তাঁর লেখা অনেকেই পড়েনি। কিন্তু যারা পড়েছে, ভুলতে পারেনি। তিনি সুবিমল বসাক। বাংলা সাহিত্যের ব্যাতিক্রমী গদ্যকারদের প্রথম সারিতেই উঠে আসা উচিৎ তাঁর নাম। অথচ, প্রকাশিত বইয়ের সংখ্যা যথেষ্ট হলেও, মূলত প্রচারের অভাব, দুষ্প্রাপ্যতা ও প্রকাশকের প্রকাশকের উদ্যোগহীনতার কারণে তাঁর বেশিরভাগ বই-ই গরিষ্ঠ সংখ্যক পাঠকের অপঠিত থেকে গেছে আজ পর্যন্ত। ভবিষ্যতের জন্য বইগুলি বাঁচিয়ে রাখা একান্ত প্রয়োজন; নইলে বাংলা সাহিত্যের কিছু দুর্মূল্য রত্ন আড়ালে চলে যাবে চিরদিনের জন্য…
(১)
১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৩৯ সালে বিহারের পাটনায় জন্মগ্রহণ করেন সুবিমল বসাক। কিন্তু আদতে তাঁর শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়। একটি সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন – “বাবা যৌবনে ঢাকা ছেড়ে আসেন, কাজের ধান্দায় নানান জায়গায় ঘুরে শেষে পাটনায় থিতু হন। ভাল কারিগর ছিলেন, উদ্যমী ছিলেন, পরিশ্রমীও ছিলেন। প্রচুর অর্থ উপার্জনের সঙ্গে সঙ্গে অভিজাত মহলেও একটা আসন গড়ে তুলেছিলেন। পাটনায় দোতলা বাড়ি নির্মাণ করেন ১৯৩৯ সালে, আমার জন্মবর্ষে, কিন্তু গৃহপ্রবেশ করেছিলেন কয়েকবছর পর; কেননা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রস্তুতিপর্বে জনৈক মিলিটারি অফিসার আমাদের বাড়িতে ঢুকে পড়েন। মা-কে ঢাকা থেকে নিয়ে আসার পর পাটনার স্থায়ী বাসিন্দা। আমাদের স্বজাতি অন্যান্য ব্যবসায়ীর তুলনায় আমাদের অবস্থা খুব উন্নত ছিল বলা যায়। পরিবারের অন্যান্যরা ঢাকায় থাকতেন, যৌথ পরিবারের দরুণ বাবাকে নিয়মিত খরচ পাঠাতে হতো। আমার মামার বাড়িও ঢাকায়, তখন বিয়ের সম্বন্ধ হতো কাছে পিঠে। পরে অবশ্য এক মামা আর মেসো খাগড়ায় স্থায়ী বাসিন্দা হন। মামাতো ভাই-বোনেরা খাগড়াই ভাষায় কথা বলে। ঢাকায় আমরা শেষ যাই পঞ্চাশ সনের কিছু আগে, পাসপোর্ট-ভিসার প্রচলন হয়নি, তখনও ভারতীয় টাকা চলতো – নোটের বাঁ-দিকে সাদা অংশে ‘গভর্নমেন্ট অফ পাকিস্থান’ ছাপা থাকতো, ডানদিকে ষষ্ঠ জর্জ। পঞ্চাশের দাঙ্গায় আত্মীয়-স্বজন সকলেই বাড়ি জমি, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ফেলে রেখে চলে আসে। রিফ্যুজি কার্ড হোল্ডার। আমরা অবশ্য সে অর্থে রিফ্যুজি নই, কিন্তু অবস্থা খারাপ ছিল রিফ্যুজি-আত্মীয়দের চেয়েও…”। তাঁর পিতা ছিলেন গহনার দোকানের মালিক। যথেষ্ট স্বচ্ছ্বল অবস্থা থাকা সত্ত্বেও, ১৯৬৩ সালে ভারত সরকার কর্তৃক ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ফলে অনেক ব্যবসায়ীর সঙ্গে তিনিও আর্থিক বিপর্যয়ের মুখে পড়েন এবং নাইট্রিক অ্যাসিড খেয়ে আত্মহত্যা করেন।
পাটনায় মলয় রায়চৌধুরী, সমীর রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় ও দেবী রায়ের নেতৃত্বে ১৯৬০ সালে শুরু হয় হাংরি আন্দোলন। বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত সংরক্ষণশীল মানসিকতা ভেঙে নতুন পথের সূচনা করাই ছিল আন্দোলনকারীদের লক্ষ্য। মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে আলাপের সুবাদে, পিতার মৃত্যুর পর, ১৯৬৩ সালের শেষের দিকে সুবিমল বসাক যোগ দেন হাংরি আন্দোলনে। তাঁর শক্তিশালী কবিতা ও গদ্যের মাধ্যমে আন্দোলনকারীদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন এবং সমান্তরালভাবে চক্ষুশূল হন বাংলা সাহিত্যের অধিপতিদের। পাটনা থেকে আগত সাবঅল্টার্ন শ্রেণীর একজন বাংলা সাহিত্যে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে – এ তাঁরা সহ্য করতে পারেননি। সুবিমল বসাক তখন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ নামের একটি লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদনা করতেন। সেই পত্রিকার এক সংখ্যায় শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের একটি কবিতা ছিল। ‘দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষ শক্তি’র ওপর ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, হাংরি পত্রিকায় লেখা দেয়ার জন্য। ফলে সুবিমল বসাকের ওপর শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের আক্রোশ জন্মায় এবং একদিন কলেজ স্ট্রিট কফি হাউজের নিচে সুবিমল বসাক’কে দলবল সহ ঘিরে ধরে শক্তি লোহার রড দিয়ে মারতে উদ্যত হন। সে সময় সেই চত্ত্বরে উপস্থিত ছিলেন দেবী রায়, ত্রিদিব মিত্র, বেলাল চৌধুরী প্রমুখ। তাঁদের তৎপরতায় ঝামেলা বেশিদূর গড়ায়নি। এ সব ঘটনা এখন কিংবদন্তী। অশ্লীলতার দায়ে হাংরি জেনারেশনের যে পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হয়েছিল, তাতে সকলের সঙ্গে সুবিমল বসাকেরও লেখা ছিল এবং যে এগারোজনের বিরুদ্ধে সাহিত্যে অবসিনিটির জন্য আদালতে মামলা দাখিল করা হয়, তাঁদের মধ্যে সুবিমল বসাক একজন। পরবর্তীকালে ১৯৬৫তে আন্দোলন সমাপ্ত হলে আন্দোলনকারীরা পরস্পরের থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান এবং ব্যক্তিগত লেখালিখির ধারা বজায় রাখেন।
সুবিমল বসাকের প্রথম গ্রন্থ ‘ছাতামাথা’, ১৯৬৫ সালে প্রকাশিত। তাঁর অন্যান্য বই – হাবিজাবি(১৯৭০), গেরিলা আক্রোশ(১৯৭৪), আত্মার শান্তি দু’মিনিট(১৯৮৫), অযথা খিটক্যাল(১৯৮৭), বিয়ার গীত ও ঢাকাই ছড়া(১৯৮৭), কুসংস্কার ১৫৫(১৯৮৭), প্রত্নবীজ(১৯৯৬), ক্যাজুয়াল লিভ(২০০০), বকবকানি(২০০০), এথি(২০০১), কুট্টি(২০০৩), তিজোরীর ভিতর তিজোরী(২০০৫), গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা(২০০৭), দুরুক্ষী গলি(২০১১), এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি(২০১৪)। এর মধ্যে ‘হাবিজাবি’ ও ‘বকবকানি’ এ দুটি কবিতা সংকলন।
সুবিমল বসাক বাংলা ভাষার অন্যতম প্রধান অনুবাদক। তাঁর অনুদিত গ্রন্থগুলি হল – প্রতিবেশী জানালা(কবিতা সংকলন, ১৯৭৫), তিসরী কসম(ফণীশ্বর নাথ রেণু, ১৯৭৬), পঞ্চপরমেশ্বর(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮০), ফণীশ্বর নাথ রেণু’র শ্রেষ্ঠ গল্প(১৯৮২), দুই সখী(প্রেমচন্দের গল্প সংকলন, ১৯৮৪), জীবন সার(প্রেমচন্দের প্রবন্ধ, ১৯৮৫), উজ্জয়িনীর রাস্তা(শ্রীকান্ত বার্মার কবিতা সংকলন, ১৯৮৬), বোবাদের পল্লীতে(জগদীশ চতুর্বেদীর কবিতা সংকলন, ১৯৮৯), খুবসুরত(খাজা আহমদ আব্বাসের গল্প সংকলন, ১৯৯২), গোমুখ যাত্রা(শীলা শর্মা’র ভ্রমণকাহিনী, ১৯৯২), মোহন রাকেশ(প্রতিভা অগ্রবাল রচিত জীবনী, ১৯৯৩), হিন্দী কাহিনী সংগ্রহ(১৯৯৯), আমার তোমার তার কথা(যশপালের উপন্যাস, ২০০১), যাত্রিক(নীল পদ্মনাভন, ২০০২)।
ওপরে ২০১৫ পর্যন্ত প্রকাশিত বইগুলির নামই উল্লেখ করা হয়েছে। ২০১৬ কলকাতায় বইমেলায় প্রকাশিত হবে সুবিমল বসাকের রচনা সংকলনের প্রথম খণ্ড(ছাতামাথা, গেরিলা আক্রোশ, আত্মার শান্তি দু’মিনিট ও অযথা খিটক্যাল), শাবানা আজমির ‘আব্বা’ বইটির অনুবাদ।
সুবিমল বসাক যশপালের হিন্দী উপন্যাস ‘মেরি তেরি উসকি বাত’ বাংলায় অনুবাদের জন্য ২০০৭ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরষ্কার অর্জন করেন।
(২)
বেলঘরিয়ার ইতিহাস প্রসঙ্গে সুবিমল বসাকের কথা লিখছি কেন? ওঁর জন্ম তো পাটনায়, শিকড় পূর্ববঙ্গের ঢাকায়, তাহলে? উত্তর খোঁজা যাক সুবিমল বসাকের এক সাক্ষাৎকারেই – “বেলঘরিয়ায় আমি আসি ১৯৬৭ সালে। তার আগে অনেক আস্তানা বদল করে ডানলপ ব্রিজের কাছাকাছি অশোকগড়ে একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম। …অশোকগড়ের বাসা ছেড়ে বেলঘরিয়ায় চলে আসি। প্ল্যাটফর্মে ঘরখালি বিজ্ঞাপন দেখে স্টেশনের ধারে যে পাড়া পাই, বিবেকানন্দ নগর – বস্তি-কাম-পাড়া – তাতে বাসা নিই। তখনও জানা ছিল না, পাড়াটা বিহারের তুলনাতেও একটি ভয়ঙ্কর জায়গা। আশেপাশে স্বাধীনতা-উত্তর ওয়াগন ব্রেকার, চুল্লুঠেক এবং খুনেদের সমাহার। যে ঘরটায় আমি থাকতাম, তার উত্তরে খোলা মাঠ, এবং ওই মাঠে যে বহু লাশ গুম করা হত সেটা পরে টের পাই। রাতবিরেতে মাতালদের হল্লা, পুলিশের যখন-তখন আস্ফালন এবং ওয়াগন ব্রেকারদের রাজত্ব বিস্তার।” ১৯৮০ সালে বিবেকানন্দ নগরের ভাড়াবাড়ি ছেড়ে বেলঘরিয়ার ভার্নার লেনে নিজস্ব বাড়ি তৈরি করে স্থানান্তরিত হন তিনি এবং এখনও ভার্নার লেনের ওই বাড়িতেই বাস করেন। সাহিত্য অনুরাগীদের কাছে দীর্ঘদিন ধরে ‘বেলঘরিয়া’ নামটি উজ্জ্বল হয়ে আছে সুবিমল বসাকের বসবাসের সৌজন্যেই, কেন না এখনও পর্যন্ত তাঁর মাপের কোনো সাহিত্যিকের দীর্ঘ সংস্পর্শধন্য হয়নি এই জনপদ। তাই, পাটনায় জন্ম হলেও, বেলঘরিয়ার সঙ্গে প্রায় পঞ্চাশ বছরের সম্পর্ক যে মানুষটির, তাঁকে অস্বীকার করলে ইতিহাস আমাদের ক্ষমা করবে কি?
সুবিমল বসাক বেশ কিছু কবিতা লিখলেও তাঁর পরিচয় মূলত গদ্যকার ও অনুবাদক হিসেবে। তাঁর সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনার জন্য একটি অধ্যায় যথেষ্ট নয়। সম্পূর্ণ একটি গ্রন্থ রচিত হওয়া উচিৎ শুধুমাত্র লেখার বিষয় ও ভাষার ভঙ্গি নিয়েই। এখানে সামান্য আভাস দিয়ে রাখি মাত্র…
তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘ছাতামাথা’ বাংলার প্রথম ডি-ন্যারেটিভাইজড উপন্যাস। গতানুগতিক সূত্র ধরে ঘটনাপ্রবাহে এগিয়ে যাওয়ার সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে এই সৃষ্টি। ঢাকার কথ্যভাষায় লেখা এই উপন্যাস শুরু হচ্ছে এইভাবে – “আন্ধার আর সুমসাম কুঠুরিতে একলা থাকলেই আমার খালি খালি নরক আর শয়তানের কথা মনে আহে। নরক যাওনের রাস্তাঘাটগুলা চিনা নাই, চিনাজানা থাকলে মাঝেমধ্যি আওন-যাওন যাইতো। পূজা-পাইলের দিনে তেহার-পরবে ঐহানে গিয়ে দুই একদিনের লাইগ্যা ঘুইর্যা আওন যাইতো। … হয়তানের কথা হগল সময়ে মনে আহে, অর কথা ভাইব্যা-ভাইব্যা শরীল নিপাত করি, অথচো কোন কুলকিনারা পাই না। ক্যান জানি মনে হয়, হয়তানে আমার কাছে পিঠেই আছে। …যারে দেহি তারেই জিগাই, ‘এখানে শ্রীযুক্ত বাবু শয়তান নামে কেউ থাকেন কি?’” বইটির উৎসর্গপত্র বাংলা সাহিত্যে আজও মৌলিক। এমনটি আর কেউ লিখতে পারেননি। ষাটের দশকে বইটি প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বাংলার এলিট সাহিত্যমহলে তীব্র সাড়া পড়ে গিয়েছিল গদ্যের ফর্মের জন্য।
‘হাবিজাবি’ বইটির সব কবিতাই ঢাকাই ভাষায় রচিত। যে কারণে অনেকের বোধগম্য না হলেও, যারা ধৈর্য ধরে সেই বেড়াটুকু টপকে যেতে পেরেছে, বাংলা কবিতার এক নতুন ফর্ম উঠে এসেছে তাদের কাছে, যে ফর্মের ধারেকাছে পঞ্চাশ বছর বাদে আজও কেউ দাঁড়াতে পারেনি। একটি কবিতা তুলে ধরি –
“সারারাত্র বাত্তি আঙাইয়া আমি আর উই শুইয়া কাটাই
নীল হেজহানে লাগালাগি চাম ছেঁওয়াইয়াও কতো আল্গা আছি
অর চ্যারায় কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
আমার চ্যারায়ও কুনো পীরিতের চিন্হী নাই
ভয়ান্নক রূপ দেহনের ডরে আমরা দুইজনে চোক্ষু জুইব্বা আছি
তবও নিষ্ঠুরের লেহান আওগাইয়া
কয় দণ্ড মুহূর্ত
কিছুটা সময়-ওক্তো
আমরা ‘পীরিতের খেলা-পীরিতের খেলা’ খেলি।”
লক্ষ্য করবেন, ভাষার আড়ালে জীবনের কী দুর্বিষহ সহনশীলতার কথা উঠে এসেছে কবিতায়। এমনই আরেকটি ‘বকবকানি’ গ্রন্থের ‘জন্মদিনে’ কবিতাটি –
“জন্মদিনে ওড়ানো আটটি সাদা পায়রা, আজ
ফিরে আসে ঊনষাটটি কালো শকুন
চাতালহীন মাথার ওপর তাদের যূথবদ্ধ
অবিশ্রান্ত ওড়াউড়ি
জটিল ও বিশৃঙ্খল ছায়া
দুর্বোধ্য ও পারম্পর্যহীন চিৎকার
আমার সমস্ত মন দূষিত করে তোলে
জানা ছিল না – কী বিশাল রোমশ কালো দাঁত
ছড়ানো চারদিকে
বারবার হড়কে পড়ি কোন এক অদৃশ্য টানে
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বেড়ে ওঠে দুঃখ-যন্ত্রণা
আজ, আমার মায়ের ঝকঝকে কণ্ঠস্বরও
ধূসর হয়ে পড়ে!”
কোনটা ছেড়ে কোনটার কথা বলি! ‘গেরিলা আক্রোশ’, ‘অযথা খিটক্যাল’, ‘আত্মার শান্তি দু’মিনিট’, ‘গোপন দস্তাবেজ ও শীততাপ নিয়ন্ত্রিত আত্মা’, ‘এখনও কোনো ব্যবস্থা হয়নি – প্রত্যেকটিই গদ্যগ্রন্থ হিসেবে ব্যাতিক্রমী এবং সুবিমল বসাকের কলমের মুনশিয়ানার চূড়ান্ত পরিচয় পাওয়া যায় এগুলিতে। সাবঅল্টার্ন অর্থাৎ সমাজের অন্ত্যজ শ্রেণীর লোকেদের কথা তাঁর লেখায় উঠে এসেছে বারবার, তিনি নিজেও সেই সমাজের মধ্যে দীর্ঘদিন বাস করায়, প্রাণবন্ত হয়েছে উপস্থাপনা। এই নজির দেখা যায় বিশেষত ‘প্রত্নবীজ’-‘এথি’-‘তিজোরীর ভিতর তিজোরী’ – এই ত্রয়ী’তে। পাটনায় অবস্থিত বিহারীদের মুখে বাংলা’র যে উচ্চারণ, সেই ভাষায় রচিত এই তিনটি বই বাংলা সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ।
পটভূমিকাও বিহারের। সতীনাথ ভাদুড়ী ছাড়া আর কেউ বাংলায় এ ধরণের লেখায় সফল হয়েছেন কিনা, জানা নেই। সুবিমল বসাক ‘এথি’ ভাষাতেও প্রকাশ করেন, ‘মহল্লা লোদীপুর’ নামে; এবং বইটি বিহারে দারুণ সমাদৃত হয়। লেখক নিজেও বিশ্বাস করেন, তাঁর ‘প্রত্নবীজ’ বইটি একদিন সমাদৃত হবেই বাংলার পাঠকসমাজে।
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর একটি অনন্যসাধারণ গবেষণাগ্রন্থ – ‘বিয়ার গীত ঢাকাই ছড়া’। লেখক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন – “বিয়ার গীত সংগ্রহ করাটা ছিল অন্যপথে। জনৈক স্বজাতির বিয়েতে হাজির হয়ে দেখেছি, কয়েকজন প্রৌঢ়া-বৃদ্ধা তাঁদের শেষ কামড় দিচ্ছে। আমি সংগ্রহ করতে শুরু করি। নদীয়া-ফুলিয়া অঞ্চলে গিয়ে কিছু সংগ্রহ করেছি। এই রীতি-নীতি, গীত, পদ এখন লোপ পেয়েছে বলা চলে। মীজানুর রহমান ‘বিয়ার গীত’ প্রাপ্তিস্বীকারে লিখেছিলেন – ‘এই বিরাট মাপের কাজটি আমাদেরই করার কথা, আপনি কাজটি করে আমাদের স্মৃতি উসকে দিয়েছেন। বাংলাদেশে প্রত্যন্ত এলাকায় এখন মাইকেল জ্যাকসন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে’। মীজানুর রহমান তাঁর পত্রিকায় পুরো বইটি ছেপেছেন।” বইটির প্রথম অংশ ‘বিয়ার গীত’। এখানে লেখক ঢাকার হিন্দুদের বিবাহের আচার-আচরণ, নিয়ম ও তৎসংলগ্ন গানের বর্ণনা দিয়েছেন। “ঢাকায় প্রচলিত বিয়ে উপলক্ষে গানকে ‘বিয়ার গীত’ বলা হয়। কেবল ঢাকা নয়, সমগ্র ঢাকা জেলায় ‘বিয়ার গীত’ বলে প্রচলিত… এইসব গানে তখনকার কাল যুগ পরিবেশ ইত্যাদির একটা মোটামুটি আভাস পাওয়া যায়, তখনকার সময়ের সহজ সরল অনাড়ম্বর অনুভূতির রেশ এই সব বিয়ার গীতে উপস্থিত থাকে”।
হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতির শেষ অস্তিস্ত্বটুকু লেখক অমর করে রেখেছেন তাঁর এই গ্রন্থে। বইটির দ্বিতীয় অংশে আছে প্রচুর ছড়া, যা ঢাকার অধিবাসীদের মুখে মুখে পরম্পরায় প্রচলিত। সেসব স্মৃতিমেদুরতায় ভারাতুর, অনায়াসে হাত ধরে নিয়ে যায় শৈশবে। দুঃখ হয় যখন দেখি, বাংলার তথাকথিত সংস্কৃতিমনস্ক মানুষেরা বইটির সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন আদৌ।
‘কুসংস্কার ১৫৫’ বইটিতে সংকলিত আছে বাংলায় প্রচলিত ১৫৫টি কুসংস্কার; যা সুবিমল বসাক দীর্ঘ অনুসন্ধানের মাধ্যমে সংগ্রহ করেছিলেন। ‘কুট্টি’ হল ঢাকার গাড়োয়ানদের মুখে মুখে প্রচলিত রসিকতার এক অনবদ্য সংকলন। অবাক লাগে, পারিপার্শ্বের যথাযোগ্য সহযোগিতা না পেয়েও তিনি কীভাবে লিখে গেছেন একের পর এক বই। সমান্তরালভাবে বেরিয়েছে অনুদিত গ্রন্থগুলিও। তাঁর স্মরণযোগ্য একটি উপন্যাস ‘দুরুক্ষী গলি’, এবং উপন্যাস হিসেবে হয়তো সর্বোত্তমও। চলিত বাংলায় লেখা হলেও বইটির পরতে পরতে মিশে আছে ফেলে আসা ঢাকা’র স্মৃতি। অভিজ্ঞতা ছাড়া এমন উপন্যাস লেখা যায় না। মলয় রায়চৌধুরী আমাদের একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, এই উপন্যাসটি লেখকের সেরা রচনা; এমন বিষয় নিয়ে আগে কেউ লেখেনি, পরেও কেউ লিখবে না সম্ভবত। স্বর্ণকারদের দৈনন্দিন জীবন ও জীবিকার এমন সূক্ষ্ম বর্ণনা অভিজ্ঞতা ছাড়া লেখা অসম্ভব। এবং ঘটনাপ্রবাহে আকর্ষণীয় করে তোলাও একটি শিল্প। বহুকাল আগে মুর্শিদাবাদ থেকে একদল তাঁতি ইংরেজদের অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে পূর্ববঙ্গে পালিয়ে গেছিলেন, বিশেষত ঢাকায়। সেখানে স্বর্ণকারবৃত্তি’কেই তাঁরা জীবিকা হিসেবে বেছে নেন। তারপর, গত শতকের চল্লিশের দশকে অনেকেই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন, দেশভাগের পূর্বাভাস পেয়ে। তাঁদের কয়েকজন বিহারের পাটনায় স্বর্ণকারের জীবিকা বজায় রাখেন। তাঁরাই উপন্যাসের নায়ক। সময়ের হাত ধরে এই উপন্যাসে উঠে এসেছে দেশভাগ, ঢাকা’র স্মৃতি, বিবাহের রীতি, কৈশোরের অনুভূতি, যৌনতার স্বাদ। এবং পরিসমাপ্তি চীন-ভারত যুদ্ধের আঙিনায়। বাংলা সাহিত্যে সম্ভবত আর কোনো উপন্যাসে ৬১’সালের চীন-ভারত যুদ্ধের পটভূমিকা আসেনি। ‘দুরুক্ষী গলি’ হল পাটনার প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি রাস্তা, যেখানে স্বর্ণকারদের বাস। তাঁদের আচারে কল্পনায় যাপনে উঠে আসে ঢাকা’র ফেলে আসা দিনগুলো। যে কারণে তারা বলে ওঠে – “খালি কলমের আঁচড় কাটল – ওমতে দেশভাগ। আমগো লগে থাকতে হইলে এই দ্যাশে আসতে হইব। হ। আরে, লোকজনের কত কষ্ট, কত দুর্দশা, কত ছিদরত, বাড়িঘর সাত পুরুষের ভিটা ছাইড়্যা, চিরদিনের মতো চইল্যা আসন কি মুখের কথা! নাড়ির টান পড়ে”। সম্পূর্ণ সাবঅল্টার্ন অবস্থান থেকে লেখা এই উপন্যাসের পরিণতিতে অস্তিত্বের সংকট কী করুণভাবে বর্ণিত হয়েছে তা সত্যিই দেখার মতো। একবার ঢাকা থেকে উচ্ছেদ হলেও যেসব লোকেরা নিজেদের জীবিকা ত্যাগ করেনি, ভারত সরকারের ‘গোল্ড কন্ট্রোল’ আইনের ঠেলায় তাদের আত্মপরিচিতি কিভাবে অভাবের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হয়ে গেল – সেই বাস্তবের এক মর্মন্তুদ দলিল এই উপন্যাস।
সুবিমল বসাক হলেন সেই সাহিত্যিক, যিনি হাংরি আন্দোলনের সময়কাল থেকে এখনও সমান সক্রিয় এবং সৃষ্টির অদম্য তাড়নায় লিখে যাচ্ছেন আজও। অসংখ্য গল্প, কবিতা ও প্রবন্ধ এখনও গ্রন্থিত হয়নি। প্রকাশিত বইগুলিও দুস্প্রাপ্য। আমাদের দেশে ফ্লিমস্টারদের খ্যাতি আকাশচুম্বী, অথচ সুবিমল বসাকের মতো একজন সাহিত্যিক নূন্যতম সম্মানটুকুও পান না সমাজ থেকে। কেন? তথাকথিত নামী প্রকাশনা থেকে তাঁর বই এখনও বেরোয়নি বলে? মানুষটি প্রচারবিমুখ বলে? না আমাদেরই উদ্যমের অভাব ও সংকীর্ণ মানসিকতা? আজকের দিনে দাঁড়িয়ে ভীষণ প্রয়োজনীয় প্রশ্ন এটি।
(‘বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে’ বই থেকে)
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন