বৃহস্পতিবার

মলয় রায়চৌধুরীর কবিতা : তৈমুর খান

বাংলা কবিতার হাতেখড়ি থেকেই বাংলা সাহিত্যে একটা গর্জন শুনেছিলাম, সেই গর্জনের নাম মলয় রায়চৌধুরী (জন্ম ২৯ অক্টোবর ১৯৩৯)। 

১৯৯১ সালে একবার বন্ধুদের সঙ্গে কলকাতায় এসে বাঁশদ্রোণীতে কলিম খানসহ এই চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়ের (সমীর ও মলয় রায়চৌধুরীর) সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল। সেদিন অনেকগুলো বইপত্রও আমার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। 

ভারী ব্যাগ নিয়ে বাড়ি ফিরে এসে সেই গর্জনগুচ্ছের কাছে নিজেকে বসিয়েছিলামও। অনেকদিন কেটে গেল। অনেক জলও গড়াল। অনেক নির্ঘুম রাতে অনুভব করি —

“চুর্মার অন্ধকারে জাফ্রান মশারির আলুলায়িত ছায়ায়
সমস্ত নোঙর তুলে নেবার পর শেষ নোঙর আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে
আমি আর পার্ছি না, অজস্র কাচ ভেঙে যাচ্ছে কর্টেক্সে”
(প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার) 


কবিতার “আমি” আমার আমিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে। যে পর্যাপ্ত আদিমতা নিয়ে, অস্থিরতা নিয়ে, শূন্যতা ও যৌনতা নিয়ে আমি জেগে উঠতে চেয়েছি, এই কবিতা যেন তারই মূলে তরঙ্গাঘাত করে ঠেলে দিয়েছে আমাকে। পোস্ট মডার্ন কখনোই বুঝতে চাইনি। তার ব্যাকরণও আমার দরকার হয়নি। শুধু এক মুক্তির পক্ষতাড়না শিল্প ও জীবনাচারকে নাড়িয়ে দিয়েছে। 

কী উল্লাস, কী আত্মক্ষরণ, কী অভিব্যক্তির মোক্ষম বিস্ময় যা আমি উপলব্ধি করতে পেরেছি তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারি না। এক আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে আমার ঘুম ও জাগরণ, আমার প্রেম ও যৌনাকাঙ্ক্ষা, আমার পূর্ব ও উত্তরজন্মের মহানির্বাণ ব্যাপ্ত হয়ে ওঠে। 

“শান্তি দাও, শুভা শান্তি দাও”

না, শুভার কাছে শুধু শান্তি চেয়েই জীবনের সমূহ প্রয়াসকে পরিচালনা করা যায় না। তরুণ গড়ুরের ক্ষুধাকে নিবৃত্তি দেওয়া যায় না। দেহবাদের চরম সীমানা পেরিয়ে গেলেও শব্দহীন কিছু কঁকানি আর মৃত্যুর সদর্থক চৈতন্যও খেলা করে। 


অসাম্ভাব্যতার ভেতর নিরর্থক জৈবক্রিয়ার সঞ্চারী বিন্যাস আত্মনিবিষ্ট সান্নিধ্যকেই ইংগিত করে। তাই শেষ পর্যন্ত “ন্যাংটো মলয়কে” দেখতে পাই। “মলয়” আমাদেরই অভিন্ন সত্তার ব্যাপ্তি। 

ঔপন্যাসিক, গল্পকার, প্রাবন্ধিক, কবি, অনুবাদক, সাংবাদিক এবং হাংরিয়ালিজম্ ও পোস্ট মডার্নিজম্ এর রূপকার মলয় রায়চৌধুরীকে এক বহুমুখী উত্থান ও জীবনপর্যটক বলেই মনে হয়েছে আমার। 


পরিবর্তনশীল জগতের প্রবহমান অস্তিত্ব নিয়ে তিনি ঝংকৃত ও পরিব্যাপ্ত। শুধু কুশলী শিল্পী হিসেবে নয়, শিল্প ভাঙার শিল্পী হিসেবেও। তিনি কখনোই নিয়ন্ত্রিত ও সীমায়িত হতে চাননি। 

সামাজিক হয়েও সমাজমননের অভ্যন্তরে বিরাজ করেন। শরীরবৃত্তীয় পর্যায়গুলি সক্ষমতার সঙ্গে লালন করেন। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর লেখায় ফিরে আসে মগ্নচৈতন্যের অবধারিত ক্রিয়াকলাপ। প্রজ্ঞানাচারী বৈভাষিক মিথলজি । 
 প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শয়তানের মুখ” জলবিভাজিকার ক্রমিক বিন্যস্ত থেকে উঠে আসে সত্তার বহুমুখীন পর্যায়। ঐতিহ্যকে ভেঙে ঐতিহ্য গড়া, আবার তাকে অস্বীকার, ক্রমবর্ধমান এই প্রবাহ থেকেই তাঁর লক্ষ্যহীন লক্ষ্য। 

অনুবাদের ক্ষেত্রে বেশ উল্লেখযোগ্য কবিরা হলেন — উইলিয়াম ব্লেক, জাঁ ককতো, সালভাদোর দালি, পল গঁগা, ব্লাইজি সঁদরা, ত্রিস্তান জারা, অ্যালেন গিন্সবার্গ, লরেন্স ফেরলিংঘেট্টি, পাবলো নেরুদা এবং ফেদেরিকো গারথিয়া লোরকা। প্রতিটিতেই স্বকীয়তার ছাপ স্পষ্ট ।তবু নিজের কাজের জন্য তিনি প্রশংসা, পুরস্কার কিছুই গ্রহণ করেননি। 

সাহিত্য একাডেমী পুরস্কারও সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি জানেন সবচেয়ে বড় পুরস্কার মানুষের ভালোবাসা। এই মাহাত্ম্য তাঁকে আরও সুউচ্চতা দান করেছে। 

মলয় রায়চৌধুরী আমাদের যে আবহাওয়ায়, যে মৃত্যুতে, যে বেঁচে ওঠার মধ্যে সঞ্চারিত হয়ে আছেন, তার প্রতিটি বোধেই আমরা আজ তাঁকে উপলব্ধি করতে পারি —

“খবরের কাগজ পড়তে ভাল্লাগে না
সারাদিন হাতে রক্ত লেগে থাকে
মাখা ভাত মানুষের দুঃখে লাল হয়ে যায়
টিভি দেখতে ভাল্লাগে না
লাশের মাংসের কান্না জামায় ছিটকে আসে”
(সত্যিই ভাল্লাগে না) 


পড়তে পড়তে আমরা তো সেই বিবেকচৈতন্যের কাছেই এসে দাঁড়াই। যেখানে আমরা দায়বদ্ধ। যেখানে মুক্তির সমূহ আলোও অন্ধকার হয়ে আসে। বিজ্ঞানী আলবার্ট আইন স্টাইনের কথাটি মনে পড়ে যায় —

“Only two things are infinite, the universe and human stupidity, and I ‘m not sure about the former.” 

কবির কাছেও হয়তো এটাই সত্যি। কিন্তু কবিতা কি শেষ পর্যন্ত এই নৈর্ব্যক্তিকতা এবং মানবিক বিমূঢ়তার ঊর্ধ্বে যেতে পেরেছে?

                                                              

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন