শুক্রবার

হাংরি আন্দোলন -- বাংলা সাহিত্যে এক অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ


হাংরি আন্দোলন -- এক অভূতপূর্ব দ্রোহের বিস্ফোরণ...



হাংরি আন্দোলন, বাঙলা সাহিত্যের এক অদ্ভুত ক্রান্তিকালে আরও অদ্ভুতুড়ে এক আন্দোলনের নাম।মাত্র ২১ বছর বয়েসে কলকাতার কবি মলয় রায় চৌধুরীর মাথার পেছন দিকের গ্রে সেলগুলোতে যখন এই আন্দোলনের দামামা প্রথম বেজে উঠল, তখন কেউ হয়তবা ধারনাও করতে পারেননি যে একসময় এই আন্দোলনই পাল্টে দেবে রবীন্দ্র-নজরুল পরবর্তী বাঙলা সাহিত্যের স্রোতধারা, বদলে দেবে অন্য সংস্কৃতি থেকে ধার করা ময়ুর পুচ্ছ দিয়ে কালজয়ী সাহিত্য তৈরির মত সাময়িক আত্মঘাতী প্রবনতাকে।

স্বদেশী আন্দোলনের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী নেতাদের দেখানো এক সুখী-সমৃদ্ধ উন্নত দেশের স্বপ্ন যখন টকে গিয়ে পচতে শুরু করল আর সেই পচনের ধারা ধীরে ধীরে বাঙলা সংস্কৃতির সৃজনশীলতাকে খেতে শুরু করে কালজয়ী সাহিত্যিক জন্মাবার সব পথ রুদ্ধ করে দেবার সকল আয়োজন প্রায় শেষ করে এনেছে, তখনই আবির্ভাব ক্ষুধিতের আন্দোলন বা ক্ষুধার্তের আন্দোলনের যা বাঙলা সাহিত্যের ইতিহাসে হাঙ্গরি আন্দোলন নামে সমধিক প্রচলিত।
ইংরেজ কবি জিওফ্রে চসারের " ইন দি সাওয়ার হাংরি টাইম থেকে অনুপ্রানিত এ আন্দোলনে অনুরনিত হয়েছিল তৎকালীন সময়ের আমেরিকার বিখ্যাত বিট জেনারেশন আর ইংল্যান্ডের অ্যাংরি ইয়াং ম্যান আন্দোলনগুলো। মূলত যে মতবাদ এ আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে সেটা হল সমাজতাত্ত্বিক অসওয়াল্ড স্পেংলারের দি ডিক্লাইন অব দি ওয়েস্ট গ্রন্হটির দার্শনিক তত্ত্ব। তিনি বলেছিলেন,একটি সংস্কৃতি কেবল সরলরেখা বরাবর যায় না; তা একযোগে বিভিন্ন দিকে প্রসারিত হয় । তা হল জৈবপ্রক্রিয়া, এবং সেকারণে সমাজটির নানা অংশের কার কোনদিকে বাঁকবদল ঘটবে তা আগাম বলা যায় না । যখন কেবল নিজের সৃজনক্ষমতার ওপর নির্ভর করে, তখন সংস্কৃতিটি বিকশিত ও সমৃদ্ধ হয় । তার সৃজনক্ষমতা ফুরিয়ে গেলে, তা বাইরে থেকে যা পায় ত-ই আত্মসাৎ করতে থাকে, খেতে থাকে, তার ক্ষুধা তখন তৃপ্তিহীন । । হাংরি আন্দোলনের কুশিলবদের মনে হয়েছিল, দেশভাগের ফলে বাঙলা সংস্কৃতির সৃজনক্ষমতা নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ধার করা সাংস্কৃতিক ঐশ্বর্য কেবল আমাদের সংস্কৃতির কফিনে শেষ পেরেকই ঠুকে দেবে না, উনিশ শতকের মত সাহিত্য দিকপাল জন্মানোর প্রক্রিয়া পুরোপুরি রুদ্ধ করে দেবে।তাদের এ ভাবনার পেছনে যথেষ্ট যুক্তিও ছিল। তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যুক্তিটা হয়তোবা হতে পারে সুকান্তের অকাল মৃত্যু এবং তারপরে বাঙলা সাহিত্যের হাল ধরবার মত আর কোন উজ্জ্বল নক্ষত্রের অনুপস্থিতি। ফলে সাহিত্যজগতে সৃষ্টি হয় এক বিশাল শূন্যতা। এটা ছাড়া এই আন্দোলনের কারন আর কি কি থাকতে পারে সে ব্যাপারে পাঠকের কাছে মতামত আশা করছি। সাহিত্যের প্রতিটি শাখায় মেধার মৌলিকত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে যখন সর্বভুক প্রজাতির খাদক হবার মাধ্যমে(লেখক ও পাঠক উভয়ই)বাঙলা সাহিত্যকেই একটা ভাগাড়ে পরিনত করবার চেষ্টা চলছিল, তখনই এইসব সাহিত্যদৈনের বিরুদ্ধে হাংরি আন্দোলনের প্রকাশ ঘটে ঝঞ্ঝারবেগে, সমাজ-সংসার সব সচকিত করে দিয়ে...

১৯৬১ সালের নভেম্বরে পাটনা শহর থেকে একটি ইশতেহার(না, ভুল পড়েননি)প্রকাশ করবার মাধ্যমে হাংরি আন্দোলনের সূচনা করেন মলয় রায় চৌধুরী, তার দাদা সমীর রায় চৌধুরী, সমীরের বন্ধু শক্তি এবং মলয়ের বন্ধু হারাধন ধাড়া ওরফে দেবী রায়। পরে তাদের সাথে যোগ দিয়ে আন্দোলনকে বেগবান করেন সুবিমল বসাক, ফালগুনি রায়,বিনয় মজুমদার, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়,প্রদীপ চৌধুরী,ত্রিদিব মিত্র,উৎপলকুমার বসু,বাসুদেব দাশগুপ্ত,রবীন্দ্র গুহ,অনিল করনজাই,সুভাষ ঘোষ,সুবো আচার্য,শৈলেশ্বর ঘোষ প্রমুখ... এখানে বলে রাখা ভালো মলয়ের দাদার শ্যালিকা শীলা চট্টোপাধ্যায়ের প্রেমিক ছিলেন শক্তি চট্টোপাধ্যায় এবং তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্হ হে প্রেম হে নৈঃশব্দ্য-এর প্রেমের কবিতাগুলো শীলার প্রেমে লিখিত ।
হাংরি আন্দোলনের উদ্দেশ্য সংবলিত প্রথম ইশতিহার মলয় রায় চৌধুরীর লেখনি থেকে সরাসরি তুলে দেয়া হল---
১. অ্যারিস্টটলের বাস্তবতাকে কখনও নকল করা হবে না, কিন্ত বলাতপ্রস্তুতির মাধ্যমে আচমকা জাপটে ধরতে হবে অপ্রস্তুত ছেনালি অস্তি ।
২. নৈঃশব্দকে অটুট রেখে নির্বাককে বাস্তব হয়ে উঠতে হবে ।
৩. ঠিক সেই রকম সৃষ্টি-উন্মার্গে চালিত হতে হবে যাতে আগে থাকতে তৈরি পৃথিবীকে চুরমার করে পুনর্বার বিশৃঙ্খলা থেকে শুরু করা যায় ।
৪. লেখকের চেতনাকে বর্জন করে প্রতিটি অন্য বোধ-জরায়ুকে কাজে লাগানো হবে ।
৫. ফাঁস করে দেয়া হবে যে, কেবল কান্তি- সত্তা হিসাবেই জীবন ও অস্তিত্ব স্বীকৃত ।
৬. অন্যের প্রদত্ত বোধ- জ্ঞানের চেয়ে বরং সমস্তরকম সন্দেহ ও অসহায়তাকে গ্রহণ করা হবে ।
৭. দ্বিপদ-উন্নতিকামী প্রাণীদের তাবৎ মূল্যবোধকে আক্রমণ করে ছারখার করা হবে ।
৮. চরম সততার উদ্দেশ্যে সবরকম চাটুকারদের মাগিদের শপৎপূর্বক পরিত্যাগ করা হবে ।
৯. আত্মাবিষ্কারের পর লেখা আর আঁকা ছেড়ে দেয়া হবে ।
আজ এ পর্যন্তই... এর পরের কিস্তিতে হাংরি আন্দোলনের কুশিলবদের সৃষ্টিকর্ম, তাদের সংস্কার তাদের কার্যক্রমের বিরুদ্ধে সরকারের মামলা, আন্দোলনের সমাপ্তি ও পুনঃআন্দোলনের চেষ্টা এবং বাঙলা চলচিত্রে হাংরি আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে আলোচনা করা যাবে...

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন