Malay Rouchoudhury in late 1980s when he came back with a vengeance
সামান্য অভুয়িষ্ট ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভুয়া লেখা লিখেছিলুম বছর পনেরো আগে, এক মফসসলি কাগজে । সেই শুরু । সেদিনের সেই সব্রীঢ় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই হাংরি সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে । আর পরপর পরিচিত হতে থাকি মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ হাংরি আন্দোলনের প্রতিভূ এবং তাঁদের সজ্ঞাননা-সম্ভূতির সঙ্গে ।
এঁদের মধ্যে, আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আর বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আলাদা কথা আছে । আলাদা, কেননা, আমার মনে হয়েছে, মলয়ই প্রথম, যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এঁদো চিন্তাভাবনা আর তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে চেয়ে লেখালিখির জগতে এসেছিলেন । মলয় এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বঙ্গসংস্কৃতির কোনো শিসই গজাবার নয় । জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় সেখানে । বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে অতিবাহিত শৈশব । টায়ার ছোটোবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যুষিত দরিয়াপুর মোহল্লায় । সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বলা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা । সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী কসরতের সাক্ষী, স্পেংলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টি-দোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালিখির মঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই আছে ।
Memoirs of slum life of childhood
বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত কবিতায় চলে আসা ন্যাকাচিত্ত পিলপিলে গীতিধর্মিতার প্রতি প্রচণ্ড বিরক্তি, ক্ষোভ আর প্রত্যাখ্যানসহ নতুন একটা কিছু করার ছটফটানি তিনি যখন সবে টের পাচ্ছেন, তখন তিনি পাটনা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির পড়ুয়া এবং মার্কসবাদ ও কবিতায় গভীরভাবে আক্রান্ত । তিরিশের পর চল্লিশ দশক থেকেতাঁর কাছে সমস্ত বাংলা কবিতাই যেন জোলো ঠেকছে । পঞ্চাশও নিজের ল্যাসল্যসানি সমেত কুণ্ডলী মেরে বসতে চাইছে । মলয় দেখলেন কবিতাকে আর এভাবে চলতে দেয়া ঠিক হবে না । বদল চাই । ফেরাফিরি চাই, তরমিম চাই । স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে আন্দোলন চাই । মলয়ের মাথায় গড়ে উঠল আন্দোলনের জিগির । আচমকা একদিন ইংরেজি পদ্যের বাবা জিওফ্রে চসারের এক টুকরো "ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম"এর মধ্যে খুঁজে পেলেন 'সমকালের অবধারিত সংজ্ঞা' । অসওয়াল্ড স্পেংলারের প্রাগুক্ত তত্বে আরোপ করলেন চসার কথিত সেই হাংরি ভাবনার দ্যোতনা । নিজের প্রজন্মের নাম দিলেন 'হাংরি' ।
মলয়কে যে গ্রন্হটি প্রভাবিত করেছিল
জিওফ্রে চসার, যার কবিতায় "ইন সাওয়ার হাংরি টাইম" বাক্যটি পেয়েছিলেন মলয়
প্রাথমিক পর্যায়ে মলয় পেয়েছিলেন দু'জনকে । হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে । পঞ্চাশের কবি হিসাবে শক্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত । মলয়ের চিন্তাভাবনায় উৎসাহিত হয়ে শক্তি পাটনা থেকে ফিরে 'ছোটোগল্প' পত্রিকায় লিখলেন "ক্ষুৎকাতর আক্রমণ", আর বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমালোচনা করতে গিয়ে সম্প্রতি কাগজে লিখলেন "হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব"। এ-দুটিই ছিল মলয়ের পরিকল্পনার প্রাথমিক ভাষ্য । পরে কেউ-কেউ, এবং শক্তি নিজে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা হিসাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামটি চালাতে চেয়েছিলেন । সে ভিন্ন কথা । ১৯৬১ সালের নভেম্বর নাগাদ 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের কাগজের ইস্তাহারটি প্রকাশ পায়, তাতে বার্জাস টাইপে ছাপা হয়েছিল 'স্রষ্টা : মলয় রায়চৌধুরী, নেতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক : দেবী রায়' । আত্মার অশ্রুত ছটফটানিসহ যে মূলবার্তা মলয় এই ইস্তাহার মারফত প্রচার করতে চেয়েছিলেন, তা হল : "কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়, অতিপ্রজ অন্ধ বল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানসিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ-ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা । কারণ কবিতা ব্যতীত কি আছে আর জীবনে !...কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মোহমুক্তির প্রতি ভয়ঙ্কর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খাঁচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । ...ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতার বর্বরতার মধ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এখন শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব ।...শখ করে, ভেবে ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে।"
বাংলা কবিতাকে চরিত্রহীনা হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাবার এ ছিল এক অভিনব আয়োজন ।এই আনকা নওল মতধারা থেকেই হাংরি আন্দোলনের পথচলা শুরু। যা পরবর্তী দিনে খাড়া করে বাংলার শক্তমুঠো প্রতিভাবান শর্করীবাজদের এক দীর্ঘ রিসালা । মলয়ের একক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীচেতনায় । ভবিষ্যত কর্মসূচি ঠিক করে নেবার জন্য দরকার হয় নির্নায়ন নিয়মাবলীর । সেই তাগিদে মলয় তৈরি করেন একটি চোদ্দদফা ইশতাহার, যা থেকে ফুটে ওঠে আন্দোলনের নিখাঁজ রূপরেখা এবং উদ্দেশ্য, কী আর কীভাবে লিখব-র উত্তর । পূর্ণাবস্হায় ইগোর ক্ষমাবর্জিত প্রকাশ, খাস লহমায় বিস্ফরিত আত্মার ইঙ্গিত পুরোপুরি শব্দবন্ধে ও প্রকাশভঙ্গীতে । ঐতিহ্য ও গতানুগতের প্রতিবাদ । এবং তার ভাস্বরতা প্রাত্যহিক জবানে । বাঁধাধরা মূল্যবোধের খেলাপে জেহাদ । ধর্ম অহিফেন, রাজনীতি বন্ধ্যা । মূলধন শুধু কবিতা । সেই কবিতাই হাংরিদের হাতিয়ার হল । সশস্ত্র হাংরিরা ছড়িয়ে পড়লেন চারিদিকে । রাস্তায় ঘাটে দোকানে বাজারে অফিসে দেওয়ালে পোস্টারে ...সর্বত্র হাংরি হাংরি হাংরি । প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ।
Hungryalist bulletin published in 1964
হাংরি কোনও 'ইজম' ছিল না । ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া । তবে স্ফীত অর্থে আন্দোলন কথাটা অনেকের পছন্দ । বলতে পারি একটা ঘটনা, বাংলা সাহিত্যে সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি । বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল একটা ঢেউ, উঠে, আছড়ে পড়েছিল ইজি গোইং সাহিত্যের প্যালপিলে ল্যাসলিসে মসৃণ চত্বরে । সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলাসাহিত্যের লিরিকফুলের সাজানো বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনও অব্দি একমাত্র বৈপ্লবিক সমীহা । পাশল অর্থে একে "আন্দোলন" বলা হচ্ছে, সেহেতু তা শুরু হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, গোষ্ঠী আর প্রস্তুতি নিয়ে । যার লিখিত ম্যানিফেস্টো ছিল। এবং যার অনেক ইশ্যু, সেই ডামাডোল প্রধান ষাট দশকে বাঙালি কবি-গদ্যকারদের এমনকি পঞ্চাশ দশকের কবিদের একাংশকেও তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিল -- যার দরুণ সুদীর্ঘ কাতার । প্রবল ঘুর্ণাবর্ত্ম ।
এটা ঠিক যে ঐ সময়ে মলয় ও তাঁর সহযাত্রীদের কজন মিলে এমন কয়েকটি কাণ্ড করেছিলেন, যার সঙ্গে আন্দোলনের ঘোষিত উদ্দেশ্যের কোনও রকম সরোকার ছিল না, এবং যার দরুণ গঙ্গাজলি সাহিত্যের কোল-আলো-করা কবি-লেখকরা আন্দোলনের ওপরই দারুণ খচে যান । কিন্তু বলা বেশি, বাড়িতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ভুয়ো খবর দিয়ে জনৈক বাজারি লেখকের অফিসে ফোন, বিভিন্ন পশুপাখি ভাঁড় আর শ্বাপদ-শয়তানের মুখোশ কিনে প্রাতিষ্ঠানিক নোকরদের নামে পাঠানো, পাবলিক ল্যাভাটরিগুলোর দেওয়ালে উদ্ভট পোস্টার সাঁটা বা বাঙালি কবিদের বংশপঞ্জি প্রচার -- এসবে নয়, প্রতিষ্ঠানের লোকেরা ভয় পেয়েছিলেন হাংরিদের যা ছিল আসল হাতিয়ার : অনুশাসন থেকে মুক্ত ছোটোলোকি শব্দের ব্যবহার আর নিচুতলার মনোভাবের ছোঁচালো সীবনীটিকে। আর সেটাই ছিল আন্দোলনের পজিটিভ দিক ।
হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা 'জেব্রা'-র দ্বিতীয় সংখ্যা
আসলে হাংরিরা যে ভাষায় ও চেতনায় গদ্য-পদ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল আমাদের এতোদিনকার বুর্জোয়া সংস্কারের বাইরে । আন্দোলনের মেজর কবি-লেখকরা প্রায় প্রত্যেকেই এসেছিলেন বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, সেই স্তরের যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কার নিয়ে । শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সমীর, সুবো, মলয়, ত্রিদিব, দেবী, ফালগুনী, অবনী, অরনি, রবিউল, বাসব,বাসুদেব, সুবিমল, সুভাষ, প্রদীপ, শৈলেশ্বর প্রমুখের সবার সম্পর্কেই এ তথ্য লাগসই । সুতরাং তাঁদের আত্মার ঘোর আততি, স্বদন্দ্বের সিনথেসিস থেকে গদ্য ও কবিতাকে রূঢ় কর্কশ ছালে সজ্জিত করা । জীবনকে প্রায় চিনিয়ে দেয়া, স্বাধীনতার তলানিটুকু পর্যন্ত উজাড় করে স্মাৎ করা, দৈনন্দিন হাড় পুঁজ রক্ত কফ উচাটন ফন্দিহীন ভাবে গদ্য ও কবিতায় আনা দগদগে আত্মবোধ ও অহং, মগজকে সম্বল করে সৃজন -- এসবের কোনো কিছুর মধ্যেই কোনও সিউডোপনা, পাঁয়তাড়া, বারফট্টাই বা কারাসাজি ছিল না । বাংলা সাহিত্যে এই জিনিস আলবৎ নতুন । আমাদের বুর্জোয়া সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীত । আসলে বাংলা গদ্য ও কবিতাকে তার কৃত্রিমতার খোলস ছাড়িয়ে একটা পরাদর্শী আর শক্ত সবল বনেদ পাইয়ে দেবার জন্যে হাংরিদের এ ছিল এক ভয়ঙ্কর আয়োজন ।
The Hungryalists in 1964 during Malay Roychoudhury's trial
ভয়ঙ্কর হলেও সাহিত্যের তাতে ক্ষতি হয়নি । কেননা অতি ভদ্র আর ঝুঁকিহীন মন্তব্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাও প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, বাংলা কবিতা নিয়ে উত্তর-রবীন্দ্রকালে নিরীক্ষার ব্যাপারটা হাংরিরা প্রথম চালু করেন । আর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাহিত্যের ক্ষতি হয় না । বরং তন্বিষ্ঠ গবেষণা একদিন বলবে, এতে করে কয়েক ধাপ হঠাৎ দুম করে এগিয়ে গিয়েছিল বাংলা কবিতা । পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় এর সুফল দুর্লক্ষ্য নয় । বিশেষত সত্তর-আশির সময় থেকে কবিতাক্ষেত্রে একটা মৃদু প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে । কবিদের একটা গণ্য অংশ অন্তত লিরিকাল ধাঁচ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, হাংরির তত্বভাবনা অনেকের লেখায় পরোক্ষভাবে কাজ করেছে এটা কম কথা নয় । বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ত্বকে পচন ও পয়মালের ঘা দগদগ করছে যখন, সেই মুহূর্তে একদল তেজি, রাগি আর প্রতিভাবান যুবক নিজেদেরকে উচ্ছন্নে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভেজানো কপাটে দিতে পেরেছিলেন একটা জোর দস্তক, এটা ঊন বা অবম তথ্য নয়। যে কারণে জন্মকালেই হাংরি আন্দোলনকে ধ্বংস করার চক্রান্ত, দুষ্প্রচার, অতর্কিত হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, মুচলেকা লেখানো, চাকরি থেকে বরখাস্ত, ট্রান্সফার ইত্যাদি স-অব ঘটেছে একাদিক্রমে এবং পরপর ।
এসবের দরুণ এবং আরও কিছু পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণে এই আন্দোলনের নখদন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে পিরেনিয়্যেল আঁচড় কেটে অচিরেই ধাবাড় মেরে যায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘটনাবহুল অস্তিত্বকাল । কিন্তু অন্যদিকে জেব্রা, উপদ্রুত, ক্ষুধার্ত, ফুঃ, উন্মার্গ, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বী, ওয়েস্ট পেপার, স্বকাল, ব্লুজ, জিরাফ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি শম্ভু রক্ষিত, আলো মিত্র, দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, তপন দাশ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, অশোক চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর দে, বিকাশ সরকার, মলয় মজুমদার, জীবতোষ দাশ, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অরুণেশ ঘোষ প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র । এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি , ক্ষুধার্ত, প্রতিদ্বন্দ্বী, সকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জিরাফ, আর্তনাদ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি রেফ্লুয়েন্ট চাককে আঁকড়ে কিছুকাল শর্করাবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি ।
আসলে সাহিত্যের আন্দোলন মাত্রেই হ্রস্বজীবি । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সমস্ত কবি-লেখকদের কথা যদি ধরি, সকলে কোনো নির্দিষ্ট সমাজ-স্তর থেকে আসেননি । তাঁদের মধ্যে নান্দনিক দৃষ্টিবৈভিন্ন্য ছিল, যা আন্দোলনের শেষাশেশি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল । এ-বাদে ব্যক্তিজীবনের উচ্ছৃঙ্খল বিষাদ, উপরতস্পৃহা, আর নিরাশাও চাগাড় দিয়ে উঠেছিল । এ-কথা অনস্বীকার্য যে তত্ববিশ্বের দিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন, কিন্তু তবু কবিতার জন্ম ফ্রম এ স্ট্রং পার্সোনাল নিড, র্যাদার দ্যান ফ্রম এনি থরো আনডারস্ট্যানডিং অফ অ্যান আইডিওলজি --- ফ্রয়েডিয় মতবাদের গুরুত্ব ও প্রভাব কম হয়ে যায় না । ছেষট্টির গোড়া থেকেই শরিকরা বয়স-অভিজ্ঞতা-চিন্তা মোতাবেক নিজের-নিজের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক রাস্তা বেছে নিতে শুরু করেছিলেন । প্রকৃত সাংস্কৃতিক নিউক্লিয়াসের অভাবে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে । তারপর আন্দোলন সম্পর্কে ভাবি-প্রজন্মের মনে দুরোধিগম্যতা, খটমটি, ভ্রান্তব্যাখ্যার যথেষ্ট সুযোগ জিইয়ে রেখে আন্দোলনের প্রভাব ডবলমার্চ করে ফিরে গেল ভাটায় । আন্দোলন পুরোপুরি বানচাল হয়ে গেলে কেউ কেউ তিন সত্যি কেটে সাইড নিয়ে নিলেন, প্রচল ধারায় লেখনীপাত শুরু করলেন, কেউ-কেউ মার্কসবাদী রাজনীতির ঝাণ্ডাতলে গিয়ে সাময়িক স্বস্তি লাভ করলেন, কেউ-বা আশ্রয় নিলেন ধর্মের, আবার কেউ-বা লেখালিখি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে, সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে চলে গেলেন অজ্ঞাতবাসে । চিরতরে হারিয়ে গেলেন কেউ-কেউ । কিংবা যোগ দিলেন অ্যাকাডেমি ও মিডিয়ার তাঁবুতলে ।
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়-এর আঁকা হাংরি আন্দোলনের পোস্টার
পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেল তারপর । পঁয়ত্রিশ বছর । নিছক কম সময় নয় । এ নিছক ঘড়ির কাঁটার টিক-টিক সরে যাওয়ার বা ক্যালেণ্ডারের তারিখ বদল নয় । অনেক বদল ঘটে গেছে এই সময়ে । এর আগে অব্দি কোথাও না কোথাও, কোনোখানে, একটা স্হৈর্য, স্হিতিবোধ, বিশ্বাসের বলয়ে জীবনকে সংবৃত করে রেখেছিল, চতিস্পার্শস্হ মসৃণ জীবনযাত্রায় জীবনমোহরের একটা স্হির অলিকল্পিত উপলব্ধি সৃজনশীল মানুষের মনে সদা জায়মান থেকেছে । কিন্তু এখন, তরবারীর সুমসৃণ যখন ফালি-ফালি করে কেটে ফেলছে আমাদের জোড়াতালি অস্তিত্ব, হঠাৎ-হঠাৎ টের পাচ্ছি সমুখে সমূহ অস্হিরতা, এখন এই অস্হির দজ্জাল সময়ে সুস্হতার মাঝে বিধ্বংসী ভালোবাসা আর বিপন্ন মগজজাত ক্ষিপ্ত চেতনা নিয়ে 'লড়াই' জেতার উপকিঞ্চিৎ লজিকটুকুও বেমালুম হাপিস । এ-সময়ে হিটলার হয়ে দুনিয়াটাকে দাপানো সহজ যদি-বা, কিন্তু নিছক কলমী বিদ্রোহ করে কিছু গড়তে পারার সম্ভাবনা বুঝি আর নেই । যাকে নিয়ে আমার চিন্তা, যার মুখ একটু-একটু করে সোজা রাখতে চাওয়া -- তার জন্য, আমাদের অভিজ্ঞতা বাৎলে দিচ্ছে, বাস্তিল থেকে শুরু করে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা কোনো কিছুতেই প্রাসাদশীর্ষ থেকে বদল সম্ভব নয় । এবং যা বিপ্লব, মত-সাপেক্ষে তা পপতিবিপ্লব । যুদ্ধ কবেই হেজে গেছে, এখন খড়গের শানানো ধারে খয়েরি পোঁচড়, গিলোটিনে আলপনা বিলাসিতা । 'প্রতিবাদ' শব্দটাকে অভিধান থেকে লোপাট করে দেবার দিন আজ । আশার পাছায় ঘাঘরা বেঁধে কোঠায় ছেড়ে দেবার দিন ।
তো ? এরকম সময়ে, এই প্রেক্ষিতে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসর যিনি করেছিলেন, বিশ-তিরিশ বছর বাদে লেখালিখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলেও, তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী খাড়া হতে পারে ?এমনিতে পঞ্চাশের কবি-লেখকরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবেক লিখে আসছিলেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি ছদ্মনামে 'রূপচাঁদ পক্ষী' হয়ে যান, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একটা নির্দিষ্ট গদ্য রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন । বিদেশ থেকে ফিরে উৎপলকুমার বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন । ষাটের কবি-লেখক হিসেবে পরিচিত অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখের লেখালিখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ-কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে । অর্জন করেছেন চারিত্র্য, আর বাংলা সাহিত্যে এনেছেন ভিন্নতর আধার-আধেয় !
মলয় রায়চৌধুরীর কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা । এবং আপাত-জটিল । বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্হান হিসেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের তলায় সেভাবে লাগেনি, যেখানে, অনেকে মানতে না চাইলেও, অনেক ধুলো । কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে । কলকাতা মলয় রায়চৌধুরীকে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল । কলকাতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের লোক নও । তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা । তোমার কলমে ছোটোলোক রক্ত । তোমার টেক্সট আলাদা । আলাদা থিসরাস । তফাত হটো তুমি । এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে । ভয়ে কোনও সম্পাদক তার কাছে আর লেখা চান না । বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে আসে ক্রমশ, এবং যারা মুচলেকা দিয়েছিল তারা সবাই স্লিপ করে যায় । লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে । এই বীভৎস যন্ত্রণা, একাকীত্ববোধ, অপমান একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে । এই যন্ত্রণা, অপমানই মলয় রায়চৌধুরীকে লেখালিখি থেকে নির্বাসন-ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে । ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন । সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন । আর নিজেকে ক্রমশ অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফ্যালেন । প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা -- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-এর ডিসেম্বরে রাজ্য-স্তরের হকি খেলোয়াড় শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহর সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে । জীবনের মতো ভেলকি জানে কে আর ! সে বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে । চটকায় । ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয় । আবার, পেড়েও আনে । জীবন লিখেওছে এমন ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না । মন বোঝে না । আদর্শ বোঝে না । আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডোর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটরে । অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' এবং পরে 'অঙশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ । এই ট্র্যাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ি করি, তাকে ব্যক্তির ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্ণিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম ।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ব । এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে বিভিন্ন শহরে কিছুদিনের জন্য এলিট সংসারি হয়ে উঠেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত । মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করছিলেন যে গার্হস্হ দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় "আর কিছুই করছেন না"। কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে আবার লেখালিখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চৌধুরী ।
প্রত্যাবর্তিত মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে অনেক মাল, অনেক মউজ । মানে, দারুণ একটা রায়বেঁশে, হই হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-টোমর রইলো না, মলয়ের কেসটা সেরকম নয় । তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ কিছু জ্যামিতিক পারফরমেন্স দেখিয়েছিলেন । বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে । দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন । আর গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন মলয় । কিংবা লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিকে আছেন, না উবে গেছেন ।
মলয় রায়চৌধুরী যে আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করেন, উনিশশো আশি-বিরাশি নাগাদ, তার পেছনে প্রাথমিক প্ররোচনা ছিল সত্তর দশকের বিশিষ্ট কবি, গদ্যকার ও 'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর । কমল নাগাদে তাগাদা দিয়ে মলয়ের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন এক গোছা মন্ময় পদ্য । আজকের এই ফিরে আসা হই-চইহীন নিরুত্তেজ উদ্দাস্ত-যমিত শান্ত অবাস্হ নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে সেদিনের সেই উত্তপ্ত অস্হির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চৌধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র । তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত ( উল্লেখ্য, মলয় রায়চৌধুরীর ডাকনাম 'ফণা' ) । সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দাক্রমণের ফলাটা এখনও তেমনি পিশুন । আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠার অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ । যেন পুরোনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা ।
তবে গড়ে-ওঠা পর্বে, খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ কালখণ্ডে লেখা কবিতার প্রথম সংকলনটি বেরিয়েছিল ১৯৬৩ সালে 'কৃত্তিবাস প্রকাশনী' থেকে, 'শয়তানের মুখ' নামে ( প্রচ্ছদ মেকসিকোর জনৈক চিত্রকর )। হাংরি আন্দোলনের বাইপ্রডাক্ট 'জেব্রা' পত্রিকা থেকে ১৯৬৫-এ বেরিয়েছিল দুটি দীর্ঘ কবিতা - "অমীমাংসিত শুভা" আর "জখম" । "জেব্রা" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মলয়ের অ্যাবসার্ড নাটক 'ইল্লত', যাকে পরবর্তীকালে বলা হয়েছে 'পোস্টমডার্ন' -- নাটকটি 'বহুরূপী' পত্রিকার কুমার রায় এবং 'গন্ধর্ব' পত্রিকার নৃপেন সাহা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন, দুর্বোধ্য হিসাবে । পরে কবিতীর্থ প্রকাশনী হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর তিনটি 'হাংরি' নাটক 'নাটকসমগ্র' নামে প্রকাশ করেছে।
মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম দিককার সমস্ত লেখা আমার পড়া হয়নি, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত মলয়ের 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' এবং 'বিংশ শতাব্দী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত 'ইতিহাসের দর্শন'। যেটুকু পড়েছি, তাতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছি 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের আগস্ট ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল কবিতাটি, যা মলয়ের জীবনে, এবং তাঁর হাংরি বন্ধুদের জীবনেও, বয়ে এনেছিল প্রচণ্ড তুফান । আদালতে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ আমি খুঁজে পাই এক তরতাজা যুবকের আর্তি, অসহায়তা, যন্ত্রণা, আমর্ষ আর ক্লেদ । বাংলা কবিতার জমিতে গড়া প্রচলিত সংস্কারের গাঁথুনির ভিত নড়বড়ে করে দিয়ে জীবনচর্চার গূঢ় সত্য প্রকাশ করে বলেই কবিতাটি একই সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্যায়ের কবিতা চর্চা আর হাংরি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেষ্ঠ মুখবন্ধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত । এ ছিল মলয়ের চেতন-অবচেতনের এক উজ্জ্বল প্রতিফলন ।
কলকাতা ব্যাংকশাল কোর্ট কর্তৃক মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ
স্বীকার করা ভালো, মলয়ের সেইসময়কার বেশিরভাগ কবিতা পড়লে মনে হয় তাঁর স্বঘোষিত 'অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে' যে লেখা বের হয়, তেমন-কিছু তিনি নামাতে পেরেছেন খুব কম । তাঁর বেশির ভাগ কবিতাকে মনে হয়েছে বানানো । শব্দ শরব্যতার দিকে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক । একেকটা শব্দকে কোথায় কীভাবে কতোটা ফাঁক দিয়ে বসালে চমক খাবে পাঠক, যেন এই প্রবণতা থেকেই এক-একটি কবিতা তাঁর । এটা ঘটেছে, কেননা আদপে তিনি কবিতা গড়েন, বানান, তৈরি করেন । এবং যথেষ্ট সচেতন থেকে তাঁর নিজের কথায় 'একটা আইডিয়া কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘোঁট পাকায় । কিছুটা ঘোরের মতো সেটা কাগজে নামাই । তারপর ঘষেমেজে কবিতাটা লিখি'। আসলে মলয় আগাগোড়া সুররিয়ালিজমকে বাহন করেছেন, অবচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির কথা ভেবেছেন ঠিকই, কিন্তু সচেতনভাবে । তাঁর কথা হলো -- "সচেতনভাবে বিহ্বল হয়েই কবিতা লেখা সম্ভব"। অর্থাৎ মেধা-মননের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে কবিতা । যে-জন্যে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্হের নাম 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'চিৎকার সমগ্র', 'যা লাগবে বলবেন'।
প্রচ্ছদ : যোগেন চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর নানা গদ্যে, সাক্ষাৎকারে, একটা কথা বেশ গুরুত্ব আর জোর দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, হাংরি আন্দোলন বা হাংরি লেখালিখি আগাগোড়া সাবভারসিভ ছিল ( তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ), সুররিয়ালিজম বাদে তাতে অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব ছিল না । কিন্তু গোড়ার দিককার তাঁর নিজের কিছু-কিছু কবিতায় বাহ্যিক প্রভাব সম্পর্কে অনেকে সন্দিহান । কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ তাঁর 'অমীমাংসিত শুভা' ও 'জখম' পর্যায়ের নির্মাণগুলিতে দেখেছেন বিট কবিদের উচ্চকিত প্রভাব । মলয় এই আরোপের বিরুদ্ধতা করেছেন । আমি সেই বিতর্কের মধ্যে যেতে চাইছি না । শুধু বলব, প্রভাব জিনিসটা কি সত্যিই নক্কারজনক ? শুনেছি, অল আর্ট ইজ মাইমোসিস । আর কবির সৃষ্টি-প্রভায় 'প্রভাব' শব্দটি সবিশেষ অর্থবহ । সামান্য 'ইনফ্লুয়েন্স' শব্দে তা নিরূপেয় নয় । প্রভাব অর্থে 'প্রকৃষ্ট ভাব', তা পূর্বতনের হলেও ভিন্নতর কবিকল্পনায় নতুন করে 'হয়ে ওঠে' । আর হাংরি কবি-লেখকরা তো ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কবিতা বানাননি, বানিয়েছেন কলম-কাগজ দিয়েই । প্রশ্ন হল, কবিতায় মলয় কতোখানি উতরেছিলেন ? আমি তাঁর প্রথম পর্বের যে কয়েকটা কবিতা পড়েছি, চার-পাঁচটি বাদে, এখনকার কবিতার তুলনায় জোলো ঠেকেছে। 'শয়তানের মুখ' আমার কাছে নেই । ঐ বইটার সুনাম কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । নিজের পাঠের সঙ্গে অন্যান্যদের বিশ্লেষণ মিলিয়ে বুঝেছি, মলয়ের সেই সময়কার অনেক রচনাই রুগ্ন । কবর-চিহ্ণে মুদ্রিত । দারুন চমকে দেবার মতো কবিতা তিনি লিখেছিলেন খুব কম ।
বরং তাঁর দ্বিতীয় পর্বের মেটামরফসিস আমাদের আকর্ষণ করে, কিছু-কিছু সংগঠন দারুন অভিভূত করে । এই পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি মহাদিগন্ত প্রকাশিত 'কবিতা সংকলন' ( ১৯৮৬ ), 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' ( ১৯৮৭ ) , 'হাততালি' ( ১৯৯১ ), গ্রাফিত্তি প্রকাশিত 'মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা' (১৯৯৪), কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রকাশিত 'চিৎকার সমগ্র' ( ১৯৯৫ ), কবিতীর্থ প্রকাশনীর 'ছত্রখান' ( ১৯৯৫ ), আর কৌরব প্রকাশনীর 'যা লাগবে বলবেন' ( ১৯৯৬ )। এ ছাড়া স্বরচিত কবিতার দুটি ইংরেজি অনুবাদ যথাক্রমে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর অনুবাদ 'স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস ( ১৯৬৮ ) ও রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে 'সেলেকটেড পোয়েমস' ( ১৯৮৯ ) । এই পর্বে অনুবাদ করেছেন অ্যালেন গিন্সবার্গের 'হাউল' ( ১৯৯৪ ) ও 'ক্যাডিশ' ( ১৯৯৫ ), ব্লাইজি সঁদরার 'ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপপেস' ( ১৯৯৭ ), উইলিয়াম ব্লেকের 'ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যাণ্ড হেল' ( ১৯৯৮ ), ত্রিস্তান জারার 'ডাডা কবিতাগুচ্ছ' ও 'ম্যানিফেস্টো' ( ১৯৯৬ ), জাঁ ককতো'র 'ক্রুসিফিকেশান' ( ১৯৯৬ ), পল গঁগার 'আত্মজীবনী' (১৯৯৯), 'শার্ল বদল্যার' ( ১৯৯৮), 'জাঁ আর্তুর র্যাঁবো' ( ১৯৯৯ ), 'অ্যালেন গিন্সবার্গ', সালভাদর দালির 'আমার গুপ্তকথা' । 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলি বুলেটিন আকারে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল, কবিতা থাকতো মলয়ের এবং তার সঙ্গে ড্রইং থাকতো প্রকাশ কর্মকারের ।
মলয় জানিয়েছেন, কবিতা তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কবিতার মধ্যেই যাকিছু দেখা ও দেখানো । ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের-নয়ের দশকের পুনরাগত মলয় রায়চৌধুরী । এ-পর্যন্ত ( ১৯৯৯ )যা লিখেছেন, সংখ্যাগত দিক থেকে -- বয়স, অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনার তুলনায় অনেক কম । তথাচ পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা এখনি গড়ে তুলতে পেরেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের সার্থক সব কবিতার পাশে তাঁর এ-যাবৎ লেখা কবিতার একটা গণ্য অংশ অন্তত সম-বা পৃথক -মর্যাদায় গৌরবের আসন দাবি করতে পারে -- এ-মন্তব্য খুব ভেবে-চিন্তে রাখা যায় । আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান জানাচ্ছে, কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুথ্থিত মলয় খুব ধীরে-ধীরে একটা জায়গা বানিয়ে নিচ্ছেন । এবং, তিনি অপ্রতিরোধ্য ।
বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হতে পারে না, মলয় রায়চৌধুরী সেখানে একটা মিশাল খাড়া করলেন । প্রচণ্ড স্প্যানিশ ভাবনার উদ্যত ছোবল দেখি তাঁর কবিতায় । তাঁর শব্দ খোঁজার কায়দা, শব্দ বানাবার টেকনিক, পংক্তিবিন্যাস, চিত্রকল্প-নির্মাণ ইত্যাদি পূর্বাপর কোনও কবির সঙ্গে খাপ খায় না। স্বচরিত্রে বিশিষ্ট তাঁর কবিতা । বিশেষত শব্দ দিয়েই কবিতা লেখেন তিনি, আর শব্দচয়নে তাঁর মুঠোর জোর এখন প্রায় সব মহলেই স্বীকৃত । এক-একটি শব্দ নিয়ে তাঁর দারুণ ভাবনা । পক্ষান্তরে ভাবনা বা ভাবনাসমূহের পারস্পরিক মারামারি ঢুসোঢুসি ছেঁড়াছিঁড়ি ধস্তাধস্তি থেকে বেরিয়ে আসে তাঁর শব্দ । তারপর সেই শব্দ তুলে এনে খুব ভেবেচিন্তে রয়েসয়ে তার সঙ্গিশব্দদের পাশে বসান তিনি । প্রচল ধারায় ভাষার জ্যামুক্ত তীব্র গতি বলতে যা বোঝায়, তা আনার কোনো প্রচেষ্টাই তাঁর থাকে না, হয়তো বা অপারগ ; কিন্তু একটা অন্য ধরণের স্পিড ( 'অ' গ্রন্হে তিনি বলেছেন যে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' হল স্পিডের কবিতা ), স্মার্টনেস থাকেই, যা আমাদের তাঁর কবিতা পড়িয়ে নিতে বাধ্য করে । আসলে, ঐ যে বললুম, তাঁর নতুন ও আনকা শব্দ, শব্দসংগঠন, পংক্তিনির্মাণ তথা চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলার কুশলতা তাজ্জব করে দেবার মতো । 'নতুন' ও 'পৃথক' বলছি তা এই কারণেও যে তিনি এ-যাবৎকাল লিখে আসছেন প্রবল অন্তর্চেতনার কবিতা, প্রচলন ধাঁচ ও লিরিকাল ব্যঞ্জনা বর্জন করে, এবং সচেতনভাবে । তাঁর সব কারবার সচেতনতা ও মেধা নিয়ে । কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনাচিন্তার কথা বহু দিন ধরে লিখে আসছেন মলয় রায়চৌধুরী । সেগুলো ততোটা নয়, কবিতাই তাকে করে তুলেছে বিশিষ্ট । আসলে কবিতা যা, সে নিজেই স্বক্ষেত্রে এক অপ্রতিবিধেয় শক্তি । কথাটা ভাবালুতায় আবিষ্ট ঠেকলে অন্য ভাবে বলা যায়, অহরহ একজাই অনিবার উথ্থান ও পতন, গহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে শশ্বৎ সে আরও শাক্তিশালিনী হয়ে ওঠে । পিতৃত্বের জন্য বীর্যবন্ত করে তোলে কবিকে । কবির রুচি, ইনার-কালচার, শিক্ষা, মেধা, আকাঙ্খা ও স্বপ্নের শন্নিপাত ঘটলে কবিতাই কবিকে করে তোলে প্রাতিস্বিক, নিজস্বতাময়, অনন্য । মলয়ের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, সেটা তাইই । মলয়ের প্রধান হাতিয়ার শব্দ, আর বুদ্ধি ও মেধার সহযোগে তার ব্যবহারের কুশলতাই তাঁর কবিতাকে উতরে দেয় । তথাকথিত লিরিকাল কবিদের প্যানপ্যানানির সঙ্গে তাঁর লড়াই এইখান থেকে, কিংবা জেহাদ বলুন । আজকের ঐ বয়স্ক কবিরা যাঁরা এখনও চিনিতে চিনিই ঢেলে যাচ্ছেন এবং ঢেলে যাবেন, মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের ফারাকটা এইখানে যে, মলয়ের এতবার ম্রক্ষণ-যুতিতে নেই, চিনির সঙ্গে একটু কৃষ্ণসীস বা সীসাঞ্জন মেশানোর দিকেই তাঁর অবসক্তি । এ-ভাবে, প্রথা ভেঙেই, আজ তিনি ক্রমশ-প্রতিষ্ঠান ।
আরেকটি কথা মলয়ের কবিতা সম্পর্কে বলার আছে । সেটি হলো, তাঁর কবিতার বিষয়, বা ইমেজ বলুন আপাতত । জেনে বা না-জেনে, চেতোমান মলয় বলেছেন, কবিতায় তিনি ছুরি-চাকু চালানো রপ্ত করেছেন চার দশক ধরে। তাঁর কবিতার সেলাখানায় আছে বিবিধ তবক কারবাইন, মাস্কেট, তোপ, কর্নি, মর্টার, মলোটভ ককটেল, করপাল, বৃক্ষাদন, কুকরি, পর্শ্বধ, বাইস, ধারাবিষ আর চিয়ার-বরশার চিত্রকল্প । আর এইসব চিত্রকল্পের ধারাবাহিক অনুশীলনে তাঁকে সাহায্য করে তাঁর আশৈশব-আহরিত ইমলিতলা পাড়ার প্রায় হাজার খানেক অসৎ কুচেল অভাগা দুর্বাহৃত শব্দাবলী আর বাক্যবিন্যাস । বর্তমানের প্রতিফলনের দরুন সন্ত্রাসের ইমেজ, যা নিছক জান্তব বা যৌন নয়, এ একা মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাতেই মেলে । যার ফলে কবির নাম না পড়েও তাঁর কবিতার স্ট্রাকচার আলাদা ও সহজ ভাবে শনাক্ত করা যায় ।
মলয় বলেছেন কবিতাই তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কিন্তু নিছক কবিতা বানাতে তাঁর জন্ম নয় । বরং বাংলা গদ্যকে তাঁর অনেক কিছু দেবার আছে, দিয়েছেন, দিচ্ছেন । এই যে বিশ বছর বিরাম, তাঁর নির্জনবাস, এর ফলে তাঁর নিজের পক্ষে যেমন, বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল । মলয়ের গদ্যে যাঁরা সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন, অন্তত তাঁদের কাছে এটা অতিশয়োক্তি বলে মনে হবে না ।
বাংলা গদ্য নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিজস্ব ভাবনা আছে । বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা গদ্যের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি । বরং বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূচনাকালে আমাদের জন্য যে গদ্যভাষা ধার্য করা হয়েছিল, এতো বছর ধরে ঐ গদ্যকেই মডেল হিসাবে সামনে রেখে আমরা রেওয়াজ করে আসছি । গদ্য, যা বাঙালির অভিন্ন জাতি-চিহ্ণ, তাকে উন্নত করার জন্য নিরীক্ষার কোনও আয়োজনই ব্যাপকভাবে সেরে রাখিনি আমরা । সাধু থেকে চলিত ভাষায় আসতেই আমাদের অনেকটা সময় গেছে । এখনও আমরা তৎসম শব্দের মোট বইছি আর তথাকথিত ইতরশ্রেণির শব্দগুলোকে নিজেদের অভিধানে ঢুকতে না দিয়ে বাংলা সবেধন দেড় লক্ষ নলাপচা শব্দ নিয়েই শব্দঘোঁট পাকিয়ে চলেছি । মলয় দেখেছেন, বাংলা ভাষায় শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন, ক্রিয়াপদের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দারুন অবকাশ আছে । তার কিছু একটা করে দেখিয়েছেন কমলকুমার মজুমদার, কমল চক্রবর্তী, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল বসাক এবং আরও দু'একজন নবীন লেখক। কিন্তু ব্যাপক স্তরে সেথা হচ্ছে না । নিচুতলার ভাষা ও শব্দাবলীকে মূলধারার সাহিত্যে অভিষেক ঘটাতে হবে । শুধু ভাষা ও শব্দকাঠামোকেই নয়, নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ঢঙ, আচার-আচরণ, খাওয়া-পরা, আনন্দ-দুঃখ সবই তুলে আনতে হবে । সাহিত্যের স্বার্থেই সেই ব্রাত্য করে রাখা শব্দ, ভাষা, সংস্কৃতিকে সাহিত্যে স্হান দিতে হবে, এবং তা সরাসরি । তাতে ফাঁকি রাখা চলবে না ।
বাংলা গদ্যে শৈলী, শব্দ ও ভাষার ব্যাপারে মলয়ের আকাঙ্খিত এই ভাবনার রূপকার মলয় স্বয়ং নন । তবে তিনি মনে করেন, আধুনিক বিশ্বের জন্যে একটা যুৎসই গদ্য আমাদের পেতে হবে । হয়তো তার জন্য প্রস্তুতিও সারা । দলবেঁধে মঞ্চে নামা হবে, না, যে-যার নিজের মতন করে ডেভলপ করতে করতে সেটা আনবেন তার ঠিক নেই । বুর্জোয়া শব্দভাঁড়ারকে সাবাড় করে একেবারে অব্যবহৃত নতুন শব্দের সাঁজোয়া নিয়ে তাঁর পক্ষে সম্ভব যিনি ঐ বুর্জোয়া শব্দপালকদের সমান বা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান অথচ নিম্নবর্ণের বা নিম্নবর্গের ও বিত্তহীন শ্রেণির । জানোয়ারকে খতম করতে জানোয়ার হতে হয়। একমাত্র সেই নিচুতলার গাড়োয়ানই পারবেন শব্দের চাপকানি দিয়ে বুর্জোয়া গদ্যের পিলপিলে ছালটাকে উখড়ে বাংলা গদ্যে নতুন দ্যুতি ফিরিয়ে আনতে।
১৯৬২ সালে 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' নামে মলয়ের যে প্রবন্ধ-পুস্তিকাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেছিলেন, বা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত 'আমার জেনারেশনের কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র' নামে জেব্রা প্রকাশনীর বইটিও, পড়ার সুযোগ আমার হয়নি । তবে ওদুটিতে গদ্যের কি কাজ ছিল তা অনুমান করতে পারি । কেননা সেই একই সময়কালে হাংরি দর্শন সংক্রান্ত মশক খানেক ইস্তাহারেই তিনি আধুনিক মনস্ক পাঠক-লেখকদের একটা অংশকে সেদিন আতপ্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, এ-সংবাদ আমরা শুনেছি । পরে সেই ম্যানিফেস্টোগুলোকে 'ইস্তাহার সংকলন' নাম দিয়ে মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায়, ১৯৮৫ সনে, যা আমি পড়েছি ।
পুনরুথ্থিত মলয় প্রধানত দু'ধরণের গদ্য চর্চা করে যাচ্ছেন । একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল, আর মেদ বর্জিত । আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তাহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশকের শেষ থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারণ, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, ঢাকার মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রথমে ধারাবাহিক প্রকাশিত এবং পরে ১৯৯৪ সালে হাওয়া উনপঞ্চাশ থেকে প্রকাশিত 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হ, হাওয়া৪৯ থেকে প্রকাশিত 'পোস্টমডার্নিজম' ( ১৯৯৫ ), এবং প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'পরাবাস্তববাদ' ( ১৯৯৭ ), কবিতা পাক্ষিক থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা', গ্রন্হগুলিতে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য । অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে মলয় রায়চৌধুরীর, যা এখনও নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করি মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন । দারুণ মডার্ন প্রোজ । দারুন-দারুন সব অ্যাঙ্গেল, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিসেবে ফুটে ওঠেন । কিন্তু ঐ, শর্ট ডিস্টান্স রানার । বেশিক্ষণ দৌড়োতে পারেন না । হেলে পড়েন । এক একটা প্যারাগ্রাফের দারুন স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরিয়ে যেতেই দম ফুরিয়ে আসে । আবার নতুন করে প্যারা শুরু করতে দমও নিতে হয় নতুন করে । এ-যেন ঠিক হার্ডল রেস । এটা অনুশীলনহীনতার কুফল। দেড়-দু দশকের গ্যাপ তো কম কথা নয় । সেই জন্যেই বলছিলুম, এই বিশ বছরের গ্যাপে মলয়ের খানিকটা ক্ষতিই হয়ে গেছে ।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন । কোনও-কোনও ক্ষেত্রে যেন অতিরিক্ত সচেতন । প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত ঢেলে ফেললে যা হয়, নুনের পরিমাণ অনেক সময়ে লাগসই হয় না । দেখেশুনে ভাবা যেতে পারে, মলয়ের নিজস্ব একটা ঢালাই ঘর আছে । সেখানে শব্দের কিউপোলা। এক-একটা অভাগা অস্পৃশ্য দুর্ব্যবহৃত জংধরা মরচেলাগা লৌহমল বা কিট্ট নিয়ে পাঁচমিশালি গহনা বানান তিনি । হিট ট্রিটমেন্ট । কিন্তু মলয়ের, ঐ যে বললুম, সবচেয়ে বড়ো মুশকিল, এক-একটা এলিমেন্ট নিয়ে বডডো বেশি ভাবেন । হরেক কিসিমের রসায়ন, রূঢ় পদার্থ আর গ্যাস দিয়ে মূল ধাতুর খোল নলচে পালটে দেন । আবার সচেতন হয়ে উঠলেই টেম্পো খুইয়ে ফ্যালেন । দারুন মেদহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার । কিন্ত যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে দেয় । ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেনলেস হয় না । ক্র্যাক করে যায় । তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন । তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না । যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে হয়ে বেঁকে-বেঁকে যায় । এর ফলে কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুন লাগলেও খুব কনট্রাইভ, আর গদ্য বানানোর দাগগুলো চোখে পড়ে যায় । এটাকে মলয়ের গদ্যের দুর্বলতা বলুন বা বৈশিষ্ট্য ।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪ সালে, এবং পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্রহ 'ভেন্নগল্প'-এর ( দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী, ১৯৯৬ ) অন্যতম ভূমিকা হিসাবে পুনর্মুদ্রিত হয় । আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে তাঁর প্রথম নভেলেট 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সালে, এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এ ( ১৯৯১-১৯৯৩-তে লেখা এবং হাওয়া৪৯ প্রকাশনী কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ) । একালের রক্তকরবীতে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও ( ১৯৯৬ ) এই গদ্যে লেখা । 'ভেন্নগল্প' গ্রন্হে প্রকাশিত এক ডজন ছোটগল্প আর শেষোক্ত দুটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্বিক মলয় রায়চৌধুরী আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে । কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা, নানা অর্ন্তদেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে । পাতি কলকাতার কাগজগুলোতে, বিশেষত 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাদের প্রোরড়মান ফেজ কাটিয়ে উঠেছে । আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রুপ যে আক্রান্ত হয়েছেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হল এই প্রথম । সতীনাথ ভাদুড়িম প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশানে যা আগে কখনও এভাবে খাপ খায়নি । মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে । খাস করে বিহারের দেশোয়ালি আর সড়কছাপ জংমরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়ে-ঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে । ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি বঙ্গকৃষ্টি দারুন-দারুন ঝাপট মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে আরম্ভ করেছে । একটা সফল ঝাপটা লাগল 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসে। বিহারের আর্থ-সমাজ সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার আলোচক-পাঠকরা । আর তাতেই তাঁরা দারুন অমায়িক হোসটেস হয়ে পড়েছেন 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর। কিন্তু, এটা মলয়ও জানেন, রানওয়ে মাত্র -- উড়ান দেখব পরবর্তী ফেজে । মলয়ই দিতে পারেন সেটা । ঢাকায় 'মীজানুর রহমানের ত্রেমাসিক পত্রিকা;য় ধারাবাহিক প্রকাশিত ও গ্রন্হাকারে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'ডুবজলে'-র তৃতীয় পর্ব 'নামগন্ধ' উপন্যাসটি এখনও আসেনি কলকাতায় । 'ডুবজলে' পাঁচটি পর্বে সমাপ্য-- 'নামগন্ধ'র পর 'ঔরস' এবং 'প্রাকার-পরিখা' ।
মলয় রায়চৌধুরী বহুপ্রজ লেখক নন -- এমন ঘোষণা এখন নির্ণিমিত্ত মাত্র । খুব লিখছেন, বেশি লিখছেন । সূর্যের আলোটা কিঞ্চিৎ স্কিম করে আস্তে-আস্তে উঠে আসছে যেন । শব্দে শব্দাক্কার হয়ে সাজছে কবিতা, গদ্য । তাতে কী হচ্ছে, কতোটা, তা সময় বলবে । তাঁর সাফ কথা : "ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো, জমিন ছাড়বো না"।
নেপালে হাংরি আন্দোলনকারীরা, নেপালি কবি-লেখকদের সঙ্গে
একটি ঘটনা, তা সামান্য বা অসামান্য যাই হোক না কেন, অনেক সময়ে সেই ঘটনার সাথে যুক্ত কোনও ব্যক্তিকে বিখ্যাত বা কুখ্যাত করে তোলে, যাঁর সম্পর্কে বহু সুনৃত তথ্য অনাবিষ্কৃত থেকে যায় । হাংরি আন্দোলন তেমনিই এক ঘটনা যার প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে অনিবার্য ভাবে চলে আসে মলয় রায়চৌধুরীর প্রসঙ্গ, এবং যাঁকে ঘিরে রহস্য, বিভ্রান্তি, দুষ্প্রচার, অপপ্রচারের অন্ত নেই । এটা ঘটেছে, যেহেতু ১৯৬৭-এর পরবর্তী দেড়-দুই দশকে নিজের বা নিজের প্রজন্মের অন্য কারও সম্পর্কে কোথাও কিচ্ছু লেখেননি মলয় । অথচ এই কালখণ্ডে মলয় ও হাংরি আন্দোলন নামের ঘটনা দুটি পাঁচকানে বাখান হয়ে-হয়ে এমন এক প্রবহ্ণিকার স্তরে পৌঁছে যায় যেখানে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ । আসলে আন্দোলন থিতিয়ে আসার বছর কয়েক পর থেকেই অভিবাদ-অভিশংসার এই নতুন খেলাটি শুরু হয়েছিল । লেখন জগতের একটা বিশেষ সেক্টর মেতে উঠেছিল এই খেলায় । সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের অবদান ব্যাপারটিকে অবজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেবার জোর কোশিশ চলেছিল । যার ফলে এই সময়সীমায় হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে গালগল্প দেদার হয়েছে, কিন্তু সিরিয়াস, নিরপেক্ষ ও অ্যাকাডেমিক গবেষণা একটিও হয়নি।
কেন হয়নি, তার জন্যে আমাদের আলোচক-গবেষকদের অসংবিদানকে দোষার্পণ করা সহজ, কিন্তু কেন এই অজ্ঞানতা তাও ভেবে দেখা দরকার। আমি এ-উত্তর দেব না যে ভারতবর্ষের বুকে সংঘটিততাবৎ সাহিত্যান্দোলনের মধ্যে একমাত্র হাংরি আন্দোলনের আকর্ষণ আলোচকদের কাছে এতো প্রবল হয়েছে, তার মূলে তথাকথিত অশ্লীল কবিতা বা ইশতাহার বিলির দায়ে ফুটপাতে থান ইঁট, লোহার রড সহযোগ হাংরিদের ওপর যুথবদ্ধ হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, জেল-জরিমানা এই সব অ্যাঙ্কর স্টোরির উপযোগী উপাদান । আসলে হাংরি আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যধারাকে জমি পাইয়ে দেবার তাগিদে এদেশের বুকে প্রথম ও একমাত্র সামাজিক মুভমেন্ট । তার দুর্নিবার গতি সেই সময় বাংলা ও ভারতবর্ষের পাঠকদের হতচকিত করে তুলেছিল। প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তারা তাকে ভয় পেয়েছিলেন, যেহেতু সাধারণ পাঠকের মনে হাংরি দর্শনের প্রতিষ্ঠা ঘটলে তাদের নিজেদের ভাবমুখে চড়ানো তাপ্পি-পুলটিশ মারা মুখোশটা উখড়ে যাবার সাধ্বস ছিল । যে-কারণে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকে ধ্বংস করার বিরাট চক্রান্ত হয়েছিল । মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলনকে এমনভাবে প্রচার করেছিল, যে সাধারণ পাঠক এটাকে নিছক হাংরি আন্দোলনকারীদের বিভীষকাময় দাপটের বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নিয়েছিলেন । পুলিশি কার্যকলাপ, মামলা-মুচলেকা, জেল-জরিমানা ইত্যাদিকেও ঐ খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়েছিল । পাঠকদের সামনে আন্দোলনের স্বরূপ ছিল অস্পষ্ট এবং বেশিরভাগ পাঠকই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে এটা আসলে প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিজীবী-বিরোধী হাঙ্গামা যার মূল লক্ষ্য অবাঞ্ছিত লেখকদের সাহিত্যক্ষেত্র থেকে বিতাড়ন আর ক্ষমতা দখল । আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে, ১৯৬৬-৬৭ সালে, হাংরি আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক কাদাহোলি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অন্য কবিদের সম্পর্কে ব্যাসোহ মন্তব্য এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকেই এই কার্যক্রম প্রকারান্তরে সমালোচিত ও নিন্দিত হওয়ায়, পাঠকদের সংশয় আরও বহু পরিমাণে বেড়ে যায় এবং তা তাঁদের মনের মধ্যে ঘর করে যায় । পাশাপাশি সাহিত্যের ছাত্র ও গবেষকরা, যাঁরা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখালিখি করেছেন, তাঁরাও থেকেছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত ।
এমতাবস্হায় নতুন করে হাংর-বিপ্লবের তাৎপর্য বিশ্লেষণ ও হাংরি-সাহিত্যের মূল্যায়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনের কথা অস্বীকার করা যায় না । এই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কয়েকটি উপায় আমাদের জানা আছে । তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলো, সমস্ত হাংরি রচনাবলী খুঁজে পেতে পড়া,, এক একটা লেখা ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা । এটা কিন্তু বুড়োদের দ্বারা আর সম্ভব নয় । যেহেতু তাঁরা আগেকার সব সেন্টো পড়ে ফেলেছেন এবং কনফিউজড । তাঁরা এটা করতে বসলে কনফিউজানের ঐ ফিতে দিকদারি করবে । এ-কাজ একমাত্র নতুন প্রজন্মের পাঠক গবেষকই করতে পারবেন । সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নতুন প্রজন্মের অন্বেষকরাই ভরসা ।
হাংরি আন্দোলন ও হাংরি লেখালিখির প্রধান সুরটি অবিকৃতভাবে খুঁজে পেতে হলে আমরা আরেকটি তরিকা অবলম্বন করতে পারি, সেটা হলো সাক্ষাৎকার চর্চা । আশার কথা যে হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দূর অতীতে মিলিয়ে যায়নি এবং অনেকেই জীবিত । যেখানে সমীক্ষার জমঘট, সর্বোপরি বৃদ্ধ পাঠক ও গবেষকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত -- সেখানে আন্দোলনের এক সময়কার শরিক, বষীয়ান লেখক-কবিদের সামনে ক্যাসেট-টেপ রেকর্ডার অন করে বসলে অন্বেষকের কাজ অনেকটা আসান হয়ে যায় । তাছাড়া সাহিত্য-বিচারের আধুনিক পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সাক্ষাৎকার-চর্চার স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে । গভীর অধ্যয়ন, অকপট নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কোনও লেখকের লেখালিখি ভাবনাচিন্তা, কাজকর্ম, সমস্যা, আদর্শ, স্বপ্ন, জীবন, অপারগতা, আকাঙ্খা ইত্যাদি ব্যাপারে স্বয়ং লেখকের কাছ থেকে বিবরণ সংগ্রহের শ্রমসাধ্য কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে সেই বিচার-বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের দাম আরও বেড়ে যায় ।
মলয় রায়চৌধুরী আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করার পর তাঁর কাছ থেকে আদায় করা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে বর্তমান গ্রন্হটি পরিকল্পিত । বাংলাভাষায় কথাবার্তার মাধ্যমে একটি সাহিত্য আন্দোলনকে বোঝবার চেষ্টা এই প্রথম । হাংরি বিষয়ে মলয় রায়চৌধুরীর কথাবার্তা স্বভাবতই একটা দলিল । কিন্তু যেভাবে এগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে দলিলের একঘেয়েমি নেই । কেননা বইটির কথা ভেবে একটা প্যাটার্ন মোতাবেক সাক্ষাৎকারগুলো নেয়া হয়নি । বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী, বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন অভিসন্ধি থেকে এগুলো গ্রহণ করেছেন । পক্ষান্তরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা নানা মত ও পথের অপেশাদার অন্বেষকের নিজস্ব জিজ্ঞাসায় মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি দর্শনের প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধায় ও মমত্বে গড়ে ওঠা এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহের মধ্যে হাংরি আন্দোলন ও বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে তাঁর যাবতীয় প্রকর্ষ ও অপকর্ষসহ এই প্রথম পৌঁছে দেয়া হলো সাহিত্য গবেষকদের ব্যবচ্ছেদ-টেবিলে ।
লেখালিখি থেকে অজ্ঞাতবাসের পর সংসারধর্ম ব্যতিরেকে 'আর কিছু না করেও' হবতো-বা নিজেরই অজ্ঞাতে এক নতুন অজ্ঞাতপূর্ব পরিবেশ ও পটভূমিতে মলয় রচিত হচ্ছিলেন এই বিশ বছর ধরে । ফিরে আসার পর তাঁর লেখাত দীধিতি আমাদের অনুমানকে সপ্রমাণ করে । ছয়ের দশকের 'নিছক বুলেটিন-লেখক আর তিরিশটি কবিতার স্রষ্টা' আটের দশকে ফিরে এসে লেখকতায় দুর্দান্ত যৌবন ফিরে পান । কিন্তু এটা একরকম ভাবে সত্য, যে নিছক কবিতা বা গল্প লিখতেই তাঁর প্রত্যাবর্তন নয় । আবার কবি বলেই যে তাঁর মধ্যে কবি-কবি ভাব রয়েছে , তাও নয় । তাঁর কাছে কবিতা হলো 'আগুনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ', এবং তিনি কবিতা শুরু করেন একটা পিক-আপ থেকে । বাসরঘরে কেলিকুঞ্চিকা পরিবৃত জামাইবাবু কবিটি তিনি নন । দারুণ বদখত, আদাড়ে, কট্টর, আর মুখফোড় এই মসীদানব । তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার ও বক্তা । তাঁর লেখায় ও কথায় নিজের ব্যাপারে যেমন অনেক কনফেশন আছে, কোনও রাখঢাক বা পুশিদা কারসাজি নেই, তেমনি অন্যের অশালীন কুৎসিত ঘৃণ্য অসূয়াবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিপ্রহার হানতেও এখন আর তিনি দ্বিধাগ্রস্ত নন । একসময় মৎসরী কলকাতার কুইসলিং বন্ধুরা অপক্রোশভাবে যে মন্তব্যটি করেছিলেন, কিছু লেখার বদলে হইচই আর হাঙ্গামার দিকেই তাঁর ঝোঁক আর চটজলদি খ্যাত পাবার লক্ষ্য, এবং তাঁর সেন্টিমেন্ট ও অপমানবোধের তোয়াক্কা না করে পর-পর দেগে গিয়েছিএন কুম্ভিলকবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ, আত্মস্তুতি, নোংরামি আর কোরকাপের আরোপ -- সেই সব কিতবের মাথা স্লাউচ করে দিতেই যেন পুনরুথ্থিত মলয়ের প্রখ্যাপন -- "অতটা খাতির নেই যে তোমরা কশাবে এই গালে থাপ্পড় আর আমু টুক করে অন্য গাল তোমাদের হাতে ছেড়ে দেব !"
ঐ চাকু চালাবার কয়েকটা ক্যারদানি বক্ষ্যমান সাক্ষাৎকারগুলিতে মিলবে । এক-একটা তাক কতরকমভাবে করা যায়, তার নমুনাও । আসলে তিনি ফিরে এসেছেন মনের ভেতরে পুষে রাখা সেই আকাঙ্খাজ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে । অনেক অপ্রিয় সুনৃত কথাও তিনি অকপটে লিখে আর বলে যাচ্ছেন । এবং কোনও তাগবাগ নেই, বারফট্টাই নেই । যদিবা কোনও কোনও মন্তব্যে তাঁকে ভীষণ অহংভাবাপন্ন ঠেকে, এবং কিছু-কিছু কথা প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা থেকে বলার দরুণ এবং তদনুযায়ী শব্দ ব্যবহারে অনেককে খুশি নাও করতে পারেন । কিন্তু যাঁরা তাঁর লেখালিখির গতের সঙ্গে পরিচিত, যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁদেরকে নতুন করে বলার কিছু নেই যে তঁর কথা ও কথনভঙ্গী তাঁর নিজের মতোই নিজস্বতাময় -- রাগি ও জেদি । লেখার মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী নিয়ত প্রচেষ্ট থাকেন যাতে প্রতিস্পর্ধী বুর্জোয়া নিউক্লয়াসকে কামান দাগা যায়। কথার মধ্যেও সেই মারমুখি প্রবণতা । কোথাও সাংবাদিক সুলভ তীর্যক, কোথাও স্লোগানধর্মী, কোথাও চিত্রল, বক্র ও বিধ্বংসী অথচ আশ্চর্যরূপে গঠনমূলক । এটা হতে পেরেছে যেহেতু আদপে তিনি ভাষাজ্ঞানী । চিন্তাবিদ লেখক ও প্রভাবশালী বক্তা । শব্দ ব্যবহারে দারুন সচেতন । খাসা ভাষা, অকপট বর্ণনা আর সরস উপমা তাঁর রাগ-ধরানো কথাবার্তাকেও সুখপাঠ্য করে তোলে । এই সাক্ষাৎকারমালায় আমরা সেই রাগি মুখফোড় খোলামেলা তত্বজ্ঞানী, শব্দজ্ঞানী, ব্রাত্য-কথককে খুঁজে পাচ্ছি ।
মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকারমালার সম্পাদনার কাজ কিছুটা আকস্মিকভাবে হাতে পেয়েছিলুম । পূর্বপ্রস্তুতি প্রায় ছিলই না, মনে-মনে পরিকল্পনাও করিনি । তবে বিগত পনেরো বছরে হাংরি সিসৃক্ষা নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি করে আসছিলুম, তাতে এ যেন একটা কাজ করার গুরুত্বের কথা একেবারেই ভাবিনি তা নয় । আসলে আমি নিজেই একটা দীর্ঘ কথোপকথন চাইছিলুম এই আশ্চর্য বিতর্কিত ব্রাত্য ভাবধারার লেখকের সঙ্গে । মলয়ের সাম্প্রতিকতম গদ্যগুলি পড়ে একটা সবিমুগ্ধ শ্রদ্ধাই যেন তোড় ভাঙতে চাইছিল । দারুণ অন্য ধরণের কিছু, কিংবা একটা স্বল্পায়তন উপন্যাস লেখার কথাও ভেবেছি তাঁকে নিয়ে । মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা যে কি প্রচণ্ড আত্যয়িক, তার আভাস আমি পেয়েছি । তবু নিজেকে নিরাসক্ত রাখতে পারছিলুম না । সেই মতো চিঠি চালাচালিও করেছিলুম মলয়ের সঙ্গে, তাঁর পুরোনো লেখাপত্তর, মলয় সম্পর্কে অন্যদের লেখা ঢুঁঢ়ে ঢুঁঢ়ে পড়া শুরু করেছিলুম, ক্রমে ক্রমে পরিকল্পনার একটা ভিজুয়াল সার্কলও গড়ে উঠছিল যখন, ঠিক তখনই, এক অচিরস্হায়ী ডামাডোলের মাঝে, হাতে এসে যায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি । তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারকে আমি এই গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত করিনি, কেননা সেগুলো প্রশ্নোত্তরের আকারে প্রকাশিত হয়নি । সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পায়েল সিংহ ( ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইনডিয়া : ১৫,৫.১৯৮৮ ) ; সোমা চট্টোপাধ্যায় ( ফ্রি প্রেস জার্নাল : ১৩.১.১৯৯১ ); এবং নওল ঘিয়ারা ( মিডডে : ১৪.৪.১৯৯১ ) । এঁদের প্রশ্নাবলী হাংরি আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না ।
Ajit Ray ( Editor of Bengali periodical 'SHAHAR' ) 2018
যে কথা আগেই বলেছি, এই সাক্ষাৎকারগুলি গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন অন্বেষখ, তাঁদের স্বকীয় ধারণা, নিজস্ব ভাবনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে । সাক্ষাৎকারগুলিকে নির্দিষ্ট রীতি-পদ্ধতি ও উদ্দেশয় অনুযায়ী পরিচালনা করতে না-পারার দরুণ বা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকার অসুবিধার ফলে, যে এলোমেলো ব্যাপারটি প্রায় অনিবার্য ছিল তাকে ডেক্সওয়র্কের মাধ্যমে, নির্বাচন ও গ্রন্হনার কাজ স্বতন্ত্রভাবে করার কথা গোড়ার দিকে মনে হয়েছিল । কিন্তু এ নিয়ে ডেলিবারেটলি নিজের সঙ্গে তর্ক করে দেখেছি, এই অসুবিধেকেই একটা মহৎ সুবিধায় পাল্টানো যেতে পারে যাতে ব্যাপারটা আরও রুচিকর আর যুক্তিগ্রাহ্য হয় । সাক্ষাৎকারগুলো পড়ে বুঝেছি, কয়েকটি সাক্ষাৎকার লিখিতভাবে নেয়া, এবং সেক্ষেত্রে স্বয়ং মলয় জবাবগুলি লিখে দিয়েছেন । মানে, এখানেও মলয়ের সেই মেদরিক্ত গতিশীল ভাষাটাকে পাচ্ছি । আবার যাঁরা মাউথপিস বা নোথখাতা ব্যবহার করেছেন, মলয়কে সামনে বসিয়ে অনর্গল কথা বলিয়ে আর লিখে গেছেন, তাঁরাও যে শুধু মলয়ের কথাগুলিকে হুবহু লিখে গেছেন, তা নয় । বরং প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন ও সেগুলির জবাবের মাঝখানে যে অন্তর্নিহিত কথাবার্তা, সেগুলিকেই সজীব করে ফুটিয়ে তুলেছেন । ফলত যেসব বিষয় গুরুগম্ভীর ছিল, সেগুলিও লেখায় অনবদ্য হয়ে উঠেছে ।
একদিকে মলয়ের সুস্পষ্ট চাঁচাছোলা সাবলীল কথাবার্তা, তার ওপর স্বচ্ছন্দ গতিতে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ -- তাকে লেখার আকারে ধরে রাখা অধিকতর অধিকতর বিচিত্র হয়েছে । অন্যদিকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, যাঁরা নিজের ভাষা মিশিয়ে মলয়ের কথাগুলি লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো জড়তা বা আড়ষ্টভাব নেই বললেই চলে । সাধারণত সাক্ষাৎকার যেভাবে নেয়া হয়, অত্যন্ত মামুলি ঢঙে, তার মধ্যে উৎসাহ বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না । কিন্তু এখানে খুব গূঢ় আর কঠিন বিষয়ও স্বচ্ছন্দ ভারমুক্তভাবে বলা ও লেখা হয়েছে । যেসব কথা মলয় রায়চৌধুরী এই সাক্ষাৎকারগুলিতে বলেছেন, সেগুলি আগেও নিজের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও প্রবন্ধসমূহে লিখেছেন । কিন্তু তবে, যাঁরা তাঁর মৌলিক রচনাগুলির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারগুলি পড়ে লাভবান হতে পারেন -- কেননা মলয়ের কথাবার্তা তাঁর লেখালিখির প্রতিনিধিত্বই শুধু করে না, তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাদ দেয় । তাঁর আগেকার লেখালিখি আর এইসব সাক্ষাৎকার পাশাপাশি রাখলেও বোঝা যায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে তাঁর ভাষা ও মানস কীভাবে কতোদূর বদলেছে । দোষে-গুণে ভরা একটা মানুষকে ধরবার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব সাক্ষাৎকারে । সর্বোপরি বক্তার বলবার মুন্সিয়ানায়, লেখকদের লিপিকুশলতার গুণে এগুলি মামুলি সাক্ষাৎকারের বিবরণমাত্র না হয়ে, এক-একটি বিচিত্র তথ্যবহুল আখ্যায়িকার রূপ নিয়েছে ।
একথা বলা যাবে না যে সব কয়টা সাক্ষাৎকারই উত্তীর্ণ হয়েছে বা নূনতম মান বজায় রাখতে পেরেছে । অমুক সাক্ষাৎকারটি যে গভীরতা পেয়েছে, তার সঙ্গে তমুক পত্রিকাগোষ্ঠীর কথোপকথন নিশ্চয়ই সমান্তরাল নয় । আবার একই প্রশ্ন একই প্রসঙ্গ বার-বার ঘুরে ফিরে এসেছে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে, সেগুলিকে কেটে-ছেঁটে লাগসই ভাবে ছাপানো যেত । কিন্তু একটি লাইনও বাদ না দিয়ে সমস্ত সাক্ষাৎকার হুবহু আসতে দিয়েছি প্রথমত আগে অন্যত্র ছেপে গেছে বলে, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি কোনও চালুনি ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমার বিশ্বাস পূর্ব-প্রকাশিত কোনও রচনার ওপর সম্পাদনার নিয়ম বেশিদূর অবধাবিত হলে, রচনা ও রচকের মর্যাদাহানি হয় । সেরকম অমার্যনীয় মাস্টারিতে আমি যাইনি । খড়কুটোকে ধানের শিষের সঙ্গে আসতে দিয়েছি । তাছাড়া বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং লিখে দিয়েছেন বলে সেব সাক্ষাৎকারের মধ্যে ভাষাগত, শৈলীগত ও পদ্ধতিগত একরূপতাও প্রকারান্তরে এসে গেছে, এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একটি নিবদ্ধ স্তবকের মতো পরস্পর অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছে । এদের পারস্পরিক ঘনতার সম্ভাবনা আঁচ করে কোনও যোগ বিয়োগের প্রয়োজন আমি অনুভব করিনি । পুরোপুরি যুক্তির ওপর নির্ভর করে রচনাগুলিকে পর-পর সাজিয়েছি মাত্র । সুতরাং এই গ্রন্হে যদি কিছু কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার জন্যে আমার নয়, অন্বেষকদের অবদানই স্বীকার্য । ধন্যবাদার্হ লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার সন্দীপ দত্ত, যিনি রচনাগুলি সংগ্রহ করে দিয়েছেন ।
পরিশেষে জরুরি যে-কথা, এবং সম্পাদক হিসেবে যে-কথা বলার দায় আমার ওপরই বর্তায়, তা হলো, সাক্ষাৎকারগুলি যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লোক, এবং এ-কথা অনস্বীকার্য যে বাঙালি জাতির যদি কোনও জাতীয় চরিত্র টিকে থাকে তবে ইদানিং তা বোধ করি ছোট কাগজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় । মতান্তরে, লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে ঘিরে যে ইন্টেলিজেনশিয়া, তা-ই আজ বাঙালির যা-কিছু । সুতরাং বড়ো মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাকে যখন খুব করে দাবানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, হাংরি আন্দোলনের শরিকরা পারস্পরিক কাদাহোলি করে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ করে দিচ্ছেন, তখন লিটল ম্যাগাজিনগুলি গোরস্হান খুঁড়ে হাংরি আন্দোলনকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবাভাবি শুরু করবে, এতে আর আশ্চর্য কী ! মলয় রায়চৌধুরীর পুনরাগমনের পর এই ভাবাভাবিটা হঠাৎ রাতারাতি বিরাট আকার নিয়ে ফেলেছে । বিশেষত আটের দশকের প্রথম পাঁচ-সাত বছরে হাংরি লেখালিখির আলোচনা-পর্যালোচনার স্রোতে লিটল ম্যাগাজিনগুলির পরিমণ্ডল কিছুটা উচ্ছ্বসিত ছিল । উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসার পর ইদানিং হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার মান উৎকর্ষ ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, হাংরি লেখকদের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে । এটা শুভ লক্ষণ । এই সাক্ষাৎকারগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়েও একটা কথা আমার বার বার মনে হয়েছে, তা হলো, আধুনিক আর কম বয়সী পাঠক-গবেষকরা ব্যাপারটাকে ক্রমাগত আরও গুরুত্ব দিতে শিখছেন ।
কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী মানে এখন আর নিছক হাংরি আন্দোলন, হাংরি বুলেটন নয়। অথচ মলয়ের সঙ্গে কথা বলতে বসেও দেখা গেছে আজকের দিনেযখন তাঁর 'কবিতা সংকলন', 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'হাততালি', 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', 'পোস্টমডার্নিজম', 'ভেন্নগল্প' 'জলাঞ্জলি', জীবনানন্দ ও নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত, বেশির ভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মূলত দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চেয়েছেন । এক, হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল বা হাংরি আন্দোলন শুরু হলো কী ভাবে ; আর, দুই, সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের স্হান কোথায় বা কতো উর্ধে । প্রশ্নদুটি এতোবার এতোভাবে তাঁকে করা হয়েছে, আর এতো ভেঙে-ভেঙে জবাব দিয়েছেন মলয় আগেও বহুবার, যে এখন আর এসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না । প্রশ্নকর্তারা তো কেউ মলয় বা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আগে থেকে কিছু না-জেনে বা না-পড়ে আসেননি । ধরে নেয়া যেতেই পারে যে আন্দোলনের বিদ্রোহাত্মক চেহারা, বড়ো প্রাতিষ্ঠানিক আঁতেলদের ভয় পেয়ে যাওয়া, পুলিশী পীড়ন, মারপিট, কোর্ট-কেস, জেল-জরিমানা এসব কোনও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে প্রাথমিক পর্বে উদ্দীপিত করেছে, এবং তাঁরা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, বা প্রশ্নাবলী পাঠিয়েছেন প্রায়-হঠাৎ ভাবনা, উদ্দীপনা আর প্রশ্রয়েই । নির্দিষ্ট কোনো বিশ্লেষণ জানার আগ্রহে নয় । যার ফলে অনেকের প্রশ্ন আর মলয়ের জবাব একঘেয়েমি এনেছে । অথচ উদ্যোগ যদি আরও একটু ভাবনাচিন্তা করে নেয়া হতো, তবে তাঁরাই হয়তো ক্রমশ গড়ে তুলতে পারতেন যুগপৎ হাংরি সাহিত্য আর মলয়-সাহিত্যের আলোচনার এক নতুন সম্ভাবনা ও সার্থকতা ।
এ-কথা ঠিক যে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবমূর্তির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে হাংরি আন্দোলনের ইমেজ । বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মলয়কে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, পক্ষান্তরে তাঁর হাংরি ইমেজটাকেই গ্লোরিফাই করার জন্য যেন । মানুষ মলয়কে, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে বেড়ে ওঠা নানান অভিজ্ঞতার আকর মলয়কে, নিজেকে সাংস্কতিক দোআঁশলা বলে পরিচিহ্ণিত করতে চাইছেন যিনি সেই মলয়কে, কবি ও গদ্যকার মলয়কে, ভাষাজ্ঞানী মলয়কে, তাত্বিক মলয়কে তাঁরা যেন খুঁজে পেতেই চাননি । আবার হাংরি প্রসঙ্গেও কিছু-কিছু প্রশ্ন এমনভাবে করা হয়েছে, তার জবাব অদীক্ষিত ও নতুন পাঠকের সামনে চিন্তাশীল কবি, বলিষ্ঠ গদ্যকার, বিরল তত্বজ্ঞানী মলয়ের আসল মানসিক গঠনটাই ধেবড়ে দিতে পারে । আবার মলয় যে ভালো বিশ্লেষক, দারুণ সমালোচক, তাঁর কাছ থেকে অন্যান্য হাংরি লেখকদের ভাষা, রচনাশৈলী, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্পর্কে বিশেষ কোনও আলোচনাই চাওয়া হয়নি । আবার মলয় সম্পর্কেই যে সবকথা জানা হয়েছে, তাও নয় । ভুলে গেলে চলবে না যে মলয় বার-বার এ-কথা বলে চলেছেন যে তিনি এখন শুধু মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, 'হাংরি' বা 'একদা হাংরি' হিসেবে নয় । তাঁর কবিতার বই আর গল্প-উপন্যাসের বইগুলি প্রকাশ হয়ে যাবার পরে যাঁরা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাঁদের অন্তত মলয়ের কবিতার প্রাতিস্বিক ধারা, গদ্যের ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল । এ-ছাড়া পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে বিরাট আলোচনা আদায় করা যেত। তিনি যে জায়গায় জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করছেন, সারা ভারত ঘুরে-ঘুরে বেড়িয়েছেন, যার ফলে কলকাতার পাতি লেখকদের সঙ্গে তাঁর যে বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ গোড়া থেকেই ঘটেছে, সেসব নিয়েও দারুণ আলোচনার স্কোপ ছিল ।
আরেকটি দিক থেকে মলয় রায়চৌধুরীর ওপর আলোকপাত করা দরকার । সেটা হলো তাঁর মনস্তত্বের উৎসসন্ধানের দিক । যেহেতু লেখকের মানসিকতা এক নিত্যসচল ও পরিবর্তমান জিনিস, এবং অক্ষর তাঁর বাহন, তাই কোনও একটি মানসিক অবস্হান থেকে কোনও কিছু লেখাকে লেখকের সব বলা যায় না । সাহিত্যসৃজনের ভেতর স্রষ্টার রচনার শক্তি, জ্ঞান, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির রূপ, কল্পনা ও চিন্তাশক্তি, বিচারবোধ ও অনুভূতি বিশেষ ভূমিকা নেয় । এসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয় জীবনের প্রতি কোনও এক ধরণের দৃষ্টি আরোপ করার ক্ষমতাও। আবার এ-কথাও ঠিক যে লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতি, আবেগদ্বন্দ্ব, কনফিউজন, মানসিক আকাঙ্খা প্রভৃতি সব সৃষ্টিমূলক অবদানের মূলেই কোনও না কোনও ভাবে কার্যকরী । আসলে, নিছক বস্তুনির্ভর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টিমূলক রচনা বোধহয় সম্ভব নয় । এই সাক্ষাৎকারসমূহে মলয় রায়চৌধুরীর বুদ্ধি, পড়াশোনা, বিচারশক্তি ও দ্বন্দ্বের ক্রিয়াশীলতার রূপ ততোটা ফুটে ওঠেনি। অধচ এইসব ফুটে উঠলে সাক্ষাৎকারগুলি তখন নিছক তথ্য ও উপাদান সংগ্রহের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য হতো না । অনেক কিছুই তখন তত্বের পর্যায়ে চলে আসতো । অনেক জরুরি প্রশ্নই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা করতে পারেননি । মলয় রায়চৌধুরীকে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় রচনা করার অবকাশ তাই থেকে গেল।
অজিত রায়
১ বৈশাখ ১৪০৬
সামান্য অভুয়িষ্ট ক্ষুধিত প্রজন্মের কবি ও কবিতা নিয়ে একটা আচাভুয়া লেখা লিখেছিলুম বছর পনেরো আগে, এক মফসসলি কাগজে । সেই শুরু । সেদিনের সেই সব্রীঢ় আত্মপ্রতর্ক থেকে প্ররোচিত হই হাংরি সিসৃক্ষার কলিন অধ্যয়নে । আর পরপর পরিচিত হতে থাকি মলয় রায়চৌধুরী, দেবী রায়, সুবিমল বসাক, উৎপলকুমার বসু, ফালগুনী রায়, সুবো আচার্য, করুণানিধান মুখোপাধ্যায় প্রমুখ হাংরি আন্দোলনের প্রতিভূ এবং তাঁদের সজ্ঞাননা-সম্ভূতির সঙ্গে ।
এঁদের মধ্যে, আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা আর বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের প্রধান স্রষ্টা মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে আলাদা কথা আছে । আলাদা, কেননা, আমার মনে হয়েছে, মলয়ই প্রথম, যিনি বাংলা সাহিত্যের প্রতিষ্ঠিত এঁদো চিন্তাভাবনা আর তার ভেক্টর প্রতিষ্ঠানের মুখে জোর থাপ্পড় মেরে তার গিল্টি করা দাঁত উখড়ে তার ভেতরকার মালকড়ি ফাঁস করে দিতে চেয়ে লেখালিখির জগতে এসেছিলেন । মলয় এসেছিলেন এমন এক মিলিউ থেকে যেখানে বঙ্গসংস্কৃতির কোনো শিসই গজাবার নয় । জীবনের অনেকরকম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত থাকতে হয় সেখানে । বিহারের ভয়ঙ্কর কুচেল অধ্যুষিত বাখরগঞ্জ বস্তিতে অতিবাহিত শৈশব । টায়ার ছোটোবেলা অতিক্রান্ত মুসলিম অধ্যুষিত দরিয়াপুর মোহল্লায় । সেই অস্বাচ্ছন্দ্য, অখল জ্বলা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে তাঁর বেড়ে ওঠা । সংস্কৃতির একেবারে নিচেকার পাদানি থেকে আসা, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে ওঠার প্রতিটি মানুষী কসরতের সাক্ষী, স্পেংলারের সংস্কৃতি ও অবক্ষয়কালীন সর্বগ্রাস তত্বে তা-খাওয়া একজন বাইশ-তেইশ বছরের কৃষ্টি-দোগলা বা কালচারাল বাস্টার্ড লেখালিখির মঠে এলে যা ঘটবে, সেটা তো রফা হয়েই আছে ।
Memoirs of slum life of childhood
বাংলা সাহিত্যের, বিশেষত কবিতায় চলে আসা ন্যাকাচিত্ত পিলপিলে গীতিধর্মিতার প্রতি প্রচণ্ড বিরক্তি, ক্ষোভ আর প্রত্যাখ্যানসহ নতুন একটা কিছু করার ছটফটানি তিনি যখন সবে টের পাচ্ছেন, তখন তিনি পাটনা ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির পড়ুয়া এবং মার্কসবাদ ও কবিতায় গভীরভাবে আক্রান্ত । তিরিশের পর চল্লিশ দশক থেকেতাঁর কাছে সমস্ত বাংলা কবিতাই যেন জোলো ঠেকছে । পঞ্চাশও নিজের ল্যাসল্যসানি সমেত কুণ্ডলী মেরে বসতে চাইছে । মলয় দেখলেন কবিতাকে আর এভাবে চলতে দেয়া ঠিক হবে না । বদল চাই । ফেরাফিরি চাই, তরমিম চাই । স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে আন্দোলন চাই । মলয়ের মাথায় গড়ে উঠল আন্দোলনের জিগির । আচমকা একদিন ইংরেজি পদ্যের বাবা জিওফ্রে চসারের এক টুকরো "ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম"এর মধ্যে খুঁজে পেলেন 'সমকালের অবধারিত সংজ্ঞা' । অসওয়াল্ড স্পেংলারের প্রাগুক্ত তত্বে আরোপ করলেন চসার কথিত সেই হাংরি ভাবনার দ্যোতনা । নিজের প্রজন্মের নাম দিলেন 'হাংরি' ।
মলয়কে যে গ্রন্হটি প্রভাবিত করেছিল
জিওফ্রে চসার, যার কবিতায় "ইন সাওয়ার হাংরি টাইম" বাক্যটি পেয়েছিলেন মলয়
প্রাথমিক পর্যায়ে মলয় পেয়েছিলেন দু'জনকে । হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায় এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে । পঞ্চাশের কবি হিসাবে শক্তি তখনই প্রতিষ্ঠিত । মলয়ের চিন্তাভাবনায় উৎসাহিত হয়ে শক্তি পাটনা থেকে ফিরে 'ছোটোগল্প' পত্রিকায় লিখলেন "ক্ষুৎকাতর আক্রমণ", আর বিনয় মজুমদারের 'ফিরে এসো চাকা'র সমালোচনা করতে গিয়ে সম্প্রতি কাগজে লিখলেন "হাংরি জেনারেশন সংক্রান্ত প্রস্তাব"। এ-দুটিই ছিল মলয়ের পরিকল্পনার প্রাথমিক ভাষ্য । পরে কেউ-কেউ, এবং শক্তি নিজে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা হিসাবে শক্তি চট্টোপাধ্যায় নামটি চালাতে চেয়েছিলেন । সে ভিন্ন কথা । ১৯৬১ সালের নভেম্বর নাগাদ 'হাংরি জেনারেশন' নামে ১/৮ ডবলক্রাউন সাইজের কাগজের ইস্তাহারটি প্রকাশ পায়, তাতে বার্জাস টাইপে ছাপা হয়েছিল 'স্রষ্টা : মলয় রায়চৌধুরী, নেতা: শক্তি চট্টোপাধ্যায়, সম্পাদক : দেবী রায়' । আত্মার অশ্রুত ছটফটানিসহ যে মূলবার্তা মলয় এই ইস্তাহার মারফত প্রচার করতে চেয়েছিলেন, তা হল : "কবিতা এখন জীবনের বৈপরীত্যে আত্মস্হ । সে আর জীবনের সামঞ্জস্যকারক নয়, অতিপ্রজ অন্ধ বল্মীক নয়, নিরলস যুক্তিগ্রন্হন নয় । এখন, এই সময়ে, অনিবার্য গভীরতার সন্ত্রস্তদৃক ক্ষুধায় মানবিক প্রয়োজন শেষ । এখন প্রয়োজন অনর্থ বের করা, প্রয়োজন মেরুবিপর্যয়, প্রয়োজন নৈরাত্মসিদ্ধি । প্রাগুক্ত ক্ষুধা কেবল পৃথিবী বিরোধিতার নয়, তা মানসিক, দৈহিক এবং শারীরিক । এ-ক্ষুধার একমাত্র লালনকর্তা কবিতা । কারণ কবিতা ব্যতীত কি আছে আর জীবনে !...কবিতা বলে যাকে আমরা মনে করি, জীবনের থেকে মোহমুক্তির প্রতি ভয়ঙ্কর আকর্ষণের ফলাফল তা কেবল নয় । ফর্মের খাঁচায় বিশ্বপ্রকৃতির ফাঁদ পেতে রাখাকে আর কবিতা বলা হয় না । ...ইচ্ছে করে, সচেতনতায়, সম্পূর্ণরূপে আরণ্যকতার বর্বরতার মধ্যে মুক্ত কাব্যিক প্রজ্ঞার নিষ্ঠুরতার দাবির কাছে আত্মসমর্পণই কবিতা । ছন্দে গদ্য লেখার খেলাকে কবিতা নাম দিয়ে চালাবার খেলা এখন শেষ হওয়া প্রয়োজন । টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেকসে কলম ডুবিয়ে, কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে । এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে । সেহেতু ত্রশ্নু বলাৎকারের পরমুহূর্তে কিংবা বিষ খেয়ে অথবা জলে ডুবে 'সচেতনভাবে বিহ্বল' হলেই, এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব ।...শখ করে, ভেবে ভেবে, ছন্দে গদ্য লেখা হয়তো সম্ভব, কিন্তু কবিতা রচনা তেমন করে কোনো দিনই সম্ভব নয় । অর্থব্যঞ্জনাঘন হোক অথবা ধ্বনি পারম্পর্যে শ্রুতিমধুর, বিক্ষুব্ধ প্রবল চঞ্চল অন্তরাত্মার ও বহিরাত্মার ক্ষুধা নিবৃত্তির শক্তি না থাকলে, কবিতা সতীর মতো চরিত্রহীনা, প্রিয়তমার মতো যোনিহীনা, ঈশ্বরীর মতো অনুন্মেষিণী হয়ে যেতে পারে।"
বাংলা কবিতাকে চরিত্রহীনা হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচাবার এ ছিল এক অভিনব আয়োজন ।এই আনকা নওল মতধারা থেকেই হাংরি আন্দোলনের পথচলা শুরু। যা পরবর্তী দিনে খাড়া করে বাংলার শক্তমুঠো প্রতিভাবান শর্করীবাজদের এক দীর্ঘ রিসালা । মলয়ের একক ভাবনা ছড়িয়ে পড়ে গোষ্ঠীচেতনায় । ভবিষ্যত কর্মসূচি ঠিক করে নেবার জন্য দরকার হয় নির্নায়ন নিয়মাবলীর । সেই তাগিদে মলয় তৈরি করেন একটি চোদ্দদফা ইশতাহার, যা থেকে ফুটে ওঠে আন্দোলনের নিখাঁজ রূপরেখা এবং উদ্দেশ্য, কী আর কীভাবে লিখব-র উত্তর । পূর্ণাবস্হায় ইগোর ক্ষমাবর্জিত প্রকাশ, খাস লহমায় বিস্ফরিত আত্মার ইঙ্গিত পুরোপুরি শব্দবন্ধে ও প্রকাশভঙ্গীতে । ঐতিহ্য ও গতানুগতের প্রতিবাদ । এবং তার ভাস্বরতা প্রাত্যহিক জবানে । বাঁধাধরা মূল্যবোধের খেলাপে জেহাদ । ধর্ম অহিফেন, রাজনীতি বন্ধ্যা । মূলধন শুধু কবিতা । সেই কবিতাই হাংরিদের হাতিয়ার হল । সশস্ত্র হাংরিরা ছড়িয়ে পড়লেন চারিদিকে । রাস্তায় ঘাটে দোকানে বাজারে অফিসে দেওয়ালে পোস্টারে ...সর্বত্র হাংরি হাংরি হাংরি । প্রথম প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা ।
Hungryalist bulletin published in 1964
হাংরি কোনও 'ইজম' ছিল না । ছিল একটা স্টাইল বা আইডিয়া । তবে স্ফীত অর্থে আন্দোলন কথাটা অনেকের পছন্দ । বলতে পারি একটা ঘটনা, বাংলা সাহিত্যে সেভাবে যা আগে কখনো ঘটেনি । বাংলা সাহিত্যের তথাকথিত মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন অনাদৃত এক উপদ্রুত এলাকা থেকে বিশাল একটা ঢেউ, উঠে, আছড়ে পড়েছিল ইজি গোইং সাহিত্যের প্যালপিলে ল্যাসলিসে মসৃণ চত্বরে । সমাজের একেবারে নিচুতলার ভাষা ও ভাবনাকে সাহিত্যের কাছাকাছি নিয়ে আসার, পক্ষান্তরে বাংলাসাহিত্যের লিরিকফুলের সাজানো বাগানকে তছনছ করে নতুন প্রতিমান প্রতিষ্ঠার তাগিদে হাংরি ছিল প্রথম আর তখনও অব্দি একমাত্র বৈপ্লবিক সমীহা । পাশল অর্থে একে "আন্দোলন" বলা হচ্ছে, সেহেতু তা শুরু হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য, গোষ্ঠী আর প্রস্তুতি নিয়ে । যার লিখিত ম্যানিফেস্টো ছিল। এবং যার অনেক ইশ্যু, সেই ডামাডোল প্রধান ষাট দশকে বাঙালি কবি-গদ্যকারদের এমনকি পঞ্চাশ দশকের কবিদের একাংশকেও তুমুলভাবে নাড়া দিয়েছিল -- যার দরুণ সুদীর্ঘ কাতার । প্রবল ঘুর্ণাবর্ত্ম ।
এটা ঠিক যে ঐ সময়ে মলয় ও তাঁর সহযাত্রীদের কজন মিলে এমন কয়েকটি কাণ্ড করেছিলেন, যার সঙ্গে আন্দোলনের ঘোষিত উদ্দেশ্যের কোনও রকম সরোকার ছিল না, এবং যার দরুণ গঙ্গাজলি সাহিত্যের কোল-আলো-করা কবি-লেখকরা আন্দোলনের ওপরই দারুণ খচে যান । কিন্তু বলা বেশি, বাড়িতে মর্মান্তিক দুর্ঘটনার ভুয়ো খবর দিয়ে জনৈক বাজারি লেখকের অফিসে ফোন, বিভিন্ন পশুপাখি ভাঁড় আর শ্বাপদ-শয়তানের মুখোশ কিনে প্রাতিষ্ঠানিক নোকরদের নামে পাঠানো, পাবলিক ল্যাভাটরিগুলোর দেওয়ালে উদ্ভট পোস্টার সাঁটা বা বাঙালি কবিদের বংশপঞ্জি প্রচার -- এসবে নয়, প্রতিষ্ঠানের লোকেরা ভয় পেয়েছিলেন হাংরিদের যা ছিল আসল হাতিয়ার : অনুশাসন থেকে মুক্ত ছোটোলোকি শব্দের ব্যবহার আর নিচুতলার মনোভাবের ছোঁচালো সীবনীটিকে। আর সেটাই ছিল আন্দোলনের পজিটিভ দিক ।
হাংরি আন্দোলনের পত্রিকা 'জেব্রা'-র দ্বিতীয় সংখ্যা
আসলে হাংরিরা যে ভাষায় ও চেতনায় গদ্য-পদ্য নিয়ে এসেছিলেন, তা ছিল আমাদের এতোদিনকার বুর্জোয়া সংস্কারের বাইরে । আন্দোলনের মেজর কবি-লেখকরা প্রায় প্রত্যেকেই এসেছিলেন বাঙালি নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে, সেই স্তরের যাবতীয় শিক্ষা-সংস্কার নিয়ে । শক্তি, সন্দীপন, উৎপল, সমীর, সুবো, মলয়, ত্রিদিব, দেবী, ফালগুনী, অবনী, অরনি, রবিউল, বাসব,বাসুদেব, সুবিমল, সুভাষ, প্রদীপ, শৈলেশ্বর প্রমুখের সবার সম্পর্কেই এ তথ্য লাগসই । সুতরাং তাঁদের আত্মার ঘোর আততি, স্বদন্দ্বের সিনথেসিস থেকে গদ্য ও কবিতাকে রূঢ় কর্কশ ছালে সজ্জিত করা । জীবনকে প্রায় চিনিয়ে দেয়া, স্বাধীনতার তলানিটুকু পর্যন্ত উজাড় করে স্মাৎ করা, দৈনন্দিন হাড় পুঁজ রক্ত কফ উচাটন ফন্দিহীন ভাবে গদ্য ও কবিতায় আনা দগদগে আত্মবোধ ও অহং, মগজকে সম্বল করে সৃজন -- এসবের কোনো কিছুর মধ্যেই কোনও সিউডোপনা, পাঁয়তাড়া, বারফট্টাই বা কারাসাজি ছিল না । বাংলা সাহিত্যে এই জিনিস আলবৎ নতুন । আমাদের বুর্জোয়া সংস্কারের সম্পূর্ণ বিপরীত । আসলে বাংলা গদ্য ও কবিতাকে তার কৃত্রিমতার খোলস ছাড়িয়ে একটা পরাদর্শী আর শক্ত সবল বনেদ পাইয়ে দেবার জন্যে হাংরিদের এ ছিল এক ভয়ঙ্কর আয়োজন ।
The Hungryalists in 1964 during Malay Roychoudhury's trial
ভয়ঙ্কর হলেও সাহিত্যের তাতে ক্ষতি হয়নি । কেননা অতি ভদ্র আর ঝুঁকিহীন মন্তব্যে যাঁরা বিশ্বাসী তাঁরাও প্রকারান্তরে স্বীকার করেছেন যে, বাংলা কবিতা নিয়ে উত্তর-রবীন্দ্রকালে নিরীক্ষার ব্যাপারটা হাংরিরা প্রথম চালু করেন । আর পরীক্ষা-নিরীক্ষায় সাহিত্যের ক্ষতি হয় না । বরং তন্বিষ্ঠ গবেষণা একদিন বলবে, এতে করে কয়েক ধাপ হঠাৎ দুম করে এগিয়ে গিয়েছিল বাংলা কবিতা । পরবর্তীকালের বাংলা কবিতায় এর সুফল দুর্লক্ষ্য নয় । বিশেষত সত্তর-আশির সময় থেকে কবিতাক্ষেত্রে একটা মৃদু প্রভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে । কবিদের একটা গণ্য অংশ অন্তত লিরিকাল ধাঁচ ছেড়ে বেরিয়ে আসছেন, হাংরির তত্বভাবনা অনেকের লেখায় পরোক্ষভাবে কাজ করেছে এটা কম কথা নয় । বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ত্বকে পচন ও পয়মালের ঘা দগদগ করছে যখন, সেই মুহূর্তে একদল তেজি, রাগি আর প্রতিভাবান যুবক নিজেদেরকে উচ্ছন্নে দিয়ে বাংলা সাহিত্যের ভেজানো কপাটে দিতে পেরেছিলেন একটা জোর দস্তক, এটা ঊন বা অবম তথ্য নয়। যে কারণে জন্মকালেই হাংরি আন্দোলনকে ধ্বংস করার চক্রান্ত, দুষ্প্রচার, অতর্কিত হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, মুচলেকা লেখানো, চাকরি থেকে বরখাস্ত, ট্রান্সফার ইত্যাদি স-অব ঘটেছে একাদিক্রমে এবং পরপর ।
এসবের দরুণ এবং আরও কিছু পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষ কারণে এই আন্দোলনের নখদন্ত বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের শরীরে পিরেনিয়্যেল আঁচড় কেটে অচিরেই ধাবাড় মেরে যায় । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৫কেই বলা যায় হাংরি আন্দোলনের সবচেয়ে উত্তেজনাকর আর ঘটনাবহুল অস্তিত্বকাল । কিন্তু অন্যদিকে জেব্রা, উপদ্রুত, ক্ষুধার্ত, ফুঃ, উন্মার্গ, চিহ্ণ, প্রতিদ্বন্দ্বী, ওয়েস্ট পেপার, স্বকাল, ব্লুজ, জিরাফ প্রভৃতি কাগজকে ঘিরে পাশাপাশি শম্ভু রক্ষিত, আলো মিত্র, দেবী রায়, মলয় রায়চৌধুরী, ফালগুনী রায়, প্রদীপ চৌধুরী, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুবিমল বসাক, সুভাষ ঘোষ, সুবো আচার্য, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, ত্রিদিব মিত্র, তপন দাশ, অলোক গোস্বামী, রাজা সরকার, অশোক চট্টোপাধ্যায়, শঙ্কর দে, বিকাশ সরকার, মলয় মজুমদার, জীবতোষ দাশ, অনিল করঞ্জাই, করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, অরুণেশ ঘোষ প্রমুখেরা গড়ে তুলেছিলেন হাংরি সিসৃক্ষার আরেকটি চক্র । এবং আন্দোলনের উত্তেজনা থম মেরে গেলেও, তারপরেও সেই সব সেরকশ আর গেঁতো মৌমাছি , ক্ষুধার্ত, প্রতিদ্বন্দ্বী, সকাল, ফুঃ, চিহ্ণ, জিরাফ, আর্তনাদ, কনসেনট্রেশন ক্যাম্প, ধৃতরাষ্ট্র প্রভৃতি রেফ্লুয়েন্ট চাককে আঁকড়ে কিছুকাল শর্করাবাজি চালিয়ে গেছেন বটে, কিন্তু আসর আর জমেনি ।
আসলে সাহিত্যের আন্দোলন মাত্রেই হ্রস্বজীবি । হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া সমস্ত কবি-লেখকদের কথা যদি ধরি, সকলে কোনো নির্দিষ্ট সমাজ-স্তর থেকে আসেননি । তাঁদের মধ্যে নান্দনিক দৃষ্টিবৈভিন্ন্য ছিল, যা আন্দোলনের শেষাশেশি ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠেছিল । এ-বাদে ব্যক্তিজীবনের উচ্ছৃঙ্খল বিষাদ, উপরতস্পৃহা, আর নিরাশাও চাগাড় দিয়ে উঠেছিল । এ-কথা অনস্বীকার্য যে তত্ববিশ্বের দিক থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়েছিলেন, কিন্তু তবু কবিতার জন্ম ফ্রম এ স্ট্রং পার্সোনাল নিড, র্যাদার দ্যান ফ্রম এনি থরো আনডারস্ট্যানডিং অফ অ্যান আইডিওলজি --- ফ্রয়েডিয় মতবাদের গুরুত্ব ও প্রভাব কম হয়ে যায় না । ছেষট্টির গোড়া থেকেই শরিকরা বয়স-অভিজ্ঞতা-চিন্তা মোতাবেক নিজের-নিজের বৌদ্ধিক ও রাজনৈতিক রাস্তা বেছে নিতে শুরু করেছিলেন । প্রকৃত সাংস্কৃতিক নিউক্লিয়াসের অভাবে আন্দোলনকে বাঁচিয়ে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে । তারপর আন্দোলন সম্পর্কে ভাবি-প্রজন্মের মনে দুরোধিগম্যতা, খটমটি, ভ্রান্তব্যাখ্যার যথেষ্ট সুযোগ জিইয়ে রেখে আন্দোলনের প্রভাব ডবলমার্চ করে ফিরে গেল ভাটায় । আন্দোলন পুরোপুরি বানচাল হয়ে গেলে কেউ কেউ তিন সত্যি কেটে সাইড নিয়ে নিলেন, প্রচল ধারায় লেখনীপাত শুরু করলেন, কেউ-কেউ মার্কসবাদী রাজনীতির ঝাণ্ডাতলে গিয়ে সাময়িক স্বস্তি লাভ করলেন, কেউ-বা আশ্রয় নিলেন ধর্মের, আবার কেউ-বা লেখালিখি ছেড়ে, বন্ধুবান্ধব ছেড়ে, সমস্ত যোগাযোগ ছিন্ন করে চলে গেলেন অজ্ঞাতবাসে । চিরতরে হারিয়ে গেলেন কেউ-কেউ । কিংবা যোগ দিলেন অ্যাকাডেমি ও মিডিয়ার তাঁবুতলে ।
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়-এর আঁকা হাংরি আন্দোলনের পোস্টার
পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেল তারপর । পঁয়ত্রিশ বছর । নিছক কম সময় নয় । এ নিছক ঘড়ির কাঁটার টিক-টিক সরে যাওয়ার বা ক্যালেণ্ডারের তারিখ বদল নয় । অনেক বদল ঘটে গেছে এই সময়ে । এর আগে অব্দি কোথাও না কোথাও, কোনোখানে, একটা স্হৈর্য, স্হিতিবোধ, বিশ্বাসের বলয়ে জীবনকে সংবৃত করে রেখেছিল, চতিস্পার্শস্হ মসৃণ জীবনযাত্রায় জীবনমোহরের একটা স্হির অলিকল্পিত উপলব্ধি সৃজনশীল মানুষের মনে সদা জায়মান থেকেছে । কিন্তু এখন, তরবারীর সুমসৃণ যখন ফালি-ফালি করে কেটে ফেলছে আমাদের জোড়াতালি অস্তিত্ব, হঠাৎ-হঠাৎ টের পাচ্ছি সমুখে সমূহ অস্হিরতা, এখন এই অস্হির দজ্জাল সময়ে সুস্হতার মাঝে বিধ্বংসী ভালোবাসা আর বিপন্ন মগজজাত ক্ষিপ্ত চেতনা নিয়ে 'লড়াই' জেতার উপকিঞ্চিৎ লজিকটুকুও বেমালুম হাপিস । এ-সময়ে হিটলার হয়ে দুনিয়াটাকে দাপানো সহজ যদি-বা, কিন্তু নিছক কলমী বিদ্রোহ করে কিছু গড়তে পারার সম্ভাবনা বুঝি আর নেই । যাকে নিয়ে আমার চিন্তা, যার মুখ একটু-একটু করে সোজা রাখতে চাওয়া -- তার জন্য, আমাদের অভিজ্ঞতা বাৎলে দিচ্ছে, বাস্তিল থেকে শুরু করে গ্লাসনস্ত-পেরেস্ত্রৈকা কোনো কিছুতেই প্রাসাদশীর্ষ থেকে বদল সম্ভব নয় । এবং যা বিপ্লব, মত-সাপেক্ষে তা পপতিবিপ্লব । যুদ্ধ কবেই হেজে গেছে, এখন খড়গের শানানো ধারে খয়েরি পোঁচড়, গিলোটিনে আলপনা বিলাসিতা । 'প্রতিবাদ' শব্দটাকে অভিধান থেকে লোপাট করে দেবার দিন আজ । আশার পাছায় ঘাঘরা বেঁধে কোঠায় ছেড়ে দেবার দিন ।
তো ? এরকম সময়ে, এই প্রেক্ষিতে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছর আগে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত সংস্কারের বিরুদ্ধে, তার পচা ভিত্তিকে উৎখাত করার একান্ত অভীপ্সায় দুর্বিনীত আসর যিনি করেছিলেন, বিশ-তিরিশ বছর বাদে লেখালিখির জগতে প্রত্যাবর্তন করতে চাইলেও, তাঁর কাছে প্রধান সমস্যাটা কী খাড়া হতে পারে ?এমনিতে পঞ্চাশের কবি-লেখকরা যাঁরা হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন, আন্দোলন ফুরিয়ে যাবার পর নিজেদের চরিত্র মোতাবেক লিখে আসছিলেন । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের এতোলবেতোল জীবন শুরু হয়ে যায় আর তিনি ছদ্মনামে 'রূপচাঁদ পক্ষী' হয়ে যান, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় একটা নির্দিষ্ট গদ্য রেওয়াজ করতে করতে নিজস্ব শৈলীতে থিতু হন । বিদেশ থেকে ফিরে উৎপলকুমার বসুও কাব্যচর্চার নবাঞ্চল অব্যাহত রাখেন । ষাটের কবি-লেখক হিসেবে পরিচিত অশোক চট্টোপাধ্যায়, দেবী রায়, শৈলেশ্বর ঘোষ, অরনি বসু, অবনী ধর, বাসুদেব দাশগুপ্ত, সুভাষ ঘোষ, ফালগুনী রায়, শম্ভু রক্ষিত, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য প্রমুখের লেখালিখি থেমে থাকেনি এবং দেখা গেছে বয়স, অভিজ্ঞতা ও সিরিয়াসনেসের দরুন এঁদের কেউ-কেউ খুঁজে পেয়েছেন নিজস্ব ফর্ম, চিন্তা ও দৃষ্টিভঙ্গীতে একজন আলাদা হয়ে উঠেছেন অন্যজনের থেকে । অর্জন করেছেন চারিত্র্য, আর বাংলা সাহিত্যে এনেছেন ভিন্নতর আধার-আধেয় !
মলয় রায়চৌধুরীর কেসটা এঁদের চেয়ে আলাদা । এবং আপাত-জটিল । বাংলা সাহিত্য-সংস্কৃতির পীঠস্হান হিসেবে বিজ্ঞাপিত কলকাতার ধুলো মলয়ের পায়ের তলায় সেভাবে লাগেনি, যেখানে, অনেকে মানতে না চাইলেও, অনেক ধুলো । কলকাতার একটা পুশিদা ক্লোমযন্ত্র আছে যা বামুন আর চাঁড়ালকে শুঁকে চিনতে পারে । কলকাতা মলয় রায়চৌধুরীকে নিজের দাঁত দেখিয়ে দিয়েছিল । কলকাতা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছিল, তুমি আমাদের লোক নও । তুমি একটা কৃষ্টিদোগলা । তোমার কলমে ছোটোলোক রক্ত । তোমার টেক্সট আলাদা । আলাদা থিসরাস । তফাত হটো তুমি । এবং, কলকাতা মলয়ের সঙ্গে সমস্ত শরোকার ছিন্ন করে । ভয়ে কোনও সম্পাদক তার কাছে আর লেখা চান না । বন্ধুবান্ধবদের চিঠি আসা বন্ধ হয়ে আসে ক্রমশ, এবং যারা মুচলেকা দিয়েছিল তারা সবাই স্লিপ করে যায় । লেখা ছাপানো অসম্ভব হয়ে পড়ে । এই বীভৎস যন্ত্রণা, একাকীত্ববোধ, অপমান একমাত্র কলকাতাই দিতে পারে । এই যন্ত্রণা, অপমানই মলয় রায়চৌধুরীকে লেখালিখি থেকে নির্বাসন-ভোগের আরেক অব্যক্ত যন্ত্রণার দিকে ঠেলে দিয়েছিল মলয়কে । ২৭ জুলাই ১৯৬৭, মানে, হাইকোর্টের রায়ে বেকসুর খালাস পাওয়ার পরদিন থেকে মলয় কবিতা লেখা ছেড়ে দেন । সবায়ের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন করেন । আর নিজেকে ক্রমশ অসীম একাকীত্বে ঘিরে ফ্যালেন । প্রশাসন ও প্রতিষ্ঠানের দুর্গদ্বার থেকে অপরিগৃহীত হয়ে লেখার জগৎ থেকে একান্তে অপসৃত হয়ে স্বরচিত নির্জনতার এক সুচারু এরিনায় নিজেকে বন্দী রেখে, রাইটার্স ব্লকের অখল জ্বালা ভোগ করা -- হাংরিদের মধ্যে এটা একমাত্র মলয়ের ক্ষেত্রেই ঘটেছে ।
আত্মবিবাসনের সেই বিবিক্ত দিনে, ১৯৬৮-এর ডিসেম্বরে রাজ্য-স্তরের হকি খেলোয়াড় শলিলা মুখার্জির সঙ্গে উদ্বাহর সাময়িক স্বস্তি ফিরিয়ে আনে তাঁর জীবনে । জীবনের মতো ভেলকি জানে কে আর ! সে বারে-বারে মানুষকে ষাঁড়ের গোবর করে । চটকায় । ঘুঁটে বানিয়ে শুকোতে দেয় । আবার, পেড়েও আনে । জীবন লিখেওছে এমন ফিচেল কেলিকিন, যে কবিতা বোঝে না । মন বোঝে না । আদর্শ বোঝে না । আলোপিছল প্রতিষ্ঠানের মসৃণ করিডোর দিয়ে হাঁটিয়ে সটান তুলে দেয় আরাম, স্বাচ্ছন্দ্য আর কর্তৃত্বের সুনিপুণ এলিভেটরে । অর্থাৎ 'একদা আপোষহীন' এবং পরে 'অঙশভাক' এই ঐতিহাসিক গল্পের পুনরাবৃত্তি মলয়ের জীবনে ঘটাল সেই নর্মদ । এই ট্র্যাজেডির জন্যে আমরা ইতিহাস আর সময়কে বাদ দিয়ে বরাবর ব্যক্তিকে দায়ি করি, তাকে ব্যক্তির ট্র্যাজেডি হিসেবে চিহ্ণিত করে সৌমনস্য উপভোগ করি, সে আমাদের প্রবলেম ।
কিন্তু ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি এক অনৈতিহাসিক তত্ব । এ-খবর সত্যি যে বিবাহোত্তর প্রবাসে বিভিন্ন শহরে কিছুদিনের জন্য এলিট সংসারি হয়ে উঠেছিলেন মলয় রায়চৌধুরী । সৃজন, সাহিত্য, বইপড়া, বাংলা ভাষা ইত্যাদি থেকে আরও দূরে সরে থাকবার মতো সরঞ্জাম তখন মজুত । মৎসরী বন্ধুরা হয়তো এই জেনে কিঞ্চিৎ আরামও উপভোগ করছিলেন যে গার্হস্হ দায়িত্ব নির্বাহ করা ছাড়া মলয় "আর কিছুই করছেন না"। কিন্তু তাঁদের গুড়ে বালি নিক্ষেপ করে আশির দশকের গোড়ার দিকে আবার লেখালিখির জগতে তুমুল বেগে ফিরে এলেন মলয় রায়চৌধুরী ।
প্রত্যাবর্তিত মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে অনেক মাল, অনেক মউজ । মানে, দারুণ একটা রায়বেঁশে, হই হল্লা, তারপর নর্তকের আর কোমর-টোমর রইলো না, মলয়ের কেসটা সেরকম নয় । তিনি যে হাত-পা ছুঁড়েছিলেন, বেশ কিছু জ্যামিতিক পারফরমেন্স দেখিয়েছিলেন । বিশ বছর বাদেও দেখছি, সেই কোরিওগ্রাফিটা থেকে গেছে । দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, গুঁতো দেবার তালেই ছিলেন যেন । আর গুঁতোবার আগে যেমন মাথা নিচু করে কয়েক পা পিছিয়ে যায় অগ্নিবাহন, তেমনি করে হয়তো-বা আবার করে অঙ্গহার দেখাবেন বলে খানিক জিরিয়ে নিচ্ছিলেন মলয় । কিংবা লেখা ছাপানো বন্ধ রেখে পরখ করে নিচ্ছিলেন তিনি টিকে আছেন, না উবে গেছেন ।
মলয় রায়চৌধুরী যে আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করেন, উনিশশো আশি-বিরাশি নাগাদ, তার পেছনে প্রাথমিক প্ররোচনা ছিল সত্তর দশকের বিশিষ্ট কবি, গদ্যকার ও 'কৌরব' পত্রিকার সম্পাদক কমল চক্রবর্তীর । কমল নাগাদে তাগাদা দিয়ে মলয়ের কাছ থেকে আদায় করেছিলেন এক গোছা মন্ময় পদ্য । আজকের এই ফিরে আসা হই-চইহীন নিরুত্তেজ উদ্দাস্ত-যমিত শান্ত অবাস্হ নিরুদ্বেগ ঠাণ্ডামাথা মলয় রায়চৌধুরীর মধ্যে সেদিনের সেই উত্তপ্ত অস্হির আন্দোলিত প্রবহস্রোতের মাঝে অবগাহনরত মলয় রায়চৌধুরীকে খুঁজতে যাওয়া গোঁয়ার্তুমি মাত্র । তবে, বুকের মধ্যে ঢেউয়ের সেই দাপানিটা আর নেই বটে, কিন্তু পানখ সাপের ফণাটা এখনও উদ্যত ( উল্লেখ্য, মলয় রায়চৌধুরীর ডাকনাম 'ফণা' ) । সেই কর্কশ আর গতলজ্জ ভাষা, নিলাজ শব্দাক্রমণের ফলাটা এখনও তেমনি পিশুন । আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নতুন করে বেড়ে-ওঠার অদম্য উৎসাহ, জেদ আর সামর্থ । যেন পুরোনো দখলতি হাসিল করতেই তাঁর ফিরে আসা ।
তবে গড়ে-ওঠা পর্বে, খুব বেশি কবিতা তিনি লেখেননি । ১৯৬১ থেকে ১৯৬৩ কালখণ্ডে লেখা কবিতার প্রথম সংকলনটি বেরিয়েছিল ১৯৬৩ সালে 'কৃত্তিবাস প্রকাশনী' থেকে, 'শয়তানের মুখ' নামে ( প্রচ্ছদ মেকসিকোর জনৈক চিত্রকর )। হাংরি আন্দোলনের বাইপ্রডাক্ট 'জেব্রা' পত্রিকা থেকে ১৯৬৫-এ বেরিয়েছিল দুটি দীর্ঘ কবিতা - "অমীমাংসিত শুভা" আর "জখম" । "জেব্রা" পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল মলয়ের অ্যাবসার্ড নাটক 'ইল্লত', যাকে পরবর্তীকালে বলা হয়েছে 'পোস্টমডার্ন' -- নাটকটি 'বহুরূপী' পত্রিকার কুমার রায় এবং 'গন্ধর্ব' পত্রিকার নৃপেন সাহা প্রকাশ করতে অস্বীকার করেছিলেন, দুর্বোধ্য হিসাবে । পরে কবিতীর্থ প্রকাশনী হাংরি আন্দোলনের সময়ে লেখা তাঁর তিনটি 'হাংরি' নাটক 'নাটকসমগ্র' নামে প্রকাশ করেছে।
মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম দিককার সমস্ত লেখা আমার পড়া হয়নি, বিশেষ করে ১৯৬২ সালে শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশিত মলয়ের 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' এবং 'বিংশ শতাব্দী' পত্রিকায় ধারাবাহিক ভাবে প্রকাশিত 'ইতিহাসের দর্শন'। যেটুকু পড়েছি, তাতে সব থেকে বেশি আক্রান্ত হয়েছি 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ। হাংরি জেনারেশন বুলেটিনের আগস্ট ১৯৬৪ সংখ্যায় প্রথম প্রকাশ পেয়েছিল কবিতাটি, যা মলয়ের জীবনে, এবং তাঁর হাংরি বন্ধুদের জীবনেও, বয়ে এনেছিল প্রচণ্ড তুফান । আদালতে অশ্লীলতার দায়ে অভিযুক্ত 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার'-এ আমি খুঁজে পাই এক তরতাজা যুবকের আর্তি, অসহায়তা, যন্ত্রণা, আমর্ষ আর ক্লেদ । বাংলা কবিতার জমিতে গড়া প্রচলিত সংস্কারের গাঁথুনির ভিত নড়বড়ে করে দিয়ে জীবনচর্চার গূঢ় সত্য প্রকাশ করে বলেই কবিতাটি একই সঙ্গে মলয় রায়চৌধুরীর প্রথম পর্যায়ের কবিতা চর্চা আর হাংরি আন্দোলনের প্রতিনিধিত্বকারী শ্রেষ্ঠ মুখবন্ধ বলে বিবেচিত হওয়া উচিত । এ ছিল মলয়ের চেতন-অবচেতনের এক উজ্জ্বল প্রতিফলন ।
কলকাতা ব্যাংকশাল কোর্ট কর্তৃক মলয় রায়চৌধুরীর দণ্ডাদেশ
স্বীকার করা ভালো, মলয়ের সেইসময়কার বেশিরভাগ কবিতা পড়লে মনে হয় তাঁর স্বঘোষিত 'অরগ্যাজমের মতো স্বতঃস্ফূর্তিতে' যে লেখা বের হয়, তেমন-কিছু তিনি নামাতে পেরেছেন খুব কম । তাঁর বেশির ভাগ কবিতাকে মনে হয়েছে বানানো । শব্দ শরব্যতার দিকে তাঁর প্রচণ্ড ঝোঁক । একেকটা শব্দকে কোথায় কীভাবে কতোটা ফাঁক দিয়ে বসালে চমক খাবে পাঠক, যেন এই প্রবণতা থেকেই এক-একটি কবিতা তাঁর । এটা ঘটেছে, কেননা আদপে তিনি কবিতা গড়েন, বানান, তৈরি করেন । এবং যথেষ্ট সচেতন থেকে তাঁর নিজের কথায় 'একটা আইডিয়া কিছুদিন ধরে আমার মাথায় ঘোঁট পাকায় । কিছুটা ঘোরের মতো সেটা কাগজে নামাই । তারপর ঘষেমেজে কবিতাটা লিখি'। আসলে মলয় আগাগোড়া সুররিয়ালিজমকে বাহন করেছেন, অবচেতন ও স্বতঃস্ফূর্ত সৃষ্টির কথা ভেবেছেন ঠিকই, কিন্তু সচেতনভাবে । তাঁর কথা হলো -- "সচেতনভাবে বিহ্বল হয়েই কবিতা লেখা সম্ভব"। অর্থাৎ মেধা-মননের ভিতর দিয়ে বেরিয়ে আসবে কবিতা । যে-জন্যে তাঁর পরবর্তী কাব্যগ্রন্হের নাম 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'চিৎকার সমগ্র', 'যা লাগবে বলবেন'।
প্রচ্ছদ : যোগেন চৌধুরী
মলয় রায়চৌধুরী তাঁর নানা গদ্যে, সাক্ষাৎকারে, একটা কথা বেশ গুরুত্ব আর জোর দিয়ে বোঝাতে চেয়েছেন যে, হাংরি আন্দোলন বা হাংরি লেখালিখি আগাগোড়া সাবভারসিভ ছিল ( তাঁর বিরুদ্ধে আদালতে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ ছিল ), সুররিয়ালিজম বাদে তাতে অন্য কোনো বহিঃপ্রভাব ছিল না । কিন্তু গোড়ার দিককার তাঁর নিজের কিছু-কিছু কবিতায় বাহ্যিক প্রভাব সম্পর্কে অনেকে সন্দিহান । কবি পবিত্র মুখোপাধ্যায়, বাসুদেব দাশগুপ্ত প্রমুখ তাঁর 'অমীমাংসিত শুভা' ও 'জখম' পর্যায়ের নির্মাণগুলিতে দেখেছেন বিট কবিদের উচ্চকিত প্রভাব । মলয় এই আরোপের বিরুদ্ধতা করেছেন । আমি সেই বিতর্কের মধ্যে যেতে চাইছি না । শুধু বলব, প্রভাব জিনিসটা কি সত্যিই নক্কারজনক ? শুনেছি, অল আর্ট ইজ মাইমোসিস । আর কবির সৃষ্টি-প্রভায় 'প্রভাব' শব্দটি সবিশেষ অর্থবহ । সামান্য 'ইনফ্লুয়েন্স' শব্দে তা নিরূপেয় নয় । প্রভাব অর্থে 'প্রকৃষ্ট ভাব', তা পূর্বতনের হলেও ভিন্নতর কবিকল্পনায় নতুন করে 'হয়ে ওঠে' । আর হাংরি কবি-লেখকরা তো ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে কবিতা বানাননি, বানিয়েছেন কলম-কাগজ দিয়েই । প্রশ্ন হল, কবিতায় মলয় কতোখানি উতরেছিলেন ? আমি তাঁর প্রথম পর্বের যে কয়েকটা কবিতা পড়েছি, চার-পাঁচটি বাদে, এখনকার কবিতার তুলনায় জোলো ঠেকেছে। 'শয়তানের মুখ' আমার কাছে নেই । ঐ বইটার সুনাম কোথাও দেখেছি বলে মনে পড়ছে না । নিজের পাঠের সঙ্গে অন্যান্যদের বিশ্লেষণ মিলিয়ে বুঝেছি, মলয়ের সেই সময়কার অনেক রচনাই রুগ্ন । কবর-চিহ্ণে মুদ্রিত । দারুন চমকে দেবার মতো কবিতা তিনি লিখেছিলেন খুব কম ।
বরং তাঁর দ্বিতীয় পর্বের মেটামরফসিস আমাদের আকর্ষণ করে, কিছু-কিছু সংগঠন দারুন অভিভূত করে । এই পর্যায়ে আমরা পাচ্ছি মহাদিগন্ত প্রকাশিত 'কবিতা সংকলন' ( ১৯৮৬ ), 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' ( ১৯৮৭ ) , 'হাততালি' ( ১৯৯১ ), গ্রাফিত্তি প্রকাশিত 'মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা' (১৯৯৪), কবিতা পাক্ষিক থেকে প্রকাশিত 'চিৎকার সমগ্র' ( ১৯৯৫ ), কবিতীর্থ প্রকাশনীর 'ছত্রখান' ( ১৯৯৫ ), আর কৌরব প্রকাশনীর 'যা লাগবে বলবেন' ( ১৯৯৬ )। এ ছাড়া স্বরচিত কবিতার দুটি ইংরেজি অনুবাদ যথাক্রমে ওয়াশিংটন স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার-এর অনুবাদ 'স্টার্ক ইলেকট্রিক জেশাস ( ১৯৬৮ ) ও রাইটার্স ওয়ার্কশপ থেকে 'সেলেকটেড পোয়েমস' ( ১৯৮৯ ) । এই পর্বে অনুবাদ করেছেন অ্যালেন গিন্সবার্গের 'হাউল' ( ১৯৯৪ ) ও 'ক্যাডিশ' ( ১৯৯৫ ), ব্লাইজি সঁদরার 'ট্রান্স সাইবেরিয়ান এক্সপপেস' ( ১৯৯৭ ), উইলিয়াম ব্লেকের 'ম্যারেজ অফ হেভেন অ্যাণ্ড হেল' ( ১৯৯৮ ), ত্রিস্তান জারার 'ডাডা কবিতাগুচ্ছ' ও 'ম্যানিফেস্টো' ( ১৯৯৬ ), জাঁ ককতো'র 'ক্রুসিফিকেশান' ( ১৯৯৬ ), পল গঁগার 'আত্মজীবনী' (১৯৯৯), 'শার্ল বদল্যার' ( ১৯৯৮), 'জাঁ আর্তুর র্যাঁবো' ( ১৯৯৯ ), 'অ্যালেন গিন্সবার্গ', সালভাদর দালির 'আমার গুপ্তকথা' । 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর' কাব্যগ্রন্হের কবিতাগুলি বুলেটিন আকারে প্রথমে প্রকাশিত হয়েছিল, কবিতা থাকতো মলয়ের এবং তার সঙ্গে ড্রইং থাকতো প্রকাশ কর্মকারের ।
মলয় জানিয়েছেন, কবিতা তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কবিতার মধ্যেই যাকিছু দেখা ও দেখানো । ছয়ের দশকের মলয়ের চেয়ে অনেক বেশি লিখেছেন আটের-নয়ের দশকের পুনরাগত মলয় রায়চৌধুরী । এ-পর্যন্ত ( ১৯৯৯ )যা লিখেছেন, সংখ্যাগত দিক থেকে -- বয়স, অভিজ্ঞতা ও পড়াশুনার তুলনায় অনেক কম । তথাচ পূর্বাপরের সঙ্গে স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় একটা সীমারেখা এখনি গড়ে তুলতে পেরেছেন এবং বাংলা সাহিত্যের সার্থক সব কবিতার পাশে তাঁর এ-যাবৎ লেখা কবিতার একটা গণ্য অংশ অন্তত সম-বা পৃথক -মর্যাদায় গৌরবের আসন দাবি করতে পারে -- এ-মন্তব্য খুব ভেবে-চিন্তে রাখা যায় । আমার ব্যক্তিগত অনুসন্ধান জানাচ্ছে, কী কবিতায় কী গদ্যে পুনরুথ্থিত মলয় খুব ধীরে-ধীরে একটা জায়গা বানিয়ে নিচ্ছেন । এবং, তিনি অপ্রতিরোধ্য ।
বাংলা সাহিত্যে প্রথা ভেঙে যেখানে কিছুই হতে পারে না, মলয় রায়চৌধুরী সেখানে একটা মিশাল খাড়া করলেন । প্রচণ্ড স্প্যানিশ ভাবনার উদ্যত ছোবল দেখি তাঁর কবিতায় । তাঁর শব্দ খোঁজার কায়দা, শব্দ বানাবার টেকনিক, পংক্তিবিন্যাস, চিত্রকল্প-নির্মাণ ইত্যাদি পূর্বাপর কোনও কবির সঙ্গে খাপ খায় না। স্বচরিত্রে বিশিষ্ট তাঁর কবিতা । বিশেষত শব্দ দিয়েই কবিতা লেখেন তিনি, আর শব্দচয়নে তাঁর মুঠোর জোর এখন প্রায় সব মহলেই স্বীকৃত । এক-একটি শব্দ নিয়ে তাঁর দারুণ ভাবনা । পক্ষান্তরে ভাবনা বা ভাবনাসমূহের পারস্পরিক মারামারি ঢুসোঢুসি ছেঁড়াছিঁড়ি ধস্তাধস্তি থেকে বেরিয়ে আসে তাঁর শব্দ । তারপর সেই শব্দ তুলে এনে খুব ভেবেচিন্তে রয়েসয়ে তার সঙ্গিশব্দদের পাশে বসান তিনি । প্রচল ধারায় ভাষার জ্যামুক্ত তীব্র গতি বলতে যা বোঝায়, তা আনার কোনো প্রচেষ্টাই তাঁর থাকে না, হয়তো বা অপারগ ; কিন্তু একটা অন্য ধরণের স্পিড ( 'অ' গ্রন্হে তিনি বলেছেন যে 'প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার' হল স্পিডের কবিতা ), স্মার্টনেস থাকেই, যা আমাদের তাঁর কবিতা পড়িয়ে নিতে বাধ্য করে । আসলে, ঐ যে বললুম, তাঁর নতুন ও আনকা শব্দ, শব্দসংগঠন, পংক্তিনির্মাণ তথা চিত্রকল্প ফুটিয়ে তোলার কুশলতা তাজ্জব করে দেবার মতো । 'নতুন' ও 'পৃথক' বলছি তা এই কারণেও যে তিনি এ-যাবৎকাল লিখে আসছেন প্রবল অন্তর্চেতনার কবিতা, প্রচলন ধাঁচ ও লিরিকাল ব্যঞ্জনা বর্জন করে, এবং সচেতনভাবে । তাঁর সব কারবার সচেতনতা ও মেধা নিয়ে । কবিতা সম্পর্কে নিজস্ব ভাবনাচিন্তার কথা বহু দিন ধরে লিখে আসছেন মলয় রায়চৌধুরী । সেগুলো ততোটা নয়, কবিতাই তাকে করে তুলেছে বিশিষ্ট । আসলে কবিতা যা, সে নিজেই স্বক্ষেত্রে এক অপ্রতিবিধেয় শক্তি । কথাটা ভাবালুতায় আবিষ্ট ঠেকলে অন্য ভাবে বলা যায়, অহরহ একজাই অনিবার উথ্থান ও পতন, গহণ ও বর্জনের মধ্যে দিয়ে শশ্বৎ সে আরও শাক্তিশালিনী হয়ে ওঠে । পিতৃত্বের জন্য বীর্যবন্ত করে তোলে কবিকে । কবির রুচি, ইনার-কালচার, শিক্ষা, মেধা, আকাঙ্খা ও স্বপ্নের শন্নিপাত ঘটলে কবিতাই কবিকে করে তোলে প্রাতিস্বিক, নিজস্বতাময়, অনন্য । মলয়ের ক্ষেত্রে যেটা ঘটেছে, সেটা তাইই । মলয়ের প্রধান হাতিয়ার শব্দ, আর বুদ্ধি ও মেধার সহযোগে তার ব্যবহারের কুশলতাই তাঁর কবিতাকে উতরে দেয় । তথাকথিত লিরিকাল কবিদের প্যানপ্যানানির সঙ্গে তাঁর লড়াই এইখান থেকে, কিংবা জেহাদ বলুন । আজকের ঐ বয়স্ক কবিরা যাঁরা এখনও চিনিতে চিনিই ঢেলে যাচ্ছেন এবং ঢেলে যাবেন, মলয় রায়চৌধুরীর সঙ্গে তাঁদের ফারাকটা এইখানে যে, মলয়ের এতবার ম্রক্ষণ-যুতিতে নেই, চিনির সঙ্গে একটু কৃষ্ণসীস বা সীসাঞ্জন মেশানোর দিকেই তাঁর অবসক্তি । এ-ভাবে, প্রথা ভেঙেই, আজ তিনি ক্রমশ-প্রতিষ্ঠান ।
আরেকটি কথা মলয়ের কবিতা সম্পর্কে বলার আছে । সেটি হলো, তাঁর কবিতার বিষয়, বা ইমেজ বলুন আপাতত । জেনে বা না-জেনে, চেতোমান মলয় বলেছেন, কবিতায় তিনি ছুরি-চাকু চালানো রপ্ত করেছেন চার দশক ধরে। তাঁর কবিতার সেলাখানায় আছে বিবিধ তবক কারবাইন, মাস্কেট, তোপ, কর্নি, মর্টার, মলোটভ ককটেল, করপাল, বৃক্ষাদন, কুকরি, পর্শ্বধ, বাইস, ধারাবিষ আর চিয়ার-বরশার চিত্রকল্প । আর এইসব চিত্রকল্পের ধারাবাহিক অনুশীলনে তাঁকে সাহায্য করে তাঁর আশৈশব-আহরিত ইমলিতলা পাড়ার প্রায় হাজার খানেক অসৎ কুচেল অভাগা দুর্বাহৃত শব্দাবলী আর বাক্যবিন্যাস । বর্তমানের প্রতিফলনের দরুন সন্ত্রাসের ইমেজ, যা নিছক জান্তব বা যৌন নয়, এ একা মলয় রায়চৌধুরীর কবিতাতেই মেলে । যার ফলে কবির নাম না পড়েও তাঁর কবিতার স্ট্রাকচার আলাদা ও সহজ ভাবে শনাক্ত করা যায় ।
মলয় বলেছেন কবিতাই তাঁর প্রাইমারি কনসার্ন । কিন্তু নিছক কবিতা বানাতে তাঁর জন্ম নয় । বরং বাংলা গদ্যকে তাঁর অনেক কিছু দেবার আছে, দিয়েছেন, দিচ্ছেন । এই যে বিশ বছর বিরাম, তাঁর নির্জনবাস, এর ফলে তাঁর নিজের পক্ষে যেমন, বাংলা গদ্য-সাহিত্যের ক্ষেত্রেও অনেকটা ক্ষতি হয়ে গেল । মলয়ের গদ্যে যাঁরা সম্ভাবনা খুঁজে পেয়েছেন, অন্তত তাঁদের কাছে এটা অতিশয়োক্তি বলে মনে হবে না ।
বাংলা গদ্য নিয়ে মলয় রায়চৌধুরীর নিজস্ব ভাবনা আছে । বঙ্কিম-রবীন্দ্রনাথের পর বাংলা গদ্যের তেমন কোনো মৌলিক পরিবর্তন হয়নি । বরং বাংলা গদ্য-সাহিত্যের সূচনাকালে আমাদের জন্য যে গদ্যভাষা ধার্য করা হয়েছিল, এতো বছর ধরে ঐ গদ্যকেই মডেল হিসাবে সামনে রেখে আমরা রেওয়াজ করে আসছি । গদ্য, যা বাঙালির অভিন্ন জাতি-চিহ্ণ, তাকে উন্নত করার জন্য নিরীক্ষার কোনও আয়োজনই ব্যাপকভাবে সেরে রাখিনি আমরা । সাধু থেকে চলিত ভাষায় আসতেই আমাদের অনেকটা সময় গেছে । এখনও আমরা তৎসম শব্দের মোট বইছি আর তথাকথিত ইতরশ্রেণির শব্দগুলোকে নিজেদের অভিধানে ঢুকতে না দিয়ে বাংলা সবেধন দেড় লক্ষ নলাপচা শব্দ নিয়েই শব্দঘোঁট পাকিয়ে চলেছি । মলয় দেখেছেন, বাংলা ভাষায় শব্দ ব্যবহার, বাক্যগঠন, ক্রিয়াপদের ব্যবহার ইত্যাদি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার দারুন অবকাশ আছে । তার কিছু একটা করে দেখিয়েছেন কমলকুমার মজুমদার, কমল চক্রবর্তী, নবারুণ ভট্টাচার্য, সুবিমল বসাক এবং আরও দু'একজন নবীন লেখক। কিন্তু ব্যাপক স্তরে সেথা হচ্ছে না । নিচুতলার ভাষা ও শব্দাবলীকে মূলধারার সাহিত্যে অভিষেক ঘটাতে হবে । শুধু ভাষা ও শব্দকাঠামোকেই নয়, নিচুতলার সংস্কৃতি, জীবনযাপনের ঢঙ, আচার-আচরণ, খাওয়া-পরা, আনন্দ-দুঃখ সবই তুলে আনতে হবে । সাহিত্যের স্বার্থেই সেই ব্রাত্য করে রাখা শব্দ, ভাষা, সংস্কৃতিকে সাহিত্যে স্হান দিতে হবে, এবং তা সরাসরি । তাতে ফাঁকি রাখা চলবে না ।
বাংলা গদ্যে শৈলী, শব্দ ও ভাষার ব্যাপারে মলয়ের আকাঙ্খিত এই ভাবনার রূপকার মলয় স্বয়ং নন । তবে তিনি মনে করেন, আধুনিক বিশ্বের জন্যে একটা যুৎসই গদ্য আমাদের পেতে হবে । হয়তো তার জন্য প্রস্তুতিও সারা । দলবেঁধে মঞ্চে নামা হবে, না, যে-যার নিজের মতন করে ডেভলপ করতে করতে সেটা আনবেন তার ঠিক নেই । বুর্জোয়া শব্দভাঁড়ারকে সাবাড় করে একেবারে অব্যবহৃত নতুন শব্দের সাঁজোয়া নিয়ে তাঁর পক্ষে সম্ভব যিনি ঐ বুর্জোয়া শব্দপালকদের সমান বা তার চেয়ে বেশি প্রতিভাবান অথচ নিম্নবর্ণের বা নিম্নবর্গের ও বিত্তহীন শ্রেণির । জানোয়ারকে খতম করতে জানোয়ার হতে হয়। একমাত্র সেই নিচুতলার গাড়োয়ানই পারবেন শব্দের চাপকানি দিয়ে বুর্জোয়া গদ্যের পিলপিলে ছালটাকে উখড়ে বাংলা গদ্যে নতুন দ্যুতি ফিরিয়ে আনতে।
১৯৬২ সালে 'মার্কসবাদের উত্তরাধিকার' নামে মলয়ের যে প্রবন্ধ-পুস্তিকাটি শক্তি চট্টোপাধ্যায় প্রকাশ করেছিলেন, বা ১৯৬৪ সালে প্রকাশিত 'আমার জেনারেশনের কাব্যদর্শন বা মৃত্যুমেধী শাস্ত্র' নামে জেব্রা প্রকাশনীর বইটিও, পড়ার সুযোগ আমার হয়নি । তবে ওদুটিতে গদ্যের কি কাজ ছিল তা অনুমান করতে পারি । কেননা সেই একই সময়কালে হাংরি দর্শন সংক্রান্ত মশক খানেক ইস্তাহারেই তিনি আধুনিক মনস্ক পাঠক-লেখকদের একটা অংশকে সেদিন আতপ্ত আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, এ-সংবাদ আমরা শুনেছি । পরে সেই ম্যানিফেস্টোগুলোকে 'ইস্তাহার সংকলন' নাম দিয়ে মহাদিগন্ত প্রকাশনী থেকে প্রকাশ পায়, ১৯৮৫ সনে, যা আমি পড়েছি ।
পুনরুথ্থিত মলয় প্রধানত দু'ধরণের গদ্য চর্চা করে যাচ্ছেন । একটা খুবই সাদামাটা, ঝরঝরে, গতিশীল, আর মেদ বর্জিত । আন্দোলনের সময়ে লেখা বিভিন্ন ইস্তাহার, প্রবন্ধ, পরবর্তী বা আটের দশকের শেষ থেকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকার জন্য লেখা হাংরি বিষয়ক আলোচনা, স্মৃতিচারণ, সাহিত্য বিষয়ক নিবন্ধ, ঢাকার মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় প্রথমে ধারাবাহিক প্রকাশিত এবং পরে ১৯৯৪ সালে হাওয়া উনপঞ্চাশ থেকে প্রকাশিত 'হাংরি কিংবদন্তি' গ্রন্হ, হাওয়া৪৯ থেকে প্রকাশিত 'পোস্টমডার্নিজম' ( ১৯৯৫ ), এবং প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত 'পরাবাস্তববাদ' ( ১৯৯৭ ), কবিতা পাক্ষিক থেকে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'আধুনিকতার বিরুদ্ধে কথাবাত্রা', গ্রন্হগুলিতে বাহন হয়েছে এই আকর্ষণীয় ও মূল্যবান গদ্য । অন্যদিকে আর একটি গদ্য আছে মলয় রায়চৌধুরীর, যা এখনও নিরীক্ষার পর্যায়ে, যাতে অনিবার নতুন আর আপাত-জটিল শব্দের তোড়, তাকে আশ্রয় করি মলয় তাঁর এখনকার মৌলিক গল্প-উপন্যাসগুলি লিখছেন । দারুণ মডার্ন প্রোজ । দারুন-দারুন সব অ্যাঙ্গেল, যে-মুহূর্তে ক্লিক করেন, মলয় আমাদের কাছে এ-সময়ের একজন মেজর গদ্যকার হিসেবে ফুটে ওঠেন । কিন্তু ঐ, শর্ট ডিস্টান্স রানার । বেশিক্ষণ দৌড়োতে পারেন না । হেলে পড়েন । এক একটা প্যারাগ্রাফের দারুন স্পিড, কিন্তু প্যারা ফুরিয়ে যেতেই দম ফুরিয়ে আসে । আবার নতুন করে প্যারা শুরু করতে দমও নিতে হয় নতুন করে । এ-যেন ঠিক হার্ডল রেস । এটা অনুশীলনহীনতার কুফল। দেড়-দু দশকের গ্যাপ তো কম কথা নয় । সেই জন্যেই বলছিলুম, এই বিশ বছরের গ্যাপে মলয়ের খানিকটা ক্ষতিই হয়ে গেছে ।
কবিতার মতো গদ্যেও মলয় খুব শব্দ-সচেতন । কোনও-কোনও ক্ষেত্রে যেন অতিরিক্ত সচেতন । প্রায় প্রত্যেকটা শব্দেই অনেক বেশি করে কলেজা-রক্ত ঢেলে ফেললে যা হয়, নুনের পরিমাণ অনেক সময়ে লাগসই হয় না । দেখেশুনে ভাবা যেতে পারে, মলয়ের নিজস্ব একটা ঢালাই ঘর আছে । সেখানে শব্দের কিউপোলা। এক-একটা অভাগা অস্পৃশ্য দুর্ব্যবহৃত জংধরা মরচেলাগা লৌহমল বা কিট্ট নিয়ে পাঁচমিশালি গহনা বানান তিনি । হিট ট্রিটমেন্ট । কিন্তু মলয়ের, ঐ যে বললুম, সবচেয়ে বড়ো মুশকিল, এক-একটা এলিমেন্ট নিয়ে বডডো বেশি ভাবেন । হরেক কিসিমের রসায়ন, রূঢ় পদার্থ আর গ্যাস দিয়ে মূল ধাতুর খোল নলচে পালটে দেন । আবার সচেতন হয়ে উঠলেই টেম্পো খুইয়ে ফ্যালেন । দারুন মেদহীন গতিশীল গদ্যের তিনি প্রাকৃত-ভাণ্ডার । কিন্ত যেইমাত্র সচেতন হয়ে ওঠেন যে তিনি গল্প লিখছেন, সেইমাত্র একরাশ আগুন হলকা তাঁর হাত দিয়ে চাঁদির চন্দোত্তরি করে দেয় । ফলত স্ক্র্যাপ আয়রন আর স্টেনলেস হয় না । ক্র্যাক করে যায় । তিনি ভালোভাবেই জানেন, ধরো তক্তা মারো পেরেক গোছের লেখক তিনি নন । তবু মারা তিনি থামাতে পারেন না । যার ফলে পেরেকের পর পেরেক ভোঁতা হয়ে হয়ে বেঁকে-বেঁকে যায় । এর ফলে কী হয়, কোনও কোনও অনুচ্ছেদ খুব দারুন লাগলেও খুব কনট্রাইভ, আর গদ্য বানানোর দাগগুলো চোখে পড়ে যায় । এটাকে মলয়ের গদ্যের দুর্বলতা বলুন বা বৈশিষ্ট্য ।
এই অবক্ষ্যমান গদ্যেই মলয়ের 'দাফন শিল্প' পড়ি ১৯৮৪ সালে, এবং পত্রিকায়, যা পরে তাঁর প্রথম গল্পসংগ্রহ 'ভেন্নগল্প'-এর ( দিবারাত্রির কাব্য প্রকাশনী, ১৯৯৬ ) অন্যতম ভূমিকা হিসাবে পুনর্মুদ্রিত হয় । আবার সেই একই গদ্যে, সামান্য আলগা-ভাবে তাঁর প্রথম নভেলেট 'ঘোঘ' পড়ি ১৯৯২ সালে, এবং সেই গদ্যের উত্তরণ দেখি তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এ ( ১৯৯১-১৯৯৩-তে লেখা এবং হাওয়া৪৯ প্রকাশনী কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত ) । একালের রক্তকরবীতে প্রকাশিত তাঁর সাম্প্রতিকতম উপন্যাস 'জলাঞ্জলি'ও ( ১৯৯৬ ) এই গদ্যে লেখা । 'ভেন্নগল্প' গ্রন্হে প্রকাশিত এক ডজন ছোটগল্প আর শেষোক্ত দুটি উপন্যাস পড়ে বুঝেছি, তাত্বিক মলয় রায়চৌধুরী আর লেখক মলয়ের মধ্যে একটা দারুণ প্রত্যাসত্তি রয়েছে । কিছু সর্ব-অস্তিত্বময় বর্তিষ্ণু চরিত্রকে ঘিরে লেখকের নিজস্ব চাকরিজীবন থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতা, নানা অর্ন্তদেশীয় চেতনা আর আচার-আচরণের সঙ্গে সমকালীন রাজনীতির জটিল প্রভাব, তত্ব ও তথ্যের প্রাচুর্যের সঙ্গে বোধ ও বুদ্ধির বিচিত্র জটিলতার এক-একটি ছবি ফুটে উঠেছে এইসব গল্প-উপন্যাসে । পাতি কলকাতার কাগজগুলোতে, বিশেষত 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর উচ্চকিত প্রশংসা পড়ে এটা ভাবা ঠিক হবে না যে বাঙালি পাঠকরা তাদের প্রোরড়মান ফেজ কাটিয়ে উঠেছে । আসলে আলোচক-পাঠকদের একটা গ্রুপ যে আক্রান্ত হয়েছেন, তার মূলে বাংলা সাহিত্যের অনেক অচ্ছুৎ-অব্যবহৃত শব্দ আর ছবি একটা বিল্টি কেটে পাঠানো হল এই প্রথম । সতীনাথ ভাদুড়িম প্রফুল্ল রায়, সুবিমল বসাককে মনে রেখেও বলা যায়, আবহমান বাংলা আখ্যান-সাহিত্যের ট্রাডিশানে যা আগে কখনও এভাবে খাপ খায়নি । মোটামুটি সবই এসেছে হিন্দি বলয় থেকে । খাস করে বিহারের দেশোয়ালি আর সড়কছাপ জংমরচে লাগা শব্দগুলোকে সামান্য ঝেড়ে-ঝুড়ে তোলা হয়েছে এই ফিকশানে । ঐ ষাট-সত্তর দশক থেকেই বিহারি বঙ্গকৃষ্টি দারুন-দারুন ঝাপট মেরে বাংলা সাহিত্যের ঘাটে এসে লাগতে আরম্ভ করেছে । একটা সফল ঝাপটা লাগল 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস' উপন্যাসে। বিহারের আর্থ-সমাজ সংস্কৃতি-রাজনীতির এমন ভিতর-বার গুলিয়ে ফেলা ফিকশান আর কোথাওটি পাননি কলকাতার আলোচক-পাঠকরা । আর তাতেই তাঁরা দারুন অমায়িক হোসটেস হয়ে পড়েছেন 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস'-এর। কিন্তু, এটা মলয়ও জানেন, রানওয়ে মাত্র -- উড়ান দেখব পরবর্তী ফেজে । মলয়ই দিতে পারেন সেটা । ঢাকায় 'মীজানুর রহমানের ত্রেমাসিক পত্রিকা;য় ধারাবাহিক প্রকাশিত ও গ্রন্হাকারে ১৯৯৯ সালে প্রকাশিত 'ডুবজলে'-র তৃতীয় পর্ব 'নামগন্ধ' উপন্যাসটি এখনও আসেনি কলকাতায় । 'ডুবজলে' পাঁচটি পর্বে সমাপ্য-- 'নামগন্ধ'র পর 'ঔরস' এবং 'প্রাকার-পরিখা' ।
মলয় রায়চৌধুরী বহুপ্রজ লেখক নন -- এমন ঘোষণা এখন নির্ণিমিত্ত মাত্র । খুব লিখছেন, বেশি লিখছেন । সূর্যের আলোটা কিঞ্চিৎ স্কিম করে আস্তে-আস্তে উঠে আসছে যেন । শব্দে শব্দাক্কার হয়ে সাজছে কবিতা, গদ্য । তাতে কী হচ্ছে, কতোটা, তা সময় বলবে । তাঁর সাফ কথা : "ন্যাটা হাতে যুঝে যাবো, জমিন ছাড়বো না"।
নেপালে হাংরি আন্দোলনকারীরা, নেপালি কবি-লেখকদের সঙ্গে
একটি ঘটনা, তা সামান্য বা অসামান্য যাই হোক না কেন, অনেক সময়ে সেই ঘটনার সাথে যুক্ত কোনও ব্যক্তিকে বিখ্যাত বা কুখ্যাত করে তোলে, যাঁর সম্পর্কে বহু সুনৃত তথ্য অনাবিষ্কৃত থেকে যায় । হাংরি আন্দোলন তেমনিই এক ঘটনা যার প্রধানতম অনুষঙ্গ হিসেবে অনিবার্য ভাবে চলে আসে মলয় রায়চৌধুরীর প্রসঙ্গ, এবং যাঁকে ঘিরে রহস্য, বিভ্রান্তি, দুষ্প্রচার, অপপ্রচারের অন্ত নেই । এটা ঘটেছে, যেহেতু ১৯৬৭-এর পরবর্তী দেড়-দুই দশকে নিজের বা নিজের প্রজন্মের অন্য কারও সম্পর্কে কোথাও কিচ্ছু লেখেননি মলয় । অথচ এই কালখণ্ডে মলয় ও হাংরি আন্দোলন নামের ঘটনা দুটি পাঁচকানে বাখান হয়ে-হয়ে এমন এক প্রবহ্ণিকার স্তরে পৌঁছে যায় যেখানে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ । আসলে আন্দোলন থিতিয়ে আসার বছর কয়েক পর থেকেই অভিবাদ-অভিশংসার এই নতুন খেলাটি শুরু হয়েছিল । লেখন জগতের একটা বিশেষ সেক্টর মেতে উঠেছিল এই খেলায় । সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের অবদান ব্যাপারটিকে অবজ্ঞার স্তরে পৌঁছে দেবার জোর কোশিশ চলেছিল । যার ফলে এই সময়সীমায় হাংরি আন্দোলনকারীদের নিয়ে গালগল্প দেদার হয়েছে, কিন্তু সিরিয়াস, নিরপেক্ষ ও অ্যাকাডেমিক গবেষণা একটিও হয়নি।
কেন হয়নি, তার জন্যে আমাদের আলোচক-গবেষকদের অসংবিদানকে দোষার্পণ করা সহজ, কিন্তু কেন এই অজ্ঞানতা তাও ভেবে দেখা দরকার। আমি এ-উত্তর দেব না যে ভারতবর্ষের বুকে সংঘটিততাবৎ সাহিত্যান্দোলনের মধ্যে একমাত্র হাংরি আন্দোলনের আকর্ষণ আলোচকদের কাছে এতো প্রবল হয়েছে, তার মূলে তথাকথিত অশ্লীল কবিতা বা ইশতাহার বিলির দায়ে ফুটপাতে থান ইঁট, লোহার রড সহযোগ হাংরিদের ওপর যুথবদ্ধ হামলা, পুলিশি হুজ্জত, কোর্ট কেস, জেল-জরিমানা এই সব অ্যাঙ্কর স্টোরির উপযোগী উপাদান । আসলে হাংরি আন্দোলন ছিল প্রতিষ্ঠানবিরোধী সাহিত্যধারাকে জমি পাইয়ে দেবার তাগিদে এদেশের বুকে প্রথম ও একমাত্র সামাজিক মুভমেন্ট । তার দুর্নিবার গতি সেই সময় বাংলা ও ভারতবর্ষের পাঠকদের হতচকিত করে তুলেছিল। প্রতিষ্ঠান ও প্রশাসনের কর্তারা তাকে ভয় পেয়েছিলেন, যেহেতু সাধারণ পাঠকের মনে হাংরি দর্শনের প্রতিষ্ঠা ঘটলে তাদের নিজেদের ভাবমুখে চড়ানো তাপ্পি-পুলটিশ মারা মুখোশটা উখড়ে যাবার সাধ্বস ছিল । যে-কারণে জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আন্দোলনকে ধ্বংস করার বিরাট চক্রান্ত হয়েছিল । মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলনকে এমনভাবে প্রচার করেছিল, যে সাধারণ পাঠক এটাকে নিছক হাংরি আন্দোলনকারীদের বিভীষকাময় দাপটের বহিঃপ্রকাশ বলেই ধরে নিয়েছিলেন । পুলিশি কার্যকলাপ, মামলা-মুচলেকা, জেল-জরিমানা ইত্যাদিকেও ঐ খাতে নিয়ে যাবার চেষ্টা হয়েছিল । পাঠকদের সামনে আন্দোলনের স্বরূপ ছিল অস্পষ্ট এবং বেশিরভাগ পাঠকই মনে করতে শুরু করেছিলেন যে এটা আসলে প্রতিষ্ঠান ও বুদ্ধিজীবী-বিরোধী হাঙ্গামা যার মূল লক্ষ্য অবাঞ্ছিত লেখকদের সাহিত্যক্ষেত্র থেকে বিতাড়ন আর ক্ষমতা দখল । আন্দোলনের শেষ পর্যায়ে, ১৯৬৬-৬৭ সালে, হাংরি আন্দোলনকারীদের পারস্পরিক কাদাহোলি, গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব, অন্য কবিদের সম্পর্কে ব্যাসোহ মন্তব্য এবং হাংরি আন্দোলনকারীদের মধ্যে থেকেই এই কার্যক্রম প্রকারান্তরে সমালোচিত ও নিন্দিত হওয়ায়, পাঠকদের সংশয় আরও বহু পরিমাণে বেড়ে যায় এবং তা তাঁদের মনের মধ্যে ঘর করে যায় । পাশাপাশি সাহিত্যের ছাত্র ও গবেষকরা, যাঁরা হাংরি আন্দোলন নিয়ে লেখালিখি করেছেন, তাঁরাও থেকেছেন দ্বিধা-দ্বন্দ্বে নিমজ্জিত ।
এমতাবস্হায় নতুন করে হাংর-বিপ্লবের তাৎপর্য বিশ্লেষণ ও হাংরি-সাহিত্যের মূল্যায়নের গুরুত্ব ও প্রয়োজনের কথা অস্বীকার করা যায় না । এই বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নের কয়েকটি উপায় আমাদের জানা আছে । তার মধ্যে সবচেয়ে কার্যকরী হলো, সমস্ত হাংরি রচনাবলী খুঁজে পেতে পড়া,, এক একটা লেখা ধরে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা । এটা কিন্তু বুড়োদের দ্বারা আর সম্ভব নয় । যেহেতু তাঁরা আগেকার সব সেন্টো পড়ে ফেলেছেন এবং কনফিউজড । তাঁরা এটা করতে বসলে কনফিউজানের ঐ ফিতে দিকদারি করবে । এ-কাজ একমাত্র নতুন প্রজন্মের পাঠক গবেষকই করতে পারবেন । সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম নতুন প্রজন্মের অন্বেষকরাই ভরসা ।
হাংরি আন্দোলন ও হাংরি লেখালিখির প্রধান সুরটি অবিকৃতভাবে খুঁজে পেতে হলে আমরা আরেকটি তরিকা অবলম্বন করতে পারি, সেটা হলো সাক্ষাৎকার চর্চা । আশার কথা যে হাংরি আন্দোলনের ইতিহাস অনেক দূর অতীতে মিলিয়ে যায়নি এবং অনেকেই জীবিত । যেখানে সমীক্ষার জমঘট, সর্বোপরি বৃদ্ধ পাঠক ও গবেষকরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে নিমজ্জিত -- সেখানে আন্দোলনের এক সময়কার শরিক, বষীয়ান লেখক-কবিদের সামনে ক্যাসেট-টেপ রেকর্ডার অন করে বসলে অন্বেষকের কাজ অনেকটা আসান হয়ে যায় । তাছাড়া সাহিত্য-বিচারের আধুনিক পদ্ধতিসমূহের মধ্যে সাক্ষাৎকার-চর্চার স্বতন্ত্র মর্যাদা আছে । গভীর অধ্যয়ন, অকপট নিষ্ঠা ও সততার সঙ্গে কোনও লেখকের লেখালিখি ভাবনাচিন্তা, কাজকর্ম, সমস্যা, আদর্শ, স্বপ্ন, জীবন, অপারগতা, আকাঙ্খা ইত্যাদি ব্যাপারে স্বয়ং লেখকের কাছ থেকে বিবরণ সংগ্রহের শ্রমসাধ্য কাজটি যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে সেই বিচার-বিশ্লেষণ বা মূল্যায়নের দাম আরও বেড়ে যায় ।
মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকারসমগ্র ( ২০১৮ ) প্রকাশক : প্রতিভাস
সম্পাদনা : প্রণবকুমার চট্টোপাধ্যায়
মলয় রায়চৌধুরী আবার নতুন করে লেখালিখি শুরু করার পর তাঁর কাছ থেকে আদায় করা ও বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারগুলি নিয়ে বর্তমান গ্রন্হটি পরিকল্পিত । বাংলাভাষায় কথাবার্তার মাধ্যমে একটি সাহিত্য আন্দোলনকে বোঝবার চেষ্টা এই প্রথম । হাংরি বিষয়ে মলয় রায়চৌধুরীর কথাবার্তা স্বভাবতই একটা দলিল । কিন্তু যেভাবে এগুলো লিপিবদ্ধ করা হয়েছে তার মধ্যে দলিলের একঘেয়েমি নেই । কেননা বইটির কথা ভেবে একটা প্যাটার্ন মোতাবেক সাক্ষাৎকারগুলো নেয়া হয়নি । বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন পত্রিকাগোষ্ঠী, বিভিন্ন ব্যক্তি, বিভিন্ন অভিসন্ধি থেকে এগুলো গ্রহণ করেছেন । পক্ষান্তরে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা নানা মত ও পথের অপেশাদার অন্বেষকের নিজস্ব জিজ্ঞাসায় মলয় রায়চৌধুরী ও হাংরি দর্শনের প্রতি ঐকান্তিক শ্রদ্ধায় ও মমত্বে গড়ে ওঠা এই সাক্ষাৎকার সংগ্রহের মধ্যে হাংরি আন্দোলন ও বাংলা আভাঁগার্দ সাহিত্যের এই বিতর্কিত ব্যক্তিত্বকে তাঁর যাবতীয় প্রকর্ষ ও অপকর্ষসহ এই প্রথম পৌঁছে দেয়া হলো সাহিত্য গবেষকদের ব্যবচ্ছেদ-টেবিলে ।
লেখালিখি থেকে অজ্ঞাতবাসের পর সংসারধর্ম ব্যতিরেকে 'আর কিছু না করেও' হবতো-বা নিজেরই অজ্ঞাতে এক নতুন অজ্ঞাতপূর্ব পরিবেশ ও পটভূমিতে মলয় রচিত হচ্ছিলেন এই বিশ বছর ধরে । ফিরে আসার পর তাঁর লেখাত দীধিতি আমাদের অনুমানকে সপ্রমাণ করে । ছয়ের দশকের 'নিছক বুলেটিন-লেখক আর তিরিশটি কবিতার স্রষ্টা' আটের দশকে ফিরে এসে লেখকতায় দুর্দান্ত যৌবন ফিরে পান । কিন্তু এটা একরকম ভাবে সত্য, যে নিছক কবিতা বা গল্প লিখতেই তাঁর প্রত্যাবর্তন নয় । আবার কবি বলেই যে তাঁর মধ্যে কবি-কবি ভাব রয়েছে , তাও নয় । তাঁর কাছে কবিতা হলো 'আগুনের ভেতর থেকে ঝলসানো বাহুর সিগনালিঙ', এবং তিনি কবিতা শুরু করেন একটা পিক-আপ থেকে । বাসরঘরে কেলিকুঞ্চিকা পরিবৃত জামাইবাবু কবিটি তিনি নন । দারুণ বদখত, আদাড়ে, কট্টর, আর মুখফোড় এই মসীদানব । তিনি একাধারে কবি, গদ্যকার ও বক্তা । তাঁর লেখায় ও কথায় নিজের ব্যাপারে যেমন অনেক কনফেশন আছে, কোনও রাখঢাক বা পুশিদা কারসাজি নেই, তেমনি অন্যের অশালীন কুৎসিত ঘৃণ্য অসূয়াবৃত্তির বিরুদ্ধে প্রতিপ্রহার হানতেও এখন আর তিনি দ্বিধাগ্রস্ত নন । একসময় মৎসরী কলকাতার কুইসলিং বন্ধুরা অপক্রোশভাবে যে মন্তব্যটি করেছিলেন, কিছু লেখার বদলে হইচই আর হাঙ্গামার দিকেই তাঁর ঝোঁক আর চটজলদি খ্যাত পাবার লক্ষ্য, এবং তাঁর সেন্টিমেন্ট ও অপমানবোধের তোয়াক্কা না করে পর-পর দেগে গিয়েছিএন কুম্ভিলকবৃত্তি, মিথ্যাভাষণ, আত্মস্তুতি, নোংরামি আর কোরকাপের আরোপ -- সেই সব কিতবের মাথা স্লাউচ করে দিতেই যেন পুনরুথ্থিত মলয়ের প্রখ্যাপন -- "অতটা খাতির নেই যে তোমরা কশাবে এই গালে থাপ্পড় আর আমু টুক করে অন্য গাল তোমাদের হাতে ছেড়ে দেব !"
ঐ চাকু চালাবার কয়েকটা ক্যারদানি বক্ষ্যমান সাক্ষাৎকারগুলিতে মিলবে । এক-একটা তাক কতরকমভাবে করা যায়, তার নমুনাও । আসলে তিনি ফিরে এসেছেন মনের ভেতরে পুষে রাখা সেই আকাঙ্খাজ্বালা, ক্ষোভ আর বিদ্রোহকে বুকে নিয়ে । অনেক অপ্রিয় সুনৃত কথাও তিনি অকপটে লিখে আর বলে যাচ্ছেন । এবং কোনও তাগবাগ নেই, বারফট্টাই নেই । যদিবা কোনও কোনও মন্তব্যে তাঁকে ভীষণ অহংভাবাপন্ন ঠেকে, এবং কিছু-কিছু কথা প্রচণ্ড রাগ আর ঘৃণা থেকে বলার দরুণ এবং তদনুযায়ী শব্দ ব্যবহারে অনেককে খুশি নাও করতে পারেন । কিন্তু যাঁরা তাঁর লেখালিখির গতের সঙ্গে পরিচিত, যাঁরা তাঁকে চেনেন, তাঁদেরকে নতুন করে বলার কিছু নেই যে তঁর কথা ও কথনভঙ্গী তাঁর নিজের মতোই নিজস্বতাময় -- রাগি ও জেদি । লেখার মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী নিয়ত প্রচেষ্ট থাকেন যাতে প্রতিস্পর্ধী বুর্জোয়া নিউক্লয়াসকে কামান দাগা যায়। কথার মধ্যেও সেই মারমুখি প্রবণতা । কোথাও সাংবাদিক সুলভ তীর্যক, কোথাও স্লোগানধর্মী, কোথাও চিত্রল, বক্র ও বিধ্বংসী অথচ আশ্চর্যরূপে গঠনমূলক । এটা হতে পেরেছে যেহেতু আদপে তিনি ভাষাজ্ঞানী । চিন্তাবিদ লেখক ও প্রভাবশালী বক্তা । শব্দ ব্যবহারে দারুন সচেতন । খাসা ভাষা, অকপট বর্ণনা আর সরস উপমা তাঁর রাগ-ধরানো কথাবার্তাকেও সুখপাঠ্য করে তোলে । এই সাক্ষাৎকারমালায় আমরা সেই রাগি মুখফোড় খোলামেলা তত্বজ্ঞানী, শব্দজ্ঞানী, ব্রাত্য-কথককে খুঁজে পাচ্ছি ।
মলয় রায়চৌধুরীর সাক্ষাৎকারমালার সম্পাদনার কাজ কিছুটা আকস্মিকভাবে হাতে পেয়েছিলুম । পূর্বপ্রস্তুতি প্রায় ছিলই না, মনে-মনে পরিকল্পনাও করিনি । তবে বিগত পনেরো বছরে হাংরি সিসৃক্ষা নিয়ে পড়াশোনা আর লেখালিখি করে আসছিলুম, তাতে এ যেন একটা কাজ করার গুরুত্বের কথা একেবারেই ভাবিনি তা নয় । আসলে আমি নিজেই একটা দীর্ঘ কথোপকথন চাইছিলুম এই আশ্চর্য বিতর্কিত ব্রাত্য ভাবধারার লেখকের সঙ্গে । মলয়ের সাম্প্রতিকতম গদ্যগুলি পড়ে একটা সবিমুগ্ধ শ্রদ্ধাই যেন তোড় ভাঙতে চাইছিল । দারুণ অন্য ধরণের কিছু, কিংবা একটা স্বল্পায়তন উপন্যাস লেখার কথাও ভেবেছি তাঁকে নিয়ে । মলয় রায়চৌধুরীকে নিয়ে লেখা যে কি প্রচণ্ড আত্যয়িক, তার আভাস আমি পেয়েছি । তবু নিজেকে নিরাসক্ত রাখতে পারছিলুম না । সেই মতো চিঠি চালাচালিও করেছিলুম মলয়ের সঙ্গে, তাঁর পুরোনো লেখাপত্তর, মলয় সম্পর্কে অন্যদের লেখা ঢুঁঢ়ে ঢুঁঢ়ে পড়া শুরু করেছিলুম, ক্রমে ক্রমে পরিকল্পনার একটা ভিজুয়াল সার্কলও গড়ে উঠছিল যখন, ঠিক তখনই, এক অচিরস্হায়ী ডামাডোলের মাঝে, হাতে এসে যায় এই গুরুত্বপূর্ণ কাজটি । তিনটি গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষাৎকারকে আমি এই গ্রন্হে অন্তর্ভুক্ত করিনি, কেননা সেগুলো প্রশ্নোত্তরের আকারে প্রকাশিত হয়নি । সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন পায়েল সিংহ ( ইলাসট্রেটেড উইকলি অফ ইনডিয়া : ১৫,৫.১৯৮৮ ) ; সোমা চট্টোপাধ্যায় ( ফ্রি প্রেস জার্নাল : ১৩.১.১৯৯১ ); এবং নওল ঘিয়ারা ( মিডডে : ১৪.৪.১৯৯১ ) । এঁদের প্রশ্নাবলী হাংরি আন্দোলনে সীমাবদ্ধ ছিল না ।
Ajit Ray ( Editor of Bengali periodical 'SHAHAR' ) 2018
যে কথা আগেই বলেছি, এই সাক্ষাৎকারগুলি গ্রহণ করেছেন বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন অন্বেষখ, তাঁদের স্বকীয় ধারণা, নিজস্ব ভাবনা ও উদ্দেশ্য নিয়ে । সাক্ষাৎকারগুলিকে নির্দিষ্ট রীতি-পদ্ধতি ও উদ্দেশয় অনুযায়ী পরিচালনা করতে না-পারার দরুণ বা সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীদের ওপর নিয়ন্ত্রণ না-থাকার অসুবিধার ফলে, যে এলোমেলো ব্যাপারটি প্রায় অনিবার্য ছিল তাকে ডেক্সওয়র্কের মাধ্যমে, নির্বাচন ও গ্রন্হনার কাজ স্বতন্ত্রভাবে করার কথা গোড়ার দিকে মনে হয়েছিল । কিন্তু এ নিয়ে ডেলিবারেটলি নিজের সঙ্গে তর্ক করে দেখেছি, এই অসুবিধেকেই একটা মহৎ সুবিধায় পাল্টানো যেতে পারে যাতে ব্যাপারটা আরও রুচিকর আর যুক্তিগ্রাহ্য হয় । সাক্ষাৎকারগুলো পড়ে বুঝেছি, কয়েকটি সাক্ষাৎকার লিখিতভাবে নেয়া, এবং সেক্ষেত্রে স্বয়ং মলয় জবাবগুলি লিখে দিয়েছেন । মানে, এখানেও মলয়ের সেই মেদরিক্ত গতিশীল ভাষাটাকে পাচ্ছি । আবার যাঁরা মাউথপিস বা নোথখাতা ব্যবহার করেছেন, মলয়কে সামনে বসিয়ে অনর্গল কথা বলিয়ে আর লিখে গেছেন, তাঁরাও যে শুধু মলয়ের কথাগুলিকে হুবহু লিখে গেছেন, তা নয় । বরং প্রশ্ন-প্রতিপ্রশ্ন ও সেগুলির জবাবের মাঝখানে যে অন্তর্নিহিত কথাবার্তা, সেগুলিকেই সজীব করে ফুটিয়ে তুলেছেন । ফলত যেসব বিষয় গুরুগম্ভীর ছিল, সেগুলিও লেখায় অনবদ্য হয়ে উঠেছে ।
একদিকে মলয়ের সুস্পষ্ট চাঁচাছোলা সাবলীল কথাবার্তা, তার ওপর স্বচ্ছন্দ গতিতে বিষয় থেকে বিষয়ান্তরে পরিভ্রমণ -- তাকে লেখার আকারে ধরে রাখা অধিকতর অধিকতর বিচিত্র হয়েছে । অন্যদিকে সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা, যাঁরা নিজের ভাষা মিশিয়ে মলয়ের কথাগুলি লিখেছেন, তাঁদের মধ্যে কোনো জড়তা বা আড়ষ্টভাব নেই বললেই চলে । সাধারণত সাক্ষাৎকার যেভাবে নেয়া হয়, অত্যন্ত মামুলি ঢঙে, তার মধ্যে উৎসাহ বেশিক্ষণ ধরে রাখা যায় না । কিন্তু এখানে খুব গূঢ় আর কঠিন বিষয়ও স্বচ্ছন্দ ভারমুক্তভাবে বলা ও লেখা হয়েছে । যেসব কথা মলয় রায়চৌধুরী এই সাক্ষাৎকারগুলিতে বলেছেন, সেগুলি আগেও নিজের স্মৃতিচারণমূলক আলোচনা ও প্রবন্ধসমূহে লিখেছেন । কিন্তু তবে, যাঁরা তাঁর মৌলিক রচনাগুলির সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা কোনও-না-কোনও ক্ষেত্রে সাক্ষাৎকারগুলি পড়ে লাভবান হতে পারেন -- কেননা মলয়ের কথাবার্তা তাঁর লেখালিখির প্রতিনিধিত্বই শুধু করে না, তাঁর ব্যক্তিত্বের স্বাদ দেয় । তাঁর আগেকার লেখালিখি আর এইসব সাক্ষাৎকার পাশাপাশি রাখলেও বোঝা যায় তিরিশ-পঁয়ত্রিশ বছরে তাঁর ভাষা ও মানস কীভাবে কতোদূর বদলেছে । দোষে-গুণে ভরা একটা মানুষকে ধরবার চেষ্টা করা হয়েছে এইসব সাক্ষাৎকারে । সর্বোপরি বক্তার বলবার মুন্সিয়ানায়, লেখকদের লিপিকুশলতার গুণে এগুলি মামুলি সাক্ষাৎকারের বিবরণমাত্র না হয়ে, এক-একটি বিচিত্র তথ্যবহুল আখ্যায়িকার রূপ নিয়েছে ।
একথা বলা যাবে না যে সব কয়টা সাক্ষাৎকারই উত্তীর্ণ হয়েছে বা নূনতম মান বজায় রাখতে পেরেছে । অমুক সাক্ষাৎকারটি যে গভীরতা পেয়েছে, তার সঙ্গে তমুক পত্রিকাগোষ্ঠীর কথোপকথন নিশ্চয়ই সমান্তরাল নয় । আবার একই প্রশ্ন একই প্রসঙ্গ বার-বার ঘুরে ফিরে এসেছে বেশ কয়েকটি সাক্ষাৎকারে, সেগুলিকে কেটে-ছেঁটে লাগসই ভাবে ছাপানো যেত । কিন্তু একটি লাইনও বাদ না দিয়ে সমস্ত সাক্ষাৎকার হুবহু আসতে দিয়েছি প্রথমত আগে অন্যত্র ছেপে গেছে বলে, আর সবচেয়ে বড়ো কথা, আমি কোনও চালুনি ব্যবহারের পক্ষপাতি নই। আমার বিশ্বাস পূর্ব-প্রকাশিত কোনও রচনার ওপর সম্পাদনার নিয়ম বেশিদূর অবধাবিত হলে, রচনা ও রচকের মর্যাদাহানি হয় । সেরকম অমার্যনীয় মাস্টারিতে আমি যাইনি । খড়কুটোকে ধানের শিষের সঙ্গে আসতে দিয়েছি । তাছাড়া বেশ কিছু প্রশ্নের জবাব মলয় রায়চৌধুরী স্বয়ং লিখে দিয়েছেন বলে সেব সাক্ষাৎকারের মধ্যে ভাষাগত, শৈলীগত ও পদ্ধতিগত একরূপতাও প্রকারান্তরে এসে গেছে, এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একটি নিবদ্ধ স্তবকের মতো পরস্পর অন্বিষ্ট হয়ে উঠেছে । এদের পারস্পরিক ঘনতার সম্ভাবনা আঁচ করে কোনও যোগ বিয়োগের প্রয়োজন আমি অনুভব করিনি । পুরোপুরি যুক্তির ওপর নির্ভর করে রচনাগুলিকে পর-পর সাজিয়েছি মাত্র । সুতরাং এই গ্রন্হে যদি কিছু কৃতিত্ব প্রকাশ পেয়ে থাকে, তার জন্যে আমার নয়, অন্বেষকদের অবদানই স্বীকার্য । ধন্যবাদার্হ লিটল ম্যাগাজিন গবেষণা কেন্দ্রের কর্ণধার সন্দীপ দত্ত, যিনি রচনাগুলি সংগ্রহ করে দিয়েছেন ।
পরিশেষে জরুরি যে-কথা, এবং সম্পাদক হিসেবে যে-কথা বলার দায় আমার ওপরই বর্তায়, তা হলো, সাক্ষাৎকারগুলি যাঁরা নিয়েছেন, তাঁরা মূলত লিটল ম্যাগাজিনের লোক, এবং এ-কথা অনস্বীকার্য যে বাঙালি জাতির যদি কোনও জাতীয় চরিত্র টিকে থাকে তবে ইদানিং তা বোধ করি ছোট কাগজের মাধ্যমে প্রকাশ পায় । মতান্তরে, লিটল ম্যাগাজিনগুলিকে ঘিরে যে ইন্টেলিজেনশিয়া, তা-ই আজ বাঙালির যা-কিছু । সুতরাং বড়ো মিডিয়া হাউসগুলো হাংরি আন্দোলন ব্যাপারটাকে যখন খুব করে দাবানোর চেষ্টা চালাচ্ছে, হাংরি আন্দোলনের শরিকরা পারস্পরিক কাদাহোলি করে ভুল বোঝাবুঝির বিস্তর সুযোগ করে দিচ্ছেন, তখন লিটল ম্যাগাজিনগুলি গোরস্হান খুঁড়ে হাংরি আন্দোলনকে নিয়ে নতুনভাবে ভাবাভাবি শুরু করবে, এতে আর আশ্চর্য কী ! মলয় রায়চৌধুরীর পুনরাগমনের পর এই ভাবাভাবিটা হঠাৎ রাতারাতি বিরাট আকার নিয়ে ফেলেছে । বিশেষত আটের দশকের প্রথম পাঁচ-সাত বছরে হাংরি লেখালিখির আলোচনা-পর্যালোচনার স্রোতে লিটল ম্যাগাজিনগুলির পরিমণ্ডল কিছুটা উচ্ছ্বসিত ছিল । উচ্ছ্বাস থিতিয়ে আসার পর ইদানিং হাংরি আন্দোলনকারীদের রচনার মান উৎকর্ষ ইত্যাদি নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে, হাংরি লেখকদের প্রতি মনোযোগ বাড়ছে । এটা শুভ লক্ষণ । এই সাক্ষাৎকারগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করার সময়েও একটা কথা আমার বার বার মনে হয়েছে, তা হলো, আধুনিক আর কম বয়সী পাঠক-গবেষকরা ব্যাপারটাকে ক্রমাগত আরও গুরুত্ব দিতে শিখছেন ।
কিন্তু মলয় রায়চৌধুরী মানে এখন আর নিছক হাংরি আন্দোলন, হাংরি বুলেটন নয়। অথচ মলয়ের সঙ্গে কথা বলতে বসেও দেখা গেছে আজকের দিনেযখন তাঁর 'কবিতা সংকলন', 'মেধার বাতানুকূল ঘুঙুর', 'হাততালি', 'ডুবজলে যেটুকু প্রশ্বাস', 'পোস্টমডার্নিজম', 'ভেন্নগল্প' 'জলাঞ্জলি', জীবনানন্দ ও নজরুল বিষয়ক প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত, বেশির ভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মূলত দুটি বিষয় নিয়ে আলোচনা চেয়েছেন । এক, হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য কী ছিল বা হাংরি আন্দোলন শুরু হলো কী ভাবে ; আর, দুই, সাহিত্যের ইতিহাসে হাংরি আন্দোলনের স্হান কোথায় বা কতো উর্ধে । প্রশ্নদুটি এতোবার এতোভাবে তাঁকে করা হয়েছে, আর এতো ভেঙে-ভেঙে জবাব দিয়েছেন মলয় আগেও বহুবার, যে এখন আর এসব প্রশ্নের কোনো মানেই হয় না । প্রশ্নকর্তারা তো কেউ মলয় বা হাংরি আন্দোলন সম্পর্কে আগে থেকে কিছু না-জেনে বা না-পড়ে আসেননি । ধরে নেয়া যেতেই পারে যে আন্দোলনের বিদ্রোহাত্মক চেহারা, বড়ো প্রাতিষ্ঠানিক আঁতেলদের ভয় পেয়ে যাওয়া, পুলিশী পীড়ন, মারপিট, কোর্ট-কেস, জেল-জরিমানা এসব কোনও সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীকে প্রাথমিক পর্বে উদ্দীপিত করেছে, এবং তাঁরা সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, বা প্রশ্নাবলী পাঠিয়েছেন প্রায়-হঠাৎ ভাবনা, উদ্দীপনা আর প্রশ্রয়েই । নির্দিষ্ট কোনো বিশ্লেষণ জানার আগ্রহে নয় । যার ফলে অনেকের প্রশ্ন আর মলয়ের জবাব একঘেয়েমি এনেছে । অথচ উদ্যোগ যদি আরও একটু ভাবনাচিন্তা করে নেয়া হতো, তবে তাঁরাই হয়তো ক্রমশ গড়ে তুলতে পারতেন যুগপৎ হাংরি সাহিত্য আর মলয়-সাহিত্যের আলোচনার এক নতুন সম্ভাবনা ও সার্থকতা ।
এ-কথা ঠিক যে মলয় রায়চৌধুরীর ভাবমূর্তির সঙ্গে জুড়ে রয়েছে হাংরি আন্দোলনের ইমেজ । বেশিরভাগ সাক্ষাৎকার গ্রহণকারী মলয়কে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় গড়ে তুলেছেন, পক্ষান্তরে তাঁর হাংরি ইমেজটাকেই গ্লোরিফাই করার জন্য যেন । মানুষ মলয়কে, নিম্ন মধ্যবিত্ত থেকে মধ্যবিত্তে বেড়ে ওঠা নানান অভিজ্ঞতার আকর মলয়কে, নিজেকে সাংস্কতিক দোআঁশলা বলে পরিচিহ্ণিত করতে চাইছেন যিনি সেই মলয়কে, কবি ও গদ্যকার মলয়কে, ভাষাজ্ঞানী মলয়কে, তাত্বিক মলয়কে তাঁরা যেন খুঁজে পেতেই চাননি । আবার হাংরি প্রসঙ্গেও কিছু-কিছু প্রশ্ন এমনভাবে করা হয়েছে, তার জবাব অদীক্ষিত ও নতুন পাঠকের সামনে চিন্তাশীল কবি, বলিষ্ঠ গদ্যকার, বিরল তত্বজ্ঞানী মলয়ের আসল মানসিক গঠনটাই ধেবড়ে দিতে পারে । আবার মলয় যে ভালো বিশ্লেষক, দারুণ সমালোচক, তাঁর কাছ থেকে অন্যান্য হাংরি লেখকদের ভাষা, রচনাশৈলী, বৈশিষ্ট্য প্রভৃতি সম্পর্কে বিশেষ কোনও আলোচনাই চাওয়া হয়নি । আবার মলয় সম্পর্কেই যে সবকথা জানা হয়েছে, তাও নয় । ভুলে গেলে চলবে না যে মলয় বার-বার এ-কথা বলে চলেছেন যে তিনি এখন শুধু মলয় রায়চৌধুরী হিসেবেই পরিচিত হতে চান, 'হাংরি' বা 'একদা হাংরি' হিসেবে নয় । তাঁর কবিতার বই আর গল্প-উপন্যাসের বইগুলি প্রকাশ হয়ে যাবার পরে যাঁরা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন, তাঁদের অন্তত মলয়ের কবিতার প্রাতিস্বিক ধারা, গদ্যের ভাবনা ইত্যাদি নিয়ে প্রশ্ন করার অবকাশ ছিল । এ-ছাড়া পোস্টমডার্নিজম সম্পর্কে তাঁর কাছ থেকে বিরাট আলোচনা আদায় করা যেত। তিনি যে জায়গায় জন্মেছেন, বড়ো হয়েছেন, পড়াশোনা করেছেন, চাকরি করছেন, সারা ভারত ঘুরে-ঘুরে বেড়িয়েছেন, যার ফলে কলকাতার পাতি লেখকদের সঙ্গে তাঁর যে বৈশিষ্ট্যগত তফাৎ গোড়া থেকেই ঘটেছে, সেসব নিয়েও দারুণ আলোচনার স্কোপ ছিল ।
আরেকটি দিক থেকে মলয় রায়চৌধুরীর ওপর আলোকপাত করা দরকার । সেটা হলো তাঁর মনস্তত্বের উৎসসন্ধানের দিক । যেহেতু লেখকের মানসিকতা এক নিত্যসচল ও পরিবর্তমান জিনিস, এবং অক্ষর তাঁর বাহন, তাই কোনও একটি মানসিক অবস্হান থেকে কোনও কিছু লেখাকে লেখকের সব বলা যায় না । সাহিত্যসৃজনের ভেতর স্রষ্টার রচনার শক্তি, জ্ঞান, সূক্ষ্ম অন্তর্দৃষ্টির রূপ, কল্পনা ও চিন্তাশক্তি, বিচারবোধ ও অনুভূতি বিশেষ ভূমিকা নেয় । এসবের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী হয় জীবনের প্রতি কোনও এক ধরণের দৃষ্টি আরোপ করার ক্ষমতাও। আবার এ-কথাও ঠিক যে লেখকের ব্যক্তিগত অনুভূতি, আবেগদ্বন্দ্ব, কনফিউজন, মানসিক আকাঙ্খা প্রভৃতি সব সৃষ্টিমূলক অবদানের মূলেই কোনও না কোনও ভাবে কার্যকরী । আসলে, নিছক বস্তুনির্ভর পরিপ্রেক্ষিতে সৃষ্টিমূলক রচনা বোধহয় সম্ভব নয় । এই সাক্ষাৎকারসমূহে মলয় রায়চৌধুরীর বুদ্ধি, পড়াশোনা, বিচারশক্তি ও দ্বন্দ্বের ক্রিয়াশীলতার রূপ ততোটা ফুটে ওঠেনি। অধচ এইসব ফুটে উঠলে সাক্ষাৎকারগুলি তখন নিছক তথ্য ও উপাদান সংগ্রহের পদ্ধতি হিসাবে গণ্য হতো না । অনেক কিছুই তখন তত্বের পর্যায়ে চলে আসতো । অনেক জরুরি প্রশ্নই সাক্ষাৎকার গ্রহণকারীরা করতে পারেননি । মলয় রায়চৌধুরীকে ঘিরে প্রশ্নের পাহাড় রচনা করার অবকাশ তাই থেকে গেল।
অজিত রায়
১ বৈশাখ ১৪০৬