বিশ্বসাহিত্যের মনমর্জি বদলায় সময়ের হাওয়া । আমরা কি লিখব, কি বলতে চাই তা নিয়ন্ত্রণ করে আমাদের সময়, সমাজ । মানুষের অস্তিত্ব নিয়ে সময় খেলা করে । রাজনীতি, অর্থনীতি মানুষের চিন্তাশক্তিকে প্রভাবিত করে । ‘মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ কথাটি একটি মিথের মতো । আছে, কিন্তু বাস্তব উপস্ইতি খুব স্পষ্ট নয় । ‘সভ্য’ বিশ্বে বলার অধিকার দেব, কিন্তু কি বলবে তা পপত্যক্ক্ষে বা পরোক্ষে আমিই নির্দিষ্ট করে দেব -- উপনিবেশবাদের এই প্রচলিত কাঠামোর বাইরে খুব বেশি এগোনো যায়নি আজকের সময়ে দাঁড়িয়েও । তবু কিছু ব্যতিক্রমী মানুষ টিকে থাকতে চায় প্রতিবাদ নিয়ে, সত্যকে আঁকড়ে । পারিপার্শ্বিকের প্রবল চাপেও অনড় হয়ে থাকা এই একরোখা মানুষের হাতেই তৈরি হয় এক-একটি কশাঘাতের মতো শিল্প-সাইত্য, যা আছড়ে পড়ে শাসকের মুখে । শোষিত জনগোষ্ঠী থেকেই জন্ম নিয়েছেন গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস, যাঁর কলমে রূঢ় বাস্তব হল জাদু, আর যে জাদু চপেটাঘাত করল বাস্তবকে । এমনই সব জাতি থেকে মাথা তুললেন সলমন রাশদি, আলেহো কার্পেন্তিয়ের, ওরহান পামুক, নবারুণ ভট্টাচার্যরা । যাঁরা শিখিয়ে দিলেন ঠাট্টা করতে, যাঁরা এতদিনের কুড়িয়ে পাওয়া লাঞ্ছনা, অপমান দিয়ে তৈরি করলেন শানিত অস্ত্র । জাদুবাস্তবতার ইতিহাস একটি সম্পূর্ণ জাতির ইতিহাস। পাশাপাশি পৃথিবীতে যেখানে যতো জাদুবাস্তবতার সৃষ্টি হয়েছে বা হবে, প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিহাস একটি বিশিষ্ট ভূমিকা নেবে ।
লাতিন আমেরিকার প্রেক্ষাপট থেকে জন্ম নিয়েছিল জাদুবাস্তবতা, বাংলা কথাসাহিত্যে জাদুবাস্তবের প্রবেশ কবে, কখন, কিভাবে ঘটল তা ঠিক নির্দিষ্ট করে বলা যায় না, যেমন বলা যায় না লাতিন আমেরিকার ক্ষেত্রেও। স্পেনীয় ও পরে লাতিন আমেরিকার দেশগুলিতে অকথ্য অমানবিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে বহুকাল ধরেই প্রতিবাদের পন্হা খুঁজছে মানুষ । মার্কেস তাঁর নোবেল পুরস্কার প্রাপ্তির সময়ে বলেন, জাদুবাস্তবতা হল ‘exaggerated proportion of reality’. তিনি জাদুবাস্তবতার ব্যাখ্যায় নোবেলপ্রাপ্তির দিন বলেছিলেন :
“লাতিন আমেরিকা ও ক্যারিবিয় অঞ্চলের মানুষদের জীবনে এই জাদুবাস্তবতা কোনো আরোপিত ব্যাপার নয় । এটা তাদের সঙ্গেই বাঁচে সব সময় । প্রতি মুহূর্তে নির্ধারিত করে দেয় অসংখ্য মৃত্যুকেও।” ( গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস ও একশো বছরের নিঃসঙ্গতা, সুচেতন মিত্র, মহাযান সাহিত্যপত্র, ৯ম সংখ্যা, নভেম্বর ২০১০, পৃষ্ঠা ৩৪ ) ।
জাদুবাস্তবতা আসলে একটি ধারণা, যার আত্মা ঘোর বাস্তব এবং শরীর কল্পনা ও উপকথা দিয়ে গড়া । দীর্ঘদিনের কিছু অবদমিত লাঞ্ছনা, অত্যাচারের ক্ষত ব্যুমেরাং করে শাসকের দিকে ফিরিয়ে দেওয়ার পদ্ধতি জাদুবাস্তব রচনাধারার মধ্যে রয়েছে ।
প্রায় দুশো বছরের ইংরেজ শাসনের পর ভারতবর্ষের অলিগলিতে যে কলোনিগুলি ঔপনিবেশিকতার অভিশাপ বহন করে চলেছে, জিবন সেখানে থমকে দাঁড়ায় । দুশো বছরের শাসনের প্রভাব প্রায় হাজার বছর ধরে অবদমন করবে ভারতীয় চিন্তা চেতনাকে । যুদ্ধপরবর্তী সময় থেকেই ভারতীয় যুবসমাজের উপর পরিচয়হীনতার যে অভিশাপ নেমে আসে, তাতে জেরবার হয়ে শিক্ষিত যুবকের দল শুরু করেন নানা সাহিত্য আন্দোলন । এ বিষয়ে পাশ্চাত্যের তরুণ সম্প্রদায়ের কয়েকটি আন্দোলন তাঁদের পথ দেখায় । বিহার ও বাঙলার শিক্ষিত যুবকদের সৃষ্ট এমনই একটি সাহিত্যনির্ভর ও ইস্তাহার নির্ভর বহুবিতর্কিত আন্দোলন ‘হাংরি জেনারেশন এর বহু লেখায় জাদুবাস্তবের বিমূর্তরূপ ধরা পড়ে ।
‘অতলান্তিক’ সাহিত্যপত্র থেকে হাংরির সূত্রপাতের ইতিহাস কিছুটা উদ্ধৃত করব : “১৯৬১ সনে পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্র বাইশ বছরের বাঙালি যুবক মলয় রায়চৌধুরী কবি চসারের ‘ভয়ানক কবিতা টুকরো In the sowre hungry tyme’ পড়ে hungry শব্দের দ্যোতনা ও অভিঘাতে অনুরূপ উত্তেজিত হন ।”( নন্দলাল শর্মা, হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ষষ্ঠ বর্ষ, দ্বিতীয় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ১৮ ) ।
ঢেকে রাখা ‘সভ্য’ সমাজের ছ্যুঁৎমার্গ ও নিম্ন অর্থনৈতিক সঙ্গতির মানুষকে তাদের না-করা অপরাধের শাস্তি দিতে আগ্রহী হিন্দু সমাজের প্রচলিত পন্হার প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে হাংরি আন্দোলন । যাঁরা দিতে পারেননি নিরাপদ ভবিষ্যত, দেহ মনের সুস্হ গঠনের সাহায্য করতে পারেননি, তরুণ প্রজন্মের আশা-আকাঙ্খা সুখ স্বপ্ন যৌনতা কোনো কিছুর ভারই যে সমাজ বা যে পরিবার নেয় না, সেই সমাজের দেওয়া রুক্ষ ও ক্রুর নিয়মের ভণ্ডামিকে দুহাত দিয়ে ছিঁড়তে চেয়েছেন এই তুণরা । মলয় রায়চৌধুরী ও সমীর রায়চৌধুরীর নেতৃত্বে গড়া এই আন্দোলনে অরুণেশ ঘোষ, দেবী রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, অবনী ধর, সুবো আচার্য, পপদীপ চৌধুরী, ত্রিদিব মিত্র, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সৈয়দ মুস্তফা সিরাজ প্রমুখ প্রতিভাবান কবি-লেকক যুক্ত থেকেছেন নানা সময়ে ।
এই সন্দর্ভের মূল আলোচ্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’, ‘নামগন্ধ’ একত্রে ‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’, ‘এই অধম ওই অধম’ ও ‘নখদন্ত উপন্যাস ।
‘অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা’ উপন্যাসটি গুরুচণ্ডালী প্রকাশনার চটি সিরিজের মাত্র ৯৬ পাতার উপন্যাস । এই স্বল্প পরিসরেই উপন্যাসটি যেন সংস্কারের সাজানো সাজানো পাঁচিলে একটি ইঁট সরিয়ে নেওয়া । মিশ্র সংস্কৃতি ও সংকর সংস্কৃতির ফাঁকে পড়ে বাঙালি সমাজে প্রচ্ছন্নভাবে প্রবাহিত হয়েছে পঙ্কিলতা, এসেছে স্বৈরাচারিতা । উপন্যাসের শুরুতে যে দুজনের উল্লেখ পাই, তারা আধুনিকতার শীর্ষে বসবাসকারী দুজন বাঙালি যুবক-যুবত, বাংলা পড়তে-লিখতে রীতিমত অনভ্যস্ত । ব্যানার্জি বংশের মেয়ে ইন্দিরার তেইশ বছর বয়সে একটি গুজরাতি বিয়েও সংলগ্ন ডিভোর্স দুইই সারা হয়ে গেছে । সুবীর দত্তও শিক্ষিত, ভালো চাকুরে যুবক খ একটি ফিরে পাওয়া ডায়েরির সূত্রে উভয়ের আলাপ, কিন্তু সেই ডায়রি আবিষ্কার করবে তাদেরই পূর্বপুরুষের শরীরী উদ্দামতার পাশবিক কাইনি । পুরুষত্বহীন স্বামীর হাতে মার খাওয়া কেকা একের পর এক পুরুষদের ব্যবহার করে পৌঁছে যায় এমন এক উপলব্ধিতে যেখানে শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত থাকা যায় । অন্য দিকে শিশির বা অতুলরা মজেছে শ্বেতাঙ্গিনীদের শরীরী নেশায় । নেপালের, বেনারসের পথে ঘাটে পাওয়া সেই সব মুক্ত বিহঙ্গ-বিহঙ্গীর দল জীবনের নামে জয়ধ্বজা উড়িয়েছিল । মলয় তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস ‘রাহুকেতু’-তে লিখেছেন
“ষাটের দশকের কথা তো । সে সময়ে ফান ফুড ফ্রিডাম ফ্রিক আউট আর ফাকিং-এর উদ্দেশ্যে দলে দলে তরুণ তরুণী আমেরিকা ইউরোপ এমনকি জাপান থেকেও নিজেদের বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে পড়তেন ; লণ্ডন বা আমস্টারডাম হয়ে বাসে, ট্রেনে হিচহাইক করে তুরস্ক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান ভারত হয়ে শেষ গন্তব্য নেপাল । “ ( পৃষ্ঠা ৬২ )
শিশিরের কাছেও শরীর ও শারীরীক উথ্থান-পতন ভিন্ন কোনো মানসিক অনুভূতির প্রয়োজন নেই । অতুলও নারী থেকে নারীতে যাতায়াত করে ও শেষে ডিপ্রেশনের শিকার হয় । এই বিস্তীর্ণ পটভূমি ও এতগুলি চরিত্র আসলে একটি সময়ের সাক্ষী । রাবীন্দ্রিক বাণী তাই ‘এঁটোকাঁটা’য় পর্যবসিত হয় । বলিউডি ছবির অনুকরণে কেকার সম্ভোগকলা, শিশিরের লেখা দিনলিপির জড়তাময় ভাষা আরেকবার বিদ্রুপের ব্যুমেরাং ছুঁড়ে দেয় শ্লীল বাংলা সংস্কৃতির দিকে । আসলে সুস্হ জীবন প্রসবে অক্ষম এই মেকি শ্লীল সমাজের বিদ্রূপভারই মলয়ের জাদুবাস্তবতার মূল উপাদান ।
‘ছোটোলোকের ছোটোবেলা’ ও ‘এই অধম ওই অধম’
মার্কেস জাদুবাস্তব আলোচনায় বলেছেন, লাঞ্ছনার ইতিহারে পরিবারের ভূমিকা থাকে । জাদুবাস্তবের একটি উপাদান মাকফেস ও মলয়ের জীবনে সমান্তরাল ঘটেছে । তা হল, উভয়েই নিজের বয়স্কা আত্মীয়ার কাছে অলৌকিক গল্প বলার পাঠ পেয়েছেন । মার্কেস একটি সাক্ষাৎকারে জানিয়েছেন,
“তিনি ( মার্কেসের ঠাকুমা ) সেইসব জিনিস বলতেন যেগুলোকে অতিপ্রাকৃত আর আজগুবি শোনাত, কিন্তু তিনি বলতেন সেগুলো একেবারে স্বাভাবিকভাবে ।” ( ‘দীর্ঘ সাক্ষাৎকার : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস’, পিটার এইচ স্টোন, বয়ান, ত্রৈমাসিক পত্রিকা, মার্কেস স্মরণ সংখ্যা, ১ম বর্ষ, ২য় সংখ্যা, জুন ২০১৪ )
মলয় যেমন বলেছেন, বড়ো জ্যাঠাইমার অসামান্য গল্পরচনার প্রতিভা:-
“আমরা দালানে ওনাকে গিরে বসতুম, আর লন্ঠনের আলো কমিয়ে উনি নিয়ে যেতেন গল্পের দেশে ।...জেঠিমার গল্পের জগত ছিল অলৌকিক…” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৪৫ )
সস্তার জীবন যাপনের জন্য বিহারী ছোটোলোকদের পাড়ায় বসবাসকারী বালকের ন্যারেশন ভোজপুরি মগহি পরিচারকদের সান্নিধ্যে শেখা তুলসীদাসি দোহা, হতদরিদ্র প্রতিবেশীদের পোকামাকড়ের মতন জীবনযাপন, স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের নগ্নচিত্র দেখায় । সংকরায়িত পরিবেশে আত্মপরিচতি খোঁজা বয দুরূহ কাজ । তার ওপর যুক্ত হয় লৌকিক বিশ্বাস, তুক-তাক, আচার-বিচার ও যৌনতার নতুন সব অনুভূতি । মামাবাড়ির ভদ্র পরিবেশ আরো স্পষ্ট দেখায় পাটনার নিম্নমানের জীবনযাপনের গ্লানি । বালক মলয় শিখে যান :-
“মামার বাড়ির কেউ কখনও পাটনায় যান না । আমরা তো ছোটোলোক।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা, পৃষ্ঠা ৫৯ )
অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারের পাশাপাশি বালক জেনেছিল মেজদা, অর্থাৎ বড়জ্যাঠার পালিত পুত্র আসলে তার ‘কেনা ভাই’ । ‘দেবতুল্য’ জ্যাঠামশাই এক পাঞ্জাবি বউয়ের কাছে দেড়শো টাকায় কেনা বাচ্চাটি আসলে জেঠামশাইয়ের অবৈধ সন্তান । যাকে ফিরে পুষ্যি নিয়ে ক্রমাগত স্লো পয়জনিং করেছেন জ্যাঠা-জ্যেঠিমা । পড়তে পড়তে মনে হয় ইমলিতলার কোনো বাস্তবিক ভৌগলিক অবস্হান না থাকলেও চলত । নাম-কা-ওয়াস্তে স্বাধীনতা পাওয়ার পর পুরো ভারতবর্ষই বোধহয় কমবেশি ইমলিতলা ছিল । শিক্ষাহীন, স্বাস্হ্যহীন, স্মৃতিহীন স্বাধীনতা উত্তরকালের ভারতবর্ষের চেহারা ছত্রে-ছত্রে বহন করে এই যুগ্ম উপন্যাস । উপন্যাসে অনেক জাদুর পাশাপাশি কিছু অসামান্য বাস্তব আছে । ভারতবর্ষের সমৃদ্ধ গ্রামগুলির চেহারা এতদূর কদর্য ও অর্থনৈতিক অবস্হা এমন পঙ্গু হওয়ার জন্য ছিল দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা :-
“ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমলে, পুঁজি বানাবার কলকাঠি কব্জা করার ধান্দায় সাবেকি গ্রামের সমাজকে দুমড়ে মুচড়ে তার নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে থাকার ক্ষমতা নষ্ট করে দিয়েছিল ইংরেজরা । ব্যাটারা মহা ঘোড়েল । যাবার সময় চাদ্দিকময় হেগে রেখে গেছে ।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১১২ )
এই বিষ্ঠা আসলে সেই স্মৃতিহীন মানব সমাজের দেহে মনে মাখামাখি হয়ে বিষাক্ত করে তোলে, দুর্গন্ধময় পঙ্কিল করে তোলে তাকে । ‘এই অধম ওই অধম’-এ পূর্ব কাহিনির নিরবচ্ছিন্নতা বজায় থাকে, শুধু যুক্ত হয় লেখকের স্মৃতিতে রয়ে যাওয়া সেই সব তুলসীদাসী পঙক্তিগুলি, যেগুলির সাথে জড়িয়ে রয়েছে লেখকের শৈশবস্মৃতি । ইমেল আদান-প্রদানে মলয় জানিয়েছিলেন :-
“হিন্দি কোটেশানগুলো তুলসীদাস-এর রামচরিতমানস, কবির এবং রহিম-এর দোহা থেকে নেয়া । বাড়ির চাকরদের তো আমাদের বকুনি দেবার অধিকার ছিল না, তাই ওরা কোটেশানের মাধ্যমে উপদেশ দিত ; তারা নিরক্ষর হলেও, শৈশব থেকে শুনে-শুনে ওগুলো তাদের স্মৃতি থেকে উৎসারিত । বইটায় আমার ন্যারেটিভের সমান্তরাল এগিয়েছে ওদের ন্যারেটিভ।”
ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়েছে, মেজদা বুড়ো অর্থাৎ পাড়ার বুঢ়ুয়া কেবলই রক্তমাংসের অস্তিত্ব নিয়ে নেই, তার অবয়ব আসলে রূপকায়িত করে পোস্টমডার্ন কলোনিয়ালিজমের সেই অপরিণত সময়কে, যাকে দাঁড়াতে হয়েছিল শত্রুপক্ষীয় স্বজন, লক্ষহীন ভবিষ্যৎ, প্রবৃত্তির নিষিদ্ধ লোভনীয় হাতছানির প্রতিস্পর্ধায় । ভোজপুরি যে মাকে তার পিতা সন্মান দেননি, সেই ক্ষোভ নিয়ে সে পিতার গোষ্ঠীবিরোধিতা করে ।
“ভোজপুরি মগহিতে গালাগাল ছিল মেজদার নান্দনিক ঔদ্ধত্য । ভাষার আদরায় রদবদল করে জীবনে পরিবর্তনের সংকেত পাঠাতে চাইত।” ( এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৭ )
আসলে পাটনার ছোটোলোকপাড়ার অবস্হান বঙ্গসংস্কৃতির খণ্ডহরস্বরূপ । যার ঝুরঝুরে চুনসুরকি খসা অস্তিত্ব মানতে পারা সহজ নয় ।
“জমিদারি বেনেদিয়ানার ধুলোবালি ঝেড়ে ফেলে উঠে দাঁড়াতে চাইছিলুম আমরা ছোটোরা সবাই,....মেজদা ঝেড়ে ফেলতে চাইছিল অতীতত্বের ক্ষীণ রেশটুকু, যা ঘাপটি মেরেছিল আমাদের পারিবারিক ভাষার আদরায়।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ৯৫ )
সাস্কৃতিক ধ্বসন ঠেকানোর উপায় নেই বলে গড়ে ওঠে প্রতিস্পর্ধা । হাতিয়ার করে জাদুবাস্তবকে । সাতজন বন্ধু মিলে একটা আইসক্রিম চেটে খাওয়া, নোংরা নর্দমা থেকে হাত দিয়ে বল তুলে নেওয়া, মৌর্যদের চৌর্যবৃত্তি এক বাস্তব, আর জেঠিমার গল্প, পুঁটির গল্প, ছোটোকাকিমার শাক্তবচন, সীতাদেবীর কুঁয়োয় ঝাঁপ, জাদুটোনা, ‘কালিদাসের কলম দিয়ে লেখা মেয়েমানুষ’, বিহারি পুলিশ অফিসারের মতন কেঁদো কুকুর...একের পর এক ছবি, যা দিয়ে গড়া হয় জাদু । এই সরস উপাখ্যান শেষ হয় একটি চাবুকের দ্বারা:-
“জেঠিমা ছোড়দিকে বলছেন, ‘করুণার ঘর থেকে বুড়োর সমস্ত জিনিসপত্তর নিয়ায়...কবচ-কুণ্ডল সব, চিতার সঙ্গে ওগুলোও ছাই করে ফেলতে হবে । কোনো রেশ যেন না থাকে।” ( ছোটোলোকের ছোটোবেলা/এই অধম ওই অধম, পৃষ্ঠা ১৪৪ )
আমাদের পূর্বপুরুষরা আসলে এভাবেই মুছে দেবেন প্রমাণ । প্রতিবাদের, পপতিস্পর্ধার । আর তার বদলে আমরাও ছুঁড়ব ঠাট্টার ব্যুমেরাং । মলয় আসলে প্রতিনিইত্ব করলেন ক্রীড়ানক প্রজন্মের যাদের সুশীল সমাজ সর্বদা বিদ্রূপই করেছে । মলয়ের একটি অসামান্য কবিতা এ প্রসঙ্গে উদ্ধৃত করা আবশ্যক:-
“আমার মাকে যেন বলবেন না”
আমি কবিতা লিখি
কি লজ্জার, না ?
আমার বাবা কখনও স্কুলে পড়েননি
কি লজ্জার, না ?
আমার মা কখনও স্কুলে পড়েননি
কি লজ্জার, না ?
আমার ঠাকুর্দা বাংলা লিখতে পারতেন না
কি লজ্জার, না ?
আমার ঠাকুমা শুদ্ধ বাংলা বলতে পারতেন না
কি লজ্জার, না ?
………...।”
এই লজ্জা তাঁর একলার নয় । আসলে সাংস্কৃতিক অবক্ষয়ের কারণ ভারতের উত্তরঔপনিবেশিক দশা । শাণিত প্রতিবাদের ধার উপন্যাসের নামকরণ থেকে শুরু করে শেষ বাক্যটি অবধি নানা রঙের জাদুয়ি বিস্তার দেখালো ।
নখদন্ত
‘নখদন্ত’ মলয়ের আরেকটি অসামান্য পোস্টমডার্ন উপাখ্যান । এই নতুন ধরণের উপন্যাসে লেখকের প্রাত্যহিক দিনলিপি ও তাঁর নিজের লেখা কয়েকটি গল্পের প্লট ও ন্যারেটিভ পাশাপাশি চলে । মেইলে কথাবার্তায় মলয় জানিয়েছিলেন :-
“নখদন্ত ন্যারেটিভটাকে আমি শুরু থেকে একটা অন্তর্ঘাতমূলক টেক্সট হিসাবে লিখতে চেয়েছিলুম।”
রামায়ণের সপ্তকাণ্ডের আদলে সাপ্তাহিক দিনলিপিতে আধুনিক এক সংস্কৃতিময়, সৃজনশীল মানুষের বৈচিত্র্যময় অবসর জীবনের চিত্র পাওয়া যায় । পশ্চিমবঙ্গের দ্রুত পচনশীল সমাজের ভাগাড়ে রোজ পচতে থাকা মানবাত্মার তীক্ষ্ণ চিৎকার যেন তাঁর কলমে বরাবরই স্বতঃস্ফূর্তভাবে উঠে এসেছে । ‘নখদন্তে’ পাই সেই সৃষ্টির পৃষ্ঠভূমি । নিজের কয়েকটি গল্পের উল্লেখ রেখেছেন মলয় এই দিনলিপির ফাঁকে । প্রথম ‘শেষ হাসি’ গল্পে কাংগাল চামারের ওপর অসহ্য অমানুষিক অত্যাচারের পরেও মুখের হাসিতে জাদুর ছোঁয়া বজায় রাখেন তিনি । চামড়া ভেদ করে বেরুনো ভাঙা পাঁজরের হাড়ের গোলাপি সাদা রঙ যেন সজোরে চপেটাঘাত করে কোমলতার সাথে গোলাপি অস্তিত্বকে । কন্সটেবল হত্যার জন্য বস্তিতে ‘হিন্দি ফিলিম’ হয় ।
‘চামার’ হয়ে ‘রাজপুত’কে হত্যার অপরাধে কাংগাল চামারকে ছিঁড়েখুঁড়ে হত্যা করে পুলিশ । ক্ষমতা ও অর্থ দখলের বাজারে সাইনবোর্ড আর টেবিল চেয়ার পেতে ট্রেড ইউনিয়নের ধামাধারীরা চটকলগুলিকে ভুতের আড্ডা বানিয়ে চলেছে । আর কাংগাল চামাররা আমারান্তা উরসুলার ( মার্কেসের ‘নিঃসঙ্গতার একশ বছর’ ) মতো মৃত্যুকালেও মুখে সন্তুষ্ট হাসি ঝুলিয়ে রাখেন । উপেক্ষার, তামাশার হাসি । ‘শহিদ’ ও ‘জিরো নম্বর মানুষ’ একই পটভূমির ভিন্ন আঙ্গিকের কাইনি । দুটোতেই মলয় চটকল শ্রমিকের বেঁচে থাকার অলৌকিক লড়াই ও সহ্যশক্তির সাথে প্রশাসন তথা ক্ষমতালোভীদের অপার্থিব নিষ্ঠুরতার গল্প জাদুর মোড়কে পরিবেশন করলেন । ‘জিরো নম্বর মানুষ’ আবার মনে করায় আইডেনটিটি ক্রাইসিস । আত্মপরিচয়হীন মানুষ কেবলই ‘লাশ’ হয় । সে লাশের মৃত্যুর কারণ পাওয়া যাক আর না যাক, তার ধর্ম পাওয়া যায় । হিন্দু মুসলিম লাশেরা জায়গা বদলায় । চেনার উপায় শুধুই ‘নুনু’ । প্রতিবাদীতা সবই কাড়ে । সবশেষে কাড়ে পরিচয় । ‘খোসা ছাড়ানো নুনু ওয়ালা খালেদালি মণ্ডল লোপাট হয়ে যায় :-
“খালেদালি মণ্দলের দেহও নেই, আইডেনটিটিও নেই । জিরো ? অ্যাঁ !” ( ‘নখদন্ত’ পৃষ্ঠা ৫৭ )
মনে করায় মার্কেসের সেই ভয়াবহ স্মৃতি, যুদ্ধে গুলি খাওয়া এক ট্রেন শব স্রেফ লোপাট হয়ে গেল ।
সমান্তরালে ‘ভাগ্যলিখনে হরফ দরকার নেই’ গল্পে শিক্ষিত বেকার যুবসম্প্রদায়ের কীটপতঙ্গের মতো অপমানের জীবন একটি বাস্তব । কিন্তু গান গেয়ে প্রতিবাদের ঐক্যবদ্ধ হাঁক পাড়ায় জাদু আছে । চাকরির ‘কুল্লে কুড়িটা’ পোস্টের জন্য অপেক্ষমাণ আগারোশো ক্যাণ্ডিডেট চূড়ান্ত ভণ্ডামি ও বশৃঙ্খলার ধিক্কারে যে সমবেত হুমহুনা বোল ধরে, তার সাথে লণ্ডন বা জার্মানির গণহত্যার জন্য সারিবদ্ধ বন্দীর গানে মিল আছে । অসউইৎজ এর চেম্বারে ঢোকার আগেও কি এভাবেই গলা মেলাতে চাইতেন না শিকলবাঁধা বন্দিরা ?
‘অট্টহাস্য বিনির্মাণ’ গল্পটির আগা গোড়াই বিদ্রূপের তীক্ষ্ণতায় জর্জর । পতাকা বহুবার টেস্ট করেই রাখা হয় উত্তোলনের আগে, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর টানে স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় পতাকার ভূমিতে পতন আসলে একটি অসামান্য বিদ্রূপাত্মক রূপক । প্রশাসন ও রাজনীতি, ভারতবর্ষকে যেখানে স্হাপন করল, তা আসলে নেতার পদযুগল । জাদু ও বাস্তবের খেলার অসামান্য শব্দশৈলী রীতিমত ঈর্ষনীয় :-
“গরম-শেষের বুড়ো ঘাসেরা যৌনতাবর্ধক বৃষ্টিফোঁটার অপেক্ষায় । শালিকশিশুকে কেঁচো কিংবা পিঁপড়ে খুঁটতে শেখাচ্ছেন ওর মাম্মি-ড্যাডি ।...ওপারে গোটাকতক রুডিয়ার্ড কিপলিঙ টাইপের নেড়ি কুকুর।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮০ )
বস্তুত পোস্টমডার্ন ভারতবর্ষের প্রতিটি স্তরে যে পাঁক প্রবিষ্ট হয়েছে, তার থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব, তাই:-
“বাঙালির জিম্মায় হাসাহাসি করা ছাড়া আর কিছু টিকে নেই।” ( ‘নখদন্ত’, হাওয়া৪৯, পৃষ্ঠা ৮১ )
‘নখদন্ত’র নোটগুলি সম্পর্কে মলয় তাঁর মেইলে জানিয়েছিলেন :-
“নোটগুলো ইংরেজিতে এই জন্য যে ইংরেজরাই চটকলগুলো স্হাপন করেছিল এবং ঔপনিবেশিক শাসকের ভাষার মাধ্যমে দেখাতে চেয়েছিলুম তারা কেমনতর ধ্বংস করে দিয়ে গেছে --- সমাজে, সংস্কৃতিতে, ভাষায়, নৈতিকতায় ইত্যাদি । সাবভার্শনের কৌশল হিসাবেই নোটগুলো যেখানে সেখানে ঢোকানো --- যাতে নোটগুলোও রৈখিকতার সীমালঙ্ঘন করে যেতে পারে ।”
তাঁর নোটগুলির অবস্হান ও যৌক্তিকতা সম্পর্কে তাঁর এই বক্তব্য এতই সম্পূর্ণ ও স্পষ্ট যে আর কোনো ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে না ।
মানসিক চেতনার এই রূপকায়ন হল দীর্ঘ এক আত্মপ্রবঞ্চনার ফলাফল । মলব লিখেছেন :-
“রাজনীতির সেল্ফকনট্যামিনেশন তো পশ্চিমবাংলায় দেখেই চলেছি । নিজেদের আদর্শের দ্বারা নিজেরাই কলুষিত হয়ে চলেছে রাজনীতি-করিয়েরা।”
জবরদখল হতে হতে বাঙালি তার অস্তিত্ব হারিয়েছে, শুধু জমি নয়, সংস্কৃতিও বিক্রি করেছি আমরা । প্রশাসনের প্রতিটি স্তরে পার্টি নির্বিশেষে সুবিধাভোগী মানুষের সংখ্যা অগুনতি । আবিলতায় ঢেকেছে আসমুদ্রহিমাচল । মলয়ের এই সাহিত্যধারা সেই স্মৃতিহীন অস্তিত্বহীনতার ক্ষুদ্র এক প্রতিবিম্ব ।
নামগন্ধ
শেষ যে উপন্যাসটি আমার আলোচ্য, তা হল ‘নামগন্ধ’ । ঔপনিবেশিকতা ও উত্তরঔপনিবেশিক পশ্চিমবঙ্গ যে কতদূর পচনের সীমালঙ্ঘন করেছিল, তার একটা অসামান্য দলিল এই উপন্যাস । যৌনতার এক ভিন্ন পরীক্ষামূলক সম্পর্কের পাশাপাশি উপন্যাসের প্লটিঙ-এ রয়েছে দৃঢ়তা ও রহস্য । ভবেশকারা আসলে সেই ‘মার্জিনাল মেন’, আঞ্চলিক দেবতা । যাঁদের ভোগ প্রস্তুত না করে কোনো গঠনমূলক কাজ করা সম্ভব নয় । দেশভাগের পর বাংলাদেশের উদ্বাস্তুরা পুনর্বাসন পান বা না পান, উদ্বাস্তু নেতাদের আখের গোছানো ছিল দৃষ্টিকটু রকমের । মলয়ের দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ফসল এই পংক্তি :-
“পথে পোড়ানো ট্রামের ছাই মেখে বাঙালির যে সৎসমাজ, ভবেশকা আজ তার অগুন্তি সন্তানদের একজন।”
খুশিদি, যিশু, ভবেশকার এই ত্রিভূজের মাঝে জাল বিস্তার করেছে প্রাকৃতিক মায়াজালে ঘেরা নীরবতা, যৌনতার রহস্যময়তা ও বারব্রত-ঝাড়ফুঁকের কাহিনি । ব্যুমেরাং করে ছুঁড়ে দেওয়া গোপন প্রেম, দেহপুজা । যেখানে যত দারিদ্র, অপ্রাপ্তি, বঞ্চনা, সেখানে জ্যোতিষের কদর, ওঝার আদর তত বেশি । অর্থপিশাচ দাঙ্গাবাজ ভবেশকা তাই ঝাড়ফুঁকের ওঝা হয় :-
“অসীম তালোধি, ওর মেয়ের ভুতের ব্যারাম আচে । দাদা ওষুধ পথ্যি করে । রোগবালাই ঝাড়ার জন্যে রাসপা ত্রিফলা হিং রসুন শুঁঠ নিশিন্দে কুচিলা বেড়ালা হত্তুকি চিতেমূল সব বাটছিলুম একসঙ্গে ।”
ভুত ঝাড়ার মন্ত্রের সাথে মিলে মিশে যায় প্রণয় নিবেদনের মন্ত্র । খুশিদিকে এক অদ্ভুত স্হবিরতার মধ্যে আটকে রাখতে পেরে ভবেশকা পায় অধিগ্রহণের আনন্দ । কিন্তু শাপভ্রষ্টা নারীর মতো খুশিদি চায় পূজা, বন্দনা, আরাধনা, তৃপ্ত হতে চায় পুরুষের মুগ্ধতা গায়ে মেখে । ভবেশকা খুশিদিকে ভোগ করেছে কিনা বা না করলেও তা কেন করেনি তার উল্লেখ লেখক করেননি । পোস্টমডার্ন তৃতীয় বিশ্বের গ্রামের চেহারা ডায়াস্পোরিক সমাজের ভণ্ডামির প্রতিস্পর্ধী হয় । শাসন ও হুমকির ভয়ে জড়সড় গ্রামীণ সমাজের প্রতিস্পর্ধায় মাথা তোলে যিশু ও খুশিদির শরীর পূজাময় প্রেম । গার্সিয়া ‘মার্কেসের নিঃসঙ্গতার একশ বছর’-এ সেই শেষ প্রজন্ম আরোলোয়ানো ও আমারান্তা উরসুলার মিলনের মতো অলৌকিক এই প্রেম । স্বার্থপরের জিইয়ে রাখা অভাবে ও শোষণে জর্জর বঙ্গভূমির ছিবড়ে হয়েছে কল্পপ্রেমের জ্বালানি ।
“ওঃ মলয়
কলকাতাকে আর্দ্র ও পিচ্ছিল বরাঙ্গের মিছিল মনে হচ্ছে আজ
কিন্তু আমাকে নিয়ে আমি কি করব বুঝতে পারছি না
আমার স্মৃতিশক্তি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে
আমাকে মৃত্যুর দিকে যেতে দাও একা
আমাকে ধর্ষণ ও মরে যাওয়া শিখে নিতে হয়নি।”
( ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’, ‘অতলান্তিক’ হাংরি জেনারেশন সংখ্যা, ৬ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, এপ্রিল-জুন, ১৯৮৬, পৃষ্ঠা ৪০ )
মলয়ের সেই বিখ্যাত কবিতার এই পংক্তিগুলি চিৎকার করে সাক্ষ্য দেয় সেই অস্তিত্বহীন শিকড়হীন সময় ও সমাজের ক্ষুধাতাড়িত যুবসমাজের, যাদের অনুভব অনুভূতির কোনো দায় দায়িত্ব পূর্বপুরুষ বা অভিভাবকরা নেন নি । তাঁদের সেই ক্ষুধার তৃপ্তিতে তাঁরা সাহিত্যের কানাগলি অবধি সন্ধান করেছেন, কিন্তু বাংলা বাজারের শ্লীল সাহিত্যের সাথে, খাপ খাওয়াতে না পেরে সৃষ্টি করেছেন চাবুকের মতো এই সাহিত্যধারার, যা বহন করেছে জাদুবাস্তবের আগাম বীজ । বাংলা সাইত্যের লেখক-পাঠক কেউই খুব সহজে মান্যতা দিতে পারেননি হাংরিদের। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বিস্ময়াদীর্ণ হয়ে বলেছিলেন এই সাহিত্য কি পিতা মাতার সামনে পাঠ করতে পারবেন এই লেখকরা ? পিতা মাতা গুরুজন অভিভাবকের নীতি আদর্শের রক্ষণশীলতার আড়ালে নিজেরা ফুরিয়ে যেতে চাননি এই তরুণরা । ডাডাইজমের প্রবর্তক ত্রিস্তান জঁরা যেমন বলেছিলেন, আমার আগে মানুষ আদৌ ছিল কিনা আমি জানতে চাই না, তেমনি মলয়, সমীর, বাসুদব, অরুনেশরা জানতে চাননি অতীতকে, যে অতীত তাঁদের সন্মুখীন করেছে এক ক্লেদাক্ত, নোংরা সমাজের সামনে । দিয়েছে কেবলই শৃঙ্খল ও পরিচয়হীনতা । প্রতিস্পর্ধায় কন্ঠ তুলতে তাঁরা স্বঘোষিত প্রতিলেখক ।
হাংরিরা যে হেনস্তা হবেনই, তা পূর্বনির্ধারিত ছিল । কিন্তু সময় বলে দিচ্ছে প্রতিস্পর্ধার আগুন ছড়াবেই । জাদুবাস্তবের প্রয়োজন আজ সমগ্র পৃথিবী অনুভব করছে । আমার তৃতীয় বিশ্বের পূর্বসূরীদের এই বিচক্ষণতাকে সন্মান জানানোই এই সন্দর্ভের মূল উদ্দেশ্য ।
( পলাশ খাটুয়া সম্পাদিত ‘ম্যাজিক রিয়ালিজম ও বাংলা সাহিত্য’, ২০১৬, বই থেকে নেয়া হয়েছে )
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন