–– ADVERTISEMENT ––
হাংরি-র পুরনো বা নতুন সব কবি বা লেখকই কিন্তু অনায়াসে ব্যবহার করেছেন অবদমিতের ভাষা। এঁদের লেখায় অনায়াসেই চলে আসে প্রকৃত শ্রমিক-কৃষকের দৈনন্দিন ব্যবহৃত শব্দাবলি। ভালবাসা-ঘৃণা বা ক্রোধ বা ইতরামি প্রকাশে হাংরিদের কোনও ভণ্ডামি নেই, রূপক বা প্রতীক নয়, এঁদের লেখায় যৌনতা বা ইতরামির প্রকাশে থাকে অভিজ্ঞতার প্রত্যক্ষ বিবরণ— একেবারে জনজীবনের তথাকথিত শিল্পহীন কথা। সংকলনে আরও আছে অরুণেশ ঘোষ, শৈলেশ্বর ঘোষ ও বাসুদেব দাশগুপ্তের তিনটি সাক্ষাৎকার। এতে, বিশেষত বাসুদেব দাশগুপ্ত ও শৈলেশ্বর ঘোষের ক্ষেত্রে যিনি সাক্ষাৎকার নিচ্ছেন ও যিনি দিচ্ছেন দুজনেরই প্রধান আগ্রহ যেন ছিল মলয় রায়চৌধুরীর নিজেকে হাংরি জেনারেশনের সৃষ্টিকর্তা বলে দাবির বিরুদ্ধে যুক্তি খাড়া করা। তা করতে গিয়ে শৈলেশ্বরের মতো মানুষও নিজের এক সময়কার সঙ্গী মলয় রায়চৌধুরীকে অপ্রত্যাশিত ভাবে  ‘বিহারী-বাঙালিবাবুটি’ বলে ফেলেছেন, যা অত্যন্ত নিন্দনীয়।

অনেকেই প্রায় সমসময়ের নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে হাংরি আন্দোলনকে তুলনা করে এদের অরাজনৈতিক তকমা দেন, কিন্তু ক্ষমতার সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক নিয়ে হাংরি জেনারেশন যে প্রশ্ন তুলেছিল তা ছিল নকশালদের তোলা প্রশ্নের চেয়েও অনেক বেশি মৌলিক। এমনকী তুমুল প্রচার পাওয়া এবং নিজস্ব অস্তিত্ব তৈরি করা সত্ত্বেও দলিত সাহিত্য আন্দোলনকে শেষ পর্যন্ত হাংরি আন্দোলনের থেকে পিছিয়েই রাখতে হয়। দাবি-দাওয়া, জমায়েত বা প্রথাগত রাজনৈতিক প্রতিবাদ আন্দোলনকে প্রথম থেকেই সাহিত্য আন্দোলনে জড়িয়ে রাখায় এই আন্দোলন দ্রুতই বুর্জোয়া কুঅভ্যাসগুলিতে আক্রান্ত হয়।
হাংরি আন্দোলন শুরুর প্রায় পঞ্চাশ বছর পর সেই সময় ও পরবর্তী কালে এই আন্দোলনে যোগ দেওয়া কবি ও গদ্যলেখকদের রচনাসংগ্রহ সম্পাদনায় উদ্যোগী হয়ে সব্যসাচী সেন খুবই প্রয়োজনীয় কাজ করেছেন। তবে উৎপলকুমার বসুর ‘পোপের সমাধি’ কবিতাটি বর্তমান সংগ্রহে না থাকাটা রীতিমতো বিস্ময়কর। আর হাংরি আন্দোলন নিয়ে ‘সম্প্রতি’ পত্রিকায় প্রকাশিত শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের পুরো প্রবন্ধটিও থাকা উচিত ছিল। সর্বোপরি সমীর রায়চৌধুরী ও মলয় রায়চৌধুরী প্রসঙ্গ। সম্পাদকীয়ের শুরুতেই আমরা সম্পাদকের এক ‘বন্ধু’র বয়ানে জেনে যাই, ‘এই (হাংরি কিংবদন্তি) গ্রন্থে মলয় রায়চৌধুরী অতীব যত্ন সহকারে নিজেকে হাংরি আন্দোলনের স্রষ্টা বলে প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করেছেন যা সর্বৈব মিথ্যা। হাংরি সাহিত্যের স্রষ্টা হলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায়।’ সে ক্ষেত্রে যতই শক্তি চট্টোপাধ্যায় শৈলেশ্বর ঘোষের ‘তিন বিধবা’ কবিতা প্রকাশের পর আন্দোলন থেকে বিদায় নিন, অন্তত ঐতিহাসিক কারণে তাঁর ‘সীমান্ত প্রস্তাব ১/ মুখ্যমন্ত্রীর প্রতি নিবেদন’ কবিতাটি এখানে অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। আর, শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে এই আন্দোলনের সৃষ্টিকর্তা ধরে নিলে তিনিই যখন আদালতে দাঁড়িয়ে ‘এটা ঘটনা যে, এই সাহিত্য আন্দোলন (হাংরি জেনারেশন) আমি কয়েক জন বন্ধুকে নিয়ে শুরু করেছিলাম’ বলে সাক্ষ্য দেন আর কয়েক জন বন্ধুর মধ্যে মলয় রায়চৌধুরী থাকেন তখন মলয় সৃষ্টিকর্তা হোন বা না হোন তাঁর অন্তত একটি লেখা এই সংকলনে ঠাঁই পাওয়ার অধিকার পেয়ে যায়। বিশেষ করে তাঁর যে লেখার জন্য এত কোর্ট কাছারি এত সাক্ষ্যদান সেই ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক কুঠার’ থাকবে না? শক্তি বা আরও অনেক কবিই এই লেখাটিকে বাজে লেখা বলেছিলেন, কিন্তু ইতিহাসের দাবিতেই এই লেখা বা সমীর রায়চৌধুরীর লেখা এই সঙ্কলনভুক্ত হওয়া উচিত ছিল। সম্পাদকীয়তে বলা আছে, ‘সুভাষ ঘোষের একটি বক্তব্যে জানা যাচ্ছে—‘‘তখন হাংরি জেনারেশনের প্রথম পর্ব শেষ... শেষ পর্বে ঝাঁকের কই মিশে গ্যাছে ঝাঁকে— আমাদের নিয়ে ’৬৩-’৬৪তে আরম্ভ দ্বিতীয় পর্বের’’—। এই সংগ্রহকে ‘হাংরি জেনারেশন (দ্বিতীয় পর্ব)’ বললে মলয়, সমীর, শক্তি বা উৎপলকুমার বসুর লেখা বাদ দেওয়ার যুক্তি বোঝা যেত। অন্য দিকে যতই মলয় রায়চৌধুরী উদ্বাস্তুদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ করে থাকুন বা নিজের বুর্জোয়া অতীত নিয়ে গর্ব প্রকাশ করুন বা ১৯৬৪ সালে হাংরি জেনারেশনের মৃত্যু ঘোষণা করুন, তাতে তিনি যে ১৯৬৫-র আগে পর্যন্ত অর্থাৎ হাংরি জেনারেশনের প্রথম পর্বের এক জন ছিলেন এটা তো অপ্রমাণ হয় না। অর্থাৎ কোথাও যেন একটু উদারতার অভাব থেকে গেল। 

( উল্লেখ্য যে শৈলেশ্বর ঘোষ ও সুভাষ ঘোষ ছিলেন মলয় রায়চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাজসাক্ষী এবং সেই কারণেই মলয় রায়চৌধুরীর একমাসের কারাদণ্ডের আদেশ হয়েছিল ।