বৃহস্পতিবার

হাংরি আন্দোলনের কবি অরুণেশ ঘোষ : তৈমুর খান

                                                                          


আদি প্রজ্ঞার বহুমুখী দরজা খুলেছেন অরুণেশ ঘোষ
– তৈমুর খান


এক প্রজ্ঞার কাছে মাথা নত হয়ে আসে আমার। যে প্রজ্ঞা অকপট আদিম প্রবৃত্তির অনুজ্ঞা থেকে উৎসারিত সমগ্র জীবনপ্রবাহে সঞ্চারিত হয়ে চলেছে। যে প্রজ্ঞায় সভ্য অসভ্য বলে কিছু নেই। যে প্রজ্ঞায় মানুষ পশুতে পার্থক্য থাকে না। যে প্রজ্ঞায় অরণ্যচারী ও নাগরিক জীবনকে সমানভাবে সম্মোহিত করে। কবি অরুণেশ ঘোষ সেই প্রজ্ঞারই দেখা পেয়েছিলেন।

অরুণেশ ঘোষ (১৯৪১—২০১১) উত্তরবঙ্গের কোচবিহার জেলার ঘুঘুমারিতে বসবাস করতেন। কবি খ্যাতি বা প্রতিষ্ঠা পাওয়ার কোনোদিন তোয়াক্কা করেননি। ২০ টিরও বেশি কাব্য নাকি তাঁর প্রকাশিতও হয়েছিল। আমরা শুধু ‘শব ও সন্ন্যাসী’ (১৯৮১) কাব্যটির নাম শুনেছিলাম। আরও কতকগুলি সংকলন হল : ‘অগ্রন্থিত কবিতা’ (১৯৬২ —১৯৮৪), ‘গুহামানুষের গান’ (১৯৮৫), ‘বিপথিক’ (১৯৯৫), ‘কালকবীরের দোঁহা’ (২০০০) ইত্যাদি।

কবি তাঁর সৃষ্টিক্ষমতায় যে অন্তঃশক্তির কাছে বারবার আমাদের নিয়ে গেছেন তা হল লিবিডো। লিবিডোর মুক্তিতেই ব্যক্তি অস্মিতের স্ফুরণ ঘটে। সব সৃষ্টির মূলেই আছে এই লিবিডো। বিখ্যাত ইংরেজ ঔপন্যাসিক অন্টোনি বার্গেস (১৯১৭—১৯৯৩) এই কারণেই বলেছেন : “I think art is sublimated libido. You can’t be eunuch priest, and you can’t be a eunuch artist.” অরুণেশও একথা বিশ্বাস করেন বলেই কবিতাগুলিতে বারবার আছড়ে পড়ে লিবিডোর তরঙ্গ। কবি একে দেখেই উপলব্ধি করেছিলেন মানবসভ্যতাকে। সভ্যতার বেশ্যা রূপকে। যা খুবই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী। ‘শহর, বেশ্যা ও বাবুদের বাড়ির ছেলে’ কবিতায় তিনি লিখেছেন —

“ঢেউকে দাবিয়ে রাখা, ফুলে ওঠা প্রবল ও বিশাল ঢেউ
পায়ের তলায় প্রতিটি সভ্যতার আবর্জনা, প্রতিটি হাহাকারের
ওরে শহর, ঘেয়ো ও উন্মাদ শহর তোকেও দাঁড়িয়ে দেখে নিতে হবে
সন্ত্রস্ত আত্মার এই ঝাঁপিয়ে পড়া, দেয়ালে হেলান দিয়ে
এগিয়ে দেওয়া শরীর
কোমরের ওপর তুলে নেওয়া শায়া ও শাড়ি
দেখে নে এই শতাব্দীর বাকল ওঠা আর ভেঙে পড়া
হাড়গোড়ের পাশে ও ভেতরে দাঁড়িয়ে কাজ সেরে নেওয়া”

একদিকে সভ্যতার জীর্ণ ধ্বংস রূপ, অন্যদিকে মোক্ষম যৌনাচার একে তো কখনোই অস্বীকার করা যায় না। প্রবৃত্তির ঘুমন্ত সত্তা তো মুক্তি চায়। এই মুক্তি তথাকথিত ‘ভালো মানুষত্ব’ থেকে মানবীয় প্রজ্ঞার অনন্ত মুক্তি। যখন অবচেতনের শেকড়েও এই বোধের ব্যাপ্তি কবি উপলব্ধি করেন, তখন স্বপ্নসম্ভবকেও ডিঙিয়ে যায় তার বিস্ময়ের ধারণ ক্ষমতা। প্রাণীর মধ্যেও তা সঞ্চারিত হয় —

“আশ্রয় দেবার ছলে তাকে ধর্ষণ করেছিল, একঝাঁক সাদা ইঁদুরের মধ্যে থেকে সে আমার দিকে কাতর চোখে তাকিয়ে আছে, তার চোখের মণি…. এক সময় ইঁদুরেরা আমার লিঙ্গ দাঁতে কেটে নিয়ে রূপসি পানউলির দিকে এগিয়ে গেল।” (ইঁদুরেরা)

আগুন রূপকের মধ্যেও এই প্রবৃত্তির পরিব্যাপ্তি লক্ষ করা যায় —
“এখানে আগুন, যশোমতী হাসছেন, তার গর্ভের শিশুও পুড়ে যাচ্ছিল আগুনে, ভেতরটা পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছিল,
যোনিদ্বার দিয়ে বে বেরিয়ে এল অগ্নিশিখা, ঠোঁট পুড়ে গেল, স্তন ও চোখের মণিদুটো, কোটরে আগুন, ঘাড় গুঁজে টিয়াও পড়ছিল।” (পুড়ে যাচ্ছে মাতৃসদন)

এই দহনের রূপ থেকে কেউ রেহাই পায়নি। কখনোই পায় না। এযুগের বিখ্যাত দার্শনিক, সমাজ চিন্তক, গ্রাফিক্স ডিজাইনার, লেখক দক্ষিণ আফ্রিকার মোকোকোমা মোখোনোয়ানা বলেছেন : “Morals are nothing but a civilized society’s attempt to tame some beast called man.” নৈতিকতাবিহীন হয়েও সভ্যতায় মানুষ গৃহপালিত জীবনযাপনে অভ্যস্ত। এটা তো মুক্তি নয়। তাই আগুন বা কাম দেহ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ে আদি প্রজ্ঞানের অসীমলোকেও। কিছুতেই এর ব্যত্যয় ঘটে না। তাই বেশ্যা পাড়ার আলো-অন্ধকারকেই কবি সভ্যতার পথ ভাবতে পারেন। বেশ্যারাই যেন সভ্যতাপিয়াসী জীবনের স্বপ্নবারুদ। কবির বর্ণনায় চমৎকারভাবে তা উঠে এসেছে —

“তোমার ঊরু ও স্তনের স্মৃতি ও বিস্মৃতির মধ্যে দিয়ে রোদ ও বাতাস
তোমার শরীরের মধ্যে দিয়ে রোদ ও বাতাস চলে আসে
একমুঠি শুভ্রতার মধ্যে ঘুরপাক খায় হাওয়া, খেলা করে
খেলা করে আর খেলা করে আর সুড়সুড়ি দেয়
রোদ ছড়িয়ে পড়ে আর প্রসারিত হয় আর ঝুঁকে পড়ে
ছোট্ট ঢিপির মতন রোমশ যৌনাঙ্গে তোমার…”
(উত্তরের বুড়ি বেশ্যার দিকে আমার এই বন্দনা গান)

‘বেশ্যা’ শব্দটিতে যুবতী ও বৃদ্ধার কোনো পার্থক্য কবি করেননি। কারণ সভ্যতাচারী প্রাণীর আবহমান instinct-কেই তুলে আনতে চান। যা সব অস্তিত্বের মধ্যেই বিরাজমান। কারণ এর যেমন ক্ষয় নেই, তেমনি অস্বীকারও নেই। একে সঙ্গে নিয়েই সমীহ ও সম্মোহন একই সঙ্গে চলতে থাকে —

ক. আমি মাথা নীচু হয়ে প্রণাম করেছিলাম বেশ্যাকে
খ. আমি চুম্বন করেছি তার তলপেটে

কবি বয়সের তফাতে যতদূর যার কাছেই গেছেন, প্রবৃত্তির ব্যাপ্তি জন্মান্তরের ঘুরপথে তাঁকে আদিসত্তায় পৌঁছে দিয়েছে। তাই বেশ্যার মা, মাতামহী যেই হোক না কেন তার সেই নির্জ্ঞান ব্রহ্ম রূপটিতেই এসে উপস্থিত হয়েছেন। চেতনা প্রবাহের সেই তত্ত্ব থেকেই আত্মাজাগরণের ঘোর বিবমিষাকে আমরা উপলব্ধি করতে পেরেছি। সভ্যতার আদি থেকে অন্তহীন প্রজ্ঞায় সেই নিবিড় সঞ্চার। মাতামহীও তখন কিশোরী —

“পোশাকবিহীন, বিবসনা কিশোরী সে। নরম ব্যাঙের ছাতার মতন স্তন, তার যোনি ছুঁয়ে প্রণাম করলে দিয়েছিল আমাকে টাটকা পদ্মের পাপড়ি।’’

তারপর কবি আরও লিখলেন—
“চুম্বন করে সংগমে আবদ্ধ হয়েছি সেই ন্যাংটো কিশোরীর সঙ্গে। ঘুমে ভিজে উঠেছে তার শরীর।
সে পেচ্ছাপ করেছে আমার রুমালে। লিচু খাওয়ার পর বাচ্চা মেয়ের মুখ মুছিয়ে দেওয়ার মতন মুছিয়ে দিয়েছি তার কোমল যোনিদেশ। এরকমভাবে সমস্ত দরজা খুলে গিয়েছে আমার কাছে।’’ (নারীকে — ক্রুশকাঠের দিকে)

এইভাবেই সমস্ত দুয়ার খুলে দিয়েছেন কবি— আমাদের জীবনের সেইসব আদিম বহুমুখী পর্যায়ের দরজাগুলি। কিন্তু আশ্চর্য, সব দরজাতেই লিবিডোর নির্ণীত ফোকাস। প্রাকৃতিক উপমাগুলিতেও এই লিবিডোর সংকেত বাহিত হয়ে চলেছে। সভ্যতাকে দেখে তাই মনে হয়েছে—
“জেগে উঠেছে ঘুমন্ত বেশ্যার শরীর আর শহর’’।

তবে এই শরীরে ক্ষত ও রক্ত দেখা গেছে। সেখানে হিংসা ও ধ্বংস যেমন আছে, তেমনি ঘাস ও ফুলের লালও। একদিকে কদর্যতা, অন্ধকার, অন্যদিকে কমলালেবুর বাগান ও। খাঁ খাঁ শূন্য ও সারবদ্ধ, বিশৃঙ্খল— তবু ভালোবাসার হাত টেনে নিয়েছে তার অমোঘ আশ্রয়ে। ‘সহজ সরল আত্মা উঠে গেছে শান্ত ও সাকার ‘ অসহায় ও উদাসীন। কবির প্রশ্ন —
“এ কোন্ যোনি…? দিব্য?…. ব্রহ্ম? কেন মাংসল লালাভ?
কেন পাপড়ির মতো মেলে ধরেছে প্রতিটি স্তর ও শূন্যতা?’’

মহাপৃথিবীর অন্বয়টি হয়তো এখানেই মহাজীবনচক্রে পাক খেয়ে ধাবিত হয়ে চলেছে। সুতরাং খণ্ডিত নয়, অখণ্ডিত অবিরাম এই শাশ্বত বিন্যাসকেই কবি ইংগিত করেছেন। যৌনতা শরীর থেকে মহাশরীরে তার ব্যাপ্তির প্রাচুর্য নিয়ে এগিয়ে চলেছে। ছিটকে পড়া সত্তাগুলিতে তারই খণ্ড খণ্ড মায়া প্রতিফলিত হয়েছে। ‘গুহামানুষের গান’ থেকে তা যেমন তার জাগরণ সূচিত করেছে, তেমনি ‘কালকবীরের দোঁহা ‘য়ও তা বহুবর্ণ রূপ প্রসারিত করেছে। কবি লিখেছেন—
“নিষিদ্ধ ভেঙে আবার আকাশ — সেইসব উন্মাদ আত্মা এসে
কলরোল তোলে : শেষ নয়, শেষ নয়, প্রতিহিংসা নয়, আরও কিছু বাকি আছে…’’ (উন্মাদাগার)
তেমনি বলেন —
“মন্দিরের ভিত ছিল রাত্রি দিয়ে গড়া
অধর্মের জয় হাসে নগ্ন সসাগরা’’
(৩৯ নং কালকবীরের দোঁহা)

আমরা এই সভ্যতারই কলরোলে নগ্ন সসাগরায় সভ্যতাচারীর প্রবাহে ভেসে চলেছি । প্রান্তিক জীবন থেকে সর্বব্যাপী জীবনের মূল ধারাকে অন্বিত করার মধ্যে দিয়েই আমাদের এই জীবনচক্র। এখানে সবাই সমন্বিত, সবাই কষ্ট ও ক্ষতকে নিয়ে লালিত। প্রগাঢ় বিষাদে পর্যুদস্ত। এর মধ্যেই যখন আমরা শুনি—
“আমি আছি আমি আছি’’
তখন আর্তুর ব়্যাঁবোর (১৮৫৪ —১৮৯১) কথাই মনে পড়ে যায়—
“I believe I am in Hell, therefore I am.’’
এই থাকার মধ্যেই আমাদের ঘোষণা যা কবিতা রচনায় বারবার প্রমাণিত হয়ে চলেছে।



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন