মঙ্গলবার

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা "জখম" : আলোচনা করেছেন জাহিদ সোহাগ

জাহিদ সোহাগ : জখমের উৎসমুখ নিয়ে কিছু কথা

এখন অনেকেই বলে থাকেন গিন্সবার্গের বিট কিংবা পশ্চিমবঙ্গের হাংরি জেনারেশন আন্দোলন বাংলা সাহিত্যে স্হায়ী কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি । এই কথাগুলো কালেভদ্রে তাদের মুখ থেকেও শুনেছি, যাদেরকে এর বুদবুদ জলের উপরিতলে ভাসিয়ে রেখেছে, পরবর্তীতে যারা নিজেদের হাড়ি-পাতিল গুছিয়েও চলে গেছেন মিডিয়ার উনুনে রান্নাটা চাপিয়ে দিতে । এই আপোসকামীতা খ্যাতি এনে দেয় বটে, দেশ-আনন্দ-দেজ’র কল্যাণে সরস্বতী আর লক্ষ্মী সে সুরের ব্যঞ্জন তৈরি করে তা রুগ্নরুচির-রসনালালিত কিনা তা ভেবে দেখার সময় তাদের মেলেনি । কিন্তু আমাদের ঢের সময় মিলেছে হাংরি শিল্পপ্রকরণের নতুনত্ব বা অভিনবত্ব এবং চৈতন্য — এসবের প্রভাব বাংলা কবিতার ধ্যান-ধারণাকে কিভাবে পাল্টে দিয়েছে তা উপলবদ্ধি করতে ।

দীর্ঘ দিনের চর্বিতচর্বণমার্কা বাংলা কবিতাকে মুক্তি দিয়েছে হাংরি । একথা কেউ স্বীকার করুক বা নাই করুক ধীরে ধীরে তা পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে তরুণ লেখকরা বুঝতে পারছে — এর পেছনে মলয় রায়চৌধুরীর পেরেকটাই হয়ত বেশি করে ঠুকে দিয়েছে রদ্দি মালের কফিনটাকে । এটা ভাবার কারণ নেই যে, এই হাংরি চৈতন্য আকাশ থেকে আমদানি হয়েছে — এর পেছনে কাজ করেছে ষাটের দশকের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনের ভাগাভাগি এবং মতাদর্শের নামে বিকট হা-ভাতে রূপ । এর নজির মিলবে মলয়ের ‘আত্মধ্বংসের সহস্রাব্দ’ কাব্যগ্রন্হের ‘হাংরি’ কবিতায় : ‘মানুষকে বারণ করা যাবে না বোঝানো যাবে না/কেননা ঈশ্বর শেষ আদর্শ শেষ/ দর্শন শেষ মানবতা শেষ প্রেম শেষ ।’ ব্যাপারটা এখানে ঈশ্বরের অনিবার্যতা দিয়ে নয় । কারণ ঈশ্বরবিশ্বাস নয়, পলিটিকাল-জুজু — যা চিরকালই ছিল । কিন্তু উপলব্ধিটা মানুষ করতে পারছে স্বার্থের উদর পূর্ণ করতে গিয়ে — এই উন্মোচনের কাজটা যে সমাজতান্ত্রিক দুনিয়া করেছিল, তারাও ক্ষমতায় আদা ও কাচকলা মেশালো । মানুষকে বাঁচতে হলে কোনো না কোনো এথিকাল জায়গায় তার ঠাঁই নিতে হয়, আধুনিক মানুষকে অন্তত বিজ্ঞানেও — কিন্তু বিজ্ঞান হয়ে উঠেছে সাম্রাজ্যবাদীদের নব্যধর্ম । এই নৈরাজ্যিক জায়গাই হলো পরিবর্তিত সময় । যেখানে এক দগদগে বিষফোড়া — মলয়ের ‘জখম’ ।

‘মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গে দু-একটি কথা’ গদ্যে উৎপলকুমার বসু লিখেছেন, “বাংলা আধুনিক কবিতার প্রসঙ্গটি নিয়ে যদি ভাবা যায়, তবে দেখব, জীবনানন্দই সেই অঞ্চলের প্রধান পুরুষ । তাকে পিছনে ফেলে এগিয়ে না গেলে পরবর্তী একটা নতুন যুগের পত্তন হওয়া সম্ভব ছিল না । মলয় রায়চৌধুরী ও তার প্রজন্মের লেখকরা ওই পাঠশালাতেই হাতেখড়ি হয়েছিল ।..বাংলা সাহিত্যের প্রধান ধারাটি একপ্রকার স্হিতাবস্হায় পৌঁছে গিয়েছিল । তার বাঁধ ভেঙে দেয়া ছাড়া উপায় ছিল না ।” এই মূল্যায়নে যে বিষয়টি সামনে এসেছে তা হল জীবনানন্দের প্রভাব — বাংলা ভাষার কবিদের পক্ষে আধুনিক কবিতা লেখা একপ্রকার অসম্ভব হয়ে পড়েছিল । চল্লিশ পঞ্চাশ দশকে অনেকে এর সংক্রমণ বুঝতে পেরে বহু নিরীক্ষা চালিয়েছেন — তার মধ্যে একটি সুকান্ত-সুভাষীয় ধারা এবং দ্বিতীয়টি, শক্তি-সুনীল-বিনয়-রাহমান-মাহমুদীয় ধারা । কিন্তু ভাবতে ভালো লাগবে না যে এঁরা জীবনানন্দের উত্তরপুরুষ । এরা একটা সময় প্রতিনিধিত্ব করেছেন মাত্র, কিংবা কেউ কেউ জাতীয়তাবাদী প্রয়োজন মিটিয়ে চলেছেন — কিন্তু এরা স্বয়ম্ভু হয়ে উঠতে পারেন নাই ।

জীবনানন্দ-অভিজ্ঞতা পাঠকের রয়েছে । ফলে একটা স্হিতাবস্হা তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক । কিন্তু ষাটের দশকে একটা উন্মাতাল ঢেউ খেলে গেছে এই হাংরি জেনারেশনদের হাতে । তারা ভালো লিখেছেন কি মন্দ লিখেছেন সেই বিবেচনা আমার নয় — আমি বলতে চাই তাদের শিল্পপ্রকরণ ও চৈতন্যে এক নতুনত্ব এসেছিল । তারা কবিতাকে বাঙালি ঐতিহ্যের নামে বৈষ্ণবীয় ভাবালুতা আর কথিত আদর্শ বা জাতীয়তার ঠুনকো ফানুসে নিজেদের মুক্তু খুঁজে পেতে দেননি । মলয় রায়চৌধুরীর ‘জখম’ এরই একটি আইকন খাড়া করেছেন ।

২.
১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশিত এই দীর্ঘ কবিতার ক্ষিণাঙ্গী পুস্তিকাটির একটি সংস্করণ যখন হাতে পাই তখন আমি ‘আর্তনাদও এক বায়বিক ঘোড়া’র ইমেজিক নোট দিয়ে ডায়েরি প্রায় ভরে তুলেছি । এলিয়ট ও গিন্সবার্গের কবিতা পড়ে দীর্ঘস্বর ধরে রাখার কলাকৌশলও মোটামুটি রপ্ত ।

‘জখম’ এর রগরগে সোনালি ক্লেদ আমাকে মুগ্ধ করে ।

( তুহিন দাস সম্পাদিত ‘ক্যাম্পে’ পত্রিকার বিশেষ ‘জখম’ সংখ্যায় প্রকাশিত । আগস্ট ২০১৩ । জীবনানন্দ সড়ক, বরিশাল )

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন