নুরুদ্দিন জাহাঙ্গীর : আসুন আমরা মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’গুলো চিহ্ণিত করি
পূর্বপাঠ: মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি জেনারেশনমলয় রায়চৌধুরী হাংরি জেনারেশনের পুরোধা । এই আন্দোলনের জনকও । এই আন্দোলনের সূচনা ১৯৬১তে । মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্তত দুজন বাংলাদেশেও স্বনামে খ্যাতিমান — শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং দেবী রায় ।
হাংরি আন্দোলন পাশ্চাত্যের এক শিল্প আন্দোলনের অনুসরণ । কিউবিজম, ফবিজম, সুররিয়ালিজম আর হালের পোস্টমডার্নিজম — এমনি সব নতুন শিল্পচিন্তার ঢেউ সাতসমুদ্র পাড়ি দিয়ে প্রাচ্যে এসেও পৌঁছে যায় কালের ‘মলয়’ ভর করে । বাংলা কবিতার নান্দনিকতার পাঠ পাকটে দেবার মানসে মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর সাহিত্য সহযাত্রীগণ সমকালীন সাহিত্যে নিয়ে আসেন এক উদ্দীপনাময় নতুন মলয়প্রবাহ । এই চেতনাপ্রবাহের নাম হাংরি আন্দোলন ।
মলয় রায়চৌধুরী এবং হাংরি জেনারেশনের কবিরা সমসাময়িক পাশ্চাত্যের এক বিশেষ শিল্প চেতনায় সংক্রামিত হয়ে নান্জদনিকতার সকল পুরানো রীতিনীতি ও কাব্যপ্রয়াস অস্বীকার করে নতুন তরঙ্গে বিমোহিত ই উচ্ছসিত হয়ে সৌন্দর্যবোধের সীমারেখা মুছে দেবার উন্মাদনায় মেতে উঠেছিলেন কিংবা চেয়েছিলেন । তাঁরা কবি ও কবিতার, কবিতা ও সময়ের, কবি ও পাঠকের সকল প্রকার আড়াল মুছে দিয়ে বোধ ও বোধির সন্মিলন ঘটাতে চেয়েছেন ; তাঁদের প্রয়াস ছিল কবিতার মুক্তি, এক নতুন ভাষার বিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে কবিতার পুনর্জন্ম । এই আন্দোলনের আদর্শপুরুষ গিন্সবার্গ যেমন বলেন : “প্রতিটি সৃষ্টিশীল মানুষেরই একজন নিজস্ব ঈশ্বর থাকে । প্রচলিত ঈশ্বর দিয়ে তাঁর চলে না ।” তেমনি বিশ্বাস হাংরি জেনারেশনের কবিদের । তাঁরা তাঁদের বিশ্বাসের রূপরেখাও ঘোষণা করেছিলেন প্রস্তুতিপর্বেই : ( ক ) সত্ত্বার পূর্ণরূপের নির্মম উচ্চারণ ; ( খ ) নগ্নতার সম্পূর্ণ নিরাভরণ উপস্হাপন ; ( গ ) সত্ত্বার মুহূর্তকালীন সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম প্রকাশ ; ( ঘ ) প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়া ; ( ঙ ) জীবন্ত কিংবা জড় ছাড়া যাকিছু দৃশ্যমান তাদের নিরীক্ষণ না করে তার অস্বীকৃতি ; ( চ ) যাকিছু বা্তব বলে প্রতীয়মান তাদের যাচাই না করে গ্রহণ না করা ; ( ছ ) সনাতন গদ্য ও পদ্যের আদর্শকে নিশ্চিহ্ণ করে কবি ও কবিতার পাঠকের মধ্যে নতুন যোগসূত্র সৃজন করা ; ( জ ) কথ্যভাষাকে কবিতায় ব্যবহার করা ; ( ঝ ) কবিতার সাধারণ কথ্যধ্বনির ক্ষুরধার প্রয়োগ ; ( ঞ ) সনাতনি কাব্যকাঠামো প্রত্যাখ্যান করে কবিতার আদি কাঠামি বিনির্মাণ ; ( ট ) কবিতাই মানুষের চূড়ান্ত ধর্ম বলে স্বীকৃতি দেয়া ; ( ঠ ) ভাষার তীক্ষ্ণক্ষুরধার অনুভূতি পাঠকের কাছে গতিময় করে পৌঁছে দেয়া; এবং ( ড ) ব্যক্তিসত্ত্বাই চূড়ান্ত মেনে নেয়া ।
হাংরি জেনারেশন মূলত পাশ্চাত্যের বিট জেনারেশানের অনুসরণকারী এবং তাদের দ্বারা সরাসরি প্রভাবিত । নির্মলেন্দু গুণের মতে, গিন্সবার্গের মতো সাম্প্রতিককালেএর আর কোনো পাশ্চাত্যের কবিই বাংলা কবিতাকে এতটা প্রভাবিত করতে পারেননি । কলকাতার হাংরি জেনারেশন বা ঢাকার ‘স্বাক্ষর’, ‘কণ্ঠস্বর’ গোষ্ঠী গঠনের পেছনে ছিল আমেরিকার বিট কবিদের গুরু গিন্সবার্গের ভারত ভ্রমণের প্রভাব । গুণ বলেছেন, তিনি এবং কবি আবুল হাসানও গিন্সবার্গের প্রভাবে বোহেমিয়ান জীবন যাপন করেন কিছুকাল । বিট জেনারেশনের কবিদের বিশ্বাস — কবিতার সঙ্গে অসম্পর্কিত কোনো কাজই কবিদের করা উচিত নয় । জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞাতায় নিজেকে সমৃদ্ধ করতে হবে। কবিদের জন্য সুখ নয়, কবিসত্ত্বাকে কলুষমুক্ত রাখার জন্য সবচেয়ে স্বাধীন জীবনের অনুকূল পরিবেশের সন্ধান করতে হবে কবিকে । অকপট জীবনসত্য প্রকাশ এবং জীবনে সবরকম অভিজ্ঞতা অর্জনই জরুরি । বিট কবি গিন্সবার্গ ভারতে আসেন ১৯৬২ সালে ; হাংরি আন্দোলনের সূচনা ১৯৬১ সালে, গিন্সবার্গ আসার একবছর পূর্বে– মূলত মলয় রায়চৌধুরীর মজ্জা থেকে ।
‘জখম’ কিংবা মানসিক উপসর্গ
‘জখম’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে, হাংরি আন্দোলন যখন তুঙ্গে । সংবাদপত্রে হাংরি আন্দোলনের খবর প্রকাশিত হলে কলেজস্ট্রিটের একটি ছাপাখানা খানিকটা কম্পোজ করেও বইটি আর ছাপতে রাজি হয়নি । শেষ পর্যন্ত মনীশ ঘটকের প্রয়াসে ‘জখম’ আলোর মুখ দেখে ।
‘জখম’ মলয় রায়চৌধুরীর চতুর্থ বই । প্রথম গ্রন্হ ‘মার্কসবাদের উত্তরাধিকার’, দ্বিতীয় ‘শয়তানের মুখ’, এবং তৃতীয়টিও দীর্ঘকবিতা ‘অমীমাংসীত’ । ১৯৬৪ সালে কবিতা লেখার জন্য ভারতীয় দণ্ডবিধি ১২০ ( বি ) এবং ২৯২ ধারায় জেল খাটতে হয় মলয় রায়চৌধুরীকে । ১৯৬৭ সালে বেকসুর খালাস । অতঃপর সাহিত্য থেকে স্বেচ্ছানির্বাসন, এবং ১৯৮৩ সালে প্রত্যাবর্তন ।
আমাদের জানা আছে জখমের পূর্ব শর্ত আঘাত । আঘাতের কারণেই জখম হয়ে থাকে । এর উপসর্গ রক্তক্ষরণ ও যন্ত্রণা । আবার অন্তর্গত রক্তক্ষরণ চাক্ষুষ নাও হয়ে থাকতে পারে । আমরা দেখতে চাই মলয়ের ‘জখম’এর ধরন কেমন । কোন ধরনের আঘাতের ফলে তার জখমের সৃষ্টি, জখম কতটা গুরুতর আর লক্ষণ কি কি, কোথায় কীভাবে এর সূত্রপাত । আমরা আরো অবলোকন করতে পারি মলয় কতটা আক্রান্ত, আর যন্ত্রণায় তিনি কাতর কী না ; জখমের ফলে তার রক্তক্ষরণ হয় । জখমের কাব্যিক রূপায়ন করে শিল্পের দায় তিনি কতটা পূরণ করেন ? বীভৎসতার উদ্ঘাটনের মধ্য দিয়ে পাঠককে কতটা আনন্দ দিতে পারেন তিনি ?
‘নীলের মধ্যে মানুষ দেখতে পায় ব্যপ্তি, আকাশের গম্বুজের মতো, যে গম্বুজটা উঠে গেছে আনন্দ এবং মুক্তির দিকে ‘ — পাবলো নেরুদার কথা । মলয় রায়চৌধুরী জখম কবিতার শুরুতেই ‘চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে’ তার নিচে শুয়ে আকাশের উড়ন্ত নীল দেখতে থাকেন, এবং ‘দুঃখ-কষ্টের শুনানি মুলতুবি রেখে সমস্ত সন্দেহকে জেরা’ করতে শুরু করেন । আর ‘চেতনার উপর দিয়ে গ্রামোফোনের পিন চালিয়ে ভবিষ্যৎ’ জেনে নিতে চান ।
একটি কবিতা কখন কবিতা হয়ে ওঠে, কবিতায় কী কী থাকতে নেই — এমন সব অমীমাংসীত বিষয়ের অবতারণা কিংবা উত্তরের অনুসন্ধান না করে আমরা মলয়ের পাশে বসবো ‘জখম’ চিহ্ণিত করতে । আমাদের বীক্ষণ হবে আকাশের উড়ন্ত নীলের দিকে — আনন্দ ও মুক্তির দিকে — জখমের যন্ত্রণা কিংবা আনন্দ উপলব্ধির জন্য ‘চাঁদোয়ায় আগুন লাগিয়ে’ বসতে হবে মলয়ের পাশে ।
মলয় রায়চৌধুরী এক নতুন চিন্তার ছুরি দিয়ে তাঁর সময় ও পুরনো কাব্যচেতনাকে আঘাত করেন, নতুন কবিতার জন্য — যা হাংরি আন্দোলনের চেতনায় শাণিত । বস্তুত মলয়ের সময়ই তাঁকে সময়ের প্রতি নিষ্ঠুর হতে বাধ্য করেছে। অন্যভাবে বলা যায়, ঔপনিবেশিক শাসনে ক্ষতবিক্ষত সময়ের মনন-মেধা ও আহত সময়ের জখমগুলো তাঁকেও আঘাত করেছে অতি নিষ্ঠুরভাবে । সময়ই অস্হির আর রক্তাক্ত করে তোলে কবিকে । এই অস্হিরতা আর যন্ত্রণার কাব্যিক প্রকাশই ‘জখম’ ।
‘জখম’কবিতায় মলয় দীর্ঘ পথ হাঁটেন, দীর্ঘ সময় ধরে হাঁটেন । ‘জখম’ একটি দীর্ঘ কবিতার স্বরূপ নিরুপন আমাদের অন্বিষ্ট নয় , আমরা কেবল ‘জখম’ নিয়ে কথা বলছি । তবু এটুকু বলা যেতে পারে যে, দীর্ঘকবিতা একটি নদীর মতো; ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলে যা বাঁক নিয়ে এগুতে থাকে, তাই নদীর তীরে দাঁড়িয়ে দীর্ঘকবিতার পাঠ নয়, আবার নৌকাভ্রঞণেও নদীর সবটা অবলোকন হয় না; বাঁকে বাঁকে এর আংড়াল । এর ব্যপ্তি বিশাল; এতে কবির চিন্তা ও চেতনার ডালপালা দীর্ঘজীবনের বাঁকগুলোর ওপর আলো ফেলে এগোয় আর সময়ের পূর্ণ উন্মোচন ঘটায় । দীর্ঘকবিতা একটি বৃক্ষের মতোও, যার সবটুকু গবাক্ষপথে সীমিত অবলোকন আমাদের প্রয়াস ।
শুরুতেই যন্ত্রণার ছবি আঁকেন মলয় । তাঁর ‘বুকের বাঁদিকের আর্মেচার পুড়ে গেছে বহুকাল, এবং এখন চোখ জ্বালা কোর্ছে মলয়ের কঙ্কাল জ্বালানো ধোঁয়ায়’। তাঁর আশপাশ দিয়ে ‘ঘণ্টায় ৯৯ কিলোমিটার দূরে উড়ে যাচ্ছে বদমতলব ঝড়’ । তাঁর সামনের সমস্ত দৃশ্য ধেবড়ে গেছে দেখতে পান ; ‘কারুর সঙ্গে খাপ খাচ্ছে না তাঁর’ । আর এভাবেই ‘জখম’ কবিতার নির্মাণ শুরু । জখম থেকে রক্ত ঝরতে থাকলে তা দিয়েই কালি ভরে নেন মলয়, রক্তাক্ত বোউ থেকেই জন্ম দেন অপূর্ব সব পঙক্তিমালা । তাবৎ পুরনো কাব্যভাষার ব্যবচ্ছেদ করে নতুন কাব্যসত্ত্বার পূর্ণরূপ উন্মোচনের প্রয়াসে অস্হিরভাবে আঘাত করতে থাকেন । তাঁর অনুভব এই যে, ‘আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে/আমার জিভ আমার ভাষা ভুলে যাচ্ছে’ । তিনি পাঠকের সামনে আবুর্ভূত হন মলয়ের গায়ের চামড়া তুলে ফেলে দিয়ে । তাঁর প্রতীতি এই যে, তাঁর আছে বংশপরম্পরায় ৬০০০ বছরের আপৎকালীন ক্রুরতা’ ; তাঁর হাড়ের কাঠামো জাপ্টে দাঁড়িয়ে রয়েছে কেবল চোটজখম । লাভলোকসানময় সমদ্বিঠ্যাঙ মানুষের দল বোধহীন সময় কাটিয়ে যাচ্ছে । তিনি পুরনো -পলেস্তরা চেঁছে মানুষের বোধহীনতা ফেলে দেন , এবং তাঁর নখগুলোকে খুবই দরকারি এবং মহানুভব মনে হয় । আর এভাবেই তিনি জখমের বয়ান তুলে ধরতে পাঠককে প্রস্তুত হতে আহ্বান করেন ।
প্রচলিত মূল্যবোধের প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে সনাতনী কাব্যকাঠামো প্রত্যাখ্যান করে কবিতার মৌলিক কাঠামো বিনির্মাণ করতে সমস্ত সন্দেহকে জেরা করে নেন মলয় রায়চৌধুরী । হাংরি আন্দোলনের অগ্রনায়ক সত্ত্বার নির্দয় উন্মোচনের জন্য ‘সাধারণ কথ্যশব্দধ্বনির ক্ষুরধার প্রয়োগের’ মাধ্যমে পাঠকের মনেও এক নতুন বোধের জন্ম দিতে চান, যে বোধ মানুষকে উদ্ধার করবে পোরোনো বোধের পাঠশালা থেকে যেখানে মানুষ খুন করার আর সেবা করার কায়দাকানুন শেখাবে না । আর এভাবেই আমরা মলয়ের স্বরূপ অবলোকন করি, যাঁর চেহারায় অসংখ্য জখমের চিহ্ণ ছাড়া আর কিছুই দেখতে পান না । তিনি আমাদের দেখাতে থাকেন সমাজ ও সময়ের অসংখ্য ক্ষত, বোধের পরাজয়, পাশবিকতার নগ্ন চেহারা আর স্হবির চিন্তার দ্বারা বন্দী মানুষের চালচিত্র । আমরা দেখতে পাই মলয়ের ‘জখম’ এর সঙ্গে একাকার হয়ে আছে অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যতের মানুষ-পচা-রক্তাক্ত মানুষ ।
মলয়ের পরিভ্রমণ ভূগোলে, সমাজে, ইতিহাসে — মানুষের সমসাময়িক জীবন-যাপনে, হেঁটে-হেঁটে তিনি অতীতে চলে যান, দুদণ্ড দাঁড়িয়ে ফিরে আসেন সময়ের তীক্ষ্ণ তীরে — তাকান ভবিষ্যতের দিকে । বস্তুত মলয় সকল মানুষকে একীভূত করে একজন হয়ে জখমের চিহ্ণ নিয়ে হেঁটে বেড়ান একাকী । তিনি অতীত বিচরণকারী নন; অসীমের অভিসারী, দুঃসহ বর্তমানকে অতিক্রম করতে চান মানুষকে সঙ্গে নিয়ে । তাই ইতিহাসের ইঙ্গিতসহ কার্যকারণ চিহ্ণিত করার পাশাপাশি বর্তমানের সকল প্রকার অন্ধকার জখমে ধারণ করেন সুতীব্র যন্ত্রণায় । একই সময়ে ভিন্ন ভিন্ন ভূগোলে তাঁর বিচরণ বলে আমরা তাঁর সঙ্গে হেঁটেও হয়তো চিন্তার সবটুকু স্পর্শ করতে পারি না, তবুও তাঁর জখম-যন্ত্রণা নিজের মতো অনুভব করি না বলে মলয়ের মতো করে সময় ও নিজেকেও চিনতে পারি না, কেবলই পোরোনো বোধে আক্রান্ত হই বলে ।
মলয় রায়চৌধুরী নিজেও অস্হির । তাঁর ‘হিমোগ্লোবিনে টহলদার আঁধারের উস্কানি’ ফি-মিনিট । ‘ব্রেনের ক্রুদ্ধ শাসনের ভাপ থেকে/রেটিনার ওপর রঙিন নাইট্রোসেলুলোজ ঝরে পড়ছে’ । তারপর পচণ্ড উন্মাদনায় অনেকটা প্রলাপের মতো আঁকেন তিনি সময়কে । আমরা জানি, মাত্র কয়েক ঘণ্টায় ‘জখম’ এর মতো দীর্ঘকবিতার জন্ম দেন তিনি । ‘জখম’ পড়তে গিয়ে আমাদের পিকাসোর গোয়ের্নিকা’র কথা মনে পড়ে । যদিও এর প্রেক্ষাপট ভিন্ন, তবু ‘জখম’ এর ক্যানভাস আর এর চিত্রায়ণ আমাদের পোরোনো বোধ ঝেড়ে ফেলে দিতে বলেন । তিনি মানুষের বোধহীনতা চেঁছে ফেলে দেন, তাঁর নখ তাঁর কাছে মহানুভব বলে মনে হয় । অর্থাৎ প্রচলিত মানবিক আচরণ তিনি মেকি বলে বিবেচনা করেন । আমরা ‘বিট জেনারেশনের’ কবিদের আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হাংরি জেনারেশন-এর কবিকে সহজেই পেয়ে যাই । তিনি হৃৎপিণ্ড নামক মানবিক বোধও অস্বীকার করেন । মলয় রায়চৌধুরী আমাদের চিন্তাগুলোকে ঝলসে-সেঁকে শুদ্ধ করে নেন । অতঃপর তিনি তাঁর নতুন কাব্যবিশ্বাস আর জখমের কথা বলা শুরু করেন । ‘মানুষই মানুষকে শেখাচ্ছে খুন আর সেবা করার কায়দাকানুন’ । তিনি বয়ান করেন –‘২০০০ শিকারি কুকুর আমাকে তাড়া করে ফির্ছে ২৫ বছর’ । আর ২৫ বছর তাঁর ব্যর্থতায় কেটেছে । মলয়ের জন্ম ১১ কার্তিক ১৯৪৬ ।
আমরা জখম-এ দেখতে পাই ২৫ বছরের চালচিত্র । মলয় রায়চৌধুরীর জন্ম ঔপনিবেশিক শাসনের এক ছেঁড়া-ছেঁড়া ভূমিতে । যে শাসনের অবসান মানুষকে যতটা না স্বাধীন করেছে তার চেয়ে বেশি করেছে রক্তাক্ত । এই রক্ত পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির জন্য যতটা তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষের মানবিক বোধের অবক্ষয়ের জন্য । মানবিক বিপন্নবোধের মধ্য দিয়ে কেটেছে মলয়ের শৈশব, রক্ত আর ভাঙনের বিপ্রতীপে আর কোনও আদর্শ ছিল না । তাঁর জন্মের ২৫ বছর পর স্বাধীন ভূমিতেও অবস্হার কোনও বদল নেই । ‘১ই শিরার মধ্য দিয়ে বয়ে যাচ্ছে গান্ধী আর আত্তিলার সমকেমিকাল রক্ত’ । ‘সকলেই যে যার কাজ গুছিয়ে ঘাটবাবুর সার্টিফিকেট নিতে চলে যাচ্ছে’, ‘উইদের থুতু দিয়ে তৈরি মাটির শিরার মধ্য দিয়ে’ । ‘কাঁচা মাংসের লাশ টেনে নিয়ে যাচ্ছে ডেঁয়োপিঁপড়ের সার’ । এখানে তারুণ্য এখন ‘গায়ে-পড়া ঢেউরা সামুদ্রিক পাড়ি দিয়ে/হেঁটে চলে যায় শকুনদের বিমর্ষ আড্ডায়’ । ‘খাদ্য জিনিসেরভ মধ্যেই ১সঙ্গে লুকিয়ে থাকে রক্ত আর পুঁজের অ্যাকালষেঁড়ে রঙ’ । ‘বিকারগ্রস্ত মেধা মাটি থেকে শুষে তোলে/তরল পরোপকারী নোংরামি’। আর শীতার্ত সময়েরই বর্ণনা করেন ‘জখম’-এ । যখন চেতনার কোনো উত্তাপ নেই ; সময় হেঁটে যাচ্ছে পেছনে কেবল । তখন তারুণ্য জন্মকেই অস্বীকার করে ; মনে করে ‘চাইনি তবু জন্মালুম’ । সময়টা কেমন ? এখন ‘দেবদারুর নতুন বাক্সে চড়ে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের লোভে/দেশবিদেশের সীমান্ত ওব্দি চলে যায় গ্রিজমাখা ৩০৩ কার্তুজ’ । সময়ের আরো ভয়ঙ্কর উন্মোচনও আমাদের সামনে অপেক্ষা করে — ‘বুদ্ধের ২৫১০ বছর পর গান্ধী ময়দানে পড়ে থাকে/পুলিশ ও অপুলিশ মার্পিটের ( রাষ্ট্রিয় সন্ত্রাসের ) ১৯৬৫ মডেলের জুতোছাতা’ । ‘কোকেন আর জাল টাকার আড়তে/দেদার আরামে ১সঙ্গে শুয়ে থাকে ভারত আর চীনের নাগরিক’।
আর মলয়ের অনুভব, ‘ঈশ্বর যন্ত্রস্হ/আমি ভুল গর্ভ থেকে নেমে ভুল নাম নিয়ে ঘুরে বেড়ালুম ২৫টা বছর/ভুল ইচ্ছে থেকে পেয়েছি ভুল দ্বেষ/ভুল সুখ থেকে ভুল দুঃখ…/আমি ভুল সংঘাত থেকে জড়ো করেছি ভুল চেতনা/…এ ভুল কোল্কাতা এ ভুল মানুষমানুষী/ভুল দম্ভ থেকে তৈরি কোরেছি ভুল হিংসে/আমি ভুল শৌচকাজ থেকে জেনেছি ভুল সরলতা/ভুল সংযম আমাকে এনে দিয়েছে ভুল বিরাগ/আমি ভুল অহংকার নিয়েভুল ভিড়ের কাছে চলে গেছি’। তদুপরি মলয় ভক্তি নিয়ে সারারাত জেগে থেকেও মুক্তি পান না । তিনি বুঝতে পারেন এ-ও এক চরম ভুল । এখানে নিখুঁত করেন তাঁর অঙ্কন । তিনি দেখিয়ে দেন, আমরা শৌচকাজ করেও শুদ্ধ হতে পারি না; সংযম মানেই প্রশান্তি নয়; ভক্তি মানেই মুক্তি নয় । ভক্তি করার মতো আমাদের কোনো আদর্শ নেই । আমরা যা শিখি তা সঠিক নয় । নিখাদ-নির্ভুল ভালোবাসাও আমাদের তারুন্যের জন্য অনুপস্হিত । যাকে সুবাতাস মনে হয় আসলে তা পুতিগন্ধময়।
অতঃপর মলয় স্বমূর্তিতে হাজির হন । একদিন তিনি তাঁর ‘আঙুলগুলো হৃদয়ের সঙ্গে সিল করে রেখে ২৫ বছর কাটিয়ে দিয়েছেন’ । এখন ‘জেগে উঠেছেন অন্ধকারের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে’ । মলয় কি আসলে আমাদেরই জাগিয়ে তুলতে চান ? আমাদের চিরচেনা আঁধারের স্বরূপ উপস্থাপন করেন মলয় । আসলে মলয় যা দেখেন আমরাও তাই দেখি । তবু, আমরা, মলয় দেখিয়ে না দিলে ‘জখম’গুলো অনুভব করি না । মলয় দেখালে পর আমাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ শুরু হয় ।
মলয় আমাদের সাথে করে ‘নীল আমেরিকা থেকে ধূসর জর্ডান ওব্দি’ পরিভ্রমণ করেন ‘ফাহিয়েন’ হয়ে । আমরা দেখি ‘বিশ্বভাতৃত্ব শিখে এঁদো বস্তিতে ফিরে যাচ্ছে মানুষ’ ; ‘গোলাপের কুঁড়িরভেতর থেকেও ৩৪টা আলজিভ’ বেরিয়ে আসে । সফল মানুষের ভেতর থাকে কার্বনরডের ছায়ার ধুলোর আড়ালে লুকিয়ে আছে ভাঙা কাঁচ । ‘আশেপাশের রাজ্য থেকে ৯০০০ জিভছোলা উড়ে এসে কোল্কাতার আকাশ চষে ফেলছে’। ‘আদালত অবমাননার দায়ে নিয়মের কাছে মাথা নোয়াচ্ছে ডারউইনের মানুষ’। এখানে নগরায়ন মানে ‘বসতবাড়ি ভেঙে জন্মনিয়ন্ত্রণের অফিস বানানো’ । ধর্মের কাছেই মানুষ পরিত্রাণ খোঁজে এখনো । প্রকৃত প্রসঙ্গে ‘জখম’ উত্তীর্ণ সময়েরও ছবি । যখন ‘এখানে নিচু কোর্টে হেরে গিয়ে সদর কোর্টে জিতে ফিরে আসে’ । ‘রাজপথ দিয়ে/বুলেটপ্রুফ পেশাদার দেশপ্রেমিকেরা আর একলা হাঁটে না’ । ‘আণবিকচুল্লি আর রেডক্রসের কার্যক্ষেত্র/আপোসে ভাগ কোরে কর্তব্যবোধে ঘেমে ওঠে মানুষ’ । আর ‘মানুষের আদর খেতে পাথরের নুড়ি চলে আসে/পেতলের পূজনীয় সিংহাসনে’ । এবং ‘সমাজের সোহাগ ছেড়ে পাহাড়-জঙ্গলের দিকে চলে যায়/আধন্যাংটো মানুষ ও তার নিজস্ব দেশলাই’ । কবি অনুভব করেন ইতিহাসের উষাকালীন মানুষের যে বাংলাদেশ কাঙ্খিত ছিল, এ তা নয়, এ হোলো ‘আমার ( মানুষের ) কঙ্কালের জয়েন্টে লাগানো সৎ-অসৎ নাটবল্টু’ কেবল । তিনি দেখেন মানুষের দেয়া আইনানুগ মৃত্যুদণ্ড পেয়ে কেবল মানুষই মরে যাচ্ছে । তিনি নগর আর নগর-কর্তৃপক্ষ বলতে বোঝেন ‘প্রসাব কোর্তে বারণ কোরে/কোল্কাতার দেয়াল বাঁচিয়ে’ রেখে দায়িত্ব পালনের পরাকাষ্ঠা দেখায় । আর নগরের চিত্র হচ্ছে ‘মানুষের ঘুম খুঁজে বের কোর্ছে/রাত্তির বেলায় রোয়াক-ফুটপাত-গাড়িবারান্দা’ । ৬৮০০০ প্রচারপত্র সকাল থেকে খুঁজে বেড়াচ্ছে কলকাতার ফাঁকা দেয়াল’ । উৎসব আর ধর্মানুষ্ঠানই চাকুরেদের দায়িত্ব এখন । রাজনীতির নমুনা হলো, ‘রেডিওতে কবিতা আর ভোটেত ফলাফল খোলশা করে ব্রডকাস্ট’ ।
মলয় রায়চৌধুরী আমাদের জানান, তাঁর ( আমাদের ) ‘শ্রদ্ধেয় পূর্বপুরুষ ১৭০০ টাকায় কোল্কাতাকে বেচে দিয়েছিলেন’ । তাই এখন ‘হৃদয়ের জায়গায় ১টা বাদুড় ঝুলিয়ে ফুটপাত দিয়ে বাড়ি ফির্ছে সফল মানুষেরা ‘। আর তাদের হাতে ‘পালকসমেত প্রায় ১.৫ কিলো মাংসসুদ্ধ বাড়ি যাচ্ছে/১জোড়া জংলি হাঁস’। মানুষের অবস্হা এরকম : ‘প্রতি মিনিটে ৪০০০০ লোক দুঃখকষ্টে ককিয়ে উঠছে কোল্কাতার পথঘাট গেরস্হালিতে ‘। ‘৪দিকে সঙ্গিন উঁচিয়ে রেখেছে ‘শান্তিকামী মানুষেরা’। আর সাধারণ মানুষেরা কেবল তৈরি হচ্ছে দুঃখকষ্ট ভোগ করার জন্য । ‘পৃথিবীর প্রতিটি পার্লামেন্টের ল্যাভাটরিতে/দৈনিক ৫০০ লিটার রাজনীতি সাংবাদিকদের নজর এড়াচ্ছে ‘। ‘মানুষই মানুষকে শেখাচ্ছে পড়াচ্ছে শৃঙ্খলার গুণ ও হিটলারের আত্মকথা’ । আর আংমলাদের অবস্হা, ‘টেবিলের নিচে ৩৫০০০ আমলার ঘুষাঘুষময় স্বদেশী পা নেচে বেড়ায় রোজ’ । শিক্ষার চেহারাটা এরকম, ‘ডাকযোগে ( বিদেশী ডিগ্রি? ) উচ্চশিক্ষা পেয়ে ফুলে উঠছে বাঙালি মফসসল । ‘স্ত্রীলোকের চেয়ে ইউরেনিয়াম আজকাল বেশি দামে বিকোয় আর আনবিক ফোড়া কম্প্রেস করা হল বিজ্ঞান’। ‘নারীর গর্ভকে অকেজো করে দেয়া মানে বিজ্ঞান’ । এখানে ‘পঙ্গপালের ঝাঁকের পেছনে উড়ে যায়/৮০০০০০ উদ্বোধনকারী মন্ত্রী ও তাদের কাঁচির দঙ্গল’।
‘জখম’ কবিতার ভাষার অভিনবত্ব আমাদের চমকে দেয় । নিরেট আমসৃণ খটমট সংখ্যার শাণিত উস্হাপন, চিরচেনা ভাষার স্নিগ্ধ রঙের বদলে কেবল লাল আর কালোর অমার্জিত ব্যবহার ছাড়া যেন ‘জখম’-এর উদ্ঘাটন সম্পূর্ণ হয় না, ‘জখম’ পাঠে আমাদের এমন বোধ জুআগে । মলয় রায়চৌধুরী সনাতন পদ্যের আদর্শকে নিশ্চিহ্ণ করে কবিতা আর পাঠকের ভাষাকে একাকার করে দেন । কথ্য ভাষার অসম্ভব সম্ভাবনাময় কাব্যিক বিনির্মাণ, সংখ্যাবাচক পঙক্তি কবিতার শরীরে শিরায় শিরায় শিওরায় নাটবল্টু আর পেরেকের মতো মজবুত ও মানানসই ব্যবহার করেন যা প্রথাগত ছন্দে রীতিনীতি ভেঙে দিয়ে ছন্দমুক্তির এক নতুন দ্বার খুলে দেয় । তার পেরেকের নির্ভুল নির্মাণ আমাদের বিরল্ত না করে ভিন্নতর দ্যোতনার সৃষ্টি করে । ৮০০০০০ কাঠের দরোজা, ১৬ ডিভিশন কাক, ২০০০ শিকারি কুকুর, ৫ পয়সার চাক্তি, মাসিক ২৮৭.৭৫ টাকা ভাড়া, ৯৯০০০ পুরোনো জিভছোলা, ২৭৬০ লক্ষ টাকার মানি অর্ডার ফর্ম, ৪৯ জন আরামখেকো লাশ, ১৯৬৫ মডেলের কোল্কাতা, ৩৫০০০ আমলার স্বদেশি পা, ৮০০০০০ উদ্বোধনী মন্ত্রী — এমন শব্দগুচ্ছ অনায়াসে কবিতার পরতে পরতে এঁকে দেন মলয় । আবার প্রতিটি খটমট পঙক্তিও এক একটি চিত্রকল্প । প্রচলিত ছন্দবন্ধন ভেঙে কিংবা উপেক্ষা করে, যতিচিহ্ণ উচ্ছেদ করে, খরস্রোতা নদীর মতন এগিয়ে যান মলয়, কোনো কিছু পরোয়া না করে । তাঁর সাহসী উচ্চারণ পাঠককে ভাবিত করে । আমরা এমন নতুন পঙক্তিও পাই — ‘দেয়ালে কপাল ঠুকে কাঁদফাএ জন্য জেরুজালেম ওব্দি চলে যাচ্ছে মানুষ’, ‘পরমাণুশক্তির উন্নয়ন সত্ত্বেও হারানো ছেলেরা ভেসে উঠছে পচা ডোবায়’, ‘অনেক পুতুলেরও নীতিবোধ জেগে উঠছে আজকাল’। মলয় রায়চৌধুরীই লিখতে পারেন — ‘১জনকে মৌলালিতে মারা মানে খুন/রাজশাহিতে মারা মানে দেশপ্রেম’ ।
২৫ বছরের ব্যর্থতা চিহ্ণিত করে, ‘জখম’-এর উন্মোচন করে, বাঁকে বাঁকে মলয় আমাদের যে নতুন আস্বাদন দেন তা লিরিকে সম্ভব নয় । তাই তিনি মাধ্যম বেছে নেন দীর্ঘ কবিতার ফর্ম । ট্রাজেডির কাল অতিক্রান্ত, মহাকাব্য সে তো পৌরাণিক বিষয় ধারন করে বেড়ে ওঠে স্বচ্ছন্দে । উত্তরাধুনিক চাতনা ধারণ করে মলয় কবিতা বলতে বোঝেন সামগ্রিক জীবন, যা উপন্যাসে সম্ভব । কিন্তু তিনি কবি বলে সেটা তাঁর পথ নয় । আর কবিতা বলেই ‘জখম’ এর বয়ান ভিন্ন ।
মলয় কি সময়ের জখম ?
সময় ও জীবনের ব্যর্থতার চিত্রায়ণ দিয়ে দীর্ঘ পরিভ্রমণ করেও ‘জখম’ নেতির দীর্ঘশ্বাস মাত্র নয়, নেতিবাচক আধুনিক হতাশার বয়ান মাত্র নয় । ‘জখম’-এ মলয় রায়চৌধুরীর ব্যক্তিগত অনুভব বৃহৎ জীবনের সঙ্গে একাকার হয়ে সমকালকে ধারন করে মহাকালের যাত্রী মানুষের অন্বিষ্ট ও গন্তব্যের দিকে ছুঁড়ে দেয় । কিন্তু কোনো উত্তর দেয় না । উত্তরআধুনিক চাতনার এটিই প্রতিপাদ্য । ‘জখম’ যন্ত্রণা মলয়কে পলায়নপর করে না; অনবরত রক্ত ঝরলেও সুস্হতাই কবির আকাঙ্খা । মলয় রায়চৌধুরী বদলে দিতে চান সময় ও সমাজ । একই সাথে আমরা দেখি কবিতার কাঠামোও বদল করেন তিনি সচেতন প্রয়াসে । তিনি বন্ধ্যা সময়, নষ্ট সমাজ, আক্রান্ত মানুষের আর কবিতার পরিত্রাণ চান । মলয় সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দেন — ‘আমার ভালো লাগছে না এইসব’ । তিনি উইলিয়াম ব্লেক, হউইটম্যান এবং জীবনানন্দের কাছে প্রশান্তি খুঁজে পাননি । তিনি সমস্ত ‘কৃতিপুরুষদের এড়িয়ে’ চলে আসেন এবং ২৫ বছর পর আধঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে কানের তুলো ঝেড়ে ফেলে ঘোষণা করেন–‘আমি কর্তৃত্বাভিমানকে লাথি মেরে চলে এলুম নিজের যন্ত্রণার কাছে’। ‘আসল সঙ্গীত শোনার জন্য/জেলের দেয়ালের ইঁট এনে তার ওপর কান পেতে শুলুম’ । মলয় নিজের ভূমিকার কথাও রাখঢাক ছাড়াই উচ্চরণ করেন– ‘এখন আমি এক এক কোরে ওড়াচ্ছি আমার রক্তমাখা চোখ’ । যদিও তিনি অনুভব করেন — ‘গাছের গায়ের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে খিল দেরাজ ফাঁসিকাঠ’। তিনি মানুষের ভুল বিভাজন অস্বীকার করেন । তাই লিখতে পারেন — ‘বাংলাদেশকে চিরে দেয়া লাইনটাকে তুলে/হিংস্র তেল চুকচুকে চাবুক কোরে নিয়েছি আজ’ । তাঁর ক্রোধ জখম-যন্ত্রণার কারণে চাপা থাকেনি । তাঁর চোখের সামরিক রক্তে ক্রোধ জমেছে ‘ধিকিয়ে ধিকিয়ে’। ‘ভারতবর্ষের ১০৮ দিকে নিস্তারহীন নজর’ তাঁর । ‘জখম’-এর প্রতিরোধে আমাদের ভূমিকাকে প্রশ্নের সন্মুখীন করে দিয়ে তার অবস্হান তুলে ধরেন সমস্ত কিছুর সঙ্গে মোকাবিলা করার জন্য, ‘আমার চোখমুখ থমথম কোর্ছে এখন।’
( ১৯৯৫ সালে যশোরের একটি পত্রিকায় প্রকাশিত হবার পর এই প্রবন্ধটি বহুবার দুই বাংলার লিটল ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে । আমাদের জ্ঞাতসারে শেষবার পুনর্মুদ্রিত হয়েছে কলকাতা থেকে প্রকাশিত প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘চন্দ্রগ্রহণ’ পত্রিকার মার্চ-এপ্রিল ২০১৪ সংখ্যায় । )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন