প্রয়াত সমীর
রায়চৌধুরী। নামটা অপরিচিত নয় কারোর। কৃত্তিবাসের বন্ধুদের সেই চাইবাসার
অফিসার বন্ধু। হাংরি মলয় রায়চৌধুরীর দাদা। এইসব পরিচয়েই চেনেন সবাই। লিটল
ম্যাগাজিন গ্রহের কেউ হলে, হাওয়া ৪৯ লিটল ম্যাগাজিনের সম্পাদক, বাংলা লেখায়
পোস্ট মডার্ন থিওরি অধুনান্তিক নামে তত্ত্বটির প্রবর্তক।হয়তো এটাও জানতে
পারেন এই অধুনান্তিক সাথে প্রভাত চৌধুরী, কবিতা পাক্ষিকের, তাঁর পোস্ট
মডার্ন তত্ত্ব উত্তরাধুনিকের থেকে আলাদা। খুব ভালো লেখক জগতের মুচমুচে
আড্ডার টপিক ছিলো এটা এককালে। কিন্তু এই মানুষটি কি, এবং লেখার জন্য বাংলা
ভাষার জন্য কতোটা করা যায়, আপনারা তার বিন্দুবিসর্গ জানেন না। (দুজনের নাম
যখন উঠলো বলিই এবার, কারন এই থ্রিলারে প্রচুর বিষ্ফোরক বিষফোঁড়ার মতো ঘটনা
যা বাংলা লিটল ম্যাগাজিন জগৎ আপনাকে যথেষ্ট শিক্ষিত মনে করেনা এই অজুহাতে
জাস্ট চেপে রেখে দেয়, সেরকম অনেক কিছুই থাকবে। বলা প্রয়োজন এখন।) এই
প্রভাতবাবুর কবিতা পাক্ষিক থেকে অনেকের বই বেরোচ্ছে পরপর। কবিতা পাক্ষিকের
কবি হিসেবে স্ট্যাম্প গায়ে লাগাতে অনেকেই লোলুপ। এবং এককালে মর্যাদাপূর্ণ
ডিগ্রীর মতো তাকে বহন করে বেরিয়েছেন, এবং সময় এলে জাস্ট পাতি ছুঁড়ে ফেলে
দিয়েছেন। শূন্য দশকের এক অতি ক্রুদ্ধ প্রতিভাবান লেখকই এই তালিকায় আছেন।
কিন্তু ওসব অন্ধকারের কথা নয়। সমীরদার কথা বলছি, উনি ছিলেন এক নিঃশব্দ, এবং
কেউ জানতে না পারা “ভিজিলান্তে” বা যারা নীরবে পাহারা দেয়, আছে বলে বোঝা
যায় না। বাংলা কবিতার জগৎ ওনার চেয়ে ভালো বোধহয় কেউ জানতো না। অথচ অনেক
তরুণ কবি কল্পনাতেও রাখতে পারবেন না যে সমীর রায়চৌধুরী ওর প্রত্যেকটি লেখা
শুধু মনে দিয়ে পড়া নয়, নোট নিয়ে পড়েছেন, ভেবেছেন, আলোচনা করেছেন। উনি
জানতেন ঢক্কানিনাদ কি পরিমাণ ক্ষতিকর। ২০১৪ সালে কোনো এক শীতের খুব সকালে,
দুর্গাপুরে ঘুমোচ্ছি আমি, একটা ফোন আসে। ঘুমচোখে ধরতে শুনি “নমস্কার, আমার
নাম সমীর রায় চৌধুরী। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞেস করার আছে। অসুবিধে নেই
তো?” বেজায় ঘাবড়ে গিয়ে উঠে পড়ি। তখন হাওয়া ৪৯ এর একটি বিশেষ সংখ্যা, সম্ভবত
২০০০ সালের পরের বাংলা কবিতা নিয়ে। তাতে কে চেয়েছিলেন মনেও পড়ছে না
ঠিকঠাক। নাসের দা না যাই হোক, মোটমাট “সমীর দা তোমাকে চারটে কবিতা দিতে
বলেছেন”। দিয়েছিলাম। সকালের ফোনটি ছিলো ওগুলির মধ্যে একটি কবিতা নিয়ে ওনার
কিছু ধারণা ও কথা আর সেগুলি সম্পর্কে আমার কি মতামত, এবং আমার কি মনে হয়
উনি কবিতা নিয়ে যা বলছেন সেগুলি সঠিক বা অন্যরকম কোনো দেখা। এইসব। বাকি
জীবনে আমার সমীর রায়চৌধুরীর সাথে দেখাও হয়নি, কথা বহুদূর। ওই একটা সকালে
ছোট্টো ফোন।
কাট
টু গতবছর। সমীরদা মারা গেলেন। শংকরদার সিনেমা বোটমেন অফ হাই সিজ, যাতে
আমিও ছিলাম, সমীরদা, মনীন্দ্র গুপ্ত, অরিত্র, সঙ্ঘমিত্রা শুভ্র দেবাদৃতা
অনেকে ছিলো। তবে শঙ্করদার কাজটি ছিলো প্রসেসের দিক থেকেও ইউনিক তাই এদের
মধ্যে একজন কি ভূমিকা, কি কি কথা বলেছে তা দেখার কোনো স্কোপ ছিলো না।
স্ট্রিক্টলি। শঙ্করদার পোস্ট থেকেই জানতে পারি সমীরদা চলে যাওয়ার কথা।
হাল্কা খারাপ লাগা বললেও অসত্যভাষণ হবে, কারন আমি তো ওনাকে চিনতাম না,
পরিচয় নেই, হ্যাঁ লেখা পছন্দ করতাম খুব। তাই ফর্মাল খারাপ লাগা। তার পরের
দিন সকালে ফেসবুকে এমন সার্কাস বা রঙ্গ অভিনীত হলো যা আমার একটি সিদ্ধান্ত
কে আরো তাড়াতাড়ি কার্যকর করতে বাধ্য করলো। চলে গেছেন একজন কবি লেখক, তো
একটা খারাপ লাগা এবং স্মৃতিচারণ জাতীয় লেখা, খুবই ফর্মাল আমি লিখলাম। আর
সেটি ওই ওপরের ঘটনাটি কারন ওই একটি ছাড়া আমার আর কোনো স্মৃতি বানিয়ে বানিয়ে
দুরন্ত প্রশংসায় ডুবিয়ে দেওয়া আমার আসে না। ফেসবুক ভর্ত্তি পোস্টের মধ্যে
আমার তৎকালীন বন্ধু, গুরুত্বপূর্ণ একজন লেখক এ সময়ের স্ট্যাটাসও ছিলো।
অসাধারণ আবেগতাড়িত একটা লেখা। যাতে এমনও ছিলো যে সমীরদা না থাকলে, সমীরদার
ক্রমাগত প্রশয় ও সাহস না দিয়ে গেলে ওর লেখা ওর তত্ত্ব এগুলি কিছুই হয়তো হতো
না। যখন সবাই রঙ্গ রসিকতা করছিলো তখন সমীরদা ওকে সবসময় যোগাযোগ রেখে
গেছেন। আমার পড়ে বেশ দ্রব দ্রব অনুভূতি হলো। আমার বন্ধুটিকে এত আবেগ ও অকপট
আমি আগে দেখিনি।
আর
তার কিছু পরে সেই সার্কাস ঘটতে শুরু করলো। আমার স্ট্যাটাসটির নীচে কমেন্টে
এক এক জন এসে লিখতে থাকলো যার মোদ্দা বক্তব্য ছিলো সমীরদা ওকেও ফোন
করেছিলেন এবং ওই সংকলনে ওরও কবিতা ছিলো। একের পর এক। এমন কি আমার বন্ধুও।
আমার অতি বিকট বিশ্রী লাগছিলো, এ কি??? আমি একটা স্মৃতিচারণা করেছি মাত্র
কোনো সাফল্যের খতিয়ান দাখিল করিনি। মানুষকি খ্যাতির লোভে মিনিমাম মনুষত্ব্য
যা একজন প্রয়াত মানুষের সম্পর্কে কথা বলার সময় রাখা উচিত সেটাও ভুলে
যাচ্ছে? আমি কিছুই দেখিনি তখনো। কারন হঠাৎ দেখলাম আমার বন্ধুটির আবেগ ও
কৃতজ্ঞতাপূর্ণ স্ট্যাটাসটি নেই। যাতে সমীরদার ভূমিকা তার লেখার জীবনে সেইসব
লেখা ছিলো। সেটি কোন জাদুবলে বদলে গিয়ে দেখি এক জ্ঞানগম্ভীর প্যারাগ্রাফ
হয়ে গেছে। যাতে সমীর রায়চৌধুরীকে লোকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পরিচয়ে চেনে
এটা লজ্জাজনক। উনি বাংলা কবিতার জগতে অতি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। উনি এবং
প্রভাত চৌধুরী পোস্টমডার্ন তত্ত্বকে বাংলা কবিতার জগতে এনেছিলেন। এবং
বন্ধুটির নিজস্ব তত্ত্ব র অনেক্টাই ঋণ আছে সমীররায়চোউধুরীর অধুনান্তিক ও
প্রভাত চৌধুরীর উত্তর আধুনিকের কাছে। এইসব লেখার পরে নিউটনের সূত্রের মতো
যা থাকে সব লেখার শেষে, যে আজকে শ্রীজাত অর্ণবদের হাতে বাংলা ভাষার এই দশা,
ব্লা ব্লা ব্লা।
আমি
বহুক্ষণ বিশ্বাস করতে পারিনি এটা কি আমি ঠিক দেখলাম? আপনাদের মনে হতে পারে
সেই কর্দম অনুরাগে এই প্রসঙ্গ তুললাম। না, একেবারেই নয়। আজকে সমীর
রায়চৌধুরী না থাকলে আমি এখন আপনাদের সামনে বসে এই যে ডাঁটের সাথে কাউকে
পরোয়া না করে বাংলা লেখার জগতের কথা লিখছি, তার জায়গায় এক ফ্রাস্ট্রেটেড
ব্যার্থ ভিজিলান্তে হয়ে ঘরে বসে মদ খেতাম আর আনন্দবাজারের মুণ্ডপাত করতাম।
সমীরদা মৃত্যুর পরেও কাজ করে গেছেন যাচ্ছেন বাংলা ভাষার জন্য।আমি বিস্ময়ে
হতবাক হয়ে গেছিলাম যখন শঙ্করদা আমাকে ইন্টারভিউর একটি এডিটেড অংশ
শুনিয়েছিলেন। তাতে আমাকে ও আরো কয়েকজন শূন্যকে নিয়ে আলোচনা ছিলো। কি দুরন্ত
গভীরভাবে উনি আমার লেখার সাথে বাকি কয়েকজনের কম্প্যারেটিভ আলোচনা করে
যাচ্ছেন যেন আমাকে আপাদমস্তক চেনেন। অনেকের প্রশংসা প্রচারের লোভে রুচিবোধ
নষ্ট হয়ে যায়। আমার কাছে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ একজন বিরাট বড়ো মানুষের
দেওয়া ওই দায়িত্ব ওই সম্মান। সেটি সর্বসমক্ষে আনার কথা ভাবিও নি, আজও
ভাবিনা। মিথ্যেবাদী বলে অপবাদ দিলেও ভাববো না। হ্যাঁ, দীপঙ্কর রঙ্গন
বিশ্বরূপদা, এইরকম অল্প কিছু মানুষ দেখেছেন ক্লিপিংস আমার ল্যাপটপে।
অনেকটাই দেখেননি। কারন সেগুলি আরো নানা সূত্র থেকে পাওয়া, যার মধ্যে প্রচুর
প্রচুর কথা আমাকে বলে গেছেন উনি। বলা যায় এক আশ্চর্য উত্তরাধিকারের
দায়িত্ব দিয়ে গেছেন। আর কি মহৎ প্রাণ, তার মধ্যে আত্মসমালোচনাও রয়েছে, ওনার
নিজের ভাবনার কোথায় ভুল হয়েছিলো তা নিয়েও কথা রয়েছে। আর বিস্ময়ের সর্বোচ্চ
জায়গাটি পেলাম যখন বৈদ্যনাথ দা আমার বাড়িতে এলেন। কাঁটা দিচ্ছে গায়ে বলতে
বলতে। বৈদ্যনাথদা সমীরদার শেষের তিরিশ বছরের একান্ত সঙ্গী ছিলেন। উনি মারা
যাওয়ার আগে হাওয়া ৪৯ এর ভবিষ্যৎ সংখ্যাগুলিতে কি কাজ হতে পারে। তা নিয়ে এক
বিস্তারিত নির্দেশ দিয়ে গেছেন বৈদ্যনাথদাকে। এবং তার মধ্যে গুরুত্বপুর্ণ
একটি অংশ ছিলো ওনাকে বলে গেছেন আমার সাথে যোগাযোগ করতে এবং আমাকে দিয়ে
লেখাতে, সেগুলির কারন, আমার লেখা নিয়ে কথা ইত্যাদি। এই সমস্ত পর্ব, এই মহান
মানুষটির এমন অসাধারণ ডেডিকেশান আমি জানতে পারছি যখন তখন উনি নেই। আজকে
“লুনাটিকা” ও শারদীয়া মধ্যবর্তী একত্রে একটি মস্তো সাফল্য পেয়েছে। যার কথা
লিখতেই আমি বসেছি। এবং আজকে সমীরদা হয়তো সবচেয়ে খুশী হতেন সেটি শুনলে। কারন
এই সাফল্যটি ব্যক্তিকেন্দ্রিক নয়, ব্যাক্তিকেন্দ্র থেকে শুরু হয়ে পরিধির
দিকে ব্যপ্ত হয়ে গেছে। কেন্দ্রিকতা ভেঙে বেড়ে উঠেছে। আমার অন্যতম প্রিয়জন
বিশ্বরূপ দয়ে সরকার এমনই এক আদর্শে বিশ্বাস করেন। সমীরদা এমনই এক স্বপ্ন
দেখতেন বাংলা ভাষা নিয়ে। আর কে জানে কেন দুজনেরই অহেতুকী ভরসা আর স্নেহের
পাত্র এই নরাধম। একজন তার মধ্যে প্রয়াত হওয়ার পরও আমাকে অকূলবিস্তারী স্নেহ
ভালোবাসা শক্তি দিয়ে চলেছেন। এমন এক অবস্থায় আমি কি করে হেরে যেতে পারি???
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন