বৃহস্পতিবার

যখন করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে গাঁজা-আফিম-চরসের গুলি ফুঁকতুম

যখন করুণানিধানের সঙ্গে গাঁজা-আফিম-চরসের গুলি ফুঁকতুম



করুণানিধান মুখোপাধ্যায় ছিল হাংরি আন্দোলনের হেনরি মিলার, লেখালিখি বজায় রাখলে ‘ট্রপিক অফ ক্যানসার’-এর আদলে নিজের জীবন নিয়ে একখানা উপন্যাস লিখে ফেলতে পারতো । হেনরি মিলারের মতনই সকাল থেকে উঠে খাবার যোগাড়ের চেষ্টা, কারোর কাঁধে চেপে পরিবারের জন্যে কিছু টাকা যোগাড় করে স্ত্রীকে কিছুকালের জন্যে দিয়ে বাড়ি ছেড়ে লোপাট হওয়া, বাড়ি মানে একটা মন্দির চত্তর যা কখনও কোনো জমিদারের ছিল আর দেখাশোনার অভাবে করুণার জিম্মায় এসে পড়ে, কোনো যুবতী রাজি হলেই তার সঙ্গে শোয়া, ষাটের দশকের শুরু থেকে বেনারসে হিপিনীদের আস্তানা গাড়তে সাহায্য করা, হিপি-হিপিনীদের জন্যে মাদকের ব্যবস্হা করা, তাদের সঙ্গে শোয়া, মাদকের নেশা করা, ছবি আঁকা, কতো কি যে করেছে করুণা, এমনকি নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়ে বেনারস ছেড়ে পালিয়েছে । হেনরি মিলারের মতনই নানা গালমন্দ ও নিজেই আবিষ্কার করেছিল, প্রয়োগও করতো কথায় কথায় ।
করুণানিধান মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিল ষাটের দশকে, কাঞ্চনকুমার মুখোপাধ্যায়ের মাধ্যমে । তারপর সত্তরের দশকে কাঞ্চন যখন নকশাল আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল তখন করুণানিধান আর অনিল করঞ্জাইও যোগ দিয়েছিল, ফলে ওদের বেনারস ছেড়ে রাতারাতি পালাতে হয় ।
কাঞ্চনকে ওদের বিশাল বাড়ি বিক্রি করে দিয়ে বেনারস ছাড়তে হয়েছিল । কাঞ্চনের নকশাল আন্দোলনে যুক্ত হবার কারণে কাঞ্চনের ভাইকে কলকাতা পুলিশের চাকরি ছাড়তে হয়েছিল । বেনারসে গেলে সাধারণত কাঞ্চনদের গ্যারাজের ওপরের ঘরটা ছিল হাংরি আন্দোলনকারীদের জন্য ।
ব্যাংকশাল কোর্টে আমার মামলার সময়ে কাঞ্চন কলকাতায় এলে ওর পুলিশ ভাইয়ের কোয়ার্টারে রাত কাটিয়েছি অনেকসময়ে, কোয়ার্টারটা ছিল ভবানী ভবনের পেছনে ।
নকশাল আন্দোলনের কারণে পুলিশ ওদের বেনারসের ছবি আঁকার স্টুডিও লণ্ডভণ্ড করে দিয়েছিল, ওদের আঁকা পেইনটিঙগুলো নষ্ট করে দিয়েছিল । অনিল এক মার্কিন যুবতীর সঙ্গে পালালো প্রথমে দিল্লি, তারপর দিল্লি থেকে ওয়াশিংটন ; কাঞ্চনও আমেরিকায় ওর কোনো আত্মীয়ের কাছে পালিয়ে গিয়ে লুকিয়েছিল ।
করুণানিধান পাটনায় পালিয়ে এসেছিল আর দাড়ি গোঁফ ভুরু কামিয়ে নাম পালটে সতীশ হয়ে গিয়েছিল। দাদা সমীর রায়চৌধুরী ওকে পাটনায় রঙিন মাছ আর অ্যাকোয়েরিয়ামের দোকান খুলে দিলে করুণা বেনারস থেকে স্ত্রী আর ছেলেকে পাটনায় ডেকে নিয়েছিল । দিব্বি সংসার করেছিল সতীশ নামের আড়ালে, পাটনায় সবাই ওকে সতীশবাবু বলে ডাকতো ।
নকশাল আন্দোলনের খুনোখুনি শেষ হলে অনিল আমেরিকা থেকে দিল্লিতে ফিরে এসেছিল, মার্কিন স্ত্রীকে না জানিয়ে, জাস্ট বাড়ি থেকে বেরিয়ে প্লেনে চেপে সোজা কেটে পড়েছিল । অনিলের ডাকে করুণাও পাটনা থেকে সপরিবারে দিল্লি চলে গিয়েছিল । মাছের দোকানটা তখন চালানো আরম্ভ করে দাদার এক শালা, সেও মারা গেছে ।
কাঞ্চন অবশ্য কলকাতায় থেকে গেল বেনারসের বাড়ি বেচে, নকশাল আন্দোলন ছাড়েনি, একটা পত্রিকাও প্রকাশ করতো, পরে সম্ভবত মাওবাদে আকৃষ্ট হয়েছিল ।


করুণা আর অনিলের জীবনের কিছু ঘটনা আমি ব্যবহার করেছি আমার  “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে । করুণার সঙ্গে পরিচয়ের আগে আমি গাঁজা আর চরস আলাদা ফুঁকেছি, আফিম চেটেছি আলাদা কিন্তু তিনটে মিলিয়ে গুলি বানিয়ে পাইপে ফোঁকার ব্যাপারটা করুণার আবিষ্কার, আর ওর এই আবিষ্কারে ও হিপিদের গুরুস্হানীয় হয়ে গিয়েছিল ।
প্রথমবার যখন অমন গুলি ফুঁকেছিলুম তখন এই কনককশানের নেশা সম্পর্কে তেমন আইডিয়া ছিল না, কড়া টান দিয়ে চিৎপটাঙ অজ্ঞান হয়ে বেনারসের রাস্তায় পড়ে গিয়েছিলুম । এল এস ডি ক্যাপসুলও পেয়েছিলুম করুণার দৌলতে, হিপিদের আনা, অনেকসময়ে কাস্টমসকে এড়াবার জন্যে হিপিরা লাইসারজিক অ্যাসিডে ব্লটিং পেপার ভিজিয়ে তারপর শুকিয়ে নিয়ে আসতো ।
গাঁজা, ভাঙ, চরস, আফিম এগুলোর নেশা করে নেশাগ্রস্ত অবস্হায় লেখালিখি করা যায়, মনের ভেতরে সেই সময়ে যা ঘটছে তা ধরে রাখা যায় । কিন্তু এল এস ডি খেয়ে মনের ভেতর কি ঘটছে তা নেশাগ্রস্ত অবস্হায় লেখা যায় না ; বলা চলে যে নিজের দেহের সঙ্গে কল্পনা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, কল্পনা অসম্ভব হয়ে ওঠে একথা সত্যি, কিন্তু পরে সমস্তকিছু আর মনে থাকে না, আবছা মনে থাকে । আমার মনে হয় রাসায়নিক মাদকের এটাই গোলমেলে অবদান যা কাজে লাগে না ।
বেশিরভাগ হিপি তাদের বাবা-মায়ের প্ররোচনায় হিপি হয়ে গিয়েছিল যাতে ভিয়েতনাম যুদ্ধে যেতে না হয় । আমেরিকা থেকে উড়ে অ্যামস্টারডম, তারপর সেখান থেকে হিচহাইক করে গ্রিস তুর্কি ইরাক ইরান আফগানিস্তান পাকিস্তান হয়ে ভারতবর্ষের বেনারসে । হিচহাইক করার এই পথের নাম হয়ে গিয়েছিল ‘হিপি ট্রেইল’  । ওদের বাবা-মায়ের পাঠানো ডলার নিয়মিত আসতো অ্যামেরিকান এক্সপ্রেসের মাধ্যমে । এখন তো হিচহাইকের পুরো রাস্তাটাই নানারকমের যুদ্ধে বিধ্বস্ত ।
অ্যালেন গিন্সবার্গ বেনারসে থাকার সময়ে করুণাদের স্টুডিওর পাড়া বাঙালিটোলাতে ছিল । অ্যালেনের খবর আমেরিকার বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হবার পরে ভিয়েতনাম যুদ্ধ এড়াতে হিপি হয়ে যাওয়া যুবক-যুবতীরা বেনারসে এসে ঘাঁটি গাড়ত ; ততোদিনে বিটনিক আন্দোলন ফুরিয়ে গেছে, বিটনিকদের অনেকে যেমন জ্যাক কেরুয়াক, উইলিয়াম বারোজ, ডায়ানা ডি প্রিমা বিটনিক তকমায় বিরক্ত হচ্ছিলেন ; হিপিদের উদ্ভবে তাঁরা বিটনিক তকমা থেকে মুক্ত হবার সুযোগ পেলেন ।
যে হেপিরা বেনারসে আসতো করুণা ছিল তাদের গাইড, সব ব্যাপারেই, মণিকর্ণিকা ঘাটে নিয়ে যাওয়া থেকে ভজনসভায় আর বিশেষ করে মাদক সংগ্রহ করার ব্যাপারে, আর হিপিনীদের সঙ্গে শোবার । গর্ভনিরোধক বড়ি ওই সময়েই আবিষ্কার হয়েছিল, আর ফেমিনিজমও তখনই দেখা দিয়েছিল । বহু হিপিনী বডিস পরতেন না। বেনারস তখন বিজেপির ঘাটি হয়ে ওঠেনি ।
তখনকার দিনে  সত্যমেব জয়তে ছাপমারা গাঁজা-আফিম-চরসের পুরিয়া সরকারি দোকানে পাওয়া যেতো ; খালাসিটোলার পাশেও একটা দোকান ছিল ; আমেরিকার চাপে আশির দশকে বন্ধ হয়ে যায় । অথচ এখন আমেরিকার বিভিন্ন রাজ্যে গাঁজা বা মারিহুয়ানা ফোঁকায় আইনের বাধা তুলে নেয়া হচ্ছে ।
বেনারসে যে হিপিরা আসতো তারা নেপালে যাবার পথে পাটনায় আমাদের বাড়িটাকে হলটিং স্টেশন করে দিন কয়েক থেকে তারপর কাঠমাণ্ডু রওনা হতো, গঙ্গা পেরিয়ে শোনপুরে গিয়ে সেখান থেকে ট্রেনে রকসওল তারপর রিকশায় বসে বর্ডার পেরিয়ে বাসে করে নদীর ধার দিয়ে কাঠমাণ্ডু । হিপিদের এই আসা-যাওয়ার সঙ্গে আমার মা মানিয়ে নিয়েছিলেন, যদিও তাঁর ভীতি ছিল যে আমি কোনো হিপিনীকে আঁকড়ে দেশ থেকে কেটে না পড়ি ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমরা যে দল বেঁধে নেপালে গিয়েছিলুম তার উদ্যোগ নিয়েছিল করুণানিধান মুখোপাধ্যায় । ও আগেই একজন হিপিকে নিয়ে কাঠমাণ্ডু চলে গিয়েছিল, তারপর সেখান থেকে এই চিঠিটা লিখে আমাদের ডাক দিয়েছিল, আমরা লোভ সামলাতে না পেরে ছুটেছিলুম কাঠমাণ্ডু ; মনে আছে কাঞ্চন বাসে বমি করতে করতে গিয়েছিল আর একজন অচেনা নেপালি বউ ওকে শাদা গুঁড়ো কিছু খাইয়ে-খাইয়ে সামলেছিল।
       
কাঠমাণ্ডু
          ১১ এপ্রিল ১৯৬৬

মলয়, হুররেরেরে
এই ঠিকানায় চিঠি দাও বা প্রভাতীর চিঠি এলে সেই চিঠিকে রিডাইরেক্ট না করে আর একটা খামের মধ্যে পুরে নতুন ভারতীয় স্ট্যাম্প লাগিয়ে পাঠাও ।
কী করে আসতে হবে চার্ট পাঠালাম ।
সমীরকে চিঠি দিয়েছি । অনিলকেও ।
কাল থেকে বেরিয়ে পড়ব বার্তা নিয়ে ।
এখানে সেই যে বালিশের নিচে মুড়ি দিয়ে র‌্যাঁবো পড়ে, সেই ঘি ( গাই )-এর সঙ্গে দেখা -- ওর ওখানেই উপস্হিত ।
দারুণ ব্যাপার ।
তাড়াতাড়ি এসো ।
লুণ্ড হয়ে থাকা যাক কিছুদিন ।
অফুরন্ত চরস আর মেয়েছেলে ।
আন্ডারগ্রাউণ্ড আর ওভারগ্রাউন্ড মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন ছেলে আর মেয়ে -- একেবারে গিজগিজ করছে । শিগগির এসো, আমি হাংরি হ্যাপেনিং করার তালে আছি । পরে মোটা খাম পাঠাচ্ছি ।
                                                       করুণানিধান মুখোপাধ্যায়

করুণার চিঠিতে পরের মোটা খামের যে উল্লেখ রয়েছে তাতে করে আফগানি চরস পাঠিয়েছিল । করুণা চাকরিবাকরি কিছুই করতো না, হিপিরা বেনারসে আসার আগে ও হিন্দি পত্রিকা আর বইয়ের মলাট এঁকে রোজগার করতো, তাও সেগুলো পাইয়ে দিতো অনিল করঞ্জাই ।
করুণার আরেকটা চিঠি :-
প্রিয় মলয়,
হঠাৎ আফগানি মাল কিছুটা পেয়ে গেলাম বেশ খানিকটা । বিলি করা শুরু করেছি, তোমায় পাঠালাম, চাপ দিলেই গুঁড়ো, সিগারেট পাইপ ছিলিম যাতে খুশি খেতে পারো । মালের প্রাপ্তি সংবাদ দিও ।
হঠাৎ আমার এক অ্যালসেশিয়ান বন্ধুর সঙ্গে কলকাতা গিয়েছিলাম । সুবিমলের আস্তানায় ছিলাম । সুবিমল, সুভাষ, ফালগুনী, শম্ভু রক্ষিত, ত্রিদিব, আলো আর দেবীও পীড়াপীড়ি করে জুটেছিল খালাসিটোলায় । মাতাল অবস্হায় জেনারেশনের সবাই গড়াগড়ি দিয়েছিল, দেবী ছাড়া ।
আজকার ভীষণ একটা যা-তা, বিশ্রী, দারুণ গালাগালি দিয়ে নিজের নোংরামিগুলো বমি করতে ইচ্ছে করছে । লেখাটা সেই নিয়ে চলছে । আমি অনিল একটা পত্রিকা বের করার তালে আছি, তোমার কানে পৌঁছে থাকবে । ভালোবাসা---
                                                               করুণা
                                                           ( তারিখ মনে নেই )
পেইনটার হিসেবে অনিল তখন থেকেই নামডাক করে ফেলেছিল, পরে ১৯৭২ সালে অনিল ললিতকলা অ্যাকাডেমির পুরস্কারও পেয়েছিল, কিন্তু নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যোগাযোগের ইতিহাসের জন্য অন্য পেইনটাররা ওকে এড়িয়ে যেতো ।
হিপিরা বেনারসে আসার পর করুণা ওদের গাইড আর ভারতীয় মাদকের ঘোঁতঘাঁতের খবর দিয়ে ভালোই উপার্জন করতো । হিপিনীদের সঙ্গেও বেশ জমে যেতো ওর সম্পর্ক । ওর স্ত্রী প্রভাতী কোনো আপত্তি করতেন না, সম্ভবত এই জন্যে যে প্রভাতীকে করুণাই আশ্রয় দিয়ে বিয়ে করেছিল আর সেকারণে করুণা বাড়ি থেকে বিতাড়িত হয়েছিল ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে আমি প্রথমবার যখন বেনারসে যাই তখন করুণা বাড়ি ছেড়ে একজন হিপিনীর সঙ্গে বেনারসের গঙ্গার চরে কুটির বানিয়ে দুজনে উলঙ্গ অ্যাডাম আর ইভ হয়ে জীবন কাটাচ্ছিল, ওদের দুজনের উলঙ্গ ফোটো তোলাতেও আপত্তি ছিল না । বস্তুত ওদের দুজনকে উলঙ্গ অবস্হায় দেখে আমিই বিব্রত বোধ করছিলুম । করুণা মাঝে-মধ্যে সকালের দিকে বাড়ি গিয়ে প্রভাতীকে খরচ দিয়ে আসতো ।
নেপালে আমরা ছিলুম ঘর ভাড়া করে, বিছানা ছিল খড়ের, তার ওপর চাদর পাতা, মাসে মাথাপ্রতি এক টাকা । বিশাল একটা চালাঘরের প্রাসাদে, পাকানো সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হতো । আমি বহুবার নেশা করে ফেরার পর ঘর গুলিয়ে ফেলেছি । একবার ওপরে উঠে নিচে নেমে কয়েকবার ওঠা-নামা করার পর একটা ঘর থেকে মেয়েলি হাতের হ্যাঁচকা টানে সেই ঘরের মহিলাটির ঘাড়ে পড়ে টের পাই যে সেটা শুঁড়িখানা আর বেশ্যালয় দুটোই একসঙ্গে। বউটি বলেছিল, “রোজ দেখি দরোজা পর্যন্ত এসে ফিরে যাও।” যে মদ ওই শুঁড়িখানায় বিক্রি হতো তার নাম রাকসি, কাঁচা মোষের মাংস চটকে রাকসির সঙ্গে খাওয়া হতো । নেপালের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আমি ধরে রাখার চেষ্টা করেছি “অরূপ তোমার এঁটোকাঁটা” উপন্যাসে ।
হাংরি আন্দোলনের সময়ে করুণানিধান মুখোপাধ্যায় আর অনিল করঞ্জাই “খেউড়” নামে একটা পত্রিকা প্রকাশ করার তোড়জোড় করেছিল কিন্তু তা ভেস্তে যায় সুভাষ-শৈলেশ্বরদের “আমরা উদ্বাস্তু -আমরা আলাদা” গ্রুপবাজির জন্য । পরে করুণা ‘সানপাকু’ নামে একটা পত্রিকা বের করবে ভেবেছিল, তাও ভেস্তে যায়, খেয়োখেয়ির কারণে ।
অনেকে দেখি হাংরি আন্দোলন বিষয়ে লেখালিখির সময়ে সুভাষ-শৈলেশ্বরের সঙ্গে আমার আর ত্রিদিব মিত্রের ঝগড়াকেই গুরুত্ব দেন, আমাদের লেখালিখি নিয়ে আলোচনা করেন না । এই অশিক্ষিত ইডিয়টগুলো জানে না যে দুই বন্ধু কার্লোস ফুয়েন্তেস আর ওক্তাভিও পাজের ঝগড়া সারাজীবনে মেটেনি, নরম্যান মেইলার ঘুষি মেরে ছিলেন গোর ভিডালকে, সালমান রুশডি আর জন আপডাইকের ঝগড়া সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় জায়গা করেছিল, হেনরি জেমস আর এইচ জি ওয়েলসের ঝগড়া তো কিংবদন্তি, জোসেফ কনর‌্যাডের সঙ্গে ডি এইচ লরেন্সের জোর বিবাদ হয়েছিল, জন কিটসের সঙ্গে লর্ড বায়রনের হয়েছিল, চার্লস ডিকেন্স আর হ্যান্স ক্রিশ্চিয়ান অ্যাণ্ডারসনের বিবাদ হয়েছিল, ঝগড়ার সময়ে মারিও ভারগাস য়োসা নাকে ঘুষি মেরেছিলেন গ্যাবরিয়েল গারসিয়া মার্কেজের। কিন্তু এনাদের লেখালিখি বিশ্লেষণের সময়ে আলোচকরা কেউই তাঁদের পরস্পরের ঝগড়াঝাটিকে গুরুত্ব দেন না ।
আঁদ্রে ব্রেতঁ কতোজনকে সুররিয়ালিস্ট আন্দোলন থেকে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন, সেগুলো তো আলোচিত হয় না, যা আলোচিত হয় তা হল সুররিয়ালিস্টদের আঁকা আর লেখালিখি । অ্যালেকজান্ডার পুশকিন সতেরোবার ডুয়েল লড়েছিলেন এবং ডুয়েল লড়তে গিয়েই মারা যান, কিন্তু এগুলো পাঠকরা আলোচনা করেন না, তাঁরা পুশকিনের কবিতা আলোচনা করেন । মার্ক টোয়েন এক সংবাদপত্র সম্পাদকের সঙ্গে পিস্তলের ডুয়েল লড়তে গিয়েছিলেন সম্পাদক মশায় তাঁর বিরুদ্ধে লিখেছিলেন বলে, কিন্তু মার্ক টোয়েন আলোচনার সময়ে তাঁর এই ডুয়েলের কথা আলোচিত হয় না, আলোচিত হয় “দি অ্যাডভেঞ্চারস অফ টম সোয়্যার” কিংবা “অ্যাডভেঞ্চারস অফ হাকলবেরি ফিন”
করুণা আর অনিল ওদের পত্রিকা ছাপানোর কাজ অনেকদূর এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, সঙ্গে ওদের আঁকা স্কেচ ছিল । সুবিমল বসাকও স্কেচ এঁকে দিয়েছিল । সুভাষ-শৈলেশ্বরের দলবাজির কারণে সব ভেস্তে যায় । তারপর করুণা-অনিলের আস্তানায় নকশাল আন্দোলনের সময়ে যখন পুলিশের রেইড হল তখন সব ছত্রাখান হয়ে যায় । আমি অনিলের দ্বিতীয়  স্ত্রী জুলিয়েট রেনোল্ডসকে জিগ্যেস করেছিলুম যে ওদের সেই সময়ের কাগজপত্র ছবি ইত্যাদি কিছু আছে কিনা ; জুলিয়েট এখন দিল্লিতে থাকেন, ফেসবুকে অনিলের আঁকা পেইনটিঙের একটা কমিউনিটি পেজ খুলেছেন । উনি জানিয়েছিলেন যে কিছুই নেই, পুলিশ সবই নষ্ট করে দিয়েছিল । জুলিয়েট এসেছিলেন আয়ারল্যাণ্ড থেকে, ভারতীয় শিল্পকলা বিষয়ে গবেষণার জন্য ।
করুণা “সানপাকু” নামে নিজের জীবন থেকে টুকরো-টাকরা নিয়ে ফিকশান লেখা আরম্ভ করেছিল, তার প্রথম পাতা কেবল আছে কেননা তা কোনো হাংরি বুলেটিন বা পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল । করুণার লেখার হাত সম্পর্কে ওর এই গদ্যটা পড়লে ধারণা করা যাবে :-
জন্মমৃত্যু সম্পর্কে
আজ ভোর ৬.৪৫ মি. আমার একমাত্র ছেলে আরক মারা গেলো । ব্রংকোনিমোনিয়া ।
আমি ওকে একা নিয়ে চলে গেলাম নদীর ওপারে বালিয়াড়িতে ।
বসে বসে অনেক কিছু ভাবলাম । তারপর ওর গায়ের সঙ্গে ভারি পাথর বেঁধে মাঝগঙ্গায় ফেলে দিলাম । পাথর খুঁজতে প্রায় দুঘণ্টা লেগে গেলো ।
বাড়ি ফিরে এসেছি । আমার বৌ ভীষণ কাঁদছে । মানুষের সেন্টিমেন্ট নষ্ট করার মতো আমার কাছে কিছুই নেই ।
আজ দুপুরে অফুরন্ত সময় ছিল ।
আমার জন্ম কাশীতে । বাবা তখন আই এন এতে নেতাজির গ্রুপে । তারপর পঁচিশ বচর যখন, বাবা আমায় নিয়ে যান রেংগুনে ।
আই এন এ ছেড়ে দিয়ে বাবা পুলিশে চাকরি নেন । রেংগুনে একনাগাড় প্রায় ১০ বছর ।
তারপর সাইরেন, ব্ল্যাকআউট,
সংবাদপত্রের হেডলাইন, হাসপাতাল । জাহাজে চেপে বর্মা থেকে সোজা খিদিরপুর ।
খিদিরপুর থেকে আবার কাশী ।
জানতে পারলাম বাবা কোনো বার্মিজ মেয়েকে বিয়ে করেছেন । সেই থেকে
সমাজের বিরুদ্ধে, সংস্কৃতির বিরুদ্ধে, নিজের বিরুদ্ধে
লড়াই ।
           লেখাপড়া হলো না । ক্লাস টেনে পৌঁছে বাবার বাবার টাকা বন্ধ হয়ে গেল ।
তখন থেকেই আমি নেমে গেলাম ।
           হেল্প ! হেল্প !! হেল্প !!!
           ছোটোবেলায় আঁকার ঝোঁক ছিল । ক্লাসে ফার্স্ট বয় ছিলাম । ছবি আঁকতে গিয়ে সব তালগোল পাকিয়ে গেল ।
           কাশীতে একটা ঘর ভাড়া করে নিজের স্টুডিও করলাম ।
           ছবি দেখে লোকে পাগল বলতে লাগল । বাড়ির লোকে মা বোন সকলেই পাগল বলে বাড়ি থেকে বের করে দিলো ।
           আমি বাড়ির বড়ো ছেলে ।
           ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাছে গিয়ে একজন কায়স্হ মেয়েকে বিয়ে করলাম ।
            অব্রাহ্মণ বলে বাড়িতে ঢুকতে পাই না ।
           কেই নেই । কেউ নেই ।



    মলয় রায়চৌধুরী

    Poet মলয় রায়চৌধুরী ১৯৩৯ সালের ২৯ শে অক্টোবর জন্মগ্রহন করেন। আধুনিক বাংলা কবিতার ইতিহাসে তিনি এক বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। গতানুগতিক চিন্তাধারা তিনি সচেতনভাবে পরিহারের মধ্য দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যে উত্তর আধুনিকতাবাদ চর্চা এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধী আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৬৪ সালে হাংরি বুলেটিনে প্রকাশিত প্রচণ্ড বৈদ্যুতিক ছুতার কবিতাটির জন্য মলয় অশ্লীলতার অভিযোগে গ্রেপ্তার হন এবং ৩৫ মাসব্যাপী কোর্ট কেস চলে। তার ১০টি কাব্যগ্রন্থ, ৪টি উপন্যাস, ১০টি সমালোচনা গ্রন্থ এবং কয়েকটি অনুবাদ গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ২০০৩ সালে অনুবাদ সাহিত্যে তিনি সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার এবং পরবর্তীকালে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন পুরস্কার প্রত্যাখ্যান করেন।

    কোন মন্তব্য নেই:

    একটি মন্তব্য পোস্ট করুন