প্রশ্ন – সাহিত্যে নিষিদ্ধতা বলতে আপনি কী বোঝেন?
সুবিমল বসাক – সাহিত্য আমরা দু’ভাবে দেখি – একটা সিদ্ধ, একটা নিষিদ্ধ। সিদ্ধ মানে যেটা চলে আসছে কোনো বাধা ছাড়াই, আর নিষিদ্ধ মানে যেটা সহজভাবে কেউ গ্রহণ করছে না। আমাদের মামলা-মোকদ্দমার সময় জেনেছি, হাইকোর্টে ‘নিষিদ্ধ’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। এমন বহু শব্দ আছে, যেগুলো সকলের সামনে উচ্চারণ করা যায় না। অবসিনিটি বা নিষিদ্ধতা শুধু লেখার ওপরেই নয়; ছবি, দৃশ্য সবকিছু মিলিয়েই। সকলের সঙ্গে, গোটা পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না এমন দৃশ্য। যেগুলি শরীর, মন, চেতনা সব মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। সেই নাড়া’টা নিশ্চই ভালো নয়, তাই সেটা নিষিদ্ধ হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ’ বলতে, এককথায়, যেটার সম্মুখীন আমরা সচরাচর হই না। এই ব্যাপারটা পূর্বপুরুষেরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সচরাচর কোনো কথা, কোনো ব্যবহার, কোনো বিষয়, কোনো পরিবেশ যখন দেখি আমাদের সংস্কারের সঙ্গে মিলছে না, তখন সেটাকে নিষিদ্ধ বলি। কিন্তু কবিতায় বা গদ্যের কোনো শব্দ, যেটাকে বলা হচ্ছে অশ্লীল, অথচ যেটা জীবনের সত্য, সেইসব শব্দের ব্যবহার আগেকার যুগে যে চলেনি তা নয়; সংস্কৃত সাহিত্যে দেখা যেত, কিন্তু সেটা ছিল অনেক ওপরতলার ব্যাপার; অর্থাৎ আগে সংস্কৃত পড়তে হত, তার অর্থ বুঝতে হত। কিন্তু এখন বাংলায় লিখলে, লোকে যেহেতু পড়তে পারে, বুঝতে পারে, সেই কারণে নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে চিহ্নিত করে নেয় তাদের মতো করে।
একটা লেখা যখন সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়, তাতে শ্লীল-অশ্লীল কোনো ব্যাপারই নয়। তখন সাহিত্য ওপরে উঠে আসে, বাকি বিষয়গুলো চলে যায় বাইরে।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের ধারণা, মূলবোধহীন কয়েকটি যুবক শুধুমাত্র নাম কেনার উদ্দেশ্যে লেখায় ভালগারিটি নিয়ে এসেছিল। সত্যিই কি তাই?
সুবিমল বসাক – যে সাহিত্যধারাটা চলে আসছিল, তার বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা দেয়ার দরকার ছিল। সেটাই আমরা করেছি। কিন্তু নাম কামাবার কোনো ব্যাপার ছিল না। আসলে আমাদের আগেকার লোকেরা কিছুটা হয়তো আমাদের চেপে রাখতে চেয়েছিল। তাই এইসব প্রচার।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনারা যদি যুক্ত না থাকতেন, তাহলে আজ আপনাদের যে পরিচিতি, এতটা ছড়ানো সম্ভব হত?
সুবিমল বসাক – একদিক দিয়ে প্রশ্নটা ঠিকই। হাংরি আন্দোলন আমরা কয়েকজন মিলে করেছিলাম। তখন যে সমস্ত লেখা হয়েছিল, সেটা তো প্রচলিত সাহিত্যধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষার ব্যবহার, বিষয় – সবক্ষেত্রেই। অথচ অনেকে বলে, ‘ওরা তো হাংরি লেখক!’ যেন লেখালিখি ছেড়ে অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত! কিন্তু আমাদের লেখা আজও, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, বলুক কেউ, ওই ধরণের লেখা আর কোথায় হচ্ছে? এখনও কেউ হাংরিদের লেখা নিয়ে এগিয়ে যাক না! বারণ তো করছে না কেউ! তখনকার সাহিত্যসমাজ আমাদের চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে আমাদের লেখা কারোর হাতে না পড়ে, কেউ জানতে না পারে যে এইধরণের আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পড়েছে। লুকিয়ে হলেও।
প্রশ্ন – নিষিদ্ধ শব্দের সমাহার ও নিষিদ্ধ উত্তেজনা পাওয়ার ট্রেন্ড থেকেই কি লুকিয়ে পড়ার প্রবণতা আসছে তাহলে?
সুবিমল বসাক – তাহলে তো সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যকেই ফেলে দিতে হয়! তা নয়। লোকের মনে একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়ে গেছে যে, হাংরিদের লেখা মানেই কয়েকটা গালাগাল, কয়েকটা অশ্লীল শব্দ থাকবেই। ফলে পরিস্থিতিও এরকম দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায় এঁদের লেখায় তো অশ্লীল শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। ওঁরাও তো হাংরি বলেই পরিচিত!
হাংরি জেনারেশনে ক’জন ছিল আর? চার্জশিট হয়েছিল মোটে বারো জনের নামে। এই বারো জনই সমস্ত সাহিত্যটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন – সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ এলেই কি তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়?
সুবিমল বসাক – তা কেন হবে? একজন কবি কেন নিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ’ মনে করতে যাবে? তাহলে তো সে লিখবেই না! তার কাছে সেটা নিষিদ্ধ নয় বলেই তো সে লিখেছে। বিনয় মজুমদারের ‘বাল্মীকির কবিতা’র কথায় ধরা যাক। ওগুলো যদি উনি নিষিদ্ধই মনে করতেন, তাহলে ছাপতে দেবেন কেন? রেখে দিতেন নিজের কাছে!
তখন, ’৬৫ সালে বিতর্ক উঠেছিল, এখন তো সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছে। মলয় তো যৌনতার ব্যবহার নিয়ে নানাভাবে লিখছে। ভাবাই যায় না, ওভাবেও লেখা সম্ভব! যৌনতা তো একটা সাবজেক্ট…
প্রশ্ন – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য কি হাংরিদের হাত থেকে বেরিয়েছি্ল?
সুবিমল বসাক – কালোত্তীর্ণ কী? কে ওটা তৈরি করেছে, সেটাও তো বলতে হবে! আন্দোলনের সময় তো আমাদের চেপে রেখেছিল। উঠতে দেয়নি, গালাগাল দিয়েছিল। নিশ্চই ভয় পেত। নইলে তারা এরকম করবে কেন? বিনয় মজুমদারের বয়েই গেছে, তিনি সমস্ত খবরের কাগজ’কে লাথি মেরে চলে গেছেন। কিন্তু তিনিও তো লিখে গেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হবে, নিশ্চই হবে। শুধুমাত্র খবরের কাগজে কালোত্তীর্ণ হলেই সব হয় না। কত লেখা পড়ে আছে, অনেক বামপন্থী লেখক ছিলেন, যাঁদের কোনো সংকলনেই ঢোকানো হয়নি। সেটার বিচার করবে কে? সম্পাদক? এমন অনেক লেখক আছেন, যারা জীবদ্দশায় পাত্তা না পেলেও পরে লোকে খুঁজে খুঁজে পড়েছে তাঁদের লেখা।
প্রশ্ন – আপনি হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গদ্যকার। আপনার লেখায় যৌনতা কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – সেটা পাঠকই বলতে পারবে। লেখক হিসেবে আমার কাছে যৌনতার আলাদা কিছু তাৎপর্য নেই। যেমন ডাল-ভাত-জল খাচ্ছি, তেমনি যৌনতাও এসেছে। যেখানে যেখানে আসার, সেখানেই। তার জন্য আলাদা কোনো প্যারা খরচ করতে হয়নি আমায়। যৌনতা অনেকে ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করে। আজকালকার সিনেমায় দেখা যায় সেটা।
‘বিবর’ লেখার জন্য সমরেশ বসু’কে প্রায় বয়কটই করা হয়েছিল। কিন্তু ‘বিবর’ না লিখে ওঁর কোনো উপায় ছিল না। কারন বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছিল হাংরিদের দৌলতে। ওইসময় সেক্স নিয়ে যত হইচই হয়েছিল, এখন কিন্তু তা নয়! এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু।
প্রশ্ন – গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি জাতি এত সহনশীল হয়ে গেল কীভাবে, যাতে সবকিছুই স্বাভাবিক হিসেবে ধরা দিচ্ছে?
সুবিমল বসাক – প্রধান কারণ বিদেশী প্রভাব। এই যে মেয়েরা জিন্স পড়ছে, টপ পড়ছে, অনেকসময় খোলাই প্রায়; এই বিষয়টা এতই চোখ সয়ে গেছে যে এখন আর গোপন বলে কিছু নেই প্রায়। অনুসন্ধিৎসা নেই। মেয়েরা নানারকম কথাও বলছে, পাবলিক প্লেসে, যেগুলো আগে কখনো ভাবাও যেত না। কাজেই আগে মানুষের যে মুখোশ পরে থাকার ব্যাপারটা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।
প্রশ্ন – মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কবিকে জেলেও যেতে হয়েছিল। আপনার চোখে কবিতাটি কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – পুলিশ কেস দাখিল করেছিল অশ্লীল শব্দ, বিষয় ইত্যাদির অভিযোগ দেখিয়ে। শক্তি, সন্দীপন, শৈলেশ্বর, সুভাষ এরা বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিয়েছিল। আমার এখনও কবিতাটা নিষিদ্ধ মনে হয় না, তখনও হয়নি। সে সময়কার কবিতার জড়তা’কে একটা আঘাত দিয়েছিল মলয়। ও যে লিখেছে – “কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”, এই প্রশ্নটা তো অশ্লীল কবিতা লেখার উদ্দেশ্যে নয়; ওর নিজের প্রচণ্ড একটা জিজ্ঞাসাই ওকে দিয়ে লিখিয়েছে। তবু অশ্লীল! এটা সংস্কৃতে লিখলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হত। আর ইংরাজিতে লিখলে তো কথাই নেই…
প্রাচীন মন্দিরগুলোয় যেসব মিথুনমূর্তি আছে, সেগুলো’কে কী বলা হবে তাহলে? ভগবান সবই করতে পারে? খাজুরাহো মন্দিরে একটা ন্যুড মূর্তি আছে, সেটার বিশিষ্ট অঙ্গে হাত বুলোতে বুলোতে কালো করে দিয়েছে সবাই।
প্রশ্ন – আপনি কি আপনার লেখালিখি পরিবারের সঙ্গেও শেয়ার করে নিতে সমান সাবলীল?
সুবিমল বসাক – তাদের মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা তাদের ব্যাপার। আমার লেখা, আমার মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা আমার ব্যাপার। তাদের ইচ্ছে হলে পড়বে, না হলে পড়বে না। পরিণত বয়সে কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
(‘আঙ্গিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত)
সুবিমল বসাক – সাহিত্য আমরা দু’ভাবে দেখি – একটা সিদ্ধ, একটা নিষিদ্ধ। সিদ্ধ মানে যেটা চলে আসছে কোনো বাধা ছাড়াই, আর নিষিদ্ধ মানে যেটা সহজভাবে কেউ গ্রহণ করছে না। আমাদের মামলা-মোকদ্দমার সময় জেনেছি, হাইকোর্টে ‘নিষিদ্ধ’ বলতে ঠিক কী বোঝায়। এমন বহু শব্দ আছে, যেগুলো সকলের সামনে উচ্চারণ করা যায় না। অবসিনিটি বা নিষিদ্ধতা শুধু লেখার ওপরেই নয়; ছবি, দৃশ্য সবকিছু মিলিয়েই। সকলের সঙ্গে, গোটা পরিবারের সঙ্গে বসে দেখা যায় না এমন দৃশ্য। যেগুলি শরীর, মন, চেতনা সব মিলিয়ে অদ্ভুতভাবে নাড়া দেয়। সেই নাড়া’টা নিশ্চই ভালো নয়, তাই সেটা নিষিদ্ধ হয়েছে। ‘নিষিদ্ধ’ বলতে, এককথায়, যেটার সম্মুখীন আমরা সচরাচর হই না। এই ব্যাপারটা পূর্বপুরুষেরা আমাদের ওপর চাপিয়ে দিয়েছেন। সচরাচর কোনো কথা, কোনো ব্যবহার, কোনো বিষয়, কোনো পরিবেশ যখন দেখি আমাদের সংস্কারের সঙ্গে মিলছে না, তখন সেটাকে নিষিদ্ধ বলি। কিন্তু কবিতায় বা গদ্যের কোনো শব্দ, যেটাকে বলা হচ্ছে অশ্লীল, অথচ যেটা জীবনের সত্য, সেইসব শব্দের ব্যবহার আগেকার যুগে যে চলেনি তা নয়; সংস্কৃত সাহিত্যে দেখা যেত, কিন্তু সেটা ছিল অনেক ওপরতলার ব্যাপার; অর্থাৎ আগে সংস্কৃত পড়তে হত, তার অর্থ বুঝতে হত। কিন্তু এখন বাংলায় লিখলে, লোকে যেহেতু পড়তে পারে, বুঝতে পারে, সেই কারণে নিষিদ্ধ ব্যাপারটাকে চিহ্নিত করে নেয় তাদের মতো করে।
একটা লেখা যখন সাহিত্যে উত্তীর্ণ হয়, তাতে শ্লীল-অশ্লীল কোনো ব্যাপারই নয়। তখন সাহিত্য ওপরে উঠে আসে, বাকি বিষয়গুলো চলে যায় বাইরে।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে অনেকের ধারণা, মূলবোধহীন কয়েকটি যুবক শুধুমাত্র নাম কেনার উদ্দেশ্যে লেখায় ভালগারিটি নিয়ে এসেছিল। সত্যিই কি তাই?
সুবিমল বসাক – যে সাহিত্যধারাটা চলে আসছিল, তার বিরুদ্ধে একটা ধাক্কা দেয়ার দরকার ছিল। সেটাই আমরা করেছি। কিন্তু নাম কামাবার কোনো ব্যাপার ছিল না। আসলে আমাদের আগেকার লোকেরা কিছুটা হয়তো আমাদের চেপে রাখতে চেয়েছিল। তাই এইসব প্রচার।
প্রশ্ন – হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে আপনারা যদি যুক্ত না থাকতেন, তাহলে আজ আপনাদের যে পরিচিতি, এতটা ছড়ানো সম্ভব হত?
সুবিমল বসাক – একদিক দিয়ে প্রশ্নটা ঠিকই। হাংরি আন্দোলন আমরা কয়েকজন মিলে করেছিলাম। তখন যে সমস্ত লেখা হয়েছিল, সেটা তো প্রচলিত সাহিত্যধারার থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভাষার ব্যবহার, বিষয় – সবক্ষেত্রেই। অথচ অনেকে বলে, ‘ওরা তো হাংরি লেখক!’ যেন লেখালিখি ছেড়ে অন্যান্য ব্যাপারের সঙ্গে যুক্ত! কিন্তু আমাদের লেখা আজও, পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল, বলুক কেউ, ওই ধরণের লেখা আর কোথায় হচ্ছে? এখনও কেউ হাংরিদের লেখা নিয়ে এগিয়ে যাক না! বারণ তো করছে না কেউ! তখনকার সাহিত্যসমাজ আমাদের চেপে রাখার চেষ্টা করেছিল, যাতে আমাদের লেখা কারোর হাতে না পড়ে, কেউ জানতে না পারে যে এইধরণের আন্দোলন হয়েছে। কিন্তু পড়েছে। লুকিয়ে হলেও।
প্রশ্ন – নিষিদ্ধ শব্দের সমাহার ও নিষিদ্ধ উত্তেজনা পাওয়ার ট্রেন্ড থেকেই কি লুকিয়ে পড়ার প্রবণতা আসছে তাহলে?
সুবিমল বসাক – তাহলে তো সমস্ত সংস্কৃত সাহিত্যকেই ফেলে দিতে হয়! তা নয়। লোকের মনে একটা কনসেপ্ট তৈরি হয়ে গেছে যে, হাংরিদের লেখা মানেই কয়েকটা গালাগাল, কয়েকটা অশ্লীল শব্দ থাকবেই। ফলে পরিস্থিতিও এরকম দাঁড়িয়েছে। কিন্তু বাসুদেব দাশগুপ্ত, দেবী রায় এঁদের লেখায় তো অশ্লীল শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। ওঁরাও তো হাংরি বলেই পরিচিত!
হাংরি জেনারেশনে ক’জন ছিল আর? চার্জশিট হয়েছিল মোটে বারো জনের নামে। এই বারো জনই সমস্ত সাহিত্যটাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল।
প্রশ্ন – সাহিত্যে যৌনতার প্রসঙ্গ এলেই কি তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়?
সুবিমল বসাক – তা কেন হবে? একজন কবি কেন নিজের লেখা ‘নিষিদ্ধ’ মনে করতে যাবে? তাহলে তো সে লিখবেই না! তার কাছে সেটা নিষিদ্ধ নয় বলেই তো সে লিখেছে। বিনয় মজুমদারের ‘বাল্মীকির কবিতা’র কথায় ধরা যাক। ওগুলো যদি উনি নিষিদ্ধই মনে করতেন, তাহলে ছাপতে দেবেন কেন? রেখে দিতেন নিজের কাছে!
তখন, ’৬৫ সালে বিতর্ক উঠেছিল, এখন তো সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছে। মলয় তো যৌনতার ব্যবহার নিয়ে নানাভাবে লিখছে। ভাবাই যায় না, ওভাবেও লেখা সম্ভব! যৌনতা তো একটা সাবজেক্ট…
প্রশ্ন – কালোত্তীর্ণ সাহিত্য কি হাংরিদের হাত থেকে বেরিয়েছি্ল?
সুবিমল বসাক – কালোত্তীর্ণ কী? কে ওটা তৈরি করেছে, সেটাও তো বলতে হবে! আন্দোলনের সময় তো আমাদের চেপে রেখেছিল। উঠতে দেয়নি, গালাগাল দিয়েছিল। নিশ্চই ভয় পেত। নইলে তারা এরকম করবে কেন? বিনয় মজুমদারের বয়েই গেছে, তিনি সমস্ত খবরের কাগজ’কে লাথি মেরে চলে গেছেন। কিন্তু তিনিও তো লিখে গেছেন, সেগুলোও কালোত্তীর্ণ হবে, নিশ্চই হবে। শুধুমাত্র খবরের কাগজে কালোত্তীর্ণ হলেই সব হয় না। কত লেখা পড়ে আছে, অনেক বামপন্থী লেখক ছিলেন, যাঁদের কোনো সংকলনেই ঢোকানো হয়নি। সেটার বিচার করবে কে? সম্পাদক? এমন অনেক লেখক আছেন, যারা জীবদ্দশায় পাত্তা না পেলেও পরে লোকে খুঁজে খুঁজে পড়েছে তাঁদের লেখা।
প্রশ্ন – আপনি হাংরি আন্দোলনের অন্যতম গদ্যকার। আপনার লেখায় যৌনতা কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – সেটা পাঠকই বলতে পারবে। লেখক হিসেবে আমার কাছে যৌনতার আলাদা কিছু তাৎপর্য নেই। যেমন ডাল-ভাত-জল খাচ্ছি, তেমনি যৌনতাও এসেছে। যেখানে যেখানে আসার, সেখানেই। তার জন্য আলাদা কোনো প্যারা খরচ করতে হয়নি আমায়। যৌনতা অনেকে ক্যাপিটাল হিসেবে ব্যবহার করে। আজকালকার সিনেমায় দেখা যায় সেটা।
‘বিবর’ লেখার জন্য সমরেশ বসু’কে প্রায় বয়কটই করা হয়েছিল। কিন্তু ‘বিবর’ না লিখে ওঁর কোনো উপায় ছিল না। কারন বাংলা সাহিত্য অনেক এগিয়ে গেছিল হাংরিদের দৌলতে। ওইসময় সেক্স নিয়ে যত হইচই হয়েছিল, এখন কিন্তু তা নয়! এতটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সবকিছু।
প্রশ্ন – গত পঞ্চাশ বছরে বাঙালি জাতি এত সহনশীল হয়ে গেল কীভাবে, যাতে সবকিছুই স্বাভাবিক হিসেবে ধরা দিচ্ছে?
সুবিমল বসাক – প্রধান কারণ বিদেশী প্রভাব। এই যে মেয়েরা জিন্স পড়ছে, টপ পড়ছে, অনেকসময় খোলাই প্রায়; এই বিষয়টা এতই চোখ সয়ে গেছে যে এখন আর গোপন বলে কিছু নেই প্রায়। অনুসন্ধিৎসা নেই। মেয়েরা নানারকম কথাও বলছে, পাবলিক প্লেসে, যেগুলো আগে কখনো ভাবাও যেত না। কাজেই আগে মানুষের যে মুখোশ পরে থাকার ব্যাপারটা ছিল, সেটা ভেঙে গেছে।
প্রশ্ন – মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতাটি অশ্লীলতার অভিযোগে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, কবিকে জেলেও যেতে হয়েছিল। আপনার চোখে কবিতাটি কীভাবে ধরা দিয়েছে?
সুবিমল বসাক – পুলিশ কেস দাখিল করেছিল অশ্লীল শব্দ, বিষয় ইত্যাদির অভিযোগ দেখিয়ে। শক্তি, সন্দীপন, শৈলেশ্বর, সুভাষ এরা বিরুদ্ধ সাক্ষ্য দিয়েছিল। আমার এখনও কবিতাটা নিষিদ্ধ মনে হয় না, তখনও হয়নি। সে সময়কার কবিতার জড়তা’কে একটা আঘাত দিয়েছিল মলয়। ও যে লিখেছে – “কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”, এই প্রশ্নটা তো অশ্লীল কবিতা লেখার উদ্দেশ্যে নয়; ওর নিজের প্রচণ্ড একটা জিজ্ঞাসাই ওকে দিয়ে লিখিয়েছে। তবু অশ্লীল! এটা সংস্কৃতে লিখলে কিন্তু দারুণ ব্যাপার হত। আর ইংরাজিতে লিখলে তো কথাই নেই…
প্রাচীন মন্দিরগুলোয় যেসব মিথুনমূর্তি আছে, সেগুলো’কে কী বলা হবে তাহলে? ভগবান সবই করতে পারে? খাজুরাহো মন্দিরে একটা ন্যুড মূর্তি আছে, সেটার বিশিষ্ট অঙ্গে হাত বুলোতে বুলোতে কালো করে দিয়েছে সবাই।
প্রশ্ন – আপনি কি আপনার লেখালিখি পরিবারের সঙ্গেও শেয়ার করে নিতে সমান সাবলীল?
সুবিমল বসাক – তাদের মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা তাদের ব্যাপার। আমার লেখা, আমার মন কীভাবে গড়ে উঠেছে সেটা আমার ব্যাপার। তাদের ইচ্ছে হলে পড়বে, না হলে পড়বে না। পরিণত বয়সে কারোর ওপর কিছু চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।
(‘আঙ্গিক’ পত্রিকায় প্রকাশিত)
|
|||
|
|
Report this ad
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন