বাংলা সাহিত্যে
স্হিতাবস্হা ভাঙার
আওআজ তুলে, ইশতাহার
প্রকাশের মাধ্যমে,
শিল্প ও সাহিত্যের যে
একমাত্র আন্দোলন
হয়েছে, তার নাম হাংরি
আন্দোলন, যাকে অনেকে
বলেন হাংরিয়ালিস্ট,
ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর,
ক্ষুধার্ত আন্দোলন।
আর্তি বা কাতরতা
শব্দগুলো মতাদশর্টিকে
সঠিক তুলে ধরতে পারবে
না বলে, আন্দোলনকারীরা
শেষাবধি হাংরি শব্দটি
গ্রহণ করেন। হাংরি
আন্দোলন, এই শব্দবন্ধটি
বাংলাভাষায় ঠিক
সেভাবে প্রবেশ করেছে যে
ভাবে মুসলিম লিগ,
কম্ম্যুনিস্ট পার্টি
বা কংগ্রেস দল ইত্যাদি
সংকরায়িত
শব্দবন্ধগুলো।
উত্তর-ঔপনিবেশিক
ভারতবর্ষে ডিসকোর্সের
সংকরায়ণকে স্বীকৃতি
দেয়া তাঁদের
কর্মকাণ্ডের অংশ ছিল।
১৯৬১ সালের নভেম্বরে
পাটনা শহর থেকে একটি
ইশতাহার প্রকাশের
মাধ্যমে হাংরি
আন্দোলনের সূত্রপাত
করেছিলেন সমীর
রায়চৌধুরী, মলয়
রায়চৌধুরী, শক্তি
চট্টোপাধ্যায় এবং
হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী
রায়। কবিতা সম্পর্কিত
ইশতাহারটি ছিল
ইংরেজিতে, কেন না
পাটনায় মলয়
রায়চৌধুরী বাংলা
প্রেস পাননি।
আন্দোলনের প্রভাবটি
ব্যাপক ও গভীর হলেও,
১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে
হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে
যায়। নকশাল আন্দোলনের
পর উত্তরবঙ্গ এবং
ত্রিপুরাব তরুণ কবিরা
আন্দোলনটিকে আবার
জীবনদান করার চেষ্টা
করেছিলেন কিন্তু
তাত্ত্বিক ভিত্তিটি
জানা না থাকায় তাঁরা
আন্দোলনটিকে এগিয়ে
নিয়ে যেতে পারেননি ।
হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে, অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তাঁরা হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন। তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স। তাঁরা বললেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা-নির্ভ� �*, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত।" তাঁরা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে। ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠিও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্তবাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষ্মণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।
১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা,মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল করঞ্জাই এবং করুণনিধান মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রকর।
হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কেন না অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সংগ্রাহকদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষার্ধে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয় । বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন । এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধায়, সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । শ্মশান, গোরস্তান,ভাটিখানা,আওড� ��া** ও শেয়ালদা স্টেশনে তাঁরা কবিতা পাঠের আয়োজন করতেন;’মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা জীব-জন্তু, দেবতা, দানবের মুখোশ পাঠাতেন মন্ত্রী, সমালোচক, প্রশাসকদের; কবিদের সমালোচনা করতেন বিবাহের কার্ডে; তৎকালীন মানদণ্ডে অশ্লীল স্কেচ ও পোস্টার আঁকতেন ও বিলি করতেন; একটি গ্রন্হের দাম রাখতেন লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি.বি. সিল ।বাণিজ্যিক পত্রিকায় গ্রন্হ রিভিউ করার জন্য জুতোর বাক্স পাঠাতেন কিংবা শাদা কাগজ পাঠাতেন ছোটগল্প নামে। তাঁদের রচনায় প্রশাসন ও মিডিয়াকে আক্রমণ করতেন। বেনারস এবং কাঠমান্ডু গিয়ে সাহিত্য সম্পর্কহীন হিপিনীদের সঙ্গে মাদকসেবন এবং যৌন যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়ে সেখানকার সংবাদপত্রে শিরোনাম হতেন । পেইনটিং প্রদর্শনী করে শেষ দিন প্রতিটি ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিতেন। এই সমস্ত অসাহিত্যিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তাঁরা দাবী করতেন যে অচলায়তনকে ভাঙা যাবে। অবশ্য তাঁদের অনুকরণে পরবর্তীকালে বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এসেছেন বাংলা সাহিত্যে, যদিও সাহিত্যের বাইরে তাঁরা অন্য কাজ করেননি। কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের কার্যকলাপে প্রশাসন অচিরে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হল ।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ান পিনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তাঁরা হলেন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়। মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে।
মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান। অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করেন। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারাল। ১২০বি ধারাটি ছিল ষড়যন্ত্রের, এবং সে কারনে প্রত্যেক হাংরি আন্দোলনকারী সম্পর্কে ডোসিয়ার খুলে ফেলেছিলেন কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগ। গ্রেফতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পান্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি ।
কৃত্তিবাস আর হাংরির উগ্রতা ও যৌন ধর্মী অ্যাজেন্ডায় কিছু মানুষ ততদিনে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে। মৃণাল বসু চৌধুরীর ‘কবিপত্র’ তখনকার ঐতিহ্যশালী পত্রিকা। পুস্কর দাসগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে উঠল শ্রুতি আন্দোলন। মৃণাল বসু চৌধুরী ও পরেশ মন্ডল শ্রুতি আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু ঐতিহ্যশালী ও হাংরির বাইরে অন্য কিছু একটা করে দেখাবার, যা বামপন্থী স্লোগান সর্বস্বতার বাইরে, যা কিনা সমাজ, সংস্কার, উগ্র আধুনিকতার বাইরের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেবে। ১৯৬৮ সালে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আর এক দল যুবক শুরু করলেন ধ্বংসকালীন আন্দোলন। ‘সাম্প্রতিক’ পত্রটি হল এর মুখপত্র। আর ‘কবিপত্র’ তার সহযোগী। মণীন্দ্র গুপ্তর তাগাদায় পবিত্র মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’। ইসলামের বিরোধী চরিত্র ইবলিশ ছিল এর নায়ক। বিপুল সাড়া পড়ে যায় এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এক বছর চলেছিল ধ্বংসকালীন আন্দোলন।
এর পরবর্তী সময়ে সেভাবে আর কোন কবিতা আন্দোলন দানা বাঁধে নি। নকশাল পিরিয়ডে কিছু রাজনৈতিক স্লোগান ধর্মী পুস্তিকা ও হ্যান্ডবিলের আদান প্রদান হয়েছে। অবশ্য সেই অস্থির সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই কবিতা আন্দোলন করার মত মানসিকতা ছিল না তখনকার যুবকদের। এর পরে একক ভাবে অনেক কবি উঠে এসেছেন। কিন্তু কবিতা হয়ে গেছে কলকাতা অভিমুখী। অর্থাৎ নাম, যশ বা কবিতা চর্চা হয়ে গেছে কলকাতা কেন্দ্রিক। এর ফলে সরকারী অ্যাকাডেমি যেমন তৈরি হয়েছে, কলকাতার বাইরের লেখক ও কবিরা রয়ে গেছেন অচ্ছুৎ। কবিতায় রাজনীতির রঙ লেগেছে। সাধারণ মানুষ যারা কবিতা ভালোবাসে, তাদের মধ্যে আবার অস্থিরতা বেড়েছে। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে অনেকে জেলায় জেলায় নতুন পত্রিকা চালু করেছেন তাদের মুখপত্র হিসেবে। ততদিনে ইন্টারনেট এসে গেছে। যদিও নেট-এর হাত ধরে বৃহত্তর দুনিয়ায় পৌঁছনো মানুষের সংখ্যা তখন কম।
এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘কৌরব’। একদম শুরুতে ১৯৬৮-৬৯ এ কৌরব নাট্যগোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জামশেদপুরে, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, সুভাষ ভট্টাচার্য্য, অরুণ আইন ও শক্তিপদ হালদারের হাত ধরে। এ’ছাড়াও নিয়মিত কবিতা গদ্যের পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ’ভাবেই কৌরবে ভেড়ে স্বদেশ সেন-এর নৌকো। ২০০৪ এর কৌরব ১০০ সংখ্যা অব্দি টানা সম্পাদনার দায়িত্বে কমল চক্রবর্তী। ১৯৯৮-এর শরতে আমেরিকা থেকে আর্যনীল মুখোপাধ্যায় আন্তর্জালে তোলেন কৌরবকে। কৌরব অনলাইনে প্রথম প্রথম ছাপা হয় প্রিন্ট পত্রিকার নির্বাচিত লেখা। ১৯৯৯ থেকে তাতে তোলা হতে থাকে ই-মেল-এ আসা পৃথিবীর নানাপ্রান্তের বাংলা কবিতাও। এ’ছাড়াও অনলাইনে যোগ হতে থাকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনের সাতপাঁচ এবং কবিতা। কৌরবের পাতায় লেখেন লরেন্স ফের্লিংঘেটি, জন অ্যাশবেরি, পিটার গিজ্জি, ক্রিস স্ট্রফোলিনো, চার্লস বার্নস্টাইন, রন সিলিম্যান প্রমূখ। ২০০৪-এ আনুষ্ঠানিক ভাবে কৌরব বন্ধ হয়ে গেলে নতুন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা ও পরিচালনা শুরু করেন আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, সঙ্গে সুদেষ্ণা মজুমদার, অভিজিৎ মৈত্র ও সব্যসাচী সান্যাল।
এই সময়েই (২০০২সালে) বারীন ঘোষালের হাত ধরে চিরাচরিত কবিতার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মেনিফেস্টোবিহীন ‘নতুন কবিতা’ আত্মপ্রকাশ করে। এই পত্রিকায় স্বপন রায় আর রঞ্জন মৈত্র ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় থেকেছেন অভিজিৎ মিত্র, ইন্দ্রনীল ঘোষ, অরূপরতন ঘোষ এবং এখন রয়েছেন তপোন দাশ এবং সব্যসাচী হাজরা! কিন্তু কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত আর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শুভাকাঙ্খী না থাকলে “নতুন কবিতা”কে চোদ্দ বছর ধরে চালানো যেত না! পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই চেষ্টা করা হয়েছিল কবিতা’র তত্ত্ব নয়, কবিতা’র ভাবনাই হবে “নতুন কবিতা”র বিচরণক্ষেত্র! প্রথম সংখ্যাটি ছিল “সম্ভাবনার কবিতা” এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে! নতুনভাবে কবিতাকে আবিষ্কার করা প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কবিরা সাধারণভাবে করবেন না! অথচ একটা দশক জুড়ে “নতুন কবিতা”র চর্চা একটা অভাবনীয় কাণ্ড করে ফেলেছিল! এঁদের কোন গুরুত্ত্ব ছিল না সিনিয়র কবিদের কাছে, তাঁরা নস্যাৎ করতেন এঁদের, কটূ কথাও বলেছেন কেউ কেউ! আর এটাই স্বাভাবিক ছিল! আমরা যেহেতু কবিতা’কে বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম অতএব “স্থা”র পক্ষে থাকা জীবনানন্দীয় ধারা, বামপন্থী সামাজিক বাস্তবতার ধারা, পঞ্চাশ দশকীয় ছন্দে লিখতে থাকা পদ্যধর্মী ধারা ইত্যাদিতে জড়িয়ে থাকা বাংলা কবিতা লিখিয়েদের ৯০ শতাংশ কবি,কবিতার কাগজ, খবরের কাগজ, রাজনৈতিক দলের কাগজ ইত্যাদি সকলের কাছেই এঁরা ব্রাত্য হয়ে গেলেন, এখনো তাই আছেন! কাউকে আক্রমণ না ক’রে, কারো প্রতি বিদ্বেষ বা অসূয়া প্রকাশ না ক’রে এঁরা লেখার চেষ্টা করছিলেন বাংলা কবিতায় যা লেখা হয়নি সেরকম কবিতা, এঁদের নিজেদের ভাষায়! এই কাজটা তরুণ কবিদের একটি অংশকে আকৃষ্ট করলো! মনে হয় কবিতাকে ভেতর থেকে ভেঙে গড়ার ইচ্ছেয় কেন্দ্র থেকে বেরনো প্রসারিত চেতনার অ্যাডভেঞ্চার তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল! ”নতুন কবিতা”র একটি সংখ্যা করা হল “শুন্য দশকের” শুরুতে লেখালিখি করা তরুণতম কবিদের নিয়ে! ”পা রাখো জুতোর বাইরে” এটাই ছিল ভাবনাসূত্র ওই সংখ্যার! ভাবনাকে চলিষ্ণু রাখার তাগিদেই করা হল “কবির দরজা”,”কবিতা ও সিনেমা”,”টাইম মেশিন” ইত্যাদি সংখ্যা!
২০০৯সালে আন্তর্জালে এলো অনুপম মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাক’। শুধুমাত্র ব্লগ নির্ভর বাংলার প্রথম পত্রিকা। এখানেও নতুনকে, নতুন ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ও হয়। অনুপম মুখোপাধ্যায় নিজে ‘পুনরাধুনিক কবিতা’ লেখেন। এই পুনরাধুনিক সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, পুনরাধুনিক কোনো তত্ত্ব নয়। এটা ভাবনা। যাপন আর সমাজের মধ্যে এর ঘোরাফেরা। মূল ব্যাপারটা হল একজন কবি বা শিল্পীর হাঁফিয়ে ওঠা। সে আর নিতে পারছে না অধুনান্তিক কালপর্বের অবান্তর বেঁচে থাকাকে, একজন স্রষ্টা হিসেবে নিজের অকিঞ্চিৎকরতাকে। ১৯৩০ থেকে এই ২০১৬ অবধি, খুব কৌশলে বাংলা কবিতা থেকে একজন কবির একলা চলার ব্যাপারটাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রতাপশালী বিবিধ প্রতিষ্ঠানের মুখে বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে যেন সাপের মুখে ছুঁচো- প্রতাপ পারছে না কবিতাকে গ্রাস করতে, পারছে না তাকে মুছে ফেলতে। বাণিজ্যিক পত্রে কবিতা ছাপা হয়, এই কারণে নয় যে পত্রিকাটির কবিতা প্রয়োজন আছে। এই কারণেই প্রতিষ্ঠান তার সুবিধাজনক কবিতাগুলোকে প্রকাশ করে যাতে কবিতার দ্রোহ এবং কবির আগুন জনসাধারণের চোখে এসে না পড়ে। একজন পুনরাধুনিক কবি কোনো প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হবেন না। তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠ হবেন। নিজের কবিতাকে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায় তিনি নিজেই নেবেন। সেই চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা কবিতার যাবতীয় গুণ তিনি আত্মসাৎ করবেন। কী লিখবেন না, এ নিয়ে তাঁর ভাবনা যাবে ফুরিয়ে। তিনি শুধু সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি কী লিখবেন। এক পৃথিবী লেখার আছে তাঁর। কবিতার কোনো লক্ষণ ও কোনো উপাদানই তাঁর চোখে অপাংক্তেয় নয়, দিব্যাস্ত্র অথবা হাতুড়ি- তাঁর প্রয়োজনমতো হাতে তুলে নেবেন। আবহমান কবিতার ধারায় একজন পুনরাধুনিক নিজেকে সনাক্ত করবেন। তাঁর লেখার ঘর, তাঁর কাজের ঘর, তাঁর সাধনকক্ষ।
এরই মধ্যে নিঃশব্দে বাঁকুড়া জেলায় অঙ্ক-কবিতা লেখা হয়েছে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে। লিখেছেন শুভঙ্কর রায় । 'শুভঙ্করী আর্যা ' তাঁরই রচনা। বিনয় মজুমদার, প্রভাত চৌধুরী, ভট্টাচার্য চন্দন, অসিত বসু, রতন দাস, পিনাকী রঞ্জন সামন্ত বাংলা ভাষায় অঙ্ক কবিতা লিখেছেন। যদিও এই অঙ্ক-কবিতাকে কোন আন্দোলন বলা যাবে না, তবু এই ধারাটি নিয়ে সম্প্রতি কার্ল কেম্পটনের সূত্র অনুযায়ী চর্চা করে চলেছেন অনিন্দ্য রায়। যে তত্ত্বের ওপর ওঁরা নির্ভর করছেন, তা এই রকম - গণিত যদি বিষয় হিসেবে, রূপক হিসেবে, অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে, যেকোনো রূপে, যে কোনো ভাবে কবিতায় ব্যবহৃত হয়, তাকেই এঁরা গাণিতিক কবিতা বলেন।
গণিত যেমন কয়েকটি শাখায় বিভক্ত, গাণিতিক কবিতাও যে শাখা রচিত সেইভাবে বিভিন্ন রকমের হতে পারে
• পাটীগাণিতিক কবিতা ( arithmetical poetry)
• বীজগাণিতিক কবিতা ( algebraic poetry )
• জ্যামিতিক কবিতা(geometrical poetry)
• ক্যালকুলাস কবিতা (calculus poetry)
• পরিমিতিক কবিতা
প্রভৃতি
এবং মিশ্র গাণিতিক কবিতা(mixed mathematical poetry ), যেখানে একটি কবিতায় গণিতের একাধিক শাখার ধারণা একই সাথে ব্যবহার করা হয়।
এর মধ্যে বাংলা ভাষায় এখনো অব্দি জ্যামিতিক কবিতা ও সম্ভাবনা কবিতা (probability poetry) বেশি লেখা হয়েছে।
আশা করি, গণিতের অন্যান্য শাখাগুলি ভবিষ্যতে বাংলা কবিতার দিগন্ত আরো প্রসারিত করবে।
....
গাণিতিক কবিতা লেখা হতে পারে
• আক্ষরিক কবিতা(lexical poetry), অর্থাৎ কেবল মাত্র অক্ষর দিয়ে রচিত। এখানে গণিতের কনসেপ্ট ব্যবহৃত হয় কবিতার থিম হিসেবে, মেটাফর হিসেবে। কিন্তু কবিতাটি রচিত হবে অক্ষর দিয়েই।
• সমীকরণ কবিতা, (equational poetry) যেখানে একটি সমীকরণ দিয়ে কবিতাটি লেখা হবে।
• দৃশ্য কবিতা (visual poetry ) যা অঙ্কের বিষয় নিয়ে রচিত হবে।
• সংখ্যা কবিতা. (number poetry ) যেখানে কবিতা প্রকাশ পাবে সংখ্যা দিয়ে।
•গ্রাফিক্যাল কবিতা (graphical poetry ), এখানে কবিতার মাধ্যম হবে গ্রাফ ।
এবং •সংকর কবিতা,( hybrid mathematical poetry ) যেখানে উপরের বিভাগগুলির এক বা একাধিক কনসেপ্ট ও টেকনিক ব্যবহৃত হবে।
বর্তমানে ওয়েব এবং ব্লগ গজিয়ে উঠছে ভুঁইফোড়ের মত। যেহেতু প্রিন্ট পত্রিকা চালানো খরচ সাপেক্ষ, তাই এত বেশি ওয়েব/ ব্লগের রমরমা। আর সম্পাদনা মানে দাঁড়িয়েছে কিছু লেখা জোগাড় করে প্রকাশ করে ফেলা। এবং লেখা নেওয়া হচ্ছে ফেসবুক কেন্দ্রিক বন্ধুদের থেকে। নতুনরা বিশেষত, পুরনোরাও আছেন কেউ কেউ পত্রিকায় প্রকাশ মাত্রই ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করতে বেশি আগ্রহী। যেহেতু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। যে প্রক্রিয়া বেশির ভাগ সময়েই আত্মতুষ্টি ডেকে আনতে পারে। তবে এই ফেসবুক কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চারও একটা সুফল আছে। যদি কেউ সত্যিই লিখতে চায়, তার ভেতরে লেখার খিদে থাকে, তবে এখান থেকেই অনেক মালমশলা সে পেয়ে যেতে পারে। এবং সমঝদারের নজরেও পড়তে পারে। আর ওয়েব বা ব্লগ তো প্রায় পুরোটাই ফেসবুক নির্ভর। আবার গঠনমূলক কিছু হচ্ছে না, এমনও নয়। সংখ্যায় কম, এই যা। বাজারি পত্রিকার পাশাপাশি প্রচুর লিটল ম্যাগ জন্মাচ্ছে। গতানুগতিক লেখা এবং নামী অথচ ফুরিয়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকদের স্বর্গ এই বাজারি পত্রিকাগুলি। গতানুগতিকতার বাইরে অল্প কিছুই চিরকাল হয়েছে, এখনও তাই। কিন্তু কোন সাহিত্য আন্দোলন আর সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। সম্ভবত আত্মকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার ফল এটি। কবি, সাহিত্যিকদের গোষ্টী আগেও ছিল, কিন্তু এখনকার গোষ্ঠী যেন কলম ছেড়ে বড় বেশি পেশী নির্ভর। সাহিত্য অ্যাকাডেমি আগেই ছিল, সম্প্রতি কবিতা অ্যাকাডেমি গঠিত হয়েছে অ্যামেরিকার আদলে। রাজনৈতিক রঙ দেখা হবে না এবং যোগ্য কবিরা মর্যাদা পাবে, এই আশা বুকে নিয়ে আছি আমরা।
হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম বাক্যটি থেকে, অর্থাৎ দেশভাগোত্তর বাঙালির কালখণ্ডটিকে তাঁরা হাংরিরূপে চিহ্ণিত করতে চাইলেন। তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে । স্পেংলার বলেছিলেন, একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয়। তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না। যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয়। তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় তাই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন। হাংরি আন্দোলনকারীদের মনে হয়েছিল দেশভাগের ফলে ও পরে পশ্চিমবঙ্গ এই ভয়ংকর অবসানের মুখে পড়েছে, এবং উনিশ শতকের মণীষীদের পর্যায়ের বাঙালির আবির্ভাব আর সম্ভব নয়। সেকারণে হাংরি আন্দোলনকে তঁরা বললেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্যকৃতিকে কাউন্টার ডিসকোর্স। তাঁরা বললেন, "ইউরোপের শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো সংঘটিত হয়েছিল একরৈখিক ইতিহাসের ধারণার বনেদের ওপর; কল্লোল বা কৃত্তিবাস গোষ্ঠী যে নবায়ন এনেছিলেন সে কাজগুলো ছিল কলোনিয়াল ইসথেটিক রিয়্যালিটি বা ঔপনিবেশিক বাস্তবতার চৌহদ্দির মধ্যে, কেন না সেগুলো ছিল যুক্তিগ্রন্থনা-নির্ভ� �*, এবং তাঁদের মনোবীজে অনুমিত ছিল যে ব্যক্তিপ্রতিস্বের চেতনা ব্যাপারটি একক, নিটোল ও সমন্বিত।" তাঁরা বললেন, "এই ভাবকল্পের প্রধান গলদ হল যে তার সন্দর্ভগুলো নিজেদেরকে পূর্বপুরুষদের তুলনায় উন্নত মনে করে, এবং স্হানিকতাকে ও অনুস্তরীয় আস্ফালনকে অবহেলা করে। ওই ভাবকল্পে যে বীজ লুকিয়ে থাকে, তা যৌথতাকে বিপন্ন আর বিমূর্ত করার মাধ্যমে যে-মননর্স্তাস তৈরি করে, তার দরুন প্রজ্ঞাকে যেহেতু কৌমনিরপেক্ষ ব্যক্তিলক্ষণ হিসাবে প্রতিষ্ঠা দেয়া হয়, সমাজের সুফল আত্মসাৎ করার প্রবণতায় ব্যক্তিদের মাঝে ইতিহাসগত স্হানাঙ্ক নির্ণয়ের হুড়োহুড়ি পড়ে যায়। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ব্যক্তিক তত্ত্বসৌধ নির্মাণ। ঠিক এই কারণেই, ইউরেপীয় শিল্প-সাহিত্য আন্দোলনগুলো খতিয়ে দেখলে দেখা যায় যে ব্যক্তিপ্রজ্ঞার আধিপত্যের দামামায় সমাজের কান ফেটে এমন রক্তাক্ত যে সমাজের পাত্তাই নেই কোনো । কৃত্তিবাস গোষ্ঠীর দিকে তাকালে দেখা যাবে যে পুঁজিবলবান প্রাতিষ্ঠানিকতার দাপটে এবং প্রতিযোগী ব্যক্তিবাদের লালনে শতভিষা গোষ্ঠী যেন অস্তিত্বহীন। এমনকি কৃত্তিবাস গোষ্ঠিও সীমিত হয়ে গেছে মাত্র কয়েকজন মেধাসত্তবাধিকারীর নামে। পক্ষান্তরে, ঔপনিবেশিক গণতন্ত্রের আগেকার প্রাকঔপনিবেশিক ডিসকোর্সের কথা ভাবা হয়, তাহলে দেখা যায় যে পদাবলী সাহিত্য নামক ম্যাক্রো পরিসরে সংকুলান ঘটেছে বৈষ্ণব ও শাক্ত কাজ, মঙ্গলকাব্য নামক পরিসরে সংকুলান ঘটেছে মনসা, চণ্ডী, শিব, কালিকা বা ধর্মঠাকুরের মাইক্রো-পরিসর। লক্ষ্মণীয় যে প্রাকৌপনিবেশিক কালখণ্ডে সন্দর্ভ গুরুত্ত্বপূর্ণ ছিল, তার রচয়িতা নয় ।
১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা,মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল করঞ্জাই এবং করুণনিধান মুখোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রকর।
হাংরি আন্দোলনকারিরা প্রধানত একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। যেগুলো পাটনা থেকে প্রকাশিত, সেগুলো ইংরেজিতে লেখা হয়েছিল। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করেছিলেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপ্তর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতি করেছেন নিজেদের, কেন না অধিকাংশ বুলেটিন সংরক্ষণ করা সংগ্রাহকদের পক্ষেও সম্ভব হয়নি।
সুবিমল বসাক, দেবী রায় ও মলয় রায়চৌধুরীর কিছু-কিছু কার্যকলাপের কারণে ১৯৬৩ সালের শেষার্ধে হাংরি আন্দোলন বাঙালির সংস্কৃতিতে প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী হিসাবে পরিচিত হয় । বহু আলোচক হাংরি আন্দোলনকারীদের সে সময়ের কার্যকলাপে ডাডাবাদের প্রভাব লক্ষ করেছেন । এই কারণে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধায়, সতীন্দ্র ভৌমিক প্রমুখ হাংরি আন্দোলন ত্যাগ করেন । শ্মশান, গোরস্তান,ভাটিখানা,আওড� ��া** ও শেয়ালদা স্টেশনে তাঁরা কবিতা পাঠের আয়োজন করতেন;’মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা জীব-জন্তু, দেবতা, দানবের মুখোশ পাঠাতেন মন্ত্রী, সমালোচক, প্রশাসকদের; কবিদের সমালোচনা করতেন বিবাহের কার্ডে; তৎকালীন মানদণ্ডে অশ্লীল স্কেচ ও পোস্টার আঁকতেন ও বিলি করতেন; একটি গ্রন্হের দাম রাখতেন লক্ষ টাকা বা কয়েকটি টি.বি. সিল ।বাণিজ্যিক পত্রিকায় গ্রন্হ রিভিউ করার জন্য জুতোর বাক্স পাঠাতেন কিংবা শাদা কাগজ পাঠাতেন ছোটগল্প নামে। তাঁদের রচনায় প্রশাসন ও মিডিয়াকে আক্রমণ করতেন। বেনারস এবং কাঠমান্ডু গিয়ে সাহিত্য সম্পর্কহীন হিপিনীদের সঙ্গে মাদকসেবন এবং যৌন যথেচ্ছাচারে লিপ্ত হয়ে সেখানকার সংবাদপত্রে শিরোনাম হতেন । পেইনটিং প্রদর্শনী করে শেষ দিন প্রতিটি ছবিতে আগুন ধরিয়ে দিতেন। এই সমস্ত অসাহিত্যিক কার্যকলাপের মাধ্যমে তাঁরা দাবী করতেন যে অচলায়তনকে ভাঙা যাবে। অবশ্য তাঁদের অনুকরণে পরবর্তীকালে বহু প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখক এসেছেন বাংলা সাহিত্যে, যদিও সাহিত্যের বাইরে তাঁরা অন্য কাজ করেননি। কিন্তু হাংরি আন্দোলনকারীদের কার্যকলাপে প্রশাসন অচিরে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হল ।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ইনডিয়ান পিনাল কোডের ১২০বি, ২৯২ এবং ২৯৪ ধারায় ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তাঁরা হলেন: সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুভাষ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ, প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়। মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে।
মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিশ্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান। অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করেন। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারাল। ১২০বি ধারাটি ছিল ষড়যন্ত্রের, এবং সে কারনে প্রত্যেক হাংরি আন্দোলনকারী সম্পর্কে ডোসিয়ার খুলে ফেলেছিলেন কলকাতা গোয়েন্দা বিভাগ। গ্রেফতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পান্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি ।
কৃত্তিবাস আর হাংরির উগ্রতা ও যৌন ধর্মী অ্যাজেন্ডায় কিছু মানুষ ততদিনে প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে উঠেছে। মৃণাল বসু চৌধুরীর ‘কবিপত্র’ তখনকার ঐতিহ্যশালী পত্রিকা। পুস্কর দাসগুপ্তের নেতৃত্বে গড়ে উঠল শ্রুতি আন্দোলন। মৃণাল বসু চৌধুরী ও পরেশ মন্ডল শ্রুতি আন্দোলনে যোগ দেন। কিন্তু ঐতিহ্যশালী ও হাংরির বাইরে অন্য কিছু একটা করে দেখাবার, যা বামপন্থী স্লোগান সর্বস্বতার বাইরে, যা কিনা সমাজ, সংস্কার, উগ্র আধুনিকতার বাইরের বিশ্বাসকে নাড়িয়ে দেবে। ১৯৬৮ সালে পবিত্র মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে আর এক দল যুবক শুরু করলেন ধ্বংসকালীন আন্দোলন। ‘সাম্প্রতিক’ পত্রটি হল এর মুখপত্র। আর ‘কবিপত্র’ তার সহযোগী। মণীন্দ্র গুপ্তর তাগাদায় পবিত্র মুখোপাধ্যায় লিখলেন ‘ইবলিশের আত্মদর্শন’। ইসলামের বিরোধী চরিত্র ইবলিশ ছিল এর নায়ক। বিপুল সাড়া পড়ে যায় এটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে। এক বছর চলেছিল ধ্বংসকালীন আন্দোলন।
এর পরবর্তী সময়ে সেভাবে আর কোন কবিতা আন্দোলন দানা বাঁধে নি। নকশাল পিরিয়ডে কিছু রাজনৈতিক স্লোগান ধর্মী পুস্তিকা ও হ্যান্ডবিলের আদান প্রদান হয়েছে। অবশ্য সেই অস্থির সময়ে স্বাভাবিক ভাবেই কবিতা আন্দোলন করার মত মানসিকতা ছিল না তখনকার যুবকদের। এর পরে একক ভাবে অনেক কবি উঠে এসেছেন। কিন্তু কবিতা হয়ে গেছে কলকাতা অভিমুখী। অর্থাৎ নাম, যশ বা কবিতা চর্চা হয়ে গেছে কলকাতা কেন্দ্রিক। এর ফলে সরকারী অ্যাকাডেমি যেমন তৈরি হয়েছে, কলকাতার বাইরের লেখক ও কবিরা রয়ে গেছেন অচ্ছুৎ। কবিতায় রাজনীতির রঙ লেগেছে। সাধারণ মানুষ যারা কবিতা ভালোবাসে, তাদের মধ্যে আবার অস্থিরতা বেড়েছে। কলকাতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে অনেকে জেলায় জেলায় নতুন পত্রিকা চালু করেছেন তাদের মুখপত্র হিসেবে। ততদিনে ইন্টারনেট এসে গেছে। যদিও নেট-এর হাত ধরে বৃহত্তর দুনিয়ায় পৌঁছনো মানুষের সংখ্যা তখন কম।
এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘কৌরব’। একদম শুরুতে ১৯৬৮-৬৯ এ কৌরব নাট্যগোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে জামশেদপুরে, কমল চক্রবর্তী, বারীন ঘোষাল, সুভাষ ভট্টাচার্য্য, অরুণ আইন ও শক্তিপদ হালদারের হাত ধরে। এ’ছাড়াও নিয়মিত কবিতা গদ্যের পাঠচক্র, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এ’ভাবেই কৌরবে ভেড়ে স্বদেশ সেন-এর নৌকো। ২০০৪ এর কৌরব ১০০ সংখ্যা অব্দি টানা সম্পাদনার দায়িত্বে কমল চক্রবর্তী। ১৯৯৮-এর শরতে আমেরিকা থেকে আর্যনীল মুখোপাধ্যায় আন্তর্জালে তোলেন কৌরবকে। কৌরব অনলাইনে প্রথম প্রথম ছাপা হয় প্রিন্ট পত্রিকার নির্বাচিত লেখা। ১৯৯৯ থেকে তাতে তোলা হতে থাকে ই-মেল-এ আসা পৃথিবীর নানাপ্রান্তের বাংলা কবিতাও। এ’ছাড়াও অনলাইনে যোগ হতে থাকে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কবিতা আন্দোলনের সাতপাঁচ এবং কবিতা। কৌরবের পাতায় লেখেন লরেন্স ফের্লিংঘেটি, জন অ্যাশবেরি, পিটার গিজ্জি, ক্রিস স্ট্রফোলিনো, চার্লস বার্নস্টাইন, রন সিলিম্যান প্রমূখ। ২০০৪-এ আনুষ্ঠানিক ভাবে কৌরব বন্ধ হয়ে গেলে নতুন করে তাকে বাঁচিয়ে তোলা ও পরিচালনা শুরু করেন আর্যনীল মুখোপাধ্যায়, সঙ্গে সুদেষ্ণা মজুমদার, অভিজিৎ মৈত্র ও সব্যসাচী সান্যাল।
এই সময়েই (২০০২সালে) বারীন ঘোষালের হাত ধরে চিরাচরিত কবিতার ওপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে মেনিফেস্টোবিহীন ‘নতুন কবিতা’ আত্মপ্রকাশ করে। এই পত্রিকায় স্বপন রায় আর রঞ্জন মৈত্র ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে সক্রিয় থেকেছেন অভিজিৎ মিত্র, ইন্দ্রনীল ঘোষ, অরূপরতন ঘোষ এবং এখন রয়েছেন তপোন দাশ এবং সব্যসাচী হাজরা! কিন্তু কবি সৌমিত্র সেনগুপ্ত আর অতনু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত শুভাকাঙ্খী না থাকলে “নতুন কবিতা”কে চোদ্দ বছর ধরে চালানো যেত না! পত্রিকার প্রথম সংখ্যা থেকেই চেষ্টা করা হয়েছিল কবিতা’র তত্ত্ব নয়, কবিতা’র ভাবনাই হবে “নতুন কবিতা”র বিচরণক্ষেত্র! প্রথম সংখ্যাটি ছিল “সম্ভাবনার কবিতা” এই ভাবনাকে কেন্দ্র করে! নতুনভাবে কবিতাকে আবিষ্কার করা প্রতিষ্ঠিত প্রবীণ কবিরা সাধারণভাবে করবেন না! অথচ একটা দশক জুড়ে “নতুন কবিতা”র চর্চা একটা অভাবনীয় কাণ্ড করে ফেলেছিল! এঁদের কোন গুরুত্ত্ব ছিল না সিনিয়র কবিদের কাছে, তাঁরা নস্যাৎ করতেন এঁদের, কটূ কথাও বলেছেন কেউ কেউ! আর এটাই স্বাভাবিক ছিল! আমরা যেহেতু কবিতা’কে বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে পাল্টে দেওয়ার চেষ্টা করছিলাম অতএব “স্থা”র পক্ষে থাকা জীবনানন্দীয় ধারা, বামপন্থী সামাজিক বাস্তবতার ধারা, পঞ্চাশ দশকীয় ছন্দে লিখতে থাকা পদ্যধর্মী ধারা ইত্যাদিতে জড়িয়ে থাকা বাংলা কবিতা লিখিয়েদের ৯০ শতাংশ কবি,কবিতার কাগজ, খবরের কাগজ, রাজনৈতিক দলের কাগজ ইত্যাদি সকলের কাছেই এঁরা ব্রাত্য হয়ে গেলেন, এখনো তাই আছেন! কাউকে আক্রমণ না ক’রে, কারো প্রতি বিদ্বেষ বা অসূয়া প্রকাশ না ক’রে এঁরা লেখার চেষ্টা করছিলেন বাংলা কবিতায় যা লেখা হয়নি সেরকম কবিতা, এঁদের নিজেদের ভাষায়! এই কাজটা তরুণ কবিদের একটি অংশকে আকৃষ্ট করলো! মনে হয় কবিতাকে ভেতর থেকে ভেঙে গড়ার ইচ্ছেয় কেন্দ্র থেকে বেরনো প্রসারিত চেতনার অ্যাডভেঞ্চার তরুণদের আকৃষ্ট করেছিল! ”নতুন কবিতা”র একটি সংখ্যা করা হল “শুন্য দশকের” শুরুতে লেখালিখি করা তরুণতম কবিদের নিয়ে! ”পা রাখো জুতোর বাইরে” এটাই ছিল ভাবনাসূত্র ওই সংখ্যার! ভাবনাকে চলিষ্ণু রাখার তাগিদেই করা হল “কবির দরজা”,”কবিতা ও সিনেমা”,”টাইম মেশিন” ইত্যাদি সংখ্যা!
২০০৯সালে আন্তর্জালে এলো অনুপম মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘বাক’। শুধুমাত্র ব্লগ নির্ভর বাংলার প্রথম পত্রিকা। এখানেও নতুনকে, নতুন ভাষাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে ও হয়। অনুপম মুখোপাধ্যায় নিজে ‘পুনরাধুনিক কবিতা’ লেখেন। এই পুনরাধুনিক সম্বন্ধে তিনি বলেছেন, পুনরাধুনিক কোনো তত্ত্ব নয়। এটা ভাবনা। যাপন আর সমাজের মধ্যে এর ঘোরাফেরা। মূল ব্যাপারটা হল একজন কবি বা শিল্পীর হাঁফিয়ে ওঠা। সে আর নিতে পারছে না অধুনান্তিক কালপর্বের অবান্তর বেঁচে থাকাকে, একজন স্রষ্টা হিসেবে নিজের অকিঞ্চিৎকরতাকে। ১৯৩০ থেকে এই ২০১৬ অবধি, খুব কৌশলে বাংলা কবিতা থেকে একজন কবির একলা চলার ব্যাপারটাকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছে। প্রতাপশালী বিবিধ প্রতিষ্ঠানের মুখে বাংলা কবিতা প্রবেশ করেছে যেন সাপের মুখে ছুঁচো- প্রতাপ পারছে না কবিতাকে গ্রাস করতে, পারছে না তাকে মুছে ফেলতে। বাণিজ্যিক পত্রে কবিতা ছাপা হয়, এই কারণে নয় যে পত্রিকাটির কবিতা প্রয়োজন আছে। এই কারণেই প্রতিষ্ঠান তার সুবিধাজনক কবিতাগুলোকে প্রকাশ করে যাতে কবিতার দ্রোহ এবং কবির আগুন জনসাধারণের চোখে এসে না পড়ে। একজন পুনরাধুনিক কবি কোনো প্রতিষ্ঠানের মুখাপেক্ষী হবেন না। তিনি আত্মপ্রতিষ্ঠ হবেন। নিজের কবিতাকে জনসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেওয়ার দায় তিনি নিজেই নেবেন। সেই চর্যাপদ থেকে আজ অবধি বাংলা কবিতার যাবতীয় গুণ তিনি আত্মসাৎ করবেন। কী লিখবেন না, এ নিয়ে তাঁর ভাবনা যাবে ফুরিয়ে। তিনি শুধু সিদ্ধান্ত নেবেন তিনি কী লিখবেন। এক পৃথিবী লেখার আছে তাঁর। কবিতার কোনো লক্ষণ ও কোনো উপাদানই তাঁর চোখে অপাংক্তেয় নয়, দিব্যাস্ত্র অথবা হাতুড়ি- তাঁর প্রয়োজনমতো হাতে তুলে নেবেন। আবহমান কবিতার ধারায় একজন পুনরাধুনিক নিজেকে সনাক্ত করবেন। তাঁর লেখার ঘর, তাঁর কাজের ঘর, তাঁর সাধনকক্ষ।
এরই মধ্যে নিঃশব্দে বাঁকুড়া জেলায় অঙ্ক-কবিতা লেখা হয়েছে খ্রীষ্টীয় অষ্টাদশ শতকে। লিখেছেন শুভঙ্কর রায় । 'শুভঙ্করী আর্যা ' তাঁরই রচনা। বিনয় মজুমদার, প্রভাত চৌধুরী, ভট্টাচার্য চন্দন, অসিত বসু, রতন দাস, পিনাকী রঞ্জন সামন্ত বাংলা ভাষায় অঙ্ক কবিতা লিখেছেন। যদিও এই অঙ্ক-কবিতাকে কোন আন্দোলন বলা যাবে না, তবু এই ধারাটি নিয়ে সম্প্রতি কার্ল কেম্পটনের সূত্র অনুযায়ী চর্চা করে চলেছেন অনিন্দ্য রায়। যে তত্ত্বের ওপর ওঁরা নির্ভর করছেন, তা এই রকম - গণিত যদি বিষয় হিসেবে, রূপক হিসেবে, অভিব্যক্তির মাধ্যম হিসেবে, যেকোনো রূপে, যে কোনো ভাবে কবিতায় ব্যবহৃত হয়, তাকেই এঁরা গাণিতিক কবিতা বলেন।
গণিত যেমন কয়েকটি শাখায় বিভক্ত, গাণিতিক কবিতাও যে শাখা রচিত সেইভাবে বিভিন্ন রকমের হতে পারে
• পাটীগাণিতিক কবিতা ( arithmetical poetry)
• বীজগাণিতিক কবিতা ( algebraic poetry )
• জ্যামিতিক কবিতা(geometrical poetry)
• ক্যালকুলাস কবিতা (calculus poetry)
• পরিমিতিক কবিতা
প্রভৃতি
এবং মিশ্র গাণিতিক কবিতা(mixed mathematical poetry ), যেখানে একটি কবিতায় গণিতের একাধিক শাখার ধারণা একই সাথে ব্যবহার করা হয়।
এর মধ্যে বাংলা ভাষায় এখনো অব্দি জ্যামিতিক কবিতা ও সম্ভাবনা কবিতা (probability poetry) বেশি লেখা হয়েছে।
আশা করি, গণিতের অন্যান্য শাখাগুলি ভবিষ্যতে বাংলা কবিতার দিগন্ত আরো প্রসারিত করবে।
....
গাণিতিক কবিতা লেখা হতে পারে
• আক্ষরিক কবিতা(lexical poetry), অর্থাৎ কেবল মাত্র অক্ষর দিয়ে রচিত। এখানে গণিতের কনসেপ্ট ব্যবহৃত হয় কবিতার থিম হিসেবে, মেটাফর হিসেবে। কিন্তু কবিতাটি রচিত হবে অক্ষর দিয়েই।
• সমীকরণ কবিতা, (equational poetry) যেখানে একটি সমীকরণ দিয়ে কবিতাটি লেখা হবে।
• দৃশ্য কবিতা (visual poetry ) যা অঙ্কের বিষয় নিয়ে রচিত হবে।
• সংখ্যা কবিতা. (number poetry ) যেখানে কবিতা প্রকাশ পাবে সংখ্যা দিয়ে।
•গ্রাফিক্যাল কবিতা (graphical poetry ), এখানে কবিতার মাধ্যম হবে গ্রাফ ।
এবং •সংকর কবিতা,( hybrid mathematical poetry ) যেখানে উপরের বিভাগগুলির এক বা একাধিক কনসেপ্ট ও টেকনিক ব্যবহৃত হবে।
বর্তমানে ওয়েব এবং ব্লগ গজিয়ে উঠছে ভুঁইফোড়ের মত। যেহেতু প্রিন্ট পত্রিকা চালানো খরচ সাপেক্ষ, তাই এত বেশি ওয়েব/ ব্লগের রমরমা। আর সম্পাদনা মানে দাঁড়িয়েছে কিছু লেখা জোগাড় করে প্রকাশ করে ফেলা। এবং লেখা নেওয়া হচ্ছে ফেসবুক কেন্দ্রিক বন্ধুদের থেকে। নতুনরা বিশেষত, পুরনোরাও আছেন কেউ কেউ পত্রিকায় প্রকাশ মাত্রই ফেসবুকে কবিতা পোস্ট করতে বেশি আগ্রহী। যেহেতু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। যে প্রক্রিয়া বেশির ভাগ সময়েই আত্মতুষ্টি ডেকে আনতে পারে। তবে এই ফেসবুক কেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চারও একটা সুফল আছে। যদি কেউ সত্যিই লিখতে চায়, তার ভেতরে লেখার খিদে থাকে, তবে এখান থেকেই অনেক মালমশলা সে পেয়ে যেতে পারে। এবং সমঝদারের নজরেও পড়তে পারে। আর ওয়েব বা ব্লগ তো প্রায় পুরোটাই ফেসবুক নির্ভর। আবার গঠনমূলক কিছু হচ্ছে না, এমনও নয়। সংখ্যায় কম, এই যা। বাজারি পত্রিকার পাশাপাশি প্রচুর লিটল ম্যাগ জন্মাচ্ছে। গতানুগতিক লেখা এবং নামী অথচ ফুরিয়ে যাওয়া কবি সাহিত্যিকদের স্বর্গ এই বাজারি পত্রিকাগুলি। গতানুগতিকতার বাইরে অল্প কিছুই চিরকাল হয়েছে, এখনও তাই। কিন্তু কোন সাহিত্য আন্দোলন আর সেভাবে তৈরি হচ্ছে না। সম্ভবত আত্মকেন্দ্রিক সাহিত্য চর্চার ফল এটি। কবি, সাহিত্যিকদের গোষ্টী আগেও ছিল, কিন্তু এখনকার গোষ্ঠী যেন কলম ছেড়ে বড় বেশি পেশী নির্ভর। সাহিত্য অ্যাকাডেমি আগেই ছিল, সম্প্রতি কবিতা অ্যাকাডেমি গঠিত হয়েছে অ্যামেরিকার আদলে। রাজনৈতিক রঙ দেখা হবে না এবং যোগ্য কবিরা মর্যাদা পাবে, এই আশা বুকে নিয়ে আছি আমরা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন