সোমবার

হাংরি জেনারেশন - একটি আভাঁগার্দ আন্দোলন : আলী হায়দার শেখ আবদুর রহমান


হাংরি জেনারেশনঃ একটি আভাঁগার্দ আন্দোলন

 ২৩:৪৯, ২৭ এপ্রিল ২০২০  ব্লগ

১৯৬৪ সাল। ঐ বছরের সেপ্টেম্বর মাসে ভারতীয় পেনাল কোডের ১২০(বি), ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন 
কবির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিলো। তারা হলেন- মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী,
 শৈলেশ্বর ঘোষ,  সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, উৎপল কুমার বসু, প্রদীপ চৌধুরী, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, 
বাসুদেব দাশগুপ্ত,  সুবো আচার্য এবং  সুবিমল বসাক।
 এদের মধ্যে ছয়জনকে গ্রেফতার করে কোলকাতার ব্যাঙ্কশাল কোর্টে তোলা হয়েছিলো। 
মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বেঁধে হাঁটিয়ে আনা হয় চোর-ডাকাতের মত।
 কিন্তু কেন?

দেশভাগের পর পশ্চিম বাংলায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সাথে উদ্বাস্তু শরণার্থীর ভিড়,
 অন্যদিকে অর্থনৈতিক স্বরাজের
 খোয়াবকে গুঁড়িয়ে চলেছে স্বার্থ আর নোংরা রাজনীতির নগ্ন খেলা। ঠিক এই সময় আবির্ভাব ঘটলো
 আভাগার্দ রূপে একদল
 তরুণ কবির। এক পাতার বুলেটিনে তারা যাপিত জীবন, দর্শন, রাজনীতি, গল্প, অণুগল্প সর্বোপরি
 কবিতা হ্যান্ডবিল
 আকারে ছাপিয়ে বিলি করতে লাগলেন প্রতিষ্ঠিত স্বীকৃত সাহিত্য তীর্থের বিপরীতে প্রান্তিক
 কফি হাউজ, চা-স্টল,
 গলির মোড়ে-মোড়ে। রবীন্দ্র-জীবনানন্দ বলয়ের বাহিরে এইসব কবিতা ধাক্কা দিয়ে গেলো
 গণমানুষের চিত্তকে। 
বাংলা সাহিত্যকে এই প্রথমবারের মত গতানুগতিক সাহিত্যিক অক্ষরবাদী বুদ্ধিজীবীদের সভা 
থেকে নামিয়ে আনা হলো রাস্তায়,
 সাধারণ মানুষের মাঝে। পোস্ট-কলোনিয়াল ভারতবর্ষের ঔপনিবেশিক সাহিত্যকে বুড়ো আঙ্গুল 
দেখিয়ে দিয়ে নিজেদের
 স্বত্ত্বার বহিঃপ্রকাশই ছিল এই আন্দোলন এর আপাত অভিপ্রায়।
 যেসব কবিরা এই বিপ্লব ঘটালো তারা নিজেদের দাবী করলো 'হাংরি জেনারেশন' হিসেবে। 

আর্তি বা কাতরতা শব্দগুলো মতাদর্শটিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা
 শেষাবধি হাংরি 
শব্দটি গ্রহণ করেন । হাংরি আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি বাংলাভাষায় ঠিক সেভাবে প্রবেশ করেছে যে
 ভাবে মুসলিম লিগ, 
কমিউনিস্ট পার্টি বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি সংকরায়িত শব্দবন্ধগুলো।
 আর এই ক্ষুধার্ত তরুণ কবিদের নেতৃত্ব দিলেন,
 পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ২১ বছরের এক তরুণ তুর্কি- মলয় রায়চৌধুরী- 
যিনি নিজেকে পরিচয় দিলেন, 'একজন কালচারাল বাস্টার্ড'।

১৯৫৯-৬০ সালে ইতিহাসের দর্শন এবং মার্ক্সবাদের উত্তরাধিকার নিয়ে দুইটি লেখা নিয়ে কাজ করার সময়
 হাংরি আন্দোলনের প্রয়োজনটা মলয় রায়চৌধুরী অনুভব করেন। ‘হাংরি’ শব্দটি প্রথমে পেয়েছিলেন কবি
 Geoffrey Chaucer এর 'In Swore Hungry Time' বাক্যটি থেকে। আর আন্দোলনের তত্ত্ব গড়েছিলেন
 Oswald Spengler এর লেখা 'The Decline of the West' বইটি থেকে। Spengler এর এই তত্ত্বটির 
সারমর্ম নিয়ে মলয় রায়চৌধুরী ‘প্রতিসন্দর্ভের স্মৃতি’ নামে একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেনঃ

'একটি সংস্কৃতির ইতিহাস কেবল একটি সরলরেখা বরাবর যায় না, তা একযোগে

বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়; তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা

অংশের কার কোন দিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল

নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে তখন সংস্কৃতিটি নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ

করতে থাকে, তার নিত্যনতুন স্ফুরণ ও প্রসারণ ঘটতে থাকে।

কিন্তু একটি সংস্কৃতির অবসান

সেই সময়ে আরম্ভ হয় যখন তার নিজের সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গিয়ে তা

বাইরে থেকে যা

পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন।'


আর সেই ভাবনা থেকেই কবি মলয় রায় তাঁর দাদা সমীর রায়, দুই বন্ধু দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়
 এর সাথে
 ধারনাটি ব্যাখ্যা করে হাংরি আন্দোলনের প্রস্তাবনা দেন এবং অন্যান্য তরুণ লেখক কবি শিল্পীদের নিয়ে
 এই আন্দোলন 
শুরু করেন। নভেম্বর ১৯৬১ সালে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশিত করা হয় পাটনা থেকে এবং সেখানে 
বাংলা ছাপাবার 
প্রেস না পাওয়ায় বুলেটিনটি প্রকাশিত করা হয় ইংরেজীতে। অতি স্বল্প কালের মধ্যেই হিন্দী ও 
নেপালী ভাষাতেও এই আন্দোলন
 ছড়িয়েছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে আন্দোলনে মিশে যান বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, 
উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, 
ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, 
অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, 
সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়,
 অমৃততনয় গুপ্ত, 
ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল,
 রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, 
দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল করঞ্জাই এবং করুণানিধান নামের দুজন চিত্রকরও 
ছিলেন এই আন্দোলনে। 
ঢাকার হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন বুলবুল খান মাহবুব, অশোক সৈয়দ, আসাদ চৌধুরী, 
শহিদুর রহমান, 
প্রশান্ত ঘোষাল, মুস্তফা আনোয়ার সহ আরো অনেকে। অনেকেই তখনও জানতেন না যে মলয়রা
 প্রথম হাংরি বুলেটিনগুলো
 ইংরেজিতে কেন প্রকাশ করেছিলেন। ফলে বিভিন্ন অঞ্চলে আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিলো ইংরেজিতে 
ইশতেহার প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
কবিতার ইশতেহারে মলয় লিখেছিলেনঃ
‘শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা কবিতা সৃষ্টির প্রথম শর্ত’। ‘এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের 
মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে। 
প্রথম ইংরেজি ইশতেহারে কবিতা সম্পর্কে লেখেন-

'Poetry is no more a civilizing manoeuvre, a replanting of the bamboozled gardens; 
it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, 
a sowing of the 
tempestual hunger.

Poetry is an activity of the narcissistic spirit. Naturally, we have discarded the

 blankety-blank 
school of modern poetry, the darling of the press, where poetry does not
 Resurrection itself
 in an orgasmic flow, but words come up bubbling in an artificial muddle. 
In the prosed-rhyme 
of those born-old half-literates, you must fail to find that scream of
 desperation of a thing 
wanting to be man, the man wanting to be spirit.

Poetry of the younger generation too has died in the dressing room, 

as most of the younge
r prosed-rhyme writers, afraid of the satanism, the vomitous horror, 
the self-elected crucifixion 
of the artist that makes a man a poet, fled away to hide in the hairs.

Poetry from Achintya to Ananda and from Alokeranjan to Indraneel, has been cryptic, 
short-hand, cautiously glamourous, flattered by own sensitivity like a public school prodigy. 
Saturated with self-consciousness, poems have begun to appear from the tomb of logic
 or the bier of unsexed rhetoric.

১৯৬২ সালে হাংরিদের প্রথম বাংলা ইশতেহার প্রকাশ হয় যার শেষ লাইন ছিলো,
'কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা ও ঈশ্বরীর মতো অনুষ্মেষিণী।'

আন্দোলনের মুল উদ্দেশ্য নির্ণায়ক নিয়মবিধির ইশতেহারে মলয় লিখলেন-

1. The merciless exposure of the self in its entirety.

2. To prevent in all nakedness, all aspects of the self and thing before it.

3. To catch a glimpse of the exploded self at a particular moment.

4. To challenge every value with a view to accepting or rejecting the same.

5. To consider everything at the start to be nothing but a 'thing' with a view to testing
 whether it is living or lifeless.

6. Not to take reality as it is but to examine it in all its aspects.

7. To seek to find out a mode of communication, by abolishing the accepted modes of
 Prose and Poetry which would instantly establish a communication between the
 poet and his reader.

8. To use the same words in poetry as are used in ordinary conversation.

9. To reveal the sound of the word, used in ordinary conversation, 

more sharply in the poem.

10. To break loose the traditional association of words and to coin unconventional 
and here-to-fore unaccepted combination of words.

11. To reject traditional forms of poetry and allow poetry to take its original forms.

12. To admit without qualification that poetry is the ultimate religion of man.

13. To transmit dynamically the message of the restless existence and 

the sense of disgust
 in a razor sharp language. 

14. Personal ultimatum.

তবে কেবলমাত্র কবিতা লিখেই ক্ষান্ত হননি এই ক্ষুধার্ত কবির দল। ১৯৬৩ সালের কথা।
 রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী, এমএলএ, সচিব, লেখক এবং সাংবাদিকরা হাংরিয়ালিস্টদের থেকে পেতে 
থাকলেন বিভিন্ন ধরনের মুখোশ। কোনোটা জন্তু-জানোয়ারের,
 কোনোটা দানবের। জোকার, মিকি মাউস, দেবতা- কোনো ধরনের মুখোশই বাদ গেল না। 
প্রতিটি মুখোশের সাথে লেখা থাকে,
 “দয়া করে মুখোশটা খুলে ফেলুন”। অন্যদিকে কবি সাহিত্যিকদের পাঠানো হলো বিয়ের কার্ড।
 তাতে লেখা "Fuck the Bastards of Gungshalik School of Poetry"।
 মূলধারার বাণিজ্যিক পত্রিকাগুলোতে ছোটগল্পের নামে আসতে লাগল সাদা কাগজ, 
আর বুক রিভিউয়ের জন্য
 পাঠানো হতো জুতোর বাক্স। প্রথাগত সাহিত্য আর সংস্কারের বিরুদ্ধে ক্রমে আরও জোরদার হলো
 'হাংরি মুভমেন্ট'।
 কখনো তারা একটি বইয়ের দাম ধরলেন এক লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি বি সিল, 
আবার কখনো চিত্রপ্রদর্শনীর 
আয়োজন করে শেষদিন পুড়িয়ে ফেললেন সমস্ত চিত্রকর্ম।

কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল সেনকে উদ্দেশ্য করে লিখেছিলেন-

"কবিতা ভাতের মতো কেন লোকে নিতেই পারছে না
যুদ্ধ বন্ধ হলে নেবে? ভিখারিও কবিতা বুঝেছে
তুমি কেন বুঝবে না হে অধ্যাপক মুখ্যমন্ত্রী সেন?"

‘জখম’ কবিতায় মলয় লিখলেন-

"মানুষের দেয়া আইনানুগ মৃত্যুদণ্ড পেয়ে কেবল মানুষই মরে যাচ্ছে
ফ্যাক্ট্রি আর বিবাহ দুটোরই রেজিস্ট্রি হয়ে চোলেছে নিয়মমাফিক
কোল্কাতায় মদের ব্যবসা থেকে নৈতিক মাইনে পাচ্ছে ৪৫০০০ ডান হাত
১ একরে ১৩৫ জোড়া পায়ের ঠেসাঠেসি আরাম খাচ্ছে ১৯৬৫ মডেলের কোল্কাতা”

'হাবিজাবি' কবিতায় সুবিমল বসাক লিখেন-

আমারে মাইরা ফেলনের এউগা ষড়যন্ত্র হইসে
চারো কোনা দিয়া ফুসফুস আওয়াজ কানে আহে
ছাওয়াগুলান সইরা যায় হুমকে থিক্যা
অরাআমারে এক্কেরে শ্যায করতে সায়
আমি নিজের ডাকাইত্যা হাতেরে লইয়া সচেত্তন আসি
কেউ আইয়া চ্যারায় দিশায় চ্যাবা কথা কয় না
আমি সুপসাপ থাকি
ভালাসির গুছাইয়া আমি কথা কইতে পারি না
২ কইতে গিয়া সাত হইয়া পড়ে
১৫ সাইলে ৯ আইয়া হাজির হব
ছ্যাব ফেলনের লাইগ্যা বিচড়াইতাসি অহন
আহ, আমার দাঁত মাজনের বুরুশ পাইতাসি না
বিশ্বাস করেন, কেউ একজনা আমার মুহের সকরা খাবার খাইসে।

'একটি উজ্জ্বল মাছ' কবিতায় বিনয় মজুমদার লেখেন-

একটি উজ্জ্বল মাছ একবার উড়ে
দৃশ্যত সুনীল কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে স্বচ্ছ জলে
পুনরায় দুবে গেল - এই স্মিত দৃশ্য দেখে নিয়ে
বেদনার গাঢ় রসে আপক্ব রক্তিম হলো ফল ।
বিপন্ন মরাল ওড়ে, আবিরাম পলায়ন করে,
যেহেতু সকলে জানে তার শাদা পালকের নীচে
রয়েছে উদগ্র উষ্ণ মাংস আর মেদ;
স্বল্পায়ু বিশ্রাম নেয় পরিশ্রান্ত পাহাড়ে পাহাড়ে;
সমস্ত জলীয় গান বাষ্পীভূত হয়ে যায়, তবু
এমন সময়ে তুমি, হে সমুদ্রমৎস্য তুমি... তুমি...
কিম্বা,দ্যাখ,ইতস্তত অসুস্হ বৃক্ষেরা
পৃথিবীর পল্লবিত ব্যাপ্ত বনস্হলী
দীর্ঘ দীর্ঘ ক্লান্ত শ্বাসে আলোড়িত করে
তবু সব বৃক্ষ আর পুষ্পকুঞ্জ যে যার ভূমিতে দূরে দূরে
চিরকাল থেকে ভাবে মিলাইবে শ্বাসরোধী কথা।

১৯৬৪ এর সেপ্টেম্বরে রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী,
 প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সমীর রায়চৌধুরী। এই একই অভিযোগে 
উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে 
ওয়ারেন্ট ইস্যু হলেও তাঁরা প্রেপ্তার এড়িয়ে যেতে পেরেছিলেন। হাতে হাতকড়া পরিয়ে,
 কোমরে দড়ি বেঁধে চোর-ডাকাতদের 
সঙ্গে তাদেরকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো-করা হয়েছিলো ঘন্টার পর ঘন্টা জেরা। 
এরপর রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের
 অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে মলয় ছাড়া বাদবাকি সবাইকে 
ছেড়ে দেয়া হলো। তার বিরুদ্ধে দায়ের করা
 মামলায় বলা হয়েছিলো যে সাম্প্রতিক হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত ‘প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীল।
কবিতাটির প্রথম কয়েক লাইনঃ


'ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও।'


মলয়ের বিরুদ্ধে এই মামলা দায়ের করা সম্ভব হয়েছিলো শৈলেশ্বর ঘোষ এবং সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী 
হয়েছিলেন বলে।
 এরপর আদালতে তোলা হলে হাংরি বুলেটিনের লিডার শক্তি চট্টোপাধ্যায় সাক্ষ্য দিলেন মলয়ের বিপক্ষে, 
অন্যদিকে পক্ষে সাক্ষী দিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। 
আদালতে সুনীল বলেছিলেন, কবিতাটিতে তিনি কোনো অশ্লীলতা পাননি।
 ফলে নিম্নআদালতে সাজা হবার পরেও উচ্চআদালতের দেওয়া রায়ে 
১৯৬৭ সালে খালাস পেয়েছিলেন মলয় রায়চৌধুরী।
 ওদিকে যাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিলো তাদের কারো কারো চাকরি চলে গেলো, 
কয়েকজনকে করা হলো বদলি। ফলে একপ্রকারে বন্ধ হয়ে গেলো হাংরি আন্দোলন।

ছবিঃ ব্যাংকশাল কোর্টৈ মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ 

বাংলা সাহিত্যে হাংরি আন্দোলনের প্রভাবঃ

❑ হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের প্রথম ও প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো তাঁরা সাহিত্যকে পণ্য হিসাবে
 চিহ্নিত করতে 
অস্বীকার করেছিলেন। কেবল তাই নয়; তাঁরা এক পৃষ্ঠার লিফলেট প্রকাশ করতেন ও বিনামূল্যে
 আগ্রহীদের মাঝে
 বিতরণ করতেন। তাঁরাই প্রথম ফোলডার-কবিতা, পোস্ট-কার্ড কবিতা ও পোস্টারে কবিতা ও 
কবিতার পংক্তির সূত্রপাত করেন।

❑ হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ অবদান প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা। তাঁদের আগমনের পূর্বে
 প্রতিষ্ঠানবিরোধিতা 
করার কথা সাহিত্যকরা চিন্তা করেন নাই। সুভাষ ঘোষ বলেছেন প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার অর্থ সরকার
 বিরোধিতা নয়, 
সংবাদপত্র বিরোধিতা নয়; হাংরি জেনারেশনের বিরোধ প্রচলিত সাহিত্যের মৌরসি পাট্টাকে উৎখাত
 করে নবতম মূল্যবোধ
 সঞ্চারিত করার। নবতম শৈলী, প্রতিদিনের বুলি, পথচারীর ভাষা, ছোটোলোকের কথার ধরণ, 
ডিকশন, উদ্দেশ্য, 
শব্দ ব্যবহার, চিন্তা ইত্যাদি । পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থী সরকার স্বত্তেও বামপন্থী কবিরা মধ্যবিত্ত মূল্যবোধ
 থেকে নিষ্কৃতি পান নাই।
 শ্রমিকের কথ্য-ভাষা, বুলি, গালাগাল, ঝগড়ার অব্যয় তাঁরা নিজেদের রচনায় প্রয়োগ করেন নাই।

❑ হাংরি জেনারেশন আন্দোলনের তৃতীয় অবদান কবিতা ও গল্প-উপন্যাসে ভাষাকে 
ল্যাবিরিন্থাইন করে প্রয়োগ করা। 
এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা ও গল্প-উপন্যাস। মলয় রায়চৌধুরী সর্বপ্রথম 
পশ্চিমবাংলার সমাজে 
ডিসটোপিয়ার প্রসঙ্গ উত্থাপন করেন। বামপন্থীগণ যখন ইউটোপিয়ার স্বপ্ন প্রচার করছিলেন
 সেই সময়ে মলয় রায়চৌধুরী 
চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেন ডিসটোপিয়ার দরবারি কাঠামো।

❑ হাংরি জেনারেশন আন্দোলনে সাবঅলটার্ন অথবা নিম্নবর্গের লেখকদের গুরুত্ব 
প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল। 
আন্দোলনের বুলেটিনগুলোর সম্পাদক ছিলেন চাষি পরিবারের সন্তান হারাধন ধাড়া।
 সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়সহ তৎকালীন
 কবিরা তাঁর এমন সমালোচনা করেছিলেন যে তিনি এফিডেভিট করে ‘দেবী রায়’ নাম নিতে বাধ্য হন।
 এছাড়া আন্দোলনে ছিলেন নিম্নবর্গের চাষী পরিবারের শম্ভু রক্ষিত, তাঁতি পরিবারের সুবিমল বসাক,
 জাহাজের খালাসি অবনী ধর, মালাকার পরিবারের নিত্য মালাকার ইত্যাদি ।
পরবর্তীকালে প্রচুর সাবঅলটার্ন 
কবি-লেখকগণকে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে দেখা গেল।

❑ হাংরি জেনারেশনের পূর্বে কবিতা-গল্প-উপন্যাস রচিত হতো ঔপনিবেশিক মূল্যবোধ অনুযায়ী 
একরৈখিক রীতিতে। 
তাঁদের ছিল লিনিয়রিটি, দিশাগ্রস্ত লেখা, একক গলার জোর, কবিরা ধ্বনির মিল দিতেন, সময়কে মনে 
করতেন প্রগতি।
 এক রৈখিকতা এসেছিল ইহুদি ও খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থের কাহিনির অনুকরণে। আমাদের দেশে বহুকাল যাবত 
সেকারণে ইতিহাস রচিত হয়েছে কেবল দিল্লির সিংহাসন বদলের। 
সারা ভারত জুড়ে যে বিভিন্ন রাজ্য ছিল তাদের 
ইতিহাস অবহেলিত ছিল। হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকগণ একরৈখিকতা বর্জন করে বহুরৈখিক রচনার 
সূত্রপাত ঘটালেন।

❑ হাংরি জেনারেশনের পূর্বে শব্দার্থকে সীমাবদ্ধ রাখার প্রচলন ছিল। রচনা ছিল কবির ‘আমি’র প্রতিবেদন।
 হাংরি জেনারেশনের কবি-লেখকরা বলেছেন কথা চালিয়ে যাবার কথা। বলেছেন যে কথার শেষ নেই।
 নিয়েছেন শব্দার্থের ঝুঁকি। রচনাকে মুক্তি দিয়েছেন আত্মমনস্কতা থেকে। 
হাংরি জেনারেশনের এই কৌম মূল্যবোধ গ্রহণ করে নিয়েছেন পরবর্তীকালের কবি-লেখকরা।
 এই প্রভাব সামাজিক স্তরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ।

❑ হাংরি জেনারেশনের পূর্বে নাক-উঁচু সংস্কৃতির রমরমা ছিল, প্রান্তিককে অশোভন মনে করা হতো,
 শ্লীল ও অশ্লীলের ভেদাভেদ করা হতো, ব্যবধান গড়ে ভেদের শনাক্তকরণ করা হতো। 
হাংরি জেনারেশনের কবি ও লেখকরা সংস্কৃতিকে সবার জন্য অবারিত করে দিলেন।
 বিলোপ ঘটালেন সাংস্কৃতিক বিভাজনের।

হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা আসলে ভূমিকম্পের মতো। 
সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল, ক্ষত সৃষ্টি করেছিলো। 
যার আফটার এফেক্টে একপ্রকার উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। 
সর্বোপরি সাহিত্যের সরলরৈখিকতাকে ভেঙ্গেচুরে ফেলতে এরকম আরো আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে জরুরী।

লিখেছেন আলী হায়দার শেখ আবদুর রহমান। 

শনিবার

কমরেড পু-এর আত্মহত্যা : হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা

উৎসর্গ : মারুফুল আলম
কমরেড পু, ম-১ এর খুড়তুতো বোন, গলায় দড়ি বেঁধে, ঝুলে পড়ল ।
         পুলিশের ডাক্তার ট-১ জানিয়েছিল, যুবতীটি মারা গেছেন
রাত ১টা ৪০শে, তাহলে পু ওর আত্মহত্যার কবিতায়, তারিখের তলায়
         কেন সময় লিখেছে রাত ৩টে ৩০ ?
কবিতাটা থানা থেকে পাওয়া যায়নি, ইন্সপেক্টর জ-৩ বললেন,
         সনেটে লেখা আত্মহত্যার চিরকুট ফেরত দেয়া নিষেধ ।
এফ আই আর-এ লেখা ছিল, "চাঁদ ওঠে নাই, বাতাস বহিয়াছিল, শৃগালিনী
         পুংশৃগালকে ডাকিতেছিল, ইহা শরৎকাল, ৩০০ বছরের পুরানো ইঁট,
         বরগার চিড়ের কারণে চড়াইপাখির ডিম পড়িয়া ফাটিয়া গিয়াছে,
         পুংচড়াই নালিশ করিতেছিল, নথিবদ্ধ করা হইয়াছে ।"
কমরেড পু, যে ম-১ এর কাকা ন-২ এর মেয়ে, কেন আত্মহত্যা করল
         তা কবিতায় লেখেনি । পু সোভিয়েত রাষ্ট্রে যেতে চায়নি ।
         পু মনে করতো, রুবলহারামিরা নবযুগ আনতে পারবে না,
         নিজের, ছেলেমেয়ের, জ্ঞাতিগুষ্টির নবযুগ আনবে বটে,
         বাড়ি, গাড়ি, নার্সিং হোম, প্রায়ভেট স্কুল খুলে ফেলবে ।
         ম-১কে লিখে বলেছে, "ছোড়দা, ছন্দে ভুল থাকলে শুধরে দিও।"
ম-১ তো নিজেই কোনো জন্মে সনেট লেখেনি, মনে-মনে ছকে রেখেছিল,
         কখনও আত্মহত্যা করলে, নাটকের আঙ্গিকে চিরকুট লিখবে,
কেননা ম-১ এর আত্মহত্যা করার বহু কারণ জীবনে ঘটে থাকলেও,
         কাজটা ম-১ মুলতুবি রেখেছে, ম-১ এর জীবনে খলনায়ক
         সংখ্যায় বড়ো বেশি, যেমন স-২, স-৩, স-৪, শ-১, শ-২ ।
কমরেড পু-এর আত্মহত্যার কোনো কারণ ছিল না । এই ব্যাপারটাই
         ভালো লাগে ম-১ এর, আত্মহত্যার কারণ না থাকলেও
         আত্মহত্যার ইচ্ছে । পু টাকাহারামিদেরও বিশ্বাস করতে পারেনি ।
         বলতো, "আমাদের আদর্শকে গুয়ের সমুদ্রে চুবিয়ে দেবে ।"
ইচ্ছেকে ক্রিয়ায় পালটে ফেলার আহ্লাদটাই কমরেড পু-এর
         আত্মহত্যার কারণ হতে পারে ।
পু যে নিৎশে, কাফকা, ভারতচন্দ্র, ঋত্বিক পড়তো, তা ম-১ জানে,
         'রসমঞ্জরী' পড়ে জানতে চাইতো ও কোন ধরণের যুবতী ।
পু আত্মহত্যা করার পর, বড়োঘরের বরগা, যা থেকে পু ঝুলেছিল,
         ভেঙে পুরোবাড়ি ধ্বসে পড়ল যখন, পু-এর আত্মহত্যা
         গুরুত্ব হারিয়ে হয়ে গেল বসতবাড়ির আত্মহত্যা ।
ম-১ এর ঠাকুমা অ বললেন, "ওই ঘর ছিল অভিশপ্ত, তোদের বংশের অনেক
         লম্পট পুরুষ বাইজির মদে মেশানো বিষ খেয়ে মরেছে ;
তা হত্যা ছিল না আত্মহত্যা না অতিযৌনতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা, আজও
         জানা যায়নি।"
ঠাকুমা অ বলে উঠেছিলেন, "ছি ছি রসমঞ্জরী ! কোন মেয়ের চুল নেই
         কোন মেয়ের কম চুল, কোন মেয়ের চুলে চুল ! ওই চুলের খোঁজেই
বংশের পুরুষগুলো মাগিদের কোঁচড়ে মুখ গুঁজে মরল । তোরা মাগিদের নিয়ে
        র‌্যালা করলে বেপাড়ায় গিয়ে করিস, সেখানকার মাগিরা
        চুল রাখে না বলে শুনিচি ।"
ম-১ এর দাদা স-১ জানতে চেয়েছিল, "এই অভিশপ্ত ব্যাপারটা কী গো?"
         ঠাকুমা অ বলেছিলেন, "ওসব আমাদের কালের ব্যাপার,
         বজরা ভাসতো, ঝাড়লন্ঠনের রোশনাই ঝিকমিক, ঘুঙুর,
         চিকের আড়াল, রুপোর রেকাবি, বিলিতি মদ, মুজরো।"
ঠাকুমার পরামর্শে ম-১ আর তার দাদা স-১ যৌবনে অনেক মাগিবাজি
         করেছিল । তরুণী গবেষকরা তা লিখে রেখেছেন ।
পু তা জানতে পারেনি, ভাগ্যিস । নয়তো এই নিমকলঙ্ককেই ওর
         আত্মহত্যার কারণ বলে শিলমোহর দিতো ।
সেই থেকে চিরকুটহীন আত্মহত্যা ম-১ এর পছন্দ । সনেটের বদলে
         পু ওয়াটার কালার এঁকে যেতে পারতো ।
ফ্রেমে আত্মহত্যা বাঁধিয়ে রাখতো ম-১ এর কাকা ন-২, আর পু-এর নিজের
         দুই বেয়াড়া ভাই জ আর ম-২ ।
আত্মহত্যার কোনো কারণ থাকা উচিত নয় । কেন ক-এর জন্য খ,
         খ-এর জন্য গ, গ-এর জন্য ঘ, ঘ-এর জন্য ঙ, ঙ-এর জন্য
আত্মহত্যা করার কারণের মানে হয় না কোনো । আত্মহত্যা করার হলে
         উঠে দাঁড়াও, বিষ খাও, সন্ধ্যার নদীতে গিয়ে ডুব দাও,
         আকাশ তোমাকে দেখুক চুল এলিয়ে সাগরের দিকে ভেসে চলেছ ।

বৃহস্পতিবার

মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে সোনালী দাস


সোনালী দাস
30 এপ্রিল, 2017
কবি মলয় রায়চৌধুরী আমার বিশেষ বন্ধু। ফেবুতে অনেকেই বন্ধু হয়েই একদম ইনবাকসোয়, "হাই, আছো?" গেছো ব্যাপার। 'আপনি' বলার অনুরোধে তাঁরা বাজে বাজেন, "আরে বন্ধুকে তুমিই বলে।" ভাগ্যিস 'তুই' নয়! আমার ধারণা, যে কথা পেরেণ্টস বা কাপলের মধ্যেও বলা যায়না, তা যাকে যায়, সেই 'বন্ধু'। কিছু সে অর্থেও কবির সাথে আমার সে বন্ধন আছে। কথাবার্তা হয়, কিছু সুখ দুঃখ-যন্ত্রণা। সুদীর্ঘ ৭৭ টি দুর্গম সৌরপ্রদক্ষিণ কেড়ে নিয়েছে তাঁর বহু শারীরিক প্রাবল্য। আমার ইনবাকসোতেও দীর্ঘক্ষণ ক্লেশ দিই তাঁর আর্থ্রাইটিস আক্রান্ত আঙুলকে প্রায়শই। তাঁকে নিয়েই এই রোব্বারে মেতে থাকা আমার।
১৯৬১ নভেম্বর, পাটনা শহর থেকে একটি ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। মলয় রায়চৌধুরী এই বিখ্যাত সাহিত্য আন্দোলনের পথিকৃৎ। কবির সাথে এই আন্দোলনের সংগঠনের দায়িত্বে ছিলেন কবির দাদা সমীর রায়চৌধুরী, আন্দোলনের সম্পাদনা ও বিতরণে ছিলেন কবি হারাধন ধারা (দেবী রায়) এবং নেতৃত্বে ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
প্রথম দিকে চারজন মিলে আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটালেও, এই চারজ্নের প্রত্যেকের যে পৃথক ঘনিষ্ঠ মহল ছিল, তারা একে একে এই আন্দোলনে যোগ দেয়। আন্দোলনের কাঠামো ছিল খোলামেলা, ফলে যোগ দেওয়ার শর্ত ছিল অবাধ। বয়সের তফাত ছিল প্রত্যেক ঘনিষ্ঠমহলের, প্রথম থেকে যে-জন্য দশকভিত্তিক জটলা বা গোষ্ঠীমুখীনতা প্রশ্রয় পায়নি। হাংরি আন্দোলনে যারা এক এক করে যোগ দিয়েছেন, এমন কি যোগ দিয়ে পরে সরে গেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ থেকেছে এই পার্থক্য আর ঐক্যের এই সমীকরণে আর কাঙ্খিত অবস্থানপন্নতার ক্রমনির্মাণে।
হাংরি আন্দোলনের তীব্রতায় হতভম্ব হয়ে পড়ে তৎকালীন অচলায়তনগুলি। আন্দোলনকারীদের গ্রেফতার করা হয়। মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বেঁধে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যায় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে।
মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত। ১২০বি এবং ২৯৪ ধারা তুলে নিয়ে কেবল ২৯২ ধারায় চার্যশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর "প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটির জন্য; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয়। কবির পক্ষে সাক্ষী ছিলেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল, জ্যোতির্ময় দত্ত এবং সত্রাজিত দত্ত। পুলিশের পক্ষে অর্থাৎ কবির বিরুদ্ধে সাক্ষী ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, পবিত্র বল্লভ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় এবং উৎপলকুমার বসু। নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান।
৪৫ বছর পরও এই কবিতাটি নিয়ে বিতর্ক কবিতাটিকে জীবন্ত রেখেছে এবং এম ফিল ও পি এইচ ডি গবেষণার বিষয়বস্তু হয়েছে। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় প্রকাশিত 'Modern And Postmodern Poetry Of The Millennium' সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে অন্তর্ভুক্ত এইটিই একমাত্র কবিতা এই "প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" কবিতাটি।
সর্বাধিক আবেদনময় ও প্রশংসার্হ কবিতাটি শুনি Tanumay Goswami এর
কাছে, < https://youtu.be/DE--EZ3F5XA >। কবিতাটির এতোটাই তেজষ্ক্রীয়তা, এখনও আবৃত্তি করে চলেছেন বহু নবীন কণ্ঠ। এখানে কবিতাটি পাঠ করেছেন বাংলাদেশের তরুণ রাজীব চৌধুরী।
নীচে কালজয়ী কবিতাটি --

প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার / মলয় রায়চৌধুরী
ওঃ মরে যাব মরে যাব মরে যাব
আমার চামড়ার লহমা জ্বলে যাচ্ছে অকাট্য তুরুপে
আমি কী কোর্বো কোথায় যাব ওঃ কিছুই ভাল্লাগছে না
সাহিত্য-ফাহিত্য লাথি মেরে চলে যাব শুভা
শুভা আমাকে তোমার তর্মুজ-আঙরাখার ভেতরে চলে যেতে দাও
চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আর আমি পার্ছিনা, অজস্র কাঁচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে
আমি যানি শুভা, যোনি মেলে ধরো, শান্তি দাও
প্রতিটি শিরা অশ্রুস্রোত বয়ে নিয়ে যাচ্ছে হৃদয়াভিগর্ভে
শাশ্বত অসুস্থতায় পচে যাচ্ছে মগজের সংক্রামক স্ফুলিঙ্গ
মা, তুমি আমায় কঙ্কালরূপে ভূমিষ্ঠ করলে না কেন ?
তাহলে আমি দুকোটি আলোকবর্ষ ঈশ্বরের পোঁদে চুমু খেতুম
কিন্তু কিছুই ভালো লাগে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না
একাধিক চুমো খেলে আমার গা গুলোয়
ধর্ষণকালে নারীকে ভুলে গিয়ে শিল্পে ফিরে এসেছি কতদিন
কবিতার আদিত্যবর্ণা মুত্রাশয়ে
এসব কী হচ্ছে জানি না তবু বুকের মধ্যে ঘটে যাচ্ছে অহরহ
সব ভেঙে চুরমার করে দেব শালা
ছিন্নভিন্ন করে দেব তোমাদের পাঁজরাবদ্ধ উত্সব
শুভাকে হিঁচড়ে উঠিয়ে নিয়ে যাব আমার ক্ষুধায়
দিতেই হবে শুভাকে
ওঃ মলয়
কোল্কাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
কিন্তু আমাকে নিয়ে কী কোর্বো বুঝতে পার্ছিনা
আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি
প্রস্রাবের পর শেষ ফোঁটা ঝাড়ার দায়িত্ব আমায় শিখতে হয়নি
অন্ধকারে শুভার পাশে গিয়ে শুয়ে পড়া শিখতে হয়নি
শিখতে হয়নি নন্দিতার বুকের ওপর শুয়ে ফরাসি চামড়ার ব্যবহার
অথচ আমি চেয়েছিলুম আলেয়ার নতুন জবার মতো যোনির সুস্থতা
যোনিকেশরে কাঁচের টুকরোর মতো ঘামের সুস্থতা
আজ আমি মগজের শরণাপন্ন বিপর্যয়ের দিকে চলে এলুম
আমি বুঝতে পার্ছিনা কী জন্য আমি বেঁচে থাকতে চাইছি
আমার পূর্বপুরুষ লম্পট সাবর্ণ চৌধুরীদের কথা আমি ভাবছি
আমাকে নতুন ও ভিন্নতর কিছু কোর্তে হবে
শুভার স্তনের ত্বকের মতো বিছানায় শেষবার ঘুমোতে দাও আমাকে
জন্মমুহুর্তের তীব্রচ্ছটা সূর্যজখম মনে পড়ছে
আমি আমার নিজের মৃত্যু দেখে যেতে চাই
মলয় রায়চৌধুরীর প্রয়োজন পৃথিবীর ছিল না
তোমার তীব্র রূপালি য়ুটেরাসে ঘুমোতে দাও কিছুকাল শুভা
শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও
তোমার ঋতুস্রাবে ধুয়ে যেতে দাও আমার পাততাড়িত কঙ্কাল
আমাকে তোমার গর্ভে আমারি শুক্র থেক জন্ম নিতে দাও
আমার বাবা-মা অন্য হলেও কি আমি এরকম হতুম ?
সম্পূর্ণ ভিন্ন এক শুক্র থেকে মলয় ওর্ফে আমি হতে পার্তুম ?
আমার বাবার অন্য নারীর গর্ভে ঢুকেও কি মলয় হতুম ?
শুভা না থাকলে আমি কি পেশাদার ভালোলোক হতুম মৃত ভায়ের
ওঃ বলুক কেউ এসবের জবাবদিহি করুক
শুভা, ওঃ শুভা
তোমার সেলোফেন সতিচ্ছদের মধ্যে দিয়ে পৃথিবীটা দেখতে দাও
পুনরায় সবুজ তোশকের উপর চলে এসো শুভা
যেমন ক্যাথোড রশ্মিকে তীক্ষ্ণধী চুম্বকের আঁচ মেরে তুলতে হয়
১৯৫৬ সালের সেই হেস্তনেস্তকারী চিঠি মনে পড়ছে
তখন ভাল্লুকের ছাল দিয়ে সাজানো হচ্ছিল তোমার ক্লিটোরিসের আশপাশ
পাঁজর নিকুচি-করা ঝুরি তখন তোমার স্তনে নামছে
হুঁশাহুঁশহীন গাফিলতির বর্ত্মে স্ফীত হয়ে উঠছে নির্বোধ আত্মীয়তা
আ আ আ আ আ আ আ আ আ আঃ
মরে যাব কিনা বুঝতে পার্ছিনা
তুল্কালাম হয়ে যাচ্ছে বুকের ভেতরকার সমগ্র অসহায়তায়
সব কিছু ভেঙে তছনছ করে দিয়ে যাব
শিল্পের জন্যে সক্কোলকে ভেঙে খান-খান করে দোব
কবিতার জন্য আত্মহত্যা ছাড়া স্বাভাবিকতা নেই
শুভা
আমাকে তোমরা ল্যাবিয়া ম্যাজোরার স্মরণাতীত অসংযমে প্রবেশ কোর্তে দাও
দুঃখহীন আয়াসের অসম্ভাব্যতায় যেতে দাও
বেসামাল হৃদয়বত্তার স্বর্ণসবুজে
কেন আমি হারিয়ে যাইনি আমার মায়ের যোনিবর্ত্মে
কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁ পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি
কেন আমি রজঃস্রাবে মিশে যাইনি শ্লেষ্মায়
অথচ আমার নিচে চিত আধবোজা অবস্থায়
আরাম গ্রহণকারিনী শুভাকে দেখে ভীষণ কষ্ট হয়েছে আমার
এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই
এখন আমার হিংস্র হৃৎপিণ্ড অসম্ভব মৃত্যুর দিকে যাচ্ছে
মাটি ফুঁড়ে জলের ঘূর্ণি আমার গলা ওব্দি উঠে আসছে
আমি মরে যাব
ওঃ এ সমস্ত কী ঘটছে আমার মধ্যে
আমি আমার হাত হাতের চেটো খুঁজে পাচ্ছি না
পায়জামার শুকিয়ে যাওয়া বীর্য থেকে ডানা মেলছে
৩০০০০০ শিশু উড়ে যাচ্ছে শুভার স্তনমণ্ডলীর দিকে
ঝাঁকে ঝাঁকে ছুঁচ ছুটে যাচ্ছে রক্ত থেকে কবিতায়
এখন আমার জেদি ঠ্যাঙের চোরাচালান সেঁদোতে চাইছে
হিপ্নোটিক শব্দরাজ্য থেকে ফাঁসানো মৃত্যুভেদী যৌন-পর্চুলায়
ঘরের প্রত্যেকটা দেয়ালে মার্মুখী আয়না লাগিয়ে আমি দেখছি
কয়েকটা ন্যাংটো মলয়কে ছেড়ে দিয়ে তার অপ্রতিষ্ঠ খেয়োখেয়ি

হাংরি বুলেটিন / ১৯৬৪