শুক্রবার

আবু সয়ীদ আইয়ুব, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও হাংরি আন্দোলন



আবু সয়ীদ আইয়ুব, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও হাংরি আন্দোলন

আবু সয়ীদ আইয়ুব, অ্যালেন গিন্সবার্গ ও হাংরি আন্দোলন
১৯৬১ সালে হাংরি আন্দোলন আরম্ভ হবার কিছুকাল পর থেকেই কলকাতার তখনকার এলিটরা লালবাজারে প্রতিনিয়ত ফোন করে আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করছিলেন। ফলে লালবাজারের প্রেস সেকশানকে অ্যাক্টিভেট করা হয়েছিল এবং দুজন ইনফরমারকে কলেজ স্ট্রিট কফিহাউস এবং আন্দোলনকারীরা যেসব ঠেকগুলোয় যেতেন আর কবিতা পাঠ করতেন সেখানে-সেখানে নজর রাখতে বলা হয়। এঁরা দুজনে, পবিত্র বল্লভ এবং সমীর বসু, মামলার সময়ে যাঁরা আমার বিরুদ্ধে ভুয়ো সাক্ষী হয়ে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়েছিলেন, আন্দোলনের বুলেটিন ও বইপত্র যোগাড় করে লালবাজারের প্রেস সেকশানে জমা দিতেন।
আমাকে আর দাদা সমীর রায়চৌধুরীকে যখন পুলিশ কমিশনারের ঘরে একটা বিশেষ ইনভেসটিগেটিং বোর্ড জেরা করেছিল, তখন দুটো ঢাউস ফাইল দেখেছিলুম গোলটেবিলের ওপর, তাতে আমাদের যাবতীয় লেখালিখি সংগ্রহ করে ফাইল করা ছিল। আমাদের বিরুদ্ধে যে এলিট ভদ্রলোকরা নালিশ ঠুকেছেন তা পুলিশ কমিশনার নিজেই আমাদের বলেছিলেন। পরে, কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম-এর সচিব শ্রী এ. বি.শাহ যখন পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে দেখা করেন, তিনি জানতে পারেন যে আমাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবার জন্য সবচেয়ে বেশি জোর দিয়েছেন আবু সয়ীদ আইয়ুব আর সন্তোষকুমার ঘোষ। কলকাতায়ে র‌্যাডিকাল হিউমানিস্ট-এর দপ্তরে শ্রী শাহ-এর সঙ্গে মকোদ্দমা নিয়ে আমার আলোচনা হয়েছিল। সন্তোষকুমার ঘোষের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলুম, তিনি রাজি হননি। বুদ্ধদেব বসুও আমার সঙ্গে দেখা করতে চাননি, আমার নাম শুনেই মুখের ওপর দড়াম করে দরোজা বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সমর সেন তখন ইংরেজি ‘নাউ’ পত্রিকার সম্পাদক, ওনার সঙ্গে দেখা করতে গেলে উনি বলেছিলেন, ‘কারা আপনাদের বিরুদ্ধে পুলিশে মৌখিক অভিযোগ দায়ের করেছেন তা আমি জানি, কিন্তু তাঁদের নাম আপনাদের বলব না।” একই কথা বলেছিলেন গৌরকিশোর ঘোষ। আবু সয়ীদ আইয়ুব-এর বাড়িতে গিয়ে আমি আর দাদা দেখা করেছিলুম ।
মজার ব্যাপার হল যে আইয়ুব সাহেব নিজেই ছিলেন ‘ইনডিয়ান কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’-এর চতুর্মাসিক ম্যাগাজিন ‘কোয়েস্ট’-এর সম্পাদক; (পত্রিকাটি আমেরিকার সি, আই.এ-র সাহায্য পায় এমন সংবাদ প্রচারিত হলে, বন্ধ হয়ে যায়), অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে একটি চিঠিতে উনি জানিয়েছিলেন যে উনি প্রতিষ্ঠিত লেখক নন এবং ওনার কোনো পদমর্যাদা নেই। পত্রিকাটির সহ-সম্পাদক ছিলেন অম্লান দত্ত, যাঁর সঙ্গে আমরা দেখা করিনি কেননা জানতে পারি যে পুলিশের হস্তক্ষেপে ওনার কোনো ভূমিকা নেই।
আইয়ুব সাহেব, যাকে বলা হয় ‘সফ্ট স্পোকেন’, তেমন মানুষ ছিলেন, কিন্তু আমাকে আর দাদাকে দেখে দৃশ্যত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন, ক্রোধ সামলাবার জন্য কাঁপছিলেন বলা যায়। দুজন যুবক দেখা করতে চাইছে শুনে উনি আশা করেননি যে ওনার সামনে দুই মুর্তিমান হাংরি আন্দোলনকারী গিয়ে দাঁড়াবে। প্রতিষ্ঠিত ঔপনিবেশিক নান্দনিক সাহিত্যতন্ত্রের সঙ্গে উত্তর ঔপনিবেশিক প্রতিষ্ঠানবিরোধীর সংঘাত! আমি আর দাদা পাটনার ইমলিতলার স্লাম থেকে উঠে আসা যুবক, আর উনি কলকাতার ওপরতলার সম্ভ্রান্ত বুদ্ধিজীবী। উনার সঙ্গে আমাদের যে কোনো বিষয়েই মিল নেই তা কথা বলে বোঝা যাচ্ছিল। কিন্তু কেন উনি নালিশ ঠুকেছেন, তা স্পষ্ট করতে চাইলেন না। উনি সম্ভবত আমাদের পড়াশোনার গভীরতা আশা করেননি; কানাঘুষোয় শুনে ভেবেছিলেন কলকাতার বাইরের খোট্টা ছোটোলোকের দল। তখনকার দিনে এরকম ধারণাই ছিল এলিট মহলে, যে, স্লাম বা বস্তি বা উদ্বাস্তু কলোনিতে যারা থাকে তাদের জ্ঞানগম্যি বিশেষ নেই।
চিত্রে: মলয় রায়চৌধুরী
আমাদের বিরুদ্ধে আইয়ুব সাহেবের নালিশের বিষয়বস্তু আমরা জানতে পারি অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা ওনার চিঠি থেকে । চিঠিতে, আমেরিকার একজন কবি, অ্যালেন গিন্সবার্গ, আমাদের পক্ষে যুক্তি দিচ্ছেন, আর বাংলা ভাষার এক প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিক, যিনি ঘোষিতভাবে কবি-লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে, তিনি আমাদের জেলে পাঠাবার ব্যবস্থা করছেন ! আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি যে উনি আমাদের বুলেটিন আর পত্রিকা কিছুই পড়েননি। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ছাড়া উনি আর কারোর নাম শোনেননি, উৎপলকুমার বসুর নামও নয়। আমি দা যেওনার সঙ্গে দেখা করেছি, তাও উনি লিখেছিলেন অ্যালেন গিন্সবার্গকে। প্রত্যুত্তরে গিন্সবার্গ তাঁর চিঠিতে আইয়ুব সাহেবকে লিখেছিলেন, ‘বেচারা মলয়- যদি ও একজন নিম্নমানের লেখকও হয়- তা হলেও ওর জায়গায় আমি থাকলে আপনার সন্মুখীন হতে আমি ঘৃণা বোধ করতাম।’
‘মুখোশ খুলে ফেলুন’ লেখা কাগজের মুখোশ, দানব রাক্ষস জন্তু-জানোয়ার পাখি ইত্যাদির মুখোশ আমরা ওনাকে পাঠাইনি কিন্তু উনি জানতেন যে অমন মুখোশ পাঠানো হয়েছে মন্ত্রী আমলা সাংবাদিকদের। কিন্তু তাও ওনার ক্রোধের কারণ ছিল না । ওনার ক্রোধের কারণ ছিল একটা বিয়ের কার্ড, যা মূলত সাহিত্যিকদের এবং সাংবাদিকদের পাঠানো হয়েছিল; যে কার্ডে ছাপানো ছিল Fuck The Bastards Of The Gangshalik School of Poetry. উনি বোধহয় নিজেকে তথাকথিত ‘গাঙশালিক’ স্কুলের দিকের মানুষ হিসাবে মনে করে থাকবেন । দ্বিতীয়ত, ওনার সম্ভ্রান্ত শ্রেণিতে ‘ফাক’ এবং ‘বাস্টার্ড’ শব্দ দুটি ছোটোলোকদের অভিধান থেকে নেয়া মনে হয়ে থাকবে। আমি আর দাদা যখন আইয়ুব সাহেবের সঙ্গে দেখা করি তখন উনি বিয়ের কার্ডটি আর তাতে ছাপানো শ্লোগান প্রসঙ্গ একেবারেই তোলেননি অথচ অ্যালেন গিন্সবার্গকে লেখা চিঠিতে উনি লিখেছিলেন যে এই বাক্যটি ‘প্রশ্নাতীতভাবে আপত্তিকর’। তিনি এও লিখেছিলেন যে হাংরি আন্দোলনকারীরা বিটনিকদের প্রতিচ্ছায়া। বস্তুত স্লাম-বস্তি-উদ্বাস্তু কলোনির ছোটোলোক স্তর থেকে উঠে আসা বাঙালি যুবকদের সম্পর্কে আইয়ুব সাহেবের কোনো ধারণা ছিল না বলে মনে হয়।
আবু সয়ীদ আইয়ুবকে লেখা চিঠিগুলোয় অ্যালেন গিন্সবার্গ হাংরি আন্দোলনকারীদের, বিশেষ করে আমার, ম্যানিফেস্টোগুলোর, প্রশ্ংসা করছিলেন, তাও বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ করে থাকবে ওনাকে । আইয়ুবকে লেখা গিন্সবার্গের চিঠি থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি:
৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : মলয় মানুষ হিসেবে আমার পছন্দের এবং ওঁর ইংরেজিদুরস্ত ম্যানিফেস্টোর প্রাণোচ্ছলতা আমার সত্যিই ভালো লাগে। আমার মতে ও যেকোনো ভারতীয় ইংরেজি গদ্যের চেয়ে বেশি বুদ্ধিদীপ্ত।
৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : Fuck The Bastards of Gangshalik School of Poetry-র মতো একটি বাক্য নিয়ে অশ্লীলতা সম্পর্কে আপনার যা বিশ্লেষণ, তার সঙ্গে আমি একেবারেই সহমত নই । এটা যে কোন ‘স্কুল’ তা আমি জানিও না। কিন্তু প্যারিস কিংবা কলকাতার কাফেতে, ত্রিস্তঁ জারার পুরোনো ম্যানিফেস্টোতে এটাই চলতি সাহিত্যভাষা- মুখের ভাষা এবং প্রকাশিত লেখাতেও। সাহিত্যে এই কায়দা, এই আবেগ, বুদ্ধিদীপ্ত হালকা বদমাইশি বিশ শতকের ‘গ্রন্হাগার পুড়িয়ে দাও’ চিৎকারের মতোই।
৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : অনুবাদ পড়ে আমি যেটুকু বুঝেছি, মলয় এবং অন্যান্য কবিদের, যাঁদের গ্রেপতার কিংবা জেরা করা হয়েছে, কবিতা এবং ম্যানিফেস্টো যথেষ্ট তৃপ্তিদায়ক।
আবু সয়ীদ আইয়ুব
৬ অক্টোবর ১৯৬৪ : আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, এঁদের কাজে আধুনিক জীবনের নানা চিহ্ণ সুন্দরভাবে ব্যক্ত হয়েছে । এঁরা জিনিয়াস বা অসাধারণ, এমন দাবি না করেও বলা যায়, সমাজব্যবস্হার প্রতি তাঁদের যে মনস্তত্ত্বগত অনাস্হা, সেটি তাঁরা ফুটিয়ে তুলেছেন স্পষ্ট ও মৌলিক ভাষায় । অন্যদিকে, এঁদের সমসাময়িক এবং অগ্রজরা এখনও ধ্রুপদি ভক্তিভাব বা সামাজিক ‘উন্নত’ ভাবনা, মার্কসবাদ, মানবতাবাদ ইত্যাদি সম্পর্কেই অধিক আগ্রহী । আমার মনে হয় না এই লেখকদের বিটনিক আখ্যা দেওয়া উচিত, বিট-অনুকারকও নয়, কারণ শব্দটাই অত্যন্ত কাগুজে বাঁধাধরা বুলি হয়ে দাঁড়িয়েছে, এমনকি আমেরিকার মাপদণ্ড অনুযায়ী ‘বিটনিকদের’ সঙ্গে এরা খাপ খায় না।
১১ নভেম্বর ১৯৬৪ : এ একদম অসুস্হকর এক পরিস্থিতি। এরকমভাবেই সব চলতে থাকবে, এই ভেবে চিন্তিত হয়ে আমি আসলে আপনাকে তড়িঘড়ি, অতি দ্রুত চিঠি লিখেছিলাম। কারণ পুলিশ শাসনতন্ত্রের অভিজ্ঞতা আমার ভারতে থাকতেই হয়েছে। এখন কিন্তু পরিস্হিতি যথেষ্ট সংকটপূর্ণ। প্রবীণ, দায়িত্ববান কোনোও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হস্তক্ষেপ না করলে এর থেকে নিষ্পত্তি সম্ভব নয়। বোধহয় ‘ক্যালকাটা কমিটি ফর কালচারাল ফ্রিডাম’ এর প্রতি চিঠি আপনাকে উদ্দেশ করে লেখা আমার উচিত হচ্ছে না। যদি তাই হয়, তাহলে কলকাতার কংগ্রেসের দপতরে এ-বিষয়ে ভারপ্রাপ্তের হাতে দয়া করে চিঠিটি পৌঁছে দেবেন। আপনাকে রুষ্ট করে থাকলে মার্জনা করবেন। তবে, চিঠিতে অন্তত আপনাকে সোজাসুজি কথাগুলো বলছি। এই মুহূর্তে আপনার আমার মতানৈক্যের থেকেও পুলিশ পরিস্থিতিই প্রকৃত চিন্তার বিষয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন