শুক্রবার

নিও-হাংরি -- হাংরি আন্দোলনের নতুন প্রজন্ম



নিও-হাংরি



  • হাংরি আন্দোলন কি? কেন? কিভাবে?
সালটা ১৯৬৪, পশ্চিমবাংলার সংবাদপত্র,পত্রিকা,ট্যাবলয়েডগুলো বেশ মশলা মাখিয়ে,কষে রান্না করে,গার্নিশ করে ‘কালচারাল বাস্টার্ড’ আর তাঁর ‘হা-ঘরে সম্প্রদায়’কে নিয়ে,বাঙালির জন্য এক উপাদেয় পদ পরিবেশন করতে লাগলো।বিষয় : ‘হাংরি মোকদ্দমা’।
এরও বছর তিনেক আগের নভেম্বর মাসে বছর বাইশের এক বাঙালি তরুণ মলয়,তাঁর দাদা সমীর রায়চৌধুরী,শক্তি চট্টোপাধ্যায়,দেবী রায়(হারাধন ধাড়া)- এঁদের নিয়ে শুরু করেছিলেন বাংলা ভাষার একমাত্র ও আজও অবধি সবথেকে বেশি সাড়া জাগানো আন্দোলন —‘হাংরি আন্দোলন’। বিহারের পাটনায় বাংলা ছাপাখানার অভাবে সেবছরই(১৯৬১) ইংরেজিভাষায় প্রথম ইশতেহার প্রকাশের মধ্যে দিয়ে সূচনা হল স্থিতাবস্থা ভেঙ্গে দেওয়ার এক দুঃসাহসিক অভিযান। সেই থেকে ১৯৬৫ সাল অবধি পুরোদমে শতাধিক(প্রায় ১০৮টি) ইশতেহার প্রকাশিত হয়।সমকালীন সাহিত্যচর্চা,রাজনীতি,অর্থনীতি,মুক্তি- এসবই ছিল মূল বিষয়।এছাড়া আন্দোলনের মুখপত্র এক পৃষ্ঠার বুলেটিন আকারে প্রকাশ করে হ্যান্ডবিল ছেপে কলেজ,ইউনিভার্সিটি,বইপাড়া,কফিহাউস,সমকালীন আঁতেলদের সমস্ত আখারায় বিলি করা চলতে থাকে। মলয় রায়চৌধুরী সম্পাদিত ‘জেব্রা’, প্রদীপ চৌধুরীর ‘ফুঃ’, সুবিমল বসাকের ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, দেবী রায়ের ‘চিহ্ন’, ইংরেজিতে আলো মিত্রের ‘The Waste Paper’ – এই পত্রিকাগুলি হাংরিয়ালিস্টদের মঞ্চ ও অবাধ বিচরনক্ষেত্র হয়ে ওঠে।বাঙালির সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক কার্যকলাপে সম্ভবত প্রথম প্রতিষ্ঠানবিরোধী গোষ্ঠী এই হাংরি জেনারেশানের কবি-সাহিত্যিকরা।তবে বলাবাহুল্য নিজেদের ঐসব পত্রপত্রিকায়, লিটল-ম্যাগাজিনে আটকে থাকেননি এঁরা। ‘মুখোশ খুলে দাও’ কর্মকাণ্ড বিশেষ সাড়া ফেলেছিল। প্রশাসন একপ্রকার বাধ্য হয়েছিল এই আন্দোলনের গতিরোধ করতে। নেতা,মন্ত্রী,সমালোচক,প্রশাসক,আমলা,মিডিয়া,ঘোমটার নীচে খ্যামটা শ্রেণীভুক্ত কেউই রেহাই পায়নি।মামলা,প্রেফতারি পরোয়ানা,হাজতবাস,ইন্টারোগেশন,সাস্পেনশন,ট্রান্সফার এসবের মাঝেও আন্দোলন চলতে থাকে। দীর্ঘ ৩৫ মাস ধরে চলা (১৯৬৮-৬৭) ‘হাংরি মোকদ্দমা’ এনে দিয়েছিল বিশ্বজোড়া খ্যাতি।
  • প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার ও মলয় রায়চৌধুরী
‘Modern And Postmodern Poetry of the Millenium’ – ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক প্রকাশিত সংকলনে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মলয় রায়চৌধুরী রচিত বিতর্কিত ‘প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার’ ছিল একমাত্র কবিতা।১৯৬৪সালে হাংরির বুলেটিনে প্রকাশিত এই কবিতার জন্য মলয়বাবুকে অশ্লীলতার দায়ে গ্রেফতার করা হয়। তৎকালীন পত্রপত্রিকা এই ঘরানার সাহিত্যচর্চাকে ‘বেহুদা’ আখ্যা দিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপ করলেও ১৯৬৭সালে মলয় বাবুর পক্ষে এই মামলার নিষ্পত্তি হয় ও লাতিন আমেরিকা,ইউরোপের পত্রিকাগুলিতে হাংরির পক্ষে সওয়াল জোরদার হতে থাকে। পরবর্তীতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বহুভাষায় ও ভারতেও বিভিন্ন ভাষায় এই কবিতা অনুবাদ করা হয় ও সমাদৃত হয়।
  • পালাবদল
হাংরি মোকদ্দমায় মলয়বাবুর পক্ষে প্রথিতযশা সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সাক্ষ্যদান, ‘কৃত্তিবাস’ থেকে মলয়বাবুর লেখা ‘শয়তানের মুখ’(১৯৬৩) প্রকাশ, এসব কারণে অনেকেই সে’সময় কৃত্তিবাস গোষ্ঠীকে হাংরির পৃষ্ঠপোষক-মঞ্চ ভাবতেন। পরে অবশ্য বিভিন্ন কারণে(কারণ যদিও অনুমেয়) কৃত্তিবাসের পক্ষ থেকে স্বাভাবিকভাবেই এ ব্যাপারে তাঁদের দায় না থাকার কথা জানিয়ে দেওয়া হয়।সাহিত্য ও কবিতাচর্চার গণ্ডির বাইরে এদেশে ও ভিনদেশে হাংরিয়ালিস্টদের কিছু কর্মকাণ্ডকে ‘যথেচ্ছাচার-ব্যাভিচার’ তকমা দেওয়া চলতে থাকে। এসব কারণে সংবাদ শিরোনামে থাকায় অবশ্য শাপে বরই হয়েছিল বলেই সমালোচকদের মত। এরই মাঝে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মত বেশ কিছু কবি-সাহিত্যিক হাংরি মুভমেন্ট ত্যাগ করেন।
নকশাল পরবর্তীকালে পশ্চিমবাংলা আর ত্রিপুরার কিছু কবি-সাহিত্যিকের লেখায় হাংরিকে আবার ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হলেও সম্ভবত তাত্ত্বিক দিকটা সেভাবে জানা না থাকায় ও প্রয়োগ আর সাংগঠনিক যোগাযোগের অভাবে বিশেষ সারা জাগাতে পারেনি।
  • নিও-হাংরি : হাংরি আন্দোলন ফিরছে
টেবলল্যাম্প ও সিগারেট জ্বালিয়ে, সেরিব্রাল কর্টেক্সে কলম ডুবিয়ে কবিতা বানাবার কাল শেষ হয়ে গেছে…এখন কবিতা রচিত হয় অরগ্যাজমের মত স্বতঃস্ফূর্তিতে … অথবা জলে ডুবে সচেতনভাবে বিহ্বল হলেই , এখন কবিতা সৃষ্টি সম্ভব… –(কবিতা বিষয়ক হাংরি আন্দোলনের প্রথম বাংলা ইস্তেহার,নভেম্বর’১৯৬১)
বাংলাসাহিত্যের স্থিতাবস্থাকে ভেঙ্গেচুরে চুরমার করে দিয়েছিল যে আন্দোলন সেটার একটা সামাজিক-রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপট ও প্রয়োজনীয়তা ছিল। অনেকেই মনে করেন এখন আর আন্দোলন-ফান্দোলন সম্ভব নয়। তাঁর কারণ হিসেবে তারা ভোগবাদী সমাজের দ্রুতির কথা বলেন। ভোগবাদী ক্ষুধার পরিসরে মননের এই ক্ষুধা আন্দোলনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অনেকেই সন্দিহান। কেউ কেউ আবার নাকও সিটকে থাকেন। নিও-হাংরিয়ালিস্টরা অবশ্য বলে -এসব সমালোচনায় তাঁদের ‘ছেড়া’ যায়।
প্রতিষ্ঠানবিরোধী লেখা, তাতে খিস্তির ব্যবহার, যৌন চিত্রকল্প – এসব আজকাল হামেশাই হচ্ছে। এই এলিমেন্টগুলো আধুনিকতাবাদী লেখকেরা ব্যবহার করেন নিজের ইমেজ তৈরি করতে আর সাহিত্য সমালোচক আর প্রকাশকরা লেখকের ইমেজকে পুঁজি করেন। সাহিত্য আলোচনায় ভাবমূর্তির ক্যানন নিয়ে আদিখ্যেতা আসলে ইউরোপীয় অধিবিদ্যাগত মননবিশ্ব। সাহিত্যের ক্ষেত্রে মিডিয়া আর বাজারের দাপট এমন সর্বগ্রাসী ভোগবাদে প্রসারিত যে শুধুমাত্র সাহিত্যক্ষেত্র থেকে সৃষ্ট আন্দোলন জনমানসে প্রভাব বিস্তার করতে গেলে তাকে ভীষণভাবে শক্তিশালী হতে হবে তাত্ত্বিক দিক থেকে। পোস্টমডার্ন সাহিত্যে সমাজ ও সাহিত্যের রৈখিক প্রগতিকেই চ্যালেঞ্জ জানানো নিও-হাংরির উদ্দেশ্য।
ঘরে-বাইরের এই ভাষাজোচ্চুরি আর বিদঘুটে পেঁকো বাংলার ব্যবহার ঠিক যেন হাফ-ন্যাংটো নৃতত্ত্ব।নিজেদের স্থবিরতা, নিষ্ক্রিয়তা, স্থিতাবস্থা সম্পর্কে আমরা কমবেশি সবাই ওয়াকিবহাল। কেউ কেউ আর নিতে না পেরে হাঁসফাঁস করছি।কিন্তু প্রশ্নটা হচ্ছে …করনীয় কি? হ্যাঁ ঠিক এই সচেতনতার কাজটাই নিও-হাংরি জেনারেশানের। ভাষার অন্দরমহল-বারমহল এই পার্থক্য ঘুচিয়ে দিতেই আবারও একটা নাড়া দেওয়ার প্রয়োজন আছে।
আত্মপ্রসাদ উদরস্থ করে ক্ষুধা নিবারণের কোনো স্থান নেই,নেই ব্যক্তিপুজোর কোনো জায়গা।প্রয়োজন নেই অর্থ,যশ,খ্যাতি প্রতিপত্তির… দু’বেলা নিয়ম করে হাওয়াই-ধোয়া জল খেয়ে, সংস্কৃতিবান,বুদ্ধিজীবির মুখোশ পড়ে ঢ্যামনামো করে চলেছে এক শ্রেণীর লোক আর একদল অন্যের মুখোশ দেখিয়ে ‘আমি তোমাদেরই লোক’ হতে চাইছে, আবার সময় সুযোগ বুঝে ডিগবাজি খাচ্ছে।আর আমরা পক্ষে-প্রতিপক্ষে-দুপক্ষেই তাল ঠুকে জাতি হিসেবে সংস্কৃতিবান জারজে পরিণত হচ্ছি।সবার সবরকমের মুখোশ ছিঁড়ে ফেলতেই আবার আসছে ‘হাংরি আন্দোলন’।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন