শনিবার

হাংরি আন্দোলন : অজিত রায়ের সমালোচনা

                                           
             হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন সুইডেনের লেখিকা জারা মাস্ত
আভাঁগার্দ আন্দোলন - হাংরি আন্দোলন
অথবা নিছক নষ্ট তৈজসে সমলৈঙ্গিক গিল্টি
-------------------------------------------------------
অজিত রায়

কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন। যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন। তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়। জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে। হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে। তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়। সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা। সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।
১৯৫৯-৬০। বৃটিশবীর্যিত মুলুকের পোঁদে গাঁড়সা পুঁতে গাদি সামলাচ্ছেন নেহেরু। দেশের দুই প্রান্তে পার্টিশানের টসটসে পাঁচড়া। পুব পাকিস্তান থেকে আগত অন্যৎপুষ্ট মানুষের কিছু থোপনা তখনও আনলোড হচ্ছে শেয়ালদার টেসেলেটেড চাতালে। হাভাতে মানুষের কেরবালা বিধানবাবুর গড় জুড়ে ছিৎরে পড়ছে। দেশভাগের সময় পুব বাঙলা থেকে যে কিশোরগুলো বাবা-মায়ের কড়ে ধরে কলকাতায় এসেছিল, তারা এদণ্ডে গাগতরে বেতর, কিন্তু বয়সে ও মগজে সাজোয়ান। দেশভাগের খসা চোকলা। কাঁধের চিক্কুটে ঝোলায় কবিতার লাজুক খাতা আর কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ ঢুয়ে কলকাতার রাস্তায় গলিঘুঁজিতে এক রাত্তির হিল্লের মনসুবায় চোখমুখ কালিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাঁঝের আলা মদ্দিম হলে সারমেয় অধ্যাসিত ফুটপাতে, হয়ত-বা কোনও দয়াল বন্ধুর ঘাড়ে অথবা গেরস্ত বাড়ির হেঁসেল-ঠোরে রাত গুজরান। ইহাদের প্রত্যেকের বুকে কবিতা নামের পিলপিলে গণ্ডুপদটি ক্ষণে ক্ষণে ঢসন মারে। ইহারা সকলে প্রবল কবিতা-পিশাচ। পিশাচ, কেননা ইহাদের মাঘার ঘিলুতে জবরদস্ত পুঁজরক্ত যাহা গোপন আঁধারে কলম দিয়া চোয়ায় আর দেউলের দেউটি সহসা নিভায়।
ষাটোত্তর গরদিশের দিনগুলি। গেরস্তের জবরদখল-করা হেঁসেলে আচকা নোটিশ হয়ে গেল। ভাঙা আয়না, দাঁড় টুনানো চিরুনি, তেলের শিশি, জীর্ণ ফতুয়া, কলা-ওঠা টিনের সুটকেশ আর লজ্জাবতী কবিতার ধুকড়ি নিয়ে পথে দাঁড়াল সুভাষ। সুভাষ শলা করল, ----- শৈল, চ, দুজনে মিলে একটা ঘর নিই। টালায় ১৬-বি শ্যামচরণ মুখার্জি স্ট্রিটের একতলায় দুর্গন্ধ-পীড়িত ফালি-খানেক ঘর যোগাড়ও হয়ে গেল। খিড়কির পাল্লা সরালেই ড্রেনের ধারে পাছা ঝুলিয়ে নিত্যকর্মে ব্যস্ত কৃশগাঁড় বিভীষিকা।
সুভাষের গেরামের ইশকূলে কমপয়সার চাকরি। দু-বেলা যুৎসই অন্ন জোটে না বটে, কিন্তু গদ্যের হাতটি খাসা। তাহাতে ড্যাশ ও হাইফেনের যাচাই ভুরিভোজ। শৈলেশ্বরেরও মতিগতি উনিশবিশ। অল্প পড়াশোনা। ভাঙাচোরা ফ্যামিলির ছেলে। অশহুরে, তথা জন্মলব্ধ সারল্য ও সততা। ফলে মানিকজোড় হতে সূর্যঘড়ি লাগেনি। দুজনেই টিউশানি ধরে, আর ছাড়ে। হপ্তায় দু-দেড় দিন ভিজিট, আর চার-পাঁচদিন একুনে নাগা। ফলে আট থেকে দশদিনের মাথায় জবাব হয়ে যায়। খাওয়ার পয়সা নেই। বৃদ্ধ পিতা পঙ্গুত্বের লেংগি খেয়ে খাটের প্রাণী। ছাত্র-রাজনীতির গাজোয়ারি-প্রসূত 'লম্বা' হাঁকন বাবদ আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে নীমসম্বন্ধ। ফলে, দিনগুলি বেজায় নড়বড়ে, জীবনযাত্রা ধূরিপথহীন। সাহিত্য করা তো দূর অস্ত, সাহিত্যের জিগির-মাত্রে পিছদাঁড়ায় কাঁপন। ডাইনির ছমছমে খিখি অষ্টপ্রহর। ক্কচিৎ পকেটে বাড়তি খুচরো জুটলে শ্যালদার চোরা-হোটেলে জলের সঙ্গে পাঞ্চ করে, ভরদুপুরে কান্ট্রি-লিকার। শ্যামবাজারের জন্তা হোটেলে ছ'আনায় ভরপেট খানা। লেটনাইটে ঘুমের ধাক্কায়, বাড়ি। একজনের ঘুম জুটত, অন্যজনের জুটত না। শৈলেশ্বরের ছিল ইনসোমনিয়ার ব্যামো। সারা-সারারাত মরা মাছের নিস্পন্দ চাউনি সিলিং-পানে।
সুভাষরা একসময় ক'জন বন্ধু মিলে 'এষণা' নামে একটা কাগজ বের করত। খুবই পাতি, অতীব বালখিল্য সে কাগজ। সুভাষ-বাদে অন্যরা সবাই মামুলি মাস্টারবেট-করা লেখক, মানে পার্ট-টাইম। অল্প খিঁচে নিল, ব্যস, সাহিত্যের বাঘ মারা হয়ে গেল। আপিসে-আপিসে কেরানিগিরি, আর রোববার সকালে পাঁচ পয়সায় আধ প্যাকেট ক্যাপস্টান কিনে শ্যামবাজার কফিহাউসে ধুন্ধুমার আড্ডা। কফির কাপ আর তামাকের কড়া ধোঁয়ায় বাঙালির বেড়ে বাফুনারি। শৈলেশ্বর-সুভাষরা ইন্টেলেকচুয়াল নয়, গেঁয়ো বুদ্ধি, গেঁয়ো কথাবার্তা। অপরপ্রান্তে, ধাউড়দের মুখে বিদিশি বই, ফরেন-কলমচিদের রেফারেন্স। ইনজিরির ছররা। দুজনের মধ্যে শৈলেশ্বরের বুদ্ধি একটু খোলা, মওকা বুঝে, সময় থাকতে কাগজটাকে নিজের হেফাজতে নিল। কাপ্তানি সুভাষের, কিন্তু কলকাঠি শৈলর হাতে। অবশ্য, চারটে মাত্র ইস্যুই হাপিস হয়েছিল 'এষণা'র।। হাংরি জেনারেশান সাহিত্যের ঐ ছিল গর্ভ-সূচনা। অচিরেই এষণার ছাদনায় এসে ভেঁড়ে প্রদীপ আর সুবো।
এবং আরও একজন। বছরটা ১৯৬৩।
ছেলেটির বয়স কুড়ি। রুজির যোগাড়ে গোড়ার দিকে থাকত কলকাতায়। টালা ব্রিজের কাছে খেলাত বাবু লেনে। বারোঘর এক উঠোনের একটি পোড়া বাড়িতে। সারাদিন রুজির খোঁজে, ফিরত রাত নিবিড়ে। পড়ে ন্যুনাধিক একটা হিল্লে হলে, অশোক নগরের উদ্বাস্তু কলোনিতে পাকাপোক্ত নোঙর। সেও ছিল দেশভাগের ঠাঁটা চোকলা। ডাঁসা বাঙাল। জিরজিরে শরীর। উপদ্রুত মন। চাঁচাড়ি-ঘেরা তার এক-কাটরা বাড়ি। ছেঁড়া শাড়ির গাঁঠরি। বাতায় ঠোঁসা সরষে তেলের শিশি। একটিপ তেল মেখে, শ্যালো টিপে দু-বালতি জলে স্নান সেরে ও গামছায় সর্বাঙ্গ মুছে, ভাঙা আয়নার সামনে ব্যাকব্রাশে টেরি চিরে দরমার দরজা ভেজিয়ে এক রোববার সে ঐ 'এষণা'র ঠেকে। লেট এন্ট্রি।
ছেলেটির নাম বাসুদেব দাশগুপ্ত।
হালিতেই সে ঝুলি থেকে বের করে এগিয়ে দ্যায় একটি লিটল ম্যাগাজিন। পবিত্র বল্লভ সম্পাদিত 'উপদ্রুত'। তাহাতে একটি দীর্ঘ গদ্য, ---- নাম 'রন্ধনশালা'। সে বলেছিল, 'গল্প'।
বাসুদেব 'রন্ধনশালা' রচনা করেন একষট্টিতে। তেষট্টিতে সেটি ম্যাগাজিনে কৃষ্ণহরফ পায়। গদ্যটি গ্রন্থত্ব লাভ করে উৎপলকুমার বসুর হেফাজতে, ১৯৬৫-তে। শুধু এই রন্ধনশালার কথাই যদি বলতে হয়, এবং ১৯৬৩-র প্রথম আলোকনের সালটিকেই যদি ধরতে হয়, বলব, সেই সময়ের প্রেক্ষিতে ভারতবর্ষের সহস্র সহস্র বছরের সর্বঅস্তিত্বগ্রাসী ক্ষুধার এ-তুল্য বহিঃপ্রকাশ এবং তার এহেন গ্রাম্য আদিম রাস্টিক তথা অস্বস্তিকর ভাষায় আত্মপ্রকাশ একটা বড়সড় তহেলকার চেয়ে বিন্দুমাত্র উনিশ ছিল না। এ ছিল এমন লেখা, যা পড়ার পর, বাংলা সাহিত্যের পাঠক আগের যা-কিছু পড়া সমস্ত হকহকিয়ে বমি করে দ্যায়। বাংলা গদ্যের শেলফ প্রায় খালি হয়ে যায় রন্ধনশালা পৌঁছনোর পর।
রন্ধনশালার হব্যাশে সেদিন আকখা কলকাতা তোলপাড়। খাসির ল্যাজ তুলে যাঁরা মাংসের বহর আন্দাজাতে পটু, সেইসব ঘোড়েল সমালোচকেরা অব্দি রচনাটিকে ফ্রানজ কাফকা, লুই ফার্দিনান্দ সিলিন এবং গিন্সবার্গ-এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলেন। বাসু-বন্ধু শৈলেশ্বর কবুল করেছিলেন : ইমাজিনেটিভ সাহিত্যের এহেন উদাহরণ বাংলাভাষায় খুব বেশি নেই। বাস্তব অভিজ্ঞতাই লেখকের পা রাখার জায়গা, তারপরই বাসুদেব পাঠককে নিয়ে যান এক সম্পূর্ণ নতুন অভিজ্ঞতার মধ্যে।
আসলে, শৈলেশ্বর জানাচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে যে ছোটলোক বা সংখ্যালঘুর মনোভাব কাজ করছিল, রন্ধনশালা ও তৎ-পরবর্তী গদ্যসমূহে সেটাকেই ঝাড়বাতির তলায় মেলে ধরেছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত।
শৈলেশ্বর-বাসুদেব-সুভাষ-প্রদীপ-সুবো ----- এঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একে-অপরের মতো, একই পেরিফেরির জীব। প্রত্যেকের জীবনের ব্ল্যাক-কমেডি উনিশবিশ একই খেপের। চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেশভাগ, রক্ততোলা বেবুঝ দাঙ্গা, যুবতীর অস্মিতা-হরণ, লাখো মানুষের বুকে ভুখা ত্রাস, জঠরে জঠরে কান্না। প্রায় প্রত্যেকের বাল্য ও যৌবন অস্বচ্ছন্দ, নিহায়ৎ গরিব, ছোটলোক আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত, বুকে অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে কোলদাবা করে বেড়ে ওঠা। আধুনিকতা নাম্নী সালংকরা পিশাচিনির পাছায় এঁরা চুমু খেতে পারেননি। প্রত্যেকে কমবেশি লিজলিজে, ঘরকুনো, আত্মভুক। ফলত, পরস্পরের বন্ধুত্ব সামীপ্য পেতে দেরি হয়নি। সেই বন্ধুত্বের তলা ও তলানি ছিল কঠিন সিলেবেলে গাঁথা। পাঁচজনের মধ্যে একটা সমকামী-সুলভ এঁঠেল প্রেম, ভাষান্তরে 'আত্মা-বিনির্মিত নির্বাক সম্পর্ক' ডেভালপ করেছিল। এঁরা একে-অপরের নেশাতেই বিভোল থাকতেন। এঁরা কে কত বড় লেখক ছিলেন, আদৌ ছিলেন কিনা, সেটা বড় কথা নয়। বড় যেটা হলো, এঁরা অন্যদের মতো ফাঁপা-বুলি বা False Note লিখতেন না, নিজেরা ভুগে লিখতেন। এঁদের লেখালেখির পেছনে একটিই আর্জি ছিল ----- পৃথিবীর সেই আদিতম মন্ত্রটি ------ 'আত্মানং বিদ্ধি' (know thyself), নিজেকে জানো। অধ্যাত্মবিদ্যার এই মূল কথা রবীন্দ্রনাথেও প্রতিধ্বনিত ----- "অসীম যিনি স্বয়ং করেছেন সাধনা / মানুষের সীমানায়, / তাকেই বলে 'আমি'।" আমি-র দুটো ডানা ---- শরীর আর মন। প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি গ্লোবাল। উভয়ে মিশে গ্লোকাল। এই দুই ডানাবিশিষ্ট যানে আরূঢ় হয়ে চলে আমি-র জীবনযাত্রা, জার্নি অফ লাইফ। শরীরে ভর করে মহামনের সঙ্গে মনের যোগবন্ধনের প্রচেষ্টা। হাংরি লেখকদের সরাসরি একটাই বিষয় ছিল ---- এঁদের লেখার বিষয় ছিল 'আমি'। সেখানে কোনো মেকি অবগুণ্ঠন ছিল না। বনেদি সমালোচকদের চোখে এঁরা 'নিরক্ষর' বলে দাগায়িত হলেও, মনে রাখতে হবে এঁরা কোনরকম ধান্দাবাজিতে না ঢুকে, যৎসামান্য সংঘশক্তি নিয়ে এবং 'নিজেদের জীবনচর্চাকে কাঁচামাল হিশেবে ব্যবহার করে' লেখালেখি করতেন। যা অচিরেই, প্রতিষ্ঠান এমনকি প্রশাসনের বুকেও মৃদু হাড়কাঁপ ধরিয়ে দিয়েছিল।
পাঠক, এই এঁরা, যাঁদের কথা আপনি পড়ছেন, এঁদের একজন যা ভাবতেন, সকলে তা ভাবতেন। এঁরা একই হারে চলমান বাংলা কবিতা আর গদ্যকে অ্যানিমিক ভাবতেন। দেশভাগের আগে ও পরে সবুজপত্র, দেশ, কল্লোল, কবিতা, পরিচয়, পূর্বাশা প্রভৃতি 'শহুরে বাঙালি মানসের সমৃদ্ধ ও প্রত্যয়পূর্ণ চিন্তাক্ষেত্র' নামে পরিচিত ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যবাজির যে ধারা বাংলা সাহিত্যকে অবক্ষয় আর প্যানপ্যানানির চূড়ান্তে এনে ছেড়েছিল, তার বিরুদ্ধে ষাট দশকের গোড়ায় এইসব হাংরি লেখকরাই হেনেছিলেন প্রথম ও সর্বাধিক জবরদস্ত ধাক্কা। সে-কারণে প্রতিষ্ঠানের ক্যামপ্রাডর নমস্যদের বিগ্রহে মাটি খসে খড় বেরিয়ে যেতে দেখা গেছিল। মাত্র দু-আড়াই জন কবি আর লেখককে এঁরা, বাসু-শৈলরা নিজেদের মতো করে 'আবিষ্কার' করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে জীবনানন্দ, ------ যিনি, বিদ্যায়তনিক উলেমাদের চোখে, এমন শব্দ ব্যবহার করেছেন যারা কবিতায় দূরে থাক 'ভদ্দরসমাজে' পর্যন্ত অচল। সুতরাং, কফিঘরের আঁতেল ধোঁয়ায় ঘুরপাক না খেয়ে, এঁরা বুঁদ থাকতেন জীবনানন্দেই। আর একজন এঁদের কিছুটা সমীহ আদায় করেছিলেন, তিনি মানিক বাড়ুজ্জে। তিনি নাকি মানুষের ভিৎরি ফাঁপা অর্থহীন অঞ্চলকে ভারি সুন্দর ঢঙে ফাঁস করতে পারতেন, এঁদের মতে। কিন্তু, পরে কমিউনিজমের 'কুচক্করে' ফেঁসে তাঁর লেখার ধার ও বহুমাত্রিকতা খসে পড়ে, এঁদের মতে। একমাত্রিকতাই অবশ্য বামবাজ লেখকদের আগমার্ক ছিল, সেও এঁরা বুঝতেন। এঁরা আরও টের পেয়েছিলেন যে সুভাষ মুখুজ্জের কবিতাগুলো আসলে শিশুতোষ ছড়া, আর সময় সেনীয় সাহিত্য স্রেফ শহুরে ধাউড়বাজি। সন্দীপন চ্যাটার্জীর বিশেষত 'বিজনের রক্তমাংস' এঁদের ভালো লেগেছিল, কিন্তু অচিরেই যখন ফাঁস হয়ে গেল সন্দীপন আসলে স্প্যানিশ দার্শনিক উনামুনোর দ্যাখাদেখি লেখায় অসুস্থতার প্র্যাকটিস ওরফে ভাঁড়ামি করছেন, তখন এঁদের অ্যাবাউট টার্ন শুরু হয়ে যায়। এঁরা এও খোঁজ পেয়েছিলেন, যে, লেখার সার্টিফিকেটের জন্য যাঁরা বুদ্ধদেব বসু, বিমল কর আর 'দেশ'-এর দোরে ধন্না লাগাতেন, সেই রোম্যান্টিকদের অন্যতম শিরোমণি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। এঁরা সবই বুঝতেন, শুধু ঠিকঠাক সমঝে উঠতে পারতেন না শক্তি চ্যাটার্জীকে। হ্যাঁ, এঁদের মতে, শক্তি চট্টোপাধ্যায় একটু বেশিই 'খেলেছেন'। শক্তির কোন কোন কবিতা এঁদের চমকে দিত। তারপরেই কোন লেখা মনে হতো এক্কেবারে 'পাইল করা মাল'। কী ব্যাপার?? কফিহাউসে কানাঘুষো খবর উড়েছিল, কোন এক উঠতি কবির কবিতার খাতা নাকি শক্তির ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে। তারপর থেকেই নাকি অমন চেকনাই শক্তির কবিতায়। ধন্দ কাটে না। বর্ধমানের দামোদরে একদিন উদোম হয়ে নাইতে নেমেছেন শৈলেশ্বর, বুকজলে দাঁড়ানো উৎপলকুমার বসুকে জিগোলেন, 'কী দাদা, কথাডা কি সত্যি?' উৎপলও কেমন, রহস্যমতন হেসে জানালেন, 'আমিও তো ভাই আপনাদের মতোই শুনছি।' ------ বলেই ডুব।
এবার সংক্ষেপে বুঝে নেওয়া যাক হাংরি-তোড়ফোড়ের প্রেক্ষাপট, বা সময়ের ডিম-লেয়ারটা। অর্থাৎ কলকাতা বা হুগলি-চত্ত্বরের সন্নিহিত এলাকায় সেসময় কী-এমন ঘটেছিল যার দরুন ডাল-ভাত খাওয়া বাঙালি বাড়ির কিছু যুবা অমন-একটা ভাব-ঘূর্ণির ঝড়ে একজাই ক্ষেপে উঠল, ----- তার প্রেক্ষিতটা।
দেশভাগ হলো, 'স্বাধীনতা' নিয়ে শাঁখ-আবির হলো ----- আর তার পরপরই কবিরা কড়ে আঙুল ফাঁসিয়ে বাংলা কবিতার ন্যাড় আটকে দিলেন। তাঁরা পাল্লা দিয়ে মেতে উঠলেন 'শহিদপ্রণাম' আর 'নয়া শপথ' গোছের টাইমপাশে। পাশাপাশি অবশ্য বাংলা কবিতার পালে রোম্যান্টিক হওয়া লাগালেন রাম বসু, বটকৃষ্ণ দে। তখন তো এমনি, নতুন কবি মাত্রেই রোম্যান্টিক আর তাতে কড়ারি তামা-তুলসী নিয়ে উঠে আসছে একটি নাম ----- দেবদাস পাঠক। পুরনো কবিদের মধ্যে অজিত দত্ত, প্রমথনাথ বিশী, বনফুল আর খুব করে দাপাতে লেগেছেন প্রেমেন মিত্তির। জীবনানন্দ বাদে অচিন্ত্যকুমার, শামসুর রাহমান, বিরাম মুখো, গোবিন্দ চক্কোত্তি, দীনেশ দাসদেরও হেব্বি বোলবালা। উদিক থেকে আবার স্তবকান্তরে ছন্দান্তর ঘটিয়ে কবিতায় বিরল ছোঁক এনে দিয়েছেন নীরেন চক্কোত্তি। চলছে পঞ্চাশের খেলা। দ্যাখাদেখি কল্যাণ সেনগুপ্ত, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তরাও নেমে পড়লেন আসরে। বিজ্ঞপ্তি দেওয়া শুরু হলো যে 'আচ্ছে দিন' ফিরে আসছে বাংলা কবিতার। যুদ্ধ-দাঙ্গা-দেশভাগ-রিফিউজি সমস্যা কাটিয়ে কবিতার স্বাস্থ্যে রিটার্ন আসছে নুরানি দ্যুতি। শবেবরাত। আখেরি চাহার শুম্বা।
আসলে ঘটনা ছিল বিলকুল উলোট। আসলে চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল। শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।' বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার। আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন। এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন। সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল।
ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা। ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের। তাঁদের ভীতি সাব্যস্ত হয় যখন বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'কে চালিয়ে দেওয়া হয় 'বিবর'-এর ব্রিডিং ক্যাপসুল হিশেবে। অন্যদিকে, কবিতার ক্ষেত্রে, মলয়-শৈলদের ঐ ভয়-পাওয়া কাউন্টার-অ্যাটাক দানা পেয়েছিল শঙ্খ ঘোষের এই শব্দগুচ্ছে : 'আত্ম অস্তিত্বের গূঢ়মূল আবিষ্কার, মৃত্যুর বোধ, অসুন্দর শয়তান আর পাপের ধ্যান একদল কবিকে একটি বিচ্ছিন্ন কুঠুরির মধ্যে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।' এমনকি, সন্ত্রাসের পাল বুদ্ধদেবের হিক্কে-তোলা বোদলেয়রী বাতাবরনকে উচ্ছ্বাসভরে স্বাগত জানিয়ে ফেলেছিল। এতে-করে পঞ্চাশের ল্যাসল্যাসানি ধরা তো পড়েই যায়, চল্লিশের কন্ডোমফোলা ফক্কাবাজিও ফাঁস হয়ে যায় একই লপ্তে।
সাহিত্যের আখড়ায় গোষ্ঠীতন্ত্র নয়াল কিছু নয়। সাহিত্য নিয়ে আড্ডা, হুজুগ আর বাওয়াল যুগে যুগে। সেই কোন ১৯০৫ থেকে পয়লা বিশ্বযুদ্ধের শেষ অব্দি লন্ডনের ব্লুমসবেরি মহল্লার এক থুত্থুড়ে কোঠায় ফি বেস্পতি সাঁঝে জমা হতেন সস্বামী ভার্জিনিয়া উলফ, রজার ফ্রাই, ক্লাইভ বেল, জন মেনার্ড কিন্স, ই এম ফর্স্টার, লিটন স্ট্র্যাচি, ডানকান গ্রান্ট প্রমুখ বুদ্ধিজীবীরা। ইংরেজি সাহিত্যের ইতিহাসে ঐ আড্ডাবাজরা 'ব্লুমসবেরি গ্রূপ' নামে বিখ্যাত। মোটামুটি ঐ ধাঁচেরই ছিল বাংলার বিনয় সরকার, সুনীতি চাটুজ্জে, সতীশচন্দ্র মুখুজ্জেদের 'ডন সোসাইটি'; এবং কিছু পরে প্রেমেন্দ্র-অচিন্ত্য-মানিক-প্রমুখের 'কল্লোল গোষ্ঠী'। যদিও জাতে ও চরিত্রে কিঞ্চিৎ আলাদা, কিন্তু তিনটিই ছিল নিছক আড্ডা-বিশেষ। সাহিত্যের আড্ডা। যা পরবর্তী কালে সাহিত্যের কিছু খাস সামিয়ানায় ঠেক পেতে কলকাতার কফি হাউসে আরও-অঙ্ক-কষে হতো, এবং যা এখন আরো-অন্যভাবে, অন্যত্রও হয়। বুকফেয়ার, নন্দনচত্ত্বরে, ইভন ফেসবুকে এবং ব্লগে। কিন্তু সাহিত্য তথা শিল্পে সেরম বাওয়াল ওরফে মুভমেন্ট যদি কিছু হয়ে থাকে, আমাদের রামায়ণ-মহাভারত-চৈতন্যের লীলাখেলা-সমূহ বাদ দিয়ে, তাহলে তার বিসমিল্লা ধরতে হয় ১৮৩০-এর ফরাসি বোহেমিয়ানদের হুল্লোড় থেকেই। তথাকথিত প্রতিষ্ঠান-বিরোধী আন্দোলনের ঐ ছিল সাড়াজাগানো পয়লা ভেঁপু। এবং পরবর্তী কালে সারা পৃথিবী জুড়ে সেই বিগউল ফোঁকা অব্যাহত থাকে। ফলে, মার্কিন ইন্টেলেকচুয়ালদের মাথায় হঠাৎ 'Angry' ঠাপ্পাটা দেখে তেমন হাসি নির্গত করার কারণ ছিল না বিশুদ্ধবাদীদের। কারণ ঐ মার্কিন অ্যাংরিরা এতখানিই বাগী আর রাগী ছিল যে নিজেদেরকে 'ইন্টেলেকচুয়াল' বলতেও ওরা রীঢ়া বোধ করত। ওরা নিজেদের জাহির করত 'Anti-Intellectual' বলে। আসলে, জ্যাক কেরুয়াক, লরেন্স ফেরলিংগোটি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, গেগরি করসো, ই ই কামিংস, কেনেথ রেকথ, হেনরি মিলার প্রভৃতি আমেরিকান কবি-লেখকদের, তথাকথিত সামাজিক ধ্যানধারণার প্রতি প্ৰচণ্ড রকমের অনীহা ও আক্রোশ থেকে গড়ে ওঠা ঐ গোষ্ঠী নিজেদের জাহির করত 'বিট' বলে। বিট মানে হেরো, পরাস্ত, হতাশ, গাণ্ডু আর এইরকম আরও কিছু। 'অ্যাংরি' কথাটা তো খচমচ করত চল্লিশের দশকের জ্যাজ বাজিয়েদের ঠেকে। তাছাড়া, মোটামুটি ঐ সময়েই ইংল্যান্ডের একদল তিক্ত-বিরক্ত-রাগী লেখক সেখানকার গঙ্গাজলী সাহিত্যকে লাথিয়ে রাতারাতি দাগি হয়েছিলেন 'Angry Young Men' নামে। অ্যাংরিরা ছিলেন জন ওয়েন, জন ব্রেন, কিংসলি অ্যামিশ প্রমুখ। অ্যাংরি আর বিটরা একসময় একটা জয়েন্ট অ্যান্থলজিও বের করে। যে-কারণে ঐ দুই বাওয়াল-পার্টিকে অভিন্ন ভেবে কিছু মানুষ চরম ভুল করেছিল। কিন্তু, ভুল তো ভুলই। আসলে হয়েছিল কি, কেরুয়াকের সুহৃদ হারবার্ট হাংকি তখন কুচেল দুনিয়ায় গহন চলাফেরায় মগ্ন এবং তাঁকে ছিঁচকে চোর, মাস্তান আর মাতাল-গাঁজাখোর বলে চেনানোর জন্যে 'বিট' খিস্তিটা চালু ছিল। এবং, খুব অবান্তর হবে না যদি ধরা হয় কেরুয়াক উক্ত লিংক থেকেই শব্দটা গেঁড়িয়েছিলেন।
এই বিটদের সঙ্গে বাঙালি যুবাদের হাংরি হাঙ্গামাকে গুলিয়ে ফেলার বেওকুফি বা ধাউড়বাজি ঠিক হবে না। আবার 'হাংরি'র স্রোত-সূত্র যে 'ক্ষুধার্ত' বা 'কাঙাল' ---- এটা ঠিক না। কেননা, প্রতিষ্ঠান বিরোধীরা কখনই মার্কামারা হতে রাজি নয়, তারা হামেহাল শেষধাপের জন্য ত্বরায়। আর, ধাপগুলো হলো অবিরাম নিচের দিকে, ঘাস আর মাটির দিকে। 'মার্কা' ব্যাপারটা মৌলবাদের লক্ষণ। প্রতিষ্ঠানের কারকিত। যেমন আমাদের পৌরাণিক নামগুলো। সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবী, জল, বায়ু, শিব, কৃষ্ণ, রাম, সীতা প্রত্যেকেরই হাজারটা করে নাম। পাড়ার মাস্তান থেকে শুরু করে লোকসভার মেম্বার, এঁদের অনেকগুলো করে নাম। যত গুণের ঘাট, তত নামের বাড়। তাছাড়া, এটাও ফ্যাক্ট, যে, ব্যক্তিকে অভিধায়িত করার জন্য যেসব শব্দকলাপ আমাদের চারপাশে ডাঁই করা আছে, এখনও, সবই সেই ব্রিটিশ মাস্টারবেশিয়ানদের নিচুড়ে-যাওয়া বইপত্র, ডিক্সনারি আর আধুনিকতাবাদী বুকনি-বীর্য থেকে হাসিল। আসলে কিন্তু, শেষ বিশ্বযুদ্ধোত্তর দুনিয়ার যে হালচাল, রাজনীতিক-আর্থিক অবস্থা, তাতে সেরকম মর্ডানিস্ট স্পেশেলাইজড ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠার সারবীজ সব পচে-হেজে গেছে। এখন আধুনিকতা ব্যাপারটাই একখানি ধ্রুপদী জোচ্চোর ও ধাপ্পাবাজ।
যাই হোক। বলবার কথা এই, হাঙ্গামার শরিকরাও যেভাবে দাবি করেছেন, ---- হাংরি, আর-পাঁচটা সাহিত্য আন্দোলনের মতোই, পূর্বাপর স্বমেহিত ছিল, তাতে কোনো বাহ্যিক ক্যাটালিটিকের কলকাঠি ছিল না। যে-কারণে এই হাঙ্গামার আবির্ভাব-কালটি বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চাশের শেষে, বিশেষত ষাটের দশকের শুরুশুরুতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্রায় একই ধাঁচে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে ব্যাপক অনাস্থা আর বিক্ষোভ দেখা দেয়। তাদের নিজ-নিজ রাষ্ট্রের শাসনতন্ত্র, সমাজ, চালু ধর্মীয় নীতিকানুন, আর্থিক বন্দোবস্তি আর কালচারাল বাতাবরন তামাম-কিছু ঐ নাগর-যুবাদের কাছে চরম অসহনীয়, সুতরাং পরম ত্যাজ্য ও বর্জনীয় ঠাহর হতে থাকে। প্যারিস, বার্লিন, প্রাগ্ব থেকে বার্কলি, জাকার্তা, কলম্বিয়া, পিকিং ----- বিভিন্ন শহরে, বিশেষ করে কলেজ-ইউনিভার্সিটির ছেলেমেয়েরা প্রবল বাগী ও তোড়ফোড়-প্রবণ হয়ে ওঠে। লিহাজা, বিক্ষোভের ঐ চোনা সাহিত্যের জলকেও লোনা করে ফেলবে, এ তো অতি লাজিম কথা।
বিশেষত, দেশভাগটা বাঙালির সত্যিকারের পাইন মেরে দিয়েছিল। ঐ প্রেক্ষাপটে, যখন নিত্যনতুন মৃত্যুপদ ও ভীতিপদ বাঙালির বত্রিশ ইঞ্চি পোস্তবাটা-বুক ক্ষণে ক্ষণে ভেবড়ে দিচ্ছে, মুহুর্মুহু মূক করে দিচ্ছে আস্ত-একটা বাতেল্লাবাজ জাতিকে, চেতনা সন্ত্রস্ত ও দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে, নালা থেকে ভাত কুড়িয়ে খাচ্ছে অনাহারী নেড়ি ও মানুষের ছা, ------ আমরা তখনও অবিশ্বাস্য নজরে দেখতে পাই হাজার বছরের ঝরঝরে মূল্যবোধগুলো বাঙালির জীবনে নতুন ধারণার পথ দেখাবে বলে, তখনও, রক্তচক্ষু মেলে দাঁড়িয়ে! নতুন শক্তি জীবনকে পথ দেখাতে চায়, তখনও। ঐ রক্তচক্ষুগুলো কাদের?? কোটি কোটি মূক ও মূঢ়ের বেদনাকে মূর্ত ধ্বনিতে তবদিল করতে উঠে আসে অই, কারা??? আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাঙলা মায়ের আনাচ-কানাচ থেকে, অন্ধগলি আর ঘুঁজিপথ থেকে বেরিয়ে আসছে অশিক্ষিত নিরক্ষর অর্ধ-নিরক্ষর ভাঙা-ভাষা ভাঙা-বানানের একগুচ্ছ অন্ত্যজ, অপর, সাব-অলটার্ন, ডায়াসপোরিক ছোটলোক। নপুংসক বুর্জোয়া শ্যাল-কুত্তায় নুচে খাবে বাংলা সাহিত্যকে, তার আগেই টিনের সুটকেশ, ভাঙা মগ, ছেঁড়া পাজামা, নোংরা গেঞ্জি ও বিষ্ঠা-লাঞ্ছিত মুর্দাফরাসের কেরবালা হা-রেরে তরিবতে ধেয়ে এলো বাংলা সংস্কৃতির মূল বিতর্দির দিকে। গোড়ার দিকে এদের পিওর লাথখোর বলে মনে হবে, এদের ভাষা গেঁয়ো আর এদের কথাবার্তা অশ্লীল স্ল্যাং-মাফিক মনে হবে, ---- সেটা একরকম রফা। মৃতের চিতায় অগ্নি-অস্তিত্বের ঐ ছিল পূর্বাভাস।
হাংরি জেনারেশন আন্দোলন ছিল, নাকি হুজুগ? হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা কে? ----- এই দুটি বিতর্ক এত এত দফা এত এত এত ভাবে দলিত মর্দিত ধর্ষিত হয়েছে যে তাকে এখন কেঁদেই বাঁচতে দেওয়া উচিত। বিশেষত দ্বিতীয় প্রশ্নটি। জঙ্গল মে মোর নাচা, কিসনে দেখা? প্রত্যেকে বলে আমি, আমি, আমি। অক্ষরের গোলামি থুয়ে অক্ষরের মালিক হওয়ার সাধ, প্রত্যেকের। তাঁরা মেতে উঠেছেন অন্ধকারে, অহংকারে, ব্যক্তিগত আরোপে, আমিত্বের বহ্বাস্ফোটে। আমি, আমি, আমি। আয়ে গওয়া হরামিয়ন সব, একে মারে যান আফত-মা হ্যায়। ----- বিতর্কটি এখন যেন এই বলছে, কঁকিয়ে, ----- এবং খাবি খেয়ে মরছে।
১৯৬২। 'সম্প্রতি' পত্রিকার থার্ড সংকলনে বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমীক্ষা বেরুল 'হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব' শিরোনামে। লেখক : শক্তি চট্টোপাধ্যায়। অনেকের ধারণা, বাসু-সুভাষ-শৈলরাও খেয়েছিলেন, যে, এই লেখা থেকেই হাংরি জেনারেশন নামের সূত্রপাত। ধারণাটা কিছু বাতাসও পেয়েছিল ১৯৬৪-৬৫ সালে হাংরি মামলায় 'this literary movement was started by me' বলে শক্তির স্টেটমেন্ট জমা পড়ায়। হাংরি গোষ্ঠীর এককালীন গড়িমসি সদস্য সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও নাকি ঐ মর্মে বয়ান রুজু করেছিলেন। কিন্তু শক্তির এ লেখা তো বেরিয়েছিল বাষট্টি সনে; অথচ, ১৯৬১ সনের নভেম্বর-ডিসেম্বরেই ছেপে গিয়েছিল 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের ইস্তেহারটি, তাতে বার্জাস টাইপে পরিষ্কার ছাপা হয়েছিল : স্রষ্টা মলয় রায়চোধুরী, নেতা শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক দেবী রায়।
আসলে, পরে জানা যায়, হাংরি জেনারেশন ছিল এমনই এক চ্যাংমাছ, কারো একার মুঠোয় বেশিক্ষণ ধরা থাকেনি। হাঙ্গামার ধূসর সূচনালগ্নের আরেক শরিক, বিলেত-রিটার্ন কলেজ-প্রভাষক উৎপলকুমার বসু পরবর্তীতে (১৯৯৪) জানালেন : "হাংরি জেনারেশন সেভাবে কোন সংগঠিত আন্দোলন ছিল না। যার খুশী, যেখান থেকে পারে হাংরি জেনারেশন নাম দিয়ে বুলেটিন বের করে বাজারে ছেড়ে দিত। এই আন্দোলন ছিল অনিয়ন্ত্রিত। কতকগুলো ফতোয়া মলয় সমীর শক্তি লিখেছিল। এগুলোর নিচে অনেকের নাম বসিয়ে দেয়া হ'ত। বহু ক্ষেত্রেই যাদের নাম দেওয়া হচ্ছে তাদের জিজ্ঞাসাও করা হঁ'ত না। ..... হাংরিদের সেভাবে কোন কাগজও ছিল না। হয়ত ত্রিপুরা থেকে একটা কাগজ বেরল, নাম দিয়ে দিল ---- হাংরি জেনারেশন বুলেটিন নম্বর ১২। হয়ত তার ১০ বা ১১ বেরোয়নি।"
আসলে, ১৯৬২-৬৩ সনে পশ্চিম বাংলার সাহিত্যে এই বাওয়ালমুখী পালাবদলের তীব্র চাগাড়ে দুটি প্রধান উপ-কেন্দ্র গড়ে উঠেছিল কলকাতা শহরের বুকে। একটি কেন্দ্রের মধ্যমণি ছিলেন বাসুদেব দাশগুপ্ত, শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী এবং সুবো আচার্য। অপর কেন্দ্রে ছিলেন মলয় রায়চোধুরী, সমীর রায়চোধুরী, দেবী রায় এবং সুবিমল বসাক। উভয় কেন্দ্রের সদস্যরাই, কমবেশি, তথাকথিত ছোটলোক, গরিব আর অশিক্ষিত ফ্যামিলি থেকে আগত। এবং প্রত্যেকের বয়স ছিল বিশ-পঁচিশের কোঠায়। যে-বয়সে যত আলো পড়ে, তত ভয় কমে। উপকেন্দ্র যেহেতু দুটি, সুতরাং দু-রকমের হাংরি বাওয়াল শুরু হয়েছিল। একটা, শৈল-বাসু-সুভাষদের বস্তি-কলকাতার 'ছোটলোকি' বাওয়াল; এখানে যে-দলের নাম দেওয়া যাক হাংরি -- 'এ' গ্রূপ। অন্যটা মলয়-সুবিমলদের ডায়াসপোরিক বাওয়াল, অর্থাৎ 'বি'-গ্রূপ। দ্বিতীয় গ্রূপের সর্বময় কর্তা ছিলেন পাটনার ছোটলোক আর কুচেল অধ্যুষিত দরিয়াপুর মহল্লার নামচিন ষ্টুডিওঅলা রঞ্জুবাবুর ছোটছেলে বিশ বছরের ফনকু ওরফে ফনা, অথবা ইমলিতলার মুল্লু খান ওরফে মলয় রায়চোধুরী, সেটা জোরও ধরেছিল মলয়ের জোরদার ইস্তেহারি ভাষার চটকে, অপেক্ষাকৃত বেশি; আর, তাঁদের সে-টিমও ছিল বেশ ভারি। বহু পুরনো জ্ঞানপাপী সে-দলে ভিড়েছিল। 'এ' গ্রূপ এই 'বি' গ্রূপের নাম দিয়েছিল 'চুলকে দেওয়া হাংরি জেনারেশন'। প্রথম গ্রূপটি মলয়কে 'মফসসলের অজ্ঞাত গাড়োল' বলেও চালাতে চেয়েছিল ব্যক্তিগত আক্রোশবশত। তাঁরা, প্রত্যেকে ছিলেন, কেউ কেউ ছদ্মভাবে, মলয়ের বিরোধীপক্ষ। বিশেষত আশির দশকে পুনরুত্থিত মলয়ের নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে চালানো, কিছু-কিছু ক্ষেত্রে তাঁর ইতিহাস-বিকৃতি এবং মাত্রাতিরিক্ত আত্মপ্রচারে দাগা পেয়েই প্রথম গ্রূপটির গোসা ধরতামাশি পেয়েছিল এবং তাঁরা পাগলের মতো ক্ষেপে উঠেছিলেন। সুতরাং প্রথম দলটির ঐ পাঁচ শরিক যাঁরা আন্দোলন-চলাকালীন, ষাটের দশকে যা নিয়ে একেবারেই মাথা ঘামাননি, আশি ও তৎ-পরবর্তী পিরিয়ডে মলয়ের মতই, নিজেদেরকে 'হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা' হিশেবে প্রচার করা শুরু করে দেন। দায়িত্ব না নিয়ে একটু হাস্যচ্ছলে বলি, হাংরি লেখকদের মধ্যে কেউ আধুনিকতাবাদীদের মতো 'ডক্টরেট' ছিলেন না, ----- সাহিত্য, ইতিহাস, দর্শন, মনোবিজ্ঞান কোন কিছুতেই একজনও 'উলেমা' ছিলেন না বলে এহেন পারস্পরিক কাদাহোলি। আমি কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কুম্ভলস চাই না, অতএব কোন্দলটি এড়িয়ে যাচ্ছি।
এ-কথা ঠিক যে হাংরি কোন ইজম ছিল না। ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া। আরও বলতে পারি, একটা ঘটনা, বাংলাভাষায় সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূল ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল এক ঢেউ, উঠে এসে, আছড়ে পড়েছিল এজি-গোয়িং সাহিত্যের ল্যাসলেসে মসৃণ চত্ত্বরে। সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলা সাহিত্যের লিরিকফুলের বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনো-অব্দি একলোতা বৈপ্লবিক সমীহা।
('হাংরি সাহিত্যের সংগ্রহশালা' থেকে)
Comments
Tanumay Goswami
Tanumay Goswami আবারও পড়লাম l আরো কিছু নতুন আবিষ্কার l বাষ্পপুঞ্জ ঘিরে ধরা ইতিহাসে নতুন করে আলো পড়লো এই লেখার মাধ্যমে l

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন