২২শে শ্রাবন: সিনেমায় হাংরি আন্দোলন
গত
শতকে ষাটের দশকে বেশ কিছু তরুন কবি মিলে ভিন্ন ধরনের কবিতা লেখা শুরু
করেন। তাদের কবিতাগুলো প্রচলিত ধারার যেকোন কবিতার থেকে ভিন্ন ছিল। তাদের
কবিতায় শব্দ চয়ন আপাতদৃষ্টিতে অসঙলগ্ন ছিল। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে
এই কবিতায় কোন ছন্দ ছিল না, এক শব্দের সাথে অন্য শব্দের স্থাপনে কোন মিল
ছিল না, যৌনতার ব্যাপক প্রয়োগ ছিল ছন্দে-শব্দে-ভাবে। সাধারণত
শিল্প-সাহিত্যে কোন আন্দোলন সংজ্ঞায়িত করেন সমালোচকরা, কখনো কখনো
শিল্পী-সাহিত্যিকরাও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন। হাংরি আন্দোলনে জড়িত কবিরা
নিজেরাই এই আন্দোলনকে ‘হাংরি আন্দোলন‘
হিসেবে পরিচিতি দেন। এই আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যে একমাত্র আন্দোলন যা
ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হয়েছে। ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি
সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে হাংরি শব্দটি চয়নের মাধ্যমে তারা
নিজেদেরকে হাংরিয়ালিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা পাটনা থেকে বাংলা
প্রেসের অভাবে ইংরেজিতে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতো – যেখানে তাদের কবিতা,
গল্প, চিত্র ইত্যাদি প্রকাশ করা হত। হাংরি আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন
তাদের মধ্যে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৬১ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সালেই শেষ হয়ে
যায়।
হাংরি আন্দোলনের স্বরূপ বোঝার জন্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতটি পড়া যেতে পারে। এই কবিতাটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল নিম্ন আদালতে যা পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। হাংরিয়ালিস্টদের কবিতা এই অশ্লীলতার অভিযোগে এত মাত্রায় অভিযুক্ত ছিল যে প্রকাশকরা তাদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী ছিলেন না। এই অশ্লীলতা প্রশাসনকে বাধ্য করেছে কবিদের কোমরে দড়ি বাধঁতে, আদালতে মামলা ঠুকতে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতা-সংক্রান্ত হাংরি মামলায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী ছিলেন, নিম্ন আদালতে অন্যান্য সাক্ষীদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। সুনীল পরবর্তীতে এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। হাংরি আন্দোলন যতটা না বিখ্যাত তারচে’ বেশী কুখ্যাত হয়ে আছে এই অশ্লীলতার জন্য। বলা হয়, অশ্লীলতা থেকে উদ্ভুত মামলা মোকদ্দমাই এই আন্দোলনকে পরিচিত করেছে, অন্যথায় এই আন্দোলন বা কবিতাসমূহ স্মরনীয় হয়ে থাকার মত কিছু ছিল না।
ষাটের দশকে ঘটে যাওয়া এই হাংরি আন্দোলন সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা ‘২২শে শ্রাবন’ সিনেমায় স্থান পেলেও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ষাটের দশক নয়, বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীই ফুটে উঠেছে সিনেমায়। হাংরি আন্দোলন সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি বর্তমান সময়েও হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনার রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত কোন এক বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে। অবশ্য এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে।
সাইকোলজিক্যাল-ক্রাইম থ্রিলার এই সিনেমা কোলকাতা শহরে একের পর এক ঘটে যাওয়া নির্ভুল ছাপহীন নির্মম হত্যাকান্ড, খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বানিজ্যিক প্রয়োজনে ত্রিভুজ প্রেম, যৌনতার সুরসুরি আর মদ-বিড়ি-অশ্লীল খিস্তিখেউরের এক অপূর্ব সমন্বয়। অথচ যে গল্পকে ঘিরে সিনেমা সেই গল্পে ফাক ফোকর দিয়ে হাওয়া যাতায়াত করে। প্রবীর রায় চৌধুরী নামের বরখাস্ত হওয়া রগচটা কিন্তু মেধাবী পুলিশ অফিসারের সহযোগী হয়ে আরেক রগচটা পুলিশ অভিজিত পাকরাশী খুনির পেছনে তাড়া করলেও তাদের চরিত্র কতটুকু যৌক্তিক ছিল সে ব্যাপারে প্রশ্ন জাগে। এর পাশাপাশি আছে চিত্রনাট্যের বাহুল্য। প্রবীর রায় চৌধুরীর জীবনে স্ত্রী-পুত্র হারানোর বেদনা থাকলেও সেই বেদনার প্রভাব তার কর্মে পড়ে না – সেক্ষেত্রে এই বেদনার গল্প কি রগচটা পুলিশের প্রতি সহানুভূতি তৈরীর কৌশল? ক্রাইম থ্রিলারে টিভি চ্যানেলের নারী কর্মী থাকতেই পারে কিন্তু তার হাত ধরে ত্রিভুজ প্রেমের উপস্থাপন সিনেমার গতিকে রুদ্ধ করেছে, রাস্তা থেকে নামিয়ে ধানক্ষেতে নিয়ে গেছে। ফলে ক্রাইম থ্রিলার পাল্টে গিয়ে হয়েছে টক-মিষ্টি প্রেমের ছবি। ওদিকে খুনী তখন পরবর্তী খুনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিভিন্ন বিখ্যাত কবিতার যথাযথ এবং সুন্দর প্রয়োগ, বিশেষত প্রতিটি হত্যাকান্ডের সাথে চিরকুটে একটি কবিতা, সিনেমায় ভিন্ন স্বাদ এনে দিয়েছে। কিন্তু এই কবিতার সাথে হাংরি আন্দোলনকে যুক্ত করার যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া ভার। মানসিকভাবে অসুস্থ্য হাংরিয়ালিস্ট কবি স্থলে মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হতাশাগ্রস্থ কোন কবির কাজে কোন পার্থক্য খুজে পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন শুধুমাত্র সিনেমার অলঙ্কার, অন্য কথায়, বাহুল্য।
সৃজিতের প্রথম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’র মত এখানেও অন্যতম চরিত্র পুলিশ অফিসার অভিজিত তার বান্ধবীর সাথে লিভ টুগেদার করেন। প্রেম বা বিয়েকে এড়িয়ে লিভ টুগেদার কি কোলকাতার স্বাভাবিক চিত্রকে তুলে ধরা না লিভ টুগেদারকে প্রমোট করা সেটা বোঝা গেল না। একইভাবে প্রশ্ন তোলে মাত্রাহীন গালিগালাজ। অপ্রয়োজনীয় নোংরা এই খিস্তিখেউরের যৌক্তিকতা শুধু একজায়গাতেই – বোধহয় পরিচালক সৃজিত নিজেও একজন হাংরি আন্দোলনের সমর্থক। প্লটে আরেকটি বিশাল গর্ত খুজে পাওয়া যায় সিনেমার শেষপ্রান্তে, যেখানে একটি টুইস্ট সিনেমার মুখ পরিবর্তন করেছে, দর্শকপ্রিয় করেছে। মাইকেল মধূসুদন দত্তের মৃত্যুদিবসে খুনীর মৃত্যুর পরেই কাহিনীর সমাপ্তি হওয়া স্বাভাবিক। সিরিয়াল কিলিঙ সমস্যার সফল সমাধানে আবার পুলিশ বাহিনীতে মর্যাদার সাথে প্রবীর রায় চৌধুরী আসীন হওয়ায় গল্প শেষ হতে পারতো, কিন্তু শেষ না হওয়ায় বোঝা গেল – গল্পের শেষ বাকী। কিন্তু এই শেষের জন্য দর্শক প্রস্তুত ছিল কি? সিনেমার পুরোটায় কোন ক্লু ছিল না, আনসলভড কোন প্রশ্ন ছিল না – অথচ সিনেমার শেষপ্রান্তে এসে খুনী নিজেই উদ্যোগী হয়ে জানালেন – আজ ২২শে শ্রাবন, সুতরাং আজ আরও একটি হত্যাকান্ড ঘটবে। ফলে এই হত্যাকান্ডের বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া, দর্শকের উপর বোঝা। যদি এমনটি হত যে খুনী ধরা পরার পরও হত্যাকান্ড ঘটে চলছে – সেক্ষেত্রে দর্শকও জানতো, রহস্যের আপাত সমাপ্তি আসলে নতুন রহস্যের শুরু। চিত্রনাট্যকার হিসেবে সৃজিত মুখার্জি তাই এখানে দুর্বল।
সিনেমায় ভালো লাগবে এর সিনেমাটোগ্রাফি। মোহনীয় লাইটিঙ করেছেন সৌমিক হালদার। বিশেষত প্রবীর রায় চৌধুরীর প্রথম উপস্থিতিতে মুখের একদিকে আলো অন্যদিকে শুধু চোখটিকে গাঢ় অন্ধকারে রাখার ফলে যে ভৌতিকতা তৈরী হয়েছে সেটা উপভোগ্য। ভালো লাগবে ছবির গানগুলোকেও। কিন্তু গানের সাথে এর দৃশ্যায়নের সামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর খুজে পাওয়া দুস্কর হবে। অন্যান্য বানিজ্যিক সিনেমার মতো এখানেও নারী শরীর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অভিনয়ের প্রসঙ্গে অভিজিত চরিত্রে পরমব্রত চ্যাটার্জী বেশ ভালো অভিনয় করেছেন, যদিও তার রগচটা আচরন কোথাও কোথাও ভিত্তিহীন – তবে এজন্য তাকে দোষ দেয়া যায় না, পরিচালকই এর দায় নিবেন। অটোগ্রাফ সিনেমার দুর্দান্ত অভিনেতা প্রসেনজিত রগচটা কখনো কখনো সীমালঙ্ঘনকারী পুলিশ অফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, প্রসেনজিতের এই রগচটা চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় অন্যান্য চরিত্রের কথায়, বরং সারাদিন মদে ডুবে থাকা একজন মদখোর হিসেবে তার ভূমিকা বরং অনেক স্পষ্ট। সিনেমার প্রথম অর্ধেকে প্রসেনজিত যতটা গম্ভীর এবং কঠিন, শেষ অর্ধেকে ঠিক ততটাই কোমল এবং মিশুক। ফলে, তার চরিত্রত্রে অতি অভিনয় প্রকট। অমৃতা চরিত্রে রাইমা সেন অভিনয় করলেও তার উপস্থিতি যতটা না কাহিনীর প্রয়োজনে তারচে বেশী শরীরের প্রয়োজনে বলেই মনে হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর চোখের অধিকারী এই নারী কেন শুধু তার শরীর দেখিয়ে দর্শক টানার চেষ্টা করেন সে আমার বোধগম্য নয়।
সিনেমার খুবই উল্লেখযোগ্য অস্তিবাচক দিক হল কবি-চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের উপস্থিতি। দীর্ঘ ২৯ বছর পর তিনি ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী চরিত্রে। সত্যিকারের অভিনয় পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। গুনী এই ব্যক্তি প্রয়োজনে আবারও সামনে দাড়াবেন, সিনেমার চরিত্রকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে তুলে ধরবেন এই প্রত্যাশা করা যায়।
সব মিলিয়ে সৃজিতের পারফর্ম্যান্স কেমন ২২শে শ্রাবন সিনেমায়? ভালো না। অন্তত: অটোগ্রাফ সিনেমার ফলে যে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল, তা পূরণ করতে পারেন নি তিনি। অটোগ্রাফ সিনেমার নায়কের মতই তিনি সিনেমার বাজারে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছেন সত্যি, কিন্তু দর্শকের মনে স্থান করে নিতে প্রয়োজনে আরও সময় ব্যয় করতে হবে তাকে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিভিউতে দশে সাড়ে আট দেখে খুশী হওয়ার আগে তাকে বুঝতে হবে – আনন্দবাজার এই সিনেমার মিডিয়া পার্টনার, অর্থাৎ দশে সাড়ে আট তার যোগ্যতার বিচারে নয় বরং সিনেমার কাটতি বাড়ানোর পদ্ধতি।
হাংরি আন্দোলনের স্বরূপ বোঝার জন্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতটি পড়া যেতে পারে। এই কবিতাটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল নিম্ন আদালতে যা পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। হাংরিয়ালিস্টদের কবিতা এই অশ্লীলতার অভিযোগে এত মাত্রায় অভিযুক্ত ছিল যে প্রকাশকরা তাদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী ছিলেন না। এই অশ্লীলতা প্রশাসনকে বাধ্য করেছে কবিদের কোমরে দড়ি বাধঁতে, আদালতে মামলা ঠুকতে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতা-সংক্রান্ত হাংরি মামলায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী ছিলেন, নিম্ন আদালতে অন্যান্য সাক্ষীদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। সুনীল পরবর্তীতে এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। হাংরি আন্দোলন যতটা না বিখ্যাত তারচে’ বেশী কুখ্যাত হয়ে আছে এই অশ্লীলতার জন্য। বলা হয়, অশ্লীলতা থেকে উদ্ভুত মামলা মোকদ্দমাই এই আন্দোলনকে পরিচিত করেছে, অন্যথায় এই আন্দোলন বা কবিতাসমূহ স্মরনীয় হয়ে থাকার মত কিছু ছিল না।
ষাটের দশকে ঘটে যাওয়া এই হাংরি আন্দোলন সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা ‘২২শে শ্রাবন’ সিনেমায় স্থান পেলেও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ষাটের দশক নয়, বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীই ফুটে উঠেছে সিনেমায়। হাংরি আন্দোলন সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি বর্তমান সময়েও হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনার রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত কোন এক বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে। অবশ্য এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে।
সাইকোলজিক্যাল-ক্রাইম থ্রিলার এই সিনেমা কোলকাতা শহরে একের পর এক ঘটে যাওয়া নির্ভুল ছাপহীন নির্মম হত্যাকান্ড, খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বানিজ্যিক প্রয়োজনে ত্রিভুজ প্রেম, যৌনতার সুরসুরি আর মদ-বিড়ি-অশ্লীল খিস্তিখেউরের এক অপূর্ব সমন্বয়। অথচ যে গল্পকে ঘিরে সিনেমা সেই গল্পে ফাক ফোকর দিয়ে হাওয়া যাতায়াত করে। প্রবীর রায় চৌধুরী নামের বরখাস্ত হওয়া রগচটা কিন্তু মেধাবী পুলিশ অফিসারের সহযোগী হয়ে আরেক রগচটা পুলিশ অভিজিত পাকরাশী খুনির পেছনে তাড়া করলেও তাদের চরিত্র কতটুকু যৌক্তিক ছিল সে ব্যাপারে প্রশ্ন জাগে। এর পাশাপাশি আছে চিত্রনাট্যের বাহুল্য। প্রবীর রায় চৌধুরীর জীবনে স্ত্রী-পুত্র হারানোর বেদনা থাকলেও সেই বেদনার প্রভাব তার কর্মে পড়ে না – সেক্ষেত্রে এই বেদনার গল্প কি রগচটা পুলিশের প্রতি সহানুভূতি তৈরীর কৌশল? ক্রাইম থ্রিলারে টিভি চ্যানেলের নারী কর্মী থাকতেই পারে কিন্তু তার হাত ধরে ত্রিভুজ প্রেমের উপস্থাপন সিনেমার গতিকে রুদ্ধ করেছে, রাস্তা থেকে নামিয়ে ধানক্ষেতে নিয়ে গেছে। ফলে ক্রাইম থ্রিলার পাল্টে গিয়ে হয়েছে টক-মিষ্টি প্রেমের ছবি। ওদিকে খুনী তখন পরবর্তী খুনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। বিভিন্ন বিখ্যাত কবিতার যথাযথ এবং সুন্দর প্রয়োগ, বিশেষত প্রতিটি হত্যাকান্ডের সাথে চিরকুটে একটি কবিতা, সিনেমায় ভিন্ন স্বাদ এনে দিয়েছে। কিন্তু এই কবিতার সাথে হাংরি আন্দোলনকে যুক্ত করার যৌক্তিকতা খুজে পাওয়া ভার। মানসিকভাবে অসুস্থ্য হাংরিয়ালিস্ট কবি স্থলে মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হতাশাগ্রস্থ কোন কবির কাজে কোন পার্থক্য খুজে পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন শুধুমাত্র সিনেমার অলঙ্কার, অন্য কথায়, বাহুল্য।
সৃজিতের প্রথম সিনেমা ‘অটোগ্রাফ’র মত এখানেও অন্যতম চরিত্র পুলিশ অফিসার অভিজিত তার বান্ধবীর সাথে লিভ টুগেদার করেন। প্রেম বা বিয়েকে এড়িয়ে লিভ টুগেদার কি কোলকাতার স্বাভাবিক চিত্রকে তুলে ধরা না লিভ টুগেদারকে প্রমোট করা সেটা বোঝা গেল না। একইভাবে প্রশ্ন তোলে মাত্রাহীন গালিগালাজ। অপ্রয়োজনীয় নোংরা এই খিস্তিখেউরের যৌক্তিকতা শুধু একজায়গাতেই – বোধহয় পরিচালক সৃজিত নিজেও একজন হাংরি আন্দোলনের সমর্থক। প্লটে আরেকটি বিশাল গর্ত খুজে পাওয়া যায় সিনেমার শেষপ্রান্তে, যেখানে একটি টুইস্ট সিনেমার মুখ পরিবর্তন করেছে, দর্শকপ্রিয় করেছে। মাইকেল মধূসুদন দত্তের মৃত্যুদিবসে খুনীর মৃত্যুর পরেই কাহিনীর সমাপ্তি হওয়া স্বাভাবিক। সিরিয়াল কিলিঙ সমস্যার সফল সমাধানে আবার পুলিশ বাহিনীতে মর্যাদার সাথে প্রবীর রায় চৌধুরী আসীন হওয়ায় গল্প শেষ হতে পারতো, কিন্তু শেষ না হওয়ায় বোঝা গেল – গল্পের শেষ বাকী। কিন্তু এই শেষের জন্য দর্শক প্রস্তুত ছিল কি? সিনেমার পুরোটায় কোন ক্লু ছিল না, আনসলভড কোন প্রশ্ন ছিল না – অথচ সিনেমার শেষপ্রান্তে এসে খুনী নিজেই উদ্যোগী হয়ে জানালেন – আজ ২২শে শ্রাবন, সুতরাং আজ আরও একটি হত্যাকান্ড ঘটবে। ফলে এই হত্যাকান্ডের বিষয়টি চাপিয়ে দেয়া, দর্শকের উপর বোঝা। যদি এমনটি হত যে খুনী ধরা পরার পরও হত্যাকান্ড ঘটে চলছে – সেক্ষেত্রে দর্শকও জানতো, রহস্যের আপাত সমাপ্তি আসলে নতুন রহস্যের শুরু। চিত্রনাট্যকার হিসেবে সৃজিত মুখার্জি তাই এখানে দুর্বল।
সিনেমায় ভালো লাগবে এর সিনেমাটোগ্রাফি। মোহনীয় লাইটিঙ করেছেন সৌমিক হালদার। বিশেষত প্রবীর রায় চৌধুরীর প্রথম উপস্থিতিতে মুখের একদিকে আলো অন্যদিকে শুধু চোখটিকে গাঢ় অন্ধকারে রাখার ফলে যে ভৌতিকতা তৈরী হয়েছে সেটা উপভোগ্য। ভালো লাগবে ছবির গানগুলোকেও। কিন্তু গানের সাথে এর দৃশ্যায়নের সামঞ্জস্যতা নিয়ে প্রশ্ন করলে উত্তর খুজে পাওয়া দুস্কর হবে। অন্যান্য বানিজ্যিক সিনেমার মতো এখানেও নারী শরীর গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। অভিনয়ের প্রসঙ্গে অভিজিত চরিত্রে পরমব্রত চ্যাটার্জী বেশ ভালো অভিনয় করেছেন, যদিও তার রগচটা আচরন কোথাও কোথাও ভিত্তিহীন – তবে এজন্য তাকে দোষ দেয়া যায় না, পরিচালকই এর দায় নিবেন। অটোগ্রাফ সিনেমার দুর্দান্ত অভিনেতা প্রসেনজিত রগচটা কখনো কখনো সীমালঙ্ঘনকারী পুলিশ অফিসার প্রবীর রায় চৌধুরী চরিত্রে রূপ দিয়েছেন। মজার ব্যাপার হল, প্রসেনজিতের এই রগচটা চরিত্রের পরিচয় পাওয়া যায় অন্যান্য চরিত্রের কথায়, বরং সারাদিন মদে ডুবে থাকা একজন মদখোর হিসেবে তার ভূমিকা বরং অনেক স্পষ্ট। সিনেমার প্রথম অর্ধেকে প্রসেনজিত যতটা গম্ভীর এবং কঠিন, শেষ অর্ধেকে ঠিক ততটাই কোমল এবং মিশুক। ফলে, তার চরিত্রত্রে অতি অভিনয় প্রকট। অমৃতা চরিত্রে রাইমা সেন অভিনয় করলেও তার উপস্থিতি যতটা না কাহিনীর প্রয়োজনে তারচে বেশী শরীরের প্রয়োজনে বলেই মনে হয়েছে। অপূর্ব সুন্দর চোখের অধিকারী এই নারী কেন শুধু তার শরীর দেখিয়ে দর্শক টানার চেষ্টা করেন সে আমার বোধগম্য নয়।
সিনেমার খুবই উল্লেখযোগ্য অস্তিবাচক দিক হল কবি-চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের উপস্থিতি। দীর্ঘ ২৯ বছর পর তিনি ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী চরিত্রে। সত্যিকারের অভিনয় পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। গুনী এই ব্যক্তি প্রয়োজনে আবারও সামনে দাড়াবেন, সিনেমার চরিত্রকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে তুলে ধরবেন এই প্রত্যাশা করা যায়।
সব মিলিয়ে সৃজিতের পারফর্ম্যান্স কেমন ২২শে শ্রাবন সিনেমায়? ভালো না। অন্তত: অটোগ্রাফ সিনেমার ফলে যে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল, তা পূরণ করতে পারেন নি তিনি। অটোগ্রাফ সিনেমার নায়কের মতই তিনি সিনেমার বাজারে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছেন সত্যি, কিন্তু দর্শকের মনে স্থান করে নিতে প্রয়োজনে আরও সময় ব্যয় করতে হবে তাকে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিভিউতে দশে সাড়ে আট দেখে খুশী হওয়ার আগে তাকে বুঝতে হবে – আনন্দবাজার এই সিনেমার মিডিয়া পার্টনার, অর্থাৎ দশে সাড়ে আট তার যোগ্যতার বিচারে নয় বরং সিনেমার কাটতি বাড়ানোর পদ্ধতি।
প্রসেঞ্জিত আর গৌতম ঘোষ এর অভিনয় খুবই ভালো হয়েছে… কিন্তু শেষের দিকে প্রবীর রায়চৌধুরীর কোমলতা আমারো আজব লেগেছে। আর খুন টা হওয়ার পর মিস্ট্রি টা সল্ভ কেন করা গেল না আমার কাছে বোধগম্য না। ত্রিভুজ প্রেম টা কলকাতার ভাষায় পুরোই “বাকওয়াস” ছিল। :S
তবে একদম লাস্ট সিন টা আমার কাছে বেশ ভালো লেগেছে। আর কবিতা গুলো চমৎকার।
ছবিটা থ্রিলার তাতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু একটা ভালো সিনেমা তখনই ভালো সিনেমা হয় যখন তার গল্পটা সুগঠিত হয় – অন্তত: সিনেমা নিয়ে কিঞ্চিত পড়াশোনায় তাই বুঝেছি। হাঙরিয়ালিস্ট মুভমেন্ট এই সিনেমার টপিক নয় জানি, কিন্তু ফেলনাও নয়। কারণ কাহিনীর অন্যতম চরিত্র গৌতম ঘোষের চরিত্র নির্মানের পেছনে কিন্তু হাংরিয়ালিস্ট মুভমেন্টই বড় কারণ। কিন্তু সেভাবে ফুটল কই?
শেষ দৃশ্যটা তো সিনেমার অযৌক্তিক পার্ট মনে হয়েছে। সিনেমা যদি গৌতম ঘোষের মৃত্যুর সাথে সাথেই শেষ হয়ে যেত তবে দর্শকের কোন আফসোস থাকতো না বলেই মনে হয়। বাকী অংশটুকু জোর করে থ্রিলার তৈরীর চেষ্টা।
তবে আপনার মন্তব্য খুবই গুরুত্বপূর্ন। সিনেমা নির্মাতারা দর্শকের জন্য সিনেমা বানান, সমালোচকের জন্য নন। দর্শকের চোখ এড়িয়ে যদি সিনেমায় গরুকে গাছে তুলতে পারেন – তবে তাই সিনেমা। সেখানেই সিনেমার এবং সিনেমা নির্মাতার সাফল্য।
আপনার মন্তব্য আমার কাছে সবসময়ই গুরুত্বপূর্ন।ভালো থাকুন সুমন
আমি জানি না আপনি কার কথা বলেছেন যিনি দেশাত্মবোধ থেকে শাকিব খানের টাইপ সিনেমার ভালো রিভিউ লিখে, কিন্তু এই সিনেমাকে ‘লাইক’ করে না – বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমা নিয়ে আমার দুটো রিভিউ আছে, তাই আমার পজিশন ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন বোধ করছি।
আমি বাংলাদেশের সিনেমা দেখার সময় ‘বাংলাদেশীদের নির্মিত সিনেমা’ দেখছি এমন একটা চিন্তা নিয়েই দেখতে বসি। আবার হলিউডের একটা সিনেমা দেখার সময় হলিউড/ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে প্রথম শ্রেনীর কারও সিনেমা দেখছি সেরকম প্রস্তুতি থাকে। কোলকাতার সিনেমার ক্ষেত্রেও এই একই রকম চিন্তা থাকে।
বাংলাদেশী কোন সিনেমাকে সাম্প্রতিক সময়ের কোলকাতা বা হলিউড/ইউরোপিয়ান সিনেমার সাথে তুলনা করা বোকামী। একই ভাবে কোলকাতার সিনেমার জন্যও প্রযোজ্য। কিন্তু কোলকাতার সিনেমা ক্রমাগত উন্নতি করছে এবং এই সিনেমাটা সম্পর্কে বাংলাদেশী দর্শকদের মধ্যে অনেক প্রশংসামূলক বাক্য আমি দেখেছি। সিনেমাটা উপভোগ্য, কিন্তু বিশ্লেষন করতে গেলে এই সিনেমার ত্রুটিগুলো বের হয়ে আসে – আমি সেগুলো তুলে ধরেছি। দর্শক ভালোভাবে গ্রহণ করেছে বলে সেই সিনেমার ত্রুটি নাই তা কিন্তু নয়। বিশ্ব সিনেমায় অনেক অনেক সিনেমা আছে যা দর্শকরা গ্রহন করে নাই, ভালো ব্যবসা করে নাই, কিন্তু অ্যাকাডেমিক সিনেমা হিসেবে সিনেমাগুলো কয়েকশ বছরের জন্য রেফারেল হয়ে থাকবে। আপনি যদি ‘রান্না উপাদেয় হল কিনা’ এই ভিত্তিতে বিবেচনা করেন তাহলে আপনিই সঠিক, কিন্তু আপনি যদি ‘রান্না স্বাস্থ্যসম্মত হলো কিনা’ সেই বিবেচনা করেন তবে আমার রিভিউকে সঠিক বলতে হবে। আর হ্যা, আপনি যদি স্বাস্থ্যসম্মত রান্নার চেয়ে উপাদেয় রান্নাকে পছন্দ করেন তবে এই নিয়ে তর্ক করা সম্পূর্ন বৃথা।
ভালো থাকুন জয়। আবার আসবেন।