বাংলা সাহিত্য এবং হাংরি মুভমেন্ট
লিখেছেন: কেএম মুত্তাকী — মঙ্গল, 03/25/2014 - 00:36
সময়টা
১৯৬১, বাংলা সাহিত্যের অবস্থা প্রায় অনেকটাই স্থিবির। সেই স্থিতাবস্থা
ভাঙ্গার ভাঙ্গার জন্য সাহিত্যের ইতিহাসে প্রথম ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে
আন্দোলনের ডাক দেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায়
এবং হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় সহ আরো কয়েকজন কবি সাহিত্যিক। ইশতাহার
গুলোর মধ্যে ছিল কবিতা বিষয়ক প্রথম বাংলা ইশতাহার (নভেমবর ১৯৬১), মুক্তি
বিষয়ক ১৪-বিন্দু ইশতাহার (১৯৬২), রাজনীতি বিষয়ক ইশতাহার (১৯৬৩)। এটি
হাংরি মোভমেন্ট বা হাংরি আন্দোলন নামে পরিচিত। যাকে অনেকে বলেন
হাংরিয়ালিস্ট, ক্ষুধিত, ক্ষুৎকাতর, ক্ষুধার্ত আন্দোলন । আর্তি বা কাতরতা
শব্দগুলো মতাদশর্টিকে সঠিক তুলে ধরতে পারবে না বলে, আন্দোলনকারীরা শেষাবধি
হাংরি শব্দটি গ্রহণ করেন।
ব্যাংকশাল কোর্টৈ মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ
হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে আর তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়। শুরুরদিকে আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল এবং করুনাছিলেন চিত্রকর। সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়, রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত, সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত পাটনা থেকে একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করতেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নিজেরাই, কেননা অধিকাংশ বুলেটিন সংগ্রাহকদের পক্ষেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র বহু চেষ্টায় গোটা দশেক সংগ্রহ করতে পেরেছে। বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সংগ্রহ করতে পেরেছে।
১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলো হল, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃসতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত এষণা, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি দি ওয়েস্ট পেপার । সত্তর দশকের শেষাশেষি আন্দোলনটিকে পুনরায় জীবিত করার যখন অসফল প্রয়াস করা হয়েছিল, তখন অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন জিরাফ, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন কনসেনত্রশান ক্যাম্প, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন আর্তনাদ, এবং অন্যান্যরা ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবট, ধৃতরাষ্ত্র ইত্যাদি।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় , সুভাষ ঘোষ , শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়। মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে।
হাংরি চিত্রকর অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা মলয় রায়চৌধুরী
মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিস্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান। এসময় অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করে চলে যান। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারাল। গ্রেপতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পান্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি কোন কবিই।
হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত। ভারতীয় পিনাল কোর্টের ২৯২ ধারায় চার্যশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান। কিন্তু মোকদ্দমাটির কারণে তাঁদের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সুবিমল বসাকের হিন্দি ভাষায় দখল থাকায় ভারতের অন্যান্য ভাষার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় তাঁদের রচনা ও কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। হাংরি আন্দোলনকারীরা তা-ই চাইছিলেন।
সেসময়কার বহুল প্রচলিত এবং প্রকাশিত খবরের কাগজ এবং মাগাজিনে তাদের নিয়ে প্রচুর খবর এবং কার্টুন ছাপা হয়। আমেরিকার টাইম পত্রিকায় (নভেম্বর ১৯৬৪) তাঁদের ফোটো এবং সংবাদ প্রকাশিত হবার ফলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার পত্রপত্রিকা তাঁদের সংবাদ ও রচনা প্রকাশ করার জন্য কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠায়। ভারতবর্ষে তাঁরা সমর্থন পেয়ে যান প্রতিষ্ঠিত লেখকদের। সাময়িক দুর্ভোগ হলেও হাংরি মোকাদ্দমা তাঁদের সাপে বর হয়। অনিল করঞ্জাই ললিতকলা একাডেমীর পুরস্কার পান। অমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবিলেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে আকল্পনীয়।
কলকাতায় এই ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: "ইহা কি বেহুদা পাগলামি?" (দর্পণ, ১.৫.৬৪), "দেবদূতেরা কি ভয়ংকর" চতুষ্পর্ণা (পৌষ, ১৩৭০), "সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?" (অমৃত, শ্রাবণ ৮, ১৩৭১), "হা-ঘরে সম্প্রদায়" (১.১০.৬৪), "কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা" (জনতা, ৪.৯.৬৪), "পুলিশি বেটন কি শিল্প বিচার করবে?" (দর্পণ, ২৭.১১.৬৪), "Erotic Lives & Loves of Hungry Generation" (Blitz, 19.9.64), "Middlebrows Thrive on New Kind of Writing" (The Statesman, 30.12.64), " Not By Poetry Alone" (NOW, 20.11.64)।
হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে।
তথ্যসুত্রঃ টাইম ম্যাগাজিন, বিডিনিউজ২৪, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলোকচিত্র এবং নথিপত্র
পূর্ব প্রকাশঃ বৃত্তায়ন সাহিত্য সাময়িকীতে
ব্যাংকশাল কোর্টৈ মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ
হাংরি আন্দোলনকারীরা হাংরি শব্দটি আহরণ করেছিলেন ইংরেজি ভাষার কবি জিওফ্রে চসারের ‘ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম’ বাক্যটি থেকে আর তাত্তিক ভিত্তি সংগ্রহ করা হয়েছিল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দর্শন থেকে। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়। শুরুরদিকে আন্দোলনের প্রভাবটি ব্যাপক গভীর হলেও, ১৯৬৫ সালে প্রকৃত অর্থে হাংরি আন্দোলন ফুরিয়ে যায় । নকশাল আন্দোলনের পর উত্তরবঙ্গ এবং ত্রিপুরার তরুণ কবিরা আন্দোলনটিকে আবার জীবনদান করার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাত্ত্বিক ভিত্তিটি জানা না থাকায় তাঁরা আন্দোলনটিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি।
১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র, ফালগুনী রায়, আলো মিত্র,অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ, আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়, শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল, রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ। অনিল এবং করুনাছিলেন চিত্রকর। সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে তোলার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু, অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার, দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়, রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত, সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ।
হাংরি আন্দোলনকারীরা প্রধানত পাটনা থেকে একপৃষ্ঠার বুলেটিন প্রকাশ করতেন। কখনও বা পোস্টকার্ড, পোস্টার এবং এক ফর্মার পুস্তিকা প্রকাশ করতেন। এক পাতার বুলেটিনে তঁরা কবিতা, রাজনীতি, ধর্ম, অশ্লীলতা, জীবন, ছোটগল্প, নাটক, উদ্দেশ্য, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ে ইশতাহার লেখা ছাড়াও, কবিতা, গদ্য, অনুগল্প, স্কেচ ইত্যাদি প্রকাশ করতেন। বুলেটিনগুলো হ্যান্ডবিলের মতন কলকাতার কলেজ স্টিট কফি হাউস, পত্রিকা দপতর, কলেজগুলোর বাংলা বিভাগ ও লাইব্রেরি ইত্যাদিতে তাঁরা বিতরন করতেন। হাংরি আন্দোলনের কথা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার এইটি-ই প্রধান কারণ বলে মনে করেন গবেষকরা। কিন্তু হ্যান্ডবিলের মতন প্রকাশ করায় তাঁরা ঐতিহাসিক ক্ষতির মুখে পড়েছেন নিজেরাই, কেননা অধিকাংশ বুলেটিন সংগ্রাহকদের পক্ষেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়নি। কলকাতার লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরি ও গবেষণাকেন্দ্র বহু চেষ্টায় গোটা দশেক সংগ্রহ করতে পেরেছে। বাংলা একাডেমিও কয়েকটি সংগ্রহ করতে পেরেছে।
১৯৬৩-৬৫ সালের মাঝে হাংরি আন্দোলনকারীরা কয়েকটি পত্রিকাও প্রকাশ করেছিলেন। সেগুলো হল, সুবিমল বসাক সম্পাদিত প্রতিদ্বন্দ্বী, ত্রিদিব মিত্র সম্পাদিত উন্মার্গ, মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত জেব্রা, দেবী রায় সম্পাদিত চিহ্ণ, প্রদীপ চৌধুরী সম্পাদিত ফুঃসতীন্দ্র ভৌমিক সম্পাদিত এষণা, এবং আলো মিত্র সম্পাদিত ইংরেজি দি ওয়েস্ট পেপার । সত্তর দশকের শেষাশেষি আন্দোলনটিকে পুনরায় জীবিত করার যখন অসফল প্রয়াস করা হয়েছিল, তখন অরুণেষ ঘোষ প্রকাশ করেন জিরাফ, অলোক গোস্বামী প্রকাশ করেন কনসেনত্রশান ক্যাম্প, সুভাষ ঘোষ সম্পাদনা করেন আর্তনাদ, এবং অন্যান্যরা ক্ষুধার্ত, ক্ষুধার্ত খবর, ক্ষুধার্ত প্রতিরোধ, রোবট, ধৃতরাষ্ত্র ইত্যাদি।
১৯৬৪ সালের সেপ্টেম্বরে ১১ জন হাংরি আন্দোলনকারীর বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছিল। তাঁরা হলেন সমীর রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায় , সুভাষ ঘোষ , শৈলেশ্বর ঘোষ , প্রদীপ চৌধুরী, উৎপলকুমার বসু, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবো আচার্য এবং সুবিমল বসাক। এঁদের মধ্যে প্রথম ছয়জনকে গ্রেফতার করা হয় এবং কলকাতার ব্যাংকশাল কোর্টে তোলা হয়। মলয় রায়চৌধুরীকে হাতে হাতকড়া এবং কোমরে দড়ি বঁধে রাস্তায় হঁটিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় চোর-ডাকাতদের সঙ্গে।
হাংরি চিত্রকর অনিল করঞ্জাইয়ের আঁকা মলয় রায়চৌধুরী
মকদ্দমার ফলে উৎপলকুমার বসু অধ্যাপনার চাকরি থেকে বরখাস্ত হন, প্রদীপ চৌধুরী রাসটিকেট হন বিস্বভারতী থেকে, সমীর রায়চৌধুরী সরকারি চাকরি থেকে সাসপেন্ড হন, সুবিমল বসাক ও দেবী রায়কে কলকাতার বাইরে বদলি করে দেয়া হয়, সুবো আচার্য ও রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় ফেরার হয়ে যান। এসময় অনেকে হাংরি আন্দোলন ভয়ে ত্যাগ করে চলে যান। লালবাজারের কনফারেন্স রুমে মলয় রায়চৌধুরী এবং সমীর রায়চৌধুরীকে জেরা করেন একটি ইনভেসটিগেটিং বোর্ড যার সদস্যরা ছিলেন স্বরাষ্ট্র দপ্তর, পুলিশ প্রশাসন, কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বিভাগ, ভারতীয় সেনার প্রতিনিধিরা এবং পশ্চিমবঙ্গের আ্যাডভোকেট জেনারাল। গ্রেপতারের সময়ে প্রত্যেকের বাড়ি লণ্ড-ভণ্ড করা হয়েছিল। বইপত্র, ডায়েরি, টাইপরাইটার, ফাইল, পান্ডুলিপি, কবিদের চিঠির সংগ্রহ ইত্যাদি যেগুলো পুলিশ নিয়ে গিয়েছিল তা আর তাঁরা ফেরত পাননি কোন কবিই।
হাংরি আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে মোকদ্দমা দায়ের হয় ১৯৬৪ সালে এবং তা চলে ৩৫ মাস, অর্থাৎ ১৯৬৭ পর্যন্ত। ভারতীয় পিনাল কোর্টের ২৯২ ধারায় চার্যশীট দেয়া হয় মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে তাঁর প্রচন্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য ; বাদবাকি সবাইকে রেহাই দেয়া হয়। নিম্ন আদালতে সাজা হলেও, তিনি উচ্চ আদালতে মামলা জিতে যান। কিন্তু মোকদ্দমাটির কারণে তাঁদের খ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। সুবিমল বসাকের হিন্দি ভাষায় দখল থাকায় ভারতের অন্যান্য ভাষার সংবাদপত্র ও পত্রিকায় তাঁদের রচনা ও কাজকর্ম নিয়ে প্রচুর বিতর্ক তাঁদের প্রচারের আলোয় নিয়ে আসে। হাংরি আন্দোলনকারীরা তা-ই চাইছিলেন।
সেসময়কার বহুল প্রচলিত এবং প্রকাশিত খবরের কাগজ এবং মাগাজিনে তাদের নিয়ে প্রচুর খবর এবং কার্টুন ছাপা হয়। আমেরিকার টাইম পত্রিকায় (নভেম্বর ১৯৬৪) তাঁদের ফোটো এবং সংবাদ প্রকাশিত হবার ফলে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার পত্রপত্রিকা তাঁদের সংবাদ ও রচনা প্রকাশ করার জন্য কলকাতায় প্রতিনিধি পাঠায়। ভারতবর্ষে তাঁরা সমর্থন পেয়ে যান প্রতিষ্ঠিত লেখকদের। সাময়িক দুর্ভোগ হলেও হাংরি মোকাদ্দমা তাঁদের সাপে বর হয়। অনিল করঞ্জাই ললিতকলা একাডেমীর পুরস্কার পান। অমেরিকা ও ইউরোপে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন বিশেষ হাংরি আন্দোলন সংখ্যা প্রকাশ করেছিল যা ওই বয়সের কবিলেখকদের জন্য নিঃসন্দেহে আকল্পনীয়।
কলকাতায় এই ধরণের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল: "ইহা কি বেহুদা পাগলামি?" (দর্পণ, ১.৫.৬৪), "দেবদূতেরা কি ভয়ংকর" চতুষ্পর্ণা (পৌষ, ১৩৭০), "সাহিত্যে বিটলেমি কী এবং কেন?" (অমৃত, শ্রাবণ ৮, ১৩৭১), "হা-ঘরে সম্প্রদায়" (১.১০.৬৪), "কাব্যচর্চার নামে বিকৃত যৌনলালসা" (জনতা, ৪.৯.৬৪), "পুলিশি বেটন কি শিল্প বিচার করবে?" (দর্পণ, ২৭.১১.৬৪), "Erotic Lives & Loves of Hungry Generation" (Blitz, 19.9.64), "Middlebrows Thrive on New Kind of Writing" (The Statesman, 30.12.64), " Not By Poetry Alone" (NOW, 20.11.64)।
হাংরি আন্দোলনের অবদান সম্পর্কে বিভিন্ন আলোচক বিভিন্ন মতামত দিয়েছেন। হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে এম ফিল এবং পি আইচ ডি গবেষণা হয়েছে।
তথ্যসুত্রঃ টাইম ম্যাগাজিন, বিডিনিউজ২৪, উইকিপিডিয়া, ইন্টারনেট থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন আলোকচিত্র এবং নথিপত্র
পূর্ব প্রকাশঃ বৃত্তায়ন সাহিত্য সাময়িকীতে
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন