শনিবার

হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা : মলয় রায়চৌধুরী


       ক্ষুধার্তের কোনো ভাষা হয় না, যা হয় তা গোঙানি আর কাতরানি : ঠাকুমার কাছে শুনেছি ক্ষুধার্ত পরিবার দরোজায় এসে কীভাবে কাৎরে বলতো, ‘একটু ফ্যান হবে গো মা।’ বাংলাদেশের কবি রফিক আজাদ লিখেছিলেন, “ভাত দে হারামজাদা নয়তো মানচিত্র খাবো” কিংবা’"ক্ষুধার্তের কাছে নেই ইষ্টানিষ্ট, নিয়মকানুন। দৈবাৎ ধরো তোমাকে যদি পেয়ে যাই, সর্বগ্রাসী ক্ষুধার কাছে উপাদেয় উপাচার হবে"। এটা ক্ষুধার্তের ভাষা নয়, এটা একজন ক্রুদ্ধ মধ্যবিত্ত কবির আস্ফালন ।

         হাংরি আন্দোলনের গদ্যলেখক ও কবি সুবিমল বসাকের গবেষক তন্ময় ভট্টাচার্য হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা সম্পর্কে লিখেছেন,“আমার মতে, হাংরি আন্দোলনকারীদের সাহিত্যের ভাষা হল একটা ভূমিকম্প। সেই ভূমিকম্প প্রচলিতের ভিতে আঘাত করেছিল। ক্ষত সৃষ্টি করেছিল। এবং আফটার এফেক্টে আখেরে উপকার হয়েছে বাংলা সাহিত্যের। যদি ১৯৬২-১৯৬৫ এই সময়কালটাকে মধ্যিখানে রাখি, তাহলে এর আগেকার প্রচলিত ও বিখ্যাত সাহিত্যের সুর ও পরের প্রচলিত ও বিখ্যাত সাহিত্যের সুরে – হ্যাঁ, মেইনস্ট্রিমেরই, তফাৎ খুঁজে পাই আমি। ওই যে বললাম ‘আফটার এফেক্ট, তা ক্রমশ ছড়িয়ে গেছে সত্তর-আশি-নব্বইয়ের লেখায়। হয়তো স্পষ্ট নয়, রচয়িতারাও হয়তো জানেন না বা খেয়াল করেননি, কিন্তু অবচেতনে হলেও হাংরি আন্দোলনের ভালোটুকু তাদের লেখায় চলে এসেছে। পরিবেশনায়, শব্দব্যবহারে। তাই, আমার বিশ্বাস, হাংরি আন্দোলনকারীদের সবচেয়ে বড় অবদান পরবর্তী জেনারেশনের সাহিত্যিকদের একধাক্কায় অনেকটা এগিয়ে যেতে দেওয়া। ১৯৬২-১৯৬৫ – এই সময়কাল ও হাংরিদের কর্মকাণ্ড বাংলায় না ঘটলে, আমার ধারণা, আরও বিলম্বিত হত এই অগ্রগতি। ষাট বছর পরে দাঁড়িয়ে, একজন তরুণ পাঠক হিসেবে পিছনের দিকে তাকালে, সমস্ত খুঁটিনাটি সরিয়ে মূল প্রভাবটুকুর দিকে খেয়াল রেখে আমার এটাই বারবার মনে হচ্ছে – হাংরিরা নিজেদের উৎসর্গ করেছেন পরবর্তী প্রজন্মের জন্য। কিন্তু সাহিত্যের উপকারই হয়েছে তাতে। ‘The Last Days of British Raj’ বইতে লিওনার্ড মোসলে একটা কথা বলেছিলেন – ‘সুভাষ বোসের আত্মা লালকেল্লায় ঘুরে বেড়াচ্ছে।’ লালকেল্লায় আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলছিল তখন। ঠিক তেমনই, আমার মনে হয়, এই ষাট বছরের সাহিত্যের ওপর ঘুরে বেড়াচ্ছে হাংরিদের আত্মা। দেখা যায় না, টের পাওয়া যায়।

         হাংরি আন্দোলন সম্পর্কিত একটি গ্রন্হ সমালোচনায় শৈলেন সরকার বলেছেন, “হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়।”

         নবারুণ ভট্টাচার্য সম্পর্কে আলোচনাকালে প্রবুদ্ধ ঘোষ বলেছেন, “আজ স্যানিটারি ন্যাপকিন নিয়ে আলোচনা হচ্ছে; প্রকাশ্যে চুম্বন করে প্রতিবাদ জানানো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় বাধানিষেধ ও সমাজের প্রচলিত ‘ট্যাবু’গুলিকে। এই বিদ্রোহ কিন্তু ’৬০ এর দশক থেকেই শুরু করে দিয়েছিলেন ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখকেরা। সমস্তরকম গোঁড়ামি এবং ‘ঢাকঢাকগুড়গুড়’ বিষয়ের ভিতে টান মেরেছেন। সাহিত্য বহু আগেই ভবিষ্যতের কোনো এক আন্দোলনের কথা স্বীকার করে যাচ্ছে- তার নিজের মত করে, নিজের প্রকাশে। না, নিশ্চিতভাবেই সাহিত্যের কাজ ভবিষ্যৎদর্শন নয়; কিন্তু হ্যাঁ, সাহিত্যের অন্যতম কাজ ভবিষ্যতের সামাজিক আন্দোলনের, সাহিত্য আন্দোলনের সূত্রগুলোর হদিশ দিয়ে যাওয়া। ফাল্গুনী রায় যখন কবিতায় বলে, ‘শুধুই রাধিকা নয়, গণিকাও ঋতুমতী হয়’, তখন কি আজকের এই আন্দোলনের কথাই মনে হয় না? যেখানে, ঋতুমতী হওয়া কোনো ‘লজ্জা’র বিষয় নয়, ‘অশুদ্ধি’র বিষয় নয়, বরং তা স্বাভাবিক জৈবনিক প্রক্রিয়া। আর, প্রতিমুহূর্তের এই আত্মজৈবনিক বিষয়গুলিই উঠে আসে হাংরি জেনারেশনের লেখায়। বা, সগর্ব্ব মানুষ-প্রমাণ ‘আমি মানুষ একজন প্রেম-পেচ্ছাপ দুটোই করতে পারি’’। এগুলো তো দৈনন্দিন। এগুলো তো স্বাভাবিক। তা’লে? আসলে, ‘শুদ্ধতা’-র একটা অর্থহীন ধোঁয়াশাবোধ তো তৈরি করেই দেয় সমাজ, একটা বর্ডারলাইন। সাহিত্যের নায়ক রক্তমাংসের মতো হবে কিন্তু তার ক্ষুধা-রেচন ইত্যাদি থাকবেনা বা পুরাণচরিত্রদের শারীরবৃত্তীয় কার্য নেই! এই ‘মেকি’ ধারণাসমূহ লালন করে আসা আতুপুতু প্রতিষ্ঠানগুলো যখন হাড়-মজ্জা-বোধ জীবন্ত হতে দেখে তখন ‘অশ্লীল সংস্কৃতি’ ছাপ্পা মারে। সমাজের জড়তা, মধ্যবিত্ত ভণ্ডামির মুখোশগুলো খুলে দেয় টান মেরে। আর, তাই ‘নিষিদ্ধ’, অশ্লীল মনে হয় এদের লেখাগুলি। হাংরি-দের যেখানে মূল বক্তব্যই ছিল প্রতিটি লেখায় ও সাহিত্যযাপনে আত্মউন্মোচন, সেখানে এই বিষয়গুলি স্বাভাবিক বীক্ষাতেই উঠে এসেছে। এবং, ‘সাহিত্য বিক্রির জন্যে আরোপিত যৌনতা’ বনাম ‘শিল্প ও জীবনের সাথে সম্পৃক্ত যৌনতা’ এই বিতর্কের ডিস্‌কোর্স তৈরি করেছে। সুভাষ ঘোষের গদ্যে থাকে সমস্ত ধড়িবাজ, রাজনীতিবাজ, সঞ্চয়িতাবাজ, পলিসিবাজ, নামকাতুরে মানুষের কথা; যারা আপাতনিশ্চিন্ততার মোড়কে মুড়ে রাখে নিজেদের দৈনন্দিন আর গান্ধীর বাঁদরের মতই কিচ্ছু না-দেখে না-শুনে না-বলে কাটিয়ে দিতে চায় রাত-দিন। আর, প্রাতিষ্ঠানিকতা এদেরই ওপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকে, নিজেকে ‘শিল্প’ বলে দাবি করে অন্য সম্ভাবনাগুলো নষ্ট করে দেয়। বেঁচে থাকাটা একটা দায় একটা নিয়ম হয়ে ওঠে পণ্যসমাজে। আর, সেই পণ্যসময়ে বেঁচে থেকে কিচ্ছু না-পেয়ে বেঁচে থেকে হতাশার অবিমৃষ্য বোধ তৈরি হয়। ’৬০-’৭০ র দশকের ক্রমাগত অর্থনৈতিক অবক্ষয়, মধ্যবিত্তের আশাহীনতার অভিঘাত নৈরাশ্যের জন্ম দেয়; এমনকি সাহিত্যেও। আর, সেই নৈরাশ্যকে এড়িয়ে গিয়ে কবিতা বা গদ্য লেখা যায় না। অরুণেশ ঘোষ তাঁর ‘কিচ্ছু নেই’ সময়কে লিখছেন- ‘১ পাগল এই শহরের চূড়ায় উড়িয়ে দিয়েছে তার লেঙ্গট/ ১ সিফিলিস রুগী পতাকা হাতে মিছিলের আগে/ ১ রোবট নিজেকে মনে করে আগামীকালের শাসক/ ১ মূর্খ ঘুমিয়ে থাকে শহর-শুদ্ধ জেগে ওঠার সময়... শীতের ভোর রাত্রে- মধ্যবিত্তের স্বপ্নহীনতার ভেতর/ আমাকে দেখে হো হো করে হেসে ওঠে বেশ্যাপাড়ার মেয়েরা’। এই স্বপ্নহীনতাকে বাড়িয়ে তোলে পুঁজিবাদের দমবন্ধ চেপে বসা। ভারতের তথা বাংলার অর্থনীতি-মডেলকে সাজানোর দোহাই দিয়ে বিদেশি শস্যবীজ এবং সবুজ বিপ্লবের সাথেই আমদানি হয় পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। আর, নগরায়ণের মুখ খুলতে থাকে। ’৬০-’৭০ র অবক্ষয়ী অথচ পণ্যপ্রিয় ভোগসমাজের কথা সেইসময়ের মতন করেই লেখেন হাংরি গল্পকাররা। আর, ভবিষ্যতের পণ্যসমাজের একটা আভাসও থাকে। “আপাতত প্রতীয়মান ধূম্রজালে জড়ানো ধীরে ধীরে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর একজন দৈত্যভৃত্য- : আপনার গোলাম আকা কি হুকুম যা বলবেন যা চাইবেন জীবনে তাই হাজির... একটি সিগারেট। ...একটি সিগারেট। পাঁচ বছরে একটি টিভি সেট। দশ বছরে একটি গাড়ি আর বিশ বছরে সিগারেট খেতে খেতে একবার সারা দুনিয়ায় চক্কর দেব। বাতাস স্তব্ধ। অবাক হঠাৎ মেঘের আকাশ-কাঁপানো অট্টহাসি।”[ঘটনাদ্বয় ও তাদের সাজসজ্জাঃ রবিউল] । বুঝে নেওয়া দরকার হাংরি-প্রজন্মের সাহিত্য আন্দোলনের নিভন্ত আগুন এবং সেই আগুনে শাসক-রাষ্ট্রের ক্রমাগত শান্তির জল ঢেলে যাওয়া; অথচ সেই নিভু আগুনের থেকে ফিনিক্সের জেগে ওঠা। নিওফ্যাসিজম্‌ বিশ্বব্যাপী ঠাণ্ডাযুদ্ধ পরবর্তী সময় থেকেই ঘর গোছাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক ভাবে দখল চালানো তো বটেই, তার সাথেই থাকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আগ্রাসন। আর, পুঁজিবাদ নতুন যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তার উৎপাদন-পদ্ধতিকে খাপ খাইয়ে নিতে চায়, তেমনি সাহিত্যকেও যেহেতু পুঁজিবাদ পণ্য হিসেবেই দেখে, তাই তার উৎপাদন-কৌশলেও নতুন ফর্মুলা নিয়ে আসতে চায়। আর, সেই ফর্ম্যুলার অন্যতম হল, একদা যা ছিল প্রান্তিক, যা ছিল শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সের’ বাইরে, তাকেই কেন্দ্রের দিকে ঢুকিয়ে দেওয়া, শাসকের ‘ডিস্‌কোর্সে’ তাকেও ঢুকিয়ে নেওয়া। হাংরি প্রজন্মের আন্দোলনের সময় যে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কৃতি তাদের ‘প্রান্তিক’ করে রেখেছিল, পরে সময়-সুযোগ বুঝে তাকেই প্রতিষ্ঠানের কৃষ্ণগহ্বরে ঢুকিয়ে নেয়। অ্যাণ্টি-কাল্‌চার ও কি বাজার-কাল্‌চার এ ঢুকে পড়ে? যখন তার প্রভাব এড়ানো যায়না আর, যখন ছাই হয়েও ফিনিক্স পাখির মতো জ্বলে ওঠে ফের তার ভাষা-সংস্কৃতি তখন বাজার নতুন ভাবে নামে? প্রতিষ্ঠান দখল করে নেয় বিগত সব প্রত্যাঘাতগুলো? একদা ‘ওরা অশ্লীল’ বলে চেঁচানো সাহিত্যিকেরাও লিখে ফেলেন হাংরি-দের কথা। বাণিজ্যিক ছবি হয়, সেখানে হাংরি-লেখক রবীন্দ্রনাথকে দিয়ে প্রুফ-চেক্‌ করাতে মুখিয়ে থাকে। এ-ও তো এক সংস্কৃতি। প্রতিস্পর্ধাকে নমনীয় করে, দোষারোপ গুলোকে বড়ো করে প্রতিস্পর্ধী-‘সংস্কৃতি’-কে ভুলিয়ে দেওয়া। কারণগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া, প্রেক্ষাপট ও প্রেক্ষিতকে গুলিয়ে দেওয়া। পণ্যমুখর পুঁজিবাদে লেখক ও লেখাদের পণ্য করে তোলা, বিপণন কৌশলে চমক! আসলে, ভোগবাদ, পুঁজির সংস্কৃতি তার নীতি বদলায় না, কৌশল বদলে ফেলে। হাংরি-দের গল্পের এবং গদ্যের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ পাঠ হচ্ছে, মুক্তসমাপ্তি। অর্থাৎ, কোনও স্থির সিদ্ধান্তে উপনীত হচ্ছেন না লেখক; হয়তো স্থির সিদ্ধান্ত হয় না কোনও। অন্ততঃ, যে সময়ে তাঁরা লিখছেন, সেই সময়ে অচঞ্চল বিশ্বাস কিছু নেই, কোনও স্থিতি নেই, সিদ্ধান্তে আসার ভিত্তি নেই। বাসুদেব দাশগুপ্তের ‘বমন রহস্য’ গল্পে আশাহীন এবং আলোহীন ভোগবাদী সমাজের প্রতি ঘৃণা ঠিকরে বেরোয়। গল্পের শেষ লাইন- “বমি করে যাই রক্তাক্ত পথের উপরে। সমস্ত চর্বিত মাংসের টুকরো, সমস্ত জীবন ভোর খেয়ে যাওয়া মাংসের টুকরো আমি বমি উগরে বার করতে থাকি। বমির তোড়ে আমার নিঃশ্বাস যেন আটকে আসে।”। পাঠকের যথেচ্ছ স্বাধীনতা থাকে, জীবনের সাথে মিলিয়ে পরিণতি ভাবার; সিদ্ধান্তে পৌঁছে দেওয়ার দায় লেখকের নয়। হাংরি লেখকেরা তাঁদের লেখালেখিতে জোর দিচ্ছেন পাঠের ওপর। অর্থাৎ, লেখকের ভাষাগত চাতুর্য, শব্দলালিত্য আর বিচার্য নয় বরং বিচার্য পাঠবস্তুটি। ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে হাংরি-দের একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে রানিং কমেণ্টারির মতোন অর্থাৎ, চলন্ত ধারাভাষ্যের মতো সাহিত্য। যা ঘটছে, যা অভিজ্ঞতা সেটাকেই গল্প বা কবিতায় তুলে আনা। কবিতা সম্পর্কে প্লেটোসহ বহু প্রাচীনপন্থীর মতামত এই ছিল যে, কবিতা বাস্তব থেকে দূরে নিয়ে যায় চেতনাকে। অথচ, হাংরি-দের কবিতা পড়লে কিন্তু তার উল্টোটাই মনে হয়। বড়ো বেশিই যেন বাস্তবের গহ্বরে ঢুকিয়ে নিতে চাইছে পাঠককে, সঙ্গে নিজেরাও। নৈর্ব্যক্তিকতাকে প্রত্যাখ্যান করে হইহই করে লেখক নিজেকেও এনে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে লেখার মধ্যেই। এর ফলে কবিতার চিরাচরিত সম্বোধক-সম্বোধিত বা অ্যাড্রেসার-অ্যাড্রেসড নিয়ম ধাক্কা খাচ্ছে। সাহিত্য আর ততটা দূর থেকে বসে, নিরাপদে লেখার বিষয় থাকছে না; যখন পৃথিবী পুড়ছে ব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে তখন লেখাও পুড়তে বাধ্য। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা থেকে প্রথম হাংরি বুলেটিন বেরোয় ইংরাজিতে। ‘Weekly manifesto of hungry generation’, যার সম্পাদক দেবী রায়, মুখ্যনেতা শক্তি চ্যাটার্জ্জী এবং ক্রিয়েটর মলয় রায়চৌধুরি। তার প্রথম অনুচ্ছেদ- “Poetry is no more a civilizing maneuver, a replanting of the bamboozled gardens; it is a holocaust, a violent and somnambulistic jazzing of the hymning five, a sowing of the tempestual Hunger.” কবিতা কোনো নিরপেক্ষতার মাপকাঠি নয়, কবিতা শুধুমাত্র ছন্দ-শব্দ দিয়ে বেঁধে রাখার নান্দনিকতা নয়। বরং, অসহ্য জীবনকে তার মধ্যে প্রতিটি ছত্রে রেখে দেওয়া, অনন্ত বিস্ফারের সম্ভাবনায়। হাংরি-দের লেখায় আত্ম-কে আবিষ্কার, জীবনের কেন্দ্রের মূল উৎস গুলোয় ফেরা, সন্ধান করা অসুখের উৎসের। কবিতা থেকে কবিতাযাপন হয়ে ওঠার প্রক্রিয়া। ক্রাইসিস-গুলোকে চিনে নিতে নিতে প্রতিস্পর্ধী হয়ে ওঠা। কবিতা মানে বাস্তব থেকে দূরে সরার, অথবা কিছু মিথ্যে স্তোকবাক্য দিয়ে বাস্তবকে আড়াল করার চেষ্টা আর নেই; চাঁদ ফুল তারা নদী আর অতটাও সুন্দর নেই যে তারাই হয়ে উঠতে পারে ‘Aesthetics’-র মাপকাঠি। এস্থেটিক্‌স-ও নিয়ন্ত্রিত হয় পুঁজির দ্বারা, পুঁজির স্বার্থেই! সেই এস্থেটিক্‌স কে প্রবল বিক্ষোভে উপহাস করেন ফাল্গুনী রায়ও- “রাজহাঁস ও ফুলবিষয়ক কবিতাগুলি আমি মাংস রাঁধার জন্যেই দিয়েছিলাম উনোনে...”। বরং দৈনন্দিন যুদ্ধদীর্ণ ‘অসুস্থ’ জীবন থেকেই উঠে আসে ‘Aesthetics’-র সারবত্তা। আর, কবির নিশ্চয়ই দায়বদ্ধতা থাকে সমাজের প্রতি; হাংরি-দের সেই নিজেকে, ভাষাকে, কবিতাকে ছিঁড়েখুঁড়ে সত্যের কাছাকাছি পৌছানোর ঔপনিষদীয় উপলব্ধি । রাষ্ট্রের ভণ্ডামিগুলো, ‘আদার্‌’ ছাপ্পা মেরে দেওয়াগুলো, ‘নিজেকে নিজের মতো গুছিয়ে নেওয়া’র গড্ডালিকা স্রোতগুলোর পালটা স্রোত সাহিত্যে-জীবনযাপনে আসে। আর, ‘সংস্কৃতি’ ঠিক করে দেওয়া কর্তারা থাকবে, ততটাই থাকবে সেই ‘সংস্কৃতিকে’ প্রত্যাখ্যান। হয়তো সমান্তরাল, তবু থাকবে। প্রবলভাবেই। সমাজশাসকেরা বরাবরই নিজেদের মত করে হেজিমনি চাপিয়ে দেয়, শাসনের ডিস্‌কোর্সের অভিমুখে দাঁড় করাতে চায় সব্বাইকে। আর, যখনই তার বিরুদ্ধে স্বর ওঠে, তা সে সাহিত্যেই হোক বা অন্য কোথাও, তাকে দমিয়ে দেওয়া হয়। ব্রাত্য করে রাখা হয় ‘সংস্কৃতি’-র শুদ্ধতার দোহাই দিয়ে। জাতীয় সাহিত্যের মাপকাঠিতে ‘অশ্লীল’ বা ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে প্রতিপন্ন হয় এই সাহিত্যগুলো। ক্ষুধার্ত প্রজন্মের লেখাকে বিশ্লেষণ না করেই তাকে দাগিয়ে দেওয়া হয় এবং পরে তাকেই আত্তীকরণ করে বাজারজাত পণ্য করার প্রাতিষ্ঠানিক চেষ্টা। ‘নিম্নবর্গের’ এই সাহিত্যগুলোই প্রয়োজন হয়, যদি ভারতীয় সাহিত্যের ওলট-পালট, এগিয়ে চলাকে খুঁজতে হয়। বিশেষতঃ পণ্যসঙ্গমরত সমাজে যেখানে জীবন-মানুষ-শিল্প সবটাই ক্রমপণ্য হয়ে যাচ্ছে, তখন বিরোধিতার স্বর, রাষ্ট্রদ্রোহিতার স্বরগুলোর হয়তো বেশিই প্রয়োজন; দ্রোহকে আরো ক্ষুরধার, শাণিত এবং সত্যসন্ধানী করে তুলতে।”

         সুবিমল বসাকের গ্রন্হাবলী আলোচনাকালে অধ্যাপক অলোক রায় বলেছেন, “সুবিমল বসাকের প্রথম উপন্যাস বা গদ্যন্যাস ‘ছাতামাথা’ (১৯৬৫) আমি পড়িনি । দ্বিতীয় উপন্যাস ‘প্রত্নবীজ’ (১৯৯৬) কয়েক বছর আগে ছাপা হলেও সদ্য আমি পড়বার সুযোগ পেয়েছি। উপন্যাস, কিন্তু আদৌ অবসর-বিনোদনের সামগ্রী নয় । পড়ে চমকে উঠতে হয় । কারও ভালো লাগবে, কারও লাগবে না, এটাই স্বাভাবিক। তবে অগ্রাহ্য করা অসম্ভব। একটা প্রবল আলোড়ন তোলা সম্ভব। অথচ সেভাবে আলোড়ন সৃষ্টি করেনি। এটাই বিস্ময়কর। অথবা বিস্ময়ের কিছু নেই। প্রত্যেক বছর বাংলায় যে একশো-দেড়শো উপন্যাস বেরোচ্ছে, তার নিশ্চয় বিশেষ একজাতের ভোক্তা আছে। তাঁরা ‘প্রত্নবীজ’ পড়তে উৎসাহ বোধ নাও করতে পারেন। বিশেষত ভাষা ব্যবহারে আঞ্চলিকতাকে যেভাবে কাজে লাগানো হয়েছে, তা বিস্ময়কর। ‘ঢোঁড়াইচরিতমানস’-এ সতীনাথকে টীকা-টিপ্পনীর আশ্রয় নিতে হয়েছিল। আলাউদ্দিন আল আজাদের ‘কর্ণফুলি’ উপন্যাসে চট্টগ্রামের ভাষাব্যবহার চমকপ্রদ লেগেছিল একসময়। কিন্তু সশেষ পর্যন্ত চরিত্রকে ফোটাবার প্রয়োজনেই বিশেষ ভাষা ব্যবহার । তা না হলে অপরিচিত মহল্লা, ততোধিক অপরিচিত মানুষজন, আর তাদের ভাষাকাঠামোতে পাটনাইয়া বুলি প্রয়োগ -- অপরিচয়জনিত বিস্ময়রস সৃষ্টিতে সক্ষম।’  প্রত্নবীজ নানা কারণে অসামান্যতা দাবি করে। আমি আমার নিজের মত করে প্রত্নবীজ পড়েছি। আমার প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে আর একজন পাঠকের অমিল হতেই পারে। তবে সুবিমল বসাকের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণশক্তি ও ভাষা ব্যবহারে নৈপুণ্য নিয়ে কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।” 

         অজিত রায় লিখেছেন, “চল্লিশ-পঞ্চাশ থেকেই বাংলা কবিতা পাঠক লস করতে শুরু করেছিল।  শঙ্খ-সুনীল-শক্তি-ফণীভূষণদের আসরে নামতে সামান্য লেট, এমন দিনে, ৫০-এর শুরুতেই বুদ্ধদেব বসু রটিয়ে দিলেন :'ছন্দ, মিল, স্তবকবিন্যাসের শৃঙ্খলা, এ-সব বন্ধনেই কবির মুক্তি।'  বুদ্ধিবাদী এনজয়মেন্টের ব্রেকিং নিউজ। পঞ্চাশের লক্ষ্মীঘরানার ফোকাসবাজ কবিরা সেটা ঝপসে গিলে ফেললেন। বিষয়ে ন্যাকাচিত্তির রোমান্টিকতা আর আঙ্গিকে রকমারি বেগুনপোড়া এনে তাঁরা 'ফাটিয়ে' দিতে চাইলেন বাংলা বাজার।  আলোক সরকার এসময় আঙ্গিকে আর শব্দের বিন্যাস নিয়ে এত কসরৎ করেন যে প্রতিটি কবিতা থেকে ক্র্যাকের পড়পড় শব্দ বেরুতে থাকে। উপরন্তু, আনন্দ বাগচী রবীন্দ্র-গানের ফাটা রেকর্ডগুলো বাজিয়ে বাজিয়ে পাঠকের মূত্রপুটের বেঁটে দুববো ঘাসে মাচিশ ধরিয়ে দিলেন।  এসব করে পঞ্চাশের কবিরা এই ভেবে স্বমেহনের তৃপ্তি লাভ করলেন যে বাংলা কবিতায় 'প্রগাঢ় প্রতীতির সুর' দেখা দিয়েছে আর স্পষ্ট হয়েছে তার এক্সপোজ-ভঙ্গি। কিন্তু এতে পাঠ্য-পাঠকের জগদ্দল সমস্যাটাই আরও বুকবাড়া পেল। বিষয়ের গরিমা বাতায় ঠুঁসে স্রেফ আঙ্গিকের প্রাকটিস যে বাংলা কবিতার পক্ষে অশুভ হতে পারে তা যেন কেউ কেউ বুঝতে পেরেছিলেন।  সময়টা ছিল ৫০-এর মাঝামাঝি, বাংলা কবিতা তার সহজ-সুগম পথ ছেড়ে অচিরেই ন্যাকানাদা লিরিক আর আঙ্গিক-সর্বস্ব শব্দচচ্চড়ি হয়ে উঠল। ফলে, অনিবার্যভাবেই ষাটে ঘটল সর্বস্তরিক তোড়ফোড়। ষাট, কেবলমাত্র একটি সময়-চিহ্ন নয়, সময়ের শান্তশায়ী বুকে একটি পিরেনিয়াল আঁচড়, এক প্রবল ঘূর্ণাবর্ত ----- সত্তর ক্রশ করে আশিতে এসে যার পরিক্রমা সমিল হয়। বাংলা কবিতাধারায় ঐ ন্যাকাচিত্তির কলাকৈবল্যবাদ আর লিরিকবাজির প্র্যাকটিসের খেলাপে প্রচণ্ড অনাস্থা আর বিরক্তি গনগনে অমর্ষ হয়ে আছড়ে পড়েছিল ষাটের ঐ হো-হাঙ্গামার দিনে, যখন প্রকাশ্য ডে-লাইটে ফুটপাথের হাঁড়িকাঠে গলা-ফাঁসানো পঞ্চাশিয়া কবিতার হালাল প্রত্যক্ষ করেছিল কলকাতা।  ন্যাকাচোদা ধুতি-কবিদের ফুল-দুববো কালচারের বিরুদ্ধে আধপেটা ছোটলোক ভবঘুরে বাউণ্ডুলে গাঁজাখোর চুল্লুখোর চরসখোর রেন্ডিগামী কবিদের তীব্র সাব-অলটার্ন আর ডায়াসপোরিক কাউন্টার কালচার চাক্ষুষ করেছে দিনদাহাড়ে ব্যাংক-রবারির ফিলমি কারকিতে। ছোটলোকদের ওই ধরদবোচা অ্যাকশানে গাঁড় ফেটে গিয়েছিল প্রতিষ্ঠানের ধামাধরা ক্লিন-শেভড পাউডার-পমেটমপ্রিয় পঞ্চাশের কবিদের।”

         উদ্ধৃতিগুলো দিলুম এইজন্যে যে পাঠকরা কীভাবে হাংরিদের লেখালিখিকে বিশ্লেষণ করেছেন তার একটা ধারণা মোটামুটি গড়ে ওঠে । সব কয়টি বক্তব্যেই একের সঙ্গে আরেকের কিছুটা বিরোধিতা আছে । আমি মনে করি যে হাংরি আন্দোলনকারীরাই প্রথম ভাষা নিয়ে চিন্তা করার কথা বলেছিলেন, তাঁরা চেষ্টা করেছিলেন ভাষাকে নিজস্ব জগতে নিয়ে আসতে, যিনি যেমন পরিবেশ থেকে এসেছিলেন তিনি সেইভাবেই গড়ে তুলেছেন তাঁর ভাষার শরীর । হাংরি আন্দোলনকারীরা সবাই একই ধরণের ভাষা ব্যবহার করেননি, তার কারণ সবাই একই পৃষ্ঠভূমি থেকে আসেনি । 

        একটু আগে সুবিমল বসাকের কথা বলেছি, যিনি ঢাকার তাঁতিবাড়ি থেকে এসেছিলেন, তাঁর বাবা পাটনায় অতিনিম্নবিত্ত পাড়ায় স্যাকরার কাজ করতেন এবং দেনার দায়ে আত্মহত্যা করেন । সুবিমল ‘ছাতামাথা’ উপন্যাসের ন্যারেটিভে প্রয়োগ করেছিলেন ঢাকাই কুট্টিদের বুলি ; অন্যান্য গদ্যে তিনি শৈশবে যে অঞ্চলে বসবাস করতেন সেখানকার ‘ডায়াসপোরিক’ মিশ্র ভাষা প্রয়োগ করেছেন । অবনী ধরের বাবা সংসার ত্যাগ করে এক সঙ্গিনীর সঙ্গে বাউলজীবন কাটিয়েছেন, পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি ; অবনী ধর স্কুল পালিয়ে জাহাজের খালাসির চাকরিতে যোগ দেন, ফিরে এসে বস্তিতে থাকতেন, অতি-নিম্নবিত্তের জীবন, অসংগঠিত শ্রমিকরা যেধরণের কাজ করতে পারেন সবই করেছিলেন, মায় রাস্তায় হকারি ; সাহিত্য সম্পর্কে কোনো ধারণা বা শিক্ষা তাঁর ছিল না, এবং যেমন যেমন স্মৃতি তাঁকে চালিত করেছে তেমনই লিখে গেছেন গল্পগুলো, তাঁর জীবনের বিভিন্ন টুকরোয় গড়া, ফলে তাঁর ভাষা একজন অসাহিত্যিকের, নির্মম, অশোভন, আক্রমণাত্মক, পথ-চলতি গদ্যবিন্যাসে তৈরি । দেবী রায় ( প্রকৃত নাম হারাধন ধাড়া ) থাকতেন হাওড়ার একটি বস্তিতে এবং কৈশোরে রাস্তার চায়ের দোকানে কাজ করতে হয়েছে বাবা-মা-ভাইয়ের সংসার চালাবার জন্য । হাওড়ার বস্তি থেকে উঠে-আসা মানুষের ভাষা নিয়েই তিনি সাহিত্যজগতে ঢুকেছিলেন । স্বাভাবিক যে শক্তিপদ ব্রহ্মচারী সম্পর্কে পিএইচডির গবেষণাপত্রে পিনাকী দাশ, তাঁর মধ্যবিত্ত বিদ্যায়তনিক বোধ থেকে লিখেছেন, “ হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা ব্যবহার অনেক সময়েই আমাদের বোঝার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, কখনো বা তথাকথিত মার্জিত রুচিকে ধাক্কা দেয় আর এও ঠিক, অনেক সময়ে তাঁদের বিভিন্ন মতামত থেকে এমন অলঙ্ঘনীয় এক সত্য উঠে আসে যা আজকের বর্তমান সমাজ পরিস্হিতিতে আরো প্রাসঙ্গিক।”

           হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা হলো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বিকল্প ভাষাবিন্যাস গঠনের প্রয়াস। হাংরি আন্দোলনকারীরা কোনো রাজনৈতিক দলের ছাতার তলায় আশ্রয় নেননি, তবু তাঁদের  কণ্ঠস্বর স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে উচ্চকিত- আগ্রাসী ( পরে নব্বুই দশকে অবশ্য সুভাষ ঘোষ সিপিএমে যোগ দেন ও চন্দননগর কমিটির সদস্য হন ; তৃণমূল ক্ষমতায় এলে শৈলেশ্বর ঘোষ তৃণমূলে যোগ দেন ) । রাজনৈতিক দলে যোগ দিলে সেই দলের বিরোধিতা করা অসম্ভব হয়ে যায় । হাংরি আন্দোলনের ইশতাহারগুলো খুঁটিয়ে পড়লেই টের পাওয়া যাবে । এটা ঠিক যে হাংরিরাও বামপন্হী দলের কবিদের  মতো পরিসর ও সময়কে তুলে ধরেছিলেন। কিন্তু শুধু এইটুকুতেই থেমে থাকেননি তাঁরা ; দ্রোহ, রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক নান্দনিক এবং সামাজিক, ছিল তাঁদের আন্দোলনের ভ্যানগার্ড। সুতরাং তাঁদের ভাষাও আশ্রয় করেছে শাসক-বিরোধিতার, বিদ্যায়তনিক শাসকদের মূল্যবোধ বিরোধিতার, প্রচলিত সাহিত্যিক মানদণ্ডের বিরোধিতার, ধিক্কারের । এতজনের লেখালিখি থেকে সেই সময়কার প্রধান সাহিত্যিক সন্দর্ভের তুলনায় হাংরি আন্দোলন যে প্রতিসন্দর্ভ গড়ে তুলতে চাইছিল, সেই কাঙ্খিত রদবদল ছিল দার্শনিক এলাকার, বৈসাদৃশ্যটা ডিসকোর্সের, পালাবদলটা ডিসকার্সিভ প্র্যাকটিসের, বৈভিন্ন্যটা কখন-ভাঁড়ারের, পার্থক্যটা উপলব্ধির স্তরায়নের, তফাতটা প্রস্বরের, তারতম্যটা কৃতি-উৎসের। তখনকার প্রধান মার্কেট-ফ্রেন্ডলি ডিসকোর্সটি ব্যবহৃত হতো কবিলেখকের ব্যক্তিগত তহবিল সমৃদ্ধির উদ্দেশ্যে। হাংরি আন্দোলনকারীরা সমৃদ্ধ করতে চাইলেন ভাষার তহবিল, বাচনের তহবিল, বাকবিকল্পের তহবিল, অন্ত্যজ শব্দের তহবিল, শব্দার্থের তহবিল, নিম্নবর্গীয় বুলির তহবিল, সীমালঙ্ঘনের তহবিল, অধ:স্তরীয় রাগবৈশিষ্ট্যের তহবিল, স্পৃষ্টধ্বনির তহবিল, ভাষিক ইরর্যাশনালিটির তহবিল, শব্দোদ্ভটতার তহবিল, প্রভাষার তহবিল, ভাষিক ভারসাম্যহীনতার তহবিল, রূপধ্বনির প্রকরণের তহবিল, বিপর্যাস সংবর্তনের তহবিল, স্বরন্যাসের  তহবিল, পংক্তির গতিচাঞ্চল্যের তহবিল, সন্নিধির তহবিল, পরোক্ষ উক্তির তহবিল, স্বরণ্যাসের তহবিল, পাঠবস্তুর অন্তঃস্ফোটিক্রিয়ার তহবিল, তড়িত বাঞ্জনার তহবিল, অপস্বর-উপস্বরের তহবিল, সাংস্কৃতিক সন্নিহিতির তহবিল, বাক্যের অধোগঠনের তহবিল, খন্ডবাক্যের তহবিল, বাক্যনোঙরের তহবিল, শীংকৃত ধ্বনির তহবিল, সংহিতাবদলের তহবিল, যুক্তিছেদের তহবিল, আপতিক ছবির তহবিল, সামঞ্জস্যভঙ্গের তহবিল, কাইনেটিক রূপকল্পের তহবিল ইত্যাদি। 

         বহু পাঠক হাংরি আন্দোলনকারীদের বইগুলো না পড়েই অশ্লীলতার দোষ খুঁজে পান, তা এইজন্য যে আমার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও কবিতায় অশ্লীলতার মামলা হয়েছিল আর নিম্ন আদালতে দণ্ডাদেশ হয়েছিল। হাংরি আন্দোলনকারীদের বইগুলো না পড়েই, ইনটারনেটে যেটুকু পান তাতে চোখ বুলিয়ে নির্ণয় করে ফ্যালেন, বিশেষ করে বাংলাদেশের আলোচকরা, কেননা সেখানে হাংরি আন্দোলনকারীদের বই যায় না । যেমন এলোরা জামান লিখেছেন,”কবিতা, গদ্য, সাহিত্য কর্মে এই সকল অশ্লীল ভাষার ব্যাবহার হাংরি জেনারেশনের কবিদের মাঝে ব্যাপকভাবে পরিলক্ষিত হয়েছে।” কিন্তু কার বা কাদের কোন লেখায় তিনি তা খুঁজে পেলেন সেকথা জানাননি । বাংলাদেশি আলোচক তামারা ইয়াসমিন ইনটারনেট থেকে তথ্য সংগ্রহ করে অবশ্য লিখেছেন যে, “‘হাংরি জেনারেশন’ আন্দোলন পরবর্তীতে বাংলা সাহিত্যের মোড় ঘুরিয়ে দেয়। নাগরিক জীবন ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অসঙ্গতিকে, এত অল্প সময়ে এভাবে কলমের আঘাতে আর কোনো সাহিত্যকেন্দ্রিক আন্দোলন, জর্জরিত করতে পারেনি।” শাহাদত জামান লিখেছেন যে, “প্রচলিত ছন্দ,অলংকার, বানানরীতিকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন এঁরা। এছাড়া বাংলা সাহিত্যে ব্রাত্য শব্দাবলীর অবাধ ছাড়পত্র দিয়েছেন হাংরিয়েলিস্টগণ।” পি এস কাজল লিখেছেন, “অনেকে মনে করেন হাংরি আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । কিন্তু বর্তমান আধুনিক কবিদের  ( সরকারি দালাল গুলোকে বাদ দিলে যারা থাকে ) লেখা কবিতা বা তাদের চিন্তা চেতনা দেখলে আমার মনে হয় না এ আন্দোলন শেষ হয়ে গেছে । তবে এটা ঠিক আন্দোলনের রকমেরও পরিবর্তন হয়েছে । কিন্তু প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে যায়নি তবে পরিবর্তন হয়েছে ভাষার স্বাভাবিক পরিবর্তনশীলতার মত ।”

          আমার সম্পর্কে অজিত রায় লিখেছেন, এবং যা পড়ে পাঠক আন্দাজ করতে পারবেন আমার গদ্য আসর কবিতা কেন ভিন্নপথযাত্রী,” কলকাতা-কেন্দ্রিক ন্যাকাচিত্তির সাহিত্যের এঁদো কপচাবাজি এবং তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি-করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে আজ থেকে তিপ্পান্ন বছর আগে দানা বেঁধেছিল বাংলা সাহিত্যের প্রথম আভাঁগার্দ আন্দোলন ----- হাংরি জেনারেশন।  যা ছিল আক্ষরিক অর্থেই কলকাতার বাইরের কবি-লেখকদের নয়াল সংযোজন। তাঁরা এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বাংলার তথাকথিত ভদ্রায়তনিক সংস্কৃতির কোনও শিস-ই গজাবার নয়। জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় যেখানে। হাংরি সাহিত্যের কলিন অধ্যয়নে এই প্রেক্ষাপটটি সর্বাগ্রে মাথায় রাখতে হবে। এই হাঙ্গামার প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরীর শৈশব অতিবাহিত হয়েছিল বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে।  তাঁর টায়ার ছোটবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যাসিত দরিয়াপুর মহল্লায়। সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে করে মলয়ের বেড়ে ওঠা। সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী শঠতার সাক্ষী, স্পেঙলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্ত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টিদোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালেখির মাঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই ছিল।”  

         আমি আমার বিভিন্ন উপন্যাসে পটভূমি অনুযায়ী গদ্যবিন্যাস গড়ার চেষ্টা করেছি, প্রথম উপন্যাস ‘ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস’ থেকে এই সিরিজের পাঁচটি উপন্যাসে, সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ উপস্হাপনের জন্য ভাষাকে ব্যবহার করেছি । ‘নামগন্ধ’ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকায়, তবুও সেখানকার আলোচকরা বইটি পড়ে তারপর হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে মুখ খোলার কথা ভাবেননি । আমার ডিটেকটিভ উপন্যাস ‘অলৌকিক প্রেম ও নৃশংস হত্যার রহস্যোপন্যাস’ সম্পর্কে বহতা অংশুমালী লিখেছেন, “এই উপন্যাসে, প্রথম বাংলা উপন্যাসে আমরা দেখতে পেলাম অপরাধ জগতের ব্যক্তিনির্ভরতার ঊর্ধ্বে সিস্টেমটাকে। আমরা দেখতে পেলাম রাষ্ট্র কোথায় অপরাধী। কিভাবে তুরুপ উপজাতির মানুষদের উৎখাত করে ফেলে খনি-মাফিয়া খনির লোভে। কিভাবে ক্যাপিটালিজমের, ব্যবসায়িক উদারনীতির, শিকার হয় অরণ্যের মানুষ। যাদের রাষ্ট্র কিচ্ছু দেয় না, যাদের “সমাজ” ব্যবস্থা , নীতিব্যবস্থা কে রাষ্ট্র স্বীকারই করে না , যাদের ভোটাধিকার নেই, পৌরসুবিধা নেই , তাদের কিভাবে অনায়াসে একটি মাত্র পুলিশ চৌকির অন্তর্গত করে ফেলে রাষ্ট্র। মায়া ও নিরঞ্জন যখন তুরুপ গোষ্ঠীর বাচ্চাদের শিক্ষিত করতে থাকেন , কিভাবে সেই মানবিক প্রচেষ্টা কে পুলিশ অবলীলায় বলে ‘উপজাতিদের পড়াশুনা শিখিয়ে তোমরা যে এই অঞ্চলের ভারসাম্য নষ্ট করছিলে সে সংবাদ আছে আমাদের কাছে ।’ এই ভারসাম্য ফেরত আসে , যখন সমস্ত আদিবাসী অরণ্য ছাড়া হয়ে খনিশ্রমিকে পরিণত হয়। কনজিউমার সোসাইটির প্রয়োজন তো সত্যই , কিন্তু আরণ্যক উপজাতির সত্যটুকুর কোনো দাম থাকে না রাষ্ট্রের চোখে । সবুজ নষ্ট হয়ে যায় । মাটিতে বড় বড় হাঁ করা গর্ত তৈরি হয়। কারণ খুঁড়েছে মাফিয়া, কোন বিবেকবান রাষ্ট্র নয় ।” 

          এই উপন্যাসে আমার ভাষাশরীরে অশ্লীলতা নিয়েও এরকম মন্তব্য করেছেন বহতা অংশুমালী, “মলয় রায়চৌধুরী সেই অর্থে অশ্লীল যে অর্থে ডি এইচ লরেন্স বা গ্যাব্রিয়েল গারসিয়া মারকেজ অশ্লীল ছিলেন। যখন ‘লেডি চ্যাটার্লিস লাভার্স’ এ কনির মনে হয় নারীকে তার নারীত্ব থেকে ছিনিয়ে নিচ্ছে আজকের পুরুষ আর সমাজ, বহু বায়বীয় কথার মধ্যে দিয়ে তার শরীরী রহস্য আর দেহোত্তীর্ণতা দুটোকেই নষ্ট করছে, তখন কংকাল প্রেমিক পরম যত্নে ধুইয়ে দেন প্রেমিকার অঙ্গ প্রেমিকার অনুজ্ঞায়, ঋতুস্রাবের পর। এই স্পর্শ আমাদের পরিচিত যৌনতার থেকে অনেক ঊর্ধ্বে। এখানে ভালোবাসা যে কোনো ‘ইজম’ কে অতিক্রম করেছে। লজ্জা ঘৃণা ভয় ত্যাগ করেছেন কৃষ্ণ এখানে, শুধু রাধা বা গোপিনীর দল নয়। এই ভালোবাসায় নিরঞ্জন নিষিক্ত হতে থাকেন মায়ার সঙ্গে , সভ্যতা-ছেঁকে পাওয়া সভ্যতায় । মেয়েদের যৌনতাকে সমাজ সাধারণতঃ অশ্লীল মনে করে। এই উপন্যাসে লেখক সেই ঢেকে যাওয়া অর্ধেক আকাশকে টেনে নিয়ে এসেছেন অনেকখানি। নিরঞ্জনের কৈশোরে মিলি, তাদের খেলাধুলোয় কেবল কৃষ্ণেন্দ্রিয় প্রীতি ইচ্ছা দেখায় না। সে আগে নিজে তৃপ্ত হয়ে নেয় নিরঞ্জনের মাধ্যমে। তারপর নিরঞ্জনকে নিয়ে যায় শিখরে। এই দেয়া নেয়ার সহজ হিসেবটুকু এই টেণ্ডারনেসের সঙ্গে আমি সচরাচর পাই নি কোন বাংলা উপন্যাসে। এই প্রসঙ্গের অবতারণা যখনই হয়েছে, কিছু বিকৃতির সঙ্গে করা হয়েছে। আবার লরেন্সের থেকে ভাবটি উদ্ধৃত করতে ইচ্ছে করে— স্পর্শ ছাড়া কিই বা টিকে থাকে, শেষ পর্যন্ত দেহে মনে অস্তিত্বের শিকড়ে ? যদি স্পর্শ তেমন স্পর্শ হয় ।”

        আমার ‘নখদন্ত’ উপন্যাসে আমি বিভিন্ন গল্পের প্রবেশ ঘটিয়েছি এবং সেই গল্পগুলোর গদ্যবিন্যাস মূল ন্যারেটিভ থেকে ভিন্ন, চটকলের মজুর খুন করায় পুলিশের অত্যাচারের শব্দাবলী ব্যবহার করেছি, ডায়েরির ও নোটসের টুকরো রেখেছি যাদের গদ্যবিন্যাস ভিন্ন । ‘আরেকবার ক্ষুধিত পাযাণ’ বড়ো গল্পে আমি প্রয়োগ করেছি সাধুবাংলা, বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের প্যাশটিশ । জীবনানন্দের ‘আটবছর আগের একদিন’ কবিতাটিরও প্যাশটিশ লিখেছি । প্যাশটিশ হলো একটি পোস্টমডার্ন টেকনিক । ‘হৃৎপিণ্ডের সমুদ্রযাত্রা’ উপন্যাসে প্রয়োগ করেছি ভাষার লেভেল জামপিং, ইনটারলকিং এবং রাইজোম্যাটিক প্রক্রিয়া । আমি একটা ইরটিক উপন্যাস লিখেছি, ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’, এতে কোনো অশ্লীল বা যৌন শব্দাবলী নেই ; তিনটি বিভিন্ন গদ্যবিন্যাস প্রয়োগ করেছি, একটি একজন অধ্যাপকের ডায়েরিতে বিদ্যায়তনিক গদ্যে লেখা তাঁর দার্শনিক মতামতের ফাঁকে-ফাঁকে আরও দুজনের ডায়েরি, একজন যুবকের হিপিনি ও বাঙালি বধুসঙ্গের যৌন বিবরণ, সাধুভাষায় লেখা, এবং বাঙালি বধুটির যৌনকর্মের বিবরণ, আটপৌরে ভাষায় লেখা । বস্তুত আমার, সুভাষ ঘোষের, সুবিমল বসাকের, অবনী ধরের, বাসুদেব দাশগুপ্তের উপন্যাসগুলো সবসুদ্ধ শতাধিক হবে, কজনই বা পড়েছেন সন্দেহ, অথচ না পড়েই অনেকে অনেকরকম মন্তব্য করতে থাকেন । সুতরাঙ হাংরি আন্দোলনকারীদের ভাষা বলতে কোনো নির্দিষ্ট একটা কমপারর্টমেণ্টে তাকে আটক রাখা ভুল হবে ।

         হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন । হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে । অতএব যে কয়েকটি ক্ষেত্রে গবেষকরা একমত সেগুলি এখানে তুলে ধরা  যেতে পারে : (১). পত্রিকার নামকরণ : হাংরি আন্দোলনের পূর্বে পত্রিকার নাম হতো কবিতা, পূর্বাশা, অরণি কৃত্তিবাস, অগ্রণি, শতভিষা,উত্তরসূরী, ধ্রুপদী, সংবেদ, ক্রান্তি, চতুরঙ্গ ইত্যাদি । হাংরি আন্দোলনকারীরা যে-ধরণের নাম রাখার চল করলেন তা বৈপ্লবিক । ফলে তার পর থেকে পত্রিকার নামকরণে বিপুল পরিবর্তন ঘটল । যেমন, কৌরব, আবার এসেছি ফিরে, মানুষের বাচ্চা, ঢ়পের কাগজ, আমি আর লীনা হঁটে চলেছি, ক্ষেপচুরিয়াস, দিল্লী হাটার্স ইত্যাদি । (২) সাবঅলটার্ন বা নিম্নবর্গ থেকে সাহিত্যক্ষেত্রে আগমন, যা কবিতা, কৃত্তিবাস, শতভিষা, ধ্রুপদী ইত্যাদি পত্রিকায় দৃষ্টিকটুভাবে অনুপস্হিত থাকতো । হাংরি আন্দোলন প্রথম যৌথভাবে প্রন্তিকের ডিসকোর্সকে স্হান করে দিল । (৩). পাঠবস্তুতে মুক্তসূচনা ও মুক্তসমাপ্তির প্রচলন ,বিশেষ করে প্রদীপ চৌধুরী, ফালগুনী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র ও শৈলেশ্বর ঘোষের কবিতা-বিশেষ যেখান থেকে ইচ্ছা পড়া যায়, স্তবক ও পংক্তি উপর-নিচ রদবদল করে পড়া যায় । একই প্রক্রিয়া গদ্যে এনেছেন সুভাষ ঘোষ, সমীর রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায় ও সুবিমল বসাক । (৪). মনস্হিতি প্রকাশকালীন অব্যয় শব্দ কবিতায় প্রয়োগ; যেমন ওঃ, আঃ, আহ, আআআআআআআহ‌,, উঃ, শ্যাঃ, ফুঃ, হাহ ইত্যাদি, বিশেষ করে মলয় রায়চৌধুরী, প্রদীপ চৌধুরী ও ফালগুনী রায়- এর কবিতায় । (৫). পাঠবস্তুতে অনুক্রমহীনতা প্রয়োগ : বাক্যবুননে লজিকাল ক্র্যাক বা যুক্তিফাটল প্রয়োগ যা দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখের কবিতার বৈশিষ্ট্য । সত্তর দশকের পর পশ্চিম বাংলায় এই প্রক্রিয়াটি অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে । (৬). গুরুচণ্ডালী শব্দগঠন ও বাক্য প্রয়োগ যা হাংরি আন্দোলনকারীদের পূর্বে নিষিদ্ধ ছিল বর্তমানে আকছার হয়ে গেছে । (৭). ভঙ্গুর বাকপ্রতিমা প্রয়োগ । হাংরি আন্দোলনকারীদের কবিতায় একটি ছবি সম্পূর্ণ গড়ে ওঠার আগেই তা মিলিয়ে গিয়ে আরেকটি ছবি ভেসে ওঠে । বাংলা কবিতায় এটি এখন প্রতিষ্ঠিত শৈলী । (৮). যৌন চিত্রকল্প, অশ্লীল শব্দ, গালমন্দ, নিচুতলার অভিব্যক্তি যা পাঁচের দশক পর্যন্ত পাঠবস্তুতে নিষিদ্ধ ছিল তার যথেচ্ছ প্রয়োগের সূত্রপাত করে গেছেন হাংরি আন্দোলনকারীরা । (৯). তাঁদের পাঠবস্তুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিস্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য লিখেছেন যে সেগুলো "সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত, প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া, এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক" । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, "ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল ভাংচুর" করেছেন তাঁরা, এবং "যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তাঁরা নিরপেক্ষ হয়ে যান" ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন