধী ছিলেন ; দুন স্কুলে যখন তাঁকে ওয়র্কশপের জন্য ডাকা হতো সেখানেও তিনি এই বিরক্তিকর বিভাজনের কথা বলতেন । তাঁর বক্তব্য ছিল যে তিনি আঁকার মাধ্যমে মেইনস্ট্রিম আর্টের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করছেন, এবং সেকারণেই হাংরি আন্দোলনের অবদান তাঁর জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । দাদা সমীর রায়চৌধুরী হাংরিদের রচনার নেপালি ভাষায় অনুবাদ ও নেপালি কবিদের লেখা নিয়ে একটা সংকলন সেসময়ে প্রকাশ করেছিলেন, যার প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছিলেন অনিল করঞ্জাই ।

         “হাংরিয়্যালিজম” শব্দটা অনিল করঞ্জাইই তৈরি করেছিলেন । হাংরি আন্দোলনের সময়ে অনিল বলতেন যে পেইনটিঙকে লোকায়ত কাজের মতন ফ্রেম থেকে এমনভাবে মুক্তি দিতে হবে, যাতে তার কোনো ফোকাল বা কোর পয়েন্ট না থাকে, যাতে ক্যানভাসের সর্বত্র বিরাজ করে ছবিটির সার্বভৌমত্ব ; একটি পেইনটিঙে মাল্ট্রি এন্ট্রি ও মাল্টি এগজিট থাকবে । অনিলের বক্তব্য ছিল যে সুররিয়্যালিস্ট, কিউবিস্ট, অ্যাবস্ট্রাকশানিস্ট পেইনটাররা কেউই ছবিকে ফোকাল পয়েন্ট থেকে মুক্ত করতে পারেননি । অনিল বলতেন যে, যিনি আঁকছেন, তিনি তাঁর জগতের ‘মাইক্রোপলিটিকাল মালটিপ্লিসিটিতে’ জারিত । বলতেন যে ছবিতে থাকতে হবে ‘ইনডিজেনাস কনসিসটেন্সি’ । এই টেনশনটি ছিল গতিচঞ্চল, বিদার-সঞ্চারী এবং এথনিক ।

         বস্তুত হাংরি আন্দোলনের সকলের মধ্যেই, লিখিয়ে হোন বা আঁকিয়ে, ঔপনিবেশিক মানদণ্ড থেকে বেরোবার যে-ছটফটানি কাজ করত, পরস্পরের মধ্যে সেটিই ছিল প্রধান যোগসূত্র । আলোচকরা প্রায় সবাই ঔপ০নিবেশিক চিন্তনতন্ত্রে প্রতিপালিত ছিলেন বলে অনিল প্রমুখ হাংরি আন্দোলনকারীদের উত্তরঔপনিবেশিক তোলপাড়কে ব্যাখ্যা করতে পারতেন না । আলোচকরা ভাবতেন, কাজ হিসাবে ছবির বা লেখার কারণ থাকতে হবে, এবং কাজটির অনেকরকম অর্থময়তা হলে চলবে না । এর ফলে অনিলের স্বীকৃতি পেতে সময় লেগেছিল । ১৯৭২ সালে অনিল করঞ্জাই ললিত কলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার পান ।

         বেনারসের গোধুলিয়ায় প্যারাডাইস রেস্তরাঁয়, পাটনার পিন্টু হোটেলে বা মহেন্দ্রুঘাট রেস্তরাঁয়, কলকাতা কফিহাউস বা খালাসিটোলায়, আর কাঠমাণ্ডুর ঠমেলে মাটিতে খড়ের বিছানায় বসে, অনিলকে দেখতুম হাতের কাছে যা পেতেন, চার মিনার সিগারেট প্যাকেটের ছেঁড়া সাদাপিঠ বা লিটল ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা বা ঠোঙার কাগজ, তাতে একটা ফুটকি কোথাও দিয়ে সেখান থেকে তাঁর কলম অপরিসীম ধৈর্যে ছড়িয়ে পড়ছে, ঘটিয়ে চলেছে মর্ফোলজিকাল ইলিউশান, অধচ আমরা সবাই তখন যে তর্কাতর্কি করছি সেদিকেও খেয়াল রেখেছেন । টেবিল ছেড়ে ওঠার সময়ে আঁকা জিনিসটা সেখানেই পড়ে থাকত, মালিকানাহীন । তাঁর ফেলে-দেয়া সেসমস্ত অমূল্য ড্রইং ছিল য়উচিন্তার একাগ্র আশ্রয়, দিগ্বিদিকে গতিময়, ঘাসের আদলে বহুদিশাময়, অপরিমেয়তায় যৌগিক, নৈর্ব্যক্তিক এবং অনেক ধরণের বার্তা বহনকারী । অদৃশ্যের দিকে, অনন্তের দিকে, এক ঠায়ে চেয়ে থাকার ফসল ।

         অনিল আর করুণা কাঠমাণ্ডুর ‘ম্যাক্স গ্যালারিতে’ ওনাদের ছবির যে প্রদর্শনী করেছিলেন, সেইটাই একমাত্র ঘোষিত “হাংরি আন্দোলন” চিত্রপ্রদশনী, তার মালিক ছিলেন এক আফ্রোমার্কিন যুবতী, তাকেই জানি না কেমন করে পটিয়ে ফেলেছিল করুণা, সব অর্থে পটিয়ে-ফেলার কথা বলছি । হাংরি বুলেটিন ও পত্রিকার জন্য সুবিমল বসাক যে সমস্ত ড্রইং এঁকেছিলেন, তারও কয়েকটা ছিল । উদ্বোধনের দিন সেখানেও অনিল বলেছিলেন, যে, আঁকিয়ের ব্যক্তিগত মগ্নচেতনা মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়, এমনকি ছবি আঁকায় তার কোনো ভূমিকা নেই । আঁকিয়েকে হয়ে উঠতে হবে ব্রহ্মাণ্ডের ও মর্ত্যপ্রকৃতির বুদ্ধিবৃত্তি ও চেতনার অংশ । আমার মনে হয় এই বোধের কারণে অনিল কোনো নির্দিষ্ট ছকে আটকা পড়েননি, যদিও অমন ছকে নিজেকে বেঁধে ফেলাটাই ছিল ওই সময়ের পাশ্চাত্য আধুনিকতাবাদের প্রধান শর্ত । অনিল বলতেন বিশ্বপৃধিবীর উদ্ভাসই ছবির অন্তর্দীপ্তি গড়ে তোলে ; তাকে ছবি-আঁকিয়ের শিল্পীচেতনা দাবি করাটা কুতর্ক । আমেরিকায় তাঁর পেইনটিঙগুলোর প্রদর্শনীতে আশানুরূপ রেসপন্স না পাওয়ার কারণ সম্ভবত তাঁর এই বিশেষ দৃষ্টিপ্রতিভা ।

         লোলা লোরিঙ ফিরে যাবার পর অনিল কিছুদিন বেশ বিষণ্ণ ছিলেন । নকশাল আন্দোলনের চাপে অনিল দিল্লি চলে গিয়েছিলেন । সেখানে ডিভোর্সি মার্কিন যুবতী মার্গারেট, সব অর্থেই মার্কিনি, করুণার মাধ্যমে পরিচয়ের পর, দুজনে লিভ-টুগেদার সংসার পাতলেন । মার্গারেটকে বিয়ে করে দুজনে মিলে আমেরিকা পাড়ি দিলেন, কেননা দিল্লির জীবন ধনী দুহিতা মার্গারেটের পছন্দ হচ্ছিল না । দিল্লিতে পেইনটিঙ বিক্রির বাজারি আর রাজনৈতিক মারপ্যাঁচের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারছিলেন না অনিল । মার্গারেট অনিলের অর্ন্তদ্বন্দ্বের হদিশ পাচ্ছিলেন এবং তার সুরাহা আমেরিকায় করা যাবে ভেবে নিয়ে গেলেন অনিলকে । কিন্তু আমারিকায় গিয়ে মার্গারেট নিজের শহর ওয়াশিংটন ডিসিতে ঘর বাঁধলেন, যখন কিনা আমেরিকায় তখন সাহিত্য ও ছবি আঁকার ঘনঘটা চলছিল নিউ ইয়র্ক এবং সান ফ্রানসিসকোতে ।

         আমেরিকা অনিলের ভালো লাগলো না । মার্গারেটের একগুঁয়েপনার জন্য অনিল ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকতে বাধ্য হলেন । অনিল ক্রমে টের পাচ্ছিলেন যে আমেরিকায় ছবির প্রদর্শনী, শিল্পসমালোচকদের হাত করার পদ্ধতি, এবং পেইনটিঙ বিক্রির এজেন্ট অধ্যুষিত রাজনীতি, দিল্লি-মুম্বাইয়ের তুলনায় অত্যন্ত হৃদয়হীন ও বহুগুণ নোংরা । মার্গারেট চাইছিলেন অনিল আমেরিকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করুন, এবং পাকাপাকিভাবে থেকে যান । প্রস্তাবে আতঙ্কিত হয়ে উঠলেন অনিল, মনমরা হয়ে পড়লেন, যা প্রতিফলিত হচ্ছিল তাঁর আঁকায় । আমেরিকায় কেবল ম্যাকলিন গ্যালারি তাঁর একক প্রদর্শনী করেছিল, কিন্তু তাঁর ছবির “আনন্দক্লিষ্টতা” দর্শকদের বোধগম্য হয়নি । ১৯৭৮ সালে একদিন সন্ধ্যায়, ওভারকোট টুপি পরে, “একটু বেড়িয়ে আসি” বলে, মার্গারেট এবং যাবতীয় পেইনটিঙ পেছনে ফেলে রেখে, দিল্লির ফ্লাইট ধরে অনিল সোজা স্বদেশে পাড়ি মারলেন ।

         দেশে ফিরে স্বস্তি পেলেন অনিল । কাঞ্চন আর করুণাও পাকাপাকিভাবে চলে এসেছিলেন দিল্লিতে । কাঞ্চন অবশ্য কলকাতায় ফিরে গিয়েছিল মাওবাদী আন্দোলন সেখানে শেকড় বেছাতে পারায় । দীপঙ্কর দত্ত, অরূপ চৌধুরী, গৌতম দাশগুপ্ত প্রমুখ দিল্লিবাসী উঠতি বাঙালি কবিদের সঙ্গে পরিচয় হল, হিন্দি ও উর্দু ভাষার বামপন্হী কবি-সাহিত্যিকদের পরিবেশে আস্বস্ত বোধ করতে লাগলেন অনিল । জোরবাগ পাড়ার নিরিবিলিতে একতলার একটা ফ্ল্যাট ভাড়া করে, দোতলার ছাদ ঘিরে স্টুডিও তৈরি করলেন ।

         দিল্লিতে অনিলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন আইরিশ শিল্পসমালোচক জুলিয়েট রেনোল্ডস, যাকে অনিলের গল্প বলে রেখেছিলেন করুণা । জুলিয়েট ভারতবর্ষে এসেছিলেন প্রাচীন ভারতীয় শিল্পকলা নিয়ে গবেষণার জন্য এবং অনিলের মতন একজনের সাহায্য তাঁর দরকার ছিল । পরস্পরের পরিচয়ের পর দুজনে জোরবাগের ফ্ল্যাটে লিভ টুগেদার সংসার পাতলেন । ডাকে মার্গারেটকে ডিভোর্স দেবার পর বিয়ে করলেন জুলিয়েটকে । অনিলের সারা জীবনের সঙ্গিনী ছিলেন জুলিয়েট । আলোচকরা বলেন অনিলের ছবি আঁকার তিনটে বাঁকবদল আছে : হাংরি আন্দোলন ও লোলা লোরিঙ পর্ব, নকশাল আন্দোলন ও মার্গারেটের পর্ব এবং জুলিয়েট রেনল্ডসের পর্ব । এই ধরণের পর্ব বিভাজনে অঙ্কনকৃতিকে কৌমনিরপেক্ষ ঠাহর করার বিপদ আছে, যখন কিনা অনিল শুরু থেকেই নিজেকে সমাজনির্মিত বলে মনে করতেন ।

         জুলিয়েট শিল্পসমালোচক ছিলেন বলে আঁকার ব্যাপারে অনিলের সুবিধা হয়েছিল, পত্রপত্রিকায় প্রতিক্রিয়ার বিশ্লেষণ করার ক্ষেত্রেও । জুলিয়েটের সমালোচনামূলক পরামর্শে অনিলের পেইটিঙের বিক্রিও বেড়ে গিয়েছিল । ১৮৮৯ সালে যখন ওনাদের জোরবাগের বাসায় গিয়েছিলুম, ভালো লেগেছিল ওনাদের পারস্পরিক নির্ভরশীলতা দেখে । আয়ারল্যাণ্ডে জুলিয়েটের মায়ের যে জমিজমা ছিল তা বিক্রি করে টাকাটা মেয়েকে দেবার দরুণ ১৯৯৬ সালে অনিল-জুলিয়েট দেহরাদুনে একটি বাংলোবাড়ি কেনেন, দিল্লির ছবি আঁকার রাজনীতি থেকে দূরে, শেষ ছবিগুলো নিশ্চিন্তে আঁকার জন্য । জুলিয়েটের একাকীত্ব দূর করার জন্য, এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতার উদ্বেগে, নেমো নামে একটি  প্রতিবন্ধী বালককে তাঁরা দত্তক নিয়েছিলেন । নিজেদের জীবন নিয়ে জুলিয়েট একটি বই লিখেছেন , ‘ফাইন্ডিং নেমো’ নামে ।

         ২০০০ সালে অনিল কলকাতায় এসেছিলেন জনৈক গ্যালারি মালিকের সঙ্গে, যিনি উনিশ শতকের বাঙালি পেইনটারদের ছবি কিনতে চাইছিলেন । অনিল বলেছিলেন সেই সময়ের বহু পেইনটিঙ পাঁজা করে অবহেলায় রাখা দেখেছেন বহু বনেদি পোড়োবাড়িতে, পড়ে-পড়ে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে । আমাএ সেই বছরেই দ্বিতীয়বার হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল শুনে দেখা করতে এসেছিলেন নাকতলার ফ্ল্যাটে । অনুরোধ করেছিলেন স্বাস্হ্যোদ্ধারের জন্য কিছুকাল দেহরাদুনে তাঁদের বাঙলোয় গিয়ে থাকতে ।

         ২০০১ সালে কাঞ্চনের টেলিফোনে খবর পেলুম যে ১৮ই মার্চ অনিল করঞ্জাই মারা গেছেন । কলকাতায় কেবল শর্মী পাণ্ডে-শুভঙ্কর দাশের পত্রিকায় তাঁর মৃত্যু সংবাদ, রেখাচিত্র ও অপ্রকাশিত চিঠি ছাপা হয়েছিল । মেইনস্ট্রিম বাংলা কাগজগুলো সংবাদসূত্র থেকে জানতে পেয়েও তাঁর মৃত্যুর খবর পাঠকদের জানালো না যে একজন প্রখ্যাত বাঙালি পেইনটার মারা গেলেন, যাঁর ছবি আঁকা কেবল রূপারোপ, রূপবিন্যাস, প্রতিফলন, উপস্হাপনা, অভিনবত্ব, জ্যামিতিকতা, নিহিতার্থ, উন্মোচন, রেখসংহতি, অলঙ্করণ, কল্প-অভিব্যক্তি, বর্ণশৈলী ইত্যাদির মানদণ্ডে সীমাবদ্ধ নয় । ১৯৯৬ সালে অনিল করঞ্জাইয়ের কাজ নিয়ে অনুসূয়া বৈদ্য ও অনিল শেট্টির তথ্যচিত্র দূরদর্শনসহ অন্যান্য চ্যানেলে বহুবার দেখানো হয়েছে । বিবিসিতে দেখানো হয়েছে । দুর্ভাগ্যের বিষয় যে দে’জ এবং কথা ও কাহিনি থেকে প্রকাশিত হাংরি সংকলন যাঁরা  সম্পাদনা করেছেন, তাঁরা অনিল করঞ্জাইয়ের নামই শোনেননি । এসট্যাবলিশমেন্ট নিজের বিষ উগরে দেবার নানা উপায় জানে ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন