হাংরি আন্দোলন :-
বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে ভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেয়া তাঁদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি । আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ।
মলয় রায় চৌধুরী এ বিখ্যাত সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ | কবির সাথে এই আন্দোলনের সংগঠনের
দায়িত্বে ছিলেন কবির দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আন্দোলনের সম্পাদনা ও বিতরণে ছিলেন কবি দেবী রায় এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় |
কবি মলয় রায় চৌধুরী বলেছেন যে ১৯৬১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর মনে হয়েছিল যে, স্বদেশী
আন্দোলনের সময় জাতিয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে
গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে | ওসওয়াল্ড স্পেংলার এর লেখা "The Decline of the
West" বইটির মূল বক্তব্য থেকে তিনি এই আন্দোলনের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন | স্পেংলারের মতে কোনো
সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা
হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না |
যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে
থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে | কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ
হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে,
খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন | তাঁর মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর
অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালীর আবির্ভাব আর সম্ভব নয় |
তাঁর মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার,
আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন |
সেই ভাবনা মতো মলয় এবং তাঁর দাদা সমীর, দুই বন্ধু দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় কে নিয়ে, অন্যান্য
তরুণ লেখক কবি শিল্পীদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করেন | নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রথম হাংরি বুলেটিন
প্রকাশিত করা হয় পাটনা থেকে এবং সেখানে বাংলা ছাপাবার প্রেস না পাওয়ায় বুলেটিনটি প্রকাশিত করা
হয় ইংরেজীতে | অতি স্বল্প কালের মধ্যেই হিন্দী ও নেপালী ভাষাতেও এই আন্দোলন ছড়িয়েছিল |
এই নব ধারার প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের জন্য মলয়ের চাকরি যায় | তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী
প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের রাজত্যকালে, ১৯৬৪ সালে, মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়,
শৈলেশ্বর ঘোষ ও সমীর রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা
হয় | পরে, এই অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, অন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে
অশ্লিল সাহিত্য রচনা করার অভিযোগে মামলা করা হয়, তাঁর "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটির জন্য |
আন্দোলনেরই কয়েকজন রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়াতে নিচু আদালতে, মামলায় হেরে যান মলয় | কিন্তু ২৬
জুলাই ১৯৬৭ মহামান্য উচ্চ আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেন | এই আন্দোলনের সেখানেই সমাপ্তি
ঘটে |
এই আন্দোলন কে নিয়ে স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরীর লেখা, দিল্লী থেকে প্রকাশিত পত্রিকা "দিগঙ্গন" এর উত্সব
সংখ্যা ২০০৪ এ প্রকাশিত "প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি" প্রবন্ধ |
হাংরি আন্দোলন নিয়ে আগ্রহী পাঠকের জন্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "হাংরি আন্দোলনের কাব্যদর্শন"- দেবী রায় (১৯৬৫), "Hungryalist Manifestoes/ ইস্তাহার সংকলন" (১৯৮৬), "হাংরি কিংবদন্তি" (১৯৯৪)-দে বুকস, "Hungryalist Interviews" edited by Ajit Ray, "বিষয় পোস্ট মর্ডানিটি" হাংরি আন্দোলনোত্তর সাক্ষাত্কার সংকলন ২০০৪, "হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার" আবার এসেছি ফিরে পাবলিকেশনস ২০০৭ প্রভৃতি |
মলয় রায়চৌধুরী
বাংলা সাহিত্যে স্থিতাবস্থা ভাঙার আওয়াজ তুলে, ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে, শিল্প ও সাহিত্যের যে একমাত্র আন্দোলন হয়েছে, তার নাম হাংরি আন্দোলন, যাকে অনেকে বলেন হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে ভাবে মুসলিম লিগ, কম্ম্যুনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো । উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের সংকরায়ণকে স্বীকৃতি দেয়া তাঁদের কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল । ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় ।কবিতা সম্পর্কিত ইশতাহারটি ছিল ইংরেজিতে, কেন না পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী বাংলা প্রেস পাননি । আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক ও গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি ।
মলয় রায় চৌধুরী এ বিখ্যাত সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ | কবির সাথে এই আন্দোলনের সংগঠনের
দায়িত্বে ছিলেন কবির দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আন্দোলনের সম্পাদনা ও বিতরণে ছিলেন কবি দেবী রায় এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় |
কবি মলয় রায় চৌধুরী বলেছেন যে ১৯৬১ সালে মাত্র ২১ বছর বয়সে তাঁর মনে হয়েছিল যে, স্বদেশী
আন্দোলনের সময় জাতিয়তাবাদী নেতারা যে সুখী, সমৃদ্ধ, উন্নত ভারতবর্ষের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা টকে
গিয়ে পচতে শুরু করেছে উত্তর ঔপনিবেশিক কালখণ্ডে | ওসওয়াল্ড স্পেংলার এর লেখা "The Decline of the
West" বইটির মূল বক্তব্য থেকে তিনি এই আন্দোলনের দর্শন গড়ে তুলেছিলেন | স্পেংলারের মতে কোনো
সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরল রেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় ; তা
হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না |
যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার উপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করতে
থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফূরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে | কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান সেই সময় আরম্ভ
হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে,
খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন | তাঁর মনে হয়েছিল যে দেশভাগের ফলে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর
অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মনীষীদের পর্যায়ের বাঙালীর আবির্ভাব আর সম্ভব নয় |
তাঁর মনে হয়েছিল যে কিঞ্চিদধিক হলেও, এমনকি যদি ডিরোজিওর পর্যায়েও না হয়, তবু হস্তক্ষেপ দরকার,
আওয়াজ তোলা দরকার, আন্দোলন প্রয়োজন |
সেই ভাবনা মতো মলয় এবং তাঁর দাদা সমীর, দুই বন্ধু দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায় কে নিয়ে, অন্যান্য
তরুণ লেখক কবি শিল্পীদের নিয়ে এই আন্দোলন শুরু করেন | নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রথম হাংরি বুলেটিন
প্রকাশিত করা হয় পাটনা থেকে এবং সেখানে বাংলা ছাপাবার প্রেস না পাওয়ায় বুলেটিনটি প্রকাশিত করা
হয় ইংরেজীতে | অতি স্বল্প কালের মধ্যেই হিন্দী ও নেপালী ভাষাতেও এই আন্দোলন ছড়িয়েছিল |
এই নব ধারার প্রতিষ্ঠান বিরোধী আন্দোলনের জন্য মলয়ের চাকরি যায় | তত্কালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী
প্রফুল্ল চন্দ্র সেনের রাজত্যকালে, ১৯৬৪ সালে, মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়,
শৈলেশ্বর ঘোষ ও সমীর রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার অভিযোগ এনে গ্রেপ্তার করা
হয় | পরে, এই অভিযোগ ধোপে টিকবে না দেখে, অন্য সবাইকে ছেড়ে দিয়ে শুধু মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে
অশ্লিল সাহিত্য রচনা করার অভিযোগে মামলা করা হয়, তাঁর "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটির জন্য |
আন্দোলনেরই কয়েকজন রাজসাক্ষী হয়ে যাওয়াতে নিচু আদালতে, মামলায় হেরে যান মলয় | কিন্তু ২৬
জুলাই ১৯৬৭ মহামান্য উচ্চ আদালত তাঁকে বেকসুর খালাস করে দেন | এই আন্দোলনের সেখানেই সমাপ্তি
ঘটে |
এই আন্দোলন কে নিয়ে স্বয়ং মলয় রায়চৌধুরীর লেখা, দিল্লী থেকে প্রকাশিত পত্রিকা "দিগঙ্গন" এর উত্সব
সংখ্যা ২০০৪ এ প্রকাশিত "প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি" প্রবন্ধ |
হাংরি আন্দোলন নিয়ে আগ্রহী পাঠকের জন্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে "হাংরি আন্দোলনের কাব্যদর্শন"- দেবী রায় (১৯৬৫), "Hungryalist Manifestoes/ ইস্তাহার সংকলন" (১৯৮৬), "হাংরি কিংবদন্তি" (১৯৯৪)-দে বুকস, "Hungryalist Interviews" edited by Ajit Ray, "বিষয় পোস্ট মর্ডানিটি" হাংরি আন্দোলনোত্তর সাক্ষাত্কার সংকলন ২০০৪, "হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহার" আবার এসেছি ফিরে পাবলিকেশনস ২০০৭ প্রভৃতি |
মলয় রায়চৌধুরী
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন