বুধবার

হাংরি আন্দোলন - সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগ

হাংরি আন্দোলন -- সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগ

১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র ও সাহিত্যে অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হলুম আমি, প্রদীপ চৌধুরী, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ এবং দাদা সমীর রায়চৌধুরী । এই অভিযোগে উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়ের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইশ্যু হয়ে থাকলেও, তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়নি । রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এই জন্যে চাপানো হয়েছিল যাতে বাড়ি থেকে থানায় এবং থানা থেকে আদালতে হাতে হাতকড়া পরিয়ে আর কোমরে দড়ি বেঁধে চোরডাকাতদের সঙ্গে সবায়ের সামনে দিয়ে রাস্তায় হাঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া যায় । বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে আর কখনও এরকম ঘটনা ঘটেনি । অন্তর্ঘাতের অভিযোগটি সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ থেকে ১৯৬৫ সালের মে মাস পর্যন্ত বজায় ছিল, এবং ওই নয় মাস যাবৎ রাষ্ট্রযন্ত্রটি তার বিভিন্ন বিভাগের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনকারীরূপে চিহ্ণিত প্রত্যেকের সম্পর্কে খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছিল, এবং তাদের তখন পর্যন্ত যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ঢাউস-ঢাউস ফাইল তৈরি করে ফেলেছিল, যেগুলো লালবাজারে পুলিশ কমিশনারের কনফারেন্স রুমের টেবিলে দেখেছিলুম, যখন কলকাতা পুলিশ, স্বরাষ্ট্র দপতর, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ ও ভারতীয় সেনার উচ্চপদস্হ আধিকারিক এবং পশ্চিমবঙ্গের অ্যাডভোকেট জেনারালকে নিয়ে গঠিত একটি বোর্ড আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে কয়েক ঘন্টা জেরা করেছিল। কেবল আমাদের দুজনকেই এই বোর্ডের সামনে দাঁড় করানো হয়েছিল, কেননা শৈলেশ্বর ঘোষ, সুভাষ ঘোষ, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, পবিত্র বল্লভ ও সমীর বসু তাঁদের জেরায় জানিয়েছিলেন যে আমরা দুজনেই হাংরি আন্দোলনের দায়িত্বে আছি এবং তাঁদের এই আন্দোলনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ নেই।

অভিযোগটি কোন সাংস্কৃতিক অধিপতির মস্তিষ্কপ্রসূত ছিল জানি না । তবে অ্যাডভোকেট জেনারাল মতামত দিলেন যে এরকম আজেবাজে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভোযোগ দেখলে আদালত চটে যাবে । তখনকার দিনে টাডা-পোটা ধরণের আইন ছিল না; নকশাল আন্দোলনও ঘটেনি। ফলত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তুলে নিয়ে ১৯৬৫ সালের মে মাসে বাদবাকি সবাইকে ছেড়ে দিয়ে কেবল আমার বিরুদ্ধে মামলা রুজু হল, এই অভিযোগে যে সাম্প্রতিকতম হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত আমার প্রচণ্ড বৈদ্যূতিক ছুতার কবিতাটি অশ্লীল । আমার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা সম্ভব হল শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ আমার বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী হয়ে গেলেন বলে । অর্থাৎ হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গেল। ওনারা দুজনে হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে মুচলেকা দিলেন, যার প্রতিলিপি চার্জশিটের সঙ্গে আদালত আমায় দিল। মুচলেকা দুটি এখানে তুলে দেয়া হল:

শৈলেশ্বর ঘোষ:  আমার নাম শেলেশ্বর ঘোষ। আমার জন্ম বগুড়ায় আর বড় হয়েছি বালুরঘাটে । আমি ১৯৫৩ সনে বালুরঘাট হাই ইংলিশ স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছি , ১৯৫৫ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে আই.এস.সি., ১৯৫৮ সনে বালুরঘাট কলেজ থেকে বি.এ., আর ১৯৬২ সনে কলকাতার সিটি কলেজ থেকে বাংলায় স্পেশাল অনার্স । ১৯৬৩ সনে  সেপ্টেম্বর মাসের শেষ দিকে একদিন কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে দেবী রায় ওরফে হারাধন ধাড়া নামে একজন তাঁর হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনের জন্য আমাকে লিখতে বলেন । তারপরেই আমি হাংরি আন্দোলনের লেখকদের সঙ্গে পরিচিত হই । আমি ব্যক্তিগতভাবে খ্যাতিমান লেখকসন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শ্যামল গঠ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন্দ্র দত্ত, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী এবং উৎপলকুমার বসুকে চিনি গত এপ্রিল মাসে একদিন কলেজসট্রিট কফিহাউসে ম।ব রায়চৌধুরীর সঙ্গে আমার দেখা হয়, এবং তিনি আমার কাছে কয়েকটা কবিতা চান । তাঁর কাছ থেকে একটা পার্সেল পেয়েছি । আমি মলয় রায়চৌধুরীকে চিনি। তিনি হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা। হাংরি জেনারেশন ম্যাগাজিনে আমি মোটে দুবার কবিতা লিখেছি। মলয় আমাকে কিছু লিফলেট আর দু-তিনটি পত্রিকা পাঠিয়েছিলেন কিন্তু সেগুলি সম্পর্কে কোনো নির্দেশ তিনি আমাকে দেননি। সাধারণত এই সব কাগজপত্র আমার ঘরেই থাকত । এটুকু ছাড়া হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আমি আর কিছু জানি না। অশ্লীল ভাষায় লেখা আমার আদর্শ নয় । ১৯৬২ থেকে আমি হুগলি জেলার ভূপেন্দ্র স্মৃতি বিদ্যালয়ে স্কুল টিচার । মাইনে পাই দু'শ দশ টাকা । বর্তমান সংখ্যা হাংরি বুলেটিনের প্রকাশনার পর, যা কিনা আমার অজান্তে ও বিনা অনুমতিতে ছাপা হয়,আমি এই সংস্হার সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছি । ভবিষ্যতে আমি হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে কোনো সম্পর্ক রাখব না এবং হাংরি পত্রিকায় লিখব না । বর্তমান বুলেটিনটি ছাপিয়েছেন প্রদীপ চৌধুরী । ( স্বাক্ষর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ )


সুভাষ ঘোষ: আমার নাম সুভাষচন্দ্র ঘোষ । গত এক বৎসর যাবত আমি কলেজ স্ট্রিট কফিহাউসে যাতায়াত করছি । সেখানে একদিন হাংরি আন্দোলনের উদ্ভাবক মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় হয় । সে আমার কাছ থেকে একটা লেখা চায় ।হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের খবর আমি জানি বটে কিন্তু হাংরি আন্দোলনের যে ঠিক কী উদ্দেশ্য তা আমি জানি না । আমি তাকে আমার একটা লেখা দিই যা দেবী রায় সম্পাদিত হাংরি জেনারেশন পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । আমি তা আমার রুম মেট শৈলেশ্বর ঘোষের কাছ থেকে পাই । সে হাংরি বুলেটিনের একটা প্যাকেট পেয়েছিল। আমি এই ধরণের আন্দোলনের সঙ্গে কখনও নিজেকে জড়াতে চাইনি, যা আমার মতে খারাপ । আমি ভাবতে পারি না যে এরকম একটা পত্রিকায় আমার আর্টিকেল 'হাঁসেদের প্রতি' প্রকাশিত হবে । আমি হাংরি আন্দোলনের আদর্শে বিশ্বাস করিনা, আর এই লেখাটা প্রকাশ হবার পরআমি ওদের সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছি । ( স্বাক্ষর ২ সেপ্টেম্বর ১৯৬৪ )


প্রসিকিউশনের পক্ষে এই দুজন রাজসাক্ষীকে, তাদের দুমুখো কথাবার্তার কারণে, নির্ভরযোগ্য মনে হয়নি । তাই আমার বিরুদ্ধে পুলিসের ইনফর্মার দুই ভুয়ো সাক্ষী, সমীর বসু এবং পবিত্র বল্লভকে, উইটনেস বক্সে তোলা হয় , যাদের আমি কখনও দেখিনি, অথচ যারা এমনভাবে সাক্ষ দিয়েছিল যেন আমার সঙ্গে তাদের কতই না আলাপ-পরিচয় । এই দুজন ভুয়ো সাক্ষীর উদ্দেশ্য ছিল আইনের দায়রায় আমাকে অপরাধী প্রমাণ করা । এরা পুলিশের ইনফর্মার ছিল বলে এদের আইন-কানুন সব জানা ছিল। আমার কৌঁসুলিদের জেরায় এরা ভুয়ো প্রমাণ হবার উপক্রম দেখা দিলে প্রসিকিউশন আমার বিরুদ্ধে উইটনেস বক্সে তোলে , বলাবাহুল্য গ্রেপ্তারের হুমকি দিয়ে --- মধ্যবিত্ত কবি-লেখকদের কাছে যে অভিজ্ঞতা ভয়ঙ্কর --- শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে ।ম ফলে আমিও আমার পক্ষ থেকে সাক্ষী হিসাবে দাঁড় করাইজ্যোতির্ময় দত্ত ( বুদ্ধদেব বসুর জামাই ), সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল ও মনোবিদ সত্রাজিৎ দত্তকে ( কবি অজিত দত্তের ছেলে )। শক্তি এবং সুনীল, দুই বন্ধু, একটি মকদ্দমায় পরস্পরের বিরুদ্ধে, পাঁচ দশক পর ব্যাপারটা অবিশ্বাস্য মনে হতে পারে ; তখন কিন্তু তেমন ছিল না ।


আমি আরও অনেক সাহিত্যিককে অনুরোধ করেছিলুম কিন্তু কেউই এগিয়ে আসেননি । সে-সময়ে কিউবায় কোনো কবির ফুসকুড়ি হলে সরোজ বন্দ্যোপাধ্যায়, অশোক মিত্র,  পদ্মশ্রী শঙ্খ ঘোষ, অমিতাভ দাশগুপ্ত, অমিয় দেব, পবিত্র সরকার, দেবেশ রায়, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী প্রমুখ প্রতিবাদের স্রোত বইয়ে দিতেন । কিন্তু আমার সমর্থনে দীপক মজুমদার তাঁদের কাছে স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে গেলে কেউই আমাকে সমর্থন করতে রাজি হননি। কোনো, লেখক বা কবি আদালতে আসতেন না । কফিহাউসে প্রায় সবাই ভয়ে কথা বলতেন না আমার সঙ্গে । শঙ্খ ঘোষ মশায় এখন অনেক বড়-বড় কথা বলেন, অথচ সেসময়ে তিনি ঘোর হাংরি বিরোধী ছিলেন ।


সবায়ের সাক্ষ্য ছিল বেশ মজাদার, যাকে বলে কোর্টরুম ড্রামা । অবশ্য তখন আমার থাকার, খাওয়ার, কোর্টে পৌঁছোবার প্রচুর সমস্যা ছিল, কেননা কলকাতায় থাকার কোনো আস্তানা আমার ছিল না । পর-পর দুদিন ডেট থাকলে কলকাতায় থাকতে হতো শরদ দেওড়া নামে একজন ব্যবসায়ীর বড়বাজারের গদিতে, যিনি হিন্দি 'অনিমা' পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন; তাঁর কর্মীরাও ওই গদিতে শুতেন; একটিমাত্র পায়খানা; স্নানের ব্যবস্হা ছিল না । নয়তো বৈঠকখানা পাড়ায় সুবিমল বসাকের জ্যাঠামশায়ের স্যাকরার দোকানঘরে; উনি দোকান বন্ধ করে দেবার পর; সেখানে পায়খানা-বাথরুম কিছুই ছিল না বলে যেতে হতো শেয়ালদা স্টেশানের টয়লেটে বা দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেনে । কাঁধের ঝোলায় দুটো গামছা রাখতুম, যাতে কোথাও স্নানের সুযোগ না পেলে গঙ্গায় সেরে নেয়া যায়; সূভাগ্যবশত ঘাটগুলো ব্যাংকশাল কোর্টের ও হাইকোর্টের পাশেই । নয়তো আহিরিটোলায় পিসেমশায়ের এক ঘরের শরিকি বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাতুম আমার ছয়টি পিসতুতো ভাইয়ের সঙ্গে, খাটের তলায় শুয়ে । এক ডেট থেকে আরেক ডেটের মাঝে বেশ কয়েক দিন সময় থাকলে উত্তরপাড়ায় আমাদের সাবর্ণ চৌধুরী বসতবাড়িতর খন্ডহরে গিয়ে থাকতুম, যেখানে বারোটি ঘর, তিনটি সিঁড়ি মিলিয়ে বিশাল এলাকায় ঠাকুমা একাই থাকতেন, হবিষ্য রান্না করে খেতেন ; আমাকে বলতেন বাইরে খেয়ে নিতে । উত্তরপাড়ার খন্ডহর থেকে হেঁটে স্টেশান, ট্রেনে হাওড়া, হেঁটে ব্যাংকশাল কোর্ট । ওই ভাবেই ফেরা। যেদিন সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র বা আমার কাকা-জ্যাঠা-বাবা-দাদা আসতেন, সেদিন খরচের সমস্যা হতো না ।


তেরোটা আদালতঘরের মধ্যে আমার মকদ্দমাটা ছিল নয় নম্বর এজলাসে । বিচারকের মাথার ওপরে হলদে টুনি বালবটা ছাড়া আলোর বালাই ছিলনা জানালাহীন ঘরটায় । অবিরাম ক্যাঁচোর-ক্যাঁচোর শব্দে অবসর নেবার অনুরোধ জানাত দুই ব্লেডের বিশাল ছাদপাখা । পেশকার গাংগুলিবাবুর অ্যান্টিক টেবিলের লাগোয়া বিচারকের টেবিল, বেশ উঁচু, ঘরের এক থেকে আরেক প্রান্ত, বিচারকের পেছনে দেয়ালে টাঙানো মহাত্মা গান্ধীর ফোকলা-হাসি রঙিন ছবি। ইংরেজরা যাবার পর চুনকাম হয়নি ঘরটা । হয়তো ঘরের ঝুলগুলোও তখনকার ।বিচারকের টাবিলের বাইরে, ওনার ডান দিকে, দেয়াল ঘেঁষে, জাল-ঘেরা লোহার শিকের খাঁচা, জামিন-না-পাওয়া বিচারাধীনদের জন্যে, যারে ওই খাঁচের পেছনের দরোজা দিয়ে ঢুকতো । খাঁচাটা অত্যান্ত নো২রা । আমি যেহেতু ছিলুম জামিনপ্রাপ্ত, দাঁড়াতুম খাঁচার বাইরে; ঠ্যাঙ ব্যাথা করলে, খাঁচায় পিঠ ঠেকিয়ে ।


পেশকার মশায়ের টেবিলের কাছাকাছি থাকত গোটাকতক আস্ত-হাতল , ভাঙা-হাতল আর হাতলহিন চেয়ার, কৌঁসুলিদের জন্যে , একটি চেয়ারের সঙ্গে আরেকটির কোনো মিল নেই। ঘরের বাকিটুকুতে ছিল নানা-মাপের আকারের রঙের নড়বড়ে বেঞ্চ আর চেয়ার, পাবলিকের জন্যে, ছারপোকা আর খুদে আরশোলায় গিজগিজে । টিপে-মারা ছারপোকার রক্তে, পানের পিকে, ঘরের দেয়ালময় ক্যালিগ্রাফি । বসার জায়গা ফাঁকা থাকত না । কার মামলা কখন উঠবে ঠিক নেই । ওই সর্বভারতীয় ঘর্মাক্ত গ্যাঞ্জামে, ছারপোকার দৌরাত্ম্যে, বসে থাকতে পারতুম না বলে সারা আদালত-বাড়ি এদিক-ওদিক র্্যা-ফ্যা করতুম, এ-এজলাস সে-এজলাস চক্কর মারতুম, কৌতুহলোদ্দীপক সওয়াল-জবাব হলে দাঁড়িয়ে পড়তুম । আমার কেস ওঠার আগে সিনিয়ার উকিলের মুহুরিবাবু আমায় খুঁজে-পেতে ডেকে নিয়ে যেতেন । মুহুরিবাবু মেদিনীপুরের লোক, পরতেন হাঁটু পর্যন্ত ধুতি, ক্যাম্বিশের জুতো, ছাইরঙা শার্ট । সে শার্টের ঝুল পেছন দিকে হাঁটু পর্যন্ত আর সামনের দিকে কুঁচকি পর্যন্ত । হাতে লম্বালম্বি ভাঁজ-করা ফিকে সবুজ রঙের দশ-বারোটা ব্রিফ, যেগুলো নিয়ে একতলা থেকে তিন তলার ঘরে-ঘরে লাগাতার চরকি-নাচন দিতেন।আমার সিনিয়ার উকিল ছিলেন ক্রিমিনাল লয়ার চন্ডিচরণ মৈত্র । সাহিত্য সম্পর্কে ওনার কোনো রকম ধারণা ছিল না বলে লেবার কোর্টের সাহিত্যানুরাগী উকিল সত্যেন বন্দ্যোপাধ্যায়কেও রাখতে হয়েছিল । সত্যেনবাবু ক্রিমিনাল মামলার বিশেষ-কিছু বুঝতেন না । দুই উকিল দুই বিপরীত মেরুর বলে, পরে বুঝতে পারি, আমার মামলাটা ঠিকমতন লড়তে পারেননি নিম্ন আদালতের এই উকিলদ্বয় । চাকরি থেকে সাসপেন্ডেড ছিলুম কেস লড়ার সময়ে, তার ওপর কলকাতায় আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল না । খরচ সামলানো প্রায় অসম্ভব হয়ে গিয়েছিল । নয়তো ভালো উকিল দিয়ে মামলাটা ঠিকমতন লড়া যেতে পারত, যা সম্ভব হয়েছিল উচ্চ আদালতে লড়তে গিয়ে ।


আদালত চত্তরটা সবসময় ভিড়ে গিজগিজ করত । ফেকলু উকিলরা গেটের কাছে দাঁড়িয়ে, "সাক্ষী চাই? সাক্ষী চাই? এফিডেভিট হবে?" বলে-বলে চেঁচাতো মক্কেল যোগাড়ের ধান্দায় । সাড়া বাড়ি জুড়ে যেখানে-সেখানে টুল পেতে টাইপরাইটারে ফটর-ফটর ত্যারা-বেঁকা টাইপ করায় সদা ব্যস্ত টাইপিস্ট, পাশে দাঁড়িয়ে চোপসানো-মুখ লিটিগ্যান্ট । গেটের ভেতর ঢুকে, কোর্টচত্তরের সর্বত্র, কাগজ, তেলেভাজা, অমলেট, চাউমিন, চা-জলখাবার, ভাতরুটির ঠেক ।  (ব্যাংকশাল কোর্টের আশে-পাশের গলিতে ফুটপাথে ভাতের হোটেলগুলো বেশ সস্তা ; আমার দুপুরের খাওয়াটা এই সব ফুটপাতিয়া হোটেলেই সারতুম।) কোর্টপেপার কেনার দীর্ঘ কিউ। চাপরাশি, আরদালিদের আদালতের কাজে  ইংরেজরা যে-সব বিহারিদের চাকরি দিয়েছিল, তারা চত্তরের খোঁদলগুলো জবরদখল করে সংসার পেতে ফেলেছে ; আদালতবাড়ির পেছনের উঠোনে তাদের পরিবারের সদস্যদের শায়া-ধুতি-শার্ট ইত্যাদি দড়িতে শুকোচ্ছে ।


জেল থেকে খতরনাক আসামিরা পুলিশের বন্ধ গাড়িতে এলে, পানাপুকুরে ঢিল পড়ার মতন একটু সময়ের জন্য চত্তরের ভিড়টা সরে যেত। কয়েদিরা যে-যার এজলাসে সেঁদিয়ে গেলে ভিড় আবার যা-কে সেই। সর্ন্দর্ভ ও প্রতিসন্দর্ভের সামাজিক সংঘাতক্ষেত্র হিসেবে আদালতের মতন সংস্হা আর বোধ হয় নেই ।


সকলের সাক্ষ্য এখানে তুলে দিলে পাঠকের পড়ার ধৈর্য থাকবেনা । আমি দুটি তুলে দিচ্ছি। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, যিনি চব্বিশে জুন ১৯৬৫ সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যিনি পাঁচুই নভেম্বর সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, তাঁদের সওয়াল-জবাবের সার্টিফায়েড কপিতে বিধৃত ইতিহাস দিয়ে আমি এই রচনার উপসংহার টানি।


শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য: পেশকার: এই নিন, গীতার ওপর হার হাত রাখুন । বলুন, যা বলব ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না।শক্তি চট্টোপাধ্যায়: যা বলব, ধর্মত সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না, কিছু গোপন করব না ।পেশকার: নাম বলুন।শক্তি চট্টোপাধ্যায়: শক্তি চট্টোপাধ্যায় ।বিচারক অমল মিত্র : আপনি কী করেন ? শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে, লিখি ।বিচারক অমল মিত্র: কী কাজ করেন তাই বলুন। হোয়াট ইজ ইয়োর লাইভলিহুড ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: লেখালিখিই করি । এটাই জীবিকা।পাবলিক প্রসিকিউটার: আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, আপনি তো একজন বি.এ. ? শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, পরীক্ষা দিয়েছিলাম।বিচারক অমল মিত্র: আপনি বি.এ. কি না তাই বলুন। আপনি কি একজন স্নাতক ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে না ।পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি তো প্রথম থেকে হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাই না ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ছিলাম।পাবলিক প্রসিকিউটার: কী ভাবে ছিলেন সেটা ইয়োর অনারকে একটু বুঝিয়ে বলুন তো ।শক্তি চট্টোপাধ্যায়: সমীরের ছোট ভাই মলয় ইংরেজ কবি চসার আর জার্মান ফিলোজফার অসওয়াল্ড স্পেংলারের আইডিয়া থেকে একটা নন্দনতত্ব দিয়েছিল । সেই আইডিয়া ফলো করে আমরা কয়েকজন মিলে আন্দোলনটা আরম্ভ করি।পাবলিক প্রসিকিউটার: আসামি মলয় রায়চৌধুরীকে তাহলে চেনেন ? কবে থেকে চেনেন ? শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ চিনি । অনেক কাল থেকে ।পাবলিক প্রসিকিউটার: কী ভাবে জানাশোনা হল ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ওর বড় ভাই সমীর আমাএ ঘনিষ্ঠ বন্ধু । সমীরের চাইবাসার বাড়িতে থাকার সময়ে আমি প্রচুর লিখতাম । সেই সূত্রে মলয়ের সঙ্গে ওদের পাটনার বাড়িতে পরিচয়। পাবলিক প্রসিকিউটার: কারা-কারা এই হাংরি জেনারেশন আন্দোলন আরম্ভ করেন ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: মলয় রায়চৌধুরী ওর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়, উৎপলকুমার বসু আর আমি । ছাপা-টাপার খরচ প্রথম থেকে ওরা দু ভাইই দিয়েছে । পরে আরও অনেকে যোগ দিয়েছিলেন, তাঁদের নাম বলব কি ?পাবলিক প্রসিকিউটার: তা আপনি যখন পায়োনিয়ারদের একজন, তখন এই আন্দোলনের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখলেন না কেন ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: এমনিই । এখন আমার লেখার কাজ অনেক বেড়ে গেছে । বিচারক অমল মিত্র: ইউ মিন দেয়ার ওয়াজ এ ক্ল্যাশ অব ওপিনিয়ন ? নট ক্ল্যাশ অব ইগো আই সাপোজ ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: আজ্ঞে হ্যাঁ । তাছাড়া এখন আর সময় পাই না ।পাবলিক প্রসিকিউটার: কত দিন হল আপনি হাংরি জেনারেশনের সঙ্গে যুক্ত নন ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: প্রায় দেড় বছর ।পাবলিক প্রসিকিউটার: দেখুন তো হাংরি জেনারেশনের এই সংখ্যাটা পড়েছেন কি না ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: পড়েছি । কবিতা পেলেই পড়ি ।পাবলিক প্রসিকিউটার: 'প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' কবিতাটা পড়েছেন কি ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: হ্যাঁ, কবিতাটা আমি পড়েছি ।পাবলিক প্রসিকিউটার: পড়ে আপনার কী মনে হয়েছে ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ভালো লাগেনি ।পাবলিক প্রসিকিউটার: ভালো লাগেনি বলতে আপনি অবসিন...ডিফেন্স কাউনসেল: আই অবজেক্ট টু ইট ইয়োর অনার । হি কান্ট আস্ক লিডিং কোয়েশ্চেন্স ইন সাচ আ ওয়ে ।পাবলিক প্রসিকিউটার: ওয়েল, আই অ্যাম রিফ্রেজিং দি কোয়েশ্চেন । আচ্ছা মিস্টার চ্যাটার্জি, ভালো লাগেনি বলতে আপনি কী বলতে চাইছেন ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ভালো লাগেনি মানে জাস্ট ভালো লাগেনি । কোনো-কোনো কবিতা পড়তে ভালো লাগে, আবার কোনো-কোনো কবিতা আমার ভালো লাগে না ।বিচারক অমল মিত্র: সো দি ডিফারেন্স অব ওপিনিয়ন ওয়াজ বেসড অন লাইকস অ্যান্ড ডিসলাইকস । হেয়ার ইউ মিন দি পোয়েম ডিডন্ট অ্যাপিল টু ইয়োর ইসথেটিক সেনসেস ?শক্তি চট্টোপাধ্যায়: ইয়েস স্যার ।পাবলিক প্রসিকিউটার: দ্যাটস অল।ডিফেন্স কাউনসেল: ক্রসিং হবে না ।


সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্য:পেশকার: এই বইটার ওপর হাত রাখুন এবং বলুন, যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিধ্যা বলব না । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: যা বলব সত্য বলব, সত্য বই মিথ্যা বলব না ।পেশকার: আপনার নাম ? সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ।ডিফেন্স কাউনসেল: আপনি কী করেন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: আমি আনন্দবাজার পত্রিকায় ফিচার লিখি ।ডিফেন্স কাউনসেল: শিক্ষা ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা ভাষায় এম.এ. ।ডিফেন্স কাউন্সেল: আপনার লেখা কোথায় প্রকাশিত হয় ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: আমি দেশ, আনন্দবাজার, বসুমতী, পূর্বাশা এবং আরও অনেক পত্রিকায় লিখি । পূর্বাশা আর প্রকাশিত হয় না । আমার অনেকগুলো বই আছে, তার মধ্যে একটার নাম ' বরণীয় মানুষের স্মরণীয় বিচার' । আমি অনেক কবিতা, ছোটগল্প, উপন্যাস লিখেছি ।ডিফেন্স কাউনসেল: আপনি মলয়ের কবিতাটা পড়েছেন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: হ্যাঁ, অনেকবার ।বিচারক অমল মিত্র: আরেকবার পড়ুন ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: জোরে-জোরে পড়ব না মনে-মনে ?বিচারক অমল মিত্র: না-না, মনে-মনে ।সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় : হ্যাঁ, পড়ে নিলুম ।ডিফেন্স কাউনসেল: পড়ে কি অশ্লীল মনে হচ্ছে ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: কই না তো । আমার তো বেশ ভালো লাগছে পড়ে । বেশ ভালো লিখেছে।ডিফেন্স কাউনসেল: আমনার শরীরে বা মনে খারাপ কিছু ঘটছে ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না, তা কেন হবে ? কবিতা পড়লে সেসব হয় না । ডিফেন্স কাউনসেল: দ্যাটস অল ইয়োর অনার ।পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি এই ম্যাগাজিনের বিষয়ে কবে থেকে জানেন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: ওদের আন্দোলন সম্পর্কে আমি প্রথম থেকেই জানি ।পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি ওই জার্নালে লিখেছেন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না, লিখিনি কখনও ।পাবলিক প্রসিকিউটার: আপনি ওরকম কবিতা লেখেন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: পৃথিবীর কোনো দুজন কবি একই রকম লেখেন না, আর একই রকম ভাবেন না ।পাবলিক প্রসিকিউটার: কবিতাটা কি অবসিন ?সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়: না । ইট কনটেইনস নো অবসিনিটি । ইট ইজ অ্যান এক্সপ্রেশান অব অ্যান ইমপর্ট্যান্ট পোয়েট ।


ছয়সরকারি পক্ষের আর আমার পক্ষের সাক্ষ্যাদি চলে ছিল বেশ কিছুদিন। সহজে ডেট পাওয়া যেত না বলে কেসটা বিলম্বিত হয়েছিল । ফলত আমার দুর্ভোগ ও একাকীত্ব। একাকীত্ব এই জন্যে যে রাজসাক্ষী হবার ঘটনা জানাজানি হবার পর এবং আমার বিরুদ্ধে মামলা চলছিল বলে, বন্ধুবান্ধব বলতে হাতেগোনা । একাই কলকাতার রাস্তায় ঘুরে বেড়াতুম । ডায়েরি রাখলে নতুন ধরণের লেখা তৈরি করা যেতে পারত । প্রতিষ্ঠিত লেখক-কবিরা তো আমায় দেখলেই অন্য দিকে মুখ করে দ্রুত হাঁটা দিতেন। কফিহাউসেও আমাকে দেখে মুখ শুকিয়ে যেত অনেকের ।


সাক্ষাদি শেষ হবার পর দু-পক্ষের দীর্ঘ বহস হল একদিন, প্রচুর তর্কাতর্কি হল । আমি খাঁচার কাছে ঠায় দাঁড়িয়ে । রায় দেবার দিন পড়ল ১৯৬৫ সালের আঠাশ ডিসেম্বর । ইতিমধ্যে আমেরিকায় 'টাইম' ম্যাগাজিনে সংবাদ হয়ে গেছি । 'যুগান্তর' দৈনিকে 'আর মিছিলের শহর নয়' এবং ' যে-ক্ষুধা জঠরের নয়' শিরোনামে সম্পাদকীয় লিখলেন কৃষ্ণ ধর । 'যুগান্তর' দৈনিকে সুফী এবং ' আনন্দবাজার' পত্রিকায় চণ্ডী লাহিড়ী কার্টুন আঁকলেন আমায় নিয়ে । 'দি স্টেটসম্যান' দৈনিকে হাংরি আন্দোলনের সমর্থনে সমাজ-বিশ্লেষণমূলক প্রবন্ধ প্রকাশিত হল । সমর সেন সম্পাদিত 'নাউ' পত্রিকায় পরপর দুবার লেখা হল আমার সমর্থনে । হিন্দিতে 'ধর্মযুগ', 'দিনমান', 'সন্মার্গ', 'সাপ্তাহিক হিন্দুস্তান', 'জনসত্তা' পত্রিকায় উপর্যুপরি ফোটো ইত্যাদিসহ লিখলেন ধর্মবীর ভারতী, এস. এইচ. বাৎসায়ন অজ্ঞেয়, ফণীশ্বরনাথ রেণু, কমলেশ্বর, শ্রীকান্ত ভর্মা, মুদ্রারাক্ষস, ধুমিল, রমেশ বকশি প্রমুখ । কালিকটের মালায়ালি পত্রিকা 'যুগপ্রভাত' হাংরি আন্দোলনকে সমর্থন করে দীর্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশ করল ।


বুয়েনার্স আয়ার্স থেকে 'প্যানারোমা' পত্রিকার সাংবাদিক আমার মকদ্দমা কভার করল । পাটানার দৈনিক 'দি সার্চলাইট' প্রকাশ করল বিশেষ ক্রোড়পত্র । বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করল জার্মানির 'ক্ল্যাক্টোভিডসেডস্টিন' পত্রিকা; নিউ ইয়র্কের 'কুলচুর' পত্রিকা ছাপালো সব কয়টি ইংরেজি ম্যানিফেস্টো-বুলেটিন। হাংরি আন্দোলোনকারীদের ফোটো, ড্রইং, রচনার অনুবাদ নিয়ে আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করল 'সল্টেড ফেদার্স', 'ট্রেস', 'ইনট্রেপিদ', 'সিটি লাইটস জার্নাল', 'সানফ্রানসিসকো আর্থকোয়েক', 'রেমপার্টস', 'ইমেজো', 'হোয়্যার' ইত্যাদি লিটল ম্যাগাজিন । সম্পাদকীয় প্রকাশিত হল নিউ ইয়র্কের 'এভারগ্রিন রিভিউ', আর্জেনটিনার 'এল কর্নো এমপ্লুমাদো' এবং মেকসিকোর 'এল রেহিলেতে' পত্রিকায় । নেট সার্চ করলে বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত এই পত্রিকাগুলোর হদিস পাওয়া যাবে।পশ্চিমবঙ্গে, বিশেষ করে কলকাতায়, টিটকিরি মারা ছাড়া আর কিছু করেননি বাঙালি সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবিরা ।


ভুয়ো সাক্ষী, রাজ সাক্ষী আর সরকারি সাক্ষীদের বক্তব্যকে যথার্থ মনে করে আমার পক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যকে নাকচ করে দিলেন ফৌজদারি আদালতের বিচারক । দুশো টাকা জরিমানা ( যা ছিল ওই ধারায় সে-সময়ে সর্বোচ্চ ) অনাদায়ে আক মাসের কারাদণ্ড ধার্য করলেন তিনি । সাজা হবার ফলে, যাওবা কয়েকজন লেখক-কবি অন্তত কয়েকটা বাক্য আদান প্রদান করতেন, তাঁরাও দূরত্ব বজায় রাখা আরম্ভ করলেন। রাজ সাক্ষীরা, তাঁদের কুকর্ম ধরা পড়ায়, কফিহাইউসও এড়িয়ে যেতেন । আমার সময় কাটতে লাগল হাইকোর্টে অ্যাপিল করার অ্যাডভোকেট খোঁজা, নিম্ন আদালত থেকে সার্টিফায়েড কপি বের করায়। খাওয়া-দাওয়া ফুটপাতিয়া হোটেলে । সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র বা ফালগুনী রায় অনেক সময়ে কলেজ স্ট্রিট বা শ্যামবাজারে পাইস হোটেলে নিয়ে গিয়ে মাছ-মাংস খাওয়াতেন ।


আমি হাইকোর্টে রিভিশন পিটিশন করার জন্যে আইনজীবিদের খোঁজে বেরিয়ে দেখলুম যে খ্যাতিমান কৌঁসুলিদের এক দিনের বহসের ফি প্রায় লক্ষ টাকা; অনেকে প্রতি ঘন্টা হিসেবে চার্জ করেন ; তাঁরা ডজনখানেক সহায়ক উকিল দুপাশে দাঁড় করিয়ে বহস করেন । হাইকোর্টে ঘোরাঘুরি করে বুঝলুম এনারা আমার ধরাছোঁয়ার বাইরে। জ্যোতির্ময় দত্ত পরিচয় করিয়ে দিলেন সদ্য লন্ডন ফেরত ব্যারিস্টারকরুণাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে, যিনি লন্ডনে থাকতে হাংরি আন্দোলোনের কথা শুনেছিলেন, পড়েছিলেন, এবং আমার মকদ্দমা সম্পর্কে উৎসাহী ছিলেন । তাঁর সৌজন্যে আমি তখনকার বিখ্যাত আইনজীবি মৃগেন সেন  ও তাঁর তিনজন সহায়ককে পেলুম । তাঁর ফিস দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না । তবু, এই ধরণের তিনি কখনও লড়েননি বলে রাজি হলেন । নিজের সহায়কদের নিয়ে তিনি কয়েকদিন বসে তর্কের স্ট্র্যাটেজি কষলেন। ১৯৬৭ সালের ছাব্বিশে জুলাই আমার রিভিশন পিটিশানের শুনানি হল । নিম্ন আদালতের রায় নাকচ করে দিলেন বিচারপতি টি.পি. মুখার্জি । টোকেন ফিস ইন্সটলমেন্টে দেবার ব্যবস্হা করে দিয়েছিলেন করুণাশঙ্কর রায় ।


হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে গিয়েছে সেই ষাটের দশকে । এখন শুরু হয়েছে তাকে নিয়ে ব্যবসা । সমীর চৌধুরী নামে আনন্দবাজার পত্রিকার এক কর্মী ( আমার দাদার নামের সঙ্গে মিলটা কাজে লাগিয়ে । 'হাংরি জেনারেশন রচনা সংকলন' নামে একটা বই বের করেছেন। তাতা অন্তর্ভুক্ত অধিকাংশ লেখককে আমি চিনি না ।এই সংকলনে আমার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, উৎপলকুমার বসু, সমীর রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, আলো মিত্র, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখের রচনা নেই! সুবিমল বসাক, অনিল করঞ্জাই ও করুণানিধান মুখোপাথ্যায়-এর আঁকা ড্রইং নেই । একটাও ম্যানিফেস্টো নেই । বাজার নামক ব্যাপারটি একটি ভয়ঙ্কর সাংস্কৃতিক সন্দর্ভ ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন