মঙ্গলবার

খাজুরাহো ধ্বংস - একটি পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী

 

খাজুরাহো ধ্বংস - একটি পোস্টমডার্ন নাটক : মলয় রায়চৌধুরী


নাদির শাহ : দ্যাখ আবদালি, এটা ১৭৭৪ সাল । তোর দু’কানের লতি এই জন্যে কেটে দিলুম যে তুই চিরজীবন মনে রাখবি তুইই আমার ভাবশিষ্য ; আমার তো কোনও বংশধর নেই । মনে রাখিস যে আমি আর আমার মা উজবেক-তুর্কীদের  দাস হিসেবে কাজ শুরু করেছিলুম কিন্তু আমি ওদের ফাঁদ কেটে পালাই। আমি তারপর  সৈন্যবাহিনীতে যোগ দিয়ে ক্রমশ  প্রধান হয়ে উঠি ।  পৃথিবীকে কাফেরমুক্ত করার দায়িত্ব তোকে দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের স্লোগান মনে আছে তো তোর ? জান, জর, জমিন । মানে, মেয়েমানুষ, সোনা, এলাকাদখল । আমাকে ভালো করে কবর দিয়ে তুই কাজে এগো । 


আদিল শাহ আবদালি : মনে থাকবে সম্রাট ; আফগানদের নাম রওশন করব । কাফের বলতে তো ওই একটাই দেশ, আল-হিন্দ । তিব্বত আছে বটে, কিন্তু ওখানে সোনাদানা আর কাজের জমি পাওয়া যায় না । বাঁচলো চিন ; সেখানে চেঙ্গিজ খানের বৌদ্ধ বংশধরদের রাজত্ব, পেরে ওঠা যাবে না । খোয়াজা চিশতির আশীর্বাদ নিয়ে আমি তাহলে এগোই।


নাদির শাহ : হ্যাঁ, বেস্ট অফ লাক ।


হজরত ইবলিশ : আপনি চিন্তা করবেন না হুজুর । আবদালিকে আমি গাইড করব । খাজুরাহোর সংবাদ ওকে জানতে দেবো না ।


নান্নুকা : ৮৩১ থেকে ৮৫৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আমি ছিলুম ভারতের চান্দেলা রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। আমি জেজকভূক্তি এলাকায়, যা এখন মধ্যপ্রদেশের বুন্দেলখণ্ড, শাসন করতুম। আশ্চর্য যে চান্দেলাদের সম্পর্কে কাব্যিক গীতগুলিতে আমার কথা  উল্লেখ করা হয়নি, আর তার বদলে চন্দেলা বংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে "চন্দ্রবর্মণ" উল্লেখ করা হয়েছে। খাজুরাহোতে ওরা যে দুটো শিলালিপি পেয়েছে, তাতে আমার, মানে নান্নুকাকে, রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে । আরেকটা শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে আমি অনেক শত্রু জয় করেছিলুম আর অন্যান্য রাজকুমাররা আমাকে ভয় পেয়ে আমার আনুগত্য স্বীকার করেছিল। তাতে আরও বলা হয়েছে যে আমাকে দেখতে ছিল "প্রেমের দেবতার মতো” । খ্রিস্টীয় ১০০২-এর  শিলালিপিতে আমাকে সূর্য আর আমার পরিবারের সদস্যদের মণি-মুক্তো হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। আমার তীরন্দাজির দক্ষতা কিংবদন্তি নায়ক অর্জুনের সাথে তুলনা করেছে।সুতরাং, খাজুরাহো বেড়াতে এলে, কথাগুলো মনে রাখবেন ।


ঐতিহাসিক আর. কে, দীক্ষিত : চান্দেলার রেকর্ডে নান্নুকাকে দেওয়া খেতাবগুলোর মধ্যে রয়েছে নাপা, নরপতি আর মহাপতি। এগুলো খুব উঁচু স্তরের খেতাব নয় । তাই কয়েকজন আধুনিক ঐতিহাসিক বিশ্বাস করেন যে নান্নুকা কেবল একটি সামন্ত  শাসক ছিলেন। বুন্দেলখণ্ডের স্থানীয় ঐতিহ্য অনুসারে, চন্দেলারা প্রতিহারদের পরাধীন করার পরে সেই অঞ্চলের শাসক হয়েছিলেন।


আবু রিহান আল বিরুনি : আমি আমার ভ্রমণকাহিনিতে লিখেছিলুম, তাই । নয়তো লোকে জানতে পারতো না যে খাজুরাহো ধ্বংসের কাজ প্রথম আরম্ভ  করেছিল গজনির সুলতান মাহমুদও ভেবেছিল যে কাফেরদের মন্দির মানেই তাতে অঢেল সোনাদানা মিলবে । সপ্তাহখানেক ভাঙচুর করার পর কিছুই না পেয়ে ওর সেনারা যখন চটে লাল, তখন ওদের বোঝালো যে মূর্তিপূজকদের মূর্তিগুলো ভাঙা ওদের কর্তব্য । পঁচাশিটা মন্দির ছিল, সুলতানের সেনারা তিরিশটার মতন ভাঙার পর হাল ছেড়ে দিলে । এরকম মূর্তি আমি দুনিয়ার কোথাও দেখিনি ।


রমেশচন্দ্র মজুমদার : চান্দেলারা প্রথমে কন্যাকুবজার (কান্নৌজ) গুর্জারা-প্রতিহারদের সামন্ততন্ত্র হিসাবে শাসন করেছিল। দশম শতাব্দীর চান্দেলা শাসক যশোবর্মন কার্যত স্বাধীন হয়েছিলেন, যদিও তিনি প্রতিহারদের  স্বীকৃতি অব্যাহত রেখেছিলেন। তাঁর উত্তরসূরী ধঙ্গদেবের সময়কালে, চান্দেলারা সার্বভৌম শক্তি হয়ে উঠেছিল। তারা প্রতিবেশী রাজবংশ, বিশেষত মালওয়ার পরমার এবং ত্রিপুরীর কালাচুরিদের সাথে যুদ্ধ করার সাথে সাথে তাদের শক্তি  হ্রাস পায়। একাদশ শতাব্দীর পর থেকে, চান্দেলারা গজনভি আর মুহম্মদ ঘুরিসহ  মুসলিম শাসকদের কাফের-নিধন ধ্বংসযজ্ঞে অভিযানের মুখোমুখি হয়েছিল। চান্দেলা শক্তি কার্যকরভাবে তেরো শতাব্দীর শুরুতে চাহমন ও ঘুরি আক্রমণগুলির পরে শেষ হয়ে গিয়েছিল ।


বিজয়শক্তি :  মধ্য ভারতের বুন্দেলখণ্ড অঞ্চলের চান্দেলা রাজবংশের নবম শতাব্দীর শাসক ছিলুম আমি। যদিও চান্দেলাদের নথিতে সাধারণত আমার বড় ভাই আর পূর্বসূরি জয়শক্তির সাথে আমার উল্লেখ পাওয়া যায়। আমরা দু'জনে মিলে  ৮৬৫ থেকে ৮৮৫ পর্যন্ত শাসন করেছিলুম । আমি ছিলুম বাকপতির ছেলে আর আমার বড় ভাই জয়শক্তির স্থলাভিষিক্ত হন। আমাকে ভিজা, বিজয়া এবং বিজজাকা নামেও জানতো লোকেরা । আমার পর আমার ছেলে রাহিলা চান্দেলার শাসক হয়েছিল । খাজুরাহো হলো মন্দিরের দেশ, চান্দেলাদের দেশ । খাজুরাহোতে পা রাখা মানেই চান্দেলাদের রাজত্বে ফিরে যাওয়া। চোখের ওপর আশ্চর্য মন্দিরগুলির অলঙ্করণ শিল্প ফিরিয়ে আনবে ৯৫০ থেকে ১০৫০ খ্রিষ্টাব্দের বাতাবরণ। মন্দিরের গায়ে দেবদেবী, অপ্সরা, নর্তকী, মিথুন মূর্তিগুলোতে  প্রাণস্পন্দন পাওয়া যাবে। এক্কেবারে শহরের কেন্দ্রে মন্দিরগুলোর অবস্থান। ফুলবাগিচায় সাজানো চত্বর জুড়ে কাণ্ডারীয় মহাদেব, লক্ষণ, জগদম্বা, চৌষটযোগিনী, চিত্রগুপ্ত প্রমুখ মন্দিরের রাজমালা। ভেবে দেখুন, বিদেশ থেকে এসে একদল ম্লেচ্ছ, যাদের কোনও শিল্পবোধ ছিল না, বেশিরভাগ স্হাপত্য গুঁড়িয়ে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে । ওদের বংশধরদের কোনও লজ্জা-শরম নেই ; ধ্বংসের কথা বুক ফুলিয়ে স্কুলের বাচ্চাদের পড়ায় ।


সবুক্তগিন : আমি তেমন বিখ্যাত নই । আমার ছেলে গজনির সুলতান মাহমুদ বেশি বিখ্যাত । আমি তো ক্রিতদাস ছিলুম । অবশ্য বলতে পারেন যে আমি গজনভি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা আবু মনসুর  সেবুক তিগিন । ৯৭৭ থেকে ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কুড়ি বছর রাজত্ব করেছিলুম।  প্রথম জীবনে  দাস হলেও আমি আমার মালিক আল্প তিগিনের মেয়েকে বিয়ে করেছিলুম ।  বুখারার সামানি সাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রথমে আমার শশুর আর তারপর আমি স্বাধীনভাবে  আফগানিস্তানের  গজনির শাসক হই । আমরা নামে সামানিদের কর্তৃত্বকে স্বীকার করলেও আমার ছেলে মাহমুদ নিজেকে পুরোপুরি স্বাধীন বলে ঘোষণা করে। 

 

ঐতিহাসিক উমা চক্রবর্তী : কল্পিত কিংবদন্তীতে চান্দেলাদের উৎস অস্পষ্ট। রাজবংশের লিপিবদ্ধ রেকর্ডগুলির পাশাপাশি বালভদ্র-বিলাস এবং প্রবোধ-চন্দ্রোদয়ের মতো সমসাময়িক গ্রন্থগুলো থেকে  বোঝা যায় যে চান্দেলরা কিংবদন্তি-কথিত চন্দ্রবংশের অন্তর্ভুক্ত ছিল । খ্রিস্টীয় ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে খাজুরাহো শিলালিপিতে রাজবংশের প্রথম রাজা নান্নুকা ছিলেন চান্দেলা ঋষি চন্দ্রত্রেয়, যিনি ছিলেন আত্রির পুত্র। ১০০০ খ্রিস্টাব্দে খাজুরাহো শিলালিপিতে কিছুটা আলাদা বিবরণ দেওয়া হয়েছে, যেখানে চন্দ্রাত্রেয়কে ইন্দুর (চাঁদ) পুত্র এবং আত্রির নাতি হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। ১১৯৯ খ্রিস্টাব্দে বাঘারী শিলালিপি এবং ১২৬০ খ্রিস্টাব্দ অজয়গড় শিলালিপিতে অনুরূপ পৌরাণিক বিবরণ রয়েছে। বালভদ্র-বিলাস চন্দ্রের পূর্বপুরুষদের মধ্যে অত্রির নামও রেখেছিলেন। আর একটি খাজুরাহো শিলালিপিতে চান্দেলা রাজা ধঙ্গদেবকে যাদবদের বর্ধনী বংশের সদস্য হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে  (যিনি চন্দ্র রাজবংশের অংশ হিসাবে নিজেকে দাবি করেছিলেন)।

 

বাকপতি :  ৮৪৫ থেকে ৮৬৫ সালে মধ্য ভারতের চান্দেলা রাজবংশের  শাসক ছিলুম।  চান্দেলার শিলালিপিতে আমার পদবী কেতিপা ("দেশের কর্তা") হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে।  খাজুরাহোর  দুটো শিলালিপি থেকে জানা যাবে, আমার বাবা ছিলেন নান্নুকা । শিলালিপিতে আমাকে আমার সাহসিকতা, শালীনতা এবং জ্ঞানের জন্য বিখ্যাত রাজা হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। শিলালিপিগুলোতে বলা আছে যে আমি বেশ কয়েকটি শত্রু দেশকে যুদ্ধে হারিয়েছিলুম আর আমি  প্রজাদের প্রিয় ছিলেন।আমার জ্ঞান ও বাকশক্তির জন্য আমার নাম বাকশতীর সাথে তুলনা করা হয়, যিনি ছিলেন আমাদের বক্তৃতার দেবতা। শিলালিপিতে  আরও বলা হয়েছে  যে আমি বুদ্ধির সাথে সাহসের সংমিশ্রণে পৃথু এবং কাকুৎস্যের মতো কিংবদন্তী রাজাদেরকে অতিক্রম করে গিয়েছিলুম।  ৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের একটা শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে বাকপতির "আনন্দ পর্বত" (ক্রিড়া-গিরি) ছিল বিন্ধ্যপর্বতে, যেখানে পদ্মের উপর বসে কিরাতা মহিলারা তাঁর সম্পর্কে গান গেয়েছিলেন, আর ময়ূররা জলপ্রপাতের শব্দে নেচেছিল। 

 

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার : পূর্ব ভারতের পাল রাজা দেবপালার দক্ষিণ সম্প্রসারণকে বাকপতি সম্ভবত সমর্থন করেছিলেন। বাকপাতির দুটি পুত্র ছিল: জয়শক্তি (জেজা) এবং বিজয়শক্তি (বিজ)। তাঁর পরে তাঁর বড় ছেলে জয়শক্তি তাঁর উত্তরসূরি বিজয়শক্তি রাজ্য শাসন করেছিলেন । 

 

তসলিমা নাসরিন : ভারতের মধ্যপ্রদেশে একটি ছোট গ্রামের নাম খাজুরাহো। খেজুর হতো বলেই হয়তো খাজুরাহো নাম গ্রামটির। খাজুরাহোর জঙ্গলের  মন্দিরগুলো চান্দেলা রাজপুত রাজারা বানিয়েছিলেন ৯৫০ সালের দিকে। ওরা রাজত্ব করেছিল দশম শতক থেকে চতুর্দশ শতক পর্যন্ত। মহারাজা রাও বিদ্যাধরের সময় শুরু হয়েছিল খাজুরাহোর মন্দির নির্মাণ। খাজুরাহোর জঙ্গলে ৮৫টি মন্দির ছিল। এখন আছে সাকুল্যে ২৫টি। বাকিগুলো ধ্বংস করেছে শত্রুসৈন্য। গজনির সুলতান মাহমুদ ছিলেন ধ্বংসকারীদের একজন। সেই প্রাচীনকালে যৌনতার যে চর্চা ছিল ভারতবর্ষে, তার কিছু নিদর্শন দেখতে পাই মন্দিরগুলোর গায়ে। আমি তো মুগ্ধ দেখে নারীপুরুষের কামশিল্প। কোনও সংকোচ নেই কারওর। নারীও পুরুষের মতো যৌনশিল্পে দক্ষ। কবে যে রক্ষণশীলতা গ্রাস করে ফেলেছে পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ, জানি না। সম্ভবত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা তাদের ভিক্টোরিয়ান রক্ষণশীলতা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে দেওয়ার পর। মানুষের মগজধোলাই তো অনেকটাই হয়েছে। তা না হলে যৌনতার যে চিত্র আমরা ধর্মের মন্দিরে দেখি, সেই যৌনতা এত শীঘ্র এই অঞ্চলে ট্যাবু হয়ে যায় কী করে?! আজকাল তো হিন্দু আর মুসলিম— দুই ধর্মীয় মৌলবাদীই নারী স্বাধীনতাবিরোধী, খাজুরাহো মন্দিরের যৌনশিল্পের ঘোরবিরোধী তারা।কামসূত্রের অনেক আসনই দেখি মন্দিরের গায়ে। কামসূত্র ভারতবর্ষে লেখা হলেও জনপ্রিয় ভারতবর্ষের বাইরে, বিশেষ করে ইউরোপে। ভারতবর্ষের মানুষ কামসূত্রের চর্চা করে না বললেই চলে। যৌনতা, এখনকার সাধারণ হিন্দুরাও মনে করে, পাপ। গান্ধীও তো বলেছিলেন সন্তান উৎপাদনের উদ্দেশ্য ছাড়া সুখভোগের উদ্দেশে যে সেক্স করে, সে পাপ করে।মন্দিরে নারী পুরুষের যৌনশিল্প আমাকে মুগ্ধ করলেও, পশুর সঙ্গে পুরুষের সঙ্গম আমাকে ভীষণ অস্বস্তি দিয়েছে। পশু-ধর্ষণ তাহলে প্রাচীনকাল থেকেই ছিল ! পশুরা নিশ্চয়ই মানুষের সঙ্গে সঙ্গম করতে চায় না, মানুষকে সঙ্গমের অনুমতি নিশ্চয়ই দেয় না তারা। তাহলে এই সঙ্গম সঙ্গম নয়, এ নিতান্তই ধর্ষণ। সেই প্রাচীনকাল থেকে পশুপাখিদের নির্যাতন করে আসছে মানুষ। তাদের হত্যা করেছে, বন্দি করেছে, যন্ত্রণা দিয়েছে। পশুপাখিরাও পুরুষের যৌন-নির্যাতনের শিকার।এখনও সব বয়সের নারী তা আছেই, দুধের শিশুরা, এমনকী পশুও পুরুষের যৌন নির্যাতন থেকে রেহাই পায় না। পুরুষ যে কবে মানুষ হবে ! জানি সব পুরুষই মন্দ নয়, সব পুরুষই ধর্ষক নয়, কিন্তু ভালো পুরুষের ওপর তো দায়িত্ব বর্তায় পুরুষ জাতটাকে মানুষ করার। ধর্ষণের বিরুদ্ধে, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে, পশু নির্যাতনের বিরুদ্ধে ভালো পুরুষরা কেন সংগঠিত হচ্ছে না। তারা কিভাবে আন্দোলন করার দায়িত্ব শুধু ভিকটিমদের, তাদের নয়? সমাজটাকে কলুষমুক্ত করার, বৈষম্যমুক্ত করার, শুদ্ধ করার দায়িত্ব শুধু নারীদের, পুরুষদের নয়?

 

গজনির সুলতান মাহমুদ : এটা সত্যি যে আমার বাবা ক্রিতদাস ছিলেন বলে আমি ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতুম আর দুর্বলদের ওপর অত্যাচার করে নিজেকে সবার চেয়ে সুপিরিয়র মনে করতুম । গজনি আসলে বেশ গরিবদের রাজ্য ছিল । আমি নানা রাজ্য আক্রমণ করে সোনাদানা মণিমুক্ত আনতুম । যাদের যুদ্ধে হারিয়ে দিতুম তাদের রাজ্য থেকে অনেককে এনে দাস হিসেবে খাটাতুম । যেসব মেয়েদের তুলে আনতুম তাদের বিলিয়ে দিতুম আমার দরবারীদের মধ্যে ।  ৯৯৭ থেকে ১০৩০ সালে আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমি পূর্ব ইরানিয় এলাকা আর ভারত উপমহাদেশের উত্তর পশ্চিম অংশ , বর্তমান আফগানিস্তান ও পাকিস্তান, জয় করি।  সাবেক প্রাদেশিক রাজধানী গজনিকে এক বৃহৎ সাম্রাজ্যের সমৃদ্ধশালী রাজধানীতে পরিণত করেছিলুম। আমার সাম্রাজ্য বর্তমান আফগানিস্তান, পূর্ব ইরান ও পাকিস্তানের অধিকাংশ এলাকা জুড়ে ছিল। আমি সুলতান  উপাধিধারী প্রথম শাসক যে আব্বাসীয় খিলাফতের আনুগত্য স্বীকার করে নিজের শাসন চালু রেখেছিলুম। ১০২২ সালে আমি খাজুরাহো ধ্বংস করেছিলুম, কিন্তু সোনাদানা কিছুই পাইনি । 

 

তাপ্তী গুহঠাকুরতা : এটি সর্বজনবিদিত যে, ১১৯২ এর  দুই শতাব্দীর আগে, যখন আদিবাসী ইন্দো-মুসলিম রাষ্ট্র এবং জনগোষ্ঠী উত্তর ভারতে প্রথম আবির্ভূত হয়েছিল, ইরানি আর তুর্কিরা পরিকল্পিতভাবে দক্ষিণ এশিয়ার প্রধান নগর কেন্দ্রগুলিতে অভিযান চালিয়ে এবং লুটপাট করে, মন্দিরগুলো ভেঙে ফ্যালে  এবং প্রচুর সোনা মণিমুক্ত দাস-দাসী ও তরুণীদের পূর্ব আফগানিস্তানে নিজেদের ঘাঁটিতে নিয়ে যায়। রীতিটি শুরু হয়েছিল ৯৮৬ সালে, যখন গজনভির সুলতান সবুকতিগিন ( ৯৭৭-৯৯৭এর রাজত্বকালে) হিন্দু  রাজাদের আক্রমণ করে হারিয়েছিল ।তারা কাবুলের উত্তর-পশ্চিম পাঞ্জাবের মধ্যবর্তী অঞ্চলটি নিয়ন্ত্রণ করতো । সুলতানের ছেলের একান্ত সচিব আবু নসর `উতবির মতে, সাবুক তিগিন লামঘান (কাবুলের তাৎক্ষণিক পূর্বে অবস্থিত) অভিমুখে যাত্রা করেছিল, এটি একটি বিশাল শক্তি ছিল সেই সময়ে আর সমৃদ্ধ শহর হিসাবে চিহ্নিত ছিল । সাবুকতিগিন এটি আক্রমণ করেছিল আর কাফেরদের বসবাসের আশেপাশের জায়গাগুলোতে আগুন ধরিয়ে দেয় । তারপর মূর্তি-মন্দির ভেঙে সাবুকতিগিন সেখানে ইসলামধর্ম প্রতিষ্ঠা করেছিল ।

 

ব্রিটিশ ইন্ডোলজিস্ট ভি. এ. স্মিথ :  চান্দেরালরা ভর বা গোন্ডের কোন এক উপজাতি ছিল । আর সি সি মজুমদার সহ আরও কয়েকজন পণ্ডিত এই তত্ত্বকে সমর্থন করেছিলেন। চান্দেলারা মানিয়া নামে একটি উপজাতির দেবী উপাসনা করতেন, যার মন্দিরগুলি মহোবা এবং মানিয়াগড়ে রয়েছে ।   গোন্ডের সাথে সম্পর্কিত  জায়গা গুলোর সাথে তাদের সম্পর্ক রয়েছে। এছাড়াও, রানী দুর্গাবতী, যার পরিবার দাবি করেছিল যে চান্দেলা বংশোদ্ভূত গারহ-মন্ডলার একজন গন্ড প্রধানকে বিয়ে করেছিলেন। ঐতিহাসিক আর. কে. দীক্ষিত এই যুক্তিগুলি বিশ্বাসযোগ্য মনে করেন না । তিনি যুক্তি দিয়েছিলেন যে মানিয়া কোনও উপজাতি দেবতা ছিলেন না। এছাড়াও, গোন্ড অঞ্চলের সাথে রাজবংশের যোগসূত্রটি  কোনও সাধারণ বংশোদ্ভূত হওয়ার ইঙ্গিত দেয় না । রাজবংশের পূর্বসূরিদের এই অঞ্চলগুলিতে শাসক পদে পোস্ট করা হতে পারে।  গোন্ড প্রধানের সাথে দুর্গাবতীর বিবাহকে এক-কথায় খারিজ করা যেতে পারে।  চান্দেলারা মূলত গুজর-প্রতিহারের প্রতিনিধি ছিল। নান্নুকা  রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। খাজুরাহোকে কেন্দ্র করে একটি ছোট রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। 


চন্দ্রবর্মণ : সুলতানটা মূর্খ ছিল । ব্যাটা জানতো না শিল্প কাকে বলে । নিজের হারেমে হাজার খানেক বউ-বাঁদি-রাখেল নিয়ে রেলা করেছে সারাজীবন, আর মূর্তিগুলো দেখে ওর গায়ে জ্বর এলো, মাথা গণ্ডোগোল হয়ে গেল । মন্দিরগুলো গড়তে কতো শিল্পীকে দিনের পর দিন কাজ করতে হয়েছে, কতো শ্রমিককে সকাল-সন্ধ্যা পাথর বয়ে আনতে হয়েছে, তা খেয়াল করলো না । একশো বছর লেগেছিল, আর সুলতান ব্যাটা যখন দেখলো এখানে সোনাদানা নেই তখন তিন দিনে যতোটা পারলো মাটিতে মিশিয়ে কেটে পড়ল । যত্তোসব বহিরাগত ইডিয়ট ।

 

সিকন্দর লোদি : আসলে আমার মা ছিলেন হিন্দু স্যাকরার মেয়ে । সুন্নি আলেমরা আমাকে খুব হ্যাটা করতো । লুকিয়ে হাসাহাসি করে বলতো কাফারের বাচ্চা কোথাকার । আমি যখন খবর পেলুম যে খাজুরাহোতে অনেক মন্দির আছে তখন ভাঙচুর করতে বাধ্য হলুম । তাছাড়া আমি আব্বাসীয় খিলাফতকে মানতুম, কেননা নবী মুহাম্মদ এর চাচা আব্বাস ইবনে আবদুল মুত্তালিবের বংশধরদের  ৭৫০ খ্রিস্টাব্দে কুফায় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদে রাজধানী নিয়ে যান। আসল ভাঙাভাঙি করেছিল  গজনির সুলতান মাহমুদ । ও ভেবেছিল সোমনাথ মন্দিরের মতন এখানকার মন্দিরেও সোনাদানা মণিমুক্ত পাবে । সেসব না পেয়ে ক্ষেপে গিয়ে আরও ভাঙাভাঙি করেছে । কিন্তু আমাকে পদে-পদে প্রমাণ করতে হয়েছে আমি খাঁটি মুসলমান। তাই আমি সালার মাসুদের বার্ষিক শোভাযাত্রা নিষিদ্ধ করেছিলুম আর হুকুম দিয়েছিলুম যে মেয়েরা কোনও সন্তের মাজারে যেতে পারবে না । মরবার দিন পর্যন্ত ভুলিনি যে আমার গায়ে মূর্তিপুজক কাফেরের রক্ত ।


হজরত ইবলিশ : এখন বুঝলি ? আমি তোদের সবায়ের ঘাড়ে চেপে আল-হিন্দে টেনে এনেছিলুম ।


জয়শক্তি : আমি বাবা বাকপাতির উত্তরসূরি । আমি জেজা বা জেজক নামেও পরিচিত। মহোবায় প্রাপ্ত একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে চান্দেলা অঞ্চলটিকে (পরে বুন্দেলখণ্ড বলা হয়) আমার নামানুসারে "জেজকভূক্তি" রাখা হয়েছিল। চান্দেলার নথিগুলোতে আমার আর বিজয়শক্তি সম্পর্কে বেশিরভাগ তথ্য প্রকৃতির গৌরবময়, এবং অল্প ঐতিহাসিক গুরুত্বের, তার কারণ আমাদের রাজত্বে স্হপতি ও ভাস্কর অনেক ছিল কিন্তু লেখক বেশি ছিল না।  এই নথিগুলোতে উল্লেখ করা হয়েছে যে আমরা আমাদের শত্রুদের ধ্বংস করেছিলুম, কিন্তু পরাজিত কোনও শাসকের নাম লেখকরা উল্লেখ করেনি ।কালাচূড়ির রাজা কোক্কাল  চান্ডেলার রাজকন্যা নাভ-দেবীকে বিয়ে করেছিলাম। বিষয়টা অবশ্য তর্কসাপেক্ষ । ঐতিহাসিক আর সি সি মজুমদারের মতে এই রাজকন্যা জয়শক্তির কন্যা হতে পারেন। আবার ঐতিহাসিক আর. কে. দীক্ষিত বিশ্বাস করেন যে মেয়েটি সম্ভবত রাহিলার মেয়ে বা বোন ছিলেন।ওনারা মনে করেন আমি  সম্ভবত উত্তরাধিকারী না রেখে মারা গিয়েছিলুম, যার কারণে আমার ছোট ভাই আমার সিংহাসনে বসেছিল ।



আবু রিহান-আল-বিরুনি : গজনির সুলতান মাহমুদের সঙ্গে আমি ছিলুম যখন ও খাজুরাহোর মন্দিরগুলো ভাঙছিল। ও বেটা ভেবেছিল এই মূর্তিগুলোর ভেতরে সোমনাথ মন্দিরের মতন অঢেল মণিমুক্ত সোনাদানা আছে। সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে মাহমুদ একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা। পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে মাহমুদের ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়। মাহমুদ বুঝতে পেরেছিল, হাজার হাজার হিন্দু সোমনাথে পুজো দেবার সময় বিপুল পরিমাণ অর্থ সম্পদ দক্ষিণা হিসেবে মন্দিরে দিতো। ফলে সোমনাথ মন্দির ছিল  ধন-সম্পদ, সোনা, রত্নের বিশাল ভাণ্ডার। মাহমুদের সতেরোতম আক্রমণ ছিল সোমনাথ মন্দিরে লুট করার উদ্দেশ্যে। রাজপুত সৈন্যবাহিনী সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করলেও সোমনাথ মন্দিরের শেষ রক্ষা করতে পারেনি। তিনদিন যুদ্ধের পর মাহমুদের বাহিনী মন্দিরে ঢুকে পড়ে, মন্দিরের সব মূর্তি এবং শিবলিঙ্গ ভেঙে ফেলে, সোনার মূর্তি, মূল্যবান পাথর, নগদ অর্থ, অলংকার যা ছিল সব নির্বিচারে লুট করে নিয়ে যায়, মূর্তি যেহেতু ইসলামে নিষিদ্ধ তাই মাহমুদ সোনার মূর্তি গলিয়ে  ২ কোটি দিনার মুদ্রায় পরিণত করে। মাহমুদ সোমনাথ মন্দির লুটের সময় ৫০০০ রাজপুত সৈন্যকে মন্দিরের মধ্যেই ধড় থেকে মাথা আলাদা করে দিয়েছিল ।


হজরত ইবলিশ : আরে গজনির মাহমুদটা তো জাহিল । পাকিস্তানের আরেক নাম জাহিলিয়া, জানিস না ?


দিল্লীর গার্গী কলেজের ইতিহাসের অধ্যাপক মীনাক্ষী জৈন :  মাহমুদ সোমনাথ মন্দির এতটাই ধ্বংস করে দিয়েছিল যে ১০২৫ থেকে ১০৩৮ সাল পর্যন্ত সেখানে কোনও তীর্থযাত্রী যেতে পারেনি। তুর্কি-ইরানি সাহিত্যে মাহমুদের সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের ইতিহাসকে মহিমান্বিত করে উপস্থাপিত হয়। মাহমুদের আক্রমণে সোমনাথ মন্দিরের নগরী সৌরাষ্ট্রে ৫০,০০০ মানুষের মৃতদেহের যে স্তূপ জমে উঠে তা সৎকার করার মত অবশিষ্ট লোক পর্যন্ত ছিল না।


হজরত ইবলিশ : ওর ঘাড়ে তো আমিই চেপে ছিলুম । এখন ব্যাটা জাহান্নমে গরম তেলেতে টগবগ করে ফুটছে।


ইবন বাতুতা : কুতুবুদ্দিন আইবকও সুলতান মাহমুদের দেখাদেখি গিয়েছিল খাজুরাহোতে । ও বেটা মূর্তিগুলো ভেঙেছিল কেননা ওগুলো ওর যৌনতাকে চাগিয়ে তুলছিল অথচ মাঠের মধ্যে মেয়েদের ধরে-ধরে ধর্ষণ করতে পারছিল না ; সে কাজগুলো করছিল ওর সেনারা, ঘোড়ায় তুলে নিয়ে খোলা মাঠেই ধর্ষণ করছিল । কুতুব উদ্দিনের মূল কৃতিত্ব আসলে রাজ্য বিস্তারের থেকেও ইসলামের প্রচার আর প্রসার ।  কুতুবউদ্দিন আইবেক কমপক্ষে এক হাজার মন্দির ধ্বংস করে সেই ভিত্তির উপরেই নতুন করে মসজিদ নির্মাণ করেছিল। হিন্দুদের উপর ন্যক্কারজনক হত্যা, নিপীড়ন, তাদের মন্দির দখলের প্রক্রিয়া চলতেই থাকল শাসক শ্রেণীর প্রত্যক্ষ মদতে আর ছত্রছায়ায়। দিল্লীর জামে মসজিদের পূর্বদিকের প্রবেশপথে কোরআনের আয়াত লেখা সোনার পাতগুলো বানানো হয়েছে বিভিন্ন মন্দির থেকে লুট করা সাতাশটা সোনার প্রতিমা গলিয়ে। 


হজরত ইবলিশ : তাহলেই বোঝো কেমন প্রজাবৎসল শাসক ছিল ।


কিশোরী শরণ লাল : কুতুবউদ্দিন আইবেকের মন্দির এবং প্রতিমা ভাঙার খ্যাতি অতীতের সবাইকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল, তার সমসাময়িক বা পরেও মন্দির বা প্রতিমা ভাঙার ক্ষেত্রে তার ধারে কাছে কেউ নেই।তাদের ওসকাতে ইরান, আফগানিস্তান থেকে দলে আসতে লাগল সুফি দরবেশ, ইসলামী পণ্ডিত। রাষ্ট্রীয় প্রচেষ্টায় এবং পৃষ্ঠপোষকতায় স্থানীয় হিন্দুদের ইসলামের দাওয়াত দেয়া চলতে লাগল সমানতালে। পরিস্থিতি কেমন ছিল, একটা উদাহরণ দিলে হয়ত একটু বোধগম্য হবে, কুতুবউদ্দিন আইবক যখন কৈল/কালিঞ্জার, এখনকার আলীগড়ে পৌঁছায়, তখন যেসব সৈন্য বুদ্ধিমান এবং ভবিষ্যৎ বুঝতে পেরেছিল, তারা দলে দলে ইসলাম কবুল করতে শুরু করে। আর যারা নিজেদের আবহমান কাল ধরে পিতৃপুরুষের প্রচলিত ধর্ম ত্যাগ করে ইসলামের ছায়া তলে আসেনি তারা চিরতরে তলোয়ারের ছায়াতলে চলে যায়। আলীগড়ে মুসলমানের আধিক্য এই কারণেই আর ওরা সেই জন্যই আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে পেরেছিল ।


কুতুবউদ্দিন আইবক : আমার পূর্বপুরুষেরা ছিল তুর্কি হাবশি  । আমার একটা আঙুল কাটা  । শৈশবে হাবশি  দাস  হিসেবে বিক্রি করা হলে আমাকে কেনে  ইরানের খোরাসান অঞ্চলের  নিসাপুরের প্রধান কাজী  । কাজী  আমাকে পড়াশোনার সুযোগ দিয়েছিল, আর ফার্সি এবং আরবি ভাষায় দক্ষ করে তোলে। সেই সঙ্গে আমাকে তীর চালানো আর ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছিল ।কাজি মারা যাবার পরে ওনার ছেলে আমাকে আবারও এক দাস বণিকের কাছে বিক্রি করে দেয়। আমাকে এবার কিনে নেয় গজনির গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ ঘুরি।  মুহাম্মদ ঘুরি আমাকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দেয় আর নিজের সহচর হিসেবে নিয়োগ করে। আমিও ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতুম, আমার কাটা আঙুল, কেনা গোলাম আর গায়ের রঙ কালো বলে ।  হাসান নিজামী ঠিকই বলেছে যে আমার নির্দেশে হিন্দু মন্দির ভেঙে মসজিদ তৈরি করা হত, যেমন স্থাপত্যিক ধ্বংসাবশেষ দিয়ে দিল্লির কুতুব মিনার কমপ্লেক্স এবং আজমিরের আধাই দীন কা ঝোপড়া তৈরি করা হয়েছে । আমি বেশিদিন রাজত্ব করিনি ;   সুলতান হিসেবে ১২০৬ থেকে ১২১০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত ,মাত্র চার বছর  সুলতানগিরি করেছিলুম ।ওইটুকু সময়েই খাজুরাহোর অনেকগুলো মন্দির ভেঙে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলুম । কুতুব মিনার তৈরি করতে অনঙ্গপাল তোমারের দুর্গ ভেঙে তার মালমশলা ব্যবহার করেছিলুম । অনঙ্গপালের লোহার মিনার কুতুবমিনারের পাশেই আছে । দেখেছেন নিশ্চয়ই ?


হজরত ইবলিশ : কুতুবউদ্দিন আইবক শাসক না হলে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় সম্ভব হতো না ; ওখানে অতো ছাত্র-ছাত্রীর জমায়েত তো কাফেরদের ধর্ম পালটানোর কারণে ।


তসলিমা নাসরিন : খাজুরাহোর পুলিশদের একজনের নাম বিধু বিশ্বাস। আমার সঙ্গে বাংলায় কথা বলেছেন। পূর্ববঙ্গে ছিল তাঁর পূর্বপুরুষের বাড়ি, ১৯৬৫ সালে বাবা মা চলে আসেন ভারতের মধ্যপ্রদেশে, এখানেই বাবার চাকরি হয়ে যায়, এখানেই স্থায়ীভাবে থেকে যান। বিধু বিশ্বাস কোনও দিন পূর্ববঙ্গে যাননি, ঢাকায় তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটেমাটিও দেখেননি। নচিকেতার গান শুনেছেন ? জিজ্ঞেস করে টের পেলাম নচিকেতার নামই শোনেননি কখনও। বাংলাটা বলতে শিখেছেন বাড়িতে বাবা মা বাংলা বলতেন বলে, আর প্রতিবেশীদের অনেকে ছিলেন বরিশাল থেকে আসা, তাদের কাছ থেকেও শিখেছেন বাংলা। বাংলা পড়তে পারেন কি না জিজ্ঞেস করলে আমার আশঙ্কা হয় বিধু বিশ্বাস বলবেন যে তিনি বাংলা পড়তে পারেন না। এই উত্তরটি শুনতে ভালো লাগবে না বলেই জিজ্ঞেস করিনি। তাঁর বাবা নাকি একবার বলেছিলেন, ‘দেশের গাছ থেকে আম খেতাম, এত বড় বড় কাঁঠাল হতো কাঁঠাল খেতাম, পেয়ারা খেতাম, লিচু খেতাম, পুকুরের মাছ খেতাম, আহা কী সুখেই না ছিলাম! এ কোন দেশে এলাম, এখানে তো মাটি নেই, চারদিক শুকনো, কিছুই ফলে না, চারদিকে শুধু পাথর, শুধু পাথর।’ বিধু বিশ্বাস আমার মনে হয় তাঁর বাবার কথাগুলো শুধু শুনে গেছেন, অনুভব করতে পারেননি। তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা, সব মধ্যপ্রদেশে। মধ্যপ্রদেশের বাইরেও কোথাও যাননি। জানেন না বাংলা ঠিক কাকে বলে, কেমন দেশকে বাংলাদেশ বলে। তাঁকে বলি একবার ঢাকা ঘুরে আসতে। একবার দেখে আসতে তাঁর বাপ-দাদার ভিটেমাটি, দেখে আসতে গাছগাছালি, পুকুর নদী। মনে আছে নচিকেতা কেমন কেঁদেছিলেন পূর্বপুরুষের মাটিতে গিয়ে ! জানি না বিধু বিশ্বাস সেভাবে কাঁদবেন কি না। ধর্মের কারণে মানুষের উদ্বাস্তু হওয়াটা আমাকে কাঁদায়। ‘ফেরা’ নামে একটি উপন্যাস লিখেছিলাম অনেক আগে, ওই উপন্যাসে লিখেছিলাম নিজের দেশের মাটি ত্যাগ করার কষ্টের কথা। আমার নিজের কিন্তু তখনও নির্বাসন দণ্ড হয়নি। তার আগেই মানুষের নির্বাসনের কষ্টটা কী করে অনুভব করেছিলাম জানি না। ধর্মের কারণে মানুষ নিষ্ঠুর হয়েছে, স্বার্থান্ধ হয়েছে। নিষ্ঠুরতা আর স্বার্থান্ধতার কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষ দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বিধু বিশ্বাসের বাবার মতো কত মানুষ যে উদ্বাস্তু হয়েছে, নিজের ভাষা আর সংস্কৃতি থেকে দূরে সরতে বাধ্য হয়েছে! বিধু বিশ্বাসের ছেলে মেয়েরা কি নিজেদের বাঙালি বলে? হয়তো বলে না। কিন্তু বিধু বিশ্বাস ইচ্ছে করলে যেতে পারেন বাংলাদেশে, ঘুরে বেড়াতে পারেন ও দেশে। আমি পারি না। আমারই অনুমতি নেই বাংলাদেশে ফেরার। মাঝে মাঝে ভাবি ওরা অমুসলিম হয়ে যত অপরাধ করেছে, আমি অধার্মিক হয়ে তার চেয়েও বেশি অপরাধ করেছি। আসলেই কি আমরা অপরাধ করেছি? নাকি তারাই অপরাধী যারা আমাদের আদর্শ বা বিশ্বাসের কারণে আমাদের অত্যাচার করে, আমাদের ধর্ষণ করে, হত্যা করে, আমাদের জেলে পোরে, নির্বাসনে পাঠায়?


রাহিলা :  আমি  বিজয়শক্তির ছেলে । আমার রাজত্বকাল ৮৮৫ সাল থেকে ৯০৫ সাল ।অন্যান্য প্রারম্ভিক চান্দেলা শাসকদের মতো আমিও প্রতিহারের অধস্তন ছিলুম।আমি বহু সামরিক অভিযান চালিয়েছিলুম যার কথা পাওয়া যাবে আমার বংশধরদের লেখা  দুটো খাজুরাহো শিলালিপিতে  । শিলালিপিতে যোদ্ধা হিসাবে আমার প্রশংসা করা হয়েছে ।  ‘পরমালা রাসো’ কিংবদন্তিতে, আমার সামরিক অভিযানের  বিবরণ আছে । প্রজাদের জন্য আমি  বেশ কয়েকটা কাজ করেছিলুম ।  অজয়গড় মন্দিরের শিলালিপিতে আমার নাম আছে । মহোবার রহিল্য সাগর হ্রদ, যার তীরে একটা মন্দির আছে, তা আমার নামে । ‘পরমালা রাসো’ অনুযায়ী  রাজাবাসিনী জনপদটা প্রতিষ্ঠা করেছিলুম, যা বাদৌসার কাছে এখন রসিন গ্রাম । এই গ্রামে চান্দেলা ধাঁচের মন্দির আছে। 


যশোবর্মণ : কোনও ব্যাটা নেড়ে রাজা-সুলতান মন্দিরগুলোর পেছনে যে কাহিনি আছে তা জানার চেষ্টা করেনি। গল্পটা এই রকম । বারানসীতে হেতম্বী নামে পরমা সুন্দরী এক ব্রাহ্মণ কন্যা ছিলেন। অল্প বয়সেই তিনি বিধবা হন। একবার গ্রীষ্মের এক জ্যোৎস্না আলোকিত রাতে তিনি যখন ঝিলের জলে স্নান করছিলেন, তখন স্নানরতা অবস্থায় তাঁকে দেখে চন্দ্রদেব মুগ্ধ হন ও তাঁকে কামনা করেন। চন্দ্র মানুষের রূপ ধারণ করে পৃথিবীতে আসেন এবং হেতম্বী ও চন্দ্রদেব মিলিত হন। শারীরিক মিলনের ফলে হেতম্বী গর্ভবতী হয়ে পড়েন ও নিজের ভুল বুঝতে পেরে চিন্তিত হয়ে পড়েন। চন্দ্রদেব তখন ভবিষ্যৎবাণী করেন যে হেতম্বীর গর্ভে যে সন্তান আছে, সে হবে বিপুল ক্ষমতার অধিকারী ও খাজুরাহোর প্রথম রাজা। হেতম্বী বারানসী ত্যাগ করে দূরে খেজুরবনে গিয়ে সন্তানের জন্ম দেন। সন্তানের জন্মের পর হেতম্বী তাঁর নাম রাখেন চন্দ্রবর্মণ। পিতার মতোই সে সাহসী ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। চন্দ্রের আদেশে চন্দ্রবর্মণ ওই এলাকায় মন্দির নির্মাণ করেন ও মন্দিরগাত্রে চন্দ্রপ্রভাবিত মূর্তি খোদাই করেন।  হেতম্বী আর চন্দ্রদেবের কাম ও প্রেমের নিদর্শন হিসেবেই খাজুরাহো মন্দির তৈরি করিয়েছিলুম । বেশিরভাগটাই দেবদেবীদের মিলন মুহূর্তের ছবি। নগ্ন শরীর, আর যৌনতা–--প্রাচীন বা ভারতীয় ঐতিহ্যে বিভিন্ন সংস্কৃত কাব্যে দেখি যে এই সমস্তর অনুপুঙ্খ বিবরণ। অর্থাৎ প্রাচীনকালে ভারতীয় সংস্কৃতিতে মিলনের বর্ণনাকে অশ্লীল বলে চিহ্নিত করা হয়নি । তাই মন্দির জুড়ে শুধু যৌনতা আর কামের ছবি। চন্দ্রের ভবিষ্যৎবাণী ছিল এই মন্দির  হেতম্বীকে তার পাপ থেকে মুক্তি দেবে। যাঁরা খাজুরাহো দেখতে আসেন তাঁরা নিজস্বপাপ মুক্তির জন্য আসেন ।

 

চন্দ্রবর্মণ : চন্দ্র দেবতা এবং এক রূপসী ব্রাহ্মণকন্যা হেমবতীর মিলনে এক পুত্র জন্মায়৷ নাম দেওয়া হয় চন্দ্রবর্মন৷ আমি সেই চন্দ্রবর্মন, যার হাতে চান্দেলা রাজবংশের জন্ম৷ খাজুরাহো ছিল চান্দেলা রাজপুত রাজাদের রাজধানী৷ চন্দ্রবর্মনের হাতে শুরু হয়ে ৯৫০ সাল থেকে ১০৫০ সাল পর্যন্ত একশো বছর ধরে বংশের নানা রাজার সময়ে বেলেপাথরের পঁচাশিটা মন্দির গড়ে ওঠে খাজুরাহোয়৷ তৈরি হয়েছে সৃষ্টিরক্ষার দেবতা বিষ্ণু ও সৃষ্টি-ধ্বংসের দেবতা শিবের এইসব মন্দির৷ অবস্থান হিসাবে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে খাজুরাহোর মন্দিররাজি : পশ্চিম, পূর্ব ও দক্ষিণ । এক,  অনবদ্য লক্ষ্মণ-- পশ্চিমের মন্দির, বারোটা মন্দির নিয়ে৷ মিথুন মূর্তির আধিক্য ঘটেছে লক্ষ্মণ মন্দিরের নিম্নভাগে৷ দুই, যুদ্ধ জয়ের স্মারক--- রয়েছে একত্রিশ মিটার উঁচু শিখরওয়ালা কাণ্ডারীয় মহাদেব মন্দির৷ খাজুরাহোর বৃহত্তম আর উচ্চতমও বটে ।  গজনির মাহমুদের সাথে যুদ্ধজয়ের স্মারক রূপে ১০৩০-এ মহারাজা বিদ্যাধরের তৈরি কান্ডারীয় মন্দির৷ তিন, পান্নার শিব- জগদম্বা থেকে সামান্য উত্তরে পুবমুখী চিত্রগুপ্ত অর্থাৎ সূর্য মন্দির৷ অর্ধমণ্ডপ, মহামণ্ডপ, অন্তরাল ও সভাগৃহ–চার স্তরে তৈরি মন্দিরের ভাস্কর্য  ৷ সিলিং-এর অলঙ্করণে অভিনবত্ব আছে৷চার, দুলাদেও--- দুলাদেও অর্থাৎ নববধূ৷ দুলাদেও আর চতুর্ভুজ এই দুই মন্দির নিয়ে দক্ষিণমন্দির গোষ্ঠী৷ মূল চবুতরা থেকে দেড় কিলো মিটার দক্ষিণে দুলাদেও মন্দির৷


হজরত আদম : খাজুরাহোর মন্দিরগুলোর আনাচে কানাচে রয়েছে নানা ঐতিহাসিক কাহিনী। একটা গল্প পাপমোচনের আবার একটা  অভিশাপের। হেতম্বী চন্দ্রদেবের সঙ্গে মিলনের পাপবোধে ভুগছিলেন। তাকে সেই পাপবোধ থেকে মুক্তি দিতেই তার সন্তান চন্দ্রবর্মন রতিক্রিয়ায় রত এই পঁচাশিটা মূর্তি নির্মাণ করান। সব মূর্তিতেই  দেব-দেবীদের দেখানো হয়েছে।  আরেকটি কাহিনী রয়েছে অভিশাপের। খাজুরাহো গ্রামে এক সাধু আসেন। তিনি তার শিষ্যদের সেখানে রেখেই যান কোথাও। সেই সময়েই তার শিষ্যরা এক রোগে আক্রান্ত হয়েছিল। তবে গ্রামের কেউই তাদের সাহায্য করেনি ভেষজ বা জল দিয়ে। সাধু ফিরে এসে সেইসব কথা জানতে পেরে রেগে গিয়ে গ্রামবাসীদের অভিশাপ দিয়েছিলেন যে পাষাণের মতো কঠোর বাসিন্দারাও পাথর হয়ে যাবে। সেই থেকেই গ্রামবাসীরা নাকি পাষাণে পরিণত হয়েছে কামরত অবস্থায়। আবার অন্যদিকে এক মহিলা তাদের শুধুমাত্র অল্প সাহায্য দিতে এগিয়ে এসেছিলেন। তার ভূমিকায় মুগ্ধ হয়ে সাধু তাকে বলেছিলেন পিছনে না তাকিয়ে গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। তবে কৌতূহলী মেয়েটি তার বিপরীত কাজটি করেছিল। কিছুদূর গিয়েও সাধুর আদেশ অমান্য করে পিছনে ফিরতেই সেও পাথর হয়ে যায়। সেই থেকেই এই মন্দিরে সন্ধের পর আর কেউ যায় না, পাথর হয়ে যাওয়ার ভয়ে।


যশোবর্মণ : খাজুরাহো (খর্জুরবাহক) স্মারকগুলো রাজপুত বংশোদ্ভুত চান্দেল রাজবংশের অধীনে ৯৫০ ও ১০৫০ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে নির্মিত।   এই সময়টা ছিল আমাদের রাজবংশের শাসনের স্বর্ণযুগ। বর্তমানে এই স্মারকসমূহের যেগুলো অক্ষত অবস্থায় আছে সেগুলো যৌথভাবে হিন্দু ধর্ম এবং জৈন ধর্ম-এর স্থাপত্য। এগুলোতে  নানান স্থাপত্যশৈলীর বিস্ময়কর মিশ্রণ দেখা যায়। এই স্থাপত্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন কন্দারিয়া মন্দির। ছয় বর্গকিলোমিটার আয়তনবিশিষ্ট মন্দিরপ্রাঙ্গণে নির্মিত পঁচাশিটা মন্দিরের মধ্যে মাত্র বাইশটা মন্দির এখনো টিকে আছে ; বাকিগুলো ভেঙে দিয়ে গেছে বহিরাগত ম্লেচ্ছ শাসকরা। মধ্যপ্রদেশে অবস্থিত এই অঞ্চলটি ১৯৮২ সালের ১৫ অক্টোবর ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় । দ্বাদশ শতাব্দীর ম্লেচ্ছ-আক্রমণের আগে চন্দেলা সংস্কৃতির অনন্য এবং মৌলিক শিল্পকৌশলের নিদর্শন ও প্রমাণ এবং একটি সাংস্কৃতিক সম্পত্তি হিসাবে মন্দিরগুলো পৃথিবীর বিস্ময় ।


ঐতিহাসিক লীলা গান্ধি : অঞ্চলটা ঐতিহাসিকভাবে অনেক রাজ্য এবং সাম্রাজ্যের অংশ ছিল। খাজুরাহোর এই অঞ্চলে সর্বাধিক পরিচিত শক্তি ছিল ভটসা। এই অঞ্চলে তাদের উত্তরসূরিদের মধ্যে মৌর্য, সুঙ্গাস, কুশান, পদ্মাবতীর নাগ, ভাকাতক রাজবংশ, গুপ্ত, পুষ্যভূতি রাজবংশ এবং গুজরা-প্রথর রাজবংশ অন্তর্ভুক্ত ছিল। গুপ্ত আমলে বিশেষত এই অঞ্চলে স্হাপত্য এবং শিল্পের বিকাশ ঘটেছিল, আর তাদের উত্তরসূরীরা শৈল্পিক ঐতিহ্য অব্যাহত রেখেছিল।  চান্দেলারা এই অঞ্চলটি নবম শতাব্দী থেকে শাসন করেছিলেন যদিও তারা গুজারা-প্রথারাসের অধীন ছিল। ধঙ্গদেবের রাজত্বকালে চান্দেলা স্বাধীন হয়েছিল এবং এই সময়ে অনেকগুলি গুরুত্বপূর্ণ মন্দির নির্মিত হয়েছিল। ১১৮২ সালে শাকম্ভরীর চাহামানাসের পরে কুতুব উদ্দিন আইবক  ১১০২ সালে চান্দেলাদের মারাত্মক আক্রমণ করে। চান্দলারা মহোবা, কালিনজর এবং অজয়গড়ের দুর্গে চলে যাওয়ার ফলে খাজুরাহো একটি ছোট্ট গ্রামে পরিণত হয়। ইবনে বতুতা খাজুরাহো ঘুরে দেখেছিল এবং মন্দিরের উপস্থিতি এবং কয়েকজন তপস্বীর বর্ণনা দিয়েছিল। কিছু মন্দির ১৪৯৯ সালে সিকান্দার লোদি দ্বারা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে খাজুরাহো একটি তুচ্ছ জায়গা হয়ে যায় এবং ১৮১৯ সালে সিজে ফ্রাঙ্কলিন (সামরিক সমীক্ষক) দ্বারা  "পুনরায় আবিষ্কার" করার আগে এলাকাটি অবহেলিত ছিল। তবে খাজুরাহোকে বিশ্বের নজরে ফিরিয়ে আনার প্রকৃত অবদান টি.এস. বার্ট-এর (একজন ব্রিটিশ সেনা ক্যাপ্টেন)  যিনি এটি ১৮৩৮ সালে পরিদর্শন করেছিলেন। পরবর্তী উল্লেখযোগ্য দর্শনার্থী ছিলেন ১৮৫২ থেকে ১৮৫৫ সালের মধ্যে আলেকজান্ডার কানিংহাম। 


ধঙ্গদেব :  শিলালিপিতে আমি ধঙ্গদেব নামে খ্যাত, ভারতের চান্দেলা রাজবংশের একজন রাজা ছিলুম। আমি জেজকভূক্তি অঞ্চলে (বর্তমান মধ্য প্রদেশে বুন্দেলখন্ড) শাসন করতুম। আমি প্রতিহরদের অধীনতা অস্বীকার করে চান্দেলাদের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিলুম।  বিশ্বনাথ মন্দির সহ খাজুরাহোতে চমৎকারর মন্দিরগুলি গড়িয়েছিলুম । আমার বাবা ছিলেন যশোবর্মণ এবং তাঁর রানী পুপা (পুষ্প) দেবী। আমার রাজত্বকালে  প্রথম শিলালিপি ৯৫৩-৯৫৪ সালের  চতুরভুজ শিলালিপি। এর আগেই আমি সিংহাসনে আরোহণ করেছিলুম। আমার আরোহন বিতর্কিত ছিল, কারণ তাঁর ভাই কৃষ্ণকে রাজ্যের মালওয়া সীমান্ত রক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল।  আমার সময়ের অন্যান্য শিলালিপিগুলির মধ্যে রয়েছে নানারা (বা নানৌউরা) শিলালিপি, ৯৯৮ সালের এবং খাজুরাহোতে লালাজি শিলালিপি -- ৯৯৯ সালের ।  বংশধরদের শিলালিপিতেও আমার নাম পাওয়া যাবে।


ঐতিহাসিক বিশ্বনাথ দত্ত : পরবর্তী মধ্যযুগীয় গ্রন্থগুলো ছত্রিশটা রাজপুত বংশের মধ্যে চান্দেলাকে অন্তর্ভুক্ত করেছে করে, যদিও সেই সময়কালে রাজপুত বলে কিছু ছিল না । তারা ষোড়শ শতাব্দীতে আবির্ভূত হয়েছিল। এই ধরনের গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে মহোবা-খন্দ, বর্ণ রত্নাকারা, পৃথ্বীরাজ রাসো এবং কুমারপাল-চরিত। বংশের উৎসের মহোবা-কাণ্ড কিংবদন্তিটি এইরকম: বেনারসের গহরওয়ার রাজার পুরোহিত হেমরাজের এক সুন্দর কন্যা ছিল, যার নাম হেমাবতী। একবার, হেমাবতী যখন একটি পুকুরে স্নান করছিলেন, তখন চাঁদ দেবতা চন্দ্র তাকে দেখে তাঁর প্রতি প্রেম করেছিলেন। অবিবাহিত মা হওয়ার অসম্মান নিয়ে হেমাবতী উদ্বিগ্ন ছিলেন, কিন্তু চন্দ্র তাকে আশ্বস্ত করেছিলেন যে তাদের পুত্র মহান রাজা হয়ে উঠবেন। এই শিশুটি ছিলেন রাজবংশের পূর্বসূরি চন্দ্রবর্মা। চন্দ্র তাঁকে একজন দার্শনিকের পাথর দিয়ে উপস্থাপন করেছিলেন এবং তাঁকে রাজনীতি শিখিয়েছিলেন।  রাজবংশের নিজস্ব রেকর্ডগুলিতে হেমাবতী, হেমরাজ এবং ইন্দ্রজিৎ উল্লেখ নেই। এইরকম কিংবদন্তিগুলি পরে দরবারি কবিদের আবিষ্কার বলে মনে হয়। সাধারণভাবে, মহোবা-কাণ্ড ঐতিহাসিকভাবে অবিশ্বাস্য। এমনকি পৃথ্বীরাজ রসোও  ঐতিহাসিকভাবে অবিশ্বাস্য  হিসেবে বিবেচিত।


হাসান নিজামি : আমার বই ‘তাজ-উল-মাসির-এ লিখেছি যে, সোমনাথ মন্দিরের ছাদ থেকে ঝুলন্ত ঝাড়বাতি মূল্যবান রত্নাদিতে খচিত ছিল। পরবর্তীকালের লেখক ফিরিস্তার মতে, গজনির সুলতান মাহমুদ ফাঁপা পাথরে তৈরি বিগ্রহ ভেঙে ফেলে তার ভেতরে রাখা হীরা ও মণি-মাণিক্য হস্তগত করে।  লিঙ্গদেবতাটি সম্পূর্ণরূপে নিরেট স্বর্ণের তৈরি ছিল। লোদি সুলতানরা মুসলমান ছিল এবং তাদের পূর্বসূরীদের মতো তারাও মুসলিম বিশ্বের উপর আব্বাসীয় খিলাফতের কর্তৃত্বকে স্বীকার করতো । যেহেতু সিকান্দার লোদির মা একজন হিন্দু ছিলেন, তাই সিকন্দার লোদি রাজনৈতিক সাফল্য হিসাবে শক্তিশালী সুন্নি গোঁড়ামির আশ্রয় নিয়ে তার ইসলামিক প্রমাণাদি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছিল। ও হিন্দু মন্দিরগুলি ধ্বংস করেছিল আর আলেমদের চাপের মুখে একজন ব্রাহ্মণকে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার অনুমতি দিয়েছিল, যিনি হিন্দু ধর্মকে ইসলামের মতো ভদ্র বলে ঘোষণা করেছিলেন। সিকন্দর লোদি মহিলাদের মধ্যে মুসলিম সাধুদের মাজার (সমাধি) দেখতে নিষেধ করেছিল এবং কিংবদন্তি মুসলিম শহীদ সালার মাসুদের বর্শার বার্ষিক মিছিল নিষিদ্ধ করেছিল। 


হজরত ইবলিশ : সিকন্দর লোদি বেজন্মা বলে পরিচিত ছিল, ওর সভাসদদের মাঝে । 


মুহম্মদ নাজিম :  গজনির সুলতান মাহমুদ তার তলোয়ারের এক আঘাতে সোমনাথের শিবলিঙ্গটি ধ্বংস করেন। যদিও তিনি বিগ্রহ ধ্বংস করেন তা হলেও একথা নিশ্চিত করে বলা যায় না যে, বিগ্রহে রক্ষিত রত্নাদি  অথবা এর গায়ে খচিত মণি-মাণিক্য ) সংগ্রহের উদ্দেশ্যেই তিনি মূর্তি ধ্বংস করেন। স্বর্ণ ব্যতীত গজনভী মুদ্রা প্রস্তুত অসম্ভব বলেই সম্ভবত এটি করা হয়। মুহম্মদ হাবিব বলেন যে, সোনা এবং রূপার তৈরি বিগ্রহ গলিয়ে গজনভীর মুদ্রায় রূপান্তরিত করা হতো। ধ্বংস করেছিল কাফেরনিধনের উদ্দেশ্যে ।


হজরত আহনাফ : মুহম্মদ ঘুরির আধ্যাত্মিক উপদেষ্টা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীর পরামর্শে শেষ রাতের দিকে পৃথ্বীরাজ চৌহানের উপর আক্রমণের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। অতর্কিত আক্রমণে চৌহানের সেনাবাহিনী দিশেহারা হয়ে পড়ে। রাতের আঁধারে ঘোড়সওয়ারী তরোয়ালধারী ম্লেচ্ছ আফগান-তুর্কি সেনাদের যৌথ আক্রমণ প্রতিহত করে পাল্টা আক্রমণ  করেই বিপুল সৈন্যক্ষয় হয়ে যায়। ঘোড়ায় চড়া তীরের মত গতিবেগের ম্লেচ্ছ সেনাদের রুখতে পারে না চৌহানবাহিনী। শেষ রাত থেকে অভুক্ত অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনী তখন ক্লান্ত, তাদের শেষ শক্তি ক্ষয় হয়ে আসছে, এদিকে যুদ্ধ চলছে একনাগাড়ে শেষরাত পেরিয়ে সকাল গড়িয়ে দুপুর পর্যন্ত। ইতিমধ্যে সেনাদের মাঝে সেনাপতি খাণ্ডেরাও মারা যাওয়ার সংবাদ ছড়িয়ে পড়ার ফলে তাদের মনোবল ভগ্নপ্রায় এবং অবিন্যস্ত। এরকম ছত্রভঙ্গ সেনাদের উপর নতুন উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল তরোয়াল হাতে দ্রুত গতির অশ্বারোহী  ১২০০০ ম্লেচ্ছ সেনা। তাদের সামনে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তখন  পৃথ্বীরাজের সেনাবাহিনীর আর অবশিষ্ট ছিল না। তারা  বেঘোরে ম্লেচ্ছদের হাতে মারা পড়তে লাগল। এদিকে যুদ্ধ দুপুর গড়িয়ে বিকেল পর্যন্ত যুদ্ধ চলতে থাকে। যুদ্ধের নতুন কৌশল নিয়ে আলোচনার জন্য ১৫০ জন ঊর্ধ্বতন সেনানায়ক এবং মিত্র রাজাদের নিয়ে পৃথ্বীরাজ চৌহান একটা গাছের ছায়ার নিচে দাঁড়ায়। তারা মরণপণ যুদ্ধের শপথ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ফেরার আগেই তুর্কি আফগান ম্লেচ্ছ বাহিনী চারিদিক থেকে ঘিরে ফেলে এবং একই সাথে চলতে থাকে বৃষ্টির মত তীর নিক্ষেপ, তখনই আসলে বেজে গেছে মরণঘন্টা। তুর্কি এবং আফগান ম্লেচ্ছবাহিনীর আক্রমণে রাজপুতরা নিমেষে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। শেষ মুহূর্তে চৌহান রাজপ্রাসাদের দিকে পালানোর চেষ্টা করলেও ঘুরির হাতে বন্দী হয়ে যায়। পৃথ্বীরাজ চৌহানকে বন্দী করেই মুহম্মদ ঘুরি চলে যায় রাজপ্রাসাদে রাণী সংযুক্তার খোঁজে। তখন সম্ভ্রম রক্ষায় সংযুক্তা তার দাসীদের নিয়ে জহরব্রত করার জন্য প্রস্তুতি নিলেও ততক্ষণে ঘুরি রাজপ্রাসাদে পৌঁছে যায় এবং তাকেও বন্দী করে নিয়ে আসে। বাইরে তখনো যুদ্ধ চলছে সমান তালে, এদিকে কিছুমাত্র সময় দেরী না করে পৃথ্বীরাজ চৌহানের সামনেই তার প্রিয়তমা সুন্দরী স্ত্রী সংযুক্তাকে ধর্ষণ করে ঘুরি। পৃথ্বীরাজকে ইসলাম কবুল করার জন্য চাপ দিতে থাকে ঘুরি। কিন্তু চৌহান রাজি হয় না। আর এদিকে চলতে থাকে সংযুক্তাকে পালাক্রমে ধর্ষণ। বন্দী অবস্থায় চৌহান ঘুরিকে হুংকার দিলে ঘুরি চৌহানের চোখ অন্ধ করে দেয়। ১৫ দিন একনাগাড়ে সংযুক্তাকে ধর্ষণ করার পর ঘুরি চৌহানের শিরশ্ছেদ করে কাটা মাথাটা খাজা মইনুদ্দিন চিশতীকে উপহার দেয়। চৌহানের কাটা মাথা দেখে, খাজা মইনুদ্দিন চিশতী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলে, “অনেক কষ্টের পর অবশেষে আমরা চূড়ান্ত বিজয় পেলাম।”

ঐতিহাসিক পাপিয়া ঘোষ : রাজপুত (সংস্কৃত রাজা-পুত্র থেকে, "একজন রাজার পুত্র") বর্ণ, গোত্র এবং স্থানীয় গোষ্ঠীগুলির একটি বৃহত  উপাদানে গড়া, যা ভারতীয় উপমহাদেশে উদ্ভূত  বংশদ্ভুত সামাজিক অবস্থান  নিয়েছে। রাজপুত শব্দটি কোনও বর্ণকে চিহ্ণিত করে না । গোষ্ঠীটিতে আকাধিক বর্ণ আছে । বৌদ্ধিকতার সাথে ঐতিহাসিকভাবে  বিভিন্ন পিতৃতান্ত্রিক গোত্রকে অন্তর্ভুক্ত করেছে: বেশ কয়েকটি গোষ্ঠী রাজপুত মর্যাদার দাবি করে, যদিও সমস্ত দাবি সর্বজনস্বীকৃত নয়। আধুনিক পণ্ডিতদের মতে প্রায় সমস্ত রাজপুত বংশের উৎপত্তি কৃষক বা যাজক সম্প্রদায়ের থেকেই হয়েছিল এবং বহু গোষ্ঠির জন্ম গ্রিকদের বংশধর থেকে । সুতরাং চান্দেলাদেরও সেই দৃষ্টিকোন থেকে দেখতে হবে । 

হজরত ইবলিশ : ম্লেচ্ছরা যদি খাজুরাহোর মন্দিরগুলো অক্ষত রাখতো তাহলে তারা এদেশের লোকেদের শ্রদ্ধা অর্জন করতো । তাদের জন্যই এখন সারা আল-হিন্দে ম্লেচ্ছদের সবাই ঘেন্না করে । আর খাজা মইনুদ্দিন একজন চিশতি হয়ে কেমন করে জঘন্য কাজকে উৎসাহ দিয়েছিল । লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে ।

                                     ---------------XXXXXXX------------------

 


কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি...অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা : মলয় রায়চৌধুরী

 

কফিহাউসে চেঙ্গিজদা, ল্যাঙড়াদা, গুলপিসি…. অ্যান্টি-হিস্ট্রির আড্ডা

 মলয় রায়চৌধুরী

চেঙ্গিজ খান : যাক তোরা সব আগেই এসে বসে আছিস দেখছি । জানিস তো, আমিই মহান খান, কিন্তু এই ল্যাঙড়া তৈমুরের মতন খান নই । আসলে আমার নাম ছিঙ্গিস খাং ছিল, ইংরেজ ব্যাটারা নিজেদের উপনিবেশগুলোতে খানের ছড়াছড়ি দেখে আমাকেও খান বানিয়ে দিয়েছে । আমি তো কাফের, নাস্তিক, তোদের মতন আস্তিকান্তরিত নই । তবু আমাকে মোঙ্গোলরা জাতির পিতা মনে করে । সবাইক খবর দিয়েছিস তো যে আজকে কফিহাউসে জব্বর আড্ডা হবে ? তুই তো শুনেছি নিউমোনিয়া আর প্লেগে ভুগে হেগে-হেগে মরেছিলিস! রাশিয়ানরা কবর খুঁড়ে তোর কঙ্কাল যাচাই করে দেখেছিল যে তুই সত্যিই ল্যাঙড়া ছিলিস আর ডান হাতের কব্জি কাটা ছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হায় মাওলা, কী করলা, তুমি মালাউন ? কী করব, তখন আমার সত্তর বছর বয়স, শীতকালের চিন, জানোই তো, আর টানতে পারিনি । তবে আমি কিন্তু কখনও খান পদবি ব্যবহার করিনি। হ্যাঁ, যতোজনকে পেরেছি, জানিয়েছি । ঋষিমুনিরা বলেছেন ম্লেচ্ছদের আড্ডায় আসবেন না ; আর বর্মায় সামরিক শাসন চলছে, তাই বাহাদুর শাহ জাফর হয়তো দেরি করে আসবেন । জাহাঙ্গির আর নুর জাহান আসবেন না ; পাকিস্তান সরকার ওনাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে, কেননা প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতা নেই আর আই এস আই ক্লিয়ারেন্স দেয়নি । অন্য সবাই আসবে বলেছে।

চেঙ্গিজ খান : তবে না তো কী ! প্রথমে আস্তিকান্তরিত হয়েছিল আমার নাতি । একজনমাত্র ঈশ্বরের ধর্ম নেয়  জোচি খানের ছেলে বারকি খান। জোচি  আমার বড় ছেলে। বাগদাদে হালাকু খানের অত্যাচারের খবর পেয়ে খাপ্পা হয়ে গিয়েছিল বারকি খান। ও এই বিষয়ে রাগ দেখিয়ে তখনকার মোঙ্গল সম্রাট উলু খাকান খান ই খানান কুবলাই খানের কাছে চিঠি লেখে।কুবলাই খান হালাকুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায়  বারকি খান রাজনৈতিক কূটচাল হিসেবে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধ লাগিয়ে দিয়েছিল।  কুতুজের পক্ষে হালাকুকে থামানো সম্ভব হত না যদি না  ও নিজের সমস্ত দৌলত, তাকত আর বুদ্ধি কাজে লাগাতো।   টেরেক নদীতীরের   যুদ্ধে হালাকুর বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল বারকি খান আর ওর ভাইপো নোগাই খান। হেরে গিয়ে হালাকু খান পরের পাঁচ বছরে আর সিরিয়া-মিশরের দিকে হাত বাড়াতে সাহস পায় নি। আমি নাস্তিক ছিলুম, তারপর নাতিরা নানা আস্তিকতায় আস্তিকান্তরিত হয়ে আমাকে বিখ্যাত করে দিয়েছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো আর খাঁটি মোঙ্গোল নই, আমি উজবেক, তুর্কি, মোঙ্গোল, চাঘতাই, ইরানি মেশানো । অটোমানের সম্রাট বায়োজিদকে  বন্দি করে রেখে সবচেয়ে আনন্দ পেয়েছিলুম । টোটাল কতো লোককে মেরেছিলুম জানো ? একশো সত্তর লাখ, আর গোলাম বানিয়েছিলুম তার চেয়ে বেশি । তবু পৃথিবীতে মানুষ কমল না ;পয়দা হয়েই চলেছে ।

চেঙ্গিজ খান : তোর কফিন খুলে নাকি সোভিয়েত রাশিয়া একটা চিরকুট পেয়েছিল । তাতে লেখা ছিল, যারা এই কফিন খুলবে তারা সেই দিনই ভয়ঙ্কর বিপদে পড়বে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ, সেই দিনই হিটলার ওদের আক্রমণ করেছিল ।

চেঙ্গিজ খান : তোতলা তুগলক পাগলা তুগলক, মোটা তুগলক, ঢ্যাঙা তুগলক, রাগি তুগলক, খোকা তুগলক, ফিরোজাবাদি তুগলক, দিল্লিওয়ালা তুগলককে আসতে বলেছিস ?

তোতলা তুগলক : এই তো আমি গাজি মালিক সুলতান গিয়াসুদ্দিন তুগলক শাহ । আআমরা আআপনার পেপেছনের টেবিবিলেই ববসে আআছি দাআআআদা । ককখনও দেদেখিনি তো আআপনাকে । ভাআআবছিলুম পপটি পলিটিককককসের লোলললকলসকর বুবুবুঝি । ভোভোভোটের গ্যাঁজানিনি চচচচলছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : যাক এসেছিস, আমিও তোদের চিনতে পারিনি । বংশধরদেরও  সঙ্গে এনে ভালো করেছিস। ওদের সম্পর্কে লোকেরা এমন সব কথা বলে বেড়ায় ! তোরা চেয়ার টেনে এই টেবিল ঘিরে বোস।

পাগলা তুগলক : গুড মর্নিঙ এভরিবডি ; আমিও আছি এখানে, সুলতান মোহম্মদ আদিল বিন তুগলক শাহ । কে কী বলে বেড়ায়, হারামিদের পাঠিয়ে দেবো দেবগিরিতে, তখন টেরটি পাবে মজা। আমি এই মোঙ্গোলদের মোটেই পছন্দ করতুম না । নেহাৎ আব্বাহুজুর বললেন, তাই এলুম ।

তোতলা তুগলক : গুগুগুরুরুরুজজজনননদেদের সাসাসামনে মুমুখ ফসসসসকে বাবাবাজে ককককথা ববববলিসনি । ওওওনাদের ককককথাগুলো ভালো ককককরে শোন । সসসসমাধির ভেতরে শুয়ে গগগগরমকালে গরররররম লাগগগগবে না, শীতকাকাকালে শীশীশীত কককককরবে না ।

ফিরোজ শাহ তুগলক : আমি মোটা তুগলক, এসেছি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো এই মোটা তুগলক মারা যাবার পর  দিল্লি আক্রমণ করেছিলুম, স্পষ্ট মনে আছে । আমার আল-হিন্দ আক্রমণ তুগলকদের পতনেকে আরও তাড়াতাড়ি এনে দিয়েছিল । আমার ভয়ে  সুলতান নাসিরুদ্দিন মামুদ দিল্লী ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিল, স্পষ্ট মনে আছে । আমার আক্রমণ দিল্লি সুলতানির ফোঁপরামিকে  তুলে ধরেছিল । ফলে দিল্লি সুলতানির মর্যাদা আর পতিপত্তি মাটিতে মিশিয়ে যায় । প্রচুর সোনা-মণি-মুক্ত লুঠ করে আমি দিল্লির অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিলুম । কিন্তু আমি আল-হিন্দে তুর্কি মোগল ইরানি উজবেক আফগানদের মতন সাম্রাজ্য বসাবার  চেষ্টা করিনি । লোকে আমাকে ভয় আর ত্রাসের প্রতীক একজন লুণ্ঠনকারী মনে করে, সেটাই যথেষ্ট, সাম্রাজ্য বসানো বোকামি ।

তুগলক খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান গিয়াস উদ দিন তুগলক শাহ : আমি ঢ্যাঙা তুগলকও এসেছি ।

সুলতান আবু বকর শাহ আবু বকর খান ইবন জাফর খান ইবন ফতেহ খান ইবন ফিরোজ শাহ: আমি রাগি তুগলক, এসেছি ।

মোহাম্মদ শাহ ইবন ফিরোজ শাহ সুলতান মোহাম্মদ শাহ : আমি খোকা তুগলক, এসেছি ।

হুমায়ূন খান সুলতান আলাউদ্দিন সিকান্দার শাহ : আমি শেষ তুগলক, এসেছি ।

মুহাম্মদ শাহ ইবন মুহাম্মদ শাহ সুলতান নাসির উদ দিন মুহাম্মদ শাহ তুগলক : ও শেষ তুগলক নয়, গুল মারছে, মোটে কয়েক মাসের জন্য সুলতান হয়েছিল ।

নুসরাত খান ইবনে ফাতেহ খান ইবনে ফিরোজ শাহ সুলতান নাসিরুদ্দিন নুসরাত শাহ তুগলক: তুইও তো শুধু ফিরোজাবাদের সুলতান ছিলিস । আমি দিল্লির সুলতান ছিলুম । আমরা দুজনে ফিফটি-ফিফটি সুলতান ছিলুম ।

চেঙ্গিজ খান : ঠিক বলেছিস তোতলা । আজকালকার ছেলেপিলেগুলোর বিশেষ জ্ঞান নেই । সব ব্যাপারে মাথা গলায় ।

তোতলা তুগলক : তৈমুরেরররর ককককথা শুনলি তোতততোরা । এএএবারে মুমুমুউখ বন্ধ ককককরে গপ্পোপোপোপো শোশোশোশোন । অবশ্য একটা কথা বলে নিই । আমার ছেলেটাই আমাকে খুন করে সুলতান হয়েছিল ।

কফিহাউসের যক্ষ : রাজা-রাজড়াদের ফ্যামিলিতে অমন একটু-আধটু হয় । আমি তো সারাদিন দেখি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকরা কলমের খোঁচায় কাকে-কাকে মারবেন তার প্যাঁচ কষেন । 

পাগলা তুগলক :  শাশ্বত মানবপ্রকৃতি বলে অবশ্যই একটা কিছু আছে।  এটাই মূলত ভিত্তি: মোটামুটি সুস্থির একটা মানবপ্রকৃতি যদি না-থাকে তবে সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক উপলব্ধিতে পৌঁছানো আদৌ সম্ভব নয়। প্রতিটি সংস্কৃতিতেই আংশিক ও গুরুতর রকম খন্ডিত অভিজ্ঞতাগুচ্ছের ওপর নির্ভর করেও মানুষ কীভাবে তাদের মাতৃভাষা কেবল শিখতেই সক্ষম হন না, খুবই সৃজনশীলভাবে সেই ভাষা ব্যবহারও করতে পারেন?  এর একটাই মাত্র ব্যাখ্যা হতে পারে: মনের ভিত্তিস্বরূপ একটা জৈব-শারীরিক কাঠামো অবশ্যই বিদ্যমান, যা মানবপ্রজাতির সদস্য হিসেবে এবং সেইসাথে ব্যক্তিসত্তা হিসেবে, আমাদের বহুরূপ ব্যক্তিক অভিজ্ঞতাগুচ্ছ থেকে একটি সুসমন্বিত ভাষায় পৌঁছাতে সক্ষম করে তোলে। আমাদের সামাজিক, বুদ্ধিবৃত্তিক ও ব্যক্তিক আচরণ পরিচালনাকারী এই বিপুল অনুপুঙ্খ-পরিকল্পনা বা সহজাত-বিন্যাস-নীতির সমগ্রককেই আমি মানবপ্রকৃতি বলে আখ্যায়িত করি ।অর্থাৎ, জৈবিকসূত্রে প্রাপ্ত অপরিবর্তনীয় একটা কিছু আছে, যেটা আমাদের মানসিক সামর্থ্য দিয়ে যা-কিছু করি না কেন তার ভিত্তিমূল হিসেবে কাজ করে । মনে রাখবেন, বিয়ের আগে আমার মা হিন্দু, মানে কাফের ছিলেন ।

চেঙ্গিজ খান : বুঝলি, ল্যাঙড়া, বুঝলি তোতলা, আমি হলুম নির্ভেজাল খান ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : কী চেঙ্গিজদা, এসেই নিজের গুণগান আরম্ভ করে দিলে ? আমিও কম যাই না । আমার জীবনী পড়ে দ্যাখো, যদিও নিজে লিখিনি, আমি তো মুকখু ছিলুম, কিন্তু বুদ্ধিমান মানুষদের আমি পছন্দ করতুম।  আমার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ, যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত । আমি সব জায়গা থেকে মাল লুটে নিজের দেশে নিয়ে যেতুম । লক্ষ-লক্ষ মানুষকে কচুকাটা করেছিল আমার সেনারা । বাগদাদের সবাইকে নিশ্চিহ্ণ করে দিয়েছিলুম আর দিল্লিতে এক লাখ মানুষের মাথা কেটে পাহাড় তৈরি করিয়েছিলুম ।

চেঙ্গিজ খান : তুই যে লোভী ছিলিস তা জানি । তার ওপর আবার নাস্তিকরা যে দেশেরই হোক, তাদের ফিনিশ করে দিতিস, বুক ফুলিয়ে তা বলে বেড়াতো তোর চেলারা । আমি মালাউন বলে ওই সব বিশ্বাস-অবিশ্বাসের হ্যাঙ্গাম ছিল না । আমি আফগানিস্তানে কতো লোককে মেরেছিলুম, বাড়িঘর মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছিলুম, যাকে এখন বামিয়ান অঞ্চল বলে । কিন্তু বামিয়ানের  বুদ্ধমূর্তি ভাঙিনি।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমিও বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ভাঙিনি, যদিও আমি মূর্তিপুজোর ঘোর বিরোধী অথচ যেসব দেশের লোক আমাকে ভালোবাসে, সেখানেই আমার মূর্তি খাড়া করে দিয়েছে । বুজকাশি খেলাটা এখন বেশ পপুলার বটে,  কিন্তু ওটা আমিই আরম্ভ করেছিলুম । বুজকাশি  বা কোক-বোরু যাকে উজবেকরা বলে কোকবারি, মাথা-কাটা ছাগল, বাছুর বা ভেড়ার বডি নিয়ে মধ্য এশিয়ার  ঘোড়সওয়ারদের খেলা, এখন আফগানিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, কিরগিজস্তান, তুর্কমেনিস্তান, কাজাখস্তান, পাকিস্তানের পাঠান এলাকায়  খেলা হয়। জানো তো, খেলোয়াড়রা তাদের ঘোড়াগুলো দৌড় করায় আর ধড়টা তুলতে চেষ্টা করে। আমার সময়ে শত্রুপক্ষের মানুষের ধড় নিয়ে খেলতুম ।

চেঙ্গিজ খান : আরে তুই আমার ধারে-কাছে লাগিস না । তুই ভেড়া চুরি করতে গিয়ে পায়ে তির লেগে খোঁড়া হয়ে গিয়েছিলি । তোর জীবনীলেখকরা সবাই আস্তিকান্তরিত বলে তোর সম্পর্কে বাড়িয়ে-চাড়িয়ে লিখে গেছে । যেমন ওই জালালুদ্দিনের পিসি, গুলবদন বেগম, ওর হুমায়ুনের জীবনী লিখতে বসে তোকে বাবরের পূর্বপুরুষ বাতলেছে, ওদের পরিবারের সব কেচ্ছা চেপে গেছে । বাবর নিজেও নাম কেনার জন্যে নিজেকে তোর বংশধর বাতলেছে ; ওরা তো চাঘতাই, গুরকানি । গুরকানি মানে ঘরজামাই । জানিস কি, মঙ্গোলিয়ার বেশির ভাগ লোক বৌদ্ধ  আর তাদের অনেকেই যাযাবর । আমিও যাযাবর ছিলুম । আমার বউরা পঞ্চাশ একশো কোশ দূরে-দূরে চামড়ার তাঁবু খাটিয়ে সংসার পাততো । ঘোড়া হাঁকিয়ে যেতুম একবউ থেকে আরেক বউয়ের তাঁবুতে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি প্রচুর বৌদ্ধও মেরেছি । আমার পরে যারা বৌদ্ধ এলাকায় গেছে তারাও বৌদ্ধদের ফিনিশ করেছে । বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি কামান দেগে ভাঙার চেষ্টা করেছিল নাদির শাহ আর আওরঙজেব, কিন্তু ভাঙতে পারেনি । আফগান রাজা আব্দুর রহমান খান মূর্তির মুখ লোক লাগিয়ে ভেঙে দিয়েছিল । পরে তালিবানরা উড়িয়ে দিয়েছে বোমা মেরে । মজার ব্যাপার কী জানো ? আমি যে লাখ-লাখ কাফের-নাস্তিকদের দাস বানিয়ে তাড়িয়ে এনেছিলুম, তাদের আস্তিকান্তরিত করার পর তাদের নাতি আর নাতির নাতিরাই গোঁড়া তালিবানি আস্তিক হয়ে নাস্তিকদের ফিনিশ করছে ; ব্যাটারা জানেই না যে ওদের দাদু আর তার দাদুকে দাস বানিয়ে এনেছিলুম ।

কফিহাউসের যক্ষ : আপনারা তো স্নান করতেন না । আপনাদের মাথায় উকুন আর গায়ে কি চামউকুন হতো?

চেঙ্গিজ খান : হতো হতো । সাধারণত যুদ্ধে বেরোবার সময়ে একজন বউকে সঙ্গে নিয়ে যেতুম । তাছাড়া, অনেকগুলো বউ ছিল, যুদ্ধ সেরে ফিরে, তাদের দিয়ে বাছাতুম । শক্তিশালী মোঙ্গোল পুরুষদের জন্য যেমন নিয়ম  ছিল, আমার অনেক স্ত্রী আর রাখেল ছিল। আমি  যে সাম্রাজ্য   জয় করতুম সেখান থেকে বউ আর রাখেল পেতুম, এই মেয়েরা সাধারণত রাজকন্যা বা রানী হতো, যাদের  বন্দী করা হয়েছিল বা উপহার হিসাবে আমাকে দেয়া হয়েছিল । সবসুদ্দু কতোজন বউ আর রাখেল ছিল বলতে পারব না । তবে, আমার সাতজন প্রধান বউ ছিল, বুঝলি । বোরতে, ইয়েসুজেন, ইয়েসুই, খুলান, মোগে, জুয়েরবিয়েসু আর ইবাকা বেকি । আমার প্রথম বউ বোরতেকে মেরকিটরা তুলে নিয়ে গিয়েছিল । আমি বোরতেকে ছাড়িয়ে এনেছিলুম আর তারপর ঠিক করি সারা জগত জুড়ে যুদ্ধ করব আর যখনই পাবো অন্যের বউকে তুলে আনবো । তারপর থেকে প্রতিটি বউ আর রাখেলের তাঁবুতে আমি পালোয়ান পাহারাদার মোতায়েন করা আরম্ভ করেছিলুম । লোকে আজও বলে চেঙ্গিস খান ছিলেন আপাদমস্তক একজন ধর্ম নিরপেক্ষ মানুষ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : খোজা পাহারাদার ?

চেঙ্গিজ খান : আরে, না রে । খোজা তো তুর্কির সুলতানরা রাখতো । খোজারা ক্ষমতাশীল মানুষের হয়ে দাস হিসেবে কাজ করে , আমার তাদের দরকার হয়নি। তুর্কির সুলতানরা হারেমের পাহারাদারের  কাজে খোজাদের রাখতো । এছাড়াও কর্মচারী, যোদ্ধা, গৃহস্থালির কাজ, সংগীতশিল্পী, সরকারি কাজকর্ম, ব্যক্তিগত রক্ষী ও চাকর হিসেবে খোজাদের ব্যবহার করা হতো। সুলতানরা ভাবতো খোজারা বেগমদের কাজে লাগবে না । বেগমরা কি অতো বোকা নাকি । হারেমে অতো বউ আর রাখেল রাখলে তাদের অরগ্যাজম যোগাবার কাজটা তো খোজারাই করতো। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমিও খোজা রাখিনি । কী দরকার ! বউ, দাসী-বাঁদি আর রাখেলদেরও তো সাধ আহ্লাদ আছে ।

চেঙ্গিজ খান : ভালো করতিস ।

কফিহাউসের যক্ষ : ভাগ্যিস আপনাদের দেশে জামাই ষষ্ঠীর ব্যাপার ছিল না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি মাথায় হেলমেট পরতুম । এতো লড়াই করতে হতো যে চুলকোবার সময় পেতুম না। চামউকুন থেকে রেহাই পাবার জন্যে দেশে ফিরে গায়ে ঘোড়ার চর্বি মাখতুম । আমার তেত্রিশজন বউ আর রক্ষিতা ছিল  । আমিও কোনও রাজ্য জিতলে সেখানকার রানি আর রাজকন্যাকে বিয়ে করে আনতুম কিংবা রক্ষিতা করতুম । আমার প্রধান বউরা ছিল তুরমিশ আগা, ওলজায় তুরখান আগা, সরায় মুলক খানুম, ইসলাম আগা, উলুস আগা, দিলশাদ আগা, তউমান আগা, চুলপান আগা, তুকাল খানুম, তোলুন আগা, মেংলি আগা, তোঘে তুরখান আগা, তুঘদি বে আগা, সুলতান আরে আগা, মালিকানশা আগা, খন্দ মালিক আগা, সুলতান আগা । রক্ষিতা বা উপপত্নী ছিল দৌলত তারখান আগা, বুরহান আগা, জানি বেগ আগা, তিনি বেগ আগা, দুরসুলতান আগা, মুনদুজ আগা, বখত সুলতান আগা, নওরুজ আগা, জাহান বখত আগা, নিগার আগা, রুহপরওয়ার আগা, দেলবেগ আগা, দিলশাদ আগা, মুরাদ বেগ আগা, পিরুজবখত আগা, খোশকেলদি আগা, দিলখোশ আগা, বরাতবে আগা, সেভিঞ্চ মালিক আগা, আরজু বে আগা, ইয়াদগার সুলতান আগা, খুদাদাদ আগা, বখত নিগার আগা, কুতলু বে আগা আর আরেকজন নিগার আগা । সবাইকে মনে রেখেছি, তোমার মতন ভুলে যাইনি । রোজ রাতে ওরা লটারি করে ঠিক করতো কে আমার সঙ্গে শোবে ।

চেঙ্গিজ খান : খোঁড়া হয়ে অতো বউ কেমন করে রাখতিস ? তোদের আস্তিকদের তো চারটে মোটে বউ অ্যালাউড।  আমি নাস্তিক মানুষ অমন নিয়ম-কানুনের হ্যাপা ছিল না । তোদের চারটে ছাড়া বাদবাকি সবাই মুত্তা ! আজকাল শুনি পট্রোডলারের জোরে সেক্স-স্টার্ভড বুড়োরা আল-হিন্দের হায়দ্রাবাদ থেকে মুত্তা কিনে নিয়ে যায় । নিজামের অনেক রাখেল বাঁদি দাসী ছিলো তো, এখন গরিব হয়ে কীই বা করবে, তাদের মেয়েদের মুত্তা করে পাঠায় !

কফিহাউসের যক্ষ : মুত্তা কী ব্যাপার স্যার ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মুত্তা মানে যে বউ নিকা করা নয় । শব্দটা আরবি ।  । আরবি ‘মুত্তা’ শব্দের মানে হলো আনন্দ। ফূর্তির জন্য এই বিয়ে। আল-হিন্দে সেই কবে থেকে বাদশা, সুলতান আর নবাবদের মধ্যে মুত্তা প্রথা চলে আসছে অথচ তুমি জানো না ? কেমন তুমি কফিহাউসের যক্ষ ! অবশ্য মুত্তার নিয়মনীতি  শিয়াদের মধ্যেই বেশি প্রচলিত ছিল। মোগলরা যদিও সুন্নি, তবে চারের বেশি বেগম ছিল তাদেরও। সেই বাবরের আমল থেকেই। বাবরকে বলেছি আসতে, ওদের কাছেই ডিটেইলড স্টোরি শুনতে পাবে । বাবরের বেগমের সংখ্যা দশ । এদের মধ্যে ছয়জনই ছিল ‘মুত্তা’ বেগম। হুমায়ুনের নিকা আর মুত্তা মিলিয়ে বেগম সংখ্যা নয়। আকবরের আট।

চেঙ্গিজ খান : তাই তো তোকে বলি, আমি একজন আলাদা বিশ্বজয়ী খান । আমিও একটা মজার কথা বলি তোকে। মিশরের লোকেরা মনে করে ওরা খাঁটি আস্তিক । ওরা যে প্রাচীন ফ্যারাও রাজত্বের মানুষ, গ্রিক, ইতালিয়, আরব, ইরানি, তুর্কিদের মিশেল, তা ভুলে যায় । কতোরকমের নাস্তিকতার ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে ভুলে যায় । এখন তো নাস্তিক ফ্যারাওদের মমি আর পিরামিড দেখিয়ে ভালো রোজগারপাতি করছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : জানি তো, চারজন বউ রাখতে হয় আর বাদবাকি মুত্তা । বুঝলে দাদা, মুত্তা হলেও, ওরা গর্ভবতী হয়ে যেতো । সে এক ফ্যাচাঙ । মুত্তাদের বাচ্চা হওয়া নিষেধ । আমি  তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস বলে কেউ বড়ো একটা আপত্তি করতো না ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কিছু মনে করবেন না  ; আমিও আফগানিস্তানের জামাই, গুরকানি । ল্যাঙড়ামিয়াঁ ইনভাইট করেছিল আসার জন্য । আমি আপনাদের মতোই বদনাম। আমার ছেলে দুর্যোধনের কাজকর্মের জন্যে লোকে আমাকে দোষ দেয় । সৎ ভাই পান্ডু যাবার পর দিল্লিতে রাজত্ব করতুম । কিন্তু আমি সত্যিকারের  জন্মান্ধ, ধর্মান্ধ নই । কান্দাহারের রাজকুমারী গান্ধারীকে বিয়ে করেছিলুম । আমার একশো ছেলে আর এক মেয়ে । এছাড়া এক বৈশ্য দাসীর সঙ্গে শুয়েছিলুম বলে তার পেটে যুযুৎসু নামে আমার  এক ছেলে জন্মেছিল । আমি আফগানিস্তান আক্রমণ করে  রাজকন্যা গান্ধারীকে বিয়ে করেছিলুম । আমি জন্মান্ধ ছিলুম বলে গান্ধারী নিজের চোখ ঢেকে রাখত। গান্ধারী যখন প্রেগন্যান্ট তখন আমার সেবা করত ওই বৈশ্য চাকরানি ।  তার ছোঁয়ায় আমার সেক্স করার ইচ্ছে চাগিয়ে ওঠেছিল আর তাকে  জড়িয়ে ধরে সেক্স করি । আমি তো অন্ধ । চাকরানি  হেল্প করেছিল। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুযুৎসু ছাড়া  অন্য সব ছেলেরা পটল তুলেছিল । আমার একশো  ছেলে আমার দোষেই  গুণ্ডামি-জোরজুলুম করে বেড়াতো । শুনেছি তাদের বংশধররা পশ্চিমবাংলা নামে একটা এলাকায় সেই একই বজ্জাতি চালিয়ে যাচ্ছে । ভোট আসলেই তারা বোমা-বন্দুক ছোরা-ছুরি নিয়ে যে যার ঘর থেকে পিলপিল করে বেরিয়ে আসে।

চেঙ্গিজ খান : কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র, জন্মান্ধ হলে ক্ষতি নেই । ধর্মান্ধ হলে সর্বনাশ । আমি ধর্মান্ধ ছিলুম না, প্রচুর যুদ্ধ করেছি জীবনে । এই ল্যাঙড়া তৈমুর ধর্মান্ধ ছিল বলেই জন্মান্ধ । আমাদের ধর্ম ছিল আকাশ । যে মানুষই আকাশের তলায় থাকে সে আমাদের ধর্মাবলম্বী বলে মনে করি । তাই কারোর ধর্ম পালটাবার দরকার হয়নি কখনও ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র :  বৈশ্যা চাকরানি সৌবালির ছেলে যুযুৎসু আমার অন্য ছেলেদের মতন বজ্জাত ছিল না । ন্যায়পরায়ণ আর ধর্মনিষ্ঠ বলে ও কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে দুর্যোধনের পক্ষ ছেড়ে পাণ্ডবপক্ষে চলে গিয়েছিল ।  পাণ্ডবরা অভিমন্যুর ছেলে পরীক্ষিৎ-কে সিংহাসনে বসায় আর যুযুৎসু’র ওপর রাজ্যের ভার দিয়ে চার ভাই ওদের বউকে নিয়ে মহাপ্রস্থানে চলে গিয়েছিল । মহাপ্রস্হানের রাস্তাটা  এখন চিনের দখলে, কে জানে কেমন আছে ওরা সবাই। 

ঢ্যাঙা তুগলক : আমদের ধর্মে অন্ধ হলে রাজা হওয়া নিষিদ্ধ । কাউকে টাইট দিতে হলে প্রথমেই তাকে অন্ধ করে দেবার রেওয়াজ ।

গজনির মামুদ : ল্যাঙড়ামিয়াঁ ডেকেছিলেন বলে আমিও এলুম । আমার নাম ইয়ামিনউদ্দৌলা আবুল কাসিম মাহমুদ ইবনে সবুক্তগিন,  সাধারণভাবে মাহমুদ গজনভি, বা সুলতান মাহমুদ আর মাহমুদে জাবুলি নামে লোকে এক ডাকে চেনে । আমার আব্বাহুজুর আবু মনসুর সবুক্তগিন ছিলেন তুর্কিদের সামরিক দাস ; নিজের চেষ্টায় সুলতান হয়েছিলুম ।  আমি ছিলুম  গজনভি সাম্রাজ্যের  শাসক । গান্ধার নামটা আমিই লোপাট করে দিয়েছি । হাঃ হাঃ । তালিবানরা ছবি আঁকা অ্যালাউ করে না, অথচ আফগানিস্তান আমার ছবি দিয়ে ডাকটিকিট বের করেছে । অ্যানিওয়ে, আই ফিল ইলেটেড । 

খোকা তুগলক : মুলতানের গপ্পোটা বলো না আঙ্কেল, পিলিজ ।

গজনির মামুদ : মুলতানে রাজা জয়পাল আর তার ছেলে আনন্দ পাল আমার সঙ্গে যুদ্ধ করলেও আমার দুর্বার গতির সৈন্যদলের কাছে ওদের সৈন্যদল খড়কুটোর মতো ভেসে যায়। ওই রাজপুতদের হাতি-বাহিনীর সৈন্যদল মূলত আমাদের ঘোড়ায় চড়া সৈন্যদের গতির কাছেই হেরে যায়, কারণ আমাদের সৈন্যদলের অপ্রতিরোধ্য গতি।  জয়পালের কাছ থেকে ২,৫০,০০০ দিনার আর ৫০টা হাতি আদায় করেছিলুম, বুঝলেন । সোমনাথ মন্দিরে আক্রমণের কারণে এখনো মুসলিমদের কাছে আমি একজন ইসলাম প্রচারক বীর যোদ্ধা, ইনটারনেটে সার্চ করলে জানতে পারবেন । পাকিস্তানের জাতীয় পাঠ্যক্রমে আমার ভারত আক্রমণকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে পড়ানো হয়, ওদের তো নিজেদের ইতিহাস নেই । কীই বা করতুম, বলুন ? আমাকে শেখানো হয়েছিল যে নাস্তিক মূর্তিপূজকদের বিনাশ করলে জান্নাতুল ফিরদৌসে যাবো। এখন অবশ্য আমি রয়েছি জাহান্নমে, সেখানে শয়তান আমাকে ঘুমোতে দেয় না, কানে বাজপাখির পালক দিয়ে সুড়সিড়ি দেয় ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : থ্যাঙ্কইউ জনাব চেঙ্গিজ । আমি চলি । রকেটের জন্যে বলে রেখেছি ইসরোকে । পৃথিবীর চারিধারে এতো মরা-রকেটের জঞ্জাল পাক খাচ্ছে যে স্বর্গে যাতায়াতও বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে । আফগানিস্তান থেকে করিৎকর্মা যুবক-যুবতীরা ইউরোপে পালাচ্ছে, আপনিও কেটে পড়তে পারতেন ।

গজনির মামুদ : গেলে তো ভালোই হতো ; বুড়ো হয়ে গেছি, আর পারি না । একটু দাঁড়ান  মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব  । আমাকে প্যারাশুট-ক্যাপসুলে গজনিতে ড্রপ করে দেবেন । ওখানেই আমার কবর, সোমনাথ মন্দির থেকে এনে চন্দনকাঠের দরোজা বসিয়েছিলুম সমাধিতে ঢোকার জন্য, তালিবানরা পালটে সাধারণ দরোজা লাগিয়ে দিয়েছে, কাফেরদের দরোজা নাকি চলবে না, দরোজাটা নাস্তিক । ঠিক সময়ে না পৌঁছোলে তালিবানরা সমাধিতে তালা মেরে দিতে পারে । জানেন তো, কিছুদিন আগে গজনিতে ভীষণ ভূমিকম্প হয়েছিল। যার ফলে আমার কবর ফেটে চৌচির হয়ে গিয়েছিল । আল-হিন্দের লোকেরা বলছিল পাপের শাস্তি।  আমার পর আর আগেও তো কতোজন আল-হিন্দে লুটপাট করতে এসেছিল । নয়কি ? বলুন !

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : হ্যাঁ, অনেকে এসেছিল, নিয়েও গেছে ঘোড়ার পিঠে, খচ্চরের পিঠে, হাতির পিঠে, মানুষের পিঠে, তাই তো পথটার নাম হিন্দু কুশ, মানে হিন্দুর কাটা মাথা । আপনি তো সতেরোবার সোমনাথ মন্দিরে হামলা করেছিলেন, দুই মন সোনা আর মণিমুক্ত নিয়ে গিয়েছিলেন । তবু আপনার দেশে, আই মিন আমার শশুরবাড়ির দেশে, গাঁয়ের মানুষ মাটির বাড়িতে থাকে কেন, কেমন যেন গরিব-গরিব মনে হয় ?

গজনির মামুদ : আসলে আমাদের দেশটা তখন ইরানের ভেতরে ছিল । সব মালকড়ি ওরাই মেরে দিয়েছে । নাদির শাহ ময়ূর সিংহাসন নিয়ে গেল কতো সোনাদানার সঙ্গে, এমনই আকখুটে যে সামলে রাখতে পারেনি। সব মণিমুক্ত খুলে-খুলে বেচে দিয়েছে । আমরা অন্য দেশ দখল করতে শিখেছিলুম গ্রিকদের থেকে । জানেন তো গ্রিকো-ইন্ডিয়ান হেলেনীয় রাজ্য ছিল, এখনকার  আফগানিস্তান জুড়ে,  আর ভারতীয় উপমহাদেশের পাঞ্জাবের সীমান্তবর্তী কিছু অঞ্চল, মানে এখনকার পাকিস্তানের উত্তরাঞ্চল  পর্যন্ত,  যা যিশুর জন্মের পর, শেষ দুই শতাব্দী জুড়ে  ত্রিশেরও বেশি  গ্রিক  রাজার শাসনে ছিল । তাছাড়া নাস্তিক বা কাফেরদের দেশ বলতে আপনাদের এই একটাই দেশ ছিল আক্রমণ করার মতন । আফ্রিকার নাস্তিকদের আমরা হাজার বছর আগেই আস্তিকান্তরিত করেছিলুম ; যে কটা ট্রাইব বেঁচে ছিল তাদের খ্রিস্টান্তরিত করে ফেললে ইউরোপের ক্যাথলিকরা ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আমি  তারও আগের রাজাধিরাজ । তবে আপনাদের দেশের লোকজন আর মেয়েদের দেখে সত্যিই মনে হয় যে গ্রিকরা নিজেদের বীর্য বিলিয়ে গেছে আপনাদের দেশে । ওদের মতন যেমন যুদ্ধবাজ আপনারা, তেমনই সুন্দরী আপনাদের মেয়ে-বউরা । আমরা অমন সুন্দর দেখতে ছিলুম না ; রাজা রবি বর্মা নামে একজন আঁকিয়ে আমাদের সুন্দর-সুন্দরী তৈরি করে দিয়ে গেছে ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা রবি বর্মা কে ? আমি তো ওনার রাজ্যে লুটপাট চালাতে যাইনি । কোথায় ওনার দেশ ?

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : রাজা রবি বর্মা ওরফে  কিলিমানোর কইল থাম্পুরান ছিলেন আল-হিন্দের বিখ্যাত  চিত্রশিল্পী। আল-হিন্দের ইতিহাসের নানাক্ষেত্রে বিচরণের জন্য তাঁকে ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ চিত্রশিল্পী হিসেবে গণ্য করা হয়। আল-হিন্দের ইতিহাস ধরে রেখে উনি ইউরোপীয় ধাঁচে ছবি এঁকে ভারতীয় চিত্রশিল্প জগতে এক অভূতপূর্ব রদবদল এনেছিলেন। এছাড়া উনি লিথোগ্রাফিতে অনেক দক্ষ ছিলেন  যা তাঁকে আরো বেশি সুপরিচিত করে তোলে। তাঁর আঁকা ছবি দেখে  পরে অনেকেই  অনুপ্রাণিত হয়েছিল। এছাড়া হিন্দু দেব-দেবী আর পুরাণের ওপর ওনার সৃষ্টিকর্মগুলো ওনাকে আরো বেশি বিখ্যাত করেছে।  রাজা রবি বর্মা ত্রিবাঙ্কোরের রাজ ঘরানার সদস্য ছিলেন। এখন ওনার ছবির দাম ময়ূর সিংহাসনের দামের কাছাকাছি । আল-হিন্দের নানা ভাষার ক্যালেণ্ডারে আপনি ওনার আঁকা সুন্দরীদের দেখতে পাবেন । তবে কেউ-কেউ গোলমালও করে দিচ্ছে আজকাল । শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে জার্সি গাই বা হলস্টিন ফ্রিজিয়ান গোরু এঁকে ফেলছে ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা রবি বর্মার নাম আর ওনার দেশের নাম শুনিনি আগে । আমি যদিও নাস্তিক মালাউন, আমাদের দ্বিতীয়বার জন্ম হয় না বলেই শুনেছি মা-বাবার কাছে , নয়তো আরেকবার জন্ম নিয়ে ওনাকে দিয়ে ছবি আঁকিয়ে আমার চোখ দুটো বড়ো আর নাকটা উঁচু করিয়ে নিতুম । তখনকার দিনে প্লাসটিক সার্জারি থাকলে দারুন হতো, কী বলেন ! আমি বেঁচে থাকতে কাউকে আমার ছবি আঁকতে দিইনি, কয়েনের ওপরেও নয়, মূর্তি গড়তে দিইনি। এখন মোঙ্গোলিয়া জুড়ে আমার মূর্তি বসানো হয়েছে । কোনো মানে হয়? নাক চেপটা, ছোটো চোখ, মোঙ্গোল চেহারার মূর্তি বানিয়ে আমার নামের লেবেল লাগানো হয়েছে । জাস্ট ডিসগাস্টিঙ ।

গজনির মামুদ : আমাদের দেশে গ্রিসের মিনানডার নামে একজন রাজা ছিল, সে নিজে বৌদ্ধধর্ম  নিয়ে সবাইকে বৌদ্ধ করে তুলেছিল । অনেকে মিনানডারকে  মেনান্দ্রোস নামে চেনে,  যিনি পালি বইগুলোতে মিলিন্দ নামে পরিচিত, উনি যিশুখ্রিস্ট  জন্মাবার একশো পঞ্চাশ বছর আগে রাজত্ব করতেন ; পারোপামিসাদাই, আরাখোশিয়া আর পাঞ্জাব এলাকা শাসন করেন। তাঁর রাজ্য পশ্চিমে কাবুল নদী উপত্যকা থেকে পুবদিকে রাবি নদী পর্য্যন্ত আর উত্তরে সোয়াট নদী উপত্যকা থেকে দক্ষিণে আরাখোশিয়া পর্য্যন্ত ছড়ানো ছিল । পূর্বদিকে গাঙ্গেয় নদী উপত্যকা বরাবর পাটলিপুত্র পর্য্যন্ত সেনা অভিযান করেছিলেন । গ্রিক রক্ত আমাদের শিরায় ঢুকে মাথা গোলমাল করে দিয়েছে। তাই যুদ্ধ, নেশাখুরি আর মাগিবাজি করার জন্য আজও আমার দেশের পাবলিক ছোঁক-ছোঁক করে। অবশ্য এই ব্যাপারে ইরান, তুর্কি, রাশিয়া, আমেরিকা, আরব হেল্প করেছে নানা সময়ে । এখন পাকিস্তান হেল্প করে। 

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আপনার শহর তো মুইজউদ্দিন মুহাম্মাদ ঘোরি দখল করে নিয়েছিল, ওনার আব্বাকে খুনের বদলা নেবার জন্যে । তারপর আল-হিন্দে জমিয়ে বসে গেল । আহমেদশাহ আবদালিও আটবার এসে লুটপাট চালিয়েছিল । ওরাও অনেক মালকড়ি নিয়ে গিয়েছিল, তবু আপনার লোকেরা আজও আফিম চাষ করে রোজগারপাতি করে কেন ?

গজনির মামুদ : ঠিকই বলেছেন আপনি । মুইজউদ্দিন গজনি শহর দখল করে নেয়। আসলে উত্তর ভারতে অভিযানের জন্য এই শহরকে স্প্রিঙবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করেছিল। এ সময়ে পশ্চিম এশিয়ায় বৃহত্তর খোরাসানের আধিপত্য নিয়ে খোয়ারিজমীয় সাম্রাজ্যের সাথে প্রতিযোগীতায় ও ওর ভাই গিয়াসউদ্দিনকে সাহায্য করেছিল। তারপর হামিদ লোদি রাজবংশের কাছ থেকে মুইজউদ্দিন মুলতান জয় করে নিলো । হামিদ লোদি পশতু ছিল, তবে ইসমাইলি শিয়াদের সাথে ওর সংযোগের কারণে মুরতাদ বা নাস্তিক হবার অভিযোগ উঠতো।  এছাড়া ও  লাহোরের গজনভি রাজ্যকে নিজের অধিকারে নিয়ে আসে। তা ছিল ওর সর্বশেষ পারস্যায়িত প্রতিপক্ষ।  গিয়াসউদ্দিন মারা যাবার পর মুইজউদ্দিন ঘুরি ওদের সাম্রাজ্যের শাসক ছিল । তার কবজার এলাকাগুলোর মধ্যে ছিল আফগানিস্তান, ইরান, তুর্কমেনিস্তান, তাজিকিস্তান, পাকিস্তান, আর আল-হিন্দ। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো যে ব্যাটারা বেশিদিন টেকেনি ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : এতো কাণ্ড করার পরও আফিম চাষ, চরস বিক্রি, বউদের ওপর কড়াকড়ি কেন?

গজনির মামুদ : কী আর বলব,  মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব  । আফিম খাইয়ে পাবলিককে ভুলিয়ে রাখলে শান্তিতে শাসন করা যায় । জনাব মার্কস বলেছেন ধর্ম হলো আফিম, তা এই কারণেই । মুহাম্মদ ঘোরি আমার চেয়েও কট্টর ছিল। বৌদ্ধধর্মকে হাপিশ করার জন্যে সবাইকে আস্তিকান্তরিত করে ফেললে । আল-হিন্দে নিয়ে এলো আফিম । বাঙালিরা আলুপোস্তর তরকারি আর সর্ষেপোস্তর এতো ভক্ত অথচ তা যে আপনার শশুরবাড়ির লোকেদের অবদান তা ভুলে যায় । আমাদের পোস্তগাছের চাষ করতে শিখিয়েছিল গ্রিকরা । আলেকজাণ্ডার যতো দেশ জয় করেছিল সব দেশে পোস্তদানা দিয়ে গেছে । যাকগে চলুন, গ্যাঁজানোও আফিমের মতন নেশা । দেখছেন তো কফিহাউসে বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গ্যাঁজাচ্ছে ছেলে-মেয়েরা ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : চলুন । আমি জন্মান্ধ আর আপনি ধর্মান্ধ । আজকাল তো ধর্মান্ধের সংখ্যা দিন-কে-দিন বেড়েই চলেছে ।  বিরোধিদের নিকেশ করার যে-কোনও উপায়কেই ধর্মান্ধতা বলতে হবে, বুঝলেন  গজনিমিয়াঁ ।  আমার ছেলেরা নিজেদের খুড়তুতো ভাইদের মনে করলো বিরোধী আর হিংসেতে নিজেদের মধ্যে দাঙ্গা বাধিয়ে ফেলেছিল। একই ব্যাপার করেছিল পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইয়েরা । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময়টুকুতে ওই গাইয়েদের খুনিরা প্ল্যান করে বাংলাদেশের জ্ঞানী-গুণী আর মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের খুন করেছিল ।  স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পৌঁছে ওই গানের খুনিবাহিনী যখন বুঝতে শুরু করল যে তাদের পক্ষে যুদ্ধে জেতা সম্ভব নয়, তখন তারা নতুন দেশটাকে সাংস্কৃতিক, সামাজিক আর শিক্ষাগত দিক থেকে দুর্বল আর পঙ্গু করে দেয়ার জন্য প্যাঁচ কষতে থাকে। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী শীতের রাতে পাক সার জমিন সাদ বাদ গাইয়েরা তাদের দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর আর আল শামস খুনিদের মদতে দেশের শ্রেষ্ঠ লোকেদের  বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের পর খুন করে। বন্দী অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন জায়গায় খুন  করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত আর বিকৃত লাশ রায়েরবাজার আর মিরপুরে পাওয়া গিয়েছিল। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। 

গজনির মামুদ : আসলে পাক-সাদ-বাদের উর্দু বলিয়েরা মনে করতো, এখনও করে,যে, বাঙালিরা নিম্নশ্রেণীর মানুষ। ওদের গ্রস ডোমেস্টিক প্রডাক্ট তো বাঙালিদের তুলনায় তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে । আমারিকার আর চিনের কাছে ফিবছর ভিক্ষা চায় বেচারারা । আপনাদের দেশভাগের সময়ে পাকিস্তানিরা ভাবতো যে কলমা পড়িয়ে নুনুর খোসা ছাড়িয়ে দিলেই মানুষ মুসলমান হয়ে যায় । ধর্ম অতো সহজ ব্যাপার নাকি । আজকাল তো কাওয়ালি-গায়কদের রঙচঙে পোশাক পরে আস্তিকান্তরিতরা ধর্মের উপদেশ বিলোয় । যাউকগিয়া, চলুন ।

শেষ তুগলক : রাজাকর আবার কী ?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  আল-হিন্দে, রাজাকার হলো একটা বাংলা গালি যা প্রধানত দেশদ্রোহীদের দেওয়া হয় ।     আল বদর হলো  বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে যারা সহায়তা করতো, সেই আধা-সামরিক বাহিনী। তাদের দলটাকে গড়া হয়েছিল পাকিস্তান রাষ্ট্রকে অখণ্ড রাখার উদ্দেশ্যে জনমত গঠন করার জন্য। পূর্বাঞ্চলীয় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল নিয়াজীর পৃষ্ঠপোষকতায় এই বাহিনী গঠিত হয়েছিল। ইসলামিক ইতিহাসের বদর যুদ্ধকে আদর্শ করে এই বাহিনী গঠিত হলেও এদের আসল কাজ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে তুলে দেয়া । সাবেক পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম জামায়াতে ইসলামীর প্রচারযন্ত্র দৈনিক সংগ্রাম এর মাধ্যমে দেশপ্রেমীদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক প্রতিরোধ ও যুদ্ধের ডাক দিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে, সে বাহিনীর আমীরের পদ নিয়ে নিলে, সেসময়ের ছাত্রসংঘের নেতা, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, আবদুল কাদের মোল্লার নেতৃত্বে আল শামস আর আল বদর বাহিনী গঠন করেছিল।  সাবেক পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রসংঘের আমীর আর পরে বাংলাদেশের মন্ত্রী মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী আল বদর আর আল শামস বাহিনীর আমীরের পদ নিয়েছিল,  আর সারা বাংলাদেশে প্রচারণা, সামরিক বাহিনীর সাথে যোগাযোগের দায়িত্ব পালন করেছিল। ঢাকা নগর ছাত্রসংঘের আমীর আর পরবর্তীকালে বাংলাদেশের মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদও এসব বাহিনীর প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছিল। আবদুল কাদের মোল্লা সামরিক জিজ্ঞাসাবাদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের আঙুল কাটার দায়িত্বে  ছিল। 

চেঙ্গিজ খান : ছি ছি ছি ছি । নিজের লোকেদের মেরে ফেলার প্যাঁচ কষেছিল ব্যাটারা ?  আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজির নাম শুনেছি বটে । লোকটা তো   ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর  লেফট্যানেন্ট জেনারেল। পূর্ব পাকিস্তানে  শেষ গভর্নর আর সামরিক আইন প্রশাসক এবং  পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক হাই কমান্ডের সর্বশেষ কমান্ডার। নিয়াজি আর রিয়ার এডমিরাল মুহাম্মদ শরীফ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধর সময়ে পূর্বাঞ্চলে সেনাদের দায়িত্বে ছিল। আত্মসমর্পণের জন্য ওকে পাকিস্তানে “বাংলার শেয়াল” বলা হয়। ওর সামরিক পদক আর সম্মানও কেড়ে নেয়া হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়ে নিয়াজি ওর পাঁচ ডিভিশন সেনা নিয়ে মুক্তি বাহিনী আর ভারতীয় সেনাবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল। যুদ্ধের সময়ে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত থাকার জন্য ওকে অভিযুক্ত করা হয়। ব্যাটা আছে এখন কোথায় ? মুখ লুকিয়ে বাড়িতে বসে থাকে বোধহয় ? 

গজনির মামুদ : নিয়াজি তো গো হারান হেরে আত্মসমর্পণের দলিলে সই করেছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : দলিলটা তোর কাছে আছে ? আচ্ছা, পড়ে শোনা তো ।

গজনির মামুদ : পড়ছি, শোনো । “পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ বাহিনীর জেনারেল অফিসার কমান্ডিং ইন চিফ, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে পাকিস্তান পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকিস্তানের সকল সশস্ত্র বাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণে সম্মত হলো। পাকিস্তানের সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনী সহ সব আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীর ক্ষেত্রে এই আত্মসমর্পণ প্রযোজ্য হবে। এই বাহিনীগুলো যে যেখানে আছে, সেখান থেকে লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কর্তৃত্বাধীন নিয়মিত সবচেয়ে নিকটস্থ সেনাদের কাছে অস্ত্র সমর্পণ ও আত্মসমর্পণ করবে। এই দলিল স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক কমান্ড লেফটেন্যান্ট-জেনারেল অরোরার নির্দেশের অধীন হবে। নির্দেশ না মানলে তা আত্মসমর্পণের শর্তের লঙ্ঘন বলে গণ্য হবে এবং তার প্রেক্ষিতে যুদ্ধের স্বীকৃত আইন ও রীতি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আত্মসমর্পণের শর্তাবলীর অর্থ অথবা ব্যাখ্যা নিয়ে কোনো সংশয় দেখা দিলে, লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার সিদ্ধান্তই হবে চূড়ান্ত। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণকারী সেনাদের জেনেভা কনভেনশনের বিধি অনুযায়ী প্রাপ্য মর্যাদা ও সম্মান দেওয়ার প্রত্যয় ঘোষণা করছেন এবং আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানি সামরিক ও আধা-সামরিক ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও সুবিধার অঙ্গীকার করছেন। লেফটেন্যান্ট-জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার অধীন বাহিনীগুলোর মাধ্যমে বিদেশি নাগরিক, সংখ্যালঘু জাতিসত্তা ও জন্মসূত্রে পশ্চিম পাকিস্তানি ব্যক্তিদের সুরক্ষা দেওয়া হবে।”

চেঙ্গিজ খান : ধর্মের কল নাড়াতে গিয়েছিল ব্যাটারা, পড়েছে মুখ থুবড়ে । পাকিস্তানিদেরও দোষ । কেন গিয়েছিলি বাঙালিদের চটাতে । নিজেদের বিশুদ্ধ আর বাঙালিদের অশুদ্ধ ভাবতো । আরে তোদের গায়েও তো গ্রিক, তুর্কি, মোগোল, উজবেক, আফগান, ইরানি,  রক্তের মিশেল ; অনেকের পূর্বপুরুষ ছিল আল-হিন্দের নাস্তিক।

পাগলা তুগলক : হ্যাঁ, জনাবেআলা । পূর্ব পাকিস্তান আর নেই । এখন এলাকাটাকে আমরা বলি বাংলাদেশ । পাকিদের একটা গানও ছিল । আল-হিন্দের কিছু মানুষ মনে-মনে দুঃখ পায়, বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে গেছে বলে । পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের অবস্হা খুবই খারাপ ।  পাকিস্তানের করাচি আর তার আশপাশেই আটকে থাকা বাঙালিদের বাস। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তারা সেখানে বসতি গড়েছিল। এরপর বাংলাদেশ স্বাধীনতা পেলে, ওদের নাগরিকত্ব আটকে দেয় পাকিস্তান । করাচিতে ওদের জন্য তৈরি করা হয়েছে ক্যাম্প। সেখানে জঘন্য পরিস্থিতিতে বহু বাঙালি বাস করছে। আটকে-পড়া বাঙালিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টা প্রথম রিপোর্ট করে পাকিস্তানের সামা টিভি। তাতে জানানো হয় দেশটার নাগরিকত্ব যাচাইকরণ প্রোগ্রামের সংসদীয় কমিটি পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র সংশোধনের মাধ্যমে আটকে পড়া বাঙালিদের বৈধ করার প্রস্তাব দিয়েছে। তবে বাঙালিদের বৈধ করার বিষয়টা সহজ নয়। কারণ এ জন্য পাকিস্তানের নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করতে হবে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাকিস্তানে প্রায় তিরিশ লাখ বাঙালি আটকে থাকলেও তাদের মধ্যে পনেরো লাখ করাচি আর তার আশপাশে রয়েছে। বহু বছর সামরিক শাসনে থাকায় আটকে থাকা বাঙালিরা রাজনীতির শিকার হয়েছে। তাদের বেশ কয়েকবার নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা উঠলেও শেষ পর্যন্ত তা হয়নি। এ জন্য সেখানকার বাঙালিদের মধ্যে অসন্তোষও রয়েছে। করাচিতে প্রায় দেড়শো বাঙালি বস্তি রয়েছে। 

তোতলা তুগলক : আআআবার মুমুমুকে মুমুকে তততকককো ! বারন করেছি না ?

গজনির মামুদ : জানি, পাকিরা গানটাকে বলে কওমি তরানা । হুমায়ুন আজাদের উপন্যাসে পড়েছিলুম কবরের আরামে শুয়ে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কওমি তরানাটা বুঝতে পারি না, তবে গানটা আল-হিন্দের জলন্ধর শহরের কবি হাফিজ জলন্ধরির লেখা !  জনাব গজনির মামুদ, রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ নামে একজন শায়র ধর্মান্ধদের নিয়ে লিখে গেছেন, শোনাচ্ছি আপনাকে :

যেমন রক্তের মধ্যে জন্ম নেয় সোনালি অসুখ

তারপর ফুটে ওঠে ত্বকে মাংসে বীভৎস ক্ষরতা।

জাতির শরীরে আজ তেম্নি দ্যাখো দুরারোগ্য ব্যাধি

ধর্মান্ধ পিশাচ আর পরকাল ব্যবসায়ি রূপে

ক্রমশঃ উঠছে ফুটে ক্ষয়রোগ, রোগেরপ্রকোপ

একদার অন্ধকারে ধর্ম এনে দিয়েছিল আলো,

আজ তার কংকালের হাড় আর পচা মাংসগুলো

ফেরি কোরে ফেরে কিছু স্বার্থাণ্বেষী ফাউল মানুষ-

সৃষ্টির অজানা অংশ পূর্ণ করে গালগল্প দিয়ে।

আফিম তবুও ভালো, ধর্ম সে তো হেমলক বিষ।

ধর্মান্ধের ধর্ম নেই, আছে লোভ, ঘৃণ্য চতুরতা,

মানুষের পৃথিবীকে শত খণ্ডে বিভক্ত করেছে

তারা টিকিয়ে রেখেছে শ্রেণীভেদ ঈশ্বরের নামে।

ঈশ্বরের নামে তারা অনাচার করেছে জায়েজ।

হা অন্ধতা! হা মুর্খামি! কতদূর কোথায় ঈশ্বর!

অজানা শক্তির নামে হত্যাযজ্ঞ কতো রক্তপাত,

কত যে নির্মম ঝড় বয়ে গেল হাজার বছরে!

কোন্ সেই বেহেস্তের হুর আর তহুরা শরাব?

অন্তহীন যৌনাচারে নিমজ্জিত অনন্ত সময়?

যার লোভে মানুষও হয়ে যায় পশুর অধম।

আর কোন দোজখ বা আছে এর চেয়ে ভয়াবহ

ক্ষুধার আগুন সে কি হাবিয়ার চেয়ে খুব কম?

সে কি রৌরবের চেয়ে নম্র কোন নরম আগুন?

ইহকাল ভুলে যারা পরকালে মত্ত হয়ে আছে

চলে যাক সব পরপারে বেহেস্তে তাদের

আমরা থাকবো এই পৃথিবীর মাটি জলে নীলে,

দ্বন্দ্বময় সভ্যতার গতিশীল স্রোতের ধারায়

আগামীর স্বপ্নে মুগ্ধ বুনে যাবো সমতার বীজ

গজনির মামুদ : দারুন লিখেছে । পাক সাদ বাদ আমিও বুঝি না । আমার ভাষা তো তুর্কি আর ফারসি, আল-হিন্দে অনেকে ফারসি জানতো। আপনাদের আল-হিন্দের পতৌদির নবাবও আফগানিস্তান থেকে এসেছিল । ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাহায্যে  পাতৌদি রাজ্যটা গড়া হয়েছিল । মারাঠা সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ইংরেজদের যুদ্ধে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিল  বারাক উপজাতির আফগান  পশতুন । উনি হন প্রথম নবাব  ।  তাঁদের পূর্বপুরুষরা লোদি রাজবংশের সময়ে  আফগানিস্তান থেকে আল-হিন্দে চলে এসেছিল । অষ্টম নবাব ইফতিখার আলী খান পাতৌদি ইংল্যান্ড আর আল-হিন্দ দুদেশের হয়ে ক্রিকেট খেলতো । ওনার ছেলে শেষ নবাবও ভারতীয় ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ছিল । এখন ওরা নবাব নয়, তবুও নিজেদের নবাব বলে বলে নবাবি করে, অঢেল পারিবারিক সম্পত্তির মালিক তো, তাই । মাঝে নিজেদের প্রাসাদকে হোটেল করেছিল, কিন্তু কে-ই বা যাবে অমন জায়গায় থাকতে, উদয়পুর-যোধপুর ছেড়ে ! চলুন, যাওয়া যাক এবার ।

রাগি তুগলক : সব ধর্মের কেন্দ্রেই কতকগুলি স্বকীয় প্রত্যয় বর্তমান, এবং প্রত্যেক বিশেষ বিশেষ ধর্মের অনুরাগীরা দাবি করে থাকেন যে তাদের ধর্মের স্বকীয় প্রত্যয়গুলি অপ্ৰতর্ক, অনপেক্ষ, সর্বজনীন এবং স্বয়ংসিদ্ধ। এই দাবির সমর্থনে কোন যুক্তি প্রমাণ মেলে না; যখন কেউ কেউ যুক্তি খাড়া করবার চেষ্টা করেন, তখন বিশ্লেষণ করলেই চোখে পড়ে তা যুক্তি নয়, যুক্ত্যাভাস মাত্র। তথ্যসংগ্রহ, পরীক্ষা-নিরীক্ষা, আবিষ্কার উদ্ভাবনের সূত্রে বিশ্বজগৎ এবং তার উপাদান ও পৃথিবীর অধিবাসী এবং তাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমাদের জ্ঞান গত তিন চার হাজার বছরের মধ্যে অনেক পরিবর্ধিত এবং পরিশ্রুত হয়েছে। কিন্তু এই বিশ্বজগতের আড়ালে তার স্রষ্টা, শাসক বা নিয়ামক হিসেবে ঈশ্বর আল্লা বা যিহােবা নামে যাকে বিভিন্ন ধর্মে কল্পনা করা হয়েছে তার সম্পর্কে ধর্মবিশ্বাসীদের প্রধান নির্ভর আপ্তবাক্য। শুধু বিনাবিচারে ঈশ্বর, আল্লা বা যিহােবর অস্তিত্ব মেনে নেওয়াই যথেষ্ট নয় ; তারই সঙ্গে ধার্মিকরা দাবি করেন যে বেদ অভ্রান্ত, বা ভগবদগীতা কৃষ্ণরূপী ঈশ্বরের নিজস্ব বাণী, বা যিহােবা মােজেসকে অথবা আল্লা মহম্মদকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর নির্দেশ প্রচারের জন্য, বা যীশু ঈশ্বরের একমাত্র পুত্র, বা চৈতন্য, রামকৃষ্ণ প্রমুখ ব্যক্তি এক-একজন অবতার-পুরুষ ইত্যাদি, ইত্যাদি। এমনকি ঈশ্বর, আল্লা অথবা যিহােবা জাতীয় কাউকে যিনি আত্মসমর্থনে টানেন নি, সেই বুদ্ধ এমন পূর্ণজ্ঞান অর্জন করেছেন বলে দাবি করা হয়ে থাকে যে জ্ঞান প্রশ্নাতীত এবং প্রমাণাতীত।

তোতলা তুগলক : তুতুতুইও গ্যাগ্যাগ্যান দিদিদিচ্ছিস ! 

ল্যাঙড়া তৈমুর : যথার্থ বলেছ জনাব রাগি তুগলক । আমি ধর্মান্ধ ছিলুম না । আক্রমণ করার জন্যে কারণ দরকার তো ? ধর্মকেই কারণ বানিয়েছিলুম । গজনির মামুদটা কিন্তু পাক্কা ধর্মান্ধ ছিল, যদিও আওরঙজেবের মতন জিজিয়া চাপিয়ে দেয়নি। আবদালিটা আবার হাজার-হাজার শিখ কোতল করে ওদের স্বর্ণমন্দির ভেঙে দিয়েছিল। চিনের উইঘুরদের ধর্ম পালটে দিয়েছিল । আসলে আবদালির দুটো কানের লতি কেটে দিয়েছিল নাদির শাহ । বেচারা কানকাটা । এখন চিন ওদের ধরে-ধরে আবার পুরোনো অবস্হায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে । যাকগে, হালাকু আবার কে ?

ঢ্যাঙা তুগলক : আল-হিন্দেও মসজিদ হাপিশ করে রামমন্দির  হচ্ছে । এখনকার পৃথিবীতে আদর্শগত  শূন্যতা বিরাজ করছে এবং পুরোনো পরিত্যক্ত সব সংস্কার-বিশ্বাসের ও ধর্মের পুনরুজ্জীবন ঘটছে। জনগণের জন্য মার্ক্সবাদ, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্রকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলা হয়েছে। ফলে এগুলো আর আদর্শ হিসেবে কার্যকর নেই। এ জন্যই সৃষ্টি হয়েছে আদর্শগত শূন্যতা। আদর্শের অবলম্বন ছাড়া চলমান অপব্যবস্থা, দুর্নীতি, জুলুম-জবরদস্তি ও অসামাজিক কার্যকলাপের মধ্যে মানুষ অসহায় বোধ করছে। আদর্শগত শূন্যতার দিকে দৃষ্টি না দিয়ে কেবল ধর্মের পুনরুজ্জীবন দেখে  অনেকে উদ্বেগের সঙ্গে বলে আসছেন, ইতিহাসের চাকা পেছন দিকে ঘুরছে।

তোতলা তুগলক : নানানাও, এ ব্যাটাতাতাতার মুমুমুমুখে ককককথা ফুফুফুফুটছে ; রারারাজ্য সাসাসাসামলাতে পাপাপারে না !

চেঙ্গিজ খান : আরে ল্যাঙড়া, হালাকু জানিস না ? কেমন আস্তিক তুই ? হালাকু খান আমার ছেলে তোলুইয়ের ছেলে। ওর মা সোরগাগতানি বেকি ছিল একজন প্রভাবশালী কেরাইত শাহজাদি। সোরগাগতানি ছিল একজন নেস্টরিয়ান খ্রিষ্টান। হালাকু খানের বউ দকুজ খাতুন আর ওর ঘনিষ্ট বন্ধু  সেনাপতি কিতবুকাও খ্রিষ্টান ছিল। মারা যাবার আগে হালাকু খান বৌদ্ধ হয়ে গিয়েছিল । বেশ কয়েকটা বৌদ্ধ মন্দির তৈরি করিয়েছিল । হালাকু খানের  তিনটে ছেলে,  আবাকা খান, তাকুদার আর তারাকাই। আবাকা খান  ইরানের দ্বিতীয় ইলখান ছিল। এরপর তাকুদার  ইলখান হয়েছিল। তারাকাইয়ের ছেলে বাইদু তারপর ইলখান হয়েছিল । হালাকু খানের ছেলের বউ আবশ খাতুনও শিরাজ শাসনের দায়িত্ব পেয়েছিল । তাহলে বুঝতেই পারছিস যে খান মানেই একই ধরণের আস্তিকান্তরিত মানুষ নয় । আর কুবলাই খান হল  তলুই আর সরগাগতানি বেকির দ্বিতীয় ছেলে, মানে আমার নাতি । চীনের ইউয়ান রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেছিল আর প্রথম সম্রাট হিসাবে অনেককাল  চীন শাসন করেছিল। কুবলাই খানেরই ভাই হালাকু খান, পারস্য জয় করে  সেখানে ইলখানাত নামে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। বুঝলি তো ? খান মানেই আস্তিকান্তরিত নয় ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আর বাবর ?

চেঙ্গিজ খান : মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর বাবরকে ইনভাইট করেছিস, অথচ বাবরকে চিনিস না ? তোকে সাবধান করে দিচ্ছি, বাবর কিন্তু হোমোসেস্কসুয়াল। নিজের অটোবায়োগ্রাফিতে সেকথা লিখে গেছে । চাঘতাই তুর্কি ভাষায় লেখা । নাতি আকবরের সময় চাঘাতাই তুর্কি ভাষা পড়বার লোক বেশি না থাকায় ও এই বইয়ের ফার্সি অনুবাদ করিয়েছিল।  আবদুর রহিম খান-এ খানান সেই কাজ  করে । এখনকার কফিহাউসের কবি-লেখকদের অটোবায়োগ্রাফিতে অমন স্বীকার করার সাহস নেই । বাবর  নামেই লোকে ওকে বেশি চেনে । বড্ডো গোঁড়া । কাফের, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান আর শিয়াদেরও ঘেন্না করে । জন্মেছিল উজবেকিস্তানে, আসলে উজবেক, অথচ গুলবদন বেগম বাবরকে বানিয়ে দিয়েছে তোর মোঙ্গোল বংশধর। লোকটা  আল-হিন্দ উপমহাদেশে মোগল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা সম্রাট। ও নাকি মায়ের দিক থেকে আমার বংশধর । ওর বাপের নাম মির্জা ওমর সাঈখ বেগ  । পানিপথের  যুদ্ধে দিল্লীর লোদি রাজবংশের সুলতান ইবরাহিম লোদিকে হারিয়ে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল । তার আগে বাবর লাহোর আক্রমণ করে শহরটাকে ফিনিশ করে দিয়েছিল । লোদি ব্যটা জানতে পারেনি ওরই কাকা বাবরকে ইনভাইট করেছিল আল-হিন্দ আক্রমণ করার জন্যে । বাবরের কাছে বন্দুক আর কামান ছিল ; লোদিকে চারিধার থেকে ঘিরে ওর সৈন্যদের কচুকাটা করে ফেললে, ইব্রাহিম লোদির মাথা আলাদা করে দিলে ধড় থেকে । বাবরের হুকুমে লোদির সব সেনার মুণ্ডু ধড় থেকে আলাদা করে মুণ্ডুর পাহাড় তৈরি করে ফেলেছিল।ও সেসব ঘটা করে লিখেছে নিজের আত্মজীবনীতে । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : লোকটার এলেম আছে, বলতে হবে ।

চেঙ্গিজ খান :ফতেপুর সিক্রি আক্রমণ করে ও অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছে, শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি, মুহাম্মদি ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতে, কেটে দু’খানা করতে, যাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।”  বাবর হুকুম দিলে, কাছাকাছি একটা পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে  স্তম্ভ তৈরী করতে। অটোবায়োগ্রাফিতে নিজেই লিখেছে, সেই টিলার ওপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী  ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট আর বায়না যাবার পথেও বহু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।” ইব্রাহিম লোদি হেরে গেল বলে ওকে ধর্মত্যাগী বলা উচিত হয়নি । জিতে গিয়ে বাবর অনেক লোককে ভয় দেখিয়ে আস্তিকান্তরিত করেছিল — তাদের বংশধররা এখন নিজেদের মনে করে খাঁটি আস্তিক । ইতিহাসের খেলা দেখলে ভিরমি খাবি রে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : আমাদের সময়কার যুদ্ধে এই ধরণের ব্যাপার-স্যাপার করা হতো না । আমরা নোটিস দিয়ে শুধু দিনের বেলা যুদ্ধ করতুম । 

চেঙ্গিজ খান : বাবর মারা যাবার পর ওর ছেলে  মির্জা হুমায়ুন সিংহাসন বসলো । আসলে  পানিপথের যুদ্ধে বাবর প্রথম কামানের ব্যবহার করে জিতে গিয়েছিল।  কিন্তু অন্য দেশে গিয়ে সিংহাসন বসবার কী দরকার, তুই বল আমাকে । আমি তো প্রধান মোঙ্গোল রাজনৈতিক-সামরিক নেতা ছিলুম । ইতিহাসও আমাকে একজন বিখ্যাত সেনাধ্যক্ষ আর সেনাপতি বলে। আমি আমার মোঙ্গোল গোষ্ঠীগুলোকে এককাট্টা করে মোঙ্গোল সাম্রাজ্যের  গোড়াপত্তন করেছিলুম। সেটাই ছিল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সম্রাজ্য। জন্মেছিলুম ফালতু বোরজিগিন বংশে। তবে সাধারণ গোত্রপতি থেকে নিজের ক্যারদানিতে বিশাল সেনাবাহিনী তৈরি করেছিলুম। কিছু লোক লিখেছে যে আমি অতি নির্মম আর রক্তপিপাসু ছিলুম ।  মোঙ্গোলিয়ায় কিন্তু তোর চেয়ে বেশি মানুষ আমাকে বিশিষ্ট ব্যক্তি মনে করে, আমাকে মোঙ্গোল জাতির পিতা ঘোষণা করেছে ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : একবার যদি দাগ ইতিহাসে লেগে যায়, তা আর ছাড়ে না । দেখছেন তো আমাকে।

চেঙ্গিজ খান : বাবর মরেছিল ইব্রাহিম লোদির মায়ের দেয়া বিষে । একজন বাঙালি কবি নাকি লিখেছে যে অসুস্হ হুমায়ুনের খাটের চারিধারে, নিরম্বু পাক খেয়ে মরেছিল  বাবর ।

কুরুরাজ ধৃতরাষ্ট্র : কবিরা অমন বানিয়ে-বানিয়ে লেখে, উনি গুলবদন বেগমের হুমায়ুননামা না পড়ে কবিতাটা লিখেছিলেন, সরকারি-বেসরকারি ইনামও পেয়েছেন । দেখছেন তো আমাকে । আমার সম্পর্কে কতো কি বানিয়ে লিখে গেছে ব্যাসদেব নামের এক কবি । যাকগে, আমি চলি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : চেঙ্গিজদা,  তুমি আর তোমার সেনারা যে দেশ দখল করতে সেখানে ধর্ষণ চালাতে । তুমি তো অনেকগুলো বিয়ে করেছিলে, তবু আশ মেটেনি ? সিকন্দর, মানে আলেকজাণ্ডার, তোমার চেয়ে বেশি দেশ দখল করেছিল, কিন্তু ওরা তো অমন পাইকারি ধর্ষণ চালায়নি ।

চেঙ্গিজ খান : করেছে, করেছে । আমি মনে করি কোনো দেশ দখল করার প্রধান অস্ত্র হলো ধর্ষণ । তুই ল্যাঙড়া বলে কম ধর্ষণ করেছিস, জানি । ওই যে, যখন পাকিস্তানিদের থেকে পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে বাংলাদেশ হলো, তখন টিক্কা খানের সেনারা আর রাজাকর, আল বদর, আল শামস, নিশ্চয়ই  যে মেয়েকে সামনে পেয়েছে, তাকে ধর্ষণ করেছে । চল্লিশ বছর বয়সে আমি  মোঙ্গোল জাতির পত্তন ঘটানোর পর বিশ্বজয়ে বের হই। প্রথমেই জিন রাজবংশকে  হারাই । চীন থেকে আমি যুদ্ধবিদ্যা কূটনীতির মৌলিক কিছু শিক্ষা নিয়ে দখল করি পশ্চিম জিয়া, উত্তর চীনের জিন রাজবংশ, পারস্যের খোয়ারিজমীয় সম্রাজ্য আর ইউরেশিয়ার কিছু অংশ। অন্য দেশগুলোর  এখনকার নাম হল গণচীন, মোঙ্গোলিয়া, রাশিয়া, আজারবাইজান, আর্মেনিয়া, জর্জিয়া, ইরাক, ইরান, তুরস্ক, কাজাখস্তান, কিরগিজিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান, আফগানিস্তান, তুর্কমেনিস্তান, দক্ষিণ কোরিয়া, উত্তর কোরিয়া আর কুয়েত। আমি মারা যাওয়ার পর আমার ছেলে আর নাতিপুতিরা দেড়শো বছর  ধরে মোঙ্গোল সম্রাজ্যে রাজত্ব করেছিল। আমরা ধর্ষণ চালাতুম বলে তুই এইসব দেশে আমার মতন কুতকুতে চোখের মানুষ দেখতে পাবি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : কুতকুতে চোখের মেয়েরা সুন্দরী হয় । 

চেঙ্গিজ খান : কফিহাউসে যে-ই আসে, দেখি নিজের ঢোলক পেটায় । কিন্তু আস্তিকান্তরিতের ঢোল পেটাসনি । জানিস আমরা মনে করতুম আকাশের চেয়ে বড়ো কিছু নেই । বব মাস্তান পলাশীতে জেতার পর আল-হিন্দে ওর স্যাঙাত ম্যাকোলে আর পাদ্রিরা এসে খোলনলচে পালটে দিলে । মূলধারার ইংরেজি ভাষার শিক্ষায়  “উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিক্ষার প্রান্তিককরণ” আর প্রথাগত ভারতীয় চিন্তাধারার থেকে সরে যেতে শিক্ষাবিদদের উৎসাহ দেওয়া হলো, আর তাদের মধ্যে “আত্ম-অবজ্ঞার চেতনা” প্ররোচিত করা হলো। বব মাস্তানের লোকেরা  ভারতীয় ঐতিহ্যকে উপড়ে ফেলেছে, আর সেখানে গেড়েছে একটা বিদেশী ব্যবস্থা যা আল-হিন্দে কেউ চাইতো না । এছাড়াও, বব মাস্তানের কারণে বিদেশী চিন্তা পদ্ধতি আল-হিন্দের চিন্তা পদ্ধতিগুলোর চেয়ে অগ্রাধিকার পেয়েছিল। আমি কিন্তু এসব কিছুই করিনি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : নিজের ভালোমানুষীর ঢোল পেটাচ্ছো । আসতে দাও বাদবাকিদের ।

চেঙ্গিজ খান : তুইও পেটা । আমি তো বারণ করিনি । কিন্তু এটা মানতে হবে যে তুই মূর্খ ছিলিস । আমি সারা জীবন নিজেদের ধর্ম শামানে বিশ্বাসী করেছি । শামানরা আকাশ দেবতায় বিশ্বাসী ছিলো।  যখন ঐক্যবদ্ধ মোঙ্গোলিয়ার নেতা নির্বাচিত হই তখন শামান ধর্মের প্রধান পুরোহিত কুকচু ঘোষণা করেছিল যে আকাশের দেবতাদের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী ছিঙ্গিস খাং পুরো পৃথিবী শাসন করার জন্যে এসেছে। বুঝলি ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : কফিহাউসে অনেকে জানে না আমার নাম তৈমুর বিন তারাগাই বারলাস, আর ল্যাঙড়া ল্যাঙড়া বলে ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে । তোমার বংশধররা অক্কা পাবার পর আমি পশ্চিম আর মধ্য এশিয়ার বিশাল এলাকা  দখলে এনে তৈমুরীয় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলুম। লোকে বলত আমি অপরাজেয় সমরবিদ । আমার কারণেই তৈমুরীয় রাজবংশ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। । যুদ্ধ করতে বেরিয়ে  অকেজো পা নিয়ে ঘোড়া হাঁকিয়েছি ।  আমার সাম্রাজ্য ছড়ানো ছিল এখনকার তুরস্ক, সিরিয়া, ইরাক, কুয়েত, ইরান থেকে মধ্য এশিয়ার অধিকাংশ অংশ যার মধ্যে রয়েছে কাজাখস্তান, আফগানিস্তান, রাশিয়া, তুর্কমেনিস্তান, উজবেকিস্তান, কিরগিজিস্তান, পাকিস্তান, ভারতবর্ষ এমনকি চীনের কাশগর পর্যন্ত। তুমি আমাকে বলছ মূর্খ, আমি কিন্তু আত্মজীবনী  রচনা করিয়েছিলুম, ‘তুজুক ই তৈমুরী’ নামে।

চেঙ্গিজ খান : আমি ওসব আত্মজীবনী-টিবনি লেখাইনি ; দরকার হয়নি । ওই তো, বাবর এসে পড়েছে। আল-হিন্দ দখলের আগে ও ভেড়ার চামড়ার শায়া আর বুকে ঘোড়ার চামড়ার মেরজাই পরতো। এখন আল-হিন্দের সিংহাসনে বসে চেহারার খোলতাই হয়েছে দেখছি, সোনার গয়না, মুকুট পরে থাকে । আয় বাবর, বোস, বোস, এই যে ইনি তোর পূর্বপুরুষ ল্যাঙড়া তৈমুর, তোর নামই শোনেনি ।

মির্জা জহিরউদ্দিন মুহাম্মদ বাবর : আরে চেঙ্গিজদাদু, আপনাকে তো জানি ; তৈমুরদাদুকে কে না জানে, আমি তো ওনার বংশধর ! কিন্তু এনারা কে আপনার টেবিলে, চিনতে পারলুম না।

কফিহাউসের যক্ষ : আমি এখানকার বেয়ারা, কফির অর্ডার নিই । বলতে পারেন, আমি কফিহাউসের মেঘ । কর্তব্যে অসাবধানতায় প্রভুর অভিশাপে যক্ষকে কফিহাউসে নির্বাসিত হতে হয়েছে। তাই ওর মাথা খারাপ হয়ে গেছে । এখানে বসে আষাঢ়ের প্রথম দিন নববর্ষায় আমাকে দেখে আমার মাধ্যমে অলকাপুরীর রম্যপ্রাসাদে ওর বিরহী প্রিয়ার উদ্দেশ্যে বার্তা পাঠাবে বলে মনস্থির করেছে। বিরহের আতিশায্যে ও ব্যাটা জড় আর জীবের ভেদাভেদজ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ও জানিয়েছে, কোন কোন নগর, নদী আর পর্বত পেরিয়ে আমাকে অলকায় পৌঁছতে হবে। ওর বর্ণনায় আল-হিন্দের  এক অসামান্য ভৌগোলিক বিবরণ ফুটে উঠেছে, অথচ সুবে-বাংলার বর্ণনা নেই বলে এখানে এসেছি । এরপর আমি কুবেরপুরী অলকা আর ওর বিরহী প্রিয়ার রূপলাবণ্য দেখবো । ও আমাকে অনুরোধ করেছে ওর প্রিয়তমার কাছে ওর কুশল সংবাদ পৌঁছে দিতে ।

মালিক অম্বর : আমি একজন হাবশি যোদ্ধা । আমার নাম মালিক অম্বর । আমি যা-কিছু তৈরি করিয়েছিলুম, সবই আওরঙজেব নিজের নামে করিয়ে নিয়েছে । মোগলদের তো আমি ঢুকতেই দিইনি আমার এলাকায় । আমি মরলুম আর ওরা আমার ছেলেকে ভুলভাল বুঝিয়ে সেঁদিয়ে এলো ।

চেঙ্গিজ খান : ভাগ্যিস তুমি মালিক অম্বর । আরেকজন ছিল মালিক কাফুর । সে লজ্জায় আসবে না । আলাউদ্দিন খলজির সেনাপতি নুসরাত খান মালিক কাফুরকে দাস বাজার থেকে কিনে এনে সুলতানকে উপহার দিয়েছিল । মালিক কাফুর ছিল খোজা। হোমোসেক্সুয়াল সুলতান মালিক কাফুরকে রোজ উপভোগ করতো। সেই তালে কাফুর প্রোমোশান পেয়ে গেল সেনাপতির পদে । আলাউদ্দিন মারা গেলে তার ছেলে শিহাবউদ্দিন ওমরকে তার জায়গায় এক মাস বসিয়ে তার মাকে বিয়ে করে নিয়েছিল কাফুর, লেজিটিমেসি পাবার জন্য । নুনু তো ছিল না। ওই নাম কা ওয়াস্তে বিয়ে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওগুলো পটি পলিটিকস । পলিটিশিয়ানরা অমন করে । ডোন্ট টেক ইট আদারওয়াইজ । এই যে আরেকজন আসছেন।

ইমাদ-উল-মুলক : তৈমুরদাদু, আপনি ইনভাইট করেছিলেন, এলুম, যদিও, পাবলিক আমাকে বলে মুরতাদ নাস্তিক।  আমি তৃতীয় গাজী উদ্দিন খান ফিরোজ জং বা নিজাম শাহাবুদ্দিন মুহম্মদ ফিরোজ খান সিদ্দিকী বায়াফান্দি, আমার লোকেদের কাছে আমি  ইমাদ-উল-মুলক নামে পরিচিত ।  আসামের সুবেদার ছিলুম, জানেন তো । আমাকে পাবলিক মনে করে  একজন প্রকৃত মোগল শাসক  । আমি দ্বিতীয় গাজী উদ্দিন খান ফিরোজ জংয়ের ছেলে আর নিজাম রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নিজাম উল মুলক আসফ জাহের নাতি । পাবলিক বলে আমি নাকি বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব । আমি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় আলমগীরকে খুন করেছিলুম ঠিকই আর  সম্রাট আহমদ শাহ বাহাদুরকে জেলে পুরে অন্ধ করে দিয়েছিলুম । সম্রাটের  পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনের জন্য আমি সুপরিচিত। ইসলামী পন্ডিতরা আর দুররানী সম্রাট আহমদ শাহ আবদালি আমাকে মুরতাদ ঘোষণা করেছিল । তাতে কী ! আমার আব্বা মারা যাবার পরে নবাব সাফদার জঙ্গ আমাকে মীর বখশি, বা কর্মীদের মাইনে দেবার কর্তার  পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছিল আর আমির উল-উমারা, মানে প্রতিভাবানদের অন্যতম, আর ইমাদ উল-মুলক উপাধি দিয়েছিল । আবদালি ব্যাটা ভুলে যায় যে নাদির শাহ ওর কানের লতি কেটে নিয়েছিল ।

খোকা তুগলক : জনাবেআলা,  মুরতাদ মানে কী ?

তোতলা তুগলক : এইটুটূটূটূকু জাজাজানিস না ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মুরতাদ শব্দের শাব্দিক অর্থ হল—- বিমুখ হয়েছে বা ফিরে গিয়েছে এমন। এর মূল মর্ম হল একটিমাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাস ত্যাগ করা বা সেই বিশ্বাসের কোনও মৌলিক  বিধানকে মানতে অস্বীকার করা, কিংবা তার প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করা,  অথবা সেই বিশ্বাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ের অবমাননা করা, যা অন্তরের ভক্তিশূন্যতা ও শ্রদ্ধাহীনতার ইঙ্গিত দেয় । 

কফিহাউসের যক্ষ : আমি বহুকাল যাবত কবি-লেখকদের কফি খাইয়ে আসছি । কাউকে অবমাননা করি না । আমার কিন্তু ক্লিওপেট্রাকে পছন্দ, যদিও উনি অনেক ভগবানে বিশ্বাস করতেন ; আমি তো ওনাকেই ভগবান বলে বিশ্বাস করি । ওনার বাবা মারা যাবার পর উনি দুই ভাই ত্রয়োদশ টলেমি ও চতুর্দশ টলেমির সঙ্গে মিলেমিশে রাজ্য শাসন করতেন।  মিশরীয় ঐতিহ্য অনুসারে উনি তাদের বিয়েও করেছিলেন।  একসময় ক্লিওপেট্রা মিশরের একক শাসক  হন। ফারাও হিসেবে উনি রোমের শাসক  সিজারের সাথে লিভটুগেদার সম্পর্ক গড়েছিলেন, যা মিশরের সিংহাসনে তাঁকে আরও শক্তিশালী করেছিলো। পরবর্তীতে জুলিয়াস সিজারের নামানুসারে ক্লিওপেট্রা তাঁর বড় ছেলের নাম রেখেছিলেন সিজারিয়ান। আমিও সিজারিয়ান হয়ে জন্মেছিলুম স্যার ।

চেঙ্গিজ খান : শুনেছি বটে ওই সুন্দরীর কথা । আমার আগেই উনি মারা গিয়েছিলেন, নয়তো বিয়ে করে মোঙ্গোলিয়ায় এনে আমার সাম্রাজ্যের রানি করতুম । ক্লিওপেট্রা ছিল মুরতাদ, আমিও মুরতাদ, তুমিও মুরতাদ। এই তালে এক রাউণ্ড কফি হয়ে যাক ।

ইমাদ-উল-মুলক : আমি মোটেই মুরতাদ নই । রাজা-মহারাজ-সম্রাটরা যা করে আমিও সেই কাজই করেছি । আহমদ শাহ আবদালির হাতে অনেক সৈন্যসামন্ত ছিল বলে যা ইচ্ছে প্রচার করেছে আর করিয়েছে । ইচ্ছে করলে আমিও দুররানির বিরুদ্ধে একটা বই লিখিয়ে ফেলতে পারতুম । ও তো  শিখ গণহত্যায় কুখ্যাত হয়ে আছে, অমৃতসরে শিখদের পবিত্র স্বর্ণ মন্দিরে হামলা করে সেটা ধ্বংস করে দিয়েছিল । তা ছাড়া  হাজার হাজার শিখকে খুন করে ভেবেছে কয়ামতের দিন ওকে জবাবদিহি করতে হবে না । নিশ্চয়ই জাহান্নমে বসে বিড়ি ফুঁকছে এখন । মেজাজ খারাপ হয়ে গেল এসে । আর কি গ্যাঁজাবো কফিহাউসে বসে ! তার চেয়ে মানে-মানে কেটে পড়ি । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ, যা তুই এখান থেকে ।

স্লাভয় জিজেক : আমি একজন দার্শনিক । সাম্যবাদী দার্শনিক । আজকাল আমিই সবচেয়ে বেশি পপুলার । প্যাঁচালো যুক্তি দিই বলে ছাত্রছাত্রীরা ডক্টরেট করার বিষয় পেয়ে যায় । 

নোবিলিআত্মন : আমি খ্রিস্টান্তরিকতার প্রচারক । ইনফিডেল বা হিদেনদের খ্রিস্টান্তরিত করার জন্য ইটালি থেকে  অনেক হ্যাপা সহ্য করে এদেশে এসেছি। পর্তুগিজরা নাস্তিক ইনফিডেল কাফেরদের ঠিক মতো খ্রিস্টান্তরিত করতে পারছে না বলে আমি ন্যাড়া মাথায় টিকি রেখে গেরুয়া আলখাল্লা পরে, হাতে বেতের লাঠি আর কমণ্ডুলুতে জল নিয়ে হিন্দু সেজেছি । রামায়ণ, মহাভারত, গীতা, চারটে বেদ সবই লুকিয়ে পড়েছি আর সেগুলো থেকে তর্ক দিয়ে ইনফিডেলদের প্রভূ যিশুর আশ্রয়ে নিয়ে আসি। জয় মা তারা, ব্রহ্মময়ী মাগো….!

ভাস্কো দা গামা : আমার নাম ভাস্কো দা গামা : আমি পর্তুগিজ । আমি আল-হিন্দ আবিষ্কার করেছিলুম, যদিও মোগলদের পরে, ইউরোপীয়দের বলবেন না যেন প্লিজ । ওরা জানে আমিই আবিষ্কারক ।  নোবিলিআত্মন যে পর্তুগিজদের কথা বলছে তাদের দেশ থাকে তাড়িয়ে এখানে পাঠানো হয়েছে। ওরা জেল খাটছিল, রেহাই পাবার জন্যে এখানে এসেছে, আটবছর সেনায় থাকতে হবে । অন্যরা ছুতোর, চামার, ভিস্তিঅলা, চাকর, চাকরানির পেটে জন্মানো অভিজাতের বেজন্মা ছেলে, উন্নতি করার জন্য এসেছে । যদি ফিরতে চায় তাহলে জাহাজে খাবার দেয়া হয় বটে কিন্তু জল দেয়া হয় না । তাই কেউ ফিরতে চায় না । ক্রীতদাসী কিনে তাদের বাচ্চার বাপ হয়ে আস্তিকান্তরিতের সংখ্যা বাড়ায় । গরুর মাংস খেলে হিন্দুদের আর শুয়োরের মাংস খেলে মুসলমানদের ধর্ম চলে যায় বলে পর্তুগিজ ছোকরা-গুণ্ডাদের বলা হয়েছে রাতের অন্ধকারে গিয়ে জোর করে খাইয়ে দিতে আর চেঁচামেচি করে পাড়া মাথায় তুলতে। এইভাবে আমরা খ্রিস্টান্তরিতের সংখ্যা অনেক বাড়িয়ে তুলেছি । দেখেছেন তো পুরো গোয়ার পাবলিক এখন ক্যাথলিক ধর্মের আস্তিকতম আস্তিক।

নোবিলিআত্মন : সেনর ভাস্কো, আপনাদের কুকীর্তি এখন সবাই জানে ।

ভাস্কো দা গামা : কোন কুকীর্তির কথা বলছেন ? নাস্তিকদের খ্রিস্টান্তরিত করার জন্য একটু আধটু জোর খাটাতেই হয় । এখন যারা ভোটাভুটির সময়ে পার্টি করে, তারাও তো জুলুমবাজি করে লোকেদের দলে টানে, মেরে-টেরেও ফেলে পাঁচ-দশজনকে।

নোবিলিআত্মন : আপনারা এদেশে এসে গোয়ায় ইনকুইজিশন চাপিয়ে দিয়েছিলেন । হিন্দুদের জীবন একেবারে নরক হয়ে গিয়েছিল–  খ্রিস্টান মিশনারিরা হিন্দুদের নির্দিষ্ট করে গণহত্যা চালাত। পর্তুগিজ মিশনারিরা হিন্দুদের ‘অসভ্য’ ও ‘মূর্খ’ বলত, যারা নাকি রাক্ষসের মত দেখতে কালো মূর্তির পূজা করে ; পর্তুগিজরা হিন্দুদের ধর্ম ত্যাগ করানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছিল আর জোর করে খ্রিস্টধর্ম চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল। গোয়ায় একটা ইনকুইজিশন দপ্তরও গড়ে তোলা হয়েছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল যতটা সম্ভব, তত বেশি হিন্দুদের সঙ্গে বৈষম্যমূলক আচরণ করা। আমি পোপের দেশের মানুষ,অথচ  তা করিনি । ইংরেজ, ফরাসি, ডাচরাও তা করেনি ।

ভাস্কো দা গামা : এদেশে আমরা অনেক কিছু দিয়েছি । ইনকুইজিশনের পাদ্রি আলফোনসোর নামে আম আমরাই দিয়েছি, যা রপ্তানি করে আল-হিন্দে অনেক টাকা আসে ।

মাও জে দং : আমার নাম মাও জে দং । আমি চিনের চেয়ারম্যান । আমি মানুষকে নাস্তিকতম নাস্তিক বানাই, সাকৃতিক বিপ্লব আর লম্বা লাফের সাহায্যে । আপাতত উইঘুর আর তিব্বতিদের নাস্তিকান্তরিত করে তুলছি । উইঘুরদের আস্তিকান্তরিত করেছিল কান-কাটা আহমেদ শাহ আবদালি আর তিব্বতিদের আস্তিকান্তরিত করেছিল অতীশ দীপঙ্কর । তাদের সুসভ্য আধুনিক করার কাজ চলছে ।

বাবর : অমন কাজ করছেন কেন ? আমি তো পেঁদিয়ে আস্তিকান্তরিত করেছি । নইলে কচুকাটা । অবশ্য এই ব্যাপারে বিখ্যাত মানুষ হলো ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি । ইউনিভারসিটিসুদ্দু মানুষকে পুড়িয়ে মেরেছিল ।

মাও জে দং : নাস্তিক্যবাদ বা নিরীশ্বরবাদ বা নাস্তিকতাবাদ একটা দর্শনের নাম যাতে ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বকে স্বীকার করা হয় না এবং সম্পূর্ণ ভৌত এবং প্রাকৃতিক উপায়ে প্রকৃতির ব্যাখ্যা দেয়া হয়। মূলত আস্তিক্যবাদ এর বর্জনকেই নাস্তিক্যবাদ বলা যায়। নাস্তিক্যবাদ বিশ্বাস নয় বরং অবিশ্বাস এবং যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত। বিশ্বাসকে খণ্ডন নয় বরং বিশ্বাসের অনুপস্থিতিই এখানে মুখ্য। শব্দটি সেই সকল মানুষকে নির্দেশ করে যারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব নেই বলে মনে করে এবং প্রচলিত ধর্মগুলোর প্রতি বিশ্বাসকে ভ্রান্ত বলে তারা স্বীকার করে। দিনদিন মুক্ত চিন্তা, সংশয়বাদী চিন্তাধারা আর ধর্মগুলো সমালোচনা বৃদ্ধির সাথে সাথে নাস্তিক্যবাদেরও প্রসার ঘটছে। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সর্বপ্রথম কিছু মানুষ নিজেদের নাস্তিক বলে পরিচয় দেয়়। পশ্চিমের দেশগুলোতে নাস্তিকদের সাধারণ ভাবে ধর্মহীন বা পারলৌকিক বিষয় সমূহে অবিশ্বাসী হিসেবে গণ্য করা হয়। কিছু নাস্তিক ব্যক্তিগতভাবে ধর্মনিরপেক্ষতা,  ধর্মের দর্শন, যুক্তিবাদ, মানবতাবাদ , প্রকৃতিবাদ, বস্তুবাদ ইত্যাদি দর্শনে বিশ্বাস করে। নাস্তিকরা মুলত কোনো বিশেষ মতাদর্শের অনুসারী নয় এবং তারা সকলে বিশেষ কোন আচার অনুষ্ঠানও পালন করে না। অর্থাৎ ব্যক্তিগতভাবে যে কেউ, যেকোনো মতাদর্শের সমর্থক হতে পারে, নাস্তিকদের মিল শুধুমাত্র এক জায়গাতেই, আর তা হল ঈশ্বর বা সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব কে অবিশ্বাস করা। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে আমাদের দেশ চালায় কমিউনিস্ট পার্টি । এখন আর কোনো দেশ সন্দেহ করে না যে আমাদের রাজনৈতিক আর আর্থিক কাঠামোই পৃথিবীতে সর্বশ্রেষ্ঠ। 

বাবর : ঠিক বুঝলুম না, শ্রেষ্ঠ কাঠামো তো জালালুদ্দিন আকবর তৈরি করেছিল ।

মাও জে দং : গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের রাজনীতি সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামোখানা একক কম্যুনিস্ট পার্টি অব চায়না দ্বারা পরিচালিত হয়, যার নেতৃত্বে রয়েছে দলের সাধারণ সম্পাদক। গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের ভেতরে রাজ্যক্ষমতা থাকে কম্যুনিস্ট পার্টি, মন্ত্রি পরিষদ আর তাদের প্রাদেশিক ও স্থানীয় প্রতিনিধিদের হাতে। এখন সারাজীবনের জন্যে বাছাই করা হয়েছে শি জিন পিঙকে । সবচেয়ে শুরুতে ছিলুম আমি । কয়েক দশকে আমেরিকা আমাদের পেছনের সারিতে চলে যাবে ।

চেঙ্গিজ খান : সেদিন খবরের কাগজে পড়ছিলুম, উইঘুর মিয়াঁ-বন্দিদের মুক্তির দাবিতে কবিতা লেখার অপরাধে  প্রখ্যাত হুই মুসলিম কবি কুই চুই হাউজিন  কে গ্রেফতার করেছেন আপনারা ?

মাও জে দং : ফালতু বিতর্ক । আমরা কেবল সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্য এই পদক্ষেপগুলো নিয়েছি ।  জিনজিয়াং প্রদেশের কোনো পুরনো মসজিদ সারাই-টারাই না করে সেই টাকায় পড়াশুনা করানো হয় । নতুন মসজিদ তৈরির খরচ স্কুল খোলায় খরচ করা হয় । আধুনিক স্হাপত্যের আদলে সংস্কার করার পরিকল্পনা  করলে অবশ্য পুরনো মসজিদ সংস্কারের অনুমোদন দেয়া হয় । প্রকাশ্যে ধর্মীয় চেঁচামেচি অনুৎসাহিত করা হয় । নামাজের জন্য মসজিদ নয়, বরং নামাজ  ঘরে পড়ার জন্যে উৎসাহ দেয়া হচ্ছে।  উইঘুর যুবকদের হান মেয়েদের বিয়ে করতে অর্থের অনুদান দেয়া হচ্ছে, কেননা হান মেয়েরা সুন্দরী।   হান ছেলেদের সঙ্গে উইঘুর মেয়েদের  বিয়ে দেয়া হচ্ছে যাতে তারা কমিউনিস্ট চিনের সত্যিকার অধিবাসী হতে পারে । হান ভাষা ইংরেজি ভাষাকে সরিয়ে দেবে কয়েক দশকের মধ্যেই ।

চেঙ্গিজ খান : হ্যাঁ, একথা মানতে হবে যে চিনেরা সুন্দরী হয় ।

মাও জে দং :উইঘুর শহর আর গ্রামের মাদরাসা ও হিফজখানায় আধুনিক শিক্ষা দেয়া হচ্ছে । শিশু-কিশোররা যাতে ধর্মীয় জ্ঞানে সময় নষ্ট না করে তার ব্যবস্হা নেয়া হচ্ছে । তাই আঠারো বছরের নিচে, শিশু-কিশোরদের জন্য ধর্মীয় শিক্ষায় অযথা সময় নষ্ট বন্ধ করা হয়েছে। উইঘুরদের বলা হয়েছে আহমেদ শাহ আবদালির চাপানো তুর্কি ভাষা ও আরবি বর্ণমালা ব্যবহার না করে হান ভাষা শিখতে, যাতে চাকরির সুবিধা হয় । কমপিউটারে হান ভাষা দরকার হয় । আমি মনে করি ধর্মের বাড়াবাড়ি সব দেশে বন্ধ করা উচিত । সমাজতন্ত্র ও কমিউনিজম স্পষ্টতই ধর্মপালনকে নিরুৎসাহিত করে। মার্কস বা লেলিন কখনই ধর্মপালনকে সমর্থন করেননি। ধর্মপালন ভালো নাকি খারাপ, এটা একটা আলাদা বিতর্ক। তবে ধর্মপালন কমিউনিস্ট আদর্শের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। কার্ল মার্কস মনে করতেন, ধর্ম হচ্ছে ‘ক্লাস ডিভাইডেড সোসাইটি’ বা শ্রেণি বিভক্ত সমাজের একটি চেহারা। মার্কস ধর্মকে কর্তৃত্ববাদী শ্রেণির ‘আইডিয়োলজিক্যাল ওয়েপন’ বা ‘মতাদর্শগত অস্ত্র’ বলেছেন । ধর্ম গরিব-দুঃখী ও শোষিতদের ভুল পথে চালিত করে। ধর্ম তাদের বিশ্বাস করতে শেখায় যে, ইহকালের দুর্ভোগ হচ্ছে নিয়তি আর এর উত্তম প্রতিদান তারা পরকালে পাবে। নির্যাতিতদের এমন মনোভাব কর্তৃত্ববাদীদের অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে দেয়। আমাদের দেশে ধর্মের ভড়ং নিষিদ্ধ করা হয়েছে ।

পাগলা তুগলক : স্যার, একটা কথা বলি । আল-হিন্দে মার্ক্সবাদীরাই মার্ক্সবাদের সবচেয়ে বড়ো অপপ্রচারকারী হয়ে দেখা দিয়েছে ; তারা সেই ১৮-১৯ শতকেই আটকে আছে ; তার কারণ তারা মার্ক্সের নয়, লেনিনের আর আপনার ভক্ত । আর স্তালিন যা পেয়েছিলেন লেনিনের কাছ থেকে সেই অর্থনৈতিক মতাদর্শ কমিউনিস্ট দেশগুলোয় কমিনটার্নের মাধ্যমে চাউর করতে চেয়েছিলেন । ট্রটস্কিদের সব কমিউনিস্ট দেশেই খুন করা হয়েছে । মার্ক্স তো খুনোখুনির কথা বলে যাননি যা কাচিনের জঙ্গলে স্তালিন করেছিলেন, আপনি করেছিলেন সাংস্কৃতিক বিপ্লবের নামে, পলপট করেছিলেন দেশের খোলনলচে পালটে ফেলার জন্যে । মার্ক্স বলেছিলেন ডিকটেটরশিপ অফ দি প্রলেতারিয়েতের কথা, কিন্তু তথাকথিত কমিউনিস্ট দেশগুলোয় দেখা দিল এক-একজন মানুষ একনায়ক, যেন প্রলেতারিয়েত বলতে তাকেই বোঝায়, জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তারা ডিকটেটরি করে গেছে ; কুর্সিতে বসে থাকার জন্য নাগরিকদের পেছনে এমন গোয়েন্দা লাগিয়েছিল যে কেউ ভয়ে ট্যাঁ-ফোঁ করতো না ।  প্রমোদ দাশগুপ্ত এই প্রক্রিয়ার শেকড় পশ্চিমবাংলায় পুঁতে গিয়েছিলেন, আর বামপন্হীরা আসন ছাড়ার পর সেই শেকড় থেকে নতুন-নতুন ঝোপঝাড় গজিয়ে চলেছে ।  

তোতলা তুগলক : তোতোতোতোর এই স্বভাভাভাব গেগেগেগেল না । 

মাও জে দং : যা জানো না, সেই বিষয়ে কথা বোলো না । তোমার কাজ কফি খাওয়ানো, সেই কাজই করো।

রাগি তুগলক : এখন তো মার্ক্সবাদ শুনলেই পশ্চিমবাংলার পেটমোটা নাড়ুগোপাল টাইপের নেতাদের মুখ ভেসে ওঠে, গ্রামে তিনতলা আধুনিক বাড়ি, শহরে ছেলের জন্যে নার্সিং হোম, মেয়ের জন্যে ইশকুল করে দিয়েছেন জনগণের গ্যাঁড়ানো টাকায় ; সেই সঙ্গে সাঁইবাড়ি হত্যা, মরিচঝাঁপি গণহত্যা, আনন্দমার্গীদের জ্যান্ত পোড়ানো, নানুর গণহত্যা, নন্দীগ্রাম গণহত্যা আর আরও নানান কেলোর কীর্তি । কিংবা সেই সব গালফুলো নেউলে লেখকদের মুখ ভেসে ওঠে যারা রাতারাতি জার্সি পালটে বামপন্হী শাসকদের লেজ ধরে পুরস্কার বা কুর্সি  হাতিয়ে ফালতু বইকেও বেস্টসেলার করে ফেলেছিল । অথচ মার্ক্সবাদ বলতে যা বোঝায় তার সঙ্গে সংসদীয় গণতন্ত্রের কবলে আটক এই লোকগুলোর রাজনৈতিক কাজকারবারের কোনো সম্পর্ক ছিল  না । সেই কারণেই সম্প্রতি মার্ক্সের দ্বিজন্মশতবার্ষিকীতে, যতোটা বিশ্বকর্মা বা শেতলা পুজো নিয়ে হইচই হলো, মার্ক্সকে নিয়ে বিশেষ তক্কাতক্কি দেখা গেল না । পশ্চিমবাংলার বাঙালির মন থেকে মার্ক্সকে মুছে ফেলতে সবচেয়ে বেশি সাহায্য করেছে সেই লোকগুলো যারা নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে চালাবার চেষ্টা করেছে, যেমন বামপন্হী দলগুলো, যেমন নকশালপন্হী নেতারা, যেমন জঙ্গলে বিপ্লব করার জন্য লুকিয়ে থাকা মাওবাদীরা । 

তোতলা তুগলক : এএএএবার ববববক্তিমে দেয়া ববববন্ধ ককককর দিদিদিকিনি ।

মাও জে দং : মাওবাদী নকশাল নেতারা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল । তবে চারু মজুমদার আসেননি। নকশাল আন্দোলন নিঃসন্দেহে সফল হয়েছিল, কেননা তা নিয়ে অনেক গল্প-উপন্যাস-কবিতা লেখা হয়েছে।  অরুন্ধতী রায়ের বুকার পুরস্কার জয়ী “গড অব স্মল থিংস্” উপন্যাসে একটি চরিত্র নকশাল আন্দোলনে যোগ দেয়। মহাশ্বেতা দেবী তাঁর ‘’’হাজার চুরাশির মা’’’ উপন্যাসে নকশাল আন্দোলন নিয়ে লিখেছেন।  এ উপন্যাসের উপর ভিত্তি করে  ফিল্ম হয়েছে, নাম ছিল “হাজার চুরাশি কি মা”। সমরেশ মজুমদার, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্নর রায় এবং আরও অনেকের উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা রয়েছে। তাছাড়াও মানব চক্রবর্তীর “কুশ” উপন্যাসে নকশাল আন্দোলনের কথা আছে। নকশাল আন্দোলনের প্রভাবে ছোটগল্প, নাটক, গণসংগীত রচিত হয়েছিল যা বাংলার চিন্তাশীল মানুষকে প্রভাবিত করেছিল । রাহুল পুরকায়স্হ নকশাল কবিতার সংকলন সম্পাদনা করেছেন । সাফল্যের জন্যে আর কী চাই! 

শেষ তুগলক : জানি না চারু মজুমদার কেমন করে অনুমান করেছিলেন যে পশ্চিমবাংলায় শিক্ষিত কিশোর-তরুণদের বিপ্লব হলে তা বহুত্ববাদী গোঁড়া-ধর্ম, কট্টর মৌলবাদ, জাতিপ্রথা ও বিচিত্র-বিশ্বাস, ভাষা এবং সংস্কৃতিতে জড়িয়ে থাকা সারা ভারতের জনজীবনে ছড়িয়ে পড়বে ; আপনার  চিনের স্প্রিং থাণ্ডার শুনে অনেকের মতো উনিও রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন, যদিও তার আগেই আপনারা ভারতের আকসাই চিন আর তিব্বত দখল করে নিয়েছিলেন । মাঝখান থেকে উনি পশ্চিমবাংলার কিশোর-তরুণদের ক্রিমি লেয়ারকে লোপাট করতে এমন সাহায্য করলেন যে বাঙালি মধ্যবিত্তের একটা পুরো প্রজন্ম নষ্ট হয়ে গেল । আর পশ্চিমবাংলার পিছিয়ে পড়ার সেটাই প্রধান কারণ । মার্ক্সের চালু করা বামপন্হীদের প্রিয় অভিধা অর্থাৎ প্রলেতারিয়েত আর বুর্জোয়ার মাঝে একটা বিরাট মধ্যবিত্ত বাফার শ্রেণি সব দেশেই গড়ে উঠেছে, যাদের আবির্ভাবের কথা মার্ক্স অনুমান করতে পারেননি, আর তারা বেশিরভাগই, যাকে বলে সার্ভিস ইনডাসট্রি, তা থেকে মোটা টাকা রোজগার করে, নিজেদের শ্রমিক বলে মনে করে না। এদের, যাদের বলা হয় মিলেনিয়াম জেনারেশন, তারা মার্ক্স পড়েনি, পড়ার আগ্রহও নেই। 

তোতলা তুগলক : এএএএরা বাবাবাবারন ককককরলেও শোশোশোনে না ; ততততক্কো ককককররররবেই ।

মাও জে দং : বাঙালিদের কথা আমায় বোলো না । ওরা নিজেদের কমরেড জ্যোতি বসুকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি। জ্যোতি বসু কেরলের লোক হলে, হতে পারতেন । চিনের দিকে তাকিয়ে দ্যাখো, তাহলেই টের পাবে কেন জ্যোতি বসুর প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিল । কেতাবি মার্কসবাদে দেশ চলে না । মার্কসবাদ হলো তরল পদার্থ, পাত্র অনুযায়ী বদলাতে হয় । যেমন কেরলের মোপলারা ধর্ম নিয়ে মেতে রইলো ; ফলে বিদ্রোহ চলে গেল বিপথে।

চেঙ্গিজ খান : মোপলারা কারা কমরেড ?

মাও জে দং: মালাবারের ওয়ালুভানাদ আর এরনাদ তালুক জুড়ে দশ লক্ষ মোপলা চাষি সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করেছিল । ব্রিটিশ সেনাদের যুদ্ধে মোপলারা  জংগলে আশ্রয় নিয়েছিল । ১৮৮৫ সাল নাগাদ দ্বিতীয় মোপলা বিদ্রোহ হয় যা দমন করতে ব্রিটিশ সরকার তিন হাজার সৈন্য আর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করে।  তাদের দমন করা হয় ‘পিটুনি কর’ বসিয়ে ও দ্বীপান্তর পাঠিয়ে। ১৮৯৪ সালে তৃতীয় মোপলা বিদ্রোহ এবং ১৮৯৬ তে চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহ ঘটে। সবকটি বিদ্রোহই  দমন করা হয়। চতুর্থ মোপলা বিদ্রোহে  শাসকগোষ্ঠী জমিদারদের বর্ধিত খাজনা ও মহাজনদের সুদ নিয়ন্ত্রণের করে । অতীতে আরব দেশ থেকে দক্ষিণ ভারতের মালাবার অঞ্চলে মোপলারা বসতি গড়েছিল । তাদের জীবিকা ছিল প্রধানত কৃষিকাজ। জমিদারদের কাছে বর্গাভিত্তিক চাষাবাদ করতো মোপলারা । দুর্ভাগ্যবশত তারা কমিউনিজমকে নিজেদের ধর্মবিরোধী মনে করেছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : কমরেড মাও জে দং, আজিজুল হক কারাগারে আঠেরো বছর বন্দি ছিলেন । তাঁর জীবন কি ব্যর্থ গেল ? উনি বলেছেন, কারাগারে ১৮ বছর বইটা  জেলখানায় বসেই মূলত লিখেছি। লেখাটি যখন পুলিশের মহাফেজখানায় যাবার অপেক্ষায় আমার বিছানার নিচে পড়েছিলো  তখুনি আজকাল পত্রিকার সম্পাদক অশোক দাশগুপ্তের অসাধারণ মেধা আর একঝাঁক করিৎকর্মা সাংবাদিকের সহায়তায় তা জেলখানার ২৪ ফুট দেয়াল টপকে বাইরে বেরিয়ে আসে। খবরের কাগজে ছাপা হতে থাকে। প্রকৃতপক্ষে ৭০ দশকের জেলখানার ছবি জেলবন্দী ছাড়া অন্য মানুষদের বোঝানো প্রায় অসম্ভব। একদিকে অকথ্য দৈহিক নির্যাতন অন্যদিকে তারই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মানসিক নির্যাতন। একইি দিনে সকালে লাঠির বাড়িতে ঘুম ভেঙ্গেছে দুপুরে পচাগলা খাবার, রাতে বিশেষ বিভাগের কর্তাদের মানসিক নির্যাতন। এর সঙ্গেই নিজের কমরেডদের খুন হয়ে যেতে দেখা। সেই দুঃসহ অবস্থার মধ্যে দিয়েই এগিয়েছে আমার জেলখানায় ১৮ বছরের প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, প্রতিটি পৃষ্ঠা। এই বইটিতে আমি চেষ্টা করেছি জেলখানায় রাজনৈতিক বন্দীদের ওপর নির্যাতনের এক প্রমাণ তুলে ধরতে। কারাগারে ১৮ বছর নিয়ে আমাকে বিস্তর আলোচনা সমালোচনা শুনতে হয়েছে। বইয়ের ভূমিকার একটা কথাই ফিরিয়ে বলি, তা হলো এই বইয়ের কাহিনী যে ইতিহাসের তাতে কুশিলব অনেকেই। এই বিশাল সেতু বন্ধনে লেখক হিসেবে আমার ভূমিকা একেবারে কাঠবিড়ালীর। রামলক্ষণ-সীতা আর হনুমানরা ইচ্ছে মতো দাপাদাপি করুন। ইচ্ছে হলে রাক্ষস খোক্কসদের নিমন্ত্রণ করে আনুন। আমি কেবল এক বরফশীতল সময়কেই আমার বইটিতে তুলে ধরতে চেয়েছি।

মাও জে দং : আমি ঠিক বলতে পারব না । শি জিন পিঙ যদি কফিহাউসের আড্ডায় আসে, ওকে জিগ্যেস করতে পারো । আমাদের একটাই দল ছিল, সেটাই আছে এখনও । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওনাদের বহুরৈখিকতা সম্পর্কে বলুন তাহলে ।

ফিরোজাবাদি তুগলক : চারু মজুমদার চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মাও জে দং এর অনুসারী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ভারতের কৃষক আর গরিব মানুষদের মাও জে দং এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে, শ্রেণিশত্রুদের চিহ্নিত করে, তাদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করা দরকার । তার কারণ তারাই সর্বহারা কৃষক শ্রমিকদের শোষণ করে। তিনি নকশালবাড়ি আন্দোলনকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তাঁর লেখার মাধ্যমে। তাঁর বিখ্যাত রচনা হল ‘’’হিস্টরিক এইট ডকুমেন্টস্’’’ বা আট দলিল যা নকশাল মতাদর্শের ভিত্তি।  বিশিষ্ট বামপন্থী বুদ্ধিজীবী সরোজ দত্ত শ্রেণিশত্রু খতমের রাজনীতির পক্ষে একাধিক প্রবন্ধ  নকশালদের মুখপত্র ‘দেশব্রতী’ পত্রিকায় লিখেছিলেন । নকশালপন্থীরা পরবর্তীতে সিপিআই(এম) থেকে বেরিয়ে ‘’’অল ইন্ডিয়া কমিটি অব কমিউনিস্ট রেভুলশনারী’’’(এ আই সি সি সি আর) গঠন করে। ১৯৬৯ সালে এ আই সি সি সি আর থেকে জন্ম নেয় কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী)। আসলে সবকয়টা নকশালবাদী দলেরই উদ্ভব হয়েছে সিপিআই(এম এল) থেকে । তবে “মাওবাদী কমিউনিস্ট সেন্টার্” নামে একটা ভিন্ন মতাদর্শের দল ছিল। তাদের উদ্ভব হয়েছিল “দক্ষিণদেশ গ্রুপ” নামে এক সংগঠন থেকে। পরবর্তীতে তারা “পিপলস ওয়ার গ্রুপ” এর সাথে যুক্ত হয়ে “কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া”(মাওবাদী) গঠন করে। এছাড়া ভিন্ন মতাদর্শের আর একটি দল হল “অন্ধ্র রেভুলশনারী কমিউনিস্টস্” এবং তারা “টি. নাগি রেড্ডি”-র “মাস লাইন” মতবাদের অনুসারী ছিল। 

তোতলা তুগলক : কোকোকোথ্থেকে জাজাজানলি ?

দিল্লিওয়ালা তুগলক : বাকিটা আমি বলছি । ১৯৭০ সালের দিকে এ আন্দোলন অন্তর্দ্বন্দের কারণে কয়েকটি বিরোধী অংশে বিভক্ত হয়ে পড়ে। ১৯৮০ সালের দিকে প্রায় ৩০ টি নকশালবাদী দল সক্রিয় ছিল আর তাদের জনবল ছিল প্রায় ত্রিশ হাজার । এছাড়া অর্ন্তকোন্দলের কারণে আন্দোলনে ছেদ পড়ে। দলের একটি বড় অংশ চারু মজুমদারের নির্দেশিত পথের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ১৯৭১ সালে সিপিআই(এম-এল) ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। চারু মজুমদারের দল থেকে সত্যনারায়ণ সিং বেরিয়ে যান। ১৯৭২ সালে চারু মজুমদার পুলিশের হাতে ধরা পড়েন এবং আলীপুর জেলে মারা যান । তাত্ত্বিক নেতা সরোজ দত্তকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেলে তাঁর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি, সম্ভবত তাঁকে হত্যা করা হয়। পলিটব্যুরোর অন্যতম নেতা সুশীতল রায়চৌধুরী আত্মগোপন থাকা অবস্থায় মারা যান। প্রধান নেতৃবর্গের বড় অংশই জেল বন্দী হন। পরে নকশালপন্থী দল ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্ক্সবাদী-লেনিনবাদী) বহু ধারা-উপধারায় বিভক্ত হয়ে যায়। অনেক বছর পরে অন্যতম প্রধান নেতা কানু সান্যাল ২০১০ সালের ২৩শে মার্চ পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলার নকশালবাড়ী থানার হাতিঘিষা গ্রামের নিজ বাড়িতে গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। 

তোতলা তুগলক : তুতুতুতুইও জাজাজাজানিস ; তাতাতাতাহলে রারারাজ্য সাসাসাসামলাতে পাপাপারলি না কেকেকেন ?

চেঙ্গিজ খান : যাকগে, গম্ভীর আলোচনা বাদ দিন । বাবর, তুই তো খুব ধার্মিক মানুষ । এখনও নেশা-ভাঙ করিস ?

বাবর : আজ্ঞে চেঙ্গিজদাদু, সম্রাট হবার পর ভালো মদ খেয়েছি আর আফিম খেয়েছি । সমরকন্দের মতন মদ আর আফিম আর কোথাও পাওয়া যায় না । আমি উজবেকদের হাতে ওগুলো আনাই । তবে সমকাম ছেড়ে দিয়েছি। আপনি তো জানেন মাত্র বারো বছর বয়সে  প্রথম ক্ষমতা পেয়েছিলুম,  ফরগানার সিংহাসনে বসি । জায়গাটা এখন উজবেকিস্তান হয়ে গেছে । আমার কাকা অনবরত আমায় সিংহাসন থেকে ঢেকলে দেবার চেষ্টা করতেন আর আমার শত্রুও ছিল অনেক । একসময় আমাকে ঢেকলে ফেলে দিতে সফল হন। ফলে জীবনের বেশকিছু সময় আমাকে আশ্রয়হীন আর যাযাবর থাকতে হয়েছিল । এই সময় আমার সঙ্গে শুধুমাত্র  বন্ধু আর চাষিদের যোগাযোগ ছিল। তখনই মদ আর আফিমের নেশা আরম্ভ করি ; আফিম আর চরসের সঙ্গে গুড় মিশিয়ে মাজুন তৈরি করে খাই । মাজুন খেয়ে সমরকন্দের উজবেক শহরে আক্রমণ চালাই আর ফটাফট দখল করে নিই। কিন্তু সঙ্গীসাথিরা কেটে পড়লে আমি সমরকন্দ আর ফেরগনা দুটোই হারাই । তখন নেশার মাত্রা বেড়ে গিয়েছিল। সারা দিনে চার-পাঁচটা মাজুনের মেঠাই খেতুম । আল-হিন্দে ভালো জিনিস কিছুই পাওয়া যায় না, একেবারে বাজে দেশ, নেহাত সিংহাসনটা সহজে পেয়ে গেলুম, নয়তো থাকার মতন জায়গা এটা নয় ।

তোতলা তুগলক : ও বাবাবাবাবা, এএএএ তোতোতো ড্রাগ অ্যাডিডিডিক্ট বাবাবাদশা !

মাও জে দং : কিছু বন্ধু বিশ্বাসঘাতকতা করবেই । মনে রাখবেন । এটা আমার অভিজ্ঞতা ।

চেঙ্গিজ খান : সমরকন্দ তো আমি ধ্বংস করে দিয়েছিলুম । আবার দাঁড়িয়ে গেছে ?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  সমরকন্দকে আমার সাম্রাজ্যের রাজধানী বানিয়ে শহরটার আবার উন্নতি করেছিলুম। কিন্তু আমার আয়েসি বংশধরদের কারণে  সাম্রাজ্যের পতন শুরু হলে উজবেকরা শহরটা দখলে করে নিয়েছিল। উজবেক শাসকেরা  তাদের রাজধানী বোখারায় সরিয়ে নিলে সমরকন্দের গুরুত্ব কমে যায়। কী আর বলব ! আমার বউয়ের নামে বিবি খানম মসজিদ বানিয়েছিলুম দামী পাথর দিয়ে । নকশাটা  আল-হিন্দ থেকে নেয়া । আল-হিন্দ থেকে কারিগর আর পাথর খোদাইকারী নিয়ে গিয়ে মসজিদের গম্বুজের নকশা তৈরি  করিয়েছিলুম । আগে সমরকন্দের প্রায় সমস্ত বাসিন্দা ছিল জরাথ্রুস্টবাদী । এছাড়া অনেক নেস্টোরিয়ান এবং বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীও শহরে বাস করত। সমরকান্দ দখলের পরে আমি শহরের বাসিন্দাদের আস্তিকান্তরিত করেছিলুম । 

চেঙ্গিজ খান : বাবর, তুই তো কড়া মেজাজের আস্তিক । শিয়াদেরও পাত্তা দিস না কেন ? তুই নিজেই ‘তাজুক-ই-বাবুরি’তে  গর্ব করে লিখেছিস যে, যুদ্ধের পরে নাস্তিকদের মাথার খুলি দিয়ে মিনার তৈরি করতে ভালোবাসতিস । আমি কতো কি করেছি কিন্তু অমন কাজ করিনি রে । 

বাবর : শাহ ইসমাইলের পারস্য শিয়া মুসলিমদের একটা অভেদ্য দুর্গে পরিণত হয়েছিল, আর ও  নিজেকে সপ্তম শিয়া ঈমাম  মূসা আল কাজিমের বংশধর হিসেবে দাবি করতে আরম্ভ করেছিল । তথন ওর নামে কয়েন চালু করা হয়েছিল আর মসজিদে খুত্‌বা পড়ার সময়ে ওর নাম নিয়ে পড়া হত। তাই আমি চটে গিয়েছিলুম । আর ছোটোবেলা থেকে শিখেছিলুম যে অবিশ্বাসীদের বিশ্বাসী করে তুলতে হবে, নয়তো নিকেশ করতে হবে । 

খোকা তুগলক : খুতবা কী, জনাবেআলা ?

তোতলা তুগলক : এএএএটুকুও জাজাজাজানিস না ?

বাবর : খুতবা শব্দটা আরবি । খুতবা  হল মসজিদে মুসল্লিদের সামনে প্রদত্ত ধর্মীয় বক্তৃতা। জুমার নামাজ ও দুই ঈদের নামাজে খুতবা পড়া হয়। খুতবা প্রদানকারী ব্যক্তিকে বলা হয় খতিব। সাধারণত খুতবা আরবি ভাষায় পড়া হয়। তবে কিছু জায়গায় লোকাল ভাষায় খুতবা দেয়ার প্রচলন রয়েছে। আমাদের সময়ে শাসকের সার্বভৌমত্বের প্রকাশ হিসেবে খুতবায় তার নাম উচ্চারণ করা হত। 

চেঙ্গিজ খান : নিজেদের মধ্যে অমন ঘেন্নাঘিন্নির যুদ্ধ করে অতো সুন্দর সিরিয়া, ইরাক, লেবানন দেশগুলো পাঁপড়ের মতন গুঁড়িয়ে গেছে । মানুষ নিজের দেশ ছেড়ে ঝূঁকি নিয়ে সমুদ্র পার হয়ে গ্রিকদেশ হয়ে ইউরোপে চলে যাচ্ছে । ইউরোপের মানুষ তাদের চায় না কিন্তু উপায় নেই । নানা জাতির মানুষ ছিল সিরিয়ায়, সিরিয়ান আরব, গ্রীক, আর্মেনিয়ান, আসিরিয়ার, কুর্দি, কার্কাসিয়ান, মানডিয়ান্স আর তুর্কি সহ। ধর্মীয় গোষ্ঠীও ছিল অনেক, যেমন, সুন্নি, খ্রিস্টান, আলাউই, ডুরজ, ইসমাঈল, মান্দিয়া, শিয়া, সালাফি, ইয়াসীদ ও ইহুদিরা। অনেকে ছেলে-ছোকরা ইউরোপে পালাচ্ছে ।

নোবিলিআত্মন : বুঝেছি, আমরা যেমন প্রটেস্ট্যান্টদের নাস্তিক মনে করি । আমি কোনোরকম জোরজুলুম না করে আল-হিন্দের চার হাজার পরিবারকে খ্রিস্টান্তরিত করেছি । এবার টিকি কেটে মাথায় চুল গজিয়ে ফিরে যাচ্ছি ইটালিতে । আমাদের পারিবারিক নীতি অনুযায়ী মিলিটারিতে যোগ দেবো । শুনেছি মুসোলিনি নামে কেউ একজন আসতে চলেছে যে পুরো ইটালির মিলিটারিকে পালটে ফ্যাসিবাদি করে দেবে । আমার নাম আসলে রোবের্তো ডি নোবিলি, পবিত্র রোমান সম্রাট তৃতীয় অট্টোর আমি বংশধর । আসার সময়ে লিবিয়া, লেবানন, ইরাক, সিরিয়ে হয়ে এসেছিলুম । সিরিয়ার আলেপ্পো, দামাসকাস, এমেসা, হোমস, লাতাকিয়া, তারতুস, আসসুয়ায়দা, দেইর এজ-জোর, দারা, ইডলিব শহরগুলোর তুলনা হয় না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : ফ্যাসিবাদ আবার কী জিনিস ?

নোবিলিআত্মন :  মুলত রাষ্ট্রের সব মানুষকে একাত্ন করে  অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। এই কাজে তারা নির্ভর করে  বিশেষ বাহিনী বা গোষ্ঠীর ওপর যারা আগে রাজনৈতিক মাঠে ততটা প্রভাবশালী ছিল না। যাদের এই কাজে সবচেয়ে বড়ো ভূমিকা থাকে তারাই  রাষ্ট্র নেতৃতে অগ্রনী দায়িত্ব নেয়। সেই রাষ্ট্র তখন প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক অত্যাচার, যুদ্ধ ও সাম্রাজ্যবাদকে অনুমোদন দেয় । সেই রাষ্ট্রের মতে নতুনভাবে রাষ্ট্র গঠনের জন্য এগুলো মৌলিক বিষয়। ফ্যাসিবাদী মতাদর্শ অনুযায়ী উচ্চবিত্ত বা প্রভাবশালী রাষ্ট্রের উচিত অন্য দুর্বল বা যাদের অর্থনীতি তেমনটা মজবুত নয় এমন রাষ্ট্র বা জাতিকে দখল করে স্থানচ্যুত করা।  ফ্যাসিবাদীরা নিজেদের জাতি ও সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ মনে করে। বলতে পারেন নতুন ধরণের আস্তিকতা । করোনা ভাইরাস যেমন মানুষকে ভয় দেখিয়ে আস্তিক করে তুলছে, ফ্যাসিবাদ আর সাম্যবাদও তাই ।

ভাস্কো দা গামা : ওহে কফিহাউসে যক্ষ, আমরা ক্রীতদাসদের জব্বর গালাগালি দিতুম ।  তোমাদের এখানকার ভাষায় তেমন শব্দ নেই বুঝি ?

কফিহাউসের যক্ষ : আছে সেনর । ওই যে পিঠখোলা ব্লাউজ আর লাল শাড়ি পরে ফর্সা নারীরা বসে আছেন, দেখুন ওনাদের পিঠে লেখা আছে গুদ, বাঁড়া, ল্যাওড়া, বাঞ্চোৎ, বোকাচোদা…

মাও জেদং : না, না, সাম্যবাদ আর ফ্যাসিবাদ এক নয় ; আর করোনা ভাইরাস আমাদের অবদান নয় ।

স্লাভয় জিজেক : মাও জেদং-এর সঙ্গে আমি একমত নই । কমিউনিজমের মৃত্যু হয়েছে চিনে। মানুষ এমন কোনো প্রজাতি নয়, আর তার গুরুত্বপূর্ণ কোনো অবস্থান নেই। বাকি প্রাণীদের মধ্যে মানুষের শরীরে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ,  এটি অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি প্রাকৃতিক ঘটনা। তবে ভাইরাসের এই মহামারীর আকার ধারণের ক্ষেত্রে দায়ি চিন। সত্যতা গোপনের ফলেই  বড় চেহারা নিয়েছে করোনা সংক্রমণ । কমিউনিজমের মৃত্যু হয়েছে চিনে।

চেঙ্গিজ খান : করোনা আবার কী ব্যাপার ?

স্লাভয় জিজেক : পশুপাখির রোগ যা মানুষের দেহে আশ্রয় নিচ্ছে আর লক্ষ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : পশুদের ধর্ষণ করে ?

নোবিলিআত্মন : না পশুপাখিদের মাংস খেয়ে । চারপায়ে চলাফেরা করে এমন সমস্ত প্রাণী খায় চিনের লোকেরা।

স্লাভয় জিজেক : কমিউনিজমের জয় হবে।

বাবর : মনে পড়েছে । হিউয়েন সাঙ একবার ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে বলেছিল বটে যে আল-হিন্দের লোকেরা কতো বোকা। বাঁদর, হনুমান, কুকুর, বিড়াল, সাপ, কাঠবিড়ালি, বাদুড়, গুবরেপোকা, কাঁকড়াবিছে কিচ্ছু খায় না। আমি তখন বিশ্বাস করিনি ; হালাল করে কেমন করে । এখন তো যা শুনছি করোনাভাইরাসই সাম্যবাদ, সবাইকে সমান চোখে দেখছে।

নোবিলিআত্মন : আমার সঙ্গে ফা হিয়েনের দেখা হয়েছিল । উনি আল-হিন্দ থেকে শেয়াল, ভোঁদড়, চামচিকে, গাধার মাংস আর চামড়া কিনে নিয়ে যাচ্ছিলেন । বললেন, ওই মাংস খেলে তুরীয়ভাব আসে, অথচ আল-হিন্দের মানুষ এতো মূর্খ যে  খায় না । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আরে ! মোটু, তুই ? তাও আবার তোর অম্মিজানকেও সঙ্গে করে এনেছিস ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : শুনলুম, কফিহাউসে আজ তোমাদের মতন দিগগজরা জড়ো হবে, তাই আর নিজেকে সামলাতে পারলুম না, চলে এলুম । অম্মিজানকে নিয়ে এলুম কারণ প্যারিসের গোরস্তানে উনি একা শুয়ে শুয়ে পাগল হয়ে যাবার যোগাড় । গান শোনাই, কতো দিন গাইনি…..কেউ টুসকি মেরে তাল দিও না কিন্তু….

বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো যায়

বাবুল মোরা নৈহর ছুটো যায়

চার কহার মিল, মোরি ডোলিয়া সজাওয়ে

মোরা অপনা বেগানা ছুটো যায় ।

আঙ্গনা তো পর্বত ভয়ো অওর দেহরি ভয়ি বিদেশ

যায়ে বাবুল ঘর আপনো ম্যায় চলি পিয়া কে দেশ

বাবুল মোরা, নৈহর ছুটো যায়…

স্লাভয় জিজেক : একা কেন ? ওনার পাশে তো শুয়ে আছেন জিম মরিসন, এডিথ পিয়াফ, ফ্রেডেরিক শোপাঁ, বেঞ্জামিন ফ্র্যাংকলিনের নাতি, অসকার ওয়াইল্ড, মার্সেল প্রুস্ত, নেপোলিয়ানের অবৈধ ছেলে, আরও কতো বিখ্যাত লোক । তোমার মা মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়ার তো একা অনুভব করার কারণ নেই ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : ব্রিটিশরা যখন আমার লখনউয়ের মসনদ কেড়ে নিয়েছিল তখন একটা বিহিত চাইবার জন্যে অম্মিজান গিয়েছিলেন কুইন ভিক্টোরোয়ার সঙ্গে দেখা করতে । ভাবলেন যে ভিক্টোরিয়াও তো ছেলের মা, ওনার কষ্ট নিশ্চয়ই বুঝবেন । দেখা করে টের পেলেন যে কুইন ভিক্টোরিয়ার কোনো ক্ষমতা নেই বিহিত করার, উনি কেবল নৌকা আর ইংরেজদের বাড়ির কথা আলোচনা করলেন । ব্রিটিশ পার্লামেন্টে দরখাস্ত দিয়েছিলেন অম্মি, তা নাকচ হয়ে গেল কেননা তা বড্ডো রাগ-দেখানো ভাষায় লেখা । তারপর ওরা বলল যে আমার অম্মি যদি ব্রিটিশ পাহারা চান তাহলে ওনাকে ব্রিটিশ নাগরিক হিসাবে ঘোষণা করতে হবে । 

বাবর : তারপর ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : ইংরেজরা আরও চটে গেল যখন মহাবিদ্রোহ আরম্ভ হলো । অম্মিজান মন খারাপ করে ফেরার ব্যবস্হা করে ফেললেন, কিন্তু ওই তুষার-পড়া ঠাণ্ডায় ওনার শরীর এতো খারাপ হয়ে গেল যে প্যারিসে মারা গেলেন । ব্রিটিশরা শবদেহ গোর দেবার কোনো সন্মানজনক ব্যবস্হা করেনি ; যা করার করেছিল তুর্কি আর ইরানের সুলতানরা । আপনি যাদের নাম বললেন তাদের কবর অনেক সুন্দর । আমার অম্মির কবর আপনি খুঁজে পাবেন না ঝোপঝাড়ের মধ্যে । আমার ছোটো ভাই সিকন্দর হাশমত অম্মিজানের সঙ্গে গিয়েছিল, সে তো ইংল্যাণ্ডে মারা গেল, প্যারিসে নিয়ে গিয়ে অম্মিজানের পাশে তাকে কবর দেয়া হলো । সিকন্দর হাশমতের হিন্দু রাজপুত বিবির বাচ্চাটাও মারা গিয়েছিল, তাকে গোর দেয়া হয়েছিল কিলবার্নের গোরস্তানে । আমার ভাগ্য ভালো যে হিন্দুস্তানে মরেছি । সচিন তেন্দুলকর জিন্দাবাদ ।

চেঙ্গিজ খান : তোর বাঁ দিকের মাই বের-করা পোশাক পরার অভ্যাস আজো গেল না । তুই তো নিজের বিরাট একখানা নাম রেখেছিলিস । সেটাও কেড়ে নিয়েছে ফিরিঙ্গিরা ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : চেঙ্গিজদাদু, আমার পুরো নাম আবদুল মুজাফর নাসিরুদ্দিন সিকান্দর জা, বাদশা-ই-আবদুল কাইজার-ই-জামান, সুলতান-ই-আলম ওয়াজিদ আলি শাহ বাদশা । সবই কেড়ে নিয়ে আমাকে আটকে নিয়েছে কলকাতার মেটিয়াবুরুজে, মানে গার্ডেনরিচে । আসলে ইংরেজরা ওদের দেনা না মিটিয়ে আমাকে কয়েদ করলো। পেনশন নিয়ে লখনউতে থাকলেই হতো ।  সাত হাজার সাঙ্গপাঙ্গ এনেছিলুম, কতোজন বিবি ছিল মনে নেই, রাখেলও ছিল অনেকগুলো, কেনাবাঁদি, গোখরো আর কেউটে সাপ, বাঁদর, ভাল্লুক, আঠারো হাজার পায়রা । আমার ‘দরিয়া-ই-তাশশুক’, কিংবা ‘বহার-এ ইশ্ক’ কেউ আর পড়ে না । কফিহাউসে এতো কবি জড়ো হয়, প্রেমের কবিতা লেখে অথচ জানেই না আমি প্রেমকে কতো গুরুত্ব দিয়েছি, যদিও প্রেম আমাকে দিয়েছে গনোরিয়া । হাবশি প্রেমিকা আজায়েব খানুমকে আমার খুবই পছন্দ হতো । কলকাতায় এসে পঞ্চাশটা বিবিকে তালাক দিয়েছি, কেননা খরচে পোষায় না ।

চেঙ্গিজ খান : আর তোর বেগম হজরতমহল ?

ওয়াজেদ আলি শাহ : হজরতমহল লখনউতে থেকে গেল, ব্রিটিশদের সঙ্গে লড়াই করল । এখন যোগী নামে একজন মুখ্যমন্ত্রী হয়েছে অওধে, হয়তো জানে না যে আমি যোগী-মেলা করতুম, যাতে সবাই গেরুয়া পোশাক পরে আসতো । শাসন করার জন্যে একটা ম্যানুয়াল লিখেছিলুম ‘দস্তুর-ই-ওয়াজিদি’ নামে । আমার ভাই সিকন্দর হাসমতের সম্মানে এক জলসার আয়োজন করেছিলুম। আমার লেখা নাটক ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেছিলুম। এই কিস্সাই  প্রথম আধুনিক উর্দু নাটক। কৃষ্ণ ছিল আমার রোল মডেল। যমুনাতীরে পূর্ণিমা রাতে গোপিনীদের সঙ্গে কৃষ্ণের লীলা আমার চিরকালীন অনুপ্রেরণা ছিল। জানেন তো কৃষ্ণের রাসলীলা থেকেই লখনউয়ে ‘রহস’-এর শুরু। আমার রহস আসলে অপেরা, যেখানে আমি ব্রজ অঞ্চলে কৃষ্ণের জীবন নিয়ে প্রচলিত নাচের সঙ্গে নিজের কত্থকের কম্পোজিশন মিলিয়েছিলুম। রহস নাটক হল নৃত্যনাট্য, যেখানে নির্দিষ্ট গল্প থাকত। লখনউয়ে নবাবির সময় আমি মোট চারটে জলসার আয়োজন করেছিলুম, আর মেটিয়াবুরুজে এসে অন্তত তেইশটা ।  মেটিয়াবুরুজে এসে নিয়মিত ‘রাধা কানহাইয়া কা কিস্সা’ মঞ্চস্থ করেছি,  আরও পরিণত। আল-হিন্দে আসার আগে ফিরিঙ্গিগুলো ঠোঁটে চুমু খেতে জানতো না, এতোই অশিক্ষিত লোকগুলো ।

ঢ্যাঙা তুগলক  : আচ্ছা, আপনার বিরিয়ানিতে আলু দেন কেন ? হায়দ্রাবাদের বিরিয়ানিতে তো দেয় না।

তোতলা তুগলক : বারন করলুম, এরা কথা শোনে না ।

ওয়াজিদ আলি শাহ : জানো না বুঝি ? আমার এক ব্যাটা বাবুর্চিকে হায়দ্রাবাদের নিজাম অনেক ঘুষ দিয়ে নিজের সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিল বিরিয়ানি খাবে বলে । ওরা হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আরম্ভ করে দিলে । আমি তাই বাঙালি বিরিয়ানি চালু করে দিলুম । বাঙালিরা আলু খেতে ভালোবাসে । ব্যাস, বাংলার বিরিয়ানি মানে আস্ত একখানা আলু তোমার প্লেটে পড়বে । নিজাম আমার পোলাও, কোর্মা, জর্দালু, রোগনি রোটি, হালিম, রেজালা, শিরমল আর শাহি টুকরার রেসিপিও চুরি করে নিয়ে গেছে ।

মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়া : আসার সময়ে রাস্তায় খুব ভিড় দেখলুম । আজকে তো মহররম নয় ।

ভাস্কো দা গামা : সালমান খান নামে একজন ফিল্মস্টারের ফিল্ম রিলিজ হচ্ছে আজ, তাই ওয়াজিদ আলি শাহের বংশধররা  সালমান খানের পোস্টার নিয়ে নাচতে-নাচতে মিছিল করছে । সালমান খানের মা হিন্দু আর বাবা মুসলমান । প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডেও একই রকম ভিড়ের জমায়েত হয়েছে । ওখানে টিপু সুলতানের বংশধররা থাকে । এখন বেশ গরিব হয়ে গেছে বংশের লোকগুলো, কেউ-কেউ রিকশা চালায় । 

বাবর : ইব্রাহিম লোদি, যে পানিপতের যুদ্ধে আমার কাছে হেরে গিয়েছিল, তার বাবা সিকন্দর লোদির মা হিন্দু ছিল। মানে কাফের ছিল ।  ওর মা ছিল সিরহিন্দের একজন হিন্দু স্যাকরার মেয়ে । সিকন্দর লোদি সেই জন্যে ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্সে ভুগতো, আর হিন্দুদের ওপর অত্যাচার করত। অথচ গুলরুখি ছদ্মনামে সিকান্দার লোদি ফারসি কবিতা চর্চা করত ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : আচ্ছা, আমি চলি । ফিরতে হবে সিবতানাবাদ ইমামবাড়ায় আমার গোরে। অম্মিজানকে  ফেরত গিয়ে গোরে আরাম করতে হবে । শুনে ভালো লাগলো যে মোগলদের আগে থেকেই নবাব-সুলতানরা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করত । আমি সঙ্গে করে অনেক কাফের মেয়েকেও এনেছিলুম । যাদের এনেছিলুম, তাদের বংশধররা এখন খিদিরপুর, মেটেবুরুজ, গার্ডেনরিচ, বটতলা, বাধাবরতলায় রাজত্ব করে।  এখনকার নেতাদের কাছে ওদের খুব নাম ডাক । 

শাহজাহান : তোমার সঙ্গে কাদের এনেছো ?

বাবর : তোর বেগমকে আনতে পারতিস সঙ্গে করে ।

ওয়াজিদ আলি শাহ : জানো না বুঝি ? তোমরা তো অনেক আগে মারা গেছ তাই জানো না । আমার বেগম হজরতমহল আমি কলকাতায় নির্বাসিত হয়ে আসার  পর  অওধের রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব নিয়েছিল। মহাবিদ্রোহের সময় আমার বেগমও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিল। তবে শেষ পর্যন্ত হেরে গিয়ে  নেপালে আশ্রয় নিয়েছিল। কাঠমাণ্ডুতেই মারা গেল । আমার যাওয়া হয়নি । কলকাতা ছেড়ে ইংরেজরা আমাকে কোথ্থাও যেতে দিতে চায়নি । ওর কবর কাঠমান্ডুর একেবারে মাঝখানে জামে মসজিদের কাছে ।

মলিকা কিশওয়ার জনাব-ই আলিয়া : সিকন্দর লোদির মা হিন্দু ছিল ? তাও কোনো রাজকন্যা নয় । গরিব স্যাকরার মেয়ে ! কীক্কাণ্ড !

স্লাভয় জিজেক : আমিও যাই । একটা বিতর্কসভায় অংশ নিতে হবে । এদেশে তো বিনা পয়সায় ইনটারভিউ দিতে হয় ; বক্তৃতা দেবারও টাকা পাওয়া যায় না । লিটল ম্যাগাজিন ছাড়া কেউ আমার আলোচনা করে না ; শুধুমুদু কফিহাউসে বসে গ্যাঁজায় ।

শাহজাহান : আরে, ওয়াজিদ আলি শাহ, তুমি চললে ? আমি কফিহাউসে ঢোকার মুখে শুনলুম, তুমি এসেছো, তাই ওপরে উঠে এলুম । তোমার অবদান তো তুলনাহীন । মোগলরা তোমার কাছে খুবই তুচ্ছ । তোমার মেটিয়াবুরুজের দরবার যন্ত্রসংগীতেও তুলনাহীন। ‘তারিখ-ই-পরিখানা’-য় তুমি লিখেছ,  বিখ্যাত সেতারি কুতুব আলি খানের কাছে সেতার শিখেছিলে । সেনি ঘরানার ওস্তাদ বসত খান মেটিয়াবুরুজে রবাব নিয়ে এসেছিলেন । সুরশৃঙ্গারও তাঁরই আনা, শুনেছি তুমি এই যন্ত্রটাকে পপুলার করেছিলে।  বিখ্যাত বিনকার ও রবাবিয়া কাসিম আলি খান তোমার আসরে আসতেন। তোমার ডাকে কালীপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়  সুরবাহার বাজিয়েছিলেন। তোমার দরবারেই  ওস্তাদ নিয়ামতুল্লা খান আধুনিক সরোদ সৃষ্টি করেন। এগারো বছর উনি তোমার  কাছে ছিলেন। তুমি তবলাকেও এ শহরে জনপ্রিয় করেছো। সানাই, এসরাজের সঙ্গেও জড়িয়ে তোমার নাম। ইউ আর গ্রেট ।

ভাস্কো দা গামা : আর এখন ওনার আর টিপুর বংশধররা বলিউডের গান-বাজনা করে, মাঝরাস্তায় নাচে।  ফিল্মের নায়কদের পোস্টার নিয়ে মিছিল করে । ওনাদের পোস্টার নিয়ে বেরোয় না কেউ ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : শাহবুদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহানদাদা, আপনি যা-যা করে গেছেন তা হাজার বছরের বেশি থাকবে। এখানকার মানুষ মোগলদের মনে রাখবে আপনার জন্যে । আপনি প্রেমিক হিসেবেই জগতজুড়ে খ্যাতি পাবেন।  আচ্ছা, আমি চলি, অম্মিজান, উঠে পড়ো । ওই দেখুন, আওরঙজেব ঢুকছে, নিশ্চয়ই শুনেছে আজকে চেঙ্গিজ খান, ল্যাঙড়া তৈমুর, বাবর সবাই কফিহাউসে জড়ো হবেন জবরদস্ত আড্ডা দেবার জন্য ।  যাকগে, আমি কেটে পড়ি । 

আওরঙজেব : কী রে ওয়াজিদ আলি শাহ, তুই চললি ? যা, যা । এখানে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা নিশ্চয়ই জানেন আমার নাম আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর, বাদশা গাজী, প্রথম আলমগীর । আমি গান-বাজনা একদম পছন্দ করি না, তাই ওয়াজিদ আলি শাহ কেটে পড়ছে । ব্যাটা সোজা জাহান্নমে যাবে । আব্বাহুজুর আবার প্রেমিক ? ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি ওয়াজেদ আলি শাহ । নিজের ভাইদের খুন করা ওনার কাছেই শিখেছিলুম । উনি শাহরিয়ার চাচাকে খুন করেছিলেন । দশ হাজার পর্তুগিজকে কচুকাটা করেছিলেন আর বাদবাকি পর্তুগিজদের আস্তিকান্তরিত করেছিলেন ।

ওয়াজেদ আলি শাহ : আমার সম্পর্কে বলছেন ? জানি, জানি । এখন  হারিয়ে গিয়েছে মেটিয়াবুরুজের সেই গৌরব। আজকের মেটিয়াবুরুজ শুধুই এই শহরের কোণে পড়ে থাকা শিয়াদের থাকার জায়গা। গরিব দর্জিদের কাজের জায়গা। খিদিরপুর ডকের ঠিক পাশে হওয়ায় ক্রিমিনাল এলাকা হিসেবেই কুখ্যাত। এই শহরের অন্য অংশের বাসিন্দারাও ওই অঞ্চলে যাওয়ার কোনও কারণ খুঁজে পায় না। আর আমাকে ?  মনে রেখেছে  শুধু আওধি বিরিয়ানি আর  অসংখ্য বেগমের জন্য। অথচ এই মেটিয়াবুরুজের ভেতরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আমার তৈরি ইতিহাস। নবাবি আমলের কোনো স্থাপত্য বা তার ছিটেফোঁটা কোনো কিছুই আর রাস্তার দু’ধারে চোখে পড়বে না, যদিও মেটিয়াবুরুজকে বলা হতো দ্বিতীয় লখনউ । দূর থেকে ইমামবাড়ার বিশাল ফটক নজরে পড়বে।  ইরান থেকে শিল্পী আনিয়ে  ইমামবাড়া তৈরি করিয়েছিলুম। বিশাল ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলেই প্রথমেই খোলা চত্বর। তারপর খোলা বারান্দা পেরিয়ে ইমামবাড়ার মূল বিল্ডিঙ।বারান্দা পেরিয়ে নামাজঘরে প্রবেশ করলে বাঁ দিকে গ্রিলঘেরা একটি অংশে আমি শুয়ে আছি । মেঝেতে কালো পাথরে আমার কবর  । বাইরে দেয়ালে শ্বেত পাথরে খোদাই করে আমাদের বংশতালিকা টাঙানো। প্রতিবছর আমার মৃত্যুর দিনে অনুষ্ঠান হয়, তখন আমার বংশধররা আসে। 

ভাস্কো দা গামা : ওয়াজিদ আলি শাহ, আপনি শিয়া, তার ওপর হিন্দু দেবতা শ্রীকৃষ্ণের গুণগান করেন, তাই আওরঙজেব আপনাকে পছন্দ করেন না ; আপনাকে নাস্তিক মনে করেন ।

মালিক অম্বর : এই আওরঙজেব লোকটা আমার করা সবকিছু নিজের নামে করে নিয়েছে । খিড়কি শহর তৈরি করেছিলুম আমি,  অথচ এই লোকটা তার নাম অওরঙ্গাবাদ করে নিয়েছে । শহরে জলের ব্যবস্হা করেছিলুম আমি, তাও লোকটা নিজের নামে করে নিয়েছে ।

আওরঙজেব : তুই তো হাবশি, এতো হামবড়াই কেন রে ? পড়তিস ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির পাল্লায়, ঠেলা বুঝতে পারতিস ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজি লোকটা কে ? বাবরও বলছিল একটু আগে।

আওরঙজেব : আরে, উনি আমার হিরো ।  তুর্কি সেনাপতি ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বখতিয়ার খিলজি নালন্দা মহাবিহার পুরো ধ্বংস করে দিয়েছিল ; এই ঘটনা আল-হিন্দে শুধু বৌদ্ধ ধর্মেকে শেষ করে দিয়েছিল।  আল-হিন্দকে দীর্ঘমেয়াদে অজ্ঞানতার অন্ধকারে ছুঁড়ে দেবার নীল নকশা বলা যায়। ইরানের ইতিহাসবিদ মিনহাজ  ‘তাবাকাত-ই-নাসিরি’ বইতে লিখেছেন যে, “হাজার হাজার বৌদ্ধ পুরোহিতকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল কিংবা মাথা কেটে ফেলা হয়; খিলজি এভাবে এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধধর্ম উৎপাটন করে ইসলাম প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে, মহাবিহারের লাইব্রেরিতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে এত পরিমাণ বই ছিল যে তা পুড়তে তিন মাস সময় লেগেছিল”। নালান্দা ছাড়াও বিক্রমশীলা, জগদ্দল, ওদান্তপুর, তক্ষশীলা বৌদ্ধবিহার ছাড়া নদীয়া, গৌড়, লক্ষণাবতীও পুড়িয়ে ছারখার করেছিল। খিলজির সেনাবাহিনী এইসব প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয়, স্থাপনা, মন্দির, লাইব্রেরি, বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আশ্রম ধ্বংস করে পুরোপুরি ধুলোয় মিশিয়ে দেয়, আগুনে পুড়িয়ে দেয়। লোকাল হিন্দু, বৌদ্ধরা প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে হাজারে হাজারে পালিয়ে যায় নেপালে, তিব্বতে, আল-হিন্দের অন্যান্য জায়গায় যে যেমন পেরেছে। যারা পালাতে পারেনি তারা সবাই নির্মমভাবে হত্যার শিকার হয়েছিল বখতিয়ার বাহিনীর তরোয়ালের আঘাতে। 

তোতলা তুগলক : কিকিকিকিছুই বুবুবুবুঝি না ।

মালিক অম্বর : তাহলেই বুঝুন । এরকম একজন লোক ওনার হিরো ।

আওরঙজেব : তুই তো আস্তিক । তাহলে অবজেকশান নিচ্ছিস কেন ? জানিস কি দিল্লীর সাহায্য নিয়ে  বখতিয়ার খলজি তার সেনাবাহিনী বড় করে বাংলায় পৌঁছোয় । বাংলার সেই সময়ের বুড়ো শাসক লক্ষ্মণ সেনের রাজ্য আক্রমণ করে।  মাত্র আঠারো জন  অশ্বারোহী যোদ্ধা  ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে  লক্ষ্মণ সেনের রাজপ্রাসাদে ঢুকে পড়ে। ভোগ বিলাসে মত্ত থাকা লক্ষ্মণ সেন তখন সবে দুপুরের আহার করতে বসেছে, এই সময়ে অতর্কিত আক্রমণে সে কোন রকম বাধা না দিয়েই   পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যায়। ইতিমধ্যেই পৌঁছে যায় তার বাকি সৈন্যরা । গৌড়, লক্ষণাবতী দখল করে বখতিয়ারের সেনাবাহিনী মেতে ওঠে রক্তের হোলি খেলায়। প্রাসাদের  সব পুরুষদের খুন করে, শিশুদের আলাদা করা হয় দাস হিসেবে বেচার জন্য, আর প্রতিটি নারীকে গণধর্ষণ করে । বুঝলি, বোকা মালিক অম্বর,  ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির জন্যেই লক্ষ-লক্ষ বাঙালি আস্তিকান্তরিত হয়েছিল । নইলে আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্র হতে পারতো না ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : একটু আগে  ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মা নামে একজন মহারাজা এসেছিলেন । তিনি জন্মান্ধ । আল-হিন্দে জন্মান্ধ হয়েও যদি মহারাজা হওয়া যায়, তাহলে মোগলরা সম্রাট হবার জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বীদের অন্ধ করে দিত কেন ?

বাবর : ধর্মের নিয়ম, তোমার সময়ে বোধহয় ছিল না । হুমায়ুনকে বলেছিলুম, ভাইদের কোনো ক্ষতি করিসনি । তবু হুমায়ুন সৎভাই কামরান মির্জাকে অন্ধ করে দিয়েছিল । অনেক বউ ছিল কামরানের, গুলরুখ বেগম, মুহতারিমা খানুম, হাজারা বেগম, মিহর আফরোজ বেগা, দৌলত বখত আগাছা, মাহ চুচাক বেগম আর আবদুল্লাহ খান মুঘলের এক বোন; ছেলেপুলেও ছিল । কে জানে তাদের কী হলো শেষমেষ ।

চেঙ্গিজ খান : তুমি এদেশে না আসলে ছেলেটা অন্ধ হতো না, বউগুলোও বেওয়ারিশ হতো না ।

বাবর : আমার রক্তের দোষে শাহ আলমকেও অন্ধ করেছিল রোহিলার শাসক । ইংরেজ গভর্নর ওয়ারেন হেস্টিংস, মোগল বাদশা শাহ আলমকে বাংলার রাজস্বের পরিমাণ দিতে অস্বীকার করেছিল। এই  অবমাননার চেয়েও বেশি অপমান করেছিল  রোহিলা শাসক গোলাম কাদির । লাল কেল্লার দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই গোলাম কাদির শাহ আলমকে তার জায়গায় সিংহাসনে বসিয়ে দিয়েছিল আরেকজন রাজপুত্রকে। শাহ আলমের ছেলে আর নাতিসহ রাজকীয় রক্তের রাজকুমারীদের ছেঁড়া পোশাক পরে রোহিলার সেনাদের সামনে নাচতে বাধ্য করা হয়েছিল । সম্রাট শাহ আলমের হারেমের মেয়েদের ছিনতাই করা হয়েছিল, আর ধর্ষণ করা হয়েছিল । মালিকা-ই-জামানী, আগের সম্রাটের এক প্রবীণ বিধবা, তাকে গরম রোদে ল্যাঙটো করে দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছিল। রোহিলা ব্যাটা শাহ আলমের বুকে  চেপে বসে,দুটো  চোখ ছুরি দিয়ে উপড়ে অন্ধ করে দিয়েছিল । তবে এই কাজটা রোহিলার জন্য ছিল মৃত্যুদণ্ডের শামিল । মারাঠা সেনাপতি, মহাদজি সিন্ধিয়া  বিশাল বাহিনী দিল্লিতে নিয়ে গিয়েছিলেন ।  গোলাম কাদির পালাতে গিয়ে খুব শীঘ্রই  মথুরায় বন্দি হল। একটা খাঁচায় ঢুকিয়ে, তার কান, নাক, ঠোঁট আর পা কেটে ফেলা হয়েছিল । শেষে, শাহ আলম, যার রাজত্বকালে মোগলরা তাদের চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকার হারিয়েছিল, গোলাম কাদিরের চোখের মণিসুদ্দু  সর্বশেষ উপহার পেলো। 

জাঁ দুভাল : আপনাদের টেবিলে কোনও মহিলা নেই, তবুও এলুম ; হাবশিদের সম্পর্কে অবমাননাকর কথা বলছেন দেখে আর সইতে পারলুম না ।

চেঙ্গিজ খান : কিন্তু তুমি কে ? আগে তো চোখে পড়োনি ? 

শাহজাহান : উনি তো বিখ্যাত একজন প্রেমিকা, জানেন না ওনাকে ? শার্ল বোদলেয়ার ওনার চুল নিয়ে একখানা দারুন প্রেমের কবিতা লিখে গেছেন ।

বাবর : চুল নিয়ে ? কোথাকার চুল ?

শাহজাহান : আমি বালের কথা বলছি না সম্রাটদাদু । আমি মাথার চুলের কথা বলছি । তবে পুরন্দর ভাট নামে আল-হিন্দের এক বিখ্যাত কবি  বাল নিয়ে কবিতা লিখেছেন, যেমন .

 “এবে শোন শালা পুলিশ পুঙ্গব

আঁটি-বাঁধা কোঁকড়ার ঝাঁট

মোরা তোরে ডরাই থোড়াই

বলে কবি পুরন্দর ভাট”

বাবর : দারুন লিখেছে ।

শাহজাহান : বাল নিয়ে পুরন্দর ভাটের আরও কবিতা শোনাই, বাল নিয়ে, শুনুন—

. “ঘনাইছে মহাকাল

চুল,… বলো বাংলায়

হিন্দিতে হল বাল… ।

রান্নাঘরের ধনে

হিন্দিতে ধনিয়া

কত ধানে কত চাল

বোঝো ঢনঢনিয়া।”

বাবর : দারুন লিখেছে । শাহি তিজোরি খালি করে ইনাম দিয়ে দাও ।

ভাস্কো দা গামা : হাবশিদের বালও দারুণ হয় । যেমন ওদের মাথার চুল, তেমনই ওদের বাল । আরব কাস্টমাররা তো বালের জন্যে ওদের ধরে আনতে বলতো । তবে আপনি নাস্তিককে আস্তিকান্তরিত করার পরও তার বাল একই থাকে । পুরন্দর ভাট বোধহয় হাবশিদের আর মোগল বেগমদের বাল দেখার সুযোগ পাননি। আঠারো শতকে সারাহ বার্টম্যান নামে বাইশ বছরের এক হাবশি যুবতীকে আফরিকা থেকে কিনে ইউরোপে নিয়ে গিয়ে হটেনটট ভেনাস নাম দিয়ে এগজিবিশান করেছিল, তা জানেন কি ? চার ফিট লম্বা মেয়েটার পোঁদ তানপুরার চেয়েও অনেক উঁচু ছিল, কোঁচকানো বালে ঢাকা যোনিও বড়ো, আর মাইও বিশাল মাপের । ইউরোপীয়রা অমন পোঁদ, যোনি আর মাই আগে কখনও দ্যাখেনি । প্রায়-উলঙ্গ মেয়েটাকে দেখার জন্যে লাইন লেগে যেতো। হেনড্রিক সিজারস আর আলেকজান্ডার ডানলপ বার্টম্যানকে আফরিকা থেকে লন্ডনে নিয়ে আসে।   সারাহ বার্টম্যানকে , হেনড্রিক সিজারস আর আলেকজান্ডার ডানলপ অবৈধভাবে এনেছিল দুটো আফ্রিকান  ছেলের সঙ্গে, সম্ভবত কেপটাউনের দাস-বাজার থেকে । এগজিবিশান করে টাকা রোজগার করতো ওরা । তারপর ডানলপ পিক্যাডিলি সার্কাসের মিশরীয় হলে বার্টম্যানের এগজিবিশান করেছিল । ডানলপ ভেবেছিল যে লন্ডনবাসীদের অমন পোঁদ আর মাইয়ের আফ্রিকান যুবতীদের সাথে পরিচিতি না থাকায় এবং বার্টম্যানের  বড় বড় নিতম্বের কারণে ও অঢেল টাকা রোজগার   করতে পারবে, করেওছিল । লোকেরা মেয়েটাকে দেখতে যেতো মানুষ  হিসাবে নয়, বরং প্রাকৃতিক বিশ্বের এক অংশের অদ্ভুত যৌন উদাহরণ হিসেবে।

চেঙ্গিজ খান : সত্যি ?

ভাস্কো দা গামা : হ্যাঁ । ১৮১৫ সালে সারা বার্টম্যান মারা যায়, তবে তার বডির এগজিবিশান  অব্যাহত ছিল। তার মস্তিষ্ক, কঙ্কাল আর যৌনাঙ্গ ১৯৭৪ সাল পর্যন্ত প্যারিসের যাদুঘরে প্রদর্শিত হতো । বেঁচে থাকতে তাকে ইউরোপে নানা জায়গায় -হাফ-উলঙ্গ প্যারেড করানো হয়েছিল, তার বিশাল পাছা দেখার জন্য জনতার ভিড় জমে যেতো । আজ তাকে বহু লোক ঔপনিবেশিক শোষণ আর বর্ণবাদ, কৃষ্ণাঙ্গদের উপহাস এবং পণ্যদ্রব্য উপস্থাপক হিসাবে দেখে । তার সঙ্গে অনেকে যৌন সম্পর্ক করে থাকবে, কেননা মেয়েটি সিফিলিসে মারা গিয়েছিল ।

শাহজাহান : জাঁ দুভালবেগম , তুমি চুলের কবিতাটা শোনাও । আমার দরবারে কতো কবি ছিল, কেউ কখনও বাল আর চুল নিয়ে কবিতা লেখেনি ।

চেঙ্গিজ খান : আরে, ওই তো ভাইপো আকবর, বালের শায়রি শুনছিলিস ! সঙ্গে ওই মেয়েটা কে ?

রূপমতি : আমার নাম রূপমতি । প্রেমিকের জন্যে আমি জীবন দিয়েছি । প্রেম নিয়ে কথা হচ্ছে দেখে আর জাঁ দুভালকে এই টেবিলে দেখে, এলুম ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আচ্ছা, প্রেম নিয়ে এতো কথা হচ্ছে, কিন্তু ব্যাপারটা কী ? কী করে প্রেম দিয়ে ? তার সঙ্গে বালের আর চুলের কী সম্পর্ক ।  

জাঁ দুভাল : আমার প্রেমিক শার্ল বোদলেয়ারের প্রেম । উনি শায়র ছিলেন । আমার চুল নিয়ে কবিতা লিখেছেন ।

শাহজাহান : আমি শোনাচ্ছি শায়রিটা, খুবই উমদা, দিল খুশ হয়ে যাবে ।

“আমাকে তোমার চুলের দীর্ঘ, দীর্ঘ সুগন্ধ নিতে দাও, ঝর্ণার জলে পিপাসার্তের মতন আমার মুখকে সম্পূর্ণ ডুবে জেতে দাও, সুবাসিত রুমালের মতন হাতে নিয়ে খেলতে দাও, বাতাসে স্মৃতিকে উড়িয়ে দিতে দাও ।

আমি যাকিছু দেখি তা তুমি যদি জানতে — যাকিছু আমি অনুভব করি — তোমার চুলে যাকিছু আমি শুনতে পাই ! অন্য লোকেদের আত্মা সঙ্গীতের প্রভাবে যেমন ভ্রমণে বেরোয় তেমনই আমার আত্মা ভ্রমণে বেরোয় এই সুগন্ধে।তোমার চুলে রয়েছে একটি পুরো স্বপ্ন, পাল আর মাস্তুলসহ ; তাতে রয়েছে বিশাল সমুদ্র, যেখানে অগুনতি মৌসুমীবায়ু আমাকে বয়ে নিয়ে যায় মোহিনী আবহাওয়ায়, যেখানে আকাশ আরও নীল আর আরও নিগূঢ়, যেখানে বাতাবরণকে সুগন্ধিত করে তুলেছে ফল, পাতা, আর মানুষের ত্বক।

তোমার চুলের সাগরে, আমি দেখতে পাই দুঃখী গানে সমাহিত বন্দর, সব কয়টি দেশের কর্মঠ মানুষ সেখানে, যতো রকম হতে পারে ততো ধরণের জাহাজ, বিশাল আকাশের অলস শাশ্বত তাপের পৃষ্ঠভূমিতে তাদের স্হাপত্য দিয়ে দিগন্তকে তনূকৃত ও জটিল করে তুলেছে।

তোমার চুলের সোহাগস্পর্শে আমি কাউচে শুয়ে কাটানো দীর্ঘ ধীরুজ সময়কে ফিরে পাই, সুন্দর জাহাজের একটি ঘরে, বন্দরের অনির্ণেয় ঢেউয়ের দ্বারা ক্রমান্বয়ে দোল খাওয়া, তাজা জলের জালা আর ফুলের টবের মাঝে ।

আগুনের পাশে রাখা কম্বলের মতন তোমার চুলে, আমি আফিম আর চিনির সঙ্গে মেশানো তামাকের শ্বাস নিই ; তোমার চুলের রাত্রিতে, আমি দেখতে পাই অসীম ক্রান্তিবৃত্তের নীলাভ ঔজ্বল্য; তোমার চুলের ঢালের কিনারায়, আমি আলকাৎরা, মৃগনাভি আর নারিকেল তেলের গন্ধে মাতাল হয়ে যেতে থেকি ।

আমাকে একটু-একটু করে খেয়ে ফেলতে থাকে তোমার তন্দ্রাতুর কালো বিনুনি । যখন তোমার স্হিতিস্হাপক, দ্রোহী চুল আমি চিবোতে থাকি, আমার মনে হয় আমি স্মৃতিগুলো খেয়ে ফেলছি।”

বাবর : দারুন লিখেছে । আমিও চুল ভালোবাসতুম । যে বেগমের যতো চুল ততো সে চুলবুলি !

ল্যাঙড়া তৈমুর : কিন্তু প্রেম ব্যাপারটা খোলসা করলে না তো ?

জাঁ দুভাল : প্রেম হল ভালোবাসার সাথে সম্পর্কিত একটি উত্তেজনাপূর্ণ, যৌনতাপূর্ণ এবং রহস্যময় অনুভূতি। এটি হল কোন ব্যক্তির প্রতি যৌন আকর্ষণের সাথে সম্পর্কিত কোন আবেগীয় আকর্ষণ হতে উদ্বুদ্ধ একটি বহিঃপ্রকাশমূলক ও আনন্দঘন অনুভূতি। গ্রিক চারটি আকর্ষণের মধ্যে এটি আগেপ, ফিলিয়া কিংবা স্টরজ-এর তুলনায় ইরোসের সঙ্গে অধিক সামঞ্জস্যপূর্ণ। মনোবিজ্ঞানী চার্লস লিন্ডহোমের সংজ্ঞানুযায়ী প্রেম হল এক প্রবল আকর্ষণ যা কোন যৌন-আবেদনময় দৃষ্টিকোণ হতে কাউকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরে, এবং যাতে তা ভবিষ্যতে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার মনোবাসনাও অন্তর্ভুক্ত থাকে। কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে এতে অপর ব্যক্তির প্রতি একইসাথে শক্তিশালী মানসিক এবং যৌন আকর্ষণ কাজ করে। প্রেমের সম্পর্কে যৌনতার তুলনায় ব্যক্তিগত আবেগ-অনুভূতি অধিক গুরুত্বের অধিকারী হয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্পর্কসমূহের সূচনাপর্বে প্রেমের অনুভূতি অধিকতর দৃঢ়ভাবে কাজ করে। তখন এর সঙ্গে এমন এক অনিশ্চয়তা এবং দুশ্চিন্তা অনুভূত হয়  যে এ ভালোবাসা হয়তো আর কখনো ফিরে নাও আসতে পারে।

তোতলা তুগলক : বুবুবুবুঝতে পাপাপারলুম না কিকিকিকিছুই ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওহ, আমার তো এরকম হয়নি, তাই জানি না । রোজই তো আলাদা একটা মেয়ের সঙ্গে শুয়েছি। একজনের সঙ্গে দিনের পর দিন চালিয়ে যাওয়াটা আমার পক্ষে সম্ভব ছিল না, কেমন যেন রেশনকার্ড নিয়ে রেশন তোলার মতন একঘেয়ে । যৌনতা ব্যাপারটা খোলোসা করলে ভালো হতো, জাঁ দুভালবেগম ।

জাঁ দুভাল : যৌনসঙ্গম, মানে যৌনমিলন, সঙ্গম, মৈথুন, রতিক্রিয়া, রতিমিলন; যৌন সংসর্গ, যৌন সহবাস, সহবাস এটসেটরা হলো একটি জৈবিক প্রক্রিয়া যা দ্বারা মূলত যৌনআনন্দ বা প্রজনন বা উভয় ক্রিয়ার জন্য একজন পুরুষের উত্থিত শিশ্ন একজন নারীর যোনিপথে অনুপ্রবেশ করানো ও সঞ্চালনা করাকে বোঝায়। অন্যান্য অন্তর্ভেদী যৌনসঙ্গমের মধ্যে রয়েছে পায়ুসঙ্গম, মানে লিঙ্গ দ্বারা মলদ্বারে অনুপ্রবেশ, মুখমৈথুন, অঙ্গুলিসঞ্চালন , মানে আঙ্গুল দ্বারা যৌন অনুপ্রবেশ, যৌনখেলনা ব্যবহার দ্বারা অনুপ্রবেশ, মানে বন্ধনীযুক্ত কৃত্রিম শিশ্ন । এই সব কাজকারবার মানুষেরা দুই বা তার বেশিজনের মধ্যে শারীরিক ও মানসিক অন্তরঙ্গতা জনিত পরিতোষ লাভের জন্য এবং সাধারণত মানব বন্ধনে ভূমিকা রাখতে সম্পাদিত হয়ে থাকে। যৌনসঙ্গম বা অপরাপর যৌনকর্ম কীভাবে সংজ্ঞায়িত হয় তা নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে, যা যৌনস্বাস্থ্য বিষয়ক দৃষ্টিভঙ্গিগুলোর উপর প্রভাব রাখতে পারে। যদিও যৌনসঙ্গম, নির্দিষ্টভাবে মৈথুন বলতে সাধারণত শিশ্ন-জরায়ুজ অনুপ্রবেশ ও সন্তান উৎপাদনের সম্ভাব্যতাকে নির্দেশ করা হয়, এর দ্বারা সাধারণভাবে অন্তর্ভেদী মুখমৈথুন ও বিশেষত শিশ্ন-পায়ুজ সঙ্গমকেও নির্দেশ করা হয়। এটি সাধারণত যৌন অনুপ্রবেশকে নির্দেশ করে, যেখানে অননুপ্রবেশকারী যৌনতাকে “বহির্সঙ্গম” নামে নামকরণ করা হয়, কিন্তু অনুপ্রবেশকারী যৌনকর্মকে যৌনসঙ্গম হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে। 

বাবর : আরে জাঁ দুভালবেগম ! পায়ুসঙ্গম তো আমি অনেক করতুম । অটোবায়োগ্রাফিতে লিখেছি ।

জাঁ দুভাল : আরও আছে, শুনুন । যৌনতা বা ইংরেজি ভাষায় সেক্স, প্রায়শই যৌনসঙ্গমের একটি সংক্ষিপ্ত ব্যবহৃত রূপ, যা দ্বারা যে কোন প্রকারের যৌনক্রিয়াকে বোঝানো হতে পারে। যেহেতু এসকল যৌনকর্মের সময়ে মানুষ যৌনবাহিত সংক্রমণের সংস্পর্শের ঝুঁকিতে থাকতে পারে, নিরাপদ যৌনচর্চার পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে, যদিও অনাভেদী যৌনতায় সংক্রমণ ঝুঁকি উল্লেখযোগ্যহারে হ্রাস পেয়ে থাকে।বিভিন্ন আইনি বিধিমালা যৌনসঙ্গমের সামাজিক অনুমতিপ্রদানের জন্য বিভিন্ন আইন ও রীতিনীতির মাধ্যমে বৈবাহিক রীতির প্রবর্তন, প্রচলন ও সমর্থন করেছে এবং বেশ কিছু যৌনকর্মের বিপরীতে নিষেধাজ্ঞামূলক আইনকে স্থান দিয়েছে, যেমন বিবাহপূর্ব ব্যভিচার ও বিবাহপরবর্তী পরকীয়া, পায়ুকাম, পশুকাম, ধর্ষণ, পতিতাবৃত্তি, অপ্রাপ্তবয়স্কের সঙ্গে যৌনচর্চা ও অজাচার। ধর্মীয় বিশ্বাসও যৌনসঙ্গমসহ অন্যান্য যৌনাচার বিষয়ক ব্যক্তিগত সিদ্ধান্তে অন্যতম ভূমিকা পালন করে, যেমন কুমারীত্ব বিষয়ক সিদ্ধান্ত, অথবা আইনি বা সরকারী নীতিমালা সম্পর্কিত বিষয়াবলি। বিভিন্ন ধর্মভেদে ও একই ধর্মের বিভিন্ন বর্গভেদে যৌনতা সম্পর্কিত ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গিতে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য পরিলক্ষিত হলেও কিছু বিষয়ে অভিন্নতা রয়েছে, যেমন ব্যভিচারের নিষেধাজ্ঞা।   

পাগলা তুগলক : কারেক্ট, আই অ্যাগ্রি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : একটু আগে ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মা নামে একজন জন্মান্ধ মহারাজা এসেছিলেন । ওনার যৌন অভিজ্ঞতা থেকে যা বুঝলুম, অন্ধ হলেও যৌনসঙ্গম করতে অসুবিধে হয় না । ওনার বউ গান্ধারী যখন প্রেগনেন্ট তখন  ওনার সেবা করত একজন চাকরানি।  তার ছোঁয়ায় ওনার সেক্স চাগিয়ে ওঠে আর সেই  চাকরানিকে জড়িয়ে ধরেন। তারপর গান্ধারীর অনুপস্থিতির সুযোগ নিয়ে চাকরানির সঙ্গে সেক্স করেন। এই সেক্সের ফলে চাকরানিও গর্ভবতী হয়। চাকরানির গর্ভে মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মার ঔরসে যুযুৎসুর জন্ম হয়। মহারাজা ধৃতরাষ্ট্রদেব শর্মার এলেম ছিল বলতে হবে ; একরাতের কাজেই প্রেগনেন্ট করে দিলেন । এখনকার ছোঁড়াছুঁড়িরা আইভিএফ করে বাচ্চা পাবার জন্যে কত্তো খরচ করে ।

জাঁ দুভাল : ওনাদের সময়ে তো যৌনরোগের ভয় ছিল না ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : যাক বাবা, আমাদের সময়ে রোগবালাই ছিল না । তোমার ছিল নাকি ? 

জাঁ দুভাল : হ্যাঁ, আমার হয়েছিল বোদলেয়ারের সিফিলিস আর গনোরিয়া থেকে, ও একগাদা মেয়ের সঙ্গে শুতো । অথচ ও আমাকেই দোষ দিয়ে বলতো যে আমি অনেকের সঙ্গে শুয়ে ওকে রোগটা ধরিয়েছি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : এখন আর চিন্তা কীসের : এখন তো দুজনেই মরে অমর হয়ে গেছো ।

জাঁ দুভাল : আজকাল অনেকে যৌনরোগ বাধিয়ে অমর হয়েছে । আজ্ঞে হ্যাঁ, অনেকেই যৌনরোগের জন্যে বিখ্যাত । এক নম্বর জেসিকা অ্যালবা, এই সুন্দরী হলিউড তারকার জেনাইটাল হারপিস রয়েছে যা তাঁর শরীরে সংক্রামিত হয় পার্টনার ডেরেক জেটারের থেকে। মারায়া ক্যারি, স্কারলেট জোহানসন থেকে শুরু করে হলিউডের বহু বিখ্যাত মহিলার শরীরেই যৌনরোগ সংক্রামিত করেছেন ডেরেক। দুনম্বর ভিক্টোরিয়া বেকহ্যাম, ডেভিড বেকহ্যামের পত্নী ও আক্রান্ত হার্পিসে। শোনা যায় অতীতের রকস্টার ভিক্টোরিয়া অনুগামীদের সঙ্গে যৌন মেলামেশা করেই এই রোগ ডেকে এনেছেন শরীরে।তিন নম্বর পল গগ্যাঁ, অবাধ যৌন সংসর্গ করে শেষমেশ সিফিলিসে মারা গিয়েছিলেন মাস্টার পেইন্টার পল গগ্যাঁ।চার নম্বর প্যারিস হিলটন, সুন্দরীর লাগামছাড়া জীবন তাঁর শরীরে হার্পিস সংক্রমণের কারণ। এর জন্য হিলটনদের উইল থেকে বাদ পড়েছে তাঁর নাম। পাঁচ নম্বর রবিন উইলিয়ামস, এই প্রয়াত হলিউড অভিনেতা অল্প বয়সে প্রোটেকশন ছাড়াই বহু যৌন সংসর্গ করতেন। ওঁর বিরুদ্ধে জেনাইটাল হার্পিস সংক্রমণের অভিযোগ আনেন এক মহিলা যার মীমাংসা হয় আদালতের বাইরে। ছয় নম্বর আর্থার অ্যাশ, টেনিস কিংবদন্তি আর্থার অ্যাশ মারা গিয়েছিলেন এইডসে। একবার অসুস্থতার সময়ে, চিকিৎসার গাফিলতিতে এইড্‌স সংক্রামিত রক্ত তাঁর শরীরে যায়। সাত নম্বর ম্যাজিক জনসন, চিকিৎসকের গাফিলতিতে, ইঞ্জেকশনের একই সিরিঞ্জ ব্যবহারের ফলে এই প্রতিভাবান বাস্কেটবল খেলোয়াড়ের শরীরে এইড্‌স সংক্রমণ হয়। এই নিয়েই  বার্সেলোনা অলিম্পিকে অংশ নিয়েছিলেন তিনি। আট নম্বর প্যামেলা অ্যান্ডারসন, স্বামীর সঙ্গে সঙ্গমের ফলে তাঁর শরীরে বাসা বেঁধেছিল হেপাটাইটিস সি। বহু বছর ধরে তিনি লড়াই করছেন এই রোগের বিরুদ্ধে। নয় নম্বরে চার্লি শিন,  হলিউড তারকা চার্লি শিন নিজে  ঘোষণা করেছেন তিনি এইচআইভি পজিটিভ এবং তা যৌন সংসর্গের কারণেই।

চেঙ্গিজ খান : আমি যখন আক্রমণে বেরোতুম তখন রোজই নতুন একজনের সঙ্গে শুতুম , সঙ্গে যে বউ থাকতো সে আপত্তি করতো না । কিন্তু আমার প্রথম বউয়ের জন্যে আমার খুবই টান আর মায়া ছিল । একবার আমার শাসনের আওতায় যারা এসেছে তারা অন্য যে কোনও জায়গার তুলনায় আমার অধীনে অনেক বেশী নিরাপদ, প্রগতিশীল, আর স্বাধীন ছিল। পৃথিবীর অন্যতম দূরদর্শী নেতা হিসাবে আমি নিজের শাসনামলে একটা দেশ, একটা ভাষা, ধর্মীয় আর রাজনৈতিক স্বাধীনতা, পোস্ট অফিস/পোনি সার্ভিস, লিখিত আইন ব্যবস্থা, টোল রোডের নেটওয়ার্ক আর অন্য অনেক নতুন জিনিষের গোড়াপত্তন  করেছিলুম, বুঝলি ল্যাঙড়া । তুই তো শুধুই ভাঙচুর করে নাম কামালি ।

শাজাহান : কলম্বাস নামে একজন লোকের দলবল প্রথমে নিজের দেশে এনেছিল রোগগুলো । পনেরো শতকের শেষের দিকে সমুদ্রে অভিযান করে, তখন ওর নাবিকদের হাইতি দ্বীপে প্যাসিওলা হয়েছিল, যাকে এখন বলে ফিরিঙ্গিরোগ , উপদংশ, গর্মি,  বা সিফিলিস  রোগ । ওরা  সংক্রামিত হয়ে ফিরিঙ্গি রোগের জীবাণু ইউরোপে নিয়ে গেল । ফরাসী সম্রাট অষ্টম চার্লস  ইতালি আক্রমণ করলে  ইতালিতে এই রোগ মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ে । ফরাসি সৈন্য আর  তাদের সহযাত্রীরা এই রোগের জীবাণু সমস্ত ইউরোপে নিয়ে গিয়েছিল । ইউরোপ থেকে তা পৌঁছে গেলো এশিয়া আর আফরিকার উপনিবেশে ।

নোবিলিআত্মন : জানি, জানি । ফরাসি মেয়েরা বড্ডো গায়ে পড়া । আমি ফরাসিদেশে গিয়ে ব্রহ্মচারী ছিলুম।

জাঁ দুভাল : শুনলেন তো ? আমি উঠি তাহলে । আপনারা ম্যাসোচিস্টিক আর মিসোজিনিক গল্পগাছা বজায় রাখুন।

রূপমতি : উঠছ কেন জাঁ দুভালবেগম ? তুমি আমার আর বাজ বাহাদুরের প্রেমের গল্প শুনে যাও। আমি ছিলুম কাফের হিন্দু,  আর বাজ বাহাদুর মুসলমান । আপনারা তো  লায়লা-মজনু, শিঁরি-ফরহাদ, প্যারিস-হেলেন, রোমিও-জুলিয়েট, ইউসুফ-জোলেখা, সাবিত্রী-সত্যবান, রাধা-কৃষ্ণ — ওনাদের প্রেমের কাহিনি শুনেছেন, তাই আমার জীবনের ট্র্যাজেডির কথাও শোনাতে চাই ।

চেঙ্গিজ খান : বলো, বলো । রূপমতিবেগম । কফি হাউসে চিকেন পকোড়া পেলে ভালো হতো।

রূপমতি : বাজ বাহাদুর ছিলেন মান্ডুর শেষ স্বাধীন শাসক, তিনি বরাবরই সংগীতের খুব ভক্ত ছিলেন। একবার শিকারে বের হওয়ার পর বাজ বাহাদুর আমাকে দেখতে পান, আমি তখন ছাগল-ভেড়া চরাচ্ছিলুম আর বন্ধুদের সাথে খেলতে-খেলতে গান গাইছিলুম । আমাকে দেখে আর গান শুনে উনি আমাকে তাঁর সাথে রাজধানীতে যেতে অনুরোধ করেন।   নর্মদা নদী দেখা যায় এমন এক প্রাসাদে আমি থাকতে রাজি, এই শর্তে মান্ডু যাই । এভাবেই মান্ডুতে রেওয়া কুন্ড তৈরি হয়েছিল। দুর্ভাগ্যক্রমে এই মুসলিম রাজপুত্রের সঙ্গে আমার  প্রেম ব্যর্থ হয়ে যায়। আপনি জালালুদ্দিন মোহম্মদ আকবর, মান্ডু আক্রমণ করে আমাকে আর  বাজ বাহাদুরকে বন্দী করার সিদ্ধান্ত নেন। আপনি আকবর, মান্ডু দখল করার জন্য আদম খানকে পাঠান । বাহাদুর ওর ছোট সেনাবাহিনী নিয়ে  মোকাবেলা করতে গিয়েছিল। আপনার বিরাট  সেনাবাহিনীর সাথে কোনও তুলনাই হয় না, মান্ডু খুব সহজেই হেরে যায় । বাজ বাহাদুর সাহায্যের আশায় চিত্তোরগড়ে  আশ্রয় নেয়। 

চেঙ্গিজ খান : আমার প্রথম বউও ভেড়া, গোরু, ঘোড়া চরাতো । 

রূপমতি : আমার গল্পটা শুনুন, মাঝখানে কথা বললে রেশ কেটে যায় ।আদম খান লোকটা বজ্জাত।  মান্ডু আসার সাথে সাথে আমাকে দেখে ফাঁদে ফেলে আটক করার চেষ্টা করেছিল । ওর ফন্দি ছিল আমাকে তুলে নিজের হারেমে নিয়ে যাবে । কিডন্যাপিঙ এড়ানোর জন্য আমি বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করি, আর এভাবেই আমাদের  প্রেম নষ্ট হয়ে যায় ।  সুলতান আমাকে হিন্দু আর মুসলমান দুই রীতিতেই বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর  বাজ বাহাদুর আর আমার  সুখের সংসার ভালোই চলছিলো। শিল্পপ্রেমী বাজ বাহাদুরের অন্য সুলতানদের সাথে ভালোই সম্পর্ক। তাই নির্ভাবনায় শিল্পসাধনায় আমাদের জীবন সুখেই কাটছিলো। আমার প্রশংসা ছড়িয়ে পড়লো সারা আল-হিন্দে। সম্রাট আকবর, আপনার কানেও গেল। আপনি বাজ বাহাদুর আর আমাকে আমন্ত্রণ জানালেন দিল্লির দরবারে। বাজ বাহাদুর  আমন্ত্রণ রক্ষা করলেন। আমি গান গেয়ে শোনালুম । কয়েকদিন দিল্লিতে থেকে বাজ বাহাদুর আমাকে নিয়ে ফিরে এলো মান্ডু। কিন্তু আপনি আকবর, কিছুতেই ভুলতে পারেননি আমাকে আর আমার গান। আপনি ভাবলেন কোথাকার কোন এক ছোট-খাট সুলতান বাজ বাহাদুর, তার কাছে আমি কেন থাকবো ! আপনি সেনাপতি আদম খানকে হুকুম করলেন বাজ বাহাদুরকে মেরে আমাকে তুলে নিয়ে আসতে। আমি যখন খবর পেলুম বাজ বাহাদুর হেরে গেছেন , আর আদম খান আমাকে ধরতে আসছে, আমি বাধ্য হলুম আত্মহত্যা করতে।   

জাঁ দুভাল : সব পুরুষ একই রকম । বোদলেয়ার ছাড়া আরও অনেকের সঙ্গে মিশেছি তো, জানি । বোদলেয়ার মনে করতো আমার থেকে ওর সিফিলিস হয়েছে । আমার উল্টোটা মনে হয় । বোদলেয়ার থেকেই আমার সিফিলিস হয়েছে। আফিমের শরবত আর হ্যাশিশের ধোঁয়া টানার পর ওর তো আর হুঁশ থাকতো না । 

শাহজাহান : আমার আব্বাহুজুর  জাহাঙ্গীর অমন করতেন না । আমি তো ওনার হিন্দু রাজপুত বউ তাজ বিবি বিলকিস মাকানি-র ছেলে । শুনেছি যে দাদাহুজুর আমার আব্বাহুজুরকে আনারকলির সঙ্গে প্রেম করতে দেননি। কারণ আনারকলি ছিল একজন  চাকরানির মেয়ে, দাদাহুজুরও মেয়েটাকে চাইতেন । জন্মসুত্রে ওর নাম ছিল নাদিরা বেগম বা শার্ফ-উন-নিসা। আনারকলি কোনও এক বণিক বহরের সঙ্গে  ইরান থেকে  লাহোরে এসেছিল। দাদাহুজুর বলেছিলেন চাকরানির মেয়েকে রাজপুত্রের ভালোবাসা অবৈধ । তাই দাদাহুজুর দুটো ইটের দালানের মাঝ জীবন্ত কবর দিয়েছিলেন আনারকলিকে।  আনারকলির ঘটনা ইচ্ছে করে ‘আকবরনামা, ’তুজক-ই-জাহাঙ্গীরী’, ‘হুমায়ুননামা’ থেকে বাদ দেয়া হয়েছে, মোগল সন্মান রক্ষা করার ধান্দায় । অথচ হারেমের হাবশি ক্রিতদাসীদের সঙ্গে শুতে কারোরই আপত্তি হয়নি । 

জাঁ দুভাল : এরকমই হয় । আমার জীবনও অনেক কষ্ট। এখন ক্রাচে হাঁটাচলা করতে হয় । যাই হোক, আমি এবার উঠি । অনেক দূর যেতে হবে । বোদলেয়ার আমাকে বলতেন কালো ভেনাস, বিপজ্জনক সৌন্দর্য, যৌনতা আর রহস্য’র মিশেল । আমাকে অমর করে দিয়ে গেছেন শাহজাহানের মমতাজ মহলের মতন । ওই যে আরেকজন মহিলা এই টেবিলের দিকেই আসছেন, আপনাদের মিসোজিনিক আলোচনায় বিঘ্ন ঘটাতে ।

ভাগমতি : তোমার কথা শুনতে পেয়েছি জাঁ দুভালবেগম । না আমি পিতৃতন্ত্রে বাগড়া দিতে আসিনি । আমিও নিজের প্রেমের কাহিনি শোনাতে এসেছি ।

 ভাইপো আকবর :  আমার নাম জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর, গুলবদন পিসির ভাইপো । ভুল করে নিউটাউন কফি হাউসে চলে গিয়েছিলুম । আজকে চেঙ্গিজদাদু, ল্যাঙড়াদাদু  আর দাদাহুজুর আড্ডা দিতে আসছেন শুনে এলুম । প্রেমের গল্প কানে এলো । কার প্রেম কার সঙ্গে ,আশা করি এই কাহিনির ভিলেন আমি নই । মোগল পরিবারে হিন্দু রাজপুত মেয়েদের বিয়ে করার চল আমিই তো আরম্ভ করেছিলুম । আর এখন তোরা আমাকে দোষ দিচ্ছিস যে আমি তোদের প্রেমে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছি । শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

ফিরোজাবাদি তুগলক : আপনিই আকবর ? আপনার কথা অনেক শুনেছি জনাবেআলা ! আপনার মালাউন প্রেম তো বিখ্যাত। আপনার দরবারে পারসি-মোগল-রাজপুত, প্রত্যেকের সমান মর্যাদা ছিল। তবে নির্ভরতা ছিল বেশি মালাউন রাজপুতদের ওপর। কারণ দরবারের আমির-ওমরাহদের মধ্যে অনেকেই তো ইরানের । ইরানের সম্রাটের প্রতি আপনাদের একটা দুর্বলতা ছিল।  প্রভাবশালী ইরানি ও মোগল আমিররা  ষড়যন্ত্রে যোগ দিতে কতক্ষণ! অন্যদিকে রাজপুতদের নিয়ে সে ভয় ছিল না। তারা বিশ্বাসী,  বীর আর প্রভুভক্ত। যুদ্ধেও ওস্তাদ। আর যদি তারা ষড়যন্ত্র করেও, ইসলাম ধর্মাবলম্বী আমিরদের সমর্থন আদায় করা তাদের পক্ষে অসম্ভব। আপনি তাই সেনাবাহিনীর উঁচু পদে অনেক রাজপুতকে নিয়োগ করেছিলেন। মোগল সেনাবাহিনীতে রাজপুতদের এ দাপট দীর্ঘদিন বজায় ছিল। এর পেছনে কি যোধা বাঈয়ের কোনো প্রভাব ছিল জনাবেআলা ! যোধা বাঈ, মোগল হারেমের প্রথম রাজপুত বেগম। মোগল হারেমে হিন্দু আদব-কায়দা আর সংস্কৃতির শুরুয়াত তো ওনার হাত ধরেই। পরে রাজপুত বেগমদের সংখ্যা যত বেড়েছে, সংস্কৃতির মিশেলও ততই বেড়েছে। দেশীয় হিন্দু রাজাদের সঙ্গে সখ্যতার সময় সন্ধিপত্রে আপনি প্রথমেই যে শর্ত জুড়ে দিতেন তা হলো, রাজপুত রাজকন্যাদের ডোলি পাঠাতে হবে মোগল হারেমে। হেরে যাওয়া রাজাদের সেই সাহস কোথায় যে আপনার শর্ত অমান্য করে! অতএব আপনার হারেমে তখন অগুনতি রাজপুত বেগম। ইসলামি রীতি মেনে কলমা পড়ে  যেমন এদের নিকা করেছেন, তেমনি হিন্দু রীতি-রেওয়াজ মেনে সাতপাক, মালা বদল,  যাগযজ্ঞ—কিছুই বাদ যায়নি। রাজপুত বেগমদের মহলে পা রাখলে বোঝার কোনো উপায় ছিল না যে তা মোগল হারেমেরই অংশ । পুজোপাঠ থেকে পোশাক-আশাক, খাবারদাবার, তাদের সবকিছুতেই হিঁদুয়ানি বড় প্রবল। রাজপুত বেগম মহলে জাঁকজমকের সঙ্গে হোলির উৎসব হোতো আর আলোর দিওয়ালিও। বাদশারা সানন্দে যোগ দিতেন সেই উৎসবে। মোগল মিনিয়েচার ছবিগুলো সে কথাই বলে।

তোতলা তুগলক : কে তোতোতোকে ববববলেছে, ওওওপরপড়া হয়ে খখখবর বিলোতে ?

ভাইপো আকবর : এতো বড়ো সাম্রাজ্য চালাতে হলে বুদ্ধি খাটাতে হয়, বুঝেছো ? এ তো আর তোমার গণতন্ত্রের ভোটাভুটি নয় যে যখন যাকে ইচ্ছে নিজের সঙ্গে নিলুম আর হাজার-হাজার কোটি টাকা কামিয়ে তাকে জেলে পুরলুম বা তাড়িয়ে দিলুম । শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

দিল্লিওয়ালা তুগলক : আপনি যমুনা তীরে বাগানঘেরা সুন্দর মহল তৈরি করিয়েছিলেন । নাম রেখেছিলেন সোহাগপুরা। স্বামী-সোহাগের স্মৃতি আঁকড়ে  বিধবা বেগম আর মুত্তারা শেষ জীবন কাটাবে এই মহলে,  তাই এমন নাম রেখেছিলেন বোধহয় । জাহাঙ্গিরের মা মরিয়ম-উজ-জামানি ছাড়া বাকিরা আপনি মারা যাবার  পর ছিলেন এই সোহাগপুরাতেই। মরিয়ম-উজ-জামানি, মানে যোধা বাই  ছিলেন ছেলের প্রাসাদে। তালাকের ঘোর বিরোধী ছিলেন আপনি। আপনি মারা যাবার পর হারেম সুন্দরীরা অন্য পুরুষের বাহুলগ্না হবে,  হিন্দুদের মতো এ ব্যাপারেও তীব্র আপত্তি ছিল আপনার। যাতে  রাজপুত বেগমরা নিশ্চিন্তে সেখানে হিন্দু বিধবাদের মতো সাত্ত্বিক জীবন কাটাতে পারেন ! যদিও একটা অংশে মোগল বেগম ও মুত্তাদের থাকার ব্যবস্থাও ছিল। আপনার পর অবশ্য এই নিয়ম আর বজায় থাকেনি। জাহাঙ্গির ওর ভাই দানিয়েলের মৃত্যুর পর তার হারেমের মেয়েদের বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছিলেন আপনি । প্রশ্ন হলো তালাক কিংবা বেগমদের পুনর্বিবাহে কেন আপনার আপত্তি ! মালাউন সংস্কৃতির প্রভাবে বোধহয় ! মালাউন ধর্ম-সংস্কৃতির প্রতি বরাবর একটা কৌতূহল ছিল আপনার মনে। সেই কৌতূহল থেকেই রামায়ণ-মহাভারত অনুবাদের হুকুম দিয়েছিলেন। আগ্রহ ছিল সংস্কৃত ভাষার প্রতিও। মূল সংস্কৃত থেকে রামায়ণ অনুবাদের হুকুম দিয়েছিলেন  বাদাউনিকে। সময় লেগেছিল চার বছর। আর নকিব খাঁ করেছিলেন মহাভারতের অনুবাদ। সাহায্য করেছিলেন বাদাউনিও এবং কয়েকজন হিন্দু পণ্ডিত। এর আগে বাদাউনি ফার্সি ভাষায় গদ্যে-পদ্যে অনুবাদ করে ফেলেছিলেন সংস্কৃত বই ‘বত্রিশ সিংহাসন’।    বইটির অনুবাদ শেষ হলে নাম রাখা হয় ‘খিবদ্-আফজা’।

তোতলা তুগলক : অঅঅঅনেক কিকিকিকিছু জাজাজাজানিস দেদেদেখছি, তাতাতাহলে রারারাজ্য সাসাসামলাতে পাপাপারিসনি কেকেকেন ?

পাগলা তুগলক : মানবপ্রকৃতি ধারণাটা আমাদের সমাজে বিভিন্ন সময়ে কীরকম ভূমিকা পালন করেছে? আঠারো শতকের প্রাণীবিদ্যাসমূহের উদাহরণ টেনে বলা যায় নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক কালে বিশেষ বিশেষ জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরে ক্রিয়াতৎপর বর্গ-ধারণাসমূহ এবং ‘প্রাণ’ বা ‘মানবপ্রকৃতি’র মতো ইতিহাসোর্ধ ধারণাগত মাইলফলকগুলোর মধ্যে পার্থক্য আছে । আমার মতে, ইতিহাসোর্ধ ধারণাগুলো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানকান্ডের অভ্যন্তরীণ পরিবর্তন সাধনে খুব সামান্যই ভূমিকা রেখেছে। আমার মতে, একজন ভাষাতাত্ত্বিক যা গবেষণার মাধ্যমে বাগধ্বনির রূপান্তরের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন ফ্রয়েড স্বপ্ন বিশেস্নষণের নীতি আবিষ্কার করেছিলেন, কিংবা একজন সাংস্কৃতিক নৃবৈজ্ঞানিক মিথ-এর কাঠামো আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা প্রকৃতপক্ষে মানবপ্রকৃতি ছিল না। বলতে পারি, জ্ঞানের ইতিহাসে মানবপ্রকৃতি ধারণাটা বস্তুত ধর্মতত্ত্ব কিংবা প্রাণীবিদ্যা কিংবা ইতিহাসের সাপেক্ষে বা বিপরীতে একটি নির্দিষ্ট ধরনের ডিসকোর্সকে প্রতিষ্ঠিত করতে জ্ঞানকান্ডীয়  সূচকের ভূমিকা পালন করেছে ।

তোতলা তুগলক : এএএই পাপাপাগলাটা মামামাঝখানে অঅঅন্য ককককথা ববববলবেই । 

ভাস্কো দা গামা : লাহোরে আমি আনারকলির কবর দেখেছি । ওই ঘরেই এখন পাকিস্তানের পুরোনো নথিপত্রের মহাফেজখানা । উইলিয়াম ড্যালরিমপলও গবেষণার নথিপত্র যাচাই করার সময়ে দেখেছে আনারকলির কবর । 

শাহজাহান : ভাগমতিবেগম, এই প্রবীণ মহিলা কি তোমার সঙ্গে এসেছেন ?

ভাগমতি : না তো ! উনি নিজেই এসেছেন আপনাদের টেবিলে ।

শাহজাহান : আর এই ফিরিঙ্গি ?

ভাগমতি : উনিও আলাদা এসেছেন । আমার সঙ্গে নয় । আমি একাই এসেছি আপনাদের আমার জীবনের ঘটনা শোনাতে ।

পাগলা তুগলক : আধুনিক কালে শিল্প, সাহিত্য পাঠে এবং সিনেমা নাটকের বিশেষ চরিত্রের মনের অলি-গলিতে আলোকপাত করার জন্য যে কতগুলো শিল্প-সাহিত্যিক তত্ত্ব—যেমন সংগঠনবাদ, উত্তর সংগঠনবাদ, আধুনিকতাবাদ, উত্তর-আধুনিকতাবাদ, নিউ ক্রিটিসিজম, উপনিবেশবাদ ইত্যাদি সাহিত্য সমালোচনা—সমালোচকেরা ব্যবহার করে থাকেন তার মধ্যে সাইকো-এনালাইসিস একটা অপেক্ষাকৃত গূঢ় ও ক্যাথারসিস—আত্মবিশোধনমূলক তত্ত্ব। এই বিশেষ তত্ত্বটি বলে—যে টেক্সট লেখকের গোপন, আশা আকাঙ্ক্ষা তার উদ্বিগ্নতা, যা তার অজ্ঞান স্তরে জমা থাকে তা প্রকাশ করে দেয়। এটা আরো বলে যে একটা টেক্সট আর কিছু নয় লেখকের মনোজগতের ভাষা-বিবরণ ছাড়া। এর মাধ্যমে আমরা লেখকের বাল্যজীবনের ট্রমা, সেক্সচুয়াল কনফ্লিক্ট, অবসেশন ইত্যাদি জানতে পারি। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে এই মনস্তাত্ত্বিক বিষয়গুলো আসে সরাসরিভাবে নয়, পরোক্ষভাবে। দাবিয়ে রাখা আবেগগুলো ছদ্মনামে, লিটেরেরি টেকনিক যেমন প্রতীক, মেটাফর  ও মেটোনিমিতে  প্রকাশিত হয়। কখনো তা প্রকাশ পেতে পারে কনডেন্সেড  অবস্থায়, একটিমাত্র ছবিতে অথবা মিলেমিশে থাকায় বিশেষ অন্য একটি শব্দে বা ছবিতে।  সাইকো-এনালাইসিস তত্ত্ব দিয়ে একটি টেক্সট পাঠ করলে পাঠকের কাছে যে বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে—সেটি হলো লেখক/চরিত্রের ডিজায়ার  বা তার অভাব।

তোতলা তুগলক : আআআবার সেসেসেই দিদিদিদিল্লির ববববদলে দৌলতাতাতাবাদ । ওফ, পারা গেল না ছেলেটাকে নিয়ে !

ঘসেটি বেগম : আমার নাম মেহের উন নিসা বেগম, আমি বাংলা, বিহার আর ওড়িশার নবাব আলীবর্দী খানের বড় মেয়ে। কফিহাউসে আজকে চেঙ্গিজদাদু , তৈমুরদাদু , বাবরদাদু আসবেন শুনে ওনাদের গল্প শুনতে এলুম । আমাকে এতো বদনাম দেয়া হয় কেন বুঝতে পারি না । অথচ আপনারা তিনজন তো হেন কাজ নেই যা করেননি । জগতশেঠ, উমিচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়রা দিব্বি পার পেয়ে গেলো । মহারাজা প্রতাপাদিত্যকে ধরিয়ে দিয়ে মানসিংহকে সাহায্য করার জন্য পুরস্কার হিসেবে ভবানন্দ মজুমদার সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে সন্মান লাভ করেছিল আর তার  ফরমান পেয়ে নদীয়া, সুলতানপুর, মারুপদহ,মহৎপুর,লেপা,কাশিমপুর, কয়েশা মমুন্দ্রা এরকম চোদ্দটা পরগনার অধিকার পেলো | মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের দেয়া চোদ্দটা পরগনার সনদসূত্রে নদীয়ার রাজা হলেন ভবানন্দ মজুমদার আর সেই সঙ্গেই নদীয়া রাজবংশের সূচনা করলেন | তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ফিরিঙ্গি শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদীয়া শাসন করলেন | ভবানন্দের আসল নাম ছিল দূর্গাদাস সমাদ্দার, কিন্তু নদীয়া রাজপদে বসে ওনার নাম হলো ভবানন্দ মজুমদার ; তাঁর ছেলেরা রায় পদবি রাখলো |  মোগোলদের ধ্বংস করে বব মাস্তানের কোম্পানি জনে-জনে রাজা-মহারাজা খেতাব বিলোলো । তার বেলায় ? শুধু আমাকেই কেন দোষ দেয়া হয় ?

প্রতাপাদিত্য : আপনারা ডাকেননি, তবুও এসেছি । আমিই প্রতাপাদিত্য । মহারাজা প্রতাপাদিত্য,বাঙালি । নিজেকে মহারাজা বলেছি বলে আপনাদের আঁতে লেগেছে, জানি । কিন্তু আপনারা নিজেরা তো এদেশের মানুষের কাছে দুর্বোধ্য নাম নিয়েছেন, যেমন নাসিরুদ্দিন মুহম্মদ হুমায়ুন, আবুল মোজাফ্ফর সাহিব উদ্দীন মোহাম্মদ সাহিব-ই কিরান শাহজাহান বাদশা গাজি , আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব  বাহাদুর আলমগীর বাদশা গাজী প্রথম আলমগীর, নুরুদ্দিন মহম্মদ জাহাঙ্গীর বাদশাহ গাজী, ইত্যাদি । 

ভাস্কো দা গামা: তোমার বক্তব্যটা কী ? ঘটনা জানতে চাই ।

প্রতাপাদিত্য : রাজনৈতিক শিক্ষার জন্য আমি কিছু সময়ের জন্য উত্তর ভারতে গিয়েছিলুম। সেইখানে থাকার সময় আমি জানতে পারি মহারাণা প্রতাপসিংহের সাহসের কথা। আমি নিজে চিতোর দর্শন করেও আসি, যা আমার মনের  স্বাধীনচেতা সত্ত্বাকে  আলোড়িত করেছিল। এছাড়া, বিভিন্ন রাজপুত পরিবারের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মোগল রীতি, আর খোশরোজের দিন হিন্দু নারীদের উপর অত্যাচারের কথা আমার মনে আপনাদের প্রতি বিতৃষ্ণার জন্ম দিয়েছিল। যশোরে ফেরার কিছুদিন পরে আমার বাবা মহারাজা বিক্রমাদিত্যে মারা যান, আর আমার অভিষেক অনুষ্ঠিত হয়। রাজগুরু পণ্ডিত কমলনয়ন তর্কপঞ্চাননের কাছে শাক্ত মন্ত্রে দীক্ষা নিই । 

ভাস্কো দা গামা : তাই মোগলরা তোমার ওপর চটে গিয়েছিল ? ঠিক যেমন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ওপর চটা !

প্রতাপাদিত্য : তার আগে আমি ছিলুম বৈষ্ণব। শাক্ত হয়ে যশোরেশ্বরী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা করি।  উৎকলবিজয় আমার শাক্ত বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করে।   সেনাবাহিনীকে আরো শক্তিশালী আর পরাক্রমশালী করে তুলি। রাখাইনের মগ আর পর্তুগিজ  দস্যুদের অত্যাচার প্রতিরোধ করি । দুর্গ তৈরি করাই । রাজধানী ধুমঘাটের দুর্গ ছাড়াও  আরো তেরোটা প্রধান দুর্গ ছিল। এর বাইরেও আমার অসংখ্য দুর্গ ছিল, যার মধ্যে কলকাতার কাছেই সাতটা । আমার  নৌবহরও ছিল ; কোনো কোনো নৌকায় চৌষট্টি বা তার বেশি দাঁড় ছিল, আর অবশ্যই অনেক নৌকায় কামান থাকত। আমার সেনাবাহিনীতে বিভিন্ন ধরণের সৈন্য ছিল, যেমন ঢালী, অশ্বারোহী, তীরন্দাজ, গোলন্দাজ, নৌসেনা, গুপ্তসৈন্য, রক্ষীসৈন্য, হস্তিসেনা।  আমার সেনাবাহিনীতে বাঙালি রায়বেঁশে, ঢালি ইত্যাদি সেনা ছাড়াও ছিল কুকি, পাঠান, পর্তুগিজ ইত্যাদি সেনা। কিন্তু  আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র আর আমার শত্রুদের নানারকম সাহায্য করেছিলেন বহু বাঙালি। 

চেঙ্গিজ খান : ভালো কাজই তো করছিলে । তুমি তো মনে হয় কোনও অভিযোগ নিয়ে কফিহাউসের এই আড্ডায় এসেছো । যা বলতে চাও, বলে ফ্যালো ।

প্রতাপাদিত্য : আমি বহিরাগত মোগলদের বশ্যতা অস্বীকার করে যশোরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলুম । নিজের নামে মুদ্রার প্রচলন করেছিলুম।  মোগলদের পক্ষে রাজা মানসিংহ ছিলেন বঙ্গদেশের দায়িত্বে । তিনি দাক্ষিণাত্য বিজয়ের জন্য শের খাঁকে রাজমহলে দায়িত্ব দিয়ে যান। সেই সময় আমার অমাত্য শঙ্কর চক্রবর্তী  সেখানে উপস্থিত হন। শের খাঁ শঙ্করকে বন্দী করে, যদিও শঙ্কর সহজেই সেখান থেকে পালিয়ে যায়।  ফলে আমি আক্রমণ করে মোগলদের প্রথমবারের মতো হারিয়ে দিই ।  এরপরে মানসিংহের সঙ্গে সরাসরি যুদ্ধের ক্ষেত্র তৈরি হয়। যুদ্ধ বেশ কিছুদিন যাবত চলেছিল।  প্রথমে দু’দিন মানসিংহ হেরে গিয়েছিলেন।  শেষদিন জয়ী হয়ে মানসিংহ স্বাধীনতার চিহ্ন পতাকা ও মুদ্রা বিলুপ্ত করবার আদেশ দিয়েছিলেন। আসলে নদীয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের পূর্বপুরুষ ভবানন্দ মজুমদার আমাকে মান সিংহের কাছে ধরিয়ে পুরস্কৃত হয়েছিলেন । শুনেছি, আমাকে খাঁচায় পুরে বন্দি করার পর, মোগল সেনাবাহিনী জিহাদ ও ‘মাল-এ-গনিমাত’ অনুযায়ী  নির্মমভাবে যশোরে  লুটপাট চালিয়েছিল। এমনকি মির্জা নাথনের মতো বুদ্ধিমান মানুষও তার নির্মম কৃতিত্ব নিয়ে গর্বিত। আমার ছেলে উদয়াদিত্য ওই মির্জাকে সোনা-মণিমুক্ত দিতে পারেনি বলে  যশোরের ওপর ভয়াবহ প্রতিশোধ নিয়েছিল। মির্জা হুমকি দিয়েছিল যে লুটপাট বলতে কী বোঝায়  তার অভিজ্ঞতা যশোরের মানুষ মনে রাখবে । মির্জা নাথন চার হাজার মহিলা, যুবতী ও বৃদ্ধকে বন্দী হিসাবে নিয়ে গিয়েছিল। কমিউনিস্ট শাসনের ৩৪ বছরে বাংলায় জাতীয়তাবাদী মনোভাব শুকিয়ে গেছে। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, এখনকার বাঙালিরা আমাকে আর আইকন মনে করে না ।

চেঙ্গিজ খান : রাজা-বাদশাদের অমন খোচর থাকে । তাদের কাজের জন্য তাদের পুরস্কার না দিয়ে উপায় নেই।

প্রতাপাদিত্য : ব্যাপারটা মিটে গেলেও, জাহাঙ্গির কিছুকাল পরে ইসলাম খাঁর নেতৃত্বে আবার সৈন্য পাঠান ।  যমুনা আর ইছামতি নদীর সঙ্গমে আমার বাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড সংঘর্ষ হয়। আমি আত্মসমর্পণ করেছিলুম। তবু ইসলাম খাঁ আমাকে শেকলে বেঁধে খাঁচায় ঢুকিয়ে রাখলো আর যশোর প্রদেশকে মোগল সম্রাজ্যের অন্তর্গত করে নিলো। আপনাদের তো যে যার কবর আছে । কেউ-কেউ তার ওপর মহলও খাড়া করেছেন । আমার আর আমার ছেলের শবদেহের কী হলো ? কোথায় আমাকে দাহ করা হয়? আমার দেহাবশেষ কি আমার বংশধরদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিল ? নাকি আমার স্মৃতিও দারা শুকোহ’র মতন লোপাট করে দেয়া হয়েছে ?

ভাইপো আকবর : জাহাঙ্গির থাকলে হয়তো বলতে পারতো । ও  কফিহাউসে আসতে পারবে না, পাকিস্তানের মিলিটারি ক্লিয়ারেন্স পায়নি । ইসলাম খাঁ আসবে বলে মনে হয় না । গুলবদনপিসি, তুমি কিছু জানো ? শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

গুলবদনপিসি : না রে ভাইপো । জাহাঙ্গীর ওর আত্মজীবনীতে ব্যাপারটা চেপে গেছে । আমি যতোটা জানি ঢাকায় বন্দী থাকবার কিছুদিন পরে আপনাকে খাঁচায় পুরে আগ্রায় পাঠানো হচ্ছিল । পথে কাশীতে আপনি মারা যান । বা হয়তো খাঁচার ভতরে মারা যাবার পর শবদেহ কাশীতে নিয়ে যাওয়া হয় । আপনার শবদাহ সেখানেই করা হয়ে থাকবে, বংশধরদের অনুপস্হতিতে । 

প্রতাপাদিত্য : আমার প্রতিষ্ঠিত যশোরেশ্বরী কালী দর্শনের নাম করে সেনাপতি মান সিংহ আমার দুর্গের নকশা নিয়ে যান। পরে আক্রমণ করে মোগলরা সেটি জয়লাভও করে। কালীর বিগ্রহের সঙ্গে আমাকে আর আমার  সেনাপতি ও পরামশর্দাতা শঙ্কর চট্টোপাধ্যায়কে বন্দি করেন মান সিংহ।জমিদার বাড়ির মধ্যে অবস্থিত ছিল যশোরেশ্বরী কালী। সেই সময়ের     জমিদার  কালী মন্দিরের জন্য দুশো বিঘা জমি দান করেছিলেন। কিন্তু আজ প্রভাবশালী ভুমিদস্যুরা জাল দলিল তৈরি করে মায়ের মন্দিরের সব জমি দখল করে ভোগ করছে।আজ  মন্দিরের ইঁটের দেওয়াল খসে পড়ছে। যাকগে, থ্যাংকস । মোগলরা আমার ভালোই ট্রিটমেন্ট দিয়েছিল । নিজেদের ভাই-ভাতিজা চাচা-আব্বাকে যারা হেনস্হা করে, অন্ধ করে, খুন করে, তাদের কাছ থেকে এইটুকু জোটাও ভাগ্যের ব্যাপার ।  মধ্যযুগে বাংলার শাসক হিসাবে বহিরাগত বাদশা আর নবাবরা যতটা গুরুত্ব পেয়েছেন, দেশীয় বাঙালি রাজারা তার সিকির সিকিও পাননি। এর একটি কারণ যদি হিন্দু শাসকদের হাত থেকে মুসলমান শাসকদের হাতে ক্ষমতার দখল চলে যাওয়া হয়ে থাকে, আর একটি কারণ আমাদের ঐতিহাসিক ও শিক্ষাবিদরা। তাই মহারষ্ট্রের শিবাজীকে নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখানো হলেও তাঁর প্রায় সমান রণকুশল আর অনেক বেশি প্রজাবৎসল হলেও বাংলার পাঠ্যপুস্তকে উল্লিখিত শুধু বাংলার বারো ভুঁইয়ার অন্যতম হিসাবে, যিনি মোগলের বশ্যতা স্বীকার করেননি। শিবাজীর চেয়ে অগ্রজ হওয়া সত্ত্বেও আমাকে  সম্মান জানাতে ব্যবহৃত হয় ‘বাংলার শিবাজী’ অভিধা, যেখানে বিপরীতটা হওয়াই সঙ্গত ছিল; কারণ আমার শৌর্যের খ্যাতি সারা ভারতে এতটাই ছড়ায়, যে সেই ক্ষমতার নেপথ্যে অলৌকিক দৈব আশীর্বাদের গল্পও জনশ্রুতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আর শিবাজীর জন্ম আমার জন্মের অনেক পরে ।

চেঙ্গিজ খান : বাঙালিদের কথা আর বোলো না । নিজেদের নায়কদের সন্মান জানাতে চায় না । এই একটু আগে মাও জে দং সেকথাই বলে গেলেন ।

প্রতাপাদিত্য : আমাকে নিয়ে উৎসবের  সূচনা করেছিলেন  রবীন্দ্রনাথের বড়ো বোন শ্রীমতী স্বর্ণকুমারী দেবীর ও শ্রী জানকীনাথ ঘোষালের মেয়ে শ্রীমতী সরলাদেবী চৌধুরানী।  প্রখ্যাত সাহিত্যিক শ্রী মণিলাল গঙ্গোপাধ্যায় দ্বারা পরিচালিত একটি সাহিত্য সভাকে সরলাদেবী দেশাত্মবোধক ও বীরত্বব্যঞ্জক রূপ দিয়ে ‘প্রতাপাদিত্য উৎসবের’ সূচনা করেছিলেন । আমার ঘোড়া কলেজ স্ট্রিটে অপেক্ষা করছে । চলি । আপনাদের কিছু শোনাবার জন্য একজন ফিরিঙ্গি দাঁড়িয়ে আছেন ।                       

অষ্টম এডোয়ার্ড : আমি দাঁড়িয়েই আমার জীবনে প্রেমের কথা বলি । আপনারা সবাই প্রেমের আলোচনা করছেন বটে কিন্তু কেউই আমার মতন রাজসিংহাসন ত্যাগ করেননি প্রেমিকার জন্যে । দুবার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে জীবনসঙ্গী করায় সিংহাসন ছাড়তে হয়েছিল ! আমার নাম এডওয়ার্ড আলবার্ট ক্রিশ্চিয়ান জর্জ অ্যান্ড্রু প্যাট্রিক ডেভিড। আমি রাজা পঞ্চম জর্জের বড়ো ছেলে । ভালোবাসার মানুষের জন্য সিংহাসন ছেড়ে মাটিতে নেমে গিয়েছিলুম সাধারণ মানুষের মধ্যে । আমার প্রেমিকার নাম ওয়ালিস সিম্পসন। জন্ম মার্কিন পরিবারে।  ওয়ালিস আমাকে বিয়ে করেও রানি হতে পারেননি। পাননি কোনো সম্মানসূচক উপাধি। কারণ, ও দুবার তালাকপ্রাপ্ত। সেই সময়ে তালাক পাওয়া মেয়েদের আদালতে যাওয়ারই অধিকার ছিল না, আর আমাকে বিয়ে করে ব্রিটিশ রাজপরিবারে প্রবেশ করাটা তো অসম্ভব ছিল! দু’বার তালাকপ্রাপ্ত মেয়েকে এডওয়ার্ড বিয়ে করলে সরকার পদত্যাগ করবে, এমন হুমকি দেওয়া হলো।  

চেঙ্গিজ খান : কেন ? রাজারানি হবে, তাতে তালাকদেয়া মেয়ে হোক বা নাই হোক । তালাকদেয়া মেয়েদেরও তো বিয়ে করা যায় ।

অষ্টম এডোয়ার্ড :দুবার তালাকপ্রাপ্ত সাধারণ এক মার্কিন পরিবারের মেয়েকে ব্রিটিশ রাজার বিয়ে করার সিদ্ধান্তে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল  ইংল্যান্ডের চার্চ, যখন কিনা রাজা নিজেই চার্চের প্রধান !  ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্ট্যানলে বল্ডউইনও আমার প্রেমের সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নেন। বল্ডউইন আমাকে তিনটি প্রস্তাব দিয়েছিলেন—এক, ওয়ালিসকে বিয়ের চিন্তা বাদ দাও। দুই,  প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়ে করা চলবে না। তিন, সিংহাসন ত্যাগ করো। চাপ সহ্য করতে না পেরে ওয়ালিস   ফ্রান্সে চলে গিয়েছিল । ও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমার সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখবে না। কিন্তু জানতুম , সেটা ওর মনের কথা নয়। ওর মনের কথাটা বাস্তবে প্রতিফলিত করতেই বল্ডউইনকে  জানিয়ে দিই, আমি  তৃতীয় প্রস্তাবটিতে রাজি !  আমি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ‘অ্যাবডিকেশন-পত্র’  জমা দিই । পরদিন তা অনুমোদন করা হয়। মাত্র ৩২৬ দিনের মাথায় সিংহাসন ত্যাগ করে ব্রিটিশ রাজতন্ত্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কম মেয়াদি রাজার তালিকায় নাম লিখিয়েছি।  ওয়ালি সিম্পসনকে বিয়ে করে প্যারিসে বসবাস শুরু করি । আমার মতন আর কেউ কি প্রেম করেছে পৃথিবীতে ? 

চেঙ্গিজ খান : আপনার পেছনে ওই মোটা সাহেব ভুতটা কে ? আপনার সঙ্গে এসেছেন ? আমি ভাবলুম ওয়াজিদ আলি শাহ পোশাক পালটে এলো !

অষ্টম এডোয়ার্ড : না, উনি উনস্টন চার্চিলের ভুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমাদের দেশে প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ।

সাহেব ভুত : চলুন ইয়োর হাইনেস । এই কালো বোকা লোকগুলোর জমায়েতে কেন এসেছেন ? 

কফিহাউসের যক্ষ : এই চার্চিল লোকটা নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী । ও  একসময় বিদ্রূপ করে বলেছিল, দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী ভারতীয়রা, ওরা  খরগোশের মতো বাচ্চা বিয়োয় ;  তা ছাড়া খাদ্য সংকট এত তীব্র হলে মহাত্মা গান্ধী বেঁচে আছেন কীভাবে?

ল্যাঙড়া তৈমুর :  আরে এই প্রেতটা তো উইনস্টন চার্চিল । আমিও ভেবেছিলুম ওয়াজিদ আলি শাহ নতুন পোশাকে এলো । পঞ্চাশের  মন্বন্তরে যখন সুবে-বাংলার মানুষ বেঘোরে মরছিল এই লোকটা তখন  সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবার বদলে গুটিয়ে নিয়েছিল।শুধু তাই নয়, অন্যেরা যেন দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের সহায়তায় এগিয়ে না আসে সে বিষয়েও  ব্যবস্থা নিয়েছিল ।  চার্চিল নিজে সরাসরি বাংলার মন্বন্তরের জন্য দায়ী ছিল। একসময় বিদ্রূপ করে বলেছিল  খাদ্য সংকট এত তীব্র হলে মহাত্মা গান্ধী বেঁচে আছেন কীভাবে? । চার্চিলের আল-হিন্দের প্রতি প্রচণ্ড ঘৃণা ছিল। আল-হিন্দে যখন ‘ভারত ছাড়ো’ বা ‘কুইট ইন্ডিয়া’ আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠছে তখন এ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। কয়েক জাহাজ খাদ্যশস্য পাঠানোর মাধ্যমে চার্চিল অনায়াসে ভয়াবহ এ দুর্ভিক্ষ প্রতিহত করতে পারত । বাংলার দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য খাদ্যশস্য পাঠানোর জন্য ভারতের দুই ভাইসরয়, চার্চিলের ভারত বিষয়ক সচিব এমনকি মার্কিন প্রেসিডেন্ট পর্যন্ত চার্চিলকে অনুরোধ জানিয়েছিল। কিন্তু, চার্চিল তাদের কথায় গা করেনি। আল-হিন্দে আগে এরকম দুর্ভিক্ষ ছিল না। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের সময়  ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিল। আর এর কারণ হলো— সে সময় এখান থেকে খাদ্যশস্য বৃটেনে রপ্তানি করা হতো কিংবা খাদ্যশস্যের বদলে চাষীদের নীল, পোস্ত বা পাট চাষে বাধ্য করা হতো।  ‘পঞ্চাশের মন্বন্তর’,  আদৌ কৃৃৃৃষির ব্যর্থতা জনিত খরা ছিল না, ছিল মনুষ্যসৃষ্ট আকাল। 

পাগলা তুগলক : জানা কথা ।

কফিহাউসের যক্ষ : কিন্তু স্যার, ১৯৫৩ সালে দ্বিতীয় রানী এলিজাবেথ ওনাকে ‘নাইট’ উপাধিতে ভূষিত করেছিলেন। একই সালে  সাহিত্যে নোবেল পুরস্কারও পেয়েছিল উইনস্টন চার্চিল ।

ভাইপো আকবর : ওসব নাইট-ফাইট আর নোবেল পুরস্কার সব ফালতু । আমি নবরত্নদের নোবেল পুরস্কারের দশগুণ মাসোহারা দিতুম । চার্চিল লোকটা মোটেই নবরত্ন হবার মেটেরিয়াল নয়। ওর মূর্তিও শুনছি ভেঙে ফেলার উপায় খুঁজছে ব্রিটেনের পাবলিক ।  সুবে-বাংলা আর আসাম উপত্যকাই ছিল হাজার বছরের শস্যভাণ্ডার। বাংলার দুর্ভিক্ষ নিতান্তই ব্রিটিশ দুঃশাসন, অব্যবস্থাপনা, বিশেষ করে শেষের দিকে, উইনস্টন চার্চিলের আলহিন্দ-বিদ্বেষ আর যুদ্ধনীতির কারণে হয়েছিল । তাই আজ যেমন খোদ নিজের শহরেই ক্লাইভের বিশাল  মূর্তি অপসারণের দাবি উঠেছে; একই দাবি উঠেছে বাংলায় ইতিহাসের মর্মান্তিক দুর্ভিক্ষের জন্য দায়ী প্রধানমন্ত্রী চার্চিলের মরণোত্তর বিচারের, অন্তত ন্যায্য বিচারের জন্য ইতিহাসের নিরপেক্ষ পুনর্মূল্যায়নের। শ্যায়খুবাবা আসেনি ?

সাহেব ভুত : আমি উইনস্টন চার্চিল, আমার দেশের লোক কিনা আমার মূর্তি ভেঙে ফেলে দিতে চাইছে ।

ইরাকি ভুত : দুঃখ করবেন না চার্চিলমিয়াঁ, আমিও অনেককে না খেতে দিয়ে মেরেছি । আমি সাদ্দাম হোসেন আবদুল মাজিদ আল তিকরিতি, আমার মূর্তিও আমার দেশবাসী ফিরদৌস স্কোয়ারে টেনে ফেলে দিয়েছে, মূর্তির মুণ্ডু ভেঙে দিয়েছে । জানেন তো, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে সর্বদা বিবাদমান বেশ কিছু জাতিগোষ্ঠী বাস করে। সবার মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ পরিচালনা অনেক সময়ই সম্ভব হয়ে ওঠে না। দেশের অখন্ডতা বজায় রাখতে গিয়ে প্রায়ই শাসককে কঠোরভাবে সব বিদ্রোহ দমন করতে হয়। এসব বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে আমি যে পন্হা নিয়েছিলুম তাকে লোকে বলে নিষ্ঠুরতা, আর  যে নিষ্ঠুরতা অবলম্বন করেছিলুম তা নাকি কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয় । ভেবে দেখুন,  ইরাকের অখন্ডতা শেষ পর্যন্ত ধরে রাখতে পেরেছিলুম, আর বাইরের শত্রুদের হাত থেকে দেশবাসীকে দীর্ঘদিন মুক্ত রাখতে পেরেছিলুম । এখন  নিজেরা লড়ে মরছে, ইউরোপে পালাচ্ছে  ।

রুশি ভুত : আমি ভ্লাদিমির লেনিন । আমাকে বিশ শতকের  প্রধান ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে বিবেচনা করা হয়।  শতাব্দীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তিত্বের ব্যাপকভাবে বিবেচিত হয়েও, আমি ১৯৯১ সালে বিলোপ হওয়া অবধি সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে মরণোত্তরকালীন এক পরিব্যাপ্ত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বের বিষয় ছিলুম। আমি মার্কসবাদ-লেনিনবাদের  আদর্শিক ব্যক্তিত্ব ছিলুম আর আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওপর  লক্ষণীয় প্রভাব ফেলেছিলুম। কিন্তু বিতর্কিত আর অত্যন্ত বিভাজক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে আমাকে আমার সমর্থকরা সমাজতন্ত্র আর শ্রমিক শ্রেণির চ্যাম্পিয়ন হিসাবে দেখলেও, অন্যদিকে বাম আর ডান উভয় দিকের সমালোচকরা আমাকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের প্রতিষ্ঠাতা ও নেতা হিসাবে আমার ভূমিকার ওপর জোর দেয় ।  তোমরা তো আমার মতন বিপ্লব আনোনি । আমি পুরো সমাজটা পালটে দিয়েছিলুম ; সবাই আনন্দে ছিল, অথচ আমার মূর্তিগুলো সব জায়গা থেকে ভেঙে ভেঙে ফেলে দিয়েছে ; এখনও কয়েক জায়গায় আছে । জানি না কদ্দিন থাকবে সেগুলো ।

জর্জিয়ার ভুত : আমি জোসেফ স্তালিন , আমার মূর্তিগুলোও দেশের লোকেরা উপড়ে ফেলে দিয়েছে। অথচ আমি একজন রুশ সাম্যবাদী রাজনীতিবিদ আর ১৯২২ থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক ছিলুম। সোভিয়েত ইউনিয়নের ইতিহাসের সেই সময়ে আমার নেতৃত্বে প্রচলিত রাজনৈতিক মতবাদ “স্তালিনবাদ” নামে পরিচিত। শুরুতে কেন্দ্রীয় কমিটির অন্যতম সচিব হিসাবে আমার ক্ষমতা সীমিত ছিল। ধীরে ধীরে আমি ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে নিয়ে দলের নেতা হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়নের শাসনক্ষমতা কুক্ষিগত করে নিই। আমি সোভিয়েত ইউনিয়নে কেন্দ্রীয়ভাবে পরিচালিত অর্থনীতি ব্যবস্থার প্রচলন করেছিলুম। তার আগে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রায় সবটুকুই অর্থনৈতিকভাবে অনগ্রসর ছিল। আমার দ্রুত শিল্পায়ন আর কৃষিকার্যের যৌথীকরণের মাধ্যমে পুরো দেশ অল্প সময়ের মধ্যে শিল্পোন্নত দেশে পরিণত হয়। কিন্তু একই সময়ে অর্থনৈতিক উত্থান-পতনের দরুন বহু মানুষ দুর্ভিক্ষে মারা যায়। ১৯৩০-এর দশকে আমি নিজের ক্ষমতা শক্ত করবার জন্য একটু-আধটু নিপীড়ন শুরু করেছিলুম, যার ফলে কমিউনিস্ট পার্টির শত্রু সন্দেহে বহু মানুষকে লোপাট করে দিই, কিংবা সাইবেরিয়া ও মধ্য এশিয়ার শ্রম শিবিরে নির্বাসিত করি। রাশিয়ার অনেক জাতিগোষ্ঠীকে তাদের বসতবাড়ি থেকে উৎখাত করে অন্য জায়গায় সরিয়ে দিই । সবই তো মানুষের ভালোর জন্যে করেছিলুম ; কিন্তু এমন আহাম্মক ওরা যে আমার মূর্তি লোপাট করে দিচ্ছে ।

স্পেনের ভুত : আমি ক্রিস্টোফার কলম্বাস, আমেরিকা আবিষ্কার করেছিলুম । মিনেসোটার সেইন্ট পলে  আদি আমেরিকান বিক্ষোভকারীরা আমার দশ ফুট ব্রোঞ্জের মূর্তি দড়ি দিয়ে টেনে এর গ্রানাইটের ভিত্তি থেকে ফেলে দিয়েছে। ওরা বলেছে, বর্ণবাদ আর পুলিশের নৃশংসতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের চিত্র এটা। ওদের দাবি, বর্ণবাদ, দাসপ্রথা বা দাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িতদের মূর্তি প্রকাশ্যে রাখা যাবে না। যদি রাখতেই হয়, তবে সেগুলোকে জাদুঘরে স্থানান্তরিত করতে হবে। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ষোড়শ শতাব্দীতে আমেরিকায় এসে স্থানীয়দের দাস হিসেবে ব্যবহার করেছিলুম।অনেক স্কুলে আমাকে ‘নতুন পৃথিবীর আবিষ্কারক’ হিসেবে পড়ানো হয়। জানি, এই ঘটনার অনেকদিন ধরেই বিরোধিতা করে আসছিলেন আমেরিকার আদি অধিবাসীরা। ওদের মতে, আমার অভিযানই আমেরিকার ঔপনিবেশিক শাসনের আর আদি আমেরিকান অধিবাসীদের গণহত্যার  কারণ। আমার আত্মা শান্তিতে ঘুমোতে পারছিল না বলে আপনাদের জমায়েতে নালিশ করতে এলুম ।

ব্রিটিশ ভুত : আমার নাম এডোয়ার্ড কলস্টোন । ব্রিস্টলে ব্রিটেনের ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ বিক্ষোভকারীরা আমার মূর্তি ভেঙে ফেলেছে । এতোদিন লোকে জানতো না আমি কে ! নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়েছিলুম স্ট্যাচু হয়ে, তাও থাকতে দিলো না ।

মামুনুল হক : আমি খেলাফত যুব মজলিসের নেতা । আমি মনে করি ধোলাইখালে শেখ মুজিবর রহমানের মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল। যারা বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন করে, তারা বঙ্গবন্ধুর সু-সন্তান হতে পারে না। এর মাধ্যমে মসজিদের শহরকে মূর্তির শহরে পরিণত করার অপচেষ্টা চলছে। এ মূর্তি স্থাপন বন্ধ করুন। যদি আমাদের আবেদন মানা না হয়, আবারও তৌহিদি জনতা নিয়ে শাপলা চত্বর কায়েম হবে।

সৌরভ হোসেন নিয়াম : আমি হেফাজতের হামলার শিকার হয়েছি, তার কারণ আমার নাম সৌরভ হোসেন সিয়াম ।প্যান্ট খুলে নুনু দেখিয়ে, তাদের কাছে আমার পরিচয় নিশ্চিত করতে হয়েছে। চার কালেমার দুই কালেমা মুখস্থ বলতে হয়েছে। কয়টা সুরা মুখস্থ তা জানাতে হয়েছে। নামের একটা অংশে সৌরভ থাকায় তারা আমাকে মালাউন মনে করেছিল । বিশ থেকে বাইশ মিনিট একটা গাছ কাটার করাত কলে আটক ছিলুম। চারদিকে ঘিরে ছিল দাড়ি-টুপিওয়ালা তৌহিদি জনতা । প্রাণ নিয়ে বেঁচে ফিরতে পেরেছি এটাই অনেক। দুপুরে মাদানীনগর মাদ্রাসার সামনে হেফাজত কর্মীরা যখন বিক্ষোভ করছিল, তখন আমি ভিডিওতে ফোটো নিতে থাকলে তারা আমাকে ধরে মারধর শুরু করেন। সেসময় তারা আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি সংক্ষেপে শুধু ডাক নাম “সৌরভ” বলি। এতেই তারা আমাকে মালাউন মনে করে ব্যাপক মারধর করে। কালেমা পাঠ করার পরও কুড়ি মিনিট আমাকে আটকে রাখেন। অন্য সাংবাদিকরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গেলে আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।

খোকা তুগলক : হেফাজত কী জনাবেআলা ?

তোতলা তুগলক : আআআআবার প্রপপপপপশ্ন । 

জর্জ ফ্লয়েড : হেফাজত হল বজরং দলের আরেক নাম । বজরং দল হল হিন্দুত্ববাদে বিশ্বাসী বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুব বাহিনী। আল হিন্দের উত্তর প্রদেশে দলটা প্রতিষ্টিত হয় এবং গোটা ভারতে  হিন্দু জাতীয়তাবাদ দল হিসেবে ছড়িয়ে পড়ে। এই দলের লক্ষ্য হল গোহত্যা বন্ধ করা আর  রাম এর জন্মভূমি আযোধ্যায় রামজন্মভুমি তৈরি । এছাড়াও ভারতের হিন্দুদের কমিউনিজমের প্রভাবমুক্ত করা , আর  ধর্মান্তর হতে বিরত রাখা। বাংলা নববর্ষ এবং পয়লা বৈশাখকে বিজাতীয় সংস্কৃতি হিসেবে প্রচার করে এর বিরোধিতা করে হেফাজতে ইসলাম। এ বিষয়ে বিভিন্ন সময় বক্ততা, গণমাধ্যমে বাঙালি জাতির মধ্যে বিভেদমূলক, বিদ্বেষমূলক ও ভিন্ন ধর্মের বিরুদ্ধে বক্তব্য প্রদান ও প্রচার করে থাকে। এখানে উল্লেখ্য, বাংলা নববর্ষ বাঙালিদের কাছে বাংলা বছরের প্রথম দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ হলো বাংলাদেশের কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই এই সংগঠনটি বাংলাদেশে ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আন্দোলন পরিচালনা করে আসছে।কিন্তু ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যা হয়েছে তা রীতিমত চমকে দেওয়ার মত ঘটনা।   সুরসম্রাট আলাউদ্দিন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনে আগুন দিয়েছে, সরকারি গ্রন্থাগারে আগুন দিয়েছে, রেললাইন উপড়ে ফেলেছে । 

মার্কিন ভুত : আমি জেফারসন ডেভিস, মার্কিন গৃহযুদ্ধের সময়ে কনফিডারেটের প্রেসিডেন্ট ছিলুম । আমার মূর্তি উপড়ে ফেলে দিয়েছে স্বদেশবাসী । মন খারাপ হয়ে গেল কবরে শুয়ে । তাই আপনাদের জমায়েতে নালিশ করতে এলুম ।

চেঙ্গিজ খান : কনফিডারেট আবার কী ব্যাপার ?

জর্জ ফ্লয়েড : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাতটা বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজ্য  ক্রীতদাসপ্রথা বজায় রাখতে চাইছিল । সেই রাজ্যগুলোকে বলা হয় কনফেডারেট রাজ্য । কনফেডারেশন গঠিত হয়েছিল: দক্ষিণ ক্যারোলিনা, মিসিসিপি, ফ্লোরিডা, আলাবামা, জর্জিয়া, লুইসিয়ানা আর টেক্সাস নিয়ে । এই  রাজ্যগুলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অতি-দক্ষিণ অঞ্চলের এলাকা । তাদের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল – বিশেষত তুলো – আর প্ল্যানটেসান ব্যবস্থায় । তার জন্য তারা আফ্রিকান  দাসদের ওপর নির্ভর করত।  রিপাবলিকান প্রার্থী আব্রাহাম লিংকনের মার্কিন রাষ্ট্রপতির নির্বাচনের মাধ্যমে শ্বেতাঙ্গ আধিপত্য আর দাসত্বের প্রতিষ্ঠানকে প্রতিরোধ করার হুমকি দেওয়া হয়েছিল । তা ছিল এমন এক প্ল্যাটফর্মে যেটা পশ্চিম অঞ্চলগুলিতে দাসত্ব প্রসারিত করার বিরোধিতা করেছিল ।  আমেরিকার গৃহযুদ্ধের সময় অনুগত রাজ্যগুলো ইউনিয়ন হিসাবে পরিচিতি লাভ করে, কনফেডারেশন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র থেকে তার বিচ্ছিন্নতা ঘোষণা করে। কর্নস্টোন অ্যাড্রেস নামে পরিচিত এক বক্তৃতায় কনফেডারেটের সহ-সভাপতি আলেকজান্ডার  স্টিফেনস তার আদর্শকে এইভাবে বর্ণনা করেছিল:  “এই মহান সত্যের ভিত্তিতে আমরা গোষ্ঠীবদ্ধ যে নিগ্রোরা সাদা মানুষের সমান নয়; দাস রাখা, উচ্চতর জাতির অধিকার, তার প্রাকৃতিক ও স্বাভাবিক অধিকার ।” 

ল্যাঙড়া তৈমুর : মোঙ্গোলিয়াতে আমার একখানা পেল্লাই মূর্তি বসিয়েছে । কেউ আবার সেটা নিয়ে জল ঘোলা করবে না তো ?

চেঙ্গিজ খান : না রে ! মোঙ্গোলিয়া নিয়ে পৃথিবীর অতো চিন্তা নেই । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমার দেশে দুর্ভিক্ষও হয় না । এতো পশু, তাদের থেকেই যথেষ্ট দুধ-চর্বি-মাংস পাওয়া যায়।

গুলবদন পিসি : আবুল ফজল ওনার ‘আইন-ই-আকবরি’ বইতে লিখে গেছেন, মোগল যুগে কার্যত বাস্তবেই ছিল ‘লাঙ্গল যার জমি তার’ এই সুনীতি। ব্রিটিশদের নির্যাতনমূলক রাজস্ব নীতি, বিশেষ করে কুখ্যাত ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে’ সুবে বাংলার কৃষক পথে বসে, আর বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা নিলামের জমি জলের দামে কিনে নিয়ে নতুন জমিদার সেজে বসে। তাদের হাতে ছিল নগদ টাকা। অথচ গৃহস্থদের কাছে ছিল জমি আর শস্য। ব্রিটিশরা ফসল দিয়ে রাজকর পরিশোধের হাজার বছরের নীতি পাল্টিয়ে নগদ অর্থে কর শোধের বন্দোবস্ত করায় অবস্থাপন্ন কৃষকরাও ভূমিহীন খেতমজুর হয়ে পড়ে, আর নতুন বেনিয়া মুৎসুদ্দিরা জমির মালিক হয়ে যায়। আল-হিন্দে আবাদ অনুযায়ী ভূমি করের চমৎকার আর বাস্তব বিধান চালু ছিল। যে নতুন চতুর মাড়োয়ারি ও বানিয়া  বাবুশ্রেণী সমাজের নতুন হর্তাকর্তা হয়ে ওঠে তাদের ঘিরে সমাজের চিহ্নিত শোষক ঠগ ও মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণীদের একটি অপবিত্র সংঘ  গড়ে ওঠে, যার মধ্যে ছিল রাজানুগত আমলা , নায়েব, বেনিয়া, দাদনদার, সুদখোর, গোমস্তা, পাইকার, রাখিদার আর শ্রফ বা ব্যাংকার। এই নব্য সুবিধাখোর, সুদখোর চক্র ব্রিটিশ জবরদখলকে কায়েমি করে রাখে।         

ল্যাঙড়া তৈমুর : মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে এসব শুনে ।    

বাবর : শাহজাহান, তুই যেন কী বলতে চাইছিলিস ?                                                                                শাহজাহান : আমি আমার বেগম আর প্রেমিকার জন্যে যে তাজমহল বানিয়েছি, তা আমাদের দুজনকে এমন অমরত্ব দিয়েছে যে পৃথিবীতে সে কথা বলে বেড়াতে হয় না ।

আওরঙজেব : ফালতু কথা । আব্বাহুজুর জানতেন যে নানা শহরে বিশাল আর সুন্দর নকশার অট্টালিকা তৈরি করে রেখে গেলে অমর হয়ে যাওয়া যাবে । আমিও একটা গুরুত্বপূর্ণ বই লিখিয়েছি, যার জন্য আমার ভক্তরা আমায় মনে রাখে । এদেশে ভুল কারণে হলেও, মনে রাখে । পাশের দেশের লোকেরা আমার জন্য গর্ব করে ; ছেলে আর নাতি হলে আমার নামে নাম রাখে । আব্বাহুজুর কতো অ্যান্টিপ্রপাগাণ্ডা করেছেন জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে যে উনি আসতেই চাইলেন না এই জমায়েতে, যখন কিনা আমার বিরুদ্ধে নানা লোকের নানা প্রপাগাণ্ডা সত্বেও এসেছি । জাহাঙ্গিরও নিজের ছেলে খুসরু মির্জার চোখ অন্ধ করে দিলেন আর আব্বাহুজুর অন্ধ লোকটাকে এতো ভয় পেতেন যে তাকে দুর্গের ভেতরেই খতম করে দিলেন । আব্বাহুজুর প্রায়ই অন্য ধর্মের সাধু-সন্তদের ধর্মকথা শোনার নাম করে আগ্রায় ডেকে আনতেন। ওনার ধর্মনিরপেক্ষতার ফাঁদে পা দেবার সঙ্গে সঙ্গে উনি তাদের আস্তিকান্তরিত হবার হুকুম দিতেন। যারা ঐ হুকুম মেনে নিয়ে আস্তিকান্তরিত হতো তারা বেঁচে যেতো। বাকিদের পরদিন সকালেই নানা রকম পৈশাচিক অত্যাচার করে খুন করা হত। সব থেকে বেশী অবাধ্যদের হাতির পায়ের তলায় পিষে মারা হত। তাছাড়া ওনার প্রাসাদের মধ্যে ঘন ঘন যৌন দাসীদের মিনা বাজার  বসিয়ে সেখানে জোর করে ধরে আনা শয়ে-শয়ে কাফের মেয়েদের বেচা-কেনা চলতো, আব্বাহুজুরের জন্য ধরে আনা শয়ে-শয়ে কাফের মেয়েকে উপহার হিসেবে দেয়া, সরকারি খরচে বেশ কয়েকশো নৃত্যপটিয়সী যৌনদাসীর ভরণপোষণ, হারেম সুরক্ষার জন্য কয়েকশো খোজা প্রহরী, ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কামুক আব্বাহুজুর ওনার কামনা ও লালসা চরিতার্থ করতেন। একবার আব্বাহুজুর ফতেপুর সিক্রি অবরোধ করে নির্মম অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কাফের প্রজাদের সর্বস্ব লুট করেন আর অভিজাত হিন্দু মহিলাদের ধর্ষণ করার আর মাই  কেটে ফেলার হুকুম দেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : সেটা কী ? বইয়ের নাম কী ?

আওরঙজেব : ফতোয়ায়ে আলমগীরী,  যাকে আমার ভক্তরা বলে ফতোয়ায়ে হিন্দিয়া । বইটা ইসলামি আইন সংকলন, যা সেই থেকে এই দেশের আইন ছিল।  সুন্নি হানাফি মাজহাবের ভিত্তিতে শরিয়া আইন এতে সংকলিত হয়েছে। অনেক আলেম এই বই লেখায় মদত দিয়েছেন। এতে কুরআন, সহীহ আল-বুখারী, সহীহ মুসলিম, সুন্না আবু দাউদ ও জামি’আত-তিরমিযী থেকে সব লেখা ইনক্লুড করিয়েছিলুম। বইতে বিভিন্ন সম্ভাব্য পরিস্থিতির সাপেক্ষে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, দাস, যুদ্ধ, সম্পদ, আন্তঃধর্মীয় সম্পর্ক, বিনিময়, কর, অর্থনীতি ও অন্যান্য আইন আর  আইনি নির্দেশনা দেয়া আছে । একশো হানাফি আলেম বইটা সম্পাদনায় অংশগ্রহণ করেছিল। সম্পাদক-মন্ডলীর সভাপতি ছিল শায়খ নিজামুদ্দিন।  বইতে বড়-বড় অক্ষরে লেখা আছে তা ইমাম আবু-হানিফার মাজহাব। 

শাহজাহান : কিন্তু তোর ভাষা তাঁবাদি হয়ে গেছে । তুর্কি, ফারসি, হিন্দুস্তানি মিশিয়ে আমার দরবারে যে উর্দুভাষা চালু করেছিলুম, এখন লোকে সেই ভাষা বোঝে । বাহাদুর শাহ জাফর, গালিব, ফিরাক, ফয়েজ, জোশ মলিহাবাদি, মীর তাকি মীর, হোসেইন-উদ-দৌলা এই ভাষায় শায়রি করেছে।

আওরঙজেব : যতোই যাই বলো, তোমার আর জাহানারার শাহজাহানাবাদ শহর তো ধ্বংস করে দিয়ে গেছে নাদির শাহ । যেটুকু টিকে ছিল, তাও ফিরিঙ্গিরা মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে । তোমার বাপ জাহাঙ্গির নিজের ছেলে খুসরু মির্জার  সমর্থকদের শূলে চড়িয়ে মেরেছিল চাঁদনি চকের দুপাশে দাঁড় করিয়ে আর তা দেখার জন্যে খুসরুকে হাতির পিঠে বসিয়ে চাঁদনি চকে নিয়ে গিয়েছিল হাঁকিয়ে । জাহাঙ্গিরনামা পড়েছো তো ?

শাহজাহান : জানি, জাহানারাকে হিংসে করিস, ও আমার সমর্থনে যুক্তি দেয় বলে ।  আমিও জানি, তুই ক্রীতদাসী  হিরা বাইয়ের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলিস আর মেয়েটা  অল্পবয়সে মারা গেল বলে দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলিস । বুড়ো বয়সে মুত্তা রাখেল উদয়পুরী বাইয়ের কবজায় ছিলিস। উদয়পুরী বাই দারা শুকোহর রক্ষিতা ছিল বলে তুই ওই মেয়েটাকে নিজের বিছানায় তুলেছিলিস । ওরা তো ছিল নাস্তিক, তার বেলায় ? এদিকে বিবাহিত স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো নারীর সঙ্গ আস্তিকদের অনুমোদন করে না। তাই মুত্তা। ‘মুত্তা’ বা ‘মুত্তাই’ হচ্ছে অস্থায়ী বিয়ে। নিকার মতো আইনানুগ নয়, কিন্তু বিয়ে তো বটে। তা তুমি যত খুশি মুত্তা করো, কেউ কিচ্ছুটি বলতে আসবে না। এক মুত্তা বেগমের ওপর থেকে বাদশার দিল উঠে গেল তো তার বদলে নতুন কোনো হাসিন মুত্তা বেগমের আবির্ভাব হয় শাহি হারেমে। । নবাব আর শাহজাদাদের প্রথম চার বিবিই শুধু বেগম। বাকিরা মহল। বেগমদের জোর তাদের খানদান, মুত্তা বেগমদের সম্বল তাদের রূপ। তা উদয়পুরির রূপ ছিল আর অদাও। এ দিয়েই সে চুরি করেছিল তোর দিল। তুই ছিলিস উদয়পুরি অন্তঃপ্রাণ। যে অপরাধ করলে অন্য লোকের গর্দান যায়, উদয়পুরি দুষ্টুমি করে সেই কাজ করেছে তোর সামনেই। । মদ-মাদক নিষিদ্ধ করেছিলিস তুই। কিন্তু ফর্সা ত্বকের উদয়পুরির আবার দিন-রাত মদে ডুবে থাকা চাই।   উদয়পুরিও ভালোবেসেছিল তোকে, দারার চিরশত্রুকে। দারা বেঁচে থাকতেই। সেই ভালোবাসায় কোনো খাদ ছিল না, জানি।  মুত্তা বেগম হলেও সাম্রাজ্যের আসলি সম্রাজ্ঞী ছিল উদয়পুরি, তোর বুড়ো বয়সের প্রেমিকা। তোর নয়নের মণি। তাই সন্তানধারণের অনুমতি পেয়েছিল। মুত্তা বেগম হওয়া সত্ত্বেও। মুহম্মদ কামবক্স, উদিপুরির আর তোর ছেলে।  কামবক্সের যখন জন্ম, উদিপুরির বয়স তখন পঁচিশ কি ছাব্বিশ আর তোর পঞ্চাশ। সেই মুহম্মদ কামবক্সকে চিঠি লিখেছিলিস তুই । লিখেছিলিস, ‘তোমার অসুস্থ আম্মিজান আমার মৃত্যুর পর সানন্দে সতী হয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করতে রাজি।’ মুত্তা উদয়পুরি বাই, সহমরণের দাবি করেছিল আর তুই  কামবক্সকে চিঠি লিখে তা করতে বারন করেছিলিস । প্রেমে পড়া গুনাহ নয় । অন্য ছেলেদের পেছনে লেগেছিলিস কিন্তু মুহম্মদ কামবক্সকে ভালোবাসতিস।

আওরঙজেব : আর তুমি কী করেছ ? জাহানারা আর রোশনারার বিয়ে দিলে জামাইরা-বেয়াইরা মিলে তোমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে তোমাকে বাদশাহের সিংহাসন থেকে উৎখাত করে দিতো । তাই ওদের বিয়ে দাওনি । জাহানারা ওর আত্মজীবনীতে লিখেছে ও এক মালাউন সঙ্গীতশিল্পী রাজপুত যুবকের সঙ্গে প্রেমাবদ্ধ হয়েছিল । আত্মজীবনীতে জাহানারা আধুনিক ট্র্যাজিক নায়িকার মতো ব্যক্তিসত্ত্বার হাহাকার ও যন্ত্রণাকে লিপিবদ্ধ করেছে । তুমি পারমিশান দিলে বিয়ে করতে পারতো । ছেলেটা কাফের বলে দাওনি । তোমার ছোট মেয়ে চিমনি বেগমের সঙ্গে তোমার অবৈধ সম্পর্ক নিয়ে দরবারে হাসাহাসি হতো । বড় মেয়ে জাহানারার সঙ্গেও তোমার অবৈধ সম্পর্ক ছিল। তুমি নিজেই তোমার সম্পর্কের কথা প্রকাশ্যেই বলতে আর যুক্তি দেখাতে যে, গাছে ফল ধরলে বাগানের মালিরই অধিকার সবার আগে স্বাদ গ্রহণ করার। তুমি আমাকে ধর্মের আর প্রেমের গল্প শুনিও না ।

শাহজাহান : আকবর বাদশার হুকুম ছিল যে বাদশাদের মেয়েরা বিয়ে করবে না । ওনার নিজের ভগ্নিপতি ওনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছিল, ভুলে গেলি ? আকবর সেই জন্য ওকে কোতল করার হুকুম দিয়েছিলেন ।এমন আজগুবি তর্ক জুড়িস ! ওরা নিজেরাও বিয়ে করতে চায়নি, মনের মতন বর পায়নি বলে । জাহানারার সুফিসঙ্গ পছন্দ বলে বিয়ে করেনি । তুই ওকেও আমার সঙ্গে আগ্রার কেল্লায় বন্ধ করে রেখে দিলি । তোর আতঙ্কে দারা শুকোহ’র বউ নাদিরা বেগম আত্মহত্যা করে নিয়েছিল ।

আওরঙজেব : ওই ফিরিঙ্গিরা মহাবিদ্রোহের পর কী করেছে জানো ? তোমার কিলা-এ-মুবারক, যাকে এখন লাল কেল্লা বলে, সেখানকার বেগমদের আর রাখেলদের ধরে-ধরে ধর্ষণ করেছে । তাজমহলে বাজনা বাজিয়ে সাহেব-মেমরা সন্ধ্যাবেলা রোজ নাচতো । ওই গালিবই লিখেছে, লাল কেল্লা থেকে পাগলের মতন বেরিয়ে দৌড়োতে-দৌড়োতে সুন্দরী বেগম আর খাতুনরা ছেঁড়া জামাকাপড়ে চাঁদনি চকে কাঁদছে, ফিরিঙ্গিদের  থেকে প্রাণে বাঁচার জন্য ।

শাহজাহান : তুইই তো দাক্ষিণাত্যে গিয়ে বসে রইলি, দিল্লিকে, আগ্রাকে, লাহোরকে কমজোর করে দিলি । শিবাজী তোর ফাঁদ কেটে উড়ে গেল বলে বুড়ো বয়েস পর্যন্ত দাক্ষিণাত্যে বসে রইলি । তোর নাতিপুতিগুলো আরও কমজোর করে দিল । ফিরিঙ্গিরা ঢুকে পড়ল । হাতে বাজপাখি নিয়ে ছবি আঁকিয়ে ভেবেছিলিস, দাক্ষিণাত্যে বসে দিল্লি-আগ্রাকে সুরক্ষিত রাখবি ।

পাগলা তুগলক : আমার মনে হয় ইনব্রিডিঙের কারণে বংশধারা ক্রমশ দুর্বল হয়ে গিয়েছিল । ইমাম শাফেয়ী  বলেছেন: “যে সম্প্রদায়ের মহিলারা বাইরের কোন পুরুষকে বিবাহ করে না এবং পুরুষেরা বাইরের কোন মেয়েকে বিবাহ করে না, তাদের সন্তান হয় বোকা ধরনের। (আল ইনতিকা ফি ফাদায়িলিস ছালাছাতিল আয়িম্মাঃ ১/৯৮)।  এছাড়া ইমাম গাজজালী  পাত্রী পছন্দ করার ব্যাপারে যেসব  নির্দেশনা দিয়েছেন, তার মধ্যে একটা হল– পাত্রী যেন নিকটবর্তী আত্মীয় না হয়। কেননা, তা তাদের জৈবিক কামনাকে কমিয়ে দেবে। (ইহইয়াউ উলুমুদ্দিন:২/৪১)। নিকটবর্তী আত্মীয়স্বজন যেমন-ফুফাতো, চাচাতো, মামাতো, খালাতো ভাই বোনদেরকে বিবাহ করলে সন্তান দুর্বল হয় বলে অনেক ইসলামিক স্কলারের অভিমত। সে জন্য বলা হয়, বিবাহ দূরবর্তীদের সাথে হলেই ভালো হয়। মোগলরা এতোশত মানতো না । আলীবর্দী খানের কোনও ছেলে ছিল না। তাঁর ছিল তিন মেয়ে । তিন মেয়েকেই তিনি নিজের বড়ভাই হাজি আহমদ-এর তিন ছেলে, নোয়াজেশ মোহাম্মদের সাথে বড় মেয়ে ঘসেটি বেগমের, সাইয়েদ আহম্মদের সাথে মেজ মেয়ে এবং জয়েনউদ্দিন আহম্মদের সাথে ছোট মেয়ে আমেনা বেগম-এর বিয়ে দেন। ঘসেটি বেগম এসেছেন আপনাদের জমায়েতে । 

তোতলা তুগলক : এএএ ছোঁছোছোড়াটা উউউপদেশ দেদেদেবেই । পাপাপারা গেগেগেলো না এএএকে নিনিবিবিয়ে ।

চেঙ্গিজ খান : আরে তোমরা বাপ-বেটায় ঝগড়া করছ কেন ? কোথায় আজকে সবাই মিলে মৌজমস্তি করবে, তা নয় ঝগড়া আরম্ভ করে দিলে ।

মালিক অম্বর : এই অওরঙজেব লোকটা  নিজের বাপের তাজমহলের নকল একটা বাড়ি হাঁকিয়েছে । ওকেই জিগ্যেস করুন সেটা কেমন হয়েছে । লোকে দেখতে যায় আর ছি-ছি করে । ওর নামের রাস্তার নাম দিল্লিতে অলরেডি পালটে দেয়া হয়েছে । ওর নামে শহরের নামও দিনকতকে পালটে যাবে, দেখে নেবেন ।

আওরঙজেব : যাবে তো যাবে । আমি আমার কাজ কারবারের কারণে অনেকের মনের ভেতরে বংশপরম্পরায় থাকবো । 

শাহজাহান : তুই তো উদয়পুরি বাইকে ভালোবাসতিস । ওর সঙ্গে তো নিকা করিসনি, অথচ ওর ছেলের বাপ হলি। উদয়পুরি বাইও তোকে ভালোবাসতো, তার প্রমাণ আছে ।

মালিক অম্বর : শাহজাহান আমাদের রাজত্ব দখল করেছিলেন বলে আওরঙজেব সেখানে গিয়ে লাঠি ঘুরিয়েছিল। মোগল  সম্রাজ্যের দক্ষিণ সীমান্তে আহমেদনগরের  নিজামশাহী রাজ্য ছিল । আমি ছিলুম প্রধানমন্ত্রী । আমি মারা যাবার পর আমার ছেলে ফতেহ খান প্রধানমন্ত্রী হল ।  নিজামশাহী সুলতান মুর্তজা নিজাম গায়ে পড়ে আমার ছেলে ফতেহ খানের সঙ্গে ঝগড়া আরম্ভ করেছিল ।  রাজ্যের সুলতান মর্তুজার সঙ্গে দ্বন্দ্ব আরম্ভ হলে, সুলতান মর্তুজা ফতে খানকে বন্দী করে জেলে পুরে দিলো । পরে উনি ফতে খানকে মুক্তি দেন। ফতে খান এই অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য মোগলদের সঙ্গে ষড় করে, সুলতান মর্তুজাকে বন্দী করেছিল, আর  ওনার নাবালক ছেলে হুসেন শাহকে সিংহাসনে বসিয়েছিল। ফলে ফতে খান  রাজ্যের প্রকৃত সুলতানে হয়ে যায়। এই সময় শাহজাহান, আপনি, আহমেদনগর জয় করার সিদ্ধান্ত নেন।  মোগল বাহিনী দৌলতাবাদ দুর্গ অবরোধ করে। ফতে খান দশ লক্ষ টাকা শাহজাহানকে ঘুষ দিয়ে ছাড়া পায় আর দুর্গটা মোগলদের দিয়ে দেয়। সুলতান হুসেন শাহকে গোয়ালিয়র দুর্গে পাঠানো হয়। আর ফতে খানকে মোগল সরকারের উচ্চপদ দেওয়া হয়।

অওরঙজেব : তবে ? আমি কখনও ঘুষখোরি করিনি । আমি যা বলেছি, ঠিকই বলেছি । মোগল সম্রাটদের মধ্যে আব্বাহুজুর ছিলেন সবচেয়ে বিলাসী। আকর্ষণীয় স্থাপত্যের প্রতি ওনার শুধু ঝোঁকই ছিল না; বরং তা রীতিমতো এক নেশায় পরিণত হয়েছিল। ফলে আল-হিন্দ জুড়ে গড়ে উঠেছে  এমন সব শৈল্পিক নিদর্শন, যা পর্যটকরা দেখতে আসে । আরজুমান আরা বেগমের সঙ্গে আব্বা হুজুরের প্রথম দেখা হয় ১৬০৭ সালে। তাঁর রূপে আর সেক্সুয়াল আকর্ষণে মোহিত হয়ে যান পনেরো  বছর বয়সী আব্বাহুজুর । এরপর  তড়িঘড়ি করে সেই বছরেই এঙ্গেজমেন্ট । আমার দাদাহুজুর  জাহাঙ্গীরের বউ নূরজাহান ছিলেন আরজুমানের ফুফু। কিন্তু এঙ্গেজমেন্টের দীর্ঘ পাঁচ বছর পর ১৬১২ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে সম্পন্ন হয় তাঁদের। আব্বাহুজুর তাঁর নামকরণ করেন ‘মমতাজ মহল’ । তবে মমতাজ কিন্তু আব্বাহুজুরের একমাত্র স্ত্রী ছিলেন না। ওনার আরও বেগম ছিলেন, এমনকি মমতাজের পরও উনি আরেকটা বিয়ে করেছিলেন, এমনই সেক্সস্টার্ভড মানুষ । মমতাজের  আগে একবার বিয়ে হয়েছিল, আব্বাহুজুরের  ষড়যন্ত্রে সেই সম্পর্কের অবসান ঘটে । তাঁদের দাম্পত্য জীবন স্থায়ী হয় মাত্র উনিশ বছর। এই উনিশ  বছরের দাম্পত্য জীবনে অম্মিজানের কোলজুড়ে আসে চোদ্দটা বাচ্চা। ভেবে দেখুন আপনারা । মারা যান চোদ্দতম সন্তান প্রসবের সময়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণের ফলে। আব্বাহুজুরেরে কাছে প্রেমের সংজ্ঞা ছিল বছরান্তে একটা করে সন্তান ! আব্বাহুজুরের সেক্সুয়াল চাহিদা উবে যায়নি । অম্মিজান মারা যাবার বছর পাঁচেক পর তাঁরই ছোট বোনের সঙ্গে  বিবাহবহির্ভূত অন্তরঙ্গ  সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। 

ঘসেটি বেগম : বলছিস কী আওরঙজেব ভাইজান !

আওরঙজেব : হ্যাঁ  বেগম। ওনার পুরো নাম আবুল মুজাফফর শিহাবুদ্দিন মুহম্মদ শাহজাহান সাহিব কিরান-ই-সানী । আব্বাহুজুরের  যেমন শৈল্পিক  মন ছিল, তেমনি সেই শিল্পের জন্য অহংবোধও ছিল  প্রবল। পরবর্তী সময়ে যদি সেসব শ্রমিকের হাত ধরে তাজমহলের মতো অন্য কোনো অনিন্দ্যসুন্দর স্থাপনা পৃথিবীর কোনো প্রান্তে দাঁড়িয়ে যায়, তাহলে আব্বাহুজুরের নাম অনেকটা স্তিমিত হয়ে যেতে পারে—এই আশঙ্কায়  চরম বর্বরতার পথ বেছে নেন উনি, তাদের আঙুল কাটার হুকুম দেন । তাজমহলে শ্বেতপাথরের ফলকে ফলকে জগদ্বিখ্যাত যে কারুকার্য খচিত রয়েছে, তাতে শুধু শ্রমিকের ঘাম নয়, মিশে আছে তাজা রক্তও। এসব ছবি যখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে, তখন তাজমহলকে প্রেমের নিদর্শন বলতে  দ্বিধাবোধ কাজ করলে তা নিশ্চয়ই খুব একটা অযৌক্তিক হবে না। জীবনের শেষ দিকে তাই আমি আব্বাহুজুরকে বন্দী করে রেখেছিলুম । মারা যাবার সময়ে ওনার নাম ছিল ‘শাহানশাহ আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম, মালিক-উল-সালতানাত, আলা হযরত আবু’ল-মুজাফফর শাহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান প্রথম, সাহেব-ই-কিরান-ই-সানী, পাদশাহ গাজী জিল্লু ‘ ল্লা, ফিরদৌস-আশিয়ানি, শাহানশাহ – ই – সুলতানন্ত উল হিন্দিয়া ওয়াল মুঘালিয়া’ । কী দরকার ছিল অমন নাম নেবার?

ঘসেটি বেগম : কিন্তু তাজমহল ছাড়াও দিল্লির জামা মসজিদ, পাকিস্তানে সিন্ধের শাহজাহান মসজিদ, লাহোরের মতি মসজিদ, লাহোরের শালিমার গার্ডেন, লাহোরের ওয়াজির খান মসজিদ, আগ্রার কেল্লা, লাহোরে নওলক্ষা দুর্গ, দিল্লির কেল্লায় দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, ময়ূর সিংহাসন উনিই তো তৈরি করে গিয়েছেন ।

আওরঙজেব : সেই কথাই তো তোমাদের বোঝাতে চাইছি । ইজ-উন-নিসা, হাসিনা বেগম, ফতেহপুরি মহল, মোতি বেগম, কুদসিয়া বেগম, আকবরাবাদি মহল — ওনাদের কেন অতোগুলো করে বাচ্চা হয়নি । হারেমে আরও কতো রাখেল, বাঁদি, ক্রীতদাসী ছিল । ওনার জন্যেই আমরা ভাইয়ে-ভাইয়ে আর বাপ-ছেলেতে খুনিখুনি করে মরলুম ।

শাহজাহান : তোর উচিত ছিল ফ্যানি হিল বইটা ফারসিতে অনুবাদ করিয়ে পড়া । প্রেম করেছিস আবার রোয়াবও দেখাচ্ছিস ।

ঘসেটি বেগম : ফ্যানি হিল কার লেখা ? ফারসি, তুর্কি, বাংলা, যে ভাষায় হোক অনুবাদ হলে আমাকে এক কপি দিও। লোকে ভাবে আমার হৃদয়ে প্রেম নেই ।

চেঙ্গিজ খান : তুই অমন করছিস কেন আওরঙজেব ? মশা কামড়াচ্ছে নাকি ?

শাহজাহান : বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে ফ্যানি হিলের মত উপন্যাস খুব কম আছে যা এত বার ছাপা হয়েছে। উনিশশো সত্তর সালের আগে উপন্যাসটার প্রকাশ আইনি স্বীকৃতি পায়নি। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে ব্রিটেন থেকে আমেরিকা, ফ্রান্স, আল-হিন্দ আর অন্যান্য বহু দেশে বইটার বেআইনি সংস্করণ ছাপা হয়েছে। প্রথম প্রকাশের ঠিক এক বছর পরে লেখক ক্লিল্যাণ্ডকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। অশ্লীলতার দায়ে ব্রিটেনের প্রিভি কাউন্সিলের সামনে তাঁকে হাজির হতে হয়। সরকারি ভাবে প্রকাশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বাজার থেকে উপন্যাসটা তুলে নেওয়া হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য সব অভিযোগ কাটিয়ে উঠে, ধ্রুপদি সাহিত্যের মর্যাদায় উত্তীর্ণ হয়েছে ফ্যনি হিল। পাঠক সমাজে উপন্যাসটার প্রভাব এত প্রবল ছিল যে লণ্ডনের বিশপ একবার ভূমিকম্পের জন্য বইটিকে দায়ী করেছিলেন।

ফ্যানি হিলের সব থেকে বড় বৈশিষ্ট্য, উপন্যাসটির ভাষা সম্পূর্ণ রূপে বিশুদ্ধ সাহিত্যের, কোনও ভাবেই তার গায়ে বটতলা সাহিত্যের তকমা দেগে দেওয়া যায় না। অক্ষতযোনি ফ্যানি যখন এক কুৎসিত কামুক বেশ্যাসক্ত ইংরেজকে অনুনয় করছে তাকে রেহাই দেওয়ার জন্য, তখন বিকৃত উত্তেজনার বদলে পাঠকের অন্তর ব্যথায় টনটন করে ওঠে। ‘…সে আবার আক্রমণ করছে ফ্যানিকে, জাপটে ধরছে,…উরু দুটিকে নিরাবরণ করছে… ’ – ফ্যানির এমন দুর্দশা পড়ে পাঠকের মনে কাম নয়, জেগে ওঠে করুণা, ক্রোধ ।

উপন্যাসটা মূলত ফ্যানির দুটি দীর্ঘ চিঠির উপর দাঁড়িয়ে। একটি চিঠি নিয়ে প্রথম খণ্ড, দ্বিতীয় চিঠি নিয়ে পরের খণ্ড। মাত্র চোদ্দ বছর বয়সে, বাবা-মাকে হারিয়ে, ল্যাঙ্কাশায়ারের একটি গ্রামের মেয়ে ফ্যানি, ক্রীতদাসীর চাকরির খোঁজে লণ্ডন শহরে পৌঁছয়। সেখানে তাকে ফুসলে নিয়ে যাওয়া হয়  পতিতালয়ে, যেখানে তার সঙ্গে চার্লসের পরিচয় হয়। চার্লসের প্রেমে পড়ে যায় ফ্যানি। উপন্যাসের প্রথম খণ্ডের পাতায় পাতায় বর্ণিত হয়েছে চার্লস ও ফ্যানির প্রেমের সম্পর্ক। কখনও তা পৌঁছেছে কবিতার ভাষায়। ‘…চার্লস আমাকে দেখতে লাগল। আমার শরীরের সব ঐশ্বর্য তার দৃষ্টি ধীর ধীরে উপভোগ করছে। তার হাত দুটি একই সঙ্গে ব্যস্ত আমার শরীরের সর্বত্র।…আমার তাজা সুঠাম অবয়ব, আমার অঙ্গের নিজস্ব ভঙ্গি-ছন্দ, সব কিছু যেন ওকে মন্ত্রমুগ্ধ করেছে। কিন্তু এই শরীরের ওপর দিয়েই তো কিছুক্ষণ আগে আমারই উৎসাহে ঘটে গেছে ওর প্রবল প্রবাহ। এখন ও চাইছে ব্যথা ও ক্ষতর জায়গাগুলোকে মায়াময় চোখ দিয়ে দেখতে।…কিছুক্ষণ পরেই আবার নতুন উদ্যমে শুরু হল ঝড়।’

ফ্যানি হিলের মত উপন্যাস বিশ্ব সাহিত্যে খুব বেশি নেই যার ভাষা, চরিত্রায়ন ইত্যাদি সব কিছু যৌনতার বর্ণনাকে নস্যাৎ করে সামগ্রিক ভাবে ক্লিল্যান্ডের সৃষ্টিকে অনেক উঁচু আসনে বসিয়েছে। পরবর্তী কালে ক্লিল্যান্ডের লেখা আরও দুটি উপন্যাস যথাক্রমে ‘দ্য সারপ্রাইজেস অফ লাভ’ বা ‘দ্য উওম্যান অফ অনার’ কিন্তু কখনও ‘ফ্যানি হিলের’ সমান উচ্চতায় উঠতে পারেনি। আসলে লেখক ফ্যানিকে সাধারণ বেশ্যাদের তুলনায় এক অন্য অবস্থানে পৌঁছে দিয়েছিলেন যেখানে ফ্যানি, তার বেশ্যালয়ের যৌনকর্মের মধ্যে ব্যর্থতা বা অনুশোচনা বা হা-হুতাশ নয়, অনুভব করে এক চরম শারীরিক আনন্দ যার সঙ্গে এক অর্থে নারীর স্বাভাবিক ও ন্যায্য শরীরি মুক্তির কথাও অব্যক্ত হয়ে থাকে যা সেই সময়ের পাশ্চাত্য সমাজে ছিল কল্পনারও বাইরে। ‘আমার সুন্দর পুরুষটি তখন যেন আমার শরীরের সঙ্গে বিচিত্র প্যাঁচে পাকে-পাকে জুড়ে আছে, যাতে আমাদের শরীরের গোপন অন্দরমহল পরস্পরকে ছুঁতে পারে।…’

ঘসেটি বেগম : দারুন, দারুন, আমাকে প্লিজ এক কপি যোগাড় করে দিন শাহানশাহ আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম, মালিক-উল-সালতানাত, আলা হযরত আবু’ল-মুজাফফর শাহাব উদ্দিন মুহাম্মদ শাহ জাহান প্রথম, সাহেব-ই-কিরান-ই-সানী, পাদশাহ গাজী জিল্লু ‘ ল্লা, ফিরদৌস-আশিয়ানি, শাহানশাহ – ই – সুলতানন্ত উল হিন্দিয়া ওয়াল মুঘালিয়া ।

খোকা তুগলক : আমারও এক কপি চাই । 

তোতলা তুগলক : তুতুতুইই কীকী করবি ? 

চেঙ্গিজ খান : কী রে আওরঙজেব, কী হয়েছে ? 

আওরঙজেব : না চেঙ্গিজদাদু, এই ছোঁড়া-ছুঁড়িগুলো আমাকে বিরক্ত করছে :

ল্যাঙড়া তৈমুর : ছোঁড়া-ছুঁড়ি ? কোথায় ছোঁড়া ? কই ছুঁড়ি ? আসার সময়ে আফিমের শরবত আর মদ মিশিয়ে খেয়ে এসেছিস ? তুই তো ওসব ছেড়ে দিয়েছিস শুনেছিলুম ।

আওরঙজেব : দেখতে পাচ্ছেন না ? আমি তো স্পষ্ট দেখছি । অ্যাই, তোমরা বিরক্ত কোরো না । লেখা নেবার হলে অন্যদের কাছে যাও । আমি আর কবিতা লিখি না । ফরমান লিখি ।

রুহ : হিঁঃ হিঁঃ হিঁঃ, আমি দারা শুকোহ, চিনতে পারছিস না ভাইজান ! আমাকে কোথায় দাফন করেছিলিস রে? আল-হিন্দের প্রত্নতাত্বিকরা হুমায়ুন-মকবরায় তিনশো কবর খুঁড়ে, ডিএনএ জাঁচ করিয়ে, আমার হাড়গোড় পায়নি! 

রুহ : হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ, আমি জাহানারা, বাদশা বেগম । ভাইজান, ভুলে গেলি ?

রুহ : কী রে ভাইজান, মনে পড়ছে না ? আমি মুরাদ বকশ । তুই আসবি শুনে আমরা দেখা করতে এসেছি।

রুহ : কেমন আছো আল-সুলতান আল-আজম ওয়াল খাকান আল-মুকাররম আবুল মুজাফফর মুহি উদ-দিন মুহাম্মদ আওরঙ্গজেব  বাহাদুর আলমগীর  বাদশা গাজী, প্রথম আলমগীর ? আমাকে চিনতে পারছ না ? আমি সম্ভাজি, মারাঠা রাজ্যের শাসক । নিজেও তো কতো বড়ো নাম হাঁকিয়েছিলে ?

রুহ : আমাকে চিনতে পারলি না ? আমি নবম শিখ গুরু তেগ বাহাদুর ।

রুহ : আমি শাহ সুজা । মনে পড়েছে ?

রুহ : আমি আপনার ছেলে আকবর । মনে পড়ছে আব্বু ?

জোড়া-রুহ :  কী বুঢঢা ? আমরা দুজন বাচ্চা ছেলে, চিনতে পারছো ? আমাদের বাবার নাম গুরুগোবিন্দ সিংহ !

রুহ : কী চাচাজান ? চিনতে পারছো ? আমি সুলেমান শিকোহ, দারা শুকোহ’র ছেলে । মনে পড়ছে কেমন করে আমায় খুন করেছিলে ?

রুহ : আব্বাহুজুর ! আমি জেব-উন-নিসা, তোমার মেয়ে, নব্বুই বছর বয়স হয়ে গেল, এখনও গদি আঁকড়ে আছো ? মনে পড়ছে আমাকে ? সেলিমগঢ় দুর্গে সারাজীবন বন্দি করে রেখেছিলে ?

চেঙ্গিজ খান : আরে, অমন করে পালালো কেন আওরঙজেব ? ময়ুর সিংহাসনে তো বসেছিল একবার !

ভাগমতি : আপনারা আমার কথা শুনছেন না । ওই ভদ্রলোক বুড়ো হয়ে গেছেন, আত্মীয়স্বজন নেই, তাই হয়তো মাথাটা একটু বিগড়ে গিয়ে থাকবে ।

আওরঙজেব : দেখে নেবো । সব্বাইকে দেখে নেবো । আমাকে চেনো না । দেখাচ্ছি মজা । কফিহাউস থেকে বেরিয়ে নিচে এসো, টের পাবে কতো গমে কতো পরোটা । আমার চামচারা নিচে অপেক্ষা করছে তোদের আড়ং ধোলাই দেবার জন্য । খুলদাবাদ থেকে ট্রেন বাস বদল করে-করে অনেক কষ্টে আসতে হয়েছিল ।

মালিক অম্বর : এই লোকটার ফলোয়াররা   পাশের দেশের বাঙালি-বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, , ছাত্রনেতা শেখ কামাল, শেখ জামাল, তাদের নতুন বিয়ে-করা বউ সুলতানা কামাল আর রোজী জামালকে খুন করেছিল । তাদের হাতের মেহেদির রং বুকের তাজা রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেল। তারা খুন করল মুজিবের ভাই শেখ আবু নাসেরকে,  সামরিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার কর্নেল জামিলকে, যিনি নিরাপত্তা দেবার জন্য ছুটে গিয়েছিলেন। খুন করল ডিউটিতে থাকা পুলিশ অফিসার আর কর্মকর্তাদের। আর সব শেষে খুন করল শেখ রাসেলকে, যার বয়স ছিল মাত্র দশ বছর। ওদের ভাষায়, রাসেলকে মার্সি মার্ডার  করা হয়েছিল। একই সঙ্গে একই সময়ে তারা খুন করেছিল যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মনিকে আর তাঁর অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনিকে। খুন করেছিল কৃষকনেতা আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে, তাঁর তেরো বছরের মেয়ে বেবিকে। রাসেলের খেলার সাথি দশ বছরের আরিফকে। বড়ো ছেলে আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর বড়ো ছেলে চার বছরের সুকান্তকে, তাঁর ভাইয়ের ছেলে সাংবাদিক  সেরনিয়াবাত নান্টুসহ পরিচারিকা আর আশ্রিত কয়েকজনকে।

ল্যাঙড়া তৈমুর : সব দোষ আওরঙজেবের নয় । এর জন্য ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজিও অনেকটা দায়ি । 

চেঙ্গিজ খান : কী বলছ হে !!

মালিক অম্বর : হ্যাঁ, চেঙ্গিজদাদু । স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করল তাঁরই মন্ত্রিপরিষদ সদস্য খন্দকার মোশতাক, রাষ্ট্রপতি হওয়ার খায়েশে। খুনিদের দলে ছিল কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক, মেজর ডালিম, হুদা, শাহরিয়ার, মহিউদ্দিন, খায়রুজ্জামান, মোসলেম গং। 

শাহজাহান : খুনোখুনির কথা শুনে মন ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছে । এবার প্রেমের কথাই শোনা যাক।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ঠিক আছে ভাগমতিদিদি, আপনার প্রেমের কথা বলুন । এখন প্রেম সম্পর্কে আমার সুস্পষ্ট আইডিয়া হয়েছে, যদিও আমার কোনও প্রেমিকা ছিল না ।

ভাগমতি : তখন আমার প্রেমিক মাত্র চোদ্দ বছরের রাজপুত্র।  একদিন মুসা নদীর পাড় ধরে আনমনে যাচ্ছিলেন রাজপুত্র, তখন  দেখলেন যে অনেকেই  মুসা নদীর ওপর নড়বড়ে কাঠের সেতু পেরিয়ে চলেছে ওপারে।কৌতুহলের বশে কয়েকজন কে প্রশ্ন করে জানলেন যে নদীর উল্টোদিকের জায়গাটার নাম যুক্তপুরা। সেখানে একটা গ্রাম আছে চিচলাম বলে।এই গ্রামে  রূপসী নর্তকী আছেন, অসাধারণ কুচিপুড়ি নাচ করেন। কোন মানবীর পক্ষে সেই স্বর্গীয় নাচ করা সম্ভব নয়। উনি নিশ্চয়ই কোন শাপভ্রষ্টা দেবী, স্থানীয় মন্দিরে আজ সেই দেবী নাচবেন । এঁরা চলেছেন তাঁর নাচ দেখতে। সেই মেয়েটাই আমি,  ভাগ্যমতি, আমি নিজের ছন্দে নাচছিলুম । তখন আমর কুড়ি বছর বয়স, আমাকে দেখে রাজপুত্র আমায় ভালোবেসে ফেললেন । আমার নাচ দেখার জন্য আর কোনও লোকের অধিকার রইলো না। শুধু রাজপুত্রের জন্যই আমি নাচতুম। তাঁর বাবা রাজপুত্রের এই অভিসার বন্ধ করতে পারলেন না ।  একবার মুসা নদীতে ভয়ঙ্কর বান এসেছে শুনে পাগলের মতন ঘোড়া ছুটিয়ে আমার কাছে পৌঁছনোর জন্য ঘোড়া শুদ্ধ নদীতে ঝাঁপ দিয়েছিলেন রাজকুমার । 

শাহজাহান : তারপর ? দারুন প্রেম তো !

ভাগমতি : এ ঘটনার পরে সুলতান ইব্রাহিম ছেলের যাতায়াতের জন্য মুসা নদীর ওপর পাথরের   সেতু তৈরি করান যার এখনকার নাম পুরানা পুল।  সুলতান ইব্রাহিম মারা গেলে  সিংহাসনে বসেন আমার প্রেমিক রাজকুমার মহম্মদ কুলি কুতুব শাহ। সকলের আপত্তি অগ্রাহ্য করে ওনার থেকে বয়সে বড় আমাকে উনি বিয়ে করেন । আমাকে  দেওয়া ওনার উপহার ছিল এক নতুন শহরের পত্তন— ভাগ্যনগর। আমি তো কাফের হিন্দু ছিলুম । ইসলাম ধর্ম নিয়ে আমার নাম রাখা হয়  ‘হায়দার মহল’ আর নতুন শহরের নাম হয় হায়দরাবাদ। যে বছর আমার প্রেমিক-স্বামী কুলি কুতুব শাহ মারা গেলেন, সেই বছর আমিও মারা গেলুম । আমাকে আমার প্রেমিকের পাশে গোর দেয়া হয়নি ; ইতিহাস থেকে আমাকে লোপাট করে দেয়া হয়েছে । কিন্তু আমার মেয়ে হায়াৎবক্স বেগমের কবর আছে, আমার জামাই মুহম্মদ কুতুব শাহ, ওদের ছেলে আবদুল্লা কুতুব শাহের সমাধি আছে ; এমনকি আবদুল্লা কুতুব শাহের গায়িকা প্রেমিকা তারামতির কবর আছে । আমি রয়ে গেছি গল্প হয়ে।

ঘসেটি বেগম : ভাগমতিদিদি, গল্পের জোর বেশি হয় কবরের চেয়ে । আমাকে দ্যাখো । আমার তো একটা নাম আছে। অথচ লোকে আমাকে ঘসেটি বেগম বলে বদনাম করে ।

ভাগমতি : আমি উঠি ঘসেটি বেগম আপা । আমার তো কবর নেই । আমাকে আমার গল্পে ফিরে যেতে হবে ।

ঘসেটি বেগম : আমারও তো কবর নেই । আমার আর ওসামা বিন লাদেনের জলকবর । জলের তলায় গিয়ে দেখি ওসামা বিন লাদেন ইউ টিউবে সুচিত্রা-উত্তমের ফিল্ম দেখছে । বলছিল, মালাউন মেয়েরা যে এমন সুন্দরী হয় তা জানতো না । যদি জানতো তাহলে বোমা-বন্দুক নিয়ে খুনোখুনি খেলতো না । অনেকে ছিল আমাদের সঙ্গে । ফর্সামনতন একজন বউ তার নাম শ্রীদেবী আর একজন কালো বউ তার নাম হুইটনি হুসটন, ওরা দুজনে নেশা করে স্নানের টবে ডুবে মারা গিয়েছিল । আর ছিল ব্রায়ান জোনস, লে কর্বুজিয়, হার্ট ক্রেন, ডেনিস উইলসন, অরুণেশ ঘোষ, আরও অনেকে, নানা দেশের পোশাকে ।

ভাগমতি : আহা গো !

ঘসেটি বেগম : জানো তো ? বব ব্যাটা আর মীরজাফরের সঙ্গে পলাশীর যুদ্ধে গোপন চক্রান্তে হাত মিলিয়েছিলুম। বলেছিলুম যতো টাকা লাগে দেবো। বব ব্যাটা আর  মীরজাফর তা বিশ্বাস করেছিল।   নবাব সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধে হেরে মরে গেল, আর মীরজাফরটা ববের হাতের পুতুল হয়ে মসনদে চড়ে বসলো।  ক্ষমতায় প্রভাব ছড়ানোর যে স্বপ্ন দেখেছিলুম তা দুঃস্বপ্ন হয়ে গেল বব ব্যাটার আধিপত্যের কারণে। মোটা টাকা দিতে পারিনি বলে মীরজাফর আর ওর ছেলে মীরমিরন আমার পোঁদে লাগলো। আমাকে বন্দী করে পাঠিয়ে দিলো পুরোনো  ঢাকার জিনজিরা প্রাসাদে। তবু আমি নানান প্যাঁচ কষেছিলুম। ব্যাটারা চটে গিয়ে ভাবলো ভবিষ্যতে বিপদ হতে পারে ।   মীরজাফরটা   কুষ্ঠ রোগে ভুগে মরেছে, বেশ হয়েছে ।  মিরন কয়েকজন অনুচরকে পাঠিয়েছিল জিনজিরায়। মুর্শিদাবাদে নিয়ে যাবার নাম করে আমরা দুই বোন আমেনা বেগম আর আমাকে, সিরাজের নিকটাত্মীয়দের, নৌকায় তুলে বুড়িগঙ্গা-ধলেশ্বরীর  ঠিক  মাঝনদীতে ওদের প্ল্যান অনুযায়ী মিরনের অনুচর আসফ খাঁ নৌকার তলার খিলগুলো খুলে দিয়েছিল। সলিল সমাধি হয়েছিল বুড়িগঙ্গা নদীতে সিরাজের মা আর খালার। এর ঠিক এক সপ্তাহ পরে মীরজাফরের ছেলে মিরন ব্যাটা মাথায় বাজ পড়ে মরেছিল, বেশ হয়েছিল, যেমন কর্ম তেমনি ফল ।

চেঙ্গিজ খান : কী রে ল্যাঙড়া ! তুই বলেছিলিস অনেকে আসবে কফিহাউসে । দারুন একখানা জমঘট হবে । কিন্তু সবাই তো আসছে আর চলে যাচ্ছে । তার চেয়ে চল খালাসিটোলায় যাই, ওখানে নিশ্চয়ই অনেক মালখোরকে পাওয়া যাবে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : উতলা হচ্ছেন কেন চেঙ্গিজদা ? আসবে, আসবে, আমি গুলবদন বেগম, গালিব, বাহাদুর শাহ জাফর, জিনত উন নিসা, মোহম্মদ শাহ রঙ্গিলা, সেনোরা জুলিয়ানা ডা কোসটা, চঞ্চল বাই, সুরোশ বাই, ধ্যান বাই, নাদিরা বানু, বৈরাম খাঁ, মহব্বত খান, সাদুল্লা, মীরজুমলা আর শাহজাহানাবাদের অনেককে বলেছি যে  চেঙ্গিজদা আসছেন কফিহাউসে ।

শাহজাহান : ততোক্ষণ ওই প্রেমিক-প্রেমিকাদের দেখুন, কেমন পরস্পর ফিসফিসানিতে মশগুল ।

চেঙ্গিজ খান : ওনারা কে ? চিনিস ?

শাহজাহান : চিনি চেঙ্গিজদাদু । লুঙ্গিপরা বাবরিচুল লোকটা হল চণ্ডিদাসদা, তার সামনে বিনা ব্লাউজের মেয়েটি রামিদিদি। গোবেচারা জবুথবু ভদ্রলোক হলেন জীবনানন্দদা আর ওনার সামনের সুন্দরীর নাম বনলতা সেনদিদি । মোটা মতন লোকটা , চুলে কলপ সাদা জুলফি, ওনার নাম সুনীলদা তার সামনে মেয়েটা, যদিও বয়স অনেক কম, তার নাম নীরাদিদি । নিজের মনে কথা বলছেন ওই লোকটা বিনয়দা আর ওনার সামনে ন্যাড়ামাথা মেয়েটি গায়ত্রীদিদি । ওপরে দেখুন বারান্দায় ওই চশমা-পরা লোকটা ভাস্করদা আর ওঁর সামনে, আমাদের দিকে পেছন ফিরে ওই মেয়েটির নাম সুপর্ণাদিদি । ওদের পাশের টেবিলে চুপ করে বসে আছেন দুজনেই, শক্তিদা আর শীলাদিদি । তার পাশের টেবিলে যাঁরা, তাঁরা বাংলাদেশি আবুল হাসান আর সুরাইয়া খানম । হামিদুর রহমান আর নভেরা আহমেদ।

বাবর : এখানে হোমোরা আসে ?

শাহজাহান : হ্যাঁ,  ওই তো । অ্যালেনদা আর অরলভস্কিদা । ওনারা বিদেশ থেকে এসেছেন । এদেশের কারা হোমো বলতে পারব না । রঙিন মিছিল বেরোয় তাতে তো কবি বা কবিনীদের দেখিনি কখনও ।

চেঙ্গিজ খান : শাহজাহানাবাদের কথা বলছিল ল্যাঙড়া তৈমুর । জায়গাটা কোথায় ?

শাহজাহান : চেঙ্গিজদাদু, আপনি সেনর ভাস্কো দা গামার মুখে শুনুন, নয়তো নিজেরই গুণগান করা হবে ।

ভাস্কো দা গামা : এখনকার পুরোনো দিল্লির নাম শাহজাহানাবাদ, তৈরি হয়েছিল জাহানারাবেগমের প্ল্যান অনুযায়ী। এখন আল-হিন্দের রাজধানি দিল্লি শহরের  অংশ।  শাহজাহানবাদ নামে পাঁচিল ঘেরা শহর হিসেবে তৈরি করা হয়েছিল  । শাহজাহান, সে সময়ের মোগল সম্রাট, আগ্রা থেকে মোগল রাজধানী দিল্লিতে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন।  শহরটা তৈরি করতে তিরিশ বছর লেগেছিল। আল-হিন্দের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে পতনের আগে পর্যন্ত শাহজাহানাবাদ ছিল মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী ।  সুন্দর মসজিদ আর বাগানে সাজানো ছিল ।  রাজপুত্রদের, আর সম্রাটের বাড়ির সদস্যদের ভবনে ভরা ছিল। আল-হিন্দের অন্য জায়গা থেকে আসা লোকেদের  ঢেউয়ের ফলে এখন  অত্যন্ত জনাকীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এটা এখনও মহানগর দিল্লির প্রতীকী হৃদয় হিসাবে কাজ করে। আর বাজার, স্ট্রিট ফুড, শপিংয়ের জায়গা আর মোগল স্থাপত্যের জন্য পরিচিত; পুরানো শহরের মাঝে বিশাল দাঁড়িয়ে আছে শাহজাহানের তৈরি  জামে মসজিদ । সেসময়ের মাত্র কয়েকটা হাভেলি টিকে রয়েছে  । শাহজাহানাবাদের ঠিক মাঝখানে দিল্লির লাল কেল্লা । তবে সেই লাল কেল্লা আর নেই । আর মাঝখানের জায়গাটার নাম এখন চাঁদনি চৌক ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : চাঁদনি চক নাম কেন ?

ভাস্কো দা গামা : চাঁদনী চৌক বা ‘মুনলিট স্কয়ার’  শাহজাহানের মেয়ে জাহানারা বেগম তৈরি করেছিলেন। শাহজাহানাবাদে বিবি কা সেরাইয়ের সামনে ছিল একটা ঝিল, চারপাশে ছিল বাড়ি, আর চাঁদনি রাতে, এই ঝিলে  চাঁদনি প্রতিবিম্বিত হয়ে ভবনগুলোকে আলোকিত করত –  তাই এর নাম চাঁদনী চৌক । এখন আবার চাঁদনি চৌককে পুরোনো দিনের জৌলুস দেবার চেষ্টা করা হচ্ছে । লাল কেল্লা আর ফতেহপুরী মসজিদটির দু’পাশে চাঁদনী চৌক বাজারের সামনে দেড় কিলোমিটার  পুনর্নির্মাণ করা হচ্ছে যা হবে কেবলমাত্র পথচারীদের জন্য । মোগল-যুগের স্হাপত্যের অনুকরণে প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, জলের ব্যবস্হা, এটিএম, টয়লেট কমপ্লেক্স আর রাস্তার পাশে বসার বন্দোবস্ত থাকবে।

চেঙ্গিজ খান : কী রে ল্যাঙড়া ! মীরজাফর, সিরাজ, মীরান, মুর্শিদকুলি খান, আলিবর্দী খান, ওদের খবর দিয়েছিলিস যে আমি কফিহাউসে গ্যাঁজাতে আসবো ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : জানেন তো চেঙ্গিজদা, মির্জা মুহম্মদ সিরাজউদ্দৌলা হলো  আলীবর্দী খানের দৌহিত্র আর   জৈনুদ্দীন আহমদ খান আর  আমিনা বেগমের ছেলে । জানতে চাইছিল কোন ঘাটে নেমে কলেজ স্ট্রিটের কফিহাউসে পৌঁছোতে হবে, আর সেখান থেকে সোনাগাছি কতোদূরে ! ব্যাটা আমাদের মতন তরোয়াল চালাতে শিখবে, তা নয়, মাগিবাজি আর কচিকাঁচাদের পোঁদ মারায় সময় নষ্ট করে । এও ইনব্রিডিঙের ফসল ।

ঘসেটি বেগম : ওরা না এলেই ভালো । আমি তো ট্রেনে করে এসেছি । ওরা এসে তোমাদের মিসোজিনিস্ট আড্ডাকে আরও নোংরা করে দেবে । যত্তো সব পিতৃতান্ত্রিক ষড়যন্ত্র । 

ঢ্যাঙা তুগলক : একটিমাত্র চোখ, হেমলকে প্রতিবিম্বিত চক্ষুসদৃশ, তাহার দিকেই, মিলন অভিলাষিণী নববধূর দিকে চাহিয়াছিল, যে চক্ষু কাঠের, কারণ নৌকাগাত্রে অঙ্কিত, তাহা সিন্দুর অঙ্কিত এবং ক্রমাগত জলোচ্ছ্বাসে সিক্ত, অশ্রুপাতক্ষম, ফলে কোথাও মায়া রহিয়া গেল।

তোতলা তুগলক : নিজের মনে বিড় বিড় করা তোর গেলো না রে ঢ্যাঙা !

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই যে কে একজন এলেন । আমি তো চিনি না । তুমি কে গো বাছা ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : আমার নাম সাবিত্রী নামবুদিরি, কেরালা থেকে আসছি, মানে কোচিন । চেঙ্গিজবাবু কলকাতার কফিহাউসে আসছেন আর জব্বর আড্ডা হবে শুনে থাকতে পারলুম না । আমার গল্প তো আপনারা জানেনই না । শুনে আপনাদের লবডঙ্কার লঙ্কা ঝুলে পড়বে !

ভাস্কো দা গামা : কেরালায় তো অনেক মালায়ালিকে আমরা আস্তিকান্তরিত করেছিলুম, আপনি কি তাদের বাড়ির কেউ ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : না, আমি ঘোর নাস্তিক । ছেষট্টিজন আস্তিকের কাছা খুলে নিয়েছি । রসিয়ে রসিয়ে বলব কিন্তু। আমি একাই নবজাগরণ ঘটিয়ে দিয়েছি নামবুদ্রী বামুনদের সমাজব্যবস্হায় । এখনকার রাজনীতিতে তাই ওরা বেপাত্তা।

চেঙ্গিজ খান : মানে ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : আমি কেরালার এক নাম্বুদিরি ব্রাহ্মণের মেয়ে । আমার জন্মের সময় নক্ষত্ররা বিপদ সংকেত দিয়েছিল । জানেন তো নাম্বুদিরির পুরুষরা সব সময় বিশুদ্ধ থাকার ভান করে । নাম্বুদিরি মহিলাদের কাছে অমন বিশুদ্ধতা হলো অভিশাপ। তারা নির্দ্বিধায় চলাফেরা করতে পারে না, কারণ তাহলে অপরিচিতদের দৃষ্টিতে তারা অধঃপতিত হয় । পুরুষদের খাওয়ার আগে তারা খেতে পারে না, তবে রান্না করাটা  তাদের  দায়িত্ব। তারা সোনার কোনও অলঙ্কার পরতে পারত না, নাম্বুদিরি কনের জন্য কেবল পিতলের চুড়ি । অল্প বয়স্ক যুবকরা যখন নিয়ম মেনে চলত, তখন পুরানো নিয়মের কারাগারে আটকে পড়ত মেয়েরা  । আমি ছিলুম অন্তরালবর্তিনী, পরদার বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ ছিল। তাদের চোখ আছে তবে আনন্দের ব্যাপার দেখা বারন ।  তাদের পা আছে তবে তাদের চলাচল নিষিদ্ধ । বাড়ির মেয়ে আর বউরা যেন জেলখানার প্রাণী ।  তাদের তাজা বাতাসে শ্বাস নেয়া, পৃথিবী দেখার অনুমতি নেই। একজন নাট্যকার  তো আমাদের জীবনকে  নরকের স্বীকৃতি দিয়েছিল । “একজন অন্তরালবর্তিনী কাঁদতে-কাঁদতে জন্মেছে, কান্নায় তার বেঁচে থাকা, আর কেঁদে কেঁদে মরে যাওয়া” । নামবুদিরিদের, নিজেরা ছাড়া, কোনও ঈশ্বর ছিল না ; শ্রদ্ধার জন্য কয়েকশো দেবতা ছিল – উত্তরে দেবতা, দক্ষিণে দেবতা; পূর্ব এবং পশ্চিমে, ছাদে দেবতা, মন্দিরে দেবতা আর আগুনেও দেবতা । এই সমস্ত দেবতাদের অনেক দাবী । তাদের  স্নান করাতে হবে – সকালে একটি স্নান এবং সন্ধ্যায় এক। আপনি বাসা থেকে বের হলে একটি স্নান, এবং কোনও যাত্রী দ্বার পেরিয়ে গেলে স্নান। যদি নিম্নবর্ণ আপনার পথে আসে, তবে স্নান  করতে হবে ।  বিশুদ্ধতা ছিল লক্ষ্য, কিন্তু এটি ছিল আনুষ্ঠানিক নিপীড়নের উপায় ।  হাতে তারা হাতকড়া পরিয়ে  দিল আর মনকে করা হলো দাস । রাজারা নামবুদিরি পুরুষদের   প্রণাম  করতেন, আর  রাজার বোনরাও  প্রণাম করতো । বউদের একমাত্র কাজ সন্তানদের জন্ম দেওয়া। আর পুরুষ  যদি  অন্য স্ত্রী আনে, তবে প্রথম স্ত্রীকে আনন্দ করতে হবে  যাতে আরও একজন দাসত্বের আনন্দ উপভোগ করতে পারে । দুইবার জন্মগ্রহণকারী প্রভুর নির্দেশে দেহ ও আত্মাকে স্বামীকে উপহার দেয় তারা। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : সাবিত্রীদিদি, আসল গল্পটা বলুন তো । আমি যে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছি ।

সাবিত্রী নামবুদিরি : আঠারো বছর বয়সে আমাকে একজন বুড়ো নামবুদিরির সঙ্গে বিয়ে দেয়া হলো । তার তো লিঙ্গই দাঁড়াতো না । আমার  থিয়েটার দেখতে ভালো লাগতো, কিন্তু বুড়ো বর কোথ্থাও নিয়ে যেতো না । একদিন আমি একজন কথাকলি অভিনেতার সঙ্গে যৌন সম্পর্ক করলুম। কী যে আনন্দ, কী বলব ! লোকটা তখন কীচক সেজেছিল, যে অন্যের স্ত্রীকে পেতে চায় । ব্যাস রাস্তা খুলে গেল । আমি বহু পুরুষের সঙ্গে সেক্স করলুম ।  এমনকি নামবুদিরি পুরুষদের সঙ্গেও, যারা সবসময় পবিত্রতার ভান করে ।

চেঙ্গিজ খান : তারপর ?

সাবিত্রী নামবুদিরি : বছরটা ছিল ১৯০৫, আর  কেলেঙ্কারিটা সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশিত হলো । সমস্ত কেরালায় একই সঙ্গে আমার বিরুদ্ধে আর নামবুদিরিদের বিরুদ্ধে লোকে রাগে ফেটে পড়ল । আধুনিকতার ঢেউ থেকে নামবুদিরিরা খুব দূরে থাকতো। হঠাৎ তাদের মহাবিশ্ব ডুবে যেতে লাগল । ওদের নৌকায় ইতিমধ্যে আমি ছ্যাঁদা করে দিয়েছিলুম যা বন্ধ করার উপায় ছিল না । আমাকে যখন রাজা জিগ্যেস করলেন, আমি বলেছিলুম “আমি একা আইন ভঙ্গ করিনি। যে লোকগুলো আমার শোবার ঘরে এসেছিল তাদেরও বিচার করা উচিত। আমি বিশ্বাসঘাতকদের তালিকা তৈরি করে প্রকাশ করে দিলুম । আমি যাদের সঙ্গে সেক্স করেছি তাদের নাম আর তারিখগুলো জানতুম, এমনকি তাদের পরিবারের নামও জানতুম । আরও অনেক বিবরণ – যেমন দেহের জন্মচিহ্ন, কোথায় জড়ুল বা  একটি তিল আছে ইত্যাদি  । ছেষট্টিজনের পুরো তালিকা দেখে ঢি-ঢি পড়ে গেল কেরালায় । তারপর থেকে নামবুদিরিরা অনেক পালটেছে । আমি চলে গিয়েছিলুম তামিলনাডুতে, নাম বদলে  থাকতুম । সেখানেই আমার শবদাহ হয়েছিল ।

ভাস্কো দা গামা : নিচু জাতের অবস্হার সুযোগ আমরা যেমন নিয়েছি, তেমন ডাচ আর ব্রিটিশরাও নিয়েছিল ।১৮৭১ সালের মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি আদমশুমারির প্রতিবেদনে দাসত্ব সম্পর্কিত একটি নোটে, আদমশুমারি কমিশনার উল্লেখ করেছিল যে কোনোরকম ব্যতিক্রম ছাড়া পুরো নিম্নবর্ণ সম্প্রদায়  উচ্চতর বর্ণের দাস ছিল , আর কৃষিক্ষেত্রের প্রায় সব চাষির একই রকম  অবস্থা ছিল।সেসময়ে  হিন্দু আইনের আওতায় আনুষ্ঠানিকভাবে পনেরো ধরণের দাসত্ব স্বীকৃত ছিল এবং স্পষ্টতই ব্রাহ্মণরা কখনও দাস হতে পারতো না। পর্তুগিজ বা ডাচ দাসব্যবসায়ীদের মতন অতো সক্রিয় না হলেও,  ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ  পরিবারসহ ছোট বাচ্চাদের কেনার জন্য  দাক্ষিণাত্যে দুটি ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ও সামাজিক বিপর্যয়ের পুরোপুরি সুযোগ গ্রহণ করেছিল।  তানজোর আর মাদুরাইয়ের স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকেও তারা দাস কিনে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে চালান করতো । ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়ায় অমন অনেক মানুষ পাবেন ।

ঘসেটি বেগম : আরে বাহ ! তুমি তো ভালো বদলা নিয়েছিলে । আমি বদলা নিতে পারিনি । ট্রেনে একজন জিগ্যেস করছিল আমি চিৎপুরের কোন যাত্রা কোম্পানিতে আছি, আর কোন ভূমিকায় অভিনয় করছি । বললুম ঘসেটি বেগমের । বিশ্বাস করতে চাইল না । বলল, ওই ভূমিকায় আপনাকে মানাবে না, আপনি বরং প্রথম রানি এলিজাবেথের ভূমিকায় অভিনয় করুন ; উনি ন্যাড়া হয়েছিলেন আর আপনার টাক মুকুটের তলায় দেখা যাচ্ছে । টাক কী আর আপনা থেকে পড়েছে ! কতো যে দুশ্চিন্তা আমার, কেউ বুঝলো না । 

সাবিত্রী নামবুদিরি : আপনারা ডাকেননি । তবু এসে আমার গল্প শুনিয়ে গেলুম । এখন যাই । কফিহাউসে আগে আসিনি কখনও ।

ভাস্কো দা গামা : আমার বাড়িও ওখানেই ছিল । পাশেই  প্রাচীন সেন্ট ফ্রান্সিস চার্চ।  ওই চার্চে আমাকে গোর দেয়া হলেও চোদ্দ  বছর পর আমার  কফিন তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল পর্তুগালে। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আপনারা, চেঙ্গিজদা আর ল্যাঙড়াদাকে দেখার জন্যে কতো দূর থেকে কতো কষ্ট করে এসেছি ।  উঁচু জাতগুলোর কাজকারবারের জন্যে আনেককে খ্রিস্টান বানাতে আমাদের এতো সুবিধা হয়েছে যে কী বলব । রাজাটাও ছিল উঁচু জাতগুলোর ধামাধরা ।  ট্রাভানকোরের রাজারা মুলাক্কারাম নামে দলিত মহিলাদের উপর একটি স্তন ট্যাক্স আদায় করত । যে দলিত মহিলারা নিজেদের মাই আঁচল দিয়ে ঢাকতো, তাদের মাই ট্যাক্স দিতে হতো । উঁচু জাতের লম্পটদের কী যে মজা, সারাদিন মাই দেখে বেড়ায় । যাদের মাই যতো যত বড় হতো তত বেশি ট্যাক্স দিতে হতো । যাদের পয়সাকড়ি ছিল তারা মাই ঢাকতো আর ট্যাক্স দিতো ।  কিন্তু উঁচু জাতের মহিলারা তাদের মাই দুটো ঢেকে  রাখতে পারত, রাষ্ট্রকে কোনও ট্যাক্স দেবার প্রয়োজন ছাড়াই। নাঙ্গেলি নামে এক গরিব দলিত মহিলা কর দিতে অস্বীকার করে ।  যখন কর আদায়কারী তাকে ধাওয়া করে, তার বাড়িতে ঢুকে মাই ঢাকা দেবার  জন্য ট্যাক্স  দাবি করল, তখন নাঙ্গোলি নিজের দুটো মাই ছুরি দিয়ে কেটে কলাপাতায় রেখে ট্যাক্স আদায়কারীর সামনে তুলে ধরল । সে ব্যাটা তো ভয়ে পালিয়ে গেল, আর নাঙ্গেলি ট্যাক্স আদায়কারীর বাড়িতে ঢুকে মুখ থুবড়ে পড়ে মারা গেল । তার স্বামী দুঃখে ক্লান্ত হয়ে নাঙ্গেলির শবের সঙ্গে লাফিয়ে পুরুষ-সতী হয়েছিল  ।  এই করের অবসান ঘটাতে রাজা বাধ্য হয় । নাঙ্গোলি যে বাড়িতে থাকতো সে জায়গাটা মুলাচিপারাম্বু নামে এখন বিখ্যাত । সেই থেকে দলিতরা উঁচু জাতের ওপর যতো চটেছে আমরা ততো তাদের খ্রিস্টান্তরিত করেছি । 

নোবিলিআত্মন : আমি হিন্দু সন্ন্যাসী হয়ে মীনাক্ষী মন্দির ঘুরে দেখেছি, মন্দিরে বসে ইনফিডেলদের মতন ধ্যান করেছি। ইনফিডেল হিদেনদের কল্পনাই যেন বাস্তব জগত । তিনটে মাইয়ের মূর্তি আছে মন্দিরে । তামিলনাড়ুর  পান্ডিয়ান রাজা মলিয়াধাজার মেয়ে জন্মেছিল তিনটে মাই নিয়ে। রাজা, ছিল শিবভক্ত, কিন্তু নিঃসন্তান, বছর তিনেক তপস্যা করার পরে মেয়ে হয় । আয়োনিজা নামে বাচ্চাটা জন্মেই রাজপরিবারকে হতবাক করে দেয় কারণ তার দুটির পরিবর্তে তিনটি স্তন রয়েছে। রাজা  ভেবেছিলেন বোধহয়  কোনও দৈত্যের দ্বারা অভিশাপিত হয়েছেন । শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন, তখন তিনি  জানালেন যে মেয়েটিকে একজন পুরুষের মতোই বড় করা উচিত আর যখন সে বিয়ে করবে, তখন তার তৃতীয় মাই অদৃশ্য হয়ে যাবে। মীনাক্ষী, এই ‘ত্রুটি’ সত্ত্বেও   সুন্দরী  হয়ে বেড়ে ওঠে । যখন সে শিবের সাথে দেখা করে, আর তার প্রেমে পড়ে যায়, তখন তার তৃতীয় স্তন অদৃশ্য হয়ে যায় ।  এখন তিনি তামিলনাড়ুর বিখ্যাত মীনাক্ষী মন্দিরের মীনাক্ষী হিসাবে পূজিত হন। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : বা্হ, মাই দেখে বেড়িয়েছো কাফেরের রূপ ধরে ?

নোবিলিআত্মন : না, আমি প্রয়াগে পূর্ণকুম্ভতেও নাগা সন্ন্যাসীদের সঙ্গে ল্যাঙটোপোঁদে  দৌড়ে গঙ্গায় ঝাঁপ দিয়েছিলুম। নাগা সাধু দিগম্বর অখিলেশপুরীর সঙ্গে কথা বলে জেনেছি ওনাদের লিঙ্গ অকেজো করে দেওয়া হয়। তাই কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। যারা যৌন কামনার প্রবল বেগকে সামলে নিতে পারে তারাই নাগা। উনি বললেন,  সেই সিদ্ধি লাভ করে যে যৌনবাসনার বিরুদ্ধে জয়ী হয়। আল-হিন্দে এসে আমার যৌনবাসনা নষ্ট হয়ে গেছে । 

ল্যাঙড়া তৈমুর : মাই নিয়ে ভাবো মনে হয় । আকার-প্রকার নিয়ে চিন্তা করো ?

পাগলা তুগলক  : আমি বলছি জনাবেআলা । আমরা এখন ভোগবাদী সমাজে বাস করি, আর কোনো চাকরি বা কাজের জন্য বুদ্ধিমতী হলেও, শারীরীক আকর্ষণ হল সফলতার একটা সিঁড়ি । সুন্দর মুখমণ্ডলের ও দৈহিক কাঠামোর নারীরা কাজের বাজারে বেশি সুযোগ পান । তবে অত্যন্ত বড়ো মাপের স্তন আবার এক্ষেত্রে ক্ষতিকারক হতে পারে, তখন শল্যচিকিৎসা করিয়ে স্তনের মাপ ছোটো করার পথ ধরতে হবে । এখনকার ফ্যাশানও হয়েছে বড়ো মাপের বর্তুল স্তন আর খাঁজ । পোশাকের ডিজাইনাররা সেইভাবেই সুন্দরীদের উপস্হাপন করেন । অত্যন্ত বড়ো মাপের বা অত্যন্ত ছোটো মাপের স্তন হলে বাজারে ব্রা পাওয়াও কঠিন হয়ে যায় । সিলিব্রিটি সংস্কৃতির জগতে ছোটো মাপের স্তন নারীজগতে ঠাট্টা-ইয়ার্কির ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায় — স্তনের মাপ বাড়িয়ে তোলার এও একটা কারণ । খ্যাতি আর জনপ্রিয়তার ভোগবাদী বাজারে স্তন এখন গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র — শল্যচিকিৎসা নারীকে বহুকাল যৌবন ধরে রাখার সুযোগ করে দিয়েছে । মিডিয়া যেহেতু সেলিব্রিটিদের  রোল মডেল  হিসাবে তুলে ধরে, তরুণীরা তাঁদের পথ অনুকরণ করেন । পর্ন ফিল্মগুলোতে যাঁরা অভিনয় করেন তাঁদের স্তন বেশ বড়ো হয় এবং অনেকে অমন ফিল্মে অভিনয় করার জন্যও স্তনের মাপ অবিশ্বাস্যভাবে বড়ো করে তোলেন । সানফ্রানসিসকোতে বুক-খোলা মেয়েরা জুতো পালিশ করেন, বার-ডান্স করেন বুক খুলে । বিভিন্ন দেশে প্রতিবাদের জন্য নারীরা বুক খুলে দাঁড়িয়ে পড়েন । স্তনের যৌনতা একই সঙ্গে আক্রমণের অস্ত্র আবার অনুরাগের ডাক দেবার কুহক।

তোতলা তুগলক : ছেলেটা মাঝখানে কথা বলা ছাড়তে পারল না ।

ভাস্কো দা গামা : আর কী জানো মাইয়ের ব্যাপারে ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার, পোপ যখন পর্তুগাল আর স্পেনকে নির্দেশ দিলেন যে তারা যথাক্রমে পূর্ব আর পশ্চিম বিশ্বকে লুটপাটের জন্য ভাগাভাগি করে নিক, তার পর  সমস্ত প্রাচীন  সংস্কৃতি মূল থেকে ধ্বংস হয়ে গেছে — মিশরীয়, ইরানি, মেসোপটেমিয়ান, গ্রিক আর রোমান, আমেরিকার মায়া ও অ্যজটেক  এবং আরও আদিম জীবন-পদ্ধতি। ভারতে তারপর আবির্ভাব হলো ইসলামি শাসকদের । নগ্নতাকে যৌন ‘পাপ’ হিসাবে দেগে দিয়েছে তারাই, এমনকী যৌনতাকেও তারা লজ্জাজনক পাপকর্ম হিসাবে চিহ্ণিত করে দিয়েছে বিভিন্ন উপনিবেশে।  স্তন যেহেতু যৌন আহ্লাদ উদ্রেক করে, তাই স্তন ঢাকার চল শুরু হল তাদের আবির্ভাবের পর । অজন্তায় বুদ্ধের মা নিজের স্তন ঢেকে রাখেননি, আর তা সম্ভব হয়েছে ভারতে নগ্নতাকে লজ্জাজনক মনে করে হতো না বলে । দক্ষিণ আফ্রিকার জুলু আদিবাসদীরা এখনও স্তনকে খোলা রাখেন — প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জেকব জুমার নবম বিয়েতে তাঁর হবু স্ত্রী সমেত আগের বউরা আর কুড়িটা বাচ্চাদের মধ্যে মেয়েরা বুক খুলে নেচে ছিলেন । প্রাচীন ভারতে স্তনের সঙ্গে যেমন ফার্টিলিটির সম্পর্ক ছিল তেমনই ছিল যৌনতার । ধনী পরিবারের নারীর পরিধান ছিল উত্তরীয়, অন্তরীয় আর কোমরবন্ধ — উত্তরীয় এখনকার ওড়নির মতন যেটি দিয়ে বুক বাঁধা যেতো । অনেকে বাঁধতেন না, কেবল ঢেকে রাখতেন । মোগল বেগমরাও যে স্বচ্ছ মসলিনে ঢেকে রাখতেন তা এঁকে গেছেন মিনিয়েচার চিত্রকররা । জেনানা মহলে তাঁরা স্তনকে লুকোবার চিন্তায় ভুগতেন না তার কারণ খোজারা ছিল তাঁদের রক্ষী। কোনো কোনো বেগম, যাঁদের বিয়ে হতো না, তাঁরা স্তনে খোজাদের আদর নিতেন ।

ভাস্কো দা গামা : আমি জানতে চাইলুম, আর আমার দেশকেই দোষ দিচ্ছ ।

বাবর : মোগল বেগমদের ব্যাপারে যা বলেছে তা আমার কানেও এসেছে । কীই বা করবে । ওদেরও তো আনন্দ দরকার ।

চেঙ্গিজ খান : ল্যাঙড়া, তুই সম্রাজ্ঞী, বেগম, রানি, খাতুনদের ডাকিসনি ? মেয়েদের গল্পগুলো বেশি ইনটারেসটিঙ ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ডেকেছি তো চেঙ্গিজদা। কুতলুক নিগার আনাম,  গুলবদন বেগম,খানজাদা বেগম,জিজি অনগা, মাহাম অনগা, দিলদার বেগম, বেগা বেগম, হামিদা বানু, সলমা সুলতান বেগম, মারিয়ম-উজ-জমানি, রোশনারা বেগম, আসিয়ান দৌলত বেগম, জিনত-উন-নিসা বেগম, জেব-উন-নিসা বেগম, গুলরুখ বেগম, গুলনার আগাচা, নারগুল আগাচা, চাঁদ বিবি, খুঞ্জা হুমায়ুন, বেগম সমরু সবাইকে বলে এসেছি । নুরজাহানকে বলার সাহস হয়নি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আরে, এ তো দেখছি আফজল খান আসছে, পেট থেকে নাড়িভূঁড়ি বেরিয়ে ঝুলছে, টপটপ করে রক্ত পড়ছে । ওর অবস্হার কথা জানতুম বলে বলিনি আসতে, তবুও এসেছে । কী রে আফজল, তুই আবার এলি কেন এই অবস্হায় ? প্রতাপগড় দুর্গের কবরে তো ভালোই ঘুমোচ্ছিলিস !

আফজল খান : তোমরা আজ কফিহাউসে আসছো আড্ডা দিতে, তাই সুযোগটা হাতছাড়া করতে চাইনি ।:তোমরা তো জানো বিজাপুরের সুলতান শিবাজীকে দমন করার জন্য আমাকে পাঠিয়েছিলেন। বন্ধুত্বের বার্তা দিয়ে শিবাজীকে আমন্ত্রণ পাঠিয়েছিলুম। কিন্তু কী আর বলব !  শিবাজী আমার অভিসন্ধি টের পেয়ে গিয়েছিল ।আলিঙ্গনের অজুহাতে যখন শিবাজীকে খুন করবার জন্য রেডি হয়েছি ঠিক তখনই শিবাজী গোপন হাতিয়ার বাঘনখ বের করে আমার পেটের নাড়িভূঁড়ি বের করে দিলে । তাতেই আমি অক্কা পেলুম । আমাকে বাঁচাতে আমার দেহরক্ষী কৃষ্ণানাজী ভাস্কর কুলকারনি তরোয়াল বের করে শিবাজীর দিকে তেড়ে গিয়েছিল । কিন্তু শিবাজীর দেহরক্ষী রুস্তম জামান তরোয়াল চালিয়ে ওর হাত কেটে দিলে ।

পাগলা তুগলক : নাস্তিককে বাঁচাতে আস্তিক আর আস্তিককে বাঁচাতে নাস্তিক দেহরক্ষী।

চেঙ্গিজ খান : এই অবস্হায় আসা তোর উচিত হয়নি । এমনিতেই চারিদিকে করোনার সাম্যবাদ ছড়িয়ে পড়েছে।

আফজল খান : আচ্ছা যাই, তোমাদের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল । ভালো থেকো সবাই ।

কফিহাউসের যক্ষ: চলুন, আমি হেল্প করছি । আমার কফির ট্রেতে আপনার নাড়িভূঁড়ি রাখুন, তাহলে কষ্ট হবে না। 

ঘসেটি বেগম : আচ্ছা, মীরজাফরের বংশধরদের কী দোষ ? আজও ওরা পাবলিকের সামনে মুখ দেখাতে পারে না ।

কফিহাউসের যক্ষ : মীর জাফরের বংশধর এখনো মুর্শিদাবাদে বসবাস করেন। মীরজাফরের অষ্টম বংশধর হলেন মীর জাফর আলম খাঁ। আমি তাঁকে চিনি ।পেশায় একজন শিক্ষক। বর্তমানে অবসরে আছেন। মীর জাফর খাঁর বাড়ির প্রধান ফটককে লোকে বলে নেমকহারাম দেউড়ি।  এলাকাটার নাম জাফর গঞ্জ। মীর জাফর   ইংরেজ বেনিয়াদের সাথে যুক্ত হয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীন বাংলার পতন ঘটিয়ে ইংরেজদের হাতে দেশ তুলে দেয়াটা পাবলিক আজও মেনে নিতে পারেনি । যে বাড়িতে মীরজাফরের বংশধররা বসবাস করতেন তা দেখতে গিয়ে লোকজন বিশ্বাসঘাতকের বাড়ি বলে অহরহ গালাগালি করায় পূর্ব পুরুষের বিশ্বাসঘাতকতার গ্লানি আর লজ্জায় স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে না পারায় অনেক দিন হলো তারা সেই বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র চলে গেছেন। মীর জাফরের বর্তমান প্রজন্ম খুবই ভদ্র নম্র হওয়া সত্বেও মানুষের কাছে সহজে উন্মুক্ত হতে পারছেন না। মীর জাফরের বিশ্বাসঘতকতার মাধ্যমে স্বাধীন বাংলার পতন এবং ইংরেজদের হাতে দেশের স্বাধীনতা চলে যাওয়ায় আজো মানুষ মীর জাফরের নামটি ঘৃণাভরে উচ্চারণ করে। যার গ্লানি জন্ম জন্মান্তর ধরে এই বংশকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বংশধরদের দোষ দেয়া কেন ? ইংরেজদের পা চেটে অনেকে নাম কিনেছে, তাদের কেন বিশ্বাসঘাতক বলা হবে না ?

ভাইপো আকবর : ওই তো গুলবদনপিসি এসে গেছে । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

গুলবদনপিসি : আমি এসে গেছি । হজ করতে গিয়েছিলুম, সবে কদিন হলো ফিরেছি । নতুন সংস্করণের জন্যে  হুমায়ুননামা ‘অর্ধেক জীবন’ বইটার প্রুফ দেখতে হবে । আগে হাতে কমপোজ হতো, পাণ্ডুলিপিতে ভুল থাকলে কমপোজিটাররা নিজেরা শুধরে দিতো । এখন কমপিউটার হয়ে, মুশকিল হয়েছে । কমপিউটার ভালো জানে, কিন্তু ভাষাটা ভালো জানে না বলে ভুল থেকে যায় । দুতিনবার করে প্রুফ দেখতে হয় । প্রথম সংস্করণে আমাদের পরিবারের কেচ্ছা সব বাদ দিয়েছিলুম ; এখন ভাবছি জুড়ে দেবো, তাহলে ভালো কাটতি হবে । 

পাগলা তুগলক : প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ার পর প্রতিটি ধর্মই কায়েমি স্বার্থবাদীদের দ্বারা জনস্বার্থের বিরুদ্ধে ব্যবহূত হয়েছে। গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের বেলায়ও একই ধরনের ঘটনা দেখা যাচ্ছে। সাধারণ মানুষ ধর্মের কিংবা আদর্শের অবলম্বন ছাড়া চলতে পারে না। আদর্শহীন বাস্তবতায় ধর্মকে শেষ করে দেওয়ার জন্য যতই চেষ্টা করা হচ্ছে, মানুষ ততই ধর্মের আশ্রয়ে চলে যাচ্ছে। গণতন্ত্রকে পুনর্গঠিত কিংবা নবায়িত করে সর্বজনীন গণতন্ত্রে রূপ দিলে এবং জনগণের জন্য প্রাণশক্তিসম্পন্ন আদর্শ রূপে সামনে আনা হলে ঘটনাপ্রবাহ সম্মুখগতি লাভ করবে।

তোতলা তুগলক : এএএ ছোঁছোছোছোড়া মুমুমুখ ববববন্ধ রারারাখতে পাপারে না ।

বাবর : আমার রুশ রক্ষিতা গুলনার আগাচা আর নারগুল আগাচাকেও আসতে বলেছ ? ওরা এসে আমার গোপন খবরাখবর না ফাঁস করে দেয় । ওরা বলছিল যে আমার কবরটা আগ্রায় থাকলেই ভালো হতো । আমি ভেবেছিলুম কাবুল জায়গাটা সুন্দর । এখন তো প্রত্যেকদিন বোমা মারামারি চলছে সেখানে । কোনওদিন না আমার কবরটাই চাঘতাই উজবেকি মনে করে উড়িয়ে দেয় । অবশ্য উজবেকিস্তান আর কিরগিজস্তানের লোকেরা আমাকে শ্রদ্ধা করে আজও । বেগম সমরুকে বলেছিস?  ও তো নাচনেওয়ালি ছিল, তায় আবার ক্যাথলিক খ্রিস্টান ।

শাহজাহান : আগ্রায় থাকলে আমি একটা নতুন ধরণের স্হাপত্য গড়ে দিতে পারতুম আপনার কবরের ওপর । কিন্তু আপনার কোন বেগমকে পাশে রাখতুম ? সেটা সমস্যা হয়ে দাঁড়াতো । মাহাম বেগম, আশিয়া সুলতান বেগম, জৈনাব সুলতান বেগম, মাসুমা সুলতান বেগম, বিবি মুবারিকা গুলরুখ বেগম, দিলদার বেগম — কে আপনার সবচেয়ে পছন্দের তা তো জানি না । আমি তাজমহল বানিয়েছি আমার সবচেয়ে পছন্দের বেগমের স্মৃতিসৌধ হিসেবে । আপনার কবর আগ্রায় থাকলে সেই স্মৃতিসৌধ দেখতে বহু পর্যটক আসতো । হুমায়ুনের কবর দেখতে কতো মানুষ আসে । অথচ ওনার দেহ প্রথমে দিল্লিতে  রাজপ্রাসাদেই গোর দেয়া হয়েছিল । পরে খঞ্জর বেগ দেহাবশেষ নিয়ে যান পাঞ্জাবের সিরহিন্দে।  বিধবা বেগম হামিদা বানু হুমায়ুন মারা যাবার নয় বছর পরে এই সমাধিসৌধ নির্মাণের কাজ শুরু করান। আপনার বেগমরা বোধহয় ততো ভালোবাসতেন না আপনাকে ।

বাবর : আরে তোকে কী বলব ! লোকে জানেই না যে আমার নয়টা ছেলে আর নয়টা মেয়ে ছিল । আমার দুই বউ মাহাম বেগম আর দিলদার বেগমের একটা করে আর গুলরুখ বেগমের দুটো ছেলে ছিল সে কথা তুইও ভুলে যাচ্ছিস। তুই হয়তো ভাববি গুলরুখের দুটো ছেলে ছিল বলে ওকেই সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতুম । তোদের সময়ের মতন ভালোবাসাবাসি ছিল না আমাদের সময়ে । হুমায়ুনের সময় থেকেই ভাইয়ে-ভাইয়ে খুনোখুনি আরম্ভ হয়েছিল । কামরন মির্জা নিজেই চলে গেল হজ করতে, আসকারি মির্জাকে হুমায়ুন অন্ধ করে হজ করতে পাঠিয়ে দিয়েছিল। আর হিন্দল মারা গেল যুদ্ধ করতে গিয়ে । হুমায়ুনের সঙ্কটজনক অসুস্হ অবস্হায় আমি ওর খাটের চারপাশে তিন দিন অবিরাম পাক খেয়ে ওর জীবনের জন্যে প্রর্থনা করেছিলুম, এসব কেউ নির্ঘাৎ আফিমের শরবত খেয়ে কেউ লিখেছে । হুমায়ুন পটল তুলেছিল নেশা করার পর সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে, গুলবদন লিখেছে তো সেকথা হুমায়ুননামা নামের ‘অর্ধেক জীবন’ বইতে ।

শাহজাহান : ভুলে যাচ্ছেন কেন যে আবুল ফজলকে আব্বাহুজুর খুন করিয়েছিলেন ।  আবুল ফজল ওনার সিংহাসনে বসার বিরোধিতা করেছিলেন। তাই ওনার ষড়যন্ত্রে নারওয়ারের কাছে সরাই বীর আর অন্ত্রীর মাঝখানে কোনো এক জায়গায় বীর সিংহ বুন্দেলার হাতে তিনি খুন হন। ওনার কাটা মাথা এলাহাবাদে আব্বাহুজুরের কাছে পাঠানো হয়েছিল। আবুল ফজলকে অন্ত্রীতে গোর দেয়া হয়।  আবুল ফজলের খুনি বীর সিংহ বুন্দেলা পরে ওরছার শাসক হয়েছিল আর ১৬০২ সালে আব্বাহুজুর জাহাঙ্গির নাম নিয়ে মোগল সিংহাসনে বসেছিলেন। পরে যদিও আব্বাহুজুর আবুল ফজলের ছেলে শেখ আবদুর রহমান আফজল খানকে বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেছিলেন।  আমিও সিংহাসন দখল করেছি শত্রুদের সরিয়ে দিয়ে, যখন কিনা আমি কাফের মা রাজপুত হিন্দু জগত গোঁসাইয়ের ছেলে । আবুল ফজল আর গুলবদন বেগম দুজনেই রাজপুত হিন্দু বউদের আসল নাম লেখেননি ; লিখেছেন মোগলদের দেয়া নাম । আব্বাহুজুরের মায়ের  নাম দিয়েছে মরিয়ম উজ জমানি, ওনার আসল নাম হরখা বাই গোপন করেছেন, বলিউডে যে ফিল্ম হয়েছে তাতে ওনাকে বলেছে যোধা বাই । হরখা বাইয়ের যে অনেকগুলো নিজের জাহাজ ছিল, আরবদেশে ব্যবসা করতে যেতো, হজযাত্রিদের নিয়ে যেতো, সেসব চেপে গেছে । আবদ-আল কাদির বাদায়ুনি তো আকবরের সংসারে এসে হরখা বাইয়ের হিন্দু পুজোপাঠ, বেদের হোমাগ্নি, শাকাহার, সূর্য আরাধনার বিরুদ্ধে রাগ উগরে গেছেন ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর বাবর, আপনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে আল-হিন্দে খাবার মতো ফল নেই, দেখার মতন বাগান নেই, মানুষগুলোও বিদকুটে । তা আপনি আপনার দেশ থেকে নানা রকমের ফল এখানে এনে চাষ করাতে পারতেন ।  আমরা তো সুদূর দক্ষিণ আমেরিকা থেকে কতো ফল-ফুল-আনাজ এদেশে এনেছি যে এখানকার মানুষ ভাবে সেগুলো এই দেশেরই প্রডাক্ট ।

বাবর : আরে আমি হলুম বাদশা, পেটুক মানুষ, আর তোমরা এসেছো খ্রিস্টান্তরন করার উদ্দেশ্যে, আমরা মোগলাই খাবারের নতুন রেসিপি আরম্ভ করেছিলুম । আমার ছেলে হুমায়ুনের ইরানি বউ  হামিদা  জাফরান আর শুকনো ফল ব্যবহারের  প্রচলন করেছিল। আকবরের রাজত্বকালে মুঘলাই খাবার বিকশিত হতে শুরু করেছিল ; ওর বহু বৈবাহিক জোটের কারণে,  রান্নার রেসিপি আল-হিন্দের প্রতিটি কোণ থেকে এসেছিল, যেমন মুর্গ মুসললম, নবরতন কোর্মা, কাবাব, কোফতা,, পুলাও বা পাইলাফ, এবং তন্দুরি  মুঘলই মুরগি, মুঘলই বিরিয়ানি, মুঘলই পরোটা, মালাই কোফতা, রেশমি কাবাব,  মুঘলাই মিষ্টান্নগুলির মধ্যে নাম করতে হয় রুটির পুডিং, শাহি টুকরা, বরফি, কলাকান্দ আর ফালুদা।  । পাঁঠার মাংস রান্নাঘরে এনেছিল আকবর । গোরুর মাংস আকবর নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল । নিহারি রান্নাটা শাহজাহানের। ইব্রাইম লোদির সঙ্গে যুদ্ধে আমি আর সৈন্যরা ঘোড়া আর গোরুর শুকনো মাংস চর্বি মাখিয়ে পুড়িয়ে খেতুম ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই তো, আওরঙজেবের চামচা মীর জুমলা এসে গেছে । কী রে মীর জুমলা, এতো দেরি হলো তোর? তোকে তো খবর পাঠিয়েছিলুম যে আজকে চেঙ্গিজদা আর আমি কফিহাউসে গ্যাঁজাতে আসছি ।

মীর জুমলা : কী বলব তোমায় ল্যাঙড়াদা । আসামের দিকে বিশাল সৈন্যবাহিনী নিয়ে তো এগিয়েছিলুম।  আসামের  আবহাওয়া এমন যে প্রথমে তার বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছিল, তারপর গড়গাঁও পর্যন্ত দখল করতে পেরেছিলুম । এরপর নেমে এলো আসামের বর্ষার ঢল। অতিবৃষ্টির কারণে আসামের রাস্তাঘাট ডুবে বন্যা সৃষ্টি হলো, সে তুমি ধারণা করতে পারবে না । আমার বাহিনী  উঁচু জমিতে আটকা পড়ে গেলো। তখন রাজা জয়ধ্বজের সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে থাকে। এমনকি আমাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছিল । এর মাঝে সৈন্যরা জলের কারনে নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যেতে লাগলো । খাবারের অভাব আর রোগের প্রকোপে বেশিরভাগ সৈনিক মারা গেলে শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে পিছপা হতে হলো আমাকে। বর্ষা শেষে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে আসাম ছাড়লুম, কী লজ্জা, কী লজ্জা, আলমগীর জানলে মাথা কেটে নিতো । ব্যর্থ আসাম অভিযান শেষে  বাংলায় ফিরে আবার যাত্রা শুরু করেছিলুম। তবে আসামের জলহাওয়ায় ভীষণ শরীর খারাপ হয়ে গেল । অসুস্থতার কারণে দুর্বল শরীরে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়েছিল । নৌকো করে ফেরার পথে খিজিরপুরে মারা গেলুম । সেই থেকে আসাম-মেঘালয় সীমায় ঠাকুরবাড়ি জেলার একটা টিলার কবরে শুয়ে আছি । কেউই খোঁজখবর নেয় না । জীবনে কতোকিছু করলুম ইরান থেকে এসে, পড়ে আছি অজ পাড়াগাঁয় ।

বাবর : আওরঙজেবটা তো তাই চটে থাকে কাফের নাস্তিকদের ওপর । ও জানে যে ওর শিরায় আছে কাফের বউদের নাস্তিক রক্ত । আসলে দোষটা আমারই, আমিই তো মোগল সিংহাসন বসিয়েছিলুম এই দেশে । 

গুলবদনপিসি : হ্যাঁ, আপনি আপনার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, শত্রুকে পরাজিত করার পর আমরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করলাম এবং ব্যপকভাবে হত্যা করতে থাকলাম। আমাদের শিবির থেকে প্রায় দুই ক্রোশ দূরে ছিল তাদের শিবির। সেখানে পৌঁছে আমি মুহাম্মদী ও আরও কয়েকজন সেনাপতিকে হুকুম দিলাম তাদের হত্যা করতে, কেটে দু’খানা করতে, যাতে তারা আবার একত্রিত হবার সুযোগ না পায়।” কত কাফের নাস্তিককে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল তার হিসাব পাওয়া যায়না। বাবর হুকুম দিলেন, কাছাকাছি একটি পাহাড়ের কাছে সমস্ত নরমুন্ডকে জড়ো করে একটি স্তম্ভ তৈরী করতে। সেই টিলার উপর কাটা মুন্ডের একটি মিনার বানাতে হুকুম দিলাম। বিধর্মী  ও ধর্মত্যাগীদের অসংখ্য মৃত দেহ পথে-ঘাটে ছড়িয়ে ছিল। এমন কি দূর দেশ আলোয়ার, মেওয়াট ও বায়না যাবার পথেও বহু মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেল।”

চেঙ্গিজ খান : আমি কিন্তু ধর্ম-টর্মর কথা ভেবে কোনও দেশ দখল করিনি ; কারোর ধর্মও পালটাইনি । আমার বংশধররা নিজেরাই আস্তিকান্তরিত হয়ে মুসলমান বা বৌদ্ধ ধর্ম নিয়েছে বা কাফের নাস্তিক থেকে গেছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি কতো দেশ দখল করেছিলুম । আমার বংশধররা কেউ সেগুলো ধরে রাখতে পারেনি ।

গুলবদনপিসি : ল্যাঙড়াদা, তোমার আত্মজীবনী  “তুজুক ই তৈমুরী”তে তুমি লিখিয়েছ ভারত অভিযানের তোমার দুটি উদ্দেশ্য ছিল। এক, বহুদেববাদ ও পৌত্তলিকতায় আচ্ছন্ন ভারতীয়দের সত্যধর্মে দীক্ষিত করা আর, দুই  ভারতের অমিত ধন ঐশ্বর্য লুঠ করা। আসলে ভারতের বিপুল পরিমাণ সম্পদ লুণ্ঠন করাই ছিল তোমার একমাত্র উদ্দেশ্য। পৌত্তলিকতার বিনাশ  অজুহাত মাত্র। মধ্য এশিয়া থেকে এত দূরদেশে অভিযানে আসতে তোমার সেনাবাহিনী ও আমির ওমরাহরা আপত্তি জানালে তুমি তাদের সামনে  ধর্মের কথা তুলে ধরো।সমরখন্দ থেকে বিশাল সেনাবাহিনী নিয়ে সিন্ধু, ঝিলাম ও রাভি নদী অতিক্রম করে রাজধানী দিল্লির দিকে এগোও। পথিমধ্য দীপালপুর, ভাতনার, শীরসা, কৈথাল  লুঠ করে আর বহু মানুষকে খুন করে  দিল্লির উপকন্ঠে পৌঁছে যাও । দিল্লিতে প্রায় একলক্ষ মানুষকে খুন করো । দিল্লির সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ ও তার প্রধানমন্ত্রী মল্লু ইকবাল তোমার  কাছে হেরে যায় । মল্লু ইকবাল বরণ প্রদেশে আর সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদ গুজরাটে  পালায় ।

পাগলা তুগলক : আমারও তাই মনে হয় ।

গুলবদন পিসি : এরপর দিল্লিতে ঢুকে টানা পনেরোদিন ধরে লুঠপাট আর খুন করতে থাকো । মানুষের কাটা মাথা দিয়ে সৌধ তৈরি করে তোমার সেনাদল উল্লাস প্রকাশ করে। শবগুলো মাংসাশী পশু ও পাখির খাবারে পরিণত হয়। এরপর তুমি অঢেল ধনরত্ন ও অসংখ্য বন্দীকে দাস বানিয়ে নিয়ে দেশে ফিরে যাও  । দেশে ফেরার পথে ফিরোজাবাদ, মিরাট, হরিদ্বার ও জম্মু অঞ্চলে লুটপাট চালিয়ে আর শিবালিকা পাহাড়ের পথ ধরে উত্তরে যাওয়ার সময় কাংড়া  দখল করো।  বদাউনির মতন গোঁড়া লোকও  লিখেছে, তোমার হাত থেকে যারা নিষ্কৃতি পেয়েছিল তারা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে প্রাণ হারায় । তোমার ভারত আক্রমণের ফলে সুলতানী শাসনের সামরিক বাহিনীর দৈন্য দশা ফাঁস হয়ে যায়। তোমার ভারত আক্রমণের পর গুজরাট, সামনা, বিয়ানা, কালপি, মাহাবা, মুলতান, পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রভুতি অঞ্চলে স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। সুলতানী সাম্রাজ্য দিল্লি থেকে পালামের ক্ষুদ্র গণ্ডির মধ্য সংকুচিত হয়ে পড়ে। হিন্দু মুসলমানদের মধ্য সম্প্রদায়গত যে বিরোধ তুমি সৃষ্টি করেছিলে  তা জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবরও জুড়তে পারেননি ।

ভাইপো আকবর : হক কথা বলেছো পিসি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি তো অতোশত ভাবিনি । সব লুটেরারা যা করে আমিও তাই করেছিলুম । বাবরও করেছিল । বাবর সম্পর্কে গুরুনানক লিখেছেন, “হে সৃষ্টিকর্তা ভগবান, জীবন্ত যম হিসেবে তুমি কি দানবরূপী এই বাবরকে পাঠিয়েছ ? অমানুষিক তার অত্যাচার, পৈশাচিক তার হত্যা লীলা, অত্যাচারিতের বুক ফাটা আর্তনাদ ও করুন ক্রন্দন তুমি কি শুনতে পাওনা? তাহলে তুমি কেমন দেবতা ?” ইখতিয়ার উদ্দিন মুহাম্মাদ বখতিয়ার খলজির দোষ আরো বেশি । তুমি হয়তো বলবে ওরা আমার দেখানো পথ অনুসরণ করেছে ।

গুলবদনপিসি : হ্যাঁ, ল্যাঙড়াদা, আমি তাইই বলব । দেখছো তো, আল-হিন্দে বাবরের মসজিদ তো ভাঙাই হয়েছে, বাবরের নামের রাস্তারও অন্য নাম দেবার চেষ্টা চলছে । তুমি জানো না যে   হিন্দু দর্শনে সর্বসৃজক ঈশ্বরে নয়, বরং প্রাচীন প্রার্থনাগাথা বেদকে মান্যকারী ব্যক্তি বা দল বা সম্প্রদায়কে আস্তিক হিসেবে চিহ্নিত করা হয় । আস্তিক দর্শন অনুসারে বেদই হলো সমন্বয়বাদী হিন্দুধর্মের প্রাথমিক উৎস । এ সংজ্ঞানুসারে সাংখ্য, যোগ, ন্যায়, বৈশেষিক, পূর্ব মীমাংসা এবং বেদান্তকে আস্তিক দর্শনের শ্রেণীভুক্ত করা হয়।

ভাইপো আকবর : পিসি, তোমার তুলনা নেই । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

ঘসেটি বেগম : বিহারের বাসিন্দা হীরকচাঁদের মৃত্যুর পর তার ছোট ছেলে বিসেনচাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। তার এক ছেলে ছিল কিসেনচাঁদ। লর্ড বেন্টিঙ্কের সময়ে তিনি ইংরেজ সরকার কর্তৃক জগৎশেঠ উপাধি পান। তার মৃত্যুর পর হীরকচাঁদের বড় ছেলে ইন্দ্রচাঁদ জগৎশেঠ হন। কোম্পানি তাকে বাৎসরিক ১,২০০ পাউন্ড পেনশন দিত। তিনি মারা গেলে তার দত্তক পুত্র গোপালচাঁদ জগৎশেঠ খেতাব পান। ১৮৪৩ সালে লর্ড অকল্যান্ড তাকে ৩০০ রুপি পেনসন দিতে চাইলে তিনি সেটা ফিরিয়ে দেন। তার মৃত্যুর পর তার স্ত্রী প্রাণ কুমারী দেবী গোলাপচাঁদকে দত্তক নেন। তার চার ছেলে ছিল। বড় ছেলের নাম ফতেচাঁদ। ১৯১২ সালের ৭ই এপ্রিল তিনি কলকাতায় মারা যান। তার মৃত্যুর পর তার ছেলে সোবাগ চাঁদ জগৎশেঠ উপাধি পান। সোবাগ চাঁদ মহিমাপুরের বাড়িতে ডাকাতের হাতে মারা যান। তখন তার দুই ছেলে বর্তমান ছিল, জ্ঞান চাঁদ জৈন ও বিজয়চাঁদ। এদের পর আর জগৎশেঠ পরিবার সম্পর্কে জানা যায় না। ১৯১২  সালের পর আর কেউ জগৎশেঠ উপাধি বজায় রাখেননি । এদের বংশধরদেরে খোঁজ করা হয় না কেন ? 

গুলবদনপিসি  : সেনর ভাস্কো, আপনি ওমানি জাহাজি শেখ আহমেদ ইবন মজিদকে বোকা বানিয়ে, প্রচুর সোনাদানা দিয়ে, আপনার পাদরিদের গির্জায় তৈরি মদ খাইয়ে জাহাজে তুলে নিয়েছিলেন, নয়তো আল-হিন্দে আসতে পারতেন না, সেকথা ভুলে যাবেন না । আপনাদের ভাগ্য ভালো ছিল যে ইবন মজিদকে পেয়ে গিয়েছিলেন, আর তার দেখানো সমুদ্রপথে আল-হিন্দে এসেছিলেন তা সত্বেও আরবদের মুর বদনাম দিয়ে তাদের জাহাজ কামান দেগে ডুবিয়ে দিতেন আর বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের খ্রিস্টান বানাতেন । ইবন মজিদের কারণেই আপনারা আল-হিন্দ থেকে মশলা-রত্ন নিয়ে যেতেন — কালো মরিচ, জায়ফল, ছোটো এলাচ, লবঙ্গ, সুপুরি, দালচিনি, আদা, হলুদ । আরবদের থেকে জেনে গিয়েছিলেন মশলাগুলো গুঁড়িয়ে মাংসতে মাখালে তা সহজে পচে না, দুর্গন্ধও হয় না ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর ল্যাঙড়া,: আপনারা এতো মানুষ মারলেন, এতো লুটপাট চালালেন, কিন্তু তার বদলে কিছু দিতে পারলেন না । আমরা এদেশে কি-কি দিয়েছি জানেন ? টম্যাটো, আলু, আনারস, আতা, পেঁপে, পেয়ারা, ঢেঁড়স, কাজুবাদাম, কাসাভা, চিনাবাদাম,ভুট্টা আর নানা রকম লঙ্কা । আগে এখানকার মানুষ গোলমরিচ ব্যবহার করতো আর তার জন্যেই আরব আর ইউরপীয় ব্যবসাদাররা লড়ে মরতো । আমরা দক্ষিণ আমেরিকা থেকে নানা রকমের ফলমূল অন্য দেশে নিয়ে গেছি । এদেশ থেকে নিয়ে গেছি আম । এখানকার আলফোনসো আম আমাদের অবদান । অবশ্য এদেশে তামাক আমরাই এনেছিলুম । আকবরের দরবারে বেশ জনপ্রিয় ছিল তামাক কিন্তু জাহাঙ্গির নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়েছিল । মেক্সিকো থেকে এনেছিলুম গাঁদাফুল । নানা রকমের লঙ্কা এনেছিলুম দক্ষিণ আমেরিকা থেকে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি ওদিকটায় যাইনি, নয়তো আমিও নিয়ে যেতুম ।

ভাস্কো দা গামা : চিকেন কারি, মাটন কারি, ফিশ কারি, ভেজিটেবল কারি শব্দগুলো কিন্তু আমরা পর্তুগিজরাই দিয়েছি তোমাদের ।

শাহজাহান : সেনর ভাস্কো, মোগল বাদশাহের দেওয়া শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি ছিল ‘মাহি মারাতিব’।  মাহি, মানে মাছ ছিল একমেবাদ্বিতীয়ম  রুই। অবশ্যই কাঁচা রুই মাছ নয়, ধাতুর তৈরি রুই মাছের প্রতিমূর্তি। এর চেয়ে বেশি আর কী ভাবে কোনও মাছকে গৌরবান্বিত, মহিমান্বিত করা সম্ভব! ইতিহাস বলছে, মোগল সাম্রাজ্যের সর্বোচ্চ সম্মান ছিল  মাহি মারাতিব। এখন ভারতে ভারতরত্ন, ফ্রান্সে লিজিয়ঁ অফ অনার কিংবা ব্রিটিশ নাইটহুড যেমন—ঠিক সেই রকম। তবে মাহি মারাতিব একই সঙ্গে ছিল শৌর্য, বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রতীক। এই ব্যাপারে যাঁরা শ্রেষ্ঠ হিসেবে গণ্য, তাঁদেরই মোগল সম্রাটরা দিতেন এই সম্মান। সোনার দু’টি দণ্ডের উপর বসানো রুইমাছের ওই বিশাল ধাতব প্রতিকৃতিকে শোভাযাত্রা করে নিয়ে যাওয়া হত । মোগলরা আর লখনউয়ের নবাবরা রুই মাছ খেতে ভালো বাসতেন। লখনউতে নবাবদের গড়া ইমারতগুলোতে দেখতে পাবেন দুটো করে রুই মাছ ।

গুলবদনপিসি : সেনর ভাস্কো, লোকে যদি জানতো আপনাদের ওই কারিতে কী লুকিয়ে আছে তাহলে খেলেই বমি করতো সেনর । আপনারা কয়েকশো আরব জাহাজিকে নোংরা মুর হিসেবে দেগে দিয়ে তাদের কান, নাক, হাত কেটে কালিকটের জামোরিন শাসককে পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন, এই নাও কারিল পাঠালুম । লোকে রান্নার ঝোলকে বলতো কারিল। সেটাকে ইংরেজরা করে দিয়েছিল কারি, বিলেতেও এদেশ থেকে নিয়ে গেল চিকেন কারি, মটন কারি । আপনারা সমুদ্রিকে করে দিয়েছিলেন জামোরিন ।

ভাস্কো দা গামা : না, সেনোরিটা, আমরা করিনি । ইংরেজরা করেছে । আমরা বলতুম সামোরিম, ওলন্দাজরা বলতো সামোরজিন, চিনেরা বলতো শামিথিশি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমি কতো দেশে লুটপাট চালিয়ে নিজের দেশে সোনাদানা টাকাকড়ি নিয়ে গিয়েছিলুম । সবই ফুরিয়ে গেছে । এখন সেই আগেকার অবস্হা । পশু চরাও আর ঘোড়ায় চেপে তীর-ধনুক চালাও ।

চেঙ্গিজ খান : আমিও কতো দেশ লুটেছিলুম । সব পয়সা খরচ করে ফেলেছে গুচ্ছের বংশধররা । একটা ব্যাপার ভালো হয়েছে যে বাইরের সৈন্য এসে আর আল-হিন্দ থেকে সোনাদানা টাকাকড়ি লুটে নিয়ে যায় না । এরা নিজেরাই লুটেপুটে বাইরে গিয়ে ঘাপটি মেরে থাকে, সুন্দরীদের হারেম রাখে, ফিরতে চায় না । বিজয় মাল্য নামে একজন লুটেরার নাম শুনলুম সেদিন, ছবিও দেখলুম হাফল্যাংটো মেয়েদের পাশে দাঁড়িয়ে হাসাহাসি করছে । শুনলুম ওর কচি গার্লফ্রেন্ড পিঙ্কি লালওয়ানিকে বিলেতে  বিয়ে করেছে । ব্যাঙ্ক থেকে নয় হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনে রয়েছে এই মদের ব্যবসাদার । আমি এদেশ থেকে নয় হাজার কোটি টাকার চেয়ে অনেক কম লুটে নিয়ে গিয়েছিলুম। আরও জানতে পারলুম ব্যাংক জালিয়াতির পান্ডা নীরব মোদি  হীরাজহরতের ব্যবসায়ী ; মুম্বাইয়ে ঘাঁটি গেড়ে পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাংকের একটা শাখা থেকে ভুয়া কাগজপত্রের মাধ্যমে ১১ হাজার ২০০ কোটি টাকা জালিয়াতি করে  বিদেশ পালিয়ে গেছে। তার সপ্তাহের মধ্যে তাঁর স্ত্রী, ভাইসহ ব্যবসার অন্য চাঁইয়েরাও দেশত্যাগী হয়েছে। ১০০ বিলিয়ন টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারির দায়ে হর্ষদ মেহতাকে বম্বে উচ্চ আদালত এবং ভারতের সুপ্রিম কোর্ট  দোষী সাব্যস্ত করার পর কম বয়সেই লোকটা মরে গেলো, আজব ব্যাপার । আল-হিন্দের সবচেয়ে বড়ো জালিয়াতি মামলায় সত্যম কর্ণধার বি রামালিঙ্গ রাজু দোষী সাব্যস্ত হয়েছে।  হায়দরাবাদ আদালত সাত বছরের কারাদণ্ড আর পাঁচ কোটি টাকা জরিমানার নির্দেশ দিয়েছে তার বিরুদ্ধে। সারদা গোষ্ঠীর কর্ণধার সুদীপ্ত সেন  হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ করে কলকাতা থেকে পালিয়ে যায়, তখনই সে সিবিআইকে লিখে যায় একটা চিঠি,  আর তাতেই  উল্লেখ করে যায় বাইশ জনের নাম, যারা সারদা গোষ্ঠীর পতনের মূলে  ভূমিকা নিয়েছিল। রোজ ভ্যালি আর সারদা এই দুই চিট ফান্ড সংস্থার দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে সেই সময় থেকেই গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে চিটফান্ড কেলেঙ্কারি। দুই চিটফান্ড সংস্থাই সাধারণ মানুষের কাছ থেকে আমানত সংগ্রহ করতো। জমা দেওয়া টাকার অত্যধিক মূল্যে  ফেরত দেওয়া হবে এমন প্রতিশ্রুতি দিলেও শেষ পর্যন্ত টাকা শোধ করতে ব্যর্থ হয় এই দুই সংস্থা। হাসান আলী খান নামে এক ঘোড়া ব্যবসায়ী  টাকা পাচার করে সুইস ব্যাঙ্কে আট হাজার বিলিয়ন ডলার জমা করেছে ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তাহলেই ভাবো । আমি তো সারা জীবন কতো দেশে কতো লুটপাট করলুম কিন্তু অতো হাজার হাজার টাকা চোখেই দেখিনি । 

চেঙ্গিজ খান : লোকটার নামে রেড কর্নার নোটিশ জারি হয়েছিল। নীরবের মামা মেহুল চোকসির বিরুদ্ধেও একইরকম অভিযোগ। সেও হাজার হাজার কোটি টাকা মেরে দিয়ে বিদেশে পালিয়েছে । দীপক তলোয়ার নামে একজন হাওয়ালার মাধ্যমে প্রায় হাজার কোটি টাকা আর্থিক তছরুপ করে  দেশ ছেড়ে সংযুক্ত আরব আমিরশাহিতে গা ঢাকা দিয়েছে । সঞ্জয় ভাণ্ডারীর  বাড়ি আর অফিসে থেকে নিরাপত্তাসংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ গোপন নথি মেলে। ফরেন এক্সচেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট অ্যাক্ট  অমান্য করে প্রায় ২৭ কোটি টাকা আর্থিক তছরুপের অভিযোগ রয়েছে  সঞ্জয় ভাণ্ডারীর বিরুদ্ধে।সেও অন্য দেশে গা ঢাকা দিয়ে রয়েছে। আরেকজন হলো ললিত মোদি ; দক্ষিণ আফ্রিকায় হওয়া আইপিএল-এ বেআইনি বিদেশি টাকা লেনদেন করেছিল ।  যে কোনও ধরনের তদন্ত থেকে রক্ষা পেতে লন্ডনের ঘাঁটি গেড়েছে  ললিত মোদী। ওকে যখন গ্রেফতার করার সব প্রক্রিয়া শেষ তখন ও  পালিয়ে গেল বিদেশে। এক দেশ থেকে অন্য দেশে পালিয়ে পালিয়ে মোদী এখন বহাল তবিয়েতে আছে । অথচ সবাই বলছে আমরা এদেশে কিছুই দিইনি । এই ডাকাতগুলো তো আমাদের পথ অনুসরণ করছে । তবে ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : ল্যাঙড়া আম বোধহয় আমার আবিষ্কার, নয়তো ল্যাঙড়া বলবে কেন, সেনর ভাস্কো ? তবে আমাদের বাবর তৈমুর সংস্কৃতির চাঘির এনেছিল, ঠিক বলছি তো বাবর ? আপেল, নাসপাতি আর আঙুরের মদ । তুই  এনেছিলিস মাজুম, যা তৈরি হয় আফিম আর গাঁজার বীজ মিশিয়ে, আখরোট, পেস্তাবাদাম, ছোটোএলাচ, মধু আর দুধ দিয়ে তৈরি বড়ি । ঠিক বলছি তো বাবর? 

ভাইপো আকবর : ওই সবের নেশাতেই আমার দুই ছেলে  মুরাদ আর দানিয়েল অল্প বয়সে মরে গেল। ভাগ্যিস শ্যায়খুবাবা এই সবের নেশার চেয়ে যুবতীদের নেশায় মজেছিল, নয়তো আমার সিংহাসন নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ? আমাকেও পর্তুগিজগুলো গড়গড়া টানার অভ্যাস করাবার তালে ছিল । ওই ধোঁয়ায় তো কোনও নেশা হলো না । আমার দরবারে খাপ খায় না । কিন্তু আবুল ফজলের মাথা কেটে আমার ওপর রাগ ফলাবার চেষ্টা করে ভালো করেনি । 

ভাস্কো দা গামা : সেনর আকবর, আপনিও বৈরাম খানকে দিয়ে হেমু বিক্রমাদিত্যের গলা কাটিয়ে আফগানিস্তানে আপনার ফ্যামিলি মেম্বারদের কাছে পাঠিয়েছিলেন, আর হেমুর দেহ একটা ফাঁসিকাঠে লটকে দিয়েছিলেন দিল্লিতে। ভেরি ব্যাড ফর ইয়োর রেপুটেশান ।

ভাইপো আকবর : হেমু ছিল বিপক্ষ পার্টিতে, আমার পার্টিতে থাকলে কাটাতুম না । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

গুলবদনপিসি  : সেনর ভাস্কো, ল্যাঙড়াদার দেশে কিছুই হতো না অন্য দেশে নিয়ে যাবার মতন, ধর্মের নেশা আর নেশার ধর্ম  ছাড়া ।

ভাস্কো দা গামা : আচ্ছা, ওনারা কারা ? চুল-দাড়ি সবই পেকে গেছে । বেশ সিরিয়াস কিছু আলোচনা করছেন বলে মনে হচ্ছে ?

কফিহাউসের যক্ষ : আজ্ঞে ওনারা হলেন অগস্ত্য, অত্রি, ভরদ্বাজ, গৌতম, জমদগ্নি, বশিষ্ঠ আর বিশ্বামিত্র । লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক । শিল্পসাহিত্য আর জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ে চলমান ধারাকে চ্যালেঞ্জ করে ব্যতিক্রমধর্মী চিন্তাধারা আর মতামত ব্যক্ত করার মুদ্রিত বাহনকে বলা হয় লিটল ম্যাগাজিন । ম্লেচ্ছদের সঙ্গে মেশেন না ।

সম্রাট অশোক : আমি ওই জানলার কাছের টেবিলে বসে আপনাদের আলোচনা শুনছিলুম । আপনাদের আলোচনার মাঝে ঢুকে পড়লুম বলে ক্ষমা করবেন । এখানে অনেকে সম্রাট বা সম্রাটদের বংশধর । আমি তৃতীয় মৌর্য সম্রাট ছিলুম , আমার বাবা বিন্দুসারের পর সিংহাসনে বসি । আমি কিন্তু বাইরে থেকে এসে সিংহাসন দখল করিনি । আমাকে ভারতবর্ষের ইতিহাসে অন্যতম শ্রেষ্ঠ  সম্রাট বলা হয় । হয়তো শুনে জালালুদ্দিন মোহম্মদ আকবরের খারাপ লাগবে । দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ ছাড়া ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অঞ্চল শাসন করেছি। আমাকে একজন সর্বভারতীয় সম্রাট বলতে পারেন ।  সাম্রাজ্যের বাইরেও আমি ধর্মীয় আর সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রভাব বিস্তার করেছিলুম। আধুনিক যুগে জীববৈচিত্র্য রক্ষার যে মনোভাব দেখা যায়  খ্রিস্টপূর্ব যুগে বিশাল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে সে ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলুম । আমার চারজন বউ ছিল, আপনাদের মতন, তিশ্যারাক্ষ, পদ্মবতী, কারুভাকী আর বিদিশা । যে পরিবারে জন্মেছিলুম তারা আজীবিক ধর্মে বিশ্বাস করতেন । তা ছিল অন্যতম  ভারতীয় ধর্ম। এই ধর্ম ২০০০ বছর ভারতীয় উপমহাদেশে প্রচলিত ছিল।  এই ধর্মের মূল বিষয় ছিল নিয়তি অর্থাৎ ভাগ্য। এই ধর্ম মতানুসারে নিয়তি সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে এবং কোনো পৌরুষাকার একে পরিবর্তন করতে পারে না।কিন্তু রক্তক্ষয়ী কলিঙ্গ যুদ্ধের পর আমার রাজনৈতিক আর নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীতে আমূল পরিবর্তন আসে। আমার নামে বসানো পাথর আর স্তম্ভলিপির মাধ্যমে প্রকাশ করেছি, কী করে কলিঙ্গ যুদ্ধের রক্তবন্যা আমাকে একজন নীতিবান মানুষে  পরিণত করেছে।  ওই সময় থেকেই আমি জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিশ্বশান্তি আর ন্যায়নিষ্ঠ শাসন প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত করি। জীবনের বাকি সময় অহিংস  ধম্মই আমার পথপ্রদর্শকের ভূমিকা পালন করেছে । চেঙ্গিজ দেবশর্মা, ল্যাঙড়া দেবশর্মা, বাবর দেবশর্মা, আওরঙজেব দেবশর্মা, রাজত্ব বাড়িয়েও আপনারা কেন আত্মসমীক্ষা করলেন না তা ভাবতে ভাবতে আপনাদের টেবিলে উঠে এলুম ।

গুলবদনপিসি  : সম্রাট অশোক, আমি আপনার কথা পড়েছি । জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর আপনার পথে হেঁটে সব ধর্মের মিলন ঘটাতে চেয়েছিলেন ।  দিন-ই-ইলাহি  সম্রাট আকবর প্রবর্তিত একটি ধর্ম। তিনি ধর্মীয় বিষয়ে গবেষণার জন্য  ফতেপুর সিক্রিতে একটা উপাসনা ঘর তৈরী করেছিলেন। যা’ধর্ম সভা’ নামে পরিচিত। সেখানে তিনি বিভিন্ন ধর্মের পণ্ডিতদের কথা শুনতেন। শেষে, সব ধর্মের সারকথা নিয়ে উনি নতুন একটি নিরপেক্ষ ধর্মমত প্রতিষ্ঠা করেন। এটিই ‘দিন-ই-ইলাহি’  নামে পরিচিত। সেই সময়ের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা এই ধর্মমতকে ভালভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। অনেক ঐতিহসিক দিন-ই-ইলাহীকে নতুন ধর্ম বলতে অস্বীকার করেন। এই ধর্মমত  আকবরকে বিতর্কিতও করে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে এই ধর্মমত তেমন প্রসার লাভ করতে পারেনি। দিন-ই-ইলাহি ধর্মমতকে মেনে নিয়েছিলেন হাতে গোনা কয়েকজন, যেমন বিরবল, জহাঙ্গির, আবুল ফজল ইবন মুবারক, যুবরাজ মুরাদ, কাশিম খান, আজম খান, শেখ মুবারাক, আবদুস সামাদ, মোল্লা শেখ মোহাম্মদ শাহাদাত, সুফি আহমেদ, মির শরিফ আমল, সুলতান খাজা, মির্জা সদরুদ্দিন, তাকি সুস্তার, শেখজাদা গোসলা বেনারসি, সদর জাহান, সদর জাহানের প্রথম ছেলে, সদর জাহানের দ্বিতীয় ছেলে, শেখ ফয়েজি, জাফর বেগ, এনারা সবাই । দারা শিকোহ  ফার্সি ভাষায় ভগবত গীতা আর উপনিষদ অনুবাদ করেন। 

সম্রাট অশোক : আমার মনে হয়  মানুষের পক্ষে কোনো ঈশ্বর বা ধর্ম ছাড়াই ন্যায় ও নীতিসম্পন্ন হওয়া সম্ভব। এখানে কখনোই মনে করা হয় না যে, মানুষ জন্মগতভাবে ভালো কিংবা মন্দ অথবা প্রকৃতির চেয়ে বড়ো কিছু৷ বরং মানবতাবাদী জীবনাদর্শে মানবতার রক্ষা এবং মানবিক সিদ্ধান্তের প্রতি দৃষ্টিপাত করাই একমাত্র দায়িত্ব।

গুলবদনপিসি  : আকবর চেয়েছিলেন তাঁর সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ধর্মের কিছু উপাদানকে একীভূত করতে । এই উপাদানগুলো প্রাথমিকভাবে ইসলাম, হিন্দু ধর্ম এবং জোরোস্ট্রিয়ান ধর্ম, খ্রিস্টান, জৈন ধর্ম এবং বৌদ্ধধর্ম থেকে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জনসাধারণ তা মানতে চায়নি । এখন প্রত্যেকটা লোক মনে করে তার ধর্মটাই বড়ো, যখন কিনা বেশির ভাগ মানুষই অন্য কোনো ধর্ম বা ধর্মহীনতা থেকে আস্তিকান্তরিত । আচ্ছা, আপনার টেবিলে এক যুবক আর এক যুবতী আপনার সঙ্গে গল্প করছিলেন, ওনারা কারা ?

সম্রাট অশোক : ওহ ওরা ? ওরা বলিউডের অভিনেতা শাহরুখ খান আর কারিনা কাপুর খান । আমাকে নিয়ে একটা ভুলভাল ফিল্ম করেছে বলে ক্ষমা চাইতে এসেছে । শাহরুখ খান বিয়ে করেছে কাফের মেয়েকে আর কারিনা কাপুর নিজেই কাফের, পতৌদির নবাব বাড়ির ছেলেকে বিয়ে করেছে। ওদের ছেলের নাম রেখেছে তৈমুর  । যাই, ওরা অনেকক্ষণ হলো এসেছে, আজকেই ফিরে যাবে । ওরা জানতো না যে আমাকে দেখতে খারাপ বলে আমার বাবা আমায় পছন্দ করতেন না । রাজা রবি বর্মার আঁকা আমার ছবি দেখে ওরা ভেবেছে আমাকে দেখতে গ্রিক দেবতাদের মতন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আমার নামে ? দারুন । ওরা জানে তো যে আমি ল্যাঙড়া ছিলুম ?

গুলবদনপিসি : ভুলভাল কেন : বাবরনামা, হুমায়ুননামা, জাহাঙ্গিরনামা, তৈমুরনামার মতন বই নেই আপনার সম্পর্কে ?

সম্রাট অশোক : আছে, অশোকাবদান  বা অশোকরাজাবদান নামে । দ্বিতীয় শতাব্দীতে লেখা বই, যেখানে আমার, মানে তৃতীয় মৌর্য্য সম্রাট অশোকের জীবন  বর্ণনা করা হয়েছে। এই বইতে ঐতিহাসিক তথ্য ছাড়াও বহু কল্পকাহিনী স্থান পেয়েছে। এই বইতে আমাকে একজন বৌদ্ধধর্মের পৃষ্ঠপোষক শাসক হিসেবে তুলে ধরা হয়েছে, কেননা আমি বিস্তীর্ণ অঞ্চলে এই ধর্ম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলুম।  অশোকাবদান বইটা বহু বৌদ্ধ প্রবাদ ও কাহিনীর সংগ্রহ হিসেবে পরিচিত দিব্যাবদান বইয়ের  অংশ বিশেষ।  ফা-হিয়েন এই বইটাকে আ-ইয়ু ওয়াং চুয়ান  নামে  চীনা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। আমার আধ্যাত্মিক টিচার বৌদ্ধ ভিক্ষু উপগুপ্তর কাহিনী দিয়ে এই বইটার শুরু । উপগুপ্তর পূর্ব-জন্ম আর মথুরা শহরে তার যৌবনের বর্ণনায় এই বইতে তার সঙ্গে নর্তকী বাসবদত্তার সাক্ষাৎ আর ভিক্ষুকত্ব নেবার গল্প বলা হয়েছে। এই বইতে আমার পূর্ব জন্মের কাহিনী  আছে । সেই কাহিনী অনুসারে, পূর্ব জন্মে আমার নাম ছিল জয়। কৈশোরে জয়ের সঙ্গে গৌতম বুদ্ধের সাক্ষাৎ হয়। জয় ধুলোকে খাদ্য জ্ঞান করে তাঁকে এক বাটি ধুলো দান করেন। তার মহাপরিনির্বাণের বহু বছর পরে এই বালক পরবর্তী কোন এক জন্মে পাটলিপুত্র নগরী থেকে চক্রবর্তী সম্রাট হিসেবে শাসন করবেন বলে গৌতম বুদ্ধ ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন। অশোকাবদান বইতে বলা হয়েছে  যে, আমার বাবা বিন্দুসার আমার কুরূপের জন্য আমাকে অপছন্দ করতেন। 

গুলবদনপিসি : সিংহাসন দখলের জন্যে আপনাদের ভাইয়ে-ভাইয়ে বা কাকা-ভাইপোর মধ্যে মোগলদের মতন খুনোখুনি হতো না ?

সম্রাট অশোক : হতো না আবার ! আরও বেশি করে হতো । আমি আমার সৎভাই, যে সিংহাসনের  উত্তরাধিকারী ছিল, তার সঙ্গে শঠতা করে  জ্বলন্ত কয়লা ভর্তি গর্তে ফেলে দিয়ে খুন করেছিলুম । আমি আমার মন্ত্রীদের বিশ্বস্ততার ওপর সন্দেহ করে পাঁচশো  মন্ত্রীকে  একের পর এক খুন করিয়েছিলুম ।  বন্দিদের থার্ড ডিগ্রি টর্চার করার জন্য একটি হলঘর তৈরি করিয়েছিলুম। এই সবই পালটে গেল, মানে আমি নিজেই পালটে গেলুম । দুঃখ কষ্টে সহনশীল এক বৌদ্ধ ভিক্ষুর সঙ্গে সাক্ষাতের পর আমি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে চুরাশি হাজার স্তূপ নির্মাণ করিয়েছিলুম ।

গুলবদনপিসি : আর কী আছে বইতে ? আমি ব্যাপারটা জানতে চাইছি যাতে হুমায়ুননামা বইটায় নতুন ইনটারেস্টিং কিছু অ্যাড করতে পারি ।

সম্রাট অশোক : বৌদ্ধ ধর্ম প্রসারে আমার ভূমিকা এই বইতে বিশদে লেখা আছে । এই বই অনুযায়ী, আমি আমার ভাই বীতাশোককে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলুম । এরপর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের সম্মান করার জন্য  মন্ত্রী যশসকে নির্দেশ দিই। তারপর উপগুপ্তকে সঙ্গে করে গৌতম বুদ্ধের সঙ্গে জড়িত জায়গাগুলোতে তীর্থ করতে বেড়িয়ে পড়ি। বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য আমি একটা পঞ্চবার্ষিকী উৎসবের প্রচলন করেছিলুম। এই উৎসবে আমার সঙ্গে পিন্ডোল ভরদ্বাজের দেখা হয়। আমার বউ  তিষ্যরক্ষার ষড়যন্ত্রে আমার ছেলে কুণালের অন্ধত্বের কাহিনীও এই বইতে লেখা আছে। কুণাল পরবর্তীকালে অর্হত্ত্ব লাভ করে। বৌদ্ধ ধর্ম নেবার পরে দুটো ঘটনায় আমি চটে গিয়েছিলুম । একবার পুণ্ড্রবর্ধনের একজন লোক একটা ছবি এঁকে এনেছিল যাতে দেখানো হয়েছিল গৌতম বুদ্ধ নিগণ্ঠ ণাতপুত্তকের পা ছুঁয়ে প্রণাম করছেন । এক বৌদ্ধধর্মাবলম্বীর অভিযোগ পেয়ে আমি তাকে গ্রেপ্তার করার নির্দেশ দিই আর পরে পুণ্ড্রবর্ধনের সমস্ত আজীবিক সম্প্রদায়ের মানুষদের মেরে ফেলার নির্দেশ দিই, যার ফলে প্রায় আঠারো হাজার মানুষ খুন হয়। কিছু সময় পরে, পাটলিপুত্র শহরের এক জৈন ধর্মাবলম্বী ওইরকম একটা ছবি আঁকলে আমি তাকে সপরিবারে জীবন্ত অবস্থায় পুড়িয়ে মারার হুকুম দিই ।  যারা  জৈন ধর্মাবলম্বীদের কাটা মাথা এনে দিতে পারবে আমি তাদের  রৌপ্য মুদ্রা দেওয়ার কথা ঘোষণা করেছিলুম। এই আদেশের ফলে ভুলক্রমে এক পশুপালক আমার ভাই বীতাশোককে জৈন সন্ন্যাসী ভেবে খুন করেছিল। আমার মন্ত্রীরা আমায় বলেন যে, এই হত্যাকাণ্ডগুলি জিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিদের মধ্যেও বেদনার সঞ্চার করেছে। নিজের ভুল বুঝতে পেরে আমি মৃত্যুদণ্ডের আদেশ রদ করে দিয়েছিলুম । অবশ্য এই গল্পগুলো বানানো, দেখাবার জন্যে যে আমি কতো খারাপ ছিলুম আর পরে কতো ভালো হয়ে গেলুম ।  তবে এটা ঠিক, অশোকাবদান বইয়ের বর্ণনা অনুসারে, শেষ জীবনে আমি আমার রাজকোষের সমস্ত সম্পদ সংঘগুলোকে দান করতুম। আমি সমস্ত সম্পদ দান করে দেবো এই ভয়ে আমার মন্ত্রীরা আমাকে রাজকোষে ঢুকতে দিতো না । তাই আমি নিজের ব্যক্তিগত সম্পদ দান করে দিয়েছিলুম ।

গুলবদনপিসি : আপনি তো খুনোখুনির ব্যাপারে দেখছি মোগল, উজবেক, আফগান, ইরানি, তুর্কি সম্রাটদের চেয়ে কম যান না ।

সম্রাট অশোক : একটা যুদ্ধের পর আমি পুরোপুরি পালটে গিয়েছিলুম । তোমার মোগল, উজবেক, আফগান, ইরানি, তুর্কি সম্রাটরা তা পারেনি । আল-হিন্দের পূর্ব উপকূলে কলিঙ্গদেশ ছিল, এখন ওডিশা নামে পরিচিত। কলিঙ্গবাসীরা যুদ্ধ করলো বীরের মতো কিন্তু আমার পরাক্রমশালী সেনাবাহিনীর সাথে পেরে উঠলো না। এক ধ্বংসাত্মক যুদ্ধের পর জয়ী হলুম । এই সংগ্রাম আর বীভৎস অত্যাচার এত গভীরভাবে আমাকে আঘাত করলো যে, যুদ্ধ আর সব রকমের সামরিক কার্যকলাপের প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জন্মে গেল।  যুদ্ধের এই ভয়াবহতা দেখে নিজের ভেতর এক বিষাদ অনুভব করলুম। এত রক্তপাত আর হত্যাকান্ডের বদলে পাওয়া রাজত্বের প্রতি নিরাসক্ত বোধ করতে আরম্ভ করলুম। এরপর আমি আর যুদ্ধ করিনি । দক্ষিণের এক ক্ষুদ্র খন্ড বাদে সমস্ত ভারত ছিল আমার অধীন, আর এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ডও আমি অনায়াসে জয় করতে পারতুম।  গৌতম বুদ্ধের অহিংস নীতির প্রতি আকর্ষণ বোধ করতে লাগলুম, আর বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত হয়ে বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচারের  চেষ্টায় জীবন কাটালুম। আমার ধর্ম,  মন্ত্র উচ্চারণ আর পূজা অর্চনায় ছিল না, মহৎ সামাজিক উন্নয়নের জন্য আমি মনোনিবেশ করলুম। দেশজুড়ে নির্মিত হলো বাগান, হাসপাতাল, রাস্তাঘাট। প্রজাদের সুপেয় পানীয়জল এর অভাব পুরণের জন্য নির্মাণ করা হলো অসংখ্য কুয়ো। নারীশিক্ষার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা নেয়া হলো। বিশাল বিশাল চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হলো, সেখানে জ্ঞানের সর্বোচ্চ শাখার পাঠদান করা হতো। এমনকি  পশুপাখিদের জন্যও আমি হাসপাতাল তৈরি করেছিলুম। এভাবে প্রজাদের উন্নতির জন্য কাজ করে, ছত্রিশ বছর রাজত্ব করে, মারা যাই । 

শাহজাহান : আমার বড়ো ছেলে দারা শুকোহ আর বড়ো মেয়ে জাহানারা অমন চরিত্রের ছিল । আওরঙজেব দুজনকেই সহ্য করতে পারতো না । আমি চেয়েছিলুম দারা শুকোহ সম্রাট হোক । আওরঙজেব ওকে খুন করে ওর গলা কেটে ফেললো । তারপর কাটা মাথাটা তরোয়াল দিয়ে থেঁতো করে আমার খাবার সময়ে পাঠিয়েছিল । দারা শুকোহকে হুমায়ুনের সমাধিতে কোথায় যে আওরঙজেব গোর দিয়েছিল তা আজ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি । দারার ছেলে সুলেমান শিকোহকেও একইভাবে খুন করেছিল ।

গুলবদনপিসি : সব পরিবারেই অবাধ্য সন্তান জন্মায় । আমাদের পরিবারে যেন বেশি জন্মেছে । আরে, ওই তো বাহাদুর শাহ জাফর আসছেন ।

বাহাদুর শাহ জাফর : অনেক কষ্টে এলুম তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে । বিদেশে নিয়ে গিয়েছিল ফিরিঙ্গিগুলো । এখন দেখে ভালো লাগছে মহাবিদ্রোহ সফল হয়েছে । এখানকার লোকেরা স্বাধীন হয়েছে । তবে আসার সময়ে শুনছিলুম চোর-ছ্যাঁচোড়ের সংখ্যা নাকি অনেক বেড়ে গেছে । যারা শাসক তারাই সিঁদ কাটছে । বেশি কথা বলতে পারি না, হাঁপিয়ে যাই । শায়রিও লিখতে পারি না । 

শাহজাহান : তোকে কী আর বলি বাহাদুর শাহ । আমি যে উর্দুভাষা তৈরি করেছিলুম, তুই আর গালিব ভালোবাসতিস, সেই ভাষা থেকে জন্মে গেল নতুন একদল মানুষ । তারা উর্দুভাষা নিয়ে একটা আলাদা দেশ বানিয়ে ফেললে । সেখানে পাসপোর্ট ছাড়া আমরা যেতে পারবো না । ওরা বলেছিল যে নাস্তিক কাফের মুরতাদদের থেকে আলাদা হয়ে যাবে, অথচ ওই দেশেই যারা সুবেবাংলার ভাষায় কথা বলতো, তাদের ওপর এমন অত্যাচার করতে লাগলো যে তারা আলাদা হয়ে গেল । উর্দূদেশের চেয়ে বাংলাদেশ অনেক উন্নতি করছে । উর্দুদেশটায় সদাসর্বদা সামরিক চোখরাঙানি চলতেই থাকে ।

বাহাদুর শাহ জাফর : ভালোই হয়েছে । গালিবের কবর তো এই দেশে । সামরিক পাহারাদাররা এসেছে আমার সঙ্গে, যদি গালিবের কবরটা দেখতে দেয় তাহলে যাবো । শুনতে পেয়েছিলুম, তুমি বলছিলে, দারা শুকোহ’র কবর পাওয়া যায়নি, আওরঙজেব লোপাট করে দিয়েছে । নয়তো একবার যেতুম ওনার সমাধি দেখতে । দারা শুকোহর সমাধি আওরঙজেব লোপাট করেছিল আর আমার সমাধি লোপাট করেছিল ফিরিঙ্গিরা । ফিরিঙ্গিরা একটা পাথরের ফলক বসিয়েছিল,  তাতে লেখা, “বাহাদুর শাহ, দিল্লির সাবেক রাজা। মৃত্যু রেংগুনে, নভেম্বর ৭, ১৮৬২। এই স্থানের কাছে সমাধিস্থ করা হয়”। কিন্তু সমাধির নির্দিষ্ট স্থান হারিয়ে গিয়েছিল। বর্মার লোকেরা কেবল জানতো যে শেদাগন প্যাগোডার কাছে আমার সমাধি আছে। ওই জায়গাতে মজুররা নর্দমা বানানোর জন্য মাটি খুঁড়ছিল। হঠাৎ বেড়িয়ে পড়ে পোড়া ইটের দেয়াল দেয়া এক কবর। ওপরে কিছু লেখা। সেই লেখা পড়ে ওরা জানতে পারে ওখানে আমি শুয়ে আছি।  গড়ে ওঠে দরগাহ। পরে সেটা ট্যুরিস্টদের  জন্য খুলে দেয়া হয়েছে । বর্মার লোকেরা বলে, সম্রাট দরবেশের দরগাহ। মরে গিয়ে দরবেশ হয়ে গেছি । 

গুলবদনপিসি  : হ্যাঁ, বাহাদুর শাহ, তুই দরবেশ হয়ে মোগলদের মুক্তি দিয়ে গেছিস ।

বাহাদুর শাহ জাফর : ওই যে, সামরিক পাহারাদাররা আসছে । উঠে পড়ি । নয়তো শু চি’র মতন চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাবে । যাবার আগে এই দু’লাইন শুনিয়ে যাই, হোলি তো এসে গেল :

আজ বহুদিন পর হাতে পেয়েছি তোমায়, যেতে দেব না

তোমার উত্তরীয় ধরে আটকে কৃষ্ণ হোলি খেলবো তোমার সাথে

(বহোত দিনন মেঁ হাথ লাগে হো ক্যায়সে জানে দেউঁ

আজ ম্যায় ফাগওয়া তা সও কানহা ফ্যায়তা পাকাড় কর লেউঁ)

ভাইপো আকবর : বহুত খুব, বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা আসবে না ?

পাগলা তুগলক : বিনির্মাণবাদ হলো আপেক্ষিক সংশয়বাদী একটা ধারা যা কিনা ফেড্রিক নিটসের হাত ধরে ষাটের দশকে দারিদার কাছে এসে পরিপুষ্ট হয়েছে। সাহিত্য বা মানুষের চিন্তার ক্ষেত্রে বিনির্মাণবাদ একটা নতুন দরোজা খুলে দিয়েছে। তিনি বলতে চেয়েছেন, আমরা একটা নির্দিষ্ট পরিসরে সুনির্দিষ্টভাবে ভাষা ব্যবহার করি, চিন্তার জগতকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। আর এক্ষেত্রে কোনও বিষয়ের লিখিত ও উপলদ্ধি-র মাঝে প্রায়শ ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ থাকে। কাজেই কোন একটা টেক্সট পড়া দরকার টেক্সট হিসেবে। তাঁর বিনির্মাণবাদের মূলসূত্র তাই, “টেক্সট বা পাঠ প্রকৃতির বাইরে কিছু নেই”। আমরা এই ছোট্ট পরিসরে দারিদার এই নতুন দার্শনিক তত্ত্বের ব্যখ্যা নিয়ে আলোচনা করার সময় পাবো না, নয়তো দর্শন, সাহিত্য, সামাজিক বিজ্ঞান, ধর্ম, এবং ইতিহাসের ওপর এর প্রভাব কতো গভীরে তা একটু তলিয়ে দেখার সুযোগ পেতুম। তার আগে যে সামাজিক ও দার্শনিক বাস্তবতার মধ্যে দারিদার এই তত্ব আত্মপ্রকাশ করেছিলো তার সামগ্রিক পরিস্থিতি নিয়ে দু’চার কথা বলা দরকার ছিল, কিন্তু আজকের আড্ডা সিরিয়াস নয় বলে আর কিছু বলতে চাই না। 

তোতলা তুগলক : পাপাপাগলাটা এএএরককককমই রয়ে গেগেগেল ; দিদিদিল্লি থেকে দৌদৌদৌলতাবাদ। লোকেরা ওওওকে ঠিঢিঢিকমতন বুবুবুবুঝতে পাপাপারেনি ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : হ্যাঁ রে গুলবদন, হুমায়ুন এলো না ?

গুলবদনপিসি  : কোন হুমায়ুন ? হুমায়ুন আজাদ ? ওনাকে তো আলাউদ্দিন খলজির বংশধররা ভেড়া কাটার চপার মেরে মেরে খুন করে দিয়েছে । আর হুমায়ুন আহমেদ জেনানাঘরে বেগম আর খাতুনদের গপপো শোনাচ্ছেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : না, না । তুই যাকে নিয়ে হুমায়ুননামার ‘অর্ধেক জীবন’ লিখেছিস সেই নেশুড়ে হুমায়ুনের কথা বলছি ।

গুলবদনপিসি  : ও তো তেহরানে পালিয়ে যাবার স্মৃতি থেকে মুক্ত হয়নি । হেলমেটে ঘোড়ার মাংস সেদ্ধ করছিল ভেড়ার চর্বি মাখিয়ে । বোধহয় খেয়েদেয়ে আসবে । আফিমের শরবতের নেশায় চুর থাকে সারাদিন । বাবর আর আকবরের নাম উজ্বল করতে পারবে না হুমায়ুন ।

চেঙ্গিজ খান : আচ্ছা ল্যাঙড়া, তুই একবার বলেছিলিস আল-হিন্দে অপ্সরারা থাকে, কই একজনকেও তো কফিহাউসে দেখছি না । সবাই কি পাথরের মূর্তি হয়ে গেল ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : আপনি যেমন শুনেছেন, আমিও তেমন শুনেছি । অপ্সরাদের মধ্যে নামকরা হলো উর্বশী, মেনকা, রম্ভা, তিলোত্তমা,  ঘৃতাচী, অলম্বুষা, মিশ্রকেশী্, জানপদী,  বিদ্যুৎপর্ণা, অদ্রিকা, পঞ্চচূড়া, সোমা, মরীচি, শুচিকা, অম্বিকা, ক্ষেমা, অসিতা, সুবাহু, সুপ্রিয়া, সুগন্ধা, সুরসা, বিশ্বাচী, পূর্বচিত্তি, প্রম্লোচা, বর্গা, প্রমথিনী, কাম্যা, শারদ্বতী, গুণবরা, ঋতুস্থলা, বুদ্বুদা, সৌরভেয়ী, ইরা, চিত্রাসেনা, সমীচী, চারুনেত্রা, পুঞ্জিকস্থলা, শুচিস্মিতা, বিশালনয়না আরও কারা কারা যেন। ওই দিকের টেবিলে কয়েকজনকে তো অপ্সরা বলেই মনে হচ্ছে ।

ঘসেটি বেগম : না, না, ওরা অমন সেজে এসেছে । দেখছো না, ওরা একটা লোককে ঘিরে বসেছে । ওই লোকটার একটা কাগজ আছে, ফি-হপ্তায় নাকি পনেরো দিনে একবার বেরোয় । ওই লোকটাই বোধহয় বিশ্বামিত্র, ওরা তালে আছে ওনার কাগজটায় নিজেদের লেখা ছাপাবার । ছাপলে তবে অপ্সরায় প্রোমোশান । যতোদিন না ছাপছে ততোদিন রাক্ষসদলেই থাকবে । অনেকে শেষ পর্যন্ত পারে না, আমার আর ওসামা বিন লাদেনের মতন জলে ডুবে মরে ।

চেঙ্গিজ খান : এই রে, লোকটা তো চলে গেল । বোধহয় কাউকে পছন্দ হয়নি ।

গুলবদনপিসি  : কিন্তু অন্য একজন বুড়ো আমাদের দিকে এতোক্ষণ তাকিয়েছিল, সে এদিকেই আসছে । বোধহয় আমাকেই অপ্সরা বলে মনে করছে । ওনার পেছন পেছন একজন যুবকও আসছে।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তোকে তো দেখতে-শুনতে ভালোই । কতো আমির-ওমরাহ তোর জন্যে জান লড়িয়ে দিতো । তোকে হয়তো ওদের দুজনের ভালো লেগেছে । দ্যাখ, কাকে পছন্দ হয় ।

গুলবদনপিসি  : দুজনকেই আমার পছন্দ ।

নাতিন্দ্রনাথ : কিছু মনে করবেন না । আপনাদের কথা শুনছিলুম । অপ্সরার কথা তুললেন বলে দেয়ালে টাঙানো ছবি থেকে নেমে এলুম আপনাদের কাছে। অপ্সরারা আমাদের ধ্যানেই আছে, কোনোখানেই তা বিষয়ীকৃত হয় নি, এ কথা মানতে কারোর ভালো লাগে না। তাই  পুরাণে স্বৰ্গলোকের অবতারণা। যা আমাদের ভাবে রয়েছে অ্যাবস্ট্যাক্ট স্বর্গে তাই পেয়েছে রূপ। যেমন, ষে কল্যাণের পূর্ণ আদর্শ সংসারে রোজ দেখতে পাই নে, অথচ যা আছে আমাদের ভাবে, সত্যযুগে মানুষের মধ্যে তাই ছিল বাস্তবরূপে এই কথা মনে করে তৃপ্তি পাই। তেমনি এই কথা মনে করে আমাদের তৃপ্তি যে, নারীরূপের ষে অনিন্দনীয় পূর্ণতা আমাদের মন খোঁজে তা অবাস্তব নয়, স্বর্গে তার প্রকাশ উর্বশী-মেনকা-তিলোত্তমায়। সেই বিগ্রহিণী নারীমূর্তির বিস্ময় ও আনন্দ উর্বশী কবিতায় লিখেছি । অন্তত পৌরাণিক কল্পনায় এই উর্বশী একদিন সত্য ছিল, যেমন সত্য তোমরা আমরা। তখন মর্তলোকেও তার আনাগোনা ঘটত, মানুষের সঙ্গেও তার সম্বন্ধ ছিল ; সে সম্বন্ধ অ্যাবসট্র্যাক্ট নয়, বাস্তব। যথা পুরুরবার সঙ্গে তার সম্বন্ধ। কিন্তু কোথায় গেল সেদিনকার সেই উর্বশী । আজ তার ভাঙাচোরা পরিচয় ছড়িয়ে আছে অনেক মোহিনীর মধ্যে, কিন্তু সেই পূর্ণতার প্রতিমা কোথায় গেল ! ফিরিবে না, ফিরিবে না, অস্ত গেছে সে গৌরবশশী । একটা কথা মনে রেখো। উর্বশীকে মনে করে যে সৌন্দর্ষের কল্পনা কাব্যে প্রকাশ পেয়েছে, লক্ষ্মীকে অবলম্বন করলে সে আদর্শ অন্যরকম হত ; হয়তো তাতে শ্রেয়স্তত্ত্বের উচ্চস্বর লাগত। কিন্তু রসিক লোকে কাব্যের বিচার এমন করে করে না। উর্বশী উর্বশীই, তাকে যদি নীতি-উপদেশের খাতিরে লক্ষ্মী করে গড়তুম তা হলে ধিক্কারের যোগ্য হতুম। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : দাদু, আমি তো কিছুই বুঝলুম না । বাদবাকি সবাই বুঝেছে কিনা জানি না ।

নাতিন্দ্রনাথ : তাহলে আরেকটা কথা বলি ।  যে প্রাণলক্ষ্মীর সঙ্গে ইহজীবনে আমাদের বিচিত্র সুখদু:খের সম্বন্ধ, মৃত্যুর রাত্রে আশঙ্কা হয়, সেই সম্বন্ধবন্ধন ছিন্ন করে বুঝি আর-কেউ নিয়ে গেল। যে নিয়ে যায় মৃত্যুর ছদ্মবেশে সেও সেই প্রাণলক্ষ্মী। পরজীবনে সে যখন কালো ঘোমটা খুলবে তখন দেখতে পাব চিরপরিচিত মুখশ্ৰী। কোনো পৌরাণিক পরলোকের কথা বলছিনে সে কথা বলা বাহুল্য, এবং কাব্যরসিকদের কাছে এ কথা বলার প্রয়োজন নেই যে বিবাহের অনুষ্ঠানটা রূপক। পরলোকে আমাদের প্রাণসঙ্গিনীর সঙ্গে ঠিক এইরকম মন্ত্র পড়ে মিলন ঘটবে সে আশা নেই। আসল কথা, পুরাতনের সঙ্গে মিলন হবে নূতন আনন্দে।

ভাইপো আকবর : দাদু, এরা বুঝবে না । এরা জাহিল । আমার দীন-ই-ইলাহী বুঝতে না পেরে এরা কতো আমার খিল্লি উড়িয়েছিল । জানে না যে, জ্ঞান-বুদ্ধি-বিবেক থাকাটাই যথেষ্ট নয়; তার সদ্ব্যবহারই প্রকৃত মানুষের কাজ।  সকলে তাদের জ্ঞান-বিবেকের সদ্ব্যবহার করতে পারে না। কেউ সদ্ব্যবহার করতে সমর্থ হলেও কেউ আবার ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

নাতিন্দ্রনাথ : সেই কথাই বলতে এসেছিলুম । যাক তুমি তো বুঝলে ? আমি যাই । সিঁড়ি দিয়ে নামতে আজকাল কষ্ট হয় । যেতে হবে জোড়াসাঁকো । দেখি উবের বা ওলা পাই কিনা । আমি আবার মোবাইল ঠিক মত হ্যাণ্ডল করতে পারি না । এই যুবক হয়তো নতুন করে বোঝাতে পারবে । 

ভাইপো আকবর : আপনারা পয়সাঅলারাই শুধু ব্রাহ্ম হলেন কেন ? চাকর-চাকরানি, মালি-মুদ্দোফরাসরা কী দোষ করেছিল । জমিদারির নমশুদ্র চাষিদের ব্রাহ্ম করতে পারতেন । আমাদের দেখুন, বাদশা থেকে ডোম-মেথর পর্যন্ত সবাই আস্তিকান্তরিত ।

নাতিন্দ্রনাথ : বাবামশায় বলতে পারবেন । উনি এখন উপাসনাঘরে ।

তিরিষ্ণুযুবক : আমি আমাদের উর্বশী আর গ্রিসের উর্বশী দুটোই হ্যাণ্ডল করেছি । গ্রিসের উর্বশীর নাম আর্টেমিস ।  দেশীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আত্মস্থ করার পাশাপাশি আমি প্রথম থেকেই বিদেশিনীদের সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে উঠি। তাই আমার জীবনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গ-অনুষঙ্গ প্রবেশ করেছে  প্রথম থেকেই।  বয়সের কারণে, জাহাঙ্গিরের মতন আমার মনেও প্রবেশ করেছে অনুরাগ, আবেগ ও নানান প্রেরণা। জাহাঙ্গিরের মতন মাত্র আঠারো বছর বয়সে আমি ইতিবাচকতা, হতাশা ও আশাবাদে  প্রবলভাবে ভুগেছিলুম ।  উর্বশী আল-হিন্দে আমার অপরূপা সুন্দরী-প্রেমিকা । গ্রিসে আমার প্রেমিকা আর্টেমিস হলো বৃক্ষ ও অমাবস্যার দেবী, শিকারে পারদর্শী আর  তরুণদের রক্ষা করতে অবিকল্প দেবী সে। অন্য দিকে সে দেবতাদের আলোর পথের দিশারি। এই দুই সুন্দরীকে নিয়ে আমি ঘর করেছিলুম । অপার রহস্যেঘেরা সৌন্দর্যের বাগানে শাহজাহানের মতন শৈল্পিক দাপট দেখিয়েছি। শাহজাহান আর জাহাঙ্গির জানবেন যে প্রেমকাতরতা আর বিলাপ যেন মানুষের জীবন থেকে ফুরোতেই চায় না । অপেক্ষা আর মনের চাঞ্চল্য মিলিয়ে আমার অনুভবে-ধরা প্রেমের এক অপরূপ প্রবাহকে । মায়া ও বিভ্রমের এই পৃথিবীতে আমি বারবার প্রেমিকাকে নিয়ে আশার সাগর তৈরি করতে চেয়েছি । অবসাদ থেকে মুক্তির পথে অগ্রসর হয়েছি প্রতিনিয়ত। আমি কল্পনায় সাজিয়েছি পৃথিবীর আদি ও অনন্ত রূপ। নারী-পুরুষের কম্পমান হৃদয়ে স্থান দিয়েছি কল্পনার রাজ্যের অপার আনন্দ

শাহজাহান : বেশ ভালো লাগছে তোমার কথাগুলো যুবক । জাহাঙ্গির তো বহু নারীর সঙ্গে প্রেম করেছে, ও থাকলে তোমাকে শাহি দরবারে নিয়ে যেতো ।

ভাস্কো দা গামা : সেনর, আপনি শুধু ফর্সা, লাল ঠোঁট, পাতলা কোমর, উঁচু বুক, গোলাপি বোঁটা, প্রেমিকাদের নিয়েই ব্যস্ত আছেন?  আমরা তো আফরিকা থেকে তুলে এনে কতো হাবশি মেয়ে এদেশে  বিক্রি করেছি । আপনি একজনকে কিনে তাকে প্রেমিকা করে তুলতে পারতেন । তাদের মতন উঁচু বুক, উঁচু পাছা, চকচকে কালো ত্বক আপনি পাবেন না । জড়িয়ে ধরলে আপনি পাগল হয়ে যাবেন । 

নাতিন্দ্রনাথ : কালো মেয়ে নিয়ে আমি লিখেছি । এবার ছবির ভেতরে যাই, উবেরের ড্রাইভার ওপরে উঠে এসেছে ।

তিরিষ্ণুযুবক : না, তেমন সুযোগ হয়নি । পেলে ভালো হতো । প্রেমের নতুন পরিভাষা তৈরি করতে পারতুম । তবে সমস্যা হলো যে কলেজের ছাত্রছাত্রীরা আমার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতো । আপনাদের টেবিলে এসে ভালো লাগলো । যাই এবার । এই সময় আমার বাড়িতে বন্ধুবান্ধবরা এসে জড়ো হয়, সবাই মিলে এক-আধ পেগ মারি । ওই বুড়ো, যিনি একটু আগে এসেছিলেন, উনি বোধহয় যৌবনে একজন হাবশি মেয়েকে ভালোবেসেছিলেন । কেননা উনি লিখেছেন, “কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,   কালো তারে বলে গাঁয়ের লোক।মেঘলা দিনে দেখেছিলেম মাঠে,  কালো মেঘের কালো হরিণ-চোখ।ঘোমটা মাথায় ছিল না তার মোটে,   মুক্তবেণী পিঠের ‘পরে লোটে।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।ঘন মেঘে আঁধার হল দেখে   ডাকতেছিল শ্যামল দুটি গাই, শ্যামা মেয়ে ব্যস্ত ব্যাকুল পদে   কুটির হতে ত্রস্ত এল তাই।আকাশ-পানে হানি যুগল ভুরু   শুনলে বারেক মেঘের গুরুগুরু। কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ। পূবে বাতাস এল হঠাৎ ধেয়ে,   ধানের ক্ষেতে খেলিয়ে গেল ঢেউ।আলের ধারে দাঁড়িয়েছিলেম একা,   মাঠের মাঝে আর ছিল না কেউ।আমার পানে দেখলে কি না চেয়ে   আমি জানি আর জানে সেই মেয়ে। কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।এমনি করে কালো কাজল মেঘ   জ্যৈষ্ঠ মাসে আসে ঈশান কোণে।এমনি করে কালো কোমল ছায়া   আষাঢ় মাসে নামে তমাল-বনে।এমনি করে শ্রাবণ-রজনীতে   হঠাৎ খুশি ঘনিয়ে আসে চিতে।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।কৃষ্ণকলি আমি তারেই বলি,   আর যা বলে বলুক অন্য লোক।দেখেছিলেম ময়নাপাড়ার মাঠে   কালো মেয়ের কালো হরিণ-চোখ।মাথার ‘পরে দেয় নি তুলে বাস,   লজ্জা পাবার পায় নি অবকাশ।কালো? তা সে যতই কালো হোক,   দেখেছি তার কালো হরিণ-চোখ।”

ভাইপো আকবর : বহুত খুব, বহুত খুব । আমার নবরত্নদের কারোর সঙ্গে তোমার কাছে পাঠিয়ে দেবো আমার পছন্দের হাবশি ক্রিতদাসীদের একজনকে । কোন হরিণের চোখের মেয়ে চাও ?  বল্গা হরিণ, মায়া হরিণ, সম্বর হরিণ,  চিত্রা হরিণ নাকি চাইনিজ ওয়াটার ডিয়ার, রেইনডিয়ার, এন্টিলোপ,  এশিয়ার মাস্ক ডিয়ার,  আর্দ্র ‌আফ্রিকার ওয়াটার চেভ্রোটেইন, কিংবা মাউস ডিয়ার, যেমন চোখের চাও, জানিও, পাঠিয়ে দেবো । শ্যায়খুবাবা এলোনা কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার ওই লম্বাদাড়ি লম্বাচুল বুড়ে, যিনি একটু আগে ছবি থেকে নেমে এসেছিলেন, উনিও মাই নিয়ে একটা কবিতা লিখেছেন, কড়ি ও কোমল বইতে আছে ; তবে কবিতাটার নাম স্তন ।

চেঙ্গিজ খান : শোনাও শোনাও ।

কফিহাউসের যক্ষ : নারীর প্রাণের প্রেম মধুর কোমল,

বিকশিত যৌবনের বসন্ত সমীরে

কুসুমিত হয়ে ওই ফুটেছে বাহিরে,

সৌরভ সুধায় করে পরান পাগল।

মরমের কোমলতা তরঙ্গ তরল

উথলি উঠেছে যেন হৃদয়ের তীরে।

কী যেন​​ বাঁশির ডাকে জগতের প্রেমে

বাহিরিয়া আসিতেছে সলাজ হৃদয়,

সহসা আলোতে এসে গেছে যেন থেমে–

শরমে মরিতে চায় অঞ্চল-আড়ালে।

প্রেমের সংগীত যেন বিকশিয়া রয়,

উঠিছে পড়িছে ধীরে হৃদয়ের তালে।

হেরো গো কমলাসন জননী লক্ষ্ণীর–

হেরো নারীহৃদয়ের পবিত্র মন্দির।

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার ওই টেবিলে যে মেয়েটি বসে আছেন, ওনার নাম মিতুল দত্ত । উনিও স্তনের ওপর কবিতা লিখেছেন । ওনার কবিতার নাম দুর্বার জন্য কবিতা ।

চেঙ্গিজ খান : শোনাও শোনাও ।

কফিহাউসের যক্ষ : যেভাবে বুক দুটোকে বেঁধে রাখিস

মনে হয় ওরা তোর মেয়ে

একটুখানি ঢিলে দিলে বেয়াড়া অসভ্য হয়ে

ডেকে আনবে পাড়ার ছেলেদের

স্নানের সময় যেই খুলে দিস

হুটোপাটি করে ওরা স্নান করে

কেউ কাউকে একটু কষ্ট না দিয়ে

যে যার মতো একা 

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও !

নোবিলিআত্মন : মাই সম্পর্কে আর কী জানো ? ইটালিতে ফিরে যে আল-হিন্দ স্মৃতিকথা লিখব তাতে ইনক্লুড করে নিতে হবে ।

পাগলা তুগলক  : আমি বলছি, আমি বলছি ।মানুষই হল একমাত্র স্তন্যপায়ী প্রাণী যার যৌন উত্তেজনার সঙ্গে স্তনের সম্পর্ক রয়েছে। সাধারণত বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষ বেশি আকর্ষণ অনুভব করে। নারী শরীরের অন্যতম নরম অংশ হল স্তন। এই কোমলতা পুরুষকে আকর্ষণ করে। ফলে স্তন স্পর্শ করতে, মুখ দিতে, মাথা রাখতে, এমনকী নারী দুই হাতে দুটি স্তনকে পরস্পরের সঙ্গে চেপে সঙ্গমছিদ্র তৈরি করলে পুরুষ আগ্রহ বোধ করে। নারী-স্তন পুরুষের কাছে অত্যন্ত আরামদায়ক। স্তনে মাথা রেখে বিশ্রাম নেওয়া তার সুপ্রাচীন অভ্যাস। জীবজগতে একমাত্র মানুষের ক্ষেত্রে নারীর স্তন বয়সের সঙ্গে মাপে বড়ো হয়, যখন কিনা স্তন্যপায়ী পশুদের স্তনের মাপ বড়ো হয় তারা পোয়াতি হয়ে বুকে দুধ আসার পর ; বাচ্চা বড়ো হবার পর আবার আগের মতো হয়ে যায় ।  ঋতুর বয়সে পড়লে নারীর বুকে কেন চর্বি জমে অমন আকর্ষক পিণ্ড গড়ে ওঠে তার নানা রকম ব্যাখ্যা দিতে চেয়েছেন গবেষকরা। কিন্তু প্রধান তর্ক হল যে তা পুরুষকে আকর্ষণের জন্য প্রকৃতির অবদান । ২০১৮ সালে প্রকাশিত ‘দি কেমিস্ট্রি বিটউইন আস : লাভ, সেক্স অ্যান্ড দি সায়েন্স অব অ্যাট্রাকশান’ বইতে ল্যারি ইয়াং ও ব্রায়ান আলেকজান্ডার জানিয়েছেন যে নারীর স্তন সম্পর্কে পুরুষদের অবশেসন ঘটে যখন সে মায়ের কোলে শুয়ে দুধ খায় এবং মায়ের অক্সিটোসিন হরমোন নির্গত হয় যার দরুন স্তনের সঙ্গে পুরুষের পাকা বাঁধন তৈরি হয়ে যায়, অবচেতনায় গেঁথে যায় । পুরুষ তার সঙ্গিনীর মধ্যে সেই একই বাঁধনযোগ্যতা খোঁজে আর তার জন্য সে বড়ো মাপের স্তনের প্রতি আকৃষ্ট হয় । যারা বেশ্যালয়ে যাতায়াত করে তারাও সুন্দর মুখমণ্ডলের বদলে বর্তুল স্তন আর খাঁজের খদ্দের হয়ে ওঠে । পুরুষ যখন চোখে দেখে, ছোঁয়, মুখ দেয়, টেপে, তখন তার অবচেতনায় শৈশবের ভালোলাগা স্মৃতি কাজ করে । বড়ো মাপের স্তনের প্রতি পুরুষের আকর্যণের কারণ হল অবচেতনে তারা স্তনকে দুধের ভাঁড়ার হিসাবে দ্যাখে ; যতো বড়ো স্তন ততো বেশি দুধ । সন্তান প্রসবের পর কোনো কোনো নারীর অত্যধিক দুধ হয় যা আগেকার কালে গেলে ফেলে দেবার চল ছিল ; এখন ডাক্তাররা বলেন যে তা সংগ্রহ করে অন্যান্য শিশুদের দিতে কিংবা তা স্বামী নিজেই স্তন থেকে পান করতে পারেন ।

তোতলা তুগলক : হ্যাঁ, এএএকটা দিদিদিল্লিতে, আআআরেকটা দৌদৌদৌলতাবাদে ।

ভাইপো আকবর : বহুত খুব বহুত খুব । আরে, একটা কমবয়সী মেয়ে হনহন করে এদিকেই আসছে ! অথচ শ্যায়খুবাবা এলো না ।

কৃপা খাতুন : আপনারা তখন থেকে মেয়েদের বুক নিয়ে ফালতু গ্যাঁজাচ্ছেন । আজকের একটা ঘটনা আপনাদের শুনিয়ে যাই । আজকে একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে, অটোতে পেছনের সিটে বসে বাড়ি ফিরছি। পেছনের সিটে অলরেডি তিনজন বসেছিল, তাই একটি স্কুল পড়ুয়া মেয়ে সামনের সিটে বসলো….

অটোচালক একজন মধ্যবয়স্ক লোক, অটো চলতে শুরু করলো, আমরা যে যার নিজের ফোন ঘাঁটছি…

হঠাৎ অটো কিছুটা চলার পরে সামনের সিটে বসে থাকা মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো, অটো থামাতে বললো….

আমরা সবাই অবাক হয়ে গেলাম, হঠাৎ কি হলো কিছুই বুঝলাম না….

মেয়েটা রাগে গজগজ করছে, সমানে চিল্লাচ্ছে…

অটোচালক অটো থামালো, মেয়েটা অটো থেকে নেমে অটোচালকের কলার ধরে টেনে হিড়হিড় করে অটো থেকে নামানোর চেষ্টা শুরু করলো….

অটোচালক কিছুতেই নামবে না, আমরা সবাই অটো থেকে নামলাম….

আমি জিগ্যেস করলাম মেয়েটাকে কী হয়েছে বলো….

মেয়েটা রীতিমতো চিল্লাতে চিল্লাতে বলছে,

“যখন থেকে অটোতে উঠেছি, তখন থেকে লোকটা অসভ্যতামি করার চেষ্টা করছে। আমি প্রথমে ভাবলাম এত বয়স্ক মানুষ, হয়তো ভুল করে হাত লেগে গেছে বুকে….

কিন্তু এই লোকটা ইচ্ছে করেই বারবার কনুই ঠেকাচ্ছে বুকে, আমার বাবার বয়সী একটা লোক কি অসভ্য, ছিঃ!

একটু আগে এত জোরে কনুই দিয়ে বুকে আঘাত করলো, যে আমি আর সহ্য করতে পারলাম না তাই চিল্লিয়ে উঠলাম”….

মেয়েটা এই কথাগুলো বলতে বলতে আশেপাশের প্রচুর লোকজন জোগাড় করে ফেলেছে….

সবাই হাঁ করে মেয়েটার কথা শুনছে, মেয়েটার বুকগুলো দেখছে, অথচ কেউ এগিয়ে এসে লোকটাকে দুটো থাপ্পড় মারছে না, পুলিশ ডাকছে না….

আমি মেয়েটাকে শান্ত করলাম, ওর চোখে মুখে জল দিয়ে দিলাম….

আমি পুলিশকে ফোন করতে যাবো, ইতিমধ্যেই দেখলাম দুটো ছেলে এসে অটোচালককে রাস্তায় ফেলে মারছে…

দুটো ছেলে বিশাল দামি কোনো শার্ট প্যান্ট পরেনি, দেখলেই বোঝা যায় অল্প শিক্ষিত ছেলে। ওঁরা পাশের গ্যারেজে কাজ করছিলো, জামায় কালিঝুলি মাখানো, চুল উস্কোখুস্ক, চুলের সামনের দিকে আবার লাল রঙ করা, চোখ মুখ শুকনো ভীষণ….

মেয়েটার গলার চিৎকার শুনে ওঁরা ছুটে এসে লোকটাকে মারতে শুরু করেছে ততক্ষণে, আর যাঁরা তথাকথিত ভদ্র সভ্য শিক্ষিত (বাহ্যিক দিক থেকে) তারা হাত পা গুটিয়ে চুপচাপ তামাশা দেখছে….

যাইহোক অটোচালক প্রথমে নিজের ভুল স্বীকার করছিলো না, তারপর ছেলে দুটোর মার খেয়ে স্বীকার করেছে নিজের নোংরামির কথা। মেয়েটার পায়ে হাত দিয়ে ক্ষমা চেয়েছে….

পড়াশুনোয় অল্প শিক্ষিত গ্যারেজে কাজ করা ছেলেদুটো মেয়েটার কাছে এসে বললো,

“দিদি তুমি একদম কাঁদবা না, এই নোংরা লোকেদের জন্য আমাদেরকে সবাই খারাপ ভাবে দিদি। এই নোংরা লোকদের জন্য চোখের জল ফেলবা না”…..

ইতিমধ্যেই ট্রাফিক পুলিশ এসে অটোচালককে নিয়ে যায় ওখান থেকে….

মেয়েটাকে আমি বললাম, ওই নোংরা লোকটাকে এত সহজে ছেড়ে দিও না। উপযুক্ত শাস্তি দিও, পুলিশে অভিযোগ জানিও, আজকে তুমি ছেড়ে দিলে কালকে অন্য একটা মেয়ের সাথে ওই লোকটা আবার নোংরামি করবে, ওর কিন্তু জেল খাটা দরকার….

গ্যারেজে কাজ করা ছেলে দুটো অন্য একটা অটো ডেকে এনে মেয়েটাকে তুলে দিলো অটোতে, নিজেই পকেট থেকে ভাড়া বার করে দিয়ে দিলো….

মেয়েটা তারপর অন্য অটোতে চেপে বাড়ি ফিরেছে সুরক্ষিত ভাবে, মেয়েটার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম, ফোন করে জানলাম। কালকে হয়তো অটোচালকের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানাবে….

মেয়েটার বয়স বেশি নয়, ষোলো সতেরো হবে, তবুও যে ও এই প্রতিবাদটা করলো এত ছোট বয়সে, মেয়েটাকে কুর্নিশ…

মেয়েটা কিন্তু প্রতিবাদ না করে পিছিয়ে আসতে পারতো, চুপচাপ সহ্য করতে পারতো, বেশিরভাগ মেয়েরা তাই করে, কিন্তু মেয়েটা প্রতিবাদ করেছে, এটাই আমার কাছে অনেক….

আর ওই ছেলে দুটোকে প্রণাম জানাই….

ওই ছেলে দুটোকে বাহ্যিক দিক থেকে দেখলে মনে হবে পাড়ার মোড়ে বসে থাকা রকবাজ ছেলে। কিন্তু ওঁরাই আসল হীরে, সবসময় শিক্ষা পোশাকে থাকে না, শিক্ষা থাকে নিজের বিবেক বোধে….

আমি আজ খুব খুশি, চারিদিকে এত কাঁচের মধ্যে আজ দুটো হীরের টুকরো ছেলের সাথে আলাপ হলো।

ওই দুটো ছেলের কাছে আজীবন ঋণী থাকলাম, যাঁরা পড়াশুনোয় হয়তো বেশি শিক্ষিত নয়, কিন্তু মানবিক দিক থেকে আমাদের চেয়েও অনেক বেশি শিক্ষিত….

এরকম ছেলে ঘরে ঘরে জন্মাক…. 

মালিক অম্বর : চাইলেই জন্মায় না খাতুন, আব্বা-অম্মির ভালোবাসা দরকার !

আসমাঅধরা খাতুন : আমার নাম ধরাছোঁয়ার বাইরের নীলাকাশ, তাই কয়েকটা কথা বলে যাই ।কবি জানোতো, ঈশ্বর বন্দনা শেষে কানের পাশ ঘেঁষে যে ডেকে ওঠে সে শকুন, কোকিল নয়। চাঁদ পূজন শেষে সেই শকুনের মতই তারস্বরে ডেকে ওঠে অন্ধকার। ওঙ্কার, ভাষা আর উপভাষায় যাকেই ডাকবে পুঁথির মতো দুলে দুলে সুর তুলে, সে দেবতা ইন্দ্রিয়ের অতীত কোন সিন্ধু অথবা বিষাদের সাগরে ভাসিয়ে দিতেই অভ্যস্ত। এই সমস্ত চণ্ডাল রাহু কেতু পরিভ্রমণ শেষে সমস্ত উপাসনা সমাপ্ত হতেই দেখবে পুড়ে যাচ্ছো স্বশরীরে। অথচ, পৃথিবীর ছাপাখানায় যে কবিতার পাণ্ডুলিপি পাঠাও তাই, চৈতন্যের দোসর তোমার। এখানে ঈষদুষ্ণ লবঙ্গ জলে কিঞ্চিত নুন মিশিয়ে সেবন করে নিলেই অহেতুক ব্যথা কম হতে পারে, সে নশ্বরতার অভিশাপ নয়। কবি, তোমার কোমল ত্বক কি সইতে পারে আঘাত, যে আঘাতে মলম পট্টি করে দিলেই সেরে যায়! তবু, শ্রীকৃষ্ণ বাঁশী বাজালেই তুমি উতলা হয়ে ওঠো, ঘুঙুর বাঁধতেই ছুটে যাও বনপথে, ময়ূরের মত নাচতে নাচতে দেখো সেখানে পড়ে থাকে কেবল ঝরা পাতা- যে পাতা তোমারই পদতলে মুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায়, সে পাতায় একটি ছোট কবিতা লিখে দেখাও তো কবি! কবিতা কি ভেসে যাচ্ছে না জলে? অশান্ত হচ্ছে না তোমার মনপুরার শান্ত অলকানন্দা? এসো বন্ধ করে দাও সমূহ অন্ধকার স্তুতিরূপ। কেবল নিজের কিয়দংশ ভরে রাখো নেফারতিতিয় রূপবন্দনা, তোমাদের অহমের অর্ধাংশও যদি নার্সিসিজম শিখে যায়, ভরে উঠবে খালি কবিতার খাতা, শূন্য গানের ঘর, পূর্ণ হবে অর্ধসমাপ্ত সমূহ গীতিকবিতা অথবা পাণ্ডুলিপি…

ঢ্যাঙা তুগলক : আহা, আহা, খাতুন, আহা !

ল্যাঙড়া তৈমুর : ওই দ্যাখ, বাবরের মতন দেখতে একজন বুড়ো এদিকেই আসছে, সিঁড়ি দিয়ে উঠে সোজা এদিকেই আসছে । কেউ চিনিস ওনাকে । মোগল বাদশা বলেই তো মনে হচ্ছে দেখে । বাবরের দাদু নাকি ?

দাদুন্দ্রনাথ  : না, আমি বাবরের দাদু নই । ওই বুড়ো যে একটু আগে ছবি থেকে নেমে এসে তোমাদের জ্ঞান দিয়ে গেল, আমি তার দাদু । আমি ব্রিটেনের কবরে শুয়ে থাকি, যদিও আমি কাফের, ইনফিডেল । আমার ছেলের বন্ধুবান্ধব আর নাতিরা মিলে তোমাদের আর খ্রিস্টানদের দেখাদেখি নতুন ধর্ম আরম্ভ করেছিল, যদিও এখন সবই ফক্কা হয়ে গেছে, ছেলেরা বউ পায় না, মেয়েরা বর পায় না, এমন অবস্হা । বাধ্য হয়ে কেউ তোমাদের বিয়ে করে, কেউ কাফের বিয়ে করে, কেউ খ্রিস্টান মেম বিয়ে করে ।

ভাইপো আকবর : আপনি বসুন, হাঁপাচ্ছেন দেখছি, জল খান, কফি আনিয়ে দিচ্ছি । শ্যায়খুবাবা এলো না কেন ?

দাদুন্দ্রনাথ : আমাকে সবাই প্রিন্স বলে ডাকে । আমার তো হৃৎপিণ্ড নেই যে হাঁপাবো । যখন বিলেতে মারা গেলুম ওরা কেউ খোঁজখবর নেয়নি । আমাকে ওখানকার লোকেরা গোর দিয়ে দিলে । আমার ছেলে আর নাতিরা চিন্তায় পড়েছিল যে দাহ না করে গোর দেয়া উচিত হয়নি । ওরা লোক পাঠিয়ে গোর থেকে আমার হৃৎপিণ্ডটুকু কেটে এনে দাহ করেছিল । ওরা আমাকে পছন্দ করতো না। আমার বউও আমাকে পছন্দ করতো না, বিলেতের মেমদের সঙ্গে মেশামিশি করি বলে একঘরে করে দিয়েছিল। এখন আমার গোরটাকে সেখানের বাঙালিরা নতুন করে তৈরি করেছে, তাতে আমার মারা যাবার তারিখ আছে কিন্তু জন্মাবার সন-তারিখ লেখা নেই ।

বাবর : কেন ? 

দাদুন্দ্রনাথ : আমি ধীরুভাই  হতে চেয়েছিলুম । সুবে বাংলাকে ধীরুভাইয়ের মতন বড়োলোকের দেশ করতে চেয়েছিলুম। কিন্তু ওদের পছন্দ হলো না । ওরা সারাদিন চোখ বুজে ধ্যান আর গান গাওয়া, শায়রি লেখাকে বড়ো কাজ মনে করতো ।

গুলবদনপিসি  : ওই তো পরীবিবি আর বেগম সমরু আসছেন ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : ধীরুভাই লোকটা কে ?

দাদুন্দ্রনাথ : চেনেন না ? ধীরুভাই তো দাউদের জাহাজে খেপে-খেপে মেশিন  এনে  পেটরলের পুরো কারখানা বসিয়ে ফেললো। আমি নিজের জাহাজ, রেল লাইন, প্রিন্সলি এসটেট, বীমা ব্যবসা, নীল ব্যবসা, আবাসন ব্যবসা আরম্ভ করেছিলুম । আমারই করা সম্পত্তি ওরা ভোগ করে আমাকেই পরিবার থেকে আলাদা করে দিলে । ধীরুভাইয়ের বড়ো ছেলে এখন এই দুনিয়ার সবচেয়ে ধনী মানুষ । আমার নাতিপুতিরাও হতে পারতো । যাকগে, নাতির লেখা গান নিয়েই এখন সুবে বাংলার ব্যবসা চলছে । তবে কে একজন বন্দ্যোঘটি শুনেছি আমাদের বাড়ির কেচ্ছা বিক্রি করে ব্যবসা করছে । যদি আমি ধীরুভাই হতুম তাহলে এই সব ফালতু ব্যবসা করতে হতো না । হাওয়ায় ফিসফিস উড়ছিল যে কফিহাউসে তোমাদের আড্ডা হবে, তাই এসে বলে গেলুম নিজের দুঃখের কথা । আমার সময়ে তো কফিহাউস বা অকারণ আড্ডার ব্যাপার ছিল না, তাই খুঁজে বের করতে দেরি হয়ে গেল । সেই সকাল থেকে খুঁজছিলুম।  এবার উঠি । আমার কবরে , কে আবার মরে গিয়ে তার ভেতর এসে শুয়ে পড়বে । আজকাল গোরের জায়গা সহজে পাওয়া যায় না। ভাগ্যিস তোমরা গোরের ওপরে মহল খাড়া করে গেছ, নইলে দেখতে বেদখল হয়ে গেছে । ওকে, গুড নাইট ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তোমাকে নিয়ে টানাটানির আবার কী হলো ? তুমি তো পুরোনো ঢাকায় শায়েস্তা খানের তৈরি দুর্গের কবরে শুয়ে থাকো বলে জানি, গুয়াহাটিতে তো নয় । বেগম সমরু, কেমন আছিস ? 

পরীবিবি : আসলে আমি তো অহোম রাজকুমারী । অহম রাজা জয়ধাজ সিংহের একমাত্র মেয়ে আর অসমিয়া যোদ্ধা লাচিত বোর্ফুকনের ভাগ্নী  রমনী গভারু ।  যখন আমার বয়স ছয় বছর তখন মীর জুমলার বাহিনীর কাছে মুক্তিপণ হিসাবে দিয়ে  দেওয়া হয়েছিল। আমার সঙ্গে ছিল টিপম রাজার নাবালিকা মেয়ে । তাকেও মোগলদের হাতে দেয়া হয়েছিল মুক্তির মূল অংশ হিসেবে।  মীর জুমলা অসুস্থ হয়ে পড়ে আর ঢাকায় যাওয়ার পথে মারা গিয়েছিল, আপনারা তো জানেন । ওনার সমাধি  মেঘালয়ের গারো পাহাড়ে । আমাকে সেসময়ে  বাংলার রাজধানী ঢাকায় নিয়ে গিয়ে শায়েস্তা খানের তত্ত্বাবধানে রাখা হয়েছিল । আওরঙ্গজেবের আদেশে আমাকে ইসলামে ধর্মে আস্তিকান্তরিত করে  রহমত বানু নাম দেওয়া হয়েছিল ।  আওরঙ্গজেবের ছেলে আমাকে বিয়ে করে   ১,৮০,০০০ টাকা যৌতুক নিয়েছিল । যদিও বাংলাদেশে আমি আমার জীবনের অন্য গল্পের ভেতরে বেঁচে আছি, সেই একই কবরে । ওরা মনে করে আমি শায়েস্তা খানের মেয়ে, যে আওরঙ্গজেবের ছেলে মুহম্মদ আজম শাহকে বিয়ে করেছিল । আমি মারা গেলে বেচারা বর, লালবাগ দুর্গটা পুরো করার আইডিয়া ছেড়ে দিয়ে আমাকে  প্রাসাদেই সমাধিস্থ করেছিল। আমি নাকি খুবই সুন্দরী, তাই আমার বর আমাকে পরীবিবি বলে ডাকতো । এখানকার রিকশঅলারা দুর্গটার নাম দিয়েছে পরীবিবির কবর । তারা প্যাসেঞ্জার এনে তাদের বলে, পরীবিবির  একজন প্রেতিনী,  রাতে লালবাগ কেল্লায় ঘোরাঘুরি করে ? ভেতরে উঁকি মেরে দ্যাখো , পরীবিবি মিটকি মেরে পড়ে আছে।  আমার ভাগ্য ভালো । কয়জনই বা একসঙ্গে দুটো দুরকম গল্পে বেঁচে থাকে, বলো ! চলি, খোদা হাফিজ । আমার কবর এমন ভাঙাচোরা যে সন্ধের আগে ভেতরে ঢুকে না পড়লে সাপখোপ আশ্রয় নেবে । বেগম সমরু, চললুম । আবার দেখা হবে । এসো একদিন পুরোনো ঢাকায় ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : হ্যাঁ, যাবো রে পরীবিবি । ভালোই আছি ল্যাঙড়াদা । সেনর ভাস্কো ভালো আছেন তো ? কতোকাল দেখাসাক্ষাৎ কথাবার্তা হয়নি আপনাদের সঙ্গে ।

ভাস্কো দা গামা : ভালো লাগলো তোকে দেখে জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে   । তুইই তো এদেশে একমাত্র ক্যাথলিক শাসক ছিলিস, সম্পত্তিও করেছিলিস অঢেল ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আপনারা, ক্যাথলিকরাই শুধু আমাকে সন্মান করেন । কিন্তু হিদেন আর ইনফিডেলরা আমাকে নাচনেওয়ালি-নাচনেওয়ালি বলে-বলে বদনাম করে । বেগম সমরু বললেই, তার সঙ্গে নাচনেওয়ালি জুড়ে দ্যায় ।

বাবর : তুই তো ছিলিসই নাচনেওয়ালি ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আপনার নাতি জালালুদ্দিন আর জালালুদ্দিনের ছেলে সেলিম তো একই নাচনেওয়ালি আনারকলিকে পেতে চাইতো ; সেলিম আনারকলিকে পেয়ে গেল বলে জালালুদ্দিন মেয়েটাকে জ্যান্ত কবর দিয়ে দিলে ।

ভাইপো আকবর : এই বেগম সমরু, মুখ সামলে কথা বলবি । তোর প্রাসাদে যে দুজন লোক আগুন লাগিয়েছিল, তুইও তাদের জ্যান্ত মাটিতে পুঁতে দিয়েছিলি । আমি তো একটা চারদেয়ালে বন্ধ করে দিয়েছিলুম । শ্যায়খুবাবা এলো না ?

চেঙ্গিজ খান : আরে ঝগড়া করছিস কেন । একটু বসুক, কফি-টফি খেয়ে চাঙ্গা হয়ে নিক, তারপর না হয় যে যার নিজের কথা বলিস ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আমাকে ল্যাঙড়া তৈমুর ডেকেছিল বলে এয়েছি । নইলে আসতুম নাকি অতোদূর থেকে এই নাস্তিকদের কফিহাউসে ! কতোকাল পরে তোমাদের সঙ্গে দেখা । সবাই বেশ ভালোই আছো দেখছি । কিন্তু তোমাদের কুতকুতে চোখ তো আল-হিন্দে হাজার বছরে হারিয়ে গিয়ে আবার যেমনকার তেমন হয়ে গেছে । সেনর ভাস্কোর লোকেরা, বব ক্লাইভের লোকেরা কতো মেয়ের সঙ্গে শুলো, তবুও জাতটা ফর্সা হলো কই । এই যদি আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা ধর্ষণ করতে-করতে আসতো তাহলে দেখতে, তুর্কি থেকে আল-হিন্দ পর্যন্ত মানুষেরা গ্রিক দেবী-দেবতার মতন দেখতে হয়ে যেতো ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : আলেকজাণ্ডারের সাইড নিচ্ছিস যে বড়ো । সারাজীবন  সাইড-বদল আর বর পালটিয়ে তো রাজত্ব করলি । তোকে কে বলল আলেকজাণ্ডারের সৈন্যরা ধর্ষণ করতে-করতে এগোয়নি । যে-সমস্ত দেশ হয়ে আলেকজাণ্ডার আল-হিন্দ পর্যন্ত পৌঁছেছিল, সেখানকার মানুষরা কতো ফর্সা আর তাদের নাক-নকশা কেমন গ্রিক দেবী-দেবতার মতন তা দেখেছিস । বেশিরভাগ মেয়েই তো রূপসী । তুই অমন বোঁচা নাক আর গালফোলা চেহারা পেয়েছিস বলে আমাদের দুষছিস কেন !

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : আলেকজাণ্ডার কোনো দেশে গিয়ে নিজের ধর্ম চাপিয়ে দেয়নি । কুড়ি বছর বয়সে বেরিয়ে হ্যাণ্ডসাম ছেলেটা কতো দেশ জয় করে ফিরে গেল । 

বাবর : ওদের সময়ে এখনকার মতন ধর্ম ছিল না, তাই চাপাবার মতন কিছুই ছিল না । তুইও তো নিজের ধর্ম পালটালি রাজনৈতিক প্যাঁচ কষবি বলে । তুই ছিলি নাচনেওয়ালি ফরজানা জেব উন নিসা, কাশ্মিরি রক্ষিতার মেয়ে, রাস্তায় রাস্তায় নাচতিস দুজনে । তা থেকে হয়ে গেলি  পেশাদার প্রশিক্ষিত ভাড়াটে সেনাবাহিনীর প্রধান, তোর জার্মান লিভটুগেদার বুড়ো বয়ফ্রেণ্ড ওয়াল্টার রেইনহার্ট সোম্ব্রের কাছে  শিখে। বাংলার নবাব তোর বুড়ো বরকে হুকুম দিলে কিছু ইংরেজকে খেতে ডেকে তাদের খতম করে দিতে । সেকাজ করে তোর বুড়ো বর নাম ভাঁড়িয়ে পালালো লখনউ, অবধের নবাবের চাকরিতে । তোর বুড়ো বরের আগেই একটা আল-হিন্দের বউ আর ছেলে ছিল । তোর বুড়ো বর যোগ দিলো মোগল শাহ আলমের সঙ্গে আর পেয়ে গেল মিরাটের কাছে সরধনার জাগির । সে যখন পটল তুললো তার পুরো সম্পত্তি, ভাড়াটে সেনার দল পেয়ে গেলি আর পাকড়াও করলি কম বয়সী এক ফরাসি ছোকরাকে । ধর্ম পালটালি কেননা ব্রিটিশ অফিসারদের সঙ্গে সেক্স করতে তোর অসুবিধে হচ্ছিল । তুই আঁচ করেছিলিস যে ব্রিটিশরা এবার সিংহাসনে বসতে চলেছে । ব্রিটিশ চিত্রকরদের দিয়ে নিজের ছবি আঁকালি, পাগড়ি পরে, হাতে গড়গড়া নিয়ে, বেগম সমরু ।

জোয়ানা নোবিলিস সম্ব্রে : নাচনেওয়ালি বলো বা বেগম সমরু বলো বা রক্ষিতার মেয়ে বলো। নেমন্তন্ন করে ডেকে পাঠিয়ে যতো ইচ্ছে অপমান করে নাও । মনে রেখো, আমি যে চার্চ তৈরি করিয়েছি, তা আজও বহাল আছে । ক্রিস্টানরা রোববার দিন জমায়েত হয়  । যেদিন মরেছিলুম, ইংরেজরা মিলিটারি স্যালিউট দিয়েছিল । তোমাদের তো ঝাড়েবংশে নিকেশ করে দিয়েছে, শেষ বংশধরকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছে । চললুম । আমার কবর এদেশেই। এখনও খ্রিস্টানরা ফুলের তোড়া রেখে যায় ।

ভাইপো আকবর : যা, যা । নিজের জাগিরের কবরে গিয়ে শুয়ে থাক । শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও?

চেঙ্গিজ খান : মিছিমিছি চটিয়ে তাড়িয়ে দিলি মেয়েটাকে । একটু গল্পগুজব করা যেতো । 

ভাস্কো দা গামা : আপনাদের দেখছি মরবার পরও মোগলাই তেজ যায়নি । 

গুলবদনপিসি : সেনর ভাস্কো, আপনি দাবি করেন যে আল-হিন্দ আবিষ্কার করেছিলেন, পর্তুগিজরা গোয়া দখল করেছিল, কিন্তু আপনি হের্নান কোর্তেস, ভেলী দে ওয়াক্সাকার প্রথম মার্কেস-এর মতন গ্রেট এক্সপ্লোরার দখলদার হতে পারেননি । হের্নান কোর্তেস ছিলেন একজন স্পেনীয় দখলদার, যিনি ষোড়শ শতাব্দীতে একটি অভিযানের নেতৃত্ব দেন যার ফলে উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত এজটেক সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং বর্তমান মেক্সিকোর বিশাল অঞ্চলগুলো স্পেনের ক্যাস্টিল রাজ্যের অধীনে আসে। ওনার খুড়তুতো ভাই  ফ্রান্সিসকো পিসার্‌রো, যিনি পরবর্তীকালে দক্ষিণ আমেরিকা মহাদেশের পশ্চিমে অবস্থিত ইনকা সাম্রাজ্য দখল করেছিলেন। কোর্তেস উত্তর আমেরিকা মহাদেশের দক্ষিণে অবস্থিত আজটেক সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্থানীয় অন্যান্য দেশজ জাতির সঙ্গে মিত্রতা স্থাপন করে বাজি মাৎ করেছিলেন। কোর্তেস  দেশজ আমেরিকানদের সঙ্গে তাদের স্থানীয় ভাষা, কেচুয়া ভাষায় যোগাযোগ করার জন্য সেখানকার ডোনা মারিনা  নামের একজন মহিলার সঙ্গে লিভটুগেদার করতেন আর সাহায্য নিতেন। ডোনা মারিনা পরবর্তীকালে কোর্তেসের এক ছেলের মা হন । আপনারা তো এদেশের রাজা-বাদশাদের ভয়ে কিছুই করতে পারেননি । এমনকি পর্তুগিজদের বলেছিলেন গোয়ার মেয়েদের সঙ্গে যেন লিভটুগেদার না করে । ঠিক কি না, বলুন ?

ল্যাঙড়া তৈমুর : মোগলাই নয় সেনর ; বলুন তৈমুরি । আরেক রাউন্ড কফির অর্ডার দিই, কী বলিস গুলবদন ?

গুলবদনপিসি  : আমি তো হজ করে ফিরে টায়ার্ড হয়ে গেছি । এই ভাস্কোর লোকেরা সুরাটে আমাদের দলটাকে একবছর আটকে সময় নষ্ট করালো ; ওরা যাওয়া-আসার সামুদ্রিক ভিসা দিতে অনেক সময় নিয়েছিল । ওরা জাহাজ ভরে-ভরে কাকের মতন পোশাকে আর কালো টুপি-পরা  পাদ্রিদের এনেছে । সঙ্গে এনেছে শুয়োরের টাটকা মাংস, আগুনের ধোঁয়ায় সেঁকা মাংস, সসেজ নামের লম্বাটে কিমা, শুকনো মাছ, নানারকম মদ, অলিভ তেল, শুকনো মাখন, পাকা ডুমুর, নানারকমের ফল । জ্যান্ত মুর্গি, ভেড়া, টার্কি, হাঁস, খরগোশ, জ্যাম, জেলিও এনেছে এদেশে খাবে বলে । ওদের জাহাজে বড়ো-বড়ো কামান । আসলে মোগলদেরও নৌবহর থাকা উচিত ছিল । বাবরের সময় থেকে তোমরা শুধু পাহাড় মরুভূমি সমতলভূমি দখলের ধান্দায় সমুদ্রের কথা ভুলে গেলে । আওরঙজেব বিষয়টা নিয়ে ভাবতে পারতো, ও তো সমুদ্রের ধারেকাছেই কতোদিন রইলো ।

চেঙ্গিজ খান : আরে আওরঙজেবের কথা ছাড় । মারাঠাদের পোঁদে লেগে জীবন নষ্ট করল, মোগল সাম্রাজ্যেরও বারোটা বাজিয়ে দিলে । তোর হজের গল্প কর বরং । বাহান্ন বছর বয়সে গেলি, ছয়-সাত বছর ধরে কতো ঘোরাঘুরি করলি, চাড্ডিখানি কথা নয় ।

গুলবদনপিসি  : আমার আগে বেগা বেগম হজ করেছিলেন, ওনার কাছে খুঁটিনাটি জেনে নিয়েছিলুম । সুরাট বন্দরের কর্তা কুলিজ খান আন্দিজানি ছিল আমাদের সঙ্গে সব সময় । তাছাড়া সালিমা সুলতান বেগম, হিন্দলের বিধবা বউ সুলতানম, হাজি বেগম, গুলজার বেগম, উম কুলসুম, সলিমা খানুমকেও সঙ্গে নিয়ে গিয়েছিলুম। চাকরানিরাও ছিল ।  মজার ব্যাপার হলো মৌলবাদী মৌলবীদের নির্দেশ অমান্য করে আকবর মোগল বেগমদেরও  হজ করতে পাঠিয়েছে । নানা দেশ থেকে লোক আসে । অনেক দেশের বউরা চোখে কাজল লাগিয়ে আসে — ওখানে তো মুখ খোলা রাখতে হয় । পুরোনো পোশাক ফেলে দিয়ে সাদা ধবধবে পোশাক পরতে হয় । হজ সেরে গরিবদের মধ্যে টাকাকড়ি, মোহর বিলিয়ে দিলুম । যদিও শিয়াদের কাছে পবিত্র, তবু উটের ওপরে চেপে আমরা কারবালা, কোম আর মাশাদে গিয়েছিলুম । ফেরার পথে এডেনে জাহাজের দুর্ঘটনা হলো, এক বছর সেখানে কাটাতে হলো । আমাদের সঙ্গে অবশ্য মীর হজ আর খোয়াজা ইয়াহা ছিল ।

ল্যাঙড়া তৈমুর : তুই তো আশি বছর বয়সে মারা গেলি ।  বেচারা আকবর সম্রাট হলে কী হবে ! কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল আর  তোর জানাজা একাই  গোর পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল । পরের বছর হামিদা বানুও মারা গেল । আকবর দাড়ি কামিয়ে ন্যাড়া হয়ে গেল । 

বাহাদুর শাহ জাফর : তোমরা নিজেদের নিয়ে মশগুল রয়েছো । আমার বংশধররা আজ কে কোথায় আছে জানো? আমাকে  রেঙ্গুনে নির্বাসনের মধ্যে দিয়ে ব্রিটিশরা মুঘল সাম্রাজ্যর চারশো বছরের শাসনের ইতি ঘটিয়েছিল। আমার  কয়েকজন ছেলেকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ফলে পরিবারের অনেকজন জীবন বাঁচাতে বর্তমান পশ্চিমবঙ্গ, হায়দ্রাবাদ, উদয়পুরে পালিয়ে গিয়েছিল । পরবর্তীতে অনেকেই নিজেদেরকে মুঘল বংশধর বলে দাবি করে। তবে বর্তমানে কয়েকজন মুঘল বংশধরের খোঁজ পাওয়া যায়  যারা আল-হিন্দের বিভিন্ন জায়গায় করুণ অবস্থায় বেঁচে আছে। দিন এনে দিন খেয়ে জীবন পার করছে। সরকারের দেয়া সামান্য ভাতা দিয়ে সংসার চালাতে প্রতি মুহূর্তে হিমশিম খেতে হচ্ছে। যেমন সুলতানা বেগম, যিনি মুঘল সাম্রাজ্যের শেষ নবাব বাহাদুর শাহ জাফরের নাতবৌ। সুলাতানার স্বামী মির্জা বেদের বুকত ১৯৮০ সালে মারা যান। এরপর থেকেই তার জীবনে দারিদ্র্য নেমে আসে। সুলতানা সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ভাতা হিসেবে পায় ছয় হাজার টাকা। যা দিয়ে ছয় ছেলেমেয়েসহ পুরো সংসার চালাতে হয় তাকে। বর্তমানে কলকাতার বস্তি এলাকায় বসবাস করেন তিনি। দুই রুমের একটি ছোট্ট বাসায় পুরো পরিবার নিয়ে থাকছেন তিনি। প্রতিবেশীদের সঙ্গে মিলিতভাবে রান্নাঘর ব্যবহার করেন। রাস্তার কল থেকে জল ভরতে হয়, সেখানে কাপড় ধুতে হয়। তারপর জিয়াউদ্দিন তুসি, যিনি বাহাদুর শাহ জাফরের উত্তরাধিকারী বর্তমানে ভাড়া বাড়িতে থাকেন । উনি আর সরকারি ভাতা পান না । তারপর বেগম লায়লা উমাহানি, যাঁর বাবা মির্জা পিয়েরে ছিলেন বাহাদুর শাহ জাফরের নাতি। তিনি এবং তার মা হাবিব বেগম হায়দ্রাবাদের ষষ্ঠ নিজাম মেহবুব আলী খান এর আত্মীয়।  স্বামী ইয়াকুব মঈনউদ্দিন তুসি। পঁচিশটা পরিবহন রিকশা ভাড়া থেকে তাদের সংসার চলে। তবে এটাই বাস্তবতা।

আলিবর্দী খান : আমার বংশধররা তো আর আল-হিন্দে থাকে না । লোকে তাদের খবর রাখে না । তারাও আমার বা সিরাজের সঙ্গে সম্পর্কের কথা গোপন রেখে জীবন কাটায় । ঢাকা শহরের একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে থাকেন নবাব সিরাজ উদ-দৌলার নবম বংশধরেরা। বর্তমানে তারা ঢাকা শহরের খিলক্ষেত এলাকার লেকসিটি কনকর্ড-এর বৈকালী টাওয়ারে বসবাস করছেন। লোকচক্ষুর আড়ালে, নীরবে নিভৃতে বাস করা বাংলার শেষ স্বাধীন নবাবের বংশধরদের খবর অনেকেই জানেন না।  শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছিল।  সিরাজ উদ-দৌলার মৃত্যুর পর তার প্রিয়তমা স্ত্রী লুত্‍ফুননিসা একমাত্র শিশু কন্যা উম্মে জোহরা, নানা আলীবর্দী খানের স্ত্রী আশরাফুন্নেসা-সহ নবাব পরিবারের নারীদের ৮ বছর বন্দি করে রাখা হয়েছিল বুড়িগঙ্গা পাড়ের জিঞ্জিরা এলাকার একটি প্রাসাদে। স্থানীয় লোকজন ওই জরাজীর্ণ প্রাসাদটিকে এখনও জানে ‘নাগরা’ নামে। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার মৃত্যুর পর থেকে তার ৫ম বংশধর পর্যন্ত কাউকে সরকারি কোনো চাকরি দেয়নি ব্রিটিশ সরকার । দেশভাগের সময়ে সপ্তম বংশধর সৈয়দ গোলাম মুর্তজা  মুর্শিদাবাদ থেকে পূর্ব বাংলায় চলে যান। প্রথমে যান রাজশাহীতে, রাজশাহী থেকে খুলনা শহরে একটি বাড়ি কিনে স্থায়ী হন। এখনও এক ধরনের অজানা আতঙ্ক তাদের মাঝে। সম্ভবত সে আতঙ্ক থেকেই প্রচারবিমুখ হয়ে আছেন তারা। মিডিয়াকে এড়িয়ে চলেন, সমাজে নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে রাখেন।

টিপু সুলতান : আমার বংশধরদেরও একই অবস্হা । আমার পরবর্তী সপ্তম প্রজন্মের উত্তরসূরী  সংসার চালাতে রিকশা চালায়। স্ত্রী সন্তানদের মুখে ভাত তুলে দিতে প্রিন্স আনোয়ার শাহ রোডের উপরে রিক্সার প্যাডেলে চাপ দেয় বেচারা। ভাগ্যের পরিহাসে এই রাস্তা যাঁর নামে‚ সেই প্রিন্স গুলাম মহম্মদ আনোয়ার শাহ ছিলেন তার প্রপিতামহ। আনোয়ার আলি-র বাকি ভাইরাও কেউ রিক্সা চালায়। কেউ সেলাইয়ের কাজ করে। কেউ ছোট কারবার চালায়। সবাই থাকে ঘিঞ্জি বস্তির ঘুপচি কামরায়। এঁদো পরিবেশ বসে ভাবে একদিন যাবেন মহীশূর। যেখানে একদিন সূর্যের আলোয় ঝকঝকিয়ে উঠত টিপু সুলতানের তরবারি। অথচ কলকাতাতেই রাজার হালে থাকার কথা তাদের। কারণ এই শহরে বিস্তর সম্পত্তি ছিল টিপু সুলতানের। আজকের রয়াল ক্যালকাটা গল্ফ ক্লাব‚ টালিগঞ্জ ক্লাব, সব ছিল মহীশূরের সুলতান টিপুর। কিন্তু এখন তার দেখভালের দায়িত্ব প্রিন্স গুলাম মহম্মদ ট্রাস্টের। নামমাত্র ভাড়ায় লিজ নিয়ে রেখেছে গল্ফ ক্লাব আর টালিগঞ্জ ক্লাব। এছাড়াও আজকের পার্ক স্ট্রিট‚ চৌরঙ্গি‚ থিয়েটার রোড আর দক্ষিণ কলকাতার বিস্তীর্ণ চাষ জমির মালিক ছিলেন টিপু সুলতান। কিন্তু তাঁর বংশধররা বঞ্চিতই থেকে গেছে। কলকাতায় টিপু সুলতানের বংশধররা সবাই যে দিন আনা দিন খাওয়া অবস্থায় আছে তা নয়। কেউ কেউ মধ্যবিত্ত জীবনও যাপন করছে। কিন্তু কারওর জীবনেই ‘রয়্যাল‘ শব্দটার ছিটেফোঁটাও নেই। অথচ ভারতে এখনও রাজবংশের উত্তরসূরীরা আছেন‚ যাঁরা‚ রাজত্ব চলে গেলেও প্রাসাদে আছেন। রাজার হালেই নবাবি করছেন। তফাৎটা হল‚ যাঁরা ব্রিটিশদের সঙ্গে আপস করে মাথা নুইয়েছিলেন ‚তাঁরা টিকে গেছেন। কিন্তু যাঁরা ব্রিটিশ শাসনের প্রতিবাদ করেছিলেন তাঁদের গরিমা ধুলোয় মিশে গেছে।

কফিহাউসের যক্ষ : আচ্ছা স্যার, এতো জায়গা থাকতে আপনাদের কলকাতাতেই কেন এনে ফেলল ?

টিপু সুলতান : কলকাতা ওদের রাজধানী ছিল আর ওরা জানতো যে বাঙালিরা ওদের সঙ্গে আছে, বিদ্রোহে যোগ দিচ্ছে না । ওয়াজেদ আলি শাহকে যখন এনেছিল, তখনই বিদ্রোহ শুরু হয়ে গেল । ওকে প্রথমে কয়েদ করে রেখেছিল । তারপর থাকার জন্যে এতো ভালো ব্যবস্হা করে দিলে যে ও এখানে ছোটোখাটো লখনউ বসিয়ে ফেললো । ওয়াজেদ আলির  প্রচারিত ও পৃষ্ঠপোষক লেখক এবং কবি ও মুশায়রা, গজল, মার্সিয়া, আর কাওয়ালি বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওনার   পরীখানায় বা  নৃত্যশিল্পীদের বাসায় নিয়মিত কথক নাচের অনুষ্ঠান হতো। মেটিয়াবুরুজের গানবাজনার আসর থেকে উপকৃত হয়েছেন স্থানীয় শিল্পীরা,  পাথুরিয়াঘাট ঠাকুর পরিবারের রাজা সৌরিন্দ্রমোহন ঠাকুর, আর পণ্ডিত যদুভট্টের মতো সেই যুগের গুণী শিল্পীরা ছিলেন। বাংলার জমিদারবাবুরা প্রথমবার এসব দেখে নিজেদের জলসাঘর  তৈরি করেছিল যেখানে নিয়মিত ঠুমরি বা কথকের অনুষ্ঠান হতো। ধনী বাঙালিরা শিল্পীদের পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ানোর পাশাপাশি  কেবল মেটিয়াবুরুজেই  নয়, সারা শহর জুড়ে কয়েকশো বাইজির কোঠা বসিয়ে ফেলেছিল। তারপর ওয়াজেদ আলির দেখাদেখি বাগানবাড়িতে রাখেল রাখার চল হল, হারেমের মতন, মদ খাওয়া, মোসাহেবদের জড়ো করে মদ আর আফিমের আড্ডা । 

কফিহাউসের যক্ষ : বাঙালিরা শুধু বাইজি নাচালো ? বিদ্রোহে অংশ নিলো না ?

বাহাদুরশাহ জাফর : বাংলাদেশের অধিকাংশ সমকালীন বুদ্ধিজীবীই সিপাহি বিদ্রোহকে সমর্থন করেননি, অংশ নেয়া তো দূরের কথা।  বাংলাসাহিত্যে এ নিয়ে কোনো আবেগ, গান, কবিতা, নাটক—কিছুই তৈরি হয়নি। এমনকি, যখন হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীনচন্দ্র সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায় পলাশীর যুদ্ধ নিয়ে, সিরাজউদ্দৌল্লার পরাজয় নিয়ে কাব্য নাটক লিখছেন, তখনও হয়নি। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামেরও কোনো কবিতা বা গান নেই সিপাহি বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে। বিদ্রোহকে সেই সময়ের শিক্ষিত বাঙালি সমাজ সমর্থন করেনি; উপরন্তু তারা বিদ্রোহী সিপাহিদের ও বিদ্রোহের সঙ্গে যুক্ত নেতানেত্রীদের ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেছিল। শিক্ষিত বাঙালি সমাজ এই বিদ্রোহে বিদ্রোহীদের পরাজয় ও ব্রিটিশদের জয় কামনা করেছিল।

কফিহাউসের যক্ষ : বাঙালিরা কেন সমর্থন করেনি জনাব ?

আলিবর্দী খান : শিক্ষিত বাঙালি সমাজ বিভিন্ন কারণে সিপাহি বিদ্রোহের বিরোধিতা করেছিল।  মধ্যযুগীশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠার ভয়ে শিক্ষিত বাঙালি সমাজ মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়লাভ করলে ভারতে আবার মধ্যযুগীয় মোগল শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। তারা মধ্যযুগীয় মোগল শাসনের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন।শিক্ষিত বাঙালি সমাজ ছিল আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের সমর্থক। তারা মনে করেছিল বিদ্রোহীরা জয়ী হলে তাদের সামন্ততান্ত্রিক শাসনে আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কারের অবসান ঘটবে। আধুনিকতার অবসানের ভয়েও তারা সমর্থন করেননি । বিদ্রোহের প্রতি বাঙালি সমাজ সেই সময়ের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় তীব্র বিদ্বেষ প্রকাশ করে। বিদ্রোহ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের নিয়ে একটি সভা হয়। সভায় বিদ্রোহীদের নিন্দা করা হয়। রাজা রাধাকান্ত দেবের সভাপতিত্বে বিদ্রোহ-বিরোধী আরও একটা সভা হয় মেট্রোপলিটন কলেজে । এই সভায় উপস্থিত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ হলেন কালীপ্রসন্ন সিংহ, কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, হরচন্দ্র ঘোষ প্রমুখ। তারা সরকারকে সবরকম সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সভায় প্রস্তাব পাস করেন আর সরকারের কাছে তা পেশ করেন। সংবাদ ভাস্কর, সংবাদ প্রভাকর আর নানা পত্রপত্রিকায় শিক্ষিত বাঙালি সমাজবিদ্রোহীদের তীব্র বিরোধিতা করেছিল। সংবাদ প্রভাকর পত্রিকার সম্পাদকের সিপাহি বিদ্রোহের নেতৃবৃন্দ নানাসাহেব, লক্ষ্মীবাঈ সম্পর্কে বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা ছিল না। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় লিখেছিলেন যে, ‘হে বিঘ্ন হর….. ব্রিটিশ গভর্নমেন্টের জয়পতাকা চিরকাল সমভাবে উড্ডীয়মান কর। অত্যাচারি অপকারি বিদ্রোহকারি দুর্জনদিগকে সমুচিত প্রতিফল প্রদান কর। ” এছাড়াও বিভিন্ন গ্রন্থ সমূহেও বাঙালি মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় নানাভাবে বিরোধিতা করেছিল।

গুলবদনপিসি : শুধু বাঙালিদের দোষ দেয়া কেন, অযথা ? যে সব সামন্তদের স্বার্থে ঘা পড়েনি, যেমন সিন্ধিয়া, গায়কোয়াড়, হোলকার প্রমুখ মারাঠি সর্দাররা, হায়াদ্রাবাদের নিজাম, মহীশূর আর ত্রিবাঙ্কুরের রাজারা, রাজপুতরা, মায় ঝিন্দ আর পাতিয়ালার শিখ সর্দাররা,  তাঁরা বিদ্রোহে সাড়া তো দেনইনি বরং এটা দমন করতে ব্রিটিশদের সাহায্য করেছিলেন পুরো দমে। 

কফিহাউসের যক্ষ : কিন্তু বেগম, মহাবিদ্রোহ শুরু হয়েছিল সুবে বাংলার ব্যারাকপুর থেকে ।

বাহাদুর শাহ জাফর : বিদ্রোহ তো শুরু হয়েছিল ব্যারাকপুর থেকেই। দক্ষিণে মহারাষ্ট্রে সাতারা, কোলাপুর, নারগুন্ড, মাদ্রাজের বিক্ষিপ্ত কিছু অঞ্চলে এর স্ফুলিংগ দেখা দিয়েছিল। শুধু অগ্নিশিখা হয়নি বলেই তাকে খারিজ করা হবে ?  তখন সেই সুদূর নিউ ইয়র্ক ডেইলি ট্রিবিউনে কার্ল মার্কস স্বয়ং একে ভারতবাসীর জাতীয় সংগ্রাম বলতে পারলেন, আর আমাদের নিজেদের দেশের ঐতিহাসিকদের এই গৌরবময় ঐতিহ্য মানতে এতো কুন্ঠা কিসের ? 

গুলবদনপিসি : বেয়ারা দুটো বর্শা নিয়ে আসছে, তাতে এক-একজনের মাথা গেঁথা, মুখে লাল রঙ মাখানো । এটা আবার কী রে বাবা !

কফিহাউসের যক্ষ : ম্যাডাম বেগম, এনারা এইভাবেই কফিহাউসে ঢুকছিলেন । আমি ভাবলুম হেল্প করি । 

ভাইপো আকবর : মাথা দুটো খুলে টেবিলের ওপর রাখো আর বর্শাগুলো চেয়ারে ঠেশান দিয়ে রাখো, ওনারা যখন যেতে চাইবেন, তখন বর্শার মাথায় পরিয়ে দেবো । আপনাদের নামটা জানতে পারি ? শ্যায়খুবাবা এলো না এখনও ।

প্রথম মাথা : আমিও একজন গুরকানি । কন্নড় ভাষায় জামাই বা গুরকানিকে বলে আলিয়া । আমি আলিয়া রাম রায়া নামে পরিচিত । বিজয়নগর সাম্রাজ্য আমার ভুলে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল । 

চেঙ্গিজ খান : আপনার ভুলে ? কী হয়েছিল ? গুরকানিরা তো সহজে ভুল করে না ।

দ্বিতীয় মাথা : মাথা তো আমারও কেটেছিল ; নিজের বিশ্বস্ত লোকে । আপনার মাথা যারা কেটেছিল তারা আপনাকে বোকা বানিয়ে কেটেছিল আলিয়া রাম রায়া । আমার শত্রুরা নামে কুকথা রটিয়েছিল । ইংরেজগুলো আমার প্যাঁদানি খেয়ে অন্ধকূপ হত্যা নামে একটা গাঁজাখুরি গল্প চাউর করেছিল । যা নাকি  সেনা হত্যাকাণ্ড, যা ব্রিটিশ আমলে সংঘটিত হয়েছিল । গল্পটা হল এই যে  ব্রিটিশ সরকারের গড়া ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের ভেতরে জানালাবিহীন ছোট্ট একটি কামরায় একশো ছেচল্লিশজন ইংরেজকে বন্দী করে রেখেছিলুম । সেখানে দমবন্ধ হয়ে এক রাতের মধ্যে একশো তেইশ জনের মৃত্যু ঘটে । এই গপ্পোটা গেঁজিয়েছিল ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মচারী, পরবর্তীতে সেনাপতি, জন যেফানিয়াহ হলওয়েল, ওর বই ইন্ডিয়া ফ্যাক্টস্‌এ। মরে যাওয়া সাহেবদের স্মরণে দুর্গের পুবদিকের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করেছিল, যা লর্ড হেস্টিংস ঘটনাটা গাঁজাখুরি জেনে ভেঙ্গে ফেলে। আমাকে  হেয় প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্য নিয়েই  এই কাহিনী লেখা ও প্রচারিত হয়েছিল । সেই সময়ের ইতিহাসে এই ঘটনার  কোনও উল্লেখ দেখা যায় নি। পরবর্তীতে ব্রিটিশ ঐতিহাসিকদের অনেকেই আমাকে নির্দয়, উদ্ধত, স্বেচ্ছাচারী প্রতিপন্ন করতে যাচাই না-করেই হলওয়েল সাহেবের গাঁজাখুরি গল্পটা বলে আর লিখে বেড়িয়েছে ।

প্রথম মাথা : আমি হতে চেয়েছিলুম দাক্ষিণাত্যের জালালুদ্দিন মুহম্মদ আকবর । সব ধর্মকে একই দৃষ্টিতে দেখতুম ।

ভাইপো আকবর : বাহ, ভালো কাজ করেছিলে । তাতে তো দোষের কিছু নেই । শ্যায়খুবাবা এলো না?

প্রথম মাথা :আমি ছিলুম বিজয়নগর সাম্রাজ্যের সেনাপতি আর  রাজবংশের প্রতি বিশ্বস্ত   । রাজা সদাশিব রায়ের বয়স কম ছিল বলে আমিই রাজ্য চালাতুম ।  দাক্ষিণাত্যের হুসেন নিজাম শাহ, আলী আদিল শাহ আর ইব্রাহিম কুতুব শাহ সুলতানরা একসঙ্গে আক্রমণে আমাকে হারিয়ে দিলো । সহজেই জিতে যেতুম । তার বদলে যুদ্ধটা হয়ে উঠল  বিপর্যয় । আমার সেনাবাহিনীর দুই আস্তিক কমান্ডার  বিশ্বাসঘাতকতা করল, আর দল বদল করে সেনাদের নিয়ে সুলতানদের দিকে চলে গেল । এর ফলে আমাকে ওরা আচমকা গ্রেফতার করে সেখানেই মুণ্ডু কেটে ফেললো। আমার কাটা মাথা তালিকোটার যুদ্ধের বার্ষিকীতে আহমেদনগরের পথে-পথে মিছিল করে পাবলিককে দেখানো হয়েছিল। সুলতানদের বংশধররা মুণ্ডুতে তেল আর লাল রঙ মাখিয়ে বর্শার মাথায় গিঁথে রেখে দিয়েছিল । ওরা পুরো বিজয়নগরকে ধ্বংস করে মাটিতে মিশিয়ে দিলো আর প্রত্যেকটা বন্দীকে কচুকাটা করে খুন করেছিল । বিজয়নগর, যা ছিল একসময়  বিখ্যাত ঐশ্বর্যের শহর,  বিশাল সাম্রাজ্যের আসন, তা  নির্জন ধ্বংসাবশেষ হয়ে ওঠেছে । জায়গাটা  এখন সামান্য শহরতলী, হাম্পি নামে পরিচিত।

গুলবদনপিসি : তোমার উচিত ছিল ওদের পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করে এনে নিজের পরিবারের সদস্য করা ; যেমন আকবর রাজপুত পরিবারের মেয়েদের বিয়ে করা । অটোমান সাম্রাজ্যের সুলতানদের বেশিরভাগ মা ছিলেন রাজকীয় হারেমের উপপত্নী । তুমি যদি বংশধারা দ্যাখো, তাহলে টের পাবে । সুলতানদের সকলের মা তুর্কি ছিলেন না। যেমন, ওসমান প্রথম, তুর্কি । ওরহান, তুর্কি । মুরাদ প্রথম, গ্রীক । বায়েজিদ,  গ্রীক । আমি, তুর্কি। মুরাদ দ্বিতীয়, তুর্কি। মেহমেদ দ্বিতীয়, তুর্কি । বায়েজিদ দ্বিতীয়, তুর্কি । সেলিম , গ্রীক । সুলেমান , গ্রীক । সেলিম দ্বিতীয়, পোলিশ । মুরাদ তৃতীয়, ইতালিয়ান (ভিনিশিয়ান) । মেহমেদ তৃতীয়, ইতালিয়ান (ভিনিশিয়ান)। আহমেদ , গ্রীক । মোস্তফা প্রথম, আবখাজিয়ান । ওসমান দ্বিতীয়, গ্রীক বা সার্বিয়ান । মুরাদ চতুর্থ, গ্রীক। ইব্রাহিম, গ্রীক । মেহমেদ চতুর্থ, ইউক্রেনীয় ।দ্বিতীয় সুলেমান, সার্বিয়ান । আহমেদ দ্বিতীয়, পোলিশ । মোস্তফা দ্বিতীয়, গ্রীক । আহমেদ তৃতীয়, গ্রীক । মাহমুদ প্রথম, গ্রীক । ওসমান তৃতীয়, সার্বিয়ান । মোস্তফা তৃতীয়, ফরাসি। আব্দুলহামিদ প্রথম, হাঙ্গেরীয় । সেলিম তৃতীয়, জর্জিয়ান । মোস্তফা চতুর্থ, বুলগেরিয়ান । মাহমুদ দ্বিতীয়, জর্জিয়ান । আব্দুলমিসিড প্রথম, জর্জিয়ান বা রাশিয়ান । আব্দুলাজিজ প্রথম, রোমানিয়ান । মুরাদ পঞ্চম, জর্জিয়ান । আব্দুল হামিদ দ্বিতীয়, আর্মেনিয়ান বা রাশিয়ান । মেহমেদ পঞ্চম, আলবেনীয় । মেহমেদ ষষ্ঠ, জর্জিয়ান ।

দ্বিতীয় মাথা : তুমি বিয়ে করো বা যাই করো, যারা শত্রুতা করবে বলে প্যাঁচ কষে ফেলেছে, তারা সুযোগ পেলে তোমাকে ছাড়বে না । আমার সমাজে বিয়ে জন্ম-জন্মান্তরের সম্পর্ক নয় ; তা একটা জন্মের চুক্তি । আমাকে অনেকে বদনাম করে, অথচ ইতিহাসের খোঁয়াড়ে দুর্লভ রায়, জগত শেঠ, উমি চাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র রায়দের কেন ঘেরাও করা হয়নি? আমার আত্মীয়রা হারিয়ে গেল ! এদের বংশধররা কোথায় লুকিয়ে আছে ? কৃষ্ণচন্দ্র রায় ছিলেন একজন কূটকৌশলী ব্যক্তি। নবাব সিরাজউদ্দৌলা ইংরেজদের সাথে সংঘাতে লিপ্ত হলে তিনি ইংরেজদের পক্ষ অবলম্বন করেন।  মীর কাশিম ওনাকে  বন্দী করলেও ইংরেজদের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি লাভ করেন। কোম্পানি সরকার তার আনুগত্যের জন্য মহারাজা উপাধিতে ভূষিত করেন । কোম্পানিকে তেল দিয়ে হয়ে গেল মহারাজা । তাঁর শাসনকালে বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলমান রাজত্বের অবসান ঘটে। এ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে তিনি ইংরেজদের সঙ্গে মিত্রতা করেন এবং ক্লাইভের পক্ষ নিয়ে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতন ত্বরান্বিত করেন। ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষের সময় নবাব  মীর কাশিম তাঁকে বন্দি করে মৃত্যুদন্ড দিলে ইংরেজদের সহায়তায় তিনি মুক্তিলাভ করেন। ইংরেজদের প্রতি পক্ষপাতিত্বের পুরস্কারস্বরূপ তিনি ইংরেজ কর্তৃক ‘মহারাজা’ উপাধিতে ভূষিত হন। তদুপরি ক্লাইভের নিকট থেকে উপঢৌকন হিসেবে পান পাঁচটি কামান। সে সময়ে বাংলায় যে বর্গীর আক্রমণ হতো তা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তিনি তাঁর রাজধানী ‘শিবনিবাস’ নামক স্থানে স্থানান্তরিত করেন। ওনার পূর্বপুরুষ নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন।  ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন। নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন।  ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন। ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন।নদিয়া রাজবংশের আদি পুরুষ ভবানন্দ মজুমদার তিনি এই রাজবংশের সূচনা করেন। তাঁর বংশধররা ‘রাজা’ উপাধি ধারণ করে ব্রিটিশ শাসনের প্রতিষ্ঠাকাল পর্যন্ত নদিয়া শাসন করেন। জানা যায়, ভবানন্দ প্রতাপাদিত্যের (বারো ভুইঞাদের অন্যতম) রাজধানীতে প্রবেশের গুপ্ত পথ দেখিয়ে এবং প্রয়োজনীয় রসদ দিয়ে তিনি দিল্লির শাসক জাহাঙ্গীরের সেনাপতি মানসিংহকে সাহায্য করেছিলেন; তাই জাহাঙ্গীর তাঁর এই কাজে খুশি হয়ে ১৬০৬ খ্রিস্টাব্দে ফরমান জারি করে ভবানন্দকে মহৎপুর, নদিয়া, মারূপদহ, লেপা, সুলতানপুর, কাশিমপুর, বয়শা, মশুণ্ডা প্রভৃতি ১৪ টি পরগনা সনদসূত্রে দেন। ১৬০৮ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন বাংলার নবাব ইসমাইল খাঁ ভবানন্দের বুদ্ধি ও বিচক্ষণতার স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে কানুনগো পদে নিযুক্ত করেন এবং সম্রাট জাহাঙ্গীরের কাছ থেকে তাঁর জন্য সনদ ও মজুমদার উপাধি এনে দেন । ১৬৩১ সালে ভবানন্দ সম্রাটের কাছ থেকে ফরমানের মাধ্যমে বৃহৎ জমিদারি লাভ করেন।

গুলবদনপিসি : কীই বা বলি বলো ! সবই সুবে বাংলার কপাল । 

দ্বিতীয় মাথা : তোমরা কি জানো এক সময় বাংলায় ছড়ি ঘুরিয়েছে বাঈজি বংশ ? আমার পরে তো সুবে বাংলায় শুরু হয়-বাঈজী বংশের শাসন। মীরজাফরের ঔরসজাত এবং বাঈজী মুন্নী বাঈর গর্ভজাত নজমউদ্দৌলাকে কোম্পানী বাংলার নবাব বানায়। বাঈজী বংশের দ্বিতীয় নবাব হন মুন্নী বাঈর অপর সন্তান সাইফউদ্দৌলা। বাঈজী বাবুবাঈও ভাগ্যবতী রমণী ছিলেন। সুবে বাংলায় পরবর্তী নবাব হন বাবুবাঈর গর্ভজাত সন্তান মোবারকউদ্দৌলা । পরে তারই ছেলে আর নাতিরা ধারাবাহিকভাবে বাংলার পুতুল নবাব হন।

কফিহাউসের যক্ষ : স্যার সুবে বাংলা নিয়ে একটা কথা আমার মাথাতেও ঘুরঘুর করে, যদি অনুমতি দ্যান তো বলি ।

চেঙ্গিজ খান : অনুমতির দরকার নেই । যার যা মনে আসে সেসব কথা বলার জন্যই তো আজকের জমায়েত ।

কফিহাউসের যক্ষ : বাংলার ইতিহাস নিয়ে আলোচনা করতে বসলেই অধিকাংশ তথাকথিত প্রাজ্ঞজনের নজরে কেবল ঘোরাফেরা করেন শ্রী অরবিন্দ, চিত্তরঞ্জন দাশ, কিংবা আশুতোষ মুখার্জির মতন রাজনৈতিক চরিত্র। কিংবা রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর মশাইয়ের মতন সমাজ সংস্কারকদের কথা বলেন কেউ কেউ। সাহিত্যের আলোচনা হলে উঠে আসেন মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল কিংবা শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। সব ঠিকই আছে। কিন্তু ইতিহাস তো একচোখো বিষয় নয়। বাংলার স্বর্ণযুগের ইতিহাসে যাদের উপস্থিতি নিয়ে কেউ কখনও কথা বলেন না অথচ আজও যাদের নিয়ে বাঙালি গর্ব বোধ করে তাদের একজন যেমন ডক্টর বর্মণ, যাঁর নামে ডাবর কোম্পানি, ঠিক তেমনি এই মহেন্দ্র দত্ত। বিখ্যাত এই ছাতা নির্মাতার কথা অবশ্য আপনি বাঙালির বাজার লব্ধ চরিতাভিধানে পাবেন না। গুগলে খুঁজতে গেলে উঠে আসবেন প্রকাশক মহেন্দ্র দত্তের কথা, কিংবা বিপ্লবী মহেন্দ্র দত্তের নাটকীয় কর্মসূচি, আর পাবেন স্বামী বিবেকানন্দের ভাই মহেন্দ্র দত্তের উল্লেখ। কিন্তু ছাতা নির্মাতা মহেন্দ্র দত্ত খুঁজলে আপনার সামনে ভেসে উঠবে গুগল ম্যাপ। 

ল্যাঙড়া তৈমুর : হক কথা । কিন্তু আমরা আক্রমণ করতে বেরিয়ে ছাতা জিনিসটা কখনও দেখিনি । তুমি বলছ এই শহরেই পাওয়া যায় । ফিরে যাবার সময়ে দুটো কিনে নিয়ে যাবো । একটা আমার, আরেকটা আমার ঘোড়ার।

কফিহাউসের যক্ষ : আপনারা সবাই বিখ্যাত মানুষজন, দুর্ভাগ্য যে তুর্কি, ফার্সি, উজবেক, পর্তুগিজ, ফরাসি, ইংরেজি জানেন অথচ বাংলাভাষা জানেন না । আপনারা কি জানেন ? ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ খুলে মণীষী কলিম খান দেখতে পেলেন একই শব্দের অজস্র অর্থ এবং সেই শব্দের অর্থ খুঁজতে ডিক্সনারি বা থিসরাস মুখস্থ করার প্রয়োজন নেই। শব্দের মধ্যেই লুকিয়ে আছে শব্দের মানে। শব্দের বানানে যে বর্ণ বা ধ্বনিগুলি থাকে, সেগুলিই সেই শব্দের অর্থকে বহন করে। আমাদের মহাকাব্য ও বেদ-পুরাণের আপাত ধাঁধা ও জটিলতার জাল কেটে বেরোতে গিয়ে পেয়ে গেলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থ তত্ত্ব। বলা ভালো পুনরাবিষ্কার করলেন। শব্দের অন্তর থেকে শব্দের অর্থ নিষ্কাশন একটি প্রাচীন ভারতীয় কৌশল। এই কৌশলের নাম ‘নির্বচন’। কলিম খান বলেন, এই কৌশলের আদি স্রষ্টা কে, তা জানা যায় না। ভারতবর্ষের সব বিদ্যার জনক যেহেতু সনাতন শিব, এই বিদ্যার স্রষ্টাও তিনিই হবেন। কথিত আছে, ‘১৪টি শিব স্ত্রোত্র’ এবং ‘মাহেশ্বর সূত্র’ অবলম্বন করেই পাণিনি তঁর বিখ্যাত ‘অষ্টাধ্যায়ী’ ও ‘শিক্ষা’ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এই কৌশল প্রথম লিপিবদ্ধ করেন যাস্ক ও পাণিনি। কলিম খান প্রাচীন কোনও চরিত্রকে ব্যক্তিচরিত্র ধরতে নারাজ। তাঁর মতে তখনও ‘ব্যক্তি’ গড়ে ওঠেনি। ফলত, যাস্ক ও পাণিনিও তাঁর মতে কোনও ব্যক্তিবিশেষ নয়, দুইটি পৃথক গোষ্ঠী। এইযুগের ভাষায় ‘ঘরানা’ বা ‘স্কুল অফ থট’ বলা যায়। এছাড়া বৌদ্ধযুগের ‘অমরকোষ’ও এই কাজটি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে করে গেছে। শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ণয় করে সেই অভ্যন্তরস্থ অর্থটিকে বাক্যের সাহায্যেই প্রকাশ করা রীতি। পরবর্তী কোষকারগণ একই পদ্ধতি মেনেছেন। মহাত্মা হরিচরণও একই কাজ করেছেন তার ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ। কোনও ক্রিয়াই দৃশ্যমান নয়। কোনও কারক যখন সেই ক্রিয়াকে ধারণ করে, তখনই সেই ক্রিয়াকে দেখা যায়। ‘করণ’ বা ‘গমন’কে দেখা যায় না। কেউ কিছু করলে বা গমন করলেই ‘করণ’ বা ‘গমন’ দৃশ্যমান হয়। অর্থ কীভাবে শব্দের ভেতরে থাকে? কলিম খান উদাহরণ দিয়ে দেখিয়ে দিলেন। যেমন ‘কর’ শব্দ = ক্‌+অ+র্‌+অ = ‘কারককে রক্ষা করে যে’। এটি আপনার ‘হাত’ হতে পারে, দেশের রাজার চাপানো ‘খাজনা’ হতে পারে, ‘রবির কর’ও হতে পারে। যে-যে সত্তা কারককে রক্ষা করে তাদের প্রত্যেকেই ‘কর’ পদবাচ্য। ফলত, শব্দ অনড় অচল নয়, স্থির নির্দেশক কোনও মানেও তার নেই। এখানে সতর্কও করছেন কলিম। তাই বলে শব্দের অনন্ত অসীম মানেও হয় না। ক্রিয়াটির সীমার মধ্যে যে-যে পড়বে, তাদের প্রত্যেককেই সেই শব্দ দিয়ে চিহ্নিত করা যাবে। এই তত্ত্বই প্রয়োগ করে কলিম খান পড়ে ফেললেন রামায়ণ-মহাভারত-পুরাণ। তারপরেই ঘটে গেল ম্যাজিক! চিচিং ফাঁক হয়ে খুলে গেল অন্তর্নিহিত অর্থের বন্‌ধ্‌ দরওয়াজা। ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস নতুন রূপে হাজির হল।সহযাত্রী হিসেবে পেলেন শ্রীরামপুর কলেজের ইংরাজি ভাষা-সাহিত্যের অধ্যাপক রবি চক্রবর্তীকে। পত্রপত্রিকায় প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি বিপুল পরিশ্রম ও নিষ্ঠায় যৌথভাবে লিপিবদ্ধ করলেন ক্রিয়াভিত্তিক-বর্ণভিত্তিক শব্দার্থের বৃহৎ দুই খণ্ড অভিধান ‘বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ’। শুভানুধ্যায়ীদের নিয়ে তৈরি করলেন ‘বঙ্গযান’ পত্রিকা। বঙ্গীয় অ্যাকাডেমিক মহল প্রত্যশা মতোই তাঁর ভাবনাকে স্বীকৃতি জানায়নি। তাতে কী, তাঁরা তো হরিচরণকেও স্বীকৃত দেন না। হরিচরণের জন্মের সার্দ্ধশতবর্ষ নমো-নমো করে সারেন, ভুলেও ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’ অবশ্যপাঠ্য বইয়ের তালিকায় আসতে দেন না! কারন কী? হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাজ সামনে আনা মানেই বাংলা ভাষা ও বানানবিধি নিয়ে ছিনিমিনি-খেলা অনেক ‘ভাষাবিদ’-এর করেকম্মে খাওয়ার দিন শেষ হয়ে যাবে। তাছাড়া অ্যাকাডেমি-নিয়ন্ত্রক পুঁজি একই শব্দের বহু অর্থ স্বীকার করবে কেন? বাজার সবসময়ই একরৈখিকতার পক্ষে। শব্দের বহুরৈখিকতা তাই স্বীকার্য নয়। হরিচরণ তাই ব্রাত্যই থেকে যান। তাঁর সুযোগ্য শিষ্য কলিম খান বিষয়েও স্বভাবত অ্যাকাডেমি নীরব। কলিম খান যা বলেছেন বা যা-যা বলেছেন সবই অক্ষয় সত্য, এমত বালখিল্য দাবি কেউই করেন না, কিন্তু ‘বিকল্প’ ভাবনা নিয়ে আলোচনা করতে বাধা কোথায়? তার বদলে হিরণ্ময় ‘নীরবতা’ দিকে তাঁকে উপেক্ষা করার এই ‘অ্যাকাডেমিক মৌলবাদ’ এত সক্রিয় কেন? আলোচনা বা চর্চায় ভয় কেন? প্রশ্নগুলো সহজ, কিন্তু উত্তর অজানা।

ভাইপো আকবর :  শ্যায়খুবাবা এলো না ?

কফিহাউসের যক্ষ : শ্যায়খুবাবা, শ্যায়খুবাবা করছেন কেন স্যার ? আপনার ছেলে সেলিম, মানে জাহাঙ্গির তো পাকিস্তানে মাটির তলায় । আনারকলিও সেখানে মাটির তলায় । দেখুন দুজনে মিলে কী করছে ।

ভাইপো আকবর : আমি জানতুম ও নিশ্চয়ই কোনো লন্দিফন্দি করছে । ছোকরা বয়সে সৎবোনের সঙ্গে লন্দিফন্দি করেছিল বলে আমি ওকে তার বুকের দুধ খেতে বাধ্য করেছিলুম । আদি গ্রন্হের লেখক পঞ্চম শিখ গুরু অর্জন দেবকেও খুন করিয়েছিল । নিজের আত্মজীবনীতে বেহায়াটা লিখেছে কী জানো ? লিখেছে, .. “ আমি নীলগাইয় মারার জন্য  তাক করে ছিলুম,  হঠাৎ করেই এক বর এবং দুজন পালকিবাহক কোথা থেকে এসে উপস্থিত হয়ে গেল আমার আর নীলগাইটার মাঝে । নীলগাই চিৎকার করে পালিয়ে গেলেও,  বরটাকে সেখানেই খুন করার হুকুম দিলুম আর পালকিবাহক দুটোকে গাধার ওপরে  চাপিয়ে  শিবিরের চারপাশে প্যারেড করালুম, যাতে অন্য কেউ  এমন কাজ করার সাহস না পায়। ” ভাঙ আর বিয়ার খাওয়া পাবলিকের জন্যে বন্ধ করে দিলেও নিজে তো আফিম আর দিশি মদের নেশা ছাড়তে পারল না, বইতে  আবার লিখেওছে বুক ফুলিয়ে যে আঠারো বছর বয়স থেকে নেশা করছে আর মাতাল হবার আনন্দ নিয়েছে । এতো মদ খেতো যে ওর হাত কাঁপা আরম্ভ করেছিল, তখন ও চাকরদের বলত ওর গলায় মদ ঢেলে দিতে ।  একজন ডাক্তার ওর নাড়ি চেক করে  বলেছিল যে ও ছয় মাসের বেশি বাঁচবে না। ডাক্তারের সামনেই  মদের সঙ্গে দিশি মিশিয়ে আর আফিম খেয়ে নিজেকে প্রফুল্ল করে তুলেছিল । আরেকটা স্বীকারোক্তি করেছে, যা শুনলে অবাক হয়ে যাবে ; ওর ছেলে শাহজাহানকে তার জন্মদিনে জোর করে মদ খাওয়াবার চেষ্টা করেছিল । আমার বাপ হুমায়ুন ছিলেন ঘরকুনো, কারোর সঙ্গে মিশতে চাইতেন না, নেশাভাঙ করে সিংহাসনে পড়ে থাকতেন, আর শ্যায়খুবাবা সারাজীবন নেশা আর মাগিবাজিতে কাটিয়ে দিল । নুরজাহানকে সেই কারণেই বিয়ে করেছিল যাতে বেগম সিংহাসন সামলাবে আর উনি লন্দিফন্দি করে বেড়াবেন । নয়তো সাঁয়ত্রিশ বছর বয়সে তেত্রিশ বছরের বিধবা বুদ্ধিমতী শিয়া মেয়েটাকে বিয়ে করবে কেন ?

কফিহাউসের যক্ষ : এই দেখুন, কে একজন মহিলা ছায়ামূর্তি এসেছেন ।

ছায়ামূর্তি : আমাকে নুরজাহান বেগম পাঠিয়েছেন । আমার নাম বেনজির ভুট্টো, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মেয়ে । আমিও ও সেখানেই মাটির তলায় আছি বটে, তবে আমার দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছিল আপনাদের পাঠানো একজন মোহাজিরের ষড়যন্ত্রে, বোমা ফেটে । সে ছিল সেনাপতি, পরে রাষ্ট্রপতি । আমার আসতে অসুবিধা হয়নি, কেননা আমার তো ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট । নুরজাহান বেগম আমার আইকন । আমার মনে হয় উনি প্রত্যেক নারীবাদীর আইকন । আপনার শ্যায়খুবাবাও বহাল তবিয়তে আছেন । ওনার অম্মি, আপনার স্ত্রী তো ওখানেই আছেন মাটির তলায় জাহাঙ্গিরের তৈরি করা মসজিদে । 

ভাইপো আকবর : যাক, শুনে মনটা হালকা হলো । তা তোমার আইকন বলছ কেন ?

ছায়ামূর্তি : সম্রাট জাহাঙ্গীর আর নুরজাহানের নাম লেখা  স্বর্ণ এবং রৌপ্য মুদ্রা ছাড়ার পর সেসময়ের মুঘল রাজদরবারের লেখক, বিদেশি কূটনীতিক, বণিক এবং পর্যটকরা উপলব্ধি করতে শুরু করেছিলেনন যে মোগল সাম্রাজ্য পরিচালনায় বেগমের  বিরাট প্রভাব । নুরজাহান একদিন রাজপ্রাসাদের ঝরোকা বা বারান্দায় দেখা দিয়েছিলেন। তা তাঁর আগে পর্যন্ত কেবল পুরুষদের জন্যই সংরক্ষিত ছিল। তবে পুরুষতান্ত্রিকতার বিরুদ্ধে নুর জাহানের এটিই একমাত্র বিদ্রোহ ছিল না। শিকারে বের হওয়া থেকে শুরু করে নিজের নামে রাজকীয় মূদ্রা এবং রাজকীয় ফরমান জারি, বড় বড় রাজকীয় ভবনের নকশা তৈরি, দরিদ্র নারীদের কল্যাণে ব্যবস্থা গ্রহণ, এরকম নানা কাজে নুর জাহান তার স্বাক্ষর রেখেছেন। যা ছিল সেকালের নারীদের মধ্যে ব্যতিক্রম। তাঁর স্বামীকে যখন জিম্মি করা হয়, তখন নুরজাহান তাঁকে রক্ষায় সেনাবাহিনীর অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন, যা তাঁকে ইতিহাসের পাতায় আর জনমানসে চিরদিনের জন্য স্থায়ী জায়গা করে দিয়েছে। প্রায়ই সম্রাটের সাথে বাঘ শিকারে যেতেন নুরজাহান। শক্তিশালী বাঘ শিকারি হিসেবে তার খ্যতি ছিল। তিনি ৬টি গুলি দিয়ে ৪টি বাঘ শিকার করেছিলেন। তাঁর বীরত্বের কবিতাও লিখেছিলেন সেসময়ের অনেক কবি। একসময় সম্রাটের বন্ধু হয়ে গিয়েছিলেন এই নারী ।  জাহাঙ্গীরের নামে তিনি রাজ্য শাসন করতেন। তিনি নিজের আত্মীয়দের দরবারের উচ্চপদে চাকরি দিয়েছিলেন। তাঁর অনুরোধে জাহাঙ্গীর তাঁর ভাই আসফ খাঁকে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়েছিলেন। তাঁর আগের পক্ষের মেয়ের সঙ্গে যুবরাজ শাহরিয়ারে বিবাহ দেন।

ভাইপো আকবর : শাহজাহান তো নুরজাহানের ওপর বেশ চটা ছিল শুনেছি । নুরজাহানের নামের সব মুদ্রা গলিয়ে ফেলেছিল আর যাদের কাছে ছিল, তাদের হুকুম দিয়েছিল গলিয়ে ফেলার । এখনকার কয়েন কালেক্টারদের কাছে ওই কয়েনগুলোর দাম অনেক ।

ছায়ামূর্তি : আমার বর যেমন ঘুষখোর ছিল, তেমন নুরজাহানের বাবাও ছিল ঘুষখোর । ‘আমার রাজ্য আমি এক পেয়ালা মদ আর এক বাটি সুরুয়ার বিনিময়ে আমার প্রিয় রানীর কাছে বেচে দিয়েছি।’ এই উক্তিও আর কারও নয়, সম্রাট জাহাঙ্গীরের। তিরিশজন বউয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরের সবচেয়ে প্রিয় বউ ছিলেন এই নূরজাহান। এত প্রভাব থাকা সত্ত্বেও নূরজাহানের জীবনের শেষ বছরগুলো ভালো যায়নি।  সম্রাট জাহাঙ্গীরের মৃত্যুর পর নূরজাহান তড়িঘড়ি করে জামাই শাহরিয়ারকে সম্রাট ঘোষণা করতে চান। কিন্তু তাঁর ভাই আসফ খান নিজের মেয়ে মমতাজের স্বামী শাহজাহানকে সিংহাসনে বসাতে কৌশলে নুরজাহানকে বন্দী করেন। শাহজাহান এই সুযোগে নিজের ভাই শাহরিয়ারকে খুন করে করে  সিংহাসন দখল করে নিয়েছিল আরোহণ করেন। অথচ সম্রাট বেঁচে থাকা আমলে নূরজাহানের বাবা ও ভাই অর্থ আত্মসাৎ ও বিশ্বাসঘাতকতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিলেন তখন ঢাল হয়ে বাঁচিয়েছিলেন এই নুরজাহান। এমনকি তাঁদের পদোন্নতিতেও সাহায্য করেছিলেন তিনি। নিজের পরিবার পরিজনদের অনেককেই তিনি নিজের প্রভাব বলে প্রশাসন ও বিচার সম্বন্ধীয় উঁচু পদে বসিয়েছিলেন । জীবনের শেষ আঠারো বছর নুরজাহানের বন্দীদশাতেই কাটে। এই পুরো সময় তিনি রাজনীতি ছেড়ে দিয়ে, তাঁর বাবার সমাধিতে দরগাহ   তৈরির তদারকি করে ও কাব্যচর্চা করে দিন কাটিয়েছিলেন ।  

ভাইপো আকবর : তোমাদের দেশে শুনেছি স্পেনের আদলে ইনকুইজিশন চলছে ? জানো তো ? ইউরোপীয় চার্চের দন্ডমুন্ডের কর্তা পোপ গ্রেগরির নির্দেশের ফলে পুরো ইউরোপে নেমে আসে ‘অন্ধকার যুগ’। তার  ফলাফল ছিল ইনকুইজিশন। চার্চের কর্তৃত্ব ধরে রাখা আর বিরোধীদের দমনের জন্য রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ বিরোধীদের গ্রেফতার ও জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করে। বিচারের সময় তাদের জিজ্ঞাসাবাদের নামে চালানো হত অমানবিক নির্যাতন। যদি কেউ এমন কথা বলতো যা চার্চ সঠিক নয় তাহলে তার সর্বচ্চো শাস্তি ছিলো  জীবন্ত পুড়িয়ে মারা । ভয়াবহ নির্যাতন ও জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যা করার পদ্ধতিটিই ‘ইনকুইজিশন’ নামে পরিচিত। এই ইনকুইজিশন শুধু খ্রিস্টধর্ম বিরোধীরাই নয়, অন্যান্য ধর্মের, বিশেষ করে ইহুদি, মুসলমান আর দক্ষিণ আমেরিকার আদিনিবাসী বহু নিরপরাধ পুরুষ, নারী ও শিশু নির্যাতন ভোগ করছে। 

ছায়ামূর্তি : জানি । শুনে অবাক হবেন যে আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পরিবার শিয়া ইসমাইলি মতের অনুসারী ছিল, যাদের এখন তালিবানিদের হাতে অত্যাচার ভোগ করতে হচ্ছে । জিন্নাহর ঠাকুর্দা ভারতের গুজরাতের কাঠিয়াওয়ারের গোন্ডাল রাজ্যের পানেলি মতি গ্রামের বানিয়া উপজাতের সদস্য ছিলেন। তিনি মাছের ব্যবসা  করতেন, আর সেই কারণে তিনি তার  হিন্দু লোহানা জাত থেকে বয়কট হন। তিনি  মাছের ব্যবসা বন্ধ করে দেবার পরও তাঁকে জাতে ফেরার অনুমতি দেয়া হয়নি। ফলে, তাঁর ছেলে পুঞ্জলাল ঠাক্কর, যিনি জিন্নাহর বাবা,  এতটাই অপমানিত ও ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে তিনি তাঁর এবং তাঁর চার ছেলের ধর্ম পরিবর্তন করে নেন,  এবং ইসলাম ধর্মে আস্তিকান্তরিত হন । জিন্নাহর বাবা পুঞ্জাভাই জিন্নো খোজা ইসমাইলি ফিরকা বিশ্বাসের সাথে প্রথম প্রজন্মের মুসলমান ছিলেন, তবে পরবর্তী প্রজন্ম তাদের বিশ্বাস শিয়া ইসলামের দিকে নিয়ে যায়। আমার দেশের লোকেরা এই ইতিহাস জানে ।

চেঙ্গিজ খান : আমি বলেছিলুম তো যে সব খান চেঙ্গিজ খান নয় ।

ছায়ামূর্তি : চরমপন্থী গোষ্ঠীর সদস্যরা আমাদের দেশেও জাতপাতের সূচনা করেছে স্যার । তাদের লক্ষ্য হলো হিন্দু, খ্রিস্টান, শিয়া, বেরেলভি, সুফি, আহমাদিয়া আর দেওবন্দী ।  কয়েক হাজার শিয়া সুন্নি উগ্রপন্থী নিজেদের মধ্যে খুনোখুনি করে মরেছে। খুনোখুনির  উল্লেখযোগ্য দিক হ’ল চরমপন্হীরা তাদের আক্রমণের ধর্মীয় দিকগুলিকে জোর দেওয়ার জন্য উপাসনার জায়গাগুলোকে টার্গেট করে।  সূফি মাজারেও হামলা হয় । এই নতুন জাতপাতের রেশারেশির ঝগড়ায় সিপাহ-ই-সাহাবা, তেহরিক-ই-তালিবান পাকিস্তান,  জুন্ডাল্লাহ ,  তেহরিক-ই-তালিবান  দায় স্বীকার করেছে। মেয়েরা বোরখা না পরলে তালিবানরা তাদের মাথায় গুলি মেরে খুন করে ।

ভাইপো আকবর : তোমার ড্যাড নিজে প্রধানমন্ত্রী হবার ধান্দায় শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হতে দেয়নি, তাই দেশটা দুটুকরো হয়ে গেল, যুদ্ধ বাধলো । যুদ্ধে যে নব্বুই হাজার সেনা বন্দি হয়েছিল তারা কি তাদের অপমান ভুলতে পারে। তারা দল বেঁধে তোমার বাপকে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দিলো ।

ছায়ামূর্তি : আমার ড্যাড আল-হিন্দের প্রধানমন্ত্রী মিস্টার নেহেরুর মতন ফ্ল্যামবয়েন্ট ছিলেন ।

চেঙ্গিজ খান : মিস্টার নেহেরু প্রায়ই এই গানটা টেলিফোনে একজনকে খাম্বাজ রাগে গেয়ে শোনাতেন–

আমি      চিনি গো চিনি    তোমারে ওগো বিদেশিনী।

তুমি      থাক সিন্ধুপারে    ওগো বিদেশিনী॥

তোমায়  দেখেছি শারদপ্রাতে,    তোমায়    দেখেছি মাধবী রাতে,

তোমায়  দেখেছি হৃদি-মাঝারে    ওগো বিদেশিনী।

আমি     আকাশে পাতিয়া কান    শুনেছি    শুনেছি তোমারি গান,

আমি     তোমারে সঁপেছি প্রাণ    ওগো বিদেশিনী।

         ভুবন ভ্রমিয়া শেষে       আমি      এসেছি নূতন দেশে,

আমি    অতিথি তোমারি দ্বারে    ওগো বিদেশিনী॥

ল্যাঙড়া তৈমুর : হায় মাওলা কী করলা । আল-হিন্দের রোগ ওদেরও ধরেছে । আমার সময়ে তো এরকম জাতপাতের খুনোখুনি ছিল না, কে বড়ো আর কে ছোটো, তা নিয়ে কাটাকাটি-মারামারি হতো না ! মেয়েদের বোরখা পরতে হতো না । 

ভাইপো আকবর : বলছিলুম । নির্ঘাত নব্য-ইনকুইজিশন । আমার দরবারে নিরীশ্বরবাদীরাও আসতো ।  নিরীশ্বরবাদ আক্ষরিক অর্থে “ঈশ্বরের অনস্তিত্ব সংক্রান্ত ধারণা”, কিংবা “ঈশ্বরহীনতা সংক্রান্ত মতবাদ” । ঈশ্বর বা দেবতার অস্তিত্বে অবিশ্বাস হিন্দু দর্শনের একাধিক মূলধারার ও ব্যতিক্রমী ধারার শাখায় সুপ্রাচীন কাল থেকে স্বীকৃত হয়েছে।] ভারতীয় দর্শনের তিনটে শাখা বেদের কর্তৃত্বকে অস্বীকার করেছে। এই তিনটি শাখা হল জৈনধর্ম, বৌদ্ধধর্ম ও চার্বাক। এগুলোকেই ‘নাস্তিক’ দর্শন বলা হয়। নাস্তিক বা ব্যতিক্রমী ধারার দর্শনে যদিও ঈশ্বরে অবিশ্বাসের থেকে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে, বেদের কর্তৃত্ব অস্বীকার ।  এই শাখাগুলো সৃষ্টিকর্তা দেবতার ধারণাটিকেও প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি নানারকম আলোচনা শুনতুম কিন্তু খুনোখুনি বরদাস্ত করতুম না । তোমার ভাবনা তোমার কাছে রাখো, অন্য সবায়ের ওপর চাপাবার কী দরকার ?

গুলবদন পিসি : একদম ।

চেঙ্গিজ খান : সন্ধ্যা হয়ে গেল তো । এবারে চলো খালাসিটোলায় । বাদবাকি চর্চা সেখানেই মাতাল হয়ে করা যাবে। চল রে ল্যাঙড়া । মহিলারা ওখানে অ্যালাউড নয় । যারা-যারা যেতে চাও চলো । পরের আড্ডা পয়লা বৈশাখ হবে নিউ টাউন কফি হাউসে । গুড নাইট লেডিজ । সি ইউ সুন ।