বুধবার

"প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার" ও একটি চিন্তা : তন্ময় ভট্টাচার্য


আমি ভাবছিলাম কোন ডাইমেনশনে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারলে একটা সন্ধ্যা মনে থেকে যাবে। আমি ভাবছিলাম আদৌ মনে রাখার মতো কিছু থাকবে কিনা আসন্ন সন্ধ্যায়। ক্যালেন্ডারের পাতার পর পাতা উল্টে যাওয়ার মধ্যে লাল কালি নিতান্ত দুষ্প্রাপ্য না হলেও মোড়ে মোড়ে চায়ের দোকানের মতো সহজলভ্যও নয়। কিন্তু সেই মোড়ে কোনো চায়ের দোকান ছিল না। ছিল না কোনো দুপুরের ঘাম মুছতে থাকা রিকশাওয়ালার বিড়ির ছাপ। একটা পুকুর, আর তার পাশ দিয়ে ড্রিমগার্লের কোমরের মতো একটা রাস্তা ঢুকে যাচ্ছে আরো গভীরে। বিতর্কের অবকাশ রইলো।

মলয় রায়চৌধুরী লিখেছিলেন –
“এরকম অসহায় চেহারা ফুটিয়েও নারী বিশ্বাসঘাতিনী হয়
আজ মনে হয় নারী ও শিল্পের মতো বিশ্বাসঘাতিনী কিছু নেই”

এ হল সেই কবিতার দুটি লাইন, যে কবিতার জন্য অশ্লীলতার দায়ে কবি’কে জেলে যেতে হয়েছিল। হাংরি আন্দোলনের সে এক উথালপাথাল সময়। কিছুটা বইয়ে পড়া, অনেকটাই শোনা শ্রদ্ধেয় সুবিমল বসাকের মুখে। আমজনতার স্থূল হিসেবে হাংরি আন্দোলন অশ্লীলতা’র চূড়ান্ত নিদর্শন। ১৯৬৪ সালের প্রেক্ষিতে বাঙালির সামাজিক তথা মানসিক অবস্থান সহজেই কল্পনা করা যায়। নারায়ণ সান্যাল তাঁর ‘অশ্লীলতার দায়ে’ বইয়ে লিখেছিলেন, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি পরিবর্তিত হতে থাকে, ফলে এককালীন ‘অবসিনিটি’ চিরকালের খাতায় কখনোই বরাদ্দ হতে পারে না। অত্যন্ত সুচিন্তিত একটি উক্তি। আজ ২০১৫-তে দাঁড়িয়ে যখন সমরেশ বসু’র ‘প্রজাপতি’ বা ‘বিবর’ পড়ছি, লরেন্সের ‘লেডি চ্যাটারলি’জ লাভার’, মলয় রায়চৌধুরীর ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ বা সুবিমল বসাকের ‘অযথা খিটক্যাল’, তখন তা আমার চোখে ধরা দিচ্ছে জীবনের অত্যাবশ্যকীয় অঙ্গ হিসেবে। অথচ বছর পাঁচেক আগেই যখন প্রথম হাংরি’দের লেখা পড়ি, বয়েস ১৬-১৭ এর আশেপাশে, অপেক্ষাকৃত অপরিণত মনে যে অশ্লীলতা’র চিন্তা উঁকি দেয় নি – সেই দাবি করা নিতান্ত অন্যায় হবে। কিন্তু জানার পড়ার ও দেখার পৃথিবী বিস্তৃত হওয়ার সাথে সাথে খোলা দরজা দিয়ে প্রবেশ করেছে অনেক আলো, এবং সেখানে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের “ভালোবাসা পিঁড়ি পেতে রেখেছিল উঠোনের কোণে” যেমন বাস্তব, ঠিক তেমনই বাস্তব মলয় রায়চৌধুরীর প্রশ্ন – “কেন আমি পিতার আত্মমৈথুনের পর তাঁর পেচ্ছাপে বয়ে যাইনি”। শঙ্খ ঘোষের “তোমার দেবতা নেই তোমার প্রেমিক শুধু আছে”এই পঙক্তি’র কাছে আমাই মাথা নত করেছি বারবার। কিন্তু তাই বলে ফালগুনী রায়ের “ইচ্ছে আছে লিঙ্গের উত্থান থেকে টেলিপ্যাথিক কম্যুনিকেশন সম্পর্কে গূঢ় তথ্য জেনে নেবার” অকিঞ্চিৎকর নয় মোটেই। এই প্যারালাল থিঙ্কিং প্রসেস কিছু ক্ষেত্রে ক্ষতিকর, কিছু ক্ষেত্রে জানার সীমানাটাকে বাড়িয়ে দেয় বহুদূর।

“প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার” আমার কাছে একটি ‘মোড় বদলানো’ কবিতা। গতানুগতিক চিন্তা’র বা পরিবেশনের ঘাড়ধাক্কা দিতে এমন কর্কশ অথচ বাস্তব লেখার দরকার ছিল অবশ্যই। হাংরি’দের সেই ধাক্কার ঢেউ এসে না পৌঁছলে আজ পঞ্চাশ বছর বাদে আমি “একটু নুন ছিটিয়ে দেখে নিতে পারো গূঢ় অঙ্গে জ্বলন ধরে কিনা” এই লাইনটা লেখার সাহস দেখাতে পারতাম না। কারণ আমাদের প্রত্যেকটা লেখা কোথাও না কোথাও পূর্বজ’দের উত্তরাধিকার বয়ে আনে। জীবনানন্দের পরেই যেমন শ্রীজাত’র ভাষা আসা সম্ভব ছিল না, তেমনি জীবনানন্দ না থাকলে শ্রীজাত তাঁর নিজস্ব ভাষা আয়ত্তও করতে পারতেন না। কাজেই লোকে যতোই খিস্তি করুক, হাংরিরা যে বাংলা সাহিত্য’কে সাবালকত্বে অনেকটাই পৌঁছে দিয়েছে, তা অস্বীকার করা যায় কি? এলাকার ডাকসাইটে গুন্ডারও প্রথম যৌনমিলনের সময় বুক কাঁপে, কিন্তু সফলতার পরই সে সর্বাঙ্গসুন্দর হয়। হাংরি আন্দোলনের লেখক/কবি’রা ইতিহাসের সেই অনুঘটক।

যে প্রসঙ্গে এই আলোচনা। মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি’র সিনেমা ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’। কবিতার ভাব নিয়ে বাংলায় এর আগে এমন কোনো সিনেমা হয়েছে কিনা, জানা নেই। ‘যারা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ একটি অসামান্য কাব্যপোন্যাস। কিন্তু সিনেমা হিসেবে চতুর্থ শ্রেণীর। মৃগাঙ্কশেখর গাঙ্গুলি পরতে পরতে ন্যারেটিভ স্ট্রাকচার ভেঙে অবচেতন ও রিয়ালিজম’কে পর্দায় ফুটিয়ে তুলেছেন, যার মধ্যে যৌনতা খিদে রক্ত হিংসা সমকাম স্থায়িত্বচিন্তা আর ধ্বংস এসেছে ঐশ্বরিক আবির্ভাবের মতো। (এখন যদি আপনারা ঈশ্বর বলতে ধূপদীপসমন্বিত ঠাকুরঘরের কথা ভাবেন, তাহলে অনুরোধ করবো দয়া ক’রে স্বর্গ থেকে পৃথিবী’তে নির্বাসিত দেব-দেবীদের কেচ্ছাগুলো ভুলে যাবেন না।) আমাদের এই ভারতবর্ষে আগামী তিরিশ বছরে এই সিনেমা প্রকাশ্যে দেখানো যাবে না। কারণ তাহলেই নামাবলি আর তসবি’র মালা রে রে করে ছুটে আসবে, ছুটে আসবে কাশী মিত্তির ঘাট থেকে গঙ্গাজল বয়ে আনা বংশধরগণ। কাজেই অশ্লীলতা’র দোষে এটিকে ফাঁসি’তে ঝোলাবেন কয়েকজন, কয়েকজন কাটাছেঁড়া করবেন ‘কী হতে পারতো’ নিয়ে। অনেকেই নিতে পারবেন না, কিন্তু একবার সেঁধোলে যে অনুভূতি, তা ভুলতেও পারবেন না। শুধু মুখ দেখে তো আর বিদেশের আট-দশটা ফিল্ম ফেস্টিভ্যালের ‘অফিশিয়াল সিলেকশন’ হয় নি!

পুনশ্চ – ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ কিন্তু ‘কসমিক সেক্স’ নয়।

 

 
   



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন