সোমবার

মলয় রায়চৌধুরী : আকাশকুঞ্জে রতিভ্রমর





আকাশকুঞ্জে রতিভ্রমর
রাস্তারদু'ধারে ভয়ে-ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারগুলো । একটা বিল্ডিং কত তলার পর ওপরেউঠে টাওয়ার হয় ? টাওয়ার হয়ে উঠলেই তাদের ভয় করতে থাকে । আমার মনে হয়উনিশতলা পর্যন্ত তারা টিন এজার থাকে । টাওয়ারগুলো ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে এইজন্য যে কখন কোন গৃহবধু কোনো বিশাল কাচের জানলা বা বারান্দা বা ছাদে গিয়েহাওয়ায় দুহাত ভাসিয়ে দেবেন।

এরকমই ঘটছে কয়েক মাস যাবত । এক গৃহবধু তার দুই ছেলেকে ছুঁড়ে-ছুঁড়ে ফেলেদিলেন আর তারপর নিজে লাফ মারলেন। কারণ ? শ্বশুরবাড়ির লোকেদের দুর্ব্যবহার ।আরকটি গৃহবধু কোলে ছেলেকে নিয়ে লাফিয়ে পড়লেন । কারন সেই একই । কিন্তু একজনগৃহবধু, সংবাদপত্র অনুযায়ী, ছেলেপুলে স্বামী শ্বশুর-শাশুড়ি নিয়ে সুখেইছিলেন , লাফ মারলেন হঠাৎই । সবাই ডাইনিং টেবিল ঘিরে খেতে বসেছিলেন । তিনিউঠে গেলেন, কাচের জানালা খুললেন । পরিবারের সদস্যরা ভাবলেন তিনি একটুসামুদ্রিক বাতাস উপভোগ করতে চাইছেন । কেউ বোঝার আগেই তিনি হাওয়ায় দুহাতভাসিয়ে দিলেন ।

টাওয়ারগুলো তাই ভয়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে , সামুদ্রিক বর্ষার প্রচণ্ড ঝড়েজলেও ।


এরকমইএকটা টাওয়ারে গিয়েছিলুম । এইসব টাওয়ারে সিকিউরিটির কড়াকড়ি থাকে । গেটে সিসিটিভিতে মুখ দেখালে যাঁর ফ্ল্যাটে যাবো তিনি মুখখানা দেখে অনুমতি দিলেযাওয়া যাবে । নয়তো গেটে দাঁড়িয়ে ইনটারকমে কথা বলে কাজ সারো । টাওয়ারগুলোরলিফ্টও দু'রকমের । ফাস্ট আর স্লো । বেশি ওপরে যারা থাকে তারা ফাস্ট ধরে উঠেযায়, সময়ও কম লাগে , কেননা তাদের গতিও তীব্র । যত বৈভবশালী তত ওপরে ।প্রতি ঘনইনচ দাম বাড়তে থাকে ওপরের ফ্ল্যাটগুলোর ।


আমি যাঁর ফ্ল্যাটে যাবো তিনি এই টাওয়ার সোসাইটির প্রেসিডেন্ট ; ফলে আরওকড়াকড়ি । কিন্তু গেটে দেখলুম পুলিস দাঁড়িয়ে । টাওয়ারেও চুরি ? এত সিকিউরিটিসিসিটিভি ইত্যাদি সত্বেও ? হতে পারে, ভাবলুম । আজকাল চোরেরা কোন কোনফ্ল্যাটে দুপুর গৃহবধু বা বুড়ো বা বুড়ি একা থাকে তার খবরটবর নিয়ে হানা দেয়, কুরিয়ারের লোক বা প্লামবার বা কার্পেন্টার ইত্যাদির চেহারায় । বেশ কিছুমানুষ, যারা একা ছিল, খুন হয়েছে সম্প্রতি ।

কিন্তু পুলিশগুলোকে দেখে মনে হল না যে কেউ খুন হয়েছে , যদিও পুলিশের মুখপ্রায় গোমড়াই থাকে সবসময় । বাড়িতে গিয়ে গোমড়ানো মুখোশটা খুলে তারপর হয়তবউ-বাচ্চার সঙ্গে গল্পগুজব করে । কিন্তু খুন হয়ে থাকলে এমনভাবে নিজেদেরজিপগাড়িটা গেটের কাছে দাঁড় করিয়ে গুলতানি করত না । দু'জন কন্সটেবলকে তোদেখে মনে হল মুচকি হাসির আভাস রয়েছে । মুচকি হাসি দেখে এটা অন্তত বুঝলুমযে, যাক, কেউ তাহলে ওপর থেকে লাফ মারেনি । কিংবা খুন হয়নি কেউ ।


যাঁর ফ্ল্যাটে আমি যাব তিনি একদা হিন্দি অফিসার ছিলেন । হিন্দি অফিসারদেরমতন আরামের চাকরি আর হয় না । ইংরেজিতে লেখা চিঠি এলে, যে ভাষায় ছাড়া এখনওকেন্দ্রীয় সরকারে কাজ চলে না, ওনারা অনুবাদ করে দেন । সে অনুবাদ কেউ পড়ে না।তারপর উত্তরটা ইংরেজিতে তৈরি হয়ে গেলে ওনারা তার অনুবাদ করে দেন । দুটোচিঠি একই সঙ্গে প্রাপকের কাছে যায় । এবার প্রাপকের ইচ্ছে সে কোন ভাষায়উত্তর দেবে । অহিন্দি রাজ্য হলে অনেক অফিসার সেই রাজ্যের ভাষায় চিঠির উত্তরপাঠিয়ে দেন । তারপর তাগাদা পেয়ে আবার ইংরেজিতে-হিন্দিতে উত্তর দেন । কেননাএরও ডাটা রাখতে হয় হিন্দি অফিসারদের । তাঁদের কাজ ডাটা বাড়াতে থাকা ।ব্যাস । যত ডাটা বাড়ে তত অফিসারের সংখ্যা বাড়ে । কেন্দ্রীয় সরকারিঅফিসগুলোয় কয়েকটা হিন্দি সংবাদপত্র আর ম্যাগাজিন নেয়া বাধ্যতামূলক । ফলেহিন্দি অফিসাররা সারাদিন টাইমপাস করার মতো খোরাক পেয়ে যান । সারা ভারতেহিন্দি পত্র-পত্রিকার বিক্রি সেকারণে অস্বাভাবিক । আমার তো মনে হয় অন্যান্যভাষাভাষীদের দাবি করা উচিত যে যত টাকা হিন্দি পত্র-পত্রিকা কিনতেসরকারিভাবে খরচ করা হচ্ছে তত টাকা অন্যান্য ভাষার পত্রিকাদের ভরতুকি হিসাবেদেয়া হোক । হিন্দি পত্র-পত্রিকার অমন বিপুল বাজারের দরুন তাদের লেখকরাওভাল আয় করেন ।


যাহোক, আমি মুখ দেখিয়ে কথা বলে পৌঁছোলুম হিন্দি অফিসারে ফ্ল্যাটে । আমিওনার কাছে এসেছিলুম আমার একটা কবিতার অনুবাদের ব্যাপারে । প্রাথমিক অনুবাদকরে দিয়েছিলেন একজন উঠতি হিন্দি কবি, যিনি বাংলা জানেন না । এই হিন্দিঅফিসার বহুকাল কলকাতায় ছিলেন বলে বাংলা শব্দ কীভাবে খেলানো হয় তার আইডিয়াআছে ।


কিন্তু সে কাজটি আর করানো গেল না । অফিসার দরোজা খুলে দিতে দেখলুম তাঁরস্ত্রী একরকম , কী বলব, হ্যাঁ, ধূর্তই বলে, ধূর্ত হাসি হেসে ভেতরে চলেগেলেন ।


আমি বললুম, পুলিস এসেছে দেখলুম, গেটের কাছে জিপগাড়ি দাঁড়িয়ে, কয়েকজন কন্সটেবল গুলতানি করছে ?


হিন্দি অফিসার এবার প্রায় অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন । ভেতরের ঘর থেকে ওনারস্ত্রীও যে একা-একা হাসছেন আর তা সামলাতে পারছেন না টের পেলুম । গেটের কাছেপুলিস আর এনারা এরকম বেআক্কেলে হাসি হাসছেন ।


ওনার হাসির কারণ শুনে আমার অনুবাদের খসড়াটা পকেটেই থেকে গেল ।


উনি বললেন, তেইশ তলার ফ্ল্যাটে একজন মডেল থাকেন, জানেন তো, আরেকজন টুটারাশিয়ানের সঙ্গে ? টুটা রাশিয়ান মানে সাবেক সোভিয়েট রিপাবলিকের কোনোঅঙ্গরাজ্য । এই সমস্ত অঙ্গরাজ্যের যুবতীরা বা টুটা রাশিয়ান মেয়েরা বেরিয়েপড়েছেন সারা পৃথিবীতে রোজগারের ধান্দায় , নিজেদের দেশে, সোভিয়েট রিপাবলিকভেঙে যাবার পর খাবার জোটানো কঠিন হয়ে গেছে । বহু যুবতী, স্হানীয় ভাষা বলতেনা পারলেও, রোজগেরে যুবক পেলে বিয়ে করে থেকে যাচ্ছেন ।


আমি বললুম, জানি, ওনাকে প্রায়ই দেখি রুপোলি স্যানট্রোতে আমাদের সামনেররাস্তা দিয়ে যেতে ; কখনও-কখনও টুটা রাশিয়ান মেয়েটিও থাকে সঙ্গে । তবে ওনারাকোন তলায় থাকেন তা জানি না ।


হিন্দি অফিসার বললেন, মডেল তো রোজ আটটারসময় বেরিয়ে যান ফেরেন অনেক রাতে । ওনার টুটা রাশিয়ান বন্ধু আবার ফেরেনও না ; দু'চার দিন কোথাও কাটিয়ে ফেরেন । আজ ওনার ফ্ল্যাট থেকে এমন আওয়াজ আসছিল যেওনার প্রতিবেশি এসে বললেন যে মডেল তো চলে গেছেন সকালে কিন্তু নিশ্চই চোরঢুকেছে , করাত দিয়ে বা কোনো কিছু দিয়ে কাটার আওয়াজ আসছে । আমিপ্রেসিডেন্ট ; তাই অনেকে নিজের ডুপলিকেট চাবি আমায় দিয়ে রেখেছেন, অরিজিনালটা হারিয়ে গেলে বা ভেতরে লক হয়ে গেলে আমার কাছ থেকে ডুপলিকেট নিয়েগিয়ে খোলেন ।


আমি তক্ষুনি গেলাম তেইশ তলায় । গিয়ে আমিও শুনে আন্দাজ করলাম যে চোরই ঢুকেথাকবে আর সে ব্যাটা কোনোকিছু কাটার চেষ্টা করছে । চোরটাকে ধরতে হবে ; পুলিসে ফোন করে দিলুম । পুলিস যখন এলো তখনও চোরটা কেটেই চলেছে , তাওদিনদুপুরে ।


পুলিসের সামনে ডুপলিকেট চাবি দিয়ে দরোজা খুললাম। আওয়াজটা তবুও আসছিল, ওনারবেডরুম থেকে । বেডরুমে গিয়ে দেখি কি চোর নয় , মডেল মেমসাহেবার ব্যাটারিঅপারেটেড ভাইব্রেটার ম্যালফাংশান করে আপনা থেকেই ভাইব্রেট করছে । একাথাকেন, বয়ফ্রেন্ড নেই, আজকাল যুবতীরা বেশ সতর্ক হয়ে গেছেন , তাইভাইব্রেটার দিয়ে নিজের সঙ্গে নিজে প্রেম করেন । এটা তো নিজেকে ভালোবাসারস্বর্ণযুগ ; শীলাকি জওয়ানি গানটা শুনেছেন তো ?


নিজের সঙ্গে নিজে প্রেম !


ওটা কোথায় ? জানতে চাইলুম, পুলিস কি নিয়ে গেছে ? ডিলডো নামের বস্তুটিদেখেছি , নানা রঙের, মাপের, আকারের । অটোমেটিক ব্যাটারি চালিত ভাইব্রেটারদেখা হয়ে ওঠেনি ।

হিন্দি অফিসার ড্রইংরুম সংলগ্ন বাথরুমে গেলেন , তোয়ালে দিয়ে ধরে একটি গোলাপি রঙের জিনিস নিয়ে এলেন । বললেন, দেখে তো মনেহচ্ছে রাতে ইউজ করা, তাই তোয়ালে দিয়ে ধরে আছি ।

গোলাপি ! রঙের চয়েসটাও প্রসংশনীয় ।

ভাইব্রেটার যা ঘটায় তা হল অরগ্যাজম ।অকুস্হলে পরিয়ে বিছানায় চোখ বুজে শুয়ে পড়ো , মৃদু কোনো সুর বাজতে থাকুকপ্রায়ান্ধকার বেডরুমে । ভাইব্রেটার তার কবিত্বের কাজ চালিয়ে যাবে তৃপ্তি নাপাওয়া পর্যন্ত । তৃপ্তির চরমে পোঁছোলে বস্তুটির সুইচ অফ করে গভীর ঘুমেএলিয়ে পড়ো । পুরুষ সামলাবার হ্যাপা নেই । পুরুষের অসফল, অর্ধসফল, সময়েরপূর্বেই ফুরিয়ে ফেলার অতৃপ্তি নেই ।

নেমে এলুম টাওয়ারের ফাস্ট লিফ্ট বেয়ে । তাহলে কেবল মৃত্যু নয়, টাওয়ারগুলো প্রেম-ভালোবাসাকেও আত্মস্হ করতে শিখে ফেলেছে ।


আগে দেখিনি । গেটের বাইরে দেখলুম গ্র্যানাইটে সোনালি অক্ষরে টাওয়ারটার নাম লেখা: 'স্মাইলিং লিপস অ্যাপার্টমেন্টস' ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন