বুধবার

সুবিমল বসাকের গেরিলা আক্রোশ - একটি অবচেতনার দলিল : তন্ময় ভট্টাচার্য


“জন্মসূত্রে পাওয়া আতঙ্ক ভয় ত্রাস – যা থেকে মানুষের নিস্তার নেই – লক্ষলক্ষ শ্বেত কপোত উজ্জ্বল আলো স্কাইক্র্যাপার্স পরিকল্পনা রাজনৈতিক রাডার সোনালী ভবিষ্যৎ কিছুই এই অন্তর্নিহিত সংকট থেকে উদ্ধার করতে পারেনি – মানুষকে অনায়াসে ঢূকে পড়তে হয় এক অদৃশ্য ঘেরাটোপে – যার সেলোটেপ সরাতে গিয়ে আঙুল দুমড়ে শীর্ণ হয়ে আসে শিরদাঁড়া বেঁকে নুয়ে পড়ে – তবুও ঐ শীর্ণ আঙুলে ভাঙা শরীরে প্রতিরোধ চালিয়ে যায় – স্বাধীনতাকামী মানুষ – তার আক্রোশ -” এই হলো বইটির উপজীব্য। সুবিমল বসাক হাংরি আন্দোলনের একজন সামনের সারির সৈনিক যার কলমে ফুটে উঠেছে সামাজিক তথা মানসিক বিপন্নতার সুচারু চিত্র। এমনই পাঁচটি গদ্যের সংকলন ‘গেরিলা আক্রোশ’। প্রকাশকাল ১৯৭৪। এতদিন পর গ্রন্থটির সমালোচনা করা কিছুটা ধৃষ্টতা তো বটেই,  কারণ কালের স্বাভাবিক নিয়মে একশ্রেণীর উৎসাহী পাঠকের কাছে সমাদৃতও হয়েছে বইটি। তবু সম্পূর্ণ অন্য ধারার এই গদ্য সংকলনটির স্বাদ আরও বৃহত্তর ক্ষেত্রে পৌঁছে দেয়ার জন্যেই এই প্রয়াস।

প্রথম গদ্যটির নাম ‘গেরিলা আক্রোশ’। লেখকের যৌবনোচিত মানসিক অস্থিরতার কথা ফুটে উঠেছে এতে। প্রধান উপাদান একটি ডাইরি ও একটি বেতারযন্ত্র। ডাইরির পাতা উল্টাতে ভয় করে তাঁর, কেননা তখনই “বুকের ভেতর রক্ত তোলপাড় শুরু করে দেয়। ঘরের একপাশ অন্ধকারে ছেয়ে থাকে, বাতি জ্বালাতে গিয়ে আলো বেরোয় না।” বিভিন্ন প্রতিকূল অভিজ্ঞতায় জর্জরিত লেখক ডাইরির কাছে এসে নিছক স্মৃতির আক্রমণের ভয়েই অবচেতনে গড়ে তোলেন বিরূপতা। আর তার থেকে মুক্তি পেতে বেতারযন্ত্রের শরণাপন্ন হন তিনি, এবং সেই বেতারেও জন্মাবধি তাঁর সমস্ত ইতিহাস ও অভিজ্ঞতা ধ্বনিত হতে থাকে। অসহায় লেখক স্বস্তি পান বেতার থামার সঙ্গে, এবং তিনি শেষ পর্যন্ত আবার ফিরে আসেন ডাইরির কাছেই। সব মিলিয়ে এক আশ্চর্য জীবন ও মনের ছবি খুঁজে পাই এই গদ্যটিতে যার পরতে পরতে মিশে আছে শান্তির জন্য হাহাকার।

দ্বিতীয় গদ্য ‘আগ্রাসী অপকর্ম’। লেখকের চারপাশে অজস্র শব্দ এবং সেই শব্দের কাছে ধরাশায়ী তিনি। শয়নে স্বপনে জাগরণে বিভিন্ন শব্দ ও তার অশান্ত ফল চাবুকের মতো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় লেখক-কে, কিন্তু শব্দহীন সেই স্থান অধরাই থেকে যায়। এমনকি ঘড়ির মধ্যে থেকেও লেখক শুনতে পান এক গম্ভীর কন্ঠস্বর – “পৃথিবীর প্রতিটি পিতা তার পুত্রকে পুরুষ বন্ধুর সঙ্গে এবং কন্যাকে মহিলা বন্ধুর সঙ্গে মিশতে দিচ্ছে।” শব্দের পীড়ন লেখককে আতঙ্কিত করে তোলে। রেডিয়ো’র নব ঘোরাতেই দুম্‌ ক’রে ঘোষিত হয় – “জন্ম-মুহূর্তে কেউ নবজাত শিশুর মুখের দিকে চেয়ে দেখে না।” শব্দ তোলপাড় হতে থাকে। এমনকি ‘মগজে প্রতিরোধহীন টুপটুপ রক্ত চুঁইতে থাকে’, টেপরেকর্ডার শুনিয়ে যায় জাম্পকাট ঘটনাবলী – অসহ্য একঘেয়েমির শেষ হয় ফিতে ছিঁড়ে গেলে। তখন পুনরায় অন্যান্য শব্দ জোরদার হয়ে ওঠে। “কানের কাছে বিশৃঙ্খল পারম্পর্যহীন শব্দাবলীর প্রতি মন রেখে বুঝতে পারি, আজীবন এই গাদাগাদা শব্দের মরণাক্রমণ আমাকে সহ্য করতে হবে। তা থেকে আমার নিস্তার নেই, কেননা মৃত্যুই শব্দহীনতা”। এই শাশ্বত উপলব্ধির কাছে নতজানু হয়ে এবং অসহায়তার কাছে আত্মসমর্পণ করেই শেষ হয় লেখকের যাত্রা।

তৃতীয় গদ্যটি হলো ‘হুঁশাহুঁশহীন ছোবল’। অবচেতনের এক অনবদ্য ছবি ফুটে উঠেছে লেখাটিতে। ফাঁকা ঘরে লেখক স্মৃতি হাতড়াতে যখন বুঁদ, দরজার বাইরে এক বিড়ালের ডাকে ঘোর কাটে তাঁর। “ওর চোখদুটো ভয়ানক জীবন্ত দেখায়।…কেমন যেন কুঁকড়ে সিঁটিয়ে পড়ি…এতক্ষণের স্মৃতি চিন্তা ধারণা বাল্যকাল ডাইরি প্রেম ভাবনা সব ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে।” ক্রমশ বিড়ালের অবয়ব পাল্টাতে পাল্টাতে লেখক দেখেন তাঁর মৃত পিতার প্রতিকৃতি। সেটিও বদলে যায় একটি ঝুলন্ত জিভে – গলন্ত সেই জিভ এগিয়ে আসে লেখককে লেহন করতে। মনের পর্দায় একের পর এক ঘটনাপ্রবাহ চলতে থাকে সিনেমার মতো, মধ্যে মধ্যে স্নায়ুতন্ত্রীতে বেজে ওঠে “বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে বাবা এসেছে…”। সমস্ত চিন্তা জট পাকিয়ে যায়। হাল ছেড়ে দিয়ে লেখক বলেন, “এখন দীর্ঘসময় চিন্তা ভয়হীন আমি ঘুমিয়ে থাকতে চাই – জানি, আমার এই ঘুম কখনও ঘটবে না।” দক্ষ শব্দশিল্পী না হলে অবচেতনকে এভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় না, আর এখানেই সুবিমল বসাকের সার্থকতা।

“চোখের পাতা নামালেই সেই সেলুলয়েড… আমার শরীর ভারী ও হিম করে তোলে, হাত নাড়াবার মত শক্তি সামর্থ্য হারিয়ে ফেলি। ভিজে কামান নেতিয়ে থাকে হাঁটুর দেয়ালে।”  – চতুর্থ গদ্য ‘অপ্রতিরোধ্য ভাইরাস’-এ বলা আছে স্বপ্নদোষের পর ঘুম ভেঙে-যাওয়া এক যুবকের কথা, অস্বস্তির চরম সীমায় পৌঁছে যে আঁকড়ে ধরতে চায় অরুণিমার শরীর। যুবকটি মন ঘোরানোর জন্য পড়তে শুরু করে একটি প্যানপ্যানে প্রেমের কাহিনী। কিন্তু সেই আপাত-গতানুগতিক কাহিনী পাঠের মধ্যে-মধ্যেও যুবকের স্মৃতিতে ঝলকানি দিয়ে ওঠে আধিভৌতিক দৃশ্যকল্প।  ক্রমশই “অরুণিমার হাঁ ক্রমশ বড়ো হতে হতে ভয়ঙ্কর হয়ে পড়ে… হাত টুক্‌ করে পড়ে যায় বাহুমূল ছিঁড়ে তারপর পা স্তন সব বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়তে থাকে…”। কাহিনীও এগিয়ে চলে বিয়োগের দিকে, সমান্তরালভাবে যুবকের মানসিক আলোড়নও চরম বিন্দু থেকে ক্রমশ শিথিল হয়ে যায়। বলা বাহুল্য, এখানে যুবকটি লেখক নিজেই।

পঞ্চম ও শেষ গদ্যটি হলো ‘তেজস্ক্রিয় দুঃস্বপ্ন’। এবং সম্ভবতঃ সবচেয়ে তেজস্ক্রিয় গদ্যও এটিই। একটি বাসযাত্রার বর্ণনা, যেখানে লেখক সিট পান জানলার ধারে বসা একটি যুবতীর পাশে। “মেয়েটি সিঁটিয়ে বসে আছে। শাড়ির ভাঁজে সংকোচ ভাব। আমার অস্বস্তিবোধ হতে থাকে। ওর অস্বাভাবিকতার জন্য আরও বেশি বিচলিত বোধ করি।” তারপর বয়সের স্বাভাবিক ধর্মে লেখক ক্রমশ আকৃষ্ট হন যুবতীর প্রতি, বাসের মধ্যেই যুবতীর চোখ বাহু ও স্তনের আভাস তাঁকে উত্তেজিত করে তোলে। “মেয়েটির প্রোফাইলে উজ্জ্বল আয়নার মত ঝকঝকে সিঁদুরে আলো – কিছুক্ষণ একদৃষ্টে চেয়ে থাকলে শিরদাঁড়া শিরশির করে ওঠে।” এরপরই যুবতীর ব্লাউজসিঞ্চিত স্তন ও লেখকের কনুইয়ের ঈষৎ স্পর্শমেদুরতা – এবং কামোদ্দীপনা – হয়তো তা উভয়ার্থেই। কিন্তু হঠাৎই বাসটির মৃদু অ্যাকসিডেন্ট এবং তারপর থেকে লেখকের মানসিকতার চূড়ান্ত মোড় ও চেতন-অবচেতনের নিদারুণ ছলনা গদ্যটিকে অমরত্বের পর্যায়ে নিয়ে যায়। অপূর্ব এই গদ্যটি – যাকে ‘জীবনদর্পণ’ বলতেও কোনো দ্বিধা নেই – বাংলা সাহিত্যের একটি উল্লেখযোগ্য সম্পদ।

সুবিমল বসাক গতানুগতিক লেখকদের থেকে সম্পূর্ণ অন্য পথে হেঁটেও যে কীর্তির নজির রেখেছেন, তাতে তাঁকে অবজ্ঞা করার কোনো উপায়ই নেই। তাঁর ভাষা অননুকরণীয়। আর, ‘গেরিলা আক্রোশ’ বইটি তো যেকোনো যুবকের মানসিকতার এক অত্যুজ্জ্বল প্রতিফলন। সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিবর্তে মানসিক ক্ষুধা ও অনুভূতিকেই সুবিমল বসাক বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন এই পাঁচটি ভিন্নধর্মী গদ্যে; আর তাই নিঃসন্দেহে বলা যায়, কালের সীমা পেরিয়েও অক্ষুণ্ণ থাকবে ‘গেরিলা আক্রোশ’ ও তার দ্যুতি।

 
   

 
   

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন