সুবিমল বসাকের বাড়িতে বইপত্র ঘাঁটতে ঘাঁটতে আবিষ্কার করি একটি বই – “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”। কবি বিনয় মজুমদার। বইটির প্রকাশকাল ৩১শে জুলাই, ১৯৬৫। ৫৫-৫৬ পাতার বইটি সংকলন জাতীয়। এতে আছে ‘নক্ষত্রের আলোয়‘ বইয়ের ৭টি কবিতা, ‘আমার ঈশ্বরীকে‘ বইয়ের ৭৯টি, ‘ঈশ্বরীয়‘ থেকে ৪৭টি ও ‘অধিকন্তু‘ শিরোনামে আরো দশটি কবিতা।
তাঁতের শাড়ি বা খদ্দরের ধুতি একটু পুরোনো দোকানগুলোতে যেমন খয়েরি রঙের ফিনফিনে কাগজের ভরে দেয়, তেমনই কাগজে ছাপা পুরো বইটি। অথচ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে বিনয় মজুমদারের মণিমাণিক্য।
—————————-
“কোনোদিন বলেনি সে পৃথিবীর সেই মৃদু পুরাতন কথা।
একটি দেবীর আর দেবতার জীবনের – হৃদয়ের অপরূপ পরিপূরকতা
মনে ক‘রে কোনোদিন ডাকবে না সে কি তবে, নেবে নাকি যেচে?
হয়তো অনেকবার ডেকেছে; স্বপ্নের মাঝে, কেবল ঘুমের ঘোরে ডাকে সে – ডেকেছে।
একদিন চুপিচুপি কাছে যদি যেতে পারি – জেগে থাকা অবসরে নয় –
জ্যোৎস্নার নীচে তার ঘুমের সময়!”
অথবা,
“তোমার দিকে তাকাই আমি, দেখি অতল চোখ,
দেখি তোমার শরীর, আর বুঝি, তোমার মন
জড়িয়ে আছে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার লোক
বিভোর দেহে বিভোর মনে বিভোর বন্ধন।
তোমার দিকে তাকাই আমি, কী যে রহস্যের
অতল এক সমুদ্রের গভীর উদ্ভাস
তোমার চোখে, শরীরে, মনে; প্রেয়সী, দেখি ফের
মিষ্টতায় ঝঞ্ঝায়িত সমুদ্রের শ্বাস।”
ভাষা তো দূরের কথা, এমন আঙ্গিকে বিনয় মজুমদারের লেখা আগে পড়িনি আমি। এগুলি ওঁর প্রথমদিকের লেখা। তবু অসামান্য প্রেমিকের চোখ ভেসে উঠছে প্রতিটা লাইনে।
—————————–
এতদিন আমি পড়েছি ‘বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা‘। সেখানের পঙক্তিগুলোই মাথায় গেঁথে ছিল। কিন্তু “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র অন্তর্গত “আমার ঈশ্বরীকে”-এর কয়েকটি লাইন পূর্ব ধারণার সংশয় জাগিয়ে দিল।
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “অতি অল্প পুস্তকেই ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”
এখানে – “অতি অল্প রমণীতে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “যেন কোনো নিরুদ্দেশে, ইঁটের মতন ফেলে রেখে।”
এখানে – “যেন কোনো নিরুদ্দেশে, কটাক্ষের মতো ফেলে রেখে।”
“সেই কোন ভোরবেলা ইঁটের মতন চূর্ণ হয়ে” – লাইনটি নেই।
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল সাপের স্পর্শে মিশে।”
এখানে – “রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল ভ্রমের স্পর্শে মিশে।”
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে”
এখানে – “ধূসর, ধূসরতর, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে”
এবং,
“তুমি নিজে ঝ‘রে গেছ, হরিতকী ফলের মতন” এর বদলে
“তুমি নিজে ঝ‘রে গেছ; শুধু ভবিষ্যৎ হেসে ওঠে।”
শ্রেষ্ঠ কবিতায় –
“অসুখ গভীরতর তবু, হায় কবি, সংক্রামক নয়
কখনো ফুলের দেহে সংক্রামিত হয় নি, হবে না।”
এখানে –
“অসুখ গভীরতর, নিঃসন্দেহে সংক্রামক তবু
কখনো ফুলের দেহে সংক্রামিত হয় না, হবে না।”
এগুলো হয়তো খুবই সূক্ষ্ম পার্থক্য, কিন্তু কবিতায় একটি শব্দও যেহেতু আবেশ পুরো পাল্টে দিতে পারে, তাই একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। কিন্তু “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র অনেক পরে প্রকাশিত হয় শ্রেষ্ঠ কবিতা।” কাজেই হতে পারে, “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র শব্দগুলি আদিম, এবং “শ্রেষ্ঠ কবিতা” কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত আঙ্গিক।
—————————
যার লেখা “নক্ষত্রের আলোয়‘, ‘গায়ত্রীকে‘, ‘ফিরে এসো চাকা‘, ‘আমার ঈশ্বরীকে‘, ‘ঈশ্বরীয়‘ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ, তিনিই আবার লিখেছেন ‘Roots of Calculus’, ‘Interpolation series’, ‘Geometrical analysis and Unital Analysis’ ইত্যাদি।
‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী‘তে কবিতাগুলির বিন্যাসও অদ্ভুত। লম্বালম্বি নয়, বরং একটি লাইনের থেকে আরেকটি লাইনের পার্থক্য সূচিত হয়েছে ‘/’ চিহ্নের মাধ্যমে।
বইটির বাঁদিকে পাঞ্চিং মেশিনের সাহায্যে করা দুটি ফুটো, এবং নীল রঙের কাপড়ের ফালি দিয়ে বাঁধা। সুবিমল বসাক বললেন, বিনয় মজুমদার নাকি স্বয়ং বেঁধে দিয়েছিলেন। জরাজীর্ণ দশা বইটির। পাতাগুলিও নরম হয়ে এসেছে। যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছি। বইটির আয়ু আরো কিছুটা বাড়িয়ে রাখার চেষ্টা…
“কানের ভিতরে কারো হৃৎপিণ্ড শব্দ করে শুনি
শুয়ে শুয়ে, ফলে ভাবি, স্বভাবতঃ ভেবে যেতে হয় –
পরস্পর ভালোবেসে শুয়ে আছি ঈশ্বরী ও আমি ও সময়।”
তাঁতের শাড়ি বা খদ্দরের ধুতি একটু পুরোনো দোকানগুলোতে যেমন খয়েরি রঙের ফিনফিনে কাগজের ভরে দেয়, তেমনই কাগজে ছাপা পুরো বইটি। অথচ পাতায় পাতায় ছড়িয়ে আছে বিনয় মজুমদারের মণিমাণিক্য।
—————————-
“কোনোদিন বলেনি সে পৃথিবীর সেই মৃদু পুরাতন কথা।
একটি দেবীর আর দেবতার জীবনের – হৃদয়ের অপরূপ পরিপূরকতা
মনে ক‘রে কোনোদিন ডাকবে না সে কি তবে, নেবে নাকি যেচে?
হয়তো অনেকবার ডেকেছে; স্বপ্নের মাঝে, কেবল ঘুমের ঘোরে ডাকে সে – ডেকেছে।
একদিন চুপিচুপি কাছে যদি যেতে পারি – জেগে থাকা অবসরে নয় –
জ্যোৎস্নার নীচে তার ঘুমের সময়!”
অথবা,
“তোমার দিকে তাকাই আমি, দেখি অতল চোখ,
দেখি তোমার শরীর, আর বুঝি, তোমার মন
জড়িয়ে আছে চিরন্তন আকাঙ্ক্ষার লোক
বিভোর দেহে বিভোর মনে বিভোর বন্ধন।
তোমার দিকে তাকাই আমি, কী যে রহস্যের
অতল এক সমুদ্রের গভীর উদ্ভাস
তোমার চোখে, শরীরে, মনে; প্রেয়সী, দেখি ফের
মিষ্টতায় ঝঞ্ঝায়িত সমুদ্রের শ্বাস।”
ভাষা তো দূরের কথা, এমন আঙ্গিকে বিনয় মজুমদারের লেখা আগে পড়িনি আমি। এগুলি ওঁর প্রথমদিকের লেখা। তবু অসামান্য প্রেমিকের চোখ ভেসে উঠছে প্রতিটা লাইনে।
—————————–
এতদিন আমি পড়েছি ‘বিনয় মজুমদারের শ্রেষ্ঠ কবিতা‘। সেখানের পঙক্তিগুলোই মাথায় গেঁথে ছিল। কিন্তু “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র অন্তর্গত “আমার ঈশ্বরীকে”-এর কয়েকটি লাইন পূর্ব ধারণার সংশয় জাগিয়ে দিল।
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “অতি অল্প পুস্তকেই ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”
এখানে – “অতি অল্প রমণীতে ক্রোড়পত্র দেওয়া হয়ে থাকে।”
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “যেন কোনো নিরুদ্দেশে, ইঁটের মতন ফেলে রেখে।”
এখানে – “যেন কোনো নিরুদ্দেশে, কটাক্ষের মতো ফেলে রেখে।”
“সেই কোন ভোরবেলা ইঁটের মতন চূর্ণ হয়ে” – লাইনটি নেই।
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল সাপের স্পর্শে মিশে।”
এখানে – “রোমাঞ্চ তো রয়ে গেছে শীতল ভ্রমের স্পর্শে মিশে।”
‘শ্রেষ্ঠ কবিতা‘য় – “ধূসর জীবনানন্দ, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে”
এখানে – “ধূসর, ধূসরতর, তোমার প্রথম বিস্ফোরণে”
এবং,
“তুমি নিজে ঝ‘রে গেছ, হরিতকী ফলের মতন” এর বদলে
“তুমি নিজে ঝ‘রে গেছ; শুধু ভবিষ্যৎ হেসে ওঠে।”
শ্রেষ্ঠ কবিতায় –
“অসুখ গভীরতর তবু, হায় কবি, সংক্রামক নয়
কখনো ফুলের দেহে সংক্রামিত হয় নি, হবে না।”
এখানে –
“অসুখ গভীরতর, নিঃসন্দেহে সংক্রামক তবু
কখনো ফুলের দেহে সংক্রামিত হয় না, হবে না।”
এগুলো হয়তো খুবই সূক্ষ্ম পার্থক্য, কিন্তু কবিতায় একটি শব্দও যেহেতু আবেশ পুরো পাল্টে দিতে পারে, তাই একটা জিজ্ঞাসা থেকেই যায়। কিন্তু “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র অনেক পরে প্রকাশিত হয় শ্রেষ্ঠ কবিতা।” কাজেই হতে পারে, “ঈশ্বরীর কবিতাবলী”র শব্দগুলি আদিম, এবং “শ্রেষ্ঠ কবিতা” কিঞ্চিৎ পরিমার্জিত আঙ্গিক।
—————————
যার লেখা “নক্ষত্রের আলোয়‘, ‘গায়ত্রীকে‘, ‘ফিরে এসো চাকা‘, ‘আমার ঈশ্বরীকে‘, ‘ঈশ্বরীয়‘ প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ, তিনিই আবার লিখেছেন ‘Roots of Calculus’, ‘Interpolation series’, ‘Geometrical analysis and Unital Analysis’ ইত্যাদি।
‘ঈশ্বরীর কবিতাবলী‘তে কবিতাগুলির বিন্যাসও অদ্ভুত। লম্বালম্বি নয়, বরং একটি লাইনের থেকে আরেকটি লাইনের পার্থক্য সূচিত হয়েছে ‘/’ চিহ্নের মাধ্যমে।
বইটির বাঁদিকে পাঞ্চিং মেশিনের সাহায্যে করা দুটি ফুটো, এবং নীল রঙের কাপড়ের ফালি দিয়ে বাঁধা। সুবিমল বসাক বললেন, বিনয় মজুমদার নাকি স্বয়ং বেঁধে দিয়েছিলেন। জরাজীর্ণ দশা বইটির। পাতাগুলিও নরম হয়ে এসেছে। যথাসম্ভব পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করেছি। বইটির আয়ু আরো কিছুটা বাড়িয়ে রাখার চেষ্টা…
“কানের ভিতরে কারো হৃৎপিণ্ড শব্দ করে শুনি
শুয়ে শুয়ে, ফলে ভাবি, স্বভাবতঃ ভেবে যেতে হয় –
পরস্পর ভালোবেসে শুয়ে আছি ঈশ্বরী ও আমি ও সময়।”
|
|
|
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন