শুক্রবার

শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমের কবিতা


যবে হাত ধরেছিলে হাতে
এ-প্রাণ ভরেছে অকস্মাতে
সকল বিস্ময়
তখনই তো ধ্বংসের সময়,
তখনই তো নির্মাণের জয়।
তোমার হাতের মাঝে আছে পর্যটন-
একথা কি খুশি করে মন?
একথা কি দেশ ঘুরে আসে
স্মরণীয় বসন্তবাতাসে!
এবার হলো না তবু ছুটি
দুলে ওঠে মোরগের ঝুঁটি
বেলা গেলো – বুকে রক্তপাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত
বাগানে কি ধরেছিলে হাত?

একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো–
দেখবে, নদির ভিতরে, মাছের বুক থেকে পাথর ঝরে পড়ছে
পাথর পাথর পাথর আর নদী-সমুদ্রের জল
নীল পাথর লাল হচ্ছে, লাল পাথর নীল
একবার তুমি ভালোবাসতে চেষ্টা করো ।
বুকের ভেতর কিছু পাথর থাকা ভালো- ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি পাওয়া যায়
সমস্ত পায়ে-হাঁটা পথই যখন পিচ্ছিল, তখন ওই পাথরের পাল একের পর এক বিছিয়ে
যেন কবিতার নগ্ন ব্যবহার , যেন ঢেউ, যেন কুমোরটুলির সালমা-চুমকি- জরি-মাখা প্রতিমা
বহুদূর হেমন্তের পাঁশুটে নক্ষত্রের দরোজা পর্যন্ত দেখে আসতে পারি ।
বুকের ভেতরে কিছু পাথর থাকা ভাল
চিঠি-পত্রের বাক্স বলতে তো কিছু নেই – পাথরের ফাঁক – ফোকরে রেখে এলেই কাজ হাসিল-
অনেক সময়তো ঘর গড়তেও মন চায় ।
মাছের বুকের পাথর ক্রমেই আমাদের বুকে এসে জায়গা করে নিচ্ছে
আমাদের সবই দরকার । আমরা ঘরবাড়ি গড়বো – সভ্যতার একটা স্থায়ী স্তম্ভ তুলে ধরবো
রূপোলী মাছ পাথর ঝরাতে ঝরাতে চলে গেলে
একবার তুমি ভলবাসতে চেষ্টা করো ।


ভালোবাসা পেলে
ভালোবাসা পেলে সব লন্ডভন্ড করে চলে যাবো
যেদিকে দুচোখ যায়- যেতে তার খুশি লাগে খুব ।
ভালোবাসা পেলে আমি কেন পায়সান্ন খাবো
যা খায় গরিবে, তাই খাবো বহুদিন যত্ন করে ।
ভালোবাসা পেলে আমি গায়ের সমস্ত মুগ্ধকারী
আবরণ খুলে ফেলে দৌড় ঝাঁপ করবো কড়া রোদে...
ভালোবাসা পেলে জানি সব হবে । না পেলে তোমায়
আমি কি বোবার মতো বসে থাকবো-
ভালোবাসা না পেলে কি আমার এমনি দিন যাবে
চোরের মতন, কিংবা হাহাকারে সোচ্চার , বিমনা--
আমি কি ভীষণ ভাবে তাকে চাই ভালোবাসা জানে।


এক অসুখে দুজন অন্ধ
--শক্তি চট্টোপাধ্যায়

আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ
দীর্ঘ দাঁতের করাত ও ঢেউ নীল দিগন্ত সমান করে
বালিতে আধ-কোমর বন্ধ
এই আনন্দময় কবরে
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ |
হাত দুখানি জড়ায় গলা, সাঁড়াশি সেই সোনার অধিক
উজ্জ্বলতায় প্রখর কিন্তু উষ্ণ এবং রোমাঞ্চকর
আলিঙ্গনের মধেযে আমার হৃদয় কি পায় পুচ্ছে শিকড়
আঁকড়ে ধরে মাটির মতন চিবুক থেকে নখ অবধি ?
সঙ্গে আছেই
রুপোর গুঁড়ো, উড়ন্ত নুন, হল্লা হাওয়ার মধ্যে, কাছে
সঙ্গে আছে
হয়নি পাগল
এই বাতাসে পাল্লা আগল
বন্ধ ক’রে
সঙ্গে আছে …
এক অসুখে দুজন অন্ধ !
আজ বাতাসের সঙ্গে ওঠে, সমুদ্র, তোর আমিষ গন্ধ ।



ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ
--শক্তি চট্টোপাধ্যায়

ইচ্ছে ছিলো তোমার কাছে ঘুরতে-ঘুরতে যাবোই
আমার পুবের হাওয়া।
কিন্তু এখন যাবার কথায়
কলম খোঁজে অস্ত্র কোথায়
এবং এখন তোমার পাশে দাঁড়িয়ে-থাকা কুঞ্জলতায়
রক্তমাখা চাঁদ ঢেকেছে
আকুল চোখ ও মুখের মলিন
আজকে তোমার ভিতর-বাইরে বিষম যুদ্ধ পুবের হাওয়া।।
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি - যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু - প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে।

 
 
 
অবনী বাড়ি আছো? --শক্তি চট্টোপাধ্যায়

অবনী বাড়ি আছো?
দুয়ার এঁটে ঘুমিয়ে আছে পাড়া
কেবল শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?

বৃষ্টি পড়ে এখানে বারোমাস
এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে
পরাঙ্মুখ সবুজ নালিঘাস
দুয়ার চেপে ধরে–
‘অবনী বাড়ি আছো?’

আধেকলীন হৃদয়ে দূরগামী
ব্যথার মাঝে ঘুমিয়ে পড়ি আমি
সহসা শুনি রাতের কড়ানাড়া
‘অবনী বাড়ি আছো?’

মনে মনে বহুদূর চলে গেছি
মনে মনে বহুদূর চলে গেছি – যেখান থেকে ফিরতে হলে আরো একবার জন্মাতে হয়
জন্মেই হাঁটতে হয়
হাঁটতে-হাঁটতে হাঁটতে-হাঁটতে
একসময় যেখান থেকে শুরু করেছিলাম সেখানে পৌঁছুতে পারি
পথ তো একটা নয় –
তবু, সবগুলোই ঘুরে ফিরে ঘুরে ফিরে শুরু আর শেষের কাছে বাঁধা
নদীর দু – প্রান্তের মূল
একপ্রান্তে জনপদ অন্যপ্রান্ত জনশূণ্য
দুদিকেই কূল, দুদিকেই এপার-ওপার, আসা-যাওয়া, টানাপোরেন –
দুটো জন্মই লাগে
মনে মনে দুটো জন্মই লাগে
 
পাবো প্রেম কান পেতে রেখে 
বড় দীর্ঘতম বৃক্ষে ব’সে আছো, দেবতা আমার ।
শিকড়ে, বিহ্বল প্রান্তে, কান পেতে আছি নিশিদিন
সম্ভ্রমের মূল কোথা এ-মাটির নিথর বিস্তারে ;
সেইখানে শুয়ে আছি মনে পড়ে, তার মনে পড়ে ?

যেখানে শুইয়ে গেলে ধীরে-ধীরে কত দূরে আজ !
স্মারক বাগানখনি গাছ হ’য়ে আমার ভিতরে
শুধু স্বপ্ন দীর্ঘকায়, তার ফুল-পাতা-ফল-শাখা
তোমাদের খোঁড়া-বাসা শূন্য ক’রে পলাতক হলো ।

আপনারে খুঁজি আর খুঁজি তারে সঞ্চারে আমার
পুরানো স্পর্শের মগ্ন কোথা আছো ? বুঝি ভুলে গেলে ।
নীলিমা ঔদাস্যে মনে পড়ে নাকো গোষ্ঠের সংকেত ;
দেবতা সুদূর বৃক্ষে, পাবো প্রেম কান পেতে রেখে ।
কিছু মায়া রয়ে গেলো
সকল প্রতাপ হল প্রায় অবসিত…
জ্বালাহীন হৃদয়ের একান্ত নিভৃতে
কিছু মায়া রয়ে গেলো দিনান্তের,
শুধু এই –
কোনোভাবে বেঁচে থেকে প্রণাম জানানো
পৃথিবীকে।
মূঢ়তার অপনোদনের শান্তি,
শুধু এই – ঘৃনা নেই, নেই তঞ্চকতা,
জীবনজাপনে আজ যতো ক্লান্তি থাক,
বেঁচে থাকা শ্লাঘনীয় তবু।
 
সুখে থাকো
চক্রাকারে বসেছি পাঁচজনে
মাঠে, পিছনের পর্চে আলো
অন্ধকার সন্ধ্যা নামে বিড়ালের মতো ধীর পায়ে
তুমি এসে বসেছো আসনে অকস্মাৎ।
হঠাৎই পথে ঘুরতে-ঘুরতে কীভাবে এসেছো
একেবারে পাশে,
তোমার গায়ের গন্ধ নাকে এসে লাগে
বৃদ্ধের রোমাঞ্চ হয়!
খুব ভালো আছো?
অন্তত এখন, তুমি?
তুমি ঠিক আছো?
না থাকার মানে হয়
বিশেষত যখন এসেছো
কৃপা করে।
কৃপা বাক্যবন্ধ তুমি কিছুতে ছাড়বে না!
ছাড়া যায়?
কিছুক্ষণ আছো?
হ্যাঁ, হাতে সময় আছে
তাই, পায়ে পায়ে
এখানে এসেছি চলে।
শুনেছি, সন্ধ্যার আড্ডা তোমার এখানে
যদি ভাগ্য ভালো হয়, দেখা পেয়ে যাবো,
ভাগ্য ভালো।
এমনই এসেছি,
তোমাকে দেখার জন্য আজ কটি দিন
কী ইচ্ছা করছিলো।
জানালে যেতাম।
কিছুতে যেতে না।

‘কাল আসবো’ বলে তুমি পালিয়ে এসেছো
সেই কাল কবে হবে? ভেবেছি তোমার
সময় অত্যন্ত কম,
আমি নিজে আসি।
আমার সময় আছে…দীর্ঘ অবসর!
চক্রাকারে বসেছি পাঁচজনে।
পাঁচজনের মধ্যে থেকে একা একা একান্ত দুজন,
পাঁচজন বুঝেছে সবই
নিচুস্বরে কথা চালাচলি করে যাচ্ছে অহেতুক শ্লথ,
পাঁচজনের মধ্যে থেকে একা একা একান্ত দুজন
অকস্মাৎ।

ধীরে ধীরে রাত বেড়ে যায়।
সন্ধ্যার আঁচলে মুড়ে করতল অন্য পাতে পায়–
করস্পর্শ।
পাখির পালক হাত খেলা করে কর্কশ মুঠিতে,
পাঁচজনে সমস্ত দেখে ধীরে ধীরে কোথা উঠে যায়
একাকী দুজনে রেখে।
চলো পৌঁছে দিয়ে আসি তোমার বাড়িতে।
যাবে?
কেন নয়।
চলো।

একগাড়ি আঁধার আজ দক্ষিণে দৌড়ায়
দ্রুত।
মনে হয়, গতি বড় দ্রুত বিদ্যুতের মতো!
কথা বলো।
কী কথা বলার?
আছে।
কাছে আছো, এ যথেষ্ট নয়?
যথেষ্ট যথেষ্ট। আজ দিন বড় বেশি কিছু দিল।
সত্যি একে দেওয়া বলো এখনো তুমিও।

না বলার সাধ্য আছে?
বহুদিনই ভাবি, হঠাৎ চলেই যাই, গিয়ে দেখে আসি–
আছোটা কেমন?
কিন্তু বড়ো ভয় করে
যদি তুমি কিছু ভাবো?
অন্যের সংসারে ও কেন হঠাৎ আসে?
সেই জন্যে ভয়,
জড়িয়ে যাবার ভয়,
মন্দ ভাগ্যে ভয়!
বড়ো দ্রুত যাচ্ছে গাড়ি সমূহ দক্ষিণে

গাড়ির আঁধার হলো হাসিতে উজ্জ্বল
এবং মধুর গন্ধ ছড়ালো বাতাসে।
আবাল্য তোমার কিছু পাওনা রয়ে গেলো।
আমি বলি শোধ হয়ে গেছে।
আজি, এইমাত্র, এই এতো কাছে পেয়ে
জীবনে এতোটা কাছে তোমাকে পাইনি,
একা বহুক্ষণ ধরে গাড়ির ভিতরে।

গাড়ি বাঁয়ে চলো, গাড়ি এখন দক্ষিণে
কিশোর প্রেমের মতো অত্যন্ত রঞ্জিত
এই সুসময় আজ দিনশেষে কেন!

মূর্ছার ভিতরে নেমে, দু’কদম গিয়ে
ফিরে এসেছিলে…
আজ নয়, অন্য একদিন।
আর দরজা থেকে একা ক্লান্ত ফিরে যাও,
দুর্বলতা গলা টিপে আছে,
আজ নয়, অন্য কোনদিন
আমার সর্বস্ব নিও।
আজ নয়, অন্য কোদিন…
তুমি হাত দুটি ধরে মুখমণ্ডলের
উপরে আগ্নেয় পাত কেন বা ঘটালে?
সর্বস্ব পেয়েছি আমি আজই, অকস্মাৎ।
সুখে থাকো, আমি ফিরে যাই
একা একা।
                               
           শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিকা শীলা ( বিয়ের পর বন্দ্যোপাধ্যায় ) তাঁর ছেলের সঙ্গে । শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের প্রতিটি প্রেমের কবিতা শীলার জন্য, বা তাঁকে না পাওয়ার বিষাদে লিখিত । তিনি ঔপন্যাসিক থেকে কবি হয়েছিলেন
শীলা চট্টোপাধ্যায়ের উৎসাহদানে, চাইবাসার মধুটোলায় । শীলার জন্য তিনি চাইবাসায় দুই বছরের বেশি সমীর
রায়চৌধুরীর বাসায় আস্তানা গেড়েছিলেন ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন