মঙ্গলবার

এক রাজদ্রোহী রাজকুমারের কাহিনি : মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কলিম খান

এক রাজদ্রোহী রাজকুমারের কাহিনি : মলয় রায়চৌধুরী সম্পর্কে কলিম খান

35078391_1815511731843417_2156203698626232320_n

Kalim Khan

প্রথম পর্ব : ষড়যন্ত্র : মারণ

( কোরাণ ও গীতা : পুনঃপাঠ )
মহম্মদ কহিলেন : হে আবুবক্কর ! মদিনা হইতে এই বিশাল সৈন্যবাহিনী লইয়া যে উদ্দেশ্যে হেথায় আসিয়াছি, তাহা বুঝি আর সফল হইল না । দেখো, সন্মুখসমরে আজ আমারই কোরেশ বংশের বংশজগণ । আর দেখো, উভয় সেনার মধ্যে আমারই পিতৃব্যগণ পিতামহগণ আচার্য্যগণ মাতুলগণ ভাতৃগণ পুত্রগণ পৌত্রগণ মিত্রগণ শ্বশুরগণ সুহৃদগণ অবস্হান করিতেছেন । আমি কাহাকে হত্যা করিব ? হে আবুবক্কর ! যুদ্ধেচ্ছু  এই সকল স্বজনদিগকে সন্মুখে অবস্হিত দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন হইতেছে এবং মুখ শুষ্ক হইতেছে । ইহা সত্য যে, ৩৬০টি প্রতিমা প্রতিষ্ঠা করিয়া ইহারা যুগযুগান্ত ধরিয়া আরববাসীগণকে প্রতারিত করিতেছে, আর ওই প্রতীকগুলির সাহায্যে পুরাতন জীবনব্যবস্হায় তাহাদিগকে মোহগ্রস্হ করিয়া রাখিয়াছে, তাহাদের ধনসম্পদ ভোগ করিতেছে । ইহাও সত্য যে, আমি এই বংশেরই এক কনিষ্ঠতম ও অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এক দুয়ো-রাজকুমার । তথাপি এক্ষণে ইহাদিগকে সমরাঙ্গনে সন্মুখস্হ দেখিয়া আমার হস্তপদ অবসন্ন হইয়া আসিতেছে ।

আবুবক্কর কহিলেন : অয় মুহম্মদ ! এই সঙ্কট সময়ে স্বর্গহানিকর অকীর্তিকর তোমার এই মোহ কোথা হইতে উপস্হিত হইল ? এ যুদ্ধ স্বার্থপ্রণোদিত নহে, ইহা জেহাদ, ধর্মযুদ্ধ । হে পরন্তপ ! তুচ্ছ হৃদয়ের দুর্বলতা ত্যাগ করিয়া যুদ্ধার্থে উথ্থিত হও ! জেহাদ অপেক্ষা ইমানদার মোমিনের পক্ষে শ্রেয়ঃ আর কিছুই নাই । হে ধনঞ্জয় ! এই যুদ্ধ জগৎপিতার নিয়মে স্বয়ং উপস্হিত হইয়াছে । ইহা আমাদের নিমিত্ত জন্নাতের দ্বার উন্মুক্ত করিবে । অতএব যুদ্ধার্থে উথ্থিত হও । অন্যথায় মহারথগণ মনে করিবেন, তুমি ভয়বশত যুদ্ধে বিরত হইতেছ, দয়াবশত নহে । সুতরাং যাহারা তোমাকে বহু সন্মান করেন, তাহাদিগের নিকট তুমি লঘুতাপ্রাপ্ত হইবে । তোমার শত্রুরাও তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করিয়া অনেক অবাচ্য কথা বলিবে । তাহা অপেক্ষা অধিক দুঃখকর আর কী আছে ? এক হস্তে অধর্মের বিনাশ ও অপর হস্তে ধর্মের প্রতিষ্ঠা নিমিত্ত তুমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ধর্মভ্রষ্টদিগকে হত্যা করিতে দ্বিধা কিসের ? সুতরাং হে সব্যসাচী, যুদ্ধে কৃতনিশ্চয় হইয়া উথ্থান করো।

সব্যসাচী কহিলেন : ইহা সত্য যে, ইহারা ধর্মভ্রষ্ট । এই কৌরবগণ আমাদিগের ন্যায় ইক্ষাকু বংশজ হইলেও ইহারা ধর্মের অমর্যাদা করিয়াছে । প্রজাপালন বিষয়ে ইহাদিগের দুঃশাসনের কোনও সীমা নাই । ইহাও সত্য যে, আমরা এই বংশেরই অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এই রাজবংশের দুয়ো-রাজকুমার এবং ইহারা আমাদিগকে আশৈশব প্রবঞ্চনা করিয়া আসিতেছে, সাধারণ প্রজাদিগের তো কথাই নাই । সেই হেতু ধর্মপ্রতিষ্ঠার স্বার্থেই ইহাদিগকে ক্ষমতাচ্যুত করা প্রয়োজন । কিন্তু এতৎসত্বেও, স্বজন ও গুরুজনদিগকে বধ করিয়া কীরূপে প্রাণধারণ করিব, এইরূপ চিন্তাপ্রযুক্ত হইয়া চিত্তের দীনতায় আমি অভিভূত হইতেছি । প্রকৃত ধর্ম কী, এ বিষয়ে আমার চিত্ত বিমূঢ় হইতেছে । ধর্মপ্রতিষ্ঠার নিমিত্ত এ আমি কাহার হত্যাকারী হইতে চলিয়াছি ? অতএব হে কৃষ্ণ ! যাহাতে শুভ হয়, আমাকে নিশ্চিত করিয়া তাহা বলো !

শ্রীকৃষ্ণ কহিলেন : প্রকৃতপক্ষে তুমি কাহারও হত্যাকারী নহ। স্বজন বা গুরুজন যাহাই হউন, যাহারা অন্যায়কারী, প্রজাবৃন্দের প্রতি নির্দয়, অচলায়তন রূপে সমাজের উপর প্রতিষ্ঠিত, তাঁহারা ধর্মভ্রষ্ট হইয়াছেন । কাল সমুপস্হিত হইলে স্বয়ং শিব ধর্মভ্রষ্টদিগের মহিমাহরণ করিয়া তাহাদিগকে হনন করিয়া রাখেন । এক্ষেত্রেও তাহাই হইয়াছে, তুমি নিমিত্তমাত্র । সত্যের জন্য, ধর্মের জন্য, স্বজন ও গুরুজনদিগের উপর বাণনিক্ষেপ করিলে কদাচ অধর্ম হয় না। সুতরাং, তুমি নিঃসংশয়ে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও । যাহারা সত্যের নিমিত্ত ধর্মের নিমিত্ত পিতৃব্য ও পিতামহ প্রভৃতি স্বজনগণকে নিকেশ করিতে দ্বিধা করেন না, তাহারাই প্রকৃত ধার্মিক । ইতিহাস তাহার সাক্ষী । অতএব, হে পাশুপতধারী মোমিন ! হে দুয়ো-রাজকুমার ! হে বংশদ্রোহী! তুমি যুদ্ধ করো ।

দ্বিতীয় পর্ব : ষড়যন্ত্র : মোহন

( দেবীপুরাণ : পুনঃপাঠ )
ঋষিগণ কহিলেন : হে পণ্ডিতপ্রবর ! যথার্থ পথপ্রদর্শক নেতাই গুরুপদবাচ্য । তাঁহাকে সম্যকরূপে অবগত না-হইয়া তাঁহার অনুসরণ করা উচিত নহে । ইহা জানিয়াও অসুরগণ কী প্রকারে ভুল নেতৃত্বের দ্বারা প্রবঞ্চিত হইলেন, এক্ষণে সে বিষয়ে আমাদিগের কৌতূহল নিবারুণ করুন ।

বৈশ্যম্পায়ন কহিলেন : বৃহস্পতি ও শুক্রাচার্য  উভয়েই ভৃগুর সন্তান হইলেও তাঁহাদের অভিমত ভিন্ন ছিল । সেই কারণে সুরাসুর সংগ্রামে তাঁহারা যথাক্রমে দেবতা ও অসুরগণের পরামর্শদাতারূপে তাহাদের গুরুর আসনে অধিষ্ঠিত হইয়াছিলেন ।

একদা অসুরগণকে সংযত থাকিতে বলিয়া শুক্রাচার্য্য তপস্যার উদ্দেশ্যে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করিলেন । একথা জানিতে পারিয়া দেবগুরু বৃহস্পতি স্বল্পকাল অতিবাহিত হইলে শুক্রাচার্য্যের রূপ ধারণপূর্বক তথায় উপস্হিত হইলেন । তাঁহাকে সমুপস্হিত দেখিয়া অসুরগণ তাঁহাদিগের গুরুদেব প্রত্যাবর্তন করিয়াছেন, এইরূপ প্রত্যয় করিল এবং তাঁহাকে পাদ্য অর্ঘ্য দানে যথাবিহিত সন্মান প্রদর্শনপূর্বক তাঁহার উপদেশের জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল । অনন্তর শুক্রাচার্য্যরূপী বৃহস্পতি তাহাদিগকে বলিলেন, বৈরিতা কুলক্ষয়ের কারণ । বৈরিতার কারণ বাসনা, অতএব বাসনা পরিত্যাগ করো । বাসনা না থাকিলে কেহই তোমাদিগকে বশীভূত করিতে পারিবে না । অতএব তোমরা বাসনামুক্ত হও, মস্তকমুণ্ডনকরতঃ গৈরিক বস্ত্র ধারণ করিয়া আচারনিষ্ঠ হও । আচারনিষ্ঠগণকে দেবতাও জয় করিতে পারিবে না । গুরুদেবের আদেশ শিরোধার্য করিয়া অসুরগণ তাহাই করিতে লাগিলেন । ইহার ফলে তাহাদিগের হৃদয় হইতে অসূয়াভাব ক্রমে তিরোহিত হইতে লাগিল ।

ইট্যবসরে, দৈত্যগুরু শুক্রাচার্য্য তাঁহার তপস্যা সমাপনান্তে তথায় সমাগত হইলেন । দেবগুরু বৃহস্পতিকে অসুরগণের গুরুপদে অধিষ্ঠিত দেখিয়া তিনি যারপরনাই বিস্মিত ও ক্রুদ্ধ হইয়া  অসুরগণকে কহিলেন— এ কাহাকে তোমরা আমার আসনে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছ ? ইনি যে দেবগুরু বৃহস্পতি, তাহা কি তোমরা উপলবদ্ধি করিতে পারো নাই ? তোমাদিগকে বিপথগামী করিবার জন্য আমার অনুপস্হিতির সুযোগ গ্রহণ করিয়া এ প্রবঞ্চক তোমাদিগের  সহিত প্রতারণা করিয়াছে । ইনি আমাদিগের ন্যায় স্বর্গদ্রোহী নহেন । তোমাদের নেতার আসন গ্রহণ করিয়া তোমাদের সংগ্রামকে ধ্বংস করাই এই প্রতারকের একমাত্র উদ্দেশ্য ।

ইহা শুনিয়া শুক্রাচার্য্যরূপী বৃহস্পতি কহিলেন : হে অসুরগণ! অবধান করো ! আমার উপদেশে তোমরা অজেয় হইতে চলিয়াছ দেখিয়া দেবগুরু বৃহস্পতি তোমাদিগকে প্রতারণা করিবার উদ্দেশ্যে এক্ষণে আমার রূপ ধারণ করিয়া তোমাদিগের সন্মুখে উপস্হিত হইয়াছেন । ইনি দেবগুরু বৃহস্পতি । অবিলম্বে ইহার মুখে চুনকালি দিয়া গর্দভের পৃষ্ঠে আরোহন করাইয়া পশ্চাতে হ্ল্লা লাগাইয়া দাও এবং বিতাড়ন করো । অসুরগণ তাহাই করিল ।

কিয়ৎকাল অতিবাহিত হইলে, অসুরগণ একদিন হৃদয়ঙ্গম করিল, তাহারা প্রবঞ্চিত হইয়াছে । কিন্তু তখন তাহাদিগের আর কিছুই করিবার রহিল না ।

এইভাবে অসুরগণ ছদ্ম-দেবদ্রোহীকে তাহাদের নেতারূপে বরণ করিয়া মোহগ্রস্ত হইয়াছিল এবং সম্পূর্ণরূপে প্রবঞ্চিত হইয়াছিল ।

তৃতীয় পর্ব : ষড়যন্ত্র : স্তম্ভন

( মুক্তধারা : পুনঃপাঠ )
এক যে ছিল রাজা । তার ছিল দুই রানি, সুয়োরানি আর দুয়োরানি। সুয়োরানি সুখে থাকে রাজপ্রাসাদে আর দুয়োরানি থাকে বনের প্রান্তে, ছোট নদীর ধারে, কুঁড়ে ঘরে। দুয়োরানির ছেলে সেই নদীতে নৌকাবায় । পারানির কড়িতে তাদের দিন কাটে । কিন্তু একদিন তার সাধের নদী শুকিয়ে গেল । কারণ, দেশের রাজ-বিভূতি বাঁধ বেঁধেছেন । কেবল জলধারা নয়, ঈশ্বরের করুণার সকল ধারার সামনেই বাঁধ বেঁধেছেন তাঁরা । লোকে বিস্বাসই করতে পারল না যে, দেবতা তাদের যে জল দিয়েছেন, কোনও মানুষ তা বন্ধ করতে পারে । কিন্তু বন্ধ হল, করুণাধারার সব শাখাই ক্রমশ শুকোতে লাগল, আর প্রজাদের জীবন উঠল অতীষ্ঠ হয়ে । এদিকে একদিন দুয়োরানির ছেলে জানতে পারল সে রাজপুত্তুর । সে গেল রাজার কাছে, বললে, রাজপুত্রের অধিকার চাইনে । কেবল ঈশ্বরের করুণাধারার সামনে দেয়া তোমাদের ওই বাঁধগুলো খুলে দাও, এই প্রার্থনা । শুনে সুয়ো-রাজপুত্রেরা অবাক হলো । তারা সেপাই ডাকল, সান্ত্রী ডাকল । ঘাড়ধাক্কা দিয়ে রাজবাড়ি থেকে বার করে ছুঁড়ে ফেলে দিলো রাস্তায় ।

ধুলো ঝেড়ে সে উঠে দাঁড়াল । তারপর গেল শিবতরাইয়ের প্রজাদের কাছে । সেখানে গিয়ে সে অবাক হয়ে গেল । সে দেখল, ধনঞ্জয় বৈরাগীর ছদ্মবেশে সুয়োরানির এক ছেলে । আর, তার পেছনে শিবতরাইয়ের মানুষগুলো চলেছে মুক্তধারার বাঁধ ভাঙতে । তখন সেই দুয়ো-রাজকুমার সবাইকে ডেকে বলতে লাগল, ওই বৈরাগী আসল বৈরাগী নয়, ও তো ছদ্মবেশী সুয়ো-রাজকুমার, ও তোমাদের ঠকাবে ।  এক নদীর মুখেই ওরা বাঁধ বাঁধেনি । সর্বহারার মুখেই ওরা বাঁধ বেঁধেছে । সেগুলি ভাঙতে হলে, তাদের রহস্য জানতে হবে । সেসব আমি জেনে এসেছি । আমার কথা শোনো । কিন্তু দু’চারজন আধপাগলা ছাড়া কেউ তার কথায় কান দিল না ।

কথাটা গেল মিথ্যে-বৈরাগীর কানে, সে বললে — ওটা বদ্ধ পাগল । ছন্নছাড়া । খেতে পায়না, হাংরি, তাই মিথ্যে কথা বলে । ওর মুখে চুনকালি মাখিয়ে গর্দভের পিঠে চড়িয়ে পিছনে ভিড়ের হল্লা লাগিয়ে দাও । মজা পেয়ে প্রজারা তাই করলে ।

এরপর গাধার পিঠে সওয়ার দুয়ো-রাজকুমারের আর কিছুই করার রইলো না । তাই সে কেবল চিৎকার করে । চিৎকারের জন্য চিৎকার । চিৎকারের ভিতরে চিৎকার । চিৎকার করতে করতে একদিন সে বিস্মৃতিলোকে চলে গেলো ।

তারপর অনেকদিন কেটে গেলে, শিবতরাইয়ের প্রজারা বুঝল তারা ঠকেছে । অতএব, তারা খোঁজ করতে লাগল সেই দুয়ো-রাজকুমারের, যে জানত সব বাঁধের রহস্য । কিন্তু তাকে আর পাওয়া গেল না । তখন যে আধপাগলারা সেসময় তার কথা শুনেছিল মন দিয়ে, তাদেরকে ধরা হলো । বাঁধ ভাঙার রহস্য ওই আধপাগলারা দুয়ো-রাজকুমারের কাছ থেকে জেনে-বুঝে নিয়েছিল কি না, সেটা জানার জন্য । কিন্তু কেউই সেসব কথা ঠিকঠাক বলতে পারল না ।

রাজপ্রাসাদ থেকেও দুয়ো-রাজকুমারের খোঁজখবর করা হলো । কিন্তু তাকে পাওয়া গেল না, পাওয়া গেল তার গাধাটাকে । তাকেই নিয়ে এসে ফুলমালা দিয়ে চন্দনের টিপ পরিয়ে রাজসভায় আনা হলো । রাজা সেই গাধাটাকেই শিরোপা দিলেন আর রাজপুরোহিত দিলেন আশীর্বাদ । সবাই বলে উঠল — সাধু, সাধু !

চতুর্থ পর্ব : ষড়যন্ত্র : বিদ্বেষণ
( অভিচারতন্ত্র : পুনঃপাঠ )
মানুষের উপর মানুষের চড়ে বসাকে বলা হয় ‘অভিচরণ’ বা ‘অভিচার’ । আদিকালে সর্বপ্রথম যে-পদ্ধতির সাহায্যে এই কর্মটি করা হতো, তাকে বলা হতো ‘শ্যেনযাগাদি’ অর্থাৎ অন্য গোষ্ঠীর লোকেদের উপর দলবদ্ধ লুঠতরাজ বা ছিনতাই । তবে সে সবই ছিল সাময়িক । তার সাহায্যে বহুকালের জন্য বা চিরকালের জন্য কারও উপর চেপে বসা যেত না । সেই উদ্দেশ্যে একদিন ভারতবর্ষ আবিষ্কার করে এক অভিনব প্রক্রিয়া —‘মূলনিখনন ও পদধূলিগ্রহণ’। এই প্রক্রিয়া প্রয়োগ করে সমাজের স্বাভাবিক জ্ঞানপ্রবাহের উপর বাঁধ বাঁধা হয় ও বৈদিকযুগের সূত্রপাত করা হয় । এটিই পৃথিবীর প্রথম বাঁধ ও আদি বাঁধ । ঈশ্বরের করুণার অন্যান্য ধারাগুলিকে বাঁধ বেঁধে নিয়ন্ত্রণ করার কথা তখনও ভাবা হয়নি ।

তা সে যাই হোক, সেই ‘মূলনিখনন ও পদধূলিগ্রহণ’ উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েছি বলে এখনও আমরা ‘বড়ো শত্রুকে উঁচু পিঁড়ি’ দিই ; যার সর্বনাশ করা দরকার তার মূর্তি গড়ে পূজা করি ও তার নীতি অমান্য করি এবং এভাবেই আমরা আজও শিব রাম গান্ধী মার্কস রবীন্দ্রনাথের পূজা করি ও তাঁদের নীতি অমান্য করে থাকি।

দুষমনকে ‘পূজা করে মেরে ফেলার’ এই বৈদিক নীতির বিপরীতে একসময় তান্ত্রিক নীতিরও জন্ম হয় এই ভারতবর্ষেই । ‘নিয়ন্ত্রণসাধন’কে তখন বলা হতিও যন্ত্র, যা দিয়ে অন্যদের নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা চালানো হতো, ঘাড়ের উপর চেপে বসা ক্ষমতাকে উৎখাত করার চেষ্টা চালানো হতো । তান্ত্রিকেরা শত্রুকে নিয়ন্ত্রণ করার উপায় হিসেবে ছয় রকম ‘নিয়ন্ত্রণসাধন’ বা যন্ত্র আবিষ্কার করেছিলেন— মারণ, মোহন, স্তম্ভন ( শত্রুকে স্ট্যাগন্যান্ট করে দেয়া ), বিদ্বেষণ ( ডিভাইড অ্যাণ্ড রুল ), উচ্চাটন ( স্বদেশভ্রংশন বা শত্রুকে তার কনটেক্সট থেকে উৎখাত করে দেয়া ) ও বশীকরণ । এই যন্ত্রগুলি প্রধানত বাঁধ ভাঙার কাজেই ব্যবহৃত  হতো । বৈদিকদের পূজা করে মেরে ফেলার বিপরীতে তান্ত্রিকেরা এই ছয় রকম যন্ত্র ব্যবহার করতেন বলে, বৈদিকপন্হীদের কালচারে এই ‘ষড়যন্ত্র’ ঘৃণ্য ও নিন্দাজনক হয়ে যায় এবং আধুনিক যুগে পৌঁছে পরিণত হয় ‘কন্সপিরেসি’তে, যদিও তান্ত্রিক কালচারে ‘ষড়যন্ত্র’ যথারীতি প্রশংসাযোগ্য ও গৌরবজনক হয়েই থেকে যায় । অর্থাৎ কিনা, ভারতের তান্ত্রিক ঐতিহ্য অনুসারে ষড়যন্ত্রের প্রয়োগ অত্যন্ত ভালো কাজ এবং তা আদৌ কন্সপিরেসি নয়।

তবে নিয়ন্ত্রণসাধনের এই চর্চা এখানেই থেমে থাকেনি । যুগ বহুদূর এগিয়ে চলে এসেছে, যন্ত্রকে করে তোলা হয়েছে ‘মোস্ট সফিসটিকেটেড’, ক্ষমতা হয়েছে নিরঙ্কুশ । শাসক ও বিদ্রোহীর হাতে ওইসকল যন্ত্রের বিপুল বিকাশ ঘটেছে । বিকাশ ঘটেছে শাসক এবং বিদ্রোহীরও । এখন শাসকের বহু রূপ, বহু সুয়ো ; বিদ্রোহীরও বহু রূপ, বহু দুয়ো । বহু ক্ষেত্রে শাসকই বিদ্রোহীর পোশাক পরে নেয়, কোনও কোনও দুয়ো ভুয়ো-বিদ্রোহী হয়ে সুয়োর দলে ভিড়ে যায় । তাছাড়া, এখন বাঁধের সংখ্যাও প্রচুর, যত ধারা ততো বাঁধ, বাঁধের নিচে বাঁধ, উপরে বাঁধ, সাপোর্টিং বাঁধ, কতো কী ! এমনকি লোকদেখানো মিথ্যে বাঁধও রয়েছে, বিদ্রোহী জনগণের আক্রোশ যার উপর ফেটে পড়ে বেরিয়ে যেতে পারবে, ডায়লুট ও ডাইভার্টেড হয়ে যেতে পারবে, অথচ প্রকৃত বাঁধটা থেকে যাবে অক্ষত ।

আরও আছে, এখনকার প্রতিটি বাঁধের পাথরপ্রতিমার রূপগুণও ভিন্ন ভিন্ন, পৃথক পৃথক স্পেশালিস্ট বা দক্ষ বিভূতিদের দিয়ে বানানো । এসব বাঁধ ভাঙতে গেলে বিদ্রোহীদেরও ভিন্ন ভিন্ন শাখার স্পেশালিস্ট হতে হয়, দক্ষ হতে হয়, অনেক তপজপ করতে হয় । কেননা এমন ব্যবস্হা করে রাখা হয়েছে যাতে কৃষিবিজ্ঞানী সাংস্কৃতিক বাঁধের রহস্য জানতে না পারেন, জীববিজ্ঞানী রাজনৈতিক বাঁধের রহস্য জানতে না পারেন…ইত্যাদি ইত্যাদি। কারণ প্রতিটি বাঁধই সেই সেই বিষয়ের প্রতীকের পাথরপ্রতিমা দিয়ে গড়া । তাই, একালে একজন দুয়ো-রাজকুমারে কিছুই হবার নয় । যতোগুলি বাঁধ, বলতে গেলে ততোজন দক্ষ দুয়ো-রাজকুমার লাগে সেগুলি ভাঙবার আয়োজন করতে।

তাই একালে দুয়ো-রাজকুমারের সংখ্যাও খুব কম নয় । এর ভিতর আবার জালি দুয়ো-রাজকুমার তো রয়েছেই । তার ওপর, কখনও বা কোনও কোনও দক্ষ দুয়ো-রাজকুমারকে রাতারাতি ফুটপাত বদল করতেও দেখা যায় । অবশ্য তার জন্য তাদের ফ্ল্যাট নিতে হয় ‘কনখল’-এ । ‘কনখল’ সেই বিখ্যাত কমপ্লেক্স, যেখানে দাঁড়িয়ে আদি দক্ষ বলেছিল, ‘কৌ ন খল অর্থাৎ কে খল নহে ? সব্বাই খল । অতএব আমিও কেন খল হবো না ?’ এই বলে, সেও খল হয়ে যায় । সেই জন্য, সেই ভিত্তিভূমির নাম হয়ে যায় ‘কনখল’ । এলাকার ফুটপাত-বদল-পারদর্শী দক্ষেরা সেই কমপ্লেক্সে আশ্রয় নিয়ে ঘোষণা করে, ‘কে খল নহে ? সব্বাই খল । কেউ কথা রাখেনি । অতএব আমিও কথা রাখব না ।’ —এই বলে তারা সুযোগ পাওয়া মাত্রই সুয়ো-রাজকুমারের দলে ভিড়ে যায় । তাই প্রকৃত বিদ্রোহী দুয়ো-রাজকুমারকে চিনতে পারা এযুগের এক কঠিন সমস্যা ।

আবার বাঁ৭ ভাঙার ক্ষেত্রেও রয়েছে সমস্যা । পালটা প্রতীকের পাথরপ্রতিমা না বসিয়ে বাঁধের বর্তমান পাথরকে সরানোর কোনও উপায় রাখা হয়নি । আর সেটা করতে গেলেই নতুন প্রতীকের বাঁধ নির্মিত হয়েযায় । ফলে, যে ভাঙতে আসে, দেখা যায়, পাকে চক্রে সে আগের বাঁধ ভেঙে তার স্হানে নতুন আর একটা বাঁধ বেঁধে ফেলেছে নিজের অগোচরেই ।

এই সমস্যার মুখোমুখি হয়ে, সাম্প্রতিক কালের অধুনান্তিক ( পোস্টমডার্ন ) তান্ত্রিক বিদ্রোহীরা একটি অভিনব পন্হা উদ্ভাবন করেছেন । বাঁধের উৎখাতযোগ্য পাথরপ্রতিমাকে অত্যন্ত স্বল্পায়ু প্রতীক দিয়ে সরিয়ে ফেলা । এ যেন মানববোমা । উদ্দিষ্ট প্রতীকটাকে ধ্বংস করে দিয়ে নিজেও মরে যাবে । এমন জ্ঞানের ব্যবহার, যা পুরোনো জ্ঞানকে মেরে ফেলবে অথচ নতুন ‘জ্ঞানের বোঝা’ হয়ে দেখা দেবে না ।

পঞ্চম পর্ব : যড়যন্ত্র : উচ্চাটন

( অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্ট রিভোল্ট প্রোগ্রামিং : অ্যান আইটি এক্সপ্লোর )
সবাই জানেন কমপিউটারের দুনিয়ায় উইনডোর নানা ভারশন প্রকাশিত হয়েছে । উইনডো ৯৫, উইনডো ০৭, উইনডো ৯৮ ভারসন ১, উইনডো ৯৮ ভারসন ২, উইনডো মিলেনিয়াম ভারসন ইত্যাদি ইত্যাদি । তবে যেটা অনেকেই নজর করেননি, তা হল প্রতিষ্ঠান বিরোধিতারও অনেকগুলি ভারসন আমাদের মার্কেটে চালু আছে । প্রতিটি ভারসনের আবার অনেকগুলি করে এডিশন রয়েছে । যার যেটা পছন্দ তিনি সেটা কেনেন, ব্যবহার করেন । ক্রেতার অবগতির জন্য এখানে কয়েকটি ভারসনের একটি করে এডিশন-এর অতি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেওয়া হল ।

ষষ্ঠ পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ১

( লঞ্চড বাই শিবশম্ভু পাষণ্ড/সনাতন এডিশন )
ইট ইজ আ প্রিমিটিভ এডিশন অ্যান্ড প্রেজেন্টলি নট অ্যাভেলেবল ইন দ্য মার্কেট।

সপ্তম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ২

( লঞ্চড বাই বাল্মীকি/চণ্ডাশোক এডিশন )
১) শাসক…ব্রাহ্মণ
২) শাসিত…ক্ষত্রিয় বৈশ্য শুদ্র ও অন্যান্য ম্লেচ্ছ সম্প্রদায়
৩) বিরোধের কারণ…সামাজিক মুক্তধারার উপরে নির্মিত বাঁধ
৪) বাঁধের কারিগর…কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন বেদব্যাস ও তাঁর শিষ্যগণ
৫) বাঁধ গড়ার উপাদান…সামাজিক প্রতীকের পাথরপ্রতিমা দিয়ে দিয়ে
৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র…পালটা প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৭) সুয়ো-রাজকুমার…রাবণ অ্যাসোশিয়েটস
৮) দুয়ো-রাজকুমার…রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম
৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার…বিভীষণ
১০) বিদ্রোহের নেতা…দাশরথীগণ
১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
১২) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান…রাম নাম সত্য হ্যায়
১৩ ) আধপাগলা…জটায়ু
১৪ ) গাধা…হনুমান

অষ্টম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ৩

( লঞ্চড বাই কে.ডি.বেদব্যাস/রিঅ্যাকটিভ এডিশন )
১) শাসক…দেবগণ
২) শাসিত…অসুরগণ
৩) বিরোধের কারণ…সামাজিক মুক্তধারার উপরে নির্মিত বাঁধ
৪) বাঁধের কারিগর…বিশ্বকর্মা
৫) বাঁধ গড়ার উপাদান…সামাজিক প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র…পালটা প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৭) সুয়ো-রাজকুমার…গন্ধর্বগণ
৮) দুয়ো-রাজকুমার…শঙ্করাচার্য
৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার…কুমারিল ভট্ট
১০ ) বিদ্রোহের নেতা…জরৎকারুপুত্র আস্তীক
১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
১২ ) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান…চাতুর্ব্বর্ণ্যব্যবস্হানং যস্মিন দেশে প্রবর্ততে । আর্যদেশঃ স বিজ্ঞেয়
১৩ ) আধপাগলা…লোমশ মুনি
১৪ ) গাধা…যাদবগণ

নবম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ৪

( লঞ্চড বাই কার্ল মার্কস/প্যারি কমিউন এডিশন )
১) শাসক…সহস্রমুখ বুর্জোয়া
২) শাসিত…সর্বহারা শ্রমিক কৃষক পেটিবুর্জোয়া শ্রেণি
৩) বিরোধের কারণ…কেবলমাত্র রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তধারার উপরে নির্মিত বাঁধগুলি
৪) বাঁধের কারিগর…যন্ত্ররাজ বিভূতি ও ভৈরবমন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসীর দল
৫) বাঁধ গড়ার উপাদান…রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র…বন্দুকের নল । পালটা প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৭) সুয়ো-রাজকুমার…সাম্রাজ্যবাদী নবীন বুর্জোয়া/প্রতিবিপ্লবী
৮) দুয়ো-রাজকুমার…ডিক্লাসড ( অবক্ষিপ্ত ) বুদ্ধিজীবী
৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার…পাতিবুর্জোয়া
১০ ) বিদ্রোহের নেতা…কমিউনিস্ট বিপ্লবী
১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা…অতিবিপ্লবী
১২) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান…ইনকিলাব জিন্দাবাদ/জাগো জাগো জাগো সর্বহারা
১৩) আধপাগলা…কমিউনিস্ট সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী
১৪ ) গাধা…একনিষ্ঠ কমিউনিস্ট কর্মী ( শ্রমিক কৃষক )

দশম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ৫

( লঞ্চড বাই রবীন্দ্রনাথ ট্যাগোর/সেকেন্ড ওয়র্ল্ড ওয়ার এডিশন । )
১) শাসক…রাজা রণজিৎ
২) শাসিত…উত্তরকূট ও শিবতরাইয়ের প্রজাবৃন্দ
৩) বিরোধের কারণ…মুক্তধারার উপর নির্মিত বাঁধ
৪) বাঁধের কারিগর…যন্ত্ররাজ বিভূতি ও ভৈরবমন্ত্রে দীক্ষিত সন্ন্যাসীর দল
৫) বাঁধ গড়ার উপাদান…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র…ছিদ্রস্হানে আঘাত
৭) সুয়ো-রাজকুমার…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
৮) দুয়ো-রাজকুমার…’স্বজনবিদ্রোহী’ খুড়ো বিশ্বজিৎ ও যুবরাজ অভিজিৎ
৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
১০) বিদ্রোহের নেতা…ধনঞ্জয় বৈরাগী
১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা…ঃঃঃঃঃঃঃঃ
১২) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান…বাঁধ ভেঙে দাও বাঁধ ভেঙে দাও দাআআআআও
১৩) আধপাগলা…গণেশ
১৪ ) গাধা…সঞ্জয়

একাদশতম পর্ব : প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : ভারসন ৬

( লঞ্চড বাই পবং এক্সক্লুসিভস / লেটেস্ট এডিশন )
১) শাসক…প্রগতিশীল ( মার্কসবাদী, কমিউনিস্ট, বিপ্লবী)
২) শাসিত…জনগণ
৩) বিরোধের কারণ…সর্বহারার মুখে নির্মিত বাঁধসমূহ
৪) বাঁধের কারিগর…প্রত্যেক ধারার নিজ-নিজ যন্ত্ররাজ বিভূতি ও তত্তদ সন্ন্যাসীর দল
৫) বাঁধ গড়ার উপাদান…তত্তদ ধারার নিজস্ব প্রতীকের পাথর দিয়ে দিয়ে
৬) বাঁধ ভাঙার মন্ত্র…ছিদ্রস্হানে আঘাত । সেই ধারার পালটা প্রতীক দিয়ে প্রতীকবদল ।
৭ ) সুয়ো-রাজকুমার…বাবুবংশের উত্তরাধিকারীগণ, বাবুভায়াগণ
৮) দুয়ো-রাজকুমার…হাংরি, শাস্ত্রবিরোধী, নকশাল, বিচ্ছিন্নতাবাদী, পোস্টমডার্ন ইত্যাদি
৯) ছদ্ম দুয়ো-রাজকুমার…মার্কসবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবী
১০) বিদ্রোহের নেতা…মার্কসবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবী
১১) ছদ্ম বিদ্রোহী নেতা…মার্কসবাদী কমিউনিস্ট বিপ্লবী, অতিবিপ্লবী, উগ্রপন্হী
১২) বিদ্রোহের ( স্লো ) গান…কে চেল্লায় শালা, কে চেল্লায় এই ভোরবেলা
১৩ ) আধপাগলা…শম্ভু রক্ষিত অ্যান্ড অ্যাসিসিয়েটস
১৪ ) গাধা…সেকেন্ড লাইন হাংরি, শাস্ত্রবিরোধী ও নকশাল এবং ফোর্থ লাইন মার্কসবাদী

দ্বাদশতম পর্ব : ‘প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা : মিলেনিয়াম ভারসন’

( দিস প্রডাক্ট ইজ নাউ অ্যাবানডন্ড । অ্যাকর্ডিং টু কমপিউটার ইনজিনিয়ার্স, দ্য এসট্যাবলিশমেন্ট রিভোল্ট প্রোগ্রামিং ইজ বিকামিং অবসলিট ইন দ্য প্রেজেন্ট কনটেক্সট । )
বলে রাখা ভালো, এই অ্যান্টি-এসট্যাবলিশমেন্ট রিভোল্ট প্রোগ্রামিং স্বভাবতই ভালনারেবল । কোনো অ্যান্টি-ভাইরাস ব্যবস্হাই একে বাঁচানোর ক্ষেত্রে সফল হতে পারেনি । অর্থাৎ এই প্রোগ্রাম আদৌ ভাইরাসপ্রুফ নয় । যখন তখন ক্র্যাশ করে যায় । এই প্রোগ্রামিং যে আজকাল আর তেমন বিকোচ্ছে না, সেটাই তার অন্যতম কারণ ।
আরও কারণ আছে । আজকের মানবসমাজ একাকারের যুগে পা রেখে ফেলেছে । ফলে, শাসক-শাসিতের অ্যান্টাগনিজম ক্রমশ কমপ্লিমেন্টারির দিকে  টাল খেয়ে যাচ্ছে । গোটা ব্যবস্হাটা, তার সমগ্র প্রেক্ষাপট ,সবই ‘এফেক্টিভ ফ্যাক্টর’ রূপে সক্রিয় হয়ে উঠেছে । মানবসমাজ, জীবজগৎ ও জড়জগৎকে নিয়ে যে-সমগ্রব্যবস্হা, সেটি ঠিক থাকছে কি না, মানব সভ্যতার অস্তিত্বের পক্ষে অনুকূল থাকছে কি না, সেসব কথাও আজ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে । অথচ প্রচলিত ধনতান্ত্রিক বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্হাগুলি এই পরিস্হিতির তুলনায়  সেকেলে হয়ে গেছে বা যাচ্ছে । বিজ্ঞানী মারি গেলম্যান-এর মতে, …neither greedy capitalists nor dogmatic communists have sufficient respect for the larger system of which we are merely a part. স্বভাবতই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রোগ্রামিংগুলিও আজকের প্রেক্ষিতে সেকেলে হয়ে গেছে । সন্মুখস্হ পরিস্হিতির বিচার বিবেচনা করে আজকের দিনের পোস্টমডার্ন চিন্তাবিদরা এমন অদ্বৈত প্রোগ্রামিং-এর কথা ভাবতে শুরু করেছেন, যা বদ্ধধারাগুলিকে কেবল মুক্তধারাতেই পরিণত করবে না ; সমগ্র ব্যবস্হাটিকেও আরও সুসংহত করবে । আর, সেটা করতে গিয়ে তাঁরা বিগত যুগের প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার প্রোগ্রামিংসমূহের সমস্ত অর্জনগুলিরও সারসংগ্রহ করে নিচ্ছেন ।

সংগৃহীত ও সারে কী রয়েছে ? শাসক-শাসিতের ( পুরুষ-প্রকৃতির, কনটেন্ট-ফর্মের ) দ্বৈতাদ্বৈত অস্তিত্বের পরিবর্তনের মূল যে-কারিকা, তার সরবরাহ ঘটে শাসিতের তরফ থেকে নয় ; শাসকের তরফ থেকেই । শাসিত তো শাসকের বিরোধী হয়ে থাকেই । কিন্তু তাতে কিছু হয় না । যে গোপন কথাগুলির ওপর ক্ষমতা টিকে থাকে, তার সব কথা শাসিতেরা কখনও জানতে পারে না বলেই শাসন সম্ভব হয় । জানতে পারে তারাই যারা ওই প্রাসাদের অংশ, উত্তরাধিকারী । সেই কারণে দলছুট প্রাসাদত্যাগী দুয়ো-রাজকুমারেরা বিদ্রোহীর দলে যোগ না দিলে কোনও রাজপ্রাসাদেরই পতন সম্ভব নয় ; এটাই ছিল এতদিনের অঙ্ক। তাই শাসনের সমস্ত খেলাই এতদিন ছিল ওই বিদ্রোহী রাজকুমারের আসনটিকে ঘিরে । কারণ তার ভূমিকার ওপরই নির্ভর করত ব্যবস্হাটি বদলাবে কি না । সেই কারণে দুয়ো-রাজকুমারের তপস্যা ভেস্তে দেওয়ার খেলা, তার ভূমিকাকে নানাভাবে বিগড়ে দেয়ার খেলাই ক্ষমতার অন্যতম খেলা ছিল । সেই কারণে, বিদ্রোহী নেতা ও দুয়ো-রাজকুমারকে আগেভাগে গুমখুন করে তার আসনটি শাসকই ছদ্মবেশীদের বসিয়ে দখল করে রেখে দিত । কিন্তু সম্প্রতি ট্রান্সপারেন্সির ডাক দিয়ে বিশ্বের সমস্ত দুয়ো-রাজকুমারেরা ক্ষমতার সেই সব খেলাই ভেস্তে দিয়েছে, দিচ্ছে । এখন কেবল ডিসক্লোজ করে যাও । কেবল মেলে ধরা, যাতে সবাই সবকিছি দেখতে পায় । এতে শাসক-শাসিতের পরিচালক-পরিচালিতে উন্নীত না হয়ে কোনও উপায়ই থাকে না । শাসন অবসানের এযুগের এই পথ ।

ত্রয়োদশতম পর্ব : ‘ষড়যন্ত্র : বশীকরণ’

( শেষ দুয়ো-রাজকুমারের কলাপ : এক ডক্টরেরটকামী ছাত্রের থিসিস থেকে )

বাংলার সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুয়ো-রাজকুমার ঠিক কী কী করেছিলেন, তা জানার জন্য আমি তাঁর বিষয়ে অনুসন্ধান চালাই । এক সময় জানতে পারি, তিনি যাদের সঙ্গে থাকতেন, সেই আধপাগলা মানুষগুলি তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু জানেন । তাঁর অনেক নথিপত্রও নাকি তাঁদের কাছে রয়েছে । একথা জানতে পারার পর, আমি সেই আধপাগলা মানুষগুলির খোঁজখবর করি এবং অনেক তেল পুড়িয়ে অবশেষে তাদের দু;জনকে খুঁজে বার করতে সক্ষম হই । তাঁদের সঙ্গে আমার যে কথোপকথন হয়েছিল, তা নিম্নে বর্ণিত হল :
আমি : শুনেছি, আপনাদের সঙ্গে দুয়ো-রাজকুমারের ক্লোজ রিলেশান ছিল?
আধপাগলা ১ : ক্লোজ রিলেশান কোথায় দেখলে ? ও তো ডিসক্লোজ রিলেশান । যতো পারো ডিসক্লোজ করে দাও । কোনও আবরণ যেন না থাকে । আবরণেই তো বাধা । আটকা আটকি । ঢেকে চেপে রাখা । অন্ধকার করে রাখা । অন্ধ করে রাখা । অন্ধকারে কী হয় জানো ? জানো না ? শ্বাপদেরা বাসা বাঁধে ।
আমি : বলছিলুম কী, দুয়ো-রাজকুমারের সাথে আপনাদের আলাপ হল কেমন করে ?
আধপাগলা ২ : সে অনেক কথা । পেথম সে এসেচিল ভোলানাথ সেজে । আমার ঠাকুদ্দার বাবার বাবাদেরও আগে, অনেকেই তাকে দেখেছিল ।
আমি : তার কথা আমি জানতে চাইছি না । যার সঙ্গে মুক্তির দশক এবং তারপরেও আপনাদের দেখা হয়েছিল, তার কথা বলুন । তার সাথে আপনাদের আলাপ হল কেমন করে, ঘনিষ্ঠতা হল কেমন করে ?
আধপাগলা ২ : ঘনিষ্ঠতা আর হল কই ? ঘন হবার আগেই তো ইষ্টদেবতা বাধ সাধলেন । গাধা এলো, গাধার টুপি এলো, চুনকালি মাখানো হল, তারপর সব হাহা হিহি হয়ে গেল । তাতে ইষ্ট ছিল না অনিষ্ট ছিল সে তো আর ঠাহর করা গেল না ।
আধপাগলা ১ : যতদূর জানি, ও এসেছিল অঙ্গদেশের পাটলিপুত্র থেকে । শুনেছি বাবুকালচারের যে দুয়োরানি বাংলার বাইরে প্রত্যন্ত শহরগুলিতে আশ্রয় নিয়েছিল, ও তাদেরই এক সন্তান । সাবর্ণ চৌধুরী নামে কলকাতার যে-বিখ্যাত বাবু রাজবংশের প্রতিষ্ঠা, ও সেই বাবুকালচারের একজন অবহেলিত অবক্ষিপ্ত উত্তরাধিকারী, এক দুয়ো-রাজকুমার ।
আমি :  শুনেছি, ওই দুয়ো-রাজকুমার যাচ্ছেতাই গালাগালি করত, অশ্লীল ভাষায় কথা বলত, অশালীন গান গাইত, গাঁজা ভাঙ খেতো, নোংরা জীবন যাপন করত — এসব ক সত্যি ?
আধপাগলা ১ : আমরা তো সবাই বস্তিতে থাকি, থাকি গণ্ডগাঁয়ে, আর ও তো আমদের সাথেই থাকত । আমাদের জীবন যাপন যেরকম, সেরকমই থাকত । সেটা অশ্লীল কি অশ্লীল নয়, সে আপনারাই জানেন । আর গালাগালির কথা যদি বলেন, সে তো আপনি থাকলেও করতেন । নিজের ভাই হয়ে সুয়ো-রাজকুমাররা ওর সাথে কোন মন্দ ব্যবহারটা করতে বাকি রেখেছিল শুনি ? ও যে ডেলি দু’চারটা খুনখারাবি করেনি, কেবল শালা-বাঞ্চোৎ করেছে, সেটাই তো অনেক ভদ্র ব্যবহার ।
আমি : শুনেছি, সেপাইরা  ওকে যখন জেলখানায় নিয়ে যায়, তখন এক-দু’জন সুয়ো-রাজকুমারই ওর হয়ে সত্যিমিথ্যে সাক্ষ্য দিয়েছিল, বলেছিল. ‘কই, ও তো রাজার মাকে ডাইনি বলেনি, যে ওটাকে ছেড়ে দে ।’ কথাটা কি ঠিক ?
আধপাগলা ২ : আরে সেটাই তো কাল হল । যে এক-দু’জন দুয়ো রাজকুমার ‘কনখল’ কমপ্লেক্সে ফ্ল্যাট কিনে সুয়ো-রাজকুমারের দলে ভিড়ে গিয়েছিল, তারাই ওরকম সাক্ষ্য দয়েছিল । তাই, ওর মনের এক কোণায় একটা বিশ্বাস থেকে গেল যে, সকল সুয়ো-রাজকুমার সমান শয়তান নয়, এক-দু’জন ভালো হয় । কিন্তু ‘কনখল’-এর বাসিন্দা মাত্রেই যে ‘সচ্ছল’ ( সচ-ছল বা সৎ সেজে ছলনাকারী ) হয়, সেটা সে খেয়াল করেনি । অনেকে বলে, ওই বিশ্বাসের জন্যেই ও নাকি হেরে গেল ।
আমি : সাংস্কৃতিক-বাঁধ ভাঙার কলাকৌশল সে নাকি খুব ভালোভাবেই জানত, আর সে-রহস্য আপনাদেরকে সে নাকি বলে গিয়েছে । কথাটা কি সত্যি ?
আধপাগলা ২ : আমাকে ওসব বলেনি বাবা । আমি সেসব কতা শুনিনি । বিশ্বাস করো ভাই, ওসব কতা আমি এক্কেরে শুনিনিকো । রাজার দেয়া বাঁধ বলে কতা । ভাঙব বললেই হল । সেপাই আচে না, সান্ত্রী আচে না ।
আধপাগলা ১ : দেখো বাছা । প্রত্যেক বাঁধের একটা না একটা ছিদ্র থাকে । সেটা সে জেনেছিল । সেখানে যন্ত্রাসুরকে আঘাত করলেই বাঁধটা ভেঙে পড়ে । কিন্তু কোন বাঁধের কোথায় ত্রুটি সেসব কথা আমার জানা নেই । যে দুয়ো-রাজকুমারের সাথে আমার দেখা হয়েছিল, সে কেবল সাহিত্য-সংস্কৃতির বাঁধের রহস্যগুলো বলত । তার সব কথা ভালো বোঝাও যেত না । তার দেওয়া একটা কাগজ আছে আমার কাছে, সেটায় সেসব সে লিখেও দিয়েছিল । তার কোনো কথাই আমার মাথায় ঢোকেনি । দেখো, তুমি বুঝতে পারো কি না ।

শেষ পর্ব : ম্লেচ্ছিতবিকল্প

সাহিত্য সংস্কৃতির সাবলীল ধারার সামনে ওরা বাঁধ বেঁধেছে অজস্র প্রতীকের পাথর দিয়ে । সেগুলিকে সাময়িক প্রত্যয়ের পাথরপ্রতিমা দিয়ে রিপ্লেস করে ফেলা দরকার । বাঁধটা যেহেতু বিশাল, অজস্র পাথর গেঁথে গেঁথে তৈরি, তাই এই ভেঙে ফেলার কাজটাও বিশাল । এটা সফল করবার জন্য আরও অনেকের হাত লাগানো দরকার । আমি আমার সধ্যমতো এই রিপ্লেসমেন্টের কাজগুলো করার চেষ্টা করে থাকি এইভাবে :-
১) শিল্পের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা ( একালের ) কবিতা রচনার প্রধান শর্ত ।
২) আমার রচনা বাংলা ভাষার একটি বিশেষ কাঠামোকে সর্বজনীন করে তোলার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ । প্রতিবাদ সংস্কৃতি পিটিয়ে কলকেতিয়া করে তোলার বিরুদ্ধে ।
৩) পশ্চিমবঙ্গে বাংলা সাহিত্যের অধ্যাপকরা ঐতিহ্যের যে মানদণ্ড  গড়ে ফেলেছেন তাকে অস্বীকার করাটা যেন তাঁদেরই অপমান করার উদ্দেশ্যে, এমন একটা ধুয়ো আজ সর্বজনস্বীকৃত । তাই শিল্প বানাবার বাঙালি চেতনা থেকে কবিতাকে মুক্ত করার চেষ্টাকে ভালো চোখে দেখা হয় না । ওদিকে কবিতা থেকে সিমবলিস্ট এবং সুররিয়ালিস্ট চাপ বাদ দেবার আইডিয়া আমার মাথায় ঘুরঘুর করছিল ।
৪) আমি মনে করি, কবিতায় ভাষার খেলা, ইমেজ গেম, রিদম গেম, মেটাফিজিক্স গেম অবশ্য বর্জনীয়, কেননা ওগুলির সাহায্যে মানুষের অসহায়তা নিয়ে জোচ্চুরি করা হয় ।
৫) আমি তো সিমবলিস্ট কবি নই যে একটা চিত্রকল্পকে কোনো কিছুর পপতীক হিসেবে সংজ্ঞায়িত করব । ( বিষয়, আঙ্গিক, উপমা, ছন্দ, প্রতীক, রূপক, অলঙ্কার — সর্বত্রই অ্যাটাক ) ।
৬) একদিকে চিৎকার, বিপরীতে ফিসফিসানি — এই দিয়ে আমি কবিতার আধুনিক স্বরকে ভেঙে দিই ।
৭) প্রেম ও অপ্রেম, শরীর ও মন ইত্যাদি যুগ্মবৈপরীত্য যেভাবে বাংলা কবিতায় তোয়াজ করা হয়েছে এতাবৎ এবং তার অন্তর্গত সন্ত্রাসটিকে কবিরা এতকাল যে-চেতনা প্রয়োগে বানচাল করেছেন, আমি তা সম্পূর্ণ অস্বীকার করে প্রেমকে সেনসরহীন স্বরূপে উপস্হাপন করি । প্রেম বা কবিতা এখন বিনোদন নয় ।
৮ ) আমি ষাটের দশকের শুরু থেকেই অলঙ্কার বর্জনের কথা বলে আসছি । অধুনান্তিক চেতনাটি নিরাভরণ । আমার কবিতায় কবিত্বের সন্ত্রাসকে উৎসাহিত প্ররোচিত করার প্রয়াস যাথার্থ দিতে চায় অলঙ্কারহীনতাকে । আমার কবিতা দার্শনিক স্তরে, সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক-আর্থিক-নৈতিক স্হিতাবস্হার বিরুদ্ধে একটি স্ব-স্বীকৃত দ্রোহতর্ক ।
৯ ) আমি সত্যিই শিল্পের বিরুদ্ধে ও সংস্কৃতির স্বপক্ষে বলতে চেয়েছিলুম । পরাবাস্তববাদের আদলে শিল্পবিরোধিতার পালটা শিল্পের কথা বলিনি ।
১০) সমস্ত কবিতার ক্ষেত্রে এক নিয়ম হতে পারে না । কনটেক্সট অনুসারে প্রত্যেকটির বয়নই তার মতো ।এমন কবিতাও অতএব হতে পারে, যেখানে ‘আলো’ প্রতিনিধিত্ব করে না কান্টিয় বা বৈদিক আলোর । কেননা এমন পরিস্হিতি তো দেখাই যাচ্ছে যেখানে ‘আলো’ নামক লোগোটি ঘৃণ্য হয়ে গেছে । রেললাইনে হাত-পা বাঁধা যে পড়ে আছে, তার কাছে আগন্তুক আলো কী ? কিংবা যে আগুনের পরশমণি থানার সেপাইদের জ্বলন্ত সিগারেট হয়ে কয়েদি চাষির লিঙ্গে ছ্যাঁকা হয়ে লাগে, তাকে কী বলা হবে ? এসব ক্ষেত্রে প্রথাবাহিত সাংস্কৃতিক অনুমানগুলিকে আমার কবিতা নস্যাৎ করতে চায় । কবির কন্ঠস্বর নামক বদল্যারীয় জীবনানন্দীয় তর্কটি এর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হয় এবং উত্তরাধিকারমুক্ত করা হয় কবিত্বকে ।
১১ ) গতানুগতিক কবিতার অনুশাসনকে ছন্দের তেল চটচটে আঙ্গিকেই ভেঙে ফেলতে চাই বলে আমি কখনও কখনও ভাষার অনচ্ছ বৈশিষ্ট্যকে ব্যবহার করে থাকি, যাতে এমন একটা আদল পাওয়া যায়, যা বর্তমান অসম্বদ্ধতাকে অসংলগ্নতাকে আকস্মিকতার সন্নিবেশকে স্বতঃস্ফূর্ত করতে পারে । সেক্ষেত্রে তাই আমার কবিতার পাঠকৃতিটি ইচ্ছাকৃতভাবে ছেতরানো, ছেঁড়াখোঁড়া, তাপ্পিমারা, বহুরঙা ও আসক্তিবিরোধী ।
১২ ) ইংরেজরা বিদেয় হবার পর এবং দিল্লির দরবারে অজস্র জোকারের আবির্ভাবের ঘনঘটায় যে-ইতিহাসোত্তর কালখণ্ডটির হামলায় শব্দজগৎ ও ভাষাপৃথিবী আক্রান্ত, কবিতার ওই প্রোটোকলবর্জিত প্রতীকবাদবিরোধী এলাকাটির দখল নেয়া জরুরি ।
১৩ ) ‘সত্য’ যে সর্বজনীন নাও হতে পারে, সে কথাটা বলা দরকার বলেই বলি ।
১৪ ) আমি মনে করেছিলুম যে, একজন কবি হিসেবে মন ও দেহের যুগ্মবৈপরীত্যের তত্বটিকে চ্যালেঞ্জ জানানো দরকার আর সেটাই আমি করেছি, যেখানে পেরেছি ।
১৫ ) বাস্তবের তৈরি অবাস্তবতায়, স্হিরতার গড়া অস্হিরতায়, মুহূর্ত দিয়ে গড়া কালপ্রবাহে, অগতি থেকে উৎসারিত গতিতে, অবজেক্ট/সাবজেক্ট বিভাজনটি ভেঙে পড়ে ।
১৬ ) দাঙ্গাকে প্রান্তিকের ওপর চাপিয়ে দেয় কেন্দ্র অথচ তা মসনদের চাকুমালিকদের অন্দরমহলের গল্প । তারা যেহেতু ক্ষমতার কেন্দ্রে, সত্যের নিয়ন্তা তারাই । শাসক মাত্রেই আধিপত্যবাদী, তা সে যে-তত্বেরই মালিক হোক ।
১৭ ) কবিতায় ঝোড়ো হাওয়া আর পোড়ো বাড়ির ভাঙা দরজার মেলবন্ধন তখনই সম্ভব যখন বাস্তবে আধিপত্যবাদী শর্তগুলো মেনে নেওয়া হচ্ছে । আমার রচনার গেম-প্ল্যান মূলত সেই আদি সাংস্কৃতিক ভঙ্গুরতা থেকে উপজাত । হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘অবিদ্যমান যুদ্ধ’-এর মতো যা অবর্তমান সেইটেই আমার রচনায় উপস্হিত হয়ে দশ পঙক্তির খেলা করে । খেলাটি সমাপ্ত হিসাবে ঘোষিত হবে তখনই, যখন ধাঁধাটির সমাধান হবে। নয়তো চলতে থাকবে মর্মার্থ-সঙ্কটাপন্ন শব্দাবলীর ঝোড়ো হাওয়া । মাত্রাতিরিক্ত মিলের মাত্রাতিরিক্ত নাটুকেপনা চলতে থাকবে ।
১৮ ) ছবিগুলি ভাষার সাংস্কৃতিক নির্দেশের অন্তর্গত এবং তা দাঙ্গার সন্ত্রাসের বাইরেকার ‘আমির’ আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠিত করে । দাঙ্গার সন্ত্রাস স্ট্রাকচার্ড হয় । রাজপথে পড়ে থাকা সন্ত্রাস-পরবর্তী টুকিটাকি প্রকৃতপক্ষে অবাস্তব ঘটনাবলীর সত্য ।
১৯ ) প্রত্যন্তকে, আধুনিকতা যে নান্দনিক সন্ত্রাসে নিয়ে গিয়ে আছড়েছে, স্বগতোক্তি ছাড়া সমস্ত শব্দ এবং ধ্বনি সেই চত্বরে অর্থহীন । সন্ত্রাসের উপাদান এক্ষেত্রে স্তব্ধতা, শিশির, ঝিঁঝি, নক্ষত্র, শীত, পাথর ইত্যাদি যা সনাতনি কবিতায় তথাকথিত সৌন্দর্য বানাবার কাজে লাগে । মাত্রা গুনে-গুনে যে ধরণের ডিজিটাল কবিতা বাজারচালু, সেই ডিজিটাল যান্ত্রিক কবিত্ব ভাঙা হয়েছে । ছন্দের ভেতরে ভেতরে কোনও মানে ঢোকানো নেই, যা কিছু মানে তা উপরিতলেই ভাসছে ।
২০ ) ছয়ের দশকেও বাংলা কবিতায় থাকত চিত্র, চিত্রকল্প । আমি ব্যবহার করি উপচিত্র । রূপক নয়, লক্ষণগুলোই আমার হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ।
২১ ) লিরিকের জমিতে রোমান্টিক চেতনার চাষ ভালো হয়, কেননা লেখকের কোনো নৈতিক দায় থাকে না । আমি কবিতায় ভঙ্গুরতা আগাগোড়া বজায় রাখি কাঠামোটিকে ‘অ্যান্টিলিরিক’ করে তোলার জন্য । একদিকে লিরিকের অচলাবস্হা থেকে এবং অপরদিকে ক্ষমতার তাত্বিক খবরদারি থেকে দূরে থাকা দরকার । লেখাকে তাই কাউন্টার-হিগেমনিক করে তোলা দরকার ।
২২ ) প্রতিষ্ঠিত ফর্ম  মাত্রেই প্রতিষ্ঠানের কুক্ষিগত, তাই তাকে ভাঙা জরুরি । জরুরি প্রতিষ্ঠিত জনপ্রিয় মনোভাবের অবিনির্মাণ । পাঠকৃতি যেন স্বেচ্ছায় আত্মদীর্ণ, অসমতল, দ্বন্দ্ব-আবিল, অক্ষহীন, দলছুট, আপত্তিসূচক, উভমুখী, অসংহত, ঘরাণা-বহির্ভূত এবং চোরা-আক্রমণাত্মক হয়ে যায় । কারণ কবি মানেই তো ‘চোরাযোদ্ধা’ ।
২৩ ) অত্যন্ত বেশি ব্যাকরণবোধ থেকে  সাজানো-গোছানো সমাজের ধান্দার দরুন পয়দা হয় ওদের স্তালিন ও আমদের  সঞ্জয় গান্ধির আদর্শ । শুভর কুহকে আত্মসমর্পণ করে নাৎসিরা অশুভর রাজপথ উদ্বোধন করেছিল । সবাইকে পিটিয়ে সমান করার ব্যাষ্টিবাদের শুভত্ব মূলত একটি মৌলবাদী জবরদস্তি যা গদ্য কবিতাকেও ঢোকাতে চায় ছন্দের তালিবানি জেলখানাণ এবং আধমাত্রা সিকিমাত্রার বেয়াদপিকে শায়েস্তা করতে চায় অ্যাকাডেমিক গেস্টাপোদের নাকচের অস্ত্র দ্বারা । আমার রচনা তা মানে না এবং না-মানার ঝুঁকি নেয় ।
২৪ ) কবিতায় আমি আপইয়েলিং ঢোকাই । আপওয়েলিং কোনো নির্মাণ নয়, সৃজনশীলতা নয়, পুনরাবৃত্তি নয়, ভাষাবয়ন নয় । ফ্রেম থেকে যাতে উপচিত্রগুলো বেরিয়ে যায়, তাই তাদের মধ্যে কোনও বার্তা পুরে দিই না ।  তারা অঙ্গপ্রত্যঙ্গহীন । যা চোখের সামনে তুলে ধরা যায় না, তাকেই তুলে ধরা । বিজ্ঞানীরা যেমন বলেন, যা চোখে দেখা যায় তার অস্তিত্ব নির্ভর করে, যা চোখে দেখা যায় তার ওপর। যেটা উপস্হিত ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন