ধারণা করা যায় না যে রবীন্দ্রনাথের কোনো পাঠক একাধারে ঘুষখোর, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী, আবার সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের প্রকোপ থেকে বাঁচতে নানা পাথর আর মাদুলির ভক্ত
আজকাল প্রায়ই শোনা যায় যে কবিতা আর কেউ
পড়ে না, কবিরা নিজেরাই লেখেন আর নিজেরাই পড়েন; মাইকেল-রবীন্দ্রনাথের সময়েও
লোকে কবিতা সম্পর্কে যথেষ্ট আগ্রহ দেখাত, কিন্তু এখন কেউ পাতা উল্টেও
দ্যাখে না। কিংবা বলা হয় যে, লোকে পড়তে চায় না তবু জোর করে পড়াবার চেষ্টা
হয়; কবিদের হাতে পত্রিকার ক্ষমতা দিয়ে দিলে তারা নিজেরা কাগজের পৃষ্ঠা দখল
করে; সভা-সমিতি-উৎসব-আবৃত্তি-পাঠ ইত্যাদির নাম করে বাজার-সমাজে বিকোবার
খেলা দেখিয়েও পাত্তা পায় না, কেননা মূল সমাজব্যবস্থা তাদের আমল দ্যায় না;
ওসব মিলনমেলায় গিয়ে যারা জোটে তারা পাঠক নয়, তারা কবিতা-লেখক। অর্থাৎ কবিতা
নামক পাঠবস্তুটি আজ সমাজ কর্তৃক পরিত্যক্ত। এ-ধরণের কথাবার্তা শুনে কবিরা
বিরক্ত হন, এমনকি অপমানিত বোধ করেন। তাই আবার তারা মঞ্চে একত্রিত হয়ে
পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চান।
গত কয়েক বছর যাবত চাকুরিসূত্রে আমি
পশ্চিমবঙ্গে অনেক অঞ্চলে ঘোরাঘুরি করেছি, এবং চেষ্টা করেছি অনুসন্ধান করতে
যে, এই যে এত মানুষ, এঁদের মধ্যেই জয়দেব-চণ্ডীদাসের সময়ে পাঠক ছিলেন,
মাইকেল রবীন্দ্রনাথের সময়ে পাঠক ছিলেন, অথচ এখন এঁরা আর কবিতা পড়েন না,
পড়তে চান না। সত্যিই কি এঁদের পূর্বপুরুষ আর এঁদের মধ্যে কোনো বিরাট রদবদল
ঘটে গেছে, যেমন ঘটেছে এঁদের চারিপাশে মনুষ্যসৃষ্ট জগতে! প্রকৃতপক্ষে কী,
ঘটেছে কী পাঠকদের মধ্যে? অথচ ইতিমধ্যে শিক্ষার, সাক্ষরতার, মাধ্যমের,
ছাপার, উপস্থাপনার, প্রচারের, যানবাহনের, ডাক-ব্যবস্থার যে প্রসার ঘটেছে তা
তো অকল্পনীয়। বিশ শতক তো দ্রুততম শতক। এই পাঠকদের সমর্থন পেয়েই পটবয়লার
সাহিত্যিকদের উপন্যাস হু-হু করে কাটতি হয়, তবু তাঁরা কবিতার ধার কাছ মাড়াতে
চান না কেন? কোনো ব্লগসাইটে আচমকা কবিতা পড়ে ফেললে বিরক্তি ও অজ্ঞানতা
প্রকাশ করে কবি-বিশেষের শ্রাদ্ধ করেন! আমেরিকায় তো আমাদের চেয়ে বেশি কবিতার
পাঠক, যখন কিনা আমেরিকানদের সংখ্যা বাঙালির চেয়ে কম । রাশিয়ায় ব্রেজনেভের
সময়ে পাঠক ছিল, ইয়েল্তসিনের সময়ে ছিল, এখন দেশটির দুর্দশা সত্ত্বেও কবিতার
পাঠক রয়েছে। বেছে-বেছে বঙ্গজীবনে ও সমাজে পাঠকদের কী হল তাহলে?
নিঃসন্দেহে সমাজজীবনে ও ব্যক্তিজীবনে,
অনুভববেদ্যতায়, আচার-আচরণে এবং যোগাযোগ-প্রক্রিয়ায় গভীর পরিবর্তন এসেছে।
আগেকার কালের তুলনায় বদল ঘটেছে অভিজ্ঞতায়, অনুমানে, অভিপ্রায়ের উদ্দেশ্যে।
এই যে পরিবর্তন, তা কী এমন খাঁটি নান্দনিক সংহতি গড়ে দিচ্ছে যে, পাঠকের মনে
হচ্ছে আগেকার কালের কবিতা ভালো ছিল, যা পাঠক স্কুলের পর হয়তো আর পড়েই নি,
এবং আজকালকার কবিতা পড়ার মানে হয় না, যা সে কোনো কালে পড়েনি এবং পড়বে না।
পাঠকের যদি মনে হতো যে আগেকার কবিতার কৌশল এবং কাঠামোকে নতুন চেহারায়
আবর্তিত করা হচ্ছে, তাহলেও না হয় বিশ্বাস করা যেত পাঠককে। কিন্তু বলা হচ্ছে
যে তার কাছে কবিতা ব্যাপারটাই হয়ে গেছে অপাঙ্ক্তেয়। পাঠক আদপে পাঠক নয়।
সে পাঠক এ পাঠক নয়।
নানা কাজে যখন রেশনের অফিসে, পোস্টঅফিসে,
ব্যাঙ্কে, পুরসভার দপতরে, আদালতে, মোটর ভেহিকলসে গেছি, কিংবা গ্রামপঞ্চায়েত
আর বিডিওর আলোচনায় গেছি, তখন মুখগুলোকে খুঁটিয়ে টের পেতে চেষ্টা করেছি
তাদের প্রজন্মগত মৌলসূত্র। হাসপাতাল আর ক্লিনিকে গিয়ে যখন বসে থেকেছি, তখনও
আঁচ করতে চেষ্টা করেছি বদলের ভিত্তি।
আগেকার দিনকাল নিয়ে সকলেরই একটা মাইন্ডসেট
গড়ে ওঠে। এটি মূলত আধুনিকতা-বিরোধী। সেনেট হল ভেঙে ফেলা হয়, এবং উবে যাওয়া
সেনেট হলের ছবি যত্রতত্র ঝুলিয়ে দেন আঁকিয়ে সুনীল মিত্র, যাতে সেনেট হলকে
নয়, কিন্তু তৎসম্পর্কিত মনস্থিতিটি ধরে রাখা যায়। কার মনস্থিতি? পথচারীর,
অর্থাৎ সব্বাইর। সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ, স্থায়ী বন্দোবস্তের স্মৃতি। সেসব
পথচারী কিন্তু আর কবিতার পাঠক হতে রাজি নন। এমন নয় যে তাঁদের হাতে সময়
একেবারেই নেই বা জীবিকার চাপে তাঁরা নুয়ে পড়েছেন। প্রতিটি চলচ্চিত্রের
প্রথম দিনের প্রথম শোয়ে যে ভিড়টি জড়ো হয়, সেই ঘর্মাক্ত যুবক-যুবতীর মাঝে আধ
ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকলে, ব্যাপারটা খোলসা হবে। তারা তাদের কথাবার্তার মাধ্যমে
জানিয়ে দিতে থাকে তারা সঠিক, সঠিক, সঠিক। এভাবেই পয়লা বৈশাখের আমুদে ভিড়ে,
বিপত্তারিণীর মহিলা-সমাগমে, রথের মেলায়, পুজোবাজারের রগড়ে, এক জায়গায় ঠায়
দাঁড়িয়ে বা গণপ্রবাহে ঢুকে, আমি খুঁঝে বের করার চেষ্টা করেছি অনাগ্রহের
চাবিকেন্দ্র।
পুরানো দিনের সম্পর্কে নবরক্ষণশীল
নস্টালজিয়াকে, কেবল কবিতায় নয়, সব সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্রেই, ছবি আঁকায়,
চলচ্চিত্রে, ভাস্কর্যে, স্থাপত্যে, নাটকে, সঙ্গীতে, সাহিত্যে একটি ঐতিহাসিক
সারগ্রাহিতার লেবেল দিয়ে বাদ দিয়ে দেয়া যেতে পারত। কিন্তু পাঠকের
চারিত্রিক পরিবর্তন ধরা যেত না। অতীতকে নিয়ে, প্রাগাধুনিক ও আদিম যুগ
সম্পর্কে এই যে নস্টালজিয়া, তা কি স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আদিখ্যেতা-জনিত ?
না কি, তা একদা যারে ছিল পাঠকশ্রেণি, তাদের চরিত্রদোষের লক্ষণ? কেননা যখন
আমরা অবক্ষয়ের কথা বলি, মূল্যবোধের অবনমনের কথা বলি, তখন পাঠকের স্তরে
অধঃপতনকে, স্খলনকে, নীচতাকে স্বীকার করে নিই।
যে পাঠক বলে যে আগেকার মত সাহিত্য হয় না,
উপন্যাস আর লেখা হয় না, সঙ্গীত আর হয় না, সিনেমা আর হয় না, নাটক আর হয় না,
ভাস্কর্য আর হয় না, সে পাঠক ওই অধঃপতিত, স্খলিত, চারিত্রিক নীচতায় আক্রান্ত
বাঙালি পাঠক। হ্যাঁ, বাঙালি পাঠক। বঙ্গসমাজে এই ধরণের চরিত্র মাইকেলের
সময়ে বা তার আগে ছিল অকল্পনীয়। ধারণা করা যায় না যে রবীন্দ্রনাথের কোনো
পাঠক একাধারে ঘুষখোর, বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদী, আবার সেই সঙ্গে গ্রহ-নক্ষত্রের
প্রকোপ থেকে বাঁচতে নানা পাথর আর মাদুলির ভক্ত। এই জোচ্চুরি এখন মড়কের
চেহারা নিয়েছে।
একজন ঘুষখোর আর যাই হোক কবিতার পাঠক হতে পারে না
এখনকার পাঠক লটারির টিকিট কিনে উনিশ শতকের
চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে ফিরে যেতে চায়। রেশনের অফিসে, জীবনবীমায়, ব্যাংকে,
পুরসভায়, পোস্টঅফিসে, আদালতে, সরকারি দপতরে, যেখানেই সে থাকুক না কেন, আজকে
সে অসৎ, কুচুটে, ফাঁকিবাজ, অলস, কামচোর, দলবাজ, দালাল, অসুস্থ। কী করে আশা
করা যায় এই লোকগুলো কবিতার পাঠক হবে? কবিতায় ভোগবাদকে প্রশ্রয় দেবার সুযোগ
নেই। আজকাল কোনও জনসেবার দপতরে ঘুষ না খেয়ে কেউ কাজ করে না। একজন ঘুষখোর
আর যাই হোক কবিতার পাঠক হতে পারে না। সে ঘুষের টাকায় দামি-দামি চিত্রকরের
ছবি কিনবে, ভাস্কর্য কিনবে, স্থপতিকে দিয়ে বাড়ি বানাবে, কিন্তু কবিতা সে
কখনই পড়বে না। পশ্চিমবঙ্গে এখন রেলের রিজার্ভেশন কাউন্টারে দালালের মাধ্যমে
মহিলাকর্মীরা ঘুষ নেন। কবিতার প্রয়োজন এই মহিলাদের জীবনে নেই। তিরিশের
দশকে, জীবনানন্দ, বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে প্রমুখের সময়ে
একজন মহিলাকর্মী ঘুষ নিচ্ছেন, ভাবা যেত না। অসৎ মধ্যবিত্ত পরিবারে শোকেসে
রবীন্দ্রনাথ, বঙ্কিম, বিবেকানন্দ রচনাবলী সাজানো থাকতে পারে, অতিথিদের
দেখাবার জন্য, কিন্তু এখনকার কবিদের গ্রন্থ থাকার সম্ভাবনা নেই; তাঁরা নামই
জানেন না এখনকার কবিদের।
চণ্ডীদাস, মাইকেল, রবীন্দ্রনাথের সময়ে,
স্কুল, কলেজ, টোলের শিক্ষকদের মাঝে ছিলেন অনেক পাঠক। আদর্শবাদিতা এবং
শিক্ষকতা প্রায় একটিই চারিত্রিক স্ফূরণরূপে স্বীকৃত ছিল। পাঠকের পরবর্তী
প্রজন্মটি গড়ে উঠত তাঁদের নেতৃত্বে এবং পথনির্দেশে। আজকের অধিকাংশ
শিক্ষকরা নতি স্বীকার করে বসে আছেন অসদুপায়ের কাছে, আলস্যের কাছে, ছিঁচকে
দলাদলির কাছে। ছাত্রদের তাঁরা ভুল পথে চালিত করেন, অধবা ছাত্র এবং
অভিভাবকদের দ্বারা ভুল পথে চালিত হন নিজেই। তাঁরা আজ অমানুষ গড়ার কারিগর।
যেহেতু তাঁদের বীজ-অস্তিত্বে সততার গোপন হাহাকার থেকে যায়, থেকে যায়
উবে-যাওয়া আদর্শবাদিত্বের কাঙ্ক্ষিত স্মৃতির রেশ, তাই তাঁদের মনে হয় যে
আগেকার কালের মতন কবিতা গল্প উপন্যাস নাটক লেখা হয় না। আসলে তাঁরা নিজেরাই
যে আগেকার কালের মতন নন, তাঁদের নিজেদেরই চারিত্রিক স্খলন ঘটে গেছে, তাঁরা
যে আজ দলবদ্ধভাবে সাংস্কৃতিক পরাজয়ের শিকার, সেই তথ্যটিকেই তাঁরা স্বীকৃতি
দেন। অমন চরিত্রের অধিকারীদের পক্ষে নিজেরা কবিতার পাঠক হওয়া এবং কবিতার
পাঠকের প্রজন্ম তৈরি করা অসম্ভব।
আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিকরাও এঁদের স্কুল থেকে ফেল করে বা টুকলি করে বেরিয়েছেন
যে-শিক্ষকরা বাংলা ভাষা স্কুলে-কলেজে
পড়ান, তাঁদের ক্ষেত্রে ব্যাপারটি আরও দয়নীয়, কেননা তাঁরা ওই ভাষায় এই জন্যে
স্নাতক যে অন্যান্য বিষয়ের, যেমন বিজ্ঞান গণিত ইনজিনিয়ারিং ডাক্তারি
ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি এলাকাগুলোতে মেধাবী ও অধ্যাবসায়ী ছাত্রদের সঙ্গে
প্রতিদ্বন্দ্বিতায় তাঁরা টিকতে পারেন নি। যাঁরা টুকলি করে পাস এবং রাজনীতিক
দাদাদের দয়ায় শিক্ষকতা যোগাড় করেছেন তাঁদের যোগ্যতা আলোচনা না করাই ভালো।
আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতিকরাও এঁদের স্কুল থেকে ফেল করে বা টুকলি করে
বেরিয়েছেন।
প্রাগাধুনিক সাহিত্য সম্পর্কে বিমূর্ত
নস্টালজিয়া কিন্তু দেখা যায় নি আধুনিক বাংলা সাহিত্যের সূচনাকালে, কারণ তখন
আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের শেষ পর্যায়, এবং পাঠকমাত্রেই উদগ্রীব ও
উদ্বুদ্ধ। তখন যারা ছিল অধঃপতিত ও স্খলিত, তারা ছিল ব্রিটিশ
এসট্যাবলিশমেন্টের সঙ্গে, তারা কবিতার পাঠক ছিল না। যে-পাঠক ব্রিটিশ
এসট্যাবলিশমেন্টের হয়ে সাহিত্য পড়েছে, সে শুধু দীনবন্ধু মিত্র বা নজরুলের
লেখায় দাগা দিয়েছে তাঁদের পাঠবস্তুকে উপনিবেশের মালিকের নজরে আনার জন্যে।
এখনকার তুলনায় তখন পাঠকসমাজে পরিষ্কার বিভাজন ছিল। ব্যক্তিজীবনে সৎ,
আদর্শবাদী, আত্মত্যাগী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, জাতীয়তাবাদী এলিটদের ডাকে
সাড়া দিয়ে, স্বাধীনতা আন্দোলনে। এঁদের মধ্যেই ছিল পাঠকবর্গ। স্বাধীনতার
সঙ্গে হল দেশভাগ এবং এবং জাতীয়তাবাদীদের নেতৃত্বে সুখভোগের দৌড়। সে দৌড়ে
একটু-একটু করে, শামিল হয়ে গেল প্রায় সমগ্র পাঠকবর্গ। যে-সততা পাঠকবর্গকে,
মূলত কবিতার পাঠকবর্গকে, আলাদা গরিমায় রেখেছিল, তা হয়ে গেল নিশ্চিহ্ণ, যার
দরুণ কবিতার পাঠক একটি বিরল প্রজাতি হিসাবে বেঁচে রইল। রাজনীতি ও ইতিহাসের
জাহাজডুবিতে আমরা দেখলুম চারিদিকে পাঠকের পচা লাশ ভাসছে, আর আকাশে উড়ছে
কমার্শিয়াল সাহিত্যের শকুন। যারা জাহাজডুবি এড়িয়ে যেতে পেরেছে, তারা এখন
উত্তর-ঔপনিবেশিক বঙ্গীয় এসট্যাবলিশমেন্টের অন্তর্ভুক্ত। তাই কবিতা কেউ পড়ে
না বলাটা ভুল। বলা উচিত কবিতার পাঠকের মৃত্যু হয়েছে। কবিতা যারা পড়বে তারা
আর বেঁচে নেই।
অসৎ অধঃপতিত স্খলিত হবার ফলে, একদা-পাঠকের
কল্পনাজগতটিতে বিস্ময়ের স্থান সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। তার চিন্তার পৃথিবী
অর্থকরী ও ভোগকেন্দ্রিক। ভ্রমণে বেরোবার আগে সে ফিরে আসবার টিকিট সম্পর্কে
নিশ্চিন্ত হতে চায়। খবরের কাগজে বা টিভিতে উত্তেজক সংবাদ না থাকলে তার
আগ্রহ হয় না। তার জন্যে তাই চব্বিশ ঘন্টা ধরে ‘ব্রেকিং নিউজ’ নামে ফালতু
খবর তৈরি হয়। গভীর জ্ঞানের পরিবর্তে সে সবজান্তা হয়ে উঠতে চায়। সমস্যা না
থাকলেও সে নিজেকে জর্জরিত রাখার নেশায় মশগুল থাকতে চায়। সে সবার সম্পর্কে
প্রশ্ন তুলবে, কিন্তু সে চায় না যে তার সম্পর্কে কেউ আঙুল তুলুক। ভ্রমের যে
এলাকাটিতে তার নিবাস, সে জায়গায় কবিতার স্বপ্ন, কল্পনা ও বাস্তবের কোনও
প্রয়োজন নেই। এই লোকগুলো, বর্তমানের মজা লোটায় আক্রান্ত। ভবিষ্যতের ভিশান
থেকে এরা বঞ্চিত। নতুন ফ্রন্টিয়ারকে এরা বরদাস্ত করতে পারে না। এদের খাদ্য
হল সাংস্কৃতিক খিচুড়ি। স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হলে এরা শঙ্কিত হয়। এদের মূল
বিচরণক্ষেত্র হল বাজার, যে বাজার এদের অন্তরে নানা চাহিদা গড়ে তোলে, এবং
কৃত্রিম চাহিদাকে তারা রূপান্তরিত করে দাবিদাওয়ায়, যে দাবিদাওয়া মেটাতে অসৎ
না হয়ে উপায় নেই। এই অধঃপতনকে বৈধতা দেবার জন্যে, এই স্খলনকে ন্যায্যতা
আরোপের জন্যে, ওই বাজার থেকেই তাকে সংগ্রহ করতে হয় উপাদান। বাজারে, যে
বাজারে সব কিছুই আজ সাংস্কৃতিক বস্তু হয়ে উঠেছে, ওই সংস্কৃতির বাজারে,
কবিতার কদর নেই। কবিতাকে জোর-জবরদস্তি নিজেকে সংস্কৃতির অঙ্গ প্রমাণ করতে
হচ্ছে। তাই অতীত নিয়ে নানা প্রকার আদিখ্যেতা হলেও, দেখা যায়, অতীতের কবিদের
কবিতাও কেউ পড়ছে না। কেউ যখন বলে যে আগেকার মতো লেখালিখি হয়নাকো আর, বুঝতে
হবে সে একজন ধাপ্পাবাজ, কেননা সে নিজেই আগেকার কালের কবিতার সঙ্গে পরিচিত
নয়। কবিতার পাঠ কমে আসার কারণ সেহেতু কবিতা নয়। কারণ হল বাঙালি পাঠকের
মৃত্যু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন