খালাসিটোলা
ছিল বাংলা সংস্কৃতির শ্রীক্ষেত্র। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একটা আস্ত
উপন্যাসই নাকি লিখে ফেলেছিলেন এই খালাসিটোলায় বসে। শুনেছি একটা লম্বা সময়
ধরে উনি সময় করে বেলাবেলি গিয়ে লিখতে বসতেন ‘পদ্মানদীর মাঝি’। ঋত্বিক ঘটক,
কমলকুমার মজুমদাররা এই বাংলা মদের ঠেকে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছেন। আড্ডা
মেরেছেন, তর্ক করেছেন। এমনকী পেশাদার লোকজনদের সঙ্গে স্ব-স্ব কাজ উপলক্ষে
মিটিংও সেরে নিতেন। বাংলা সংস্কৃতিতে খালাসিটোলা জুড়ে আছে সেই কবে থেকে।
এখনে বিক্রি হয় বাংলা মদ বা কান্ট্রি লিকার। এখনে বিস্তৃত জায়গা– যেখনে
বসে, হাত পা ছড়িয়ে আড্ডা মেরে মদ্যপান করা যায়। সম্ভবত দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি এই ঠেকে খালাসি মায়কুলিকামাররা বেশি আসত। পরবর্তীতে
মুখ লুকিয়ে কিছু ভদ্দরলোকও আসতে শুরু করে আর্থিক সঙ্গতি না থাকার দরুন। একে
ধেনো বলে, কালি মার্কাও বলে।অত্যন্ত কম পয়সায় এই মদ্য তৈরি হয় চাল থেকে। বহু বিদেশিকে নিয়ে গেছি। তারা এই নাম্বার ওয়ান স্পিরিটের প্রকার চেখে অত্যন্ত খুশি।
তখন আমরা একে রাইস লিকারও বলেছি। কিন্তু অমিতরঞ্জন বসুর লেখায় পড়লাম এই মদকে ধান্যেশ্বরীও বলা হয়।
ঋত্বিক ঘটককে খালাসিটোলায় আমি পাইনি। পেয়েছি ‘তেরো নদীর পারে’-র পরিচালক বারীন সাহাকে। বারীনদা বলেছিলেন এই মদের ঠেকে বসেই ছবির পরিকল্পনা করেছেন। এখানেই চিত্রনাট্য ঘষামাজা করেছেন, শট ডিভিশান করেছেন। বাজেট নিয়েও আলোচনা হয়েছে এই মালের দোকানে বসে। ঋত্বিক ঘটকের চিত্রগ্রাহক বেবী ইসলাম এই খালাসিটোলায় বসেই আমাদের শোনাচ্ছিলেন কীভাবে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এর আলো ও লেন্স পরিকল্পনা তৈরি হয়েছিল ঘণ্টার পর ঘণ্টা মদের পাত্রে চুমুক দিয়ে। সাহিত্যিক অরূপরতন বসু মদ্যপান করতেন না। কিন্তু টেলিভিশন চ্যানেলের শুরুর যুগে তাঁকেও আসতে হয়েছিল খালাসিটোলায় সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ের গল্প নিয়ে সিরিয়াল করার জন্য টেকনিসিয়নদের আলোচনায়। এমনকী আশির দশকের মাঝামাঝিও এই সরাইখানার একটা মাহাত্ম্য ছিল।
প্রশস্থ জায়গা নিয়ে এস এন ব্যানার্জী রোড আর রফি আহমেদ কিদওয়াই রোডের সংযোগস্থলের কর্নার প্লট এই খালাসিটোলা। সকালের দিকে খালি থাকে মোটামুটি। দুপুরেও তেমন লোকজন থাকে না। সন্ধে থেকে শুরু হয় হরেক লোকের আনাগোনা। মুটে-মিজুর-রিক্সাওয়ালা থেকে দোকান কর্মচারী, ছোট ব্যবসাদার আর নিম্ন মধ্যবিত্ত কেরানী আর পিওনকূল। টেবিল উপচে গেলে মাটিতে বসে, কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে মদ্যপান করছে অগণিত মানুষ। ডালের বরা, আলুকাবলি, বাদাম-ছোলা-মটর, ফল-পাকুরের টুকরো সব কিছুরই ব্যবস্থা আছে। কাউন্টার থেকেমদ কিনে গেলাস নিতে হয় পয়সা জমা রেখে। বোতল ও গেলাস ফেরতে পয়সা পাওয়া যায়। তিন ধরণের বোতল। ছশো মিলিমিটার মানে বড় বোতল। তিনশোটাকে বলে পাঁইট আর দেড়শ মিলিমিটার হল ফাইল।
কলকাতায় একমাত্র ফিফটি আপ পাওয়া যায়। মফস্বলে সিক্সটি
বা এইট্টি আপ। একটা সময় আমরা কলকাতা থেকে ফিফটি আপের কড়া মদ নিয়ে যেতাম
শান্তিনিকেতনে রামকিঙ্কর বেইজ-এর জন্য। উনি পছন্দ করতেন খালাসিটোলার মদ।
অথচ এটা ঘটনা যে বাঙালি বাবুসমাজ বা ভদ্দরলোকেরা এই বাংলা মালকে অচ্ছেদাই
করেছে। আপাদমস্তক ধার্মিক বাঙালি লেখকদের কমলকুমার মজুমদার রামকৃষ্ণদেবের
দর্শনে ভাবিত হওয়ার পর নাকি স্কচ-হুইস্কি-জিন-ভদকা ত্যাগ করেছিলেন। একমাত্র
বাংলা-ই পান করতেন। এর আবার সাধু নাম কারণ বারি। শাক্তরা তো বটেই,
মধ্যবিত্তের কালীপূজায়ও এই মদ-প্রসাদের প্রচলন আছে। জেনেছি এহেন জোড়াসাঁকোয়
ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও কান্ট্রি স্পিরিট পান করতেন নির্দিষ্ট কালীপূজায়।
বাঙালির সারা বছরের নানা তিথির কালীপূজায় এই মদ-প্রসাদের প্রচলন আছে।
জেনেছি এহেন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির মেয়েরাও কান্ট্রি স্পিরিট পান করতেন
নির্দিষ্ট কালীপূজায়। বাঙালির সারা বছরের নানা তিথির কালীপূজায় মদ প্রসাদের
আসন পেলেও মেইন স্ট্রিম বাংলা কালচারের মদ কোনও ঠাঁই পায়নি। এটা ছিল
তরুণতুর্কী, উঠতি, মেজাজি প্রতিষ্ঠান বিরোধীদের আস্তানা। অন্তত দিনে দিনে
সেভাবেই পরিবর্তিত হয়ে এসেছে। এই সংস্কৃতি।
কৃত্তিবাস
ও কৌরব সাহিত্য পত্রিকা খালাসিটোলাকে কেন্দ্র করেই তৈরি হয়েছিল। হাংরি
জেনারেশনের আন্দোলনও গতি পায় এই বাংলা মদের ঠেক থেকে। তখন অবশ্য আমার থাকার
কথা নয়। তবে শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার, মলয় রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায়, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,
পৃথ্বিশ গঙ্গোপাধ্যায়, কমল চক্রবর্তী-সহ অনেককেই দেখেছি। কারও কারও সঙ্গে
সঙ্গ সহ দু’পাত্র পানও করেছি। হাংরি লেখকদের সঙ্গে এই খালাসিটোলায় আড্ডা
মারতে মারতে শুনেছি, একবার তারা এখানে জীবনানন্দ দাশের জন্মদিন পালন
করেছিলেন এবং প্রতিষ্ঠিত লেখকদের বাড়িতে একটা করে জুতোর বাক্স উপহার পাঠিয়েছিলেন ডাকযোগে। কান্ট্রি স্পিরিট খেয়ে গরু মেরে জুতো দানের
স্পিরিট থেকে এই ঘটনা ঘটেছিল কিনা আজ আর তা জানা যায় না। এখানে কিন্তু
মহিলাদের যাওয়ার কোনও অবকাশ নেই। একবার কী একটা কারণে বাইরের দরজার সামনে
ফুটপাথে এক বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করছি, আমার পাশেই একজন মাঝ বয়সী মহিলা
দাঁড়িয়ে। একটু অবাকই হই মদের দোকানের সামনে ওই মহিলাকে দেখে। কিছুক্ষণ পর
দেখি একজন ছাপোষা গোছের লোক বগলে ফোলিও ব্যাগ নিয়ে ঢুকছে। এই মহিলা হঠাৎ
তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। জামা ধরে টানাটানি, ব্যাগ নিয়ে আকচাআকচি।
ভদ্রমহিলা চিৎকার করে গলা ফাটিয়ে দিচ্ছেন। বোঝা গেল যে এরা স্বামী এবং
স্ত্রী। আজ মাসে পয়লা দিন, তাই এই ভিজিল্যান্স। যাই হোক শেষ পর্যন্ত মদ্যপ
স্বামীকে দশটি টাকা হাতে ধরিয়ে বাদবাকী টাকা নিয়ে হন হন করে করে রাস্তা পার
হয়ে গেলেন সেই দোর্দাণ্ডপ্রতাপ।
বাংলার ঠেকে বুদ্ধিজীবী বা হবু কবিদের ভিড়ের মধ্যেই থাকত চোরচোট্টা, রাহাজানি কিংবা ডাকাতি কেসের আসামী আর খুনে, লম্পট আরবেশ্যাপল্লীর দালাল। ফলে মাঝে মধ্যেই বোতল ভাঙাভাঙি, গেলাস ছোঁড়াছুড়ি লেগে থাকত। তবে অত্যন্ত সীমিত সময়ের জন্য। কর্তৃপক্ষের অর্থাৎ ঠেকের মালিকদের লোকজন আছে। আর আছে শান্তিপ্রিয় মাতালরা। সুতরাং বশি হুজ্জতি এখানে চলবে না। রসিয়ে মদ খাওয়ার জায়গা এই খালাসিটোলা। যেখানে বসে আকাশ দেখা যায়। টেবিল বাজিয়ে গান গাওয়া যায়। সুখ দুঃখের কথা বলা যায়। আবার হাংরি জেনারেশনে শুধু কবিতা নয়, বহু গল্পকার গল্প লেখেন শুনেছি এখানে বসে। হাংরির গদ্যকার বাসুদেব দাশগুপ্তের প্রথম উপন্যাস খেলাধুলা এখানে বসে শুনেছি । মলয় রায়চৌধুরী মামলার সময়ে খালাসিটোলায় 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' আবৃত্তি করেছেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দীপক মজুমদার আর পৃথ্বীশ গঙ্গোপাধ্যায়ের গলায় কত যে খালি গলায় গান শুনেছি! এহেন বাংলা মদ নিয়ে আবার একটা বিভ্রান্তিও আছে। অনেকে মনে করেন যাহা বাংলা মদ তাহাই চোলাই। দোকান থেকে বিক্রি হওয়ার কথা। ইতিমধ্যে আমার পাঠক নানা গল্প শুনে নিয়েছেন সংবাদপত্রের বিষমদ কাণ্ড পড়ে। ফলে তা নিয়ে এখানে লেখার প্রয়োজন বোধ করি না। কিন্তু বাংলা মদ নিয়ে আরেকটু জানানোর আছে। যেমন এই মদের বোতলগুলি মোটা স্বচ্ছ বা বাদামী-কালো কাঁচের তৈরি৷ আগে ওয়াইনের বোতলের মতো সোলার ছিপি ঢোকান থাকত৷ এখন আধুনিক বটলিং সিস্টেমের আওতায় পড়ে গেছে ৷ এর গায়ের আবছা ছাপা লেবেলটির মধ্যে ছিল মা কালির ছবি৷ হয়তো সেকারনেই ‘কালি মার্কা’ ৷ সেই মদ কেউ খায় পরিমাণ মতো জল মিশিয়ে, কেউ আবার কাঁচা গলাধঃকরন করে৷ কেউ অনেকক্ষণ ধরে বসে, মজিয়ে পান করে, কেউ আবার এক ঢোকে এক ফাইল৷ হ্যাঁ, তক ঢক করে ৷
বাংলার মদের স্বাদ নিয়ে নানা পক্ষের নানা মত। কেউ যদি বা বলল অসম্ভব চড়া স্পিরিটের গন্ধ তো কেউ বলল, ‘মধু… মধু’ ৷ খালাসিটোলা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে রানি রাসমনি রোডের ওপর আছে বারদুয়ারী৷ সেও অনেক পুরনো ঠেক৷ দুতলা এই বাড়ির বারোটি দরজার জন্যই সম্ভবত বারদুয়ারী৷ সেখানেও লেখক শিল্পীদের যাতায়াত ছিল৷ একবার এই দোকানে অশীতিপর বৃদ্ধ মালিক সাহাদাকে দেখলাম অপেক্ষাকৃত একটা ফাঁকা বেঞ্চে বসে একাই মদ্যপান করছেন৷ হাতের কাছে একটা টিফিন কৌ্টো থেকে কি একটা চাট হিসেবে খাচ্ছেন৷ অন্য লোকজন তখন ভেড়ে না৷ মালিক বলে কথা৷ আমরা তো তখন অকুতভয়৷ সোজা ওনার পাশে গিয়ে বসলাম৷ উনি মৃদু হাসলেন যেন বহুদিনের চেনা৷ বসেই প্রথমে লক্ষ করি সাহাদা ছানা দিয়ে মদ খাচ্ছেন৷ জানতে চাই ছানা কেন? উনি বললেন , ‘মাছ-মাংস মদের সঙ্গে কখনওই খাওয়া উচিত নয়৷ শাক-সবজি, ফল পাকুর চলতে পারে তবে কম পরিমাণে৷ আমার দাঁত নেইরে ভাই তাই ছানা খাচ্ছি৷’ জানতে পারলাম ওনার ষোলো বছর বয়স থেকে এই বাংলা মদ খাচ্ছেন৷ প্রথমে লুকিয়ে চুরিয়ে, পরবর্তীকালে সুড়ি বাড়ির ছেলে হওয়ার সূত্রে রোজকার সান্ধ্যকালীন বরাদ্দ, ফলে অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে এই মদ্যপান৷ শুরু নাকি করেছিলেন একটা ফাইল দিয়ে৷ মধ্য বয়সে সেই পরিমাণ গিয়ে দাঁড়ায় একটা বড় বোতলে৷
তারপর আবার ক্রমে পাইট৷ পাইট থেকে এখন আবার ফাইলে চলে এসেছেন৷ দিব্য শরীর ৷ তেমন অসুখ বিসুখের কথা বলতে পারলেন না৷
এখনও মদ খেতে খেতে আড্ডা মারতে মজা পান৷
এছারাও ছিল গাঁজা পার্কের বাংলার দোকানদারি সেখানেও বিজন ভট্টাচার্যকে দেখেছি৷ তার ভক্ত শিষ্যদের সঙ্গে আডা মারছেন৷ কবি অনন্য রায়কে দেখেছি৷ তুষার চৌধুরীর সঙ্গে আড্ডা মেরেছি৷ এইভাবে যেমন মনে পরে বন্দুক গলি বলে মধ্য কলকাতার এক মদের আড্ডাকে৷ সেখানে চাটাই পেতে বসতে হত৷ নুনে জড়ানো আদাকুচি আর ছোলা পাওয়া যেত ফ্রিতে ৷ চলচিত্রকার বারীন সাহা বলেছিলেন, মদের দোকানে এই আপ্যায়ন আর ভবিষ্যতে থাকবে না৷ চল একটা তথ্যচিত্র বানাই৷ সে ছবি হয়নি৷ কিন্তু শহরের উঠতি মধ্যবিত্ত দের বারের এখন বারবারন্ত৷ ফলে সংস্কৃতির বাংলা বাজার থেকে মুখ ঢেকেছে বাংলা মদ৷ তার নতুন তর বিপননের কথাও সরকার ভাবেনি৷ যদিও সরকার এর থেকে অনেক ট্যক্স পায়
দেখা যাক কি অবস্হা গিয়ে দাঁড়ায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন