২২শে শ্রাবন: সিনেমায় হাংরি আন্দোলন
গত
শতকে ষাটের দশকে বেশ কিছু তরুন কবি মিলে ভিন্ন ধরনের কবিতা লেখা শুরু
করেন। তাদের কবিতাগুলো প্রচলিত ধারার যেকোন কবিতার থেকে ভিন্ন ছিল। তাদের
কবিতায় শব্দ চয়ন আপাতদৃষ্টিতে অসঙলগ্ন ছিল। সাধারণ দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে
এই কবিতায় কোন ছন্দ ছিল না, এক শব্দের সাথে অন্য শব্দের স্থাপনে কোন মিল
ছিল না, যৌনতার ব্যাপক প্রয়োগ ছিল ছন্দে-শব্দে-ভাবে। সাধারণত
শিল্প-সাহিত্যে কোন আন্দোলন সংজ্ঞায়িত করেন সমালোচকরা, কখনো কখনো
শিল্পী-সাহিত্যিকরাও এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখেন। হাংরি আন্দোলনে জড়িত কবিরা
নিজেরাই এই আন্দোলনকে ‘হাংরি আন্দোলন‘
হিসেবে পরিচিতি দেন। এই আন্দোলনই বাংলা সাহিত্যে একমাত্র আন্দোলন যা
ইশতেহার প্রকাশের মাধ্যমে হয়েছে। ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি
সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে হাংরি শব্দটি চয়নের মাধ্যমে তারা
নিজেদেরকে হাংরিয়ালিস্ট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তারা পাটনা থেকে বাংলা
প্রেসের অভাবে ইংরেজিতে একটি বুলেটিন প্রকাশ করতো – যেখানে তাদের কবিতা,
গল্প, চিত্র ইত্যাদি প্রকাশ করা হত। হাংরি আন্দোলন যারা শুরু করেছিলেন
তাদের মধ্যে সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
ইত্যাদি অন্যতম। ১৯৬১ সালের নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে ১৯৬৫ সালেই শেষ হয়ে
যায়।
হাংরি আন্দোলনের স্বরূপ বোঝার জন্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতটি পড়া যেতে পারে। এই কবিতাটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল নিম্ন আদালতে যা পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। হাংরিয়ালিস্টদের কবিতা এই অশ্লীলতার অভিযোগে এত মাত্রায় অভিযুক্ত ছিল যে প্রকাশকরা তাদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী ছিলেন না। এই অশ্লীলতা প্রশাসনকে বাধ্য করেছে কবিদের কোমরে দড়ি বাধঁতে, আদালতে মামলা ঠুকতে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতা-সংক্রান্ত হাংরি মামলায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী ছিলেন, নিম্ন আদালতে অন্যান্য সাক্ষীদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। সুনীল পরবর্তীতে এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। হাংরি আন্দোলন যতটা না বিখ্যাত তারচে’ বেশী কুখ্যাত হয়ে আছে এই অশ্লীলতার জন্য। বলা হয়, অশ্লীলতা থেকে উদ্ভুত মামলা মোকদ্দমাই এই আন্দোলনকে পরিচিত করেছে, অন্যথায় এই আন্দোলন বা কবিতাসমূহ স্মরনীয় হয়ে থাকার মত কিছু ছিল না।
ষাটের দশকে ঘটে যাওয়া এই হাংরি আন্দোলন সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা ‘২২শে শ্রাবন’ সিনেমায় স্থান পেলেও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ষাটের দশক নয়, বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীই ফুটে উঠেছে সিনেমায়। হাংরি আন্দোলন সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি বর্তমান সময়েও হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনার রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত কোন এক বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে। অবশ্য এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে।
সাইকোলজিক্যাল-ক্রাইম থ্রিলার এই সিনেমা কোলকাতা শহরে একের পর এক ঘটে যাওয়া নির্ভুল ছাপহীন নির্মম হত্যাকান্ড, খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বানিজ্যিক প্রয়োজনে ত্রিভুজ প্রেম, যৌনতার সুরসুরি আর মানসিকভাবে অসুস্থ্য হাংরিয়ালিস্ট কবি স্থলে মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হতাশাগ্রস্থ কোন কবির কাজে কোন পার্থক্য খুজে পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন শুধুমাত্র সিনেমার অলঙ্কার, অন্য কথায়, বাহুল্য।
সিনেমার খুবই উল্লেখযোগ্য অস্তিবাচক দিক হল কবি-চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের উপস্থিতি। দীর্ঘ ২৯ বছর পর তিনি ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী চরিত্রে। সত্যিকারের অভিনয় পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। গুনী এই ব্যক্তি প্রয়োজনে আবারও সামনে দাড়াবেন, সিনেমার চরিত্রকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে তুলে ধরবেন এই প্রত্যাশা করা যায়।
সব মিলিয়ে সৃজিতের পারফর্ম্যান্স কেমন ২২শে শ্রাবন সিনেমায়? ভালো না। অন্তত: অটোগ্রাফ সিনেমার ফলে যে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল, তা পূরণ করতে পারেন নি তিনি। অটোগ্রাফ সিনেমার নায়কের মতই তিনি সিনেমার বাজারে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছেন সত্যি, কিন্তু দর্শকের মনে স্থান করে নিতে প্রয়োজনে আরও সময় ব্যয় করতে হবে তাকে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিভিউতে দশে সাড়ে আট দেখে খুশী হওয়ার আগে তাকে বুঝতে হবে – আনন্দবাজার এই সিনেমার মিডিয়া পার্টনার, অর্থাৎ দশে সাড়ে আট তার যোগ্যতার বিচারে নয় বরং সিনেমার কাটতি বাড়ানোর পদ্ধতি।
এই লেখাটি ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের সংস্কৃতি পাতায় প্রকাশিত হয়েছে
হাংরি আন্দোলনের স্বরূপ বোঝার জন্য মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কবিতটি পড়া যেতে পারে। এই কবিতাটি অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত হয়েছিল নিম্ন আদালতে যা পরবর্তীতে উচ্চ আদালতে বাতিল হয়ে যায়। হাংরিয়ালিস্টদের কবিতা এই অশ্লীলতার অভিযোগে এত মাত্রায় অভিযুক্ত ছিল যে প্রকাশকরা তাদের লেখা ছাপাতে আগ্রহী ছিলেন না। এই অশ্লীলতা প্রশাসনকে বাধ্য করেছে কবিদের কোমরে দড়ি বাধঁতে, আদালতে মামলা ঠুকতে। মলয় রায়চৌধুরীর এই কবিতা-সংক্রান্ত হাংরি মামলায় শক্তি চট্টোপাধ্যায় রাজসাক্ষী ছিলেন, নিম্ন আদালতে অন্যান্য সাক্ষীদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন। সুনীল পরবর্তীতে এই আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেন। হাংরি আন্দোলন যতটা না বিখ্যাত তারচে’ বেশী কুখ্যাত হয়ে আছে এই অশ্লীলতার জন্য। বলা হয়, অশ্লীলতা থেকে উদ্ভুত মামলা মোকদ্দমাই এই আন্দোলনকে পরিচিত করেছে, অন্যথায় এই আন্দোলন বা কবিতাসমূহ স্মরনীয় হয়ে থাকার মত কিছু ছিল না।
ষাটের দশকে ঘটে যাওয়া এই হাংরি আন্দোলন সৃজিত মুখার্জীর দ্বিতীয় সিনেমা ‘২২শে শ্রাবন’ সিনেমায় স্থান পেলেও প্রতিষ্ঠিত হয় নি। ফলে ষাটের দশক নয়, বর্তমান সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীই ফুটে উঠেছে সিনেমায়। হাংরি আন্দোলন সিনেমায় এসেছে হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী’র হাত ধরে। মানসিক বিকারগ্রস্থ এই কবি বর্তমান সময়েও হাংরি আন্দোলনকে নিজের মধ্যে ধরে রেখেছেন এবং কিছুটা মানসিক বিকারগ্রস্থ হয়ে গভীর রাতে এলোমেলো ভাবে ঘুরে বেড়ান, সেলফোনে তার কবিতার বইয়ের প্রকাশক রবীন্দ্রনাথের সাথে কথা বলেন, কবিতা আবৃত্তি করে শোনার রাতের মাতালদের। এই কবি পুলিশের খাতায় তালিকাভুক্ত কোন এক বইমেলায় আগুন ধরিয়ে দেয়ার অপরাধে। অবশ্য এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত শেষ পর্যন্ত মানসিক হাসপাতালে হয়েছিল। কোলকাতা শহরে ঘটে যাওয়া সিরিয়াল কিলিঙ একসময় এই কবির দিকেই আঙ্গুল তুলে ধরে।
সাইকোলজিক্যাল-ক্রাইম থ্রিলার এই সিনেমা কোলকাতা শহরে একের পর এক ঘটে যাওয়া নির্ভুল ছাপহীন নির্মম হত্যাকান্ড, খুনিকে ধরার জন্য পুলিশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বানিজ্যিক প্রয়োজনে ত্রিভুজ প্রেম, যৌনতার সুরসুরি আর মানসিকভাবে অসুস্থ্য হাংরিয়ালিস্ট কবি স্থলে মানসিক ভাবে অসুস্থ্য হতাশাগ্রস্থ কোন কবির কাজে কোন পার্থক্য খুজে পাওয়া যাবে না। সেক্ষেত্রে হাংরি আন্দোলন শুধুমাত্র সিনেমার অলঙ্কার, অন্য কথায়, বাহুল্য।
সিনেমার খুবই উল্লেখযোগ্য অস্তিবাচক দিক হল কবি-চিত্রপরিচালক গৌতম ঘোষের উপস্থিতি। দীর্ঘ ২৯ বছর পর তিনি ক্যামেরার সামনে দাড়ালেন হাংরিয়ালিস্ট কবি নিবারণ চক্রবর্তী চরিত্রে। সত্যিকারের অভিনয় পাওয়া গেল তার কাছ থেকে। গুনী এই ব্যক্তি প্রয়োজনে আবারও সামনে দাড়াবেন, সিনেমার চরিত্রকে নিজের মধ্যে মিশিয়ে তুলে ধরবেন এই প্রত্যাশা করা যায়।
সব মিলিয়ে সৃজিতের পারফর্ম্যান্স কেমন ২২শে শ্রাবন সিনেমায়? ভালো না। অন্তত: অটোগ্রাফ সিনেমার ফলে যে প্রত্যাশা তৈরী হয়েছিল, তা পূরণ করতে পারেন নি তিনি। অটোগ্রাফ সিনেমার নায়কের মতই তিনি সিনেমার বাজারে নিজের স্থান দখল করে নিয়েছেন সত্যি, কিন্তু দর্শকের মনে স্থান করে নিতে প্রয়োজনে আরও সময় ব্যয় করতে হবে তাকে। আনন্দবাজার পত্রিকার রিভিউতে দশে সাড়ে আট দেখে খুশী হওয়ার আগে তাকে বুঝতে হবে – আনন্দবাজার এই সিনেমার মিডিয়া পার্টনার, অর্থাৎ দশে সাড়ে আট তার যোগ্যতার বিচারে নয় বরং সিনেমার কাটতি বাড়ানোর পদ্ধতি।
এই লেখাটি ২১ এপ্রিল ২০১২ তারিখের দৈনিক জনকন্ঠের সংস্কৃতি পাতায় প্রকাশিত হয়েছে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন