একজন নিজেকে চিহ্ণিত করতে ভালোবেসেছেন এক 'সফল না-লেখক' হিসেবে আর অন্যজন নিজের দিকে আঙুল তুলেছেন 'কালচারাল বাস্টার্ড' বলে । একজন তীক্ষ্ণ কলমে আজীবন ছিঁড়ে ফালাফালা করে দেখাতে চেয়েছেন নিজের সময় তথা প্রজন্মকে আর অন্যজন কলমের আদলে, যেন বা গাণ্ডীব, তুলে ধরেছেন আদ্যন্ত নিজেকেই, এবং চারপাশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে নয়, বরং বড় বেশি একাকার করে নিয়ে, শিকড়-বাকড়-সহ, সবশুদ্ধ । একজন 'প্রয়াণের পরেও' সত্যিই 'বাংলা ভাবনা তথা সচেতনতার গদ্যভাষাকে ডেনমার্কের রাজকুমারের মতন এক আঙুলে শাসন করে চলেছেন এবং সম্ভবত যতদিন বাংলা ভাষা-সাহিত্য জীবিত থাকবে ততদিন করেও যাবেন', আর অন্যজন অনুবাদক হিসাবে অকাদেমি পুরস্কারের পাশাপাশি গলা খাঁকারি দিয়ে বলে দিতে দ্বিধা করেন না যে, 'পুরস্কার আমার লেখালিখিকে গৌরবান্বিত করার বদলে খেলো আর খাটো করে দেবে', এবং এই মুহূর্তেও নিজের মুখোমুখি বসে যাঁর বলতে গলা কাঁপে না যে, 'রাষ্ট্রধর্ম কনসেপ্টটাই দুর্বৃত্তসুলভ । রাষ্ট্রের আবার ধর্ম হয় নাকি ? তাহলে তো পথঘাট, লাউ-কুমড়ো, কাক-কোকিলেরও রাষ্ট্রধর্ম থাকবে।" একজনের লেখা তো বটেই, এমনকি ভাবনা তথা বাগভঙ্গীতেও ধরা পড়ে বৈশ্বিক বাঙালির 'মননের পপতিটি আড়মোড়া', আর সেই ষাটের দশকের শেষে নকশাল মুভমেন্টের ধাক্কায় যখন থেকে বাঙালি মধ্যবিত্তের রাজনীতি-ভাবনা ছেড়েই দিন এমনকী তার হেঁশেল তথা খাওয়ার ঘরটা অব্দি ছারখার হতে শুরু করেছে, সেই উপদ্রুত সময়পর্বে নিজেকে নিরুপায়ভাবে চিহ্ণিত করে চলেন 'মেজরিটির বিরুদ্ধে মাইনরিটির কন্ঠ' হিসেবে, আরেকজন পিষে নিশ্চিহ্ণ করা হবে জেনেও আপাদমাথা বিরুদ্ধ কেবল নয়, বরং বলা ভালো বিরুদ্ধতম পরিসরেও মাথা তথা শিরদাঁড়া সিধে রেখে টিকে থাকার লড়াই লড়তে পারেন কেবলমাত্র 'এথিকাল বৈধতা' সম্বল করে। ২০১৮-এর বইমেলায়,প্রতিভাসকে ধন্যবাদ, একই সঙ্গে, পাশাপাশি এমন দুজনের 'কথাবার্তা সংগ্রহ' প্রকাশ করার জন্যে । এখানে বলে নেওয়া যাক, এতক্ষণ যে দুজনের কথা বলা হল ওপরে, তাঁদের একজন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় ও অন্যজন মলয় রায়চৌধুরী ।
'কথাবার্তা সংগ্রহ' বলতে আমরা এখানে যা বোঝাতে চাইছি তা সন্দীপন ও মলয়ের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনকে দেয়া সাক্ষাৎকারের সংকলনকে, এটা বলে বোঝানোর আলাদা দরকার নেই অবশ্যই । বিপুল আকারের এই সংগ্রহদ্বয়ের পাতায় পাতায় পাঠক যেমন পাবেন কৃত্তিবাস ও হাংরি আন্দোলন পর্ব থেকে বাংলা ও বাঙালির মানসিক দাঁড়াবার জায়গাটুকুর ক্রমবিবর্তমান ভেতরের চেহারাটার আদল, তেমনি আবার পাবেন বাঙালির সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক চিন্তাভাবনার আজকের দিগন্তেরও হদিশ । বলা বাহুল্য, বিপুল মাপের এই সংকলনদ্বয়ের অন্যতম গুরুত্ব এখানেই । গত শতকের ছয়ের দশকের শেষ, অর্থাৎ যখন থেকে বাংলা ও বাঙালির জীবনে সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক বিবিধ ঘাত-পপতিঘাত প্রতিনিয়ত নতুন থেকে নতুনতর চেহারা পেতে শুরু করেছে, যার মধ্যে দিয়েই স্পষ্ট হয়ে বেরিয়ে আসছেন এই সংগ্রহদ্বয়ের অবলম্বিত মূল দুই ব্যক্তিত্ব, তৈরি হয়ে উঠছে তাদের নির্দিষ্ট আদল, সেই তখন থেকে শুরু হয়ে, এই 'কথাবার্তা সংগ্রহ' আমাদের এনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে একেবারে সাম্প্রতিক কালে । এবং তারই মধ্যে কিন্তু প্রতি পলে ধরিয়ে দেওয়া হতে থেকেছে সময়ের প্রতিটি পা-তোলা পা-ফেলা ---- যেটা কিনা এখানে আসল কথা ।
'ওঁর কথা বলার একটা নিজস্ব বাচনিক পদ্ধতি ছিল । থেমে থেমে মজা করে কথা বলতেন' --- ধরিয়ে দিয়েছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের 'কথাবার্তা সংগ্রহ'-এর সংকলক ও সম্পাদক অদ্রীশ বিশ্বাস । কিন্তু সেই মজার মূলে যে ছিল কোনো কোনো মহল, বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের জন্যে তো বটেই, কখনো কখনো তাঁর চার পাশের অজস্র প্রিয়জনদের জন্যেও এমনকী, আপাদমস্তক কতটা বিপজ্জনক সত্যভাষণ তা হাড়ে হাড়ে টের পেতে পড়তে হয় ২৪৫ পৃষ্ঠার এই সংকলনটিতে, পড়তেও হবে না, শুধু একটু চোখ বোলালেই হবে । যেমন ধরা যাক 'সংবাদ প্রতিদিন'-এ ১৯৯৬-এর ফেব্রুয়ারিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং অন্যান্যদের সঙ্গে কথোপকথনের একদম শিরোনামেই সন্দীপন জানিয়ে দিচ্ছেন "কৃত্তিবাস" বেরিয়েছিল বলেই আমরা লেখক, "দেশ" পত্রিকা বেরিয়েছিল বলে আমরা লেখক নই ( পৃ ১১০ ), বা ধরুন অন্যত্র, যেখানে সন্দীপন জানাচ্ছেন 'যখন আমার সমসাময়িক গদ্যলেখকরা প্রায় সকলেই ইমিডিয়েট বাঙালি পূর্বসূরী কথাশিল্পীদের মধ্যে মুক্তি খুঁজছেন, আমি তখন বাংলা কবিতা পড়ে গেছি, বাংলা গল্প-উপন্যাসের তুলনায় বিদেশি লেখকদেরই আমি বেশি মন দিয়ে পড়েছি । যদিও তা খুবই সামান্য...' ( পৃ ২০৭ ), কিংবা আচমকা কোথাও বলে উঠছেন তিনি 'আমার লেখা হচ্ছে পুরোপুরি ননকন্টেমপ্লেটিভ এবং ননথিওরেটিকাল, স্রেফ মাংস বিক্রি...' ( পৃ ১৫২ ) ইত্যাদি। বলছেন আর তলেতলে এলোমেলো করে দিচ্ছেন আমাদের জন্য প্রতিষ্ঠানের সযত্নে বানিয়ে তোলা তথাকথিত এক-একটি মনোসামাজিক ধারণা -- এটাই ঘটনা । এবং এই প্রেক্ষিতে মলয় কিন্তু অনেক বেশি সরাসরি । মজার ধার অব্দি না ধেরে তাঁকে আমরা লক্ষ করি আর-একটুখানি স্পষ্ট গলায় বলে নিচ্ছেন, 'আমলাশোল আর ডুয়ার্সের চাষি আর মজুররা না খেতে পেয়ে মারা যাচ্ছে বলে সরকারকে তুলোধনা করব । নিজেকে ক্ষুধার্ত বলব কেন ?' তিক্ত গলায় বলছেন, 'হাংরি আন্দোলন থেকে বেরিয়ে যারা সিপিএম-এর ছত্রছায়ায় ঢুকেছিল, তারাই এই গোলমালটা বাধিয়েছে । দিব্বি চাকরি-বাকরি করে আরামে থেকেছে আর নিজেদের বলেছে সর্বহারা ।' ( পৃ ১৫২ ) প্রশ্ন তুলেছেন, 'প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতার বিরোধিতা লেখকরা না করলে কারা করবে ?' ( পৃ ৬২) আসলে এসব পড়তে পড়তেই বেশ বোঝা যায় সন্দীপন আর মলয় দুজনেই ঠিক কোন সচেতন ভূমি থেকে কাদের জন্যে কী লিখতে এসেছিলেন । স্পষ্ট হয়ে যায় দিনানুদৈনিকতায় গা-ভাসানো লেখকদের থেকে এঁরা কোথায় আলাদা, কতটুকু অন্যরকম, কোথায় তাঁরা সৎ আর দ্রষ্টা । ২৪৫ আর ৩১২ পাতার এই দুটি সংকলনের আসল মূল্য বা গুরুত্ব, এগুলো ঠিক কোথায় আর কতটুকু । বাকিটা -- অর্থাৎ ওই বিবিধ মজা আর সন্দীপনীয় জবানে এনটারটেনমেন্ট ( পৃ ৬ ) তো বটেই, বিশেষ করে ফেলে আসা সময়ের গনগনে আঁচ, সেসব এখানে অবশ্যই উপরি পাওনা । স্বাধীনতা-উত্তর বাংলা সাহিত্য এবং পরিবেশ, মূলত সে পরিবেশের ক্রমিক বদলে যাওয়ার কারণ ও সেই করাণের অন্তর-প্রকৃতি, এসব নিয়ে ভবিষ্যতে যাঁরা কাজ করবেন, সমসময়ের বহু কুশীলব বিষয়ে সন্দীপন ও মলয়ের বহু মতামত ও পাঠ তাঁদের কতটা সাহায্য করবে জানি না, কিন্তু এই দুই সংকলনের অবলম্বিত মানুষ দুজনের সততা এবং উপলব্ধির ধাঁচ-ধরন যে তাঁদের অনেকটাই পথ দেখাবে তা এখানে আলাদা করে বলে রাখা বাহুল্যমাত্র ।
( কথাবার্তা সংগ্রহ, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সংকলন ও সম্পাদনা অদ্রীশ বিশ্বাস, দাম ৪০০ টাকা । কথাবার্তা সংগ্রহ, মলয় রায়চৌধুরী, সংকলন ও সম্পাদনা প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়, দাম ৪০০ টাকা । প্রতিভাস প্রকাশন, ১৮ এ, গোবিন্দ মণ্ডল রোড, কলকাতা ৭০০ ০০২ । ফোন : ০৩৩-২৫৫৭-৮৬৫৯ এবং ০৩৩-৬৫৪৪-৪৮৯৮ ) Email : prativash1986@rediffmail.com
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন