বাংলা
কবিতায় ষাটের দশকে একঝাঁক তরুণ কবি প্রচলিত ধ্যান ধারণাকে আক্রমণ নিজেদের
‘হাংরি জেনারেশন’ বলে ঘোষণা করেন, এবং জীবনানন্দকে তাদের নিজস্ব ভাবধারার
পূর্বসূরী বলে দাবি করেন। ১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি
ইশতাহার প্রকাশের মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূত্রপাত করেছিলেন সমীর
রায়চৌধুরী, মলয় রায়চৌধুরী, শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং হারাধন ধাড়া ওরফে
দেবী রায় ।১৯৬২-৬৩ সালে হাংরি আন্দোলনে যোগদান করেন বিনয় মজুমদার,
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, উৎপলকুমার বসু, সুবিমল বসাক, ত্রিদিব মিত্র,
ফালগুনী রায়, আলো মিত্র, অনিল করঞ্জাই, রবীন্দ্র গুহ, সুভাষ ঘোষ,
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়, প্রদীপ চৌধুরী, সুবো আচার্য, অরুপরতন বসু,
বাসুদেব দাশগুপ্ত, সতীন্দ্র ভৌমিক, শৈলেশ্বর ঘোষ, হরনাথ ঘোষ, নীহার গুহ,
আজিতকুমার ভৌমিক, অশোক চট্টোপাধ্যায়, অমৃততনয় গুপ্ত, ভানু চট্টোপাধ্যায়,
শংকর সেন, যোগেশ পাণ্ডা, মনোহর দাশ, তপন দাশ, শম্ভু রক্ষিত, মিহির পাল,
রবীন্দ্র গুহ, সুকুমার মিত্র, দেবাশিষ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ । অনিল এবং
করুনা ছিলেন চিত্রকর । সত্তর দশকের শেষে যাঁরা পুনরায় আন্দোলনটিকে জিইয়ে
তোলার চেষ্টা করেন তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন অরুণেশ ঘোষ, অরণি বসু,
অরুণ বণিক, অলোক গোস্বামী, আপ্পা বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্য মালাকার, কিশোর
সাহা, জামালউদ্দিন, জীবতোষ দাশ, দেবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, নির্মল হালদার,
দেবজ্যোতি রায়, পার্থপ্রতিম কাঞ্জিলাল, প্রিতম মুখোপাধ্যায়, বিজন রায়,
রবিউল, সমীরণ ঘোষ, রতন নন্দী, রাজা সরকার, সত্যেন চক্রবর্তী, সৈকত রক্ষিত,
সুব্রত রায়, সুব্রত চক্রবর্তী, রসরাজ নাথ, সেলিম মোস্তফা, শঙ্খপল্লব
আদিত্য, সুভাষ কুন্ডু , স্বপন মুখোপাধ্যায় প্রমুখ ।হাংরি আন্দোলনের
বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের রিডার ড, শঙ্কর ভট্টাচার্য
লিখেছেন যে সেগুলো “সাধারণত প্রতিবাদ-মুখর, আনুষ্ঠানিকতা-বর্জিত,
প্রাতিস্বিকতায় ভঙ্গুর, অস্হির, আস্বস্তিকারক, ছকহিন, ঐক্যহীন, খাপছাড়া,
এলোপাতাড়ি ও আয়রনিমূলক” । কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগীব প্রধান
ড. তরুণ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন, “ভাষায়, ছন্দে, অলংকার, স্তবকে তুমুল
ভাংচুর” করেছেন তাঁরা, এবং “যৌনতার সঙ্গে এসেছে ব্যঙ্গ, আত্মপরিহাস ও
অসহায় মানুষের নিস্ফলতার যন্ত্রণা; আত্মপ্রক্ষেপ ঘটিয়ে তঁরা নিরপেক্ষ
হয়ে যান” । মাত্র চার বছর স্থায়ী হয়েছিল এই আন্দোলন । সুনীল , শক্তি,
বিনয় মজুমদার, উৎপল বসু, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়রা হাংরি দর্শনেই প্রভাবিত
হয়ে তাদের কাব্যজীবন শুরু করেছিলেন । সুনীলের ‘কৃত্তিবাস’ অবশ্য ঘোষণা
করেছিল হাংরি আন্দোলনের সঙ্গে তাদের সম্পর্ক নেই । সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
নিজেও তাঁর অবস্থান পরিস্কার করে জানিয়েছিলেন “আমি হাংরি জেনারেশান পছন্দ
করি না (সাহিত্য আন্দোলন হিসেবে),আমি ওদের কিছু-কিছু পাজী ব্যবহারে বিরক্ত
হয়েছি”। শক্তি চট্টোপাধ্যায় ১৯৬৪ তেই হাংরি সঙ্গ ত্যাগ করেছিলেন ।
বিনয় মজুমদার, উৎপল বসুরাও মূল স্রোতে ফিরে বাংলা কাব্য জগতকে দারুণ
সমৃদ্ধ করলেন । “ধরো, আমি একটি কবিতা পড়লাম। তারপর সেই কবিতা থেকে মনে মেন
আবৃত্তি করলাম- ‘আমি ফাগুন এলে কুড়িয়ে নেব’। সঙ্গে সঙ্গে কবির মুখটা আমি
দেখতে পাচ্ছি-হাবড়া প্ল্যাটফর্মে”। – বিনয় মজুমদারের এই উপলব্ধিই যেন কবি,
এবং কবিতা। কবির জীবনযাপনের সঙ্গেই, তাঁর কবিতার উপলব্ধি বসবাস করে। পাঠকও
এই উপলব্ধির মধ্যে প্রবেশ করে। তখন কবি এবং কবির দর্শনকে পাঠক দেখতে পায়।
কবির প্রতিটি কবিতা একটি অভিজ্ঞতামুহূর্ত। তাঁর কাব্যের প্রকাশ হয়ে ওঠে
অভিজ্ঞতার ডায়রি।
স্বাধীনতা
পরবর্তী পঞ্চাশ – ষাট – সত্তর দশকের সময় কালটা বাংলার সমাজ জীবনের এক
ক্রান্তিকাল বলেই চিহ্নিত । একদিকে তীব্র প্রতিষ্ঠান বিরোধী গণ আন্দোলন
যাকে আরো তীব্রতর হওয়ার রসদ যোগাচ্ছিল সেই সময়ের সাহিত্য, নাটক । এবং
৬৯’এ তরাই’এর নকশাল বাড়ির কৃষক বিদ্রোহ । যে সময়কালে কবিতা- গল্প-
উপন্যাসে মানুষ কান পেতে আরো বেশি ‘সময়ের প্রতিধ্বনি’ শুনতে চাইছিল , এই
সব অনিবার্য চাহিদাগুলো যারপরনাই খামচে ধরে সত্তর আশির দশকে কবিতা লিখতে
আসা একঝাঁক মেধাবী তরুণকে। তাঁরা প্রথমেই এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি হন যে,
তাঁরা কেন, জাতি হিসাবে কী হবে তাঁদের প্রকৃত পরিচয়, স্বজাতির মধ্যেই কেন
বিভেদ বৈষম্যের চোরাজাল, তাঁদের আত্মপরিচয়ের সঠিক সংজ্ঞা নিরূপণে কেনইবা এত
আলোছায়া, মেঘরৌদ্রের লুকোচুরি খেলা! এবং এসব জিজ্ঞাসা থেকেই ষাটের কবিরা
আত্মআবিষ্কার ও আত্মসম্মানবোধ নিয়ে নিজেদের সঠিক পরিচয় রচনা করতে শেখেন।
শেখেন কবিতায়, রাজপথে, বিবৃতিতে, ঘরে-বাইরে, অন্তরে। এ সময়ে কবিতা লিখে
ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিদের মধ্যে অন্যতম মল্লিকা সেনগুপ্ত সুবোধ সরকার
কৃষ্ণা বসু জয় গোস্বামী,আশীষ স্যন্যাল, শুভ দাশগুপ্ত, পরবর্তী দশকের
(সত্তর, আশি কিংবা নব্বইয়ের) কবিদের মধ্যেও দুই বাংলাতেই তসলিমা নাসরিনের
দাপট খুব কম নয়। জয় গোস্বামীর চাইতে তার পাঠকপ্রিয়তা বেশি না হলেও কম
নয়।এরপরেও রয়েছেন মন্দক্রান্তা সেন, পল্লব কীর্তনীয়া, প্রমুখেরা।
আলাদা
করে কারো নাম উল্লেখ না করেও বলাই যায় নয়ের দশক পেরিয়ে শূণ্য দশকে এসে অনেক
বেশি সাবালক হয়েছে বাংলা কবিতা। নব্বই ও শূন্য এই দুই দশক মধ্যবর্তী সময়ে
বাংলা গান…সুমন থেকে বাংলা ব্যান্ড…যেভাবে নিজেকে ভেঙ্গেছে…তা বাংলা
কবিতাকে অনিবাযত পরিশীলিত করেছে।মহীনের ঘোড়াগুলির মণিদা বা
সুমনচট্টোপাধ্যায়(অধুনা কবীর)-এর কাছে আমাদের,বাংলা কবিতালিখিয়েদের ঋণ
অনেক।আর এ সময়ে আবার বেশ কিছু লিটল ম্যাগাজিন কলকাতা ছাড়াও বাংলা ভাষাভাষী
নানান অঞ্চল থেকে বেরোতে থাকে,এই দুই দশকের সাহিত্যে যেগুলি খুবই
গুরুত্বপূণ্র। প্রিন্টমিডিয়া, ব্লগ, লিটল ম্যাগাজিন( লিটল হলেও সেই সন্দীপ
দত্তর ভাষায় লোডেড ম্যাগাজিন.)আধুনিক কবিতার জোয়ারে প্রাণ ঢেলে দেয়।
একঝলক
নজর ফেরাই বাংলাদশের দিকে।সুচারুভাবে বাংলাসাহি্ত্যের চর্চা চলছে সেখানেও।
নজরুলের পর এই চল্লিশের দশকেই আরো বেশ কয়েকজন আধুনিক কবিকে পাই: ফররুখ
আহমদ, আহসান হাবীব ও সৈয়দ আলী আহসান এর মধ্যে প্রধান। সৈয়দ আলী আহসান ভাঙা
গদ্য ও টানা গদ্য কবিতাও লিখেছেন। সাতচল্লিশে দেশ বিভাগের পর কবিরাও ভাগ
হয়ে গেছেন।হাসান হাফিজুর রহমান, সুফিয়া কামাল আল মাহমুদ প্রমুখ কবিরা
পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কবি হিসাবে স্বীকৃতি পান। বলা হয়,ত্রিশের কবিদের পর
বাংলা কবিতায় সবচেয়ে জনপ্রিয় চার কবি হলেন, শামসুর রাহমান, সুনীল
গঙ্গোপাধ্যায়, আল মাহমুদ এবং শক্তি চট্টোপাধ্যায়। দুজন এ বাংলার, দুজন ও
বাংলার; শামসুর রাহমান শুরুতে মাত্রাবৃত্ত ছন্দকে প্রাধান্য দিয়ে তিন
ছন্দেই লিখেছেন; কিন্তু তিনি শামসুর রাহমান হয়ে উঠেছেন মুক্তক অক্ষরবৃত্তে
কবিতা লিখেই। শামসুর রাহমানের অধিকাংশ কবিতা মুক্তক অক্ষরবৃত্তে সাজানো।
তিনি মুক্তিযুদ্ধের এবং শহরের আধুনিক কবি হিসাবেই নিজেকে মেলে ধরেছেন। তিনি
মাত্রাবৃত্ত ছন্দ, স্বরবৃত্ত, গদ্য ছন্দ কিংবা সনেট-সবর্ত্রই সাবলীল;
কিন্তু মুক্তক অক্ষরবৃত্ত তার স্বাভাবিক ছন্দ। শামসুর রাহমানের পর
গুরুত্বপূর্ণ কবি আল মাহমুদ। একইভাবে তিনিও শুরু করেছিলেন ছন্দোবদ্ধ কবিতা
লিখে। তার সবচেয়ে আলোচিত কাব্যগ্রন্থ তিনটি হলো ‘লোক লোকান্তর’, ‘কালের
কলস’ ও ‘সোনালী কাবিন’। আল মাহমুদ প্রথম দুটি কাব্যগ্রন্থ লিখে কবিখ্যাতি
পেলেও সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়েছেন ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যগ্রন্থের সনেটগুলো
লিখে। তবু তার শেষ আশ্রয় আধুনিক গদ্য কবিতায়। রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক,
হুমায়ুন আজাদ একই সময়ের অন্যতম প্রধান কবি। এর মধ্যে হুমায়ুন আজাদ তার শেষ
কাব্যগ্রন্থ ‘পেরোনোর কিছু নেই’ -এ ছন্দ ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন। হয়তো
গদ্য কবিতাতেই কাব্য সম্পূর্ণভাবে প্রকাশ পায়। গদ্য কবিতা কবিতার
বিবর্তনের আধুনিকতম রূপ। বিশ শতকের শেষ কয়েক দশক ও একুশ শতকের শূন্য দশকে
এসে আমরা বাংলাদেশে অসংখ্য তরুণ প্রতিশ্রুতিশীল কবির দেখা পাই। বদরে মুনীর,
আলফ্রেড খোকন, কামরুজ্জামান কামু, রহমান হেনরী, টোকন ঠাকুর, সরকার আমিন,
ব্রাত্য রাইসু, তপন বাগচী, সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ, রেজাউদ্দিন স্টালিন, আবু
হাসান শাহরিয়ার, জাহিদ হায়দারসহ আরো অনেকে কবি স্বীকৃতি পেয়েছেন। শুন্য
দশকের কবিঃ অনিন্দ্য আকাশ, অপূর্ব সোহাগ, আলী প্রয়াস, ত্রিস্তান আনন্দ,
অবনি অনার্য, আদিত্য অন্তর, নির্লিপ্ত নয়ন, সজল সমুদ্র, হিমেল বরকত,
সোমেশ্বর অলিঃমধুক্ষরা…এরা গদ্য কবিতার উন্নয়ন ঘটিয়েছেন, এগিয়ে নিচ্ছেন।
কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ সহজ হওয়া বা অনেক বেশি কবিতা লেখায় তাদের কাব্যগ্রন্থের
সংখ্যা অনেক। কিন্তু একটি বহুল আলোচিত কবিতা এদের কাছ থেকে আসেনি। আরো আগে
রুদ্র মোহাম্মদ শহিদুল্লাহর ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ তুমুল আলোচিত হয়েছিল।
হেলাল হাফিজ প্রকৃতপক্ষে একটি কাব্যগ্রন্থই রচনা করেছেন, ‘যে জলে আগুন
জ্বলে’। এই কাব্যগ্রন্থের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ এখন যৌবন যার মিছিলে যাওয়ার
তার শ্রেষ্ঠ সময়সহ বেশ কয়েকটি গদ্য কবিতা জনপ্রিয়তা পায়। কবিতার উদ্দেশ্য,
পরিধি, গঠন, কৌশল, ছন্দ, আবৃত্তি ইত্যাদি কারণে দশকে দশকে বদলে গেছে কবিতা।
কবিতার পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে নিয়মিত।
আধুনিক
কবিতা হলো একটি শব্দ শব্দ খেলা। উপমা, উৎপ্রেক্ষা এবং ভাবানায় তা হয়ে ওঠে
আরো পরিপূর্ণ। যিনি যতো বেশি শব্দ নিয়ে খেলবেন তিনি ততো বেশি ভালো লিখবেন।
প্রতিটি শব্দ যদি হ’য়ে ওঠে চিত্রকল্প তবেই না কবিতার স্বার্থকতা। তারপর
অন্তমিল, ছন্দের বুনন, শব্দ চয়ন তো আছেই। তবে ছন্দহীন টানা গদ্যের শেষে
অন্তমিল কোনো কবিতার পর্যায়ে পড়ে না। সেটাকে নিতান্ত পদ্যের পর্যায়েও ফেলা
যায় না। পদ্যেও কিন্তু ছন্দ থাকে, তবে কবিতার মতো ভাবানার বিশালতা, উপমা,
উৎপ্রেক্ষা বা চিত্রকল্পের বালাই নেই সেখানে। আছে শুধু গল্প-উপন্যাসের মতো
ধারা বর্ণনা।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন