রবিবার

সমীর রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন উল্কা ও ঋষি সৌরক

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কিছু স্মৃতির কথা বলুন...
সুনীলের হাংরিকে ভেঙে দেবার মানসিকতা ছিল । সুনীল যা বলে তা লেখেন । সুনীল তো প্রকাশ্যেই মলয় কে চিঠি লিখেছে আমাকেও চিঠি লিখেছেন । যা বলবার বলেছেন । এগুলো লুকোবার নয় । সুনীলকে দেখেছি পরে একটা কাজ করেছে যখন ওঁকে চাইবাসা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে তখন সেসব ব্যাপার সযত্নে এড়িয়ে গেছেন । সাক্ষাৎকারটা নিয়েছিলেন ধনঞ্জয় ঘোষাল বলাকা  পত্রিকার জন্য । সুনীলের আত্মপ্রকাশ এবং ‘জীবন যে রকম’ উপন্যাসে দেখবে যে মেয়েগুলোর নাম সেগুলো তো চাইবাসার সতী আর তাতা এদের যে পরিবার সেই পরিবারেরই সব বোনেদের নাম আছে  ওদের সুনীল যে চিঠি লিখেছেন তা ‘নর্থ স্টার’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে । আর ওদের তিন ভাই । তিনভাইয়ের মধ্যে যে বড়ো তার নাম সন্তু । আর বাস্তবিক জীবনে সুনীলই ছিলেন গল্পের সন্তুর কাকাবাবুআগেকার দিনের ছড়াগুলো সব গেয়ে গেয়ে বলতেন । এখনও আমার ছেলেমেয়েকে জিজ্ঞাসা করলে তারা বলে দেবে , সন্তুকে জিজ্ঞাসা করলে সন্তু বলে দেবে। সন্তুর ইন্টারভিউ ‘নর্থ স্টার’-এ বেরিয়েছে ।  সেসব মধুর স্মৃতি...সন্তু কাকাবাবু নামটা তো ওখান থেকেই পেয়েছে। তারপর সন্তুকে কাল্পনিক ভাবে সম্প্রসারিত করেছেন । লেখার সময় তো অসাধারণ লিখেছে
বাংলা সাহিত্যে যে ঝড় উঠবে সেই ঝড়ের নাভিকেন্দ্র ছিল চাইবাসা।
সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় স্বাতী আর পুপলু আমার কাছে গিয়েছিল দ্বারভাঙ্গায় । সুনীলই আমার সাথে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্বাতী আর পুপলুকে । সেটাই ‘বলাকা’ পত্রিকায় ছাপা হয়েছে সুনীলের জীবিতকালে। 

সুনীলকে শুধু চাইবাসা নিয়ে প্রশ্ন করলে এড়িয়ে যেতেন , কিন্তু ওঁর বইগুলোতে তো তার চিহ্ন রয়ে গেছে।
চিঠিতে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় যে কলকাতার খবর পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন এবং যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছেন সেটা থেকে আপনার কী মনে হয়?
কলকাতায় যারা ছিলেন মানে সুনীলের উপর নির্ভরশীল একটা গোষ্ঠী ছিলেন তাঁদের স্বার্থে ঘা পড়ছিল । ফলে তাঁরা উল্টোপাল্টা জানাচ্ছিলেন । যত উল্টোপাল্টা জানাবে তত তাঁদের লাভ... অনেকেই ছিলেন তাঁদের মধ্যে , এখন যারা বৃদ্ধ হয়েছে তাঁরা ! এরকমও আছে যারা হাংরিতে থেকেছে স্বাক্ষরও দিয়েছে আবার সুনীলের দলে ভিড়ে গিয়ে ওখান থেকে আবার অ্যাকাডেমি পুরষ্কার কি করে পাওয়া যায় সেদিকে মন দিয়েছে
সম্প্রতি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় একটি বহুল প্রচারিত পত্রিকায় ৫০-এর দশকের অন্যতম প্রধান এবং সর্বজনশ্রদ্ধেয় কবির লেখাটা পড়ে আপনার প্রতিক্রিয়া কী ?
হাংরি আন্দোলনের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কের যে আঠা ছিল সেটা বিভিন্ন গোষ্ঠীতে ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার ব্যাপারে প্রধান ভূমিকা ছিল ওই কবির  বহুল প্রচারিত পত্রিকায় যে লেখা বেরিয়েছে সে ব্যাপারে কেউ কেউ আমাকে ফোন করে জানিয়েছে। উনি তো একটি নামী প্রকাশনী থেকে হাংরিসম্পর্কিত একটা বইও বের করিয়েছেন , অথচ সেই বইটার মধ্যে হাংরি আন্দোলনের যে স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীই বাদ ! ওঁর মত প্রবীন ও মাননীয় লোক যদি এধরনের কথা বলেন...
আলোচনা করছেন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে নিয়ে আর তুলে আনছেন হাংরি আন্দোলনকে । তুলে এনে সমীর এবং মলয়কে অপদস্থ করার একটা অজুহাত খুঁজে বের করছেন । এটা একটা শিশুসুলভ আচরণ । এরম কাজকর্ম কোন প্রবীন লোকের ক্ষেত্রে মানায় না । তাঁর আলোচনা করা উচিত ছিল সুনীলের গল্প কবিতা উপন্যাস নিয়ে, সুনীলের কিশোর উপন্যাস বা সন্তু কাকাবাবু নিয়ে, নীললোহিত নামে যা লিখেছে তাই নিয়ে, এমনকি সুনীলের গল্প নিয়ে সত্যজি রায় যে সব সিনেমা করেছেন সেটা নিয়েও । তা না করে হাংরিকে টেনে এনে হাংরির সাথে যারা যুক্ত ছিল সমীর মলয় তাদের আঘাত করার অহেতুক চেষ্টা করছেন ।
হাংরি আন্দোলনের যে দার্শনিকতা, স্রষ্টা মলয় তা প্রমান করেছে তার লেখালিখির মাধ্যমে । হাংরি আন্দোলনের ইস্তাহারে যা যা বলতে চেয়েছিল... তাই নয় কি ? আসলে কিছু লোকের একটা আছে না যে কে টিকে থাকবে ? তাদের কাছে একজন টিকলে আরেক জন টেকে না । লোকেদের এইরকম সব ধারনা । সুনীল টিকলে শঙ্খ টেকেনা, বা সুনীল টিকলে মলয় টেকেনা এই ধরনের সব ধারনা আর কি...আমার কাছে যে সব মিডিয়া আসছিল তাদের মধ্যে কয়েকজন সাক্ষাৎকারে অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন করছিল ’ আপনার কী মনে হয় ... সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আর কতদিন টিকবেন ?আমি যেন জ্যোতিষী আর আমি যেন বলে দেব কোনটা টিকবে আর কোনটা টিকবে না । কেউ বলতে পারে নাকি ! সুনীলের একটা কবিতা আছে ‘জ্বলন্ত জিরাফ’ আবার সাল্ভাদর দালিরও একটি পেইন্টিং আছে জ্বলন্ত জিরাফ’ । সুনীলের সাথে দালির দেখা হয়েছিল যখন নিউইয়র্কে গেছিলেন । সাল্ভাদর দালি আর পিকাসোর মধ্যেও তো এই ধরনের সব কথা চলত যে কে টিকে থাকবে । আজ দুজনেই তো দেখছি টিকে আছে বহাল তবিয়তে পেইন্টিং এর ইতিহাসে ! সাল্ভাদর দালিও নিজের জায়গায় আছেন পিকাসোও নিজের জায়গায় আছেন । কে টিকবে সেটা প্রশ্ন দিয়ে হয় না । কে টিকবে সেটা তার কাজ এবং কালের বিচারে বোঝা যাবে...এরকম নয় এটা একটা এভারেস্টের চুড়ো যেখানে একজনই দাঁড়াতে পারে ।



শৈলেশ্বর ঘোষের মুচলেকা সম্পর্কে কী মনে হয়?
আসলে ওসব পুলিশের ভয়ে...আসলে বেচারা ইস্কুলে চাকরি করতেন । পুলিশে ভয় । তাছাড়া চাকরির ভয় তো সবারই থাকে । একটা উদবাস্তু পরিবার থেকে এসেছেন , অতএব ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক যে চাকরি গেলে খাবে কি । ফলে পুলিশ যতটা পেরেছে ভয় দেখিয়েছে এবং মুচলেকা আদায় করে নিয়েছে । আর মুচলেকা তো সবাই দিয়েছেন ।

শৈলেশ্বর ঘোষ সম্প্রতি মারা গেলেন । শৈলেশ্বর ঘোষ তাঁর নিজের অবস্থানে ঠিকই আছেন । হাংরি আন্দোলনের যে ইস্তাহার সেই ইস্তাহারকে তো তিনি মেনেছেন ।

হাংরি আন্দোলনের সব ইস্তাহারই মলয়ের লেখা এবং শিল্পবিষয়ক ইস্তাহার অনিল করঞ্জাই-এর লেখা । এই ইস্তাহারগুলো প্রত্যেকেই মানত । বিভাজনগুলো তো কৃত্রিমভাবে সৃষ্টি করা ।
সমীরদা, সাহিত্যের ক্ষেত্রে আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা কি আছে কিছু ?
হাংরি আন্দোলন তো একমাত্র আন্দোলন নয় । হাংরি আন্দোলনকে অনুসরন করে আরও কুড়িটা আন্দোলন হয়েছে বাংলা সাহিত্যে । পরপর হতে থেকেছে । হাংরি আন্দোলনকে এক পেশে করে যতই বলা হোক না কেন বাকি আন্দোলনগুলো সম্পর্কে কি বলবে ? আমাদের নিয়ে অদ্ভুত সব লিখেছে বিটনিকদের দ্বারা প্রভাবিত ইত্যাদি ইত্যাদি... অথচ অ্যালান গিন্সবার্গ আসার এক বছর আগেই শুরু হয়েছিল হাংরি আন্দোলন । কোনো ভারতীয় কবিকে কি বিদেশ থেকে প্রভাবিত করতে পারে ! তার তো নিজের উত্তরাধিকার আছে ! তার যে দার্শনিক পটভূমি তা যথেষ্ট ধনী ।
হাংরি আন্দোলন ১৯৬১ সালে হয়েছিল । ৫২ বছর হয়ে গেছে এই আন্দোলনের তবুও আজ সুনীল মারা যাওয়ার পর বারবার উঠে আসছে এই আন্দোলনের নাম । যেখানে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মারা যাওয়ায় ওনার গদ্য নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল কবিতা নিয়ে কথা হওয়ার কথা ছিল, তাঁর কর্ম জীবন নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা ছিল সেখানে কথার ফাঁকে ঢুকে পড়ছে হাংরি আন্দোলনের নাম । এটাই তো প্রমান করছে এই আন্দোলনের যথেষ্ট প্রাসঙ্গিকতা আছে ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাথে কেমন ছিল আপনার সম্পর্ক শেষ অবধি ?বন্ধুত্ব নাকি প্রতিযোগিতা?
আমি সুনীলের প্রথম কবিতার বইটা প্রকাশ করেছিলাম আর আমার সাথে ওঁর একটা বন্ধুত্ব ছিল । বন্ধুত্ব মানেই এই নয় যে তোমার বন্ধুর কোন বিষয়ে যা যা মত থাকবে তোমারও তাই থাকতে হবে । তুমি তোমার মতো লিখবে আর সে তার মতো । লেখালিখির করতে এসে দুজনের মতাদর্শের মধ্যে বিভেদ তো থাকতেই পারে । তোমার মতো লেখেনা বলে কি তোমার সাথে তার কলহ হয়ে যাবে ? আর সেটা কি একজন প্রকৃত লেখকের পরিচয় ? এরকম কিছু নয় । কিন্তু সেটা কে বোঝাবে ?
হাংরি আন্দোলনের পর বা হাংরি আন্দোলনের সময় কৃত্তিবাস কি যথেষ্ট মুক্ত ছিল আপনার জন্য?
'কৃত্তিবাস'-এ সবাই ছিল না যারা হাংরি আন্দোলন করেছিল । আমি ছিলাম । মলয় ছিল না , তবে মলয়ের বই বেরিয়েছিল ‘শয়তানের মুখ’ ... আর হাংরি আন্দোলন চলাকালীনও 'কৃত্তিবাস'-এ আমার লেখা বেরিয়েছে । 'কৃত্তিবাস' আর হাংরি আন্দোলন কখনোই কণ্টেস্ট করেনি । এমন ভাবার কোনো কারণ নেই । 'হাওয়া ৪৯' এও তো অনেকে লিখেছে ।পুরনো সংখ্যা গুলো খুলে দেখলেই বুঝতে পারবে । 'হাওয়া ৪৯'-এ কমল চক্রবর্তীর উপন্যাস বেরিয়েছে । তবে কি আমরা কমল চক্রবর্তীকে হাংরি বলে দেব ? লেখালিখিতে কৃত্তিবাস/হাংরি এমন কোন ভেদাভেদ থাকার কথাই নয় ।কৃত্তিবাস কোনো আন্দোলন নয়,  টা একটা পত্রিকা । মুক্ত পত্রিকা, যে কেউ লিখতে পারে যেখানে  তরুণতম কবিদের মুখপত্র ...  যেখানে শৈলেশ্বর , আমি সকলেই লিখেছি ।
সুনীলের ‘নীরা’-কে আপনি কিভাবে চেনেন?
‘নীরা’ কে বলতে গেলে দুটো কথা বলতে হয় । প্রথমত নীরা শব্দটার ব্যাখ্যা । এখন নীরা নামের অনেক মেয়ে পাবে কিন্তু সুনীলের এই কবিতাগুলো লেখার আগে নীরা নামের কোন মেয়েকে আমার মনে হয় না পাওয়া যাবে । বাংলা শব্দে পুং বাচক শব্দকে স্ত্রী বাচক করতে গেলে ‘ইনী’ প্রত্যয় বা ‘নিনী’ প্রত্যয় লাগাতে হয় । যেমন ইন্দ্র থেকে ইন্দ্রাণী । এই যে ‘নী’ লাগানো হচ্ছে এখানে নী সকলকে নিয়ে বলতে নী-রা যে এনটিটি হয় তাকেই কবি বলছেন নীরা । শব্দের দিক থেকে এর ব্যাখ্যা । কিছু কিছু কবিতায় সুনীলের আছে নীরা আবার কিছু কিছু কবিতায় মানে অন্য প্রসঙ্গের কবিতায় চলে এসেছে নীরার নাম । সুনীলের নীরা নামের কবিতা গুলিতে একজন ফরাসি যুবতীর কথা সেভাবেই উল্লেখ করা আছে । তার নাম মার্গারেট ম্যাথিউ ... সুনীল তাকে নিয়েই কবিতা লিখেছে । কিন্তু নীরা তো কেবল মাত্র ফরাসি মেয়েটি নয়, নীরা ‘নী’ সকল মানে এক এবং বহু  তিনি যখন একের কথা লিখছেন আমরা পাচ্ছি ফরাসি যুবতীকে আবার তিনি যখন বহুতে ফিরে আসছেন তখন আমরা পাচ্ছি নী-রাকে । নী বাচক নারীকে পাচ্ছি ।
সমীরদা , আপনি বেশ অসুস্থ আজ আর আপনাকে বিরক্ত করছি না । পরে আবার আসব । অনেক ধন্যবাদ ‘বাক্’-কে এই কথাগুলো উপহার দেওয়ার জন্য ।
        

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন