সমীর রায়চৌধুরী – হাংরি সময় থেকে অধুনান্তিক সময়ে
August 27, 2016
আমরা
সম্প্রতি হারালাম কবি ও সাহিত্যিক শ্রদ্ধেয় শ্রী সমীর রায়চৌধুরীকে । সমীর
রায়চৌধুরী এমন একজন গাছ-মানুষ, যার ছায়ায় গত শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে
শুরু করে এই শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক পর্যন্ত কয়েক প্রজন্মের কবি এবং
সাহিত্যিকরা, প্রচলিত বাজারি প্রাতিষ্ঠানিক স্বাতন্ত্র্য-হীন সাহিত্য
ভাবনার পরম্পরার যাঁতাকল থেকে বেরিয়ে, বাংলা সাহিত্যের ভাষা, বিষয়,
উপস্থাপনা, বিন্যাস ইত্যাদির দিগন্তকে প্রসারিত করার পরীক্ষা নিরীক্ষায়
উৎসাহিত হয়েছেন।
হাংরি আন্দোলনের অন্যতম
পুরোধা সমীর রায়চৌধুরীর জন্ম মামার বাড়ি ২৪ পরগণার পাণিহাটিতে ১৯৩৩ সালে।
তাঁর দাদামশায় কিশোরীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ম্যালেরিয়া রোগের কারণ
আবিষ্কারকারী স্যার রোনাল্ড রসের সহগবেষক। সমীর কলকাতার আদি নিবাসী
সাবর্ণ-রায়চৌধুরী পরিবারের উত্তরপাড়া শাখার সন্তান। তাঁর বাবা রঞ্জিত
রায়চৌধুরী ছিলেন পাটনা শহরের প্রাচীনতম ফটোগ্রাফি সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা।
জ্যাঠামশাই প্রমোদ রায়চৌধুরী ছিলেন পাটনা শহরের মিউজিয়ামের কিপার অব
পেইনটিংস অ্যান্ড স্কাল্পচার।
স্কুল
জীবন পাটনায় কাটিয়ে ১৯৪৯ সালে তিনি কলকাতার সিটি কলেজে গিয়ে বিজ্ঞান
শাখায় ভর্তি হন, এবং সেই সূত্রে পরিচিত হন সহপাঠী কবি দীপক মজুমদারের
সঙ্গে। সিটি কলেজের দেয়াল পত্রিকায় প্রকাশিত অন্য এক সহপাঠী কবির কবিতাকে
ভালো লাগাকে কেন্দ্র করে আলাপ হয় কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে। দীপক
মজুমদার এবং সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে বন্ধুত্বের সূত্রে কৃত্তিবাস
গোষ্ঠীতে সক্রিয় ভাবে জড়িয়ে পরেন। কৃত্তিবাস গোষ্ঠীতে যুক্ত থাকার সময়ে
তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছিল : ‘ঝর্ণার পাশে শুয়ে আছি’
এবং ‘আমার ভিয়েতনাম’ । এই সময়ে তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং নিজ অর্থে
প্রকাশ করেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়-এর কাব্য গ্রন্থ ‘একা এবং কয়েকজন’।
কৃত্তিবাস গোষ্ঠী ত্যাগের পর, হাংরি আন্দোলন-এর কারণে তাঁর কবিতায়
লক্ষণীয় বাঁক-বদল ঘটে, এবং তা প্রতিফলিত হয় তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্থ
‘জানোয়ার‘ এবং ‘আমার ভিয়েৎনাম’-এ । সেই সময়ে, নিমডি নামের সাঁওতাল
গ্রামের পাহাড়চূড়ায়, তাঁর চাইবাসার বাড়িটি, হয়ে উঠেছিল একটি
গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য-কেন্দ্র। ৫০ ও ৬০ দশকের বহু কবি ও লেখকের রচনায়
চাইবাসার কথা বারবার উচ্চারিত হয়েছে। নিমডিতে তার বাড়িতে দুই বছরের বেশী
ছিলেন কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কাব্যগ্রন্থ “হে
প্রেম হে নৈঃশব্দ্য”-এর প্রেমের কবিতা গুলি এই পর্বের লেখা।
১৯৬১
সালের নভেম্বরে তিনি ছোট ভাই মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও
দেবী রায়ের সঙ্গে হাংরি আন্দোলন শুরু করেন। পরে হাংরি আন্দোলনে যোগ দেন
উৎপলকুমার বসু, বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, সুবিমল বসাক, অনিল
করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, ফাল্গুনী রায়, ত্রিদিব মিত্র ও আলো
মিত্র, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরূপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ
ঘোষ, সতীন্দ্র ভৌমিক, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, শৈলেশ্বর ঘোষ, অশোক
চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর সেন, যোগেশ পাণ্ডা,
মনোহর দাশ প্রমুখ।
হাংরি
আন্দোলনকারীরা ‘হাংরি’ শব্দটি পেয়েছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের
‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে। তাত্ত্বিক ভিত্তি হয়েছিল
সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের ‘দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট’ গ্রন্থটির
দর্শন থেকে। স্পেংলারের মতে ‘সংস্কৃতি’ একটি জৈব প্রক্রিয়া। একটি
সংস্কৃতির ইতিহাস সরল রৈখিক নয়, তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় এবং
সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোন দিকে বাঁক বদল ঘটবে তা আগাম বলা যায়
না। স্পেংলার ‘সংস্কৃতি’ এবং ‘সভ্যতা’ এই দুই শব্দকে দুটি পৃথক অর্থে
ব্যাবহার করেছেন। তাঁর মতে, ‘সংস্কৃতি’ সৃজনশীল এবং “হয়ে ওঠার” প্রক্রিয়া।
‘সংস্কৃতি’ অন্তর্মুখী এবং তার শক্তির প্রকাশ নিজেকে বিকশিত ও সমৃদ্ধ করার
উদ্দেশ্যে। সময়ের নিয়মে একসময় সেই সংস্কৃতির সৃজন ক্ষমতা ফুরিয়ে যায় তখন
তার “হয়ে ওঠার” প্রক্রিয়ার অবসান হয় এবং সে পরিণত হয় ‘সভ্যতা’য়। ‘সভ্যতা’
বহির্মুখী এবং তার শক্তির প্রকাশ নিজেকে বিকশিত করার কাজে নয় বরং নিজেকে
প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন সে বাইরে থেকে যা পায় তা-ই
আত্মসাৎ করতে থাকে, তখন তার ক্ষুধা তৃপ্তিহীন। স্পেংলার মতে ‘সংস্কৃতি’
অন্তর্মুখী তাই সে জীবনের প্রতি আন্তরিক এবং সৎ। কিন্তু ‘সভ্যতা’ যেহেতু
বহির্মুখী সে হয়ে ওঠে কৃত্রিম এবং অসৎ।
হাংরি
আন্দোলনকারীরা উত্তর-ঔপনিবেশিক বাংলা ভূখণ্ডে কৃত্রিম, অসৎ,
সৃজন-ক্ষমতাহীন স্পেংলারের ‘সভ্যতা’র প্রতিবিম্ব দেখেছিলেন যেখানে জীবনের
সৎ, আদিম এবং কাঁচা অনুভূতি গুলিকে সভ্যতার মুখোশে ঢেকে পরম্পরার স্তূপীকৃত
জঞ্জালকে সাহিত্যের নামে বাজারে পণ্য করা হয়। হাংরি আন্দোলনকারীদের যুদ্ধ
ছিল আধিপত্য-প্রণালীর বিরুদ্ধে। রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আর্থিক,
নৈতিক, নান্দনিক, ধার্মিক, সাহিত্যিক, শৈল্পিক ইত্যাদি সমস্ত রকম আধিপত্যের
প্রণালীবদ্ধতাকে ভেঙে ফেলে পরিসরটিকে মুক্ত করা ছিল আন্দোলনের উদ্দেশ্য,
অভিমুখ, উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং গন্তব্য। তারা শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে
শুরু করলেন কাউন্টার কালচারাল আন্দোলন, এবং নিজেদের সাহিত্য-ভাবনাকে তারা
বললেন কাউন্টার ডিসকোর্স।
কবি
মলয় রায়চৌধুরীর ভাষায় - “সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায়
হাংরি আন্দোলন যে প্রতি-সন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সে রদবদল ছিল দার্শনিক
এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালা বদলটা ডিসকার্সিভ
প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কথন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের ,
তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের । তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি
ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবি-লেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ।
হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের
তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল,
অধঃস্তরীয় বাক-বৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার
তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের
তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের তহবিল, পংক্তির
গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, পাঠবস্তুর
অন্তঃস্ফোটক্রিয়ার তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খণ্ডবাক্যের তহবিল, তড়িত
ব্যঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল,
বাক্য-নোঙরের তহবিল, শীৎকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল,
যুক্তিচ্ছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যবদলের তহবিল, কাইনেটিক
রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি।“
হাংরি
আন্দোলনের শতাধিক বুলেটিনের অধিকাংশ সমীর রায়চৌধুরীর খরচে প্রকাশিত
হয়েছিল। হাংরি আন্দোলনের সময় লেখা সমীর রায়চৌধুরীর “হণির জন্মদিন” কবিতায়
সেই কাউন্টার ডিসকোর্সের প্রতিফলন দেখা যায়। কবিতা শ্লীল এবং অশ্লীলের
ছুঁৎমার্গ থেকে বেরিয়ে পড়ে জীবনের অনুসন্ধানে। অকৃত্রিম জীবন সবসময়
শিল্প-রুচিসম্মত নিয়মাবলী মেনে চলে না, তাই জীবনের অনুসন্ধানে কবিতাকে
যুদ্ধ ঘোষণা করতে হয় শিল্পের বিরুদ্ধে -
‘মধ্যরাত্রে শূন্য খোলা রাজপথে যুগ্ম শিশ্ন তুলে ধরে আমি ও সুনীল
কলকাতা চুরমার করে
বহুবার ছুটে গেছি মেটিয়াবুরুজে।
ন্যাংটো করে অভিলাষ কুমারীর দেহ খুঁড়ে সন্দীপন ভেঙেছে প্রাসাদ,
সমরেন্দ্র বিলিয়েছে রূপসী বেশ্যার গৃহে কোম্পানির বিজয় টনিক—’
(হণির জন্মদিন - সমীর রায়চৌধুরী - হাংরি বুলেটিন ১৯৬২)
আদিম
এবং অকৃত্রিম জীবনের যে সমস্ত সৎ শব্দ এবং অনুভূতিগুলো তদানীন্তন বাংলা
সাহিত্যে অচ্ছুত ছিল সেগুলি অনায়াসে গিলে ফেলে জন্ম নেয় ক্ষুৎকাতর কবিতা –
‘মসৃণ চাবুক হাতে বাগনানে ভয়ংকর কাফ্রী হয়ে গেছি
আমরা সদলবলে দ্রৌপদীর দীর্ঘবস্ত্রহরণের ওই লিঙ্গ প্রধান প্রহসনে
মনোবেদনার জন্য মহিলার তলপেটে ছেয়েছি বাগান’
(হণির জন্মদিন - সমীর রায়চৌধুরী - হাংরি বুলেটিন ১৯৬২)
হাংরি
আন্দোলনের কারণে ১৯৬৪ সালে তিনি গ্রেফতার বরণ করেন, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে
কোনো প্রমাণ না থাকায় অচিরে মুক্তি পান। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল যে তিনি
তরুণদের বিপথগামী করছেন (ভারতীয় দণ্ড সংহিতার ২৯৪ ধারা)। হাংরি আন্দোলনের
সময়কাল খুবই সংক্ষিপ্ত , ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত। কিন্তু তার প্রভাব বাংলা
সাহিত্য-মননে বিশেষ ভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এবং হাংরি আন্দোলনের বীজ থেকে
পরবর্তী কালে আরো অনেক সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। গ্রেপ্তারির
অপমানের কারণে, এবং ১৯৬৫ সালে হাংরি আন্দোলন প্রকৃত অর্থে ফুরিয়ে
যাওয়ায়, প্রায় তিন দশক লেখালিখি থেকে দূরে সরে ছিলেন । ৯০ দশকে তিনি
আবার লেখালিখিতে ফিরে আসেন, এবং তা কবি, ছোট-গল্পকার ও ভাবুক ও “হাওয়া-৪৯”
পত্রিকার সম্পাদক রূপে ।
নব্বই
দশকের শুরুতে সমীর রায়চৌধুরী ‘হাওয়া ৪৯’ নামে একটি ত্রৈমাসিক
সাহিত্য-পত্রিকা সম্পাদনা শুরু করেন । ‘উনপঞ্চাশ বায়ু’ বলতে সংস্কৃতে
অবচেতন মনের অবস্থা বোঝায়। ‘হাওয়া ৪৯’ সাহিত্য ও বিজ্ঞানকে একটি মঞ্চে
একত্রিত করে তিনি নবতর একটি সাহিত্য-চিন্তা প্রণয়ন করেন । পরবর্তীকালে
পত্রিকাটি সাহিত্যতত্ত্ব ও ভাষাতত্ত্বের পত্রিকা হয়ে ওঠে, এবং তাকে
আলোচকরা ‘অধুনান্তিক’ বলে স্বীকৃতি দেন । এই ধারায় রচিত তাঁর কবিতা এবং
ছোটগল্পের সংকলন সম্পূর্ণ ভিন্ন ধারার বাংলা লেখা হিসাবে স্থান করে নিতে
পেরেছে ।
‘অধুনান্তিক’ ভাবনা কোনো নিছক
সাহিত্যতত্ত্ব নয় এটি একটি আর্থ-সাংস্কৃতিক এবং ঐতিহাসিক কালখণ্ডের
যুগলক্ষণ। যে কালখণ্ডে আমাদের ভাবনা, সরল রৈখিক না হয়ে, হয়ে ওঠে বহুমুখী
এবং কোন একটি কেন্দ্রে ঘনীভূত না হওয়ার কারণে তৈরি হয় ভাবনার বিশৃঙ্খল
জটিলতা। এই কালখণ্ডে সর্বব্যাপী ডিজিটাল মিডিয়া আমাদের উপলব্ধিকে প্রভাবিত
করে সর্বক্ষণ। সর্বব্যাপী টেলিভিশন, মোবাইল ফোন, ইন্টারনেট আমাদের
পারিপার্শ্বিক প্রত্যক্ষ বাস্তবতার ভাবনাকে একই সময়ে যুক্ত করে পৃথিবীর
অন্য-প্রান্তে হতে থাকা অপ্রত্যক্ষ বাস্তবতার সাথে এবং দুরের কল্পলোকের
সাথে । আমরা একই সাথে অনেক কিছুর সাথে যুক্ত। আর একসাথে অনেক কিছুর সাথে
যুক্ত হওয়ার কারণে আমরা সমস্ত কিছু থেকে অসংযুক্ত। আমাদের এই কালখণ্ডে
ভাবনার এই বিশৃঙ্খল জটিলতাই আমাদের চালিকা শক্তি। এই আর্থ-সামাজিক পরিসরে
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষের কথ্য ভাষার সাথে, বিভিন্ন ডিজিটাল মিডিয়ার ভাষা,
টেলিভিশন, সংবাদপত্র, বিজ্ঞাপন এবং উন্মুক্ত বাজারের ভাষার সংকরায়নে তৈরি
হচ্ছে অধুনান্তিক ভাষা।
সমীর
রায়চৌধুরীর অধুনান্তিক পর্বের বিভিন্ন কবিতায় আমাদের এই কালখণ্ডের
প্রতিফলন দেখা যায়। সমীর রায়চৌধুরীর মতে, অধুনান্তিক কালখণ্ডে কবিতা সরল
রৈখিক হবে না, তার থাকবে বহু শিকড়, বহু কেন্দ্রবিন্দু-
‘তাহলে দূর্গাপুর থেকে আজই ফিরলেন ঐ রজতশুভ্র
আমি তো মিনিং ব্যাপারটার একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি
একটা বিশ্ব ব্যাকরণের যোগান অর্থবোধকতা খুঁজছে বানান
দূর্গাপুরে কি পাত্রী দেখলেন নাকি কবিদের সঙ্গে
রথীনের বউ বেশ ছোট সাইজের ভূত আর চোরের ভয়’
(একটি বহুরৈখিক টেক্সট - সমীর রায়চৌধুরী)
কোন কিছুই সম্পূর্ণ বুঝে ফেলার চেষ্টা বৃথা হবে কারণ ‘মিনিং থামতে জানে না না কোনো শেষকথা নেই…’
‘রজতশুভ্র নতুন কিছু লিখছে নাকি এখনও সেই রসুলপুর
ধরুন আনন্দ কত রকমের এক গোলে জেতার আনন্দ
লোডশেডিঙে আচমকা ফিরে আসা আলো
পুরোনো প্রেমিকার সঙ্গে হঠাৎ উল্টোদিকের বাসের জানলায়
কুড়িয়ে পাওয়া পঞ্চম জর্জের আধুলি রসুলপুর মানে
একটা কিছু ভর করলেই মুশকিল
মিনিং থামতে জানে না না কোনো শেষকথা নেই…’
(একটি বহুরৈখিক টেক্সট - সমীর রায়চৌধুরী)
(একটি বহুরৈখিক টেক্সট - সমীর রায়চৌধুরী)
একটি কবিতাকে বিভিন্ন ভাবে অনুভব করা যাবে — একই পাঠ্য-বস্তু থেকে জন্ম নেবে বহু পাঠ্য-বস্তু। একটা পর্যায়ে কবিতার পাঠ্য-বস্তু আর শুধুমাত্র কবিতার নিজস্ব সম্পত্তি হিসেবে থাকবে না। কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়বে গল্প-প্রবন্ধ-চিত্রকলা-সিনেমা-বিজ্ঞাপন— অর্থাৎ কবিতা হয়ে উঠবে মুক্ত-মুখী, অসীম। বস্তু তার উপমার বাঁধন ছেড়ে শুধু মাত্র বস্তু হিসেবেই প্রতিফলিত হবে আর প্রতীকের মৃত্যু ঘটবে কবিতায়।
‘—সবাই ঘড়িতে ঢুকছে— ঘড়ি স্বয়ং পাখি হয়ে ফুড়ুৎ—
নারীর আড়মোড়া, পুরুষের হনহনে হাঁটার ভঙ্গি, ঘড়ির
সেকেন্ডের কাঁটা, উড়োপাখির ডানা,— ডানা থেকে
ঝরে পড়ছে প্রসাধনসামগ্রী টুকিটাকি গ্যাজেট আসবাব—
জড়ো হচ্ছে রদ্দি বাতিল কাবাড়ির আস্তানায়—
কবি হুমড়ি খেয়ে বেছে নিচ্ছেন উপমা প্রতীক লোগো—‘
(ছাদনাতলার ক্রসকানেকশন - দৃশ্য তিন: সময় - সমীর রায়চৌধুরী)
এভাবেই সমীর রায়চৌধুরী তার সাহিত্য-যাপনে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য ভাবনার পরম্পরার জঞ্জাল থেকে বাংলা সাহিত্যের ভাষা, বিষয়, উপস্থাপনা, বিন্যাসকে মুক্ত করে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন।
এভাবেই সমীর রায়চৌধুরী তার সাহিত্য-যাপনে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক সাহিত্য ভাবনার পরম্পরার জঞ্জাল থেকে বাংলা সাহিত্যের ভাষা, বিষয়, উপস্থাপনা, বিন্যাসকে মুক্ত করে আমাদের সমৃদ্ধ করেছেন।
‘আমার সম্পর্কে সবার ধারণার ধারক সমীর
সবার ধারণা এক নয় …
আমি সমীর নয় এই ধারণা
একান্ত আমার’
(সমীরের খামতিগুলো: ৬ - সমীর রায়চৌধুরী)
অধুনান্তিক পর্বে তাঁর দুটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে, ‘মাংসের কস্তুরীকল্প’ এবং ‘অপূর্বময়ী স্মৃতি বিদ্যালয়’ ।
ছোটোগল্পকার
হিসাবে তাঁর ফিকশানগুলোয় তিনি এনেছেন জাদুবাস্তবতা, বিশেষ করে ‘বহুজাতিক
ভুতের গল্পের খসড়া’, ‘আলজাজিরা’, ‘সিগারেটের তিরোভাব’ এবং ‘টিনিদির হাত’-এ।
বাংলা
সাহিত্য ওনার কাছে বিশেষ ভাবে ঋণী এবং ২২ শে জুন ২০১৬ সালে ওনার প্রয়াণে
বেশ খানিকটা গরিব হয়ে পড়ল । উনি বেঁচে থাকবেন, আমাদের মাঝে ওনার সাহিত্য
দর্শনের প্রতিফলনে। লেখাটি শেষ করব শ্রী সমীর রায়চৌধুরীকে প্রণাম জানিয়ে
এবং ওনার লেখা কয়েকটি কবিতার মাধ্যমে ওনাকে শ্রদ্ধা জানিয়ে।
(কৃতজ্ঞতা
স্বীকার – শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক এবং কবি মলয় রায়চৌধুরীর সহায়তা ছাড়া এই
লেখাটি সম্ভব হত না। ওনার কাছ থেকে হাংরি আন্দোলন সম্বন্ধে অনেক কিছু জানতে
পেরেছি, যা আমাকে সমৃদ্ধ করেছে । উনি আমার এই লেখাটি সম্পাদনা করে দিয়েছেন
এবং সমীর রায়চৌধুরীর কবিতা গুলি প্রকাশের অনুমতি দিয়েছেন)
(বিধিসম্মত
সতর্কীকরণ – সমীর রায়চৌধুরীর কবিতা গুলি প্রাপ্তবয়স্ক এবং প্রাপ্তমনস্ক
পাঠকের জন্য। কবিতাগুলি পাঠ করা, বা না করা, পাঠকের স্বাধীনতা এবং পাঠ
প্রতিক্রিয়ার দায়িত্ব সম্পূর্ণই পাঠকের)
হণির জন্মদিন
সাতলক্ষ যুবতীর পোঁদে লাথি মেরে
ভেবেছিলাম কাতরানি গড়াবে প্রচুর,
মধ্যরাত্রে শূন্য খোলা রাজপথে যুগ্ম শিশ্ন তুলে ধরে আমি ও সুনীল
কলকাতা চুরমার করে
বহুবার ছুটে গেছি মেটিয়াবুরুজে।
ন্যাংটো করে অভিলাষ কুমারীর দেহ খুঁড়ে সন্দীপন ভেঙেছে প্রাসাদ,
সমরেন্দ্র বিলিয়েছে রূপসী বেশ্যার গৃহে কোম্পানির বিজয় টনিক—
শক্তি যে কিঞ্চিৎ ভীতু
সে-ও তবু হাওয়ায় ছুঁড়িয়াছে লাথি,
সঙ্গোপনে ফুলকুমারীর প্রতি;
মসৃণ চাবুক হাতে বাগনানে ভয়ংকর কাফ্রী হয়ে গেছি।
আমরা সদলবলে দ্রৌপদীর দীর্ঘবস্ত্রহরণের ওই লিঙ্গ প্রধান প্রহসনে
মনোবেদনার জন্য মহিলার তলপেটে ছেয়েছি বাগান।
অকস্মাৎ ঘুম ভেঙ্গে প্রত্যুষের বিছানায় দেখি—
নীলপদ্ম রেখে গেছে প্রতিহারী আস্ফালন মায়াবী প্রহার,
করুণ ফোয়ারা বেয়ে ঝরে পড়ে আশ্চর্য প্রসার,
অকস্মাৎ ত্রুটিহীন পরিচর্যা দাবি করে আমাদের প্রসূত সন্তান—
প্রত্যেকের ঘরে ঘরে তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখি।
একটি বহুরৈখিক টেক্সট
তাহলে দূর্গাপুর থেকে আজই ফিরলেন ঐ রজতশুভ্র
আমি তো মিনিং ব্যাপারটার একেবারে দোরগোড়ায় পৌঁছে গেছি
একটা বিশ্ব ব্যাকরণের যোগান অর্থবোধকতা খুঁজছে বানান
দূর্গাপুরে কি পাত্রী দেখলেন নাকি কবিদের সঙ্গে
রথীনের বউ বেশ ছোট সাইজের ভূত আর চোরের ভয়
যেভাবে চিনির শিশি খুঁজে বের করে এক রতি পিঁপড়ে
বুঝে ফেলাকে যে জন্যে বলা হয়েছিল অবগতি
এবার প্লেটোর গুহার বিপরীত দিকে
ঐ রসুলপুর সেই ব্রাশ ফেলে যাওয়ার স্মৃতি মেলোডি
ঘটনা স্থির দর্শক গতিময় ঘটনা খুঁজছে দর্শক
কপালে একটা ছোট্ট কাটা দাগ আর সব ভালো মেয়েটার কি হলো
বৈদ্যবাটির হাইটটা কম তবে হাতে রেখেছেন তো
ছেলে কি বলছে কোয়ান্টাম নিয়ে ভাবছে কেরিয়ারিস্ট
প্রেম করার সময় নেই
সেই যে মাছ ধরা ট্রলারের ডেরিকে দাঁড়িয়ে দেখেছিলেন অচেনা পাখির ঝাঁক
সম্ভাব্য সফলতার নিশ্চয়তার চিরকুট
রজতশুভ্র নতুন কিছু লিখছে নাকি এখনও সেই রসুলপুর
ধরুন আনন্দ কত রকমের এক গোলে জেতার আনন্দ
লোডশেডিঙে আচমকা ফিরে আসা আলো
পুরোনো প্রেমিকার সঙ্গে হঠাৎ উল্টোদিকের বাসের জানলায়
কুড়িয়ে পাওয়া পঞ্চম জর্জের আধুলি রসুলপুর মানে
একটা কিছু ভর করলেই মুশকিল
মিনিং থামতে জানে না না কোনো শেষকথা নেই…
ছাদনাতলার ক্রসকানেকশন
দৃশ্য তিন: সময়
দেয়ালে ঘড়ি, ঘড়ি থেকে বেরিয়ে কয়েকজন ব্যস্ত পুরুষ
হনহন করে এগিয়ে গেল, বের হলো আড়মোড়া ভাঙা
নারীভঙ্গি,— হনহনে লোকগুলোর একজন নারীকে
দেখছে, নারীশরীর প্লটজমিতে পালটে যায়— অন্যজন
মাথা হেঁট করে কুকুরে যেভাবে মাংস শোঁকে, জমি
দেখছে খুঁটিয়ে— নারী এবার দেখছে গাছের ডালে
বসা ফিঙে, লোকটাকে ইশারায় দেখায়
ঐ জমিটা যেখানে পাখি বসে! পাখি ডাল
ছেড়ে সকলের জমির উপর দিয়ে উড়ে যায়—
পাখির পেছনে ছুটতে থাকে হনহনে পুরুষের ভিড়—
—সবাই ঘড়িতে ঢুকছে— ঘড়ি স্বয়ং পাখি হয়ে ফুড়ুৎ—
নারীর আড়মোড়া, পুরুষের হনহনে হাঁটার ভঙ্গি, ঘড়ির
সেকেন্ডের কাঁটা, উড়োপাখির ডানা,— ডানা থেকে
ঝরে পড়ছে প্রসাধনসামগ্রী টুকিটাকি গ্যাজেট আসবাব—
জড়ো হচ্ছে রদ্দি বাতিল কাবাড়ির আস্তানায়— কবি হুমড়ি
খেয়ে বেছে নিচ্ছেন উপমা প্রতীক লোগো—
Tags:
নীড়বাসনা শ্রাবণ ১৪২৩
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন