অধুনান্তিক সাহিত্যের প্রকাশক ভিন্নচোখ প্রকাশনী ২০১৮ সালে বের করেছে পশ্চিম বাংলার হাংরি আন্দোলনের পুরোধা ও কিংবদন্তীসম আভাঁ-গার্দ লেখক মলয় রায়চৌধুরীর গ্রন্থ “স্বনির্বাচিত”। বাংলাদেশে এই প্রথম একক গ্রন্থাকারে মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা, কাব্যনাটক, অনুবাদ, প্রবন্ধ, গল্প, উপন্যাস ও আত্মজীবনী সংকলিত হলো। উল্লেখ্য, গত শতকের ষাটের দশকের প্রথমার্ধে তাঁর হাংরি আন্দোলন ভারতে ও পাশ্চাত্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করলেও, সে সম্পর্কে সমর্থক-অসমর্থক অতি অল্পসংখ্যক লেখকের বাইরে এ-দেশের ( বর্তমান বাংলাদেশ ) সাধারণ পাঠক পরিচিত ছিল না। এর আদি কারণ, ভারতের পাটনা ও কোলকাতার সাহিত্য-ভুবন যখন প্রথা ও প্রতিষ্ঠানবিরোধী হাংরি আন্দোলনে জবথবু, তখন এই বাংলার ওপর একদিকে চলছিল দ্বিজাতি-তত্ত্বের খোলসে পাকিস্তানি সংরক্ষণবাদী দুঃশাসন এবং অন্যদিকে, এখানকার সাহিত্যবলয়ে প্রথা-প্রতিষ্ঠানের দাপট। স্বভাবতই, ভারত-বিদ্বেষী এই আয়রন কার্টেনের ভেতরে হাংরির মতো বৈপ্লবিক সাহিত্য-চেতনার প্রভাব পড়েনি বা পড়তে দেওয়া হয়নি। ফলত, এটা অবাক করার মতো কিছু ছিল না, যখন সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে কোলকাতায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের বাসায় রফিক হায়দার নামে একজন বাংলাদেশি কবি মলয় রায়চৌধুরীকে জানালেন যে, তিনি কখনও হাংরি আন্দোলনের কথাই শোনেননি। এ প্রসঙ্গে মলয়বাবু তাঁর গ্রন্থটির “আত্ম-জীবনী” অংশে রসিকতা করে লিখেছেন, “ সম্ভবত তখন কলকাতা থেকে আন্দেোলন চলে গেছে উত্তরবঙ্গে আর ত্রিপুরায়”।
স্বাধীনতা-পরবর্তী কালে ভারতের সাথে বাংলাদেশের যোগাযোগের পথ খুলে গেলে এবং এ-দেশে পশ্চিম বাংলার সমকালীন সাহিত্য প্রবেশাধিকার পেলে মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি সম্পর্কে অবশ্য আরো কিছুসংখ্যক লেখক-পাঠকের জানা-বোঝার সুযোগ সৃষ্টি হয়। এ বিষয়ে অনুসন্ধিৎসুদের তৃষ্ণা নিবৃত করেছিল “মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা”— আশির দশকের মধ্য ভাগে, মলয়রায়চৌধুরীর “হাংরি কিংবদন্তী” ধারাবাহিকভাবে প্রকাশের মাধ্যমে। মলয়বাবুর আত্ম-জীবনী থেকে জানা যায়, মীজান সাহেব সেই লেখাগুলো এ-বাংলায় গ্রন্থাকারে প্রকাশের উদ্যোগ নিলে তা বন্ধ করার জন্য কলকাত্তাই এস্টাবলিসমেন্ট-এর চাঁই সুনীল গং তাঁদের এ-দেশীয় সুহৃদ কবি শামসুর রাহমানকে ব্যবহার করেন। এই পরিস্থিতিতে মীজান সাহেব তাঁর ইচ্ছের কবর দিয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশ করলেন মলয়বাবুর উপন্যাস “নামগন্ধ”। তাই মলয়বাবু লিখেছেন, “ আমাকে নিয়ে সাংস্কৃতিক রাজনীতি কেবল পশ্চিম বাংলাতেই নয়, তা বাংলাদেশ পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে”।
এ-দেশে হাংরি আন্দোলনের ভাবাদর্শসমৃদ্ধ লেখাগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে যেতে পারেননি সম্পাদক মীজানুর রহমান। তিনি আজ প্রয়াত। তিনি যা পারেননি, সেটাই প্রায় তিন দশক পর আজ এ-দেশের পাঠকের কাছে উপহার দিলেন একালের এস্টাবলিশমেন্ট-বিরোধী লেখক-প্রকাশক ও ভিন্নচোখের স্বত্বাধিকারী আলী আফজাল খান। বিভিন্ন সময়ে লেখা এ-সব রচনা মলয়বাবুর হাংরিয়ালিস্ট, জাদুবাস্তব তথা অধুনান্তিক চিন্তা-চেতনার ফসল। গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত কবিতা, কাব্যনাটক, গল্প ও উপন্যাস বিষয়ের অভিনবত্ব ও ভাষার ব্যতিক্রমিতা নিয়ে অনবদ্য সৃষ্টি। কিন্তু তাঁর দীর্ঘ রচনা ”আত্মজীবনী” থেকেই এই প্রতিষ্ঠান-বিরোধী লেখকের বেড়ে-ওঠা, হাংরি আন্দোলনের সূচনা ও বিস্তার, এর প্রভাব, বিশ্বখ্যাতি এবং প্রতিষ্ঠানপন্থী লেখকদের বিরুদ্ধ-ভূমিকা সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে জানা যাবে।
বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি-ই একমাত্র আন্দোলন, যা প্রথা, প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, প্রাতিষ্ঠানিক স্বার্থের আবর্তে ঘুরপাক-খাওয়া সাহিত্য ও সনাতন অনুশাসনের মর্মমূলে আঘাত হেনে সাহিত্যের এক নতুন ধারা প্রবর্তনে সমর্থ হয়েছিল। মলয় রায়চৌধুরী তাঁর বড় ভাই সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায় প্রমুখকে নিয়ে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন প্রকাশের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে এই আন্দোলন সূচনা করেন, যা অচিরেই কোলকাতা সহ সমগ্র পশ্চিমবাংলায় বিস্তৃত হয়। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, বিনয় মজুমদার, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, ত্রিদিব মিত্র, বাসুদেব দাশগুপ্ত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, রবীন্দ্র গুহ ও অনিল করঞ্জাই সহ প্রায় অর্ধশত তরুণ কবি, সাহিত্যিক ও শিল্পী-ও হাংরি আন্দোলনে অংশ নেন। ১০৮টি বুলেটিন প্রকাশ করে তাঁরা একদিকে যেমন উত্তরঔপনিবেশিক সাহিত্যরীতির কট্টর সমালোচনায় তার মুখোস উন্মোচন করেন, অন্যদিকে ভাষিক ও বৈষয়িক—এ উভয় ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন এনে তাঁদের প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্য তুলে ধরেন। বুলেটিনের বাইরেও তাঁরা এই বৈপ্লবিক চেতনার আশ্রয়ে লেখা প্রকাশ করেন এবং পশ্চিম বাংলার ব্যাপক পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হন। ১৯৬৪ সালে বুলেটিনে প্রকাশিত ”প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” শীর্ষক কবিতাটির জন্য মলয় রায়চৌধুরীকে অশ্লীলতার দায়ে গ্রেফতার করা করা হয়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, হাংরি আন্দোলনের সাথিদের মধ্যে শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ রাজসাক্ষী এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু প্রমুখ সরকার-পক্ষের সাক্ষী হয়ে যান। অবশ্য সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, তরুণ সান্যাল ও জ্যোতির্ময় দত্ত সহ কয়েকজন আসামি-পক্ষে সাক্ষ্য দান করেন। একটি কবিতা লেখার জন্য এমন মামলা ভূ-ভারতে আর কখনও হয়েছে বলে জানা নেই। পশ্চিম বাংলা ও ভারতের পত্র-পত্রিকায় ঘটনাটি ব্যাপক প্রচার পায়। সে-সাথে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক পত্র-পত্রিকা মলয় রায়চৌধুরী ও তাঁর হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে ব্যাপক কভারেজ দেয়। আমেরিকার ‘টাইম’ ম্যাগাজিন বিষয়টি নিয়ে মুখ্য প্রতিবেদন ও প্রচ্ছদ প্রকাশ করে। আমেরিকা সহ বিভিন্ন দেশে মলয়বাবু ও তাঁর অনুসারীদের কবিতার অনুবাদ প্রকাশ পায়। আমেরিকার বীট কবি অ্যালেন গিন্সবার্গ, মেক্সিকোর কবি ওক্তাভিও পাজ সহ অনেকে এই আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানাতে ভারতে আসেন। বলতে গেলে, পশ্চিম বাংলা ও পাশ্চাত্যের সাহিত্যাঙ্গনে একটা তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হয়। বাঙলা শিল্প-সাহিত্যের ইতিহাসে এ এক অভাবিতপূর্ব ঘটনা। মামলার রায়ে মলয়বাবুকে ২০০ টাকা জরিমানা ( সর্বোচ্চ ), অনাদায়ে এক মাসের কারাবাস— এই দণ্ড প্রদান করা হয়। কিন্তু হাইকেোর্টে আপীল করা হলে প্রায় তিন বছর পর তাঁকে বেকসুর খালাস দেওয়া হয়। তারও আগে ১৯৬৫ সালে হাংরি আন্দেোলনের কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যায়। এ হলো হাংরি আন্দেোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস। কিন্তু এ-সব নিয়েই মলয়বাবুর স্মৃতিতর্পন শেষ নয়। সাহিত্যজগতের কায়েমি স্বার্থবাদী গোষ্ঠী কীভাবে তাঁর প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন ও হাংরি সাহিত্যের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য ও গোপন চক্রান্তে সামিল হয়েছিলেন এবং তাঁদের ছত্রছায়ায় হাংরির একদল কর্মী মুচলেকা দিয়ে খালাস পেয়ে মলয়বাবুর বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন তারও বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যাবে গ্রন্থটিতে। গ্রন্থে তুলে ধরা হয়েছে আন্দোলন চলাকালে অ্যালেন গিন্সবার্গ ও বীট জেনারেশনের আরেক দিকপাল লরেন্স ফার্লিংঘেট্টি এবং মলয়বাবুর মাঝে আদান-প্রদানকৃত চিঠিগুলো এবং তৎকালীন প্রতিষ্ঠানপন্থী সাহিত্যের গুরু আবু সয়ীদ আইয়ুব কর্তৃক মলয়বাবু ও হাংরির বিরুদ্ধে গিন্সবার্গকে লেখা চিঠি এবং গিন্সবার্গ কর্তৃক প্রদত্ত এর দাঁতভাঙা জবাব সংবলিত চিঠিটাও । তাছাড়া পাটনার বস্তি এলাকায় কৈশোর ও যৌবনে মলয়বাবু যে উদ্দাম, কামনামদির ও সংস্কারমুক্ত জীবন কাটিয়েছেন তারও অকপট ও সরস বর্ণনা রয়েছে আত্ম-জীবনী অংশে। মলয়বাবু ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে বাংলাদেশের পাঠকদের জানা ও বোঝার জন্য এই লেখাটি যথেষ্ট সহায়ক হবে।
আত্ম-জীবনী ছাড়াও গ্রন্থটিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে কাব্য-নাটক “যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের” , “প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার “ সহ ২৩টি কবিতা, ”নাম নেই” নামে একটি প্লটমুক্ত উপন্যাস, জাদুবাস্তবতা বিষয়ক একটি প্রবন্ধ, গিন্সবার্গের প্রখ্যাত কবিতা “হাউল’-এর অনুবাদ, প্রবন্ধ “হাংরি আন্দোলন ও শক্তি চট্টোপাধ্যায়” এবং “মিহিকার জন্মদিন “ শীর্ষক একটি ছোটগল্প। ”স্বরচিত” গ্রন্থের কবিতা ও গল্প-উপন্যাস পাঠে সহজেই মলয়বাবুর রচনাশৈলীর অভিনবত্ব ও প্রতিষ্ঠান-বিরোধী চেতনার প্রকৃতি বোঝা যাবে। তিনি তাঁর মতো করেই লিখেছেন, এমনকি সমকালীন হাংরিয়ালিস্ট বা পশ্চিমা প্রভাবের অধুনান্তিক লেখকদের চেয়ে একেবারে আলাদাভাবে সৃজনকর্মে ব্যাপৃত থেকেছেন। আশির দশকের পর থেকে তিনি অধুনান্তিক ও জাদুবাস্তব ধারায় লেখা শুরু করলেও, তাঁর বিশেষ উদ্ভাবনী ক্ষমতায় প্রতিটি ক্ষেত্রে স্বকীয়তারই দীপ্তি ছড়িয়েছেন। আবার, গদ্য-রচনা হোক বা কবিতা, তাঁর একটি রচনার ভাষাবন্ধও অন্যটি থেকে একেবারেই পৃথক এবং প্রসঙ্গ ও অনুষঙ্গ উপস্থাপনের বেলায় সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় সমৃদ্ধ থেকেছে। নির্দিষ্ট আঙ্গিকরীতি, যুক্তি বা নিয়ম-পদ্ধতি থেকে মুক্ত নতুন ধারার বাচনিক নির্মাণ তাঁর সাহিত্য। কী কবিতায় কী গদ্যে, বিচিত্র যৌন-অভিজ্ঞতা তুলে ধরার ক্ষেত্রে তিনি মোক্ষম শিল্পী। নিষিদ্ধকে তিনি খোলামেলা ভাষায় তুলে ধরেছেন। একদিকে জৈবিকতা এবং অন্যদিকে প্রথাগত সমাজের নানা কুশ্রিতা ও অন্যায়-অপরাধের বিরুদ্ধে সরস সমালোচনা তাঁর সাহিত্যের উপজীব্য। সেখানে রয়েছে এমন সব উপাত্ত যে-গুলো নির্মম সত্যেরই প্রকাশ ঘটায়, মুখোস খুলে দেয় প্রচলিত সভ্যতার, উলঙ্গ করে ছাড়ে এতৎকালের সাহিত্য-শিল্পের অনুশাসনকে।
প্রায় চারশত পৃষ্ঠার এই ”স্বনির্বাচিত” গ্রন্হ, বাঙলা সাহিত্যের কিংবদন্তীসম লেখক মলয়বাবু ও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে জানা-বোঝার এক মোক্ষম দলিল। আরো ওজস্বিতা নিয়ে একভাবে বলা যায়, এ যেন হাংরিয়ালিস্ট তথা অধুনান্তিক বাঙলা সাহিত্যের বাইবেল। বাংলাদেশে অধুনান্তিক সাহিত্যের চর্চায় যাঁরা আগ্রহী, এই গ্রন্থটি তাঁদের মনন ও চিন্তা-চেতনা গঠনে নির্দেশক হতে পারে বলে আমি মনে করি।
(গ্রন্থ : স্বনির্বাচিত। লেখক : মলয় রায়চৌধুরী। প্রকাশক : আলী আফজাল খান, ভিন্নচোখ প্রকাশনী, ঢাকা। প্রচ্ছদ : নির্ঝর নৈঃশব্দ। মূল্য : ৬৬০ টাকা।)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন